বইয়ের ব্যাবসা

বইয়ের ব্যাবসা

সাধারণত লোকের একটা বিশ্বাস আছে যে, বই-জিনিসটে পড়া সহজ কিন্তু লেখা কঠিন। অপর দেশে যাই হোক, এদেশে কিন্তু নিজে বই লেখার চাইতে অপরকে পড়ানো ঢের বেশি শক্ত। শনতে পাই যে, কোনো বইয়ের এক হাজার কপি ছাপালে এক বৎসরে তার এক শ’ও বিক্রি হয় না। সাধারণ লেখকের কথা ছেড়ে দিলেও, নামজাদা লেখকদেরও বই বাজারে কাটে কম, কাটে বেশি পোকায়। বাংলাদেশে লেখকের সংখ্যা বেশি কিংবা পাঠকের সংখ্যা বেশি, বলা কঠিন। এবিষয়ে যখন কোনো স্ট্যাটিসটিকস পাওয়া যায় না, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে মোটামটি দুই সমান। কেউ-কেউ এমন কথাও বলে থাকেন যে, লেখা ও পড়া এ দুটি কাজ অনেক স্থলে একই লোকে করে থাকেন। একথা যদি সত্য হয়, তাহলে অধিকাংশ লেখকের পক্ষে নিজের লেখা নিজে পড়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। কেননা, পরের বই কিনতে পয়সা লাগে, কিন্তু নিজের বই বিনে-পয়সায় পাওয়া যায়। অবশ্য কখনো-কখনো কোনো-কোনো বই উপহারস্বরূপে পাওয়া যায়, কিন্তু সেসব বই প্রায়ই অপাঠ্য। এরূপ অবস্থায় বঙ্গসাহিত্যের ক্ষতি হওয়া প্রায় একরূপ অসম্ভব। কারণ, সাহিত্যপদার্থটি যাই হোক না কেন, বই হচ্ছে শুধু বেচাকেনার জিনিস, একেবারে কাঁচামাল। ও মাল ধরে রাখা চলে না। গাছের পাতার মত বইয়ের পাতাও বেশি দিন টেকে না, এবং একবার ঝরে গেলে উনন-ধরানো ছাড়া অন্য কোননা কাজে লাগে না।

এ অবস্থা যে সাহিত্যের পক্ষে শোচনীয় সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কার দোষে যে এরূপ অবস্থা ঘটেছে, লেখকের কি পাঠকের, সেকথা বলা কঠিন। অবশ্য লেখকের পক্ষে এই বলবার আছে যে, এক টাকা দিয়ে একখানি বই কেনার চাইতে, এক শ টাকা দিয়ে একখানি বই ছাপানো ঢের বেশি কষ্টসাধ্য। অপরপক্ষে পাঠক বলতে পারেন যে, এক শ’টি টাকা অন্তত ধার করেও যে-সে বাংলা বই ছাপানো যেতে পারে, কিন্তু নিজের বুদ্ধি অপরকে ধার না দিয়ে যে-সে বাংলা বই পড়া যেতে পারে না। অর্থকষ্টের চাইতে মনঃকষ্ট অধিক অসহ্য। আমার মতে, দু পক্ষের মত এক হিসেবে সত্য হলেও আর-এক হিসেবে মিথ্যা। বই লিখলেই যে ছাপাতে হবে, এইটি হচ্ছে লেখকদের ভুল; আর বই কিনলেই যে পড়তে হবে, এইটি হচ্ছে পাঠকদের ভুল। বই লেখা জিনিসটে একটা শখমাত্র হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বই-কেনাটা শখ ছাড়া আরকিছু হওয়া উচিত নয়।

বাংলাদেশে বাংলাসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হওয়া উচিত কি না, সেবিষয়ে আমি কোনো আলোচনা করতে চাই নে। কারণ, সাহিত্য-শব্দ উচ্চারণ করবামাত্র নানা তর্কবিতক উপস্থিত হয়। অমনি চারধার থেকে এইসব দার্শনিক প্রশ্ন ওঠে, সাহিত্য কাকে বলে, সাহিত্যে কার কি ক্ষতি হয় এবং কার কি উপকার হয়? তারপর সাহিত্যকে সমাজের শাসনাধীন করে তার শাস্তির জন্য সমালোচনার দণ্ডবিধি-আইন গড়বার কথা হয়। সমালোচকেরা একাধারে ফরিয়াদি উকিল বিচারক এবং জল্লাদ হয়ে ওঠেন। সতরাং কথাটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, সাহিত্য যে কি সেসম্বন্ধে যখন এখনো একটা জাতীয় ধারণা জন্মে যায় নি, তখন এবিষয়ে এক কথা বললে হাজার কথা শুনতে হয়। কিন্তু বই-জিনিসটে কি, তা সকলেই জানেন। এবং বাংলা বই যে বাজারে চলা উচিত। সেবিষয়ে বোধ হয় দ-মত নেই, কারণ ও-জিনিসটে স্বদেশী শিল্প। যদি কারও এবিষয়ে সন্দেহ থাকে, তাহলে তা ভাঙাবার জন্যে দেখিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, নব্য স্বদেশী শিল্পের যে দুটি প্রধান লক্ষণ সে দুটিই এতে বর্তমান। প্রথমত নব্যসাহিত্য-পদার্থটা স্বদেশী নয়, দ্বিতীয়ত তাতে শিল্পের কোনো পরিচয় নেই।

লেখা-ব্যাপারটা যতদিন আমরা মানুষের একটা প্রধান কাজ হিসেবে না দেখে বাজে শখ হিসেবে দেখব, ততদিন বইয়ের ব্যাবসা ভালো করে চলবে না। সুতরাং বঙ্গসাহিত্যের উন্নতি, অর্থাৎ বিস্তার, করতে হলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে এ যুগে সাহিত্য প্রধানত লেখাপড়ার জিনিস নয়, কেনাবেচার জিনিস। কোনো রচনাকে যদি অপরে অমুল্য বলে তাহলে রচয়িতার রাগ করা উচিত, কারণ সে পদার্থের মূল্য নেই, তা যত্ন করে পড়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।

ব্যাবসার দুটি দিক আছে : প্রথম, প্রোডাকশন (তৈরি করা), দ্বিতীয়ত, ডিসট্রিবিউশন (কাটানো)। মানবজীবনের এবং মালের জীবনের একই ইতিহাস, তাব একটা আরম্ভ আছে একটা শেষ আছে। যে তৈরি করে তার হাতে মালের জন্ম এবং যে কেনে তার হাতে তার মৃত্যু। জন্ম-মৃত্যু পর্যন্ত কোনো-একটি মালকে দশ হাত ফিরিয়ে নিয়ে বেড়ানোর নাম হচ্ছে ডিসট্রিবিউশন। সুতরাং বইয়ের জন্মবত্তান্ত এবং ভ্রমণবৃত্তান্ত দুটির প্রতিই আমাদের সমান লক্ষ্য রাখতে হবে।

এস্থলে বলে রাখা আবশ্যক যে, আমি সাহিত্যব্যবসায়ী নই; অর্থাৎ অদ্যাবধি বই আমিই কিনেই আসছি, কখনো বেচি নি। সুতরাং কি কি উপায় অবলম্বন করলে বই বাজারে কাটানো যেতে পারে, সেবিষয়ে আমি ক্রেতার দিক থেকে যা বলবার আছে তাই বলতে পারি, বিক্রেতা হিসেবে কোনো কথাই বলতে পারি নে।

সচরাচর দেখতে পাই যে, বই বিক্রি করবার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া, অধমূল্যে কিংবা শিকিমুল্যে বিক্রি করা, ফাউ দেওয়া এবং উপহার দেওয়া প্রভৃতি উপায় অবলম্বন করা হয়ে থাকে। এসকল উপায়ে যে বইয়ের কাটতির কতকটা সাহায্য করে সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেইসঙ্গে বাধাও যে দেয় সে ধারণাটি বোধ হয় বিক্রেতাদের মনে তত স্পষ্ট নয়।

প্রথমত, বিশখানি বইয়ের যদি একসঙ্গে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এবং তার প্রতিখানিকেই যদি সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়, তাহলে তার মধ্যে কোনখানি যে কেনা উচিত, সেবিষয়ে অধিকাংশ পাঠক মনস্থির করে উঠতে পারে না। অপরাপর মালের একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণীবিভাগ আছে। বিজ্ঞাপনেই আমাদের জানিয়ে দেয় যে, তার মধ্যে কোনটি পয়লা নম্বরের, কোনটি দোসরা নম্বরের, কোনটি তেসরা নম্বরের ইত্যদি; এবং সেই ইতরবিশেষ-অনুসারে দামেরও তারতম্য হয়ে থাকে। সুতরাং সেসব মাল কিনতে ক্রেতাকে বাঁশবনে-ডোমকানা হতে হয় না, প্রত্যেকে নিজের অবস্থা এবং রুচি অনুসারে নিজের আবশ্যকীয় জিনিস কিনতে পারে। কিন্তু বই সম্বন্ধে এরূপ শ্রেণীবিভাগ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া সম্ভব নয়; কেননা, যদিচ সাহিত্যে ভালোমন্দের তারতম্য অগাধ, তবুও কোনো লেখক তাঁর লেখা যে প্রথমশ্রেণীর নয়, একথা নিজমখে সমাজের কাছে জাহির করবেন না। সুতরাং বিজ্ঞাপনের উপর আস্থা স্থাপন করে, হয় আমাদের বিশখানি বই একসঙ্গে কিনতে হয়, নয় কেনা থেকে নিরস্ত থাকতে হয়। ফলে দাঁড়ায় এই যে, বই বিক্রি হয় না। কেননা, যাঁর বিশখানি বই কেনবার সংগতি আছে, তাঁর বিশ্বাস যে সাহিত্য নিয়ে কারবার করে শুধু লক্ষ্মীছাড়ার দল।

অর্ধমূল্যে এবং শিকিমূল্যে বিক্রি করবার দোষ যে, লোকের সহজেই সন্দেহ হয় যে বস্তাপচা সাহিত্যই শুধু ঐ উপায়ে ঝেড়ে ফেলা হয়। পয়সা খরচ করে গোলাম-চোর হতে লোকের বড়-একটা উৎসাহ হয় না।

কোনো বই ফাউ হিসেবে দেবার আমি সম্পূর্ণ বিপক্ষে। আর-পাঁচজনের বই লোকে পয়সা দিয়ে কিনবে এবং আমার বইখানি সেইসঙ্গে বিনে পয়সায় পাবে, একথা ভাবতে গেলেও লেখকের দোয়াতের কালি জল হয়ে আসে। লেখকদের এইরূপ প্রকাশ্যে অপমান করে সাহিত্যের মান কিংবা পরিমাণ দয়ের কোনোটিই বাড়ানো যায় না। যদি কোনো বই বিনামূল্যে বিতরণ করতেই হয় তো প্রথম থেকে প্রথম সংস্করণ এইরূপ বিতরণ করা উচিত, যাতে করে পাঠকদের সঙ্গে সহজে সে বইটির পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। উক্ত উপায়ে Tab-সিগারেট এদেশে চালানো হয়েছে। প্রথমে কিছুদিন বিলিয়ে দিয়ে, তারপর দ্বিগুণ: দাম চড়িয়ে সে সিগারেট আজকাল বাজারে বিকি করা হচ্ছে; এবং এত বিক্রি বোধ হয় অন্য-কোনো সিগারেটের নেই। বই-জিনিসটিকে মেপত্রের সঙ্গে তুলনা করাটাও অসংগত নয়। কারণ অধিকাংশ বই কাগজেমোড়া ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সে যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে এই যে, বিজ্ঞাপনাদির দ্বারা লোকের মনে শুধু কেনবার লোভ জন্মে দেওয়া যায় কিন্তু কোনো যায় না। কোনো জিনিস কাউকে কেনাতে হলে সেটি প্রথমত তার হাতের গোড়ায় এগিয়ে দেওয়া চাই, তারপর সেটি তাকে গতিয়ে দেওয়া চাই। এ দুই বিষয়ে যে পুস্তকবিক্রেতারা বিশেষ-কোনো যত্ন করেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আমার বিশ্বাস যে, নতুন বাংলা বই যদি ঘরে-ঘরে ফেরি করে বিক্রি করা হয়, তাহলে বঙ্গসাহিত্যের প্রতি লক্ষ্মীর দৃষ্টি পড়বে।

সাহিত্যে প্রোডাকশন সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, ডিম্যাণ্ডের প্রতি লক্ষ্য রেখে সাহিত্য সাপ্লাই করতে হবে। যে বই লোকে পড়তে চায় না, সে বই অপর যে-কোনো উদ্দেশ্যেই লেখা হোক না কেন, বেচবার উদ্দেশ্যে লেখা চলে না। এবং কি ধরনের বই লেকে পড়তে চায়, সেবিষয়ে একটা সাধারণ কথা বলা যেতে পারে। এটি একটি প্রত্যক্ষ সত্য যে, সাধারণ পাঠকসমাজ দুই শ্রেণীর বই পছন্দ করে না এক হচ্ছে ভালো, আর এক হচ্ছে মন্দ। যে বই ভালোও নয় মন্দও নয়, অমনি একরকম মাঝামাঝিগোছের সেই বই মানুষে পড়তে ভালোবাসে এবং সেইজন্য কেনে। প্রতি দেশে প্রতি যুগে প্রতি জাতির একটি বিশেষ সামাজিক বুদ্ধি থাকে। সে বুদ্ধির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সংসারযাত্ৰানির্বাহ করা, এবং সামাজিক জীবনের কাজেতেই সে বুদ্ধির সার্থকতা। কিন্তু সচরাচুর লোকে সেই বুদ্ধির মাপকাঠিতেই দর্শন বিজ্ঞান সাহিত্য আর্ট প্রভৃতি মনোজগতের পদার্থগুলোও মেপে নেয়। সে মাপে যে পদার্থটি ছোট সাব্যস্ত হয় সেটিও যেমন গ্রাহ্য হয় না, তেমনি যেটি বড় সাব্যস্ত হয় সেটিও গ্রাহ্য হয় না। সামাজিক বৃদ্ধির সঙ্গে যদি কোনো বিশেষ বন্ধি খাপেখাপে না মিলে যায়, তাহলে হয় তা অতিবন্ধি নয় নির্বুদ্ধি; এবং এই উভয় শ্রেণীর বুদ্ধির সহিত সামাজিক মানব পারৎপক্ষে কোনোরূপ সম্পর্ক রাখতে চায় না। এই কারণেই সাধারণত লোকে নির্বুদ্ধিতার প্রতি অবজ্ঞা এবং অতিবৃদ্ধির প্রতি বিদ্বেষভাব ধারণ করে। উচুদরের লেখক এবং নীচুদরের লেখক সমসাময়িক পাঠকসমাজের কাছে সমান অনাদর পায়। কারণ, বুদ্ধি চরিত্র প্রভৃতি সম্বন্ধে লোকসমাজ উচুতেও উঠতে চায় না, নীচুতেও নামতে চায় না; যেখানে আছে সেইখানেই থাকতে চায়। কেননা, ওঠা এবং নামা দুটি ক্রিয়াই বিপজ্জনক। সমাজ ‘বিষয়-বালিশে আলিস’ রেখে নাটক-নভেলের পণে নিজের পোশাকী চেহারা দেখতে চায়, কবির মুখে নিজের স্তুতি শুনতে ভালোবাসে, এবং যে গুরুর কাছ থেকে নিজ মতের ভাষ্য লাভ করে তাঁকেই দার্শনিক বলে মান্য করে। প্রমাণস্বরূপ দেখানো যেতে পারে, জজ মেরেডিথের অপেক্ষা মেরি করেলির নভেলের হাজার গুণ কাটতি বেশি। এবং যে কবি সমাজের সু-মনোভাব ব্যক্ত করেন, তাঁর চাইতে, যিনি সমাজের কু-মনোভাব ব্যক্ত করেন, তাঁর আদর কিছু কম নয়। কিপলিঙের বই টেনিসনের বইয়ের চাইতে কম পয়সায় বিক্রি হয় না। সুতরাং সাহিত্যব্যসায়ীদের পক্ষে ভালো বই লেখবার চেষ্টা করবার কোনো দরকার নেই; বই যাতে খারাপ না হয়, এই চেষ্টাটকু করলেই কার্যোদ্ধার হবে। এবং কি ভালো আর কি মন্দ, তা নির্ণয় করতে সমাজের প্রচলিত মতামতগুলি আয়ত্ত করতে হবে। এককথায়, ব্যাবসা চালাতে হলে যে রকমের সাহিত্য সমাজ চায়, তাই আমাদের যোগাতে হবে।

‘নিত্য তুমি খেল যাহা, নিত্য ভালো নহে তাহা,
ভারত যেমত চাহে, সেই খেলা খেল হে’

এরূপ অনুরোধ করে যে কোনো ফল নেই, তা স্বয়ং ভারতচন্দ্র টের পেয়েছিলেন— আমরা তো কোন ছার। বাংলাদেশে কিরকমের বইয়ের সবচাইতে বেশি কাটতি, সেইটি জানতে পারলে বাঙালিজাতির মানসিক খোরাক যোগানো আমাদের পক্ষে কঠিন হবে না। শুনতে পাই, বাজারে শুধু রূপকথা, রামায়ণমহাভারতের আখ্যান এবং গল্পের বই কাটে। একথা যদি সত্য হয় তো আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে বালবদ্ধবনিতাতেই বাংলা বইয়ের ব্যাবসা টিকিয়ে রেখেছে। আর একথা যে সত্য, সেবিষয়ে সন্দেহ করবার কোনো কারণ নেই; কেননা, মানুষ সবচাইতে ভালোবাসে গল্প। আমাদের অধিকাংশ লোকের জীবনের ইতিহাস সম্পর্ণে ঘটনাশন্য, অর্থাৎ আমাদের বাহ্যিক কিংবা মানসিক জীবনে কিছু ঘটে না। দিনের পর দিন আসে, দিন যায়। আর সেসব দিনও একটি অপরটির যমজভ্রাতার ন্যায়। বিশেষত এদেশে যেমন রাম না জন্মাতে রামায়ণ লেখা হয়েছিল, তেমনি আমরা না জন্মাতেই আমাদের জীবনের ইতিহাস সমাজ কর্তৃক লিখিত হয়ে থাকে। আমরা শুধু চিরজীবন তার আবত্তি করে যাই। সেই আবত্তির এখানে-ওখানে ভুলভ্রান্তিটুকুতেই পরস্পরের ভিতর যা বৈচিত্র্য। কিন্তু যন্ত্রবৎ চালিত হলেও মানুষ একথা একেবারে ভুলে যায় না যে, তারা কলের পুতুল নয়–ইচ্ছাশক্তিবিশিষ্ট স্বাধীন জীব। তাই নিজের জীবন ঘটনাশন্য হলেও অপর লোকের ঘটনাপর্ণ জীবনের ইতিহাস চর্চা করে মানুষে সখ পায়। অন্যরপ অবস্থায় পড়লে নিজের জীবনও নিতান্ত একঘেয়ে না হয়ে অপব বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে পারত, এই মনে ক’রে আনন্দ অনুভব করে। মানুষের উপবাসী হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাবার প্রধান সামগ্রী হচ্ছে গল্প, তা সত্যই হোক আর মিথ্যাই হোক। স্ত্রী-সংহ করবার জন্য আমাদের ধনভঙ্গও করতে হয় না, লক্ষ্যভেদও করতে হয় না, সেইজন্যই আমরা দ্রৌপদীস্বয়ংবর এবং রামচন্দ্রের বিবাহের কথা শুনতে ভালোবাসি। আমাদের বাড়ির ভিতর ‘কুন্দ’ও ফোটে না এবং বাড়ির বাহিরে ‘রোহিণী’ও জোটে না, তাই আমরা বিষবক্ষ’ ও ‘ভ্রমর’ একবার পড়ি দু বার পড়ি তিনবার পড়ি। আমরা দশটায় আপিস যাই এবং পাঁচটায় ঠিক সেই একই পথ দিয়ে, হয় গাড়িতে নয় ট্রামে নয় পদব্রজে, বাড়ি ফিরে আসি। তাই আমরা কল্পনায় সিন্ধবাদের সঙ্গে দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি।

তাহলে স্থির হল এই যে, আমাদের প্রধান কার্য হবে গল্প-বলা–শুধু নভেলনাটকে নয়, সকল বিষয়ে। ধর্মনীতি দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস–বত উপন্যাসের মত হবে ততই লোকের মনঃপত হবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, গল্প যত পুরনো হয় ততই সমাজের প্রিয় হয়ে ওঠে। প্রমাণ, রূপকথা এবং রামায়ণ-মহাভারতের কথা। এর কারণও স্পষ্ট। পরনোর প্রধান গুণ যে তা নতুন নয়, অর্থাৎ অপরিচিত নয়। নতুনের প্রধান দোষ যে তা পরীক্ষিত নয়। সুতরাং তা সত্য কি মিথ্যা, উম্ভাবনা কি আবিষ্কার, মানুষের পক্ষে শ্রেয় কি হেয়, তা একনজরে দেখে কেউ বলতে পারেন না। তাছাড়া নতুন কথা যদি সত্যও হয়, তাহলেও বিনা ওজরে গ্রাহ্য করা চলে না। মানুষের মন একটি হলেও মনোভাব অসংখ্য। এবং সে মন যতই ছোট হোক না কেন, একাধিক মনোভাব তাতে বাস করে। একত্রে বাস করতে হলে পরপর দিবারাত্র কলহ করা চলে না। তাই যেসকল মনোভাব বহুকাল থেকে আমাদের মন অধিকার করে বসে আছে, তারা ঐ সহবাসের গুণেই পরপর একটা সম্পর্ক পাতিয়ে নেয়, এবং সুখে না হোক শান্তিতে ঘর করে। কিন্তু নতুন সত্যের ধর্মই হচ্ছে মানুষের মনের শান্তিতঙগ করা। নতুন সত্য প্রবেশ করেই আমাদের মনের পাতা-ঘরকন্না কতকটা এলোমেলো করে দেয়। সুতরাং ও-পদার্থ মনের ভিতর ঢুকলেই আমাদের মনের ঘর নতুন করে গোছাতে হয়; যেসব মনোভাব তার সঙ্গে একত্র থাকতে পারে না, তাদের বহিষ্কৃত করে দিতে হয় এবং বাদবাকিগুলিকে একটু বদলেদলে নিয়ে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে দিতে হয়। তাছাড়া, নতুন সত্য মনে উদয় হয়ে অনেক নতুন কর্তব্যবৃদ্ধির উদ্রেক করে। আমরা চিরপরিচিত কর্তৃব্যগলির দাবিই রক্ষে করতে হিমশিম খেয়ে যাই, তারপর আবার যদি নিত্যনতুন কর্তব্য এসে নতুন-নতুন দাবি করতে আরম্ভ করে তাহলে জীবন যে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তার আর সন্দেহ কি? মানযে সুখ পায় না, তাই মোয়াস্তি চায়। যে লেখক পাঠকের মনের সেই সোয়াস্তিটকু নষ্ট করতে ব্রতী হবেন, তাঁর প্রতি অধিকাংশ লোক বিমখ ও বিরক্ত হবেন। সুতরাং সাবধানের মার নেই—এই সত্রের বলে যে লেখক যেকথা সকলে জানে সেইকথা গদ্যেপদ্যে অনর্গল বলে যাবেন, বাজারে তাঁর কথার মূল্য হবে। উপরে যা বলা গেল, তার নির্গলিতাৰ্থ দাঁড়ায় এই যে, ব্যাবসার হিসেবে সাহিত্যে গল্প বলা এবং পুরনো গল্প বলাই শ্রেয়।

সাহিত্যের অবশ্য ডিম্যাণ্ড না বাড়লে সাপ্লাই বাড়বে না। সুতরাং সাহিত্যের ব্যাবসার শ্রীবৃদ্ধি অনেকপরিমাণে পাঠকের মজির উপর নির্ভর করে, লেখকের কৃতিত্বের উপর নয়। এদেশের শিক্ষিত লোকদের বই-পড়া-জিনিসটে বড়-একটা অভ্যেস নেই। সাহিত্যচর্চা করাটা নিত্যনৈমিত্তিক কিংবা কাম্য কোনোরূপ কমের মধ্যেই গণ্য নয়। এর বহতর কারণ আছে : যথা অবসরের অভাব, অর্থের অভাব এবং ফায়দার অভাব; কারণ সাহিত্যচর্চা করবার লাভটি কেউ টাকায় কষে বার করে দিতে পারেন না। যে বিদ্যে বাজারে ভাঙানো যায় না, তার যে মূল্য থাকতে পারে— এ বিশ্বাস সকলের নেই। কিন্তু স্কুলকলেজের বাইরে যে আমরা কোনো বই পড়ি না, তার প্রধান কারণ—কুলপাঠ্যপুস্তক পাঠ্যপুস্তকের প্রধান শত্র। বছর বছর ধরে স্কুলপাঠ্যগ্রন্থাবলী গলাধঃকরণ করে যার মানসিক মন্দাগ্নি না জন্মায়, এমন লোক নিতান্ত বিরল। সুতরাং শিক্ষিত সম্প্রদায়কে সাহিত্যচর্চা করবার উপদেশ দিয়ে কোনো লাভ নেই। কিন্তু বই-কেনাটা যে একটি শখমাত্র হতে পারে এবং হওয়া উচিত, এই ধারণাটি আমি স্বদেশী সমাজের মনে জন্মিয়ে দিতে চাই।

বই গৃহসজ্জার একটি প্রধান উপকরণ, এবং সেই কারণে শুধু ঘর সাজাবার জন্যে আমাদের বই কেনা উচিত। আমরা যে হিসেবে ছবি কিনি এবং ঘরে টাঙিয়ে রাখি, সেই একই হিসেবে বই কেনা এবং ঘরে সাজিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য। আমরা ছবি পড়ি নে বলে ছবি-কেনাটা যে অন্যায়, একথা কেউ বলেন না; সুতরাং বই পড়ি নে বলে যে কিনব না, এরূপ মনোভাব অসংগত। এস্থলে বলে রাখা আবশ্যক যে, বইয়ের মত ছবিও একটা পড়বার জিনিস। ছবিরও একটা অর্থ আছে, একটা বক্তব্য কথা আছে। বইয়ের সঙ্গে ছবির একমাত্র তফাৎ হচ্ছে যে, উভয়ের’ ভাষা স্বতন্ত্র। যা একজন কালি ও কলমের সাহায্যে ব্যক্ত করেন, তাই অপর-একজন রং ও তুলির সাহায্যে প্রকাশ করেন। তাছাড়া, বাংলা বইয়ের স্বপক্ষে বিশেষ করে এই বলবার আছে যে, বাঙালি ক্রেতা ইচ্ছে করলে তা পড়তে পারেন, কিন্তু ছবি-জিনিসটে ইচ্ছে করলেও পড়তে পারেন না।

সচরাচর লোকে ঘর সাজায় গহের শোভা বৃদ্ধি করবার জন্য নয়, কিন্তু নিজের ধন এবং সুরুচির পরিচয় দেবার জন্য। শেষোক্ত হিসেব থেকে দেখলেও দেখা যায় যে, বৈঠকখানার দেয়ালে হাজার টাকার একখানি নোট না ঝুলিয়ে হাজার টাকা দামের একখানি ছবি ঝোলানোতে যেমন অধিক সুরুচির পরিচয় দেয়, তেমনি নানা আকারের নানা বর্ণের রাশিরাশি বই সারিসারি সাজিয়ে রাখাতে প্রমাণ হয় যে, গৃহকর্তা একাধারে ধনী এবং গুণী।

পূর্বোক্ত কারণে আমি এদেশের ধনী লোকদের বই কিনতে অনুরোধ করি, গিলতে নয়। তাঁরা যদি এবিষয়ে একবার পথ দেখান, তাহলে তাঁদের দৃষ্টান্ত সম্পৃষ্টান্ত হিসেবে বহলোকে অনুসরণ করবে। যতদিন না বাঙালিসমাজ নিজেদের পাঠক হিসেবে না দেখে পুস্তকক্রেতা হিসেবে দেখতে শিখবেন, ততদিন বঙ্গসাহিত্যের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে না।

আমার শেষ কথা এই যে, গ্রন্থক্রেতা যে শুধু নিঃস্বার্থ পরোপকার করেন, তা নয়। চারিদিকে বইয়ের দ্বারা পরিবত হয়ে থাকাতে একটা উপকার আছে। বই চব্বিশঘণ্টা চোখের সম্মুখে থেকে এই সত্যটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এ পৃথিবীতে চামড়ায়-ঢাকা মন-নামক একটি পদার্থ আছে।

বৈশাখ ১৩২০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *