সাহিত্য
ভাষার কথা
ভারতবর্ষ
সমাজ
বিচিত্র

প্রাণের কথা

প্রাণের কথা
ভবানীপরসাহিত্যসমিতিতেকথিত

এরকম সভার সভাপতির প্রধান কর্তব্য হচ্ছে প্রবন্ধপাঠকের গণগান করা, কিন্তু সে কর্তব্য পালন করা আমার পক্ষে উচিত হবে কি না সে বিষয়ে আমার বিশেষ সন্দেহ ছিল। প্রবন্ধপাঠক শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র ঘটক আমার বন্ধু, এবং সাহিত্যিকবন্ধ। কধর মুখে বন্ধুর প্রশংসা একালে ভদ্রসমাজে অভদ্রভা বলেই গণ্য। ইংরেজিতে যাকে বলে মিউঁচুয়াল অ্যাডমিরেশন, সে ব্যাপারটি আমরা নিতান্ত হাস্যকর মনে করি; অথচ এ কথাও সম্পূর্ণ সত্য যে, গুণানুরাগ উভয়পাক্ষিক না হলে কি প্রণয় কি বন্ধুত্ব কোনোটিই স্থায়ী হয় না। সে যাই হোক, বস্তৃতি সাহিত্যসমাজে যে নিষিদ্ধ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবং যেহেতু আমি বর্তমান সাহিত্যসমাজের নানারূপ নিয়মভঙ্গের অপরাধে অপরাধী হয়ে আছি, সে কারণ আবার-একটা নূতন অপরাধে অভিযুক্ত হতে অপ্রবত্তি হওয়াটা আমার পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক।

কিন্তু প্রবন্ধটি শুনে আমি প্রবন্ধলেখকের আর-কিছুর না হোক, সাহসের প্রশংসা না করে থাকতে পারছি নে। প্রবন্ধপাঠক মহাশয় যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা যুগপৎ সৎসাহস ও দুঃসাহস। এ পৃথিবীতে মানুষের পক্ষে যা সবচাইতে মূল্যবান অথচ দুর্বোধ্য—অর্থাৎ জীবন-ঘটকমহাশয় তারই উপর হস্তক্ষেপ করেছেন। এ অবশ্য দুঃসাহসের কাজ।

ঘটকমহাশয়ের প্রবন্ধের সার কথা এই যে, উপনিষদের সময় থেকে শুরু করে অদ্যাবধি নানা দেশের নানা দার্শনিক ও নানা বৈজ্ঞানিক জীবনসমস্যার আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ তার চুড়ান্ত মীমাংসা করতে পারেন নি। আজ পর্যন্ত জীবনের এমন ভাষ্য কেউ করতে পারেন নি যার উপর আর টীকাটিপ্পনী চলে না।

আমার মনে হয় দর্শনবিজ্ঞানের এ নিষ্ফলতার কারণও স্পষ্ট। জীবন সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান লাভ করবার পক্ষে প্রতি লোকের পক্ষে যে বাধা, সমগ্র মানবজাতির পক্ষেও সেই একই বাধা রয়েছে। জীবনসমস্যার চড়ান্ত মীমাংসা করবে মৃত্যু। মৃত্যুর অপর পারে আছে-হয় অনন্ত জীবন নয় অনন্ত মরণ, হয় অমরত্ব নয় নির্বাণ। এর কোনো অবস্থাতেই জীবনের আর কোনোই সমস্যা থাকবে না। যদি আমরা অমরত্ব লাভ করি তা হলে জীবন সম্বন্ধে আমাদের জানবার আর কিছু বাকি থাকবে না; অপর পক্ষে যদি নির্বাণ লাভ করি তো জানবার কেউ থাকবে না। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, সমগ্র মানবজাতি না মরা তর্ক এ সমস্যার শেষ মীমাংসা করতে পারবে না। আর যদি কোনোদিন পারে তা হলে সেই দিনই মানবজাতির মৃত্যু হবে; কেননা তখন আমাদের আর কিছু জানবার কিংবা করবার জিনিস অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের পক্ষে সর্বজ্ঞ হওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল নিষ্ক্রিয় হওয়া, অর্থাৎ মত হওয়া; কেননা প্রাণ বিশেষ্যও নয়, বিশেষণও নয়-ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া মাত্র।

জীবনটা একটা রহস্য বলেই মানুষের বেচে সখ। কিন্তু তাই বলে এ রহস্যের মর্ম উদঘাটন করবার চেষ্টা যে পাগলামি নয় তার প্রমাণ, মানুষ যুগে যুগে এ চেষ্টা করে এসেছে, এবং শতবার বিফল হয়েও অদ্যাবধি সে চেষ্টা থেকে বিরত হয় নি। পৃথিবীর মধ্যে যা সবচেয়ে বড়ো জিনিস তা জানবার ও বোঝবার প্রবৃত্তি মানুষের মন থেকে যে দিন চলে যাবে সে দিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে। জীবনের যা-হয়-একটা অর্থ স্থির করে না নিলে মানুষে জীবনযাপন করতেই পারে না। এবং এ পদার্থের কে কি অর্থ করেন তার উপর তাঁর জীবনের মূল্য নির্ভর করে। এ কথা ব্যক্তির পক্ষেও যেমন সত্য জাতির পক্ষেও তেমনি সত্য। দর্শন-বিজ্ঞান জীবনের ঠিক অর্থ বার করতে পারুক আর না পারুক, এ সম্বন্ধে অনেক ভুল বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে। এও বড়ো কম লাভের কথা নয়। সত্য না জানলেও মানুষের তেমন ক্ষতি নেই-মিথ্যাকে সত্য বলে ভুল করাই সকল সর্বনাশের মূল। সুতরাং প্রবন্ধলেখক এ আলোচনার পুনরোপন করে সৎসাহসেরই পরিচয় দিয়েছেন।

২.

সতীশবাবু তাঁর প্রবধে দেখিয়েছেন—এ বিষয়ে যে নানা মুনির নানা মত আছে শুধু তাই নয়, একইরকমের মত নানা যুগে নানা আকারে দেখা দেয়। দর্শনবিজ্ঞানের কাছে জীবনের সমস্যাটা কি, সেইটে বুঝলে সে সমস্যার মীমাংসাটাও যে মোটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। জীবন

পদার্থটিকে আমরা সকলেই চিনি, কেননা সেটিকে নিয়ে আমাদের নিতা কারবার করতে হয়। কিন্তু তার আদি ও অত আমাদের প্রত্যক্ষ নয়। সহজজ্ঞানের কাছে যা অপ্রত্যক্ষ, অনুমান-প্রমাণের দ্বারা তারই জ্ঞান লাভ করা হচ্ছে দর্শনবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। জীবনের আদি অন্ত আমরা জানি নে, এই কথাটাকে ঘুরিয়ে দরকম ভাবে বলা যায়। এক, জীবনের আদিতে আছে জন্ম আর অন্তে মৃত্যু; আর-এক, জীবন অনাদি ও অনন্ত। জীবন সম্বন্ধে দার্শনিকতত্ত্ব হয় এর এক পক্ষ নয় আর-এক পক্ষ -ভুক্ত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, এ দুয়ের কোনো মীমাংসাতেই আমাদের জ্ঞান কিছুমাত্র এগোয় না; অর্থাৎ এ দুই তত্ত্বের যেটাই গ্রাহ্য কর না, যা আমাদের জানা তা সমান জানাই থেকে যায়, আর যা অজানা তাও সমান অজানা থেকে যায়। সুতরাং এরকম মীমাংসাতে যাঁদের মনস্তুষ্টি হয় না তাঁরা প্রথমে জীবনের উৎপত্তি ও পরে তার পরিণতির সন্ধানে অগ্রসর হন। মোটামুটি ধরতে গেলে এ কথা নিয়ে বলা যায় যে, প্রাণের উৎপত্তির সন্ধান করে বিজ্ঞান, আর পরিণতির সধান করে দর্শন।

এ কথা আমরা সকলেই জানি যে, আমাদের দেহও আছে মনও আছে, আর এ দুয়ের যোগাত্রের নাম প্রাণ। সুতরাং কেউ প্রমাণ করতে চান যে, প্রাণ দেহের বিকার; আর কেউ-বা প্রমাণ করতে চান যে, প্রাণ আত্মার বিকার। অর্থাৎ কারো মতে প্রাণ মূলত আধিভৌতিক, কারো মতে আধ্যাত্মিক। সুতরাং সকল দেশে সকল যুগে জড়বাদ ও আত্মবাদ পাশাপাশি দেখা দেয়—কালের গুণে কখনো এ মত, কখনো ও মত প্রবল হয়ে ওঠে; সে মতের গুণে নয়, যুগের গুণে। আমার বিশ্বাস একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদ মূলে একই মত। কেননা উভয় মতেই এমন-একটি নিত্য ও স্থির পদার্থের স্থাপনা করা হয়, যার আসলে কোনো স্থিরতা নেই।

অবশ্য এ দুই ছাড়া একটা তৃতীয় এবং মধ্য পন্থাও আছে, সে হচ্ছে প্রাণের স্বতন্ত্র সত্তা গ্রাহ্য করা। এই মাধ্যমিক মতের নাম ভাইটালিজম, এবং আমি নিজে এই মধ্যমতাবলম্বী। আমার বিশ্বাস, অপ্রাণ হতে প্রাণের উৎপত্তি প্রমাণ করবার সকল চেষ্টা বিফল হয়েছে। এর থেকে এ অনুমান করাও অসংগত হবে না যে, প্রাণ কখনো অপ্রাণে পরিণত হবে না। তার পর জড়, জীবন ও চৈতন্যের অন্তর্ভূত যদি এক-তত্ত্ব বার করতেই হয় তা হলে প্রাণকেই জগতের মূল পদার্থ বলে গ্রাহ্য করে নিয়ে আমরা বলতে পারি-জড় হচ্ছে প্রাণের বিরাম ও চৈতন্য তার পরিণাম। অর্থাৎ জড় প্রাণের সত অবস্থা, আর চৈতন্য তার জাগ্রত অবস্থা। এ পৃথিবীতে জড় জীব ও চৈতন্যের সমন্বয় একমাত্র মানুষেই হয়েছে। আমরা সকলেই জানি আমাদের দেহও আছে, প্রাণও আছে, মনও আছে। প্রাণকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের পক্ষে এক লক্ষে দেহ থেকে আত্মায় আরোহণ করা যেমন সম্ভব, দর্শনের পক্ষেও এক লক্ষে আত্মা থেকে দেহে অবরোহণ করাও তেমনি সম্ভব। জমান বৈজ্ঞানিক হেকেল এবং জর্মান দার্শনিক হেগেলের দর্শন আলোচনা করলে দেখা যায় যে, জড়বাদী পরমাণুর অন্তরে গোপনে জ্ঞান অনুপ্রবিষ্ট করে দেন এবং জ্ঞানবাদী জ্ঞানের অন্তরে গোপনে গতি সঞ্চারিত করে দেন। তার পর বাজিকর যেমন খালি মুঠোর ভিতর থেকে টাকা বার করে, এরাও তেমনি জড় থেকে মন এবং মন থেকে জড় বার করেন। এসব দার্শনিক-হাতসাফাইয়ের কাজ। আমাদের চোখে যে এদের বুজরুকি এক নজরে ধরা পড়ে না তার কারণ, সাজানো কথার মশক্তির বলে এরা আমাদের নজরবন্দী করে রেখে দেন। তবে দেহমনের প্রত্যয় যোগস্ত্রটি ছিন্ন করে মানুষে বুদ্ধিসূত্রে যে নূতন যোগ সাধন করে, তা টেকসই হয় না। দর্শনবিজ্ঞানের মনগড়া এই মধ্যপদলোপী সমাস চিরকালই বন্দুসমাসে পরিণত হয়।

৩.

প্রাণের এই স্বাতন্ত্র্য অবশ্য সকলে স্বীকার করেন না। শুধু তাই নয়, ভাইটালিজম, কথাটাও অনেকের কাছে কণশল। এর কারণও স্পষ্ট। ভাইটাল ফোর্স নামক একটি স্বতন্ত্র শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ প্রাণের উৎপত্তির সধান ত্যাগ করা। এ জগতের সকল পদার্থ সকল ব্যাপারই যখন জড়জগতের কতকগুলি ছোটোবড়ো নিয়মের অধীন, তখন একমাত্র প্রাণই যে স্বাধনি এ কথা বিনা পরীক্ষায় বৈজ্ঞানিকের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে যা বিভিন্ন মূলত তা যে অভিন্ন, এই সত্য প্রমাণ করাই বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং প্রাণ যে জড়শক্তিরই একটি বিশেষ পরিণাম, এটা প্রমাণ না করতে পারলে বিজ্ঞানের অকে একটা মস্ত বড়ো ফাঁক থেকে যায়। গত শতাব্দীতে ইউরোপের বৈজ্ঞানিক সমাজে এই ফাঁক বোজাবার বহু চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু সুখের বিষয়ই বলন আর দুঃখের বিষয়ই বলন, সে চেষ্টা অদ্যাবধি সফল হয় নি। প্রাণ জড়জগতে লীন হতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাওয়ার অর্থ যে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হওয়া, এ কথা কে না জানে?

আমার পূর্ববর্তী বা বলেছেন যে, ইউরোপ যা প্রমাণ করতে পারে নি বাংলা তা করেছে; অর্থাৎ তাঁর মতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বস, হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, জড়ে ও জীবে কোনো প্রভেদ নেই। আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের সর্বাগ্রগণ্য বিজ্ঞানাচার্য এ কথা কোথায়ও বলেন নি যে, জড়ে ও জীবে কোনো প্রভেদ নেই। আমার ধারণা, তিনি প্রাণের উৎপত্তি নয়, তার অভিব্যক্তি নির্ণয় করতে চেষ্টা করেছেন। কথাটা আর-একটু পরিষ্কার করা যাক। মানুষমাত্রই জানে যে, যেমন মানুষের ও পশুর প্রাণ আছে তেমনি উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। এমন-কি, ছোটো ছেলেরাও জানে যে, গাছপালা জন্মায় ও মরে। সুতরাং মানুষ পশু ও উদ্ভিদ, যে গুণে সমধর্মী সেই গুণের পরিচয় নেবার চেষ্টা বহনকাল থেকে চলে আসছে। ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল যে, অ্যাসিমিলেশন এবং রিপ্রোডাকশন-এই দুই গুণে তিন শ্রেণীর প্রাণীই সমধর্মী। অর্থাৎ এতদিন আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষার প্রবত্তি ও শক্তিই ছিল প্রাণের লীস্ট কমন মালটিপল-একালের কুলের বাংলায় যাকে বলে লসাগু।

আচার্য জগদীশচন্দ্র দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এই দুই ছাড়া আরো অনেক বিষয়ে প্রাণীমাত্রেই সমধর্মী। তিনি যে সত্যের আবিষ্কার করেছেন সে হচ্ছে এই যে, প্রাণীমাত্রেই একই ব্যথার ব্যথী। উদ্ভিদের শিরায়-উপশিরায় বিদ্যুৎ সঞ্চার করে দিলে ও-বস্তু আমাদের মতোই সাড়া দেয়, অর্থাৎ তার দেহে স্বেদ কম্প মূর্ছা বেপথু প্রভৃতি সাত্ত্বিক ভাবের লক্ষণ সব ফুটে ওঠে। এক কথায়, আচার্য বসু উদ্ভিদজগতেও হৃদয়ের আবিষ্কার করেছেন, পূর্বাচার্যেরা উদর ও মিথুনত্বের সধান নিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। বসুমহাশয় প্রাণের লসাগু-তে সন্তুষ্ট না থেকে তার গসাগু, অর্থাৎ গ্রেটেস্ট কমন মেজার -এর আবিষ্কারে ব্রতী হয়েছেন। যখন উদ্ভিদের হৃদয় আবিষ্কৃত হয়েছে তখন সম্ভবত কালে তার মস্তিষ্কও আবিষ্কৃত হবে। কিন্তু তাতে জড় ও জীবের ভেদ নষ্ট হবে না, কেননা জড়পদার্থের যখন উদরই নেই তখন তার অন্তরে হৃদয়-মস্তিকাদি থাকবার কোনোই সম্ভাবনা নেই। যে বস্তুর দেহে অন্নময় কোষ নেই, তার অন্তরে মনোময় কোষের দর্শনলাভ তাঁরাই করতে পারেন যাঁদের চোখে আকাশকুসুম ধরা পড়ে।

৪.

আমি বৈজ্ঞানিকও নই, দার্শনিকও নই; সুতরাং এতক্ষণ যে অনধিকারচর্চা করলাম, তার ভিতর চাই-কি কিছু সার নাও থাকতে পারে। কিন্তু জীবন জিনিসটে দার্শনিক বৈজ্ঞানিকের একচেটে নয়, ও-বস্তু আমাদের দেহেও আছে। সুতরাং প্রাণের সমস্যার মীমাংসা আমাদেরও করতে হবে, আর-কিছুর জন্য না হোক, শুধু প্রাণধারণ করবার জন্য। আমাদের পক্ষে জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে প্রাণের মূল্য, সুতরাং আমাদের সমস্যা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক-দার্শনিকের সমস্যার ঠিক বিপরীত। প্রাণীর সঙ্গে প্রাণীর অভেদজ্ঞান নয়, ভেদজ্ঞানের উপরেই আমাদের মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠিত। কেননা, যে গুণে প্রাণীজগতে মানুষ অসামান্য সেই গুণেই সে মানুষ।

উদ্ভিদ ও পশুর সঙ্গে কোন কোন গুণে ও লক্ষণে আমরা সমধর্মী, সে জ্ঞানের সাহায্যে আমরা মানবজীবনের মূল্য নির্ধারণ করতে পারি নে, কোন কোন ধর্মে আমরা ও-দই শ্রেণীর প্রাণী হতে বিভিন্ন, সেই বিশেষ জ্ঞানই আমাদের জীবনযাত্রার প্রধান সহায়; এবং এ জ্ঞান লাভ করবার জন্য আমাদের কোনোরূপ অনুমান-প্রমাণের দরকার নেই, প্রত্যক্ষই যথেষ্ট।

আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই যে, উদ্ভিদ মাটিতে শিকড় গেড়ে বসে আছে, তার চলৎশক্তি নেই। এক কথায় উদ্ভিদের প্রত্যক্ষ ধর্ম হচ্ছে স্থিতি।

তার পর দেখতে পাই, পশরা সর্বত্র বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, অর্থাৎ তাদের প্রত্যক্ষ ধর্ম হচ্ছে গতি।

তার পর আসে মানুষ। যেহেতু আমরা পশু সে-কারণ আমাদের গতি তো আছেই, তার উপর আমাদের ভিতর মন নামক একটি পদার্থ আছে, যা পশর নেই। এক কথায় আমাদের প্রত্যক্ষ বিশেষ ধর্ম হচ্ছে মতি।

এ প্রভেদটার অন্তরে রয়েছে প্রাণের মুক্তির ধারাবাহিক ইতিহাস। উদ্ভিদের জীবন সবচাইতে গণ্ডীবদ্ধ, অর্থাৎ উদ্ভিদ, হচ্ছে বন্ধ জীব। পশু মাটির বন্ধন থেকে মুক্ত কিন্তু নৈসর্গিক স্বভাবের বন্ধনে আবদ্ধ, অর্থাৎ পশু বদ্ধমত্ত জীব। আমরা দেহ ও মনে না মাটির না স্বভাবের বন্ধনে আবদ্ধ, অতএব এ পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র মক জীব।

সুতরাং মনুষ্যত্ব রক্ষা করবার অর্থ হচ্ছে আমাদের দেহ ও মনের এই মুক্তভাব রক্ষা। আমাদের সকল চিন্তা সকল সাধনার ঐ একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। যে জীবন যত মক্ত, সে জীবন তত মুল্যবান। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে, মানুষের পক্ষে প্রাণীজগতে পশ্চাদপদ হওয়া সহজ। প্রাণের প্রতি মত অবস্থারই এমন-সব বিশেষ সুবিধা ও অসুবিধা আছে যা তার অপর মত অবস্থার নেই। উদ্ভিদ, নিশ্চল, অতএব তা পারিপার্শ্বিক অবস্থার একান্ত অধীন। প্রকৃতি যদি তাকে জল না জোগায় তো সে ঠায় দাঁড়িয়ে নির্জলা একাদশী করে শুকিয়ে মরতে বাধ্য। এই তার অসবিধা। অপর পক্ষে তার সুবিধা এই যে, তাকে আহার সংগ্রহ করবার জন্য কোনোরূপ পরিশ্রম করতে হয় না, সে আলো বাতাস মাটি জল থেকে নিজের আহার অক্লেশে প্রস্তুত করে নিতে পারে। পশুর গতি আছে, অতএব সে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সম্পূর্ণ অধীন নয়, সে এক দেশ ছেড়ে আর-এক দেশে চলে যেতে পারে। এইটকু তার সুবিধা। কিন্তু তার অসুবিধা এই যে, সে নিজগুণে জড়জগৎ থেকে নিজের খাবার তৈরি করে নিতে পারে না, তাকে তৈরি-খাবার অতিকষ্টে সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে হয়। পোষমানা জানোয়ারের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র, সে উদ্ভিদেরই শামিল; কেননা সে শিকড়বদ্ধ না হোক, শিকলবদ্ধ।

মানুষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার অধীন হতে বাধ্য নয়; সে স্থানত্যাগ করতেও পারে, পারিপার্শ্বিক অবস্থার বদল করেও নিতে পারে। একালের ভাষায় যাকে “বেষ্টনী’ বলে মানুষের পক্ষে তা গণ্ডী নয়, মানুষের স্থিতিগতি তার স্বেচ্ছাধীন। এই তার সুবিধা। তার অসুবিধা এই যে, তাকে জীবনধারণ করবার জন্য শরীর ও মন দুই খাটাতে হয়। পশকেও শরীর খাটাতে হয়, মন খাটাতে হয় না; উদ্ভিদকে শরীর মন দুয়ের কোনোটিই খাটাতে হয় না। অর্থাৎ উদ্ভিদের জীবন সবচাইতে আরামের। পশুর শরীরের আরাম না থাক, মনের আরাম আছে। মানুষের শরীর-মন দুয়ের কোনোটিরই আরাম নেই। আমরা যদি মনের আরামের জন্য লালায়িত হই তা হলে আমরা পশুকে আদর্শ করে তুলব; আর যদি দেহমন দয়ের আরামের জন্য লালায়িত হই তা হলে আমরা উদ্ভিদকে আদর্শ করে তুলব, এবং সেই আদর্শ অনুসারে নিজের জীবন গঠন করতে চেষ্টা করব। এ চেষ্টার ফলে আমরা শুধু মনুষ্যত্ব হারিয়ে বসব। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম ভয়াবহঃ’ এই সনাতন সত্যটি মানুষের সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য, নচেৎ মানবজীবন রক্ষ করা অসম্ভব। আর-একটি কথা, মানুষের পক্ষে জীবন রক্ষা করার অর্থ জীবনের উন্নতি করা। মানুষের ভিতরে-বাইরে যে গতিশক্তি আছে, তা মানুষের মতির দ্বারা নিয়মিত ও চালিত। এই মতিগতির শুভপরিণয়ের ফলে যা জন্মলাভ করে তারই নাম উন্নতি। আমাদের মনের অর্থাৎ বুদ্ধি ও হৃদয়ের উৎকর্ষ সাধনেই আমরা মানবজীবনের সার্থকতা লাভ করি। জীবনকে সম্পূর্ণ জাগ্রত করে তোল ছাড়া আয়, বৃদ্ধির অপর কোনো অর্থ নেই।

শ্রাবণ ১৩২৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *