প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন

সন্ধ্যার ঝোঁকে যখন গলিটা অন্ধকারে ভরে ওঠে, অস্থির হয়ে ওঠে শ্বাসরুদ্ধ ধোঁয়ায় এবং অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা যায় গলির লোকগুলোকে তখন মনে হয় মানুষের জগৎ ছাড়া যেন কোনও অন্ধকার গুহার অভ্যন্তর এটা। হাওয়া ঢোকে না এখানে বেরুবার পথ নেই বলে। সরকারি আলো নেই, কারণ সরকারি গলি নয় এটা। তাই মেথর খাটা বা ঝাড় দেওয়ার কথা এখানে অবান্তর। জলকলের কথা উপহাস মাত্র। মনে হয় আকাশ নেই গলিটার মাথায়।

এ সময়ে বাসন্তী যখন তার কোমল বেড়া বিনুনিটিতে গিট দিয়ে ছোট ছোট হাতে উনুনে আগুন দেয়, তখন তার বাবা ঠাণ্ডারাম আফিমের নেশায় বুদ হয়ে রক্তচক্ষু আধবোজা করে এসে বসে উনুনের প্রায় কাছটিতে। তারপর একবার উনুনের ধোঁয়া ও বাসন্তীর মুখের দিকে দেখে চোঙা মুখে দিয়ে কথা বলার মতো মোটা গলায় বলে, লবাবের বেটির কোন রাজকাজটি হচ্ছিল আতখোন, এ? জানো না তোমার বাপ আসার সময় হল?

রোজকার ব্যাপার, রোজকার কথা। বাসন্তী একটু সরে বসে যাতে ঘুষি লাথিটা এসে গায়ে না পড়ে। ঠাণ্ডারামের নেশাচ্ছন্ন মনে কারবাইড গ্যাসের মতো উত্তাপ চড়তে থাকে। চা বিনা আফিমের ধোঁয়ানো নেশা আসে সাফ হয়ে।

বাসন্তীর অদূরেই তার পিঠের বোন হারাণী ঘুমিয়ে থাকে অন্ধকার কোণে, ওর সারা গায়ে গোবরের গন্ধ। পায়ে গোবর, গোবর তার হাতে শুকিয়ে থাকে। সারাদিন গোবর কুড়িয়ে আর চাপটি দিয়ে বসে থাকতে আর পারে না সে।

হারাণীর পিঠোপিঠি ভাই কেলো রোজ ঠিক এ সময়টিতেই রকের ধারে রাস্তার পাশে কাঁচা নর্দমাটিতে বসে মলমূত্র ত্যাগ করতে এবং হাত মাথা নেড়ে গলার শির ফুলিয়ে দুলে দুলে শুরু করে গান।

ছকি, বাঁছি আল্ কি কালুল নাম জানে না…

তার এ গানকে যদি সানাইসুর মনে করা যায় তা হলে ঠিক পোঁয়ের মতো থেকে থেকে সাড়া দিয়ে ওঠে তার নিজের ভাই আট মাসের নোলা। সারাদিন ছেলেটা রকে হামা দিয়ে জলে কাদায় মাখামাখি করে বাসন্তীর কোল ধামসে একরকম থাকে। সন্ধ্যার ঝোঁকটাতেই শুরু করে কান্না।

ঠাণ্ডারামের জমাট নেশাটা ভেঙে পড়তে চায় এ কান্নায় আর গানে। কেলোকে চেঁচিয়ে গান থামাতে বলে। কেলো শুনতে না পেলে সে প্রাণপণ চিৎকার করে ওঠে, ওরে শশারের বাচ্ছা, বাঁশি তোর বাপের নাম জানে। চুপ মার, নইলে তোর কেষ্টলীলা আমি…

কেলো অন্ধকারে পিটপিট করে বাপকে দেখে কিন্তু গানটার আমেজ তার অবুঝ মনে এতই গভীর যে, গলা নামালেও গুনগুনানি আর থামতে চায় না।

এর পরে আসে সুকি, অর্থাৎ সুকুমারী। ঠাণ্ডারামের পরিবার, লোকে বলে নবার মা। বড় ছেলের নাম তার নবা। সে আসে ফরফর করে, বসে ধপাস করে ঠাণ্ডারামের হাতখানেক দূরে। নোলাকে টেনে তুলে নেয় কোলের উপর। বুক থেকে কাপড়টা সরিয়ে স্তন গুঁজে দেয় তার মুখে। একবার দেখে নেয় উনুনে চায়ের জল চেপেছে কিনা তারপর ঠাণ্ডারামের দিকে খানিকক্ষণ কটকট করে দেখে বাঁ হাতে মুখের থেকে পানের ছিবড়ের দলাটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে বাইরে। আর একবার দেখে ঠাণ্ডারামের ঝিমুনি, তারপর নিজের মনেই কখনও ঠোঁট বাঁকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে নাক ফুলিয়ে হঠাৎ দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে, অমন নেশার কপালে মারি ঝাড়।

ঠাণ্ডারাম হঠাৎ যেন ধাক্কা খেয়ে সটান হয়ে ওঠে। তার বেড়ানো মুখটা লম্বা হয়ে ওঠে এবং রক্তচক্ষু শিবনেত্র করে একবার সুকিকে দেখেই হেসে ওঠার মতো করে দাঁত বের করে ফেলে। চোখ কুঁচকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, এয়েছ ঠাকরুন? বাঁচিয়েছ।

খ্যাঁকানোর চেয়ে এ তিক্ত খোঁচানি আরও অসহ। সুকি রীতিমতো গলা চড়িয়েই জবাব দেয়, আসব না তো নেশা করে পথে পথে ঘুরব? না, তোমার ভিটেয় এয়েছি?

নাঃ, তোমার বাপের ভিটেয় এয়েছ। আরও তিক্ত আরও মোলায়েম করে বলে ঠাণ্ডারাম। তাতে সুকি আরও চড়ে এবং ঠাণ্ডারাম নেশাখোর না লাথখোর সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে বলে, যার নিজের পেট চলে না, সে ওই থুতু খায় কী বলে? ভাগাড়ে মুখ দে পড়ে থাকগে না।

এইভাবে যখন হাওয়া গরম হতে থাকে, তখন আসে না। গায়ে ভরা ধূলা আর ঘাম, নাকের পাটা দুটো ফোলা, নিশ্বাস পড়ে ঘন ঘন। আসে যেন পথের ধারে এটা একটা চা-খানা। গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকা জামাটা খুলতে খুলতে বলে, লাও জলদি চা লাও।

গলার স্বরটা তার ছেড়া, সরু ও ঝাঁজালো। চেহারাটা প্রায় ঠাণ্ডারামের ইয়ারের মতো হয়ে উঠেছে।

সে এসে ঢুকতে না ঢুকতেই হাজির হয় তার পিঠের ভাইটা কেষ্ট। ঠাণ্ডারাম বলে, ম্যানেজার সায়েব। একটা ফুল প্যান্ট তার পরনে, জামাটা বেশ খানিকটা পরিষ্কার এবং সেটা গুঁজে দিয়েছে প্যান্টের মধ্যে। পায়ে ক্যাম্বিসের তালিমারা জুতো। মাথার টেরিটি সুস্পষ্ট ও আঁচড়ানো। ফিটফাট কেষ্ট সকলের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রক্ষা করে ফু দিয়ে হাত দিয়ে ঝেড়ে ঘুমন্ত হারাণীর কাছে আলগোছে বসে। বাসন্তী সবাইকে চা দেয়। সবাই যখন চা পান আরম্ভ করে তখন হঠাৎ মনে হয়, সকলেই পরম তৃপ্ত। হ্যাঁ তৃপ্ত বটে, কিন্তু এর মাঝে আছে এক দারুশ রুদ্ধ গুমসানি। লক্ষর শিষটাও এ সময়ে স্থির হয়ে থাকে। এরা সকলেই রোজ কামানোর লোক। ঠাণ্ডারাম একটা সেলুনে কাজ করে, ওটা তার জাত ব্যবসা। কুমারী করে ঠিকা ঝিয়ের কাজ। নবা রিকশা চালায়, কেষ্ট হাফ-বেকার। কখনও কাজ পায়, কখনও বসে থাকে। রিকশা চালাতে সে নারাজ।

চা খেতে খেতেই সুকি আরম্ভ করে, নেশার মৌতাত তো জমাচ্ছ, পয়সা বের করে পিণ্ডি গেলার!

ঠাণ্ডারাম যেন শুনতেই পায়নি এভাবে সে মহা আরামে চায়ে চুমুক দিতে থাকে।

নবা কেষ্টও চায়ের গেলাসে তাড়াতাড়ি চুমুক দেয়।

সুকি তাদের দিকে তাকিয়ে বলে, চা তো গিলছিস সব, পয়সা দে ঘরের।

কে কার কথা শোনে।

ঠাণ্ডারাম বলে ওঠে, তুই কে পয়সা নেওয়ার। অ্যা! আমি থাকতে তুই কে? দে, তোর পয়সা দে দিকিনি।

সুকি অমনি জ্বলে ওঠে তুবড়ির মতো, ওরে আমার লাটরে, ওকে নেশা করতে আমি পয়সা দেব। দেব, ঝাড় দেব।

নেশাই জমুক আর দেহে বলই বাড়ক, যাই হোক, এবার ঠাণ্ডারাম রুদ্রমূর্তিতে হেঁকে ওঠে, চো—প, চোপরাও শালী। তোর বাপের পয়সায় নেশা করি রে? দাও পয়সা, দেলবা, তোর পয়সা দে।

নবা বলে ওঠে, লবারটা বড় মিষ্টি, না? আগে তোমারটা দেও, কেষ্টা দিক আগে।

কেষ্ট একবার জ্বলন্ত চোখে নবাকে দেখে বলে, আজ কিছু কামাইনি।

ঝেঁজে ওঠে নবা, কামাসনি তো খাস কেন? বানচোত মেয়েমানুষের বাড়ি যাস রোজ রাতে।

তোর পয়সায় খাই না খাই। বেশি বলবি তো—

নবা তেড়ে আসে, মারবি, মার না দেখি।

সুকি মারামারির তোয়াক্কা করে না কিন্তু পয়সা হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে আগেই দুজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, লাথখোরেরা যেখানে খুশি মরগে যা, আগে পয়সা দে।

ঠাণ্ডারামও গর্জন করে উঠে আসে, হ্যাঁ, পয়সা লাও আগে।

নবা এক ধাক্কায় ঠাণ্ডারামকে দেওয়ালের গায়ে সরিয়ে দিয়ে হঠাৎ হিন্দিতেই বাপকে বলে ওঠে, চোপ শালা, বাবাগিরি ফলানে আয়া?

তারপরেই হঠাৎ তাদের চারজনের মধ্যে একটা দারুণ ধ্বস্তাধ্বস্তি পেটাপিটি শুরু হয়ে যায়। কে কার লক্ষস্থল বোঝবার জো থাকে না। কিল চড় লাথি ঘুষি আর মাঝে মাঝে সুকি বলে ওঠে, জগা নাপতের বেটি হই তো

ঠাণ্ডারামেরও গলা শোনা যায়, বাপের ব্যাটা হই তো—

বলতে বলতে তাড়াতাড়ি মার বাঁচিয়ে জলভরা ঘটিটা উবু করে উনুনে ঢেলে দেয়। ভোঁস করে উনুনটা যায় নিভে। তার ফলে মারামারিটা আরও জমে।

নবা বলতে থাকে, খুন করেঙ্গা আজ…

কেষ্ট যুগপৎ জামা প্যান্ট ও টেরি আগলাতে আগলাতে এবং সামনের আটার হাঁড়িটা লাথি মেরে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করতে থাকে, আর ধ্বস্তাধ্বস্তির মধ্যেই বলতে থাকে শালাদের উপোস না রাখলে ঢিট হবে না।

এ দৃশ্য খানিকক্ষণ দেখতে দেখতে বাসন্তীরও চোখ মুখ জ্বলে ওঠে এবং হঠাৎ যে কোনও একজনের উপর পড়ে আঁচড়ে খামচে দিতে থাকে।

ঘুমন্ত হারাণী আচমকা ককিয়ে ঘুম ভেঙে করে চিৎকার করে উঠেই যাকে সামনে পায়, তার কোমরে পায়ে কামড়ে ধরে।

কেলো সুযোগ বুঝে গলা ছেড়ে গান ধরে,

ছকি, আমি যখন বছে থাকি গুলুজনের মাঝে
নাম ধলিয়ে বাজায় বাঁছি…

আর একটা ছোট লাঠি দিয়ে রকের ধারে পিপের টিনের বেড়াটা পিটতে থাকে, ঝম ঝম ঝম…।

আট মাসের নোলা সারাদিন পরে মায়ের স্তন পেয়ে আবার হারিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়। লক্ষর লালচে আলোয় ছায়াগুলো আরও কিম্ভুতকিমাকার হয়ে ওঠে। মানুষ নয়, মানুষের একটা দলা যেন ছটফট করে। আগুনে জল পড়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে উনুনের। কলসিটা থেকে জল গড়িয়ে কাদা হয়ে যায়।

মনে হয়, এরা মা নয়, বাপ নয়, ছেলেমেয়ে নয়, ভাই বোন নয়। একদল ক্ষিপ্ত জানোয়ার পরস্পরকে আক্রমণ করে গিলে খেতে চাইছে।

অন্ধ সুড়ঙ্গের মতো গলিটার খুপরি ঘরগুলোতে এদের মরণ কামনা করতে থাকে কটূক্তি আর শাপমন্যিতে, কেউ হাসি-তামাসা করে খিস্তি খেউড়ের ঢেউ তুলে।

এই হয় রোজ। যেন এটা ওদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

তারপর ওরা নিজেরাই একসময় থামে, থেমে বসে হাঁপাতে থাকে। ঠাণ্ডারাম মোটা গলায় কাঁদে বোধ হয় নেশা ছুটে যাওয়ার জন্য, সুকি ভূতে পাওয়ার মতো কাঁপানো সরু গলায় বিড়বিড় করে, নবা খিস্তি করতে থাকে, কেষ্ট থাকে চিরুনি দিয়ে টেরি বাগাতে, বাসন্তী, হারাণী আর কেলো কোথায় লুকিয়ে পড়ে অন্ধকারে কিছুক্ষণের জন্য। এমনি হয় রোজ।

কিন্তু তাদের জীবনের রোজকার এই বাঁধাধরা গতি একদিন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে আচমকা একটা মস্ত ফাটল ধরে যেন এক বিচিত্র প্রাণের ধাক্কায় ও টানে চিড় খেয়ে গেল।

সেদিনও যখন এমনিভাবে আস্তে আস্তে খুঁয়ে ফাঁয়ে চাপা আগুন ধ্বক করে জ্বলে উঠতে যাবে ঠিক সেই সময় বাসন্তী তার মায়ের হাত দুটো ধরে কান্নাভরা গলায় বলে উঠল, মা থাম, দাদা থাম তোরা, তোমার পায়ে পড়ি বাবা, থামো!..

তারা এমন কথা আর কোনও দিন শোনেনি, সবাই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সবাই ভেবেছিল রোজকার মতো আজ হয়তো সে কাউকে কামড়ে খামচে দিতে আসছে কিন্তু আজ সবাই তাজ্জব হয়ে দেখল বাসন্তীর মুখটা কান্নার বেদনা ও যন্ত্রণায় অপূর্ব হয়ে উঠেছে। কেন?

অবশ্য কিছুদিন থেকে সে এমনিতেই সরে সরে থাকত। কিন্তু আজ…

-থাম তোরা থাম পায়ে পড়ি। বলতে বলতে সে ফুঁপিয়ে উঠল।

ঠাণ্ডারাম বাসন্তীকেই একটা ঘুষি তুলেও হঠাৎ থেমে গেল। কী করুণ আর মিনতিভরা মুখ হয়েছে মেয়েটার! তবু খানিক ভয় ভয় ভাব।

নবার সটান লাথিটা থেমে গিয়ে পা বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বোন বাসির ভাসা ভাসা চোখ দুটোতে জল দেখে প্রাণটা তার চমকে উঠল।

কেষ্ট জামা আর টেরি বাগাবে কী, সে খালি তাকাতে লাগল, বাসিটা এত সুন্দর!…

সবাই অবাক। এমন কী কেলো পর্যন্ত গান ভুলে দিদির অমন মুখখানি হাঁ করে দেখতে লাগল।

তাকিয়ে থাকতে থাকতে চমকে উঠল সুকি। দেখল, বাসন্তীর সারা শরীর যেন কী জাদুতে উজলে উঠেছে, ছেড়াখোড়া ময়লা ফ্রকটা ফেটে যেন উছলে উঠতে চাইছে শরীরের প্রতিটি রেখা। বেড়া বিনুনি নেই, নিজের হাতে বাঁধা তার বাঁকা খোঁপা, হাতে পায়ের গোছ হয়ে উঠেছে ভারী শক্ত আর সুন্দর। হায় পোড়াকপাল, ছুড়ি যে কবে ধুমসী মাগী হয়ে গেছে।

খপাত করে মেয়ের হাত ধরে ঘরের ভিতরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল সুকি। বিড়বিড় করতে লাগল, আ সব্বোনাশ, ছুঁড়ির জল নেগেছে কবে গো, বাড় নেগেছে কবে?…

বলে তাড়াতাড়ি নিজেরই একটা ছেড়া ময়লা শাড়ি জড়িয়ে দিল বাসন্তীর গায়ে আর মনে মনে বলতে লাগল, তাই! ছুঁড়ির শরীরে রং নেগেছে, মনে রং নেগেছে, সাত পাঁচ ওর ভাল লাগে না, ওর ভাল লাগে না এত ঝম ঝামেলা তাই…তাই।

আর জীবনে বুঝি এই প্রথম বাসন্তী মায়ের রুক্ষ বুকটাতে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, তোরা এমন করিসনে মা, আমার গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করে।

বাইরের ক্ষিপ্ত মানুষগুলো এই ফোঁপানি শুনতে শুনতে পরস্পরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে যে যার জায়গায় বসে পড়ল। তাদের কানের মধ্যে বারবার সেই একই সুর বাজতে লাগল, তোরা থাম…থাম। এবং এক বিচিত্র বেদনা বোধে সকলেরই মনটা যেন কীসের আঘাতে টনটন করতে লাগল। কে জানত তাদের লাথঘুষিখেগো বাসি আবার অমন কথা বলতে পারে আর ঘরের এসব কাণ্ড দেখে গলায় দড়ি দিতে মন চায়।

ঠাণ্ডারাম গম্ভীরগলায় বলে উঠল, হুঁ হুঁড়ি ডেসেছে। খো-উব হুঁশিয়ার, হাঁ বলে দিলুম।

বলতে বলতে একটা দীর্ঘনিশ্বাসে তার গলার স্বর হারিয়ে গেল। তার প্রথম জীবনের ছবিটা ভেসে ভেসে উঠতে লাগল চোখের সামনে।

নবা আর কেষ্টর মনটা হঠাৎ কেমন বাউল বিবাগী হয়ে উঠল।

নবা বলল, না, কিছু ভাল লাগে না আর শালা।

কেষ্ট বলল, চলে যাব মাইরি কোথাও।

হঠাৎ আজকে তাদের সকলের কাছে চলতি জীবনটা বড় অসহ্য ক্লেদাক্ত আর ভারী হয়ে উঠল। এ ঘরের বাসিন্দাদের মৃত্যুকামীরা ভাবল বুঝি আজ সন্ধ্যা নামেনি গলিটাতে। কে জানে গলিটার মাথায় আজ আকাশ দেখা দিয়েছে কিনা।

.

অম্বুবাচির রজস্বলা গঙ্গার অথৈ লাল জলে আচমকা চোরা বান এসে তার শক্ত শুকনো পাড়কে ভিজিয়ে নরম করে দেওয়ার মতো ঠাণ্ডারামের পরিবারটা যেন খানিকটা প্রাণের রসে ভিজে উঠল। তাদের সে প্রাণগঙ্গা হল বাসন্তী, তাদের বাসি।

মানুষ তার মনের হদিস কতটুকুন পায়। নবা সেদিন যে মন নিয়ে বলেছিল, কিছু ভাল লাগে না, সে মনই আবার তার মনে মনে গাইল, জগতের সবাই আর কিছু খারাপ নয়। কেষ্টর যে বিবাগী প্রাণটা মাইরি দিব্যি কেটে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিল, তার মনে হল যেন মায়া পড়ে গেছে হা-ভাতে ঘরটার উপর। মেয়ের বয়সের ভারে যে সুকির বুকে পোড়ানি লেগেছিল, সে সব পোড়ানি কাটিয়ে খানিক কন্যে-সোহাগী মা হয়ে উঠল আর ডাসা মেয়ের হুঁশিয়ারি করতে গিয়ে ঠাণ্ডারাম নিজের মনটাকেই দিতে লাগল হুঁশিয়ার করে।

হারাণী আর কেলো জন্মে অবধি যাকে দিদি বলেনি, তাকেই তারা দিদি বলে আদর কাড়ানো শুরু করল।

আর বাসি..হাসিতে গাম্ভীর্যে পরিশ্রমে নবরসে এক নতুন কিশোরী সকলের মন কেড়ে এ ঘরের উনুন আস্তাকুঁড় থেকে মানুষগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যেন সকলের আপদ বালাই বিষজ্বালা নিয়ে থুয়ে মনে আর শরীরে আলো নিয়ে ভাঙা অন্ধ ঘরটায় মশালের মতো জ্বলছে।

তা বলে কি এ ঘরের বিবাদ বিসম্বাদ, পয়সা নিয়ে কাড়াকাড়ি গালাগালি খেয়োখেয়ি একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছে। না, তা যায়নি।

তারা এখনও পরস্পরকে আক্রমণ করে বসে, হঠাৎ শুরু হয়ে যায় লাথি ঘুষির ঝড়, ছোটে গালাগালির ভোড়। কিন্তু বাসি প্রতিমুহূর্তে তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।

ঠাণ্ডারাম তেমনি আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে এসে উনুনের ধারে বসে, সুকি তেমনি গালাগাল দেয়…ঠাণ্ডারাম মারবার উদ্যোগ করলেই বাসি গিয়ে মাঝখানে পড়ে; তখন ঠাণ্ডারাম বাসিকেই বলে, দ্যাখদিনি হারামজাদীর কাণ্ড, সরিয়ে নে যা ওকে, নইলে মারব মুখে—

সুকিও তড়পে ওঠে, মার দিকি মিনসে, দেখি

বাসি মায়ের হাত চেপে ধরে, মা থাম।

বাপের পায়ে হাত রেখে বলে, তা বাবা তুমি সব পয়সার নেশা করলে সমসার চলবে কেন?

ঠাণ্ডারাম অমনি ধমকে ওঠে, অ্যাই চোপ। ডেপোমি করবি তো মারব এক থাবড়া।…তারপর হঠাৎ যেন একেবারে ঝিমিয়ে পড়ে জোর করে নেশাচ্ছন্ন চোখের পাতা একটু খুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চাপাগলায় বলে, কোথা ছিলি অ্যাাঁ? সেদিনে ছিলি কোথা, যেদিন পয়লা নেশায় হাতেখড়ি হল? আজ যখন মরতে বসেছি…

হঠাৎ চুপ করে গিয়ে আবার তার গলায় যেন গোঙানি ওঠে, ওই তোর মা, মাগী বিয়োতে লাগল কাঁড়ি কাঁড়ি, এ ঘরের পেট হল অভর, শালা খালি দে দে খাই খাই…। তো নেশা করব না তো কী করব? কী করব? খুন করব না ডাকাতি করব? আর মাইরি বলছি, লোকের মাথায় শালা চুল গজানোই কমে গেল না কি নাপতের বংশই বেড়ে গেল, দুটো খদ্দের পাওয়া যায় না সারাদিনে!…

তারপর হাত ঝটকা দিয়ে বলে, এ শালার দুনিয়া বিগড়ে গেছে, নইলে বামুনের ছেলে সেলুন ঘর খুলে বসে?

সুকির প্রাণে খোঁচা লেগেছে। তাই সেও সুর করে বাসিকে মধ্যস্থ করে, তা বল তুই বাসি, আমি বিয়োলুম কাঁড়ি কাঁড়ি, সে কি আমার দোষ? বলি জগা নাপতের বেটি কবে ভেবেছিল নোকের দোরে দোরে ঘুরে ঝি খেটে মরবে, মিনসের ঝাঁটা নাথি খাবে।…তো বলি, কি না ছেলে আমার? কিন্তুন…এ সমসারের ঝকমারি কলের ঠাওর পাইনে আমি।..

থাক থাক…বলতে বলতে ঠাণ্ডারাম হয়তো কখনও হঠাৎ কিছু পয়সা বাসির কাছে বাড়িয়ে দেয়। নে যা ছেল নিয়ে নে। কাল যদি কামাই হয় তো মরব নেশা বিনে দেখিস। বলে তোবড়ানো মুখটায় বিচিত্র হেসে বলে বাসিকে, তখন কিন্তু কিছু দিস অ্যাঁ? লইলে তোর বাপ…বলতে বলতে আবার হঠাৎ বিকৃত মুখে বলে, হু, খুব ভেঁপো হয়ে গেছিস। খোউব হুঁশিয়ার!…

সুকিও তার রোজ কামানোর প্রাণধরা পয়সা একটি একটি করে টিপে টিপে দেয় বাসিকে দু-চোখ ভরা সংশয় নিয়ে। অর্থাৎ সাবধান, একটি পয়সা যেন এদিক ওদিক না হয়। তারপর নিজেই আবার বলে, শোনপাপড়ি না কি খেতে চেয়েছিলি? খাস, খাস কালকে দু-পয়সার।….

নবা এসে রোজই সেই এক কথা বলে, মাত্তর পাঁচসিকে পেয়েছি। অর্থাৎ রিকশার মালিককে ভাড়া বাবদ রোজ পাঁচসিকে দিতে হয়। অতএব..কেষ্টকে দেখিয়ে বলে, ও দিক না।

বলতে না বলতেই তাদের পরস্পরের মধ্যে লেগে যায়। সুকি ঠাণ্ডারামও বাদ যায় না। তারাও হামলে পড়ে এবং ছেলের পয়সায় মায়ের হক বেশি না বাপের হক বেশি সমস্যায় হঠাৎ এক হুড়োহুড়ি আরম্ভ হয় হয় প্রায়।

বাসি অমনি সকলের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। ঠাণ্ডা করে সবাইকে। নবাকে বলে, থাক দাদা, না থাকলে কোত্থেকে দিবি?

 নবা সরু গলায় হি হি করে হেসে ওঠে, পরমুহূর্তেই বুক ঠুকে বলে, লবা রিকশাওয়ালা পসা নেই মানে? হেঃ বলে শালা ঘেয়ো কুকুর সোয়ারি হলেও ছাড়িনে জানিস? এই মোটর বাস চালু হয়েই যত সর্বেনাশ করেছে লইলে…

বলে পয়সা বাড়িয়ে দেয় বাসির হাতে। চেয়েও দেখে না কেষ্ট পয়সা দিল কিনা কিংবা রইল কি নিজের খরচের পয়সাটা।

কেষ্টও লুকোয় না। হয়তো তার একটা শৌখিন রুমাল কিংবা একটা চিরুনি কেনার সাধ ছিল। কিন্তু বাসির কাছে মিছে বলতে কেমন খচখচ করে। যা থাকে সব দিয়ে বলে, নে, কানু মুদির দরজার পাল্লাটা সারিয়ে দিয়েছিলাম, কিছু পেয়ে গেছি।

তারপর দারুণ দুঃখে ও রাগে ফোঁস করে ওঠে, শালা দিনকালও তেমনি হয়েছে, একটা কাজ তো দূরের কথা, চটকলগুলোতে রোজ দুটো চারটে মিস্তিরি তাড়াচ্ছে।

সারাদিন খাটুনির পর সব ঝাড়ঝামেলা কাটিয়ে সবাই উনুনের কাছে বার্সিকে ঘিরে বসে। বাসি রুটি বেলে বেলে সেঁকে সবার পাতে পাতে দিতে থাকে।

সবাই খেতে থাকে আর তাদের প্রাণের যত কথা সব পেড়ে বসে বাসির কাছে।

ঠাণ্ডারাম তো বলবার ফাঁক না পেয়ে চেঁচিয়েই ওঠে, থামবি তোরা, আমাকে একটু বলতে দিবি নাকি যত কেরামতি তোদেরই।

প্রাণটা ভরে ওঠে বাসির। প্রাণের খুশির গমকে মুখে তার হাসিতে সোহাগে অপূর্ব হয়ে ওঠে। সে হাসির ঢেউই যেন তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে পরম গাম্ভীর্যে ও জৌলুসে।

এ সময়ে এদের দেখলে মনে হয়, কোনও দিন এরা বিবাদ করেনি, মারামারি করেনি, খেয়োখেয়ি কামড়াকামড়ি করেনি পয়সার জন্য। সুখে দুঃখে ওরা পরস্পরের গায়ে গা দিয়ে বেঁচে আছে।

.

শুধু এই নয়, আর কিছু ছিল। সে হল বাসির ঢল নামা যৌবন ও নীলাকাশের মতো মস্ত প্রাণটাতে আর একজনের আনাগোনা। সে যেন এক পক্ষীরাজের পিঠে চাপা রাজপুত্তুর, বাসিকে নিয়ে উড়ান দিয়ে নিয়ে চলে যেতে চায়।

বাসি যখন ঘরের মানুষগুলোর প্রাণ ঠাণ্ডা করে, প্রাণতোষ করে বসিয়ে খাওয়ায়, তখন সে এসে বোজ দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে কিম্বা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে আসে।…শক্ত কালো জোয়ান ছোকরা, নাম পবন। এ বস্তিরই উলটোদিকে একটা ঘরে থাকে, কাজ করে ফিটার মিস্তিরির, রোজগার নেহাত মন্দ নয়। খায় পরে একলা, মা ছিল, মরে গেছে। তারপর কিছুদিন পবন এ ঘাটে সে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছে বাউণ্ডেলের মতো। কিন্তু সে ভারী ওস্তাদ কারিগর, লোহা আর মেশিনের সঙ্গে তার মিতালি গভীর। আবার কাজ ধরল। কিন্তু কেমন যেন নিজের মনপ্রাণের হদিস হারিয়ে ঝিমিয়ে পড়ল সে। অবশেষে ঘরের কানাচে যেদিন বাসিকে আবিষ্কার করল, সেদিন থেকে তার প্রাণের পালে হাওয়া লেগে গেল।

কেমন করে জানি না, বাসি যেন আষ্টেপৃষ্টে ধরা পড়ে গেল বনের কাছে। তাতে তার কিশোরী মনটা যেন ভরা গঙ্গার মতো তীব্র স্রোতবাহী অথচ গম্ভীর মৌনতায় ভরে উঠল। রহস্যময়ী হয়ে উঠল তার ঠোঁটের রেখাটি, বিচিত্র ভাব ঝলকে ঝলকে উঠতে লাগল তার ভাসা চোখ দুটোতে।

আবার এ রূপের মহিমায় ঘরের মানুষগুলোও কেমন যেন অবাক মানে অথচ এক অপূর্ব আনন্দে তাদের ক্ষতবিক্ষত বুকগুলো ভরে উঠে। যেন যৌবন এসেছে এই অন্ধবন্ধ সারা ঘরটাতে।

প্রাণ খানিক খুলে গেছে কেলোরও। দুপুরবেলা দিদির কাছে তার কেষ্টলীলা গাওয়ার ভয় নেই। সে থেকে থেকে গান ধরে—

ছকি, কেন কুঞ্জল ধালে দাঁলিয়ে কালা,
ফিলে যেতে বল।

সে গানে হঠাৎ বাসিরও মনটা নেচে ওঠে। মনে হয়, যেন রাধিকার মতো মিলনের ছল খুঁজে সে-ই পবনকে অভিমান করে ফিরিয়ে দিচ্ছে। সে চোখ ঘুরিয়ে কপট বেদনার ভাব করে বলে, কেন বলব ফিরে যেতে?

কেলো কেষ্টযাত্রার রাধার ঢঙে গেয়ে ওঠে

আমি না বুঝে-ছুঝে লাখালে ছঙ্গে মজে,
ছকি, তাল পেলেম পিতিফল।

তাই কি? হাসতে গিয়ে থমকে যায় বাসি। তার কানে বাজে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পবনের প্রাণের ডাক : বাসি, চল, চলে যাই, ঘর করিগে দুজনে বেশ সোন্দর, তুই আর আমি। বাপ ভাই কি কারও নেই, না চেরকাল থাকে? আমি ভ্যানতাড়া করে ঘুরি, পয়সা কিছু জমিয়েছি, সব লষ্ট হয়ে যাবে, চল চলে যাই, হ্যাঁ।

সঙ্গে সঙ্গে বাসির চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘরের মানুষগুলোর শুকনোপোড়া মুখগুলো, তাদের সেই মারামারি গালাগালি কাড়াকাড়ি, তাদের হাসি কান্না সোহাগ। সে বলে, যাব যাব। কিন্তু যেতে পারে না।

কোলের ভাই নোলাটাও অদ্ভুত হয়ে উঠেছে। বাসিকে শাড়ি পরা দেখে বোধ করি মা ভেবেই তার অশক্ত নড়বড়ে ঘাড়টা মাটি থেকে তুলে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আঁউ-আঁউ করে কেঁদে ওঠে। কোলে উঠেই নোলা আজকাল বাসির বুকে মুখ ঘষে কাঁদে।

বাসি খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, এই সেরেছে, আমি কি মা নাকি রে?

নোলা সে সব বোঝে না, কেবলই হাঁই হাঁই করে আর মুখ ঘষে।

শেষটায় বাসি ঘরের অন্ধকার কোণটায় গিয়ে সত্যি ভাইয়ের মুখের কাছে তার শক্ত পুষ্ট বুক খুলে দেয়। কিছুই হয়তো নোলা পায় না। তবু অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে পরম শান্তিতে। কেবল কাঁটা দিয়ে ওঠে বাসির সারা শরীরে, মাথাটার মধ্যে ঝিমঝিম করে। তার পরে অবাক হয়ে দেখে বিন্দু বিন্দু ঘামের মতো সাদাটে গাঢ় রস ফুটে বেরুচ্ছে স্তনের বোঁটায়। মুহূর্তে তার সারা শরীরটা দুলে ওঠে, হাসিকান্নায় বেদনায় ভরে ওঠে বুকটা। উদাস হয়ে যায় মনটা। তাড়াতাড়ি নোলাকে শুইয়ে দিয়ে ঘরের ফোকর দিয়ে এক চিমটি আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, চলে যাব চলে যাব।

কিন্তু তার পরেই আসে সন্ধ্যা। রাজ্যের বোঝা ঠেলে মানুষগুলো ফিরে আসে তিক্ত উত্তপ্ত মনে! রুক্ষ শুকনো ধুলো-কালিভরা চেহারা নিয়ে, নিয়ে চড়াভরা মেজাজ। তবু আজকাল তাদের কাড়াকাড়ি খেয়োখেয়ি অনেকটা কমে শান্ত নরম হয়ে এসেছে মনটা।

বরং ঠাণ্ডারাম হয়তো কারচুপে দু পয়সার ঘুগনিদানা বা এক টুকরো বোম্বাই আমসত্ত্ব বাসির হাতে তুলে দেয়, নবা হয়তো নিয়ে আসে বাসির বড় সাধের সরপুঁটি, কেষ্টর হাতে ঝলকে ওঠে সরেস ব্লাউজের ছিটের একটা ফালি কিংবা একরাশ কাচের চুড়ি। কী প্রাণপণ কষ্টে যে দালা ঘিয়ের কারখানায় প্যাকিং বাক্স বানাবার কাজটা পেয়েছে, তা বাসি ছাড়া বুঝি কেউ জানে না।

বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। সুকির চেয়েও যে হারাণীর পয়সা হল প্রাণ, সেও তার খুঁটে বিক্রির পয়সা বাসির হাতে তুলে দেয়।

মাঝে মাঝে তাদের মন কষাকষি বিবাদে হঠাৎ তারা তাদের মেয়ে ও বোন বাসির কাছে বিচার দাবি করে বসে।

বাপ মা ভাই বোন মিলে এক ভরা-সংসার তাদের।

পবনের ব্যাপারটাও সকলেই আঁচ করে নিয়েছে এবং সকলেই তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেয় পবনকে।

নবা বলে, শালার চোখ গেলে দেব এদিকে তাকালে।

কেষ্টর রাগটাই বোধ হয় বেশি, কেননা সেও মেশিনের কাজকর্ম জানে কিছু।

আর জামাকাপড়েও পবন ভারী দুরস্ত। বলে, শালা ভারী মিস্তিরি। লোহা কাটতে পারলেই হল। ঝাড়ব একদিন রদ্দা, বাপের নাম নে ঝরে পড়বে।

সুকিও চোখ পাকায়। ঠাণ্ডারাম বলে, লে আয় ব্যাটাকে, আপিম গুলে খাইয়ে ফেলে দিয়ে আসি গঙ্গায়। নেশাও হবে, মজাও বুঝবে।

তারপর তারা বাসিকেও বলে দেয়, খুব হুঁশিয়ার। ওই মুদ্দোটাকে একদম ঘেঁসতে দিসনি।

কোনও কোনও দিন হঠাৎ তারা সবাই তাদের তিক্ত সংশয়ে ফেটে পড়ে; হিসেব চেয়ে বসে বাসির কাছে; দে, হিসেব দে, কালকের পসার। কী করছিস কারচুপে কে জানে।

বলে তারা ক্ষিপ্ত জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বার উদ্যোগ করে।

বাসি দাঁতে দাঁত চেপে কান্না রোধ করে তাদের পাইপয়সাটির হিসাব দিয়ে দেয়, বরং তার বুদ্ধির দৌড়ে এদের হিসেবের কড়ি বাড়তিও থেকে যায়।

মুহূর্তে সব মানুষগুলো ধিক্কারে লজ্জায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে মাথা নিচু করে নেয়, মুখ লুকোয়, মুখ ফুটে ক্ষমা চাইতে পারে না। তোষামোদের হাসি হাসতে গিয়ে হঠাৎ বিষয় হয়ে এক বোবা বেদনায়

ও গভীর সংশয়ে ড্যাব ড্যাবা চোখে নতমুখী বাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।

বাসি মনে করে, তবু তো এইটুকুন, কুরুক্ষেত্তর তো করেনি।

আর ওরা পরস্পর হঠাৎ কে আগে হিসেব চেয়েছে তাই নিয়ে বিবাদ শুরু করে দেয়। বাসি আবার মাঝে এসে দাঁড়ায়।

.

পবনের প্রাণের দামামা আরও উদ্দাম হয়ে ওঠে, প্রাণটা ছটফট করে শক্ত শরীরের পিঞ্জরে। সে কারখানা পালিয়ে দিনের নিভৃতে আসে মাঝে মাঝে। অনুরাগে, আবেগে অস্থির হয়ে সে বাসির হাত দুটো ধরে বলে, চল বাসি চল। মাইরি তোর এ থমকানি আর সয় না। বাপ ভাই কি আর কারও থাকে না?

বাসি তবু থমকে থাকে। কী বলবে, ভেবে পায় না।

পবন হঠাৎ রেগে মাটিতে প্রচণ্ড একটা ঘুষি মেরে বলে, আমি মরে গেলে যাবি? ধ্যাত শালা, আর যদি আসি তো—

একটু গিয়েই আবার সে ফিরে এসে বাসির সামনে দাঁড়ায়।

অসহায় চোখে, বেদনায় বঙ্কিম ঠোঁটে, আড়ষ্ট মনে অবহেলায় ঝোঁকা শরীরে এক বিচিত্র বেদনায় অথচ কি অপূর্ব রূপ যে ফুটে ওঠে বাসির সারা শরীরে! প্রাণ ও মনের জোয়ারের কুলুকুলু ধ্বনি যেন শোনা যায় তার শক্ত বলিষ্ঠ শরীরটার রেখায় রেখায়।

পবন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাত বাড়িয়ে দেয় পায়ের কাছে, আমি পারব না বাসি, তোকে ছাড়ত্বে পারব না। চল চল…

বাসিও পারে না, ভেঙে পড়ে। পবন যে তার ভালবাসার মানুষ। শক্ত জোয়ান ফিটফাট ওস্তাদ কারিগর পবন!

পবনের পায়ে ধরা হাত দুটো বুকে তুলে বলে, যাব, ঠিক যাব।

পবনের গলা কেঁপে ওঠে, কবে?

যবে বলবে।

আজকেই?

বেশ।

হাসতে গিয়ে আটকে গেল পবনের বুকে। দিশেহারা হয়ে সে হঠাৎ একলাফে কারখানার দিকে ছুটল। বাসি ঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে হাসল, কতরকম তার ভাব। ফিসফিস করে উঠল, আমার ঘর, সমসার, ছেলে, পবন।–

.

সন্ধ্যার ঝোঁকে অন্ধ সুড়ং গলিটার মধ্যে সুকিদের রকটা অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসেছিল এবং সবাই ফিরে এসে অবাক বিস্ময়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর লম্ফটা জ্বালতেই খালি উনুনটা, চায়ের জলের হাঁড়িটা হাহাকার করে উঠল। … এক কোণে হারাণী বসে আছে নোলাকে নিয়ে। কেলো বসে আছে এক কোণে একটা কুকুর বাচ্চার মতো। হাতা খুন্তি কড়াগুলো যেন ঠুটো জগন্নাথের মতো পড়ে আছে, উনুনের ধারে পিঁড়েটা পাতা, কিন্তু যেন কতদিন ধরে।

সুকি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, বাসি কোথা?

হারাণী বলে, চলে গেছে?

চলে গেছে? কোথা?

পবন মিস্তিরির সঙ্গে।

পবনের সঙ্গে? হঠাৎ খেপে গিয়ে সুকি হারাণীকেই দড়াম করে কষাল এক লাথি।

সে হাউমাউ করে নোলাকে ফেলে দিল ছুট।

তারপর তারা সকলেই হাঁকডাক চিৎকার শুরু করে দিল, লে আও শালাকে, মেরে ফেলব ওদের, দুটোকেই আজ খুন করব।…

কিন্তু কোথায় তারা। চিৎকারটা তাদের নিজেদের কানেই অসাড় ঠেকতে তারা থেমে গেল।

ঠাণ্ডারাম তার নেশা-জড়ানো গলায় বলে উঠল সুকিকে, বলেছিলুম কিনা, ছুড়ি খোউব ভেঁপো হয়েছে, পেকেছে আর অমনি টুপ করে খসেছে। অ্যাই তোর—মাগী সব তোর দোষ।

সুকিও অকারণ দায়দোষে রুখে উঠল, ছাঁচড়া মিনসে, আমার দোষ হল? সোহাগ করে আমি নুকে নুকে ঘুগনি খাওয়াতুম?

চো-প।

তুই চোপ। সুকিও বলে।

নবাও বলে উঠ, সব তোদের দোষ। কেষ্টকে বলল, যা না, খুব চুড়ি এনে দে, জামা এনে দে..

তুই-ই তো মাছ এনে খাওয়াতিস, আবার আমাকে বলছিস?

পরস্পরের এমনি ঝগড়ায় ঝগড়ায় তারা পরস্পরের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েও হঠাৎ থেমে গেল। আচমকাই তাদের নজরটা গিয়ে পড়ে খালি উনুন, উবু করা হাঁড়ি, রান্নসাজহীন রক, খালি পিঁড়েটা। বাসি নেই সেখানে।

চকিতে মনটা তাদের ভেঙে টুণ্ডা হয়ে যায়, জড়োসড়ো হয়ে বসে লম্ফটার দিকে দিকে চেয়ে থাকে। তাদের মুখে বেদনা না কান্না ঠাহর পাওয়া যায় না। উদ্বন্ধনে মৃত একদল চোখ চাওয়া মড়ার মতো বসে থাকে তারা, অসহায় উদ্দীপ্ত জোড়া জোড়া চোখ। অন্ধ গুহার গায়ে একদল প্রস্তর মূর্তি নয় তো যেন ভুতুড়ে পুতুলেরা বোবা অস্থিরতায় নিরেট।

বাসি চলে গেছে…

হ্যাঁ, বাসি চলেছে শহর ছাড়িয়ে, পবনের পাশে পাশে দীর্ঘ মাঠের পথ দিয়ে গঙ্গার দিকে। পবনের হাতে একটা টিনের সুটকেশ, পরনে কারখানার পোশাক। দুলে দুলে উঠছে তার শক্ত জোয়ান শরীরটা চলার তালে তালে।

আঃ! কী অফুরন্ত হাওয়া। সন্ধ্যা রাত্রির তারাভরা আকাশ। সেই আকাশে মিশে গেছে মাঠ গঙ্গা। হাওয়ার শরশরানি গান গেয়ে চলেছে, ডাক দিয়েছে যেন দূর চক্রবালের কানাচে অস্তগামী সূর্যের তপ্ত ধূসর আকাশ।

প্রাণ খুলে বকবক করে চলেছে পবন, জানিস বাসি, চন্দননগর শহরটা ভারী সোন্দর। খুব ছোটমোটো একখানা ঘর দেখেছি। ভাড়াও খুব কম। আমার এক দূর সম্পর্কের পিসি আছে, তাকে বলব আমাদের বে দিতে অ্যাাঁ? মাইরি, তুই যা ভোগালিউঃ। কালকেই সব গুছিয়ে ফেলব ঘরের। তবে বলি তোকে, আমার না, তিনশো টাকা আছে—মাইরি। তুই যা খুশি তাই করিস।

এ-সব বলতে বলতে তারা গঙ্গার ধারে এসে পড়ে।

তীব্র বেগে জোয়ার ছুটে চলেছে উত্তরে। তারার আলো ঢেউয়ে ঢেউয়ে নিমেষে হারিয়ে যাচ্ছে।

পবন বলল, আজকে আর খেয়া লৌকয় লয়, জানলি বাসি। সে তো সব সময়ই হয়। আজকে একটা পুরো লৌকই ভাড়া করব অ্যাঁ?

মাঝগঙ্গার অন্ধকারে আচমকা মাথা তোলা ঢেউয়ের মতোই বিচিত্র হেসে ঘাড় নাড়ে বাসি।

পবন নৌকা ডাকে। নৌকা দরদস্তুর করে বলে, ওঠ বাসি, জোয়ারের টানে পেরুই, শালা ভাটায় আবার বেশি টাইম লেগে যাবে।

বাসি হঠাৎ পবনের পায়ের উপর পড়ে বলে উঠল, আমি যাব না, না মিস্তিরি ফিরে চলো।

পবনের মনে হল গলায় এসে তার প্রাণটা ঠেকে গেছে। অ্যাঁ, কী বলছিস তুই, পাগল নাকি? ওঠ ওঠ।

বাসি কান্নায় ভেঙে পড়ল, আমি পারব না মিস্তিরি। এখোন ওরা না জানি কী করছে। ওরা নিশ্চয় মারামারি করছে, মরছে বুঝি মারামারি করে।

করুক। ধমকে ওঠে পবন, সবাই করে, ওঠ।

কিন্তু বাসির প্রাণে আরও উৎকণ্ঠা, আরও বেশি অস্থির হয়ে ওঠে সে। না ফিরে চলল মিস্তিরি!…

পবন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না।

মাঝি বলল, যাবে না কি?

পবন দেখল, অন্ধকারে চোখের জল চকচক করছে বাসির গালে। জামা নেই, হাওয়ায় কাপড় এলোমেলো। হাওয়াতেই বুঝি শিউরে শিউরে উঠছে তার শরীরটা। আর জোয়ারের জলে ভেজা পাড়ের মতো কেমন চকচক করছে বাসির রংটা। কিন্তু বাসি একেবারে মুখ ঘুরিয়েছে।

কান্নাই পায় নাকি রাগই হয়, পবনও আর পারে না। সে মাটির উপর আছড়ে ফেলে সুটকেশটা। ছেড়া গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, নাঃ শালা মেয়েমানুষের সঙ্গে কখনো ভালবাসা করতে নেই। যা যা, তুই আমার সামনে থেকে চলে যা।

রহস্যময়ী অন্ধকারে করুণ চোখ তুলে তাকাল বাসি পবনের দিকে।

পবন আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, যা বলছি।…

তার সে চিৎকারের প্রতিধ্বনি উঠল জোয়ারের ঢেউয়ে ঢেউয়ে।

মাঠের পথ ধরে বাসি ফিরে চলল, ধীরে ঝুঁকে পড়ে, যেন হাওয়ায় গা ভাসিয়ে। সে হাওয়ায় ভেসে গেল তার ফিসফিসানি, আমি পারব না, ওরা যে মরে যাবে।

রুদ্ধনিশ্বাসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল পবন। রাগে দুঃখে স্তব্ধ।

অন্ধকার মাঠটা তার দিকে যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার কিনারে কিনারে ঢেউয়ের ছলছলানি যেন হেসে হেসে বিদ্রূপ করে উঠল তার কিছুক্ষণ পূর্বের স্বপ্ন রচনাকে।

সে ফিরে তাকাল ওপার চন্দননগরের দিকে। গঙ্গার বুক থেকে উঠে আসা হাওয়ায় তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ল চোখে মুখে।

হঠাৎ তার চোখ দুটো জ্বালা করে মাঠ গঙ্গা চন্দননগর…সব ঝাপসা হয়ে গেল। উবু হয়ে সুটকেশটা কুড়িয়ে সে আবার ওপারের অন্ধকারের দিকে দেখল। নাঃ বাসি যদি নেই তবে আর চন্দননগরে কী আছে!…

বাসির ফিরে চলা মাঠের পথ ধরে সুটকেশটা কাঁধে নিয়ে এগুলো সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *