মরুভূমিতে মুক্তি

মরুভূমিতে মুক্তি

আশ্চর্য, এমন একটা ছবি রানির ভালো লাগল না। অর্ধেকও হয়নি, তখনি সে অস্বস্তি বোধ করেছিল। আগে, পেছনে ও পাশের দর্শকগুলো তন্ময় হয়ে দেখছে, কিন্তু রাণি তার চোখ দুটি যদিও পর্দার দিকে রেখেছে, ভালো লাগছে না তার। অথচ এখানে আসতে তারই আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।

সে বিমলকে চুপি চুপি বললে, চলো বাড়ি যাই।

–কেন, ভালো লাগছে না?

–না, তুমি চলো।

—বিমল বললে, দাঁড়াও ইন্টারভ্যালটা তো হোক।

হলের ভেতরের হাওয়া যেন ভারী হয়ে উঠেছে, রাণি নিশ্বাস ফেলতে পারছে না।

বিশ্রাম হল, কিন্তু বিমল যা মনে করেছিল তা হল না, রাণি আর থাকল না। সে আর কী করে, নীল আলোর নীচ দিয়ে বাইরে এসে গাড়িতে উঠল।

কনকনে শীত। চলতি গাড়িতে বাতাসও লাগছে। রাণি আরও ঘন হয়ে বসল।

বাসায় চাকর রামলোচন অপেক্ষা করছিল। রাণি গিয়ে তাকে বিদায় দিয়ে দিলে। তারপর ওপরে গিয়ে একেবারেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। যেন এই শীতের রাতেও অনেক ক্লান্ত। ওর এই এক দোষ, একটা সামান্যতম কিছু অসঙ্গতি ঘটলে, সে তা চেপে রাখতে পারে না, প্রকাশ করে ফেলে। কিন্তু ওদিকে আবার কী যে অসঙ্গতি ঘটেছে তাও সহজে জানাবে না, এখন যদি কেউ তার অনুভবের তীক্ষ্ণতায় জানতে পারে।

বিমল একটা চেয়ারে বসেছিল। ঘরের জানালাগুলো বন্ধ। টেবিলের ওপর আলো জ্বলছে। কিন্তু পরে রাণি জানালাগুলো খুলে দিয়ে খাটের ওপর বসল।

-বাইরে ভয়ানক হিম পড়ছে, জানলা খোলার কী দরকার ছিল?

–থাক না খোলা, পরে বন্ধ করে দেব।

বিমল একটা সিগারেট ধরাল। কথায় কথায় রাণি বললে, আচ্ছা মেয়েটি যে ওরকম অবৈধভাবে ভালোবেসে চলল, এর শেষ কোথায় জান?

—শেষ পর্যন্ত দেখলেই তো জানা যেত, বিমল বললে, কিন্তু আমি জানি, বই পড়েছি, Anna আত্মহত্যা করল।

—আমিও তাই ভাবছিলুম। ওরকম জীবন কখনো ভালো নয়। তার শেষ কখনো ভালো হতে পারে না।

—কিন্তু মানুষের ভুল বলে একটা জিনিষ আছে, এটা তো স্বীকার করো।

–করি, কিন্তু এও জানি, সে ভুল আমরা জেনেশুনেই করি। তাই তার ফল কখনো ভালো হয় না। কেবল দুঃখ আর দুঃখ। তার পরের জীবন একটা কান্নার সমুদ্র। ওর জন্যে দুঃখ হয়, কিন্তু সেজন্যে তুমি আর কী করতে পারো বল? যে মেয়ে স্বামী আর ছেলে থাকতে আর একজনকে ভালোবাসে, সে ভালোবাসার, ধরো তোমার কাছেই যদি ওরকম কোনো ঘটনা ঘটে, তার পক্ষে তুমি কি তাহলে সাক্ষী দিতে পারবে? পারবে না। কেবল দুঃখই হয়।

—তা ছাড়া আর উপায় কী বল? কিন্তু তুমি যা বললে তা না করতে পারলেও নিজের দিক থেকে প্রশান্ত মনে ক্ষমাও তো করতে পারি?

—তা পারো। রাণি আবার শুয়ে পড়ল। কতক্ষণ কাটল চুপচাপ। বিমলের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। সে হাত-পা গুটিয়ে বসেই রইল। পাশের বাড়ির বাসন মাজার শব্দ কানে আসছে।

—ঘুমুলে?

—না।

—হঠাৎ অত মনমরা হয়ে গেলে কেন? বিমল যেন অনেক সাহসে বললে।

–কী হবে অত পরেরটা ভেবে? রাণির স্বর ভারী হয়ে এল।

বিমল লক্ষ করছে, তবু বললে, তা ঠিক। তবে শুধু নিজের ভাবনাই তো সার নয়।

—এও ঠিক, কিন্তু সার নয় কখন, যখন নিজের ভাবনা বলে একটা কিছু অন্তত থাকে।

বিমল আবার জিজ্ঞেস করলে, সে কি একেবারেই নেই?

—আছে কি নেই তা কি তুমি নিজেই জান না? রাণি উষ্ণ হয়ে উঠল, কেন আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছ? তুমি আমার চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান, এটুকু বোঝবার শক্তি আমার থাকলে তোমারও নিশ্চয়ই আছে। ভাবনা! সে কার থাকে? তুমি বলো। তুমিই খুঁজে বের করো।

-আমি তো অনেক দেখেছি, পাইনি। জানতাম, তোমারও নেই। এখন দেখছি কিছু আছে। বলো তাহলে। কিছু সময় কাটানো যাবে। যে দিনগুলো এত অবহেলায় আর আলস্যে সেগুলোর কিছু অন্তত কাজে লাগানো যাবে।

-ইস, আমি তো আর পারিনে। রাণি আর বলতে পারলে না, স্বর বাষ্পচ্ছন্ন, সে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল।

বিমলও চুপ করে গেল। রাত বেড়ে চলেছে। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। দূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল। সঙ্গে হুইসিলের শব্দ। শহরের প্রান্তে গভীর রাতের ট্রেন যাচ্ছে।

বিমলের চোখে ঘুম নেই। সে নড়েচড়ে বসল। কী শীত! ঘরের আলোটাও দুরন্ত শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু একটা কিরকম যেন অলসতায় বিমল চেয়ার থেকে উঠল না।

গির্জার ঘড়িতে বারোটা বাজল।

এবার সে চমকে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে জানালাগুলো আগে বন্ধ করল, তারপর সেইখানেই কতক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ভাবে দাঁড়িয়ে খাটের কাছে গেল। রাণি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ঘুমের চোখেই হয়তো আলোর দিকে পাশ ফিরে শুয়েছে। বাইরের পোশাকই এখন গায়ে। সেই জরিপেড়ে নীল সিল্কের শাড়ি, গায়ের সবকিছু একেবারে একটা গরম জামায় গিয়ে শেষ, বুকের মাঝখানে সবগুলো জামা ঈষৎ ফাঁক হয়ে একটা কোণের মতো সৃষ্টি করেছে। শুভ্র কতটুকু বুক। একটা সরু হার। চারিদিকে একটি মিষ্টি গন্ধ।

বিমল ডাকল না।

নিঃশব্দে ভাঁজ করা লেপটি তার গায়ের ওপর টেনে দিয়ে এবার টেবিলের কাছে একটা বই খুলে পড়তে লাগল। সময়ের বিরাম নেই। একটা বিড়াল এসেছে ঘরে। ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যের নয়। কিন্তু আশ্চর্যের যা তা হচ্ছে ওর ভীষণ চেহারা–গায়ের রঙ মিশকালো, একটু সাদা ছিট নেই, আর চোখদুটো আলোর ভাঁটার মতো জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ দেখলে ভয় করে।

বিড়াল। বিমল দেখতে পেয়েছিল। সে এটা আরও অনেকবার দেখেছে, কিন্তু অন্যবার আজ রাতের মতো হয়ে ওঠেনি। সে চেয়ে রইল তার দিকে একদৃষ্টে, বিড়ালটাও চেয়ে রয়েছে একইরকম ভাবে।

বিমলের হঠাৎ ভয়ানক হাসি পেল : মনে মনে বললে, ওরে তোরও কি নিদ্রাবিহীন রাত্রি?

কিন্তু এখন হাসবার কথা নয়। ভয় পাওয়ার, নইলে রাগবার কথা। বিমল এবার রেগে গেল, হাতের কাছে ছিল একটা খালি সিগারেটের কৌটো, খুব চুপিচুপি সেটা হাতে নিয়ে হঠাৎ ছুঁড়ে মারল বিড়ালটার দিকে। কিন্তু তার পায়ে সেটা লাগল না। বিড়ালটা যেখান দিয়ে এসেছিল সেখান দিয়েই দৌড়ে পালাল।

ইতিমধ্যে কৌটোর শব্দে রাণি জেগে উঠেছে। বিমল অপ্রতিভ হয়ে তাড়াতাড়ি আবার বইয়ে মন দিলে। রাণি আশ্চর্য হয়ে বললে, ওকি, তুমি এখনও বসে!

সে আস্তে উঠে তার কাছে এল, বললে, ক-টা বেজেছে?

–বোধহয় একটা।

–একটা! রাণির চোখ দুটি বড়ো হয়ে গেল, বলল, আর তুমি এখনও জেগে?

-তা এমনকী হয়েছে? রাত একটা, এমনকী! বেশি ঘুমোনো কি ভালো? জগতে যত বড়ো বড়ো লোক আছেন তাঁরা কখনও বেশি ঘুমোননি, বই খুলে দেখো গিয়ে।

এই কয়েক ঘণ্টা আগের কথা রাণির মনে পড়লো, হঠাৎ অনুতাপে, আর একটা দুঃখে তার চোখ দুটি সজল হয়ে এল। বলল, তুমি কি বড়োলোক?

-না, তা নই, কিন্তু মহাজনপন্থা অনুসরণ তো করতে হবে।

–দরকার নেই। রাণি যেন ভয়ানক অনুতপ্ত হয়ে বলল, আমার অনেক অপরাধ হয়েছে। তুমি এখনও না খেয়ে আছ, আর আমি কি না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করো।

মাথাটি নীচু করে সে দুহাত জোড় করল। বিমল তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে তার দুটি হাত নিজের হাতে নিয়ে বললে, আহা, একি করছ? তোমার কিছু অপরাধ হয়নি। আমি এতটুকু মনে করিনি।

কতক্ষণ এমনি কাটল। রাণি হঠাৎ বললে, চল খেতে।

বিমল খেতে গেল।

কয়েকদিন পর। একদিন সাইকেলে করে একটি চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সি ছেলে এল। দুপুরবেলা।

কী একটা পর্ব উপলক্ষে বিমলের অফিসে ছুটির দিন।

ছেলেটি রাণিকেই খুঁজছিল। রাণি তার কাছে গিয়ে বললে, কাকে ডাকছো?

—বিমলবাবুর বাসা না এটা?

-হ্যাঁ।

-মানে, তারই—মানে, আমার দিদির বন্ধু রাণি বলে কেউ আছে এখানে?

–আছে। রাণি মুচকি হেসে বলল।

—তাকে একটু ডেকে দিন না।–আমিই।

-ওঃ, আপনি। ছেলেটি তাড়াতাড়ি শার্টের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে তার হাতে দিয়ে বললে, দিদি লিখেছে। কালকে আবার ঠিক দশটার সময় আসব।

ছেলেটি চলে যাচ্ছিল, রাণি তাড়াতাড়ি বললে, আমাকে এখনই আবার উত্তর দিতে বলেনি তো?

-ওঃ, একেবারেই ভুলে গেছি। ছেলেটি সাইকেল রেখে আবার কাছে এসে বললে, আমার সঙ্গেই উত্তর দিয়ে দিতে বললে।

—এই দ্যাখো, আমি মনে করে দিয়েছি বলেই না! তুমি এই ঘরে একটু বোসো, আমি আসছি।

—আচ্ছা।

-রাণি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘরে গিয়ে খাম ছিড়ে চিঠিখানা খুলে পড়ল। লেখিকা তার স্কুলের সময়কার অন্তরঙ্গ বন্ধু ললিতা। তার ছেলের অন্নপ্রাশন কাল। তাকে আর বিমলকে যেতেই হবে, নইলে ভয়ানক রাগ করবে। আরও নানা কথা।

রাণী হাসল, এই না সেদিন বিয়ে হল! হ্যাঁ, সেদিন বলেই তো মনে হচ্ছে, আর আজই ছেলের অন্নপ্রাশন!

আর লিখেছে, রাগ করবে। কুমারী জীবনে যখন ও ছাড়া আপনার বলতে আর কেউ ছিল না, তখন একথা শুনলে কী ভয়ই না পেত, কিন্তু আজ আর ভয় হয় না, চোখেও জল আসে না, বরং—

এই তো সেদিন বিয়ে হল। আর আজই ললিতা ছেলের চিন্তায় মশগুল। সমস্ত চিঠিতে কেবল তারই কথা। বরং এখন রাণির যেরকম অবস্থা—তার বুক কোথাও যেন ব্যথায় কনকনিয়ে উঠল, কোথাও যেন একটু রাগও সঞ্চিত হয়েছে।

সে থমকে দাঁড়াল, না আমি যাব না। একদিন যখন ভাব ছিল তখনই এসব।

আবদার খাটত, আজ আবার তার পুনরালোচনা কেন?

—রাণি, ওখানে দাঁড়ালে কেন? চিঠি কার? বিমল এসে দাঁড়াল।

–কারোর নয়। সে তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে একখন্ড কাগজে তার কিছুতেই যাওয়া হবে না, এই লিখে ভাঁজ করে ছেলেটিকে দিয়ে এল। সে সাইকেল নিয়ে চলে গেল।

বিমল কিছুই বুঝতে পারেনি, ব্যাপার দেখে আশ্চর্য হয়েছিল, জিজ্ঞেস করল, কী হল, ও কার চিঠি?

রাণী চিঠিটা হাতের মুঠো থেকে বিমলের কাছে ছুঁড়ে দিলে।

-আমি পরের চিঠি পড়ি না, তুমি যদি পার বলো।

—স্বামী যে কী মনে করে তার স্ত্রীর কাছে দেওয়া কারোর চিঠি পড়তে পারে , সে তো আমার জানা নেই।

সে তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে চলে গেল। বিমল স্তব্ধ। বিকেলবেলা মনটা হয়তো একটু হালকা হল। রাণি ভাবল, সে কি পাগল হয়েছে? কী করতে কী করে ফেলছে। একসময় এসব কথা মনে হলে যে হাসি পায়।

বিমল তখন যাইরে বেড়াতে বের হচ্ছিল, সে এসে বললে, চিঠিটা লিখেছে আমার বন্ধু ললিতা, সেই যে যার কথা তোমাকে অনেক বলেছি। ওর ছেলের অন্নপ্রাশন।

-ছেলে! বিমল সমস্ত ব্যাপারটা এক মুহূর্তে মনে করে নিল, তার দিকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকাল।

—হ্যাঁ, রাণি বললে, তা আমাদের যেতে বলেছে, অনেক অনুরোধ করে চিঠি লিখেছে। কিন্তু কে যায়? আমি যেতে পারব না লিখে দিয়েছি। তুমি কি বল?

বিমল বললে, আমি কী বলব? তবে, একজনের দুঃখ যে তোমার চেয়ে বেশি হবে, এটা বেশ বুঝতে পারি।

—আমার চেয়ে! রাণি অতিকষ্টে বলল।

—হ্যাঁ। আমি কিন্তু যেতেই বলি।

বিমল আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল।

পরের দিন ললিতা নিজেই এল। রাণি এতটা ভাবতে পারেনি। বড়োলোক, তাদের কতো আত্মীয়-স্বজন, জীবনের কতত প্রাচুর্য, সেসব চাকচিক্য ফেলে তার মতো নগণ্য একজন বান্ধবীকে নিজে নিয়ে যেতে আসবে, এটা কল্পনা করা যায় না।

ললিতা বললে, তুই তো জানিস, আমার এখানে কেউ নেই।

-কেউ নেই? আমি তো জানতুম অনেকে আছে।

-না, আত্মীয় বলতে কেউ নেই। বাবা তো কবেই এখান থেকে বদলি হয়ে গেছেন। কিন্তু রাণি তুই না লিখে দিলি কেন? হায়রে নিষ্ঠুর, ছোটোবেলার কথা আজ বেমালুম ভুলে গেছিস।

দুজনেই হেসে উঠল।

হাসি থামতে ললিতা বললে, তবে আমি যাই, এখনও অনেক কাজ ভাই, অনেক কাজ। ছেলেটাকে আবার ফেলে এসেছি। কী হল কে জানে! তোরা নিশ্চয় করে যাবি। নইলে দেখবি, আবার এসে উপস্থিত হয়েছি। আমার কি এখন আর মরবার সময় আছে? নানাদিকে নজর রাখতে হয়। যাই ভাই।

ললিতা একটা আলেয়ার মতো মিশে গেল। ইস, কী রূপ। একটা অগ্নিশিখার মতো দেখতে হয়েছে। আগে এত সুন্দরী ছিল না। ললিতা ছিল ছোটো, কিন্তু আজ যেন তাকেই বড়ো দেখা যায়।

যথাসময়ে রাণিরা ওদের বাড়ি গেল।

লোকজন সত্যি তেমন নেই। কিন্তু সেই কয়টিতেই সমস্ত বাড়িটা হাসি কোলাহলে মুখরিত করে রেখেছে। ছেলের জন্যে শোবার ঘরেই একটি দোলনা করে দেওয়া হয়েছে। নরম বিছানায় শোয়ানো। সুন্দর, ফুটফুটে, মার আদলই পেয়েছে বেশি। গলায় মালা, কপালে চন্দন, চোখে কাজল। ছোটো হাত-পাগুলো শূন্যের দিকে ছুঁড়ছে আর মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত শব্দ করছে। রাণি দোলনাটা একটু দুলিয়ে দিল।

ললিতা বলল, অনেক নাম মজুত হয়েছে। কিন্তু এখনও চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি। তুইও একটা বল, রানু–

-বলে কী হবে, আমার দেওয়া নাম তো আর রাখবিনে!

–পছন্দ হলে রাখব, বল তুই।

–আমি কী নাম রাখব! রাণি হেসে ফেললে, বললে, যা, রাখলুম চয়ন।

-বাঃ, বেশ নাম তো। তোর ভাই পছন্দ আছে। এই নামই রাখব। একটু দাঁড়া, আমি আসিগে, এই নামই রাখা হল।

ললিতার খুশি আর ধরে না। বিকেলবেলা রাণিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির সুমুখে বাগানের ধারে গিয়ে বসল।

রাণি বলল, আর কতক্ষণ থাকব বল, সেই কখন এসেছি।

ললিতা তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে, আজ বৈ তো নয়। আর তুই যদি এমন কথা বলিস, তবে কে আর বলবে না? রানু, টের পাচ্ছিস, দক্ষিণা বাতাস বইতে শুরু করেছে, আর ওই যে ঝাউ গাছ, দেখছিস তো?

রাণি কিছুদূরে একটা ঝাউগাছের দিকে স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, হুঁ দেখছি।

—ওগুলো দেখে কি মনে পড়ে?

–মনে পড়ে অনেককিছু। কিন্তু লতা, সে-সব কথা মনে করে কী লাভ?

—লাভ নেই, কি বলিস? আমার কী ইচ্ছে করছে জানিস? ললিতা রাণির মুখটি দুহাতে চেপে ধরে তার গালে একবার ঠোঁট দুটি স্পর্শ করে খিলখিল করে হেসে উঠল।

রাণি হাসল। কিন্তু ললিতার হাসি যেন তাকে বিধছে। ঝাউগাছের নীচে টুকরো ছায়া বাতাসে কাঁপছে। রাণি কাতরভাবে বললে, আজ আসি ভাই, সেই কখন এসেছি।

—না কিছুতেই যেতে পাবি না।

–আমাকে মাপ কর ভাই।

এ-কথায় যদিও ললিতা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল, কিন্তু তবুও তার কাছে রেহাই পাওয়া শক্ত।

রাত নটা অবধি কিছুতেই বাড়ি যেতে পারল না। বিদায় দেওয়ার সময় গেটের কাছে ললিতা এল, আর তার স্বামী এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু রাণি তার নিজের মুখে একটা বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত জানাতে পারল না।

বাসায় এসে বিমল বলল, চমৎকার লোক। কি বল?

ছোট্ট একটা হুঁ বলে রাণি কাপড় বদলাতে চলে গেল।

বিমলের একটা নতুন উপসর্গ জুটেছে। তাদের অফিসের তার এক ফেলো অফিসার এসেছেন এ-পাড়ায়। বুড়োমানুষ, রিটায়ার্ড হবার সময় হয়ে এসেছে। অত্যন্ত রসিক, আর ভয়ানক গল্প বলতে পারেন, এঁকে ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিমলের তাসের আড্ডা চলে, অনেক রাত অবধি, সময়কে চোখ রাঙিয়ে।

রোজ রাতে নীচের ঘরে আলো জ্বলে নিষ্কম্প। জানালা দিয়ে সে-আলো গিয়ে অনেক দূরে পড়ে। ভেতরে চারটি প্রাণী খেলায় রত। হঠাৎ একদিন রাণি ডাকল, বললো, তোমার খাওয়া-দাওয়া নেই?

-ওঃ, ভুলেই গেছলাম। তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব, না?

স্বামীর এই অপ্রতিভ ভাব দেখে রাণির একটু কষ্ট হয়, বলে, না, কষ্ট আর কি? আমার তো বেশ মজা! খালি ঘুমুই, আর জেগে থাকলে বই পড়ি।

কিন্তু ওঁরা কি গেছেন? আলোটা ধরে বিদেয় দিয়ে এসো, নইলে কে জানে কোথায় হোঁচট খেয়ে পড়বেন।

কথায় ইঙ্গিত ধরে বিমল লজ্জা পেল, নম্রভাবে বলল, না পথ তো খারাপ নয়। যে হোঁচট খেয়ে পড়বেন।

-এই রাতে তুমি হেঁটে দেখেছ?

শূন্যের বাতাস ভারী, আকাশ মেঘাবৃত, পৃথিবী প্রাণহীনতায় স্তব্ধ, শেষরাতে কুকুরের ডাক, নিশাচর মানুষের ক্লান্ত পদধ্বনি আর কঠিন শীত—আর পাষাণ শীতল দেহ।

রাণি কেবল বসে থাকে। বিষণ্ণ সন্ধ্যা, রাত্রি আসে চুপিচুপি, যায় নিঃশব্দে, সে তখন চমকে ওঠে।

বসন্তের হাওয়ার পরশ নেই!

রোজই রাত্রে বিমলকে ডেকে পাঠাতে হয়, নইলে তার হুঁশ হয় না, কিন্তু মাঝে-মাঝে ভুল হয়ে যায়। সেদিন হয়তো রাণি ঘুমিয়ে থাকল, আর রাত বারোটা-একটা অবধি তাস খেলে বিমল শোবার ঘরে সেই চেয়ারে বসেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিল। রাণিকে জাগাতে তার ভয় হয়।

আর পান্ডুর আলোয়, তার হাতে যে ধরানো সিগরেটটা থাকে তার সাদা ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরের দিকে ওঠে।

ল্যাম্পের আলোর রঙ যেন ধূসর, শীত যেন সহ্য করা যায় না। সমস্ত খাট জুড়ে ঘুমিয়ে আছে রাণি।

বিমলের বন্ধু অশোক; শিলং-এ থাকে, তার আসার কথা ছিল। সে চিঠি লিখেছিল। একদিন হঠাৎ এসে হাজির হল।

বিমল খুশি হয়ে বললে, এতদিন পরে যে? সেই কবে লিখেছো তো?

–সময় যে করে উঠতে পারিনে, কিন্তু আগে যদি জানতুম তোমার গৃহে আমার এমন বউদি আছেন তবে কি আর এত দেরি করি!

অশোকের কথাই এরকম, অথচ কেউ কাউকে দেখেনি। রাণির চমক লাগল।

অশোক বললে, আমি মনে করেছিলুম, ইস্কুলের সেই ফার্স্ট বয় বিমল আমাদের জন্যে আর এমন কী বউদি আনবে! ওঃ, এখনও বুঝি নমস্কারটা জানানো হয়নি? ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। নমস্কার বউদি।

নমস্কার। রাণি হেসে বললে।

চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে অশোক বললে, বাঃ, বেশ সাজানো গোছানো তো! বউদি, আপনারই হাতের গৌরব।

সে হাসতে লাগল।

অনেকদিন এ ধরনের কথা শোনা হয়নি, সে আজ পাঁচ-ছ-বছর হয়ে গেল, বিমল উৎফুল্ল হয়ে বললে, নাঃ, তুই এখনও সেই চন্ড অশোকই রয়েছিস, কবে মানুষ হবি বলত?

—মানুষ আর হব না, অশোক বললে, আর কেমন করেই বা হই বল? বিয়ে তো আর করিনি–

—যাক, বিমল বললে, একটু বিশ্রাম করো বন্ধু, আমি আসছি।

দুপুরবেলা। বিমল অফিসে।

অশোক কয়েকটা চিঠি লেখা শেষ করে রাণিকে খুঁজতে গেল। রাণি এখনও ভালো করে কথা বলেনি, কিন্তু সে আর এরকমভাবে থাকতে পারে না, তার অভ্যাস নয়।

অশোক দোতালার সিঁড়ির ওপর থেকে, নীচে গিয়ে, আবার উপরে এসে বউদি বলে ডাকল অনেক, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। তারপর শোবার ঘরের কাছে পর্দার বাইরে থেকে ডাকল, বউদি, ও বউদি! বারে আমি বুঝি একা-একা কাটাব এমনি করে?

রাণির মাথার নীচে একটা হাত রেখে শুয়েছিল, তন্দ্রাও একটু এসেছিল। হঠাৎ জেগে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে বললে, ওঃ, আপনি!

-আপনি ঘুমিয়েছিলেন আর আমি এদিকে ডেকে ডেকে হয়রান! অশোক বললে।

রাণি হেসে বললে, আমার তাহলে অন্যায় হয়েছে।

—কিছু নয়। আপনি আসুন। আহা, দাঁড়িয়ে রইলেন যে! তাড়াতাড়ি আসুন, দেখে যান একটা জিনিষ–

অশোকের যেখানে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে সেই ঘরে সে গেল, পেছনে রাণি, একটা কৌতূহল নিয়ে।

অশোক দেয়ালের গায়ে রাণি-বিমলের একসঙ্গে তোলা একখানা ফটোগ্রাফ দেখিয়ে বললে, এটা তো বিয়ের অল্পকাল পরেই তোলা, না?

রাণি অনেকদিন সেদিকে ভালো করে তাকায়নি, আজ দেখে মনে মনে শিউরে উঠল, ফটোটা যেন তাকে ব্যঙ্গ করছে, সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে কোনোরকমে বললে, হুঁ।

–তবে আমাকে এককপি পাঠাননি কেন?

–আমি কি জানতুম যে–রাণি জোর করে একটু হাসল।

অশোক এ প্রসঙ্গে আর অগ্রসর না হয়ে বললে, বারে, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন। রাণি হাসলো।

অশোক বললে, গল্প বলুন বউদি, গল্প বলুন।

-কী বলব?

-বাঃ, এই পঞ্চম বৎসরে কোনো কাহিনিই কি রচিত হয়নি? হা ভগবান? অশোক যেন সত্যি বড়ো হতাশ হল।

রাণি জোর করে হেসে বললে, সে কাহিনি কি সকলের কাছেই বলা যায়?

—নিশ্চয়ই নয়। সে কাহিনি শোনবার অধিকার কারোর নেই। আমার ভুল হয়েছে।

অশোক সরলভাবে হাসতে লাগল।

রাণির এখন লজ্জায় লাল হবার কথা, কিন্তু হল নীল। কিছু বলতে পারল না।

চুপ করে বসে থাকা অশোকের স্বভাব নয়, বললে, না, এরকমভাবে তো চলতে পারে না। বউদি, তাস আছে?

-আছে, কেন?

–দুহাত ব্রিজ খেলব, নিয়ে আসুন তো। রাণি হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার দেখল, মশারির ওপরে বিছানার তলায়, দেয়ালের সবখানে খুঁজে দেখল, কিন্তু পেল না। কি মজা, এর আগে সে নিজে আরও কয়েক জোড়া তাস ছিড়ে ফেলেছে রাগে, আজ তাকেই আবার নিজের প্রয়োজনে খুঁজতে হল।

সব জায়গাই দেখা হয়েছে, এবার আলমারির ওপরটা বাকি। কোমরে কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে, একটা চেয়ার আলমারির কাছে এনে, সে তার ওপর দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, হ্যাঁ, সত্যিই আছে একজোড়া নতুন তাস।

এত দেরী দেখে এমন সময়ে অশোক এসে ঘরে ঢুকল, তাকে এমন অবস্থায় দেখে হেসে উঠল, বললে, উদ্যোগ-পর্ব এখনও শেষ হয়নি নাকি?

আস্তে আস্তে নামতে নামতে রাণি হেসে বললে, হয়নি। এখন ভেবে দেখুন, এর পরের পর্বটা কীরকম হতে পারে!

রাণি আলমারির কাছে চেয়ারটা সরাতে যেতেই অশোক বললে, আপনি যান, শাফল করুন গে, আমি সব ঠিক করছি।

সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে বিমল রাণিকে অত্যন্ত খুশি দেখতে পেল। এই দেখে তার পাঁচ বছর আগেকার কথা মনে পড়ে গেল। সেই আলোকিত দিনগুলোর কথা আজ এখন একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তখনকার দিন আর রাত্রিগুলো যেন হাতের মুঠোর মধ্যে আনন্দে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে থাকত, আর বলরুমের পিছল মেঝেতে পা চালানোর মতো নিঃশব্দে গড়িয়ে যেত। কিন্তু আজ?

বিমল বললে, আজ কোনো সুখবর আছে নাকি! খুশি দেখছি যে বড়ো?

—আছে, রাণি হেসে বললে, অশোকবাবু আজ সর্দারী করে নিজের হাতে চা বানাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছেন।

—এটা কি সুখবর হল?

 —তা নয় তো কি? অত সর্দারী কেন? আমি কত বললাম—

–কই সে?

বিমল অশোকের ঘরে গিয়ে দেখল, সে একটা বই পড়ছে।

বললে, কীরে চন্ড, কোথায় দাহন হল?

-খুব বেশি নয়। অনামিকার এই অগ্রভাগ।

অশোক শান্ত ছেলে হয়ে শুদ্ধ বাংলার অবতারণা করে আঙ্গুলটিই দেখাল, বললে, আমার একটুও দোষ নেই। বউদির মতো এমন দুষ্টু আর দেখিনি

দুজনের মাঝে এইসব কথার পেছনে হাস্যমুখর দৃশ্যাভিনয়ের মতো কতকটা কল্পনা করে বিমলের চোখ দুটো করুণ হয়ে উঠল।

রাণি কাছেই ছিল, বললে, আবার বউদির নামে কী লাগানো হচ্ছে? দুদিনের চেনা দুদিন পরেই আবার চলে যাবেন, কেন অনর্থক একজন নিরীহ মানুষকে দোষ দেওয়া বাপু!

-ওঃ, সত্যি কথা বললেই বুঝি ভালো লাগে না?

অশোক মুচকি হাসল। বিমল চলে এল।

আবার সন্ধ্যার ছায়া। রাত্রি। জানালায় উজ্জ্বল আলো উঁকি মারে, পথের পাশে শ্রান্ত আলো; রাতের কুয়াশা, রুদ্ধ গৃহে গৃহে চুড়ির শব্দ, আর চাপা কথা, নিঃশ্বাস। আর বিমলের নীচের ঘরের চারটি প্রাণীর চোখে ঘুম নেই।

বিমলের এখন অফিসে যাওয়ার সময়। রাণি আজ তাকে বাইরের দরজা অবধি এগিয়ে দিলে। কিন্তু এ দেখে আর কারোর না হোক বিমলকে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হতে হবে। কিন্তু সে কিছু বললে না।

কিন্তু দুপুরের ঢিমে-তেতালা সময়ে যতই চেষ্টা করুক নিজেকে দরজা বন্ধ করে রাখতে; মনকে কোথায় যেন আকর্ষণ করছিল, যা কিছুতেই থামানো যায় না। পা এগিয়ে চলল। গন্তব্য স্থানেও পৌঁছল। অশোক বিস্ময়ে বললে, আপনি!

রাণির মাথাটি কতকটা নীচু হয়ে আসছে।

—কিন্তু দেখুন বউদি দোহাই আপনার, অমন আষাঢ়ে মেঘের মতো মুখ করে থাকবেন না, আমার ভয় করে, ভালো লাগে না।

রাণি অনেক কষ্টে মাথা তুলে একটু হাসল।

–বাঃ, আপনাকে আজ কী সুন্দর দেখাচ্ছে! অশোক বলেই ফেলল।

অতি আপনার জন ছাড়া আর এক পুরুষের সম্মুখে রূপ বর্ণনায় বোধহয় কেউ সপ্রতিভ থাকতে পারে না, রাণিও পারল না, অধোবদন হয়ে মাটির দিকে চেয়ে রইল।

একটু দুঃখ পেয়ে অশোক বললে, দেখুন বউদি, যদি আমার কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, ক্ষমা করবেন। বাপ মা বোন ভাই কেউ নেই, স্নেহের স্পর্শ কোনোকালে একদিন পেলেও আজ আর চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিনে। তাই ভুলচুক হওয়া স্বাভাবিক।

রাণির এতক্ষণে চমক ভাঙলো, ব্যস্ত হয়ে বললে, ওকি! কেন আপনি ওসব কথা বলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন। আমি তো কিছুই মনে করিনি।

–করেননি, তাহলে বসুন। অশোক এবার হাসল।

বসলে পরে বললে, আচ্ছা, এত একা আপনার কেমন করে সময় কাটে? সারাটি দুপুর–

—সে চিন্তা করে কী লাভ, কিছুই যখন হবার নয়। তবে বর্তমানে তো আর কোনো আপশোসের দরকার নেই।

-আজ নয় আমি আছি, অন্য দিন?

—সেদিন আছে ঘুম, নইলে বই!

—এসব তো আর চিরকাল ভালো লাগতে পারে না, একদিন নিশ্চয়ই বিরক্তি ধরে যাবে।

—অশোকবাবু, সেদিন আমি আত্মহত্যা করব। হয়েছে তো?

আর না পেরে এই বলে কান্না চেপে রাণি দৌড়ে পালাল।

অশোক শুধু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে, যে পথে রাণির পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল সেইদিকে চেয়ে রইল।

এরপরে, দুদিন আর দেখা হয়নি, কথাবার্তাও হয়নি, যদিও দেখা করবার অবসর দুজনেরই প্রচুর। সেদিনের কথা মনে করে রাণি যেন কিছুতেই আর নিজেকে অশোকের সামনে বার করতে পারছিল না। অবস্থা আবার আগের মতোই হয়েছে।

একবার সিঁড়ির পাশে দেখা হলে পর অশোক নিজেই জিজ্ঞেস করল, আপনার কি কোনো অসুখ করেছে বউদি?

-না তো।

–তবে দেখিনে কেন? অশোকের চোখের ওপর ম্লান ছায়া।

—আমিও তো আপনাকে দেখিনে।

অশোক কোনো দ্বিধা না করে বললে, কেন এমন হল বলতে পারেন?

–জানি না।

—আমি কিন্তু জানি।

–তবে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?

—আপনাকে ছাড়া আর কাকে করব? রাণি যেন সবে সহজ হয়ে দাঁড়ল। সেদিন দুপুরেই দেরাজ থেকে নতুন। একখানা টকটকে লাল সিল্কের শাড়ি পরে রাণি খুব ভালো করে প্রসাধন সেরে অশোকের ঘরে গেল।

লাল শাড়ি! যেন আগুনের মাঝে সীতা দেবী।

অত্যন্ত আনন্দে অশোক কেবল বললে, বউদি!

রাণি তার কাছে এসে একটু হেসে বললে, আপনার দেওয়া কাপড়, অশোকবাবু।

–নাকি? আমি তো ভুলেই গেছি। তাহলে আপনাকে কখনো না দেখেও একটা আন্দাজ করে নিয়েছিলাম সত্যি, নইলে আর এত ভালো মানিয়েছে কী করে?

রাণির মুখে মধুর লজ্জার রঙ ফুটে উঠল।

অশোক বললে, এটা এতদিন পরেননি কেন?

রাণীর মুখে উত্তর নেই, তার নিঃশ্বাস চেপে আসছে। শাড়ির পাতলা আঁচল বাতাসে উড়ছে।

আবার সেই রাত হল। বিমলের তাস খেলা তখনও পুরোদমে চলে। ভয়ানক শীত, চারদিকে সাদা কুয়াশা, নিস্তব্ধ শহর। সমস্ত শরীরে গরম কাপড় জড়িয়ে পথে কদাচিৎ মানুষের যাতায়াত, তাদের চকিত পদধ্বনি, আর রাত্রির নিঃশব্দ গতি।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে রাণি অগ্রসর হল।

অশোক এখনও ঘুমোয়নি। ভেজানো দরজা, একটু ফাঁকা রাণি চেয়ে দেখল, আলোর সামনে বসে অশোক কী ভাবছে।

তার পা দুটি অবশ, বুকে অসহ্য দাপাদাপি। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল। তার চারদিকে কেবল অন্ধকার।

কিছু আগেই শোবার ঘর, কিন্তু এতটুকু পথ হাঁটতেই সে যেন ক্লান্ত, দাঁড়াতে পারছে না। রাণির চোখ ফেটে জল এল।

তারপর, হঠাৎ একটু অন্যমনস্কতায় ওদিকে সরতে গিয়ে একটা কী যেন লাগলো পায়ে, হল প্রবল শব্দ। অশোক বললে, কে? আর রাণি ভয়ানক ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে একেবারে দরজায় খিল দিল। বুক দারুণ কাঁপছে, যেন কিছু চুরি করেছে আর কি!

রাত যখন একটা তখন বিমলের তাসের আসর ভেঙেছে। বন্ধুরা চলে গেলেন, নীচের ঘরের আলোও নিভল।

বিমল আস্তে ঘরে ঢুকে আগের মতো সেই চেয়ারে বসল।

টেবিলের উপর আলোটা আজ ভয়ানকভাবে জ্বলছে, সে আবার উঠে বাতিটা একটু কমিয়ে দিলে, তারপর স্থির হয়ে বসল।

আর একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব আরামে টানতে লাগল।

আজও জানালা খোলা, ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বিমল আর কী করে, উঠে জানালা বন্ধ করে আবার বসল। সিগারেটের অনেকখানি পুড়ে গেছে, ছাই কমেছে, আস্তে একটু ঝেড়ে ছাইগুলো ফেলে সে আবার খেতে লাগল।

দেয়ালে ঘড়ির টিক টিক শব্দ।

ঘরটি অন্যদিন বেশ পরিষ্কার থাকে, আজ একটু অগোছালো, আলনার কাপড়–জামায় শৃঙ্খলা নেই, মেঝেতে কাগজের টুকরো। টেবিলের ওপর দু-তিনটি বই ছড়ানো, খাটের নীচে রাণির দুটি স্লিপারের একটি ওই কোণে।

বিমলের সিগারেট শেষ। সেটা মেঝেতে পিযে আগুন নিভিয়ে সে বাইরে ফেলে দিলে। কী ভেবে একবার আলোটা বাড়িয়ে খাটের কাছে এল। রাণি ঘুমিয়ে রয়েছে। মুখে দেহে যেন অনেকদিন পরে সাজগোজের ছাপ। চুলগুলো ভালো করে বাঁধা, ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেলকালার, মুখটা চকচক করছে, কানে নতুন পরা একজোড়া দুল, গলায়ও নতুন হার, হাতে অনেকগুলো চুড়ি।

বিমল আবার চেয়ারে গিয়ে বসল।

রাণির নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যায়।

ঘড়িতে টিক টিক শব্দ।

হঠাৎ কান্নার শব্দে বিমল চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, রাণি ঘুমের ঘোরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

সে তাড়াতাড়ি তার কাছে গেল,-রাণি, রাণি, ওকি? ওঠো। কাঁদছো কেন? ওঠো।

কয়েক ডাকেই সে উঠল। ঘুমজড়িত চোখে বলল, কী হয়েছে?

তুমি কাঁদছো?

রাণির হয়তো কিছু মনে হল, তাই যেন খুব ভীত হয়ে আবার বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে রইল।

বিমল আর একটি কথাও বললে না, নিঃশব্দে নিজের জায়গায় ফিরে এল। ঘরের কোণে, আর নানা জিনিষপত্রের পেছনে ছোটো ছোটো অন্ধকার, টেবিলের উপর সবখানে পৌঁছোতে পারেনি। পেরেছে দেয়াল আর মেঝেতে, খাটে শায়িত রাণির গায়ে…।

বিমল এই আলোর সঙ্গে সমদৃষ্টিতে চেয়ে সবই দেখেছে, কিছুই তার চোখ এড়ায়নি, কিন্তু মাঝে মাঝে কী যেন হয়, তার চোখের পাতা ভিজে ওঠে, দেহ অবশ হয়ে আসে।

কপালের কুঞ্চন হয়তো বা কিছুক্ষণের জন্যে সরল হয়ে যায়। আলোর কাছে তারই নিকটতম অবস্থিতি; তাই মুখের কোনোখানে এতটুকু ছায়াপাত হয়নি, সব পরিষ্কার দেখা যায়। অথচ কিছুই বলতে পারে না।

রাত বেড়ে চলেছে।

পরদিন অফিসে যাবার ইচ্ছে বা সামর্থ্য কিছুই ছিল না। তবু বিমল গেল এই ভেবে যে বাসায় থাকলে সামর্থ্যহীনতা আরও বাড়বে। কারোর দেখা পাওয়া গেল না। কিন্তু সামান্য কাজ করেই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

রাণির ঘরের দরজা বন্ধ। বিমল সেখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে, অশোকের ঘরে এসে দেখল, সেখানে কেউ নেই। নীচে নেমে চাকরকে জিজ্ঞেস করলো, সে বললো, অশোকবাবু চলে গেছে, এই একটু আগে।

-মালপত্র নিয়ে?

–হ্যাঁ বাবু।

—কিন্তু আমাকে জানায়নি তো।

বিমল ব্যাকুল হয়ে ওপরে এল, রাণির বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়াল।

এই কি বন্ধুত্ব? যাবার সময় আমাকে একবার জানানোও দরকার বোধ করলে না?

জোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে বিমল ডাকলো, রাণি, দরজা খোল।

দরজা খুলল। রাণির মুখ নীচু।

বিমল তার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, অশোক কি চলে গেছে? কেন গেল? তুমিই বা ওকে বিদেয় দিলে কেন? কেন দিলে?

হঠাৎ রেগে গেল রাণি, বললে, কী বলছো তুমি? ইচ্ছে হয় মেরে ফেলল, তবু ওসব কথা বোলো না।

-বলব না? আমাকে সে না বলে কয়ে চলে গেল কেন? আমি একটা মানুষ নই? বিমল একটু নরম হয়ে বললে, কিন্তু তুমি অত রাগলে কেন? কাল সারারাত জেগে রয়েছি, মেজাজের কি ঠিক আছে? কী বলতে কী বলে ফেলি নিজেই বুঝে উঠতে পারিনে।

বিমল চলে এল নীচের ঘরে। চুপ করে বসে রইল।

এমনি কতক্ষণ কাটবার পর হঠাৎ বাইরে জুতোর আওয়াজ পেয়ে চমকে সে মুখ তুলে দেখল, অশোক আবার আসছে।

সে ভয়ানক খুশি হয়ে বললে, আমার ওপর রাগ কেন বলো তো বন্ধু? আমাকে বলা নেই, কওয়া নেই—সে যাক—কী হল, গাড়ি ফেল করলে?

-হ্যাঁ।

–বেশ হয়েছে। ওপরে চল।

সমস্ত বাড়িটির মধ্যে একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত নেই। যেন কেউ মরেছে।

সন্ধ্যা হতে বেশি বাকি নেই, আকাশের পশ্চিমদিক লাল, কতকগুলি চিল এখনও উড়ছে আকাশে।

বিমল অনেকক্ষণ বেরিয়েছে, এখনও ফিরে আসেনি।

রাণি তার ঘরে বসে এমনি একটা বই-এর পাতা ওলটাচ্ছিলো। কিছুতেই মন বসে না, আর ক্ষণেক পরেই চোখ ছলছলিয়ে আসে।

হঠাৎ একটা ভাঁজ-করা কাগজ বেরিয়ে পড়ল বই থেকে। রাণি খুলে দেখলো, তাতে লেখা : তোমার জীবনের পথ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালাম। অনেকদিন ধরেই একথাটা ভাবছি, কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারিনি। আজ সুযোগ হল তাই করলাম। যেহেতু আমি জানি, সন্তান না হবার জন্য দায়ী আমি, আমারই দোষ, আমিই অনুপযুক্ত। নিজের জন্যে আমার এতটুকু দুঃখ নেই, কিন্তু দুঃখ হয় তোমার জন্যে। স্বামী হতে না পারলেও ভালোবেসেছিলাম সত্যি।

—তোমার আর অশোকের দীর্ঘ মাধুর্যময় জীবন কামনা করি। এ চিঠিখানা রেখে দিও, তোমার দরকার হতে পারে।

অকস্মাৎ একটা অপ্রত্যাশিত আঘাতে দারুণ চমকে উঠল রাণি। তারপর সে দু হাতে নিজের মুখ ঢাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *