উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

পরের উপকার করিও না

পরের উপকার করিও না

আমি প্যালারাম, ক্যাবলা আর হাবুল সেন—তিনজনে নেহাত গো-বেচারার মতো কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছি। তাকিয়ে আছি কাঠগড়ার আসামীর দিকে। তার মুখ আমাদের চেয়েও করুণ। ছ ফুট লম্বা অমন জোয়ানটা ভয়ে কেম্নের মতো কুঁকড়ে গেছে। গণ্ডারের খাঁড়ার মতো খাড়া নাকটাও যেন চেপসে গেছে একটা থ্যাবড়া ব্যাংয়ের মতো। সাধুভাষায় যাকে বলে, দস্তুরমতো পরিস্থিতি।

কে আসামী?

আর কে হতে পারে? আমাদের পটলডাঙার সেই স্বনামধন্য টেনিদা। গড়ের মাঠের গোরা ঠ্যাঙানোর সেই প্রচণ্ড প্রতাপ এখন একটা চায়ের কাপের মতো ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে। চায়ের কাপ না বলে চিরতার গেলাসও বলতে পারা যায় বোধহয়।

-হুজুর ধর্মাবতার—

ফরিয়াদি পক্ষের উকিল লাফিয়ে উঠলেন। মনে হল যেন হাত দশেক ছিটকে উঠল একটা কুড়ি-নম্বরী ফুটবল। গলার আওয়াজ তো নয়—যেন আট-দশটা চীনে-পটকা ফাটল একসঙ্গে। ধর্মাবতার চেয়ারের ওপর আঁতকে উঠে পড়তে পড়তে সামলে গেলেন।

—অমন বাজখাঁই গলায় চেঁচাবেন না মশাই, পিলে চমকে যায়। জজ সাহেব ভূ কোঁচাকালেন : কী বলতে হয় ঝটপট বলে ফেলুন।

উকিল একটা ঘুষি বাগিয়ে তাকালেন টেনিদার দিকে। একরাশ কালো কালো আলপিনের মতো গোঁফগুলো তাঁর খাড়া হয়ে উঠল।

–ধর্মাবতার, আসামী ভজহরি মুখুজ্জে (আমাদের টেনিদা) কী অন্যায় করেছে, তা আপনি শুনেছেন। অবোলা জীবের ওপর ভীষণ অত্যাচার সে করেছে, তার নিন্দের ভাষা নেই। একটা ছাগল পরশু থেকে কাঁচা ঘাস পর্যন্ত হজম করতে পারছে না। আর-একটা সমানে বমি করছে। আর-একটা তিন দিন ধরে যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে ফরিয়াদির একটা ট্যাঁক-ঘড়ি সুষ্ঠু চিবিয়ে ফেলেছে!

রোগা সিঁটকে একটা লোক, হলধর পালুইসে-ই ফরিয়াদি। হলধর ফোঁসফোঁস করে কাঁদতে লাগল।

–খুব ভালো ঘড়ি ছিল হুজুরকী শক্ত! আমার ছেলে ওইটে ছুঁড়ে ছুঁড়ে আম পাড়ত। চলত না বটে, তবু ঘড়ির মতো ঘড়ি ছিল একটা বলে, হলধর এবার ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ফেলল। কান্নার বেগ একটু কমলে বললে, ঘড়ি না-হয় যাক হুজুর, কিন্তু আমার অমন তিনটে ছাগল! বুঝি পাগল হয়ে গেল হুজুর—একেবারে উদ্দাম পাগল।

জজ কানে একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে চুলকোতে চুলকোতে বিরক্ত মুখে বললেন, আঃ জ্বালাতন! আরে বাপু, তুমি তো দেখছি একটা ছাগল! ছাগল কখনও পাগল হয়? সে যাক, অপরাধের গুরুত্ব চিন্তা করে আমি আসামী ভজহরি মুখুজ্যেকে তিন টাকা জরিমানা করলাম। এই তিন টাকা ফরিয়াদি হলধর পালুইকে দেওয়া হবে তার ছাগলদের রসগোল্লা খাওয়াবার জন্যে।

জজ উঠে পড়লেন।

টেনিদা আমাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ভাবটা এই; এ-যাত্ৰা তরিয়ে দে! আমার ট্যাঁক তো গড়ের মাঠ।

আমি, ক্যাবলা আর হাবুল সেন—চার মূর্তির তিন মূর্তি–চাঁদা করে তিন টাকা জমা দিয়ে টেনিদাকে খালাস করে আনলাম।

নিঃশব্দে চারজনে পথ দিয়ে চলেছি। কে যে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।

খানিক পরে আমি বললাম, খুব ফাঁড়া কেটে গেছে।

ক্যাবলা বললে, হ্যাঁ-জেল হয়ে যেতে পারত।

হাবুল ঢাকাই ভাষায় বললে, হ, দ্বীপান্তরও হইতে পারত। একটা ছাগলা যদি মইর্যা যাইতগা, তাইলে ফাঁসি হওনই বা আশ্চর্য আছিল কী।

এতক্ষণ পরে টেনিদা গাঁকগাঁক করে উঠল : চুপ কর, মেলা বাজে বকিসনি। ইঃ, ফাঁসি। ফাঁসি হওয়া মুখের কথা কিনা।

আবার নিস্তব্ধতা। টেনিদার পেছু-পেছু আমরা গড়ের মাঠের দিকে এগিয়ে চললাম। খানিক পরে আমিই আবার জিজ্ঞাসা করলাম, চানাচুর খাবে টেনিদা?

–নাঃ—টেনিদার মুখে-মুখে একটা গভীর বৈরাগ্য।

—আইসক্রিম কিনুম?—হাবুল সেনের প্রশ্ন।

–কিচ্ছু না।—টেনিদা একটা বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : মন খিঁচড়ে গেছে বুঝলি প্যালা। সংসারে কারও উপকার করতে নেই।

আমি বললাম, নিশ্চয় না!

—উপকারীকে বাঘে খায়।–ক্যাবলা বললে।

আমার মনের কথাটা বলে দিয়েছিস বলে টেনিদা ক্যাবলার পিঠ চাপড়ে দিলে ক্যাবলা উঃ উঃ করে উঠল।

হাবুল বললে, বিনা উপকারেই যখন পৃথিবী চলতে আছে, তখন উপকার করতে গিয়ে খামকা ঝামেলা বাড়াইয়া হইব কী?

—যা কইছস!–মনের আবেগে টেনিদা এবার হাবুলের ভাষাতেই হাবুলকে সমর্থন জানাল। তারপর গর্জন করে বললে, আমি আর-একখানা নতুন বর্ণ-পরিচয় লিখব। তার প্রথম পাঠ থাকবে : কখনও পরের উপকার করিও না।

ক্যাবলা বললে, সাধু, সাধু।

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, সাধু! খবরদার–সাধু-ফাধুর নাম আমার কাছে আর করবিনে। যদি ব্যাটাকে পাই বলে, প্রচণ্ড একটা ঘুষি হাঁকাল আকাশের দিকে।

ব্যাপারটা তা হলে খুলেই বলি গোড়া থেকে।

মানুষের অনেক রকম রোগ হয় : কালাজ্বর, পালাজ্বর, নিমোনিয়া, কলেরা, পেটফাঁপা—এমনকি ঝিনঝিনিয়া পর্যন্ত। সব রোগের ওষুধ আছে, কিন্তু একটি রোগের নেই। সে হল পরোপকার। যখন চাগায় তখন অন্য লোকের প্রাণান্ত করে ছাড়ে।

টেনিদাকে একদিন এই রোগে ধরল। ছিল বেশ, পরের মাথায় হাত বুলিয়ে খাচ্ছিল-দাচ্ছিল, বাঁশি বাজাচ্ছিল। হঠাৎ কী যে হল কালীঘাটের এক সাধুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল।

হাতে চিমটে, মাথায় জটা, লেংটি পরা এক বিরাটকায় সাধু। খানিকক্ষণ কটমট করে টেনিদার দিকে তাকিয়ে হেঁড়ে গলায় বললে, দে পাঁচসিকে পয়সা।

পাঁচসিকে পয়সা! টেনিদা বলতে যাচ্ছিল, ইয়ার্কি নাকি! কিন্তু সাধুর বিশাল চেহারা, বিরাট চিমটে আর জবাফুলের মতো চোখ দেখে ভেবড়ে গেল। তো-তো করে বললে, পাঁচসিকে তো নেই বাবা, আনাসাতেক হবে!

—আনা-সাতেক? আচ্ছা তাই দে, আর একটা বিড়ি।

–বিড়ি তো আমরা খাইনে বাবাঠাকুর।

—হুঁ, গুডবয় দেখছি। তা বেশ। বিড়ি-ফিড়ি কক্ষনো খাসনি—ওতে যক্ষ্মা হয়। যাক—পয়সাই দে।

পয়সা হাতে পেয়ে সাধুর হাঁড়ির মতো মুখখানা খুশিতে ভরে উঠল। ঝুলি থেকে একটা জবা ফুল বের করে টেনিদার মাথায় দিয়ে বললে, তুই এখানে কেন রে?

–আজ্ঞে প্যাঁড়া খেতে এসেছিলাম।

সাধু বললে, তা বলছি না। তুই যে মহাপুরুষ রে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে, পরোপকার করে তুই দেশজোড়া নাম করবি।

—পরোপকার।—টেনিদা একটা ঢোক গিলে বললে, দুনিয়ায় অনেক সকাজ করেছি। বাবা। মারামারি, পরের মাথায় হাত বুলিয়ে ভীমনাগের সন্দেশ খাওয়া, ইস্কুলের সেকেন্ড পণ্ডিতের টিকি কেটে নেওয়া কিন্তু কখনও তো পরোপকার করিনি!

–করিসনি মানে?—সাধু হেঁড়ে গলায় বললে, তুই ছোকরা তো বড্ড এঁড়ে তক্কো করিস। এই আমাকে নগদ সাত আনা পয়সা দিলি, খেয়াল নেই বুঝি? আমার কথা শোন। সংসার-টংসার ছেড়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে যা। দুনিয়ায় মানুষের অশেষ দুঃখু—সেই দুঃখু দূর করতে আদা-নুন খেয়ে লেগে পড়। আর্তের সেবা কর—দেখবি তিন দিনেই তোর নামে টি-টি পড়ে যাবে। দে-দে একটা বিড়ি দে—

–বললাম যে বাবাঠাকুর, আমি বিড়ি খাই না।

—ওহো, তাও তো বটে! বেশ, বেশ, বিড়ি কখনও খাসনি। আর শোন—পরের উপকারে নশ্বর জীবন বিলিয়ে দে। আজ থেকেই লেগে যা–বলে কান থেকে একটা আধপোড়া বিড়ি নামিয়ে, সেটা ধরিয়ে সাধু ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হল।

টেনিদা খানিকক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপরেই কালীঘাটের মা কালীর মহিমাতেই কি না কে জানে সাধুর কথাগুলো তার মাথার মধ্যে পাক খেতে লাগল। পরোপকার? সত্যিই তো, তার মতো কি আর জিনিস আছে! জীবন আর কদিনের? সবই তো মায়া—স্রেফ ছলনা। সুতরাং যেকদিন বাঁচা যায়—লোকের ভালো করেই কাটিয়ে দেওয়া যাক।

সেই রাত্রেই সংসার ছাড়ল টেনিদা। মানে কলকাতা ছাড়ল।

গেল দেশে। কলকাতা থেকেই মাইল-দশেক দূরে ক্যানিং লাইনে বাড়ি। গাঁয়ের নাম। ধোপাখোলা। দেশের বাড়িতে দূর-সম্পর্কের এক বুড়ি জ্যাঠাইমা থাকেন। কানে খাটো। টেনিদাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে, এমন অসময়ে দেশে এলি যে?

—পরোপকার করব জেঠিমা!

—পুরী খেতে এসেছিস? পুরী এখানে কোথায় বাবা? পোড়া দেশে কি আর ময়দাফয়দা কিছু আছে? ইংরেজ রাজত্বে আর বেঁচে সুখ নেই।

–ইংরেজ রাজত্ব কোথায় জেঠিমা? এখন তো আমরা স্বাধীন, মানে-টেনিদা বাংলা করে বুঝিয়ে দিলে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট।

–কোট-প্যান্ট?—জেঠিমা বললেন, ছি বাবা, আমি বিধবা মানুষ, কোট-প্যান্ট পরব কেন? থান পরি।

—দুত্তোর—এ যে মহা জ্বালা হল। আমি বলছিলাম, দেশে রোগবালাই কিছু আছে?

-মালাই। মালাই খাবি? দুধই পাওয়া যায় না। গো-মড়কে সব গোক উচ্ছন্ন হয়ে গেছে।

–উঃ কানে হাত দিয়ে টেনিদা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।

কিন্তু দিন-তিনেক গ্রামে ঘুরে টেনিদা বুঝতে পারল, সত্যিই পরোপকারের অখণ্ড সুযোগ আছে। গ্রাম জুড়ে দারুণ ম্যালেরিয়া। পেটভরা পিলে নিয়ে সারা গাঁয়ের লোক রাত-দিন বোঁ-বোঁ করছে। সেইদিনই কলকাতায় ফিরল টেনিদা। পাঁচ বোতল তেতো পাঁচন কিনে নিয়ে দেশে চলে গেল। কিন্তু দুনিয়াটা যে কী যাচ্ছেতাই জায়গা, সেটা টের পেতে তার দেরি হল না।

অসুখে ভুগে মরবে, তবু ওষুধ খাবে না।

একটা জামগাছের নীচে বসে ঝিমুচ্ছিল গজানন সাঁতরা। সন্দেহ কী—নির্ঘাত ম্যালেরিয়া। টেনিদা গজাননের দিকে এগিয়ে এল। তারপর গজানন ব্যাপারটা বুঝতে না বুঝতে এবং ট্য-ফোঁ করে উঠবার আগেই টেনিদা তার মুখে আধ বোতল জ্বরারি পাঁচন ঢেলে দিলে। যেমন বিচ্ছিরি, তেমনি তেতো! আসলে গজাননের জ্বর-ফর কিছু হয়নি—খেয়েছিল খানিকটা তাড়ি। যেমন পাঁচন মুখে পড়া—নেশা ছুটে গিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর সোজা মারমার শব্দে টেনিদাকে তাড়া করল।

কিন্তু ধরতে পারবে কেন? লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে টেনিদা ততক্ষণে পগার পার।

কী সাঙ্ঘাতিক লোক এই গজানন। পরোপকার বুঝল না, বুঝল না টেনিদার মধ্যে আজ মহাপুরুষ জেগে উঠেছে। তবু হাল ছাড়লে চলবে না। পরের ভালো করতে গেলে অমন কিছু-না-কিছু হয়ই। মনকে সান্ত্বনা দিয়ে টেনিদা স্বগতোক্তি করলে, এই দ্যাখো না বিদ্যাসাগর মশাই—

পরদিন বিকেলে সে গেল গ্রামের পাঁচুমামার বাড়িতে।

একটা ভাঙা ইজিচেয়ারে শুয়ে পাঁচুমামা উঃ-আঃ করছেন।

–কী হয়েছে মামা?–বগল থেকে পাঁচনের, বোতলটা বাগিয়ে দাঁড়াল টেনিদা।

—এই গেঁটে বাত বাবা! গাঁটে গাঁটে ব্যথা। করুণ স্বরে পাঁচুমামা জানাল।

–বাত? ওঃ—টেনিদা মুহূর্তের জন্যে কেমন দমে গেল। তারপরেই উৎসাহের চিহ্ন ফুটে উঠল তার চোখেমুখে।

–আর ম্যালেরিয়া? ম্যালেরিয়া কখনও হয়নি?

–হয়েছিল বইকি। গত বছর।

–হতেই হবে!—বিজ্ঞের মতো গম্ভীর গলায় টেনিদা বললে, ওই হল রোগের জড়। ওই ম্যালেরিয়া থেকেই সব। কিন্তু ভেব না তফাত সব ভালো করে দিচ্ছি।

—ভালো করে দিবি?—পাঁচুমামার মুখে-চোখে কৃতজ্ঞতা ফুটে বেরুল : তুই তা হলে ডাক্তার হয়ে এসেছিস? কই শুনিনি তো!

ডাক্তার কী বলছ মামাতার চেয়ে ঢের বড়। একেবারে মহাপুরুষ।

অগাধ বিস্ময়ে পাঁচুমামা হাঁ করলেন। টেনিদার দিকেই মুখ করে ছিলেন : কাজেই হাঁ করার সঙ্গে সঙ্গেই আর কথা নয়-জ্বরারি পাঁচন চলে গেল মামার গলার মধ্যে।

—ওয়াক-ওয়াক! ওরে বাবারে-ডাকাত রে—মেরে ফেললে রেওয়া-ওয়াক্‌-গেছি গেছি—পাঁচুমামা হাহাকার করে উঠলেন।

টেনিদা ততক্ষণে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে। শুনতে পেল, ভেতর থেকে মামা অশ্রাব্য ভাষায় তাকে গাল দিচ্ছেন। তা দিন-তাতে কিছু আসে যায় না। পরোপকার তো হয়েছে। এর দাম মামা বুঝবে যথাসময়ে। তৃপ্তির হাসি নিয়ে টেনিদা পথ চলল।

খানিক দূর আসতেই চোখে পড়ল একটা আমগাছতলায় একটি বছর-আটেকের ছেলে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে।

-এই, কী নাম তোর?

ছেলেটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললে, সাচ্চু।

–লাড্ডু! তা অমন করে কাঁদছিস কেন? চোখের জলে যে হালুয়া হয়ে যাবি-আর লাড্ড থাকবি না। কী হয়েছে তোর?

–বড়দা চাঁটি মেরেছে।

—কেন, তোকে তবলা ভেবেছিল বুঝি?

–না। লাচ্ছু বললে, আমি কাঁচা আম খেতে চেয়েছিলাম।

—এই কার্তিক মাসে কাঁচা আম খেতে চেয়েছিস! শুধু চাঁটি নয়, গাঁট্টা খাওয়ার মতো শখ।

টেনিদা চলে যাচ্ছিল, কী মনে হতেই ফিরে দাঁড়াল হঠাৎ।

—তোর টক খেতে খুব ভালো লাগে বুঝি? লাড়ু মাথা নাড়ল।

—হুঁ—নির্ঘাত ম্যালেরিয়ার লক্ষ্মণ! তোর জ্বর হয়?

-হয় বইকি।

—তবে আর কথা নেই—টেনিদা বোতল বের করে বললে, হাঁ কর—

লা আশান্বিত হয়ে বললে, আচার বুঝি?

—আচার বলে আচার। দুরাচার, কদাচার, সদাচারসক্কলের সেরা এই আচার। হাঁ কর-হাঁ কর ঝটপট—

লাড়ু হাঁ করল।

তার পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। বাপরে মা-রে বড়দা-রে বলে লাড্ড চেঁচিয়ে উঠল।

টেনিদা দ্রুত পা চালাল।

–বাপ—

পিঠের উপর একটা ঢিল পড়তেই চমকে উঠল টেনিদা। লাড়ু ঢিল চালাচ্ছে। অতএব যঃ পলায়তি এবং প্রাণপণে। লাড়ু বাচ্চা হলেও ঢিলে বেশ জোর আসছে, হাতের তাকও তার ফসকায় না।

কিন্তু আর চলে না। গ্রামের লোক খেপে উঠেছে তার ওপর। বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখলে হইহই করে ওঠে। রাস্তায় দেখলে তেড়ে আসে। তাকে দেখলে ছেলেপুলে পালাতে পথ পায় না।

জ্যাঠাইমা বললেন, তুই কী শুরু করেছিস বাবা? লোকে যে তোকে ঠ্যাঙাবার ফন্দি আঁটছে।

টেনিদা গম্ভীর হয়ে রইল। পরে বললে, পরের জন্যে আমি প্রাণ দেব জেঠিমা!

–কী বললি? ঘরের লোকের কান কেটে নিৰি? কী সর্বনাশ! ওগো, আমাদের টেনু কি পাগল হয়ে গেল গোমড়াকান্না জুড়লেন জ্যাঠাইমা।

উদাস ব্যথিত মনে পথে বেরিয়ে পড়ল টেনিদা। কী অকৃতজ্ঞ, নরাধম দেশ। এই দেশের উপকারের জন্যে সে মরিয়া হয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে, অথচ কেউ বুঝছে না তার কদর! ছিঃ ছিঃ। এইজন্যেই দেশ আজ পরাধীনথুড়ি স্বাধীন। কিন্তু কী করা যায়? কীভাবে মানুষগুলোর উপকার করা যায়?

টেনিদা শূন্য মনে একটা গাছতলায় এসে বসল। ভরা দুপুর। কার্তিক মাসের নরম রোদের সঙ্গে ঝিরঝিরে হাওয়া। আকুল হয়ে চিন্তা করতে করতে হঠাৎ চটকা ভেঙে গেল।

একটু দূরে একটা নিমগাছের নীচে একটা ছাগল ঝিমুচ্ছে। ঝিমুচ্ছে! ভারি খারাপ লক্ষণ। এখানকার জলে হাওয়ায় ম্যালেরিয়া। ছাগলকেও ধরেছে। ধরাই স্বাভাবিক। আহা—অবোলা জীব! উপকার করতে হয়, তো ওদেরই। কেউ কখনও ওদের দুঃখ বোঝে না। আহা!

তা ছাড়া সুবিধেও আছে। মানুষের মতো এরা অকৃতজ্ঞ নয়। উপকার করতে গেলে তেড়ে মারতেও আসবে না। ঠিক কথা—আজ থেকে সেই অসহায় প্রাণীগুলোর ভালো করাই তার ব্রত। ছিঃ ছিঃ! কেন এতদিন তার একথা মনে হয়নি।

পাঁচনের বোতল বাগিয়ে নিয়ে টেনিদা ছাগলের দিকে পা বাড়াল?

তারপর?

তারপরের গল্প তো আগেই বলে নিয়েছি।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *