পঞ্চায়েত

পঞ্চায়েত

শনিবার সন্ধ্যাবেলা পঞ্চায়েত বসল মাতাদীনের উঠোনে। ঘোর সন্ধ্যায়। উঠোনের একপাশে সজনে গাছের নরম গায়ে তেলচটের মশাল জ্বালিয়ে পুঁতে দিল একজন। তার অদূরে বাতাবিনেবুর তলায় পিসিডান অর্থাৎ সভাপতির খাটিয়া পাতা হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন গলায় ঝোলানো ঢোলকটা পিটিয়ে দিল দুম দুম দুম দুম্।

জায়গাটা চটকল শহরের পুবের রেললাইন ঘেঁষা খানিকটা গ্রাম্য নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। লোকগুলো সব চটকলের মজুর হলেও পশ্চিম প্রদেশের ছোটজাতের মানুষগুলোর রীতিই একরকম। এরা সকলেই চামার, কাহার, কৈরী, কামকার অছিরো জাত; পেছনে ফেলে আসা গ্রামকে তারা ভুলতে পারে না। তাই সাংঘাতিক দুর্ঘটনা কিছু না ঘটলে মহল্লা এলাকার অন্যায়ের প্রতিকারটা তারা নিজেরা বিচার করে পঞ্চায়েত বসিয়ে। এ বিচার অমান্য করলে, কোর্ট কাছারির ফ্যাসাদ না হোক, অমান্যকারীকে কেউ টিকতে দিবে না এখানে। জীবন তার দুর্বিষহ করে তুলবে।

ঢোল বেজে উঠল অর্থাৎ সময় হল সভা বসবার। দুচারটি টিমটিমে লম্ফও জ্বলে উঠল এ-দিকে ও-দিকে। দক্ষিণের তেপান্তরের জোনাকি পোকার মতো পিটপিটে আলো জ্বলছে ডোমবস্তির কুঁড়েগুলোতে। সেখানকার ছাড়া শুয়োরগুলো ছানার পাল নিয়ে খাদ্যন্বেষণে বেরিয়েছে। তেপান্তর পেরিয়ে যখনই শুয়োরগুলো এদিককার বাড়িতে নর্দমাখানার দিকে এগোচ্ছে তখনই এখানকার কুকুরগুলো ঘেউ-ঘেউ করে যাচ্ছে তেড়ে। শুয়োরগুলো ঘোঁত ঘোঁত করে পালিয়ে যাচ্ছে। পুবে রেললাইনটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে যে পাহাড়ের মতো পেপারমিলের সাদা নীল রাবিশের বিরাট স্তূপটা, সেখানে তখনও সন্ধ্যকালীন সভা বসবার নিশানা পেয়ে কেউ তাড়াতাড়ি কাজ গুছোবার চেষ্টা করতে লাগল।

বুড়ি ভুজাওয়ালি দোকান বন্ধ করে বাদাম আর ভুট্টার খইভাজার ধামা নিয়ে এসে পঞ্চায়েতের আসরে বসল। আজকের শনিবারের সন্ধ্যার বিকিকিনি তার এখানেই হবে। কিন্তু সে এসে যখন দেখল তার আগেই কোত্থেকে একটা ঘুগনিওয়ালা এসে জমিয়ে বসে আছে তখনই তার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। নামহীন উদ্দেশ্যে সে গালাগাল দিতে শুরু করল। খাবার বেচা না ছাই, আসলে বস্তিঘরের মেয়েমানুষ দেখবার মতলবেই এখানে আসা হয়েছে, তা কি জানি না।

ঘুগনিওয়ালা মিষ্টি হেসে ছড়া কেটে চলল ঘুগনির রসালো ফিরিস্তি দিয়ে—যে খাবে ঘুগনিদানা, সে পাবে সোনাদানা, হায় এমনি ঘুগনি এনেছি, বহুড়ি লেড়কি মরদ পাবে, বহুড়া মরদ জরু পাবে, হায়—খেয়ে দেখো, এমন মশলা দিয়েছি।

কিন্তু সে ছড়ার দিকে কারও কান নেই তখন। সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে খাটিয়ার এক পাশে ওই সজনের গায়ে পোঁতা মশালটার শিখার মতোই শুকালুর বিধবা বহুড়ি কুনতির উপর। আগুনের শিখাই বটে। মশালের আলোয় তার সারা দেহ আগুনের মতো জ্বলছে। শান্ত চোখের মণি দুটো শুন্যে স্থির নিবদ্ধ। দোলায়িত শিখার আলোকে কপালের টিপটা জ্বলছে দপদপ করে, ঠোঁট দুটো টেপা, বিদ্রূপের ভঙ্গিতে বাঁকা। উদ্ধত যৌবনের গরিমায় বলিষ্ঠ বুক মশালের আলো-আঁধারিতে যেন এক বিচিত্র উদ্দামতার রূপ নিয়েছে। কোলের ছেলেটা তার বারবারই বুকের কাপড়টা খুলে ফেলে শুন মুখে পুরে দেওয়া চেষ্টা করছে। না, অবুঝ স্তন্যপায়ী ছেলেটা মানুকানা। মায়ের বুক ঢাকার গোপন লজ্জা তো সে জানে না! কুনতির ছ বছরের আর চার বছরের মেয়েটাও দু-পাশ থেকে ঘিরে বসেছে মাকে। যেন পাহারা দিচ্ছে। বড় মেয়েটা অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট মেয়েটা সভায় ভিড় করা মেয়ে-পুরুষদের মুখগুলো গভীর সন্দেহে নিরীক্ষণ করছে তার ড্যাবা ড্যাবা চোখে। যেন এদের কাউকে বিশ্বাস নেই তার। প্রয়োজন হলে এরা বোধহয় তার মায়ের ফাঁসির হুকুমও দিতে পারে। কোলের ছেলেটা বুকের কাপড় টেনে টেনে হতাশ হয়ে হাঁ করে মশালটার দিকে তাকিয়ে রইল রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে।

শুকালুর এ বিধবা বহুড়ি কুনতির বিচারের জন্যই পঞ্চায়েতের আয়োজন।

বস্তির মেয়েরা যে যার কাজ গুছিয়ে তাড়াতাড়ি নিজেদের একটা জায়গা করে বসেছে। যারা কাজ এখনও মেটাতে পারেনি তারা কেউ স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়েছে, পেটাচ্ছে বাচ্চাদের। এ সভার উপরে যেন তাদের অনেক কিছু নির্ভর করছে। কিন্তু সব পঞ্চায়েতেই মেয়েরা এরকম ভিড় করে না। যে কুনতির নিশ্বাসে তারা বিষ ঝরতে দেখে, তার বিচারসভা যদি ফসকে যায় তবে বুঝি জিন্দিগির মধ্যে একটা বিরাট ফাঁকই থেকে যাবে।

রতনতাঁতির রোগা বউটা কিছুতেই বুকের নিশ্বাসটা আটকে রাখতে পারল না কুনতির দিকে তাকিয়ে। ইস্! কে বলবে ওই বাচ্চা তিনটের মা ওই মাগী। যেন সেদিনে গাওনা মিটিয়ে জোয়ান লেড়কি শ্বশুরঘর করতে এসেছে।

মেয়েদের সকলের চোখই প্রতিহিংসায় জ্বলজ্বল করছে। তাদের সমবেত চাউনি থেকে ভাবটা ফুটে উঠেছে এমন যেন তাদের এক দুর্জয় শত্রুকে এইমাত্র ধরাশায়ী করে তখনও ঘৃণায়, রাগে ক্লান্তিতে ফুঁসছে তারা।

মেয়েদের দলটার সামনেই যে বউটি নাকের পাটা ফুলিয়ে ঠোঁট টিপে স্থির শক্ত দৃষ্টিতে কুনতির দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে হল ধনিয়া। এ বস্তির মালিক মাতাদীনের দ্বিতীয়পক্ষের খাণ্ডার বউ। বলতে গেলে সে-ই এ পঞ্চায়েতটা ঘটাল, কুনতিকে সে কোনও দিনই সহ্য করতে পারে না। তাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ প্রায় দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল, খানিকটা সতীনের ঝগড়ার মতো, শেষ পর্যন্ত কালকে কুনতির সঙ্গে তার হাতাহাতি মারামারি হয়ে গেছে। কম করে নিজ এলাকার মেয়েপুরুষ নিয়ে দু তিনশো লোক সে মারামারি দেখেছে। তাকে মারামারি না বলে দুই বেড়ালীর কামড়াকামড়ি খামচা-খামচি বললেই ভাল হয়। কুনতির ঠোঁটের আর ভ্রূর উপরে যে ক্ষতের দাগ রয়েছে তা ওই ধনিয়ার কঙ্কনের ঝাপটাতেই হয়েছে। মহল্লার ঝি বহুড়িরা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে দজ্জাল ধনিয়ার পিটুনি খাইয়েছে কাল কুনতিকে। কেউ ছাড়ানো তো দূরের কথা, বরং সবাই হাততালি দিচ্ছিল আর মরদদের মধ্যে যারা ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল তাদের দু-হাতে টেনে ধরে রেখেছিল। মাতাদীন পর্যন্ত মুদিখানা ছেড়ে ছুটে এসেছিল। ধনিয়া তখন কুনতির চুলের মুঠি ধরে মাটিতে লুটোপুটি করছিল, আর কি শরম কি বাত! মাদীন এসে দেখল ধনিয়া লড়তে গিয়ে পা দুটো ঠেস মারার জায়গা না পেয়ে এমনভাবে শূন্যে পা ছুড়ছে যে পুরুষরা তো দুরের কথা ঝি বহুড়িরা লজ্জায় মুখ ফেরাবার চেষ্টা করছে। সে লজ্জায়, ভয়ে হায় রাম বলতে বলতে যেমনি ধনিয়ার গায়ে হাত দিয়েছে অমনি ধনিয়া তাকেই পা ঘুরিয়ে মেরেছে এক লাথি। আর শাসিয়ে দিয়েছে, বাড়িবালা হয়ে তুই বুড়ো রেন্ডি পুষবি বস্তিতে! তোর বাড়িবালার মুখে মারি ঝাড়।

মাতাদীনের আর চোদ্দোপুরুষেরও সাহস ছিল না ধনিয়ার গায়ে হাত দেয়। সে তার স্কুলে পড়া গোঁফের ফাঁকে হায় রাম করতে করতে বসে পড়েছিল। যেন তাইতেই দেবী তুষ্ট হয়ে রোখ ছাড়বে।

এ রকম কতক্ষণ চলত বলা যায় না যদি এ সময়টাতে হীরালাল না এসে পড়ত। সে এ বাড়ির বাসিন্দা ঠিক নয়, তবে এ মহল্লা এলাকায় তাকে সবাই খুব ভালভাবে চেনে। নানান জনে তার নানান নাম দিয়েছে। কেউ বলে ফেরেব্বাজ, কেউ বলে গুণ্ডা, কেউ বা খুব লিখাপড়া জানা জোয়ান, কেউ কেউ চোখ বড় বড় করে ফিসফিসিয়ে বলে, ও ছিয়াশি মানায়। অর্থাৎ বিপ্লবী মানুষ। সে যে কী তা অবশ্য নিশ্চয় করে বলা কঠিন। তবে সে হল চটকলের একজন স্পিনার, একলা বেঝামেলার মানুষ! শাদি বেহার ধার ঘেঁষেনি সে।

ব্যাপারটা এসে দেখেই তার সমস্ত মুখটা রাগে ঘৃণায় বেদনায় জ্বলে উঠল। পরমুহূর্তেই কঠিন বিপে হেসে সে চিৎকার করে উঠল, আরে বাবা, কেয়া মজাদার খেলা! বেশ বেশ! কুনতির ছেলেমেয়েরাও ধূলায় পড়ে ডাক ছেড়ে কান্না জুড়েছে। সেদিকে দেখে বলল, আরও জোরে চিল্লা, এদের কানের পরদা একটু মোটা কি না। ধনিয়া তখন কঙ্কনের ঝাপটা মারছে কুনতির ঠোঁটে পাশে। সেদিকে দেখে বলে উঠল, আরও জোরে, আরও জোরে চালাও বাড়িবালি ভউজি। ঠোঁট যদিও বা ফাটে, থুতনিটা ভাঙবে না ওতে।

হীরালালের উলটো গাওয়ার ফল ফলতে দেরি হয়নি। ধনিয়ার হাত আপনা থেকে শিথিলই শুধু হয়ে এল না—জোঁকের মুখে নুন দেওয়ার মতো এতক্ষণ যে লজ্জার মাথা একেবারেই খেয়ে বসেছিল তা যেন চকিতে তাকে অবশ করে দিল। সে তাড়াতাড়ি গা আর ঘোমটা ঢাকবার জন্য নিজের কাপড় নিয়ে টানাটানি শুরু করল।

কুনতি এ মারামারিতে প্রতিরোধের চেষ্টাই করেছে। সে-ও প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় নিজেকে ঢাকবার চেষ্টা করছে। ছেলেমেয়েগুলি মাকে মুক্ত পেয়ে তখন ধরেছে ছেঁকে।

কিন্তু হীরালালের বাক্যবাণ তখনও শেষ হয়নি। সমবেত মেয়েপুরুষদের দিকে তাকিয়ে সে বলল, একি, রাজা মহারানীর দল তোমরা থেমে গেলে কেন? ভউজিদের নিয়ে আর একবার মারো হাততালি, মাদারিখেল শুরু হয়ে যাক্।

বিদ্রূপটা স্পষ্ট না বুঝলেও সকলেই কেমন বিব্রত কাষ্ঠহাসিতে দাঁতগুলো বের করে রাখল শুধু। হীরালাল মঞ্চের অভিনেতার মতো দু-পা এগিয়ে এসে আবার বলল, সারাদিন বাদে সাহেব সদারের ঠোক্কর খেয়ে কারখানা থেকে ফিরে এসেছ, এখন একটু খেলা না জমলে দিলখুশ হবে কেন? কি বলো বৈজু ভাই? মুরগি লড়াই নয়, ষাঁড়ের লড়াই নয়, একেবারে অওরতে অওরতে। আরে বাপরে।

চলল সে হাসতে হাসতে কিন্তু তার চোখ দুটো যেন ধকধক করে জ্বলছে। জমাটি ভিড়টা তখন তাড়াতাড়ি ভেঙে যেতে বসেছে।

সময় বুঝে মাতাহীন উঠে দাঁড়াল। হ্যাঁ, এতক্ষণে তাকে বাড়িওয়ালা বলে চেনা যাচ্ছে। গোঁফটা দু-হাতে তুলে, সকলের দিকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে ঘোষণা করল, কাল এর বিচার হবে, পঞ্চায়েত বসবে। সকলে হাজির থাকবে। এসব আর চলবে না আমার বাড়িতে।

জরুর। হীরালাল পা ঠুকে বলল, এতদিন চলল কী করে সেটাই তাজ্জবের ব্যাপার। বলে সে এমনভাবে মুখটাকে বিকৃত করে তুলল যে, তাই দেখে মাদীন চলে যেতে যেতে অস্ফুট গলায় বলে উঠল, লুচ্চা কাঁহিকা।

ভিড়টা কেটে গেল প্রায়। কুনতি গায়ের ধুলো ঝেড়ে ওইখানে বসেই কোলের ছেলেটাকে স্তন পান করাচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা বার বার স্তন থেকে মুখ তুলে মায়ের ঠোঁটের রক্তাক্ত ক্ষতটা নিরীক্ষণ করছে আর শিশুমনের কৌতূহলেই বোধ হয় তার ছোট আঙুলের ডগায় ক্ষত থেকে রক্তের ফোঁটা নিয়ে নিজের ঠোঁটের পাশে ঘষে দিচ্ছে। মেয়ে দুটো গালে চোখের জলের শুকনো দাগ নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।

রাগে না ক্লান্তিতে বোঝা যায় না, কুনতির বুকটা তখনও ফুলে উঠছে। কাপড় ঢেকে ছেলেটাকে স্তন খাওয়াতে চাইলেও তার সুগঠিত বুক আনমনা অবহেলায় খানিক উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার ঠোঁটের পাশের নিয়ত রহস্যময় বঙ্কিম রেখাটি। তবু চোখে তার এক ফোঁটা জল নেই। এত ধুলো মাখামাখিতেও জ্বল জ্বল করছে পেতলের টিপটা তৃতীয় নয়নের মতো তার সুর মাঝখানে।

এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে হঠাৎ হীরালাল নিচু গলায় বলল, চোটটা বড় জোর লেগেছে। বলিস্ তো ডগদরবাবুর কাছ থেকে থোড়া দাওয়াই নিয়ে আসি? বলতে বলতে বিদ্রূপভাষী হীরালালের মুখাটা একেবারে অন্যরকম হয়ে উঠল।

কিন্তু কোনও জবাব দিল না কুনতি। শুধু মেয়ে দুটো অবাক হয়ে হীরাচাচার দিকে তাকিয়ে রইল সংশয় নিয়ে। জন্মের পর থেকে ওরা দেখেছে, যারা মায়ের সঙ্গে কথা বলে তারা সকলেই মতলববাজ।

পরমুহূর্তেই হীরালাল গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করল, বেশ, তুই-ই বল্ না কেন, তোর মতো কোনও বিধবা বহুড়ি কেবলি যদি পেটে বাচ্চা ধরে কার না গোসা হয়? মহল্লার মেহেরারুরা তোকে কোনদিন পিটিয়েই মেরে ফেলবে।

কুনতি এবার ফুঁসে উঠল, আপনা পেটে ধরি, কার বাবার কী?

বাঃ বেশ বলেছি। কার বাচ্চা ধরিস? হীরালাল হাসতে চেষ্টা করে।

কুনতি ছেলে নিয়ে উঠে বলল, যারই ধরি তোমার তো নয়।

আফসোস! এবার হেসে ফেলল হীরালাল।

হঠাৎ আগুনের মতো জ্বলে উঠে কুনতি বলল, আফসোস নয়, তোমার মতলব আমি খুব জানি। ভুলিয়ে ভালিয়ে ফোকাটিয়া কাম চাও তুমি। সে ওই বুড়ো ভাতারি ধনিয়ার কাছেই হবে। বলতে বলতে রুদ্ধ কান্নায় থথমিয়ে উঠল তার মুখ।

হীরালাল দরাজ গলায় হেসে উঠল এবার।

কুনতি আপনমনে বলে উঠল, পঞ্চায়েত হবে, বিচার হবে আমার! খানা বিনা যখন মরছিলাম কটা পঞ্চায়েত বসেছিল তখন? বেহায়া দুনিয়ার ফুটানির মুখে মার ঝাড়ু।

যেন ঝাড়ু দিতে দিতেই ঘরে চলে সে। কেবল হীরালালের উদগত হাসিটা বুকেতেই আটকা পড়ে গেল। আপন-মনে বিকৃতমুখে বিড়বিড় করতে লাগল সে, বেহায়া দুনিয়ার ফুটানি…

দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে যার বুকে জ্বালা ধরে গেল, সে হল ধনিয়া। নিজের জ্বালায় সামনের উনুনের উপর কড়াতে যে ভাজি পুড়ে ছাই হয়ে গেল তা সে খেয়াল করল না। কেবলি মনে হতে লাগল, হীরালালের মতো মানুষ ওই রেভিটার সঙ্গে কী কথা বলছে এতক্ষণ?

.

এতক্ষণে হঠাৎ কুনতি পঞ্চায়েতের আসরে চোখ তুলে ধরল। সত্যিই সেই দিলখোলা হাঁকডাক করা মানুষ হীরালালটা কোথায়? কুনতির বিচারে কি সে গরহাজির থাকবে?

সে মুখ তুলতেই নতুন বিয়ে করা বিলে হাসকুটে ছোঁড়া পুনিয়া দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এই যে বড় ভউজি আমি এখানে। কী বলবে বলো? যেন কুনতি তাকেই খুঁজছে।

কুনতি অপ্রতিভভাবেই মুখটা ফিরিয়ে নিল তার দিক থেকে। পুনিয়া অমনি দুহাত তুলে হাতাশার ভঙ্গি করে বলল, হায় রাম! আমাকে নয়? একটা হাসির রোল পড়ে গেল চারদিকে।

রাগে বিস্ময়ে অবাক মানল ঝি বহুড়িরা, পুনিয়ার ঠাট্টায় কুনতির ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দেখে। পুনিয়ার নতুন বউ পাকা পাকা মেয়েটা রূপোর নতুন নথটা নাড়িয়ে বলল, ওমা, মাগী কী বে-শরম! বলে সে চোখ পাকিয়ে তাকাল পুনিয়ার দিকে। পুনিয়া এক চোখ বুজে তার জবাব দিল।

মিসিমাখা মাড়ি বের করে বলল বুড়ি ছেদি, রেন্ডির আবার শরম। জোয়ানী উমরে আমাদেরও গোলমাল হয়েছিল। পঞ্চায়েত হয়েছিল, সাজা দিয়েছিল। তা আমরা কি ওই হারামজাদীর মতো বসেছিলাম? বুক অবধি ঘোমটা ছিল—হাঁ। না জানি কী কথাই বলল এমন বুড়ির ভাবখানা।

রতনের রোগা বউটা বলে উঠল, মহল্লার মরদদের রক্ত খাওয়া চেহারা যে। খুলে দেখাবে না?

এমন সময় পুরুষদের মধ্য থেকে একজন দু-হাত কানে লাগিয়ে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে গেয়ে উঠল,

এ যমুনাকে যানে বহলি, কহি তেরি গোর লাগি
উদাস তুহার নয়ন হমসে মিলাকে যা।

চারদিক থেকে একটা উল্লাসধ্বনি উঠল, হায় হায় হায়।…

আর একজন সরু গলায় সুর করে রাধার উক্তি করে উঠল,

চোট্টা কানাইয়া কালা বিল্লি বকে আওত…

হাসি আর খেউড়ের ঝড়ে সমস্ত পঞ্চায়েতের সভাটা উন্মত্ত হয়ে উঠল।

কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে এত গান হল্লা, সেই কুনতি নির্বিকার। মেঘের কোণে বিদ্যুৎ চমকানির মতো শুধু তার ঠোঁটের কোণের বঙ্কিম রেখাটি ও কপালের উজ্জ্বল টিপটি ঝিলিক দিয়ে উঠছে। কিন্তু তা যেন ঘুমন্ত অজানায় আচম্বিতে। ভিড়ের মাঝে চোখজোড়া তার খুঁজছে হীরালালকে।

মাতাদীন চিৎকার করে উঠল, চুপ, চুপ সব বেতমিজ কোথাকার। পঞ্চায়েতের কারবার এখুনি শুরু হবে। ঠাকুরজি আসছে।

ঠাকুরজি অর্থাৎ হড়কু ঠাকুরজি আসছে। নিজেদের গাঁ ঘরে পঞ্চায়েত হলে সরপঞ্চ অথবা রউয়া হুজুর মালিকেরাই সভার প্রধান হয়। না হলে নিজের জাতের মুখিয়ারা সভাপতিত্ব করে। এখানে এই বিদেশে চটকল শহরে সে সুযোগ নেই, তার উপায়ও নেই। কালোবাজারে যারা ধনে মানে বড় বা কারখানার হেডসর্দার, তেজারতি মহাজনী, কারবারি, তাদেরই এরা পিসিডান অর্থাৎ সভাপতি করে কাজ চালায়।

ঠাকুরজি একজন মস্ত ধার্মিক তো বটেই, সুদী কারবারি বলেও বিখ্যাত। এখানকার ফকির কুলি কামিনকে অভাবে ধারকর্জ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। সুদটা একটু বেশি। কিন্তু সে তো সে নেয় পরমেশ্বর রামজির সেবার জন্যে। আর ডোম বস্তির দক্ষিণে অন্ধগলিতে যে সুদীর্ঘ বেশ্যাবস্তিটা গড়ে উঠেছে তার কর্তাও সে। বলে, ঘরের ময়লা সাফ করে ফেলবার জন্য একটা আঁস্তাকুড় চাই তো। সে তোমার দেওতার রাজত্ব স্বর্গেও খানিক আঁস্তাকুড় আছে। দুনিয়ার নিয়ম এটা।

ইতিমধ্যে মাতাদীনের উঠোনটা একেবারে ভরে গেছে। ভিন মহল্লার যারা শুনেছে ঘটনাটা, তারাও এসেছে। কেননা কুনতি কম বেশি সব মহল্লাতেই পরিচিত। পঞ্চপাণ্ডবের মা শাশ্বত কুনতি সূর্যদেবতার অনুরাগে পুড়ে লুকিয়ে সেই অগ্নিগর্ভে নিজের যৌবন সমর্পণ করেছিল। লাভ করেছিল অবৈধ সন্তান। সবাই বলে এটা নাকি কলিযুগ। হীরালাল বলে, নোকরশাহীর যুগ। এ যুগের কুনতি নিজেই অগ্নি-ফুলিঙ্গের মতো মহল্লায় জোয়ান-মরদদের দিল পুড়িয়ে বেড়ায়। মহল্লাগুলো মাতাল হয়ে ওঠে, সেই আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য। তাই তার বিচারে এত ভিড়। কেউ রীতিমতো শুড়ি-তাড়িখানার আড্ডা ছেড়ে এসেছে চলে। তবে এই জমাটি সভায় পানীয়ের ভাঁড়টি নিয়ে এসেছে কেউ কেউ। তা ছাড়া গতকাল গেছে শুক্রবার। হপ্তার দিন, শনিবারের রাত্রে আকণ্ঠ পিপাসা না মেটালে সমস্ত সপ্তাহটাই যে ব্যর্থ।

লম্ফ আরও দু একটি এসেছে। ঘুগনিওয়ালার হাঁড়ি প্রায় শেষ। ভুজাওয়ালি একটানা বকবক করে গালাগাল দিয়েই চলেছে। কেননা এখনও তার কাছ ঘেঁষেনি কেউ। আর এই ঘুগনি খানেওয়ালারাই না ঘরে চাল আটা গিলে শেষ করে ধারে তার ভুট্টা আর ছাতু খেয়ে পড়ে থাকে! বেইমানের দল!

এক পাশে আর একটি পঞ্চায়েত বসেছে। তবে সেটা হল ছোট ছোট বালবাচ্চাদের। অনুকরণের কায়দা আছে। বড়দের সভায় এখনও সভাপতি আসেনি যখন, তখন তাদের সভায়ও ইটপাতা আসনটি খালি রয়েছে। সবচেয়ে দেখতে ভাল ভিখারির মেয়েকে তারা বানিয়েছে কুনতি, আবার তার থেকেও বড় দুটো মেয়েকে বানানো হয়েছে তার মেয়ে। মাতাদীনের আগের পক্ষের ধুমসসা পাঁচ বছরের ছেলেটাকে সাজানো কুনতির ছোট্ট কোলটিতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার ছেলে বলে। বেচারির জান যায় আর কী! কিন্তু অমান্য করবার উপায় নেই।…বড়দের মতো এরাও গান আর খিস্তি জুড়েছে। কেবল বৈজুর ছেলেটা সাজানো কুনতির কানের কাছে সবাইকে লুকিয়ে বার বার বলে যাচ্ছে, এ খেলাটা মিটে গেলে তোর সঙ্গে আমার শাদি হবে, অ্যাঁ?

কিন্তু সাজানো কুনতি নির্বাক! কারণ আসল কুনতিও নির্বাক যে!

হঠাৎ ভিড়ের মাঝখান থেকে হীরালাল চেঁচিয়ে উঠল, মার হাততালি, খেল এখনি শুরু হবে। ওস্তাদ আসছে।

একদল সত্যি সত্যি হাততালি মেরে উঠল। ওস্তাদ অর্থাৎ হড়কু ঠাকুরজি আসছে। মাদীন গোঁফের পাশ দিয়ে হিসিয়ে উঠল, লুচ্চা কাঁহিকা।

হীরালাল চকিতে একবার কুনতিকে দেখে নিল। কুনতিও তার দিকেই তাকিয়েছিল। সে অবাক মানল লোকটার এতক্ষণ ভিড়ের মাঝে চুপ করে বসে থাকা দেখে। কেন? এত দিল্লেগি, এত ফালতু বাত যে করে, কুনতির বিচারে বুঝি তার কোনও আগ্রহ নেই। তার আদমি শান্তশিষ্ট শুকালু ছিল জোয়ান হীরার মস্ত ভক্ত। প্রথম যেদিন সুদূর গ্রাম ছেড়ে ঘর ছেড়ে, শুকালু এই চটকল শহরে এল সেদিন থেকেই যেন সে ভেঙে পড়েছিল। সেই ভেঙে পড়ার দিনে হীরা ছিল তার একমাত্র অন্তরঙ্গ। নানা দেশ বিদেশের গল্প করত আর মাঝে মাঝে আগুনের মতো জ্বলে উঠত নিজেদের জীবনের কথা বলতে গিয়ে, আরে গোলামের জান আছে, আমাদের চটকলিয়াদের শালা তাও নেই। আমরা মেশিন, দোসরা আদমির মরজি আমাদের চালায়। কখনও কখনও শুকালুর শান্তিপনাকে সে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ করত, হাঁ, আশমানের দেওতার দিকে তাকিয়ে থাকো, সে একদিন আবার তোমাকে নিরালা গাঁয়ের ভিটায় তুলে দিয়ে আসবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই শুকালুর হাতটা চেপে ধরে বলত, দোস্ত, তুমি এরকম থেকো না, মরে যাবে। এ যে চটকলের বাজার। কিছু না পারো, দমভর দারু পিয়ো, মাতলামি করো, জরুকে পাকড়ে পেটাও, নইলে যত শোচবুঝ করবে, তত দেখবে, চটকল তোমাকে গিলতে আসছে। আর নইলে…নইলে ফিকির করো এ দুনিয়া পালটে ফেলবার। কিন্তু গিলেই ফেলল চটকল শুকালুকে। দু-সাল গেল না, ভঁইষের লেজ মোচড়ানো লাঙলধরা হাতে যেদিন এসে মেশিনে হাত দিল সেদিন থেকেই মৃত্যু তার হৃৎপিণ্ডে জেঁকে বসল। ওহহ, কী মড়ক যে এসেছিল দেশে! মানুষ মরল, ভঁইস মরল, জমিন শক্ত হাঁ করে পড়ে রইল বাপহারা বেটীর মতো। মহাজনের রাক্ষুসে হাত দরজায় দরজায় থাবা বাড়াল।…শস্যহীন ঝরাপাতায় হাওয়া উঠানের উপর দিয়ে কুনতিকে নিয়ে চলে এল সে! মোষবাঁধার শূন্য খোটাটা নীরব ব্যথায় স্তব্ধ হয়ে যেন তাদের বিদায় দিয়েছিল। কিন্তু মানুষটা বাঁচল না।..

নিশ্বাসে দুলে উঠল কুনতির বুক। সামনে থেকেই কে যেন জিভ দিয়ে তু-তু শব্দ করে উঠল সান্ত্বনা দিয়ে। রতন তাঁতির বউ হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, এখন কত পানি পড়বে চোখের। রাক্ষসের মতো পেটবাগানোর সময় মনে ছিল না? খিলখিল করে হেসে উঠল ধনিয়া। বুড়ি ছেদি মাড়ি বের করে বলল, চোখের পানিতে না সভাটাই ড়ুবে যায়।

ও! কুনতির চোখে বুঝি জল এসেছে! তাই সান্ত্বনার তু-তু শব্দ, বহুড়িদের এত কথা! তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে জল মুছল সে। ঘুমন্ত কোলের ছেলেটাকে মাটিতে শুইয়ে দিল।

বৈজুদের দলটা ততক্ষণে তাড়ির নেশায় চুর চুর। মত্ত বৈজু চেঁচিয়ে উঠল, বোলাও শালা লেবারবাবুকে, হাজির করো হাজিরাবাবুকে, বলুক সামনে এসে আমার কাছ থেকে দুটো টাকা ঘুষ খেয়েছে কি না। মাদীন খিঁচিয়ে উঠল, নিকাল দেও গিদ্ধর মাতালটাকে।

তাড়িমত্ত আর একজন চেঁচিয়ে উঠল, হাঁ নিকাল দেও মাতালটাকে।

হাসি আর শোরগোল পড়ে গেল একটা।

কিন্তু হীরালাল বৈজুর নাম ধরে একটা হাঁক দিতেই মাতালের দলটা সামলে উঠল খানিকটা। তারপর আর সবাইকে হাত জোড় করে বিয়ে হেসে বলল সে,মেহেরবাণী করে একটু শুনুন হুজুর হুজুরাইনরা, দিল কি বাত একটু বাদেই করবেন।

কুনতি তাকিয়েছিল হীরালালের দিকে। হ্যাঁ, এমনি দিলজ্বালানো দিল্লাগি করা স্বভাব লোকটার। হপ্তা আর ছুটির দিনে যখন ছোকরা মরদেরা সাফা জামা গায় দিয়ে মাথায় তেল চুরচুর করে বেরোয়, তখন হীরা তাকে সেলাম করে যেমন কারখানার সাহেবসর্দারকে করে আর বেশ্যাগলির পথটা দেখিয়ে বলে, হুজুর গরমি বিমারের দাওয়াইয়ের দামটা ফেরবার ফেরবার সময় হড়কু ঠাকুরজির কাছ থেকে উধার নিয়ে এসো। মেয়েরাও সেজেগুজে এদিক ওদিক দেখে চট করে বস্তি থেকে বেরিয়ে পড়ে। কেউ যায় জংলা ঘুমে। কারখানার বাঁধাধরার মধ্যে থেকেও জীবনের কোনও বাঁধাধরা নিয়ম যেন নেই এখানে। প্রতি মুহূর্তের নিরাশায় উচ্ছঙ্খল মহল্লাগুলোর কোনও কোনও জোয়ানী সব ভুলে অভিসারে বেরিয়ে পড়ে। হীরা তাদের বলে, শুনো হো, একটা গয়লার গলায়ও মহব্বতের দড়ি পরিয়ো, নইলে তোমার আনেবালা বাচ্চা দুধ বেগর পটল তুলবে।

তার কথায় কেউ হাসে, কেউ রাগে। কিন্তু সকলেরই মনটা শুধু দমে যায় না, কেমন যেন বিব্রত, অস্বস্তিতে বুকটা ভরে ওঠে। কিন্তু হাঁ, বড় তাজ্জবে অবাক হয় কুনতি। লোকটা নিজে কোনও আওরতের কাছে ধরা দেয় না। না, কুনতির কাছেও না, যার দিকে মহল্লার সব মরদেরা হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকে। অথচ কুনতি একসময়ে ভাবত..

আবার শুকালুর কথা মনে পড়ে গেল তার। লোকটা মরে গেল। কিন্তু এখানকার ভাষায় সে বিধবা হল না, হল বেওয়ারিশ আওরত। চটকলের পাটঘরে তার একটা সলতানি বদলি নোকরি মিলল। সলতানি অর্থে পার্মানেন্ট। বদলি মনে অন্য মেয়ে মজুর যখন ছুটিতে যায়, রোগে পড়ে, তখন সে পুরো মাইনে পায়। না হলে কোম্পানি থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে দু টাকা মাইনে দেবে।…জোয়ান উমরের আওরত, সন্তানহীনা, চলতে ফিরতে বলিষ্ঠ শরীরে তার যৌবন যেন উছলে পড়ত। শোকাচ্ছন্ন হীরা দূর থেকে তাকিয়ে থাকত। কী যেন সে বলতে চায়, কী যেন বোঝাতে চায় তার চোখের চাউনি। কিন্তু দ্বিধা সংকোচে এগুত না। কুনতি ভাবত, কী বলবে বলল জোয়ান, অমন করে চেয়ে কেন থাকো! হীরার ভাব দেখে সেই মুলুকের গাঁয়ের লু বয়ে যেন বুক পুড়ে যেত তার। এ সময়েই একজন তাকে বিয়ের নাম করে ঘরে নিয়ে তুলল। কিন্তু মতলব ছিল লোকটার। একদিন গভীর রাতে পাটকলের সর্দারকে ঘরে এনে ওর আলিঙ্গনে তুলে দিল কুনতিকে। বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, সলতানি বদলি নোকরিটা পেলি, তার নজরানা দিতে লাগবে না?…

সেই হল তার নতুন জীবনের শুরু। ধীরে ধীরে হীরার শোকের ছায়াটা কেটে গিয়ে স্বাভাবিক বিদ্রূপ হাসি ফুটে উঠল। বলত, জিতা রহো চটকলবাজার।কুনতিকে আর সে ভউজি বলত না। নাম ধরে মাঝে মাঝে বলত, তোর মতলব ভাল নয়। নইলে এত মরদ থাকতে কারও সঙ্গে তো তোর মহব্বত হয় না!

মহব্বতের কথা শুনলে কুনতির ঠোঁটের বঙ্কিম রেখাটি আরও বেঁকে ওঠে কঠিন বিদ্রূপে। মহব্বত!..পর পর কয়েক ঘর ঘুরেছে সে শুধু বিয়ের আশায়। কিন্তু বিয়ে কেউই করেনি। উপরন্তু পেটে এসেছে বাচ্চা, ঘর করার নামে মিলেছে শুধু মাতালের মার। তারপর নিজের ভার নিজেই নিয়েছে সে।

না, তবু কুনতি হীরালালের ধাতটা ঠিক বুঝতে পারে না। রোজই একবার কুনতির খবর জিজ্ঞেস করে সে আর বলে, এ পথ ছেড়ে দাও।

কোন পথ ধরবে কুনতি? অনাহার আর মৃত্যু? জিজ্ঞেস করলে খানিকক্ষণ থম করে বলে, নাঃ তোমার ভাল মতলব নেই। কিন্তু তার মতলবও কুনতি আবার বুঝতে পারে না। তবে কি…

হ্যাঁ, সেই ভেবে কোনও কোনও দিন বিলোল কটাক্ষে মোহিনী ভঙ্গিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সে হীরাকে। সুর মাঝে টিপ কাঁপিয়ে হেসেছে। কিন্তু হীরা বিকৃত মুখে দূরে সরে গেছে। রাগলে তাই কুনতি বলে, ফোকাটিয়া কাম চাও তুমি।

সভার মধ্যে হঠাৎ মাতাল মহাদেও চেঁচিয়ে উঠল বুক চাপড়ে, কসম খেয়ে বলছি ওর আদমি শুকালু আমার কাছ থেকে বারো আনা উধার নিয়েছিল। মাতাল বৈজু তাকে দুহাতে ধরে বলল, ওরে শালা, আদমি মরে গেলে উধার শেষ হয়ে যায়।

মহাদেও তবু চেঁচাতে লাগল, আমি বলছি উধার নিয়েছে।

হীরালাল উঠে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তবে কী হবে হুজুর? কুনতিকে আপনার চাই? মহাদেওয়ের ঘোলাটে চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠল আরও। সে চুপ করে গেল।

মাতাহীন চেঁচিয়ে উঠল, নিকাল দেও মাতালগুলোকে।

বৈজুও মাতাল গলায় হেঁকে উঠল, হাঁ, নিকাল দেও শালাদের।

ঘুগনিওয়ালা তার শেষ কণাটিও মাতালদের কাছে বিক্রি করে এবার পঞ্চায়েতের বয়ান শুনবার জন্য এগিয়ে এসে বসল। ভুজাওয়ালি আপনমনে শুধু বকে চলেছে, কাল থেকে কাউকে আর আমি উধার দেব না। ইমান থাকে তো ধার খানেওয়ালারা এখনি পয়সা মিটিয়ে যাও।

ধার খানেওয়ালারা বোধ হয় ইমানদার কেউই নয়। কারণ, কেউই তার কথার জবাব দিল না।

কেবল হীরা বলল ঠোঁট কুঁচকে, নানী, সব বেটা বেইমান।

মাতাদিন হাঁকল, চুপ চুপ।

সভাপতি হড়কু ঠাকুরজি বলল, সবই রামজির খুশিতে চলছে। এই যে আওরতটিকে তোমরা এত গালি বকছ, ওর এই দুভাগ্য তো রামজির কৃপা।

বুড়ো নাথনি ঘাড় দুলিয়ে বলল, ঠিক, ঠিক।

কিন্তু তার থেকেও কয়েক কাঠি বুড়ো মতিলাল বলে উঠল নাথনিকে, তোমার মাথা। ওই ছেদিকে যখন তুমি…।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েদের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেল। কারণ রামু হামাগুড়ি দিয়ে পেছন হটতে হটতে একেবারে হরিশের বহুড়ি শ্যামদেইর গায়ের উপর গিয়ে পড়েছে। কী ব্যাপার? কেউ লক্ষ করেনি, পঞ্চায়েত সভায় কখন রামুর পাওনাদার কাবুলিটা এসে দাঁড়িয়েছে। গতকাল হপ্তা পেয়ে সে কোনওরকমে কাবুলির চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছিল। আজ আর কেউ না দেখুক, রামুর নজরটা ওদিকে কড়াই ছিল। কিন্তু সুকোতে গিয়ে যে মাঠের মাঝে হাঁড়ি ভেঙে যাবে তা সে ভাবেনি।

ব্যাপার বুঝে কাবুলিটা একবার লজ্জিত সন্ত্রস্ত রামুর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। কাল সবেরে শালা তুমকো পাকড়ায়েগা।

কিন্তু রেহাই দিল না শ্যামদেই। সে গলা চড়িয়ে গালাগাল দিতে শুরু করল। ফলে রামুর বউ পাতিয়াও কোমর বেঁধে এল।

বুড়ি ছেদি গাড়ি বিকশিত করে বলল, হায় রাম। আমি ভাবি বুঝি আন্ধারে মহববতের কারবারই চলছে। তবে বলি শোন ওই বুড়ো নাথনির কথা। একবার..

পাতিয়া তখন শ্যামদেইকে ছেড়ে রামুকে ধরেছে। কুনতিকে দেখিয়ে বলল, আরে যা রে কামিনা আদমি রেন্ডি তোর বসে আছে।

তারপর সে কাঁদতে শুরু করল, ওই মাগী জরুর আমাদের হপ্তার টাকায় ভাগ বসায়, জরুর।

বহুড়িদের কয়েকজনও ওই কথা বলে চেঁচিয়ে উঠল।

মাতাদীন হামলে উঠল, চুপ, চুপ করো সব।

মাতাল বৈজুও হেঁকে উঠল, চুপ, চুপ করো সব।

হড়কু ঠাকুরজি আবার শুরু করল কুনতিকে দেখিয়ে, বেচারির তগদীর। তবে ওর মতো আওরতের এ বস্তিতে থাকা চলে না, কি বলো?

মেয়েরা বলে উঠল, জরুর।

কিন্তু ধনিয়ার চোখ জোড়া জ্বলে উঠল, ফুলে ফুলে উঠল বুক আর নাকের পাটা। তার জ্বালানো রোষের রোশনাই ঝিলিক দিয়েউঠল নাকের নাকছাবিতে। সে বলে উঠল, ওই মাগীকে কবুল খেতে হবে, ওর বাচ্চাগুলোর বাপ কে।

মেয়েরা কলরব করে উঠল ধনিয়ার কথার প্রতিধ্বনি করে।

প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল সভাটা। এমন কি হড়কু ঠাকুরজিও। মাতাদীনের গোঁফজোড়া যেন বসে গেল।

ইতিমধ্যে লম্ফ দু একটা নিভে গেছে। মশালের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল কুনতির কপালের টিপ। উদ্ধত বুক টান করে বসল সে, বুঝি দুলে উঠল নাগিনীর মতো। কেঁপে কেঁপে উঠল ঠোঁটের রহস্যরেখা। অঙ্গারের মতো জ্বলিত চোখ তুলে তাকালো সে সমবেত পুরুষদের দিকে।

তার মেয়ে দুটো অবাক আকুল অপলক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের আবার বাপ, তাদের আবার বাপ আছে নাকি?

পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ অন্ধকার ঘেঁসে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ সন্ত্রস্ত ভীত জানোয়ারের মতো মাথা নিচু করে রইল বসে। স্তব্ধ, নিঃসাড় সভা।

ঝি বহুড়িদের অপলক চোখগুলো প্রতিহিংসায় জ্বলজ্বল করছে।

হীরালাল চিৎকার করে উঠল, বাতলে দাও, দেখি কে বাপের ব্যাটা আছ, বাতলাও মরদেরা।

সারা মুখে কুনতির নির্মম হাসি। চোখ দুটো যেন ছুরির ফলার মতো চকচক করছে। পুরুষদের মুখের উপর দিয়ে চোখ তার যেন অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ আলোর মতো এগিয়ে চলল। কে? কে তার এ বাচ্চাদের বাপ? এই পুরুষদের মধ্যে কোন জন? কে, কে?

খুঁজতে খুঁজতে কুনতির চোখ পড়ল হীরার উপর। অবাক মানল সে হীরার মুখ দেখে, খুশিও হল। এত আগ্রহ হীরার এ জবাব শোনবার জন্য?

কিন্তু হায়, কুনতি কেমন করে বলবে এর মধ্যে কারা বা কে তার সন্তানের বাপ! একলা কার মুখে চুন কালি মাখাবে সেকার ঘর ভাঙবে?

প্রতিহিংসায় প্রজ্জ্বলিত বহুড়িদের দিকে তাকাল সে। দেখল অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালানো মানুষগুলোকে। বেলাশেষের শান্ত ঝিলের মতো ছায়া নেমে এল কুনতির চোখে। তার সন্তানের আছে শুধু মা, বাপ নেই। মা বাপ দুই-ই ওদের কুনতি। আকুল আগ্রহ ভরা নিজের মেয়ে দুটোর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন আচমকা বুক থেকে একটা তুফান উঠে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল তার। নিজের সন্তানদের উদ্দেশ্যেই যেন সে মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।

মেয়েরা আক্রোশে ফেটে পড়ল। বুড়ি ছেদি বলল, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, ও মাগী পঞ্চায়েতের রায় কিছুতেই মানবে না। নইলে সাফ জানিয়ে দিলে ও কবুল খাবে না?

মাতাদীন আর ঠাকুরজি কি বলতে চাইল। গোলমালে ড়ুবে গেল তাদের কণ্ঠস্বর। পুরুষদের মধ্যে থেকে একটা হাঁফ ছাড়ার নিশ্বাসের সঙ্গে নানা রকম গুনগুনানি শুরু হয়ে গেল।

হঠাৎ পুনিয়া গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে গেয়ে উঠল;

এনানী বঢ়ায়ি হম কেয়সে কহু তুঝে
হম আইহনকে ঘরওয়ালীকো দিল চৌপাট কৈলান কৌন সে ॥

পাতিয়া চেঁচিয়ে উঠল, হে ভগবান, হারামজাদির জান চৌপাট করো।

বুড়ো মতিলালের গম্ভীর গলা শোনা গেল, আজকালকার মরদুরা সব ডরপুক, বে-দিল নীচ।

ছোট বাচ্চাদের পঞ্চায়েত এতক্ষণ সুন্দর অনুকরণে বেশ ভালই চলছিল। কিন্তু সাজানো কুনতির কান্নায় ওদের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেল। মাতাদীনের ধুমসো ছেলেটা ওর ছোট্ট কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ আগেই সে উঠব উঠব করছিল। কিন্তু আর সহ্য করতে না পেরে বেচারি কাপড়েই পেচ্ছাব করে দিয়েছে। করে ফেলে তারপর কাঁদতে আরম্ভ করেছে।

বৈজুর ছেলেটা মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝে ওই অবস্থাতেই সাজানো কুনতির কাপড় ধরে চেঁচিয়ে উঠল, আমি কিন্তু ওকে শাদি করব, হাঁ।

ভুজাওয়ালির কাছে তখন কেউ কেউ ভিড় করতে আরম্ভ করেছে। আর ভুজাওয়ালি সবাইকেই বলছে, কেন ঘুগনি খাওগে যাও। কিন্তু কাউকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে না। বুড়ি ছেদী তবে বলি শোন বলে কেবলি চেষ্টা করছে তার যৌবনের গল্প জমাবার। মাতালদের দলটার মধ্যে একজন কুনতির নাম করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আর এক মাতালও তার কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠল। অন্য একটা দল পঞ্চায়েতের কোনও কথাতেই না থেকে কারখানার সাহেব সর্দারদের আলোচনায় উঠেছে জমে। মেয়েদের নানান দফে নানান আলোচনা। ঘর, কারখানা, পয়সা, ব্যয়ারাম, পুরুষ, ভালবাসা—কোনও কথাই বাদ নেই।

হীরালাল একবার এখানে বসছে, একবার ওখানে বসছে, কথা শুনছে সকলের।

প্রায় সব কটা লম্ফই নিছে এসেছে। দুএকটা মাত্র জ্বলছে আর মশালটাও খানিক কমজোর হয়ে গেছে। সেই ক্রমাগত অন্ধকার যেন চেপে বসছে ধনিয়ার সারা মুখে।

ডোম বস্তির ধাড়ি শুয়োরের ঘোঁত ঘোঁত শব্দ শোনা যাচ্ছে। বোধ হয় শেয়ালের আক্রমণের সম্ভাবনায় ছানাপোনাদের প্রতি সাবধানী সঙ্কেত। কুকুরুগুলো ঘোরাফেরা করছে পঞ্চায়েতের আশেপাশেই।

বহুদূর থেকে কার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে—হো-উই!

ঠাকুরজি বলল, তোমরা সব শুনেছ। কিন্তু আমার বড় দুঃখ হয় কুনতি বেটির জন্য।

হীরালাল মাতালদের দেখিয়ে ঠাকুরজিকে বলল, হুজুর, ওই দুঃখেই এরাও কেঁদে মরছে।

এ নাস্তিকটার বাক্যবাণ সহ্য হয় না ঠাকুরজির। মাতাদীন খালি বলল, লুচ্চা কাঁহিকা।

কুনতির মুখে দেখা দিয়েছে আবার সেই বিচিত্র হাসি। পঞ্চায়েতের আসল বয়ানে তার কান আছে কিনা বোঝা যায় না। সে যেন রামলীলার মজা দেখতে এসেছে।

ঠাকুরজি বলল আবার, রামজির কী লীলা। নইলে বলল, কুনতি বেটিরই কেন এ দুর্দশা হবে, আদমি মরে যাবে? তোমার আমার কোনও হাত নেই এতে। যা হবার তা হবেই। আমরা খালি অশান্তিটা দূর করে দেব। এ বস্তি ছেড়ে ওকে চলে যেতে হবে। বলে তাকাল কুনতির দিকে যেন তার মমতা, করুণা এ স্বৈরিণী মেয়েটার জন্য।

হীরালাল চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে হুজুর?

কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, জাহান্নামে।

আর একজন বলে উঠল, বোধ হয় ডোমবন্তির দক্ষিণে ঠাকুরজির জেনানা পট্টিতে। একটা হাসির রোল পড়ে গেল। অর্থাৎ ঠাকুরজির বেশ্যাপট্টিতে। গম্ভীর হয়ে উঠল ঠাকুরজির মুখ। বলল, কাল ধনিয়া বেটির সঙ্গে মারপিট করেছে ও, আর বিধবা হয়ে তিনটে বাচ্চা পয়দা করেছে, ও জাত থেকে আলাক হয়ে গেছে।

ঠাকুরজি ব্রাহ্মণ মানুষ। এরা তার দেশের সব চামার কাহারের জাত। দেশের গাঁয়ের পঞ্চায়েতে সে বহুবার সভাপতিত্ব করেছে। এখানেও করেছে। কিন্তু এখানে এ কালোবাজারে সেই মানুষগুলোর চরিত্রই শুধু বদলায় না। এখানে সমাজ ব্যবস্থা না থেকেও এক বিচিত্র বস্তি সমাজ আছে। সামাজিক বিচারের যে শাস্তি তার কোনও মূল্যই প্রায় নেই এখানে। এখানকার শাস্তি জরিমানা করেই বেশি হয়। মনে করে, বিদেশে কোনওরকমে নিয়ম রক্ষা করা। কিন্তু এতদিন পরে সকলের ইচ্ছায় অনিচ্ছায় কুনতির এই যে পরিণতি, এর রায় দেওয়ার পুর্বে ঠাকুরজিকে একটু ভেবে নিতে হয়। এ ছোট জাতের লোকগুলোকে শান্ত করতে হবে আবার নিজের মতলবও হাসিল করতে হবে।

সে বলল, কুনতি অন্যায় করেছে, আবার মারপিটও করেছে। সেই জন্য ওকে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিতে হবে আর একঘরে হতে হবে। কালকেই ওকে এখানকার ঘর ছেড়ে দিতে হবে। এর বেশি বেচারি আর কী পারবে বলে?

সারা মুখে হাসির ঢেউ খেলল কুনতির। সে সকলের দিকে তাকাল।

হীরালাল জিজ্ঞেস করল, টাকা কোথা থেকে দেবে?

না পারলে আমিই এখন উধার দেব। কী বলিস রে বেটি? স্নেহ ঝরে পড়ে ঠাকুরজির চোখ থেকে।

ঝি বহুড়িদের দমটা যেন নিভে গেছে। কেবল ছেদি আর কয়েকজন বলে উঠল, ঠিক হয়েছে।

হীরা জিজ্ঞেস করল আবার, উধার শুধবে কী করে হুজুর?

কে একজন বলে উঠল, সে ঠাকুরজি আদায় করে নেবে।

ঠাকুরজি আবার বলল, আর ওকে থাকার জায়গা আমিই না হয় দিয়ে দেব একটা।

মাতাব্দীন শুধু শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে বলে উঠল, বাহবা। বলে বাহাদুরের মতো তাকাল ধনিয়ার দিকে। কিন্তু ধনিয়ার মুখ অন্ধকার।

হীরালাল হঠাৎ তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল, শুনুন ভাইয়ারা, সকলেই তার দিকে তাকাল। উত্তেজনায় থমথমে মুখ হীরালালের। চোখ দুটো জ্বলে উঠল। হাত জোড় করে সবাইকে বলল, আর এবার থেকে আপনারা দয়া করে সকলেই ঠাকুরজির দেওয়া জায়গাতে তসরিফ রাখবেন। বলে সে হো-হো করে হেসে উঠল। বোধ হয় হাসির দমকেই ফুলে ফুলে উঠল কুনতির শরীরটা। হীরার হাসির শব্দেই মাটিতে শোয়া তার ঘুমন্ত ছেলে চমকে কেঁপে উঠল। 

কেবল মাতাল বৈজু হাত ঝটকা দিয়ে জড়ানো গলায় বলল, হাঁ, ঠাকুরজি, তোমাকে আমরা দিয়ে দিলাম আমাদের কুনতিকে।

কুনতি ঘুমন্ত ছেলেটাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এ পঞ্চায়েতকে সে না মানতেও পারত। এখানকার কোনও সংস্রব না রেখে সে পারত চলে যেতে। কিন্তু কোথায়? এখানকার এ মেয়ে মরদেরা তবু তাকে চেনে। শুকালুর বিধবা বহুড়ি, খুবসুরত বেওয়ারিশ আওরত সে। বস্তি থেকে তাকে চলে যেতে হবে ঠাকুরজির মেবস্তির দক্ষিণে বেশ্যা বস্তিতে। দেহ খাটানো রুজির জায়গা আর রূপ পরিবর্তন শুধু। তবু বুক তার হাহাকার করে উঠল। মাতাল বৈজুদেরই কুনতি ছিল যে সে! হ্যাঁ, এখানকার মেয়েমরদ সবাইকেই ভালবাসে সে। জীবনের সবচেয়ে পচা জায়গাটিতে থেকেও দুনিয়াকে সে সবচেয়ে বেশি জেনে নিয়েছে।

তবু সে হাসল সবার দিকে তাকিয়ে, মেয়েদের দিকে তাকিয়ে। এ শুধু চিত্ত-বিভ্রম ঘটানো হাসি নয়, বন্ধুদের কাছ থেকে বাসা বদলের বিদায়ের হাসি। যে হাসির ধারে ধারে অশুর বাষ্প জমে আছে।

তারপর অপরিসীম ঘৃণায় জ্বলন্ত হেসে ঠাকুরজিকে বলল, তোমার লাইনে তবে একটা ঘর বন্দোবস্ত করে রেখো।

বলবার দরকার ছিল না সে কথা। মশালটা কয়েকবার দপদপ করে নিভে গেল। রাত হয়েছে বেশ। আকাশে ক্ষীণ চাঁদ রয়েছে। কুনতি ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

ঝি বহুড়িদের দলটা স্তব্ধ, হতাশ। বুকের মধ্যে যেন দমটা ভারী হয়ে গেল আরও।

পঞ্চায়েত ভেঙে গেল। শিশু পঞ্চায়েতের সভাপতি তখন আসনের ইটের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মা এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল। ভুজাওয়ালি ঘোষণা করল, কালকে যেন সবাই তার দেনা মিটিয়ে দেয়।

বৃদ্ধ মতিলালের গম্ভীর গলা শোনা গেল, দুনিয়াতে মরদ নেই।

.

ঘরে ঢোকবার আগেই হীরা কুনতির দিকে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তা হলে

কুনতির তিনটি চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠল। তার কপালের টিপটিও তার চোখ। ঘাড় ঝাঁকিয়ে বঙ্কিম হেসে বলল, তা হলে ঠাকুরজির লাইনে। বলে খিলখিল করে কাচের শার্সি ভেঙে পড়ার মতো হেসে উঠল সে। হাসির দমকে দুলে উঠল সারা শরীর।

চুপ রহ। প্রায় ধমকে উঠল হীরালাল! কোঁচকানো ভ্রূর তলায় চোখ দুটো তার ঢেকে গেছে। প্রায়। মুখের শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। মনের প্রতিচ্ছবির মতো সেগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে।

অবাক কুনতির কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল। হীরালালকে অন্য মানুষ মনে হল তার। কী বলবে সে!

পঞ্চায়েতের শূন্য আসরে তাড়ির ভাঁড় আর ঘুগনির পাতাগুলো চাটছে বাড়ির কুকুরগুলো।

কুনতির কোল থেকে ছেলেটাকে হঠাৎ নিজের কোলে নিয়ে বলল হীরা, ঢের হয়েছে, এবার বেরুবি চল।

কোথায়?

ঘরে!

ঘরে?

নয় তো কি ঠাকুরজির লাইনে?

হঠাৎ যেন ফিক ব্যথায় কথা আটকে গেল কুনতির গলায়। বলল, তোমার ঘরে?

হীরা বিড়বিড় করতে করতে তখন পা বাড়িয়েছে, না বুঝ বেতমিজ আওরত, তবে কার ঘর?

ঝাপসা চোখে হোঁচট খেতে খেতে মেয়ে দুটোকে নিয়ে কুনতি পথে নামল, এগুলো হীরালালের পেছনে পেছনে। ভাঙাগলায় বার বার বলতে লাগল, বহুরূপী আদমি, কিছুতেই ওর ধাত বুঝি না আমি, কভি না। পুবে পাহাড়ের মতো পেপারমিলের সাদা নীল রাবিশের পটার অন্ধকার কোল থেকে হীরার গলা আবার শোনা গেল, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আয়।

দূর থেকে এ দৃশ্য দাঁতে দাঁত চেপে স্তব্ধ হয়ে দেখছিল ধনিয়া চালার ছায়া বারান্দার কোল ঘেঁষা অন্ধকারে। পিছন থেকে মাদীন তার পিঠে হাত দিয়ে সোহাগ করে ডাকল, ঘরে চলে এসো মেরি মন। আচমকা যেন ক্লেদাক্ত সরীসৃপের স্পর্শে ঘৃণায় চমকে করুন দিয়ে এক ঝাপটা কষিয়ে দিল ধনিয়া মাতাদীনের মুখে। ক্রুদ্ধ সাপিনীর মতো হিসিয়ে উঠল, হটু যা বুঢ়া মরদ। তার পর ঘরে ঢুকে মেঝেয় মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল। কেবল মাতাদীনের মোটা গলার সুর করে কান্নার চাপা শব্দ থেকে থেকে অন্ধকারকে হাসিয়ে তুলতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *