০২. নেতা ও অনুসারী

নেতা ও অনুসারী

দুই ধরনের প্রেরণা ক্ষমতা লাভের একটি নেতাদের ভেতর স্পষ্ট, অন্যটি অনুসারীদের ভেতর প্রচ্ছন্ন। নেতার নেতৃত্বাধীন দল কর্তৃক ক্ষমতা অর্জন করাই হচ্ছে কোনো নেতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুসরণ করার উদ্দেশ্য। কারণ তারা নেতার সাফল্যেই তাদের সাফল্য মনে করে। বিজয় লাভের লক্ষ্যে অধিকাংশ লোকই নেতৃত্বদানে নিজের যোগ্যতার ভরসা করতে পারে না। তাই তারা শ্রেষ্ঠত্ব। অর্জনের প্রয়োজনীয় সাহস ও বিচক্ষণতা আছে এমন এক ব্যক্তিকে তাদের দলের নেতা বানাতে চায়। এমনকি এই আবেগ ধর্মের বেলায়ও বিদ্যমান। নিয়েজেক খ্রিস্টবাদকে জোরপূর্বক দাসনীতির ধারণা জন্মাবার জন্য দোষারোপ করেছে। কিন্তু লক্ষ্য ছিল সবসময় সর্বশেষ বিজয়ের। মহিমান্বিত ব্যক্তিরাই ভদ্র কারণ তারাই পৃথিবী পাবে, অথবা

যুদ্ধে যাবে দেবতাপুত্র
 রাজমুকুট পাওয়ার আশায়
স্রোতের বানে তার রক্তাক্ত বেনার ভাসে
তার ট্রেনে যে যাবে।
 যুদ্ধের সরাব ভার যে পান করে
সবার উপরে বিজয়ী দেব।

এই-ই যদি দাসনীতি হয় তাহলে দাস হিসেবে বিবেচিত হবেন সমরাভিযানে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালনকারী সৈনিক ও নির্বাচনে কঠোর পরিশ্রমী রাজনীতিকদের সবাই। প্রকৃতপক্ষে খাঁটি সমবায় উদ্যোগের অনুসারীরা দাস নন, নেতা।

এজন্য মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে সংগঠনের আওতাভুক্ত ক্ষমতা অসম বন্টন মেনে নেবার। ক্ষমতার এই অসম বন্টন সমাজ প্রগতির সঙ্গে বাড়বে বই কমবে না। যতদূর জানা যায় মানব সমাজে ক্ষমতার এই অসমবন্টন সব সময়ই ছিল। এটি ঘটে থাকে আংশিকভাবে বাহ্যিক প্রয়োজনে এবং আংশিকভাবে তা মানুষের স্বভাবজাত কারণে। অধিকাংশ সমবায় উদ্যোগ সম্ভব হয়ে ওঠে একমাত্র প্রশাসনিক বোর্ডের পরিচালনার মাধ্যমে। যেমন কোনো বাড়ি তৈরি করতে হলে কাউকে না কাউকে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে; রেললাইনে রেলগাড়ি চালাতে হলে তার সময়সূচি ড্রাইভারের খামখেয়ালির উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না; নতুন রাস্তা তৈরি করতে হলে রাস্তাটি কোথায় যাবে তা কাউকে স্থির করতে হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হলেও সরকার সরকারই। সুতরাং যে ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্বের সম্পর্ক অনুপস্থিত সে ক্ষেত্রে সমবেত উদ্যোগ সার্থক করার জন্য কিছু সংখ্যক মানুষ এমন থাকবে যারা নেতৃত্ব দেবে এবং অন্য মানুষেরা নেতৃত্ব মেনে নেবে। কিন্তু আসল ঘটনা এই যে, প্রকৃত অসম ক্ষমতা কৌশলগত কারণে অনিবার্য মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এই সত্য ব্যাখ্যা করা যেতে পারে শুধু মনোবিদ্যা ও শরীরবিদ্যা সাপেক্ষে। কিছু মানুষের চরিত্র এমনই যে তারা নির্দেশ প্রদান করে এবং তা সর্বদা অন্য লোকেরা পালন করে। কোনো কোনো অবস্থায় এই দুই চরম অবস্থার মাঝামাঝি লোকজন আদেশ প্রদান করে, কিন্তু ভিন্ন অবস্থায় নেতার অনুগত হওয়াই পছন্দ করে।

Understanding Human Nature নামক বইয়ে এডলার দুই ধরনের মানুষের পার্থক্য দেখিয়েছেন–একটি শাসিত অন্যটি শাসক। তিনি বলেন, অন্যের দ্বারা আরোপিত নিয়ম শাসিত ব্যক্তি মেনে চলে এবং সব সময় একটা হীন অবস্থা খুঁজে বের করে নিজের জন্যে। অন্যদিকে শাসকশ্রেণি কি করে সবার থেকে শ্রেষ্ঠ হতে পারে তা ভাবতে থাকে। প্রয়োজনের সময় বিপ্লবের মাধ্যমে সবার উপরে উঠে আসেন এমন মানুষও দেখতে পাওয়া যায়। উভয় ধরনের লোকই তাদের চরম অবস্থায় অনভিপ্রেত বলে এডলার মনে করেন। শিক্ষার ফসল বলে তিনি তাদের অভিহিত করেন। তিনি বলেন, কর্তৃত্বপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা শিশুমনে ক্ষমতার একটি আদর্শিক ধারণার জন্ম দেয়, এটা একটা বড় অসুবিধা এবং এটি ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন এক আনন্দের দিকে ইঙ্গিত করে। আমরা আরও বলতে পারি, কর্তৃত্বপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করে দাস ও স্বেচ্ছাচারী মানুষ। কারণ তা তাদের এই অনুভূতির দিকে ধাবিত করে যে দুজন মানুষের মাঝে সহযোগিতার একমাত্র সম্পর্ক হচ্ছে এক ব্যক্তি আদেশ প্রদান করবে এবং অন্য ব্যক্তি তা মেনে চলবে।

সীমিত ক্ষমতা বিশ্বজনীন; কিন্তু বিরল চরম ক্ষমতালিপ্সা। গৃহ পরিচালনায় একজন মহিলা যে ক্ষমতা রাখেন তা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার তুলনায় কম বলেই মনে হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্র শাসন করতে যখন আব্রাহাম লিংকন ভীত নন তখন তিনি মোকাবেলা করতে পারেননি নিজ দেশে গৃহযুদ্ধের। নৌকায় পালানোর জন্য ব্রিটিশ অফিসারদের আদেশ নোপোলিয়ন হয়তো মাথা পেতে নিতেন বেলেরোফন জাহাজ ডুবির মতো দুর্ঘটনায় পতিত হলে। মানুষ যতক্ষণ তার যোগ্যতায় বিশ্বাস করে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সে ক্ষমতার আশা করে। কিন্তু যখন নিজের অযোগ্যতা সম্বন্ধে বুঝতে পারে তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় একজন নেতাকে অনুসরণ করার।

আদেশদানের প্রেরণার মতোই প্রকৃত ও সাধারণ আনুগত্যের প্রেরণা। ভয়ের ভেতর এর জন্ম। চরম অবাধ্য ছেলের দলও অগ্নিকাণ্ডের মতো ভীতিপ্রদ পরিস্থিতিতে পুরোপুরি বাধ্য হয়ে যায় যোগ্য বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির। প্যাস্কারসরা যুদ্ধের সময় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল লয়েড জর্জের সাথে। অধিকাংশ লোকই বিপদ দেখা দিলে নেতা খুঁজে বের করে এবং আত্মসমর্পণ করে তার কাছে। এ রকম সময়ে খুব কম লোকই স্বপ্ন দেখে বিপ্লবের। সরকারের প্রতি জনগণের এ ধরনের মনোভাব পরিলক্ষিত হয় যখন যুদ্ধ বাধে।

সব সময় এমন কথা সত্য নয় যে বিপদ মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে সংগঠনগুলো গঠিত হয়। কয়লা খনির মতো কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিপদাপন্ন হতে পারে সংগঠনগুলো। কিন্তু তা নিতান্তই আপতিত। এগুলো যদি দূর করা যেত তাহলে প্রভূত সমৃদ্ধি হতো সংগঠনগুলোর। সাধারণ বিপদ মোকাবেলা করা অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রধান উদ্দেশ্যের আওতাভুক্ত নয়। অথবা অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ে ব্যস্ত রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোরও নয়। কিন্তু বিপদ মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যেই জীবনতরী ও অগ্নিনির্বাপক বাহিনী তৈরি করা হয়। ধর্মীয় সংগঠনের বেলায়ও একটি বিশেষ লঘু অর্থে সত্য, যেগুলো আমাদের প্রকৃতির গভীর আংশিকভাবে বিদ্যমান প্রোথিত অধিবিদ্যাগত ভয়ের উপশমের উদ্দেশ্যে। এ ব্যাপারে যদি কারও সন্দেহের উদ্রেক হয় তাহলে নিচের স্তুতিবাক্য সম্পর্কে চিন্তা করতে পারেন :

আমার পরিচয় প্রাচীন শিলায়
আমি তারই মাঝে লুকিয়ে থাকি
জেস্যু আমার আত্মার আত্মীয়।
আমায় যেতে দাও তার বুকে
 পানি যখন গড়িয়ে যায়।
আর তীব্র হয় উতলা হাওয়া

এমন ধারণা আছে যে চূড়ান্ত ক্ষমতা নিহিত রয়েছে স্বর্গীয় ইচ্ছার কাছে। আত্মসমর্পণের মধ্যে। এর ফলে ধর্মীয় মর্যাদাবোধ হ্রাস পেয়েছে অনেক শাসকের মধ্যে। শুধু পার্থিব শক্তির কাছে এমন শাসকরা মাথানত করতে অপারগ। সর্বপ্রকার বশ্যতার মূলে রয়েছে ভয়, তা মানুষ অথবা স্বর্গীয় যে কোনো সত্তার কাছেই হোক না কেন।

এমন ধারণা আজকাল স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে আক্রমণের মূলেও রয়েছে ভীতি। এই তত্ত্বটি অনেক দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে এ কথা ভাবতে আমি বাধ্য। এটি বিশেষ ধরনের আক্রমণের বেলায় সত্য। উদাহরণস্বরূপ ধরা যেতে পারে D.H. Lawrence-এর আক্রমণ। কিন্তু আমার সন্দেহ হয় যে, যেসব মানুষ দস্যুপ্রধান হয়েছে তারা কি তাদের পিতার চরম ব্যবহারে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল অথবা Austerlitz-এ নেপোলিয়ান কি ভেবেছিলেন যে তিনি মেডাম মেয়ারের উপরও প্রতিশোধ নিচ্ছেন! আমি কিছুই জানি না এটিলার মা সম্পর্কে। তিনি তার প্রিতমের ক্ষতিসাধন করেছিলেন বলে আমার সন্দেহ হয়, পরবর্তী সময়ে দুনিয়া যার কাছে অস্বস্তিকর বলে মনে হতো। কারণ তা সময় সময় বাধা সৃষ্টি করত তার খেয়াল-খুশির উপর। আমি এটা মনে করি না যে বড় বড় নেতার মাঝে ভীতি থেকে এমন আক্রমণ প্রবণতা উৎসাহ যোগায়। আমার বলা উচিত বাহ্যিকভাবে নেতাদের ভেতর আত্মবিশ্বাস বিরাজ করে না, বরং তা তাদের অবচেতন মনের অনেক গভীরে অবস্থান করে।

বিভিন্নভাবে সৃষ্টি করা যেতে পারে নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস। ঐতিহাসিকভাবে এটি হচ্ছে হুকুমের উত্তরাধিকার অবস্থান। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখা যায় সংকটকালে রানী এলিজাবেথের ভাষণ। আপনি দেখবেন, রাজা ভদ্রমহিলাকে প্রভাবিত করে তার মাধ্যমে জাতীয় মনের প্রত্যয় সৃষ্টি করেছেন যে কি করতে হবে তা তিনি জানেন। অথচ তা জানার আশা করতে পারে না সাধারণ মানুষ। তার বেলায় সঙ্গতিপূর্ণ হলো জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌম ক্ষমতার স্বার্থ। এ জন্যই মহান রানী তিনি। ঘৃণার উদ্রেক না করেই তিনি করতে পারতেন পিতার গুণকীর্তন। নিঃসন্দেহে দায়িত্ব পালন ও ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর করে আদেশদানের অভ্যাসই। অধিকাংশ নির্বাচিত প্রধানের চেয়ে বংশগত গোষ্ঠীপতির অনুসরণ করে কোনো উপজাতির ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল অর্জন সম্ভব। অপরদিকে ব্যক্তির গুণাগুণের ভিত্তিতে মধ্যযুগীয় চার্চের মতো সংগঠনগুলোতে নেতা নির্বাচন করা হতো, যারা ভালো ফল লাভ করতেন বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে বংশগত রাজতন্ত্রের চেয়ে।

ইতিহাসে পরিচিত বৈপ্লবিক পরিবেশে আবির্ভূত হয়েছেন কোনো কোনো নেতা। আমরা এখন আলোচনা করব ক্রমওয়েল, নেপোলিয়ন এবং লেলিনের ওইসব গুণ সম্পর্কে যা তাদের সফলতা এনে দিয়েছে। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের স্বেচ্ছামূলক সেবাকর্ম গ্রহণ করেন, যারা স্বভাবগতভাবে অধীনতামূলক আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন না। অফুরন্ত সাহস ও আত্মবিশ্বাস ছিল তাদের। সংকটমুহূর্তে তাদের সহকর্মীরা এগুলো সহযোগে উত্তম ব্যক্ত করতেন অভিমত। এই তিনজনের ভেতর ক্রমওয়েল ও লেলিন ছিলেন এক ধরনের আর নেপোলিয়ন ছিলেন ভিন্ন ধরনের। প্রগাঢ় ধর্মবিশ্বাস ছিল ক্রমওয়েল এবং লেলিনের। অতিমানবীয় কার্য সম্পাদনের জন্য নিয়োজিত-এমন বিশ্বাস করতেন তারা। তাদের ক্ষমতালাভের তাড়না নিঃসন্দেহে ন্যায়ভিত্তিক বলে তারা মনে করতেন বিলাস ও আরামের মতো পুরস্কার লাভের জন্য তারা খুব কমই যত্নবান ছিলেন। কারণ তা সৃষ্টি সম্পর্কিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তারা মনে করতেন। তা আবার বিশেষভাবে সত্য লেলিনের বেলায়। জীবনের শেষের দিকে পাপে পতিত হওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন ক্রমওয়েল। তা সত্ত্বেও তারা উভয়ই তাদের অনুসারীদের মাঝে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন বিশ্বাস ও সামর্থ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে নেতৃত্বে বিশ্বাস সৃষ্টির বিষয়ে।

ক্রমওয়েল ও লেলিনের বিপরীতধর্মী ছিলেন নেপোলিয়ন। তিনি সৌভাগ্যবান সৈনিকের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন। তাকে যোগ্য হওয়ার সুযোগ এনে দেয় বিপ্লব। না হলে তিনি উদাসীন হতেন এর প্রতি। যদিও তিনি ফরাসি দেশপ্রেমের বাসনা চরিতার্থ করেন তারপরও ফ্রান্স ছিল তার কাছে বিপ্লবের মতো একটি সুযোগ মাত্র। যৌবনে তিনি কারসিকার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ধারণা পোষণ করেন। তার সফলতার পেছনে অসাধারণ চরিত্রবল ততটা ছিল না যতটা যুদ্ধের কলা-কৌশলগত দক্ষতার ভূমিকা ছিল। তিনি জয়যুক্ত হতেন যখন অন্যরা পরাজিত হতো। তিনি সফলতার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতেন ১৮ মেয়ার এবং সারেঙ্গার চূড়ান্ত সময়ে। তার কো-এডজুটেন্টদের সাফল্যগুলোর সংযোজনে তার দান তাকে সাহায্য করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ফরাসি সৈন্যদল। তাকে সফলতা এনে দেয় নেপোলিয়নের চাতুর্যই। অবশেষে ভাগ্যতারকায় বিশ্বাস তার পতন ঘটায়। এটি তার বিজয়ের ফল–কারণ নয়।

এ যুগে ক্রমওয়েল ও লেলিনের শ্রেণিভুক্ত হলো হিটলার আর মুসোলিনি নেপোলিয়নের ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকদের ধারণার চেয়েও বেশি গুরুত্ব রয়েছে সৌভাগ্যবান সৈনিক অথবা দস্যুপ্রধানদের। কখনও তিনি নেপোলিয়নের মতো কোনো জনগোষ্ঠীর নেতা হতে সমর্থ হন যার উদ্দেশ্য আংশিকভাবে নৈর্ব্যক্তিক। ফরাসি বিপ্লবের সৈনিকরা নিজেদের ইউরোপের উদ্ধারকর্তা বলে মনে করত। একইভাবে অনেকে তা-ই ভাবত ইতালি ও পশ্চিম জার্মানিতে। কিন্তু নিজের উন্নতি বিধানের জন্য প্রয়োজনের বেশি স্বাধীনতা অর্জন করেননি নেপোলিয়ন। প্রায়ই নৈর্ব্যক্তিক উদ্দেশ্যের ছলনার অস্তিত্ব থাকে না। প্রাচ্যকে আলেকজান্ডার হয়তো গ্রিসে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার এ ধরনের অভিযানে মেসিডোনীয়রা যে আগ্রহী ছিল যথেষ্ট সন্দেহ আছে তাতে। প্রজাতন্ত্রের শেষ একশো বছর রোমান জেনারেলরা প্রধানত অর্থের সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন এবং তাদের সৈনিকদের আস্থা অর্জন করেন জমি ও সম্পদ বিতরণের মাধ্যমে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতে সিসিল রোডস। বেশ ফলদায়ক হয়েছিল এই বিশ্বাস। মিটারল্যান্ড জয় করার জন্য তিনি যেসব সৈনিককে নিয়োজিত করেছিলেন তাদের নগ্নভাবে দেখানো হয় আর্থিক প্রলোভন। বিশ্বযুদ্ধগুলোতে প্রলোভনের ভূমিকা রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে।

প্রধানত ভীতির মাধ্যমেই সাধারণ শান্তিপ্রিয় নাগরিক নেতার অনুগত হয়। এ কথাটি শান্তিপূর্ণ কোনো পেশার সম্ভাবনা না থাকলে ডাকাতদলের বেলায় প্রযোজ্য নয়। নেতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি বিদ্রোহী লোকের মনে ভয় সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু নেতা না হলে এবং অধিকাংশ মানুষ কর্তৃত্ব স্বীকৃতি না পেলে তিনি ভয় সৃষ্টি করতে পারেন না। নেতৃত্ব অর্জন করতে তার কর্তৃত্বের উপযোগী আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন এবং তাকে গুণান্বিত হতে হবে ত্বরিত ও দক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো গুণে। নেতৃত্ব আপেক্ষিক : এন্তনিকে সিজার অধীনস্ত করতে পারতেন, কিন্তু তা অন্য কেউ পারত না। অধিকাংশ মানুষ মনে করে রাজনীতি খুব কঠিন এবং কোনো নেতাকে অনুসরণ করাই শ্রেয়। প্রবৃত্তিবশত তারা অবচেতন মনে তা অনুভব করে থাকে, যেভাবে কুকুর আচরণ করে তার প্রভুর প্রতি। তা না হলে খুব কমই সম্ভব হতো সংঘটিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ।

সুতরাং কাপুরুষতার দ্বারা সীমিত হয়ে পড়ে ক্ষমতাপ্রীতি। আবার আত্মনিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছাকেও সীমিত করে কাপুরুষতা। আকাঙ্ক্ষা পূরণে ক্ষমতা অধিকতর সহায়ক বিকল্প পন্থার চেয়ে। সুতরাং ক্ষমতার প্রত্যাশাই স্বাভাবিক যদি কাপুরুষতা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। এ ধরনের কাপুরুষতা দায়িত্ব পালনের অভ্যাসের দ্বারা কমানো যেতে পারে। সুতরাং ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা বাড়াতে দায়িত্ব সক্ষম। একজন মানুষকে নিষ্ঠুরতা ও বন্ধুত্বহীনতা যে কোনো দিকে চালাতে পারে। সহজেই যারা ভীত হয় তা তাদেরকে ইচ্ছা যোগায় দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার। সাহসী ব্যক্তিরা উৎসাহ পায় তাদের অবস্থান খুঁজে বের করার, ফলে দুঃখভোগ। করার চেয়ে তারা নিষ্ঠুরতা চালাতে পারে।

স্বৈরতন্ত্রের কথা আসে অরাজকতার পর। কারণ তা সহজ হয়ে পড়ে স্বাধীনতা ও কর্তৃত্বের প্রবৃত্তিগত বিষয়াবলির দ্বারা। তা উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা যায় পরিবার, রাষ্ট্র ও ব্যবসায়। স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে কঠিন উভয়মুখি সহযোগিতা। এর সঙ্গতি প্রবৃত্তির সঙ্গে অনেককম। পূর্ণ কর্তৃত্বের জন্য চেষ্টা সবার জন্য স্বাভাবিক হয়ে যায় উভয়মুখি সহযোগিতার জন্য চেষ্টা করলে। এর কারণ অধীনতামুলক তাড়না নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। একটা সাধারণ আনুগত্য মেনে চলা সংশ্লিষ্ট সব মানুষের জন্য প্রয়োজন। চীনে পরিবারভিত্তিক ব্যবসা সর্বদাই সাফল্য লাভ করে পরিবারের প্রতি কনফিউসীয় আনুগত্য থাকার জন্য। কিন্তু সেখানে নৈর্ব্যক্তিক যৌথ কারবার অচল প্রমাণিত। কারণ সেখানে একজন শেয়ার মালিক অন্য শেয়ার মালিককে সতোর জন্য বাধ্য করে না। সফলতার জন্য আইনের প্রতি একটি সাধারণ শ্রদ্ধাবোধ থাকতেই হবে যেখানে সরকার আলোচনা ও সতর্ক বিবেচনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। তা না হলে সেই শ্রদ্ধা থাকতে হবে জাতির প্রতি অথবা সব দলের নীতির প্রতি। সংশয়মূলক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বন্ধুসমাজে কোনো ভোট নেয়া হয় না বা সংখ্যাগরিষ্ঠের নীতি মেনে চলে না। তারা আলোচনা করে চলে পবিত্র আত্ম কর্তৃক প্রণোদিত হয়ে সভার মূল চেতনার কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত। তাদের বেলা সমশ্রেণিভুক্ত সমাজই ছিল আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু সরকার সততা ছাড়া আলোচনার মাধ্যমে অচল হয়ে পড়ে।

সরকার গঠনের উপযোগী ঐক্যবোধ ফুগায় ও রথশেল্ডস-এর মতো পরিবারে, কুয়েকারের মতো ছোট ধর্মীয় সংগঠনে, বর্বর সামজে, যুদ্ধকালীন বা যুদ্ধের আশংকায় জর্জরিত সমাজে আলোচনার মাধ্যমে বিনা দ্বিধায় সৃষ্টি করা যেতে পারে। এর ফলে অনিবার্য হয়ে পড়ে বাহ্যিক চাপ। পৃথক ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলার ভয়ে দলীয় সদস্যরা একসাথে থাকে। সমতা সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো একটা সাধারণ বিপদ। অবশ্য পুরো পৃথিবীর ক্ষমতা সংকট সমাধানের দিকনির্দেশনা নয়। যুদ্ধ সংহতি সৃষ্টি করে সত্য, ক্ষমতা সংকট সমাধানের দিক নির্দেশনা নয়। যুদ্ধ সংহতি সৃষ্টি করে সত্য, কিন্তু এর বিপদ দূর করতে চাই আমরা। সামাজিক সহযোগিতা নষ্ট করতে চাই না আমরা। এটি রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে একটি কঠিন সমস্যা এবং বিচার-বিবেচনা করলে দেখা যায় কোনো প্রাথমিক স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে কোনো জাতির এ ধরনের সমাধান সম্ভব। অভিজাততন্ত্রের মতোই কঠিন জাতিতে-জাতিতে মুক্ত সহযোগিতা ও বিভাগপূর্ব পুলিশ। এক্ষেত্রেও সাধারণ ত্রাণ অপেক্ষা ধ্বংস অগ্রগণ্য। সরকার মানবজাতির জন্য প্রয়োজন, কিন্তু অরাজকতাপূর্ণ সামজে প্রথমে স্বৈরতন্ত্রের কাছেই জনগণ বশ্যতা স্বীকার করে। তাই প্রথমেই চেষ্টা করা প্রয়োজন স্বৈরতন্ত্রের কাছেই জনগণ বশ্যতা স্বীকার করে। তাই প্রথমেই চেষ্টা করা প্রয়োজন স্বৈরাচারী সরকার গঠনে। শুধু সফল গণতন্ত্রের আশা করা যায় সরকার পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হলেই। পরম ক্ষমতা সংগঠন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন। সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্ট পরম ক্ষমতা সংগঠন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন। সামাজিক চাপ সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্ট সবার কল্যাণে ক্ষমতা ব্যবহারের দাবিতে। চার্চ ও রাজনীতির ইতিহাসে এই চাপ স্থির থাকলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর উপরিস্থিতি ইতিমধ্যেই ঘটেছে।

আমি এ পর্যন্ত শাসক ও শাসিতের সম্পর্কেই বললাম। কিন্তু তৃতীয় এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা এ দুয়ের কোনো পর্যায়েই পড়ে না। অধীনতাকে অগ্রাহ্য করার সাহস রাখে এমন কিছু মানুষও আছে। আবার তারা শাসন করবে এ রকম ঔদ্ধত্যও দেখায় না। এ ধরনের মানুষ নিজেকে সমাজ কাঠামোতে মানিয়ে নিতে পারে না। কমবেশি নির্জন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে এ রকম একটা আশ্রয় তারা যে কোনোভাবে খুঁজে বের করে। কখনও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে এই প্রকৃতির মানুষরা। গোড়ার দিকে এই একই জেনাসের দুই প্রজাতি ছিল খ্রিস্টান ও আমেরিকার প্রথম কর্মীরা। এই আশ্রয় কখনও মানসিক এবং কখনও তা বাস্তব। সন্ন্যাসীর আশ্রমের মতো কখনও কখনও তারা পূর্ণ নির্জনতা চায়। আবার কখনও সামাজিক নির্জনতা চায় মঠের মতো। মানসিক আশ্রয় প্রার্থীদের ভেতর রয়েছে অস্পষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ যাদের স্বার্থ নির্দোষ খামখেয়ালের অন্তর্ভুক্ত। যারা অর্জন করেছেন দুর্বোধ্য ও গুরুত্বহীন পাণ্ডিত্য। এরা তাদের অন্তর্ভুক্ত। পনেরো বছর ধরে শুধু ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে একত্রে বাস করছেন এমন বাস্তব আশ্রয় প্রার্থীদের ভেতর রয়েছেন সভ্যতার সীমারেখা সন্ধানকারী এবং আমাজন অববাহিকার বেটস অনুসন্ধানকারী প্রকৃতিবিজ্ঞানী। বিভিন্ন প্রকার বৈশিষ্ট্যের জন্য কিছু সন্ন্যাসী মেজাজ অপরিহার্য উপাদান। এটি মানুষকে ঈর্ষাপরায়ণতার পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে যেতে, জনপ্রিয়তার লোভ সংবরণে এবং সাধারণ উদারতা ও নির্ভুল সিন্ধান্তে উপনীত হতে সামর্থ্য যোগায়।

অকৃত্রিমভাবে উদাসীন নয় তৃতীয় দলের কেউ কেউ। স্বাভাবিকভাবে তারা তা অর্জন করতে অসমর্থ। হতে পারে এসব মানুষ দরবেশ বা বিরুদ্ধ মতাবলম্বী। শিল্প অথবা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সন্ন্যাসী জীবনধারা নব্য পন্থার প্রবর্তন করতে পারে। এরা তাদের শিষ্যত্ব অর্জন করে যারা অধীনতাপ্রীতির সঙ্গে বিদ্রোহাত্মক আবেগের সমন্বয় সাধন করে। গোঁড়ামির বিরোধিতা করেন শেষোক্ত ব্যক্তিরা। কিন্তু কোনোরকম বাছবিচার না করেই প্রথমোক্ত ব্যক্তিরা নতুন মতবাদ গ্রহণ করে। এর উদাহরণ টলস্টয় ও তার অনুসারীরা। অকৃত্রিম নির্জনতা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সবিষাদ জেস এর পূর্ণাঙ্গ উদাহরণ। তিনি নির্বাসন কাটিয়েছেন ভালো সর্দারদের সঙ্গে এবং কোর্টে ফেরার পরিবর্তে খারাপ সর্দারদের সঙ্গে জঙ্গলে কাটিয়েছেন। সভ্যতার ছোঁয়া পেতেই আমেরিকার প্রথম দিকের অনেক কর্মী কষ্ট ও বঞ্চনা ভোগ করে খামার বিক্রি করে আরও পশ্চিমে সরে পড়েন। এ ধরনের মানুষেরা পৃথিবীতে খুব কমই সুযোগ পেয়ে থাকে। এরা ধাবিত হয় কিছুটা অপরাধের দিকে, কিছুটা বিষণ্ণতার দিকে এবং কিছুটা অসামাজিক দর্শনের দিকে। তাদের মনোভাব গড়ে ওঠে সঙ্গীদের সঙ্গে বেশি মেলামেশার ফলে মনুষ্যদ্বেষিতায়। আর তাই যখন নির্জনতা লাভ করা যায় না তখন তা হিংস্রতায় মোড় নেয়।

কাপুরুষদের সংগঠন গড়ে ওঠে শুধু নেতার প্রতি বশ্যতা স্বীকারের মধ্য দিয়েই নয়, বরং তা গড়ে ওঠে সমমনা মানুষের ভেতর নিশ্চিত ঐক্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে। আনন্দানুভূতি বিদ্যমান সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত উদ্যমপূর্ণ জনসভায় উৎসাহ ও নিরাপত্তার সমন্বয়ে। অহংবোধ বৃদ্ধি পেলে বিজয়ানুভূতি ছাড়া অন্য সবই সাধারণ আবেগের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে দূরীভূত হয়। আনন্দদায়ক কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন সমবেত উত্তেজনা। এর ফলে সহজেই স্বাভাবিকতা, মানবতা ও আত্মরক্ষা বিঘ্নিত হয়। অবশ্য সমভাবে সম্ভব সহিংসতা ও শহীদের বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু। এর ছোঁয়া একবার পেলে অন্যান্য উন্মত্ততার মতো তা প্রতিহত করা কঠিন। কিন্তু এটি পরিশেষে অনীহা ও ক্লান্তি এনে দেয় এবং উত্তরোত্তর আগ্রহের জন্ম দেয় প্রথমোক্ত আগ্রহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।

কোনো নেতা অপরিহার্য নয় এই তাড়না সৃষ্টির জন্যে। কারণ তা সৃষ্টি করা যেতে পারে সঙ্গীত এবং উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে বক্তার কথা। সুতরাং নেতৃত্বের জন্য সংঘবদ্ধ আনন্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নেতার অংশগ্রহণের প্রয়োজন নেই নিজের জাগানো অনুভূতিতে। তিনি শেক্সপিয়রের এন্তনিয়র মতোই বলতে পারেন :

Now let it work : mischief there art afoot,
Take thou what course thou will!

নেতার প্রভাব না থাকলে অনুসারীদের উপর তার সফলতার সম্ভাবনা কম। এ কারণে তিনি গুরুত্ব দেবেন এমন পরিস্থিতির যা তার সাফল্য সহজ করে দেয়। যে পরিস্থিতির মোকাবেলায় নিজেকে সাহসী মনে করা মারাত্মক বিপদ তা-ই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু ভীতি সৃষ্টির মতো এত ভয়ানক নয়। দুর্দমনীয় হচ্ছে এমন পরিস্থিতি, কিন্তু অজেয় নয়। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধংদেহী মনোভাব জাগাতে একজন দক্ষ বক্তা চান শ্রোতাদের ভেতর দুই স্তরের বিশ্বাস সৃষ্টি করতে। এর একটি হলো অগভীর স্তর, এতে বড় করে দেখানো হয় শত্রু পক্ষের ক্ষমতা এবং ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করা হয় যে এর মোকাবেলায় অধিক সাহস সঞ্চয় করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যটি হলো গভীর স্তর, যেখানে বিরাজ করে বিজয়ের দৃঢ় বিশ্বাস। অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে শক্তির উপর-এ ধরনের স্লোগানে উভয়টি বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।

বক্তার প্রত্যাশা হলো চিন্তাশীল জনগণ অপেক্ষা আবেগপ্রবণ আন্দোলনকারীর জনতা। ভয় ও ঘৃণায় পূর্ণ থাকবে তাদের মন। তাদের ধৈর্য থাকবে না ধীর ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যদি বক্তা সম্পূর্ণ নিন্দুক না হন তাহলে তিনি কিছু বিশ্বাস অর্জন করবেন, যা প্রমাণ করবে তার কার্যকলাপের বৈধতা। তিনি যুক্তির চেয়ে অনুভূতিকেই ভালো পথপ্রদর্শক ভাববেন। মতামত গঠনে রক্ত মস্তিষ্ক অপেক্ষা অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত উপাদানই হলো জীবনের সবচেয়ে ভালো উপাদান। তার হাতে শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকলে তিনি শিক্ষাকে অনুশীলন ও যৌথ আন্দোলনের পর্যায়বৃত্ত গতির ভেতর সীমাবদ্ধ রাখবেন এবং একই সঙ্গে তিনি জ্ঞান ও বিচার ক্ষমতা ত্যাগ করে যাবেন অতিমানবিক বিজ্ঞানের নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের কাছে।

ক্ষমতালোভী ব্যক্তিরা সবাই বক্তা নন। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের তারা। ক্ষমতা প্রীতির দাবি মিটানো হয়েছে কার্য সম্পাদনের ব্যবস্থাপনার উপর নিয়ন্ত্রণ দ্বারাই। উদাহরণস্বরূপ বিবরণ দেয়া যায় আবিসিনিয়ার আকাশযুদ্ধে মুসোলিনির কর্তৃত্বের:

জঙ্গলে আগুন দিতে হয়েছিল আমাদের। ছোট ছোট গ্রাম এবং মাঠেও। মাটি ছোঁয়ার আগেই বোমাগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছিল সাদা গ্যাস নির্গত করে এবং এগুলোর লেলিহান শিখা দেখাচ্ছিল। তখন জ্বলতে আরম্ভ করে শুকনো ঘাস। আমি ভাবছিলাম পশুগুলোর কথা : খোদা কিভাবে দৌড়াচ্ছিল ওরা! আমি হাতদিয়ে এগুলো ফেলছিলাম বোমা রাখার তাক শূন্য হওয়ার পর। লম্বা বৃক্ষ বেষ্টিত জারিরাতে আঘাত করা সহজ ছিল না, এটাই ছিল সবচেয়ে মজাদার ব্যাপার। আমাকে খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়েছিল খড়ের চালে। আমি সফল হয়েছিলাম তৃতীয়বারের চেষ্টায়। হতভাগ্যরা ভেতরেই ছিল। ওরা যখন দেখল তাদের ঘরের ছাদ জ্বলে যাচ্ছে তখন তারা লাফিয়ে বের হয়ে দৌড়াতে লাগল পাগলের মতো।

প্রায় পাঁচ হাজার আবিসিনীয় বৃত্তাকার আগুনে আটকা পড়ে অনভিপ্রেত পরিণতির শিকার হলো। এটা নরকসদৃশ।

বক্তা যখন সজ্ঞাত মনস্তত্ত্বের প্রয়োজন বোধ করেন তার সফলতার জন্যে, ব্রুনো মুসোলিনির মতো বিমানচালক আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করা বেদনাদায়ক এমন মনস্তত্ত্বেই আনন্দ পান। বক্তা হলেন প্রাচীন ধরনের; সংগঠনের ব্যবস্থার উপর যার ক্ষমতা নির্ভরশীল তিনি আধুনিক। এ উদাহরণ আংশিকভাবে হলেও দেয়া যেতে পারে যে, যুদ্ধ শেষে প্রথম কার্তেজ বিদ্রোহপ্রবণ ভাড়াটে সৈন্যদের হত্যা করার জন্য কিভাবে ব্যবহার করেছিলেন হাতি। এক্ষেত্রে মনস্তত্ত্ব ব্রুনো মুসোলিনির মনস্তত্ত্বের মতোই। কিন্তু তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে আমাদের যুগেই যান্ত্রিক ক্ষমতা অন্য যুগের চেয়ে অধিক বৈশিষ্ট্য বহন করে।

এ পর্যন্ত কোথাও পূর্ণতা লাভ করেনি যান্ত্রিক ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল অলিগার্কি মনস্তত্ত্ব। যা হোক এর আসন্ন সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা গুণগত দিক দিয়ে না হলেও পরিমাণগত দিক দিয়ে একেবারে নতুন। কৌশলগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অলিগার্কির পক্ষে সম্ভব প্রজাগণের সমর্থন লাভ না করেই এরোপ্লেন, পাওয়ার স্টেশন, মোটরযান ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। লুপুতা সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো এর কেন্দ্র ও বিদ্রোহাত্মক প্রদেশের ভেতর মধ্যস্ততা করার সামর্থ্য দ্বারা। একই জাতীয় কঠিন কিছু করা ঐক্যবদ্ধ বৈজ্ঞানিক কুশলীদের পক্ষে সম্ভব। তারা অনশনে রাখতে পারত অবাধ্য এলাকার জনগণকে এবং বঞ্চিত রাখতে পারত লাইট, তাপ ও বিদ্যুৎ শক্তির মতো আরামপ্রদ উপকরণে ব্যবহারের নির্ভরতায় উৎসাহদানের পর। তারা ভাসিয়ে দিতে পারত বিষাক্ত গ্যাস ও বেকটেরিয়ার বন্যায়। বিরোধিতা হলো চূড়ান্ত নিরাশাব্যঞ্জক। যন্ত্রের গঠন কৌশলের উপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিরা মানুষকে অনুভূতিহীন এবং কিছু নিয়মকানুনের অধীন বলে গণ্য করে। ব্যবহারকারী এসব নিয়ম-কানুন নিজ সুবিধামত কাজে লাগাতে পারেন। অন্য যে কোনো সময়ের সরকার ব্যবস্থাপনার চেয়ে এমন সরকারের নিষ্ঠুরতা বেশি।

আমার উদ্দেশ্য বস্তুর উপর নয়, মানুষের উপর ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করা। কিন্তু মানুষের উপর কৌশলগত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বস্তুর উপর ক্ষমতার ভিত্তিতে। যাদের অভ্যাস আছে শক্তিশালী গঠন কৌশলের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার এবং এই নিয়ন্ত্রণ দ্বারা যারা মানুষের উপর ক্ষমতা অর্জন করেছেন, তারা তাদের প্রজা সম্পর্কে গঠন করতে পারেন একটি কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গি। ওইসব মানুষ থেকে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, কারণ তারা যুক্তি-পরামর্শের উপর নির্ভরশীল। আমাদের অনেকেই গোলমাল বাধিয়ে দেখেছেন কেমন হৈচৈ শুরু হয়ে যায় খামখেয়ালি পিপীলিকার বাসায়। নিউইয়র্কের আকাশচুম্বী দালানের উপর থেকে নিচে তাকালে দেখা যায়-মানুষগুলো মানুষ নয় যেন কিম্ভুতকিমাকার। কেউ বজ্র ও অশনিসহ সশস্ত্র হলে জড-এর মতো একে সজোরে জনতার উপর ফেলার প্রবণতা জাগত। এক্ষেত্রে তাড়নাটি পিপীলিকার বাসায় ঘটিত তাড়নার মতো। বিমান থেকে আবিসিনীয়দের দেখে মুসোলিনির যে অনুভূতি জেগেছিল স্পষ্টতই এটা তার অনুরূপ। কল্পনা করা যাক একটি বৈজ্ঞানিক সরকার যে হত্যার ভয়ে থাকে এরোপ্লেনে এবং মাঝে মধ্যে নামে উঁচু টাওয়ারের চূড়ায় বা সমুদ্রে ভাসমান বেপটের উপর। এ ধরনের সরকারের পক্ষে কি সম্ভব জনকল্যাণমূলক যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করা? অপরপক্ষে এটি বাস্তব সত্য নয় কি যে তা তাদেরকে মেশিনের মতোই মনে করবে অনুভূতিহীন? কিন্তু যখন কোনো ঘটনা দ্বারা বুঝতে পারে যে এরা মেশিন নয় তখন উদয় হয় তার চৈতন্য এবং ধ্বংস করে দেয় এর সব রকম বাধা।

আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে পারতাম যে পাঠকের কাছে মনে হবে এ সব কিছুই অপ্রয়োজনীয় নেশা। যান্ত্রিক ক্ষমতা নতুন মানসিকতার জন্ম দেয় এ আমার বিশ্বাস। যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সরকার নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজে বের করা। গণতন্ত্র কঠিন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কৌশলগত উন্নতির দরুন এর গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। বিশাল যান্ত্রিক ক্ষমতা রয়েছে আজ্ঞাধীন যে মানুষটার, অনিয়ন্ত্রিত হলেও নিজেকে তিনি মনে করে বসতে পারেন ঈশ্বর–তবে তা খ্রিস্টানদের ঈশ্বর নন, পৌত্তলিকদের অধিদেবতা।

লিওপার্ডি ভিসেরিয়াস স্লোপে ভলকেননা ক্রিয়ার ফলাফল বর্ণনা করেন এভাবে:

These lands that now are strewn
With sterilising cinders and embossed
With lava frozen to stone
That echones to the lonely pilgrims foot
Where nestling in the sun the snake lies coiled.

মানুষ এখন এই ফলাফল অর্জন করতে পারবে। এগুলো অর্জিত হয়েছে গার্মিকোতে; অদূর ভবিষ্যতে এগুলো লন্ডনে অর্জিত হবে। কি ফায়দা লাভ করা যাবে এমন ধ্বংসের মাধ্যমে অলিগার্ক থেকে গজিয়ে ওঠা ডমিনিয়োন থেকে? লন্ডন ও প্যারিস নতুন দেবতাদের বত্র ও অশনি দ্বারা ধ্বংস না হয়ে যদি বার্লিন ও রোম ধ্বংস হতো তবে ধ্বংসকারীদের ভেতর একজনেরও পরও কি অবশিষ্ট থাকতে কোনো মানবতা?

প্রারম্ভিক মানবিক অনুভূতি ছিল যেসব মানুষের তারা কি পাগল হয়ে যেত না অতিরিক্ত মায়ায়? এমনকি খারাপ হয়ে যেত না কি তাদের চেয়েও যাদের করুণা, সহানুভূতি ঢাকা দেয়ার হয়নি প্রয়োজন।

পুরাকালে মানুষ মোহিনীশক্তি লাভ করার জন্য শয়তানের কাছে বিলীন করে দিত তার নিজের সত্তা। আজকাল মানুষ নিজেই বিজ্ঞান থেকে এ শক্তি লাভ করে হয়ে যায় শয়তান। কোনো আশা নেই শক্তির লালন ও পোষণ করে এক মানবতার সেবায় ব্যবহার করতে না পারলে। এ গোষ্ঠীর বা ওগোষ্ঠীর নয় এই উন্মাদ অত্যাচারী, বরং তা সাদা, হলুদ এবং কালো, ফ্যাসিস্ট, কমিউনিস্ট এবং গণতন্ত্রী নির্বিশেষে সব মানুষের জন্যে। কারণ, হয় সবাই বেঁচে থাকবে অথবা সবাই মারা যাবে–বিজ্ঞান এটি অনিবার্য করে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *