বিসর্জন

বিসর্জন

এমন যদি হত, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত ঘরের এক কোনায়; যা সকলের জোটে তাই একমুঠো খেয়ে চুপচাপ দিন কাটিয়ে দিত, তা হলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই লালচ বাড়ছে বুড়ির। এখন যেন রাক্ষসের খিদে এসে পেটে জমা হয়েছে ওর। একরাশ গিলল, ঝিম মেরে বসে রইল কিছুক্ষণ, তারপরেই আবার ভাঙা গলায় চ্যাঁচাতে লাগল, ওরে, আমায় খেতে দে রে, খিদেয় যে আমি মরে গেলুম।

তা-ও যদি পেটে রাখতে পারত।

ছেলেবেলায় একবার শখ করে একটা কোকিলের ছানা ধরে এনেছিল সুদাম। মনে মনে ভারি সাধ ছিল, ছানাটা বড়ো হবে, তারপর রাত-দিন কুহু-কুহু করে গান গেয়ে প্রাণ একেবারে মাতোয়ারা করে দেবে। হয়তো দিতও, কিন্তু বড়ো হওয়ার আগেই সে সুদামকে প্রায় পাগল করে দিলে। বাচ্চাটার খাঁই আর মেটে না। সব সময়ে ক্যাঁ-ক্যাঁ করে চিৎকার আর লাল টুকটুকে একটা হাঁ সে মেলেই রয়েছে। ছাতুর গুলি, ময়দার পিন্ডি সেই হাঁ-এর ভেতরে ছেড়ে দিতেই টপ করে গিলে ফেলা, তারপরেই আবার কান-ফাটানো চ্যাঁচানি। যেন বিশ্বসংসার গিলে ফেলেও তার খাঁই মিটবে না।

ঠিক একরকম। বুড়িটার সঙ্গে কোকিলের ছানার কোনো তফাত নেই।

মেঘের আড়াল থেকে এক টুকরো ভাঙা আর জবুথবু চাঁদ উঠবে উঠবে করছে, কিন্তু এখনও মুখ বার করতে পারছে না। মনমেজাজ ভালো থাকলে সুদাম বেশ রস দিয়ে বলতে পারত— ঘোমটার আড়াল থেকে নতুন বউ এক বার দেখে নিতে চাইছে। কিন্তু সামনে থেকে খাণ্ডার শাশুড়িটে আর নড়ে না। কিন্তু এখন আর রসিকতা করবার অবস্থা নয় তার। অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে সুদামের মনে হল আরও কিছুক্ষণ চারদিক এইরকম থমথমে অন্ধকারে তলিয়ে থাকুক, সারা আকাশটা মেঘে ঢেকে যাক। এই ডিঙিটাকে পৃথিবীর কেউ যেন এখন দেখতে না পায়, কেউ না।

ক্যানালের গেরিমাটি জল এই অন্ধকারে মেঠো শামুকের মতো রং ধরেছে। দু-ধারের ঝোপজঙ্গলে চাপবাঁধা অন্ধকারে ঝিকমিক করছে জোনাকি, এক-আধটা খড়ের ছাউনি কিংবা টিনের চালা ছায়া ছায়া হয়ে দেখা দিয়েই হারিয়ে যাচ্ছে আবার। এরই ভেতরে কোথায় একটা ছোটো বাচ্চা ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কেঁদে উঠল। সুদাম মনে মনে বললে, কাঁদো কাঁদো, এখন থেকেই গলায় জোর করে নাও। কান্নার এখুনি হয়েছে কী? দিন তো সামনে পড়েই রয়েছে।

এক টুকরো আলোও কোথাও জ্বলছে না। কার দায় পড়েছে এই মাঝরাত্তিরে একটা লণ্ঠন জ্বেলে বসে থাকতে? কেরোসিন পেতে যা ঝঞ্ঝাট আর যা তার দাম! কেবল ঝিলমিল করে জোনাকি জ্বলছে। ওদের কোনো ভাবনা নেই, পয়সা দিয়ে ওদের কেরোসিন কিনতে হয় না।

সুদাম এক বার আড়চোখে চেয়ে দেখল বুড়ির দিকে। মাথাটা হাঁটুর ভেতরে গুঁজে একটা ময়লা তামাকের পুঁটলির মতো বসে রয়েছে। না, ঘুমুচ্ছে না। সুদাম জানে বুড়িটা কখনো ঘুমোয় না। রাত-দিন-সন্ধ্যা-সকাল সব এখন একাকার হয়ে গেছে। যখন জেগে থাকে তখন থাকে; যখন জেগে থাকে না, তখনও সম্পূর্ণ ঘুমোয় না। ঘুম আর জাগার মাঝামাঝি একটা অদ্ভুত জায়গায় তার মন নানারকম ছবি দেখে। তিরিশ বছর আগে যে মরে গেছে সে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। কোনকালে কোন সধবা স্বামী-পুত্রের সংসার রেখে চলে গিয়েছিল, তুলসীতলায় নামানো তার আলতা-রাঙানো পা দুখানা দেখতে পায় বুড়ি। কে যেন তাকে ডাক দিয়ে বলে, বাড়িতে দশসেরি রুই মাছ এয়েছে গো, ও নতুন বউ, কুটতে যাবে না? আর এইসব ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নের ভেতর তার খিদে পায়, যন্ত্রণায় তার পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যেতে থাকে, ঘোর ভেঙে গিয়ে বুড়ি হঠাৎ বিকট গলায় গোঁ-গোঁ করে ওঠে; এবাড়িতে সব মরে-হেজে শেষ হয়ে গেল নাকি গো? আমাকে কেউ চাট্টিখানি খেতেও দেবে না?

রাগে ঝনঝন করে ওঠে সুদামের বউ তুলসী।

এবাড়ির সব মরে শেষ না হয়ে গেলে তোমার খাঁই মিটবে কী করে? তুমি যে যমের খিদে নিয়ে এসেছ। নিজে তো আর মরবে না, তিন যুগের ভূশন্ডি কাগ হয়ে বসে রয়েছ।

না, বুড়ি যে মরবে না এ ব্যাপারে সুদামও নিঃসন্দেহ হয়েছে। তারও তো একদিন ঘরসংসার সব ছিল; স্বামী, ছেলে-মেয়ে সব। কী করে যে মরে-হেজে একাকার হয়ে গেল, সুদাম তার খবর রাখে না। তার ছেলেবেলা থেকেই বুড়িকে এবাড়িতে সে দেখছে। সম্পর্কে তার মায়ের কীরকম যেন মাসি হয়, অনাথা দেখে তার মা এনে এখানে ঠাঁই দিয়েছিল। তখনই বুড়ির চুলে পাকধরা। তবু খাটাখাটনি করত, ধান সেদ্ধ করত, গোরু দেখত। তারপর সুদাম বড়ো হল, বিয়ে-থা করল, মা-বাপ চলে গেল। কিন্তু বুড়ি সেই যে ঠায় যক্ষী বুড়ির মতো বসে রয়েছে তার আর নড়বার নামটিও নেই। এবাড়ির ওপর দিয়ে এত বার যমের আনাগোনা ঘটে গেল, কিন্তু এর দিকে চেয়েও দেখল না একটি বার।

এখন না পারে চলতে-ফিরতে, না পারে উঠে দাঁড়াতে। বছর দুই আগেও পিঠটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে একটা লাঠি নিয়ে এক-আধটু ঘুরে বেড়াত। এখন তা-ও পারে না। কখনো পিন্ডি পাকিয়ে বসে থাকে, কখনো কুকুরের মতো কুন্ডলী করে ঘুমোয়। না, ঘুমোয় না। ঘুম আর জাগার মাঝখানে একটা অদ্ভুতজগতে একরাশ ছায়ার মিছিল দেখে আর থেকে থেকে চমকে ওঠে— কে— কে ওখানে? আজ কি তোরা আমাকে একমুঠো খেতেও দিবিনে? অথচ একটু আগেই—হয়তো আধ ঘণ্টা আগেই তুলসী যে তাকে এক কাঁসি ভাত-তরকারি গিলিয়ে গেছে সে তার মনেও থাকে না।

শুধু তাই নয়। ভাঙা গলায় দাঁত-পড়ে-যাওয়া-মুখের জড়ানো আওয়াজে শাপমন্যিও দিতে থাকে, হে ভগবান! এদের এত আছে, তবু একমুঠো খেতে দেয় না আমাকে। তুমি এর বিচার কোরো।

জ্বলন্ত চোখে তুলসী বলে, শুনলে? শুনছ তো?

হুঁ।

তুমি আর কতটুকুন বাড়িতে থাক, রাতদিন ওই শাপশাপান্ত আমাকে শুনতে হয়। রাগে দুঃখে তুলসীর চোখে জল আসে, ছেলে-মেয়ের পেট মেরে সমানে খাওয়াই—এই তার প্রিতিদান।

সুদাম বলে, বুড়িটার গলা টিপে মেরে ফেলবে একদিন।

আঃ, কী-যে বক!

তবু সুদাম জানে, মুখে যা-ই বলুক, মনে মনে কোথায় তুলসীর একটা মায়া আছে বুড়ির জন্যে। মনটন ভালো থাকলে বলে, আহা—বলছে বলুক, ওর কি আর বোধভাষ্যি আছে। কোনো? এককালে তো বিস্তর করেছে তোমাদের। নতুন বউ হয়ে যখন তোমাদের বাড়িতে এলুম, রাতদিন কাঁদতুম মা-র জন্যে; তখন কত আদর করত আমায়, চোখের জল মুছিয়ে দিত, লুকিয়ে লুকিয়ে মিষ্টি এনে খাওয়াত। এখন অথর্ব হয়ে পড়েছে বলে…

সুদাম তাকিয়ে থাকে তুলসীর মুখের দিকে। মেয়েদের মন বোঝা ভগবানেরও সাধ্যি নয়। একটু আগেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছিল— হয় বুড়িটাকে যেখানে তোক বিদেয় করো, নইলে আমিই বিদেয় হই। এখন ঠিক উলটো সুর ভাঁজতে শুরু করেছে। বুড়িটাও নিশ্চয় তুলসীকে বোঝে। তাই মরতে মরতেও মরে না, রাতদিন কোকিলের ছানার মতো হাঁ করে থাকে, ভাবে দুনিয়ায় যা-কিছু খাওয়ার আছে এই বেলা তা পেটপুরে খেয়ে নিই।

না, সুদামের কোনো মায়া নেই বুড়ির জন্যে। এক বিন্দুও না। কবে বুড়ি তাকে আদর করে দু-চারটে নাড়-মোয়া খাইয়েছে কিংবা কোলে বসিয়ে রূপকথা শুনিয়েছে, সেকথা ভেবে সুদামের মন মমতায় ভরে ওঠে না। এই সংসারে থেকেছ, যেটুকু করবার করেছ। তারপর মানে মানে, সময় থাকতে যদি চলে যেতে হলে সুদাম ডাক-চিৎকার ছেড়ে কাঁদত তোমার জন্যে, কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে যেত, এমনকী শ্রাদ্ধশান্তি করতেও তার আপত্তি হত না।

কিন্তু এ কী ব্যাপার?

বাপ-ঠাকুরদার আমলে যা ছিল, ছিল। কিন্তু সেসব দিন তো আর নেই। অবস্থা পড়ে গেছে। সামান্য যা জমিজমা আছে, তাতে ছ-মাসের খোরাকির টানও উঠে আসে না। তরিতরকারি বেচে, কখনো-বা আরও দু-চারটে খুটখাট কাজকর্ম করে কোনোমতে চালিয়ে দিতে হয়। আষাঢ়-শ্রাবণের দুটো মাস একবেলার বেশি খাওয়াই হয় না। সামনে আরও আকাল আসছে, চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে সেটা। তিন টাকা ছাড়িয়ে উঠেছে চালের কিলো, আর কটা দিন বাদে গাঁয়ের আরও অনেক বাড়ির মতো তাকেও হয়তো মধ্যে মধ্যে উপোস দিতে হবে।

এর ভেতরে একটা বাড়তি পেট। কোনো আয় দেয় না—শুধু বাজে খরচ। দিন-রাত, সকাল-সন্ধে ঘোর ভাঙলেই মুখে কেবল খাই খাই রব। সুদামের মাথার ভেতরে আগুন ধরে যায়। একটা ধূমাবতী এসে ঘরে ঢুকেছে। কখনো কখনো তার মনে হয় বাড়িসুদ্ধ সব মরে গিয়ে যখন শ্মশান হয়ে যাবে, পোড়া ভিটের ওপর গজিয়ে উঠবে সাপের জঙ্গল, দাওয়ায় গর্ত করে শেয়ালে বাসা বাঁধবে, তখনও সেই শেয়াকুল কাঁটা আর ধুতরো-আকন্দ-বুনো ওলের মাঝখানে ডাকিনীর মতো জিভ মেলে বসে থাকবে বুড়িটা। তার পাটের মতো চুলগুলোতে লাউডগা সাপ খেলে বেড়াবে আর সন্ধ্যার লালচে আকাশের দিকে চেয়ে সে ডাক ছাড়তে থাকবে— দে দে, আরও খাই, আরও খাই।

ভাবতে গিয়ে রক্ত হিম হয়ে আসে। সুদামের মনে হয় সব বুড়িটার জন্যে। তারা তো মোটামুটি সচ্ছল গেরস্তই ছিল, কেন এমনভাবে একটু একটু করে সব যাচ্ছে? কেন দু-বছর আগে অমন দুধল রাঙা গাইটাকে মা মনসায় কেটে দিলে? ধানগুলোর অমন সর্বনাশ হয়ে গেল কেন? যে-মাটিতে প্রতিবার কম করে একশো কুমড়ো ফলে সেখানে এ বছর বিশ পঁচিশটার বেশি হলই না!

আশ্চর্য, বুড়িটা মরেই না! বয়েস কত হল? সত্তর-পঁচাত্তর-আশি? কিংবা আরও বেশি, সুদাম জানে না। তুলসীই ঠিক বলেছিল, ওটা ভূশন্ডি কাগ। ওদের বয়েসও নেই, মরণও নেই।

আজ তিন মাস ধরে এই মতলবটা তার মাথায় এসেছে। তুলসীটা এমনিতে বুড়ির ওপর যতই গর্জাক কিছুতেই এতে সায় দেবে না, বরং নিজের ভাত ক-টা নিয়ে গিয়ে বুড়ির মুখে গুঁজে দিয়ে আসবে। তাজ্জব মেয়েদের মন, ভগবানও বুঝতে পারেন না!

কিন্তু সুদামের ধৈর্য শেষ হয়ে গেছে। আর চলে না, চলতেই পারে না।

সুযোগ এসেছে তিন মাস পরে। কাল ছেলে-মেয়ে নিয়ে তুলসী গেছে বোনের বাড়িতে, ফিরতে আগামীকাল সন্ধে। অতএব এই বেলাই…

বুড়ির তত দিনও নেই রাতও নেই। চোখে কিছু দেখতে পায় না, কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে না উঠলে শুনতেও পায় না। তাই সুদাম যখন তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলে, তখন বুড়ি বিড়বিড় করে বললে, কে ও? জগৎ নাকি?

মা কালীই জানেন জগৎ মানুষটা কে! কোন কালে কোথায় বেঁচে ছিল, কবে মরে শেষ হয়ে গেছে। হয়তো বুড়ি এখন সেই লোকটাকে দেখছিল বসে বসে। না চেঁচিয়ে, বুড়ির কানের কাছে ঝাঁঝাঁ করে চাপাস্বরে সুদাম বললে, আমি সুদাম।

অ, সুদাম।

বুড়িকে তুলে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে সুদাম এগোতে লাগল। একেবারে ওজন নেই গায়ে, পাখির মতো হালকা। জটাবাঁধা চুলগুলো সুদামের মুখে লাগছিল, একটা বিশ্রী দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে যাচ্ছিল। নাকের পাশ দিয়ে পিপির করে কী উঠে যাচ্ছিল—নিশ্চয় বুড়ির চুল থেকে উকুন। অসম্ভব ঘেন্না করতে লাগল সুদামের। আশ্চর্য, এটাকে তুলসী নাওয়ায়-ধোয়ায় খাওয়ায় কী করে! মেয়েরা সব পারে, ওদের অসাধ্যি বলে কিছু নেই।

বুড়ি বিড়বিড় করে বললে, আমাকে কোথায় নিয়ে চললি সুদাম?

তুমি যে শিমুলতলির মন্দিরে যেতে চেয়েছিলে গো। তাই নিয়ে যাচ্ছি।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস বললি?

শিমুলতলির মন্দিরে।

আ–হা! বেঁচে থাক, বেঁচে থাক। বুড়ির জড়ানো অস্পষ্ট আওয়াজ যেন খুশিতে দুলে উঠল এক বার, আ–হা! কতদিন মাকে দশশন করিনি।

এখনই যেন কত দর্শন করতে পারবে! চোখের মাথা তো খুইয়ে রেখেছে। কথাটা মুখে এলেও সুদাম বলল না। বরং তার মনে হল, দর্শনের ব্যবস্থাটা পাকাঁপাকিই করে দিচ্ছি। এবার। আমার ঘাড় থেকে নেমে সেখানে গিয়েই বাস্তু বাঁধে এখন।

মেঘে আধখানা আকাশ ঢাকা, চাঁদের ভাঙা টুকরোটা তাই ভেতর থেকে ফুটতে পারছিল। সারা গ্রাম মাঝরাতেই ঘুমে নিথর। একটু হাওয়া নেই, একটা পাতা নড়ছে না, একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকছে না কোথাও। মেঠো শামুকের মতো রং নিয়ে ক্যানালের গেরিমাটি জল ভাটার টানে নদীর দিকে ছুটেছে। বুড়িকে নৌকোয় তুলে সুদাম স্রোতে ভেসে পড়ল।

সেই থেকে বুড়ি নিশ্ৰুপ। যেখানে বসিয়েছিল, সেইখানেই হাঁটুর ভেতরে মাথা গুঁজে একটা তামাকের ময়লা পুঁটলির মতো পড়ে আছে। আবার স্বপ্ন দেখছে হয়তো। অনেককাল আগেকার মরে-যাওয়া মানুষগুলো এখন একে একে সার দিয়ে তার মনের সামনে দিয়ে সরে যাচ্ছে। একটু পরেই হয়তো চেঁচিয়ে উঠবে, কে যায়, কে যায় ওখান দিয়ে? আজ কি তোরা আমাকে একমুঠো খেতে দিবিনে?

চাঁদটা উঠতে চেষ্টা করছে, উঠতে পারছে না। আশেপাশে, দূরে, অনেক দূরে একটা আলোও জ্বলছে না। কার দায় পড়েছে আলো জ্বালবার, কেরোসিন তেল কি এতই সস্তা? জোনাকি ঝিলমিল করছে ঝোপজঙ্গলে, কিন্তু জোনাকির আলোয় কেউ কিছু দেখতে পায় না, জোনাকিরা কারও সাক্ষী থাকে না। এই ভালো, আজ এই অন্ধকারটাই সুদামের দরকার।

নৌকো নদীতে এসে পড়ল। ভাটার ডাক উঠেছে জলে। এতক্ষণ গুমোট ছিল, এবারে হঠাৎ খানিকটা হাওয়া যেন হা-হা করে উঠল। ডিঙিটা দুলতে লাগল অল্প অল্প, ফিকে সাদাটে জল চিকচিক করতে লাগল।

সুদাম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলে চারদিক। না, কোথাও কেউ নেই। দু-মাইল দূরে বাঁকের মুখে গঞ্জে এক-আধটা আলোর বিন্দু দেখা যায় কি যায় না। এদিকে অন্ধকারে সাদাটে রঙের প্রকান্ড নদীটা ধু-ধু করছে, বাতাসে হা-হা করছে। আজ রাতে সুদামের এইটেই দরকার ছিল।

মনে মনে সে হিসেব করেই রেখেছে। চার-পাঁচ ঘণ্টা ভাটা আছে এখনও। একটা চরায় পৌছুতে কতক্ষণই-বা। বুড়িকে তার ওপর নামিয়ে দিয়ে নিঃসাড়ে ফিরে আসা। তারপরে জোয়ার আসবে। তারও পরে…

বইঠা টানতে টানতে সুদাম যেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে চাইল–কাজটা অন্যায়? কিন্তু কেন অন্যায়? মরবার সময় হলেও যে মরে না, সম্পূর্ণ অকারণে যে জ্যান্ত মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খায়, এ ছাড়া আর কী করা যেতে পারে তার জন্যে? সুদাম জানে, সরকারি চাকরিরও একটা মেয়াদ আছে; সময় হলেই তোমাকে ছাড়িয়ে দেবে—সে তুমি হাকিমই হও আর পেয়াদাই হও। তেমনি বেঁচে থাকারও একটা সীমা থাকা দরকার, তারপরে তুমি আর কেউ নও, কোথাও তোমার আর দরকার নেই।

সুদাম, সুদাম।

সুদাম চমকে উঠল। প্রথমটা শুনতে পায়নি, কিন্তু শব্দটা এত অস্বাভাবিক, নদীর একটানা কলধ্বনির ভেতরে এমনই বেসুরো যে হঠাৎ যেন ওটা তার কানে গিয়ে ঘা মারল, হাত কেঁপে উঠল তার।

বুড়ি তাকে ডাকছিল।

ডাকছিল তার কাছ থেকে দু-হাত দূরে বসেই। অথচ সুদামের মনে হল যেন আধ মাইলের ওপার থেকে ডাকটা তার কানে আসছে।

সুদাম বললে, হ্যাঁ গা, বলছ কিছু?

আমরা কোথায় যাচ্ছি? হ্যাঁ রে সুদাম?

বললুম-না, শিমুলতলির মন্দিরে?

ঠিক, শিমুলতলির মন্দিরে? বুড়ি বিড়বিড় করতে লাগল— কতদিন মাকে দশশন করিনি। কিন্তু… আচ্ছা সুদাম!

আবার কী হল?

বড়ো গাঙের মতো আওয়াজ পাই যেন! গায়ে ঠাণ্ডা লাগে যেন! ও সুদাম!

কী বাজে বকছ? সুদাম বিরক্ত হয়, একটু চুপ করে বসে থাকো দিকিনি।

বুড়ি চুপ করে। হাঁটুর ভেতর মাথাটা গুঁজে দিয়ে আবার তলিয়ে যায় সেই না-জাগার স্বপ্নের ভেতরে। সুদাম আস্তে আস্তে দাঁড় বাইতে বাইতে সেই স্বপ্নগুলোর কথা ভাবতে চেষ্টা করে। কারা বেঁচে ছিল অনেক দিন আগে, এখন আর নেই, কিন্তু বুড়ির মনের সামনে তারা এখনও আসে-যায়। কেউ এই মাত্তর ধান কেটে ফিরল মাঠ থেকে, কেউ কলমি শাক তুলছে একটা পুরোনো পুকুর থেকে, নতুন জলে-ভরা বর্ষার নদীতে কারা যেন নাইতে এসেছে দুপুর বেলা, নাকে নোলক আর ধানি রঙের শাড়ি পরে একটি নতুন বউ এসেছে তাদের সঙ্গে–বুড়িই হয়তো। কে যেন নতুন বউটার হাতে রাঙা রাঙা কাচের চুড়ি পরিয়ে দিতে দিতে বলছে, হাট থেকে অনেক খুঁজে নিয়ে এলুম তোর জন্যে, এমন হাতে এ চুড়ি না হলে কি মানায়?

সুদামের হঠাৎ হাসি পায়। দুত্তোর, তাকেও তো আচ্ছা পাগলামিতে ধরল। বুড়ির মতো সেও কি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।

যে-হাওয়াটা উঠে এসেছিল, আবার থেমে গেছে সেটা। নদীতে ঢেউ আছে কি নেই, শুধু ভাটার জলের কলকল ডাক শোনা যায়। চোখে পড়ে—অনেক দূরে উত্তরের আকাশটা এক এক বার লালচে হয়ে উঠেই আবার ঢেকে যাচ্ছে কালচে ছাইয়ের রঙে। ইস, এই রাত্তিরে আবার কার সুখের ঘরে আগুন লাগল হে!

সুদাম! বুড়িটা নড়ে উঠল।

কী হল তোমার?

আমার শীত করে।

শীত কোথায় এখন এই চত্তির মাসের রাত্তিরে? তোমার যত বাজে কথা।

আমার শীত করে সুদাম।

ভালো জ্বালা। সুদাম বিরক্ত হল। বোঠে ছেড়ে দিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ল বুড়ির দিকে, গিটবাঁধা ছেঁড়া আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে দিলে তার গায়ে। কিন্তু জড়াতে গিয়ে কী করে ফেঁসে গেল অনেকখানি। বুড়ির কাপড়টায় আর পদার্থ নেই, পচে গলে শেষ হয়ে গেছে একেবারে। কতদিন যে বুড়িকে কাপড় কিনে দেয়নি সুদাম, তা মনে করতে পারল না।

সুদাম, আমার শীত যায় না।

বুড়িকে নদীর চড়ায় নামিয়ে দিতে চলেছে বলে নয়, কতদিনকতকাল তাকে একখানা কাপড় কিনে দেয়নি। হঠাৎ সেই কথাটা মনে হওয়ায় সুদামের নিজেকে কেমন অপরাধী বলে বোধ হয়। হতে পারে কাপড়ের অনেক দাম, কিন্তু…

সুদাম, ভারি শীত লাগে আমার।

অপরাধবোধটা তীব্র বিরক্তির ভেতরে বাঁক ঘুরল। তোমার শীত কোনোদিন আর যাবেও। মনে মনে দাঁত খিচোয় সুদাম। কোমরে বাঁধা বড়ো নতুন গামছাটা খুলে বুড়ির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললে, নাও-হল এবার?

হল কি না কে জানে, বুড়ি চুপ করল। আবার সেই হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে চুপ করে বসে থাকা। সুদাম বিড়ি ধরাল একটা। দেশলাইয়ের একটুখানি আলোতে হঠাৎ কেমন একটা চমক লাগল তার। লাল গামছায়-জড়ানো বুড়িটাকে এক বারের জন্যে লাল শাড়িপরা ভারি ছেলেমানুষ একটা বউয়ের মতো মনে হল। সুদামের মা বলত, বয়েসকালে নাকি বুড়ির চেহারা খুব সুন্দর ছিল।

সে কতকাল আগে কে জানে! সুদাম অবশ্য সেরকম কোনো চেহারা দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। ছেলেবেলা থেকেই দেখছে পাকধরা চুল, শুকনো মুখ, রোগা রোগা হাত পা নিয়ে হয় ধানসিদ্ধ করছে, নইলে গোরুর জন্যে জাবনা কাটছে; আর নয়তে দাওয়ায় মাটি লেপছে। অল্প বয়সে লালশাড়ি পরলে তাকে কেমন লাগত সে আছে বুড়ির স্বপ্নের ভেতর, সুদাম তা দেখতে পাচ্ছে না।

অ সুদাম!

আবার কী?

বউয়ের গলা শুনিনে কেন? সে কোথায়?

সুদাম ঝপাং করে জলে বোঠে ফেলল।

কেন? তাকে কী দরকার আবার?

বাড়ি যে নিঝুম মেরে রয়েছে। সে গেল কোথায়?

কী জ্বালা! তোমাকে যে শিমুলতলির মন্দিরে নিয়ে চলেছি। নৌকো করে যাচ্ছি যে। বউ তো সঙ্গে আসেনি।

বুড়ি মাথা তুলল। মাথাটা নড়তে লাগল থরথর করে। বেশ জেগে উঠেছে এখন। বউ কেন এল না সুদাম?

তার ঘরসংসার আছে-না? সব ফেলে সে কি বেরুতে পারে সবসময়?

মিথ্যেকথার জের টানতে সুদামের খারাপ লাগছিল, তোমার অনেক দিনের শখ, তাই নিয়ে এলুম।

তবু নিয়ে আসতে হত। যেন পলকা একটা সুতোয় বাঁধা রয়েছে এইভাবে বুড়ির মাথাটা নড়নড় করতে লাগল। বউমানুষ মায়ের পুজো দিলে সোয়ামি-পুত্তুরের মঙ্গল হয়।

আর মঙ্গলে দরকার নেই, বেশ হয়েছে। সুদাম আস্তে আস্তে বললে। বুড়ি শুনতে পেল।

নৌকোটা প্রায় নিঃশব্দে ছুটছে ভাটার টানে। সুদাম চোখ ছড়িয়ে দিলে অন্ধকার-ছড়ানো ধু-ধু নদীটার সাদাটে জলের ওপর। ভালো করে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু সুদামের সব চেনা, পুরো আন্দাজ আছে তার। আর বেশি দেরি নেই, যে-চরাটার কথা ভেবেছে সেটা প্রায় এসে পড়ল বলে।

বিড়িতে একটা শেষ টান দিতে গিয়ে গলায় লাগল। খক খক করে কাশি এল খানিকটা। বুড়ির বোধ হয় আবার ঝিম আসছিল, জেগে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।

অ সুদাম! বাঁ-হাতের তেলোয় মুখটা মুছে ফেলে সুদাম বললে, কী বলছ আবার?

তোর ভারি কাশি হয়েছে না?

না, কিছু হয়নি।

হয়েছে বই কী, কাশছিস বলে মনে হল যে! চোখে তো দেখতে পাইনে দাদা, একটু কাছে সরে আয় দিকি, তোর বুকে একটু হাত বুলিয়ে দিই।

দরকার নেই, আমি বেশ আছি। সুদামের খুব খারাপ লাগল। বুড়িটা বুঝতে পেরেছে? তাই কি মায়া বাড়াতে চায়?

বুড়ি একটু চুপ করে রইল। তারপর ভাঙা গলায় বললে, তুই জানিস?

কী জানব আবার?

ঠিক কথা, তুই কী করে জানবি! তুই তখনও হসইনি। তোর বাপের বুকে সে-বার সর্দি বসে খুব কাশি হয়েছিল। আমাকে বলত, মাসি, তুমি আমার বুকে একটু হাত বুলিয়ে দাও, তা হলেই আমার সব কষ্ট চলে যাবে। বলতে বলতে গলা জড়িয়ে গেল, খেই হারিয়ে গেল কথার, অনেকগুলো ছায়ার মিছিল এল চোখের সামনে। কী বিষ্টি—কী বিষ্টি সে-বার! দশ দিন ধরে একনাগাড়ে চলেছে, থামেই না। মাঠ-ঘাট-পুকুর সব ভেসে গিয়েছিল। উঠোনে উঠে এসেছিল কী বড়ো বড়ো সব কই মাছ। তোর বাবা ধরছিল, পেরানকেষ্ট একটা মস্ত বোয়াল গেঁথে তুলেছিল। ঘরের দাওয়ায় এক জোড়া চন্দ্রবোড়া সাপ…

বুড়ির কথাগুলো আবছা হতে হতে স্বপ্নের ভেতর মিশে গেল। শুনতে শুনতে এক বারের জন্য অন্যমনস্ক হল সুদাম। সেও হয়তো এমনি করে বুড়ো হয়ে অনেক অনেক দিন যতদিন তার বেঁচে থাকা ভালো, তারও চেয়ে ঢের বেশিদিন এই বুড়িটার মতো বেঁচে থাকবে। সেদিন তারও চোখ এমনি করে বাইরের জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়ে ভেতরে তলিয়ে যেতে থাকবে। এমনিভাবেই আজকের চেনা মানুষ, চেনা দিনগুলো ছাড়া ছাড়া ছবি ছবি হয়ে, আর…

আর সেদিনও কি তার ছেলে কিংবা তার নাতি মাঝরাতে তাকে এমনি করে নৌকোয় তুলে নিয়ে… দুত্তোর।

কী আজেবাজে ভাবনা হে! না, এমন করে বেঁচে থাকা তাদের বংশে নেই। তার বাপ মরেছিল ষাটের ঘরে, তখনও ভারি জোয়ান ছিল সে, জ্বরে পড়বার দিনও সে সারাটা সকাল মাঠে লাঙল দিয়েছিল। সুদামের বেশ মনে আছে, বাড়িতে মা সেদিন বড়ো বড়ো লাল ধেনোকাঁকড়ার ঝোল বেঁধেছিল। মাঠ থেকে ফিরে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে শুতে শুতে বাবা বলেছিল, আজ আর কিছুটি খাব না সুদামের মা, শরীলটা যেন কেমন কেমন লাগছে। মা-র বয়েস কত হয়েছিল সুদাম জানে না। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর তিনটে বচ্ছরও সে রইল না। বড়ো ভালোবাসত বাবাকে।

ক্যাঁও-ক্যাঁও-ক্যাঁও–

সুদাম চমকে উঠল। কী বেয়াক্কেলে একটা বিচ্ছিরি পাখি হে! এই মাঝরাত্তিরে বাজখাঁই গলায় ডাকতে ডাকতে চলেছে, বুকের ভেতরটা যেন কাঁপিয়ে দিলে একেবারে। এত বড় নদীটা পড়েই রয়েছে দু-ধারে, ঠিক মাথার ওপর দিয়েই ডাকতে ডাকতে না গেলেই আর চলছিল না?

চমকে উঠল বুড়িও।

অ সুদাম!

শুনছি, বলো।

তোর ছেলে কাঁদে কেন?

আমার ছেলে নয়। ওটা পাখি।

না, লুকোচ্ছিস আমায়। চোখে তো কিছু দেখতে পাইনে, তাই মিথ্যে করে বলছিস। কী হয়েছে ছেলের?

আচ্ছা জ্বালা তো। এই নৌকোয় ছেলে আসবে কোত্থেকে? বললুম-না ওটা পাখি?

নৌকো কেন সুদাম? তুই আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?

তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না দিদিমা। বার বার করেই তো বলছি, তোমায় নিয়ে যাচ্ছি শিমুলতলির বিশালাক্ষীর মন্দিরে।

হুঁ, মায়ের মন্দির। কতদিন বউকে বলেছি, এক বার নিয়ে চল। বউ বলে, এই শরীল নিয়ে তুমি যাবে কোথায়? আমি বলি, বউ, আমার দিন তো ফুরিয়ে এল, যাহোক করে নিয়ে চল—শেষ বার মায়ের পায়ে একটা পেন্নাম করে আসি।

বোঠেটা এক বারের জন্যে সুদামের হাতে আটকে গেল। বুড়িটাও তা হলে মরণের কথা ভাবে। ঠিক এই সময় এই কথাটা শোনবার জন্যে সুদাম তৈরি ছিল না।

সেই বিড়িটার ধোঁয়া কী করে যেন গলায় আটকে আছে এখনও। আবার খানিকটা কাশি এল।

তুই কাশছিস সুদাম।

না গো, ও কিছু নয়।

খুব পুরোনো ঘি আছে আমার কাছে। তোর ঠাকুর্দার ঠেয়ে চেয়ে নিয়েছিলুম। তোর বুকে একটু মালিশ করে দেব।

আবার মায়া বাড়াচ্ছে বুড়িটা। সুদামের ভয়ংকর খারাপ লাগল। কী-একটা যন্ত্রণার মতো চমকে গেল মনের ভেতর, বুড়ির ওপরে খানিকটা প্রবল বিদ্বেষ অনুভব করল সুদাম।

আমার কিছু দরকার নেই, আমি বেশ আছি।

কিন্তু মরণের ভাবনা বুড়িকে পেয়ে বসেছিল। এমনি করেই এক-একটা ভাবনার ঘোর ওর আসে। মরণের কথাটা মনে হলেই যেন এতদিনের জীবনটাতে যত মৃত্যু সে দেখেছে— সবাই, সবগুলো, ছবির মতো ভিড় করে আসতে থাকে তার ন্যাবা চোখের সামনে।

তোর দাদামশাই হঠাৎ মরে গেল। বেশ বসে ছিল দাওয়ায়—কী যে হল, বললে, বুকটায় বড্ড ব্যথা করছে। কবিরাজ এল, কিছুই করতে পারল না। আগের দিন নতুন কাপড় কিনে এনেছিল, সেইটে দিয়ে ঢেকে শুইয়ে রাখল ছাতিম গাছটার তলায়। সুদাম, আমিও একদিন…

চরায় নৌকো ভেড়াল সুদাম। চাঁদ এতক্ষণে বেরিয়ে এসেছে মেঘের আড়াল থেকে। লালচে আলোয় নদীর জলে কচি বাদাম পাতার রং লেগেছে মনে হয়। চরাটা পড়ে আছে প্রকান্ড একটা বোয়াল মাছের সাদা পেটের মতো।

বুড়ি বললে, সুদাম, আমিও একদিন অমনি করে মরে যাব। একটা কথাও বলতে পারব না হয়তো। তা ছাড়া সবই তো ভুলে যাই। সুদাম, আমার বালিশটার ভেতরে দু-কুড়ি রুপোর টাকা লুকোনো রয়েছে। মনে করে বার করে নিস কিন্তু। আর পারিস তো আমাকে একখানা নতুন কাপড় দিয়ে…

দাঁতে দাঁত চাপল সুদাম। বোঠে রেখে উঠে দাঁড়াল। বললে, দিদিমা এসে গিয়েছি।

কিছু না, কিছু না। ঘণ্টা দুই আরও বুড়িকে বসে থাকতে হবে ভিজে চড়াটার ওপর। তারপরে জোয়ার আসবে। তারও পরে আর কিছুই নেই।

তুলসীর কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে, গাঁয়ের লোকেও জানতে চাইবে। কিন্তু কী জানে সুদাম? হয়তো দোর খুলে রেখেছিল, শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে। হয়তো অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, তারপর উঠোন ডিঙিয়ে কোনো সময় খালে গিয়ে পড়েছে। সারাদিন খেটেখুটে অঘোরে ঘুমুচ্ছিল সুদাম, এসব কিছুই তার জানবার কথা নয়। সে তো আর রাত জেগে বসে চৌকি দিতে পারে না।

বুড়ি মরার কথা ভাবছিল। আবার কী-একটা যন্ত্রণার মতো চমকে গেল সুদামের মাথার ভেতর দিয়ে। এত দিন তো কেটেছে, না-হয় যেতই আরও ক-টা দিন। বুড়ি নিজেই হয়তো…

লগি দিয়ে নৌকোটাকে সরিয়ে আনতে আনতে সুদাম নিজের বিরুদ্ধেই প্রাণপণে মাথা নাড়ল। না, মরবে না। ওই ভূশন্ডি কাগের মরণ নেই। তার ভিটের সব মানুষগুলোকে খেয়ে শেষ করবার পরে পোড় পোতার ওপর বুনো ওল, আকন্দ আর বিছুটি বনের মধ্যে ধূমাবতীর মতো লকলকে জিভ মেলে আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকবে বুড়িটা। তার পাটের মতো চুলগুলোর ভেতরে খেলে বেড়াবে লাউডগা সাপ…

চরার দিকে কীরকম একটা আওয়াজ এল কানে। সুদাম ফিরে তাকাল। ভিজে বালির ওপর হাঁটুর ভেতরে মাথা গুঁজে বসে আছে বুড়িটা। জবুথবু ভাঙা চাঁদটা লালচে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে মুঠো মুঠো। সেই আলোয় লাল গামছা-জড়ানো বুড়িকে ঠিক নতুন কনেবউয়ের মতো মনে হল।

আরে! চরার দিকে পোড়া কাঠের মতো ভেসে যাচ্ছে কী ওটা? তারই তো আওয়াজ পেয়েছিল সুদাম! মরা জ্যোৎস্নায় ওর দুটো চোখ জ্বলছে যে। শালা কুমির! বুড়িকে খেতে যাচ্ছে।

হেই হেই–হেই…

জলের ওপর সজোরে বোঠে আছড়াল সুদাম। তিরবেগে নৌকো ঘুরাল চরার দিকে। চোখের সামনে কুমিরে টেনে নিয়ে যাবে? ব্যাটাচ্ছেলে আর আধ ঘণ্টাও দেরি করতে পারল না?

কুমির ডুব মেরেছিল। সুদাম লাফিয়ে পড়ল চরার ওপর।

না, হল না। তুমি খুনি হতে পারো, কিন্তু চোখের সামনে আর একটা খুন সহ্য করবে কী করে?

আবার উজান ঠেলে ঠেলে ফিরে যাওয়া। ক্লান্তি, বিরক্তি আর না-ঘুমোনো রাতের অবসাদে পাড় ঘেঁষে হিংস্রভাবে লগি মেরে এগিয়ে চলল সুদাম। বুড়ি ডিঙির ওপর তেমনি পুঁটলি পাকিয়ে নিথর। হয়তো সব বুঝেছে, হয়তো কিছুই বোঝেনি। হয়তো আবার ওর চোখের সামনে দিয়ে ছায়ার মিছিল চলে যাচ্ছে।

হারামজাদা কুমির! আর আধ ঘণ্টাও দেরি করতে পারল না?

নীচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে শক্ত করে চেপে লগি ঠেলতে লাগল সুদাম। তার মনে পড়ল— এই এতক্ষণ ধরে বুড়ি এক বারও খেতে চায়নি, এক বারও বলেনি–বউ খিদেয় যে আমি মরে গেলুম। যদি বলত—পরাভূত সুদামের মনে হল, তা হলে কুমিরটাও কিছু করতে পারত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *