মেঘ-মল্লার
মৌরীফুল
যাত্রাবদল
জন্ম ও মৃত্যু
কিন্নর দল
বেনীগীর ফুলবাড়ি
নবাগত
তালনবমী
উপলখন্ড
বিধুমাস্টার
ক্ষণভঙ্গুর
অসাধারণ
মুখোশ ও মুখশ্রী
নীলগঞ্জের ফালমন্ সাহেব
1 of 2

নসুমামা ও আমি

নসুমামা ও আমি

ছেলেমানুষ তখন আমি। আট বছর বয়স।

দিদিমা বলতেন, তোর বিয়ে দেব ওই অতুলের সঙ্গে।

মামারবাড়িতে মানুষ, বাবা ছিলেন ঘরজামাই—এসব কথা অবিশ্যি আরও বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম।

অতুল আমার দিদিমার সইয়ের ছেলে, কোথায় পড়ে, বেশ লম্বামত আধফর্সা গোছের ছেলেটা। আমাদের রান্নাঘরে বসে দিদিমার সঙ্গে আড্ডা দিত। অতুলকে আমার পছন্দ হত না, কেমনধারা যেন কথাবার্তা। আমায় বলত—এই পাঁচী, যা—এখানে কী? ওইদিকে গিয়ে খেলা করগে যা—

কখনো বলত—অমন দুষ্টুমি করবি তো বাঁশবনে লম্বা শেয়ালটা আছে তার। মুখে ফেলে দিয়ে আসব বলে দিচ্চি

অতুলকে সবাই বলত ভালো ছেলে। লেখাপড়ায় বছর বছর ভালো হয়ে ক্লাসে উঠত, আমার ছোটোমামার সঙ্গে কীসব ইংরিজি-মিংরিজি বলত—যদি তার কিছু বুঝি!

এইসবের জন্যেই হয়তো অতুলকে আমার মোটেই ভালো লাগত না। তা সে যতই ভালো হোক, লোকে তাকে যতই ভালো বলুক।

ভালো আমার লাগত মুখুজ্যেবাড়ির নসুকে। কী সুন্দর ফর্সা চেহারা, ননী-ননী গড়ন, ডাগর চোখদু-টি, বেশ হাসিহাসি মুখখানি। বয়সও অতুল মামার মতো অত বেশি নয়, আমার চেয়ে সামান্য কিছু বড়ো হবে। অতুল মামার বয়েস হয়ত ছিল ষোলো-সতেরো।

নসু হাসলে তার মুখ দিয়ে যেন মুক্তো ঝরত—দিদিমার সেই গল্পের মতো। এমন সুন্দর মুখ আমার আট বছরের জীবনে এ অজ পাড়াগাঁয়ে ক-টাই বা দেখেছি! দিদিমার কাছে এসে বসে মাঝে মাঝে সেও গল্প করত, সে যা বলত তা যেন মধুর, অতি মধুর! আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে একমনে ওর কথাগুলো যেন গিলতাম। অতুলও তো কথা বলে, কিন্তু তার কথা এত ভালো লাগত না তো?

দিদিমা বলতেন—অতুলের সঙ্গে পাঁচীর বিয়ে দেব, বেশ মানাবে।

আমি মুখ ভারি করে বলতাম—ছাই মানাবে। দি

দিমা হেসে বলতেন—ওমা মেয়ের কাণ্ড দেখো। কেন মানাবে না?

-তুমি তো সব জানো!

—তবে তোর মনটা কী শুনি? কাকে বিয়ে করবি তুই?

—ওই নসুকে।

দিদিমা হেসে গড়িয়ে পড়ে বলতেন—এর মধ্যেই মেয়ে নিজের বর বেছে নিয়েচে। ধন্যি যা হোক, একালের মেয়ে কিনা! শুনলে সই, নসু নাকি ওর বর হবে।

অতুলের মা হেসে বলতেন—কেনরে, অতুলকে তোর পছন্দ হয় না কেন?

—অতুল মামার বয়েস বেশি।

—বেশি আর কত? ষোলো বছর।

—তা যাই হোক, ষোলো বছরের বুড়োকে আমি বুঝি বিয়ে করব? নসু ছেলেমানুষ।

দিদিমা বলতেন—দ্যাখো সই একালের মেয়ের কাণ্ড। নসুর বয়স বারো, ওকেই বেশি পছন্দ। তোমার-আমার কাল চলে গিয়েছে। তেরো বছর বয়সে আমার বিয়ে হল, উনি তখন বিয়াল্লিশ, দোজপক্ষে আমায় ঘরে আনলেন। তোমারও তো

অতুলের মা বললেন—আমার অত না! উনি তখন ঊনত্রিশ, আমার এগারো।

—দোজপক্ষ তো বটে।

—শুধু তাই? সতীন বেঁচে।

—আমায় ভগবান সেদিক থেকে নিষ্কণ্টক করেছিলেন তাই খানিক রক্ষে।

মাঝে মাঝে নসুকে অনেকদিন দেখতাম না। আমাদের পাড়ায় সে আসত না খেলতে। আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠত, ছুটে যেতাম মুখুজ্যেবাড়িতে।

নসুমামা উঠোনে বসে কঞ্চি কেটে খেলাঘরের বেড়া বাঁধছে। সঙ্গে আরও তিন চারটি ছেলে, ওরই বয়সি।

—আমি বলতাম—ও নসুমামা, আমাদের বাড়ি যাওনি যে?

—কী রোজ রোজ যাব! তুই এতদূর এলি যে? আসতে ভয় করে না?

—না।

—খেলা করবি?

–হুঁ।

অন্য ছেলেগুলো তখুনি বলে উঠত—মেয়েমানুষ আবার আমাদের সঙ্গে খেলবি কেন? যা তুই, পুঁটি মান্তিদের সঙ্গে খেলগে যা।

নসু বলত—খেলুক আমাদের সঙ্গে—তাতে কী।

হাবু বলত—ও কী দা দিয়ে কঞ্চি কেটে আনতে পারবে? কী খেলা হবে ওকে নিয়ে? যা তুই

আমাকে কাঁদো-কাঁদো দেখে নসু এসে হাত ধরত। বলত—কেন ওকে অমন কচ্ছিস তোরা? ও কেন কঞ্চি কাটতে যাবে? মেয়েমানুষ, চুপ করে বসে থাকবে। বোস তুই পাঁচী—

আমি অমনি কৃতার্থ হয়ে উঠোনের একপাশে বসে পড়তাম। নসুমামা খেলতে খেলতে হয়তো একটা পেয়ারা ছুড়ে দিত আমার দিকে। বসে বসে পেয়ারা চিবুতাম। অনেকক্ষণ পরে বলতাম—নসুমামা, খিদে পেয়েছে—

হাবু অমনি বলে উঠত—ওই শোনো কথা। ওসব হ্যাঙ্গাম—

নসুমামা বলত—তুই চুপ কর হাবু। খিদে পেয়েচে? চল পিসিমার কাছে, দুটো চালভাজা খাবি তেলনুন দিয়ে, না-হয় একটা কচি শসা পেড়ে দেব—

আমি বলতাম—না, তুমি বাড়ি দিয়ে এসো। আমি বাড়ি গিয়ে ভাত খাব।

হাবু অমনি চোখ পাকিয়ে বলে—তবে একলা এলি কী করে? কে এখন তোর সঙ্গে যাবে পৌঁছে দিতে? উঃ, ভারি পাজি মেয়ে—

নসু আমার আগে আগে বাড়ি পৌঁছে দিতে আসত, ধুলোমাটির পথের ধারে কত কেঁচোর মাটি, কত বেনে-বউ গাছে গাছে, পাকা বকুল পড়ে থাকত বকুলতলায়। নসুকে পাকা বকুল খাওয়াতে ইচ্ছে করত, আমি বড্ড ভালোবাসি পাকা বকুল। নসুমামাকে কুড়িয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে বলত—দূর, ও কষা কষা লাগে। তুই খা, আমি খাব না। নসুকে খেতে দিয়ে যেন আমার তৃপ্তি, সে সুযোগ ও আমায় দিত কই।

এইভাবে সারা শৈশব ও বাল্যকাল কেটে গেল সেই আমার ছেলেবেলাকার অতিপরিচিত মামারবাড়ির গ্রামের গাছপালার ছায়ায় ছায়ায়, চৈত্র মাসের পাখি ডাকা শীতল সকালবেলাকার মতো। তারপরেই জীবনের রোদ খরতর হয়ে উঠল ক্রমশ। ফুল-ফোটা পাখি-ডাকা বসন্ত প্রভাত গেল ধীরে ধীরে মিলিয়ে। বাতাস গরম হয়ে উঠল।

সেই গাঁ, সে-ই তাঘরা-শেখহাটি এখনও আছে। মাঝে মাঝে এখনও সেখানে যাই, কত বদলে গিয়েচে সে জায়গা। সে মামারবাড়ি নেই, সে দিদিমাও নেই।

বাবা কোথায় কাদের আড়াতে কাজ করতেন। সামান্য ক-টি টাকা মাইনে পেতেন, দিদিমার সঙ্গে সংসারের খরচপত্র নিয়ে তাঁর প্রায়ই ঝগড়া-তর্ক হত। বাবা রাগ করে চলে যেতেন বাড়ি থেকে, দু-একমাস কোনো খবর আসত না, মা কান্নাকাটি করতেন, হঠাৎ বাবা একদিন এসে হাজির হতেন। দিন এভাবেই চলত।

তেরো বছর বয়সে আমার বিয়ে হল আড়ংঘাটার কাছে এক গ্রামে। বিয়ের দিনকতক আগে নসুদের বাড়ি গিয়েছিলাম। নসুর মার শরীর খারাপ, নসু রান্নাঘরে ভাত রাঁধছে। উনুনের আঁচে ওর ফর্সা মুখ রাঙা হয়ে গিয়েছে। ওদের বাড়ির কোনো বিলিব্যবস্থা নেই। অনেকগুলো ভাই নসুর। তারা কেউ বাইরে পড়ে, কেউ কাজ করে। নসুর মার শরীর চিররুগণ, সংসারের রান্নাবান্নার ভার নসুমামার উপর। আজ অনেকদিন থেকেই নসুর এই অবস্থা দেখছি।

নসুর অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হল। নসুর মুখের দিকে চাইবার কেউ নেই, ভাইয়েরা সব স্বার্থপর, সংসার চালানোর ভার ওর ওপর ফেলে দিয়ে সবাই তারা নিশ্চিন্ত হয়ে আছে।

নসুমামা আমায় দেখে হেসে বললে—আয় পাঁচী, বোস। কাল দই পেতেছিলাম, দইটা বসেনি। উনুনের পাড়ে রেখে দেব, কী বলিস?

যত সব মেয়েলি গল্প নসুর। সাধে কী ওকে সকলে বলে জনার্দন মুখুজ্যের বিধবা মেয়ে?

আমায় বললে—কাল বুঝলি, এক কাঠা মুগের ডাল ভাজলাম, ভাঙলাম। বেলা গেল ডালডুল করতে। গা-হাত-পা ব্যথা।

বললাম—তুমি ডাল ভাজলে? সত্যি?

—হ্যাঁরে। নইলে কে করবে? আবার কাল একগাদা ময়লা কাপড় সোডাসাবান দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে।

দুঃখিত সুরে বললাম—ওসব মেয়েলি কাজ। তুমি ওসব করো কেন? আমায় ডাকলে না কেন? আমি ডাল ভেজে দিতাম।

নসু বললে—আহা! আমি না-পারি কী? তোকে আবার ডাকতে যাব কেন?

—লেখাপড়া করবে না নসুমামা? এসব কাজ কী তোমার সাজে? পুরুষমানুষ, লেখাপড়া করো।

—আমায় কে পড়াবে? দাদারা এক পয়সা দেবে না। তা ছাড়া মার শরীর খারাপ, আমি বাড়ি থেকে গেলে রান্নাবান্না কে করে বল। পড়বার খরচ জুটলেও আমার পড়া হত না।

আমি বসে বসে ওর কুটনো কুটে দিলাম। আমার বিয়ে কথা বললাম। নসুমামা বিশেষ কোনো আগ্রহ প্রকাশ করলে না। ও যদি একটুও আগ্রহ প্রকাশ করত, শুনত কোথায় আমার বিয়ে হচ্চে ইত্যাদি, তাহলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু নাঃ, সে সুখ আমার অদৃষ্টে নেই। নসুমামা একটা কথাও জিজ্ঞেস করলে না সে সম্বন্ধে।

আমার বিয়ের রাত্রে নসু নেমন্তন্ন খেয়ে এল পেটপুরে, কিন্তু না-এল একবার বিয়ে দেখতে, না-একবার বাসরঘরে উঁকি মেরে দেখলে। আমার মনটা যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা, ও যদি আসত তবে খুব ভালো লাগত। মনের মধ্যে ডুব দেবার সময় আমার নয় তখন, তবুও কী যেন একটা হয়ে গেল, এত বাজনা, এত খাবার দাবার, এত লোকজনের যাতায়াত, আমার নতুন কাপড় গয়না—কিছুই ভালো লাগল না। মনে উৎসাহ নেই।

আগেই বলেছি আমার বিয়ে হয়েছিল আড়ংঘাটার কাছে শিকারপুরে। স্বামীর বয়সও সতেরো-আঠারোর বেশি নয়, রোগা চেহারা, মাথার চুল-ওঠা। বিয়ের পরে জানা গেল স্বামী ম্যালেরিয়ার পুরোনো রোগী। মাসে দু-বার ম্যালেরিয়া জ্বর বাঁধা আছেই। আড়ংঘাটার যুগলকিশোর ঠাকুরের মেলার সময় ময়রার দোকান খোলেন আমার খুড়শ্বশুর, স্বামী তাড় দিয়ে সন্দেশ-মুড়কি ভিয়েন করেন।

শ্বশুরবাড়িতে যাবার সময় মনে খানিকটা কৌতূহল নিয়ে যে না-গিয়েছিলাম এমন নয়। না-জানি কেমন বাড়ি-ঘর, কেমন খাওয়া-দাওয়া। গিয়ে দেখি, পুরোনো আমলের ইটবের-করা কোঠাবাড়ি, দুটিমাত্র ঘর, ছোটো একটা বারান্দা, তবে সব ঘরগুলির সামনে সান-বাঁধানো টানা রোয়াক এবং রান্নাঘরটিও কোঠা। খুব বড়ো একটা আমগাছ সমস্ত বাড়ির উঠোনজুড়ে ঘুপসি করে রেখেছে।

আমার শাশুড়ি গর্বের সুরে বললেন—আমের সময় তো আসছে, দেখো বউমা। এমন আম এ অঞ্চলে নেই আমার বাগানে যা আছে, ডাকসাইটে বাগান, কর্তা করে রেখে গিয়েছিলেন, ইস্তক গোয়াড়ি, ইস্তক শান্তিপুর, কোথা থেকে কলমের চারা এনে না-পুঁতেচেন!

আমের সময় এল, কোথা থেকে ব্যাপারীরা এসে বাগান কিনে নিলে। দু-এক ঝুড়ি আম যা আমাদের বাড়ি এল, তা থেকে দুটো-একটা জুটল আমার ভাগ্যে। শাশুড়ি নিতান্ত বাজে কথা বলেননি, আম ভালো।

স্বামীর সঙ্গে আলাপ জমল মন্দ নয়। ক্রমে তাঁকে ভালোও লাগল।

আমায় বল্লেন—তুমি কী খেতে ভালোবাসো?

আমি লজ্জা-টজ্জার ধার ধারিনে, বলে ফেললাম—তেলেভাজা খাবার।

স্বামী বললেন—দূর! অমন বোকা মেয়ে কেন? ভালো খাবারের নাম করো।

—গজা। জিলিপি।

–কেন খাজা?

—সে আবার কী গা? আমাদের গাঁয়ে শুনিনি তো।

উনি হো-হো করে হেসে বললেন—পাড়াগেঁয়ে ভূত! আমাদের এ শহর বাজার জায়গা। কাল খাজা আনব লুকিয়ে। কিন্তু সাবধান, মা যেন টের না-পায়। বকবে। আমি নিজে খাজা ভিয়েন করি।

সেই থেকে মাঝে মাঝে স্বামী লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার আনেন। কোনোদিন খাজা, কোনোদিন মিহিদানা। আমরা দুজনে লুকিয়ে খাই। স্বামী বলেন—সবাইকে দিতে গেলে চলে না। খুড়তুতো ভাইয়েরা হাঁসের পাল, সবার মুখে দিতে গেলে তোমার আমার মুখে একটুকরো উঠবে কিনা উঠবে।

শ্বশুরবাড়ি ভালো লাগল না বটে, তবে স্বামীকে কিছুটা ভালো লাগল এই খাবার খাওয়া থেকে। উলোর জাতের মতো বড়ো মেলা এ অঞ্চলে নেই, সে-সময় ময়রার দোকানে কাজ বেশি। উনি ফেরেন অনেক রাতে। হাতে বড়ো বড়ো ঠোঙায় খাবার ভর্তি। উনি হেসে বলতেন—খাও, খাও, খুব খাও—এসো দুজনে পেট ভরে খাই।

একদিন কী করে খুড়শ্বশুর টের পেলেন লুকিয়ে খাবার আনার ব্যাপারটা। এ নিয়ে খুব ঝগড়া হল বাড়িতে। আমাকে আর ওঁকে যথেষ্ট অপমান গালিগালাজ সহ্য করতে হল।

খুড়শাশুড়ি বললেন—অমন নোলায় সাত ঝাঁটা মারি। লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার খেয়ে দোকানটা শেষ করে দিলে গা! এমন অলক্ষ্মী বউ তো কখনো দেখিওনি, শুনিওনি। লজ্জাও করে না গুরুজনকে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে।

স্বামীকে রাত্রে বললাম—আর ওসব এনো না। দ্যাখো তো কী কাণ্ড বাধালে!

স্বামী বললেন—না, আনবে না! আমায় কী মাইনে দেয় কাকা? বিনি মাইনের চাকর করে তো রেখেচে। পেটে দুটো খাব না? ঠিক আনব লুকিয়ে, তুমি দেখো। কেমন করে ধরবে কাকা তা দেখব।

স্বামীর শরীর ভালো নয় অথচ ঘোর পেটুক। আমার কথা শুনতেন না। খাবার চুরি বন্ধ হল না। রোজ রাত্রে একগাদা বাসি লুচি আর রসগোল্লার রস আনেন। নিজে খান, আমাকেও যথেষ্ট দেন। ওঁর পেটের অসুখ ছাড়ে না। আমার বারণ শোনেন না মোটে।

বলেন—খেয়ে যা উঠিয়ে নিতে পারি। কাকা একপয়সা উপুড়-হাত করবে না।

আমি বললাম—আমি বাপেরবাড়ি যাব আষাঢ় মাসে, আমায় নতুন কাপড় কিনে দেবে না?

উনি ঠোঁট উলটে বললেন—কে দেবে? কাকা? তা দেখে আর বাঁচলাম না!

—সত্যি আমার নতুন কাপড় হবে না? বাপেরবাড়িতে কিন্তু সবাই নিন্দে করবে।

—যদি আমি দিতে পারতাম, সব হত। আমার কী ইচ্ছে করে না তোমায় কাপড় দিতে? কোথায় পাব?–

তাই তো। অনেকের নিন্দে শুনতে হবে তাই ভাবছি।

আষাঢ় মাসে বাপেরবাড়ি এলাম। স্বামীও আমার সঙ্গে এলেন। তাঁকে দেখে গ্রামের সমবয়সি মেয়েরা নানারকম নিন্দাবাদ করতে লাগল।

আমায় একদিন রায়বাড়ির মেজোগিন্নি বললেন—হ্যাঁ পাঁচী, জামাই নাকি তাড়ঘোঁটে ময়রার দোকানে?

আমি অতশত বুঝিনে, বললাম—হ্যাঁ। খুব ভালো খাজা তৈরি করে। সবাই হাতের সুখ্যাতি করে মাসিমা।

মেজোগিন্নি হেসেই খুন! তাঁর বড়ো পুত্রবধূ যে বাপেরবাড়ি থেকে আসতে চায়, বাপের বাড়ির গ্রামে কোন প্রতিবেশী ছেলের সঙ্গে প্রণয়াসক্ত, এসব কথা। তিনি তখন ভুলে গেলেন। আমার স্বামীর খাবারের দোকানে কাজটাই প্রবল দোষের ও নিন্দের কারণ হয়ে উঠল তাঁর কাছে। আমার স্বামীকে গ্রামের লোকে নতুন জামাই বলে খাতির আদর করলে না। আমার তাতে মনে বড় দুঃখ হল। নতুন জামাইকে সকলে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়, আমার স্বামীকে সবাই যেন কেমন হেনস্থা করলে।

নসুমামা ঠিক তেমনি ভাত রাঁধচে। আমি তার ওখানে গিয়ে গল্প করে একটু যা আনন্দ পেতাম। একটা জিনিস দেখলাম, নসু ধর্মে-কর্মে মন দিয়েছে এই বয়সেই। চন্দন ঘষচে দেখে বললাম—দিদিমা পুজো করেন বুঝি আজকাল? নসু হেসে বললে—মা নয়। পুজো করব আমি। রোজ শিব গড়িয়ে পুজো করি। মানুষ হয়ে জন্মে শুধু খেয়ে যাব শুয়োরের মতো!

আমার হাসি পেল ওর মুখে তত্বকথা শুনে। নসুমামা আমাকে শসা কেটে খেতে দিল, নিজেই নারকেলের নাড় করেচে ঘরে, তা দিলে, চা খেতে দিলে।

বছর দুই-তিন কাটল। আমার স্বামীর শরীর সারল না। ক্রমেই যেন আরও খারাপ হয়ে উঠছে। শাশুড়ি ও খুড়শাশুড়ি বলেন—ওই অলক্ষুণে বউ এসে বাছার শরীর একদিনও ভালো গেল না।

শাশুড়ি বললেন—সংসারের কোনো জিনিসে আট নেই তা দেখেছ লক্ষ করে? কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়, এ আমিও স্বীকার করচি। সত্যিই যেন আমার কোনো জিনিসে কোনো আসক্তি নেই। ভালো কাপড় নয়, গহনা নয়—কোনো কিছুতে না। আমার স্বামী বলেন–পয়সা জমাও না কেন? যা মাঝে মাঝে হাতে

এনে দিই, জমিও। তোমার আখেরে ভালো হবে।

ওসব কথা আমি শুনেও শুনিনি কোনোদিন। কার আখেরে কী হবে সে ভেবে ফল কী!

আমার একটি ছেলে হল, কয়েক মাস পরে মারাও গেল। স্বামীর অসুখ সারে। সংসারে খেটেই মরি, মুখের মিষ্টি কথা কেউ বলে না। স্বামী আমায় নানারকম সাংসারিক উপদেশ দেন। তাঁর যেরকম শরীর, কবে মরে যাবেন, তখন কী উপায় হবে? আমি যেন কিছু কিছু হাতে রাখি। এ কথা আমি যখন শুনি তখনই মনে থাকে, তারপর আর মনে থাকে না।

সেই মাঘ মাসে আমি বাপেরবাড়ি এলাম। গ্রামে এসে শুনি নসুমামার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, সে দিনরাত পুজোআচ্চা নিয়ে থাকে, কারো সঙ্গে কথা বলে না, কি রকম যেন। আমি গিয়ে দেখা করলাম বিকেলের দিকে। নসুমামা বললে— কী খবর পাঁচী, কখন এলি?

—কাল এসেছি। ভালো আছ?

—ভালো আছি। খুব আনন্দে আছি।

—সবাই তোমাকে পাগল বলচে যে?

নসুমামা মৃদু হেসে চুপ করে রইল। তারপর আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বললে—আমি আসল বস্তু পাওয়ার চেষ্টায় আছি। এতে যে-যা বলে বলুক। আমি পাগলই হই আর ছাগলই হই—হি-হি-হি-হি হ্যাঁরে পাঁচী?

শেষের কথাগুলো আমার কানে একটু অসংলগ্ন-মতো ঠেকলেও নসুমামার ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। কী যেন একটা ওর মধ্যে আমি পেলাম, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখিনি। ওর মুখের চেহারা যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। লোকে টাকাকড়ি ঘর-জমি আঁকড়ে পড়ে আছে দেখছি আমার চারিপাশে, খুড়শাশুড়িকে দেখেছি গাছের সামান্য একটা আম যদি গাছের তলা থেকে কোনোবাড়ির ছেলে কুড়িয়ে নিয়ে যায় তবে ঝগড়া করে পাড়া মাত করেন। গাঁয়ের মধ্যে দেখেচি এক হাত জমি হয়তো এগিয়ে বেড়া দিয়েছে কেউ, তাই নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা দু-তিন বছর ধরে চলেচে। এমন আবহাওয়ার মধ্যে নসুমামা মানুষ হয়েও স্বতন্ত্র, ওর কাপড়েচোপড়ে, খাওয়ায়, বিষয়-আশয়ে কোনো আসক্তি নেই; পৈতৃক বিষয় আছে, কিন্তু ভায়েদের দিয়ে বসে আছে সর্বস্ব, একটা পয়সাও চায় না।

আমার স্বামী এসে দু-চারদিন রইলেন। স্বামীর ওপর আমার কেমন একটা মায়া হয়। এর মুখের দিকে কেউ যেন চায় না আমার শাশুড়ি ছাড়া—তাও তিনি বুড়ো হয়েছেন, দেওরের কাছে কোনো কথা তাঁর খাটে না।

আমাদের গ্রামেও তাঁর তেমন খাতির-যত্ন নেই।

বললেন—এই গাঁয়ে একটা ঘর করলে ভালো হয়।

আমি বললাম—কেন, শ্বশুরবাড়ি বাস করবে? কেউ কিছু বলবে না?

—বলুক গে। কাকার ওখানে আর ভালো লাগে না।

—দেখো ভেবে।

—তোমাদের গাঁয়ের লোকগুলো যেন কেমন কেমন? ভালো করে কথাই বলে।

আমার রাগ হল, বললাম—তাড়ঘোঁটা জামাইকে কে খাতির করবে শুনি? স্বামী হেসে চোখটিপে বললেন—ইঃ! রোজ রোজ রাত্তিরে খাজা খাওয়ার সময় তো খুব ভালো লাগে?

দু-একদিন পরে উনি চলে গেলেন। যাবার সময় আমার হাতে তেরো আনা পয়সা দিয়ে বলে গেলেন—এই পয়সা দিয়ে খাবার কিনে খেও। মাসখানেক থাকো, তারপর এসে নিয়ে যাব।

আর আসেননি তিনি। সেই মাসের শেষের দিকে পুরোনো আমাশা রোগে তিনি আমার সিঁথির সিঁদূর আর হাতের শাঁখা ঘুচিয়ে ইহলোক ত্যাগ করলেন। বাবা চিঠি পেয়ে আমাদের প্রথমে কিছু বলেননি, তারপর দু-দিন পরে মাকে একদিন বললেন—হ্যাঁ একটা কথা, জামাইয়ের বড়ো অসুখ, চিঠি পেয়েছি।

মা আড়ষ্ট সুরে বলে উঠলেন—সে কী গো! এতক্ষণ বলোনি কেন? হাটে চিঠি পেলে? কই দেখি চিঠি।

বাবা আমতা আমতা করে বলেন—তা—ইয়ে—মনে ছিল না। তা নয়—ইয়ে–

আমি কানখাড়া করে পাশের ঘরে বসে সব শুনচি। আমার বুকের মধ্যে টিপটিপ করচে। মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে যেন। জিব শুকিয়ে আসছে। আমি বুঝতে পেরেচি সব। বাবা অত্যন্ত ব্যস্তবাগীশ লোক, জামাইয়ের অসুখ-সংবাদে চুপ করে বসে থাকবার মানুষ নন। মা ছুটে হাঁপিয়ে বাবার কাছে এসে বললেন—তার কাছে। এখুনি চলে যাও। মেয়ের যাবার কথা লেখেনি? ওকেও নিয়ে যাও—

বাবা শুষ্কমুখে বললেন—আর সেখানে গিয়ে কী হবে গিন্নি। সব শেষ হয়ে গিয়েছে!

মা মেঝের ওপর আছড়ে পড়লেন আর্ত চিৎকার করে। আমি কিন্তু বেশ সহজভাবেই কথাটা শুনলাম কারণ আমি আগেই বুঝতে পেরেছি বাবা কী বলবেন।

এইভাবে আমার বিবাহিত জীবনের ইতি হয়ে গেল। কী করব, আমার অদৃষ্ট। বাবা তো বুড়াহাবড়া স্বামীর হাতে আমায় দেননি, ছোকরা দেখে দিয়েছিলেন, আমার কপালের লেখা, কারো দোষ নেই। আমার কিন্তু বিশেষ কোনো দুঃখ নেই মনে। বিশেষ কিছু যে হারিয়েছি, বিশেষ কোনো অভাববোধ নেই। লোকে বলচে আমার নাকি সর্বনাশ হয়ে গেল। কী সর্বনাশ হল কিছু বুঝতে পারচিনে। মাছ খেতে পাব না, না-ই বা পেলাম; একাদশী করতে হবে, করব। ভালো খাওয়া বা পরার দিকে আমার কখনো কোনো ঝোঁক নেই। তবে মানুষটার ওপর মায়া জন্মেছিল বটে। তাকে আর দেখতে পাব না, এইটুকু যা কষ্ট।

বিধবা হওয়ার পরে আমি অনেকবার শ্বশুরবাড়ি গেলাম।

শাশুড়ির সেবা করি, মুখরা জায়ের সংসারে পুত্রহীনা বৃদ্ধার বড়ো কষ্ট, যত দূর পারি সেটুকু ঘোচাবার চেষ্টা করি। একাদশীর দিন শাশুড়ি-বউয়ে নিরস্তু উপোস করি, সন্ধের সময় তাঁর পায়ে তেল মালিশ করি।

খুড়শাশুড়ি সর্বদা শোনান, আমি অলক্ষুণে বউ, আমায় ঘরে এনেই তাঁর সোনার চাঁদ ছেলে, দুধের বাছা মারা গেল।

ভাসুরপোর ওপর এমন স্নেহ ভাসুরপোর জীবদ্দশায় কোনোদিন দেখেচি বলে মনে করতে পারলাম না। আশ্চর্য!

 

একবার বাপেরবাড়ি এসে শুনলাম নসুমামা বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। ছ-মাস পরে খবর এল হালিশহরের এক কালীমন্দিরে সে আছে, গঙ্গার তীরে দু খানা ভাঙা মন্দির, সেখানে সে পুজো-আচ্চা নিয়েই নাকি আছে।

খবরটা দিলে ওপাড়ার বুধো গয়লার মা, ঘোষপাড়ার দোল দেখে দেশে ফেরবার পথে সে হালিশহরে গিয়েছিল, সেইখানেই দেখা হয়েছে। আমি মনে মনে ভাবলাম ওর পক্ষে ভালোই হয়েছে। কী জানি কেন আমার মনে হয় নসুমামা যা করে তাই ভালো।

এইভাবে দিনের পর দিন কাটে। বৃদ্ধা শাশুড়িকে কত যত্নে আগলে নিয়ে বেড়াই, বাপের-বাড়ি গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারিনে, পাছে বুড়ির কষ্ট হয়। একদিন শাশুড়ি বললেন—চল মা, সান্যালমশায়ের বাড়ি ভাগবত শুনে আসি

—সে কে মা?

—পাড়ার বুড়ো সান্যাল দাদা, দ্যাখোনি বুড়োকে?

সান্যালমশায়ের বাড়ি গেলাম। ওঁর অবস্থা বেশ ভালো বলে মনে হল বাড়িঘর দেখে, শুনলাম দুই ছেলে কলকাতায় চাকরি করে, তাদের স্ত্রী-পুত্র তাদেরই সঙ্গে কলকাতার বাসায় থাকে। সান্যালমশায় বিপত্নীক। বয়স ছিয়াত্তর বছর, নিজেই বললেন। একটি বিধবা বোন বাড়িতে থাকে ও রান্নাবান্না করে। আমাদের দেখে খুব যত্ন করলেন, আমাদের সামনে ভাগবত ব্যাখ্যা করে শোনালেন।

 

সেই থেকে সান্যালমশায়ের বাড়িতে রোজ যাই। আমায় তিনি বড়ো ভালোবাসেন, যোগবাশিষ্ঠ ও ভাগবত তাঁর প্রিয় বই। যদি দু-দিন না-যাই, সান্যালমশায় আমার শ্বশুরবাড়ি আসবেন। আমার শাশুড়ি তাঁর বউমা। ডেকে বলেন-ও বউমা?

বৃদ্ধা শাশুড়ি মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে বলেন—কী দাদা?

—নির্মলা (আমার ভালো নাম) কোথায়? ডেকে দাও।

আমি বের হয়ে এসে বলি—কী দাদু?

—দাদু কীরে, তোমার জ্যাঠামশাই হই। তোমার শ্বশুরের চেয়ে এগারো বছরের বড়ো আমি। আমার ওখানে ক-দিন যাওনি কেন? আজ অবিশ্যি যাবে।

আবার নিয়মিত ভাবে যাই। সান্যালমশায় আজকাল আর কোনো শ্রোতা চান, আমার মধ্যে কী যে দেখেছেন—আমাকে পেয়ে খুব খুশি। যোগবাশিষ্ঠ পাঠ জমে না আমি না-গেলে।

একদিন তাঁকে বললাম—জ্যাঠাবাবু, আমি তো মুখ মেয়েমানুষ, আমার মধ্যে কী পেলেন আপনি?

—কী পেলাম কী জানি। কিন্তু তুমি এলে মা আমার গীতা আর যোগবাশিষ্ঠ জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ওদের শ্লোকের মধ্যে থেকে নতুন ভাষ্য বেরিয়ে আসে। আনন্দ যদি শাস্ত্র-আলোচনার উদ্দেশ্য হয়, তবে সেটার ষোলো আনাই পাই তুমি আসলে মা।

আমি হেসে বললাম—তাহলে বলুন জ্যাঠামশাই, আমার মতো শ্রোতা আপনি অনেকদিন পাননি?

—সত্য মা, এতদিন জানতাম না যে লোককে শুনিয়ে এত আনন্দ হয়। নিজেই চর্চা করতাম, এই পর্যন্ত। আজ কিন্তু অন্যরকম বুঝচি। উপযুক্ত শ্রোতা পেলে—

আমারও ভালো লাগে বলেই যাই। কেমন যেন মন বদলে যাচ্ছে, যে মন আমার কোনো কালেই সংসারে ছিল না—তা আরও নিরাসক্ত হয়ে পড়েছে। বন্ধনের মধ্যে কেবল বৃদ্ধা শাশুড়ি। বৃদ্ধা কাঁদেন, আমি বসে যোগবাশিষ্ঠের উপদেশ শোনাই। কিন্তু তাতে তাঁর মন ভেজে না। ঘোর বিষয়ী মন। এ বয়সেও কাঁঠালের ভাগ নিয়ে, সজনে ডাঁটার ভাগ নিয়ে খুড়শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া। আমি বলি—মা, কী হবে আপনার এঁচড় আর সজনেডাঁটার চুলচেরা ভাগে। ওর কী সার্থকতা? ভগবানের নাম করুন।

বাতাবি লেবু-ফুল ফুটল ফাগুন মাসে—পথে পথে অপূর্ব সুগন্ধ ছড়িয়ে। ঘেঁটুফুলে বাঁশবনের তলা ভর্তি হয়ে গেল। কোকিলের ডাকে মন উদাস হয়ে ওঠে, কত কথা ভাবি। বাল্যকালের কথা, মা-বাবার কথা, স্বামীর কথা—জীবনে কিছু না-পেয়েই যেন সব-কিছু পেয়েছি। যদি কোনো হিসাবি বিষয়ী লোক বলে, কী পেয়েচ, হিসেব দেখাও হয়তো কিছু দেখাতে পারব না—কারণ বাইরে আমার অমলিন সরুপাড় ধুতি আর দু-গাছি অতি সরু বিবর্ণ সোনার চুড়ির মধ্যে কেউ কোনো লাভের সন্ধানই খুঁজে পাবে না, আমার মন বলে কী-এক জিনিসের ঠিকানা মিলেচে, যার দরুন অফুরন্ত আনন্দের ভাণ্ডার আজ আমার কাছে খোলা। অন্য সব কিছু যেন তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে।

একদিন আমার শাশুড়ি বললেন-ও বউমা, তোমাদের গাঁয়ের একটি ছেলে আমাদের গ্রামে হরি কলুর বাড়িতে এসে চাকরি করচে। বামুনের ছেলে, দিব্যি চেহারা। কিন্তু বাপু, কলুবাড়ি জল তোলে, গোরুর জাব কাটে, এ আবার কেমন কথা! বড্ড গরিব বোধ হয়। আমি দেখিনি, কে কাল বলছিল ঘাটে। বললে, বউমার দেশের লোক।

যেদিন শুনলাম, সেইদিনই পথে নসুমামার সঙ্গে দেখা। কিন্তু প্রথমটা চিনতে পারিনি। নসুমামার মাথায় বড়ো বড়ো চুল, পরনে শাড়ি, আধ-ঘঘামটা দেওয়া, হাতে কাঁচের চুড়ি, মেয়েলি বেশ, অথচ মুখে ঈষৎ গোঁফ-দাড়ি। আমার হাসি পেল ওর এই অপরূপ বেশ দেখে। আমায় দেখে মেয়েলি সুরে বললেও পাঁচী, ভালো আছিস তো ভাই?

আমি অবাক হয়ে বললাম—তোমার এ কী বেশ নসুমামা?

নসুমামা অদ্ভুত হাসি হেসে বললে—এই, থাকলেই হল একরকম।

–তুমি নাকি কলুবাড়ি বাসন মাজো, জল তোলো?

—দোষ কী?

—তুমি যা ভালো বোঝে। বৃদ্ধা শাশুড়ি সেই শ্রাবণ মাসে দেহ রাখলেন। দিন-দশেক জ্বরে ভুগে গভীর রাত্রে মৃত্যুর কিছু পূর্বে অশ্রুভরা চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন—তোমাকে কার কাছে রেখে যাচ্চি মা?

বৃদ্ধার আকুল সুরে মনে ব্যথা বাজল আমার। তাঁর জ্বরশীৰ্ণ হাত দুটি ধরে বললাম—কেন, আমার সোনার চুড়ি আছে, এক বিঘে আমন ধানের জমি আছে

-ভাবনা কী মা আমার? কিছু ভেব না আমার জন্যে।

বিষয়ী লোককে বিষয়ের ভাষায় সান্ত্বনা দিই। আমি জানি যাঁর কাছে আমি আছি, তিনি আমায় কোনোদিন ফেলবেন না, চরণে স্থান দেবেনই।

নসুমামার সঙ্গে দেখা আবার একদিন। সে একগাদা কাপড়-সেদ্ধ নিয়ে ঘাটে যাচ্চে কাচতে। আমি বল্লাম—ও-সব কাজ আমায় দাও নসুমামা। আমি তোমায় করতে দেব না।

জোর করে সেগুলো তার কাছ থেকে নিয়ে নিজে কেচে দিলাম। আমার চোখের সামনে ও-সব খাটুনি খাটতে দেব না ওকে। বললাম—হরি কলুর বাড়ি গোয়াল পরিষ্কার আমি করে দেব।

—না পাঁচী, লক্ষ্মীটি, লোকে কী বলবে?

—আমি গ্রাহ্য করিনে।

—আমি করি।

—মিথ্যে কথা, তুমি কিছু গ্রাহ্য করো না, কলুবাড়ির বাসন মাজচো অথচ—

—পাঁচী, এসব তুই বুঝবিনে। ওসব করিসনে কক্ষনো। ওর কথা সান্যাল জ্যাঠাকে বলতে তিনি বড়ো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওকে দেখবার জন্যে। হরি কলুর বাড়ির পেছনে একটা পুকুর, পুকুরের চারিধারে আম কাঁঠালের বাগান। তারই একটা গাছতলায় দেখা গেল ও চোখ বুজে বসে। সেই থেকে সান্যালমশায়ের সঙ্গে ওর ভাব হয়ে গেল। যোগবাশিষ্ঠের দলে ভিড়ে পড়ল।

সান্যাল জ্যাঠা বলেন—ছেলেটি শুদ্ধসত্ব।

শীতের প্রথমে কলুপাড়ায় কলেরা দেখা দিল। একদিনে আঠারোটার কলেরা হল, পাঁচটা মরে গেল। নসুমামা কী ভীষণ পরিশ্রম করে সেবা শুরু করলে। হরি কলুর ছোটো ভাই ওর সেবাতেই নাকি বেঁচে উঠল। রাত্রে ঘুমোয় না। নিজে হাতে রোগীদের গা ও বিছানা পরিষ্কার করে।

কলেরায় কলুপাড়া উজাড় হয়ে গেল—ধরলে কিছু দূরে মুচিপাড়াকে। ভয়ে তখন মুচিপাড়ার অনেক লোক পালিয়েছে। বুড়ো হিরু মুচি একদিনের অসুখে মারা গেল। কিন্তু তখন এমন ভয় হয়ে গিয়েচে সকলের, মড়া ঘরের মধ্যে পড়ে রইল সারাদিন, কেউ ফেলতে চায় না। সন্ধের পর নসুমামা একা গিয়ে ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে ফেলে দিয়ে এল খালের ধারে শ্মশানে।

যোগবাশিষ্ঠের আসরে এ কথা শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। আমিও যাব, নসুমামাকে সাহায্য করব। লোকে যে যা বলে বলুক গে।

জ্যাঠামশায় হেসে বললেন—মা, এ কাজ তোমার নসুমামার। তোমার জন্যে নয়। সব কাজে অধিকারী-ভেদ আছে।

—কেন? আমার অধিকার জন্মায়নি?

—তোমার বুড়ো শাশুড়ি মরে গিয়েছে, জগতে আরও কী বুড়োহাবড়া নেই?

—আপনি বলুন নসুমামাকে। ও আমাকে নিতে চায় না কোনো কাজে। আমি যাব, জ্যাঠামশায়।

এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন নসুমামা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। কলুপাড়ার সবাই হায় হায় করতে লাগল। খুড়শাশুড়ি বললেন—ভালোই হল চলে গেল, সুবুদ্ধি হয়েছে। বামুনের মুখ অমন করে হাসাতে হয়? ছিঃ ছিঃ

তারপর মুখ টিপে হেসে বললেন—বউমার বাপেরবাড়ির লোক। খুব কষ্ট হয়েচে বউমা তোমার—না? যখন-তখন দেখা হত তো! অন্য গাঁ থাকতে এ গাঁয়ে এসেছিল সেজন্যেই হয়তো, তবুও তো দেশের ঘরের লোক আছে একটা।

ছিলে-খোলা ধনুকের মতো সটাং সোজা হয়ে বলে উঠিনিশ্চয়ই। আমার কষ্ট তো হবারই কথা।

হরি কলু একদিন সান্যাল জ্যাঠার কাছে বললে—অমন মানুষ হয় না। ছোটো ভাইটা বেঁচে উঠল, পায়ে ধরতে গেলাম, বলি তুমি ব্রাহ্মণ, আমার ঘরে হেনস্থা কাজ আর করতে দেব না। দু-মাসের মাইনে বাকি, একটা পয়সাও নিয়ে গেলেন

যাবার সময়। হঠাৎ পালিয়ে গেলেন। আমায় যেন ক্ষ্যামা করেন তিনি। হাতজুড়ে সে উদ্দেশে প্রণাম করলে।

আবার ফাগুনে বনে বনে ফুল ফুটেছে। আবার কোকিলের ডাক পথে পথে। মুচুকুন্দ চাঁপার সুগন্ধে ঘাটের রানা ভুরভুর করে। আমি একদিকে যেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব। জ্যাঠামশায়ের বৈঠকখানায় যোগবাশিষ্ঠ শুনতে যাই রোজ বিকেলে। সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে রিক্ত হয়েই বোধ হয় সেখানে পৌঁছুতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *