বায়ু পুরাণ ৭১-৮০

একাত্তরতম অধ্যায়

ব্রাহ্মণেরা সূতের এই সকল বিবরণ বিস্তারিতভাবে শুনে অবশিষ্ট বিষয়ে শোনার জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। শাংশপরান বললেন– যিনি আগে দক্ষ কন্যা সতী ছিলেন, তিনি কিভাবে মেনকার গর্ভে উমা হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন? মেনা যাঁদের মানসী কন্যা, মেনাক দৌহিত্র, একপর্ণা। উমা এবং সর্বপূর্বজা গঙ্গা যাঁদের দৌহিত্রী, সেই পিতৃগণকে? এঁরা কোথায় থাকেন? কিভাবে তাঁরা উৎপন্ন হয়েছেন। তাদের স্বরূপ কি। যে কারণে এই পিতৃগণ আমাদের দৃষ্টিগোচর হননা। তার কারণ কি? কোন কোন পিতৃগণ স্বর্গে আর কারাই বা নরকে বাস করেন? কোন, কোন শ্রাদ্ধে পিতা, পিতামহ, ও প্রপিতামহের নাম উল্লেখ করে তিনটি পিণ্ড, দান করতে হয়? নরকের পিতৃগণ ও কি প্রকারে ফল প্রদানে সক্ষম?

ঋষিরা এইসকল বৃত্তান্ত সূতকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতে লাগলেন- মন্বন্তরগুলিতে পিতৃগণ জন্মগ্রহণ করেন। তারা দেবপুত্র, অতীত-ভবিষ্যতের ভেদের জন্য জ্যেষ্ঠত্ব বা কনিষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা হয়। পূর্বে মন্বন্তরের শেষে দেবতাদের সাথে যারা অতীত হয়েছেন, এবং যারা এখনও রয়েছেন, তাদের বিবরণ আমি বলছি। মানুষদের শ্রদ্ধার সঙ্গে নিবেদন করা বস্তুই এঁদের শ্রাদ্ধ। ভগবান ব্রহ্মা দেবতা সৃষ্টি করলেও তাদের পূজা করেন নি। এজন্য তারা ব্রহ্মাকে উপেক্ষা করে নিজেরাই সৃষ্টি করতে আরম্ভ করেন, এরজন্য ব্রহ্মা তাদের শাপ দিলেন। ঐ দেবতারা আবার প্রণত হয়ে পিতামহের কাছে দয়া প্রার্থনা করলেন। তখন ব্রহ্মা তাদের বললেন–তোমরা প্রায়শ্চিত্ত করো। তোমরা ব্যাভিচার করেছে, তোমরা তোমাদের পুত্রদের জিজ্ঞাসা কর, তাহলেই জ্ঞান জন্মাবে। এরপর প্রায়শ্চিত্তকামী ওইসব দেবতারা নিজের পুত্রদের প্রায়শ্চিত্ত বাক্য মন দিয়ে শ্রবণ করলেন এবং কর্মজ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

দেবতারা পুত্রদের কথায় সংজ্ঞা লাভ করলেন। খুশি হয়ে বললেন–তোমরা আমাদের পিতা, আমরা তোমাদের পুত্র। ধর্মজ্ঞান অথবা কাম, কোন বর তোমাদের দেব বল? ভগবান ব্রহ্মা দেবতাদের বললেন– তোমরা সত্যবাদী। তাই তোমাদের পুত্রদের যা বলেছ, তার অন্যথা হবে না। তোমরা বলেছে–আমারা তোমাদের পুত্র। এজন্য তোমাদের বর দিলাম। ব্রহ্মার বরে পুত্রেরা পিতৃত্ব-প্রাপ্ত হলেন আর পিতারা পুত্রত্ব লাভ করল। ঐ পুত্রেরা পিতৃগণ নামে প্রসিদ্ধ। ব্রহ্মা আরও বলেছিলেন, যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে পিতৃদের পুজো না করে অন্য কাজ করে, তার ঐ কাজের ফল দানব ও রাক্ষসেরা ভোগ করে থাকে।

শ্রাদ্ধে আরাধিত পিতৃগণ আপ্যায়িত হয়ে অব্যয় সোমকে বর্ধিত করে থাকেন। সোম শ্রাদ্ধ দিয়ে আপ্যায়িত হয়ে সবনপর্বত চরাচর সমস্ত জগৎ আপ্যায়িত করেন, যে মানুষ পুষ্টি কামনা করে শ্রাদ্ধ দান করেন, পিতৃগণ তাদেরকে সবসময়ই প্রজা ও পুষ্টি বিতরণ করেন। শ্রাদ্ধে নাম গোত্র উল্লেখ করে তিনটে পিণ্ড দান করলে, পিতা থেকে প্রপিতামহ পর্যন্ত সবসময় সন্তুষ্ট হয়ে পিণ্ডদাতা সন্তানদের আপ্যায়িত করেন।

ব্রহ্মা বলেছেন, শ্রাদ্ধ দিয়েই দান, অধ্যয়ন ও তপস্যা সিদ্ধ হয়ে থাকে। পিতৃগণই তোমাদের জ্ঞান প্রদান করবেন। পিতৃগণই দেবতা এবং দেবতাগণই পিতৃদেব। এরা পরস্পর পিতা। মুনিগণ এবার সূতকে জিজ্ঞাসা করলেন–দেবতাদের সোমবর্ধন, দেবতা প্রতীম পিতৃগণ কত সংখ্যক কোন কালে তারা বর্তমান থাকেন? সূত বললেন–আগে শংয়ু, পিতা বৃহস্পতির কাছে যা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি সেই পিতৃসর্গ বলছি।

পিতা বৃহস্পতিকে পুত্র শংযু একবার বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–হে তাত, যাদের আমরা পিতৃদেব বলে জানি, তারা কে? তাঁরা সংখ্যায় কত? কি নাম বা কিভাবে প্রাদুর্ভুত হয়েছেন? এদের কেন পিতৃগণ বলে? সবার আগে যজ্ঞে তাঁদের পূজা করা হয় কেন? শ্রাদ্ধ কাকে বলে? কিরূপ দান মহাফলজনক? কোন তীর্থ বা নদীতে শ্রাদ্ধ করলে অক্ষয় ফল দেয়? কোন্ স্থানে শ্রাদ্ধ করতে গেলে শ্রাদ্ধের নির্দিষ্ট কাল কি কি? শ্রাদ্ধের বিধি কি প্রকার? এইসব বিষয়ে আমি বিস্তারিত ভাবে শুনতে চাই।

পুত্ৰ শংযু এভাবে জিজ্ঞাসা করলে বৃহস্পতি তার উত্তরে বললেন– হে পুত্র, তুমি আমায় কয়েকটি উত্তম প্রশ্ন করেছো, এর উত্তর আমি যথাযথ দিচ্ছি। যখন স্বর্গ, পৃথিবী, নক্ষত্র দিক, সূর্য, চাঁদ, দিন ও রাত কিছু ছিল না, তখন সবাই অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। ব্রহ্মা তখন কঠিন তপস্যা শুরু করেন। পিতার কথা শেষ হতে না হতেই শংযু জিজ্ঞাসা করেন– হে পিতঃ। সর্বভূতেশ প্রজাপতি কিভাবে তপস্যা করে ছিলেন?

বৃহস্পতি তখন উত্তরে বললেন–যে, তপোযোগ সব যোগের শ্রেষ্ঠ। ভগবান ব্রহ্মা এই যোগ অবলম্বন করেই ধ্যানের মধ্যে দিয়ে তিন লোকের সৃষ্টি করেন। ভগবান ব্রহ্মা প্রথমে ভূত ভবিষ্যৎ, জ্ঞান লোক ও সমস্ত বেদ প্রকাশ করেন। প্রভু তপস্যা ও যোগের মধ্যে দিয়ে প্রথম দেবতাদের সৃষ্টি করেন। এঁরা আদি দেব নামে খ্যাত। সর্বকামপ্রদ, মহাতেজার, আদিদেবরা দানব ও মানুষেরও পূজ্য। এরা সাতজন এবং ত্রিলোকে পূজিত। এঁদের মধ্যে তিনজন অমূর্ত ও চারজন সমূর্তি সম্পন্ন। এঁদের থেকেই প্রথমে দেবতারা, তারপর ভূমি, তারপর তোক পরম্পরা, তারপর মেঘ, বৃষ্টি আর বৃষ্টি থেকেই লোক সৃষ্টি তারা যোগবলে অন্ন ও ভগবান সোমকে আপ্যায়িত করেন। এ জন্যই তারা লোকপিতা। তাদের লোভ, মোহ ও ভয় নেই, তাঁদের সংশয় নেই, এবং তারা শোকবর্জিত। এরা তোক পরিত্যাগ করে সুমঙ্গল লোকপ্রাপ্ত হন। এঁরা স্বর্গীয়, সুপুণ্য, মহাত্মা ও বিগত পাপ। এই ব্রহ্মাবাদীরা যুগ সহস্রের শেষে জন্ম নেন ও আবার যোগ অবলম্বন করে অবয়বহীন হয়ে মোক্ষ লাভ করেন। যারা গুরুপূজা প্রভৃতি শুভ কর্মের আচরণ করেন, তাদের ঐ ক্রিয়া দিয়ে যোগবৃদ্ধি হয় ও পিতৃগণ আপ্যায়িত হন। পিতৃগণ শ্রাদ্ধে খুশি হয়ে যোগ অবলম্বন করে সোমকে আপ্যায়িত ও জগৎকে জীবিত করে থাকেন।

তাই এই পরমযোগী পিতৃগণকে যত্ন সহকারে শ্রাদ্ধ দান করা কর্তব্য। যোগই পিতৃগণের পরম ফল এবং যোগ থেকেই সোমদেব প্রবর্তিত হন। একজন যোগবিদ ব্যক্তিকে খুশি করতে পারলে সহস্র ব্রাহ্মণ ভোজনের সমান ফল লাভ হয়। সহস্র ব্রাহ্মণ শত স্নাতক, এক যোগচার্যকে খাওয়ালে মহৎ ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। হাজার গৃহস্থ, শত বানপ্রস্থ, সহস্র ব্রহ্মচারী অপেক্ষা একযোগী বিশিষ্ট, যোগী ব্যক্তি যেমন হোন না কেন, নাস্তিক, সংকীর্ণ অকর্মা, চোর, তবু কোন বিচার না করে তাকেই দান করা উচিত।

যদি কোন তপস্বী জলমাত্র গ্রহণ করে এক বছরকাল একপদে দাঁড়িয়ে তপস্যা করেন, তাহলেও ধ্যানযোগীকে তার থেকে শ্রেষ্ঠ বলতে হবে। এটি হল ব্রহ্মার অনুশাসন। সিদ্ধগণ বিপ্রবেশে এই পৃথিবীতে বিচরণ করেন, এজন্য অতিথিকে কৃতাঞ্জলি হয়ে সাদরে গ্রহণ করবে এবং তাকে অর্ঘ্য দিয়ে। পদসেবা করে আশ্রয় ও ভোজন দিয়ে অতিথি সৎকার করবে। যোগেশ্বর দেবতারা নানা রূপ ধারণ করে এই পৃথিবীতে বিচরণ করেন। তাই নর, বিপ্র ও অতিথিদের সবসময় দান করবে। এতক্ষণ আমি দান ও ফলের কথা বললাম।

হাজার অশ্বমেধ, শত রাজসূয় ও হাজার পুণ্ডরীক যজ্ঞ থেকে যোগীদের সংসর্গে বাস করা অনেক পুণ্যজনক। এই অমিততেজা পিতৃগণই আদি। এরপর অবশিষ্ট পিতৃগণ এবং সন্ততি, সংস্থিতি ও ভাবনা প্রভৃতি বিষয় যথাক্রমে বলছি।

.

বাহাত্তরতম অধ্যায়

স্বর্গে শ্রেষ্ঠ সাতজন পিতৃগণ অবস্থান করেন। এদের মধ্যে তিনজন মূর্তিমান ও চারজন অমূর্ত– সূত এই কথা বললেন। এখন তাঁদের প্রজাসর্গ বলছি শুনুন। তাদের ধর্মমূর্তিধর কন্যা ও দৌহিত্রদের ধর্মমূর্তি তিনটে গণ আছে। স্বর্গে বিরজা নামে যেসব ভাস্বর লোক আছে, তারা অমূর্ত পিতৃগণ এবং তারা প্রজাপতির পুত্র। বিরজা লোকের বাসিন্দারা বৈরাজ নামে প্রসিদ্ধ। বৈরজরা প্রথম কল্প। মেনা ঐ পিতৃগণের মানসী কন্যা, ইনি হিমবানের পত্নী। ইনি মৈনাককে প্রসব করেন। মৈনাক সর্বোষধির, রত্নাকর পর্বতপ্রবর ও পবিত্র। ক্রোঞ্চ পর্বত এঁর পুত্র, শৈলরাজ মেনার গর্ভে তিন কন্যা জন্মে। এঁরা হলেন অপর্ণা, পর্ণা এবং একপাটলা। অপর্ণা গৃহ ছেড়ে একপণী বটগাছ আশ্রয় করে এবং একপাটলা একটি পাটলা গাছকে আশ্রয় করে লক্ষ বর্ষ কাল কঠিন তপস্যা করেন।

একপর্ণা একটি মাত্র পাতা, একপাটলা পাটল মাত্র খেয়ে দু’হাজার বছর কাটিয়ে দেন। এঁদের মধ্যে প্রথমা অর্পণা একেবারে উপবাসী থাকতেন। এজন্য তাঁর মা মেনা দুঃখিত হয়ে ‘উ’ ‘মা’ অর্থাৎ অনাহারে থেকে এরকম তপস্যা করো না, এরকম নিষেধ করেছিলেন। এই জন্য দুশ্চর ব্রতচারিণী মহাভাগ অপর্ণা এই পৃথিবীতে উমা নামে খ্যাত। যতদিন পৃথিবী থাকবে এই তিনজন তপঃ শরীর, যোগবলাম্বিতা শুরু করবে কিভাবে? এদের মধ্যে উমা হলেন মহা যোগী। এই উমাদেবী মহাদেবকে স্বামীরূপে পেয়েছিলেন।

দন্ত, কাম্ব, উশনা, ভৃগুনন্দন উমার ছেলে। অসিতের পত্নী একপর্ণা। ইনি সাধ্বী, তপোব্রতা। এঁর মানসপুত্র বরিক্ষঠ, দেবল। তৃতীয় কুমারী একপাটলা শত শিলাকের পুত্র জৈগীষব্যকে পতিত্বে বরণ করেন। এঁর অযোনিজ-দুই পুত্র শঙ্খ ও লিখিত? শঙ্কর ও শঙ্করীরর পরস্পর আকাঙ্ক্ষায় ভীত হয়ে অগ্নিকে পাঠালেন বিঘ্ন ঘটানোর জন্য। মিলন না হওয়ায় দেবী রেগে গিয়ে অগ্নিকে অভিশাপ দিলেন।

তুমি আমার রতি বিঘ্ন ঘটিয়েছো, এজন্য তুমি এ শুক্র গ্রহণ করে গর্ভধারণ কর। আমি এই দণ্ডাদেশ দিলাম। হে দ্বিজগণ! তারপর অগ্নি রূদ্রাণীর শাপে গর্ভধারণ করে অনেক বছর কাটিয়ে দিলেন। এবং শেষ কালে গর্ভের কষ্টে কাতর হয়ে গঙ্গার কাছে এসে বললেন– গর্ভধারণ করে আমি খুব ক্লান্তিবোধ করছি। তুমি আমার মঙ্গলের জন্য গর্ভধারণ কর। তোমার কষ্ট হবে না। গঙ্গা খুশি হয়ে বললেন–তথাস্তু। অগ্নির মতো দীপ্যমান মহাতেজা রুদ্রাগ্নি সিদ্ধগণেরা পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলো। কুমারের জন্মের পর সিদ্ধগণেরা পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলো। মধুর স্বরে দুন্দুভি বাজতে লাগলো গন্ধর্বরা গান গাইতে লাগলো। যক্ষ, বিদ্যাধর, সিদ্ধ, কিন্নর, হাজার মহানাগ, পতঙ্গ অগ্নি শুদ্ধপুত্র কুমারকে দেখার জন্য সেখানে এল। মায়ের মতো স্নেহময়ী দেবপত্নীরা সপ্তর্ষি ভার্যাদের সাথে এসে কুমারকে অভিষেক করলেন।

কুমার সবাইকে দেখবার জন্য কৌতুক করে নিজের ছটি মুখ সৃষ্টি করলেন। তার প্রভাবে দৈত্য, রাক্ষসরা নিহত হন। উনি কৃত্তিকাগণের দ্বারা রক্ষিত হয়েছিলেন বলে তিনি কার্তিকেয় নামে পরিচিত হলেন। বাল্যকালে কার্তিকের খেলার জন্য বিষ্ণু ময়ূর, কুকুর, বায়ু, পতাকা, বীণা, স্বয়ম্ভ ছাগ শন্তু মেষ প্রভৃতি দান করেন। হে বিপ্রগণ, তারকাসুর বধ করবার জন্য দেবতারা এঁকে দেবসেনাপতিত্বে বরণ করলেন। অভিষেকের পর থেকে দেবতারা; প্রমথগণ, ভূতগণ, বিবিধ মাতৃগণ, ও বিনায়কেরা এঁকে দেব সেনাপতি, নরনায়ক বলতে শুরু করেন।

.

তিয়াত্তরতম অধ্যায়

বৃহস্পতি বললেন– সোমপাদ নামে দেবলোকে একটি লোক আছে। ঐ লোকে মরীচিনন্দন পিতৃগণ। বাস করে। সমস্ত দেবতা ঐ পিতৃণের পূজা করে থাকেন। আচ্ছোদা নামে নদী এঁদের মানসী কন্যা। এর থেকেই আচ্ছেদ সরোবর এসেছে। এই স্বর্গীয় সরোবর আদ্রিকা নামে অপ্সরা ও অসংখ্য বিমানে পরিশোভিত। এই আচ্ছোদা পিতৃগণকে মূর্তিহীন দেখে বিস্মিতা ও দুঃখিতা হন। অন্তঃরীক্ষচারী অমাবসু নামে বসুপিতা আয়ু পুত্রকে বরণ করলেন। ঐ পতিকামা কামরূপিণী ব্যভিচার দোষে স্বর্গ থেকে নীচে পড়ে গেলেন। সেইসময় জ্বলন্ত আগুনের মতো বিমানে অবস্থিত সূক্ষ পিতৃগণকে দেখতে পেয়ে বললেন–আমায় পরিত্রাণ করুন। তারা বললেন–ভয় নেই।

তারা এরকম অভয় দিলে অচ্ছোদা পতন থেকে মুক্তি পেয়ে অতি করুণ স্বরে তাদের খুশি করলেন। পিতৃগণ বললেন–তুমি নিয়মের ব্যতিক্রম করে নিজের দোষেই পতিত হয়েছে। দেবগণ যেরূপে শুভাশুভ কর্ম করে থাকেন, ঐ জন্মেই একই অঙ্গ দিয়ে সেই কর্মের ফল ভোগ করেন। কিন্তু মানুষের কর্মফল মরণের পর ফলে থাকে। তাই তুমি জন্মান্তরে কর্মফলে অমাবসুকে পিতৃরূপে পাবে। অচ্ছোদার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ধ্যান যোগে ভবিষ্যতের ঘটনাগুলি জেনে বললেন–মহাত্মা অমাবসু মানুষ ও রাজা হয়ে ধারতলে জন্মগ্রহণ করলে, তুমি তার কন্যা রূপে জন্ম নিয়ে আবার নিজ লোকে আসবে।

তুমি আঠাশ দ্বাপর যুগে মৎস্যযোনী পেয়ে অমাবসু থেকে অদ্রিকার গর্ভে জন্মাবে। আর পরাশর ঋষির পুত্রকে উৎপাদন করবে। তুমি শান্তনুর বিচিত্রবীর্য ও চিত্রাঙ্গদ নামে দুই কীর্তিমান পুত্রের জননী হবে। এইসব পুত্র হলে আবার তুমি নিজের লোকে ফিরে আসবে। পিতৃগণ দ্বারা একথা বিবৃত হলে আচ্ছাদা দাসকন্যা সত্যবতী হয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। গঙ্গা ও যমুনা এই উভয়ের সঙ্গমে আদ্রিকা নামে মৎস্যযোনিতে অমাবসু রাজার বীর্যে তাঁর জন্ম হয়। বিরজা নামে লোকস্বর্গে পিতৃগণ দীপ্তি পেয়ে থাকেন। পিতৃগণের মানসী কন্যা হল পীবরী। ইনি আঠাশ দ্বাপরে যোগিনী, যোগমাতা হবেন।

পরাশর ফুল থেকে উদ্ভূত শুক মহাযোগী মহাতপা। ইনি পীরবী নামে এক কন্যার জন্ম দেন। ঐ কন্যা যোগ মাতৃস্বরূপিণী। ইনি ব্রহ্মদত্তের জননী ও অনুহের মহিষী ছিলেন। ধর্মাত্মা শুকদেব এই সন্তান সন্ততি উৎপাদন করে মহাযোগ অবলম্বন করে গতি লাভ করেছেন। ইনিই আবার কালান্তরে সর্বব্যাপী মুক্ত মহামুনি হবে।

পিতৃগণের মধ্যে যারা ধর্মমূর্তিধর, তারাই মূর্তিহীন। এই তাদের তিনগণ বলা হয়। এবার চতুর্থ গণেরা হল মূর্তিমান এবং মহাপ্রভ। এরা অগ্নি কন্যা স্বধা থেকে উৎপন্ন। এই পিতৃগণ জ্যোতির্ময় দেবালোকে বিরাজ করেন। এই পিতৃগণের গো নামে মানসী কন্যা স্বর্গে রয়েছেন। ইনি শুক্রের প্রিয় মহিষী ছিলেন। সনৎকুমার এঁকে সম্প্রদান করেন।

ভার্গবদের একত্রিশ সংখ্যক বংশধির বিখ্যাত, এঁদের লোক মরীচিগর্ভ। এরা অঙ্গিরার পুত্র ও সাধ্যদের সাথে বর্ধিত। স্বর্গে উপহৃত নামে এক দীপ্ত পিতৃগণ আছেন। ক্ষত্রিয়রা এঁদের উপাসনা করে থাকেন। এঁদের মানসী কন্যার নাম যশোদা। এই যশোদা বিশ্বমহতের পত্নী। বিশ্বকর্মার পুত্রবধূ ও মহাত্মা খট্টাঙ্গ নামে রাজর্ষির জননী। আগে এই খট্টাঙ্গের যজ্ঞে মহর্ষিরা গান করেছিলেন। পিতৃগণ যজ্ঞে অগ্নির আবির্ভাব দেখে মহাত্মা শান্তিল্যের যজ্ঞমান দিলীপ ও সত্যবানকে দর্শন করেন। এই স্বর্গজয়ী অমররাই আদ্যপা নামের পিতৃগণ।

এঁরা পুলহ থেকে উৎপন্ন এবং কর্দম প্রজাপতির পিতা। এরা স্বর্গ লোকে বিমানে করে আকাশমন্তলে বিচরণ করেন। বৈশ্যরা এঁদের শ্রাদ্ধে আপ্যায়ন করেন। এদের বিরজা নামের মানসী কন্যা যযাতির জননী। ইনি আবার নহুষের পত্নী। বশিষ্ঠ প্রজাপতির সুকালা নামে পিতৃগণ, এঁরা, হিরণ্য গর্ভের সূত। শূদ্রগণ এঁদের উপাসনা করেন। স্বর্গের মানসলোকে এঁদের বাস। নর্মদা এদের মানস কন্যা।

দক্ষিণ দেশগামিনী নর্মদা জীবের মঙ্গল করেন। পুরু কুৎসের পত্নী ইনি, দস্যুর জননী। মনুই মন্বন্তরে প্রথমে পিতৃ লোকদের শ্রাদ্ধ প্রবর্তিত করেছেন। তাই দ্বিজগণ! স্বধর্ম রক্ষার জন্য শ্রদ্ধার সাথে রূপোর পাত্রে পিতৃলোকদের শ্রাদ্ধদান করা অবশ্য কর্তব্য। স্বহা মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্রাদ্ধ দান করতে হয়। এতে পিতৃলোক খুব খুশি হয়।

অগ্নিতে হোম করে সোম, অগ্নি, ও বৈবস্বতকে আপ্যায়িত করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়। যে ব্যক্তি ভক্তি ভরে পিতৃগণকে খুশি করেন, পিতৃগণ খুশি হয়ে তাকে তার ইচ্ছামত বর দিয়ে পরিতৃপ্ত করেন। পিতৃগণ সন্তান প্রার্থী ও পুষ্টিকামী সন্তানদের সন্তান, পুষ্টি ও শেষে স্বর্গদান করে থাকেন। দেবতার কার্যের থেকে পিতার কার্য কঠিন। কারণ শাস্ত্রে বলা আছে, দেবতাদের আগে পিতৃগণকে আপ্যায়ন করা উচিত। এতক্ষণ আমি পিতৃগণের স্বরূপ, তাদের লোক, দুহিতা, দৌহিত্র, যজমান সমস্ত কিছুর বিবরণ দিলাম। চারজন মূর্তিমান ও তিনজন অমূর্ত পিতৃগেণের শ্রাদ্ধ দেবতারা যত্ন সহকারে করে থাকেন। ইন্দ্র, মরুৎ, ব্রহ্মাদি দেবতা, অত্রি, ভৃগু, অঙ্গিরা সমস্ত ঋষি, যক্ষ, নাগ, সুপর্ণ, কিন্নর, সবাই একমনে পিতৃগণের পূজো করে থাকেন।

এই আত্মা পিতৃগণ শ্রাদ্ধে পরিতৃপ্ত হয়ে সমস্ত প্রজাদের শত সহস্র বর দান করেন। ত্রৈলোক্য, সংসার ও জরা-মৃত্যু ভয় ছেড়ে পিতৃগণেরা মোক্ষ ও যোগ ঐশ্বর্য দান করে থাকেন। যোগ ও উত্তম বিত্তই ঐশ্বর্য স্বরূপ, যেমন পাখনা ছাড়া পাখি উড়তে পারে না, তেমনি ঐশ্বর্য ছাড়া কোন প্রকার লাভ হয়না। সনাতন মোক্ষধর্মই সমস্ত ধর্মের শ্রেষ্ঠ। পিতারা সন্তুষ্ট হলে, সমস্ত কামদায়ক অপ্সরাগণ, বিমান, প্রজা, পুষ্টি, স্মৃতি, মেধা, রাজ্য, আরোগ্য, কোটি, রত্ন, মুক্তা, বৈদুর্য, বাস এবং বাজি, নাগ, হংস, সমুক্তা শোভিতা বিমান লাভ করেন।

.

চুয়াত্তরতম অধ্যায়

বৃহস্পতি বললেন– সোনা, রূপা ও তামা রূপা খচিত পাত্রই পিতৃগণের প্রশস্ত পাত্র। পিতৃগণের উদ্দেশ্যে রূপা দান, অক্ষয় স্বর্গীয় দান বলা হয়। সৎ পুত্রেরা এইসব দান দিয়ে পিতৃলোককে উদ্ধার করে থাকেন। কৃষ্ণজিন সান্নিধ্য, দর্শন, দান ও ব্রহ্মাচর্যের মন্ত্র এইসব দ্রব্য ও মন্ত্র পিতৃগণকে উদ্ধার করে। সোনার পাত্র, রূপার পাত্র, তামার পাত্র, দৌহিত্র, দিবাভাগের অষ্টমভাগ, তিল, বস্ত্র ইত্যাদি দ্রব্য, ত্রিদণ্ডী যোগ শ্রাদ্ধের কাজে ভাল। এটাই সনাতন বাহ্যবিধি বলা হয়। এই বিধি শ্রাদ্ধকারীর আয়ু, কীর্তি, প্রজা ও সন্তান বর্ধন করেন।

যেখানে শ্রাদ্ধ করা হয় ঐ জায়গায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণের জায়গা বিদিকস্থান নামে বিখ্যাত। পিতৃগণের অনুশাসনের জন্য শ্রাদ্ধ সম্বন্ধীয় নানা স্থানের কথা বলব। শ্রাদ্ধীয় স্থান কীর্তনে ধন, আরোগ্য, আয়ু, বল বাড়ে। শ্রাদ্ধের জায়গায় তিনটে গর্ত ও তিনটি খদির কাঠের দণ্ড করতে হবে। গর্তগুলি রজত খচিত হবে আর দণ্ড চার আঙুল পরিমাণ বেষ্টন বিশিষ্ট হবে। ঐ নিচ্ছিদ্র দণ্ডগুলি পূর্ব-দক্ষিণ মুখ করে মাটিতে পেতে পবিত্র কার্য, জল ও ছাগলের দুধ দিয়ে শুচিভাবে ধুয়ে দিতে হবে। এইভাবে তর্পণ করলে তর্পণকারী ব্যক্তি ইহালোকে শ্রীমান ও সর্বগুণসমিম্বিত হয়। এইভাবে পিতৃদেবের অর্চনা করলে, অশ্বমেধ যজ্ঞের ফললাভ হয়।

চার আঙ্গুল মাটির গর্তে অমাবস্যার দিনে তর্পণের বস্তু স্থাপন করতে হয়। এটি ত্রিসপ্ত যজ্ঞ নামে প্রসিদ্ধ। সেই ব্যক্তি ঐশ্বর্য, আয়ু, সন্ততি, লক্ষ্মী ও মোক্ষ লাভ করে। এই যজ্ঞের ব্রহ্মানির্মিত অমৃতময়। মন্ত্র বলছি- যথা দৈবাতাজ্যঃ পিতৃভ্যশ্চ মহাযোগিত্য বে চ, ‘নম স্বধায়ে স্বাহায়ে’ নিত্যমেব ভবন্তু্যতে। শ্রাদ্ধে আদিতে অবসানে ও পিন্ড প্রদানের সময় এই মন্ত্র তিনবার পাঠ করতে হয়। এই মন্ত্র পাঠ করলে পিতৃলোকরা। তিন লোক থেকে উদ্ধার করে।

নিয়মিত ভাবে এই মন্ত্র জপ করলে পিতৃলোক প্রীত হয়। আমি অমূর্ত, সমূর্ত, দীপ্ততেজা, ধ্যানী, যোগচক্ষু, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের সপ্তর্ষি গনের পিতা পিতৃগণকে নমস্কার করি, মনু, সুরেশ, সূর্য, চাঁদ, চর, নক্ষত্র দিয়ে পৃথিবী এবং দেবর্ষিদের ও জনয়িতা পিতৃগণকে হাতজোড় করে প্রণাম করছি। প্রজাপতি, কশ্যপ, সোম, বরুণ ও যোগ যোগেশ্বর প্রভৃতি পিতাদের নমস্কার করি। সাতলোকের সাত পিতৃগণকে ও যোগচক্ষু স্বয়ম্ভ ব্রহ্মাকে আমার নমস্কার, সপ্তর্ষি সাথে ব্রহ্মর্ষিদের পূজিত এই মন্ত্র আমি বললাম। যে মানুষ বিধিপূর্বক এই অনুষ্ঠান করে সে অন্ন, আয়ু, ও সুত এই তিনবর পিতৃগণের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন। যে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি পরম ভক্তি ভরে, শ্রদ্ধার সাথে সপ্তচিষ মন্ত্র জপ করেন, তিনি এই সপ্তদ্বীপ ও সপ্তসাগর বেষ্টিত পৃথিবীর রাজা হন। বাড়িতে যে ভোজ্য বস্তু তৈরি হয়ে থাকে, সেগুলি পিতৃগণকে নিবেদন না করে খেতে নেই।

.

পঁচাত্তরতম অধ্যায়

বৃহস্পতি বললেন–শ্রাদ্ধকারী ব্যক্তি পলাশ পাত্রে শ্রাদ্ধ করলে ব্রহ্মচর্য, অশ্বত্থ পাতায় শ্রাদ্ধ করলে রাজ্য, পাকুড় গাছের পত্রে শ্রাদ্ধ করলে সর্বভূতাধিপত্য, বটগাছের পত্রে শ্রাদ্ধ করলে পুষ্ট প্রজা, ধৃতি ও স্মৃতি, কাস্পর্য পত্রে রাক্ষস হানি ও যশ, মধুক পত্রে উত্তম সৌভাগ। ফল্প পত্রে সর্বকামনা, বিপত্রে লক্ষ্মী, মেধা ও আয়ু লাভ করে। বেনুপত্রে শ্রাদ্ধ করলে শ্রাদ্ধ কারীর শস্যক্ষেত্রে অজস্র বর্ষণ করেন, ঐ সব পত্রে যে একবার শ্রাদ্ধদান করেন তিনি নিখিল যজ্ঞের ফলভাগী হন। এভাবে যিনি পিতৃগণকে সুগন্ধি মালা দান করেন, তিনি দিবাকরের মতো দীপ্তি। যিনি মধুদই দিয়ে শ্রাদ্ধ করে ধূপ প্রভৃতি দান করেন তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের ফললাভ করেন। যে ব্যক্তি দীপদান করে সে অপ্রতিম চোখ লাভ করে, তেজ, যশ, কান্তি ও বলে পৃথিবীতে বিখ্যাতনামা হয়ে স্বর্গ গমন করে।

দ্বিজেরা প্রথমত ফল, মূল, ধূপদীপ দিয়ে নমস্কার করে, অন্ন প্রভৃতির দিয়ে পুজো করেন। শ্রাদ্ধকালে পিতৃগণ বায়ুভূত হয়ে দ্বিজ শরীরে আবিষ্ট থাকেন। সুতরাং শ্রাদ্ধকালে অন্ন, বস্ত্র, ভোজ্য ভোক্ষ্য, পেয়, গো, অশ্ব, গ্রাম দান করে দ্বিজত্তমদের পূজা করতে হয়। ব্রাহ্মণরা ডানহাত দিয়ে দভত, পিণ্ড, ভক্ষ্য, নানা ফুল গন্ধ ও অলঙ্কার একে একে পিতৃগণ এর উদ্দেশ্যে দান করবেন। পিতৃগণকে অন্ন দিয়ে তাদের নাম গোত্র উল্লেখ করে তাদেরকে বস্ত্র, অর্থ, সূত্র দান করবেন।

শ্রদ্ধকারী মাটিতে বসে ঘি, তিল মিশিয়ে তিনটে পিণ্ড পিতৃউদ্দেশ্যে মাটিতে নির্বাপন করবেন। শ্রাদ্ধকারী ব্যক্তি অন্ন, জল, ফুল, ভক্ষ্য দিয়ে মাতামহ পক্ষেরও শ্রাদ্ধ করবেন। আচার্যরা বলে থাকেন, তিনটি পিণ্ড মাতা পক্ষেও ‘নমোব’ঃ পিতরঃ সুষ্মে এই মন্ত্রে ডানহাত দিয়ে যত্নের সঙ্গে দান করা হয়। ব্রাহ্মণেরা উলুখল, পরিষ্কৃত পান উদক পাত্র থেকে জল ও নতুন ক্ষৌমসূত্র, শোনসূত্র, কাঁপাসিত সূত্র পিতৃগণকে প্রদান করবেন। কালো তিল ও তার থেকে যে তেল হয় সেই তেল, চন্দন, অগুরু, তমাল, পদ্ম, ধূপ, সাদা ফুল এবং পদ্মোৎপল এইসব দ্রব্য শ্রাদ্ধে সুপ্রশস্ত। উগ্রফল দেওয়া যাবে না। শ্রাদ্ধে প্রধান যজমান স্বয়ং দক্ষিণমুখে বসবেন আর আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণেরা উত্তরমুখে বসবেন। পিতৃগণের সামনে যত্নের সাথে কুশ ও দুর্বা ও পিণ্ডদান করবেন।

এইভাবে বিধি অনুযায়ী নিজেরই পিতামহদের অর্চনা করবেন ভগবান প্রজাপতির চুলগুলি মাটিতে পড়ে কাশ রূপে জন্মেছে। তাই শ্রাদ্ধের কাজে কাশ অবশ্যই প্রয়োজন। ঐশ্বর্যকামী ব্যাক্তি তাতেই পিণ্ডদান করবেন। যে ব্যক্তি একবার মাত্র দক্ষিণ মুখ হয়ে পিণ্ডদানের জন্য কুশ ব্যবহার করে, পূর্ব দক্ষিণ মুখ হয়ে বিধি বাক্য করে, তার প্রজা, কান্তি, প্রজাপুষ্টি, দ্যুতি ও কীর্তি চিরস্থায়ী হয়। কাশ সবসময় পবিত্র ও প্রদীপ্ত হয়ে থাকে। ক্রুদ্ধ বা অন্য মনে শ্রাদ্ধের কাজ করতে নেই। একাগ্রমনে শ্রাদ্ধাদি করতে হয়। যা কিছু অবধ্য তা আমি বিনষ্ট করি।

আমার দ্বারাই অসুর, দানব, রক্ষ, যক্ষ, পিশাচ সমূহ নিহত হয়। সুসংহতভাবে এই মন্ত্রে কুশ দিয়ে একবার বেদী লিখে মঙ্গলময় ঐশ্বর্য কামনায় সেই কুশ উত্তর দিকে ফেলে দিতে হবে। এইভাবে যে। ব্যক্তি পিতৃশ্রাদ্ধে অন্নদান করে, অসুরেরা তার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না। যে স্থানে এই মন্ত্র পাঠ হয়, সেখানে রাক্ষসরা থাকতে পারে না, অশুচি ব্যক্তি শ্রাদ্ধে অন্নদান এমনকি দর্শনও করতে পারবে না। ব্রাহ্মণরা বিধি মেনে শ্রাদ্ধ করবে।

শ্রাদ্ধ করলে পিতৃগণ সন্তুষ্ট হয় ও রাক্ষসেরা অসন্তুষ্ট হয়। পিতৃগণ প্রসন্ন হয়ে বরদান করেন। পুনর্ভব কাশ দিয়েই সমস্ত কাজ করবে। এরপর যত্ন করে হোম সামগ্রী নিয়ে কার্যসিদ্ধির জন্য অস্বর্গ লৌকিক দ্রব্য হোম করবে। একটা হোমের শেষে, সমিধ হোম করে সমাহিত ভবে অন্য হোম বিধান করবে। হোমের মন্ত্র হল–অগ্নয়ে কব্যবাহনায় স্বধা অগ্নিরসে নমঃ সোমায় পিতৃমতে অগ্নিরসে নমঃ, যমায় অগ্নিরসে স্বধা নমঃ এই তিনটে মন্ত্র দিয়ে হোম করলে কার্যসিদ্ধি হয়।

সধূম আগুনে হোম করলে অন্ধ ও পুত্রহীন হয়। দুর্গন্ধ বিশিষ্ট, নীল বা কালো অগ্নিতে হোম করলে পরাজয় হয়। উজ্জ্বল শিখা বিশিষ্ট, ঘি ও সোনার মত বর্ণ এবং প্রদক্ষিণ করে জ্বলে এমন আগুনই কার্যসিদ্ধি করে, আগুনের দ্বারাই পূজো পেয়ে পিতৃগণ নিষ্ঠা ভরে অগৌনকারী এই প্রশ্ন করবেন, ব্রাহ্মণরা কুরুত্ব ফল ও সমিধ শ্রাদ্ধের বিষয়ে পবিত্র শাস্ত্রকারী নিষ্ঠাভরে অগৌণকারি এই প্রশ্ন করবেন, ব্রাহ্মণেরা গুরুত্ব বলে আদেশ দিলে, স্ত্রী পুত্র নিয়ে অগ্নিতে হোম করবেন, প্লক্ষ, বট, অশ্বত্থ, বিল্ব, চন্দন, সবল শাল, দেবদারু গাছগুলি স্বর্গীয়। এদের কাঠ হোমের কাজে প্রশস্ত। গ্রাম কাঁটা গাছ, ও অন্যান্য যজ্ঞীয় গাছ থেকে যজ্ঞের কাঠ থেকে সংগ্রহ করাই প্রশস্ত। এটি পিতৃগণ বলেদেন, পিতৃগণের মন্ত্রের শেষে স্বধা ও দেবতাদের যজ্ঞ কাজে স্বাহা মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে থাকে।

.

ছিয়াত্তরতম অধ্যায়

সূত বললেন–বৃহস্পতি বিধি অনুসারে নির্দেশ করেছেন যে দেবতা দু-প্রকার পিতৃ দেবতা ও অপিতৃ দেবতা দুজনকেই পুজো করা উচিত।

কিন্তু যজ্ঞবিশেষে দেবতাদের আগে পিতৃদেবকেই পুজা করা বিধেয়। হে ধর্মজ্ঞ। দক্ষের বিশ্বা নামে এক কন্যা ছিল। বিধাতা কন্যাকে ধর্মের হাতে দান করেন। ঐ কন্যার পুত্ররা বিশ্বদেব নাম প্রসিদ্ধ। এই ত্রিভুবন বিখ্যাত, সর্বলোক নমস্কৃত বিশ্বদেবগণ রমণীয় হিমাচল শিখরে সমস্ত অপ্সরা ও দেব গন্ধর্বের মহৎ উগ্র তপস্যা করেন। তপস্যায় পিতৃগণ সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর আমিও যথেষ্ট খুশি হয়েছি তোমরা কোন্ বর চাও বল? তখন বিশ্বদেবগণ একসাথে বললেন–শ্রাদ্ধে আমাদের অংশ থাকুক। এটাই আমাদের কামনা। তখন ব্রহ্মা ও পিতৃগণ বললেন–তাই হবে। এ পৃথিবীতে যেখানে যে শ্রাদ্ধকার্য হবে সব কাজেই আমাদের সাথে সাথে তোমাদের ভাগ রক্ষিত হবে। তোমাদের আসন আগে হবে।

মানুষেরা মালা, গন্ধ, অন্ন দিয়ে তোমাদের পূজা করার পর, আমাদের ঐসব নিবেদন করবে। আমাদের আগে বিসর্জন হবে, তোমাদের হবে পরে। ভূত, দেবতা ও পিতৃগণের শ্রাদ্ধে রক্ষা ও আতিথ্যের দুটো বিধি আছে। ব্রহ্মা বিশ্বদেবদের এইভাবে বর দিয়ে পিতৃগণের সাথে স্বস্থানে চলে গেলেন। বেদে মানুষদের পাঁচটি মহাযজ্ঞ বলা আছে। মানুষেরা সবসময় ঐ পঞ্চ মহাযজ্ঞ নিষ্পন্ন করবে। শ্রাদ্ধ দানকারী ব্যক্তিরা যেখানে ভয় নেই, কষ্ট নেই, অহঙ্কার নেই, শোক নেই, ব্যথা নেই সেই ব্রহ্মলোকে স্থান পান। পঞ্চযজ্ঞ কর্ম শুদ্রদেরও করা উচিত। যে ব্যক্তি পঞ্চযজ্ঞ কর্ম না করে যায়, সে ঋণগ্রস্ত হয়। কেউ বলেন পিতৃলোক জীবিত থাকলেও নৈবেদ্য দান করা যায়।

জলদানের পর বলি ও জলকলস দান করা উচিত। আগে শ্রেষ্ঠ শিং যুক্ত গাভী বলি দিতে হয়। জীবিত পিতাদের পিণ্ড দান কার অনুচিত। নিজের ইচ্ছেমত অন্ন এবং অন্যান্য ভোজ্য দিয়ে পিতৃগণকে খাওয়ানো উচিত। এ সম্বন্ধে বেদবিহিত বিধি আছে। মহাত্মা বৃহস্পতি বলেছেন– আগে পিণ্ডদান করে পরে ব্রাহ্মণ ভোজনের সময় একজন যোগী ব্রাহ্মণ থাকেন। তবে তিনি যজমানকে উদ্ধার করেন।

যে ব্যক্তি অতিথি ও ধার্মিক ব্যক্তিকে ত্যাগ করে মূর্খ ভোজন করায় সেই দাতা আগের সকর্ম হারিয়ে বিনষ্ট হন। দক্ষিণ মুখ হয়ে জলে দাঁড়িয়ে আকাশকে আচ্ছাদন করবে। দক্ষিণ দিক পিতৃগণের আবাসস্থল। দ্বিজরা আগে একটি পিণ্ড উদ্ধারের কথা বলেছেন, তবে আদেশ দিলে পাঁচটি পিণ্ড উদ্ধার করা যায়। পুষ্প, ফল, ভোজ্য অন্নের অগ্রভাগ উদ্ধার করে আগুনে হোম করতে হয়। যা কিছু উত্তম–অন্ন, ফল ইত্যাদি আগুনে হোম করে পরে দক্ষিণ মুখ হয়ে পিণ্ড দিতে হয়।

বৈবস্বত ও সোমকে পিণ্ড নিবেদন করে পরে উদক আহরণ করে ব্রাহ্মণদের অন্নাদি দিয়ে ভোজন করানো কর্তব্য। ভোজ্য ও সুগন্ধ রস দিয়ে একাগ্রমনে হাত জোড় করে পিতৃগণের উপাসনা করলে সমস্ত ইচ্ছে পূর্ণ হয়। এরপর শ্রাদ্ধকারী লোক স্বধা উচ্চারণ করে অন্ন ইত্যাদি দিয়ে ব্রাহ্মণদের প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে সকার করে হাতজোড় করে সংযত ভাবে বিদায় দেবে।

.

সাতাত্তরতম অধ্যায়

বৃহস্পতি বললেন– হে সৌম্যগণ! যোগাত্মা, মহাত্মা, বিগত পাপ, অব্যয় পিতৃগণ একবার মাত্র অর্চিত হলেও খুশি হয়ে থাকেন এবং মৃত্যুর পর এর স্বর্গ ও সুবিস্তার কম, ঐশ্বর্য লাভের জন্য মোক্ষ লাভ করে যেসব জায়গা অনুগৃহীত করেছেন সেই সব নদী, সরোবর, পুণ্যতীর্থ, দেশ, পর্বত ও আশ্রমের কথা বলছি।

পবিত্র অমরকন্টক একটি ত্রিলোক প্রসিদ্ধ পর্বত। এই পুণ্যময় পর্বতে ভগবান অঙ্গিরা অনেক বছর ধরে কঠিন তপস্যা করেছিলেন। ঐ পর্বতের সীমায় অসুর, রাক্ষস ও মৃত্যুর কোনো গতিবিধি নেই। সেখানে ভয় অলক্ষ্মীও নেই। শৃঙ্গবান ও ম্যাগবান পর্বতের মতো সর্বক্ষণ তেজে দীপ্ত আগুনের মতো ঐ অমরকন্টক পাহাড় যশ ও তেজে দীপ্তি পেয়ে থাকে, ভগবান অঙ্গিরা দক্ষিণ নর্মদার কুশ নামে খ্যাত। এক জায়গায় জলপান করে স্বর্গের সোপান লক্ষ্য করেন। ঐ কুশগুলি মৃদু, সুগন্ধ যুক্ত মসৃণ, মহাতেজা অঘিহরা ঐ কুশগুলি গ্রহণ করেন।

যে ব্যক্তি অমরকণ্টক পাহাড়ে ঐ সব কুশের ওপর পিণ্ডদান করেন, সেই শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয় ও পিতৃগণও তৃপ্ত হয়। ঐ জায়গায় পুণ্যময় জ্বলা সরোবর ও বিশল্যকরণী নদী আজও দেখা যায়। এই সরোবর পর্বতের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে। ঐ সরোবর ও নদীতে স্নান করলে প্রাণীদের পুণ্য হয়। অমরকন্টকের এই সিদ্ধ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তর্পণ করে পিতৃলোককে তৃপ্ত করে তারাই ধন্য, অল্প তপস্যায় তাঁদের সিদ্ধি লাভ হয়। মহেন্দ্র পর্বত ইন্দ্রের থাকার একটি সুন্দর জায়গা, সেখানে শ্রাদ্ধ করলে মহৎ ফল লাভ হয়। সেখানে বিস্বাধঃ শিদ্বয়ে যোগীরা বাস করেন, মানুষ সেখানে গেলে দিব্য দৃষ্টিলাভ হয়।

মানুষ সপ্তগোদাবরী ও গোকর্ণ নামে তপোবনে স্নান করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফললাভ করে। ধূতপাততীর্থে স্নান করে পবিত্র হওয়া যায়। এই গিরির সিদ্ধচারণ সেবিত দেবর্ষি ভবন শৃঙ্গে উঠলে মানুষ স্বর্গে যেতে পারে। ঐ জায়গা থেকে সবসময় চন্দন মিশ্রিত জল বয়ে যায়। ঐসব তীর্থস্থান থেকে তাপণী নদী প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ সাগরের দিকে বয়ে চলেছে। ঐ নদীতে শঙ্খ, মুক্তা উৎপন্ন হয়। নদীর ঐ চন্দন মিশ্রিত শঙ্খ, মুক্তার জল নানা রোগ থেকে মুক্তি দেয়। পাপকারী পিতৃলোকদেরও উদ্ধার করে পুণ্যজনের আবাস, যদির, বিল্ব, পাকুড়, অশ্বত্থ, কাবেরী প্রভৃতি গাছ শ্রেণীবদ্ধ ভাবে দেখা যায়। নর্মদা পিতৃগণের মানসী কন্যা, এতে শ্রাদ্ধ করলে শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়।

পুণ্যময় বিন্ধ্যপর্বতের সাধুরা কখনো কোনো পাপধারা দেখতে পাননা, শুধু পুণ্য ধারাই দেখে থাকেন। সেখানে শুভকাজগুলির সুস্পষ্ট পুণ্যধারাই দেখা যায়। কোশলাতে মাতঙ্গের এক পাপ বিনাশিনী জলাশয় আছে, সেখানে স্নান করলে পাখিরাও স্বর্গে যেতে পারে। কুমার কোশলতীর্থ, কালতীর্থ কালপঞ্জুর পর্বত পাতুকুল সমুদ্ৰান্ত, পন্ডার কবন, বিমল, বিপাপ, প্রভব, শ্রীবৃক্ষ, গৃধকূট জন্তুমার্গ এবং যোগাচার্য অসিতের পুণ্যময়ী অসিতাতীর্থে শ্রাদ্ধ করলে অনন্তফল দান করে। পুষ্কর তীর্থে শ্রাদ্ধ ও তপস্যা ফলদায়ক। মহোদধি তীরে ও প্রভাসে শ্রাদ্ধ করলেও আগের মত ফলপ্রাপ্তি হয়। নিষ্পাপ যোগেশ্বররা সবসময় ঐ তীর্থের সেবা করে থাকেন। যেজন ওখানে শ্রাদ্ধ দান করেন তার দেওয়া শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়ে পিতৃগণকে খুশি করে থাকে। অগ্নির সাক্ষাৎ মূর্তির মত ওখানে জাতবেদ নামে এক শিলা আছে। যে ব্যক্তি অগ্নিশিলাতে প্রবেশ করে সে স্বর্গগামী হয় এবং শান্ত নামে অগ্নি হয়ে জন্ম নেয়। ঐ শিলাতে যা দেওয়া হয়, তাই অক্ষয় হয়ে থাকে। জয়শির নামে এক সদ্য বরপদ তীর্থ আছে, ঐ তীর্থে শ্রাদ্ধ দান করলে তা অক্ষয় হয়, শ্রাদ্ধকারী অক্ষয় ফল লাভ করে। কুম্ভতীর্থে শ্রাদ্ধ করলে পাপমুক্ত হওয়া যায়। অজুতঙ্গ নামে তীর্থে সবসময় পিতৃলোকের তর্পণ করা উচিত। এখানে দেবতাদের ছায়া পড়ে।

পাণ্ডবেরা ঐ জায়গায় শ্রাদ্ধ করে নীরোগ হয়। সমস্ত যোগেশ্বর সেবিত তীর্থে যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধ করে বা পিতৃঅর্চনা করে, তার পিতৃগণের সাক্ষাৎ লাভ হয়। শিব নামে একটি পুণ্যময় শ্রেষ্ঠ হ্রদ আছে। ব্যাস সর ও ব্রাহ্মসর নামে দুই সরোবর নিয়ে এটি গঠিত। পবিত্র উজ্জ্বন্ত পর্বতে মহাত্মা বশিষ্ঠের পুণ্যময় আশ্রম রয়েছে। ভগবান ব্রহ্মা এইসব তীর্থের মধ্যে পঞ্চম বেদস্বরূপ কপোত নামে তীর্থ রচনা করেন। এই তীর্থে গিয়ে মানুষেরা পাপমুক্ত ও সনাতন গুণের মতো তেজস্বী হয়, ঐ জায়গাতে জপ, হোম ও তপ করলে অনন্ত ফল পেয়ে থাকে। পুণ্ডরীক তীর্থে শ্রাদ্ধ করলে পুণ্ডরীক যজ্ঞের সমান ফল পেয়ে থাকে।

সিন্ধু সাগরে ও পঞ্চনদ তীর্থে সব কাজই অক্ষয় হয়ে থাকে। মাণ্ডবাতীর্থে মানুষ পবিত্র হয়। সপ্তহ্রদ মানস, মহাকূট, বন্দ, ত্ৰিকুকুদগিরি, সন্ধ্যা, এবং মহাবেদী এইসব তীর্থে শ্রাদ্ধ করতে হয়। এখানে একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যায়। এই দুই তীর্থে অশ্রদ্ধাবান ব্যক্তি যেতেই পারে না। এখানে অগ্নির শিলা আছে। শ্রাদ্ধ দান করলে অগ্নিকার্য ও শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়। সায়াহ্নে সদ্যোবরপ্রাপ্ত এক তীর্থ আছে, সেখানে মানুষ কৃতত্মা কি অকৃতাত্মা, তা বুঝতে পারা যায়। সপ্তর্ষিরা ঐ তীর্থে পরস্পর হিংসা ত্যাগ করে স্বর্গে যান।

ঐ জায়গাতে নন্দীশ্বরের যে মূর্তি আছে তা পাপী ব্যক্তির চোখে পড়ে না। সেখানে এক কাঞ্চন যুগ আছে, তা প্রদক্ষিণ করলে মানুষ স্বর্গে যায়। কুরুক্ষেত্র তীর্থে তিল দিয়ে পিতৃগণের অর্চনা করা কর্তব্য। যে ব্যক্তি কুরুক্ষেত্রে বারবার পিতৃশ্রাদ্ধ করে সে পিতার সৎপুত্র ও ঋণমুক্ত হয়। সরস্বতী, ব্যসতীর্থ, গঙ্গা, মৈনাক ও যমুনা তীর্থে শ্রাদ্ধ করা উচিত। যমুনা প্রভাবে শ্রাদ্ধ করলে সব পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এই যমুনা যমের বোন ও মার্তণ্ডর কন্যা। ব্রহ্মতুঙ্গ হ্রদে স্নান করামাত্র তখনই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় ও এখানে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধ, জপ, তপ, হোম সব কাজই অনন্তপ্রাপ্ত হয়। মহাতপ বশিষ্ঠ ঐ তীর্থে স্থানভূত হয়ে আছেন।

ঐ তীর্থের গাছগুলি মণিমণ্ডিত দেখা যায়। পিতৃগণ-এর গণকারী নামে এক যোগ পরায়ণা কন্যা দিলেন। ইনি মহাত্মা ব্যাসকে উৎপাদন করেন। মহামুনি ব্যাসদেব এক বেদকে চারভাগে ভাগ করেন। ব্রহ্মতুঙ্গে অচ্ছোদ নামের সরোবরের তীরে পুণ্যাত্মা ঋষিদের আশ্রম আছে। এখানে একবার মাত্র দেওয়া শ্রাদ্ধ অক্ষয় ফল এবং যোগ ও সমাধি দুই-ই উৎপাদন করে।

নন্দা বেদী নামে একটি তীর্থ আছে। যে দুরাচারী, তারা এই তীর্থ দেখতে পায়না। ধীমান মহাদেব দেবালয়ে একপাদে দাঁড়িয়ে তপস্যা করেন। উমাতুঙ্গ, ভৃগুতুঙ্গ, ব্রহ্মতুঙ্গ, মহালয়, কাত্রবতী, শাণ্ডিলী ও বামগুহা এইসব তীর্থে মানুষ পবিত্র হয়। শ্রাদ্ধ, হোম, তপ, জপ ইত্যাদি অক্ষয় হয়। গুরুভক্ত ব্যক্তিরা ঐ তীর্থগুলিতে একশো বছর ধরে ব্রহ্মচর্য পালন করে আসছেন। ঐ সব তীর্থে স্নান করলে সফল পাওয়া যায়। কালসর্প নামে কশ্যপের মহাতীর্থে ও শালগ্রাম তীর্থে দেওয়া শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়ে থাকে। অসৎ ব্যক্তিরা ঐ তীর্থে যেতে পারে না। ঐ তীর্থে যে হ্রদ আছে সেখানে নাগরাজ সৎ ব্যক্তির দেওয়া পিণ্ড গ্রহণ করেন। ঐ নাগরাজ শ্রাদ্ধে দেওয়া অন্ন খেয়ে শেষ করতে পারে না।

কালঞ্জয়, দশতন, নৈমিষ, কুরুজাঙ্গল, ও বারাণসী তীর্থে যত্নের সাথে শ্রাদ্ধ দান করা কর্তব্য। বারাণসী ধামে যোগেশ্বর সবসময় রয়েছেন। সুতরাং ঐ জায়গাতে দেওয়া শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়। এখানে শ্রাদ্ধ দান করলে মানুষ পবিত্র হয়, অনন্ত ফল লাভ করে। লৌহিত্য, বৈতরণী, স্বর্ণবেদী, সমুদ্ৰান্ত, গঙ্গা, ধর্মপৃষ্ঠ, পয়া, ব্রহ্মসর ও গৃপ্রকূট এইসব তীর্থে শ্রাদ্ধ করলে মহাফলদায়ক হয়। ভারতের পুণ্যাশ্রম সন্নিধামে এক পবিত্র হ্রদ আছে, তা মানস চোখ দিয়ে দেখা যায়। পঞ্চবন তীর্থে পুণ্যবান ব্যক্তিরা থাকেন। এই স্থানে আজ পর্যন্ত পাণ্ডু বিশালতীর্থ আছে। মহাদেব মুণ্ডপৃষ্ঠ তীর্থে বাস করে। অনেক যুগ ধরে কঠিন তপস্যা করেন। ধর্ম পরায়ণ ব্যক্তি সাপের খোলসের মত পাপ ত্যাগ করে।

লেলিহান সাপেরা সবসময় ফণা বিস্তার করে ঐ তীর্থস্থানকে রক্ষা করে। সাপেরা পাপীদের ভয় দেখায় ও সিদ্ধদের আনন্দ দেয়। ত্রৈলোক্য বিখ্যাত কনকনন্দী নামে এক তীর্থ আছে, ঐ তীর্থের উত্তরদিকে দেবর্ষিদের এক তীর্থ আছে। ঐ তীর্থে শ্রাদ্ধ দান করলে স্বর্গ লাভ করা যায়।

উত্তর মানসতীর্থে গিয়ে মানুষ উত্তম সিদ্ধি লাভ করে, ঐ তীর্থে গিয়ে যথাবিহিত শ্রাদ্ধ করলে মোক্ষ লাভ হয়। শ্রেষ্ঠ সরোবর তীর্থ মানসে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। গঙ্গাদেবী সোমপাদ থেকে এসে মাটিতে পড়েছেন। ঐ জায়গা থেকে আকাশে এক সূর্যের মত তোরণ দেখা যায়। ঐ তোরণ স্বর্ণময় ও স্বর্গদ্বারের মত আবৃত। হিমালয়ে নানা ঋতু বিভূষিত, সিদ্ধচারণ সেবিত পর্বতে সুষুম্মা নামে এক সরোবর আছে। এই সরোবরে স্নান করলে মানুষ দশ হাজার বছর বেঁচে থাকে এবং শ্রাদ্ধ করলে অনন্তফলদায়ক হয়। দশ পুরুষ উদ্ধার পায়। পাহাড়ের পাদদেশে, গুহায়, গর্তে, ঝর্নায়, গোষ্ঠে, সঙ্গমে, গৃহে যাথাবিধি সবসময় শ্রাদ্ধ করবে। মানুষ এতে মেধাবী হয়ে ব্রহ্মসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়। বর্ণাশ্রম ধর্ম যেখানে প্রতিষ্ঠিত আছে, তমোগুণ নেই যেখানে সেই জায়গাতেই পিতৃগণ পুজো পেয়ে থাকেন। তীর্থ করে পাপী ব্যক্তিরা যদি শুদ্ধ হতে পারে, তাহলে শ্রদ্ধাবান জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিও তীর্থ সেবা করে শুদ্ধি লাভ করবেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

তীর্থসেবী কখনও কুদেশে জন্মগ্রহণ করেন না, স্বর্গে বাস করেন ও মোক্ষ লাভ করেন। ধ্যানই সনাতন ব্রহ্মতীর্থ। বিষয় ও ইন্দ্রিয়কে সমান করে মনকে বুদ্ধিতে সংযত করলে সকলেরই নিবৃত্তি ঘটে। ইন্দ্রিয় সকলের মধ্যে মনই বুদ্ধি প্রভৃতির জনক। অনাহার থেকে ইন্দ্রিয় বোধের ক্ষয় হয়। তাই অনশনই তপস্যা। ফলে শুদ্ধতা নির্বাণ লাভ করে।

.

আটাত্তরতম অধ্যায়

বৃহস্পতি বললেন–এরপর শ্রাদ্ধের কাজে কোনগুলি পবিত্র ও কোগুলি বর্জনীয় শুনুন। হিম পড়ার সময় হিম নিয়ে এবং হিম অবস্থানে অগ্নিহোত্রী হয়ে শ্রাদ্ধ করা উচিত। এরকম শ্রাদ্ধ পরম পুণ্যজনক। রাত্রিতে শ্রাদ্ধ করা উচিত নয়। রাত্রি ছাড়া অন্য সময়ে রাহু দর্শন ঘটলে সমস্ত ব্যয় করেও শ্রাদ্ধ ও দান করবে। গ্রহণের সময় যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধ করে না সে পাকে নিমজ্জিত গাভীর মত পাপী হয়, বহু মাংস যুক্ত ভোগ্য বিশ্বদেব ও পিতৃগণের প্রিয়, সে বস্তু শ্রাদ্ধে দান করলে অসূয়া নাশ হয়।

একদা ত্বষ্টা মহাত্মা দেবেশ কর্তৃক নিবারিত হয়ে শচীপতির সোমরস পান করে পৃথিবীতে আসেন। পুজোর জন্য শ্যামাক ধান উৎপন্ন হয় আর ভূপতিত ত্বষ্টার নাসারন্ধ্র থেকে আখ জন্মায়। তাই আখ শ্লেষ্ম বর্ধক, শীতল ও মধুর। শ্যামাক ও আখ পিতাদের তৃপ্তি বিধান করে। শ্যামাক, হস্তীনাম, পাটাল, বৃহতীফল ও অগস্ত্যশিখা– এরা খুব তীব্র ও কষায়। এছাড়া শ্রাদ্ধের উপযোগী অন্যান্য ফল আছে, যথা– নাগর, ঘুরস, বংশী করীর ইত্যাদি। শ্রাদ্ধ বর্জনীয় হল–লঘুন, পলাভু প্রভৃতি। কেন এগুলি শ্রাদ্ধে বর্জনীয় তা বলছি।

আগে দেবাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় বলির ক্ষতযুক্ত ব্রণ থেকে রক্ত পড়ছিল, তা থেকেই এসব দ্রব্যের উৎপত্তি, এজন্য এরা শ্রাদ্ধে অচল। যে কোন রকম নির্যাস, লবণ, দুর্গন্ধযুক্ত দ্রব্য, যে জলে গরু তৃপ্তি পায় না, যে জল রাত্রে তুলে রাখা হয় সেই জল এবং উট, মোষ ও চমরীর দুধ শ্রাদ্ধে লাগেনা। বন্য ফলমূল এনে শ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রাদ্ধ করা উচিত।

কোনো জন্তু-জানোয়ার পূর্ণ দেশে বা দুর্গন্ধ যুক্ত ভূমিতে শ্রাদ্ধ করা যায় না। সাগর পর্যন্তগামী নদীগুলির তীর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের দ্বার ত্রিশঙ্কু দেশ শ্রাদ্ধে বর্জনীয়। কলিঙ্গ ও সিন্ধু নদীর উত্তর ভাগ এবং আশ্রম ধর্মহীন দেশ গুলি সযত্নে পরিত্যাগ করা উচিত। নগ্ন বা উলঙ্গ প্রভৃতি লোক শ্রাদ্ধ দেখবে না। এই লোকেদের দেখা শ্রাদ্ধের দ্রব্য পিতৃপুরুষ পান না।

বৃহস্পতি বললেন–ত্রয়ী সমস্ত ভূতের আবরণ স্বরূপ সেই ত্রয়ী বা বেদ যারা পরিত্যাগ করে, এরাই নগ্ন বা উলঙ্গ। যারা ধর্মরূপী বৃষকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র বেদ প্রভৃতিতে মোক্ষ প্রাপ্তির চেষ্টা করে, তারা মোক্ষ প্রাপ্তির যোগ্য হতে পারে না। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র- এই চারবর্ণ পূর্বে দেবাসুর দ্বারা পাষণ্ড রূপে পরিণত হয় এবং এই সৃষ্টি স্বয়ম্ভুকৃত নয়। এই অবসাদে তারা শ্রাদ্ধবিহীন ও ধর্মশাস্ত্রহীন হয়ে স্বেচ্ছাচারে জীবনযাপন করে।

যারা নিজের ধর্ম আচরণ করে না, তারাই নগ্ন। তাই এই চারজাতি নিজেদের ধর্মভ্রষ্ট হয়ে নগ্নবেদ বলে বিবেচিত হয়েছিল। বৃথাজীবি, বৃথামুন্ডী, বৃথানগ্ন, বৃথাব্রতী, বৃথা জাপী এরা নগ্ন। কুপথগামী মানুষেরও শ্রাদ্ধ বৃথা, এছাড়া অন্যান্য পাপকর্মকারী, দেবর্ষি নিন্দুক, অসুর শ্রাদ্ধে বর্জন করা উচিত।

পিতৃগণ বলেন, কৃতযুগে বেদ পূজা করা হয়, ত্রেতায় পূজাপান দেবতারা, দ্বাপরে যুদ্ধবিদ্যা ও কলিকালে শুধু পাষণ্ডরা পূজার পাত্র। অপবিত্র মানুষ, কুকুর, শূকর- এরা শ্রাদ্ধ দর্শন করা মাত্র শ্রাদ্ধ পণ্ড হবে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

জমাট বাধা ঘি দিয়ে শ্রাদ্ধ করা ঠিক নয়। সাদাসর্ষে ও তিল ছড়িয়ে দেবে। শ্রাদ্ধের দ্রব্যগুলির মধ্যে যদি কিছু শুষ্ক, বা বালু, কঙ্কর, কেশ, কীট থাকে তবে তা বর্জন করবে। দই শাক প্রভৃতি বস্তু শ্রাদ্ধে বর্জনীয়। সেদ্ধ বলবন ও মাসমন্ডব লবণ, এই দুই বস্তু প্রত্যক্ষ লবণ পেলেও পরম পবিত্র, এই সব লবণ শ্রাদ্ধে দেওয়া উচিত। শ্রাদ্ধীয় দ্রব্য ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত। মাটির পাত্র আবার পুড়িয়ে নিলে শুদ্ধ হয়। ছাই দিয়ে কাঁপাসিক দ্রব্যের শুদ্ধি হয়, লেপনের সাহায্যে মাটি শুদ্ধ হয়।

সাধু ব্যক্তিরা তীর্থ ক্ষেত্রে সবসময় কমণ্ডলু রাখবেন। পাদ প্রক্ষালন ইত্যাদি শৌচ কমণ্ডলু দিয়ে করবেন, কুকুর ও চণ্ডালকে ছুলে ব্রতচারণ করবেন। মানুষের অস্থি স্পর্শ করলে শুদ্ধির জন্য উপোস করতে হয়। বেদপারগ শিষ্ট সাধুরা পাপদেশ বর্জন করবে। পাপসঙ্কুল দেশে বাস করলে মহাপাপ হয়। অবঞ্চকারী ও পাপীদের তির্ষক যোনিতে জন্ম হয়। অশুচি জনকে শুদ্ধ করলে সে স্বর্গলাভ করে। দেবতারা শুচি কামনা করেন।

.

উনআশীতম অধ্যায়

ঋষিরা বললেন–আপনি সমস্ত শ্রাদ্ধ কল্প বলেছেন, এবার অবশিষ্ট ঋষিমত বলুন। সূত বললেন–হে বিপ্রগণ! অবশিষ্ট ঋষিমত বিস্তারিত বলছি, শুনুন। আগে শ্রাদ্ধ, শুনুন। আগে শ্রাদ্ধ বিধির কথা বলেছি, এবার ব্রাহ্মণের কথা বলব। দেব ও পিতৃ কাজে ব্রাহ্মণদের পবিত্র হতে হয়। ব্রাহ্মণের যদি দোষ দেখা যায়, যিনি সাধু সমাজ থেকে বর্জিত, আর যিনি জেনেও পতিত লোকের সাথে মেলামেশা করেন সেই ব্রাহ্মণ শ্রাদ্ধে বর্জনীয়। শ্রাদ্ধ গ্রহণ করার জন্যে যত্নের সঙ্গে ব্রাহ্মণের পরিচয় নেওয়া দরকার। পণ্ডিত ব্যক্তিরাই অপরিচিত ব্রাহ্মণকে পরীক্ষা করবেন।

সিদ্ধগণ বিপ্ররূপ নিয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করেন। এজন্য গৃহস্থরা হাতজোড় করে বাড়িতে আগত অতিথিকে অভ্যর্থনা করবেন। পা ধুইয়ে, খাইয়ে তাঁকে পুজো করবেন, দেবতারা নানা রূপ ধরে এই পৃথিবীতে বিরাজ করেন। বিপ্র অতিথিকে ভক্তিভরে পুজো করে নানা ব্যঞ্জনের সাথে খেতে দেবেন, অতিথিকে দুধ দান করলে অগ্নিষ্টোম ফল, ঘৃত দান করলে দিব্য দৃষ্টি, মধুদান করলে অধিরাত্র ব্রত ফল লাভ হয়।

যে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি ভক্তির সাথে ব্রাহ্মণ ভোজন করান, তিনি সমস্ত যজ্ঞেরই ফল লাভ করে থাকেন। দেব, পিতৃ ও বহ্নি–এরা ব্রাহ্মণের রূপে ভোজন করেন। এরা পূজিত হয়ে মানুষকে ইচ্ছেমতো ফলদান করেন, তাই গৃহস্থ ব্যক্তি সর্বস্ব ব্যয় করেও অতিথি সৎকার করবে। বানপ্রস্থ, গৃহস্থ, গৃহাগত, দীনবালক, ও যতিদেয়, অতিথি বলে জানবে। অতিথি পরম যোগী স্বরূপ। অতিথি-সুদৃশ্য, সুবিদ্য, বিশেষজ্ঞ, সন্তান সমুদ্ধ, আচারবান না হলেও, সে যদি শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত হয়, তবে তাকে যথাযথ সেবা ও দান করা উচিত।

এরকম করলে যজ্ঞফল লাভ হয়। ভৃগুতুঙ্গে আরোহণ এবং পুণ্য সরস্বতী, পুণ্য মহানদী, গঙ্গা, হিমাচল থেকে নির্গত অনান্য নদী এবং অন্যান্য সমস্ত তীর্থে, ঋষি পূজিত সরোবরে মানুষ স্নান করে পাপমুক্ত হয়। স্বর্গলোকে পূজিত হন। ব্রাহ্মণদের মৃতাশৌচ ও মৃতকাদের অশৌচ দশরাত, ক্ষত্রিয়দের বারোরাত, বৈশ্যদের অর্ধেক মাস ও শূদ্রের একমাস। মৃতিকা, কুকুর, নাপিত, নগ্ন এবং শব বাহকদের স্পর্শ করলে গায়ে বারে বারে মাটি দিয়ে স্নান প্রয়োজন শ্রাদ্ধের কাজে সবকিছু জল দিয়ে পরিষ্কার করা একান্তই প্রয়োজন।

বেদীর উত্তর দিকে সাজাতে হবে, দক্ষিণ দিকে বিসর্জন দিতে হবে। ডানহাত দিয়ে ডানদিকের বেদীতে লিখবে, খাওয়ার পরা আচমন না করলে, ইদ্দিষ্ট স্পর্শ করলে, পা ধুলে ও অধর্মাচরণ করলে অশুচি হয়। পূর্ব মুখে বা উত্তর মুখে নতজানু হয়ে শুদ্ধ জায়গাতে বসে হাত-পা ধুয়ে জল স্পর্শ করবে। পরে স্থির শান্ত হয়ে বসে তিনবার স্বচ্ছ জল পান ও দুবার মার্জন, একবার প্রক্ষালন এবং শেষে নিজের মাথা, হাত ও পা ধোবে। এরকম আচমন করলে শ্রাদ্ধকর্তার বেদ, যজ্ঞ, অপ, দান ও ব্রহ্মচর্য সফল। আচমন না করে, কাজ শুরু করলে, কাজই বৃথা। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে অন্ত্যজদের খাওয়ায়, সে দুরাত্মা। যে মানুষ উঁচু ও নিচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের এক সারিতে খাওয়ায় তাকে পাপ স্পর্শ করে। জ্ঞানী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের স্থান সকলের আগে। যে দ্বিজোত্তম ইতিহাস, পঞ্চমবেদ সব পাঠ করেন, জ্ঞানী ব্যক্তির তাঁকেই শ্রাদ্ধকার্যে নিয়োগ করা উচিত। এবার পরক্তিতে ব্রাহ্মণদের স্থানের কথা বলছি। প্রথম যাদের কথা বলা হয়েছে তারা এবং ষড়ঙ্গী বিনয়ী, যোগী, সর্বতন্ত্র ও যাযাবর– এই পঞ্চ ব্রাহ্মণ পরক্তি পাবেন। আঠারো বিদ্যায় পারগামী যে ব্রাহ্মণ, তিনি পাবেন।

অতিথি, ব্রহ্মচারী, ধ্যাননিষ্ঠ, ধার্মিক, বালখিল্যদের শ্রাদ্ধে খাওয়ানো উচিত। বানপ্রস্থরা পূজামাত্রে তুষ্ট হন। গৃহস্থ ভোজন করালে বিশ্বদেবরা পূজিত হন। বানপ্রস্থরা পূজিত হলে ঋষিরা, বালখিল্যরা পূজিত হলে পুরন্দর, যোগীদের পুজো করলে ব্রহ্মা সাক্ষাৎ পূজিত হয়। পাঁচটি পবিত্র আশ্রমের মধ্যে দেব ও পিতৃ কাজে চারটি আশ্রম পূজণীয়, যারা চার আশ্রমের বাইরে তারা ক্ষুধার্ত হলেও দান করবে না। প্রতিদিন এক ব্রাহ্মণকে শ্রাদ্ধকর্মে নিমন্ত্রণ করবে না; যে ব্রাহ্মণ প্রতিদিন শ্রাদ্ধে অন্ন খেয়ে থাকেন, তিনি কৃষ্ণবর্ণ হন। যে ব্রাহ্মণ শূদ্রের সঙ্গে ভোজন করে থাকেন, তিনি পংক্তিস্পৃষক। কৃষি, বাণিজ্য ও পশুপালন এগুলি ব্রাহ্মণের কাজ নয়। মিথ্যাচারী– দুবৃত্ত, দাম্ভিক, লোভমোহ কলার্থী, ব্রহ্মবিক্রয়ী ব্রাহ্মণ শ্রাদ্ধে বর্জনীয়।

এঁদের নিয়োগের কোনও বিধি বেদে নেই। যদি কোন ব্যক্তি এদের শ্রাদ্ধের মাঝে নিয়োগ করেন তিনি পাপাচারী হবেন। এরকম ব্রাহ্মণকে শ্রাদ্ধে খাওয়ালে দাতা দানফল থেকে বঞ্চিত হয়। যে ব্যক্তি বেতন প্রার্থীর কাজে অধ্যয়ন করে, যিনি বেতন নিয়ে অধ্যাপনা করেন– এরা উভয়েই শ্রাদ্ধ বর্জনীয়। ব্রাহ্মণ জীবিকার জন্য কেনা বা বিক্রয় করেন কিছু তাহলে নিন্দনীয় হন। কারণ ক্রয়-বিক্রয় বৈশ্য শ্রেণী জীবিকা। এতে ব্রাহ্মণের দোষ হয়। যিনি বেদপাঠ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, যিনি বৃথা যজ্ঞে গমন। করেন, যিনি নাস্তিক– এঁরা সকলেই শ্রাদ্ধ বর্জনীয়।

যিনি নিজের জন্যই রান্না করেন, দেবতা বা অতিথির জন্য নয়, তিনি শ্রাদ্ধ আমন্ত্রিত হওয়ার উপযুক্ত নয়। ব্রাহ্মণ শূকরের মতো বিকৃতভাবে ভোজন করেন তার হাতের শ্রাদ্ধ পিতৃগণ গ্রহণ করেন না। শ্রাদ্ধ উচ্ছিষ্ট দ্রব্য স্ত্রীলোক বা শূদ্রকে দান করতে নেই। দই ও ঘি মিশিয়ে তা ছেলে বা শিষ্যকে দেবে। ভাত যদি পবিত্র হয় ও গরম থাকে, তা হলেই পিতৃগণ খেয়ে থাকেন। দান, হোম, ভোজন ও বলি ইত্যাদি হাত ও হাতের আঙুল দ্বারা সুচারু রূপে করবে। এই সব কাজ হাঁটুমুড়ে বসে যথা নিয়মে আচমন করে করবে। এরকম করলে শ্রাদ্ধে অসুরদের কাছ থেকে ভয় থাকে না।

যে জ্ঞানবান, ধ্যাননিষ্ঠ, ও দেবভক্ত ও সবসময় ব্রতচারণ করেন, তাঁদের দেখেই জনগণ পবিত্র হয়, চরাচর জগৎ যোগেশ্বর দিয়েই ব্যপ্ত। ঐ সর্বজ্ঞ মহাত্মাদের থেকেই মহাত্মাদের মোক্ষ ইত্যাদি সবরকম। জ্ঞান হয়। তাঁদের পবিত্র গুণে আসক্ত হয়ে তোক সকল শুভ লাভ করে থাকে। যিনি ঋক জেনেছেন, তিনি বেদও জেনেছেন, যিনি যজুর্বেদ জানেন, তিনি অবশ্যই যজ্ঞ জানেন। যিনি সামবেদ জানেন, তিনি নিশ্চয়ই ব্রহ্মবিদ এবং যিনি মানস জানেন, তিনি সমস্তই জানেন।

.

আশীতম অধ্যায়

বৃহস্পতি বললেন– শ্রাদ্ধ সম্বন্ধীয় দান ও তার ফলের কথা এবার বিস্তারপূর্বক বলছি। ইহলোকে যা শ্রেষ্ঠতম, যা নিজের প্রিয়বস্তু, সেসব বস্তু পিতৃগণের অক্ষয় তৃপ্তির জন্য তাদেরকে দান করা কর্তব্য। যে মানুষ শ্রাদ্ধের কাজে নতুন বস্ত্র দান করে, তার আয়ু, প্রচুর-ঐশ্বর্য, রূপ এবং পুত্র লাভ হয়। যে মানুষ শ্রাদ্ধ কালে উপবীত দান করে সে নিখিল বিপ্রকে ব্রাহ্মদান করার ফল লাভ করে। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে কমণ্ডলু দান করে, সে দুগ্ধবতী গাভী তার ফলরূপে পেয়ে থাকে। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে ফুলমালা দিয়ে সজ্জিত সম্পূর্ণ শয্যা দান করে, সে পরলোকে দিব্য প্রাসাদ পায়।

যে মানুষ শ্রাদ্ধে যতিদের শয্যা, আসন ও ভোজ্যের সাথে রত্নপূর্ণ ভবন দান করে তার স্বর্গলোকে গতি হয়। সে মুক্তা বসান নানা রত্নযুক্ত, চন্দ্ৰসূর্যের সমান প্রভাব বিশিষ্ট দিব্য বিমান লাভ করে। ঐ বিমানে অপ্সরাগণ তাকে ঘিরে স্তব করে। সুগন্ধি দ্রব্য গায়ে ছড়িয়ে দেয়, কখনো পুষ্পবৃষ্টি করে, কখনো গন্ধবদের সাথে গান করে। যে মানুষ হাজার ঘোড়া ও হাজার হাতি দান করে সে যোগিনীদের সঙ্গে বাস করে। যে মানুষ যোগী পিতৃগণের উদ্দেশ্যে দীপ দান করে, সে প্রচুর স্বর্ণলাভ করে। অবশ্য জীবন দান করার মতো উৎকৃষ্ট দান আর নেই। প্রাণীদের জীবনদানই অতি পরম দান। অহিংসা সমস্ত ফল দান করে।

শ্রাদ্ধে সোনার পাত্রে দান করবে। সুবর্ণপাত্রে দান করলে দাতা রথ, ভক্ষ্য ও সৌভাগ্য লাভ করেন। শ্রাদ্ধ ভোজনে আসবাবপত্রাদি দান করতে হয়। তাহলে তার ইচ্ছেমত ধন লাভ হয়। শ্রাদ্ধের কাজে সোনা, রূপার জিনিস দান করলে দাতা যথেচ্ছ ধর্ম লাভ করেন। যে ব্যক্তি হেমন্ত ও শীত ঋতুতে ব্রাহ্মণদের কাঠ ও আগুন সংগ্রহ করে দেন, তিনি নিত্যই সংগ্রামে জয়লাভ করেন। এবং সুশ্রী হয়ে দীপ্তি পেয়ে থাকেন।

যে ব্যক্তি সুগন্ধি পাত্রের সঙ্গে ফুলমালা দান করে সে নানা সুখভোগ করে। তার অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। যে দ্বিজ শ্রাদ্ধে ঘৃতপূর্ণ পাত্র দান করেন তার ধেনুদানের পুণ্য লাভ হয়। শ্রাদ্ধে আকাঙিক্ষত বস্তু দান করলে পুণ্ডরীক যজ্ঞের এবং রম্য গৃহদান করলে রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়।

ফলফুল দীপদান করলে সৌরভ লাভ হয়, কূপ, তড়াগ, ক্ষেত্র, গৃহদান করলে স্বর্গে গিয়ে আনন্দ পেয়ে থাকেন। শ্রাদ্ধে রত্নভূষিত শয্যা দান করলে পিতৃগণ সন্তুষ্ট হন, দাতার অনন্তকাল স্বর্গ বাস হয় এবং দাতাকে রাজাদের সঙ্গে পূজা করা হয়।

কৌশেয় বস্ত্র, কম্বল, অজিল সোনার কাপড়, মৃগলোম এইসব দান বস্তু বিপ্রগণকে ভোজনের পরে দান করলে শ্রাদ্ধকারী ব্যক্তি বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ করে থাকেন। ইহলোকে স্ত্রী, পুত্র নিয়ে আনন্দে থাকেন। কৌশেয়, ক্ষৌম ও কার্পাস এইসব বস্ত্র শ্রাদ্ধে যে ব্যক্তি দান করে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। অলক্ষ্মী দূর হয়ে যায়। বস্ত্র হল সর্বদেবময়, বস্ত্র দান ছাড়া যজ্ঞ, তপস্যা, শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হয় না। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে বস্ত্র দান করে সে যজ্ঞ, দান ও তপশ্চরণের ফল লাভ করে।

যব, ঘি, শর্করা, মধুপক্ষর, জল, পায়েস যে দান করে সে তার ইচ্ছেমত বস্তু, স্বর্গরাজ্য লাভ করে। ঘি দিয়ে ব্রাহ্মণ ভোজন করাতে হয়। গয়াশ্রাদ্ধে হাতি দান করলে তাকে কখনো শোক করতে হয় না। জল, পায়েস, মধু, ফল ও নানারকম ভক্ষ দ্রব্য শ্রাদ্ধে দান করে, ইহলোকে সে পরলোকের আনন্দ পেয়ে থাকেন। স্নিগ্ধ বস্তু, দইযুক্ত খাবার বিপ্রদের ভোজন করাতে হয়। শ্রাদ্ধে যত্নের সাথে সব শস্য দান করতে হয়। হাত জোড় করে অতিথিকে খাবার জন্য আসন গ্রহণ করতে বলা কর্তব্য।

ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে গরমভাত ও স্নিগ্ধ ব্যঞ্জন গ্রহণ করতে অনুরোধ করতে হয়। অন্নদান-এর মতো উৎকৃষ্ট দান আর নেই। অন্ন থেকেই সমস্ত প্রাণী জন্মে ও জীবিত থাক। অন্নদান-এর অর্থ জীবন দান। অন্ন থেকেই ত্রৈলোক্য বেঁচে আছে, অন্নই সাক্ষাৎ চরাচর বিশ্ব বিস্তৃত হয়েছে। তাই অন্ন থেকে উৎকৃষ্ট দান আর হবে না।

পিতৃভক্ত মানুষ এই পৃথিবীর যাবতীয় রত্ন, বাহন ও স্ত্রী খুব তাড়াতাড়ি লাভ করে। অতিথিকে অশ্রয় দেওয়া উচিত। হাজার হাজার অতিথি দিব্য আতিথ্য লাভ করা জন্য প্রতীক্ষা করে আছেন। যেসব দানের কথা বলা হল, যে ব্যক্তি ঐসব দান করে, সে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজা হয়। সকার পূর্বক দানই পরম ধর্ম। পিতৃভক্ত মানুষ মনে মনে যা কামনা করেন, পিতৃদেবরা তাই দান করেন।