1 of 2

নতুন বইয়ের গন্ধ – শুভমানস ঘোষ

নতুন বইয়ের গন্ধ – শুভমানস ঘোষ

রেগেমেগে সুজয় বেরিয়ে তো পড়ল বাড়ি থেকে। এখন যায় কোথায়? এ তো একদিনের ক্রিকেটের মতন টোকেন রাগ নয়, বাস ধরে ধর্মতলায় গিয়ে ম্যাটিনি-শো দেখে আর এক প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে বাড়িতে ফিরে ‘খাব না যাও’ বলে সোজা বিছানায় চলে যাবে। বউয়ের ওপর রাগ দেখানোর ব্যাপারে খাওয়া ব্যাপারটা চিরকালই বেশ কাজে দেয়। তবে তার চেয়েও ভাল হয়, ‘রইল তোর সংসার’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একেবারে মহানগর থেকেই মিলিয়ে যাওয়া। এতে বউকে ভাল রকম জব্দ করা হল, রাগকে রাগ দেখানো হল, আবার সংসারের ক্যাঁচমেচি এড়িয়ে দুদিন ফুরফুরে হাওয়ায় আনন্দ-সফরও হল। একের ভেতর নি।

-আরে সুজয় যে! সাতসকালে হাঁপাতে হাঁপাতে কোথায়?

ভজন দত্ত, মানে ভজাদা। গোঁফদাড়িতে, পান-বিড়ি-গাঁজা-কারণে, আর আধ্যাত্মিক তেজে পঞ্চাশেই বুড়োটে মেরে গেছেন। বিশ বছর কোনো এক মহাতান্ত্রিকের আন্ডারে আধ্যাত্মিক শ্রমদান করে পৈতৃক বাড়ির ভাগ নিতে কিছুদিন হল আবির্ভূত হয়েছেন। এই ভদ্রলোক কী করে বুঝবেন একজন সংসারী মানুষের ঘরে ফিরতে রাত নটার জায়গায় মাত্র দশটা বেজে গেলে বউয়ের কাছ থেকে কী রকম অভ্যর্থনা পাওয়া যায় কী রেটে একটার পর একটা গল্প বলে তবে পার পাওয়া যায়।

—ভাল আছেন ভজাদা? মুখে একটু হাসি টেনে, সুজয় জিজ্ঞেস করল।

—তা তো আছি। কিন্তু তুই চললি কই?

সেটা কি সুজয় নিজেও জানে? চট করে একটা গল্প বনিয়ে দিল, এই একটা সেমিনার আছে।

-কোথায়?

—গোবরায়।

—কি?

না না মগরা, মগরা।

সুজয় আর দাঁড়াল না। বিয়ে করলে সব ছেলেই কি তার মতন গল্প বানাতে শুরু করে? কিন্তু গল্পের বেলুনটা যখন ফাটে তখনই হয় বিপদ। সকালে সুজয় সবে চায়ের কাপে ঠোঁট ঠেকিয়েছে, সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল মঞ্জিরা। বউটা সুজয়ের দেখতে শুনতে ভালই, কিন্তু রাগলেই অবিকল শীত্রে গোড়ায় ওঠা বেগুন। সুজয়ের দিকে সিনেমার টিকিটের একজোড়া কাউন্টারপার্ট বাড়িয়ে দিয়ে রাগে ফেটে পড়েছিল, এটা কী? পকেটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলে। কী এটা?

জিভে চায়ের ছ্যাকা খেয়ে সুজয় আঁক করে উঠেছিল, টিকিট!

—টিকিট? মঞ্জিরা গর্জন ছেড়েছিল—এই যে কাল তুমি বললে কোথায় কোন্ প্রোফেসর না পাবলিশারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে।

–বলেছিলাম নাকি? সুজয় ব্যাপারটা হাল্কা করার চেষ্টা করল— দূর অত হিসেব করে কথা বলা যায় সবসময়? কাল মানসের সঙ্গে সিনেমার গেছিলাম। সিনেমার কথা শুনলে তুমি যেমন ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে যাও, তাই…

—আবার মিথ্যে কথা? মঞ্জিরা টিকিট দুটো কুচিকুচি করে বলল, মানস না মানসী? কার সঙ্গে কাল সিনেমায় গিয়েছিলে? আমি ঘর সামলাব, ছেলে সামলাব, বাবু সিনেমা হলে বসে প্রেম করবেন।

সুজয় কাপ-ফাপ উলটে দিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। সুজয় স্ব সহ্য করতে পারে, কিন্তু চরিত্রদোষের অপরাধ কভি নেহি। আসলে এ ব্যাপারটায় কিছু করে দেখাতে গেলে যে রকম চেহারা আর সাহস থাকা দরকার তার কোনোটাই ওর নেই। তাই এই নিয়ে কেউ বদনাম করলে ওর মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আর যখনই সুজয়ের মাথায় রক্ত চড়ে এখনই ওর বউয়ের মাথাটাও যায় বিগড়ে। ফলে কিছুক্ষণ ভীষণ অবস্থা। কালাশনিকভ, কামান, রকেট-লঞ্চর ব একসঙ্গে চলছে। আর তার পরেই….

চৌরাস্তার মোড়ে পোকার মত কিলবিল করছে একগাদা অটোরিক্সা। সুজয় ঘাড় গুঁজে তার একটায় চড়ে বসল। ইন্টারনেটের যুগে পৃথিবীটা দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে। তার সঙ্গে কমে কমে যাচ্ছে মানুষের মাথার মাপ। ভাবতে ভাবতে সুজয়ের মনে পড়ে গেল তার পুত্ররত্ন পাপুর কথা। গত জুলাইয়ে তিনে পা রাখলে কী হবে, অটোরিক্সার ওপর কীসের এত টান কে জানে। খেতে বসে ভূত রাক্ষস রাজারানি আঙুরফল টক, এমনকী, লেটেস্ট শক্তিমানও চলবে না, ওকে অটোর গল্প বলতে হবে।

সুজয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল। একের ভের তিনে এই একটাই অসুবিধে, ছেলেটা। আরও সমস্যা, ছেলে এই একপিসই। দুটো হলে একটাকে বউকে ধরিয়ে দিয়ে উঁটের মাথায় বলে দেওয়া যেত, নিজের পথ নিজে দেখে নাও। ডিভোর্স হলেও কাঁচকলা। একটা তো আমার কাছে রইলই। বলে কিনা মানসী! ইস কেন যে আর একবার ট্রাই করিনি।

-হাওড়া?

সুজয় তাকিয়ে দেখল এক গুরুগম্ভীর ভদ্রলোক বকের মুখ বাড়িয়ে তাকে দেখছেন।

—হুঁ। সুজয় ঘাড় নাড়ল।

–কখন ছাড়বেন?

সামনের সিটে বসে আছে বলে ভদ্রলোক সুজয়কে ড্রাইভার ভেবেছেন। সুজয় গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, এই লোক হলেই ছাড়ব।

ভদ্রলোক অটো কাঁপিয়ে ভেতরে ঢুকে স্কুম ছাড়লেন, নে নে ডাক। আমার তাড়া আছে।

ড্রাইভার কনফার্ম হতেই একধাক্কায় তুই। মানুষের মাথার মাপই কি শুধু কমছে? সুজয় বেঁকে গেল ভদ্রলোকের দিকে, ট্রেন ধরবেন নাকি?

ভদ্রলোকেরা সাধারণত অটোয় উঠেই সিগারেট ধরিয়ে ফেলেন। পাশের লোকের অসুবিধা হচ্ছে কি না ফিরেও তাকান না। ইনিও সুজয়ের নাক তাক করে একরাশ এঁটো ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, হুঁ, কর্ড। বেরিয়ে গেলে একগাল মাছি।

সুজয় নড়েচড়ে বসল। গুড়াপ স্টেশনটা কর্ড লাইনে না? ওখানেই তো ওদের অরুণাংশু থাকে। বড় ভাল ছেলে অরুণাংশু। সুজয়ের অনেক জুনিয়র। ছেলেটা কলকাতার একটা পত্রিকা-অফিসে ছবি আঁকে। হাতটা ভারি চমৎকার। কতবার বলেছে তার বাড়িতে যেতে। সুজয় ঘড়িটা দেখল, অরুণাংশু এগারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোয়। দেখিই না একেবার ট্রাই করে।

—এই যে কাকু, আপনি সামনে গিয়ে বসুন তো।

অটোরিক্সার ড্রাইভার এতক্ষণে দেখা দিয়েছেন। জিনস-টিনস পরা শৌখিন ছোঁকরা। তার পেছনে কুচোকাচা সমেত পুরো এক ব্যাটেলিয়ন অবাঙালি গৃহবধূ। অটোর এই এক মজা। কেউ নেই, পিঁপড়ে কেঁদে বেড়াচ্ছে। তারপর এল তো এল বাঁধ ভেঙে, কুল উপচে, দলে দলে, পালে পালে। অটোওয়ালারা মহানুভব, কাউকে ফেলে যেতে রাজি নয়।

ভদ্রলোক ‘হুঁহু’ বলে ভয়ানক এক নাকঝাড়া দিয়ে সুড়সুড় করে নেমে সুজয়ের পাশে বসলেন। বসলেন মানে অর্ধেক ভেতরে, অর্ধেক বাইরে। এইবার সুজয়ের হাসির পালা। হাসতে হাসতে ভদ্রলোককে বলল, বুঝলেন তো এখন কেন আমি ভেতরে বসিনি? সিগারেটটা ফেলুন এবার।

গুড়াপে পৌঁছতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। সুজয়ের যতদূর মনে পড়ে অরুণাংশু প্ল্যাটফর্ম ধরে কিছুটা গিয়ে একটা লেভেল-ক্রসিংয়ে কথা বলেছিল। তার আশেপাশেই ওর বাড়ি। সুজয় হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে লোকজনের মুখগুলো ভাল করে লক্ষ করছিল। অরুণাংশুর বেরিয়ে পড়ার টাইম হয়ে গেছে।

ঠিক দুমিনিট লাগল লেভেল-ক্রসিংয়ে পৌঁছতে। লোকজন-দোকানপাট গাড়িঘোড়ায় জায়গাটা জমজমাট। পাকাবাড়িও বিস্তর চোখে পড়ছিল। সুজয় একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। দোকানের শো-কেসে মাখা-সন্দেশ, আর বারকোষে। পেটাই পরোটা ছাড়াও রকমারি মিষ্টির সঙ্গে প্রচুর ভিমরুল আর মাছি চোখে পড়ছিল। সুজয় দোকানদারকে পাঁচশো মাখা-সন্দেশ বলতে না বলতে ভুবন অন্ধকার করে দিয়ে সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াল একটা ট্রেকার। গাড়ির চাকাগুলো ছাড়া আর কিছু দেখাত যাচ্ছিল না। পেছনের ফুটবোর্ডেও মেয়েরা ঝুলছিল। পাপু যদি দেখ! সুজয়ের মনটা ধাপ হয়ে গেল আর একটা বাচ্চা যদি থাকত তাহলে এভাবে একা একা রাস্তায় ঘুরতে হত না। বউটাও যা খুশি বলে যেতে পারত না। বলে কিনা মানসী? সুজয়। দোকানদারকে লক্ষ করে গলা ছেড়ে দিল এই যে বড়দা, ওটা পুরো এককিলো করে দিন। যত্ত।

দোকানদার সুজয়কে দেখলেন, আজ্ঞে সব?

সব নয়, এককিলোর বলে সুজয় জিজ্ঞেস করল, এখানে অরুণআংশু সরখেল কোথায় থাকে বলতে পারেন?

–কী হংস বললেন?

—হংস-টংস নয়, অরুণাংশু। রোগা করে কোকড়ানো চুল, গাড়ি আছে। ছবি আঁকে।

—কে, গোদল? আঁকার ইস্কুল করেছে তো? খুব চিনি ওকে। ওই যে দেখছেন মাথায় অ্যানটেনা—ওই বাড়ি। দোকানদার থপাস করে একতাল সন্দেশ দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়ে ফের বললে, কী হংস বললেন?

অরুণাংশুদের বাড়ির সামনেই সুন্দর টলটলে ভরা মস্ত একখানা পুকুর। তাতে শালুক-টালুক ফুটে আছে, হংস-টংস চরছে, ঘাটে কলরব করছে মেয়েবউয়ের দল। সুজয়কে দেখে কোত্থেকে কঁক কঁক করে তেড়ে এলে এক রিয়েল রাজহংস। একলাফে তিন পা পেছিয়ে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে পুকুরপাড়ের ধুলো-ওড়া পথের শেষে রেললাইন দিয়ে হাহাকার করে ছুটে এল ট্রেন। ফ্যানটাস্টিক! এখান থেকে তিনদিনের আগে কখনই নয়। অরুণাংশু ঝাড়া হাত-পা লোক। সুজয়ের একের মধ্যে তিন এবার দারুণ জমে যাবে।

–অরুণ আছে? অরুণাংশু?

কয়েক সেকেন্ডেজ্ঞ মধ্যে বেরিয়ে এল একটা ছেলে। গায়ে গেঞ্জি আর নস্যি কালার পাজামা। ডান হাতের আঙুলে, আংটি, গলায় রুপোর চেন। সুজয় কাঁধের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে বলল, একটু গোদল—অ্যাহ, অরুণাংশুকে ডেকে দেবে ভাই?

ছেলেটা সেকেন্ড কয়েক হাঁ করে থেকে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল, আরে সুজয়দা আপনি? আমায় চিনতে পারছে না?

সুজয় আশ্চর্য হয়ে গেল, তুমি অরুণ। কী আশ্চর্য, তোমার দাড়ি গেল কই?

—কেটে ফেলেছি। আসুন আসুন।

অরুণাংশুদের বাড়িখানা প্রকাণ্ড। গলার আওয়াজ পেয়ে ঘরদোর থেকে বেরিয়ে এল বাচ্চা হাফবাচ্চা, বুড়ো-আধবুড়ো মিলিয়ে কম করে হাফ ডজন লোক। তাদের দিকে চেয়ে অরুণাংশু সগর্বে ‘আমার দাদা’ বলে সুজয়কে খাতির করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল।

অরুণাংশুর ঘরখানা দেখে তা লেগে গেল সুজয়ের। ঘরের আধাআধি আলুতে বোঝাই। আলুর ফাঁকে ফাঁকে গোটানো আর্ট-পেপার, রং-তুলিরুলার, ড্রইং-খাতা, ল্যান্ডস্কেপ-মা, ছেলে-পাগলা ঘোড়া একটার পর একটা। এই ঘরটা দেখে বোঝা যায় দেহকলার সঙ্গে শিল্পকলার তলে তলে ভালই মাখামাখি আছে।

–সুজয়দা, একেবারে বিছানায় উঠে বসুন। অরুণাংশু খুশি খুশি চোখে সুজয়ের দিকে তাকাল—আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। পা তুলে বসুন। বালিশ দেব?

সুজয় হাত নেড়ে ওকে নিরস্ত করে বলল, দেখলে তো বলেছিলাম না, আম্ব। তবে মাইন্ড ইট এসে যখন পড়েছি সহজে নড়ছি না।

অরুণাংশু হেসে ফেলল—খুব ভাল কথা। থাকুন না।

–বটে? আজ কলকাতা যাবে না?

দাড়ি কেটে ফেললেও এখনও দাড়িতে হাত বোলানোর অভ্যাসটা যায়নি অরুণাংশুর। বলল, এই হপ্তাটা ছুটি নিয়েছি।

—ফাইন! বেছে বেছে ঠিক সময়েই এসে পড়েছি, বলো? বলতে বলতে সুজয় নিজেই একখানা বালিশ টেনে নিল—তোমাদের এখানে কী কী দেখার আছে চটপট লিস্ট করে ফ্যালো তো।

—এখানে? অরুণাংশুর চোখ ঘুরে গেল দরজার দিকে, এখানে এস।

সুজয় বালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বসল। নূপুরের রুমঠুন শব্দ বাজিয়ে ঘরে ঢুকে এল পনেরো-ষোলো বছরের একটা মেয়ে। মুখচোখ, চেহারা, রং-টং এককথায়, বাহ! মেয়েটি এগিয়ে এসে হঠাৎ সুজয়কে প্রণাম করে বসল। সুজয় ‘এ কী এ কী’ বলে নড়েচড়ে উঠে অরুণাংশুর দিকে ফিরল, কে গো?

অরুণাংশুর দাড়ি নেই ভুলে গিয়ে ততক্ষণে দাড়ি চুলকোতে শুরু করে দিয়েছে; লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলল, সুজয়দা আপনি জানেন না, এর মধ্যে এটা হয়ে গেল।

অফিসের দু-একজন ছাড়া কেউ জানে না।

সুজয়ের মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল—হয়ে গেল মানে? তুমি বিয়ে করেছ? এই বুঝি সে? মেয়েটা মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। হুম, ঠিক তো, মাথায় সিঁদুর। নাকের এক পাশেও তার গুঁড়ো লেগে আছে। সঙ্গে সঙ্গে কট অ্যান্ড বোল্ড। সুজয়ের মনে পড়ে গেল মঞ্জিরার কথা।

–কী নাম তোমার?

মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল। পালকে ঠাসা সুন্দর একজোড়া চোখ। বলল, মণিকাঞ্চন।

–মণিকাঞ্চন? ফাইন! তোমাদের দুজনকে দেখেই বুঝেছি, মণিকাঞ্চনযোগ কাকে বলে, বলে সুজয় অরুণাংশুর দিকে তাকাল—তোমার তো দারুণ পছন্দ গো, অরুণ। এই না হলে আর্টিস্ট।

অরুণাংশু একগাল হাসল। নিঃশব্দে সুজয়কে থ্যাঙ্কস দিয়ে মণিকাঞ্চনের দিকে ফিরল। সুজয়ের প্রশংসার চোখ দিয়ে এবার সে আবিষ্কার করতে শুরু করল মেয়েটাকে। দেখতে দেখতে আশ্চর্য নরম হয়ে গেল শিল্পীমশাইয়ের চোখ। মুখে নেমে এল অদ্ভুত প্রশান্তি। দৃষ্টিরও সম্ভবত শব্দতরঙ্গ হয়। মণিকাঞ্চন হঠাৎ মুখ তুলে অরুণাংশুর দিকে চেয়ে স্থির হয়ে গেল। এই রকম একটু সময়। তার পরেই লজ্জা পেয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল বাইরে। সুজয়ের গায়ে কাঁটা দিল। এই দৃশ্যটা তার কাছে মঞ্জিরার মতনই ভীষণ চেনা লাগল।

সুজয় ব্যাগ থেকে সন্দেশের প্যাকেট বের করে বলল, অরুণাংশু, আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি তো জানতাম না, তা হলে হাতে করে কিছু নিয়ে আসা যেত। তার বদলে এটা নাও।

অরুণাংশু গোলমাল করে উঠল—আবার এ সব আনতে গেলেন কেন সুজয়দা? এসব ফর্মালিটি আপনাকে মানায় না।

মানায় না, মানিয়ে নিতে হয়। এটাই হয়, জীবন।

অরুণাংশু প্যাকেট নিয়ে চলে গেল। ফিরেও এল কিছুক্ষণ পরে। পেছনে মণিকাঞ্চন। ওর হাতে কাঁচের গেলাসে সরবত।

—আপনি লেখক? গেলাসটা বাড়িয়ে দিয়ে মণিকাঞ্চন হঠাৎ সুজয়কে প্রশ্ন করে উঠল।

সুজয় গেলাসটা ধরে বলল, লেখক কি না জানি না লিখি এই পর্যন্ত। তুমি গল্প টল্প পড়ো?

মণিকাঞ্চন উচ্ছ্বসিত হল-হা হা, পড়ি। আমার গল্প পড়তে খুব ভাল লাগে। অরুণাংশু অবাক হল, এটা তো জানতাম না।

সুজয় জোরে জোরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, এই তো শুরু হল। এইবার একে একে কত বেরোবে। বলে মণিকাঞ্চনের দিকে ফিরল—আমাদের অরুণাংশু ভাইকে কেমন লাগছে মণিকাঞ্চন? ও কিন্তু বড় অভিমানী ছেলে। খুব সেন্টিমেন্ট।

মণিকাঞ্চনের চোখে আগ্রহ ঝিলিক দিল— তাই? রাগি নয় তো? আমার ভয় করে।

—ভয় করে? তা হলে তো তুমি ভিতু। অরুণাংশু ঠাট্টার চালে বলে উঠল।

–একটু একটু। তুমি বুঝি খুব সাহসী।

–একটু একটু।

এ দুটো যে রীতিমতন প্রেমালাপ জুড়ে দিয়েছে। সুজয় মুচকি হেসে গেলাসের দিকে তাকাল। এখন ওরা দুজন দুজনের কাছে নতুন বইয়ের মতন। পাতায় পাতায় কত চমক, কত বিস্ময়! সুজয়ের বুকটা হঠাৎ কেমন টনটন করে উঠল। তার নিজের বইটা পুরনো হয়ে গেছে বলে? আর তার জন্য এদের রুদ্ধশ্বাস দুপুর আর রোমাঞ্চকর রাতগুলোর বারোটা বাজাতে থাকব?

–কী হল সুজয়দা? গেলাসে কিছু পড়েছে?

সুজয় সচকিত হয়ে উঠল। গেলাসের ওপরটা ফেনা ফেনা, একদম তলায় গুলে আসা চিনির মধ্যে একা পড়ে আছে একটা লেবুর বীজ। একেবারে একা। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সুজয় টের পেল ধড়াধড় পড়ে যাচ্ছে একটার পর একটা উইকেট।

–গেলাসে নয়, মনে পড়েছে। সুজয় মুখ তুলে অরুণাংশুর দিতে চাইল —হ্যাঁওড়ার ট্রেন ক’টায় অরুণাংশু?

অরুণাংশুদের ম্যানেজ-ট্যানেজ করে বাড়ি ফিরতে তিনটে বেজে গেল। মঞ্জিরাই দরজা খুলল। ওর চেহারাই বলে দিচ্ছে সারাদিন ধরে ওর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। চুল বাঁধা দূরের কথা, চান-খাওয়াও করেনি নির্ঘাত। মুখখানা শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। দরজা দিয়ে সুজয় মঞ্জিরার কাঁধে হাত রাখল—শোনো মঞ্জু…….

মঞ্জিরা আঁচলের পাখার গন্ধ ছড়িয়ে হনহন করে চলে গেল ভেতরে। তার মানে নো কম্প্রোমাইজ। মেয়েরা কেন যে এত অবুঝ হয়।

সুজয় বাথরুম সেরে ঘরে এল। আলমারির রঙের চোকলা উঠে গেছে এখানে সেখানে। টেবিলটা লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। সোফার কুশনের তুলো বেরিয়ে পড়েছে। পাপু মানুষ হচ্ছে। বিছানায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল মঞ্জিরা। বলে উঠল, রান্নাঘরে খাবার ঢাকা আছে।

বিছানায় পাশবালিশ আঁকড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে পাপু। সুজয় এগিয়ে গিয়ে আর একবার চেষ্টা চালাল-শোনো……

মঞ্জিরা সুজয়ের হাতটা টেলে সরিয়ে দিল জোরে। এত রাগ? তার মানে ও ধরেই নিয়েছে সুজয় অন্য মেয়ের সঙ্গে সিনেমায় যায়? এ তো মহা জ্বালা। তবু সুজয় আর একটা চান্স দিল মঞ্জিরাকে—আরে তাকাও না আমার দিকে!

—সরে যাও সরাও হাত! মঞ্জিরা মুখ তুলল এতক্ষণে।

সুজয় গুম হয়ে গেল এবার। মেয়েদের মাথাটা কি পুরোপুরি ওয়ান ওয়ে……একবার যেটা ঢোকে বেরোয় না কখনও? তার মানে সমস্ত জীবন এই অবিশ্বাস আর সন্দেহের কাটার বিছানায় শুয়ে থাকো। ভাবতে ভাবতে সুজয়ের গলা। চড়ে গেল—তুমি আমায় কী ভাবো বলো তো? কী?

হঠাৎ মঞ্জিরার মুখ ঘুরে গেল সুজয়ের দিকে। সেই সঙ্গে বদলে গেল তার গলা, চোখের ভাষাও–বোকা!

–বোকা? সুজয় হাঁ হয়ে গেল।

—বোকা তো। একেবারে ছেলেমানুষ। বলতে বলতে মঞ্জিরার চোখদুটো নরম আর সুন্দর হয়ে উঠল রাস্তায় রাস্তায় খুব ঘুরেছ?

সঙ্গে সঙ্গে সুজয় গলা কঠিন করে ফেলল, সঙ্গে মানসী ছিল।

মঞ্জিরা ভেঙে পড়ল—তুমি তো জানো আমাকে। চেনো ভাল করে। তবু কেন রাগ করো? বাড়ি ছেড়ে চলে যাও? দিদি-জামাইবাবুর মধ্যে এত ঝগড়া হয়, কই

জামাইবাবু তো কখনও বাড়ি ছেড়ে যায় না। তাকাও না আমার দিকে!

সুজয় ক্লিন বোল্ড হয়ে গেল। আর রাগ নেই, চেয়ে আছে মঞ্জিরার মুখের দিকে। মঞ্জিরা তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, তোমায় খুব কষ্ট দিই, না? মাঝে মাঝে কী যে হয় আমার? পরে এত কষ্ট হয়, এত কষ্ট হয়। আমারও কষ্ট, ছেলেরও কষ্ট। সারাদিন কেঁদে কেঁদে এই ঘুমল।

আবার একটা উইকেট পড়ল। ছেলের কপালে আলতো চুমু দিয়ে সুজয় বলল, সত্যি বেচারির মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। কেন যে ঝগড়া করি আমরা? পাপু খুব কাঁদছিল।

—খুব। খালি বলে বাবা কোথায় গেল আর বাবা কোথায় গেল। একটা ছেলে না? ভীষণ অভিমান।

সুজয় মঞ্জিরার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিল। চুলের মধ্যে ভুরভুর করছে খুব চেনা গন্ধ একটা। কীসের গন্ধ? বলল, একটাই ভাল কী বলো? কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারব না।

মঞ্জিরা কেঁপে উঠল একেবারে। বলল, ছেড়ে যাবে? ইশ? দেখি তো কেমন ছেড়ে যাও। বলে আচমকা সুজয়ের বুকে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সুজয় চমকে উঠল। এই তো মনে পড়েছে তার। বই, বই! কী আশ্চর্য, মঞ্জিরার গায়েও অবিকল নতুন বইয়ের গন্ধ। ফরফর করে উড়ছে তার একটার পর একটা পাতা।

দেখতে দেখতে সুজয় একদম অল-আউট হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *