মেঘ-মল্লার
মৌরীফুল
যাত্রাবদল
জন্ম ও মৃত্যু
কিন্নর দল
বেনীগীর ফুলবাড়ি
নবাগত
তালনবমী
উপলখন্ড
বিধুমাস্টার
ক্ষণভঙ্গুর
অসাধারণ
মুখোশ ও মুখশ্রী
নীলগঞ্জের ফালমন্ সাহেব
1 of 2

যদু হাজরা ও শিখিধ্বজ

যদু হাজরা ও শিখিধ্বজ

আপনারা একালে যদু হাজরার নাম বোধ হয় অনেকেই শোনেননি।

আমাদের বাল্যকালে কিন্তু যদু হাজরাকে কে-না জানত? চব্বিশ পরগনা থেকে মুর্শিদাবাদ এবং ওদিকে বর্ধমান থেকে খুলনার মধ্যে যেখানেই বাজারে বা গঞ্জে বড়ো বারোয়ারির আসরে যাত্রা হত সে-সব স্থানে দশ-বারো ক্রোশ পর্যন্ত যদু হাজরার নাম লোকের মুখে মুখে বেড়াত। কাঠের পুতুল চোখ মেলে চাইত—যদু হাজরার নাম শুনলে। আপনারা কেউ কী যদু হাজরাকে নল দময়ন্তী পালাতে নলে-র পার্ট করতে দেখেননি? তাহলে জীবনের বহু ভালো জিনিসের মধ্যে একটা সেরা ভালো জিনিস হারিয়েছেন।

আমি দেখেছি।

সে একটা অদ্ভুত দিন আমার বাল্যজীবনে। তখন আমার বয়স হবে বারো কী তেরো। আমাদের গ্রামের একটি নববিবাহিতা বধূর বাপেরবাড়িতে কী একটা কাজ উপলক্ষ্যে, নব বধূটিকে নৌকো করে তার বাড়িতে আমাকেই রেখে আসতে হবে ঠিক হল।

পৌঁষ মাস। খুব শীত পড়েছে। বধূটি গ্রাম-সম্পর্কে আমার গুরুজন, আমার চেয়ে তিন-চার বছরের বড়োও বটে। দুজনে গল্পগুজবে সারাপথ কাটালুম। তাঁর বাপেরবাড়ি পৌঁছে আমি কিন্তু পড়লুম একটু মুশকিলে। মস্ত বড়ো বাড়ি; উৎসব উপলক্ষ্যে অনেক জায়গা থেকে আত্মীয়-কুটুম্বের দল এসেছে, তার মধ্যে দুটি শহর অঞ্চলের চালাক চতুর জ্যাঠা-ছেলে আমার বড়ো অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠল। আরও এত ছেলে থাকতে তারা আমাকেই অপ্রতিভ করে কেন যে এত আমোদ পেতে লাগল, তা আমি আজও ঠিক বুঝতে পারি না।

একটি ছেলের বয়স বছর পনেরো হবে। রং ফর্সা, ছিপছিপে, সিল্কের পাঞ্জাবি গায়ে—নাম ছিল যতীন, নামটা এখনও মনে আছে—সে আমাকে বললে—কী পড়ো?

আমি বললাম—মাইনর সেকেন্ড ক্লাসে পড়ি। সে বললে—বলো তো হাঁচি মাইনাস কাসি কত? প্রশ্ন শুনে আমি অবাক। বাংলা স্কুলে পড়ি, ‘মাইনাস’-কথার মানে তখন জানিনে। তা ছাড়া এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন! আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে অমনি আবার জিজ্ঞাসা করল—’হবগবলিন’ মানে কী?

আমি ইংরাজি পড়ি বটে কিন্তু সে সুশীল ও সুবোধ আবদুলের গল্প, দারোয়ান ও জেলের গল্প, বড়ো-জোর গুটিপোকা ও রেশমের কথা—সে-সবের মধ্যে ওই অদ্ভুত কথাটা নেই; লজ্জায় লাল হয়ে বললুম—পারব না।

কিন্তু তাতেও আমার রেহাই নেই। ভগবান সেদিন লোকসমাজে আমাকে নিতান্ত হেয় প্রমাণিত করতেই বোধ হয় যতীনকে ওদের বাড়িতে হাজির করেছিলেন। সে দু-হাতের আঙুলগুলো প্রসারিত করে আমার সামনে দেখিয়ে বললে—এতগুলো কলা যদি একপয়সা হয়—তবে পাঁচটি কলার দাম কত?

আমি বিষণ্ণ মুখে ভাবছি, ওর দু-হাতের মধ্যে কতগুলো কলা ধরতে পারে— সে খিলখিল করে হেসে উঠে বিজ্ঞের ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে আমার মাইনর স্কুলে সেকেন্ড ক্লাসে অর্জিত বিদ্যার অকিঞ্চিৎকরত্ব প্রতিপন্ন করলে।

তারপর থেকে আমি তাকে ভয়েভয়ে এড়িয়ে চলতে লাগলুম। বয়স তার আমার চেয়ে বেশিও বটে, শহর অঞ্চলে ইংরেজি স্কুলে পড়েও বটে, দরকার কী ওর সঙ্গে মিশে? তা ছাড়া চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি আর কত অপমানই বা সহ্য করি।

কিন্তু সে আমায় যতই জ্বালাতন করুক, জীবনে সে আমার একটা বড়ো উপকার করেছিল—সে জন্যে আমি তার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ। সে যদু হাজরার অভিনয় আমাকে দেখিয়েছিল।

সন্ধ্যার কিছু আগে সে আমায় বললে—এই, কী নাম তোমার, রাজগঞ্জের বাজারে বারোয়ারি হবে, শুনতে যাবে?

রাজগঞ্জ ওখান থেকে প্রায় আড়াই ক্রোশ পথ। হেঁটেই যেতে হবে, কিন্তু যাত্রা শুনবার নামে আমি এত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম যে, এই দীর্ঘ পথ এর সাহচর্যে অতিক্রম করবার যন্ত্রণার দিকটা একেবারেই মনে পড়ল না।

তথাপি সারা পথ যতীন ও তার দলের তারই বয়সি জনকয়েক ছোকরা অশ্লীল কথাবার্তা ও গানে আমাকে নিতান্ত উত্যক্ত করে তুললে। আমি যে বাড়ির আবহাওয়ায় মানুষ,আমার বাবা, মা, জ্যাঠামশায় সকলেই নিতান্ত বৈষ্ণব প্রকৃতির। প্রায় আমারই বয়সি ছেলের মুখে ওরকম টপ্পা ও খেউড় শুনে আমার অনভিজ্ঞ বালকমনের নীতিবোধ ক্রমাগত ব্যথা পেতে লাগল।

ওরা কিন্তু আমায় রাজগঞ্জের বাজারে পৌঁছে একেবারে রেহাই দিলে। সেই অপরিচিত জনসমুদ্রে আমায় একা ফেলে ওরা যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল— আমি কোনো সন্ধানই করতে পারলুম না।

যাত্রা বোধ হয় রাত্রে, তখন সবে সন্ধ্যা হয়েছে, বারোয়ারির খুব বড়ো আসর, অনেক ঝাড়লণ্ঠন টাঙিয়েছে—বাঁশের জাফরির গায়ে লাল-নীল কাগজের মালা ও ফুল, আসরের চারিধারে রেলিং দিয়ে ঘেরা, রেলিং-এর মধ্যে বোধ হয় ভদ্রলোকদের বসবার জায়গা—বাইরে বাজে লোকদের।

রাজগঞ্জের বাজারে আমি জীবনে আরও দু-একবার বাবার সঙ্গে এর আগে যে–এসেছি এমন নয়, কিন্তু এখানে না-আমি কাউকে চিনি, না-আমাকে কেউ চেনে। রেলিং-এর ভিতরে জায়গা আমার মতো ছোটো ছেলেকে কেউ দিলে না— আমিও সাহস করে তার মধ্যে ঢুকতে পারলুম না, বাইরে বাজে লোকদের ভিড়ের মধ্যে ঠেসাঠেসি করে ইট পেতে বসতে গেলুম—তাতেও নিস্তার নেই— বারোয়ারির মুরুব্বি পক্ষের লোকেরা এসে আমাদের সে জায়গা থেকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বিশিষ্ট লোকদের জন্যে বেঞ্চি আনিয়ে পাতিয়ে দেয়,আবার যেখানে গিয়ে বসি, সেখানেও কিছুক্ষণ পরে সেই অবস্থা। অতিকষ্টে আসরের কোণের দিকে দাঁড়াবার জায়গা কোনোমতে খুঁজে নিলুম। অন্যান্য বাজে লোকদের কী কষ্ট! তারা প্রায়ই চাষাভুষো লোক, পাঁচ-ছয় ক্লোশ দূর থেকে পর্যন্ত অনেকে মহা আগ্রহে যাত্রা শুনতে এসেছে—এই শীতে তারা কোথায়ও বসবার জায়গা পায় না, কেউ তাদের বসবার বন্দোবস্ত করে না—স্টেশন মাস্টারবাবু, মালবাবু, কেরানিবাবু ও পোস্টমাস্টারবাবুদের যত্ন করে বসাতে সবাই মহাব্যস্ত।

যাত্রা আরম্ভ হল। নল-দময়ন্তীর পালা। একটু পরেই যদু হাজরা ‘নল’ সেজে আসরে ঢুকতেই—তখন হাততালির রেওয়াজ ছিল না—চারিদিকে হরিধ্বনি উঠল। অত বড়ো আসর মন্ত্রমুগ্ধবৎ স্থির ও নীরব হয়ে গেল।

আমি যদু হাজরার নাম কখনো এর আগে শুনিনি, এই প্রথম শুনলাম। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলুম, শ্যামবর্ণ, সুপুরুষ—বয়স তখন বোঝবার ক্ষমতা হয়নি, ত্রিশও হতে পারে, পঞ্চাশও হতে পারে। কিন্তু কী কথা বলবার ভঙ্গি, কী চোখমুখের ভাব, কী হাত-পা নাড়ার ঢং। আমার এগারো বৎসরের জীবনে আর কখনো অমনটি দেখিনি। ভিড়ের কষ্ট ভুলে গেলুম, কিছু খেয়ে বেরুইনি, খিদেতে পেটের মধ্যে যেন বোলতায় হুল ফোটাচ্ছে—সে-কথা ভুললুম।

যাত্রা থেমে গেলে এত রাত্রে এক অজানা স্থানে শীতে কোথায় যাব—সে-সব কথাও ভুলে গেলুম—পঞ্চ দেবতা পঞ্চ নলরূপে দময়ন্তীর স্বয়ংবর সভায় এসে বসেছেন, আসল ‘নল’-রূপী যদু হাজরা বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টিতে চারিদিক চেয়ে বলছেন—

এ কি হেরি চৌদিকে আমার–
মম সম রূপ নল চতুষ্টয়
মম সম সাজে সাজি বসিয়াছে
সভা মাঝে
বুঝিতে না পারি কিবা মায়াজাল
ইষ্টদেব,
পুরাও বাসনা মোর, মায়া জাল ফেল ছিন্ন করি।

এমন সময়ে বরমালা হস্তে দময়ন্তী সভায় প্রবেশ করতেই নল বলে উঠলেন—

দময়ন্তী, দময়ন্তী, মনে পড়ে হংসী মুখে
আনন্দ-বারতা? এই আমি নল-রাজ
বসি স্তম্ভ পাশে।–

অপর চারজনও সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে বলে উঠল—

দময়ন্তী, দময়ন্তী, মনে পড়ে হংসী মুখে
আনন্দ-বারতা? এই আমি নল-রাজ
বসি স্তম্ভ পাশে।–

প্রকৃত নলের তখন বিমূঢ় দৃষ্টি!

তারপরে বনে বনে ভ্রাম্যমান রাজ্যহীন সহায়-সম্পদহীন উন্মত্ত নলের সে কী করুণ ও মর্মস্পর্শী চিত্র! কতকাল তো হয়ে গেল, যদু হাজরার সে অপূর্ব অভিনয় আজও ভুলিনি। চোখের জল কতবার গোপনে মুছলুম সারারাত্রির মধ্যে, পাছে আশেপাশের লোক কান্না দেখতে পায়, কতবার হাঁচি আনবার ভঙ্গিতে কাপড় দিয়ে মুখ চেপে রাখলুম। যাত্রা শেষরাত্রে ভাঙল। কিন্তু পরদিনও আবার যাত্রা হবে শুনে আমি বাড়ি গেলুম না। একটা খাবারের দোকানে কিছু খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলাম। রাত্রে আবার যাত্রা হল—শিখিধ্বজের পালা। যদু হাজরা সাজল শিখিধ্বজ। এটা নাকি তার বিখ্যাত ভূমিকা, শিখিধ্বজের ভূমিকায় যদু হাজরা আসর মাতিয়ে পাগল করে দিলে। সেই একরাত্রের অভিনয়ের জন্যে চার-পাঁচখানা সোনা ও রুপোর মেডেল পেলে যদু হাজরা। যাত্রা ভাঙল যখন তখন রাত বেশি নেই। আসরে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে রাত কাটিয়ে সকালে একা নিজের গ্রামে ফিরে এলুম।

তারপর কয়েক বছর কেটেছে। তখন আমি আরও একটু বড় হয়েছি—স্কুলে ভর্তি হয়েছি। যদু হাজরার কথা প্রায় এর-ওর মুখে শুনি। যেখানেই যাত্রা দলের কথা ওঠে, সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে যাত্রা দলের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা যদু হাজরা।

আমি কিন্তু বহুদিন যদু হাজরাকে আর দেখলুম না।

এর অনেক কারণ ছিল।

আমি দূরে শহরের স্কুল-বোর্ডিং-এ গেলুম।

মন গেল লেখাপড়ার দিকে, ধরাবাঁধা রুটিনের মধ্যে জীবনের মুক্ত গতি বন্ধ হয়ে পড়ল। অ্যালজেব্রার আঁক, জ্যামিতির একস্ট্রা, ইংরেজি ভাষার নেশা, ফুটবল, ডিবেটিং ক্লাব, খবরের কাগজ জীবনের মধ্যে নানা পরিবর্তন এনে দিলে। ছেলেবেলার মতো যেখানে যাত্রার নাম শুনব সেখানেই দৌড়ে যাব—তা কে জানে চার ক্রোশ, কে জানে ছ-ক্রোশ—এমন মন ক্রমে ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। ইচ্ছে হলেও হয়তো স্কুলের ছুটি থাকে না, স্কুলের ছুটি থাকলেও বোর্ডিং-এর সুপারিনটেন্ডেন্ট ছাড়তে চান না—নানা উৎপাত।

পাড়াগাঁয়ের ছেলে ছিলুম, থিয়েটার কাকে বলে জানতুম না। যে শহরে পড়তুম, সেখানে উকিল-মোক্তারদের একটা থিয়েটার ক্লাব ছিল, তাঁরা একবার থিয়েটার করলেন, পালাটা ঠিক মনে নেই—বোধ হয় প্রতাপাদিত্য। ভাষা ও ঘটনার বিন্যাসে থিয়েটারের পালা আমাকে মুগ্ধ করল—ভাবলুম যাত্রা এর চেয়ে ঢের খারাপ জিনিস। প্লটের এমন বাঁধুনি তো যাত্রার পালাতে নেই। তারপর অনেকবার উকিলদের ক্লাব থিয়েটার দেখলুম—ছেলেবেলার মন ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে, বাজারে যাত্রা হল বারোয়ারির সময়ে, কলকাতার দল, কিন্তু তাতে আগেকার মতো আনন্দ পেলুম না।

তারপর কলকাতায় এলুম। তখন নতুন মতের অভিনয় সবে কলকাতায় শুরু হয়েছে। বড়ো বড়ো বহু বিখ্যাত নটদের অভিনয় দেখবার সুযোগ জীবনে এই প্রথম ঘটল, তাদের নানা পালাতে নানা অভিনয় দেখলুম—বিলিতি ফিলমে বিশ্ববিখ্যাত নটদের অভিনয় অনেকদিন ধরে দেখলুম—মানুষ ক্রমে ক্রমে বিজ্ঞ হয়, উকিল মোক্তারদের প্রধান অভিনেতা গুরুদাস ঘোষ—যাকে এতকাল মনে মনে কত বড়ো বলে ভেবে এসেছি—এখন তার কথা ভাবলে আমার হাসি পায়।

আরও কয়েক বছর কেটে গেল। কলেজ থেকে বেরিয়ে চাকুরি করি। কলকাতার থিয়েটারের অভিনেতারাও তখন আমার কাছে পুরোনো ও একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে—থিয়েটার দেখাই দিয়েছি ছেড়ে। ফিলম সম্বন্ধেও তাই। খুব নামজাদা অভিনেতা না-থাকলে সে-ছবি দেখতে যাইনে—যাঁদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি একদিন—এখন তাঁদের অনেকের সম্বন্ধেই মত বদলেছি।

এই যখন অবস্থা, তখন কী একটা ছুটিতে বাড়ি গিয়ে শুনি দেশে বারোয়ারি। শুনলুম, কলকাতা থেকে বড় যাত্রার দল আসছে—দেড়শো টাকা এক রাত্রির জন্যে নিয়েছে, এমন দল নাকি এদেশে আর কখনো আসেনি। ভালো বিলিতি ফিলমই দেখিনে, থিয়েটার দেখাই ছেড়ে দিয়েছি ভালো লাগে না বলে—এ অবস্থায় রাত জেগে যাত্রা দেখবার যে বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও মনে জাগবে না—এ কথা বলাই বাহুল্য। যাত্রা আবার কী দেখব! নিতান্ত বাজে জিনিসকে কষ্ট করে এই গরমের মধ্যে লোকের ভিড়ে বসে যাত্রা দেখতে যাবে?

কিন্তু বন্ধুবান্ধবেরা ছাড়লেন না। বারোয়ারির কর্তৃপক্ষেরা বিশেষ বিশেষ অনুরোধ করে গেলেন—আমার যাওয়া চাই-ই। কী করি, ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। খানিকটা দেখে না-হয় উঠে এলেই হবে। নিতান্ত না যাওয়াটা ভালো দেখাবে না হয়তো—বিশেষ দেশে যখন তত বেশি যাতায়াত নেই।

সন্ধ্যার সময় যাত্রা বসল। যাত্রা জিনিসটা দেখিনি অনেককাল—দেখে বুঝলুম সেকালের যাত্রা আর নেই। জুড়ির গান, মেডেলধারী বেহালাদারদের দীর্ঘ কসরত—এসব অতীত ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। সলমা-চুমকির কাজ করা সাজ পোশাকও আর নেই—কলকাতার থিয়েটারের হুবহু অনুকরণ যেমন সাজ পোশাকে, তেমনি তরুণ অভিনেতাদের অভিনয়ের ঢঙে। এমনকী কয়েকজন অভিনেতার বলবার ধরন, মুখভঙ্গি ও হাত-পা নাড়ার কায়দা কলকাতার স্টেজের কোনো কোনো নামজাদা বিশিষ্ট অভিনেতার মতো। দেখলুম, আসরের শ্রোতার দলের মধ্যে যারা তরুণ বয়স্ক তাদের কাছে এরা পেলে ঘন ঘন হাততালি। কেউ কেউ বললে—ওঃ, কী চমৎকার নকলই করেছে কলকাতার স্টেজের অমুককে বাস্তবিক দেখবার জিনিস বটে!

এমন সময়ে আসরে ঢুকল একজন মোটা কালো ও বেঁটে লোক। কীসের পার্টে তা আমার মনে নেই। লোকটির বয়স ষাটের উপর হবে, তবে স্বাস্থ্যটা ভালো। কেউ তার বেলা একটা হাততালি দিলে না, যদিও সে দর্শকদের খুশি করার জন্যে অনেক-রকম মুখভঙ্গি করলে, অনেক হাত-পা নাড়লে। আমার সঙ্গে একদল স্কুলের ছেলে বসেছিল, তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল—এ বুড়োটাকে আবার কোথা থেকে জুটিয়েছে? দেখতে যেন একটা পিপে। অ্যাক্টিং করছে দ্যাখো না, ঠিক যেন সং!

পাশের আর একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন—ও এককালে খুব নামজাদা অ্যাক্টর ছিল হে, তখন তোমরা জন্মাওনি! ওর নাম যদু হাজরা।

আমি হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখের দিকে চাইলুম, তারপর একবার বৃদ্ধ অভিনেতাটির দিকে চাইলুম। বাল্যদিনের একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে গেল। সেই কনকনে শীতের রাত্রি, সেই শহুরে-ভেঁপো-ছেলেদের সঙ্গ, সেই তারা আমাকে ফেলে কোথায় পালাল—তারপর বাড়ি থেকে অনেক দূরে এক অপরিচিত গঞ্জের বারোয়ারি আসরে ময়রার দোকানে খাবার খেয়ে আমার সেই

একা বিদেশে দু-দিন কাটানো। সে রাত্রে যার অভিনয় দেখে আমার বালক মন মুগ্ধ বিস্মিত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল—সেই যদু হাজরা এই?

একসময়ে তার যে ধরনের মুখভঙ্গি দেখে ও কথাবার্তার উচ্চারণ শুনে দর্শকেরা আনন্দে উন্মত্ত হয়ে উঠত, আজও যদু হাজরা সেইসব হুবহু করে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে—অথচ দর্শকেরা খুশি নয় কেন? খুশি তো দূরের কথা, তাদের মধ্যে অনেকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছে কেন, বসে বসে এই কথাটাই ভাবলুম।

মন যেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। অপর লোকের কথা কী, আমারই তো যদু হাজরার হাবভাব হাস্যকর ঠেকছে! কেন এমন হয়?

বাল্যদিনের সেই যাত্রার আসরে এঁকে আমি দেখেছিলুম, এঁর সেই অভিনয় এখনও স্পষ্ট মনে আছে। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতির সঙ্গে রাজার কনিষ্ঠ পত্নী ভ্রষ্টা, রাজা একদিন দু-জনকে নির্জনে প্রেমালাপে নিমগ্ন দেখতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কী ভেবে বললেন—’মধুছন্দা, আমি প্রৌঢ়, তুমি তরুণী, এই বয়সে তোমায় বিবাহ করে ভুল করেছি। তোমায় আমি এখনও ভালোবাসি, প্রাণে মারব না—তোমরা দুজনে আমার চোখের সামনে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো হাত-ধরাধরি করে চলে যাও। কিন্তু আমার রাজ্যের বাইরে। আর কখনো তোমাদের মুখ না দেখি।’ ওরা ধরা পড়ে দুজনে ভয়ে ও লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়েছে। রাজার সামনে এ কাজ কেমন করে করবে? হাত-ধরাধরি করে কেমন করে যাবে? রাজা তলোয়ার খুলে বললেন—’যাও, নইলে দুজনকেই কেটে ফেলব—ঠিক ওইভাবেই যাও।’

শেষে তারা তাই করতে বাধ্য হল। রাজা স্থিরদৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়েছিলেন।

—তারা যখন কিছুদূর চলে গিয়েছে, তখন তিনি হঠাৎ উদভ্রান্তের মতো মুক্ত তলোয়ার হাতে ‘হা-হা-হা’ রবে একটা চিৎকার করে তাদের দিকে ছুটে গেলেন —সঙ্গে সঙ্গে তারাও আসরের বাইরে চলে গেল। মনে আছে রাজার সেই চমৎকার ভঙ্গিতে, তার হতাশ ‘হা-হা’ রবের মধ্যে এমন একটা ট্র্যাজিক সুর ছিল, আসরসুদ্ধ দর্শককে তা বিচলিত করেছিল। আমি তখন যদিও নিতান্ত বালক, কিন্তু আমার মনে সেই দৃশ্যটি এমন গভীর দাগ দিয়েছিল যে, এই এত বয়সেও তা ভুলিনি।

পরের দিন যদু হাজরার সঙ্গে দেখা হল। ওদের যেখানে বাসা দিয়েছে, তার সামনে একটা টুলের উপর বসে সে তামাক টানছে। আমি বললুম—কাল আপনার পার্ট বড়ো চমৎকার হয়েছে। বৃদ্ধ আগ্রহের সুরে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে—আপনার ভালো লেগেছে? বললুম—চমৎকার! এমন অনেক দিন দেখিনি!

কথাটার মধ্যে সত্যের অপলাপ ছিল। বৃদ্ধ খুব খুশি হল, মনে হল প্রশংসা জিনিসটা বেচারির ভাগ্যে অনেকদিন জোটেনি। আসরে কাল যখন তরুণ অভিনেতাদের বেলায় ঘন ঘন হাততালি পড়েছে, যদু হাজরার ভাগ্যে সে জায়গায় বিদ্রুপ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।

বৃদ্ধ বললে—আপনি বোঝেন তাই আপনার ভালো লেগেছে। আর কী মশায় সেদিন আছে? এখনকার সব হয়েছে আর্ট-আর্ট, সে যে কী মাথামুণ্ডু তা বুঝিনে। বউ-মাস্টারের দলে ভৃগু সরকার ছিল। রাবণের পার্টে অমন অ্যাক্টো আর কেউ কখনো করবে না। আমি সেই ভৃগু সরকারের সাগরেদ—বুঝলেন? আমায় হাতে ধরে শিখিয়েছেন তিনি। মরবার সময় আমার হাত ধরে বলে গেলেন—যদু, তোমায় যা দিয়ে গেলাম, তোমার জীবনে আর ভাবনা থাকবে না!

আমি বললুম—এ বয়সে আপনি আর চাকুরি কেন করেন?

-না-করে কী করি বলুন? বড়ো ছেলেটি উপযুক্ত হয়েছিল, আজ বছর দুই হল কলেরা হয়ে মারা গেল। তার সংসার আমারই ওপর, নাতনিটির বিয়ে দিতে হবে আর কিছুদিন পরেই। পয়সা আগে যা রোজগার করেছি হাতে রাখতে পারিনি। এখন আর তেমন মাইনেও পাইনে। দেড়শো টাকা পর্যন্ত মাইনে পেয়েছি একসময়—আমার জন্যে অধিকারী আলাদা দুধ বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল, যখন ভূষণ দাসের দলে থাকতাম। এখন পাই পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনে। আর সতীশ বলে ওই-যে-ছোকরা কাল রামের পার্ট করলে—সে পায় আশি টাকা। ওরা নাকি আর্ট জানে। আপনিই বলুন তো, কাল ওর পার্ট ভালো লাগল আপনার, না আমার পার্ট ভালো লাগল? এখনকার আমলে ওদেরই খাতির বেশি অধিকারীর কাছে। আমাদের চাকরি বজায় রাখাই কঠিন হয়েছে।

মনে মনে ভেবে দেখলুম, যদু হাজরার এতদিন বেঁচে থাকাটাই উচিত হয়নি। চল্লিশ বছর আগে তরুণ যদু হাজরাকে বউ-মাস্টারের দলের ভৃগু সরকার যেভাবে হাত-পা নাড়বার ভঙ্গি ও উচ্চারণের পদ্ধতি শিখিয়েছিল, বৃদ্ধ যদু হাজরা আজও যদি তা আসরে দেখাতে যায়, তবে বিদ্রুপ ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য হবে না—এ কথা তাকে বলি কেমন করে? কালের পরিবর্তন তো হয়েছেই, তা ছাড়া তরুণ বয়সে যা মানিয়েছে এ বয়সে তা কী আর সাজে?

 

এই ঘটনার বছর পাঁচ-ছয় পরে নেবুতলার গলি দিয়ে যাচ্ছি; একটা বেনেতি মশলার দোকানে দেখি যদু হাজরা বসে আছে। দেখেই বুঝলুম দারিদ্র্যের চরম সীমায় এসে সে ঠেকেছে। পরনে অর্ধমলিন থান, পিঠের দিকটা হেঁড়া এক ময়লা জামা গায়ে। আমায় দেখে সে চিনতে পারলে না। আমি ওকে খুশি করবার জন্যে বললুম—আপনি চিনতে পারুন আর না-ই পারুন, আপনাকে না-চেনে কে! আগুন কী ছাই চেপে ঢেকে রাখা যায়? তা এখন বুঝি কলকাতায় আছেন?

বৃদ্ধের চেখে জল এল প্রশংসা শুনে। বললে, আর বাবুমশায়, আমাদের দিন ফুরিয়েছে। এই দেখুন, আজ তিনটি বছর চাকুরি নেই। কোনো দল নিতে চায় না। বলে, আপনার বয়স হয়েছে হাজরা মশাই, এ বয়সে আর আপনার চাকরি করা পোষাবে না, আসল কথা আমাদের আর চায় না। ভালো জিনিসের দিন আর নেই, বাবুমশায়। এখনকার কালে সব হয়েছে মেকি। মেকির আদর এখন খাঁটি জিনিসের চেয়ে বেশি। আমার গুরু ছিলেন বউ-মাস্টারের দলের ভৃগু সরকার, আজকালকার কোন ব্যাটা অ্যাক্টার ভৃগু সরকারের পায়ের ধুলোর যুগ্যি আছে? রাই উন্মাদিনী পালায় আয়ান ঘোষের পার্টে যে একবার ভৃগু সরকারকে দেখেচে

আরও বার কয়েক প্রশংসা করে এই ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধ নটকে শান্ত করলুম। জিজ্ঞাসা করে ক্রমশ জানলুম এই মশলার দোকানই বৃদ্ধের বর্তমান আশ্রয়স্থল। কাছেই গলির মধ্যে কোনো ঠাকুরবাড়িতে একবেলা খেতে দেয়, রাত্রে এই দোকানটাতে শুয়ে থাকে। দোকানের মালিক বোধ হয় ওর জানাশোনা।

কার্যোপলক্ষ্যে গলিটা দিয়ে প্রতিদিনই যাতায়াত করি, আর ফিরবার সময়ে যদু হাজরার সঙ্গে একটু গল্পগুজব করি। একদিন বৃদ্ধ বললে—বাবুমশাই, একটা কথা বলব? একদিন একটু মাংস খাওয়াবেন? কতকাল খাইনি!

একটা ভালো রেস্টোরেন্টে তাকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালুম। ওর খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হল, বৃদ্ধ কতদিন ভালো জিনিস খেতে পায়নি। তারপর দুজনে একটা পার্কে গিয়ে বসলুম। রাত তখন নটা বেজে গিয়েছে। শীতকাল, অনেকে পার্ক থেকে চলে গিয়েছে। একটা বেঞ্চে বসে বৃদ্ধ নিজের সম্বন্ধে কত কথাই বললে। কোন জমিদার কবে তাকে আদর করে ডেকে নিজের হাতে সোনার মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন, তার অভিনয় দেখে কবে কোন মেয়ে তার প্রেমে পড়েছিল, হাতিবাঁধার রাজা নিজের গায়ের শাল খুলে ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন।

বলতে বলতে মাঝে মাঝে যেন ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। পঁচিশ বৎসর আগের কোন তরুণী প্রেমিকার হাসিমাখা চাহনি ওর আবেশ-মধুর যৌবনদিনগুলির উপর স্পর্শ রেখে গিয়েচে—কে জানে, সেইসব দিন, সেইসব বিস্মৃতপ্রায় মুখ ও মনে আনবার চেষ্টা করছিল কিনা। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললুম—শিখিধ্বজ আর মধুছন্দার সেই অভিনয় আমার বড়ো ভালো লাগে, সেই যখন রাজা বললেন, ‘তোমরা প্রেমিক-প্রেমিকার মতো হাত-ধরাধরি করে চলে যাও’—সেই জায়গাটা এখনও ভুলিনি।

বৃদ্ধ নট সোজা হয়ে বসল। তার চোখে যৌবনকালের সেই হারানো দীপ্তি যেন ফিরে এল। বললে—ওঃ, সে কত কালের কথা যে! ও পালা গেয়েছি প্রসন্ন নিয়োগীর দলে থাকতে। দেখবেন—করে দেখাব?

আমি উৎসাহের সঙ্গে বললুম—মনে আছে আপনার? দেখান না? ভাগ্যে পার্কে তখন বিশেষ কেউ ছিল না। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াল—আমি হলুম মধুছন্দা, ও নিজের পার্ট বলে যেতে লাগল—দেখলুম কিছুই ভোলেনি। শেষে আমার দিকে ফিরে জলদ গম্ভীর সুরে বললে—যাও মধুছন্দা, তোমরা দুজনে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো হাত-ধরাধরি করে চলে যাও। তারপর আমি কয়েক পা এগিয়ে যেতেই বৃদ্ধ তার সেই পুরোনো ট্র্যাজিক সুরে ‘হা-হা-হা-হা করে আমার দিকে উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলে। সত্যই কী অপূর্ব সে সুর! কী অপূর্ব ভঙ্গি। ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধ নট তার জীবনের সমস্ত ট্র্যাজেডি ওর মধ্যে ঢেলে দিলে। যেন সত্যই ও ভগ্নহৃদয় প্রৌঢ় রাজা শিখিধ্বজ, অবিশ্বাসিনী মধুছন্দা ওকে উপেক্ষা করে তার তরুণ প্রেমিকের সঙ্গে হাত-ধরাধরি করে চলে গেল। অল্প কয়েক মুহূর্তের জন্যে বৃদ্ধ যদু হাজরা ত্রিশ বছর আগেকার তরুণ নট যদু হাজরাকেও ছাড়িয়ে গেল।

এই যদু হাজরার শেষ অভিনয়। এর মাসখানেক পরে একদিন নেবুতলায় সেই মশলার দোকানটাতে খোঁজ করতে গিয়ে শুনলুম সে মারা গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *