2 of 2

ধারাবাহিক – মৃণাল বসুচৌধুরী

ধারাবাহিক – মৃণাল বসুচৌধুরী

হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে একটু অবাক হ’ল আরতি। শ্রীনগরে এত ভালো ভালো হোটেল থাকতে হঠাৎ নিরঞ্জন এখানে থাকার কথা ভাবল কেন? থাগে—আরতি মন থেকে ভাবনাটা তাড়াল। ওর কোন অসুবিধে নেই। তাছাড়া হোটেলটা খারাপ নয়—ডাল লেকের মাঝখানে দ্বীপের মতো একটা জায়গায়—পুরনো ধরনের একটা বাড়ি। সম্প্রতি বোধহয় রং করা হয়েছে। সামনে ছোট্ট কিন্তু সুন্দর ফুলের বাগান। চতুর্দিকে জল। হোটেলের সামনেই নৌকো তৈরী—কোথাও বেরোতে গেলে ওরাই নিয়ে যাবে। আরতির আবার জলে খুব ভয়। সাঁতারও জানে না। বারবার নৌকো করে যাবার কথা ভাবতে একটু খারাপ লাগল তার? অবশ্য নিরঞ্জন সঙ্গে আছে—কোন কিছুতেই এখন আর ভয় নেই আররি। আশ্চর্য! এই ক’দিন আগেও এই লোকটার কোন অস্তিত্বই ছিল তার কাছে আর আজ কেমন পরম নির্ভরতায় নিজের ভালো-মন্দ সমস্ত কিছুই দিয়েছে নিরঞ্জনের হাতে।

—কি ভাবছো? এগিয়ে এল নিরঞ্জন। এতক্ষণ নৌকো থেকে নামানো মালপত্রের তদারকি করছিল সে।

—কি আবার ভাববো?

—পছন্দ হচ্ছে না? ভালোনা পরিবেশটা?

–খুব ভালো। দারুণ রোমান্টিক।

–এই রোমান্স ব্যাপারটা অবশ্য আমি ঠিক বুঝি না-হাসল নিরঞ্জন।

—সেটা সময় মতো বোঝা যাবে—মুখ টিপে একটু হাসল আরতি।

নিরঞ্জন মুহূর্ক্সে জন্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। হাসলে আররি চিবুকে বেশ কয়েকটা টোল পড়ে। কেমন যেন মোহময়ী হয়ে ওঠে।

—কি দেখছো?

—তোমায়।

—আমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো?

নিরঞ্জন হেসে এগিয়ে গেল অফিসের দিকে। এবার আরতির দেখার পালা। পেছন থেকে নিরঞ্জনকে দেখল সে। সুন্দর সুঠাম চেহারা-দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। কানের পাশে অবশ্য কিছু চুল পেকে গিয়েছে–তবু–

—চলো। দোতলার কোণের দিকে ঘরটা পাওয়া গিয়েছ। আমি টেলিগ্রাম করে এটাই বুক করেছিলাম।

—কেন? ঠিক ঐ ঘরটাই কেন?

–আসলে ঘরটা বড় ভালো। চারদিকের জানলা খুলে রাখলে ঘরটা একেবারে–

–স্বর্গ হয়ে ওঠে। আরতি হাসল।

–ঠিক বলেছো। একেবারে মাটির স্বর্গ।

ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত হয়ে উঠল নিরঞ্জন। সাইড ব্যাগ থেকে তোয়ালেটা বার করে চায়ের অর্ডার দিল—আর তারপরেই ঢুকে গেল বাথরুমে। আরতি জানলার সামনে দাঁড়াল। এদিকটায় শুধু জল। ছোট ছোট নৌকা করে চলেছে সবাই। কেউ কেউ বাজার করে ফিরছে। দূরে একটা নৌকোয় অনেক রঙীন জিনিষ দেখে একটু কৌতূহলী হয়ে উঠল আরতি। কাছে এলে বুঝতে পারল ওটা একটা চলমান স্টেশনারী দোকান। বিভিন্ন হোটেল, হাউসবোটের বোর্ডাররা ওর ক্রেতা। একটু আগে ঘরে ঢুকেই কেমন যেন হতাশ হয়ে গিয়েছিল সে। একেবারেই সাদামাটা একটা ঘর। বিছানার চাদর আর ঘরের পর্দাগুলো ময়লা—প্রায় রং ওঠা। বাথরুমটাও কেমন ছোট আর অপরিষ্কার। এখন এই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অবশ্য মন্দ লাগছে না—অদ্ভুত এক ধরনের মজা আছে। সামনের জল, নৌকো আর হাউসবোটগুলোর ছাদ পেরিয়ে চোখ চলে যায় দূরের পাহাড়ে। আরত্রি মন ভরে ওঠে। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

বিয়ের আগে কলকাতা ছেড়ে খুব বেশী বেরোয় নি আরতি। একবারই বাবার সঙ্গে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিল। আরতির বাবা কাজ করতেন রেলে। পাশ, পি.টি.ও পেতেন—তবু ওরা কখনো বাইরে যায়নি। কারণ বাবার জন্য খুব কষ্ট হয় আরতির। প্রচণ্ড অভাবের মধ্যেও বাবা কোনদিন ভেঙে পড়েননি—অন্তত ওদের চোখের সামনে। শুধু—সেদিনের কথাটাও আজও মনে আছে আরতির। ঐ একদিনই বাবার চোখে জল দেখেছিল সে।

…সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে মুখ হাত ধুয়ে আরতিকে ডেকেছিলেন পরিমলবাবু। ওর বাবা। সামনে চায়ের কাপটা রেখে বাবার পাশে বসেছিল ও। মা ও বসেছিলেন বিছার এক কোণে। আরতির চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বাবা বলেছিলেন—

–তুই বড় হয়েছিস—আমার অবস্থা তো সব বুঝিস। ভাবছিলাম—

বাবা বোধহয় কথাগুলো গুছিয়ে নেবার জন্য থেমে ছিলেন একটু।

–কবে যে তোর বিয়ে থা দিতে পারবো কিছুই জানি না। ইতিমধ্যে নিরঞ্জনবাবু একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছে—

আরতি কোন কথা বলেনি সেদিন। নিরঞ্জনবাবুকে সে চিনতো। ওর বান্ধবী অসীমার মামা। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। ওর স্ত্রী বছর দুয়েক আগে চলে গিয়েছে ওঁকে ছেড়ে। ছেলেপুলে নেই। অসীমার কাছেই এসব শুনেছে আরতি। নিরঞ্জনবাবুর স্ত্রী অঞ্জলিদেবী নাকি খুব আধুনিকা ছিলেন– আর…

একটু থেমে পরিমলবাবু আবার বলেছিলেন–

–খবর নিয়ে দেখেছি, লোকটি খারাপ নয়। সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান। টাকা পয়সাও অনেক। কলকাতায় দুখানা বাড়ি—পৈতৃক ব্যবসা বড়বাজারে। শুধু বয়সটাই—

—বেয়াল্লিশ, তেতাল্লিশটা আজকাল কোন বয়সই নয়—

এতক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎ ওর মাকে কথা বলতে শুনে একটু অবাক হয়েছিল আরতি। কিন্তু কেন জানি না সেদিন বোধহয় বোবা হয়ে গিয়েছিল সে। নীরবে শুধু তাই শুনেছিল—

—আসলে কোন মা বাবাই চায় না—কোন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে মেয়ের সম্বন্ধ করতে, কিন্তু–

—আমি সব বুঝি বাবা—আরতি উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ। সেই প্রথম এবং সেই একদিনই আরতি কাঁদতে দেখেছিল তার বাবাকে।…

—চা দিয়েছে? মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরোল নিরঞ্জন।

—না তো! আরতির পাশে দাঁড়িয়ে নিরঞ্জন বললো

-কি, বলেছিলাম না–ঘরটা—

—হ্যাঁ খুব সুন্দর…

—আসলে…

কি যেন একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল নিরঞ্জন। আরতিও কিছু বললো না। এই মুহূর্তে অনেকগুলো প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মনে। শুধু হোটেলটা দেখেই নয়–যেদিন এখানে আসার কথা ঠিক হয়েছিল—সেদিন থেকেই কেমন যেন একটু অবাক হয়েছে আরতি। নিরঞ্জনের যা সামর্থ্য তাতে ট্রেনের সেকেণ্ড ক্লাসে আসার কথা নয়। নিজের ব্যবসার কাজে বাইরে যেতে হলে প্লেনে যায়—পাঁচতারা হোটেলে থাকে—অথচ–

এসব নিয়ে অবশ্য কিছুই মনে করেনি আরতি। সেকেণ্ড ক্লাসে আসা কিম্বা মাঝারী হোটেলে থাকা এসবে আরতির কোনরকম কষ্টই হবার কথা নয়—ওর খারাপ লেগেছে নিরঞ্জনের অসুবিধার কথা ভেবে। কিন্তু–

—আসুন মেমসাহেব—চা তৈরী।

—নিরঞ্জনের পাশের চেয়ারে বসল আরতি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাকাল নিরঞ্জনের দিকে।

-কি দেখছো?

–সাহেবকে? খালি গায়ে বসে আছো, ঠাণ্ডা লাগছে না?

–না, গরমজলে স্নান করলাম তো।

আরতি উঠে গিয়ে স্যুটকেশ থেকে হাউসকোটটা বার করে নিয়ে এল–

–নাও এটা পরো। গরমজলে স্নান করেছে ঠাণ্ডা লাগবে। ওঠো—

আরতির ভালোবাসা মেশানো হুকুম মেনে নিল নিরঞ্জন

—তুমি বোধহয় ভাবছো, এত হোটেল থাকতে এখানে এলাম কেন?

–কই না তো’—আমার তো ভালোই লাগছে।

—আসলে–

—কি আশ্চর্য! আমার সত্যি ভীষণ ভালো লাগছে। অসুবিধে যদি কিছু হয়—তোমার হতে পারে—আমার

নিরঞ্জন কিছু না বলে তাকাল ওর দিকে। সেই তাকানোয় ঠিক কি ছিল বোঝাতে পারবে না আরতি। তবে ওর হঠাৎ জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হয়েছিল নিরঞ্জনকে।

—শোনো, আমি একটু বেরোবো। তুমি বরং স্নানটান করে তৈরী হয়ে নাও।

–কোথায় যাবে?

–এই একটু…

–আমায় নিয়ে যাবে না?

–না, না, বেড়াতে যাচ্ছি না বাজারেও নয়—একটু সামনের দোকানে গিয়ে টুকিটাকি…।

—ও আমি বুঝি বাজার ছাড়া, বেড়ানো ছাড়া কিছু বুঝি না—মুখ ফুলিয়েছিল আরতি। তারপরেই হেসে ফেলেছিল।

—যাও ঘুরে এসো। দেরী করো না। বাথরুমে ঢুকতে গিয়েই মাথায় একটা ধাক্কা খেল আরতি। দরজাটা ছোট ছিল খেয়াল করেনি। হাউসকোট আর ভোয়ালেটা রাখতে গিয়ে দেখল কাঠের দেয়ালে কয়েকটি পেকে ঘড়া আর কিছু নেই। নিজের মনেই একটু হাসল সে। ব্যাপারটা সত্যিই কেমন অদ্ভুত লাগছে। বিয়ের পর এই দুমাসে নিরঞ্জনকে যতটুকু দেখেছে তাতে আর যাই হোক আরত্রি এ কথা কখনোই মনে হয় নি যে রিঞ্জন টাকা পয়সা নিয়ে খুব ভাবে। প্রায়দিনই কাজ থেকে ফিরে ওকে নিয়ে চলে গিয়েছে রেস্তোরাঁয়। রব্বিার সকালে হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছেদু’জন গাড়ি হাঁকিয়ে-যে দিকে খুশি। আরতিকে অবাক করে দেবার জন্য প্রায়ই কিনে এনেছে দামী দামী শাড়ি-পারফিউম, সাবান আরো কত কি! আররি খুব সিনেমা দেখার শখ শুনে এই তো সেদিন, নিরঞ্জন একটা ভিডিও টেপ নিয়ে এল বাড়িতে সেই রিঞ্জন সামান্য কিছু পয়সা বাঁচাবার জন্যে, হঠাৎ..কে জানে?

বাথরুম থেকে বেরিয়ে জানালার কাছে একটা চেয়ার নিয়ে বসল আরতি। হাতে চিরুনী। সামনে লেকের মধ্যে সারি সারি নৌকো। জলের ওপ্র লম্বা দাগ টেনে রঙীন নৌকার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সামনের আকাশে চোখ রাখল আরতি। এক ঝাক পানকৌড়ি। ছন্দময় তাদের গতি। যেন আকাশ জুড়ে আলপনা আঁকছে। হঠাৎ একটু উদাস হয়ে গেল আরতি।

—কি পাখি বলো তো?

—পানকৌড়ি।

–দ্যাখো কেমন অদ্ভুত নক্সা কেটে উড়ছে আকাশেযেন এই বিকালবেলাটাকে মোহময় করে দেবার দায়দায়িত্ব আজ ওদের ও। যেন তোমার আমার এই মিলনমধুর ক্ষণটাকে স্মরণীয় করার…

খুব ভালো কথা বলতে পারত শেখর। পরম মুগ্ধতায় ওর কথা শুনতে শুনতে কতদিন সমস্ত চরাচর ভুলে থেকেছে আরতি। তখন শেখকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকার কথা স্বপ্নেও কি ভাবতে পারত সে? না, বোধহয়। অথচ, বাবার কথায় কোন আপত্তি না করে কি করে নিরঞ্জনের ঘরে চলে এল—কোন অভিমানে? নাকি বাউণ্ডুলে শেখরের ওপর ভরসা রাখতে পারল না সে? একথা ঠিক, শেখ তাকে ভাবাসতো। কিন্তু বিয়ে করে তাকে ঘরুণী করার সামর্থ্য অর ছিল না। কেননা মামার সংসারে শের নিজেই ছিল পরগাছা। তবু হয়তো। না, আরতি আর ভাবতে চায় না এসব। শেখরকে সে ভালোবাসতো ঠিকই, কিন্তু রিঞ্জনকে নিয়েও তার কোন অসুখ নেই। শে তার স্বপ্নের বাসিন্দা আর নিরঞ্জন বোধহয় মরে দেবতা। না, তখন বোধহয় নিরঞ্জনও তার স্বপ্নের সহ।…

—কি ধর মেমসাহেব? রেডি?

—অনেকক্ষণ। এত দেরী করলে যে।

—খবরাখবর নিচ্ছিলাম। একটা গোলমেলে খবর আছে।

—কি?

–গুলমার্গ, পহেলগাঁও যাওয়া হচ্ছে না আমাদের।

—তাতে কি হল?

–বাঃ, কত আশা করে আছো–

—শোনো, গুলমার্গ তো দূরে কথা, আমি যদি এই ঘর থেকেও আর না বেরোই, আমার কোন ক্ষোভ নেই।

–সত্যি বলছো?

–সত্যি, এমন সুন্দর একটা পরিবেশ সঙ্গে তুমি, আর কি চাই?

–তোমার কষ্ট হচ্ছে না?

–না, বিশ্বাস করো—

এগিয়ে গিয়ে নিরঞ্জনের বুকে মাথা রাখল আরতি। নিরঞ্জন তুলে ধরল ওর মুখ। আরতি দেখল নিরঞ্জনের চোখে এক অপরূপ আনন্দের আভাস। কিসের আনন্দ নিরঞ্জনের? কে জানে? নিরঞ্জনকে মাঝে মধ্যে কেমন যেন বুঝতে পারে না আরতি। প্রতিটি ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে নিরঞ্জনের চোখ থেকে কেমন যেন কৃতজ্ঞতার ঝর্ণা ঝরে পড়ে। অথচ ঠিক উল্টোটাই হবার কথা। আরতিরই নতজানু হওয়া উচিত নিরঞ্জনের সামনে। কিন্তু…

রাত্তিরে খাবার টেবিলে বসে আরতির দিকে মেনুকার্ডটা এগিয়ে দিল নিরঞ্জন। আরতি কিছুক্ষণ সেটা দেখে ফিরিয়ে দিল নিরঞ্জনকে—

—তুমি অর্ডার দাও।

–না, আজ তুমি বলবে।

—আমি তো যা পাবো তাই খাবো।

—তাহলে তুমি বরং মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন কারি নাও। সঙ্গে একটা ফিরে প্রিপারেশন।

—আর তুমি?

–আমি একটু ব্রেডটার আর কফি খাবো ভাবছি।

—আমিও তাই খাবো-আরতি বলল—আজ আমারও শরীরটা ঠিক…

নিরঞ্জন হেসে উঠল।

—মানে আমি না খেলে তুমি খাবে না?

–ঠিক তাই। আররিও মুখে হাসি।

নিরঞ্জন কিছু না বলে তাকাল আরতির দিকে। আবার সেই অস্বস্তিকর চাহনি। যার অর্থ আরত্রি জানা নেই। শ্রীনগরে আসার পর হঠাৎ যেন কেমন অসহায় হয়ে গিয়েছে নিরঞ্জন।

সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে নিরঞ্জনকে ডাকল আরতি। হাতে চা। হাত থেকে কাপটা নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে আরতিকে কাছে টেনে নিল নিরঞ্জন। ওর মুখের ওপর মুখ রেখে বললো–

—তুমি এত ভালো কেন বলো তো?

—আসলে তোমার চোখ দুটো নিষ্পাপ আর ভালো বলে তুমি আমাকেও ভালো দ্যাখো। আমি কিন্তু আস্ত একটা ডাইনী।—দুজনের হাসির মধ্যেই শব্দ হল দরজায়। রিঞ্জনকে তুলে দিল আরতি। বাইরে লোকটার সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিরঞ্জন ঘরে ঢুকে জানতে চাইল–

—আরতি, তোমার কি কেনাকাটার আছে বলো তো?

–বিশেষ কিছু না।

–তবু–

—যদি রাগ না করো, অনেক দিনের ইচ্ছে বাবার জন্য একটা শাল…

মুগ্ধ বিস্ময়ে একটার পর একটা শাল দেখছিল আরতি। পাশে নিরঞ্জন অনেকক্ষণ ধরে একটা শাল নিয়ে কি যেন ভাবছিল।

—কি ভাবছো? জানতে চাইল আরতি।

—না–কিছু না—

—ওটা তোমার জন্য নাও না—খুব ভালো।

—এবার বেশী খরচ করা যাবে না—তোমার যা নেবার নাও।

ভিড়ের মধ্যে নিরঞ্জনকে একপাশে টেনে নিয়ে এল আরতি

—আমি বলছিলাম কি ঐ শালটা তুমি নিয়ে যাও বাবার জন্য পরে কিনবো—তাছাড়া কলকাতায়ও তো পাওয়া যায়। দেখলে না—আমি নিজের জন্য কিছুই দেখলাম না। কলকাতায় কিনবো’খন। তবে তুমি যে শালটা দেখছিলে ওরকম কলকাতায় পাবে না।

না, না, তা হয় না–তুমি বাবার জন্য নিয়ে নাও।

—সে আমি পারবো না।

—তবে আজ চলো–কাল দেখা যাবে।

দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছিল দু’জনে। আরতি কষ্ট পায়নি। কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে তার। নিরঞ্জন টাকা পয়সার কথা ভেবে একটা শাল কিনলো নাসত্যি, স্বামীর নতুন একটা রূপ দেখল আরতি—এ ক’দিনে। হঠাৎ কেমন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। ব্যবসায় কোনরকম গোলমাল হয় নি তো? হঠাৎ টাকা পয়সা আটকে গেল কোথাও? কিন্তু তাই বা কি করে হবে? আসার আগের দিন রাত্তিরেই তো প্রায় জনা পঁচিশ বন্ধুবান্ধব নিয়ে পার্টি দিল। তাহলে? নিজের ওপর হঠাৎ রাগ হল আরতির। বাবার জন্যে শালের কথাটা না বললেই হ’ত। সেকেণ্ড ক্লাসে আসা, এই হোটেলে থাকা, এ সমস্ত দেখে তার বোঝা উচিত ছিল, যে কোন কারণেই হোক, নিরঞ্জন একটু অসুবিধেয় আছে। অন্তত আর্থিক ব্যাপারে। কে জানে কি ভাবল ও। কিন্তু…না, কিছুতেই মেলাতে পারছে না আরতি। আসার দিন সকালেও নিরঞ্জন আরতিকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলেছিল-রাখো, বেড়াতে যাচ্ছো, তোমার লাগতে পারে। আরতি সে টাকা নেয়নি। ঞ্জিনের সঙ্গেই তো থাকবে সারাক্ষণ—আলাদাভাবে কি দরকার হবে তার? এখন এই মুহূর্তে, কিছুই বুঝতে না পারায়, অদ্ভুত এক বিষাদ পেয়ে বসছে আরতিকে।

ভোরের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আরত্রি। বোধহয় ঠাণ্ডায়। উঠে বসে দেখল গায়ের কম্বল মেঝেয়। বাইরে কোথা থেকে যেন এক ফালি আলো ঢুকেছে ভেতরে। সেই আলোয় নিরঞ্জনের মুখ দেখতে পেল আরতি। কেমন যেন মায়াময়। শিশুর মতো নিশ্চিন্ত। হঠাৎ নিরঞ্জনকে খুব আদর করতে ইচ্ছে হ’ল আরতির। কাল রাত্তিরে সে নিরঞ্জনের আর এক রূপ দেখেছে। আহত, যন্ত্রণাময় এক পুরুষ। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরতি খুব কষ্ট পেল—আস্তে আস্তে হাত বোলাল ওর মাথায়। কম্বলটা ভালো করে চাপা দিয়ে দিল গায়ে। কাল রাত্তিরে, ওকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল নিরঞ্জন। আর সেই মুহূর্তে, নিজের সর্বস্ব দিয়ে, ওকে সুখী করার শপথ নিয়েছিল আরতি। এখনও ও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নিরঞ্জনের বিষাদ মাখানো স্বর। ওর প্রতিটি কথা মূর্ত হয়ে উঠে এই ঘরের অন্ধকারে যেন তৈরি করছে এক অবয়ব। ক্লান্ত পরিত্যক্ত, হতাশাক্লিষ্ট এক মানুষের…।

আরতিকে প্রায় বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল নিরঞ্জন—খুব আস্তে বলেছিল

০০একটা কথা বলবো আরতি?

–বলো—

—তুমি আমায় ক্ষমা করো

—কেন?—আরতি অবাক হয়েছিল।

—আমি তোমায় ঠিক চিনতে পারি নি।

আরতি আরো ঘনিষ্ঠ হয় নিরঞ্জনের। কিন্তু ওকে থামায় না। ওর প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করে। পারে না। নিরঞ্জনের চোখ মুখ তখন প্রায় ভূতে পাওয়া মানুষের মতোকণ্ঠস্বরে অনুশোচনার ছোঁয়া

—তোমায় পেয়ে আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে আরতি। মাঝে কিছুদিন ঘেন্না ধরে গিয়েছিল এই জীবনে। তুমি—

একটু থেমে থেমে নিরঞ্জন, হয়ত কিছু ভেবে নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলেছিল,

—এর আগেও আমি একবার কাশ্মীরে এসেছিলাম। তখন আমি সবে ব্যবসা শুরু করেছি। প্রায় দিন আনি দিন খাই অবস্থা। সেবারও এসে অঞ্জলিকে নিয়ে এখানে উঠেছিলাম। হাওড়া স্টেশন থেকেই ও অশান্তি শুরু করেছিল। সেকেণ্ড ক্লাসে অসভ্য মানুষদের ভিড়…এই হোটেলে এসে ঘর দেখে প্রায় তখনই ফিরে যেতে চেয়েছিল অঞ্জলি। আমার দারিদ্র্যকে নিয়ে পরিহাস করেছিল। সেবার লান্ডস্লাইডে সত্যি সত্যিই রাস্তা বন্ধ ছিল গুলমার্গের। অঞ্জলি বিশ্বাস করেনি। ভেবেছিল ওটা আমার চালাকি। কৃপণতা। খাওয়ার টেবিলে বসে অকারণ অনেক খাবারের অর্ডার দিতে ইচ্ছেমতো—খরচ সামলাতে আমি প্রায় রোজই অসুস্থ থাকার ভান করতাম। আমার বুড়ো বাবার জন্য একটা মালার কিনেছিলাম—তার জন্যেও… আর বলতে পারেনি নিরঞ্জন। আরতিও আর কিছু বলতে দেয়নি ওকে। নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিল ওর মুখ। প্রচণ্ড আবেগে-ভালোবাসায়। নিরঞ্জনের চোখের জলে ওর বুক ভিজে যাচ্ছিল। ওর চোখও তখন ঝাঁপসা। সেই মুহূর্তে আরতি চেয়েছিল পৃথিবী তোলপাড় করে সমস্ত সুখ নিয়ে আসতে নিরঞ্জনের জন্য। কানায় কানায় ভরিয়ে দিতে চেয়েছিল ওকে। কিন্তু পরক্ষণেই কেমন যেন অসহায় লেগেছিল নিজেকে—এক ধরনের ভয় পেয়ে বসেছিল। সে কি পারবে? কি আছে তার? না পারুক, তবু চেষ্টা করবে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করবে আরতি।…

বাথরুম থেকে বেরিয়ে আরতি দেখল নিরঞ্জন জিনিষপত্র গোছাতে ব্যস্ত। মুখে মিষ্টি হাসি।

-কি ব্যাপার? ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ না ধুয়ে এসব কি করছো? আররি প্রশ্নে মুখ তুলে নিরঞ্জন বললো—

–বাঃ—যেতে হবে না?

—কোথায়?

–এবার একটা ভালো হোটেলে যাব।

—কেন? পরীক্ষায় পাশ করেছি-তাই?–

–না, না, তা নয়লজ্জা পেল নিরঞ্জন—এমনিতেই অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমায়। আর–

–কিন্তু আমি যে আর কোথাও যাবো না।

–মানে?

—এই হোটেলেই থাকবো।

নিরঞ্জন উঠে দাঁড়ালো। কোন এক সম্মোহনী টান ওকে টানছে আরতির দিকে। দু’হাত বাড়াল নিরঞ্জন। দু’চোখের মধ্যে অসীম সমুদ্রের ঢেউ। যা এখন আছড়ে ভেঙে পড়তে চাইছে আরতির বুকে, মুখে, সমস্ত শরীরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *