১.০৪ পলায়ন (১৩২৪)

১৩২৩ সালে আমার ভগ্নিপতি আঃ হামিদ মোল্লা আমার সেজ ভগ্নীকে নেকাহ করে এসেছেন আমাদের সংসারে। তিনি এসে আমার নীলামী সম্পত্তিটুকু জমিদারের কাছ থেকে পুনঃ পত্তন গ্রহণ করলেন। কিন্তু জমির অর্ধেক কবুলিয়ত দিয়ে নিলেন তিনি তার মাতা মেহের জান বিবির বেনামীতে এবং অর্ধেক দিলেন আমাকে (নাবালক বিধায় আমি কবুলিয়ত দিতে না পারায়) আমার মাতার বেনামীতে। এ সময় তিনি আমাদের একান্ন ভূক্ত থেকে কৃষিকাজ করতেছিলেন। আমি তাঁর মাঠের কাজে সহায়তা না করে বেয়ারাপনা ও আনাড়ী কাজ করায় তিনি ছিলেন আমার উপর অত্যন্ত রুষ্ঠ ।

১৩২৪ সালের ৩রা চৈত্র। মোল্লা সাব দুপুরে হাল ছেড়ে মাঠ হতে এসে দেখতে পেলেন যে, আমি পুকুরের পাড়ে বসে “জলের কল” চালাচ্ছি। তখন ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি আমাকে কয়েকটি কিল-চড় মেরে হাত ধরে একটি আছাড় দিলেন এবং বহু পরিশ্রমের তৈরী “জলের কল” ভেঙ্গে চুরে ফেলে ঘরে চলে গেলেন। আমি কিছু সময় কান্না করে ঘরে যেয়ে দেখি যে, মা ভাত পাক করছেন আর মোল্লা সাব-আমার বহু দিনের পুঁজী করা ছবি ও বই গুলি জ্বলন্ত চুলোয় দিয়ে জ্বলিয়ে দিচ্ছেন। উহা দেখে ক্ষোভে-দুঃখে আমি আবার কাঁদতে লাগলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম-আমি আর ছবিও আঁকব না, জলের কলও বানাব না, “হয়ত পড়ব, নয়ত মরব” ।

বেলা ১২টা। একখানা ছেড়া লুঙ্গি পরে ও একটি ময়লা জামার পকেটে চৌদ্দ আনা পয়সা গুজে অভুক্ত লুকিয়ে ঘর হতে বের হলাম পশ্চিম দিকে। বেলা দুটোয় বরিশাল পৌঁছে কিছু খেয়ে লক্ষ্যহীন ভাবে চলতে লাগলাম পশ্চিমে। কলেজ রোডে এক ভদ্রলোকের সহগামী হলাম। চলতে চলতে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-আমার বাড়ী কোথায়, কেন কোথায় যাব ইত্যাদি। আমি আমার ঠিকানা বল্লাম আর বল্লাম যে, কোথায় যাব, তা জানি না, তবে উদ্দেশ্য আমার লেখা-পড়া শিক্ষা করা। আমার বক্তব্য শুনে ভদ্রলোকটি আমাকে তার সঙ্গে যেতে বল্লেন। আমি রাজী হয়ে তার সাথে সাথে চল্লাম।

ভদ্রলোকটির নাম এখন স্মরণ নাই, তার ঠিকানা-বরিশাল থেকে সতর মাইল পশ্চিমে “বাকপুর” গ্রামে প্রসিদ্ধ কাজীবাড়ী। পিতার নাম মহব্বত আলী কাজী। রাত বারোটায় আমরা কাজীবাড়ী পুছলাম। আহারান্তে ভদ্রলোকটি আমাকে বল্লেন যে, ওখান থেকে তিন মাইল পশ্চিমে বানরীপাড়া থানা। সেখানে থেকে (বেলা ১০টায়) স্টিমার যোগে স্বরূপকাঠী যাওয়া যায় এবং ওখান হতে সামান্য উত্তর দিকে “মাগুরা” গ্রামে মৌলুভী নেছার উদ্দিন সাবের বাড়ী। আমি সেখানে গেলে হয়ত পড়বার সুযোগ পেতে পারি (সে সময়ের লোকে “সর্ষীণা”কে “মাগুরা” এবং “পীর সাবকে” শুধু মওলানা সাব বলত। সংকল্প ঠিক করে শুয়ে পরলাম।

৪ঠা চৈত্র। ভোরে আহারান্তে ভদ্রলোকটির কথিত পথ ধরে বেলা ১১টায় আমি মৌলুভী সাবের বাড়তে পুছলাম এবং দেখতে পেলাম যে, কয়েক জন ছাত্র ছোট একটি পানা ভর্তি পুকুরে পানা পরিষ্কার করছে আর মওলানা সাব পাড়ে বসে তা দেখছেন, দু-তিন জন লোক তার কাছে দাড়ানো। আমি ছালাম বলে দাড়াতেই মওলানা সাব জিজ্ঞেস করলেন আমার নাম, ধাম ও ওখানে যাবার কারণ কি। আমি সবিনয়ে সকল কথা বল্লাম। শুনে তিনি আমাকে বল্লেন-“তুমি মাষ্টার সাবের কাছে যাও, মাদ্রাসায় ভর্তি হও গিয়ে”। শুনে আমি আনন্দে যেন স্বর্গের দ্বারে পুছলাম।

খোঁজ নিয়ে মাষ্টার এমদাদ আলী সাবের সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং বল্লাম যে, মওলানা সাব আমাকে তার মাদ্রাসায় ভর্তি হতে বলেছেন, আপনি দয়া করে ভর্তি করে নিন। শুনে মাষ্টার সাব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-“তোমার অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে এসেছ ?” বল্লাম “হা”। আবার জিজ্ঞেস করলেন-“অনুমতি পত্র এনেছ?” বল্লাম “না”। তিনি আমাকে বল্লেন -“বাড়ীতে অনুমতির জন্য চিঠি দাও, উত্তর পেলে ভর্তি করব”। আমার কাছে পয়সা নাই” বলে জানালে তিনি আমাকে দুখানা পয়সা দিয়ে বল্লেন-“এর দ্বারা পোস্টকার্ড কিনে বাড়ীতে চিঠি দাও”।

আমি মহা ফাঁপরে পড়ে মনে মনে ভাবতে লাগলাম যে, বাড়ীতে চিঠি দিলে মা আমাকে কিছুতেই বিদেশে থাকবার ও পড়বার অনুমতি দেবেন না, বরং আমার খোঁজ পেয়ে মোল্লা সাবকে পাঠিয়ে আমাকে ধরে নিবেন, হয়ত মারধোরও করতে পারে। অধিকন্তু মাস্টার সাবের নিকট আমি “মিথ্যাবাদী” প্রমাণিত হব। এর চেয়ে এখন স্বেচ্ছায় আমার বাড়ীতে যাওয়াই শ্ৰেয়ঃ।

আমি মাষ্টার সাবের কাছ থেকে চলে এলাম। মাষ্টার এমদাদ আলী সাব যেন আমাকে স্বর্গের দ্বার হতে ফিরিয়ে দিলেন মৰ্ত্তে।

দেখলাম-মওলানা সাবের বাড়ীতে একটি লঙ্গরখানা (দাতব্য হোটেল) আছে। মাদ্রাসার শিক্ষক, বিদেশী ছাত্রবৃন্দ ও অন্যান্য বহুলোক ওখানে খেয়ে থাকে। আমি দুপুরে ওখানে খেলাম এবং রাত্রেও। জানতে পারলাম যে, লঙ্গরখানার বাবুর্চি সাব ছুটি নিয়ে আজ শেষ রাতে নৌকো যোগে বাড়ীতে যাবেন। বাড়ী তাঁর ঝালকাঠীর নিকটবর্তি “গাবখান” গ্রামে। আমি ঝালকাঠী যাবার উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ জানালে তিনি রাজী হলেন এবং যথা সময়ে আমাকে ডেকে নিলেন। আমি মাগুরা ত্যাগ করলাম।

৫ই চৈত্র। বেলা ১০টায় আমরা গাবখান পুছলাম। আমার পথের সম্বল ১৪ আনা পয়সা – বরিশালের হোটেল ও (বানরীপাড়া -সরূপকাঠী) ষ্টিমারেই খরচ হয়েছিল। এখন পকেটে আছে মাত্র মাষ্টার সাবের দেওয়া দুটি পয়সা। পয়সা দুটি বাবুর্চি সাবের হাতে দিলাম আর বল্লাম-“এ পয়সা দুটি মাষ্টার সাবের হাতে দেবেন”। নৌকো হতে উঠে আমি ঝালকাঠীর পথ ধরলাম ।

যখন ঝালকাঠী পৌঁছলাম, তখন বেলা ১১টা। বেশ ক্ষুধা পাচ্ছিল। কিন্তু ওখানে বসে থাকলেত ক্ষুধা মিটবে না! ভেবে স্থির করলাম যে, আজ সারাদিন না খেয়েই আমাকে চলতে হবে। চৈত্র মাসের দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে (উনিশ মাইল পথ ঝালকাঠী-বরিশাল ১৩ ও বরিশাল লামচরি ৬ মাইল) বরিশালের রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করলাম।
ক্রমে রোদের তাপ ও ক্ষুধা উভয়ই বাড়তে লাগল। কিন্তু কমতে লাগল-শক্তি ও সহ্য। সামান্য হাটি আবার ছায়া পেলে বসি। এ ভাবে হেটে-বসে বেলা দুটোয় পাড়ি দিতে হল পেমারের বিশাল মাঠ। প্রায় ঘন্টাখানেক অবিশ্রাম চলতে হ’ল। কেননা এখানে কোন গাছপালা নাই। ক্ষুধা-পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, বিশেষতঃ রোদে। মাঠ পার হয়ে এক গেরস্তের বাড়ীর দরজায় বসে বিশ্রাম নিলাম ও চেয়ে কিছু চাল-পানি খেয়ে আবার হাটতে শুরু ৬ করলাম। যখন বাড়ীতে পুছলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা।

আমি ভেবেছিলাম যে, বাড়ীতে এসে আমার মায়ের তিরষ্কার ও মোল্লা সাবের অত্যাচার ভোগ করতেই হবে। কিন্তু তা কিছুই হ’ল না। আমাকে দেখে মা’র আনন্দ আর ধরে না। তিনি আনন্দে কাঁদতে লাগলেন, কাছে টেনে নিয়ে আমার বুকে-পিঠে হাত বুলালেন, তাড়াতাড়ি খেতে দিলেন। শোনলাম – আমি বাড়ী হতে যাবার পর মা আর আহার করেন নাই। সব সময় কেদেছেন আর আমার “জলের কল” ভাঙ্গা ও “বই-ছবি” পোড়ার জন্য মোল্লা সাবকে আবোল-তাবোল বলেছেন আর বকেছেন—তুমি আমার সব সম্পত্তি খাবার মতলবে “কুড়ী” কে মেরে ঘরের বের করেছ। ওটা মারা গেলেই তোমার ভাল। ওকে তালাশ করে এনে দাও ইত্যাদি (ছোটবেলা মা আমাকে “কুড়ী” বলে ডাকতেন এবং অন্যরাও)।

মা’র কোন কথার উত্তর না দিয়ে মোল্লা সাব সেদিন পাড়ার আত্নীয়-কুটুম্বদের বাড়ীতে এবং বরিশাল জাহাজ ঘাট গিয়ে বিদেশগামী জাহাজ সমূহে আমাকে খোঁজ করেছেন। পরের দিন দূরাঞ্চলের আত্নীয়-কুটুম্বদের বাড়ীতে খোঁজ করে কোথায়ও না পেয়ে “নিরুদ্দেশ” সংবাদ পুলিশে জানাতে আজ থানায় গিয়েছেন।

মোল্লা সাব রাত ৮টায় বাড়ীতে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে খুশী হলেন কি-না, জানি না; তবে নিশ্চিন্ত হলেন। পরের দিন আবার তিনি থানায় গেলেন (বরিশাল) আমার “পোঁছার” সংবাদ পুলিশে জানাবার জন্য। রাত্রে তিনি বাড়ীতে এসে বল্লেন যে, সে পুলিশের “কনেষ্টবল” পদে ভর্তি হয়ে এসেছেন। আসছে বৈশাখ মাসের মধ্যভাগে তিনি ট্রেনিং এ যাবেন। যথা সময়ে মোল্লা সাব ছয়মাস ট্রেনিং এর জন্য ঢাকায় গেলেন। আমি শ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। (বৈশাখ ১৩২৫)

ভাবতে লাগলাম-এখন কি করব। প্রতিজ্ঞা করেছি-“হয়ত পড়ব নয়ত মরব”। প্রতিজ্ঞা বহাল রাখতে হলে আমাকে পড়তে হবে, নচেৎ মরতে হবে। কিন্তু কোথায়ও পড়বার সুযোগ পাচ্ছি না বলে কি মরব? মরা ত সোজা কথা নয়। কেমন করে মরব। আত্নহত্যা ইচ্ছা-মৃত্যু চেষ্টা সাপেক্ষ। স্বেচ্ছায় মরতে হলে তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। মরার জন্য যেমন চেষ্টা আবশ্যক, তেমন পড়ার জন্যও। তবে কোনটা আগে করব? স্থির করলাম যে, আগে পড়বার জন্য চেষ্টা করব, বিফল হলে পরে মরবার চেষ্টা।

এখন সমস্যা হল- কোথায় পড়ব? কার কাছে পড়ব? কি পড়ব? ইত্যাদি। সমাধান করলাম-আমি কোথায়ও পড়ব না, কারও নিকট পড়ব না, একটা কিছু পড়ব না। আমি ঘরে বসে পড়ব, একা একা পড়ব, সব কিছু পড়ব; অর্থাৎ যা-ই-পাব, তা-ই-পড়ব।