2 of 2

যৌথ একাকিত্ব – মঞ্জু সরকার

যৌথ একাকিত্ব – মঞ্জু সরকার

১.

দু’জন দুই অফিসে যায়। পথ আলাদা। ফিরেও আসে আলাদাভাবে। ঘরে যখন একত্রিত এবং রাতে বিছানায় পাশাপাশি, তখনও দু’জনের মাঝখানে থাকে বিস্তর ব্যবধান। দূরত্বটা অলঙ্ঘনীয় মনে হয় প্রায়শ। পাশ ফিরলেও ছোঁয়া যায় না। টুকটাক দরকারি কথা হয়, কিন্তু সেসব কথা প্রাণ চলাচলের সেতু বানায় না। মনমরা ও ক্লান্ত থাকে বিছানায়, যে যার ভাবনা ও ঘুমের জগতে প্রবেশ করে, একা একা।

মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম ঘটে। দাম্পত্য অভ্যাস জোড় বাঁধার ইচ্ছে জাগে। স্বামী জাগলে স্ত্রীকে জাগাতে চায়, কখনো বা স্ত্রী স্বামীকে। পুরনো ভালবাসাবাসির উষ্ণতা খোঁজে দু’জনই। তেমন প্রচ্ছন্ন বাসনা থেকেই হয়তো, ঘুমের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আগে শান্তা কথা বলে প্রথম, এই ঘুমালে? জানো অফিসে আজ এক মজার কাণ্ড হয়েছে।

ঘরে অফিসের স্মৃতি-ভাবনা অসহ্য লাগে আরিফের। তবু স্ত্রীর মজায় ভাগ বসানোর মৃদু আগ্রহ নিয়ে সাড়া দেয়, বলো, শুনি।

আমাদের পার্সোনেল ম্যানেজারও বোধহয় আমার প্রেমে পড়ে গেছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলেছিল, এত বছর ঘর-সংসার করেও শরীর সৌন্দর্য ধরে রাখেন কীভাবে! তার সঙ্গে আজ বাইরে লাঞ্চ করার প্রস্তাবও দিয়েছিল। আমি কী জবাব দিয়েছি জানো?

বেচারাকে একটু সঙ্গ দিলেই পারতে। গাড়িতে পাশাপাশি বসার, ফাঁকা অফিস রুমে এক-আধটা চুমু খাওয়ার সুযোগ দিলে কী এমন ক্ষতি!

ছোটলোক। নিজের মতো ভাবো সবাইকে। খোঁজ নিয়ে দেখ, অফিসে কি রকম পার্সোনালিটি নিয়ে থাকি।

আর যাই হোক, স্বামীটি তার ছোটলোক কিংবা সন্দেহবাতিক নয়। মনে মনে শান্তা নিশ্চয় তা মানে। মহৎ স্বামীকে আদর করেই ছোটলোক বলে হয়তো বা। কিন্তু পরকীয়া প্রেমে স্ত্রীকে উৎসাহদান আরিফের নিছক ঠাট্টা নয়, বাস্তবকে মেনে নেয়ার চেষ্টাও বটে। শান্তা যে এনজিওতে চাকরি করে, তার কর্তাব্যক্তিটির নারীপ্রীতির খবর সবাই জানে। দুস্থ নারীসেবার প্রজেক্ট খুলে সে বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা পায়। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সুস্থ ও সুশ্রী নারীসঙ্গলাভ করাটাই নাকি তার আসল নেশা। এমন। লোকের নেকনজরে পড়ে শান্তা অফিসে পদোন্নতি পেয়েছে, বেন বেড়েছে তার। খুশির খবরে স্বামী হিসেবে স্ত্রীর আনন্দ সমানভাবে শেয়ার করেছে আরিফ। কাজের চাপে শান্তা দেরিতে বাসায় ফেরে, ছুটির দিনেও অফিসে যায়। কারণ জানতে চেয়ে কখনো সন্দেহ প্রকাশ করেনি। স্ত্রী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সে।

স্বামীর ঔদার্য কিংবা প্রেমহীনতার সুযোগ নিতেই কি মধ্য যৌবনে স্ত্রী পরপুরুষের চোখে আপন মূল্য খোঁজে? শান্তা ঘটা করে সেজে অফিসে যাক এবং দুস্থ নারীসেবার নামে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যত খুশি যেভাবে খুশি হাতিয়ে নিক, আরিফের তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু আজকাল বিছানায় শুয়েও সে অবৈধ প্রেমের খুনসুটি স্মরণ করে কেন? যেন স্বামী-সহবাসে লিপ্ত হওয়ার জন্যেও অবৈধ সম্পর্কের স্মৃতি সম্ভাবনা থেকে উত্তেজনা সংগ্রহ করাটা জরুরি। উৎসাহী শ্রোতা হিসেবে সমর্থন যোগালে শান্তার উচ্ছলতাও বেড়ে যায়। কিন্তু স্ত্রীর শরীরে দুস্থ নারীর ঘ্রাণ খুঁজে পায়। আরিফ। ভালবাসার বদলে করুণা জাগে। দুস্থ নারীসেবা কেন্দ্র এবং পরিচত কিছু সুস্থ-সবল নারী মনে উঁকি দেয়। তখন কামোত্তেজনায় ঘৃণা এবং হিংস্রতাও বুঝি। মেশে খানিকটা। স্ত্রীকে শক্ত আলিঙ্গনে বেঁধে আরিফ টের পায়, তার বুকে মাথা রেখেও শান্তা হারিয়ে যায়, চরম মুক্তি খোঁজে অন্য কোথাও। তারপর একঘেয়ে বিস্বাদ ও ক্লান্তি নিয়ে, পরস্পরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শোয় তারা। যে যার ভাবনা ও ঘুমের জগতে প্রবেশ করে চুপচাপ।

২.

দু’জনের আয়ে সংসার চলে। বাড়ি ভাড়া পুরোটা দেয় শান্তা। বাদবাকি দায়িত্ব আরিফের। তারপরও বাকি থেকে যায় অনেক কিছু। যেহেতু শান্তা বেতন পায় বেশি, স্বামীর দায়িত্বে ভাগী হয়ে সংসারের নানা খাই মেটাতে হয় তাকেই বেশি বেশি। নিজের বেতনের টাকা স্বাধীনভাবে খরচ করতেও পারে না, বেচারী। তারপরও স্ত্রীর কাছে দাবির অন্ত নেই আরিফের। সরাসরি হাত পাতে না। কিন্তু স্ত্রীর ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল জানে নানারকম।

স্বার্থ হাসিলের প্রয়োজন হলে স্ত্রীর প্রতি দরদ উথলে ওঠে আরিফের। আগের দিন শান্তা অফিস ফেরতা বাজার করে এনেছে। খবরটা জেনেও পরদিন সন্ধ্যায় আরিফ স্ত্রীর হুকুমের দাস সেজে বলে, কই গো, বাজার-টাজার করতে হলে বলো, ঘুরে আসি। বাজারে যেতে হবে না শুনে দায়িত্ব মুক্তির আনন্দ নিয়ে আরিফ আবদার করে, তোমার হাতের এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। অনেক দিন খাই না।

শান্তার রোজগার যেমন, তেমনি তার হাতের রান্না খেতেও কম ভালবাসে না আরিফ। কিন্তু সারাদিন অফিস করার ক্লান্তি এবং অফিসে যাওয়া-আসার ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরে রান্নাঘরে ঢোকার কথা ভাবলেও বিরক্ত হয় শান্তা। কাজের বুয়া যেমন রাঁধে মুখ বুজে তাই খায়। কিন্তু খেতে বসে আরিফ প্রায়ই গজর গজর করে। শান্তাকে তাই স্বামীর রসনা তৃপ্তির আনন্দ যোগাতে অনিচ্ছাতেও রান্নাঘরে ঢুকতে হয় মাঝে মধ্যে। ঘন দুধে কড়া লিকার মিশিয়ে তার পছন্দসই চা বানিয়ে দেয়। চায়ে চুমুক দিয়ে পরিতৃপ্ত স্বামীর দরদ আজ এতটাই উথলে ওঠে যে, স্ত্রীকে ছাড়িয়ে তা স্ত্রীর জ্ঞাতিগোষ্ঠীকেও স্পর্শ করতে চায়।

তোমাদের বাড়ির খবরটবর কিছু পেয়েছ? রিটেয়ারমেন্টের পর আব্বার সামান্য পেনশন দিয়ে সংসার কীভাবে যে চলছে–আল্লাই জানে।

শ্বশুরবাড়ির জন্য স্বামীর টেনশন দেখে শান্তার সন্দেহ তীক্ষ্ণ হয়। বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে তার দায়িত্ববোধের কথা আরিফের অজানা নয়। গত মাসেও ছোট ভাইকে গোপনে এক হাজার টাকা দিয়েছে সে। আরিফের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে জবাব দেয় শান্তা–হ্যাঁ, আব্বার আশা ছিল অন্তত একটা ভাই-বোনের দায়িত্ব নিয়ে আমি তাকে কিছুটা রিলিজ দেব।

এরকম আশা করাটা খুব স্বাভাবিক। আর আমাদের মতো মিডল ক্লাস ফ্যামিলির বড় সন্তানের জন্য এরকম কিছু কর্তব্য পালন তার নৈতিক দায়িত্ব। এক কাজ করো শান্তা, তুমি কান্তাকে ঢাকায় এনে কলেজে ভর্তি করিয়ে দাও। ওর লেখাপড়া, বিয়ে, সব দায়িত্ব আমরা পালন করবো।

নিজের মেয়েদের লেখাপড়ার খোঁজ নেয় না কখনো সেই মানুষ আজ শ্যালিকার প্রতি দায়িত্ব পালনে এত আগ্রহী কেন? স্বামীর মতলব ঠিক ধরতে না পেরে ঠাট্টার ভঙ্গিতে শান্তা সরাসরি জানতে চায়—কী ব্যাপার। হঠাৎ শালির প্রতি এত দরদ যে! কান্তা চিঠি-টিঠি দিয়েছে নাকি?

আমাকে চিঠি দেবে কেন! কান্তার দায়িত্ব নিলে আব্বা-আম্মা কিছুটা হাল্কাবোধ করবেন। তাছাড়া ঢাকায় থাকতে পারলে কান্তাও খুশি হবে।

কিন্তু কান্তা তোতা ওখানে কলেজে পড়ছে। ওর চেয়ে জামালকে আনলে আব্বা মা বেশি খুশি হতো। জামালের কথা বলছ না কেন?

আমরা সারাদিন বাইরে থাকি। কান্তা থাকলে বাচ্চাদের সুবিধা হতো। তাছাড়া ও দেখতে শুনতে ভাল। ঢাকায় রাখলে ওর জন্য ভাল ছেলে খুঁজে পাওয়াটা সহজ হতো।

বাসায় যুবতী কাজের মেয়ে রাখলে স্বামীর যেমন সুবিধা হয়েছিল, কান্তা এলে তার চেয়েও বেশি সুবিধা হবে—এ সত্য শাস্তা বোঝে। সন্দেহ প্রকাশ করে লু স্বামীর মহত্ত্ব খাটো করতে চায় না সে। অন্যদিকে প্রস্তাবের মূলে আরিফের যে কোনো গোপন স্বার্থচিন্তা নেই, সেটা বোঝাতেই যেন তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত পাল্টায় সে।

বেশ তো, কান্তার বদলে জামালকেই তবে নিয়ে এস।

শান্তা এবার দৃঢ়কণ্ঠে সিদ্ধান্ত জানায়, না। কাউকে আনার দরকার নেই। এমনিতে দু’জনের আয়ে সংসার ঠিকমতো চলে না। তার ওপর কলেজ-ইউনিভার্সিটি গোয়িং এক জনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার সাহস নেই আমার। তারচেয়ে পারলে মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব।

কিন্তু এদিকে আর একজন তো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসার জন্য আসছে। রক্ত সম্পর্ক, ঠেকাবার কোনো উপায় নেই। পারি না পারি বোঝা টানার চেষ্টা করতেই হবে।

দীর্ঘ ভূমিকা শেষে, পরিবেশ অনুকূলে আনার চেষ্টা ব্যর্থ হলে আরিফ সরাসরি আসল খবরটি জানায়। তার সর্বকনিষ্ঠ ভাইটি গ্রামে ম্যাট্রিক পাস করেছে। এখন তার সব দায়-দায়িত্ব আরিফকেই নিতে হবে। বাবা নেই। মায়ের এটাই সিদ্ধান্ত। আগামী সপ্তাহে ছোট ভাইকে নিয়ে মা ঢাকায় আসছেন। শ্বশুরবাড়ির প্রতি দরদ যে নিজের মা ও ভাইকে স্ত্রীর কাছে সহনীয় করে তোলার জন্য, বুঝতে সময় লাগে না শান্তার। তার মতামত উপেক্ষা করে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। সহজে মেনে নিতে পারে না সে।

আরিফ সান্ত্বনা দেয়, সে জন্য বলছিলাম শান্তা, এক জনের দায়িত্ব নেয়া আর দু’জনের দায়িত্ব নেয়া একই কথা। আমাদের একটু কষ্ট হবে। কিন্তু কী আর করা। তুমি বাড়িতে লিখে দাও জামাল চলে আসুক।

শান্তা জবাব দেয় না। নীরবে স্বামীর পাশ থেকে সরে যায়।

৩.

স্বামীর পাশ থেকে নীরবে সরে আসা যে আসন্ন বিচ্ছেদ ঘোষণা, প্রথমে তা নিজেও বুঝতে পারেনি শান্তা। একা হলে মন ক্রমে বুঝিয়ে দেয়। স্বামী সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুক্তিগুলো সংসার থেকে স্বতঃস্ফুর্ত উঠে আসে। রাতে বিছানায় শোয়ার পর নিরাবেগ শান্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেয় শান্তা।

শোনো, আমি কাল বাড়িওলাকে নোটিস দিতে চাই। এত টাকা ভাড়া দিয়ে এ বাসায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তার মানে?

অফিরে কাছাকাছি এলাকায় দেড়-দু’রুমের ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে আমি মেয়েদের নিয়ে উঠব। তুমি অবশ্য ইচ্ছে করলে এ বাসা রাখতে পারো। কিংবা আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে তোমার মা-ভাইকে নিয়ে থাকতে পারো।

মা ও ছোট ভাইকে বাসায় ঠাঁই দেয়ার আগে শ্বশুরকুলের সকল উৎপাত সইবার মতো উদারতা দেখিয়েছে আরিফ। আপন ভাইয়ের সঙ্গে শালা-শালিকে রাখতে চেয়ে স্ত্রীকে সমান মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু শান্তা শাশুড়ি-দেরকে কখনো আপন ভাবতে পারে না। তাই বলে এমন চরম প্রতিক্রিয়া আশা করেনি আরিফ। অনেকক্ষণ নীরব থেকেও চোট সামলাতে পারে না। তার অভিমান হয়। রাগও বাড়ে।

কী! কথা বলছ না যে।

সেপারেশনের নোটিস দিচ্ছ মনে হয়। কিন্তু আমি যদি আমার মেয়েদের তোমার সঙ্গে যেতে না দেই?

তাহলে আরো ভালো। তোমার মেয়ের দায়িত্ব তোমার। একা হলে আমিও নিজের বাবা-মায়ের প্রতি বেশি বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারব।

শুধু বাবা-মা কেন, আলাদা বাসা নিয়ে লাংদের নিয়ে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে। খানকী মাগী কোথাকার। গালটা মুখে এলেও, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত রাখে আরিফ। গম্ভীর কণ্ঠে বলে শুধু, তুমি আসলে খুব সেলফিশ মেয়ে শান্ত।

স্বার্থপর আমি না তুমি?

আমি সেলফিস হলে মা-ছোট ভাইয়ের দায়িত্ব অস্বীকার করতাম। তোমার বাড়ির কারো প্রতি সিমপ্যাথি থাকত না।

তুমি আসলে একটা ভণ্ড। হিপোক্রাট। আই হেইট যু। আমার চেয়ে বল বেতন পাও। হেইট তো করবেই।

দেখো তো শুধু আমার রোজগারটাই। চাকরিটা না থাকলে তোমার সংসারে কাজের মেয়ের চেয়ে বেশি মর্যাদা থাকত না আমার।

কাজের মেয়ের চেয়েও তোমার মন-মানসিকতা জঘন্য।

তা তো হবেই। রাস্তার মেয়ে কাজের মেয়ের সঙ্গে শুতে যার রুচিতে বাঁধেনি, তার কাছে স্ত্রীর মন-মানসিকতা জঘন্য তো হবেই।

রাতদুপুরে চিৎকার করবে না।

পুরনো প্রেমিকার কথা বলায় আঁতে ঘা লাগল!

তোমার সাথে ঝগড়া করার রুচি আমার নেই। আলাদা হও, আর কারো সঙ্গে লটকে পড়–কালকেই এ বাসা ছেড়ে চলে যাবে তুমি।

আমি যাব কেন? এ বাসার ভাড়া দেয় কে? গেলে তুমি যাবে।

আবারও টাকার গরম দেখাও মাগী! ছোট লোক।

খবরদার, গায়ে হাত দেবে না।

ঠিক এ সময়ে পাশের ঘর থেকে দশ ব বয়সের বড় মেয়ে রিয়া ছুটে আসে। অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে বাবা-মাকে শাসন করে, তোমরা এত রাতে ঝগড়া করছ। কেন? পিয়ার ঘুম ভেঙে যাবে।

শান্তা ততক্ষণে খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। চোখে টলমল অশ্রু নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায় সে, না, আর ঝগড়া নয় সব শেষ। এখন থেকে তোরা তোর বাবার সঙ্গে থাকবি।

মেয়েকে বাবার কাছে রেখে, হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঝটিতে পাশের ঘরে চলে যায় শান্তা।

বাবা, কী হয়েছে। মাকে বকেছ কেন?

শুধু বকা নয়, দু’গালে দুটি ওজনদার চড় কষাতে পারত যদি আরিফ, বিদায়ী উপহার দিতে পারার আনন্দ হতো। কিন্তু তা করতে না পারায় স্ত্রীকে খতম করার আক্রোশ, সংসার তুচ্ছ করার বিধ্বংসী ক্রোধ বুকের ভেতর ফুলে ফেঁপে ওঠে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সংযত হয় আরিফ। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে ভেতরের যন্ত্রণা লাঘব হতো কিছুটা। কিন্তু রিয়ার সহানুভূতিশূন্য রুক্ষ দৃষ্টি দেখে আবেগটা তেমন জোরালো হতে পারে না।

আত্মজার হাত চেপে ধরে যন্ত্রণাবিকৃত কণ্ঠে বলে, তোর মা এখন থেকে আলাদা থাকবে। তোরা আমার সঙ্গে থাকবি মা।

রিয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জানায়, না। আমিও মায়ের সঙ্গে থাকব। তারপর পাশের ঘরে চলে যায়।

৪.

সাজানো ঘরসংসার দেখে মনে হবে না, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর্যায়ে। অবশ্য সংসার গোছানো ও সচল রাখার ব্যাপারে যার ভূমিকা প্রধান, সেই কাজের বুয়াটি কাজ করে যায় যথারীতি। গ্রাম থেকে শান্তার শাশুড়ি-দেবর এসে সংসারে অশান্তির আগুন কোথাও দেখতে পায় না। সারাদিন অফিসে গত করে বাসায় ফিরে শান্তা দৈনন্দিন ভূমিকায় আগের মতো স্বাভাবিক হাসিমুখে শাশুড়ি-দেবরের সঙ্গে কথা বলে, খোঁজ-খবর নেয়, রিয়া-পিয়াকে পড়তে বলে এবং কাজের বুয়াকে আদেশ দেয়। নানারকম।

একদিন অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা উতরে গেলে শাশুড়ি মৃদু অভিযোগ করে, আরিফ তো বিকেলেই ফেরে। তোমার অফিস থেকে ফিরতে এত রাত হয় যে!

শান্ত হাসিমুখে জবাব দেয়, আপনার ছেলের প্রকারি চাকরি। আমারটা বেসরকারি। বেন দেয় জ্বল, খাটিয়েও নেয় বেশি বেশি। পারলে সারারাতই খাটিয়ে নেয়।

এ ধরনের কথায় শাশুড়িবধূর প্রচ্ছন্ন বিরোধ যতটা প্রকাশ পায়, তারচেয়ে বেশি প্রকাশ্য করার আগ্রহ বা সাহস উভয় পক্ষের কেউ দেখায় না আর।

স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সঙ্কট চাপা দিতে এবং তাদের আসন্ন বিচ্ছেদ বিলম্বিত করতেই যেন বা এক সকালে বাসায় অপ্রত্যাশিত মেহমান আসে। শান্তার বাবা, মা ও বোন। বিনা নোটিসে এসেছে তারা। স্বামী-স্ত্রী দুজনই খুব অবাক, পরস্পরের প্রতি। সন্দেহ জাগে। শান্তা ভাবে, তাকে জব্দ করার জন্যে আরিফ হয়তো গোপন খবর দিয়ে তার বাবা-মাকে এনেছে। বিশেষ করে কান্তাকে দেখে সন্দেহটা তীক্ষ্ণ হয়। অন্যদিকে আরিফ ভাবে, প্রতিশোধ নিতে কিংবা ছাড়াছাড়ির বিষয়টা পাকাঁপোক্ত করতে শান্তাই নিশ্চয় বাবা-মাকে জরুরি তলব করেছে। কিন্তু উভয়ের সন্দেহ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আসল খবর শ্বশুরের মুখে প্রথম জানা গেল। শান্তার মা অসুস্থ, পেটের কোণায় হঠাৎ হঠাৎ তীব্র ব্যথা। স্থানীয় ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঢাকায় পিজির এক প্রফেসরকে তাড়াতাড়ি দেখানোর পরামর্শ দিয়েছে। সে কারণে খবর না দিয়ে রওয়ানা হয়েছে তারা। কান্তাও জোর করে সঙ্গে এসেছে।

শ্বশুর-শাশুড়িকে শুধু স্বাগতম ও সান্ত্বনা জানিয়ে ক্ষান্ত হয় না আরিফ। ডাক্তারের সঙ্গে এপোয়েন্টমেন্ট করার দায়িত্ব নেয় নিজে। অফিসে যাওয়ার আগে বাজারেও ছুটে যায়। স্ত্রীকে ভালবাসতে পারার অক্ষমতা পুষিয়ে নিতে আরিফ যেন শ্বশুর-শাশুড়িকে বেশি বেশি সেবাযত্ন করতে তৎপর। শাশুড়িকে ডাক্তার দেখানোর ঝামেলা বহন নয় শুধু, খরচের টাকা যোগাতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সে। এ কারণে টাকা ধার করতে দ্বিধা করেনি। শান্তার সঙ্গে বিচ্ছেদ যদি ঘটেই যায়, শ্বশুর শাশুড়ি নিশ্চয় বলবে, তাদের প্রাক্তন জামাই কত ভাল মানুষ ছিল। এতসব ঝামেলার মধ্যেও সুযোগ পেলে শ্যালিকার সঙ্গে সহাস্য বাক্য বিনিময় এবং বাকাচোরা চাউনিতে যথেষ্ট স্নেহ শুভেচ্ছা প্রকাশেও কার্পণ্য করে না আরিফ। দাম্পত্য শূন্যতা ভরিয়ে তোলার জন্য বাসায় অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ।

কিন্তু রাতে বেশ একাবোধ করে আরিফ। সকলের সুবিধাজনক শোয়ার ব্যবস্থা করে দিতে গিয়ে নিজে অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়েছে। ড্রয়িং রুমে সোফার ওপর একা ঘুমায়। মশারি খাটাবার উপায় নেই। নিচে কয়েল জ্বলে। ঘুম আসে না সহজে। ঝগড়ার পর শান্তা তার সঙ্গে কথা বলেনি এখনো। তার মতিগতি বেশ রহস্যময়। কথা বলুক, রাতে স্বামীর সুবিধা-অসুবিধা স্বচক্ষে দেখতে ড্রয়িং রুমে সে আসতে পারে। কিন্তু আসে না। নিধুম ভগ্নিপতির সঙ্গে গল্প করতে কান্তা স্বাচ্ছন্দ্যে এ ঘরে আসতে পারে। কিন্তু বোনের ভয়ে আসার সাহস পায় না হয়তো। এসব ভাবনা নিয়ে রাতে আরিফ কয়েলটার মতো নিঃশব্দে জ্বলতে থাকে একা।

.

পরদিন অফিস ছুটির পর দুপুরে মায়ের দূত হয়ে রিয়া বাবার কাছে আসে।

মোহাম্মদপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে সপরিবারে দাওয়াত খেতে যাওয়ার কর্তব্যটি ভুলে গিয়েছিল আরিফ। শান্তার মনে আছে দেখে আশ্চর্য হয়। বিরক্ত হয়ে মেয়েকে বলে, তোর মাকে নিয়ে যা। আমি যাব না।

মা-ই-তো রেডি হতে বলল। শুধু আমরা চার জন যাব। তাড়াতাড়ি জামা-প্যান্ট পরে নাও।

মেয়ের অতিউৎসাহে, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগ্রহে, নাকি নিছক লোকদেখানো সামাজিকতা রক্ষার দায়ে স্বামী-স্ত্রী সেজেগুঁজে বাইরে বেরয়? নিজেরাও ঠিক জানে না তারা। সঙ্গে বাচ্চারা। অন্যের অতিথি হওয়ার জন্য গোটা পরিবারকে সাজতে দেখে বাড়ির অতিথিরাও বেশ খুশি। বাচ্চা দুটির খুশি আরো বেশি।

রিকশায় পাশাপাশি বসে তারা। বাবা-মায়ের কোলে মেয়ে দুটি। গলি পেরিয়ে রিকশা যখন বড় রাস্তায় জ্যামে পড়ে অচল, আরিফ স্ত্রীর দিকে তাকায়। কথা বলে প্রথম, এর মধ্যে হাজার দেড়েক টাকা ধার হয়েছে আমার।

শান্ত স্বামীর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে জবাব দেয়, বাইরে আমারও ধার-দেনা বাড়ছে। তারপর অবরুদ্ধ পথে দু’জন দুদিকে তাকিয়ে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *