বায়ু পুরাণ ৩১-৪০

একত্রিংশ অধ্যায়

সূত বললেন–আগের মন্বন্তরে ভগবান প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করলে তা থেকে প্রথমে জল ও পরে দেব, অসুর, মানুষ সৃষ্টি হয়। এরপর তিনি পিতৃগণের জন্ম দিলেন। ব্রহ্মা বললেন–দেব, মানুষ, অসুর–সবার আমি পিতা। এই ভাবনা থেকে মধু প্রভৃতি দুটি ঋতুর জন্ম হল। বৈদিকী শ্রুতি আছে — ‘ঋতু সকল পিতৃদেব’। অতীত, অনাগত সব মন্বন্তরে এদের জন্ম। এঁদের নাম অগ্নিস্বাক্ত ও বহিষদ। অগ্নিব্যাক্ত নামে প্রসিদ্ধ পিতারাই অনাহিতাগ্নি আর যস্বা। সোমপীথী তাঁরা বহির্ষদ নামে অগ্নিহোত্রী বলে খ্যাত। চৈত্র-বৈশাখ-রস, জৈষ্ঠ্য-আষাঢ়-অগ্নি, শ্রাবণ-ভাদ্র-জীব, আশ্বিন-কার্তিক-সুধা, অগ্রহায়ণ পৌষ-মনু এবং মাঘ-ফাল্গুন-ঘোর শিশিরস্বরূপ। এই ঋতুগুলি ব্রহ্মার অভিমানী ছেলে, মাসার্ধকালে ঋতু অতিব রূপ পান আর স্থান ছাড়া তারা অভিমানী হয়ে থাকেন। অহোরাত্র মাস, ঋতু, অয়ন ও সংবৎসর এইসব কালের রূপগুলি কালবিস্থাভিমানী, নিমেষ, কলা, কাষ্ঠা, মুহূর্ত, দিন ও রাত্রি ব্রতে যে সব কালের রূপ রয়েছে, তাদের কালাত্মক বলে–তাঁদের নাম কীর্তন করছি, শুনুন। পর্ব, তিথি, সন্ধ্যা, মাসার্ধ নামে পক্ষ, নিমেষ, কলা, কাষ্ঠা, মুহূর্ত, দিন, রাত্রি দুই অর্ধেক মাসে একমাস, দু’মাসে এক ঋতু, তিন ঋতুতে এক অয়ন, দক্ষিণ ও উত্তর নামে অয়নদ্বয় নিয়ে এক বছর। এক বৎসরকে সুমেক বলা হয়। ঋতুগুলি সুমেকপুত্র, এরা ছয় ও আটভাগে বিভক্ত। ঋতুদের পাঁচ ছেলে, তাদের আর্তব বলা হয়। আর্তব থেকে জাত স্থানু জঙ্গম সকলেই আর্তবেয়। আর্তব পিতাদের মত, ঋতুগুলো পিতামহের মত, আগে সবাই সুমেক থেকে উৎপন্ন হয়ে মারা যায়। সুমেক প্রজাদের পিতামহ। প্রজাপতি সম্বৎসর স্বরূপ আর সম্বৎসর অগ্নি ও ঋতুস্বরূপ। ঋতু থেকে ঋতুদের জন্ম। এজন্য এদের নাম ঋতু। মাসগুলো ষড়ঋতু বলে নির্দিষ্ট। পাঁচটি আর্তব ঐ ষড়ঋতুর সূতস্থানীয়। দ্বিপদ, চতুষ্পদ, পাখি, সাপ ও স্থাবরদের পুষ্পকেই কালার্তিব বলা হয়। ঋতু আর আর্তবদের পিতা বলা হয়।

সব মন্বন্তরেই অগ্নিত্তা ও বহিষদ নামে দুজন পিতৃপুরুষ রয়েছেন। এই দুই পিতা থেকে দুই কন্যা জন্মান। এঁরা হলেন মেনা ও ধারিণী। এঁরাই বিশ্ব পোষণ করেন। পিতারা ধর্মের জন্য এই দুই কন্যা প্রদান করেন। মেনা নামক কন্যাকে হিমবানের হাতে সম্প্রদান করে। মো ও হিমবানের পুত্র মৈনাক, সরিদ্বরা গঙ্গা লবণোদধির স্ত্রী। ক্রৌঞ্চি মৈনাকের ছোটভাই। এই ক্রৌঞ্চ থেকেই ক্রৌঞ্চ দ্বীপ। মেরুপত্নী ধারিণী মন্দর নামে পুত্র ও তিনটি কন্যার জন্ম দেন। তিন কন্যার নাম বেলা, নিয়তি আয়তি। ধাতা ও বিধাতা বিবাহ করেন, আয়তি ও নিয়তিকে। এদেরও সন্তান সন্ততি আছে। বেলা ও সাগরের এক অনিন্দিতা কন্যা হয়। সাবণী নিজের সামুদ্ৰী নামে কন্যাকে বৰ্হির হাতে সম্প্রদান করেন। তা থেকে দশজন পুত্র জন্মায়। এদের বলা হয় প্রাচেতন। চাক্ষুষ মনুর সময়ে ত্র্যম্বকের অভিশাপে দক্ষ তাদের পুত্র হয়ে জন্ম নিলেন।

একথা শুনে সূতকে জিজ্ঞাসা করলেনহে সূত, দক্ষ কিভাবে শাপভ্রষ্ট হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন? সূত বলতে লাগলেন–দক্ষ প্রজাপতির আট মেয়ে। কন্যাদের তিনি নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে সম্মান দিয়ে রেখে দিলেন। এঁদের মধ্যে অতীজ গজ্জননী ত্র্যম্বক–পত্নী। কিন্তু রুদ্রের ওপর রাগ করে সতীকে বাড়িতে আনলেন না। কারণ সতীর পতি কখনো দক্ষকে প্রণাম করতেন না। জামাই হয়েও শ্বশুরের ওপর দাপট দেখাতেন। সতীকে নিমন্ত্রণ করা না হলেও অন্য বোনেরা এসেছে শুনে তিনি পিত্রালয়ে এলেন। কিন্তু দক্ষ তাকে যথাযোগ্য সম্মান জানালেন না। সতী দুঃখ পেয়ে বললেন– আমার বোনেরা যা সম্মান পাচ্ছে, আমি বড় মেয়ে হয়েও সেই সম্মান পেলাম না কেন? দক্ষ বললেন–হে সতী, তুমি আমার বড় মেয়ে বটে, কিন্তু তুমি ছাড়া আমার অন্য মেয়ের জামাইরা আমার মনের মত। তারা তপোনিষ্ট, মহাযোগী, ধার্মিক, গুণী, বশিষ্ঠ, অত্রি, পুলহ, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, ক্রতু, ভৃগু ও মরীচি–এরা আমার শ্রেষ্ঠ জামাই। শিব আমার প্রতিকূল হলেও শিবের প্রতি তোমার অনুরাগ বেশি। তাই আমি তোমার পক্ষপাতী নই। দক্ষ যেন শাপগ্রস্থ হওয়ার জন্যই একথা বললেন।

সতী তখন বললেন–আপনি বিনা দোষে আমায় অপমানিত করলেন, এখন আমি এই কলুষিত দেহ ত্যাগ করব। সতী মনে মনে মহেশ্বরকে প্রণাম করে বললেন–আমি জ্যোতির্ময়ী মূর্তিতে আবার জন্ম নেব আর ভগবান ত্র্যম্বকের ধর্মপত্নী হব। তিনি মনে মনে অগ্নির ধারণা করা মাত্র, দেহ ভস্মীভূত হয়ে গেল তার। এদিকে শূলধারী শঙ্কর দেবীর নিধন সংবাদে ভীষণ রেগে বললেন–তুমি যেমন আমার সতীকে অপমানিত করে অন্য জামাইদের অপমানিত করেছে। এর ফলস্বরূপ বৈবস্বত যুগে তোমার অনুগত মহর্ষির মৃত্যুকবলিত হয়ে আবার দ্বিতীয় যজ্ঞে অযোনিজ হয়ে জন্ম নেবে। ভগবান ব্রহ্মা দক্ষযজ্ঞে হোম করেছিলেন তখন ঋষিদের একথা বলেন মহাদেব। তারপর দক্ষকে বলেন- প্রচেকতার পুত্র চাক্ষুষ নামে এক রাজা হবে। সে তোমাকে বৃক্ষনন্দিনীর মারিষ্যার গর্ভে জন্ম দেবে। দক্ষ রেগে গিয়ে বললেন–আমি সে জন্মেও তোমার সব কাজে বাধা দেব। আর যে সমস্ত ঋষিদের তুমি তিরস্কার করছ, তার ফল স্বরূপ ব্রাহ্মণরা দেবতাদের সঙ্গে তোমার পূজা করবে না। তারা আহুতি দিয়ে যজ্ঞকুণ্ডে জল ঢেলে দেবে। সুতরাং তোমাকে স্বর্গ ছেড়ে মর্তেই বাস করতে হবে।

রুদ্র বললেন–মূঢ়, ভূর্লোক সকলের শ্রেষ্ঠ। দেবতাদের চারবর্ণ আছে। তারা সকলে এক সাথে খেয়ে থাকে। আমি তাদের সঙ্গে ভোজন করি না। তারাই আমাকে আলাদা ভোজন করিয়ে থাকেন। পূজা বা হবিষ্যি আমি আলাদা ভাবে গ্রহণ করি। যাই হোক, দক্ষ রুদ্রের কাছে তিরস্কৃত হয়ে মানুষ জন্ম নিলেন এবং দেবতাদের সঙ্গে মহাযজ্ঞ শুরু করলেন। এদিকে সতী পরের জন্মে মেনকার গর্ভে উমাদেবী হিসেবে জন্ম নিলেন। একই দেবী আগে সতী পরে উমা। যেমন দিতি মারীচ কাশ্যপকে, লক্ষ্মীনারায়ণকে, কীর্তি বিষ্ণুকে, রুচি সূর্যকে আর অরুন্ধতী বশিষ্ঠকে যেমন কোনোভাবে ত্যাগ করেন না। এরা তেমনই কল্পে কল্পে আবার নিজ নিজ স্বামীর সাথে মিলিত হন। তেমনি সতী ভবের সহধর্মিণী। এরপর দক্ষ রুদ্রের শাপে দশ প্রচেতার পুত্র রূপে মার্ষার গর্ভে জন্ম নিলেন। ভৃগু প্রভৃতি ঋষিরা বৈবস্বত মনুর কালের আগে ত্রেতাযুগে বরুণের মতো রূপধারী দক্ষযজ্ঞে জন্ম নিলেন।

এইভাবে দক্ষ ও রুদ্রের বিবাদ জন্মান্তরেও চলতে থাকল। রাগ বা হিংসা করা উচিত নয়। কারণ তা জন্মান্তরেও লোপ পায় না। ঋষিরা বললেন–হে সূত! বৈবস্বত মনুর অধিকারকালে কিভাবে দৃক্ষের অশ্বমেধ যজ্ঞ বিনষ্ট হল? বিধ্বস্ত যজ্ঞ কিভাবেই বা শেষ হল? কিভাবেইবা দক্ষ ক্ষুব্ধ রুদ্রকে খুশি করলেন? এসব আমরা জানতে চাই। সূত বললেন–আগে দেবাদিদেব সর্বরত্নবিভূষিত জ্যোতিষ্ক নামে মেরুশৃঙ্গে পালঙ্কে বসেছিলেন, সেখানে শৈলরাজের কন্যা সবসময় তার পাশে থাকতেন। সেই সময় আদিত্যরা, বসুরা, দুইজন অশ্বিনীকুমার, সনৎকুমার প্রভৃতি ঋষি, গন্ধর্ব, নারদ, পর্বত, অপ্সরারা সকলে সেখানে এলেন। সেখানে সুগন্ধ যুক্ত বাতাস বইছে চিরদিন। সব ঋতুতেই ফুল ফলে ভরা। তপস্বীরা পশুপতির উপাসনা করতে থাকলেন আর রাক্ষস, ভূত, মহাকাল পিশাচেরা মহাদেবের অনুচরের কাজ করতে লাগল। ভগবান নন্দীশ্বর মহাদেবের কাছে থেকে তাঁর আদেশ পালন করতে থাকলেন।

স্বয়ং সতীর্থময়ী গঙ্গা দেবের আরাধনা করতে লাগলেন। প্রাচীন কালে দক্ষযজ্ঞ হিমালয়ে গঙ্গাতীরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই যজ্ঞে শোনা যায় অনলকান্তি, শতক্রতু দেবতারা জ্বলন্ত আগুনের মতো নিজস্ব বিমানে গঙ্গাদ্বারে এসেছিলেন। তখন পৃথিবীবাসী, অন্তরীক্ষবাসী ও স্বলোকবাসী সকলেই ধার্মিক দক্ষের প্রশংসা করে। আদিত্য, বসু, রুদ্র, সাধ্য ও মরুতরা সকলে দেব বিষ্ণুর সাথে যজ্ঞভাগ নেবার জন্য সেখানে এলেন। পিতা ব্রহ্মার সাথেও অনেকে এলেন। এছাড়া ভূত, বায়ুজ, উদ্ভিজ্জ প্রভৃতি প্রাণীরাও এসেছিল। নিজ নিজ পত্নীদের সঙ্গে দেবরা সেখানে বিরাজ করতে লাগলেন। সে সময় দধীচি সব দেখে প্রজাপতিকে বললেন–আপনি সর্বপূজনীয় দেব পশুপতিকে নিমন্ত্রণ করেননি কেন? দক্ষ বললেন–এগারো প্রকার অবস্থা প্রাপ্ত শূলপাণি কপর্দী রুদ্র আমার আছে। অন্য মহেশ্বর আমি জানি না। দধীচি বললেন–শঙ্করের থেকে উৎকৃষ্ট দেবতা তো আমি আর দেখি না। তাকে ছাড়া কি যজ্ঞ হয়? দক্ষ বললেন–আমি এই যজ্ঞের সব উপকরণ সোনার পাত্র শ্রীবিষ্ণুকেই অর্পণ করব। দেবতারা সব দক্ষের যজ্ঞভূমিতে আসছে দেখে শৈলরাজ সুত হরকে জিজ্ঞাসা করলেনভগবান, এই দেবতার কোথায় যাচ্ছেন? মহেশ বললেন–দক্ষ নামে এক প্রজাপতি অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন, দেবতারা সেখানেই চলেছেন। দেবী বললেন–হে মহাজন, আপনার কেন এই যজ্ঞে যাওয়া হল না? মহেশ্বর বললেন–দেবতারাই কোনও যজ্ঞে আমার ভাগ কল্পনা করেন না। যজ্ঞভাগ্ আমাকে দেন না।

দেবী বললেন–আপনি তো সবথেকে প্রভাশন অজয়, তেজ যশ সম্মানিত। এতগুণ থাকতেও আপনাকে যজ্ঞভাগ দেয় না শুনে আমি দুঃখিত, বিচলিত। এমন কোনও তপস্যা, দান বা নিয়ম আছে, যা করলে আপনি যজ্ঞের দ্বিতীয় বা তৃতীয় অংশ লাভ করতে পারেন? দেবীকে দুঃখিত দেখে ভগবান দেবেশ হেসে বললেন–তুমি কি জানো না তোমার এমন কথা বলা সাজে না। আমার মোহে ত্রিলোকেই মুগ্ধ হয়েছে। দেখছো না যজ্ঞে আমারই স্তবগান হচ্ছে। ব্রাহ্মণরা আমাকে ব্রহ্মযজ্ঞে পুজো করে থাকেন। ভগবান বলেন–হে দেবী! আমি আত্মস্তুতি করছি না। তুমি আমার কাছে এসে দেখ, আমি যজ্ঞ লাভের জন্য এক ভূত সৃষ্টি করছি। তারপর তিনি নিজের মুখ থেকে ক্রোধাগ্নিযুক্ত এক ভূত সৃষ্টি করলেন। ঐ ভূত হল–হাজার মাথা, হাজার পা, হাজার শর হাতে, শঙ্খচক্র গদাপাণি তলোয়ার হাতে সাক্ষাৎ ভয়স্বরূপ।

সেই মহারৌদ্র, ঘোর রূপে দীপ্যমান, বাঘের চামড়া তার পরিধেয়, অর্ধচন্দ্র তার ভূষণ, সর্বাঙ্গে রক্তমাখা, লম্বো, লম্বকর্ণ, তেজে দীপ্ত কেশ, মহাবল, মহাতেজ, তীক্ষ্ণ দাঁতযুক্ত, অগ্নিজ্বালা বিশিষ্ট মুখ, মহাসর্প বেষ্টিত, রাগে উদ্ভান্ত চোখ। সে নানা অঙ্গভঙ্গী করে নাচতে লাগলো। কখনো ধ্যান করতে লাগল, কখনো বা কাঁদতে লাগলো, তারপর জ্ঞান, বৈরাগ্য, তপস্যা, ক্ষমা ধৃতি ইত্যাদি যুক্ত হয়ে দেব দেব মহেশ্বরকে বলল–হে দেব! আদেশ করুন আপনারা, কি কাজ আমি করব? তখন মহাদেব বললেন–তুমি প্রজাপতির যজ্ঞ ধ্বংস কর। তার পর সেই মহাবলী মহেশ্বরের পায়ে প্রণাম জানিয়ে খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া সিংহের মতো ভীষণ রাগে দক্ষের যজ্ঞভূমির দিকে চলল। ঐ সময়েই দেবীর ক্রোধসম্ভতা মহাভীমা মহেশ্বরী ভদ্রকালী বীরভদ্রের অনুসরণ করল। অত্যন্ত রাগী প্রেতাবাসী বীরভদ্র । তখন দেবীর রাগ কমানোর জন্য নিজের রোমকূপ থেকে রৌদ্র নামে অসংখ্য গণেশ্বরকে সৃষ্টি করলেন। ঐ সহচররা রুদ্রের মতোই মহাবলশালী ও রুদ্র রূপধারী, শত শত সহস্র সহস্র সংখ্যায় তারা যজ্ঞভূমি আক্রমণ করল। সমস্ত দেবেরা ভয় পেয়ে গেল। আকাশ বাতাস শব্দে ভরে গেল, বসুন্ধরা কাঁপতে লাগল। সাগর ফুঁসে উঠল, সূর্য যেন তেজহীন হয়ে পড়ল। তারারা সব নিভে গেল। সমস্ত জায়গা অন্ধকার হয়ে গেল। যজ্ঞে আমন্ত্রণ পাওয়া সমস্ত দেব, অসুর মহাত্মা ঋষিদের নির্দয়ভাবে মারধোর করতে লাগলো। যজ্ঞ পাত্রগুলি ভেঙে ফেলল এবং অন্ন, পানীয় ক্ষীর, পায়েস, ঘি, মধু, শর্করা, মাংস যথেচ্ছ ভাবে খেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ফেলল।

সমস্ত যজ্ঞভূমি লন্ডভন্ড করে দিল। তখন যজ্ঞপতি দক্ষ হরিণের ছদ্মবেশে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বীরভদ্র তা জানতে পেরে অন্তরীক্ষে গিয়ে দক্ষের মাথা কেটে ফেলেন। অচেতন দক্ষকে বীরভদ্র পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেলেন। তখন তেত্রিশ কোটি দেবতা বীরভদ্রের কাছে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন–প্রভু আপনি কে? আপনি তুষ্ট হন, আমাদের দয়া করুন। তখন বীরভদ্র বলেন–আমি এখানে খেতে আসিনি আমি দেবতা বা আদিত্য নই। আমি এসেছি শুধুমাত্র দক্ষযজ্ঞ বিনাশ করার জন্য। আমি রুদ্রকোপজাত বীরভদ্র, আর সতীর ক্রোধ থেকে উদ্ভূত হয়েছেন এই ভদ্রকালী দেবী। মহাদেব আমাদের যজ্ঞভূমিতে পাঠিয়েছেন। হে রাজেন্দ্র, আপনি উমাপতিকে স্মরণ করুন। ধার্মিক শ্রেষ্ঠ দক্ষ বীরভদ্রকে সম্মান জানিয়ে শূলপাণিকে সন্তুষ্ট করলেন। শূলপাণি বিনষ্ট যজ্ঞভূমি দেখলেন। সেখানে যে দ্বি-জাতিরা এসেছেন, তারা আক্রান্ত। পরিচারকরা কাঁদছেন ভীষণ আগুন নিভে গেছে। অট্টহাস্য করে শঙ্কর দক্ষকে বললেন–তোমার অজ্ঞানতার জন্যই এই যজ্ঞ নষ্ট হল।

কিন্তু তোমার প্রতি আমি সন্তুষ্ট, তোমার জন্য কি করব বল। প্রজাপতি দক্ষ হরের কথা শুনে কেঁদে ফেললেন। কেঁদে ফেলে বললেন– সম্ভারগুলো আবার ফিরে পেতে চাই। যেগুলি অযথা সব নষ্ট হয়ে গেছে। ভগবান হর বললেন, ‘তাই হবে। তখন দক্ষ বর পেয়ে আট হাজার-এর বেশি বার তার নাম স্তব করতে লাগলেন। দক্ষ বললেন–হে দেব দেবেশ! আপনি দেবারিবলসূদন দেবেন্দ্র, অমরশ্রেষ্ঠ, সহস্রাক্ষ, বিরূপাক্ষ, সর্বতঃচক্ষু, শ্রুতিমান, আপনাকে নমস্কার। হে শঙ্কু, কর্ণ, অর্ণবালয়, গজেন্দ্রকর্ণ, গোকর্ণ আপনাকে নমস্কার। আপনি শতোদর, শতজিহ্বা, শতানন, আপনি দেবদানবের পালক, ব্রহ্ম, শতক্রতু, সমুদ্রের জলরাশি। আপনিই ক্রিয়া, কাজ, কারণ, কর্তা, সদসৎ প্রভব ও অব্যয়, আপনাকে নমস্কার। আপনি ভব, নাথ, রুদ্র পশুপতি। আপনাকে প্রণাম। আপনি ব্রিজট, ত্ৰিশীর্ষ, ত্রিগুণধারী, ত্রিনেত্র, চন্ড, মুনচ, নীল গ্রীব শিব।

আপনি সূর্য, সূর্যপতি, প্রমথনাথ, বৃষস্কন্ধ, হিরণ্যপতি, স্তুত, স্তত্য আপনাকে প্রণাম। আপনি সর্ব ভক্ষাভক্ষ, ভূতান্তরাত্মা, চলমান, নর্তনশীল, গীত বাদ্যরত, কল্প, ক্ষয়, উপক্ষয় ভীমাসন প্রিয়। আপনি উগ্র, দশবাহ, চিতাভস্মপ্রিয়, ভীষ্ম, বিভীষণ, মাংসলুব্ধ, বরকৃষ্ণ, বরদ, বর-গন্ধ-মাল্যবস্ত্র, বাত, ছায়া, শোভন, অক্ষমালী, বিভিন্ন, বিকট, অঘোর রূপরূপ, শিব, শান্ত, যদুনেত্র, একশীর্ষ, চণ্ড, ঘন্ট, প্রাণদণ্ড, হুঙ্কার আপনাকে নমস্কার। গিরিবৃক্ষফল, তারক যজ্ঞাধিপতি, দ্রুত, উপদ্রুত, তথ্য, তপন, তট, অন্নদ অন্নপতি, সহস্ৰশীর্ষ, সহস্রচরণ, সহস্ৰচোখ, বালরূপধর, শুদ্ধ বুদ্ধ অক্ষত, মুক্তকেশ, ত্রিকর্মনিরত, শ্বেতপিঙ্গল নেত্র, ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ, সাংখ্য, যোগাধিপতি আপনাকে নমস্কার। হে সাংখ্য, বিরথ্য, আপনি চতুষ্পথ, ঈশান বজ্রসংহ, হরিকেশ, কাম, কামদ, ধৃষ্ট, সর্ব, সর্বদ, মহাবল, মহাবাহু, মহাদ্যুতি, মহাকাল, বল্কল জিনধারী, তপোনিত্য, সভাবর্ত, চন্দাবর্ত, যুগাবর্ত, মেঘাবর্ত, অন্ন অন্নকর্তা, জরায়ুজ, স্বেদজ, উদ্ভিজ্জ দেব দেবেশ। আপনি জল, বায়ু, জ্যোতি পদার্থের নিধি। ব্রহ্মবাদীরা আপনাকে ঋক, সাম, ওঙ্কার বলে। আপনি হোমের আহুতি, আপনি বাষ্ময়, সমার্থকময়, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, শূদ্র, ঋতু, মাস, মাসার্ধ, কলা, নিমেষ, নক্ষত্র, যুগ, গ্রহ, মৃগদের মধ্যে সিংহ, পক্ষীদের মধ্যে গরুড়, সাপেদের মধ্যে অনন্ত, যন্ত্রের মধ্যে ধনু, প্রহরণের মধ্যে বজ্র, হৃতদের মধ্যে সত্য।

ইচ্ছা, রাগ, মোহ, দম, ধৃতি, লোভ, ক্রোধ, কাম, জয়, অজয়, প্রহর্তা, নেতা, ইন্দ্র, সমুদ্র, সরিৎ, লতা বল্লী, তৃণ, ওষধি, পশু, আদি, অনন্ত, মধ্য, গায়ত্রী, ওঙ্কার, হরিত, লোহিত, কৃষ্ণ, নীল, পীত অরুণ, কপিল, কপোত সুবর্ণরেতা, সুবর্ণনামা, সুবর্ণ প্রিয়, ইন্দ্র যম, বরুণ অনল উৎফুল্ল চিত্রভানু, স্বর্ভানু, হোত্র, হোতা, হোম শতরুদ্রিয় পবিত্রের পবিত্র, মঙ্গলের মঙ্গল, গিরিস্তোক, বৃক্ষ, জীব, সত্ত্ব, রজ, তম, প্রজন, প্রাণ, অপান, সমান, উদান, আপনি উন্মেষ, মেষ, লোহিতাঙ্গ, নদী, মহোদর, ঊর্ধ্বকেশ, ত্রিলোচন, গীতবাদনপ্রিয়, মৎস, জলা, জল, জল্য, জপ, কাল, ফণী, বিষাল, সুকাল, দুষ্কাল, মৃত্যু, ক্ষয়, অন্ত, হর, সংবর্তক, ঘট, ঘটিক, চূড়নিল, বল, বলী ব্ৰহ্মকাল, দণ্ডী, মুণ্ডী, চতুর্বেদ, চতুষ্পথ, চতুরাশ্রমবেত্তা, চতুবর্ণকার, ধূর্ত, অগণ্য গিরিশ, গিরিশপ্রিয়, শিল্পীশ, শিল্পীশ্রেষ্ঠ, সর্ব, চন্দ্র, পুষা, দণ্ডবিনাশন, গূঢ় প্রতিনিষেবিত তারণ; তারক, সর্বভূত, সুতারণ, ধাতা বিধাতা, ধারণ, ধর, তপ, সত্য, অর্জব, ভূতাত্মা, ভূতভব্য, তদুপভি, মহেশ্বর, ঈশাণ, বীক্ষণ, শান্ত, দুর্দান্ত, দন্তনাশন, সুরাবর্ত, কামাবর্ত, কাম-বিম্ব, নিহত, ভীমমুখ, দুর্মুখ, মুখ, চতুর্মুখ হিরণ্যগর্ভ, শকুনি, মহোদধি, বিরাট, অর্ধমহা, দণ্ডধার, রণপ্রিয়, গৌতম, গো বৃষেশ্বর বাহন, ধর্মকৃৎ, ধর্মস্রষ্টা, গোবিন্দ, মানদ, মান, তিষ্ঠ, স্থির, স্থান, নিষ্কম্প, দুঃসহ, দুরতিক্রম, দুর্জয়, শশ, শশাঙ্ক, আধি, ব্যাধি, যজ্ঞ, মৃগ, ব্যাধ, শিখণ্ডী, পুণ্ডরীকাক্ষ, দণ্ডধর, অমৃতপ, সুরাপ, ক্ষীর, মধুপ, মহাবল, বৃষভ লোচন, চন্দ্র, আদিত্য আপনার দুই চোখ, আর পিতামহ আপনার হৃদয়। অগ্নি, জল, ধর্মকর্ম, দেবগণ ব্রহ্ম, গোবিন্দ আর পুরাণ ঋষিরা কেউ আপনার মাহাত্ম্য কীর্তন করতে পারে না। আপনার যে অতিসূক্ষ্ম মূর্তিগুলো, তা আমাদের দৃষ্টি পথে আসে না।

এইসব মূর্তি দিয়ে আপনি পিতার মতো আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনি আমায় দয়া করুন। আমি আপনার রক্ষণীয়। আপনাকে নমস্কার করি। আপনি ভক্তানুকম্পী। আমি আপনার ভক্ত। আপনি বহু সহস্র পুরুষ আহরণ করে একা সমুদ্রগর্ভে থাকেন, আপনিই আমার পালনকর্তা। আপনি যোগাত্মা, আপনাকে নমস্কার। যুগান্তকাল এলে আপনি সমস্ত ভূত খেয়ে নিয়ে জলের মধ্যে শুয়ে থাকেন, আপনাকে নমস্কার। আপনি রাত্রিতে রাহুমুখে ঢুকে তাকে গ্রাস করেন এবং স্বর্ভাণু ও সোমাগ্নি হয়ে সূর্যকে কবলিত করেন। আপনি দেহীদের দেহস্থ অষ্ঠমাত্র পুরুষ, আপনি সবসময় আমায় রক্ষা করুন। যে অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষ গর্ভ থেকে পড়ে যায় ও অধোগত হয় স্বাহা ও ঋধা তাদের রুচিকর হয়ে থাকে। তারা দেহস্থ অবস্থাতে কাঁদে না এবং প্রাণীদের কাদায় না বা আনন্দ দেয় না। তাদের নমস্কার। ঐ অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষ সমুদ্রে নদীতে, দুর্গে, পর্বতে, গুহাতে, গাছের মূলে, গোঠে, গভীর বনে, চতুষ্পথে, রথে, চত্বরে, সভাভূমিতে, চাঁদ ও সূর্যের মাঝে রসাতলে ও অন্যান্য জায়গাতেও রয়েছেন, তারা স্কুল, সূক্ষ্ম, কৃশ, হ্রস্ব। আপনি তাদের স্বদেশ। তাই আমি তাদের সবসময় প্রণাম করি। আপনি নিখিল বস্তু, সর্বগ, সাধ, ভূতপতি, ভগবান, সর্বভূতাত্মারাত্মা, এই জন্যই আপনাকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়নি, ভূরিদক্ষিণ যজ্ঞে আপনি বিধিমতো যজনীয় হন। আপনি সবার কর্তা, এজন্যই আপনি নিমন্ত্রিত হন নি।

হে দেব! হয়তো আপনিই আমাকে সূক্ষ্ম মায়া দিয়ে অভিভূত করেছেন, এজন্য আপনি নিমন্ত্রিত হননি। হে দেবেশ! আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হন, আপনি আমার একমাত্র শরণ্য। আপনি আমার গতি ও প্রতিষ্ঠা। আপনি ছাড়া আমার গতি নেই। প্রজাপতি দক্ষ এভাবে ভগবান মহেশ্বরের স্তব করলে মহেশ্বর খুশি হয়ে আবার দক্ষকে বললেন–হে সুব্রত! আমি তোমার বিরাট স্তবে তুষ্ট হয়েছি, এর বেশি তোমায় বলতে হবে না, তুমি আমার কাছে এসো। এই বলে ভগবান তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বস্ত করলেন। বললেন–হে দক্ষ! তুমি এই যজ্ঞে বাধায় কষ্ট পেয়ে রেগে যেও না। আমিই এ যজ্ঞ ধ্বংস করেছি। তুমি আমার কাছে আবার কোনও বর চাও। হে প্রজাপতি। তুমি আনন্দের সাথে শোন — তুমি হাজার অশ্বমেধ ও শত বাজপেয় যজ্ঞের ফলভোগী হবে। তুমি ষড়ঙ্গ বেদ উদ্ধার করে সাংখ্যাযোগ ও বিপুল তপ স্মরণ করে গূঢ়, বিপরীত ভাবাপন্ন, সমবর্ণাশ্রম ধর্ম প্রচার কর। এই পশুপাপ বিমোচন, পশুপত ব্ৰত আমি সর্বাশ্রেয়ীর কাছে প্রচার করব। এই ব্রত আচরণ করলে যে ফল হবে, তার সমস্ত ফলই তুমি পাবে। তুমি মানসকাল ত্যাগ কর। এই বলে মহেশ্বর সপত্নীক অনুচরদের সাথে অদৃশ্য হলেন। তিনি ব্রহ্ম পরিকল্পিত যজ্ঞভাগ লাভ করে সর্বভূতের শান্তির জন্য জ্বরকে অনেক ভাগে ভাগ করলেন। হে ব্রাহ্মণরা, আপনারা শুনুন, শ্বাপদের শীর্ষাভিতাপ, পর্বতগুলোর শিলাজনিত পীড়া, জলের নালিকা, পৃথিবীর উর্বরতা, হাতিদের প্রতি দৃষ্টি অবরোধন, ঘোড়াদের রন্ধ্রোদ্ভব, ময়ূরদের শিখোদ্ভোব আর কোকিলদের নেত্র রোগকে জ্বর বলে। এভাবে অজদের শিঙভেদ, শুকদের হিথিকা ও বাঘদের শ্রমকে জ্বর বলে। মানুষদের জ্বরকে জ্বরই বলে। এটি মানুষের জন্ম মৃত্যু বা মাঝেও হয়ে থাকে।

এই যে দারুণ জ্বর একে শাম্ভব তেজ বলে জানবেন, এই জ্বররূপী তেজ সমস্ত প্রাণীর নমস্য। যে মানুষ শান্তভাবে মন দিয়ে জ্বরের কারণ বর্ণনা পাঠ করেন, তিনি সমস্ত রোগ থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দের সাথে যা চায় তাই পায়। যে মানুষ স্তব পাঠ করেছিলেন, তা পড়েন বা শোনেন তার অমঙ্গল হয় না। সে দীর্ঘায়ু লাভ করে। যেমন সব দেবতার মধ্যে ভগবান হরই শ্রেষ্ঠ, তেমনি যাবতীয় স্তবের মধ্যে ব্রহ্মনির্মিত দক্ষ কথিত এই স্তব অতি মহনীয়। যারা যশ, রাজ্য সুখ, ঐশ্বর্য, বিত্ত, আয়ু এবং ধন পেতে চায়, তারা ভক্তি ভরে এই স্তব পাঠ করবে। আর যারা অসুস্থ, দুঃখিত, ভীত্ ও রাজকাজে যুক্ত তারাও এই স্তোত্র পাঠ করলে ভয় থেকে মুক্ত হয়। যেখানে ভগবান ভব স্তুত হন, সেখানে যক্ষ, পিশাচ, নাগ ও বিনায়কেরা কোনও বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। যে ব্রহ্মচারিণী নারী ভক্তি করে এই স্তোত্র পাঠ করে বা শোনে, সেই নারী, পিতৃকুল, ভর্তৃকুল–দুকুল থেকে দেবের মত পূজা পায়। যে এই স্তব শোনে বা বারবার পড়ে তার সব কাজ নির্বিঘ্নে শেষ হয়। যা মনে মনে ভাবা যায় না, সবকিছু এই স্তব পাঠে সিদ্ধ হয়।

কার্তিকেয়সহ বিভব অনুসারে যে দেব ত্রিলোচন দেবী ও নন্দীশ্বরের বলি পূজাদি করে সে তার যা ইপ্সিত সেই বস্তু পায়, তার অভিলাষ পূর্ণ হয়। আর মারা গেলে স্ত্রী সহস্র পরিবৃত হয়ে স্বর্গে যায়। বিষয়ী বা পাতক যুক্ত সব মানুষ দক্ষের এই স্তব পাঠ করলে পাপ থেকে মুক্তি পায়। এই স্তোত্র কেউ সহসা প্রকাশ করবে না। শুনবেও না। পাপী, বৈশ্য, স্ত্রী ও শূদ্র যদি পরমগোপনে এই স্তব শোনে তাহলে রুদ্রলোক প্রাপ্ত হয়।

.

দ্বাত্রিংশ অধ্যায়

সূত বললেন–পিতৃবংশ বর্ণনা প্রসঙ্গে ভগবান ভব ও দক্ষ সম্বন্ধে আপনারা জেনেছেন। এখন পিতৃবংশের মতো দেববংশের বর্ণনা করছি। স্বায়ম্ভর মনুর অধিকার কালে ত্রেতাযুগের প্রথমে দেবগণ ‘যাম’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। আগে এরা যজ্ঞপুত্র নামেও বিখ্যাত ছিলেন। এঁদের মধ্যে অজিতেরা ব্রহ্মার ছেলে এবং জিত, জিৎ এবং অজিত এঁরা মনুর শুক্র নামক মানস পুত্র। দেবদের মধ্যে তিনটি গণ আছে। বলা যায়। তার মধ্যে এই সব ছেলে তৃপ্তিমান গণ বলে খ্যাত। মনুর তেত্রিশ জন ছেলে ছন্দোগ নামে প্রসিদ্ধ। যদু, যযাতি, দীধর, সবস, মতি, বিভাস, ক্রতু, প্রজাপতি, বিশত, দ্যুতি বারস ও মঙ্গল– এই বারোজনকে যামদেব বলা হয় এবং অভিমন্যু, উগ্রদৃষ্টি, সময়, বিশ্বরূপ, সুপ, মধুপ, তুরীয়, সাধন অমৃতানন ইত্যাদি স্বয়ম্ভব অধিকারে সোমপায়ী ছিলেন।

এঁরা মহাবল ত্বিবিমন্ত শন বলে বিখ্যাত, বিশ্বভূত বিভু সবসময় এদের ইন্দ্র ছিলেন। তখন অসুর সুপর্ণ, যজ্ঞ, গন্ধর্ব, পিশাচ, উরগ ও রাক্ষস এই আটটি গণ তাদের জ্ঞাতি বন্ধু ছিলেন। তখন পিতৃগণের সাথে জামাতাগণও দেবযোনি ছিলেন। এঁদের রূপ-গুণসম্পন্ন আয়ুষ্মন সহস্র সন্তান-সন্ততি অতীত হয়েছেন। অতীত মনুর সৃষ্টি বিস্তার সাম্প্রতিক মনুর ন্যায়ে জানা যাবে, মনুর অধিকার কাল শেষ হলে বর্তমান বৈবস্বত মনুর দৃষ্টান্ত তখনকার স্বভাবগুলো দেখা যায়। আগের মন্বন্তরে যারা প্রজা, দেবতা, ঋষি, পিতৃগণের সাথে সপ্তর্ষি ছিলেন তাদের নাম বলছি শুনুন, অঙ্গিরা মরীচি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, অত্রি, বশিষ্ঠ। অগ্নী, অতিবাহু, মেধা, মেধাতিথি, বসু, দ্যুতিমান, হব্য, সবন ও পুত্র জ্যোতিষ্মন–এই দশজন মহৌজা মনুর ছেলে। বায়ু বলেছেন এঁরাই মন্বন্তরের প্রথম রাজা ছিলেন। আর অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, উরগ, রাক্ষস, পিশাচ, মানুষদের সাথে বহু অপ্সরা সেই মন্বন্তরে ছিলেন। কিন্তু সংখ্যায় তারা এত বেশি যে তাদের আনুপূর্বিক নাম বলা অসম্ভব। মন্বন্তরে যে সব ব্রজকুল নামে প্রজা ছিল, বাহু অয়ন, অব্দ ও যুগ ক্রমে বহুকাল হল তারা অতীত হয়েছে।

ঋষিরা বললেন–হে সূত! ঐ সর্বভূতের অপহরক কাল কে? এঁর উৎপত্তি, আদি, তত্ত্বস্বরূপ চোখ, মূর্তি, অবয়ব, নাম ও দেহ কি তা বলুন। সূত বললেন–সূর্যযোনি নিমেষ প্রভৃতিকে কাল বলো সংখ্যা কালের চোখের মত। এই কালের মূর্তি অহোরাত্র নিমেষ ও কালাত্মক সংবৎসর তার নাম, ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান কালই স্বয়ং প্রজাপতি। এখন দিন, পক্ষ, মাস, ঋতু ও অয়ন দিয়ে পাঁচ ভাগে বিভক্ত, কালের অবস্থাভেদ বলছি শুনুন–প্রথম সংবৎসর–দ্বিতীয় পরিবৎসর, তৃতীয় ইদ –বৎসর, চতুর্থ–অনুবৎসর এবং পঞ্চম বৎসরকে বলা হয় পরম বৎসর। এদের স্বরূপ বলছি। যে ঋতুকে অগ্নি বলা হয়, তা সংবৎসর আদিত্য যে কালভাগ করেন তা পরিবৎসর সোম ই বৎসর, এর শুক্ল ও কৃষ্ণ এই দুই গতি, আর ইনি জলসারময় ও আকাশগামী। এটাই পুরাণ অনুমোদিত।

যিনি সাত সাতটি তনু দিয়ে এই লোকসকলকে তাপ দিয়ে সচেষ্ট করেন তিনিই বায়ু আর ঐ বায়ু অনুবৎসর। এঁদের যথার্থ তত্ত্ব বলছি শুনুন। কাল, আত্মা, প্রপিতামহ, অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, যোগে ঋক সাম, যজুর নিদান, ও পঞ্চ কালের ঈশ্বর। তিনিই অগ্নি, যজু, সোম, ভূত ও প্রজাপতি। যিনি অগ্নি তিনিই সূর্য এবং সেই সূর্যই মনীষীদের মত সংবৎসর। এই সূর্য থেকেই কাল বিভাগ, মাস, ঋতু, অয়ন, গ্রহ, নক্ষত্র, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, আয়ু ও দিনের ভাগ হয়ে থাকে। এই প্রজাপতির দিন, মাস ও ঋতুর প্রবর্তক আর ইনিই পিতামহ স্বরূপ।

ইনিই আদিত্য, সবিতা, ভানু, জীবন ও ব্রহ্মস্যকৃত। ইনিই ভূতগণের উৎপত্তি বিনাশ সাধক বলে এঁকে ভাস্কর বলে। তৃতীয় পরিবৎসর তারাভিমান সোমেরা ওষধির পতি বলে তিনিও প্রপিতামহ ও সর্বভূতের যোগক্ষেমকারী, ইনি অংশু দিয়ে জগৎ পরিব্যপ্ত করেন। তিথি পর্বসন্ধি, পুর্ণিমা ও অমাবস্যায় ইনি যোনি। ইনি নিশাকর, অমতৃত্মা ও প্রজাপতি, এজন্য এই সোম পিতৃমান এবং ঋক্ ও যজু ছন্দোময়। ইনিই প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যানাত্মক কারা দিয়ে সমস্ত প্রাণীর সব চেষ্টার প্রবর্তন করেন। ইনি প্রাণ অপান সমান বায়ুর প্রবর্তক। ইনিই ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, স্মৃতি, রসের যথা সময়ের পুষ্টি সাধক। ইনি এঁদের ক্রিয়া সম্পাদক, ইনিই সর্বত্মা প্রভঞ্জন, সমস্ত জীবের জীব স্বরূপ বিখ্যাত। ইনিই জল, অগ্নি, ভূমি, রবি, চাঁদের উৎপত্তি স্থান তাই ইনি প্রজাপতি, লোকাত্ম ও প্রপিতামহ বলে বিখ্যাত। প্রজাপতি প্রভৃতি ইষ্ট লাভ-এর জন্য ত্ৰিকপাল ও অম্বক দিয়ে ভগবান রুদ্রের পূজা করেন। এজন্য তাঁর নাম এ্যম্বক হয়েছে। মনীষীরা এভাবে পঞ্চবর্ষকে একযুগ বলেন। দ্বিজরা এই যে পাঁচরকম সম্বৎসর এর কথা বলেছেন। এক এক বর্ষ, মধু প্রভৃতি ছয় ঋতু হয়ে আসে। ঋতু পুত্র আর্তবেরা পাঁচ ভাগে বিভক্ত। সংক্ষেপে একে কালসর্গ বলা হয়, বায়ু এভাবে বায়ু কাল রূপে প্রাণীদের জীবন ক্ষয় করে নদীর বেগের মত বয়ে চলেছে। এই কাল থেকে। অহোরাত্র হয়েছে। এই কালই এবার বায়ুমূর্তি ধরে। এরা সকলেই প্রজাপতির সর্বদেহীর প্রধান, সমস্ত লোকের পিতা ও লোকাত্মা বলে বিখ্যাত।

ভগবান ব্রহ্মা ধ্যানস্থ থাকলে ভগবান ভব তা থেকে আবির্ভূত হন। ইনি ঋষি, বিপ্র, মহাদেব রূপভূতাত্মা ও পিতামহ। ইনিই সকলের ঈশ্বর, প্রণবের জন্যই এঁর আবির্ভাব। ইনি আত্মরূপে প্রাণীদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ উৎপত্তির কারণ। ইনিই অগ্নি সংবৎসর, সূর্য, চাঁদ ও বাতাস, ইনি যুগাভিমানী, কালাত্মা নিত্য সংহারক এবং ইনি উন্মাদক অনুগ্রহ কর্তারূপে ইদ বৎসর বলে প্রসিদ্ধ। ইনিই রেগে গিয়ে নিজের ‘তেজে এ জগতে প্রতিভাত হচ্ছেন, আলব তাঁরই প্রভাবে আবার লোকানুকূল সৃষ্টি হয়েছে এবং দেব, পিতা, কাল প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। পব ও উৎপন্ন ভূতেবা আবার তার পূজা করে। ভগবান ভব প্রদেশ, প্রজাপতি, পতির ও পতি, সর্বভূতের প্রভু ও ক্ষীণ ওষধিদের পুনঃ পুনঃ প্রতিষ্ঠাতা। যিনি এই স্থির কীর্তি প্রজাপতিদের মহৎ বংশ বর্ণনা করেন, তিনি মহতী সিদ্ধি লাভ করেন।

.

ত্রয়োত্রিংশ অধ্যায়

এরপর প্রণবের বিষয় বলছি শুনুন। ওঙ্কার অক্ষরটি ব্রহ্মস্বরূপ, ওঙ্কারের তিনটি বর্ণ রয়েছে। এটা মন্ত্রের প্রথমে যোগ হয়। ওঙ্কারস্থ বর্ণ থেকে ঋক, সাম, যজুঃ, বায়ু, অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি দেবতারা এসেছেন। দেবতাদের মধ্যে যে চোদ্দজন মহাত্মা, তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বগ, সর্বগত ও সর্বযোগবিদ তিনিই লোকানুগ্রহের জন্য ওঙ্কারের আদি, মধ্য ও অন্তরূপে আর্বিভূত। সপ্তর্ষি, ইন্দ্র, দেবগণ, পিতৃগণ এঁরা সকলেই দেবদেব মহশ্বেরস্বরূপ ওঙ্কার অক্ষর থেকে আর্বিভূত হয়েছেন। মনীষীরা ঐ ওঙ্কার অক্ষরকে ইহলোক ওপরলোকের হিতকর পরমপদ বলেন। আগে আমি কৃত, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগ এদের সাথে কালের বিষয় বলেছি। যুগগুলো চাকার মত ঘুরতে থাকলে দেবতারা কালের বশে, কালের ইয়ত্তা করতে পারলে না তখন মন্বন্তরের প্রথমে ইন্দ্র প্রভৃতি দেব, ঋষি ও তপোধনরা হাজার বছর ধরে তীব্র তপস্যাঁতে মন দিলেন। তখন কালভয়ে ভীত তারা ভগবান মহাদেবকে লাভ করেন।

তাঁরা বলেন–হে মহেশ্বর মহাদেব! এই দেবেশ কাল চারমূর্তি, চারমুখ এর তত্ত্বকে কে জানতে পারে। মহাদেব চতুর্মুখ কালকে দেখে দেবগণকে বললেন, তোমাদের ভয় নেই। আমি তোমাদের কোন্ ইচ্ছে পূর্ণ করব তা তোমরা বলো। তোমাদের বৃথা কষ্ট করতে হবে না। এই বলে কালরূপী দেবদের বলতে শুরু করলেন–এই চারটে জিহ্বাযুক্ত সাদা রঙের মুখ দেখছ, এটি কালের কৃত যুগের নামের প্রথম মুখ। আর এই মুখই দেবসুর শ্রেষ্ঠ ব্রহ্ম। আর ইনিই বৈবস্বত নামক মুখ। তারপরে লাল দুটো জিহ্বাযুক্ত লেলিহান দ্বিতীয় মুখ, এটাই ত্রেতাযুগ, এতেই মহেশ্বর থেকে যজ্ঞপ্রবৃত্তি হয়। এর থেকেই যজ্ঞ শুরু। এর তিন জিহ্বা তিন অগ্নিস্বরূপ। দুই জিহ্বাযুক্ত ভীষণ লাল মুখ, এই মুখই দ্বাপর যুগ, আর ঐ যে কালো রঙের লাল চোখ এক জিহ্বা লেলিহান স্থল চতুর্থ মুখ, এটাই কল্পমুখ স্বরূপ, সমস্ত লোক ভয়ঙ্কর ঘোর কলিযুগ। কলিযুগে মুখও নেই নির্বাণও নেই, সব প্রজাই কলিগ্রস্ত হয়ে থকে। কৃতযুগে ব্রহ্মাপূজ্য, ত্রেতার যজ্ঞ, দ্বাপরে বিষ্ণু আর আমি চারযুগে পূজ্য। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও যজ্ঞ–এরা কালের তিনটি অংশ মাত্র। আমি যুগের কর্তা পরম পরপরায়ণ। এজন্য আমি কলিযুগে লোকের মঙ্গল ও দেবগণের অভয়ের জন্য ভব্য ও পূজ্যই হয়ে থাকি। হে মহাত্মাগণ কলিকাল এলে আপনাদের ভয়ের কিছু নেই। দেব, ঋষি কালরূপী ভগবান এর কাছে এসব কথা শুনে তাকে মাথা নিচু করে প্রণাম করে আবার। বললেন– এই কাল চতুর্মুখ হলেন কিজন্যে? মহাদেব বললেন– এই চতুমূর্তি, চতুর্মুখ, চতুর্দংষ্ট্র কাল লোক রক্ষার জন্য সব কিছুকেই পেরিয়ে চলে। এই চরাচরে তার অসাধ্য কিছু নেই। তিনি সমস্ত সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আস্তে আস্তে ধ্বংস করেন। সবাই কালের বশবর্তী কিন্তু কাল কারোর বশে নেই। একাত্তর যুগে এক যুগান্তর হয়। একথা বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। কালই দেব, ঋষি, দানবদের সৃষ্টি ও ধ্বংস করেছেন বার বার। কলিযুগে সকলের যত্ন সহকারে তপস্যা করা উচিত।

যিনি তপস্যায় মহাদেবকে লাভ করেন, তাঁর পুণ্যফল মহৎ। এজন্য ধর্মপরায়ণ দেব ও ঋষিরা কলিকালে অবতীর্ণ হয়েই তপস্যা করতে ইচ্ছে করেন, এজন্য যাঁরা কালের অতীত হয়েছেন, তারাও এই চারযুগে সপ্তর্ষিদের সাথে জন্মগ্রহণ করে। এরপর আমি স্বৰ্গত নৃপতিদের বিবরণ বর্ণনা করছি। শুনুন ওই বংশকে ইক্ষবাকু বংশের আদি বলা হয়। অনেক নৃপতি ওই বংশে জন্মে শত শত বংশ বিস্তার করেন, ভোজ বংশের রাজাদের এদের দ্বিগুণ বংশ। ভোজ বংশের চারটি অংশ আছে। এখানে বিস্তারিতভাবে অত বলা সম্ভব নয়। এরা সবাই প্রজাপালক নৃপতি।

.

চতুর্বিংশ অধ্যায়

সূত বললেন–আগে মহর্ষির সৃষ্টি কথা বলা হয়েছে। এখন বিস্তৃতভাবে স্বায়ম্ভুব মনুর বংশের কথা বলছি শুনুন। স্বায়ম্ভুব মনুর দশ পৌত্র। তারা সকলেই গুণবান, ধার্মিক। সত্য ও ত্রেতা যুগে তারা যোগ ও তপশ্চরণ দিয়ে সসমুদ্রা, সমস্ত পৃথিবীর কর গ্রহণ করতেন। বীর প্রিয়ব্রতের এক কন্যা জন্মায়। তিনি কর্দম প্রজাপতি স্ত্রী। এছাড়া তাঁর আবার দুইকন্যা এবং সম্রাট ও কুক্ষি প্রভৃতি একশো পুত্র জন্মান। এদের মধ্যে দশজন প্রবল বলশালী। প্রিয়ব্রত এদের সাতজনকে সাতটি দ্বীপে অভিষেক করলেন। যেমন অগ্নীকে জন্মদ্বীপ, মেধা তিথিকে প্লদ্বীপ, বপুষ্মনকে শাল্মলী দ্বীপের, জ্যোতিষ্মনকে কুশদ্বীপ, দ্যুতিমানকে ক্রৌঞ্চদ্বীপ-এর, হব্যকে শাকদ্বীপের ও সবনকে পুষ্করদ্বীপের রাজা করলেন। সবনের মহাবীত ও ধাতকীয় নামে পুত্র হয়। ক্রৌঞ্চ দ্বীপে কয়েকজন পুত্র হল দ্যুতিমানের কুশল, মনুগ প্রভৃতি। কুশদ্বীপে জ্যোতিষ্মনের সাত ছেলে জন্মায়-উদ্ভিদ, বেনুমান, লবণ প্রভৃতি। বপুম্মানের সাত ছেলে, শ্বেত, হরিত, জীমূত, রোহিত প্রভৃতি। মেধাতিথির সাত ছেলে। এবার জম্বুদ্বীপের কথা বলছি। জম্বুদ্বীপের রাজা অগ্নীব্র। এর কয়েকটি পুত্র হয়, তাদের সবার বড় পুত্রের নাম নাভি, এর ছোট কিম্পুরুষ। তারপর হরিবৰ্ষ, ইলাবৃত, রম্য। হরিন্মান ভদ্রাশ্ব, কুরু, কেতুমাল, এঁদের পিতা নাভিকে দক্ষিণ বর্ষ, কিশুরুষকে হেমকূট, হরিবর্ষকে নৈবধবর্ষ, ইলাবৃতকে, সুমেরুর মধ্যদেশ, রম্যকে নীলবর্ষ, হরিন্মানকে শ্বেতবর্ষ, কুরুকে শৃঙ্গবানের উত্তরদেশ, ভাশ্বকে মাল্যবান বর্ষ ও কেতুমালকে অন্ধমাদন বর্ষ দান করেন। অগ্নী-এর পুত্রদের যে আটটি বর্ষের কথা বলা হয়। সেখানে অধিবাসীরা ছিল সুখী, জরা, মৃত্যু, অধর্ম ইত্যাদি কিছুই ছিল না। নাভির যে বংশ, সেখানে ঋষভ নামে এক পুত্র জন্মায়। তার থেকেই ভরতের জন্ম। ঋষভ ভরতকে হিম নামে দক্ষিণ বর্ষে অভিষিক্ত করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন।

জায়গাটার নাম তাই হল ভারতবর্ষ। ভরতের পুত্র সুমতিকে ভারতবর্ষে অভিষিক্ত করে বানপ্রস্থে যান, সুমতির পুত্ররা–তৈজস, প্রজাপতি ও অমিত্রজিৎ। বিদ্বান ইন্দ্রদ্যুম্ন হলেন তৈজসের ছেলে, ইন্দ্রদ্যুম্ন-এর ছেলে প্রতিহার। তার ছেলের নাম প্রতিহর্তা। প্রতিহর্তার পুত্র উন্নেতা। তার ছেলে ভুব, তাঁর ছেলে উশীথ, তার ছেলে প্রতাবি–এইভাবে সকলে বংশপরম্পরায় প্রজা সংখ্যা বাড়িয়েছিলেন। এদের বংশের হাজার হাজার সন্তানরাই কৃত ও প্রেতাদি যুগক্রমে মন্বন্তর পর্যন্ত এই ধরা ভোগ করেছেন। অতীত যুগের অনেকেই এঁদের বংশজাত হয়েছেন। এভাবেই হাজার হাজার নৃপতি গত হয়েছেন। আর তাদের সৃষ্টি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

.

পঞ্চত্রিংশ অধ্যায়

ঋষিরা এবারে সূতের কাছে পৃথিবীর আয়তন ও বিস্তার সম্বন্ধে আগ্রহপূর্বক জানতে চাইলেন। বললেন–প্রভু, পৃথিবীতে কত দ্বীপ, কত সমুদ্র, কত পর্বত, কত বর্ষ, আর সেই সব বর্ষে কত নদী রয়েছে? মহাভূতদের প্রমাণ কী? লোকালোক ও চন্দ্র সূর্যের পর্যায় পরিমাণই কেমন? আমাদের বর্ণনা করুন। সূত বললেন–সাতটি প্রধান দ্বীপের মাঝে যেসব ছোট ছোট হাজার হাজার দ্বীপের অস্তিত্ব রয়েছে তাদের বর্ণনা একশ বছরেও দেওয়া যাবে না। সুতরাং এখন চন্দ্র-সূর্য গ্রহগুলির সাথে প্রধানতঃ সাতটি দ্বীপের কথাই বলছি।

জম্বুদ্বীপের বিস্তার এক হাজার একশ যোজন পরিমাণ। অনেক জনপদযুক্ত, এখানে সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব ও অনেক পাহাড় আছে। সেই পর্বতে অনেক ধাতু ও শিলা রয়েছে। এখানে অনেক পাহাড়ী নদী রয়েছে। এটি নটি বিশাল বর্ষে পরিব্যাপ্ত। লবণ সাগর দিয়ে চারদিকে ঘেরা দুটি বর্ষ পর্বত আগে পরে রয়েছে। হিমপ্রায়, হিমবান, হেমময়, হেমকূট। বালুকি বর্ণের মতো হৈরণ্য, নিষধ, নীল ও মেরু– এই দুটি প্রসিদ্ধ বর্ষ পর্বত। এদের মধ্যে মেরু সবার চেয়ে উঁচু। এটি সুবর্ণময়, চতুরা উন্নত। এর পাশে নানা রঙের সমাবেশ। ব্রহ্মার নাভিপদ্ম থেকে এই মেরুগিরির উৎপত্তি। এর পূর্বদিক সাদা রঙের, দক্ষিণদিক পীত রঙের।

এর পশ্চিমদিক ভৃঙ্গপক্ষের মতো উত্তরদিক লাল রঙের, অর্থাৎ যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শুদ্র, ক্ষত্রিয়-এর কথা ইঙ্গিত করে।

স্বভাব, বর্ণ ও পরিমাণ অনুসারে এই মেরুগিরির আসল রূপ বলা হল। নীলগিরি বৈদূর্যময় আর হৈরণ্য। নীলগিরির বর্ণ ময়ূরের মতো। এই সব পর্বত শ্রেষ্ঠ সিদ্ধ ও চারণগানে সেবিত, ঐ পর্বতগুলোর মধ্যে ইলাবৃত বর্ষ রয়েছে। ঐ পর্বতের মাঝখানে মহামেরু নিধূম পাবকের মতো রয়েছে। মেরুর দক্ষিণ দিকে এর বেদী ও উত্তরদিকে এর উত্তর ভাগ। এখানে সাতটি বর্ষ রয়েছে, তাদের বর্ষ পর্বতগুলো, প্রত্যেককে দুহাজার যোজন বিস্তীর্ণ। এদের মধ্যবর্তী নীল ও নিষ্ঠগিরি দুশো হাজার যোজন বিস্তৃত। শ্বেত, হেমকূট, হিমবাহ ও শৃঙ্গ বান এরা দুই পর্বতের থেকে ছোট। এই পর্বতগুলোর সমষ্টি বিরাশি হাজার বিরানব্বই যোজন আয়তন পরিমাণ। জনপদগুলি সাতটি বর্ষে ভাগ করা হয়েছে। এই সমস্ত বর্ষে নানাজাতের প্রাণী বাস করে। এটি ভারত নামে বিখ্যাত। এর পরের বর্ষ হেমকূট এবং তার পরের বর্ষকে কিম্পরূপ বর্ষ বলে। নিষেধ ও হেমকূট নিয়ে হরিবর্ষ নির্দিষ্ট। হরিবর্ষ ও মেরুর পরবর্তী ইলাবৃত বর্ষ। ইলাবৃতের পর রম্যক বর্ষ প্রসিদ্ধ। রম্যকের পরবর্তী বর্ষ শ্বেত, এটিকে হিরন্ময় বলে। হিরন্ময়ের পরে একে কুরুবর্ষ বলে। দক্ষিণোত্তর দিকের দুটি বর্ষ ধনুকের আকারে রয়েছে।

মাল্যবান নামে মহাগিরি উত্তরদিতে রয়েছে। এই গিরি নীল ও নিষধাচল থেকে হাজার যোজন উঁচু। মাল্যবানের পশ্চিম দিকে গন্ধমাদন। বিস্তারে মাল্যবানের সমান। এই মেরু বৰ্ত বর্ণশালী সুন্দর। এতে সমস্ত ঋতু ও জল অব্যক্ত ভাবে উৎপন্ন হয়েছে। অব্যক্ত থেকে পৃথিবী পদ্মের আবির্ভাব হয়েছে। এই মেরুগিরি ঐ পদ্মের কর্ণিকা স্থানীর। আগের অনেক কল্প সমন্বিত নানারকম পুণ্যের ফলে কৃতাত্মারা এখানে বাস করে থাকেন। যিনি জিতেন্দ্রিয় মহাত্মা পুরুষোত্তম, যাঁকে মহাদেব, মহাযোগী, জগৎ প্রধান মহেশ্বর বলা হয়, সেই সর্বলোকের মধ্যগত অনন্ত অশরীরী রূপে এই পথে আবির্ভূত হন। মাংস, মেদ, অস্থি সমন্বিত দেহ তারা নয়। ঐ সনাতন লোকপথ তারই জন্যে উৎপন্ন হয়। কল্পশেষের কালের গতি এমন হয় যিনি প্রজাপতি, জগৎপ্রভু, দেবদেব চতুর্মুখ ব্রহ্ম, তিনিই ঐ পদ্মে আবির্ভূত হন। ঐ পদ্মের বীজ সৃষ্ট, সত্যমূলক। ঐ পদ্ম বিষ্ণুর সৃষ্টি তার নাভি থেকে পদ্মর আর্বিভাব। পৃথিবীই পদ্ম আকারে যেন উৎপন্না হয়েছিল।

এই পৃথিবী চারটি দ্বীপ লোক, পদ্মের পাতার মতো, মহাবল মেরু এর কর্ণিকার মত। ঐ মেরুর পাদগুলো নানা বর্ণময়। এর পূর্বদিক সাদা, দক্ষিণ পীত, শৃঙ্গ কালো, উত্তরদিক লাল, এই মেরুগিরি রাজার মত শোভিত। এর আকার তরুণ তপনের মতো, এর বিস্তার চুরাশি হাজার যোজন। এই গিরি নীচের দিকে ষোলো যোজন। এর চারদিকের আয়তন বিস্তার থেকে তিনগুণ এখানে দিব্য ওষধি আছে। এই শৈলরাজির উপরিভাগ দেব, গন্ধর্ব, উরপ, রাক্ষস, সুন্দরী অপ্সরা প্রভৃতিরা থাকেন। এর নানাদিকে চারটি দেশ রয়েছে।

ঐ চারটি দেশের নাম ভদ্ৰাস্ব, ভারত, কেতুমাল ও উত্তর কুরু। উত্তরকুরু পুণ্যবান আশ্রয়স্থল। ভূপদ্মের বীজকোষ চারিদিকে ছিয়ানব্বই হাজার যোজন বলে বিখ্যাত। এর কেশরগুলো চারিদিকে বিস্তীর্ণ। আগে ভূপদ্মের যে চারটি পাতার কথা বলা হয়েছে, তাদের বিস্তার এর হাজার গুণ যোজন। এই পদ্মের কর্ণিকা বীজ কোষ, তাকে অত্রিমুনি বাতাস, ভৃগু ঋষি মহস্রা, সাবর্ণী অষ্টা ও ভাসুরি চতুরাশ্রাকারে এবং বাৎসায়ণী সমুদ্রাকরে, গালব বায়বালোয়ে, গাজি উৰ্ব্ববেণীর আকারে এবং ক্রোফ্টকি পরিমণ্ডলাকারে একে জেনেছেন। ফলে যে ঋষি যেমন ভাবে এই পর্বতাধিপতির পার্শ্ব সম্বন্ধে জেনেছেন, এর পার্শ্ব বস্তুতঃ সেই রূপেই আছে। কিন্তু এর সমস্ত তত্ত্ব একমাত্র ব্রহ্মাই জানেন। নাগাত্তম মেরুগিরি নানা রকম মনিরত্ন ও নানা রকম বর্ণপ্রভাতে সমুজ্জ্বল। এর প্রভা সুবর্ণ ও সূর্যের মতো, এটি দেখতে রমণীয়, হাজার পর্ব, এখানে রয়েছে আর হাজার হাজার পদ্মপূর্ণ।

এখানে মণিরত্নখচিত অনেক স্তম্ভ আছে। মণিমণ্ডিত বেদী রয়েছে। এটি বহু বিক্রম তরণে অন্বিত। দেবগণের নিবাস আছে এখানে। ব্রহ্মবিদদের বরেণ্য দেবপ্রধান চতুর্মুখ ব্রহ্মা। এর উপরে রয়েছেন। এই গিরির নানাদিকে বহু সহস্ৰ মহাপুর রয়েছে। এদের মধ্যে ব্রহ্মসভা অতি রমণীয়। এটি সমস্ত লোকে বিখ্যাত, সেখানে মহাবিমানে দেবদেব ঈশাণ-এর একটি আবাস আছে। এটি হাজার সূর্যের মতো উজ্জ্বল এবং নিজের মহিমায় দীপ্ত। সেখানে দেব, ঋষি এমনকি স্বয়ং চতুরানন সমসময় রয়েছেন। ঐ জায়গাটিতে আদিত্য সমতেজা, দেবরাজ মহেন্দ্রর একটি আবাসস্থান রয়েছে। ঐ ইন্দ্রলোক পরম সমৃদ্ধ। প্রধান প্রধান অমরদের সর্বক্ষণের সেবা পেয়ে ইন্দ্রলোক প্রজ্জ্বলিত। এর পূর্ব-দক্ষিণ দিকে অগ্নিদেবের এক ভাস্বর মহবিমান রয়েছে। সেটি বিচিত্র ধাতুতে তৈরী অতিতেজ সম্পন্ন। এখানে অনেক স্বর্ণ উদ্যান নামে মহাসভা আছে। এই বিভাবসু অগ্নিকে দেব ঋষিরা স্তুতি করেন ও তাকে আহুতি দিয়ে থাকেন। তিনিই সমস্ত তেজঃ সমষ্টি ভিন্ন ভিন্ন ভোগ পেয়ে সেই একই তেজ বিভূরূপে বিরাজ করছেন।

মেরুর তৃতীয় অন্তরতটে এইরকম আর একটি মহাসভা আছে। এটি যমের সুসংযমা নামে মহাসভা লোকে বিখ্যাত। এরপর ধীমান বিরূপাক্ষের একটি সভা আছে, তার নাম কৃষ্ণাঙ্গনা। মেরুর পঞ্চম অন্ত তটে বৈবস্বতের শুভগতি নামে আরও একটি রমণীয় মহাসভা রয়েছে। মহাত্মা জলধিপতি বরুণের সতী নামক সভা সুবিখ্যাত। ঐ সভাপুরীর উত্তরে মেরুর সুরম্য ষষ্ঠ অন্তরতটে পবনদেবের নবতী নামক সভা সুপ্রসিদ্ধ। মেরুর সপ্তম অন্তরতটে নিশাপতির মহাদয়া নামে সভা আছে। এটি বিশুদ্ধ বৈদুর্য বেদীতে অলঙ্কৃত। মেরুর অষ্টমতটে মহাত্মা ঈশাণের যশোবর্তী নামে সভা রয়েছে। কাঞ্চনের মতো উজ্জ্বল সেই সভা। এখানে ইন্দ্র ইত্যাদি আটটি বিমানের কথা বলা হল। এই গিরি চরেই দৈবলোক রয়েছে বলা হয়ে থাকে। নানা রকম যজ্ঞনিয়মে ও অনেক জন্মের বহু পুণ্যফলে মানুষ এই দেবলোক পায়।

.

ষষ্ঠত্রিংশ অধ্যায়

সূত বললেন, আগে যে কর্ণিকা মূলের কথা বলেছি, তা সত্তর হাজার যোজন নীচের দিকে রয়েছে। এর মণ্ডল পরিমাণ আটচল্লিশ হাজার যোজন, ঐ মণ্ডল পাহাড় দিয়ে ঘেরা, আগের যে হাজার হাজার পর্বতের কথা বলেছি, তা নদী, ঝর্না, গুহা, নিকুঞ্জ, ইত্যাদিতে ঘেরা। ফুলে ফুলে ঢাকা এদের তট ও উঁচু উঁচু প্রাসাদ। এই সব পর্বত মাঝে অসংখ্য অনুপম কুঞ্জ আছে, মতবাত পাখির গান শোনা যায়। সিংহ, বাঘ, সরভ ইত্যাদি জন্তুতে পর্বত পরিপূর্ণ, এদের মধ্যে দশটি পর্বত খুব উঁচু। সূর্যের রথবাহী ঘোড়র ক্ষুরের আঘাত লাগে সেই পর্বত চূড়ায়। জঠর ও দেবকূট এই দুটো পর্বত পূর্বদিকে রয়েছে। এর দক্ষিণ-উত্তর ভাগের আয়তন নীল নিষধাচল পর্যন্ত ব্যাপ্ত। দক্ষিণ কৈলাস ও হিমবান ও উত্তরদিকে। এর পূর্ব ও পশ্চিমে আয়তন এবং সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। হে দ্বিজগণ আপনাদের যে উঁচু কনকাঁচল সুমেরুর কথা বলেছি এবার তার কথা বলছি। মেরুর চারিদিকে চারটে মহান পাদ রয়েছে। ঐ চারটে পাদ এই সপ্তদ্বীপা মহীকে ধরে রাখে। তাই এটি কখনো টলে না। ঐ চারটে পাদের আয়াম দশ হাজার যোজন বলা হয়। এরা নানারত্নে শোভিত। দেব, গন্ধর্ব ও যক্ষদের বাসস্থল। ঐ সব পাদ থেকে অসংখ্য ঝরনার শব্দ শোনা যায়। অসংখ্য ফুলে বৃক্ষ দিয়ে পাদদেশগুলো সাজানো।

এদের স্থানে স্থানে অনেক রত্নখচিত নানা গুহা রয়েছে। তাদের কতস্থানে গৃহ, সুসজ্জিত তটদেশ। সুন্দর মনোরম আশ্রম রয়েছে সেখানে, পূর্বদিকে মন্থর, দক্ষিণে গন্ধমাদন পশ্চিমে বিপুল, উত্তরদিকে সুপার্শ্ব পর্বত রয়েছে। এদের শৃঙ্গের ওপরে চারটে মহাবৃক্ষ প্রদীপ্ত কেতুরূপে উৎপন্ন হয়ে রয়েছে। এইসব গাছের মূল দৃঢ়, এরা হাজার হাজার শাখা নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত। এদের মূলে যেসব বেদী রয়েছে তারা হীরা, বৈদুর্যমণিতে তৈরী। গাছগুলোর স্নিগ্ধ পাতার ছায়ায় এই আশ্রমগুলি ফুলে ফলে পূর্ণ। যক্ষ, গন্ধব, সিদ্ধ ও চারণরা এইসব গাছের সেবা করেন। মন্দর গিরির শৃঙ্গে এক মহাবৃক্ষ আছে। এর শাখা প্রশাখার সামনের দিক ও কোটর, চারিদিকে ঝুলে রয়েছে। এইসব গাছে সমস্ত ঋতুতে ফুল ফোটে। তারা এক একটি মহাকুম্ভের সমান। বাতাসে এর সুগন্ধ চারিদিকের হাজার যোজন স্থান আমোদিত করে।

হে দ্বিজগণ, ভদ্ৰাস্ব নামে এক প্রধান কেতুস্থানীয় দেশ প্রসিদ্ধ আছে, যেখানে সাক্ষাৎ হৃষিকেশকে সিদ্ধ পুরুষরা পুজো করে। সেই দেশে এই গাছ আছে এর নাম ভদ্ৰকদম্ব। হরি পুরাণকালে একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে ঐ গাছের কাছে আসেন। তিনি সেখানে এসে সমস্ত দ্বীপ দেখেন। এজন্য ঘুরে তার নাম মিলিয়ে ঐ দেশের নাম হয় ভদ্ৰাস্ব। দক্ষিণ পর্বতের চূড়ায় একটি বিশাল জাম গাছ রয়েছে। এটি ফুলে ফলে শোভিত। এর ফল বৃহৎ, সুস্বাদু অমৃতের মতো। পাহাড় চূড়ায় বরফ পড়ে জম্বু নামে মধুবাহিনী নদীর সৃষ্টি হয়েছে। দেব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস প্রমুখরা অমৃতের মতো জন্ধুরস পান করে। এই জম্বু বৃক্ষের জন্য দ্বীপের নাম জম্বুদ্বীপ হয়েছে। পশ্চিম দিকে একটি অশ্বথ গাছ রয়েছে। পাহাড় চূড়ায় বহু পুরানো এই গাছ থেকে অনেক ঝুরি নেমেছে। গাছটির তলে সুবর্ণ মণিময় বেদী রয়েছে। এই গাছে বহু প্রাণী বাস করে, ফলগুলিও লোভনীয়। এটি কেতুমাল প্রদেশের কেতু নামে প্রসিদ্ধ।

হে বিপ্রগণ! কিজন্য কেতুমাল নাম হল তা বলছি শুনুন। পুরাকালে সমুদ্র মন্থনে দৈত্যপক্ষ পরাজিত হয়। ইন্দ্রদেব যুদ্ধ ক্ষেত্রে একটি মালা পরে ছিলেন। ওই প্রবল যুদ্ধের পরও সে মালাটি অবিকৃত হইল। ইন্দ্র তখন ঐ মালাটি অশ্বথগাছের গলায় নিজেই পরিয়ে দেন। তখন থেকে সিদ্ধ চারণরা সেই সৌভাগ্যবতী মালাকে পুজো করতে থাকেন। সেই কেতু স্বরূপ গাছের ওপর ঐ দেবদত্ত মালা সদাসর্বদা বিরাজ করত। হাওয়ার দোলায় এটি সুগন্ধ ছড়াত। এজন্য কেতু ও মালা এই দুই-এর নামে পশ্চিমদিকের এই দ্বীপটি কেতুমাল নামে বিখ্যাত হল স্বর্গে ও মর্তে। সাপাস্ব পর্বতের উত্তর চূড়ায় ন্যাগ্রোধ নামে এক মহাবৃক্ষ আছে। এটি বহু যোজন পর্যন্ত বিস্তৃত। সিদ্ধ ও চারণেরা এই গাছের সেবা করেন। এই গাছের শাখা-প্রশাখায় মধুফলের সমাহার। ঐ গাছ উত্তর কুরুদেশের কেতুরূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সনকুমার প্রভৃতি মহাভাগ সাত ব্রহ্মানন্দনদের নামে উত্তরকুরু বিখ্যাত। এই সব সুন্দর শশ্বেত দেশে পুণ্যকীর্তি জ্ঞানী ব্রহ্ম কুমাররা থাকতেন। সাত মহাত্মা মানস পুত্রের নামে ঐ দ্বীপ উত্তরকুরু নামে স্বর্গে ও মর্ত্যে বিখ্যাত।

.

সপ্তত্রিংশ অধ্যায়

সূত বললেন– আগে চারটে পর্বতের কথা বলেছি। সেগুলির রমণীয় সংস্থান-এর কথা বলছি। ঐ পর্বতে সমস্ত ঋতু ফল, ফুলে ভরা। এখানে স্থানে স্থানে ময়ূর, সারিকা, চপের মদ্যোকট সূক ও ভৃঙ্গ রাজেরা দলে দলে বিচরণ করে। কোকিল, বন্ধু, হেমক প্রভৃতি পাখির নিনাদে ও অন্যান্য শব্দে ঐসব প্রদেশে সব সময়ই মুখরিত। কোথাও মৌমাছিদের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কখনও মৃদু হাওয়ায় সুন্দর পাতাগুলি দুলে দুলে ফুল ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে। প্রতিটি পর্বতের স্থানে স্থানে কতশত রমণীয় সুন্দর পাথর। দেব, দানব, গন্ধর্ব অপ্সরা, সিদ্ধ, যক্ষ ইত্যাদিরা ইচ্ছেমতন ঘুরে বেড়ায়। চারটে পর্বতের চারদিকে চারটে দেহবাদ্যান আছে, এদের নাম হল পূর্বে চিত্ররথ, দক্ষিণে মন্দন, পশ্চিমে বিভ্রাজ ও উত্তরে সবিতৃবন।

এই সব মহাবনের ভেতরে সুন্দর সুললিত পাখির কূজনে ভরা, সবিশাল মহাপুণ্য গাছেরা রয়েছে। এখানে মহানাগেরা থাকে আর থাকেন মহাত্মারা। সুনির্মল সুশীতল সব জলাশয় রয়েছে এসব বনের ভেতরে। সরোবরে পদ্ম ও অন্যান্য ফুলগুলি সুগন্ধযুক্ত, বড় বড় ছাতার মতো এদের আয়তন। এদের মধ্যে চারটে মহাসরোবরের নাম হল–পূর্বে অরুণোদ, দক্ষিণে মানস, পশ্চিমে শীতোদ ও উত্তরে । মহাভদ্র। মন্দর গিরির পূর্বদিকে অরুণোদ সরোবরের পাশে অনেক পাহাড় আছে। মানস সরোবরে দক্ষিণে অনেক পর্বত রয়েছে। যথা–শ্রী শিখের, শিশির, কলিঙ্গ, পতঙ্গ প্রভৃতি। শীতোদ সরোবরের পশ্চিম দিকের মহাপর্বতগুলি হল–বৈদুর্যগিরি, পরিজাত, মধুখান, অঞ্জন প্রভৃতি। মহাভদ্র সরোবরের উত্তরের পর্বতগুলি হল-হংসনাগ–কপিল, নীল, কনকশৃঙ্গ ইত্যাদি। এইসব পর্বতের মাঝে যে সরোবর আছে তাদের কথা এবার বলব।

.

অষ্টত্রিংশ অধ্যায়

সূত বললেন, পাহাড়ের মাঝখানে যে সব জলাশয় আছে তা পাখির কলরবে মুখরিত, সেখানে অনেক জলচর প্রাণীর বাস। ঐসব বনভূমি তিনশো যোজন আয়তন ও শতযোজন বিস্তৃত। এখানে একটি সরোবর আছে। তার জল নির্মল, স্বাদু, পম ও অন্যান্য ফুলে ভরা। এই পুণ্য সরোবরের কথা সবাই জানে। এর নাম শ্রীঘর। এই সরোবরের পদ্ম বনে একটি মহাপদ্ম রয়েছে। এর কোটি কোটি পাপড়ি সূর্যের মতো উজ্জ্বল, সবসময়ই ফুটে থাকে। কখনো শুকায় না বা ঝরে পড়ে না। কমল কুসুমে ঢাকা এই গাছের মধ্যে ভ্রমর গুনগুন করে। ঐ পদ্মে সাক্ষাৎ ভগবতী লক্ষ্মী বিরাজ করছেন।

ঐ সরোবরের পূর্ব দিকে এক বিরাট বিশ্ব বন রয়েছে। ফল, ফুলে পরিপূর্ণ সেই বন। এটি একশ যোজনে বিস্তৃত ও ত্রিশ যোজন আয়ত, হাজার হাজার মহাবৃক্ষ আছে। এইগুলি উচ্চতায় বিশাল ও অজস্র, শাখা-প্রশাখায় ভরা। সোনার মতো ফলগুলি সুস্বাদু অমৃতের মতো। বনটির নাম শ্ৰীবন। এটি সর্বলোক সিদ্ধ। এই বিশ্ব বনে গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ রয়েছে। সিদ্ধজনেরা বিফলের আশায় সব সময়ে বনে বিচরণ করে। বিবিধ ভূতবৃন্দ সবসময়ই ঐ বনে থাকে। আর সাক্ষাৎ লক্ষ্মীদেবী এই বনে রয়েছেন, সিদ্ধরা সবসময় তাকে প্রণাম করেন।

বিকল্প ও মণিশৈলের একশ যোজন বিস্তীর্ণ ও দুইশো যোজন আয়ত এক বিপুল চম্পক বন রয়েছে। এখানে চারণ, সিদ্ধজনেরা আছেন, এই বনে অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় ভরা গাছ রয়েছে। এই গাছ গুলো দিয়ে চম্পক বন ঘেরা। সুগন্ধি যুক্ত সুন্দর ফুল দিয়ে সমস্ত চম্পক বন শোভিত।

দেব, দানব গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, কিন্নর, অপ্সরী ও মহানাগেরা ঐ বনে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়ায়। সেখানে ভগবান কশ্যপ প্রজাপতির এক আশ্ৰম আছে। সিদ্ধজনেরা সেখানে থাকেন। বেদধ্বনিতে আশ্রম স্থানগুলি মুখরিত।

এই পর্বতের মধ্যে সুখা নামে একটি মহানদীর তীরে একটি অতি সুন্দর তালবন আছে। সেই বনের উচ্চতা অনেক আর দৈর্ঘ্য ত্রিশ যোজন আর প্রস্থে পঞ্চাশ যোজন। ঐ বনে বহু বৃক্ষ রয়েছে। এরা মহামূল বিশিষ্ট, স্থির। এই সবগাছের ফলগুলি সুগন্ধ ও সুরসযুক্ত। এই তালবন ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত এর বাসভূমি নামে বিখ্যাত। এ ছাড়া বেণুমণ্ড ও সুমেরু পর্বতের উত্তরে এক বন আছে। এটি একশো যোজন বিস্তৃত। এতে গাছ লতা কিছুই নেই, এখানে শুধু দূর্বাবন রয়েছে, কোন প্রাণী নেই। নিষধ ও দেব পর্বতের উত্তরে হাজার যোজন আয়ত বিস্তৃত ভূভাগ আছে। এতে গাছ, গুল্ম, লতা কিছুই নেই, শুধু পা ডুবে যায় এমন জলে ভূমিটি পরিপূর্ণ।

.

নবত্রিংশ অধ্যায়

সূত বললেন–যেসব সিদ্ধসেবিত পাহাড় দক্ষিণ দিকে আছে, তাদের বিবরণ বলছি শুনুন। বিশাল মহাপর্বত শিশির ও পতঙ্গ এই দুই পর্বতের মধ্যভাগে এক রমণীয় উদুম্বর বন রয়েছে। উঁচু উঁচু বিশাল শাখা-প্রশাখা যুক্ত নানারকম গাছে পূর্ণ আর সেখানে নানা জাতীয় পাখি রয়েছে। গাছের ফলগুলি আকারে বিশাল। মহামূল্য মণিরত্নের মতোই বর্ণোজ্জ্বল। এই সব সুন্দর ফলে যজ্ঞডুমুরের এই বন উজ্জ্বল। সিদ্ধ, রক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, উরগ, বিদ্যাধরেরা আনন্দিত হয়ে এই বনের সেবা করেন। বনের পুণ্য জলধারা নিয়ে নদী বয়ে চলেছে। মধ্যে মধ্যে চারিদিকে সরোবর। সেখানে ভগবান কদম প্রজাপতির আশ্রম।

এই আশ্রম রমণীয়, দেবতারা এই আশ্রমের সেবা করেন। সেই বনভূমির চারিদিকের মণ্ডল একশো যোজন বিস্তৃত। তাম্রপর্ণ ও পতঙ্গ পাহাড়ের মাঝে একশো যোজন চওড়া, দুশো যোজন লম্বা একটি মহাপুণ্য সরোবর আছে। হাজার হাজার পদ্মফুলে শোভিত। এই সরোবরে দেব দানব ও মহানাগেরা থাকেন। বনের ভেতর একটি একশো যোজন চওড়া আর ত্রিশ যোজন লম্বা লাল রঙের ধাতুমণিজাত জনপদ আছে। উঁচু উঁচু পাঁচিল যুক্ত, তোরণদ্বার যুক্ত প্রাসাদ আছে। সেখানে অনেক নরনারীর বাস ও ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। সেখানে জনপদের মাঝখানে এক সুসজ্জিত বিদ্যাধর পুরী। এই পুরীর ভিতর যেসব উঁচু উঁচু মহাভবন রয়েছে, সেগুলি নানারকম মণিখচিত, নানা ছবিতে অলঙ্কৃত। ঐ পুরীর মধ্যে বিখ্যাত বিদ্যাধরপতি শুলোমা বাস করেন। তিনি বিচিত্র বেশধারী মাল্যযুক্ত ও মহেন্দ্রের মতো দ্যুতিময়। সূর্যের মতো তেজময়, বিচিত্র বেশধারী, হাজার হাজার বিদ্যাধর নিয়ে তার রাজসভা। মহাপর্বত বিশাল ও পতঙ্গের মধ্যে তাম্রপর্ণ নামে সরোবরের পূর্বতীরে এক সুসমৃদ্ধ বিরাট আমবন রয়েছে। ঐ বন সুন্দর শাখাযুক্ত, নানাবর্ণে শোভিত ফল রয়েছে। গাছগুলোতে পাতার থেকে ফলের সংখ্যাই বেশি। ঐসব ফলের আকার, গন্ধ, স্বাদ সেই সুস্বাদু অমৃতের রস পান করে থাকে। মহাত্মারা এই রস পান করে আনন্দিত।

হে বিপ্রগণ! অচলেন্দ্র সমূলে ও বসুধারের মাঝে ত্রিশ যোজন বিস্তৃত আর পঞ্চাশ যোজন আয়তন পরিমাণ এক বিল্বন রয়েছে। ঐ বনে অনেক পাখি রয়েছে, বনটি সুমিষ্ট কলকাকলিতে পরিপূর্ণ। বনের গাছগুলি ফলভারানত। ঐসব ফল পেকে গাছের নীচে পড়লে সেখানকার বিস্তীর্ণ মাটি কাদা হয়ে যায়।

বিল্বফল প্রিয় যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, সিদ্ধ ও নাগেরা ঐ বনে আশ্রয় নিয়ে থাকে। বসুধায় ও রত্নধার পর্বতের আড়ালে ত্রিশ যোজন লম্বা একশো যোজন চওড়া এক সুগন্ধ পুষ্পবন আছে, এটি কিংশুক বন। ফলের বর্ণে ও শোভায় সমস্ত বন যেন আলোকিত হয়ে আছে। শত যোজনব্যাপী সেই পুষ্প-কানন সৌরভে পূর্ণ। সিদ্ধ ও চারণ ও অপ্সরাগণ এই জলাশয়ের ধারে সুরম্য কিংশুক বনে ঘুরে বেড়ান। প্রজাপতি, আদিত্যগণ প্রতিমাসে সেখানে নেমে আসেন। পঞ্চকূট ও কৈলাস পর্বতের মাঝখানে ছত্রিশ যোজন আয়ত ও একশো যোজন বিস্তৃত বনভূমি রয়েছে, এটি পার হওয়া যায় না। বনের সমস্ত জায়গা হাঁসের গায়ের রঙের মত সাদা, ছোট প্রাণী পর্যন্ত সে বনের কোথাও নেই।

এবার যেসব বনভূমি, পর্বত আছে তার বর্ণনা করছি। সুবক্ষ ও শিখি, পাহাড়ের আড়ালে চারিদিকে একশো যোজন বিস্তীর্ণ ভূমিময় শিলাতল রয়েছে। এটিকে স্পর্শ করা যায় না, প্রচণ্ড উত্তপ্ত। এটি ঈশ্বর এর পক্ষেও ভয়াবহ। সেই পাথরে বিশাল বেদীর মাঝখানে ত্রিশ যোজন জায়গা জুড়ে অগ্নিকুণ্ড রয়েছে। সবসময় সেখানে আগুন জ্বলছে। অগ্নির যে ভাব কল্পনা করা হয়েছে, সেই সংবর্তক অগ্নি সব সময় সেখানে জ্বলছে। দেবাপি ও জয়ের আড়ালে দশযোজন আয়ত এক মাতলঙ্গ স্থলী রয়েছে। পাকা, মধুময় ফলে শোভিত। সেখানে বৃহস্পতির এক আশ্ৰম আছে। সিদ্ধজনের এখানে বাস করেন।

কুমুদ ও অঞ্জন পাহাড়ের মাঝে বহু যোজন আয়ত কেসর নামে নিম্নভূমি রয়েছে। সেই বনে সমস্ত কালের ফুল ফুটে রয়েছে। সবসময় এখানে শত ভ্রমররা গুঞ্জন করে থাকে। ফুলগুলো চাঁদের কলার মত সাদা, মনোহর গন্ধ বিশিষ্ট। সেখানে সুর গুরু বিষ্ণুর আবাস। এটি তিনলোকে বিখ্যাত ও নমস্কৃত।

কৃষ্ণ ও পাণ্ডু নামে শৈলরাশির মাঝখানে ত্রিশ যোজন বিস্তীর্ণ নব্বই যোজন আয়ত শিলাময় এক সুন্দর সমভূমি রয়েছে। সেখানে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করা যায়। এক রমণীয় সরোবরে হাজার হাজার পদ্ম শোভা পাচ্ছে। সুগন্ধযুক্ত বিশালকার পদ্মবন ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখরিত। এখানে স্থলপদ্মের বন অনেক দূর বিস্তৃত। এর মাঝে একটি বিশাল বটগাছ রয়েছে, এই গাছটি পাঁচ যোজন জায়গা ঘিরে রয়েছে! এর অনেক শাখা-প্রশাখা, সেখানে ভগবান নীলাম্বর দেব রয়েছেন। তার আকার চাঁদের মতো সাদা। তিনি শ্রীহরি, পূর্ণচন্দ্রের মতো তাঁর মুখ, সহস্রবদন, তিনি দেবতাদের শত্রুনাশ করে থাকেন। সেই মহাভাগকে সেই পদ্মমালা শোভিত বনের মধ্যে যক্ষ, গন্ধর্ব, বিদ্যাধরেরা পূজা করে থাকেন। এই জায়গাটি অনন্ত পদ নামে তিনলোকে বিখ্যাত।

হাজার শিখর ও কুমুদাচলের আড়ালে যে পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে সেখানে রয়েছে প্রচুর পাখি। এর চারদিকে ফলের গাছ। গাছগুলি প্ৰকাণ্ড সুমিষ্ট সুগন্ধযুক্ত ফলে ভরা। ঐ শিখরে পুণ্যকর্ম ভগবান শুক্রাচার্যের এর পুণ্যাশ্রম আছে। ঐ আশ্রম দেব ও ঋষিরা সেবা করে থাকেন। আশ্রমটি দেখতে অতি উজ্জ্বল। শঙ্খকূট ও বৃষভ পাহাড়ের আড়ালে অনেক দূর বিস্তৃত এক রমণীয় শব্দ যকস্থলী আছে। সেখানে বৃন্তচ্যুত পুরুষ ফলের রসে মাটি কাদা হয়ে যায়। ঐ সব পুরুষ্ঠ ফল বেলের মত সুগন্ধি, সুন্দর, মহা সুস্বাদু। কিন্নর, উরগভ, চারণেরা এই পুরুষ্ঠ ফলের রস পান করে থাকেন। কপিঞ্জল ও নাগপর্বতের আড়ালে এক বৃক্ষ বন বিভূষিত মহাস্থলী আছে। অনেক রমণীয় দ্রাক্ষা বন, খেজুর বন, সুস্বাদু ডালিম, অতসী, তিলক, কলাবন চারিদিকে পরিপূর্ণ।

ঐসব বনের মধ্যে দিয়ে স্বাদু শীতল জলের নদীগুলি বয়ে গেছে। পুষ্কর ও মহামেষ নামে পাহাড়ের আড়ালে ছয় যোজন লম্বা ও একশো যোজন চওড়া এক বনভূমি আছে। এর নাম কানন স্থল। এই জায়গাটি কঠিন প্রান্তর। এতে গাছ, লতা, তৃণ কিছুই নেই। কোন প্রাণীও নেই। এই রকম কত যোজন যোজন বিস্তৃত মহাসরোবর, মহাবন, বনস্থলী ইত্যাদি আছে তার হিসাব নেই। এমন কত ঘোর বনভূমি আছে যেখানে দিনের বেলায় পর্যন্ত সূর্যালোক পৌঁছায় না।

.

চল্লিশতম অধ্যায়

সূত বললেন–এরপর যে যে পর্বতে বিভিন্ন দেবতাদের সুন্দর সুন্দর বাসস্থান রয়েছে সেই স্থানগুলির কথা বলব। ঐসব পাহাড়ের মাঝে শীতাস্ত নামে এক বহুদূর বিস্তৃত মহাপর্বত রয়েছে। ঐ পাহাড়ে অনেক রত্ন-মণি-মাণিক্য ইত্যাদি আছে। আর চারিদিকে ফুলের বন রয়েছে। গিরির চারধার ভ্রমর গুঞ্জনে গুঞ্জরিত। ফুলে ঢাকা সানুদেশ, লতায় ভরা। প্রস্রবণের মাঝে নিকুঞ্জবন আছে। পর্বতের স্থানে স্থানে গুহা আছে, সেখানে গন্ধর্ব ও যক্ষরা থাকেন। এই পাহাড় ঘন জঙ্গলে ভরা। এখানে দেবরাজের বিরাট পারিজাত বন, মলয় পবন সেই পারিজাত ফুলের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে দিত। সেখানেও বহু সরোবর আছে। সরোবরের জলে সোনার মত দ্যুতিময় অনেক ফুল, ফল ও বিচিত্র পাখির কলকাকলি মুখর। এটি মহৎ ক্রীড়াবন বলে বিখ্যাত। এর ভেতরে বিচিত্র আকারের নানা বানর বা অন্যান্য প্রাণীরা ঘুরে বেড়ায়। এই ইন্দ্রবনে সুন্দর সুন্দর বিহারভূমি আছে। ঐসব ভূমি নানা রত্নময় শয্যা ও আসনে সাজানো। ঐ স্থানে সূর্য না অতি উষ্ণ না অতি শীত হয়ে সবসময় প্রকাশ পায়। বসন্তের বাতাস ফুলের গন্ধে সুবাসিত হয়ে বয়ে যায়। ঐ বাতাস সব সময়ই শ্রম ও ক্লান্তি কমিয়ে দেয়। ঐ পর্বতের পূর্বদিকে কুমুঞ্জ নামে এক শৈলেন্দ্র আছে, এটি খুব উঁচু, সেখানে অনেক ঝরনা ও গুহা রয়েছে। ঐ পর্বতের শৃঙ্গগুলোতে মহাত্মা দানবদের বহু বিস্তৃত আটটি পুরী আছে। তক পর্বতে রাক্ষসদের অনেক বাসস্থান আছে। ঐ আবাস ভবনগুলো বহু নর-নারীর আবাস। ঐ সব গৃহে নীলক নামে ভীষণ নিশাচরেরা সব সময় থাকে। এই সব নিশাচর ভীষণ বলবীর্যশালী।

শৈলেন্দ্র মহানীলের উপরিভাগে মহাত্মা কিন্নরদের পনেরোটি পুরী আছে। দেবসেন ও মহাবাহু প্রভৃতি পনেরো জন গর্বিত কিন্নররাজ ঐ সব পুরীর রাজা। সেখানে নগরের প্রাচীরগুলো প্রায়ই সোনা দিয়ে ঢাকা, ও অন্যান্য বর্ণে রঞ্জিত। ঐ সব নগরের ভেতরে শত শত ভীষণাকারে বিষধর সাপ বাস করে, মহাপর্বত সুনাগের ওপর হাজার হাজার-দৈত্যের বাসস্থান আছে। সুরম্য অট্টালিকা রয়েছে। সেখানে, নগরটি প্রাচীর ও তোরণে ঘেরা।

বেনুমন্ত পাহাড়ের উপরে তিনটি বিদ্যাধর পুরী আছে। উলুক, রোমশ ও মহান্ত্রে নামে তিনজন শক্তিশালী প্রধান বিদ্যাধর এই পুরের রাজা। বৈকুণ্ঠ নামে পাহাড় চূড়োর ভেতরে অনেক ঝরনা আছে। ঐ মহাউচ্চ রত্নধাতু যুক্ত চূড়াতে সুগ্রীব নামে এক বীর্যবান গারুড়ি আছে। এর গতিবেগ বাতাসের মতো। বিকল্ক পাহাড়ে মহাবলী, অতিকায় সব পাখি আছে। করঞ্জ পাহাড়ে সাক্ষাৎ ভূতপতি বৃষবাহন যোগীবর মহাদেব শঙ্কর সব সময় রয়েছেন। তার চারপাশে নানা বেশধারী দুর্ধর্ষ ভূত ও প্রমথরা রয়েছে। বসুধার পর্বতে আটজন মহাত্মা বসুদেব আছে। মহাপর্বত হেমশৃঙ্গ চতুরানন প্রজাপতির পুণ্য আশ্রম রয়েছে। গিরিবর রত্ন ধাতুর উপরিভাগে মহাত্মা সপ্তর্ষিদের সাতটি আশ্রম আছে। শৈলেন্দ্র সুমেধ নানা ধাতুরাগে রাঙ্গানো।

এটি দেখতে মেঘের মতো, এই পাহাড়ের চূড়ায় আদিত্যরা, বসুগণ, রুদ্রেরা, ও অশ্বিনীকুমার দ্বয় এর রমণীয় আশ্রমগুলো আছে। যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নরেরা এই সব আশ্রমে পুজার কাজ করে থাকে। হেমকক্ষে রয়েছে এক সুসমৃদ্ধ গন্ধর্ব নারী। বিশাল উঁচু প্রাচীর ও সুন্দর সুন্দর তোরণ দিয়ে এটি ঘেরা। যুদ্ধ বিদ্যাশালী গন্ধর্বরা ঐ পুরীতে থাকেন, রাজা কপিঞ্জল এদের অধিপতি। অনল পর্বতে রাক্ষসদের বাসস্থান ও পঞ্চকূট দানবদের বাসস্থান। শতশৃঙ্গ পর্বতে অমিত তেজা যক্ষদের একশোটি পুরী আছে। তাম্র শিখরে কদ্রু পুত্র তক্ষকের এক শ্রেষ্ঠ পুরী আছে। পর্বতশ্রেষ্ঠ নিশাচকে যক্ষ ও গন্ধর্বদের জন্ম হয়েছে। ঐ স্থানে কুবেরের মহাভবন, হরিকূট শৈলে সমস্ত জনের প্রণম্য বরিদের বাস। কৃষ্ণাচলে গন্ধবদের বিশাল পুরী। মহাগিরি সহস্ৰশৃঙ্গ কঠোর কর্ম দৈত্যদের এক সহস্র পুরী আছে। পুষ্পক পর্বতে মুনিরা সবসময়ই আনন্দিত মনে থাকেন। এই সমস্ত অসংখ্য পাহাড় এবং সুরম্য অট্টালিকা প্রসাদে বাস করে গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ। নানা সিদ্ধজনেরা সবসময়ই নিজেদের ইষ্টদেবের পুজো করেন।