নূর-ইসলাম

নূর-ইসলাম

মিসিস এনি বেশান্তের “ইসলাম” শীৰ্ষক বক্তৃতা পাঠ করিলে বাস্তবিক মোহিত হইতে হয়। “ইসলাম” শব্দের সমভিব্যাহারে মিসিস বেশান্তের নাম শুনিয়া আপনারা কেহ ভীত হইবেন। না। প্ৰথমে আমারও আশঙ্কা হইয়াছিল যে, তিনি হয়ত তাহার “থিয়োসফী” ধর্ম্মের মহিমা প্রচার করিতে গিয়া আমাদের একমাত্র সম্বল ইসলামের উপর, খানিকটা হাত সাফ করিয়া লইয়াছেন। কিন্তু বক্তৃতা পাঠ করিয়া আমার সে ভ্রান্তি দূর হইল। হাত সাফ করা ত অতি দূরে-ইহার প্রতি পত্র-প্রতি ছত্র সুপক্ক আঙ্গুরের ন্যায় অতি মিষ্ট ভক্তিরসে পরিপূর্ণ। তিনি নূর-ইসলাম (বা ইসলাম-জ্যোতির) এমন উজ্জ্বল জ্যোতিৰ্ম্ময় চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন যে তাহার তুলনা হয় না।—এমনকি প্রিয় বঙ্গভাষায় ইহার মৰ্ম্মোদ্ধার করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিতেছি না।

তবে কথা এই যে, অনুবাদ করিবার মত ক্ষমতা ও বিদ্যাবুদ্ধি সকলের থাকে না–বিশেষতঃ আমার ন্যায় লোকের তাদৃশ চেষ্টা! তাহাতে আবার আমি বহু চেষ্টা করিয়াও মিসিস এনি বেশান্তের মূল ইংরাজী বক্তৃতা-পুস্তিকাখনি সংগ্ৰহ করিতে পারি নাই। আমাকে উহার উর্দু অনুবাদের উপরই নির্ভর করিতে হইতেছে। অনুবাদক মহোদয় অতি উচ্চ (সুফিধৰ্ম্ম ভাবপূর্ণ) ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন! সুতরাং আমি যদি ঐ অনুবাদের অনুবাদ করিতে গিয়া লক্ষ্যভ্ৰষ্ট হইয়া, নিজের ভাব ব্যক্ত এবং বিকৃত ভাষা ব্যবহার করিয়া ফেলি, সে ত্রুটি মাৰ্জনীয় বলিয়া ভরসা করি।

আর একটি কথা,–মিসিস এনি বেশান্তি যেমন হজরতের নাম উল্লেখ করিতে অত্যধিক সম্মানের ভাষা ব্যবহার না করিয়া, ভক্তের সরল ভাবপূর্ণ ভাষা প্রয়োগ করিয়াছেন, অনুবাদক মোঃ হাসেনউদ্দিন সাহেবও তদ্রুপ করিয়াছেন; যথা “আব ওহ মহম্মদ সিরফ মহম্মদ হি না রহা বালকে ওহ পয়গম্বরে আরব হুয়া” ইত্যাদি। ভাব ও ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দৰ্য্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে আমিও অনুবাদক মহাশয়ের প্রথা অনুসরণ করিতে বাধ্য হইয়াছি। আর দিবাকরের সমুজ্জ্বল কান্তি দেখাইবার জন্য, অন্য আলোকের প্রয়োজন হয় না; পুষ্পের সৌন্দৰ্য্য-বদ্ধনের নিমিত্ত অলঙ্কারের প্রয়োজন হয় না। যাহা হউক, আশা করি, আমি আড়ম্বরপূর্ণ সম্পমানসূচক শব্দের বহুল প্রয়োগ বজ্জন করায় দোষী হই নাই।

এখন আপনারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করুন, মিসিস বেশান্ত কি বলিতেছেন :

ভদ্ৰ মহোদয়গণ!
প্রত্যেক দেশের জাতীয় উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উন্নতির যাবতীয় কারণ সমূহের মধ্যে প্রধান কারণ হইতেছে-ধৰ্ম্ম! ধৰ্ম্ম ব্যতিরেকে মানুষ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি কিম্বা সভ্যতা লাভ করিতে পারে না। যে দেশের সমুদয় অধিবাসী একই ধৰ্ম্মবলম্ববী, যে দেশে সকলে একই ভাবে একই ঈশ্বরের পূজা করে-তাহাকে সকলে একই নামে ডাকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির মনোভাব একই সূত্রে গ্রথিত থাকে, সে দেশ অত্যন্ত সৌভাগ্যশালী, সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার মতে যে দেশে এক ঈশ্বরকে লোকে বিভিন্ন নামে ডাকে; একই ঈশ্বরের উপাসনা বিবিধ প্ৰণালীতে হয়; একই সৰ্ব্বশক্তিমান ঈশ্বরের নিকট লোকে বিভিন্ন ভাষায় প্রার্থনা করে, তথাপি সকলে ইহাই মনে করে যে, আমরা সকলে একই গন্তব্যস্থানে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলিয়াছি, এবং এইরূপ পার্থক্যের মধ্যে একতা থাকে; যদি কোন দেশের ঐ অবস্থা হইত, (কিন্তু অদ্যপি এমন কোন ভাগ্যবতী দেশের বিষয় জানা যায় নাই।)—আমার মতে সে দেশ নিশ্চয়ই ধর্ম্মে প্রধান হইত।

অন্যান্য দেশেও বিভিন্ন ধৰ্ম্ম এবং ভিন্ন ভিন্ন ধৰ্ম্মবিশ্বাসী লোক আছে, কিন্তু ভারতবর্ষ এই আদর্শের অদ্বিতীয় দেশ-ইহার তুলনা এ ভারত নিজেই। এ দেশে এত স্বতন্ত্ৰ ধৰ্ম্ম এবং এত পৃথক বিশ্বাসের লোক বাস করে যে, মনে হয় যেন ভারতবর্ষে সমস্ত পৃথিবীর ধৰ্ম্ম-মতসমূহের প্রদর্শনী-ক্ষেত্র। এবং এই দেশই সেই স্থান, যেখানে পরস্পরের একতা, মিত্রতা এবং সহানুভূতির মধ্যে ধর্ম্মের সেই আদর্শ–যাহাকে আমি ইতঃপূৰ্ব্বে বাঞ্ছনীয় বলিয়াছি—পাওয়া যাইতে পারে।

আপনাদের স্মরণ থাকিতে পারে, তিন চারি বৎসর পূৰ্ব্বে আমি আপনাদিগকে চারিটি প্রধান ধৰ্ম্মের, অর্থাৎ বৌদ্ধ, খ্ৰীষ্টীয়, হিন্দু এবং অনল-পূজার বিষয় বলিয়াছিলাম, কিন্তু তিনটি শ্ৰেষ্ঠ ধাম্পের্মর, অর্থাৎ ইসলাম, জৈনমত, এবং শিখধর্ম্মের আলোচনা রহিয়া গিয়াছিল। এই তিন ধর্ম্ম-যাহা ভারতবর্ষের প্রধান সাতটী ধর্ম্মের অন্তৰ্গত-ইহাদের পরস্পরে। এত অনৈক্য দেখা যায় যে, ইহারা একে অপরের রক্ত-পিপাসু হইয়া উঠে এবং দুইজনের মনের মিলনের পক্ষে এই ধৰ্ম্ম-পাৰ্থক্য এক বিষম অন্তরায় হইয়া আছে।

আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, ভারতবর্ষ হেন দেশে যদি সকলে চক্ষু হইতে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের আবরণ উন্মোচন করিয়া ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করতঃ চিন্তা করিয়া দেখেন, তবে তাহারা বুঝিতে পরিবেন যে “আমরা প্রকৃতপক্ষে একই প্রভুর উপাসনা বিভিন্ন প্ৰণালীতে করিতেছি—একই প্রভুকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ও ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকিতেছি।”

[“পুরাও পুরাও মনস্কাম,-
কাহারে ডাকিছে অবিশ্রাম
জগতের ভাষাহীন ভাষা?”–

–ডা. ববীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

“সকলে তাঁরেই ডাকে,
আমি যাঁরে ডাকি,–
রাঙ্গা রবি নিয়া বুকে
ঊষা ডাকে সোণামুখে
গোধূলি বালিকা ডাক
শ্যাম ছটা মাখি।”–

–মানকুমারী দেবী।]

আর, একই স্থান হইতে আমরা আসিয়াছি এবং সেইখানে পুনরায় যাইতেছি। ইহার ফল এই হইবে যে, একে অপরের সহিত নিতান্তু আন্তরিক ও প্রকৃত ভ্ৰাতৃভাবে মিশিতে পরিবে। একের দুঃখে অপারে দুঃখিত হইবে-সমুদয় ভারতবাসী একই জাতি বলিয়া পরিগণিত হইবার অধিকার প্রাপ্ত হইবে। অধিকন্তু জগতের বড় বড় শক্তিপূঞ্জ ভারতসন্তানকে একজাতি বলিয়া স্বীকার করিবে। যখন হিন্দু মুসলমানে, পারসী-খ্ৰীষ্টানে, জৈন-য়ীহুদীতে এবং বৌদ্ধশিখে প্ৰেমপূৰ্ণ হৃদয়ে আলিঙ্গন হইবে, তখন আমি মনে করিব যে, ধর্ম্মের জয় এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের পবিত্র নাম শান্তিপ্রদ হইয়াছে।

অদ্য আমি ইসলাম-সম্বন্ধে দুই চারি কথা বলিব এবং আগামী কল্য ও পরশ্ব অবশিষ্ট দুই ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে, এবং অনন্তর সমুদয় ধৰ্ম্মের প্রকৃত মৰ্ম্ম-সারতত্ত্ব অর্থাৎ সেই থিয়োসকী (ব্ৰহ্মজ্ঞান বা “এলমে-এলাহী”) সম্বন্ধে আলোচনা করিব, যাহাতে প্ৰত্যেক ধৰ্ম্মবিশ্বাসের সারভাগ আছে এবং যাহা সকলের উপর একই প্রকার অধিকার রাখে-যাহাকে কোন বিশেষ ব্যক্তি তাহার নিজস্ব বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ধৰ্ম্ম বলিতে পারে না; বরং তদ্বিপরীত যে কোন ধৰ্ম্মবিশ্বাসের অধিকারী বলিতে পারে যে, ইহাই আমারও ধৰ্ম্ম। আদ্য সমিতির সম্ববাৎসরিক অধিবেশন দিনে আমার এই প্রার্থনা যে, বিশ্ব-সংসারের সমুদয় ধৰ্ম্মগুরুদের পবিত্ৰ-আত্মা আমাদের ও আমাদের কাৰ্যকলাপের প্রতি র্তাহাদের আশীৰ্ব্বাদপূর্ণ দৃষ্টিপাত করুন-যেন তাহাদের শিষ্যমণ্ডলী একজন অপরকে ভাল বাসিতে পারেন। আমীন!

ইসলাম

কোন ধৰ্ম্ম পরীক্ষা করিতে হইলে, আমাদিগকে চারিটি বিষয় সম্পবন্ধে চিন্তা করিতে হয়। সৰ্ব্বপ্রথম সেই ধর্ম্মের উৎপত্তির ইতিহাস, যাহার প্রভাব তাঁহাতে (সেই ধর্ম্মে) লুক্কায়িত থাকে। দ্বিতীয়, তাহার প্রকাশ্য বা বাহ্যিক মত অথবা শাখা পল্লব, যাহার সহিত সাধারণে সম্পর্ক রাখে। তৃতীয়, ধৰ্ম্মের দর্শন, যাহা বিদ্বান এবং সুশিক্ষিত লোকদের জন্য। চতুৰ্থ, ধর্ম্মের গৃঢ় রহস্য, যাহাতে সাধারণতঃ মালবের আপনি অহং বা অস্তিত্বজ্ঞানের ভাণ্ডারের সহিত মিশিবার স্বাভাবিক ইচ্ছা প্ৰকাশ পায়। আমি এই কষ্টিপাথরে ইসলামকে পরীক্ষা করিয়া আপনাদিগকে দেখাইতে চাই যে, সৰ্ব্বপ্রথমে আরব ও শামদেশের অবস্থার প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া দেখুন, সে দেশের কি দশা ছিল।

খ্ৰীষ্টীয় যষ্ঠ শতাব্দীতে যখন সমস্ত আরব, শাম ও আজমদেশে অসভ্যতার ঘোর অন্ধকারে কুসংস্কারের প্রবল ঝঞ্চানিল বহিতেছিল; যুদ্ধকলহ ও পরস্পরের রক্তারক্তি এক দলকে অন্য দল হইতে পৃথক করিতেছিল; হিংসা দ্বেষ এমন প্রবল ছিল যে, একই বিষয়ের ঝগড়া কয় পুরুষ পৰ্যন্ত চলিত;(1) যথা এক ব্যক্তি কোন বিষয় লইয়া অন্য একজনের সহিত বিবাদ করিল, অনন্তর শত বৎসর পরে একের পৌত্র অপরের পৌত্রকে শুধু এই অজুহাতে হত্যা করিত যে, “ইহার পিতামহ আমার পিতামহের শত্রু ছিল!” ইহা সেই আরব দেশসেখানে কেবল এই কথায় যুদ্ধ আরম্ভ হইত যে, “তোমার উষ্ট্র আমার উষ্ট্রকে অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইল কেন?” বাস, এই সামান্য কারণে রক্তনদী প্রবাহিত হইত-শবরাশি স্তূপীকৃত হইত! এ সেই আরব দেশ-যেখানে নিষ্ঠুর পিতা, মাতার ক্রোড় হইতে শিশু কন্যাকে কাড়িয়া লইয়া গৰ্ত্ত খনন করিয়া তাহাতে জীবন্ত প্রোথিত করিয়া আসিত। আর নিরুপায় মাতা আপন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহপূর্ণহৃদয়ের অসহ্য বেদনা লইয়া মরমে মরিয়া থাকিত। স্ত্রীলোক হওয়ার দরুণ পাষণ্ড স্বামীর ঐ নিম্পর্মম অত্যাচারে আপত্তি করিতে পারে, এতটুকু ক্ষমতাও তাহার ছিল না। কাহাকেও জামাতা বলিতে না হয়, এইজন্য কন্যা হত্যা করা হইত। ইহা সেই দেশ, যেখানে ঘূণিত পৌত্তলিকতা বিরাজমান ছিল—ঘরে ঘরে নতুন দেবতা; এক ঠাকুর আবার অন্য ঠাকুরের প্রাণের শত্রু। প্রতিমার সম্প্ৰমুখে নরবলিদান” ত নিত্য ক্রীড়া ছিল; যেখানে মানবজাতির প্রতি স্নেহ মমতার পরিবৰ্ত্তে বিলাসিতা ও আত্মপরায়ণতা পূর্ণ মাত্রায় রাজত্ব করিত। যে কোন প্রবল ব্যক্তি আপন দুৰ্ব্বল প্রতিবেশীকে বিনা কারণে কিম্বা অতি সামান্য কারণে হত্যা করিয়া ফেলিত; তাহার ঐ দুহিব্রুয়ায় বাধা দিবার লোক ত দূরে থাকুক, একটি কথা জিজ্ঞাসা করিবারও কেহ ছিল না।

তদানীন্তন আরবে বিলাসিতার ও অন্যান্য “মকারাদি” কুক্রিয়ার অন্ত ছিল না; এক স্বামী ভেড়া ছাগল প্রভৃতি পশুর ন্যায় অসংখ্য ভাৰ্য্যা গ্ৰহণ করিত; আর এই বিষয়ে গীেরব করা হইত। যে অমুক ধনী ব্যক্তি এত অসংখ্য স্ত্রীর স্বামী। ঈশ্বরের সৃষ্টি-স্ত্রীজাতি এমন জঘন্য দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধা ছিল যে, তাহারা নিতান্ত অসহায় গৃহপালিত পশুর ন্যায় জীবন যাপন করিত। মোটের উপর এমন কোন নিকৃষ্ট পাপ ও জঘন্য দোষ নাই, যাহা তৎকালীন আরবে না ছিল।

সেই স্বাৰ্থ, অত্যাচার ও আত্মপরতার পূতিগন্ধময় জলবায়ু পরিবেষ্টিত এক কোরেশগহে একটি শিশু (সে পবিত্র শিশুরত্নের উদ্দেশে সহস্র দরুদ!) জন্মগ্রহণ করিলেন, র্যাহার পিতা তাঁহার জন্মের কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই ইহধাম পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। আর তিনিও সেইরূপ পিতা ছিলেন, যিনি তদীয় পিতৃকর্তৃক কোন প্রতিমার সম্পমুখে নরবলিরূপে আনীত হইয়াছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ দেবালয়ের সেবিকার কৃপায়-সে যাত্রা রক্ষা পাইয়াছিলেন।(2) এই শিশু এমন একটি হতভাগিনী দুঃখিনী নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ইনি ভূমিষ্ঠ হইবার পূৰ্ব্বেই বিধবা হইয়াছিলেন,-আর দারুণ বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া কয়েক মাস পরেই এ অবোধ দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিঃসহায় অবস্থায় ফেলিয়া স্বামীর অনুগমন করেন। ইহার ফলে এই পিতৃমাতৃহীন শিশু কিছুদিন স্বীয় পিতামহ কর্তৃক প্রতিপালিত হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাহার পিতামহও কয়েক বৎসর পরে দেহত্যাগ করিলেন। তখন সেই অসহায় বালক বয়োপ্রাপ্ত হওয়া পৰ্যন্ত, স্বীয় পিতৃব্য আবু তালেবের আশ্রয়ে রহিলেন। ইহা ত অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে, এইরূপ বিপদগ্ৰস্ত পিতৃমাতৃহীন সহায়সম্পদশূন্য একটি অজ্ঞান বালক যে শিক্ষাদীক্ষা হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকিবেন, ইহাই স্বাভাবিক। বাস্তবিক কাৰ্য্যতঃও তাঁহাই হইয়াছিল। শিক্ষা, বা অধ্যয়ন বলিতে একটি অক্ষরের সঙ্গেও তাঁহার পরিচয় হয় নাই, নীতি বা আচার নিয়মের অনুশাসনের বাতাস পৰ্যন্ত তাহাকে স্পর্শ করে নাই। তথাপি তাহার শৈশবকাল, অতি পবিত্র জীবনের উচ্চ আদর্শ ছিল। তাঁহার নিম্পর্মল জীবনে মানবের বাঞ্ছনীয় যাবতীয় সদগুণরাজিযথা, দয়া, সৌজন্য, প্রেম, ধৈৰ্য্য, নম্রতা, বিনয়, শান্তিপ্রিয়তা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি স্বভাবতঃ বিরাজমান ছিল। তিনি নানা গুণে সকলের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিয়াছিলেন।

বাল্যজীবন অতিক্রম করিয়া তিনি কৈশোরে উপনীত হইলেন। এখন জীবিকা-অৰ্জ্জনের নিমিত্ত তিনি আপন কোন বিধবা আত্মীয়ার গৃহে কৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে বাধ্য হইলেন। উক্ত বিধবা খাদিজা বিবি তাহাকে পণ্যদ্রব্যসহ বাণিজ্য উপলক্ষে শামদেশে প্রেরণ করিতেন। এই বিষয়কর্ম্মে খজিদাবিবি দেখিতে পাইলেন যে তাহার এই নূতন কৰ্ম্মচারী অতিশয় ধৰ্ম্মভীরু, ন্যায়পরায়ণ, মিতব্যয়ী এবং অতি বিশ্বাসী। অতঃপর তিনি ইহার সহিত পরিণীত হন।

ইহা স্মরণ রাখা কৰ্ত্তব্য যে, এই নবীন যুবক যাহার নাম মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওসাল্লাম) ছিল, সে সময়ে পয়গম্বর হন নাই। আর তাঁহার পত্নী হজরত খাদিজাও তাঁহার ধৰ্ম্মবিশ্বাসের অনুবৰ্ত্তিনী ছিলেন না; তিনি স্বয়ং অল্পবয়স্ক তরুণ এবং তাঁহার জায়া তদপেক্ষা দ্বিগুণ বয়োজেষ্ঠা ছিলেন। কিন্তু বিবাহের পর তাহারা এমন সুখের দাম্পত্য জীবন ভোগ করিয়াছিলেন যে, পৃথিবীতে তেমন মধুর দাম্পত্যজীবনের উচ্চ আদর্শ আর কেহ দেখাইতে পারিয়াছে কি না সন্দেহ–আর তেমনই ভাবে তাঁহাদের বিবাহ জীবনের পূর্ণ ২৬ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর হজরত খাদিজার মৃত্যু হইল। অতঃপর পয়গম্বর সাহেবের স্বভাব চরিত্র ও কাৰ্যকলাপ সৰ্ব্বদাই অতি প্ৰশংসনীয় ছিল। যখন তিনি মক্কার সন্ধীর্ণ গলিকুচাতে যাতায়াত করিতেন, সে সময় তত্ৰত্য ক্ৰীড়ারত অবোধ শিশুগণ তাঁহার পদযুগল জড়াইয়া ধরিত, আর তিনি সততই তাহাদের সহিত স্নেহসিক্ত মিষ্টভাষায় কথা বলিতেন, তাহদের মস্তকে হস্তামর্শন করিতেন। কেহ কখনও শুনে নাই যে, তিনি প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছেন। তিনি সৰ্ব্বদা বিপদগ্ৰস্তের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকিতেন; বিধবা ও পিতৃহীন শিশুদের সান্তুনা ও প্ৰবোধ দান তাহার নিত্য কম্পর্ম ছিল। প্রতিবেশিবৰ্গ তাহাকে “আমীন” (বিশ্বস্ত) বলিয়া ডাকিত। “আমীন” শব্দের অর্থ বিশ্বাসভাজন-এমন উচ্চ ভাবপূর্ণ উপাধি কেবল শ্রেষ্ঠ হইতে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিই বিশ্ব জগতের নিকট প্রাপ্ত হইতে পারেন। এখন আপনারা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন ত; যে ব্যক্তির বাহ্যিক জীবন জগতেব পক্ষে এমন উপকারী এবং সুখ শান্তিপ্রদ ছিল, তাহার আভ্যন্তরীণ জীবন কেমন হইতে পারে। অহো! (সত্য তত্ত্বজ্ঞান লাভের নিমিত্ত) তাহার আন্তরিক ব্যাকুলতার বন্যাস্রোতেব তাড়না তাঁহাকে বনে বনে ও জনপ্রাণিগৃন্য মরুভূমি ভাসাইয়া লইয়া যাইত। তিনি কতৰ্ধার দিবানিশি অনশনে অনিদ্রায় বিপৎসস্কুল পৰ্ব্বতকন্দিরে বাস করিতেন। তিনি যে ভাবে আত্ম-বিস্মৃত হইয়া ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ঈশ্বর-অনুসন্ধান করিতেন, তাহা বৰ্ণনা করিবার উপযুক্ত ভাষা দুর্লভ; অথবা ইহার মৰ্ম্ম কেবল তাহারাই বুঝিতে পারেন, র্যাহারা একাগ্রচিত্তে খোদার পথে আত্মসমৰ্পণ করিয়াছেন।

ক্রমে হজরত মোহাম্মদের (দঃ) এই প্রকার ধ্যান-আরাধনা এত বৃদ্ধি পাইল যে, তিনি লোকালয় পরিত্যাগ পূর্বক দূরে-অতি দূরে-ঘোর অরণ্যে চলিয়া যাইতেন; দুৰ্গম ও ভয়ঙ্কর গিরিগুহায় মাসাধিককাল পৰ্যন্ত বাস করিতেন—সেখানে শুধু সিজদায় (নতশিরে) পড়িয়া অনবরত রোদন ও বিলাপ ব্যতীত তাঁহাব অন্য কোন কাজ ছিল না। এমনকি তিনি অনু্যন পঞ্চদশ বর্ষ এই ভাবে যাপন করিলেন-অবশেষে সেই শুভ মুহূৰ্ত্ত আসিল, যখন দৈববাণী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “উঠ! খোদায় পাকের (পবিত্র ঈশ্বরের) নাম উচ্চারণ কর!” কিন্তু তিনি বুঝিতে পারিলেন না, সে শব্দ কাহার; অথবা ঐ আকাশবাণী বাস্তবিকই বিশ্বাসযোগ্য দৈববাণী কি না? কারণ তিনি বেশ জানিতেন যে, তিনি নিরক্ষর লোক ছিলেন। তাঁহার সন্দেহ হইত যে, ইহা হয়ত তাঁহার ভ্রম বা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র-কিম্বা তাঁহার অহংজ্ঞান তাহাকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত ঐ রূপ শব্দ করিতেছে; এবং সম্ভবতঃ ইহা সেই দৈববাণী নহে, যাহা স্বয়ং খোদাতালার নিকট হইতে পয়গম্বরগণ শুনিতে পাইতেন, যাহাকে “এলহাম” কিন্বা “অহি” বলে।

অবশেষে আর একরার যখন তিনি ঈশ্বর-চিন্তায় অত্যন্ত আকুল ছিলেন, সহসা তাঁহার চতুস্পার্শ্ব এক অলৌকিক স্বগীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, আর সেই আলোকরশির মধ্যে একটী জ্যোতিষ্মান মূৰ্ত্তি দেখা দিয়া বলিলেন, “যাও, সত্য নাম উচ্চারণ কর।” একরার সাহসে ভর করিয়া সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি কাহাকে ডাকিব?” ইহার উত্তরে স্বৰ্গদূত তাঁহাকে ঈশ্বরের একত্ত্ব, ফেরেশতাদের রহস্য, পৃথিবীর সৃষ্টি এবং মানবজাতির অস্তিত্ব বিষয়ে শিক্ষাদান করিলেন এবং তাঁহাকে সেই দায়িত্বপূর্ণ গুরুতর কৰ্ম্মভারের (পয়গম্বরীর) কথাও বলিলেন, যে জন্য তাঁহার জন্ম হইয়াছে। অর্থাৎ দেবদূত বলিয়া দিলেন যে, তাহাকে বিশ্ব জগতের ধর্ম্মপথ প্ৰদৰ্শক এবং উপদেষ্টার কার্য্যভার সমর্পণ করা হইয়াছে।

এদিকে দেবদূত অদৃশ্য হইলেন, ওদিকে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) যিনি এখন হইতে আরব দেশের পয়গম্বর নামে অভিহিত হইবেন, অত্যন্ত অস্থির ও ভীতি বিহবল চিত্তে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন এবং অদ্ধ অচৈতন্য অবস্থায় ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িলেন। পতিপ্ৰাণা সতী হজরত খাদিজা উপযুক্ত শুশ্রুষা সহকারে তাঁহার তাদৃশ বিহবলতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রত্যুত্তরে পয়গম্বর সাহেব আনুপূর্বিক সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করিয়া বলিলেন, “বোধ হয় ইহা, আমার মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ।” ইহাতে পতিপরায়ণ সাধবী রমণী অতিশয় সান্তনাপূৰ্ণ মধুর বচনে তাহার নিস্তেজ হৃদয়ে বল সঞ্চার করিয়া বলিলেন, “না, না, তুমি সত্যবাদী- বিশ্বাসী—“আমীন”; প্রতিজ্ঞা পালনে যত্নবান; পিতৃহীনের প্রতি স্নেহ বৰ্ষণ কর; দরিদ্র, আতুর ও বিধবার প্রতি দয়া করিয়া থাক—এমন লোককে বিশ্বপাত কখনই অকালে নষ্ট করবেন না। প্ৰভু খোদাতালা কখনও বিশ্বাসী ভক্তদিগকে প্রবঞ্চনা করেন না। উঠ, এখন সেই দৈববাণী—প্রকৃত সত্য দৈববাণীর প্রত্যাদেশ অনুসারে কাৰ্য্য কর।”

সেই পুণ্যবতী মহিলা, যিনি সৰ্ব্ব প্রথমে পয়গম্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন,— এমনই সঞ্জীবনীসুধা পূর্ণ প্ৰবোধ বাক্যে র্তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন যে তিনি-যিনি নিজের দুর্বলতায় জড়ীভূত ও নিরুদ্যম হইয়া সম্পূর্ণ পরাজয় স্বীকার করিয়া বসিয়া ছিলেন,(3) এখন পূর্ণ সাহসে ও উৎসাহপূর্ণ হৃদয়ে, একেবারে উঠিয়া দাড়াইলেন! আর সে মোহাম্মদ কেবল মোহাম্পমদ মাত্রই রহিলেন না-বরং প্রবল প্ৰতাপশালী পয়গম্বর হইয়া গেলেন। তিনি একটা অসভ্য, অরাজক দেশকে শান্তিপূর্ণ এবং একটা জনপ্রাণীবিরল নগণ্য উপদীপকে এক মহা সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়া তুলিলেন। তাহার শিষ্যমণ্ডলী ইউরোপে ধৰ্ম্ম ও জ্ঞানের আলোক লইয়া গেলেন, এই দুইটী বস্তু সেখানে প্রায় ছিলই না। তাঁহার অনুবৰ্ত্তিগণ পৃথিবীতে বড় বড় সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থান করিলেন। তাহারা সমবিশ্বাসীগণ এমন নিষ্ঠার সহিত এলাহীর ধ্যান ও স্মরণে নিমগ্ন হইলেন যে, তাহার আদর্শ অন্য কোন ধৰ্ম্মে পাওয়া সম্ভবপর কি না সন্দেহ। কারণ আপনারা একটু চিন্তা করিলে এবং ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাইবেন যে, অন্য কোন ধৰ্ম্ম এমন নাই, যাহাতে এমন অকপটহাদয় সত্যবিশ্বাসী লোক পাওয়া যায়। এই জ্ঞান বিশ্বাস তাহারা (মুসলমানেরা) আরবদের পয়গম্বর হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে।

যদি বেন সাহেবের কথামত ইহাই সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় যে, সাধারণ আচার ব্যবহার হইতে ধর্ম্মবিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহা হইলে আপনারা ঐ ধর্ম্মের অনুবৰ্ত্তিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন এবং ভাবিয়া দেখুন, তাহার (হজরতের) বাক্যসমূহ তাঁহার শিষ্যবর্গের হৃদয়ে কেমন স্পষ্টভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে। মুসলমানেরা আরবের পয়গম্বর হইতে যে শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে তাহাদের বিশ্বাস এমন সুদৃঢ় যে, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ স্থান পায় না।

একজন মুসলমান-যদ্যপি এমন কোন স্থানে এমন কতকগুলি লোক দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, যাহারা তাহাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের ছুরিকায় খণ্ড খণ্ড করে এবং তাহার পরগাস্বরের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে—নমাজে মস্তক অবনত করিতে কিছুমাত্র লজ্জিত বা কুষ্ঠিত হয় না।(4)

আপনারা আরও একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন, পয়গম্বরের সুপারিশের (শাফাআতের) প্রতি তাহাদের বিশ্বাস কেমন অটল যে, তাহারা মৃত্যুভয় একেবারে জয় করিয়া ফেলিয়াছে। আফ্রিকার দরবেশবৃন্দের সৎসাহসের তুলনা কেহ আমাকে দেখাইতে পারেন কি?-র্যাহারা ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু তোপ-কামানের সম্পমূখে স্থিরভাবে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাড়াইবার জন্য এমনই আনন্দের সহিত অগ্রসর হইতেন, যেন বরযাত্রিরূপে কোন বিবাহ সভায় যাইতেছেন। এবং যে পৰ্য্যন্ত তাঁহাদের দলের কয়েক ব্যক্তি শক্রসেনা পৰ্যন্ত পেঁৗছতে না পারিতেন, সে পৰ্যন্ত দলে দলে কামানে ধ্বংস হইতেন। সে কোন উদ্দীপনা ছিল, যাহা তাঁহাদিগকে এমন ভীষণ মৃত্যুমুখে লইয়া যাইত? তাহা কেবল পয়গম্বরের-কোরআনের মহিমা, এবং ইসলামপ্রেম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, (তাহাদের) এই ভক্তি পৃথিবীতে ভবিষ্যতেও অটল রহিবে, বরং বৰ্ত্তমান যুগ অপেক্ষা ভবিষ্যতে আরও উজ্জ্বল আলোক বিকীর্ণ করবে। (আমীন!)

ভদ্ৰ মহোদয়গণ! এখন আমি আরবীয় পয়গম্পবরের সত্যনিষ্ঠা সম্পবন্ধে একটি প্রমাণ আপনাদের সম্পমুখে উপস্থিত করিতেছি। তাহা এই যে—পয়গম্বরের “নবুয়তে” সৰ্ব্বপ্রথমে বিশ্বাস করিয়াছিলেন তাঁহার সহধৰ্ম্মিনী—যিনি তাহার গাৰ্হস্থ্য জীবনের সমুদয় রহস্য অবগত ছিলেন, আর তাঁহার অতি অন্তরঙ্গ আত্মীয়া ছিলেন বলিয়া তাহার আশৈশব জীবনের স্বভাব-চরিত্র সমুদয় উত্তমরূপে জ্ঞাত ছিলেন। এই যদি আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখেন, তবে, পয়গম্ববরের সত্যপরায়ণতা সম্প্ৰবন্ধে অতি জ্বলন্ত প্ৰমাণ পাইবেন। আপনারা নিজেরাই বেশ জানেন যে, কোন বিজ্ঞ বক্তৃতানিপুণ ব্যক্তি কোন সভা সমিতিতে গিয়া বেশ ঝাড়া দুই ঘণ্টা উৎকৃষ্ট বক্তৃতা প্রভাবে শ্ৰোতৃবৰ্গকে মোহিত ও চমৎকৃত করিয়া স্বমতে তাঁহাদের বিশ্বাস জন্মাইতে পারে- যেহেতু সে সময় লোকে তাহাকে কেবল বক্তৃতা—মঞ্চেই দেখে; তাহার আভ্যন্তরীণ জীবনের অবস্থা কিছু জানে না। কিন্তু ইহা বড় কঠিন, এমন কি অসম্ভব যে নিজের স্ত্রী, কন্যা, জামাতা প্রভৃতি অতি নিকটবতী আত্মীয়গণ তাহার সত্যতার সাক্ষ্যদান করে– যদি সে ব্যক্তি বাস্তবিক তদ্রােপ নিম্পর্মল ও সত্যপর না হয়। আমাদের মতে ইহারই নাম “পয়গম্বর” এবং সত্য বলিতে কি এমন বিশ্বব্যাপী জয়লাভ হজরত মসিহের (যীশুর) ভাগ্যেও ঘটে নাই।(5)

আরবীয় পয়গম্ববরের আত্মীয়বান্ধবদের মধ্যে কেবল তাহার পিতৃব্য আবু তালেবই (?) এমন ছিলেন, যিনি কেবল নিজের একওঁয়ে গোড়ামীর জন্য তাঁহার ধৰ্ম্মমতে (প্ৰকাশ্যে) বিশ্বাস করেন নাই। তিনি সম্প্রান্ত কোরেশ বংশের দলপতি ছিলেন বলিয়া আপন পুরাতন পৈতৃক ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দেওয়া নিজের জন্য মানহানিকর বোধ করিতেন; নতুনবা তাঁহার কায্যকলাপে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইত যে, তিনি পয়গম্বরের ধৰ্ম্মে সম্পূর্ণ বি ছিলেন। কারণ তিনি রাসুলোল্লাহকে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছিলেন, “হে পিতৃব্যপ্ৰাণ! তুমি অসঙ্কোচে আপন কৰ্ত্তব্য পালন করিতে থাক; আমার জীবদ্দশায় কাহার সাধ্য যে, তোমার দিকে কটাক্ষপাত করে?” একদিন আবু তালেব স্বীয় পুত্র হজরত আলীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর ধৰ্ম্ম বিশ্বাস কি? আর তুই মোহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে কি মনে করিস?” হজরত আলী অত্যন্ত সম্পমান। অথচ উৎসাহের সহিত উত্তর করিলেন, “পিতৃদেব! আমি একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহকেই পূজনীয় মনে করি, এবং মোহাম্মদকে আল্লাহতালার প্রকৃত প্রেরিত বলিয়া মানি। আব এই জন্য পয়গম্বরের সংশ্ৰব পরিত্যাগ করিতে স্বীকৃত হইব না।”

ঈদৃশ উত্তর শ্রবণে পিতার অসন্তুষ্টি হইবারই সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তাহা তো হইল না! বরং তিনি বলিলেন, “পিতৃ-প্ৰাণ-পুত্তলি! আমি তোমাকে অতিশয় সন্তুষ্ট চিত্তে তাহার শিষ্যত্ব গ্রহণ ও তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে অনুমতি দিতেছি। যেহেতু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি তোমাকে সুপথ ছাড়া কুপথে পরিচালিত করিবেন না।”

নবুয়তের (পয়গম্বরী প্রাপ্তির) তিন বৎসর পর্যন্ত পয়গম্বর সাহেব নীরবে, বিনা আড়ম্ববরে আপনি মিশনের কার্য্য করিতেছিলেন। সে সময় তাহার প্রতি বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা মাত্র ৩০ জন ছিল। অতঃপর তিনি প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতা করিলেন, তাহাতে আল্লাহতালার একত্বের বিষয় অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণনা করিয়াছিলেন, এবং নরবলিদান, বিলাসিত ও সুরাপান যে অতি কদৰ্য্য, তাহাও বিশদরূপে বুঝাইয়া বলিয়াছিলেন। তাহার ঐ বক্ততার গুণে অনেকের হৃদয়ে বিশ্বাসের জ্যোতি প্ৰদীপ্ত হইল এবং তাঁহার শিষ্য সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল। কিন্তু ইহার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবন্ধকতা-বহ্নিও পয়গম্বর সাহেবের বিরূদ্ধে দেশময় প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিল। বিরোধী দলের হস্তে পয়গম্বর সাহেব যত প্রকার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও নিগ্ৰহ ভোগ করেন, সাধারণ মানব তাহা কিছুতেই সহ্য করিতে পারিত না।

বিধর্ম্মী শত্ৰুগণ পয়গম্ববর সাহেবের ভক্ত, বিশ্বাসী লোককে যখন যেখানে দেখিতে পাইত, তমুহূৰ্ত্তেই হত্যা করিত। কাহারও প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করিত। কাহাকে বা হস্ত পদ শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া সূৰ্য্যের দিকে মুখ করিয়া মরুভূমিতে উত্তপ্ত বালুকার ড্রপরে শয়ান করাইয়া তাঁহার বক্ষের উপর প্রস্তর চাপা দিয়া বলিত, “তুই মোহাম্মদ ও তাহার আল্লাহকে অস্বীকার কর।” কিন্তু এত যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাঁহারা মোহাম্মদের কলেমা পড়িতে পড়িতে অকাতরে প্রাণত্যাগ করিতেন!

একদা কোন দুরাত্মা জনৈক মুসলমানকে ধরিয়া তাহার দেহ হইতে খণ্ড খণ্ড মাংস কাটিয়া ফেলিতেছিল, আর বলিতেছিল, “এ তুই যদি নিজের পুত্র পরিবারের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে ঘরে থাকিতিস, আর তোর স্থলে তোর মোহাম্মদ এইরূপ ছিন্নদেহে ভূমে লুটাইয়া ছট্‌ফট্‌ করিত তবেই বেশ ভাল হইত!” কিন্তু সেই সত্য ধৰ্ম্মপ্রাণ মুসলমান মৃত্যু পর্যন্ত এই একই উত্তর দিতেছিলেন, “আমার গৃহ, পুত্র কলাত্র-সুখ স্বাচ্ছদ্য, সমুদয় হজরৎ রসুলের পদতলে উৎসর্গ হউক। আমার সম্মুখে যেন তাহার চরণ কমলে একটি কন্টকও বিদ্ধ না হয়।”(6)

অবশেষে বিরোধী শত্ৰুগণ পয়গম্বর সাহেব ও তদীয় শিষ্যবৰ্গকে এত অধিক ক্লেশ দিতে লাগিল যে, তাহারা শেষে রসূলের ইঙ্গিতে দেশান্তরে গিয়া আশ্ৰয় লইতে বাধ্য হইলেন। পয়গম্বর সাহেবের একদল যখন শত্রু-তাড়নায় ব্যস্ত হইয়া হাবশ (আবিসিনীয়া) দেশে গেলেন, তখন শক্রিগণও তাঁহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া সে দেশে উপস্থিত হইল, এবং তত্ৰত্য খ্ৰীষ্টান রাজাকে অনুরোধ করিল যে, গকে উহাদের হন্তে সমর্পণ করা হউক। রাজা তখন হতভাগ্য প্রবাসী দিগকে ডাকিয়া তাহদের অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাহারা বলিলেন, “রাজন! আমরা অজ্ঞতা ও মূর্খতার সমুদ্র নিমগ্ন ছিলাম, আমরা ঘূণিত পৌত্তলিক ছিলাম; আমাদের জীবন দুৰ্দান্ত পশুপ্রকৃতি নরপিশাচের ন্যয় নীচ ও জঘন্য ছিল; নরহত্যা আমাদের দৈনন্দিন ক্রীড়া ছিল; আমরা জ্ঞানান্ধ, ঈশ্বরদ্রোহী ও ধৰ্ম্মজ্ঞান বিবজ্জিত ছিলাম; পরস্পরের প্রতি স্নেহশ্ৰীতি বা মনুষ্যত্বের নামগন্ধ আমাদের মধ্যে ছিল না; অতিথি সেবা কিম্বা প্রতিবেশীর প্রতি কৰ্ত্তব্য পালন বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম; আমরা ‘জোর যার মুলুক তার ব্যতীত অন্য বিধিনিয়ম জানিতাম না। আমাদের ঐই ঘোর দুরবস্থার সময় আল্লাহুতালা আমাদের মধ্যে এমন একজন মানুষ সৃষ্টি করিলেন-যাহার সত্যতা, সাধুতা এবং সরলতার উজ্জ্বল চিত্র আমাদের হৃদয়পটে অঙ্কিত রহিয়াছে; সেই ব্যক্তি আমাদিগকে এই শিক্ষা দিয়াছেন যে, “আল্লাহ এক, সৰ্ব্ব কলঙ্ক হইতে পবিত্র, কেবল তাঁহারই উপাসনা করা আমাদের অবশ্য কৰ্ত্তব্য; আমাদিগকে সত্য অবলম্বন এবং মিথ্যা বর্জন করিতে হইবে; প্রতিজ্ঞা পালনে বিশ্বজগতের প্রাণিবৃন্দের প্রতি স্নেহ মমতা প্রদর্শনে, প্রতিবেশীর প্রতি কৰ্ত্তব্য পালনে যেন বিমুখ না হই; যেন স্ত্রীজাতির প্রতি সদ্ব্যবহার করি, পিতৃহীনের সম্পত্তি আত্মসাৎ না করি; নিয়ম মত দৈনিক উপাসনা ও উপবাস (রোজা) ব্ৰত পালনে অবহেলা না করি।” রাজন! আমরা এই ধৰ্ম্মে বিশ্বাস রাখি এবং এই শিক্ষা গ্ৰহণ করিয়াছি।”

ভদ্ৰ মহোদয়গণ! পয়গম্বর সাহেবের শিষ্যবর্গের বিশ্বাস এবং ধৰ্ম্মমত এমনই উচ্চ ছিল যে, তাহারা প্ৰাণ হেন প্রিয় বস্তু করতলে লইয়া বেড়াইতেন! আমি আরবীয় পয়গম্ববরের সত্যতা ও অকপট হৃদয়ের প্রমাণ স্বরূপ আর একটি বিষয় আপনাদের শ্রবণগোচর করিতেছি।

একদা পয়গম্বর সাহেব আরবের কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন, এমন সময় একজন অন্ধ তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “হে খোদার রসূল! আমাকে পথ দেখাইয়া দাও, আমি সত্য পথ লাভ করিবার আশায় আসিয়াছি।” পয়গম্বর সাহেব বাক্যালাপে অন্যমনস্ক থাকাবশতঃ তাহার উক্তি শ্রবণ করেন নাই। সে পুনরায় উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিল, “হে রসুলোল্লাহু! আমার কথা শুন, ধৰ্ম্মপথ দেখাও!” তদুত্তরে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তির সহিত তাহাকে অপেক্ষা করিতে ইঙ্গিত করিলেন। কিন্তু ইহাতে সে অন্ধ ক্ষুন্নচিত্তে চলিয়া গেল। পর দিবস পয়গম্বরের প্রতি যে “অহি” (দৈবাদেশ) আসিয়াছিল, যাহা অদ্যপি কোরআনে লিপিবদ্ধ আছে এবং চিরকাল থাকিবে, তাহার মৰ্ম্ম এই:

“রসুলের নিকট এক অন্ধ আসিল, কিন্তু সে (রাসুল) অবজ্ঞা করিল ও তাহার কথায় ভ্ৰক্ষেপ করিল না। তুমি কি করিয়া জান যে, সে পাপমুক্ত হইবে না, উপদেশ গ্রহণ করিবে না এবং সেই উপদেশ সে উপকৃত হইবে না? যে ব্যক্তি ধনী, তাহার সহিতই তুমি সসম্প্রম সম্ভাষণ করিতেছ, যদ্যপি সে বিশ্বাসী (ইমানদার) না হইত, তজ্জন্য তুমি অপরাধী হইতে না। কিন্তু যে ব্যক্তি স্বয়ং সরল হৃদয়ে সত্য ও মুক্তির অন্বেষণে আসিল, তাহার প্রতি মনোযোগ করিলে না। (ভবিষ্যতে যেন আর কখনও এরূপ না হয়)।”

ঐ দৈবা।দেশ পয়গম্বর সাহেবের মনে অত্যন্ত ফলপ্ৰদ হইয়াছিল। তদবধি যখনই তিনি উক্ত অন্ধকে দেখিতেন, তখনই বলিতেন, ইহার আগমন শুভ। যেহেতু ইহারই উপলক্ষে আল্লাহ আমাকে শাসন করিয়াছেন। পয়গম্বর সাহেব উক্ত অন্ধকে অত্যন্ত আদর যত্ন করিতেন এবং দুইবার তাহাকে মদিনায় কোন উচ্চপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ফল কথা এই যে, পয়গম্বর সাহেব কেবল অপরকেই উপদেশ দিতেন না, বরং নিজের আত্মাকে উপদেশ গ্রহণের নিমিত্ত সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক প্ৰস্তুত রাখিতেন।

সচরাচর যেরূপ প্ৰত্যেক পয়গম্পবরের সহিত হইয়া আসিয়াছে, সেইরূপ আরবীয় পয়গম্বরের বিরুদ্ধেও সাধারণের বৈরিতারূপ ঝঞ্চানিল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ধৰ্ম্ম সংক্রান্ত শক্ৰতা সাধনের নিমিত্ত পয়গম্বর সাহেব ও তদীয় শিষ্যমণ্ডলীর বিরুদ্ধে নূতন বিপদের সূত্রপাত হইতে লাগিল! অবশেষে অবস্থা এমন ভীষণ হইয়া দাড়াইল যে পয়গম্বর সাহেব সমুদয় মুসলমানকে আপন আপন প্ৰাণ লইয়া যত্রতত্র পলায়ন করিতে অনুমতি দিলেন। তখন হজরতের নিকট মাত্র একজন ব্যতীত আর কেহই রহিল না। কিন্তু পয়গম্পবর সাহেব স্বীয় কৰ্ত্তব্য তেমনই নিভীক চিত্তে পালন করিতে থাকিলেন। এই সঙ্কট সময়ে তাহার আরিকুল তাহার প্রাণ বিনাশের সুযোগ অন্বেষণ করিতে লাগিল। তাহার পিতৃব্য আবুতালেব আর সাহা করিতে না পারিয়া তাহাকে ডাকিয়া সয়েহে বলিলেন, “হে পিতৃব্য-প্ৰাণ! কথা শুন, অমূল্য প্রাণ এমন অবহেলায় হারাইস না। আরবের রক্ত পিপাসু খঞ্জরাসমূহ তোরই জন্য শাণিত হইতেছে! তুই নিবৃত্ত হ’, তোর বক্তৃতা বন্ধ কর।”

তাঁহার কথায় পয়গম্বর সাহেব অতি সাহসের সহিত যে উত্তর দিয়াছিলেন, তাহা চিন্তা করিবার উপযুক্ত বটে। তিনি বলিলেন :

“পিতৃব্যদেব! আমি নিরুপায়। আমি ত কিছুই করি না, কে যেন আমার দ্বারা করাইতেছে। যদি বিধৰ্ম্মীগণ আমাকে এক হস্তে সূৰ্য্য অপর হস্তে চন্দ্র দান করিয়া বলে, “তুমি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ কর, তবু নিশ্চয় জানিবেন, আমি এ কার্য হইতে বিরত হইব নাযে পৰ্য্যন্ত ঈশ্বরের সেরূপ ইচ্ছা না হয়। অথবা আমি আমার এই সাধনার নিমিত্ত প্ৰাণত্যাগ করিব। তবে যদি আপনি নিজের জন্য ভয় করেন ত বলুন, আমি এই মুহূৰ্ত্তে আপনাকে ছাড়িয়া অন্যত্র যাই—আমার আল্লাহ আমার সঙ্গে থাকিবেন।” এই বলিয়া পয়গম্বর সাহেব সাশ্রুনিয়নে গমনোদ্যত হইলেন।

কিন্তু পিতৃব্যের স্নেহের উৎস উথলিয়া উঠিল, তিনি ব্যস্তভাবে বলিলেন, “প্ৰাণাধিক! আমি তোকে কিছুতেই ছাড়িব না। তোর অরিকুল হইতে তোকে রক্ষা করিব। তুই নিৰ্ভয়ে আপন কাজ কর।”

কিন্তু ভদ্ৰ মহোদয়গণ! আরবীয় পয়গম্বরের এই স্নেহময় পিতৃব্য আর অধিক দিন তাহার সঙ্গে থাকিতে পারেন নাই। সেই ঘোর দুর্দিনে তিনি দেহত্যাগ করিলেন। আর এই বৎসরই তাহার পতিপ্ৰাণা বনিতা খাদিজা বিবিও প্ৰেম-পাশ ছিন্ন করিয়া অনন্ত ধামে প্ৰস্থান করিলেন। এই সময় বাস্তবিক পয়গম্পর্বর সাহেবের পক্ষে অতি কঠোর শোক ও বিপদাকীর্ণ পরীক্ষার সময় ছিল। রসূলের শত্রুপক্ষ এই সময় প্রবল হইতে প্রবলতর হইল। (আহা! বিপদ কখনও একা আইসে না)।

ক্রমে অবস্থা এমন ভয়ানক হইল যে, পয়গম্বর সাহেব মক্কা পরিত্যাগ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন। তখন হজরত আলী এবং আবুবকর সিদীক-মাত্র এই দুইজন ব্যতীত, তাহার নিকট আর কেহই ছিল না। তমোময়ী নিশীথে পয়গম্বর সাহেব ত আবুবকরকে সঙ্গে লইয়া মদিনা অভিমুখে যাত্রা করিলেন, এদিকে হজরত আলী তাঁহার শয্যায় শয়ন করিয়া রহিলেন যাহাতে শত্ৰুগণ নিশ্চিন্ত থাকে। মোহাম্মদ সাহেবের অরাতিকুল যথাকলে উন্মুক্ত কৃপাণ হস্তে তথায় উপস্থিত হইল; বস্ত্রাবরণ উন্মোচন করিয়া দেখিল, একি! এ ত মোহাম্মদ (দঃ) নহেন! এ যে আলী শয়ান রহিয়াছেন! উহারা তাহাকে কিছু না বলিয়া পয়গম্বর সাহেবের মস্তক আনয়নের নিমিত্ত বহুমূল্য পুরস্কার ঘোষণা করিল।

পয়গম্বর সাহেব যৎকালে একমাত্র সঙ্গী আবুবকর সিদীক সহ গমন করিতেছিলেন, তখন আবুবকর অত্যন্ত ব্যাকুল চিত্তে কহিলেন, “হে হজরত! আমরা ত মাত্র দুইজন!” তিনি উত্তর করিলেন, “না, না! আমরা তিন জন-ইহাদের একজন অতিশয় প্রতাপশালী— সমুদয় বিশ্বজগৎ এক দিকে, আর তিনি একা এক দিকে।” আবুবকর সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন, “হজরত! সে তৃতীয় জন দ্বারা আপনি কাহাকে বুঝাইতে চাহেন? ” উত্তর হইল, “সেই সৰ্ব্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত সঙ্গে আছেন।” এ কথায় আবুবকর নিশ্চিন্ত হইলেন।

পয়গম্বর সাহেব মদিনা নগরে উপস্থিত হইলেন। সেখানে তিনি আশাতীত যত্ন ও সমাদরে গৃহীত হইলেন। শত শত সমাজ-নেতা অগ্রসর হইয়া, তাহাকে আমন্ত্ৰণ করিয়া লাইতে আসিলেন, এবং তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন। হজরতের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অনুচরবর্গও ক্রমে ক্ৰমে মদিনায় আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু পয়গম্বরের বিপক্ষগণ সেখানেও তাঁহাকে নিশ্চিন্ত মনে তিষ্ঠিতে দিল না। তাহারা এবার সৈন্য সামন্ত সংগ্ৰহ করিয়া পয়গম্বর সাহেবকে আক্রমণ করিল। তখন পয়গম্বর সাহেবও কেবল আত্মরক্ষা কলেম্প স্বীয় ক্ষুদ্র যোদ্ধৃদল লইয়া বাহিরে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে প্রার্থনা করিলেন :

“জগৎপাতা! তুমি সমস্তই দেখিতেছি, এবং সবিশেষ অবগত আছ। অদ্য যদি আমার ক্ষুদ্র সেনাদল বিনষ্ট হইয়া যায়, তবে তােমার সত্য নাম প্রচার করিবার লোক আর কেহ থাকিবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তুমি সত্যের সহায় হইবে।”

অবশেষে এই প্রথম রক্ত প্রবাহিনী যুদ্ধ-যাহা বন্দরের যুদ্ধ নামে বিখ্যাত—হইয়া গেল। ওদিকে ত সহস্ৰ সহস্ৰ যোদ্ধা ধরাশায়ী হইল, এদিকে একশত বীরও ক্ষয় হইয়াছিল কি না। সন্দেহ। কাৰ্য্যতঃ ইহা সুস্পষ্টই বোধ হইতেছিল যে, মুসলমানদের পক্ষে কোন অদৃশ্য শক্তি যুদ্ধ করিতেছিল, তাই স্বল্প সময়ের মধ্যেই মোসলেমগণ সম্পূর্ণ জয়লাভ করিলেন। পয়গম্বর সাহেবের জীবনে এই প্রথম রক্তপাত-যাহা তিনি অনন্যোপায় হইয়া করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নতুবা তিনি এমন দয়ার্দ্রহৃদয় ও বিশ্বপ্রেমিক ছিলেন যে, দুৰ্দ্ধৰ্ষ লোকেরা তাঁহাকে ভীরু ও কাপুরুষ বলিত। এইরূপে কয়েকরার আরবের মোসলেম-বিদ্বেষিগণ মহা সমারোহে যুদ্ধায়োজন লইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করে, এবং পয়গম্বর সাহেব শুধু আত্মরক্ষাশিষ্যমণ্ডলীর প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত যুদ্ধ করিতে বাধ্য হন। পরস্তু সৰ্ব্বদা সত্য ও ঈশ্বরের অনুগ্রহ তাহার সঙ্গে থাকায় বিজয়ের উপর বিজয় লাভ করিতে থাকিলেন। এবং অযাচিত প্রভুত্ব লাভ করিলেন। এমনকি তিনি স্বাধীন রাজার ন্যায় সমগ্র আরব উপদ্বীপে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।

এই সময় পয়গম্বরের অতীত ও বৰ্ত্তমান জীবনে বিশেষ পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হইল। পূৰ্ব্বে লোকে তাহার প্রতি অত্যাচার করিলে তিনি তাহার প্রতিশোধ না লইয়া তাহাদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করিতেন। এখন তিনি সৈন্য সেনানী ও যথাবিধি সমর্যায়োজন রাখিতে বাধ্য হইলেন-যাহা একজন সম্রাটকে করিতে হয়। এবং অপরাধীকে শাস্তিদান করিতেও হইত। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তিনি অতি উচ্চ আদর্শের দয়া ও ন্যায় বিচার প্রদর্শন করিয়াছেন।

পয়গম্বর সাহেবের জন্মের পূর্বের অর্থাৎ যে সময়কে আরবীয় মুসলমানদের মূর্খতার যুগ বলা হয়, যুদ্ধে ধৃত বন্দীগণের প্রতি এমন নৃশংস নিৰ্য্যাতন করা হইত যে, তাহার তুলনা নিতান্ত অসভ্য বৰ্ব্বর জাতির মধ্যেও পাওয়া কঠিন। কিন্তু পয়গম্বর সাহেবের সময়ে যুদ্ধে ধৃত বন্দীদিগের প্রতি যেরূপ সদয়, সুভদ্র ব্যবহার করা হইত, তাহার আদর্শ অদ্যপি কোন অতি সভ্য দেশ ও সমাজে পাওয়া যাইবে কি না, সন্দেহ। একদা রণযাত্রাকালে তাঁহাদের সমভিব্যাহারে এক দল বন্দী ছিল। খাদ্য সামগ্ৰীতে (রাসাদে) আটা অল্প ছিল বলিয়া সংবাদ পাওয়া গেল; তচ্ছবিনে রসুলোল্লাহ আদেশ দিলেন যে, বন্দীদিগকে রুটী দান করা হউক, আর স্বাধীনেরা খৰ্জ্জুর ভক্ষণ করুক। (কি মহত্ত্ব!)

আর এক বারের ঘটনা এই যে, যুদ্ধ জয়ের পর, লুষ্ঠিত দ্রব্য যখন বণ্টন করা হইল, তখন পয়গম্বর সাহেব স্বীয় নিকটবৰ্ত্তী প্রিয় সহচরবৃন্দকে ভাগ লইতে দিলেন না। ইহাতে তাহারা ক্ষুব্ধ হইয়া পরস্পর আলোচনা করিতে লাগিলেন। পয়গম্বর সাহেব তাহা অবগত হইয়া, সহচরদের ডাকিয়া বলিলেন, “বন্ধুগণ! তোমরা জান, পূৰ্ব্বে তোমরা কিরূপ বিপন্ন ছিলে, আল্লাহ তোমাদের বিপন্মুক্ত করিয়াছেন; তোমরা একে অপরের রক্ত পিপাসু ছিলে, প্ৰভু তোমাদিগকে এখন ভ্রাতৃপ্রেম দান করিয়াছেন; তোমরা কোফরের (অধৰ্ম্মেীর) অন্ধকারে কারারুদ্ধ ছিলে, তিনি বিশ্বাসের নিম্পর্মল জ্যোতিতে তোমাদের মন আলোকিত করিয়াছেন। তাহার এই সকল অনুগ্রহপূরস্কার কি তোমরা প্রাপ্ত হও নাই?” তাহারা এক বাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ আমাদের অবস্থা বাস্তবিক এইরূপই ছিল, এবং এখন যে সুখ সম্পদ ভোগ করিতেছি, আল্লাহতালারই অনুগ্রহে এবং আপনার দয়ায় আমাদের ভাগ্যে ঘটিয়াছে।” তিনি উহাদের কথায় বাধা দিয়া বলিলেন, “না, নাং বল যে কেবল খোদার অনুকম্প ছিল। আর যদি তোমরা এইরূপ বলিতে ত’ আমিও সাক্ষ্য দিতাম। আমার সম্বন্ধে তোমরা ইহা বলিতে পার যে, তুমি এখানে পলায়ন করিয়া আসিয়াছ, আমরা তোমায় আশ্রয় দিয়াছি; তুমি দুঃখচিন্তা ভারাক্রান্ত ছিলে, আমরা তোমায় সাত্ত্বনা দিয়াছি।” (এ কথায় তাহারা কোন উত্তর দিলেন না। তাঁহাদিগকে মৌনাবলম্বন করিতে দেখিয়া) পুনরায় পয়গম্বর সাহেব বলিলেন, “হে প্রিয় সহচরবৃন্দা! লুষ্ঠিত দ্রব্যের বিনিময়ে কি তোমরা আমাকে পাইতে ইচ্ছা কর না? খোদার কসম! খোদার সমস্ত রাজ্য বিপক্ষে দাড়াইলেও মোহাম্মদ আপনি সহচরদের পক্ষে থাকিবে, যে হেতু তাঁহারা বিনা স্বার্থে-শুধু ঈশ্বরোদেশে কষ্ট স্বীকার করিতেছেন।”

পয়গম্বর সাহেবের এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার সুফল এমন হইল যে, উক্ত সহচরীগণর্যাহারা মরিতে মারিতে নিভীক, শৌৰ্য বীৰ্য্যে সিংহ-তুল্য জাতি ছিলেন, এক্ষণে দর বিগলিত ধারায় অশ্রু বিসৰ্জন করিতে লাগিলেন এবং বলিলেন, “হে রসুলাল্লাহু! আমাদের বাৰ্ত্তমান। অবস্থায় সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হইয়াছি।”

আমার হিন্দু ভ্রাতৃগণ! আপনারা বাস্তবিক আরবীয় পয়গম্বরের অবস্থা কিছুমাত্র অবগত নহেন। আপনারা এ অলৌকিক ঐশিক শক্তি দেখিতে সক্ষম নহেন, যাহা তাঁহার সহস্ৰ সহস্র শিষ্যকে কষ্ট স্বীকার তা তুচ্ছ—মৃত্যুর সম্পমুখীন করিয়াছে; যাহা কোটী কোটী লোকের অন্তরে ঈশ্বর প্ৰেম অঙ্কিত করিয়াছে আপনারা আরবীয় পয়গম্ববরের নিরহঙ্কার ভাবও আত্মত্যাগের বিষয় একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন ত! তিনি অনুবৰ্ত্তিগণকে এই শিক্ষাই দিয়াছেন যে তাঁহাকে যেন কেহ দেবতা কিম্বাবা অমাধারণ ব্যক্তি বলিয়া জ্ঞান না করে। তিনি বার স্বার বলিয়াছেন, “আমি তোমাদেরই মত মানুষ, এইমাত্র প্রভেদ যে, আমি তাহার (খোদার) দূত, তাহার সংবাদ তোমাদিগকে পেঁৗছাই।” পয়গম্বর সাহেবের নিরভিমান ও সরলতার প্রমাণ এতদপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পারে। যে সময় তিনি রাজাধিরাজ সম্রাট ছিলেন, তখন স্বহস্তে আপন জীর্ণবস্ত্রে চীর সংলগ্ন করিতেন-ছিন্ন পাদুকা স্বহস্তে সেলাই করিতেন! তাহার শান্ত স্বভাব সম্বন্ধে তদীয় ভূত্য আনাস বলিয়াছেন, “আমি দশ বৎসর তাঁহার নিকট ছিলাম, তিনি কদাচ অপ্রিয় বচন কহিবেন দূরে থাকুক, আমার ‘তুই’ পর্য্যন্ত বলেন নাই।” (হাদীস শরীফে তুই শব্দের উল্লেখ নাই), ভ্রাতৃগণ! এমনই আড়ম্বর-শূন্য জীবন ছিল সেই সম্রাটের, যিনি ইচ্ছা করিলে পরিচর্য্যার জন্য সহস্রাধিক দাস দাসী রাখিতে পারিতেন!

আরবীয় পয়গম্বর যে “মিশনের জন্য জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহ সমাধা করিলে পর সেই (দারুণ) সময় আসিল, যখন একদিন (মৃত্যুর কিছুদিন পূৰ্ব্বে) রোগক্লিষ্ট অবস্থায় তিনি বহু কষ্টে নমাজের নিমিত্ত মসজিদে আনীত হইলেন। (নামাজ শেষ হইলে) তিনি আপন পীড়িত ক্ষীণ কণ্ঠ যথাশক্তি উচ্চ করিয়া বলিলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা সাধারণে ঘোষণা করিয়া দাও, যদি আমি এ জীবনে কাহারও প্রতি অত্যাচার অবিচার করিয়া থাকি, তবে সে অদ্য আমা হইতে প্ৰতিশোধ লউক, পরলোকের জন্য যেন স্থগিত না রাখে। যদি কাহারও কিছু প্রাপ্য থাকে, সে ঋণ শোধের নিমিত্ত আমার ঘরদ্বার তাহাকে সমর্পণ করিতেছি। অদ্য আমি সকল প্রকার জবাবদিহির জন্য উপস্থিত আছি।”

একজন বলিল, হজরতের নিকট তাহার ত্রিশ “দেরেম’ পাওনা আছে, তাহা রসুলোল্লাহ তম্মমুহূৰ্ত্তে শোধ করিলেন।(7) এই তাঁহার মসজিদে শেষ আগমন। অতঃপর ৬৩২ খৃষ্টাব্দে ৮ই জুন আরবীয় পয়গম্বর নশ্বর মৃন্ময় দেহত্যাগ করলেন, যাহাতে অতি উচ্চ অনন্তধ্যমে গিয়া স্বীয় প্রতিষ্ঠিত ধর্ম্মের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে পারেন। এই জীবন অতি উচ্চ, পবিত্র বিস্ময়কর এবং বাস্তবিক খোদার পয়গম্ববরেরই যোগ্য ছিল। (অবশ্য, সাধারণ মানবের জীবন এরূপ হওয়া অসম্ভব)।

ভদ্ৰ মহোদয়গণ! এখন আমি আপনাদিগকে আরবীয় পয়গম্ববরের প্রতি যে সব অন্যায় দোষারোপ করা হয়, তাহার বিষয় বলিতেছি। অনভিজ্ঞতা ও ন্যায়ান্যায় জ্ঞানাভাবে, অথবা শুধু কুসংস্কারবশতঃ রসূলের প্রতি ঐসব দোষারোপ করা হইয়া থাকে। তাহার একতম দোষ এই বলা হয় যে, তিনি র শেষভাগে সৰ্ব্বশুদ্ধ ৯জন মহিলার পাণিগ্রহণ করেন। তিনি বিবাহ করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আপনারা কি আমাকে বুঝাইয়া দিতে পারেন যে, সেই ব্যক্তি, যিনি ২৪ বৎসর বয়ঃক্রম পৰ্যন্ত কোন প্রকার “মকারাদি” কু অবগত ছিলেন না, পরে নিজের অপেক্ষা অনেক অধিক বয়স্ক একটি বিধবার পাণিগ্রহণ করিয়া তাঁহারই সহিত অতি সুখে জীবনের ২৬টি বৎসর যাপন করিলেন; তিনি শেষ বয়সে, যখন মানুষের জীব নিৰ্ব্বাপিত প্রায় হয়, শুধু আত্মসুখের জন্যই যে কতকগুলি বিবাহ করিবেন, তাহা কি সম্ভব? যদি ন্যায় বিচারের সহিত বিবেচনা করেন, তবে আপনারা বেশ জানিতে পরিবেন।– সে বিবাহের উদ্দেশ্য কি ছিল। প্ৰথমে দেখিতে হইবে, তাহারা (হিজরতের পত্নিগণ) কোন শ্রেণীর কুলবোলা ছিলেন, আর কেনই বা তাঁহাদের রসুলের প্রয়োজন ছিল।—কতিপয় নারী এরূপ ছিলেন যে তাঁহাদের বিবাহের ফলে রসুলের পক্ষে ‘নূর-ইসলাম’ প্রচারের সুবিধা হইল। আর কয়েকজন। এরূপ ছিলেন যে, বিবাহ ব্যতীত তাহদের ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অন্য কোন উপায় ছিল না।

আরবীয় পয়গম্ববরের প্রতি আর একটি দোষারোপ এই করা হয় যে, তিনি রক্তপাতের প্রশ্রয় দিতেন এবং কারণে অকারণে কাফের হত্যা করিতে আদেশ দিতেন। এখন এ সম্পবন্ধে আপনারা আমার বক্তব্য শ্রবণ করুন। যখন আইনের দুই দফা প্রায় একই প্রকার হয় অর্থাৎ একটি কোন সৰ্ত্তের অধীন এবং অপরটি সত্তাবিহীন তখন সৰ্ত্তহীন ধারাও সৰ্ব্বদা সৰ্ত্তাধীন ধারা বলিয়াই মানিতে হয়। মুসলমানদের শাস্ত্রকারগণ সৰ্ব্বদা এ বিষয়ের সম্মান রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন এবং কোরআনের বচনসমূহেও একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যথা একস্থলে বলা হইয়াছে, “কাফেরকে হত্যা কর,” এবং অপর স্থলে বলা হইয়াছে, “হত্যা কর, যদি তাহারা তোমাদের ধৰ্ম্মকর্ম্মে বাধা দেয়।” এখন আমি আপনাদিগকে সেই মূল্যবচনসমূহের-যাহা রসূলের প্রতি প্রত্যাদেশ হইয়াছে, শাব্দিক অনুবাদ শুনাইতেছি। আমি নিজের ভাষায় বলিব না, কারণ যদি আপনারা মনে করেন যে আমি তাহাদের (মুসলমানদের) ধৰ্ম্মপ্রচার করিতেছি। তবে শ্রবণ করুন :

“যদি তাহারা তোমাদের প্রতি শত্রুতচরণ হইতে নিবৃত্ত হয়, তবে যাহা হইয়া গিয়াছে, ক্ষমা করা যাউক। কিন্তু যদি তাহারা তোমাদিগকে আক্রমণ করিতে অগ্রসর হয়, তবে পূৰ্ব্ববৰ্ত্তী পয়গম্বরদের প্রতি বিরুদ্ধাচরণের নিমিত্ত যেরূপ শাস্তি দেওয়া গিয়াছে সেইরূপ শাস্তি ভোগ করবে। এজন্য উহাদের সহিত যুদ্ধ করা যে পৰ্যন্ত উহারা পৌত্তলিকতা রক্ষার নিমিত্ত তোমাদের বিরুদ্ধাচরণে নিবৃত্ত না হয় এবং অদ্বিতীয় খোদার ধৰ্ম্মকে অমান্য করে, যুদ্ধ করিতে থাকে। আর যদি তাহারা মানে তবে নিশ্চয় জানিও আল্লাহ তাহদের কার্য্যকলাপ পৰ্য্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু যদি তাহারা সত্যাধর্ম্মের বিরোধী হয় তবে আল্লাহ তোমাদের সহায় হইবেন। তিনি সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ অভিভাবক এবং সাহায্যকৰ্ত্তা।”

আর একটি বিষয়, যাহা পয়গম্বরকে উপদেশ দানের নিমিত্ত কোরআনে অবতীর্ণ হইয়াছে, আপনাদের শ্রবণগোচর করিতেছি :

“মনুষ্যদিগকে নাম মৃদু ভাষায় যুক্তি সহকারে উপদেশ দিয়া আল্লাহতালার ধৰ্ম্মপথে আহবান করা; তাহদের সহিত অতিশয় ধৈৰ্য্য, ও গান্তীৰ্য্যের সহিত সদয়ভাবে তর্ক কর, কেন না। উহাদের কে সত্য পথ ভুলিয়া ভ্রান্ত হইয়াছে এবং কে সত্যপথে আছে তাহা আল্লাহ সবিশেষ অবগত আছেন। যদি তুমি প্রতিশোধ লও। তবে লক্ষ্য রাখিও যে তাঁহা তোমার প্রতি যে অত্যাচার অনাচার হইয়াছে (ন্যায় বিচার অনুসারে) তাহার সমান হয়; আর যদি তুমি প্রতিশোধ না লইয়া সহ্য কর তবে সাবের (সহিষ্ণু) ব্যক্তির পক্ষে আরও ভাল কথা। সুতরাং ভাল হয় যদি শক্ৰদের প্রপীড়ন ধীরতার সহিত সহ্য কর। কিন্তু স্পমরণ রাখিও তোমার কাৰ্যকলাপ তবেই সফল হইবে, যখন তাহার সহিত আল্লাহতালার অনুগ্রহ মিশ্রিত থাকিবে। কাফেরদের ব্যবহারে দুঃখিত হইও না, এবং উহাদের চাতুরী শঠতায়ও ব্যতিব্যস্ত হইও না, কারণ আল্লাহ তাহারেই সাহায্য করেন—যাহারা সাধু ও ন্যায়পরায়ণ হয় এবং তাহাকে ভয় করে।”

আর একটী উপদেশ শ্ৰবণ করুন; -“ধৰ্ম্ম কম্পম ব্যাপারে কাহারও প্রতি অত্যাচার করিও না; যদি সে ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্রহণ করে তবে বুঝিও আল্লাহ তাহাকে সৎপথ প্রদর্শন করিয়াছেন, আর যদি ধৰ্ম্ম স্বীকার না করে তবে আর কি করা-তোমার কাজ ত কেবল উপদেশ দান ও প্রচার করাই ছিল।”

আরও শ্রবণ করুন,-পয়গম্বর সাহেব কাফেরের কিরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, “কাফের তাহারাই যাহারা ন্যায় বিচারের বিপরীত কাৰ্য্য করে; পাপী কেবল তাহারাই যাহারা ইসলাম ধৰ্ম্মের বাহিরে।” ইহাতে সুস্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে ইসলাম ধৰ্ম্মের বৃত্তি তত সঙ্কীর্ণ নহে যে কেবল পয়গম্বর সাহেবের শিষ্যবর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে।

আর একস্থলে (প্রত্যাদেশ) আসিয়াছে যে “যদি তাহারা তোমাদের বিরোধী হইয়া যায় কিন্তু তোমাদের সহিত যুদ্ধ কলহ না করে আর তোমাদের সহিত বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করে

ভুল হাদিগকে হত্যা করা কিবা তাহাদের বশীভূত করিতে চেষ্টা করা ঈশ্বরাদেশের বিরুদ্ধ।

উপস্থিত মহোদয়গণ আপনারা কি বলিতে পারেন যে ইহা ন্যায় বিচারের কথা হইবে যে আমরা পয়গম্বর সাহেবের তাদৃশ মিলনপ্ৰয়াসী শান্তিসূচক বচনসমূহের প্রতি-যাহা সেরূপ যুদ্ধ কলহ এবং অত্যাচারের যুগে বলা হইয়াছিল, একটু মনোযোগ না করি, আর কেবল ঐ সকল বচন, যাহা তিনি কোন এক ক্ষুদ্র সৈন্যদলকে প্রবল শত্রুর সম্পমুখীন হইবার সময় উৎসাহিত করিবার জন্য বলিয়াছিলেন, সেগুলিকে ধরিয়া লই? আর আমার মতে যে কোন সেনাপতি এরূপ স্থলে থাকিতেন, তিনি এতদপেক্ষা অধিক যোগ্যতার কাজ আর কি করিতেন?

বেশ, এখন আপনারা সেই শান্তিপ্রিয়তা শিক্ষার আর একটি দৃষ্টান্ত, যাহা পয়গম্বর সাহেবের স্বকীয় ব্যবহারে দেখা যায়, একটু সমালোচনা করিয়া দেখুন ত অত্যাচার এমন কোন ছিল না, যাহা পয়গম্ববরের প্রতি করা হয় নাই,–আর তিনি তাহা ক্ষমা না করিয়াছেন; কোন নিৰ্য্যাতন এমন হয় নাই যাহা তিনি ক্ষমা করিতে প্ৰস্তুত না ছিলেন। হে ভ্ৰাতৃগণ! কোন ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা জানিতে হইলে তাহাকে ঠিক সেইভাবে দেখুন যে অবস্থায় তিনি বাস্তবিক থাকেন, কুসংস্কারের চশমা পরিয়া দেখিবেন না।

প্রত্যেক ধৰ্ম্মেই কিছু না কিছু দোষ জমিয়াই থাকে; সমস্ত সাধু প্রকৃতি লোকের কাৰ্যকলাপে কোন না কোন দোষ থাকেই, বিধৰ্ম্মী এবং মূখ শিষ্য একে আর বুঝিয়া থাকে। কোন ধৰ্ম্ম দেখিতে হইলে সেই ধৰ্ম্মাবলম্ববীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকে দেখা উচিত; তাহা না করিয়া কোন নরাধমকে দেখিয়াই তাঁহাকেই দৃষ্টান্ত বলিয়া ধারণা করা অন্যায়। তবেই আমরা একে অপরকে ভ্ৰাতার ন্যায় ভালবাসিতে শিখিব এবং বন্য অসভ্যদের মত একে অপরকে ঘূণার চক্ষে দেখিব না।

আমার দুঃখ হইতেছে যে সময়াভাবে আমি ইসলামের শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় সম্বন্ধে কিছু বলিতে পারিলাম না। যদিও সে বিষয়টিও আপনাদের ভাল লাগিত কিন্তু তাহা তত প্রয়োজনীয় নয় বলিয়া আমি এস্থলে সে বিষয় পরিত্যাগ করিলাম।

প্ৰত্যেক ধর্ম্মেই বাহ্যিক অবস্থার পরে দর্শন থাকে। যদি এ সময় ইসলামের বাৰ্ত্তমান অবস্থায় আমরা তাহার স্বল্পতা দেখিতেছি, (তাহাতে বিশেষ ক্ষতি নাই) কারণ, আমরা যখন সেই সময়ে-যখন ইসলামের জ্যোতি আরম্ভ হইয়াছিল, দৃষ্টিপাত করি তাহার গুণ ব্যাখ্যার উপযুক্ত ভাষা ও শব্দ পাই না।

এখন আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখুন, আরবীয় পয়গম্বর তের শত (১৩০০) বৎসর পূৰ্ব্বে শিক্ষার উপকারিতা সম্বন্ধে কি বলিয়াছিলেন -“বিদ্যা শিক্ষা কর; যে বিদ্যা শিক্ষা করে সে নিম্পর্মল চরিত্র হয়; যে বিদ্যার চর্চা করে সে ঈশ্বরের স্তব করে; যে বিদ্যা অন্বেষণ করে সে উপাসনা (এবাদত) করে; যে উহা শিক্ষা দেয় সেও উপাসনা করে; শিক্ষাই সুপথ প্রদর্শন করে; শিক্ষাই নিৰ্জ্জনে নিৰ্ব্বাসনে প্রকৃত বন্ধুর কাজ করে; বনবাসে সাত্মনা প্রদান করে; বিদ্যা আমাদিগকে উন্নতির মাৰ্গে লইয়া যায় এবং দুঃখে সহানুভূতি প্রকাশ করে। বন্ধু সভায় বিদ্যা আমাদের অলঙ্কার স্বরূপ; শত্ৰু সম্পমূখে অস্ত্র স্বরূপ।(8) বিদ্যার দ্বারা আল্লাহতায়ালার বিপন্ন দাস পুণ্যের সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়।”

পয়গম্বর সাহেবের নিম্নোক্ত বচনসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে আমি ভক্তিপ্রেমে অভিভূত হইয়া পড়ি। তিনি বলিয়াছেন, “বিদ্বানের (লিখিবার) মসী শহীদ (ধৰ্ম্মৰ্থ সমরশায়ী)-দের রক্তাপেক্ষাও অধিক মূল্যবান।” ভ্রাতৃগণ! বিদ্যার গৌরব বর্ণনা। এতদপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পারে?

হজরত আলী যিনি পয়গম্বর সাহেবের প্ৰিয় জামাতা ছিলেন, আর র্যাহার সম্পবন্ধে পয়গম্বর সাহেব বলিয়াছেন যে “আলী ইসলামে বিদ্যা জ্ঞানের দ্বার স্বরূপ।” মুসলমানদের মধ্যে হজরত আলীই প্ৰথমে এলমে-এলাহী প্রচার আরম্ভ করেন। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে হজরত আলীর যে সকল বক্তৃতা আছে তাহা পাঠের উপযুক্ত। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহের সময়ও (যুদ্ধক্ষেত্রে) ধৰ্ম্ম বক্তৃতা (খোতবা) পাঠ করিতেন।

বিদ্যার প্রশংসা বিষয়ে আলীর রচনাবলী হইতে কয়েকটি আমি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি :

“অন্তর আলোকিত করিবার জন্য সুশিক্ষা উজ্জ্বল রত্ন; সত্য তাহার (বিদ্যার) লক্ষ্য; ঈশ্বরতত্ত্ব (এলহাম) তাহার পথ প্রদর্শক; বুদ্ধি (সুবোধ?) তাহাকে গ্রহণ করে; বানরের ভাষায় বিদ্যায় যথোচিত প্ৰশংসা হইতে পারে না।”

ওদিকে মুসলমানেরা দেশসংক্রান্ত কৰ্ত্তব্যসাধনে মগ্ন ছিলেন, এদিকে হজরত আলীর শিষ্যবৰ্গ শিক্ষা বিস্তার করিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁহারা যেখানেই যাইতেন শিক্ষার মশাল সঙ্গে লইয়া যাইতেন, তাহার ফলে এই হইল যে খৃষ্টীয় চতুৰ্দশ শতাব্দী পৰ্যন্ত ইসলামের শিশুদের হন্তেও শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রদীপ দেওয়া হইয়াছিল। যেখানে তাঁহারা দেশ জয় করিতেন, সেইখানেই পাঠশালা ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন। ইহার প্রমাণস্বরূপ কাহেরা, বাগদাদ, হিসপ্যানিয়া এবং কার্ডাভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রদর্শন করিতেছি।(9)

ইংলণ্ডের লোকদিগকে মুসলমানরাই তাহাদের বিস্মৃত বিদ্যার বর্ণমালার পুস্তকাবলী অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন। তাঁহারা জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছেন, ভারতবর্ষের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক পুস্তকের অনুবাদ করাইয়াছেন; রসায়ন এবং অঙ্কশাস্ত্রের পুস্তকাবলী রচনা করিয়াছেন।

জনৈক পোপ (দ্বিতীয় মিস্লউটিয়ার) যিনি খ্ৰীষ্টীয় ধৰ্ম্মের অতি উৎকৃষ্ট পণ্ডিত ও গুরু ছিলেন, তিনি মুসলমানদেরই কার্ডাভা মাদ্রাসায় অঙ্কশাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিলেন। এই কারণে লোকে তাঁহাকে বিধর্ম্মী বলিয়া জনসমাজে অপদস্থ করিয়াছিল এবং তাঁহাকে “শয়তানের বাচ্চা” বলিয়াছিল। ইহাতে স্পষ্টই জানা যায় সে সময় ইউরোপের খ্ৰীষ্টীয় বিভাগ কেমন ঘোর মুখতায় তমসাচ্ছন্ন ছিল, আর কেবল ইসলামের অনুবৰ্ত্তিগণই তাহাদিগকে (ইউরোপীয়দিগকে) জ্ঞানের আলোকরশ্মি দেখাইতেছিলেন।

মুসলমানেরা শিল্প এবং আবিষ্কারেও পশ্চাৎপদ ছিলেন না। অনুবীক্ষণ যন্ত্র তাহারাই নিম্পর্মাণ করেন; পৃথিবীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের পরিমাণ র্তাহারাই স্থির করেন। গ্ৰীকদের নিকট হইতে র্তাহারা অঙ্কবিদ্যালাভ করেন; সঙ্গীত ও কৃষিবিদ্যাকে তাহারা উন্নতির চরম সীমায় উপনীত করিয়াছিলেন। তাহারা এই পৰ্য্যন্ত করিয়াই নিশ্চিন্তু ছিলেন না, বরং ধর্ম্মের দর্শন তত্ত্বের অতি সূক্ষ্ম আলোচনা করিয়া “ফানাফিল্লাহ’র গুঢ় তত্ত্বে উপনীত হইয়াছেন। তাঁহারা প্রচার করিলেন যে আল্লাহ অদ্বিতীয় এবং সমুদয় মানবজাতি এক জাতীয় (মানবের মধ্যে জাতিভেদ নাই)। আর এই বিধান তাহারা অতি মনোরম ভাষায় বুঝাইয়াছেন।

হে হিন্দু ভ্রাতৃগণ! আপনারা যদি ঐ শাস্ত্রবিধানসমূহের বিষয় চিন্তা করেন ত আপনারা উহাকে প্রকৃত (আসল) বেদান্ত স্বরূপ পাইবেন; মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণ ছয় শত বৎসর পৰ্যন্ত শিক্ষা উন্নতির দিকে অগ্রসর হইয়াছিল। অদ্য যদি আমার মুসলমান ভ্রাতৃগণ নিজেদের ঐ সকল জগন্মান্য পূৰ্ব্বপুরুষদের রচিত শিক্ষা সংক্রান্ত পুস্তকাবলী আধুনিক প্রচলিত ভাষায় অনুবাদ করিয়া লয়েন এবং সৰ্ব্বসাধারণে ঐ শিক্ষা প্রচার করেন তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাহারা ইসলামী দর্শনকে সমস্ত জগতের শীর্ষস্থানে তুলিতে সক্ষম হইবেন। আর ইসলামের আবালবৃদ্ধবনিতা— (কচি কচি শিশুগণ)ও ইসলামী দর্শন কণ্ঠস্থ করিতে পরিবে। (যেমন হিন্দুগণ এখন আপন বেদান্ত প্রচারে মনোযোগী হইয়াছেন)। আপনারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন যে তাহারা ইসলামের প্রকৃত গৌরব সৃষ্টি জগৎকে দেখাইবার জন্য কিরূপে ধর্ম্মের সেবা করিয়াছেন।

হজরত মোহাম্মদ, হজরত ঈসা, রাজদশত, মুসা, মহর্ষি বুদ্ধদেব—সকলে একই অট্টালিকায় আছেন। তাহারা এক জাতি হইতে অন্য জাতিকে ভিন্ন মনে করেন না। আর আমরা যে তাঁহাদের সামান্য শিষ্য, তাহাদের শিশু সন্তান-আমাদের উচিত যে তাঁহাদের বিশ্বপ্রেমের সারাতত্ত্ব লাভ করি। প্রেম দ্বারাই তাহারা আমাদের নিকটবৰ্ত্তী হন। পয়গম্বর মোহাম্মদ সাহেব’ স্বেচ্ছায় স্বীয় শিষ্যের নিকটবৰ্ত্তী হন না, যে পৰ্য্যন্ত শিষ্য মনের কঠোরতা দূর না করে এবং তাহার হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার না হয়।

হে আমার মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ! পয়গম্বর সাহেব যেমন আপনাদের সেইরূপ আমাদেরও আপন। যত পয়গম্বর মানবজাতির কল্যাণের নিমিত্ত জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, সকলের উপরই আমাদের দাবী (হক) আছে। আমরা তাহাদিগকে ভালবাসি, তাহদের সম্পমান করি এবং তাঁহাদের সম্পমূখে অতি নম্নভাবে ভক্তি সহকারে মস্তক অবনত করি।

খোদার নিকট এই প্র্যর্থনা করি যে তিনি সকলেরই আল্লাহ;- তিনি আমাদিগকে এইরূপ বুঝিবার শক্তি দান করুন যে তাহার নামের জন্য যেন আমরা পরস্পরে ঝগড়া না করি।–আমাদের শিশুসুলভ দূৰ্ব্বল অধরে যে নামই উচ্চারিত হউক না কেন-কিন্তু তিনিই ত অদ্বিতীয় এবং সকলেরই উদ্দেশ্য (উপাস্য) একমাত্র তিনিই।(10)

——————
1. আশ্চর্য্যের বিষয়, এই সভ্যযুগেও বঙ্গীয় মুসলমানদের ঘরে ঐরূপ বংশানুক্রমে চিরস্থায়ী বিবাদ দেখা যায়। এইজন্য আমরা কলিকাতা হাইকোর্টে “Hereditary enemy” শব্দ শুনিতে পাই। আহা! কবে আমাদের প্রতি খোদাতালার রহমৎ হইবে!
2. হিজরতের পিতামহ আবদুল মুত্তালিব যে স্বীয় পুত্র হজরত আবদুল্লাকে প্রস্তরমূৰ্ত্তির নিকট বলিদান করিতে গিয়েছিলেন, এ কথার সত্যতায় আমার একটু দ্বিধা বোধ হয়। আলেম ফাজেলগণ দয়া করিয়া আমার সন্দেহ ভঞ্জন করিলে বিশেষ বধিত হইব। বাঙ্গালা “আমির হামজা” পুঁথিতে দেখিয়ছি, – (হজরত আবদুল মুত্তালিবের অন্য পুত্র হজরত আমির হামজা পিতাকে বলিলেন)-
“কাফেরে খাজনা দিবে মোছলমান হৈয়া।
আমি এয়ছা বেটা তবে কিসের লাগিয়া।।”
3. ইহা মিসিস বেশান্তের অতিশয়োক্তি। (আল-এসলাম সম্পাদক)
4. মিসিস এনি বেশন্তের বর্ণিত মুসলমান কি আমরাই? ছিঃ! ছি:! ধিক আমাদের! আমরা মুসলমান নামের কলঙ্ক। বঙ্গদেশে দড়ি ও কলসী একেবারে নাই কি?
5. অল্পদিন হইল-মুসলমান গ্ৰন্থকাবগণ ইংরাজী ভাষায্য এসলাম-সম্বন্ধে পুস্তক পুস্তিকা লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন, ইহার পূৰ্ব্বে ইউরোপে এসলাম সম্বন্ধীয় সমস্ত জ্ঞাতব্যই খ্ৰীষ্টান মিশনের এজেন্সী হইতে সংগ্ৰহ করা হইত-কাজেই অজ্ঞ ইউরোপ এসলামের নামে একেবারে শিহরিয়া উঠিত। এই অল্পদিনের চেষ্টায় কিরূপ ফল হইয়াছে, এই বক্তৃতা হইতেই তাহার আভাষ পাওয়া যাইতেছে। লর্ড হেড্রলি, খাজা কামালুদ্দিন, মিঃ, এহয়-উন-নাসর পর্কিনসন প্রভৃতি মুসলমান লেখকগণের চেষ্টায় ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের কিরূপ মত পরিবর্তন হইতেছে, “Islamic Review” পত্র পাঠ করিলে তাহা সম্যক অবগত হওয়া যাইতে পারে। আল-এসলাম-সম্পাদক।
6. মিসিস বেশান্ত এখানে দুইটী ঘটনা ভ্রমক্রমে এক বর্ণনার ভিতর ফেলিয়াছেন। অমুসলমানের পক্ষে এইরূপ ভ্ৰম মার্জনীয় (আল এসলাম–সম্পাদক)
7. মিসিস এনি বেশান্তি এ স্থলে “আক্কাসের তাজিয়ানৱ” বিষয় উল্লেখ করেন নাই; আমার মনে হয় এজন্য “প্রতিশোধ” বিষয়টি অঙ্গহীন ও অসম্পূর্ণ রহিয়াছে। সে তাজিয়ানার কথা এই :
কোন এক দিন হজরত কোন কারণে আক্কাস নামে এক ব্যক্তিকে এক ঘা কোড়া মাবিয়াছিলেন। অদ্য সেই আক্কাস মসজিদে আসিয়া সেই কোডার প্রতিশোধ পাইবোব দাবী কবিল, তখন বসূল, তাহার হস্তে কশাঘাত গ্ৰহণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। ইহা দেখিয়া উপস্থিত সহচরবৃন্দ ও আত্মীযবান্ধবগণ অত্যন্ত শোকসন্তপ্ত ও উদ্বিগ্ন হইলেন; যেহেতু হজরত এমন পীড়িত অবস্থায় কোড়াব আঘাত কিছুতেই সহ্য করিতে পরিবেন না। র্তাহারা অনুনয বিনয় কবিয়া আক্কাসকে নিবৃত্ত হইতে, অথবা রসুলের পবিবৰ্ত্তে তাঁহাদের গাত্রে একাধিক কোড়া মারিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু আক্কাস তাহাদের কোন কথায় কৰ্ণপাত কবিল না। তখন তাহাবা অতিশয় অধীব হইয়া ক্ৰন্দন ও বিলাপ কবিতে লাগিলেন,-নিষ্ঠুর আক্কাস করে কি? হায় হায, বসুল হত্যা করিবে; হজরত কিন্তু অবিচলিত চিত্তে আক্কাসকে তাহার আকাঙ্গিক্ষত প্রতিশোধ লহঁতে ইঙ্গিত কবিলেন। সে বলিল, “হজরত! আমি নগ্ন পণ্ঠে আপনার কোড়ার আঘাত পাইয়াছিলাম।” এতচ্ছবণে রসূলে করিম তৎক্ষণাৎ গাত্রবস্ত্র উন্মোচন করিয়া নগ্নদেহে কশাঘাত গ্ৰহণ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন। বলি, আজ পর্যন্ত জগতে কেহ ঐরূপ ঋণ পবিশোধ করিতে পাবিয়াছে কি? আমার বিশ্বাস বসুলকে গাত্র বস্ত্র মোচন কবিতে দেখিযা স্বর্গদূত (ফেরেশতা) পর্যন্ত কম্পিত হইয়াছিলেন! এরূপ। মাহাত্ম্যু আরও কোন মহাপুরুষ দেখাইতে পারিয়াছেন কি? আক্কাস অবশ্য রসূলকে কোড়া মারিবার অভিপ্ৰায়ে আসিয়াছিল না, তাহার উদ্দেশ্য ছিল হজরতের পবিত্র পৃষ্ঠ চুম্বন করা। সে উদ্দেশ্য সফল হইল-ত্রুদনের রোলের মধ্যে ভক্তির জয় জয়কার ঘোষিত হইল।
–লেখিকা।
8. সুশিক্ষার কল্যাণে শত্রু জয় করা যায় একথা ধ্রুব সত্য। ঐ কারণেই বোধ হয় নারী বিদ্বেষী মহাশয়গণ স্ত্রী শিক্ষায় আপত্তি করেন। যেহেতু তাহা হইলে স্ত্রীলোকের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়! শুনিয়াছি, করটীয়ার প্রসিদ্ধ জমিদার মরহুম জমবরদন্নেসা খানম সাহেবা নাকি বলিয়াছেন, “এখন মরদের হাতে কলম; একবার জানোনার হাতে কলম দিয়া দেখা।” ইংরাজী প্রবচন বলে। “Pen is mightier than sword” –লেখিকা
9. আমাদের সদাশয় বৃটিশ প্ৰভুৱা দাবী করেন যে তাহারা অনুগ্রহপূর্বক ভারতবর্ষ জয় করিযাছেন বলিয়াই আমরা (বৰ্ব্বারবা) শিক্ষার আলোক প্রাপ্ত হইয়াছি। আর আমরাও নত মস্তকে স্বীকার করিয়া বলি যে,-“ইয়ে হয় আহলে মগরেবকে বরকৎ কদমকী” (ইহা পশ্চিম দেশবাসিদিগের শ্ৰীচরণের প্রসাদ)। কিন্তু মিসিস বেশান্ত ত বলেন যে শিক্ষা বিস্তার বিষয়ে মুসলমানেরাই ইউরোপের শিক্ষা গুরু।
10. এই সকল বিষযেব সহিত আমাদের মতানৈক্য নাই। মিসিস এনি বেশান্তি মহোদয়া থিওসোফীী একজন লর প্রতিষ্ঠ প্রচারক ও শিক্ষা গুরু। তিনি নিজের শিক্ষা ও ধর্ম্মের দিক দিয়া এসলামের সমালোচনা করিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার সব কথার সহিত আমাদের মতের মিল থাকিতে পাবে না। এসলামেী প্রকৃত স্বকাপ এখনও বহুস্থলে অপ্রকাশিত বহিয়াছে। আমরা যদি যথাযথভাবে ঐ স্বরূপটা জগতের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারি, তাহা হইলে প্রত্যেক ন্যায়দর্শী ও সত্যানুসন্ধিৎসু হৃদয়ই তাহার নিকট আত্মদান করিতে বাধ্য হইবে। আল্লার খেরিত সমস্ত ধৰ্ম্মপ্রচারক যাহারা মানবজাতির কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে আগমন করিয়াছেন, মুসলমান মাত্রেরই মান্য ও নমস্য। তাহাদিগের উপর বিশ্বাস না কবিলে কেহ মুসলমানই হইতে পারে না। আর আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রে যে সকল পয়গম্বরের নামোল্লেখ হইয়াছে, তাহা বাদে আরও অনেক পয়গম্বর আছেন, যাহাঁদের নাম হজবত মোহাম্মদ (দঃ) কে জ্ঞাত করা হয় নাই। অধিকন্তু প্ৰত্যেক দেশ ও প্রত্যেক জাতির নিকট প্রেরিত পুরুষগণ আসিযাছেন ও স্বর্গের বাণী শুনাইয়াছেন, এই সমস্ত কথার প্ৰত্যেকটিই কোরআন শরীফের স্পষ্ট আয়াৎ দ্বারা প্রতিপন্ন হইতেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আমরা মিসিস মহোদয়ার মন্তব্যের পূর্ণ সমৰ্থন কবিতেছি। (আল। এসলাম-সম্পাদক।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *