উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

নিদারুণ প্রতিশোধ

নিদারুণ প্রতিশোধ

চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে পটলডাঙার টেনিদা বেশ মন দিয়ে তেলেভাজা খাচ্ছিল। আমাকে দেখেই কপকপ করে বাকি বেগুনি দুটো মুখে পুরে দিয়ে বললে, এই যে শ্রীমান প্যালারাম, কাল বিকেলে কোথায় গিয়েছিলে? খেলার মাঠে তোর যে টিকিটাও দেখতে পেলুম না, বলি ব্যাপারখানা কী?

আমি বললুম, আমি মেজদার সঙ্গে সাকাস দেখতে গিয়েছিলাম।

–বটে-বটে! তা কী রকম দেখলি?

–খাসা! ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস যাকে বলে! হাতি, বাঘ, সিঙ্গি, ফ্লায়িং ট্রাপিজ, মোটর সাইকেল কত কী! কিন্তু জানো টেনিদা, সব চাইতে ভালো হল শিম্পাঞ্জির খেলা। চা খেল, চুরুট ধরাল।

–আরে ছোঃ ছোঃ!–টেনিদা নাকটাকে কুঁচকে পাতিনেবুর মতো করে বললে, রেখে দে তোর শিম্পাঞ্জি। আমার কুট্টিমামার বন্ধু রামগিদ্ধড়বাবু একবার একটা গোদা হনুমানের যে-খেল দেখেছিলেন, তার কাছে কোথায় লাগে তোর সাকাসের শিম্পাঞ্জি! নস্যি–স্রেফ নস্যি।

–তাই নাকি?–আমি টেনিদার কাছে ঘন হয়ে বললুম : রামগিদ্ধড়বাবু কোথায় দেখলেন সে-খেলা?

–উড়িষ্যায়।

আমি মাথা নেড়ে বললুম, বুঝেছি। পুরীতে গিয়ে জগন্নাথের মন্দিরে আমি কয়েকটা বড় হনুমান দেখেছিলুম।

ধ্যাত্তোর পুরী। ওগুলো আবার মনিষ্যি–থুড়ি হনুমান নাকি? গাদাগাদা জগন্নাথের পেসাদ খেয়ে নাদাপেট নিয়ে বসে আছে-গলায় একটা করে মাদুলি পরিয়ে দিলেই হয়। হনুমান দেখতে গেলে জঙ্গলে যেতে হয়, মানে কেওনঝড়ের জঙ্গলে।

–কেওনঝড়! সে আবার কোথায়?

–তাই যদি জানবি, তা হল পটলডাঙায় বসে পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাবি কেন র‍্যা? নে, গপ্পো শুনবি তো এখন মুখে ইস্কুপ এঁটে চুপটি করে বসে থাকবকের মতো বকবক করিসনি।

–বক তো বকবক করে না—ক্যাঁ-ক্যাঁ করে।

–চোপ রাও! বক বকবক করে না? তা হলে তো কোন্‌দিন বলে বসবি কাক কাকা করে না, পাঁঠার মতো ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে ডাকে।

–হয়েছে, হয়েছে, তুমি বলে যাও।

–বলবই তো, তোকে আমি তোয়াক্কা করি নাকি? এখন আমাকে ডিসটার্ব করিসনি। মন দিয়ে রামগিদ্ধড়বাবুর গল্প শুনে যা বিস্তর জ্ঞান লাভ করতে পারবি। হয়েছে কী, রামগিদ্ধড়বাবু কনট্রাকটারের কাজ করতেন। মানে, পুল-টুল রাস্তাঘাট এইসব বানাতে হত তাঁকে। সেই কাজেই তাঁকে সেবার কেওনঝড়ের জঙ্গলে যেতে হয়েছিল।

কুলি, তাঁবু, জিপগাড়ি–এইসব নিয়ে সে-এক এলাহি কাণ্ড। বনের ভেতরেই একটুখানি ফাঁকা জায়গা দেখে রামগিদ্ধড় তাঁবু ফেলেছেন। মাইল দুই দুরে পাহাড়ি নদীর ওপর একটা পুল তৈরি হচ্ছে, সকালে বিকালে সেখানে জিপ নিয়ে রামগিদ্ধড়বাবু কাজ দেখতে যান।

জঙ্গলে এনতার হনুমান, গাছে গাছে তাদের আস্তানা। কিন্তু লোকজনের উৎপাতে আর জিপের আওয়াজে তারা এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল। রামচন্দ্রজী তো আর নেই-কার ওপরে আর ভরসা রাখবে বল্? কুলিরা অবিশ্যি মাঝে মাঝে ঢোল আর খঞ্জনি বাজিয়ে রামা হে রামা হো’ বলে গান গাইত, কিন্তু সেই বিকট চিৎকার শুনে কি আর অবোলা জীব কাছে আসতে সাহস পায়?

তবু একটা কাণ্ড ঘটল।

সেদিন দুপুরবেলা তাঁবুর বাইরে বসে রামগিদ্ধড় চাপাটি খাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, সামনে গাছের ডালে বসে একটা গোদা হনুমান জুলজুল করে তাকাচ্ছে। মুখের চেহারাটা ভারি করুণ–’কাঙালকে কিছু দিয়ে দিন দাতা’–ভাবখানা এই রকম।

রামগিদ্ধড়বাবুর ভারি মায়া হল। একটা চাপাটি ছুঁড়ে দিলেন, হনুমান সেটা কুড়িয়ে নিয়ে মাথাটা একবার সামনে ঝুঁকিয়ে দিলে, যেন বললে, ‘সেলাম হুজুর। তার পরেই টুপ করে গাছের ডালে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।

পরের দিন রামগিদ্ধড় যেই খেতে বসেছেন, ঠিক হনুমানটা এসে হাজির। আজও রামগিদ্ধড় তাকে একটা চাপাটি দিলেন, সে-ও তেমনি করেই তাঁকে সেলাম দিয়ে, চাপাটি নিয়ে উধাও হল।

এমনি চলতে লাগল মাসখানেক ধরে। রোজ খাওয়ার সময় হনুমানটা আসে, তার বরাদ্দ চাপাটিখানা নিয়ে চলে যায়, যাওয়ার সময় তেমনি মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম করে। আর কোনওরকম বিরক্ত করে না, কোনওদিন একখানার বদলে দুখানা চাপাটি চায় না। মানে সেই বর্ণ-পরিচয়ের সুবোধ বালক গোপালের মতো আর কি–যাহা পায়, তাহাই খায়।

তা খাচ্ছিল, চলছিলও বেশ, রামগিদ্ধড়বাবুই একদিন গোলমালটা পাকিয়ে বসলেন। সেদিন কুলিদের সঙ্গে বকাবকি করে মেজাজ অত্যন্ত খারাপ–অন্যমনস্কভাবে খেয়েই চলেছেন। ওদিকে সেই গোপাল-মাকা সুবোধ হনুমান যে কখন থেকে ঠায় বসে আছে, সেদিকে তাঁর খেয়ালই নেই। ধীরে-সুস্থে সব কটা চাপাটি চিবুলেন, বড় একবাটি দুধ খেলেন, তারপর মোটাসোটা গোঁফজোড়া মুছতে-মুছতে উঠে গেলেন। হনুমানের কথা তাঁর মনেও পড়ল না।।

পরদিন যেই চাপাটির থালা নিয়ে বসেছেন–অমনি হুপ করে এক আওয়াজ। ব্যাপার কী যে হল ভালো করে ঠাহর করবার আগেই রামগিদ্ধড় দেখলেন, থালার আটখানা চাপাটি বেমালুম ভ্যানিশ। তাঁর নাকের সামনে মস্ত একটা ল্যাজ একবার চাবুকের মতো দুলে গেল, ‘হুপ করে শব্দ, আর একবার গাছের ডাল ঝরঝর করে নড়ে উঠল ব্যস, কোথাও আর কিছু নেই।

দু-একজন কুলি হইহই করে উঠল, ঠাকুর হায়-হায় করতে লাগল আর রামগিদ্ধড় স্রেফ হাঁ করে রইলেন। আঁ–এইসা বেইমানি! রোজ রোজ হতচ্ছাড়া হনুমানকে চাপাটি খিলাচ্ছি–আর সে কিনা অ্যায়সা বেতমিজ। আর কোনও জানোয়ার হলে রামগিদ্ধড় তাকে গুলি করে মারতেন, কিন্তু মহাবীরজীর জাতভাইকে তো আর সত্যিই গুলি করা যায় না। সে তো মহাপাপ।

রাগের চোটে রামগিদ্ধড় মুখের এক গোছা গোঁফই টেনে ছিঁড়ে ফেললেন। বললেন, দাঁড়াও–রামগিদ্ধড় চৌধুরী খাস বালিয়া জিলার রাজপুত। আমিও তোমায় ঠাণ্ডা করে দিচ্ছি। পরদিন ঠাকুর-কে ডেকে বললেন, এখানে সব চাইতে ঝাল যে মিরচাই–মানে লঙ্কা পাওয়া যায়, তারই বাটনা কর ছটাকখানেক। আর তাই দিয়ে তৈরি কর দুখানা চাপাটি। তারপর আমি দেখে নিচ্ছি হনুমানজীকে–

খেতে বসেই কোনওদিকে না তাকিয়ে–মানে থালাসুন্ধু লোপাট হওয়ার কোনও চান্স না দিয়েই রামগিদ্ধড় সেই লঙ্কাবাটা ভর্তি চাপাটি দুখানা ছুঁড়ে দিলেন মাটিতে। আবার শব্দ হল ‘হুপ’–হনুমান নেমে পড়ল, কুড়িয়ে নিলে চাপাটি, রোজকার মতো সেলাম করলে, তারপরেই টুপ করে গাছের ডালে। রামগিদ্ধড়ের কুলিরা তাঁর দুপাশে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রইল যাতে কোনও অঘটন না ঘটে। আর দু মিনিটের ভেতরেই গাছের ওপর থেকে নিদারুণ এক চিৎকার শোনা গেল। হনুমান এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল, আওয়াজ হতে লাগল : খ্যাঁ—খ্যা–খ্যাঁ, খোঁ-খোঁ উপুস-গুপুস! পাখিরা চিৎকার করে পালাতে লাগল, গাছের ঘেঁড়া পাতা উড়তে লাগল চারদিকে। মানে, দ্বিতীয়বার হনুমানের মুখ পুড়ল, আর শুরু হয়ে গেল দস্তুরমতো লঙ্কাকাণ্ড।

গাছ থেকে হনুমান চেঁচাতে লাগল : খ্যাঁ-খ্যাঁ-খোঁ-খ্যাঁ, আর নীচ থেকে সদলবলে রামগিদ্ধড় হাসতে লাগলেন : হাঃহাঃ-হো-হোঃ। হনুমান আজ আচ্ছা জব্দ হয়েছে। রামগিদ্ধড়ের চাপাটি লুঠ! মানুষ চেনো না! বোঝো এখন।

খানিকক্ষণ দাপাদাপি করে হনুমান কোনদিকে ছটকে পড়ল কে জানে। আর রামগিদ্ধড় আরও আধ ঘণ্টা ভুড়ি কাঁপানো অট্টহাসি হেসে তাঁর সেই জিপগাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কাজ দেখতে। হনুমানের মুখ পুড়িয়ে মনে মনে তো বেজায় খুশি হয়েছেন, কিন্তু রামায়ণে রাবণের যে কী দশা হয়েছিল, সেটা বেমালুম ভুলে গেছেন তখন, টের পেলেন বিকেলেই।

কাজ দেখে যখন ফিরে আসছেন, বনের মধ্যে তখন ছায়া নেমেছে। দিব্যি ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে, চারিদিকে পাখিটাখি ডাকছে, রামগিদ্ধড়ের মেজাজটাও ভারি খুশি হয়ে রয়েছে। আস্তে-আস্তে জিপ চলেছে আর রামগিদ্ধড় গুনগুন করে গান গাইছেন : আরে হাঁবনমে চলে রামচন্দ্রজী, সাথমে চলে লছমন ভাই-এই সময় জিপের ড্রাইভার বাঁটকুল। সিং বললে, আরে এ কোন্ বেকুবের কাণ্ড। রাস্তাজুড়ে গাছের ডাল ভেঙে রেখেছে। এখন যাই কী করে? রামগিদ্ধড় দেখলেন তাই বটে। ছোট বড় ডালপালা দিয়ে বনের ছোট পথটি যেন একেবারে ব্যারিকেড করে রাখা হয়েছে। বুনো লোকগুলোর কারবারই আলাদা। বিরক্ত হয়ে বললেন, গাড়ি থামিয়ে রাস্তা সাফ করো বাঁটকুল সিং! বাঁটুল সিং জিপ থেকে নেমে রাস্তা পরিষ্কার করতে যাচ্ছে, আর ঠিক তখন–গুপ–গাপ, হুপ—হুপ–গবাৎ–

সমস্ত বন যেন একসঙ্গে ডাক ছেড়ে উঠল। গাছের মাথায় মাথায় ঝড় বয়ে গেল, আর বললে বিশ্বাস করবিনে প্যালা, দুপ-দাপ শব্দে কোত্থেকে কমসে কম দেড়শো হনুমান লাফিয়ে পড়ে রামগিদ্ধড়বাবুর জিপগাড়ি ঘেরাও করে ফেললে। দ্বিতীয় লঙ্কাকাণ্ডের পর এ যেন দ্বিতীয় রাবণবধের ব্যবস্থা।

ব্যাপার দেখেই তো বাঁটুল সিংয়ের হয়ে গেছে। সে তো আরে বাপ বলে বনবাদাড় ভেঙে দৌড়! রামগিদ্ধড়ও জিপ থেকে লাফিয়ে পড়লেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গোদা হনুমান তাঁকে জাপটে ধরলে।

–বাবা-রে মা-রে–গেছি রে–বলে পরিত্রাহি হাঁক ছাড়লেন রামগিদ্ধড়, কিন্তু দেড়শো হনুমানের গুপ গাপ শব্দে তাঁর চ্যাঁচানি কোথায় তলিয়ে গেল। তখন কী হল বল দিকি? দুটো হনুমান তাঁর দুকান শক্ত করে পাকড়ে ধরলে, একটা তাঁর দু’গালে ঠাঁই ঠাঁই করে বেশ ক’বার চড়িয়ে দিলে।

–জান গিয়া জান গিয়া বলে যেই রামগিদ্ধড় চেঁচিয়ে উঠে হাঁক ছেড়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই যে হনুমানসকালে যাকে খুব জব্দ করেছিলেন, সে রামগিদ্ধড়ের মুখের ভেতর একখানা চাপাটি গলা পর্যন্ত ঠেসে দিলে।

কোন চাপাটি বুঝেছিস তো? মানে, লঙ্কা বাটায় লাল টুকটুকে সেই দোসরা নম্বরের চিজটি। জিভে সেটা লাগতে না লাগতেই রামগিদ্ধড়ের মুখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। একবার ফেলে দিতে গেলেন মুখ থেকে কিন্তু সাধ্য কী! তক্ষুনি দুগালে ধুমধাম করে দুই থাপ্পড়!

অগত্যা রামগিদ্ধড় নিজের কীর্তি সেই চাপাটি খেলেন, মানে খেতেই হল তাঁকে। দেড়শো হনুমানের সঙ্গে তো আর চালাকি নয়। দেড়শো হাতের দেড়শোটি চাঁটি খেলে রামগিদ্ধড়ও রাম-ইঁদুর হয়ে যাবেন। কিন্তু চাঁটি বাঁচাতে যা খেলেন তা চাপাটি নয়–সোজাসুজি দাবানল যাকে বলে। চিবুনি দিতেই চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল, মনে হতে লাগল, গলা থেকে চাঁদি পর্যন্ত কী বলে–একেবারে লেলিহান শিখায় জ্বলছে। রামগিদ্ধড় কেবল তারস্বরে বলতে পারলেন : জল–তার পরেই সব অন্ধকার।

ওদিকে কুলির দল আর বন্দুক-টক নিয়ে বাঁটকুল যখন ফিরে এল, তখন হনুমানদের এতটুকু চিহ্ন কোথাও নেই। কেবল রামগিদ্ধড় পথের মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তারপর সেই চাপাটির চোট সামলাতে পাক্কা একটি মাস হাসপাতালে।

তাই বলছিলুম, আমার কাছে সার্কাসের শিম্পাঞ্জির গপ্পো আর করিসনি। আসল খেল দেখতে চাস তো সোজা কেওনঝড়ের জঙ্গলে চলে যা।

এই বলে পটলডাঙার টেনিদা আমার চাঁদিতে কড়াং করে একটা গাট্টা মারল আর তার পরেই তিন-চারটে বড় বড় লাফ দিয়ে সোজা শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের দিকে হাওয়া হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *