তীর্থযাত্রা

তীর্থযাত্রা

মেঘনার জল কালীদহের মতো কালো। কালো কালো ঘূর্ণি যেন সাপের মতো কুন্ডলী পাকাচ্ছে। টলমল করে উঠেছে এত বড়ো ভাউলে নৌকাখানা। নরোত্তম বললে, হুশিয়ার ভাই হুঁশিয়ার।

কঠিন মুঠোতে হালের আগা আঁকড়ে ফরিদ মাঝি তাকালে আকাশের দিকে। উত্তরে যেখানে তীরতটের কাছে গাংশালিকের ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে আর নিরবচ্ছিন্ন খানিকটা সবুজ অরণ্যকে দেখা যাচ্ছে ঝাপসাভাবে, ঠিক ওইখানে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের রাশ জমে উঠেছে। ফরিদ মাঝি জানে লক্ষণটা ভালো নয়। কালো কালিন্দীর মতো মেঘনার জল থেকে কালীয়নাগের বিষনিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে যেকোনো মুহূর্তে ওই হাঁসের পাখার মতো মেঘ কষ্টিপাথরের রং ধরে দিগদিগন্তকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। তারপর মাতাল মেঘনা তো রইলই।

ঘূর্ণির আকর্ষণে ভাউলে নৌকা থরথর করে কাঁপছে। নিজের অজ্ঞাতেই নরোত্তমের একখানা হাত চলে গেছে মলিন পৈতার গুচ্ছের ভেতরে। না, নিজের প্রাণের ভয় করে না নরোত্তম। জীবন তো পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মতো, একদিন টপ করে ঝরে যেতে পারে। দেহতত্ত্বের গানে বলেছে–ধুলোর দেহ একদিন ধুলো হয়ে যাবেই। কালের অনিবার্য করাল স্পর্শকে কেউ অতিক্রম করতে পারবে না কোনোদিন। ধুলো না-হয়ে দেহটা জলে জলাঞ্জলি হয়ে গেলেও নরোত্তমের দিক থেকে আক্ষেপ নেই কিছু। কিন্তু এতগুলো প্রাণীকে জলে ডুবিয়ে মারলে যে মহাপাতক এসে তার ওপরে অর্শাবে, তারজন্যেই নরোত্তম খুব বেশি পরিমাণে চিত্তচাঞ্চল্য বোধ করছে।

ও মাঝি ভাই হুঁশিয়ার। দেখো, সবসুদ্ধ জলে ডুবিয়ে মেরো না যেন।

ক্যাঁ…চ। নৌকাটাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হাল ঘুরে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘামে ফরিদের দু হাতে কঠিন মাংসপেশি দুটো জ্বলছে—শক্তি আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। করকরে ভাঙা গলায় ফরিদ বললে, তুমি চুপ করে বসো-না ঠাকুর। পাঁচ পিরের নাম নিয়ে পাড়ি ধরেছি, যা করবার আল্লা করবেন।

ফরিদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল নরোত্তম। লোকটা দেখতে কুৎসিত। শুধু কুৎসিত নয়—ভয়ংকর। পুরু পুরু প্রকান্ড ঠোঁট দুটো কাতলা মাছের মতো বাইরের দিকে ঝুলে পড়েছে। অসংখ্য লাল লাল শিরায় রেখাঙ্কিত চোখে যেন একটা ক্ষুধার্ত বন্যজন্তুর পিঙ্গল হিংস্রতা। গালে আর কপালে রাশি রাশি ব্রণের ক্ষতচিহ্ন। নিষ্ঠুর উদ্দাম মেঘনার সঙ্গে যেন কোথায় ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে লোকটার।

কিন্তু পাঁচ পির! বিশাল মেঘনার দিকে তাকিয়ে যেন আশ্বাস পায় না নরোত্তম। শুধু পাঁচ পিরেই কুলোবে না। এই নদী পাড়ি দিতে তেত্রিশ কোটি দেবতার দরকার, নইলে উনপঞ্চাশ পবনকে ঠেকাবে কে? একটা বরুণমন্ত্র জানা থাকলে সুবিধে হত, জপ করা যেত এই সময়ে। ময়লা পৈতার ভেতরে নরোত্তমের আঙুলগুলো চঞ্চল হয়ে উঠল।

নৌকোয় অনেকগুলো প্রাণী। সবাই মিলে তারস্বরে কোলাহল জুড়ে দিয়েছে। নরোত্তমের মেজাজ আরও বেশি করে বিগড়ে গেল। একা কত দিক সামলানো যায়?

ভাদ্রের ভরা গাং। আকাশে শরতের নীলাঞ্চল মায়া ছড়িয়েছে। দূরে আধডুবো চরের উপরে চিকচিক করছে সোনা-মাখানো বালি, স্তবকে স্তবকে ফুটে উঠেছে কাশের ফুল। পাড়ের কাছে গাংশালিকের ঝাঁক উড়ছে। আশ্বিন আসন্ন।

পূর্ববাংলার নদী দিয়ে এই সময়ে চলাচল করে অসংখ্য ভাউলি নৌকা, নরোত্তমের এই নৌকাখানার মতো। ঘরে ঘরে দুর্গা পূজা, আনন্দমুখরিত শারদীয়ার আয়োজন। দেশ-বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা বড়ো বড়ো নৌকায় বোঝাই দিয়ে পাঁঠা বিক্রি করতে আনে—মহিষমর্দিনী চন্ডিকার মহাপ্রসাদ।

কিন্তু তেরোশো পঞ্চাশ সালের আশ্বিন মাস। বাংলার সীমান্তে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়েছে মেঘনার উত্তর দিগন্তে মহানাগের বিষনিশ্বাসের মতো। এসেছে সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ। ভাঙা চন্ডীমন্ডপে সাপ আর শেয়াল এসে বাসা বেঁধেছে। বোধনতলায় ছড়িয়ে আছে নরমুন্ড। দেবী এবার আদৌ মর্তে আসবেন কি না পঞ্জিকায় উল্লেখ নেই। কিন্তু তাঁর দোলা-চৌদোলা যে আগে থেকেই পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সে-সম্পর্কে সন্দেহ করবে কে? শাস্ত্র বলেছে, ফল মড়কং।

তাই পাঁঠার নৌকায় এবার পাঁঠা নেই। এবার নতুন পদ্ধতিতে দেবীপূজার ব্যবস্থা। শহরের পূজামন্ডপে ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত স্বর্ণযজ্ঞের আহুতি। বাংলার ঘরে ঘরে মঙ্গলপ্রদীপের শিখা নিবে গেছে, ছায়াকুঞ্জের নীচে সোনার পল্লিতে কল্যাণী গৃহবধূর কাঁকন আজ আর ছলভরে বেজে উঠছে না। ব্ল্যাক-আউটের দিনেও নিবে যাওয়া তুলসীতলায় প্রদীপ সহস্র ছটায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে মহানগরীর গণিকাপল্লিতে। সন্ধ্যাশঙ্খের শেষ পরিণতি হয়েছে ঘুঙুরের শব্দে, হারমোনিয়ামের বেতালা মত্ততায়, মাতালের জড়িত চিৎকারে। যুদ্ধের কনট্রাক্ট যাদের রাতারাতি গৌরীসেনের ভান্ডার খুলে দিয়েছে, আজ সোনার বাংলা তাদের কাছে প্রতিফলিত হয়েছে সোনালি মদের ফেনিল পাত্রের ভেতরে।

নতুন পুজোর নতুন ব্যবস্থা। দেবী আর ভোলা মহেশ্বরের ভিখারিনি গৃহিণী নন, কুলত্যাগ করে তিনি কুবেরের অঙ্কলক্ষ্মী হয়েছেন। বাংলার নারীত্বও তাই আজ বিশ্বমাতার দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করেছে। যাজন-যজন নরোত্তমের পৈতৃক ব্যাবসা, নতুন কালের হাওয়ায় তার রূপান্তর ঘটেছে। পাঁঠার নৌকায় একদল নারী বোঝাই দিয়ে নরোত্তম বিক্রি করতে চলেছে শহরে। শ্মশান বাংলার গ্রামে গ্রামে রিক্ত মহেশের দীর্ঘনিশ্বাস ঘূর্ণি হাওয়ায় কেঁদে বেড়াচ্ছে।

নৌকার ভেতরে কলহ, কোলাহল আর দাপাদাপি। ভাউলেখানা বাঁ-দিকে কাত হয়ে পড়ল। বলিষ্ঠ মুঠিতে নৌকার হালে মোচড় দিয়ে ফরিদ বললে, তোমার সওয়ারিদের একটু থামাও-না ঠাকুর। যে-হট্টগোল বাঁধিয়েছে, ঝড় আসবার আগেই ওরা ডুবিয়ে দেবে দেখছি।

ছইয়ের ভেতর মুখ বাড়িয়ে দিলে নরোত্তম।

এই, কী হচ্ছে ওখানে? একটু ক্ষান্ত হয়ে বসো-না সবাই।

কিন্তু ক্ষান্ত হবার মতো মনের অবস্থা নয় কারোর। তেরো থেকে ত্রিশ পর্যন্ত নানা বয়সের এক দঙ্গল মেয়ে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে বাদুড়ের ছানার মতো ঝুলে রয়েছে তিন-চারটি শিশু। নরোত্তমের মতে এরা নিতান্তই অনাবশ্যক বোঝা, কিন্তু বর্জন করবার উপায় নেই। কালো কালো জীর্ণদেহ কতগুলো মানবের সমষ্টি। দেখলে বাৎসল্য জাগে না, পা ধরে টেনে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে মেঘনার অথই জলের মধ্যে। আরও যত বিড়ম্বনা ওই অপোগন্ডগুলোকে নিয়েই।

ছোটো ছেলেটাকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে চিৎকার করছে সরলা। ছেলেটার অঙ্গসংস্থান দেখলে মনে হয় কারোর অসতর্ক খেয়াল কালো চামড়ায় ঢাকা অসংলগ্ন কতগুলো অপরিণত অবয়বকে জুড়ে দিয়েছে একসঙ্গে। ঘাড়ে-পিঠে দগদগ করছে ঘায়ের চিহ্ন, চোখ মেলে সেদিকে তাকিয়ে থাকলে ঠেলে যেন বমি আসতে চায়। কিন্তু ওই বিকৃত জীবনটাকেই ঐকান্তিক ক্ষমতায় আঁকড়ে রেখেছে সরলা—বাইরের এতটুকু কাঁটার আঁচড় অবধি যেন সইতে দেবে না।

তুমিই এর বিচার করো ঠাকুর। অমন ভালোমানুষ সেজে বাইরে বসে থাকলে চলবে না।

কী বিচার করব আবার? খেকিয়ে উঠল নরোত্তম। জোড়হাত করে বলছি, জিবে শান দেওয়াটা একটু বন্ধ রাখো সকলে। শুকনো ডাঙায় উঠে যত খুশি চেঁচিয়ে, কিন্তু এখন…

সরলা কিন্তু থামতে চায় না। অদ্ভুত গলা, কানের মধ্যে শানিত হয়ে বিঁধে যায় এসে। মাথার রুক্ষ চুলগুলো ঘাড়ের দু-পাশে গোছায় গোছায় ভেঙে পড়েছে, যেন রক্ষাচন্ডীর মূর্তি। দেখে নরোত্তমের ভয় করে।

জানি জানি, সুখীর ওপরেই তোমার যত নেকনজর। ওকে একটা কথা বলতে গেলেই তোমার বুক চড়চড় করে ফেটে যায়। অতই যদি একচোখোমি তাহলে ওকে নিয়ে মনের সাধে নৌকাবিলাস করলেই তো পারো, সবগুলোকে এক নৌকোয় ঠেলে তুলেছ কেন?

আহা-হা থামো-না। কেন এমন করে চিৎকার করছ, থামো-না। গলার স্বর শান্ত আর কোমল করবার চেষ্টা করলে নরোত্তম, ববাঝোই তো সব, একসঙ্গে চলাফেরা করতে গেলে…

আড়চোখে নরোত্তম তাকাল সুখীর দিকে। আঠারো-উনিশ বছরের সুশ্রী মেয়ে। জাতে জেলে, কিন্তু মুখের শ্রী-ছাঁদ দেখলে সেকথা মনে হয় না কারও। বাইরে নৌকোর গায়ে কালো জল খেলা করছে, তার নির্নিমেষ চোখ দুটো নিবদ্ধ হয়ে আছে সেই জলের ওপর। নিজের ভেতরেই যেন একান্তভাবে নিমগ্ন হয়ে আছে সে। তাকে কেন্দ্র করে এত কলহ আর কোলাহল কিছুই যেন তার কানে যাচ্ছে না।

দেখে অদ্ভুত একটা মায়া হল নরোত্তমের। মেয়েটার ভেতরে এমন একটা কিছু আছে যা সমস্ত মনকে অকস্মাৎ যেমন ব্যথিত, তেমনি পীড়িত করে তোলে। কিন্তু কী করতে পারে নরোত্তম? ব্যাবসা ব্যাবসাই, তার ওপরে কারও কোনো কথা চলে না।

সরলার চিৎকারের কিন্তু বিরাম নেই।

খামোকা? খামোক আমি চেঁচিয়ে মরছি, না? জিজ্ঞেস করো-না তোমার ওই আদরের সুখীকে। আমার ছেলের গায়ে ঘা, আমার ছেলে মরে যাবে। তোর গায়ে ঘা হোক হারামজাদি, তুই মর—মর—মর–

মট মট করে আঙুল মটকাবার শব্দ কানে এল। সরলার চোখ রাক্ষসীর মতো জ্বলছে। চমকে ছইয়ের বাইরে গলা টেনে নিলে নরোত্তম। যেন সরলার অভিশাপটা সাপের ফণার মতো উদ্যত হয়ে উঠে ফোঁস করে তারই বুকে একটা ছোবল মারবে।

দুর্বল গলায় নরোত্তম বললে, যাচ্ছ একটা ভালো কাজে, কালীঘাটে মা কালীর দরবারে। কিন্তু যা আরম্ভ করেছ তাতে মাঝগাঙে নাও ডুবিয়ে তবে তোমরা ছাড়বে।

হালের মাচায় ফরিদ মাঝি পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে নিশ্চল হয়ে। উত্তরের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো যে মেঘের টুকরোটা দেখা দিয়েছিল, হাওয়ার মুখে আবার যেন তা দিকচিহ্নহীন নীলিমার বুক বেয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। গাংশালিকের ঝাঁক চক্রাকারে ঘুরছে মাথার ওপর। গলুয়ের সামনে বসে যে-দুজন মাল্লা দাঁড় টানছে, তাদের পিঠে শুকনো ঘামের ওপর চিকচিক করছে সাদা সাদা লবণের বিন্দু।

কাতলা মাছের মতো প্রকান্ড মুখোনায় খানিকটা ভয়ংকর হাসি ফুটিয়ে তুলেছে ফরিদ।

আর ভয় নেই ঠাকুর। ঝগড়ার চোটেই তুফান পালিয়েছে। যা সওয়ারি তুমি নিয়েছ, মেঘনার সাধ্য নেই যে এদের গিলে হজম করতে পারে।

তা ঠিক। অন্যমনস্কভাবে হেসে বিড়ি ধরাল নরোত্তম।

সত্যি এ এক মহা ঝকমারির কাজ। পরোপকার করতে গেলেও বিঘ্ন অনেক, অনেক বিড়ম্বনা। গাঁটের কড়ি খরচ করে সে এদের কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছে, কালীঘাটে কালী দর্শনও করাবে তাতেও তো মিথ্যে নেই কিছু। তারপরে? তারপরে যা হবে তার জন্যে তো আর দায়ী করা চলে না নরোত্তমকে। দেশ-গাঁয়ে পড়ে থেকে ভিটে কামড়ে মরে যাচ্ছিল সমস্ত, তার চাইতে এ সহস্র গুণে ভালো। তাসের গড়া সংসার তো দুর্ভিক্ষের একটা দমকাতেই ভেঙে পড়েছে। ঠুনকো আত্মসম্মান; পেটে ভাত না পড়লে যে তার এতটুকুও দাম নেই এ সত্য নরোত্তম ভালো করেই জানে।

তা ছাড়া এমন দোষই-বা আছে কোনখানে। কলকাতায় যারা এই জীবনকে মেনে নিয়েছে সহজভাবে, কেমন সুখে আছে তারা। শহরের সমস্ত বড়োলোক তাদের পায়ের তলায় মাথা বাঁধা দিয়ে বসে আছে। রাত্রির আলোয় তাদের রংমাখা মুখগুলো দেখে অপ্সরা বলে মনে হয়, ঋষি-মুনিরও বিভ্রম জাগে তাতে। গায়ে জড়োয়ার গয়না, দামি দামি শাড়ির চটক। ওদের একটি হাসির জন্যে মানুষ ভিটেমাটি বন্ধক দেয়, ওদের অবজ্ঞার অপমানে লাখপতি আত্মহত্যা করে। খুঁটেকুড়ানি থেকে রাজরানি হতে পারে সবাই, নরোত্তমের সান্ত্বনা শুধু যৎকিঞ্চিৎ দালালি ছাড়া আর কিছুই নয়। নিঃস্বার্থ সেবাব্রত ছাড়া আর কোন আখ্যা দেওয়া চলে একে?

ফরিদ হাসে।

ভালো ব্যাবসা তোমার ঠাকুর। ধান-চাল-পাটের চাইতে ঝক্কি ঢের কম, কাঁচা পয়সা অনেক বেশি। আগে জানলে কে এমন করে নৌকো ঠেলে মরত?

নৌকোর ভেতরদিকে আড়চোখে তাকাল নরোত্তম। সন্ত্রস্ত গলায় বললে, চুপ চুপ। ফরিদ তবুও হাসছে। কিন্তু সত্যিই কি হাসছে! ওর চোখ দুটো দেখে নরোত্তমের সন্দেহ হল।

তুমি তো বামুন। সমাজের ইজ্জত বজায় রাখা তোমার কাজ। ঘরের পর ঘর উজাড় করে মেয়েদের বিক্রি করে দিচ্ছ পেশাকরদের কাছে। সমাজের মুখে হাজার বাতির রোশনাই জ্বলে উঠছে নিশ্চয়!

নরোত্তম জবাব দিল না, কথাটা সে যেন শুনতেই পায়নি। নীরবে চিন্তাকুল মুখে সে শুধু বিড়িটা টেনে চলল। ফরিদের কথায় মাথার মধ্যে হিন্দুত্বের রক্ত চনচন করে উঠল একবার। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিবাদ বাঁধাবার মতো সময় এ নয়, মনের অবস্থাও নয়। এই হিংস্র উন্মত্ত নদীর কান্ডারি ওই লোকটা ইচ্ছে করলেই পাকের মধ্যে নৌকো ফেলে দিয়ে সবসুদ্ধ একসঙ্গে পাতালপুরীতে পৌঁছে দিতে পারে।

ফরিদ আবার বললে, ঠাকুরমশাই, মরে তুমি বেহেস্তে যাবে। নরোত্তম তবু জবাব দিল না। বলছে বলুক, ওসব ছোটো কথায় কান দিতে গেলে অনেক কাল আগেই সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে হত। বিপন্ন নারীর একটা সুবন্দোবস্ত করে দিলে পাপ হবে এমন কথা শাস্ত্রে লেখা নেই কোথাও। কিন্তু ফরিদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। শাস্ত্রের গভীর রহস্য যবনে কেমন করে বুঝবে?

মেঘনার মেঘবরণ জল প্রশান্ত মন্থরগতিতে চলেছে সমুদ্রের দিকে। অজস্র হাওয়ায় রাশি রাশি ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে, নদীর বুকে ফুটছে ফেনার ফুল যেন কালীয়নাগের হাজার ফণা ছোবল তুলছে একসঙ্গে। মহানাগের কুন্ডলীর মতো এখানে-ওখানে চক্রাকারে উলাস দিচ্ছে শুশুকের দল। নৌকার পচা কাঠ আর জলের একটা মিষ্টি গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে বাতাস।

নৌকার ভেতর থেকে গুনগুন করে একটা গানের আওয়াজের মতো কানে আসছে। সরলার চিৎকার থেমে গেছে, কিন্তু গান গাইছে কে? সাগ্রহে কান পাতল নরোত্তম। না, গান নয়। সুমতি কাঁদছে। তারই চোখের সামনে তার স্বামী একরাশ বুনো লতা চিবিয়ে ভেদবমি হয়ে মরেছে, সেই শোকেই কাঁদছে।

কাঁদছে–কাঁদছে! নরোত্তমের মেজাজ যেন সপ্তমে চড়ে যায়। কেন কাঁদে, কার কাছে কাঁদে? কে আছে কান্না শোনবার জন্যে? অথচ সবাই কাঁদছে। মরবার আগে সপ্তমে চেঁচিয়ে কাঁদছে, মরবার সময় অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুমরে গুমরে কাঁদছে। তবু ভালো, মরবার পরে মানুষের কান্না শোনা যায় না। তাহলে সে-কান্নার শব্দে আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে যেত।

গুনগুন করে সুমতি কাঁদছে। নরোত্তমের দু-হাতে কান চেপে ধরতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে গলার ভেতর একটা গামছা ঠেসে দিয়ে সে-কান্না বন্ধ করে দেয় সুমতির। তাদের পাশের গাঁয়ে একবার একটা খুন দেখেছিল নরোত্তম। সম্পত্তির লোভে বিধবা বড়োভাজের গলার ভেতর একখানা আস্ত থানকাপড় ঠেসে দিয়েছিল ছটোদেবর। মেয়েটার অস্বাভাবিক হাঁয়ের চেহারা দেখে তাকে মানুষ বলে মনে করবার উপায় ছিল না, চিরে-যাওয়া গালের দু পাশ দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত নেমে তার গলা পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়েছিল। উঃ, কতরকম বীভৎসভাবেই যে মরতে পারে মানুষ! এই দুর্ভিক্ষের সময় পূর্ববাংলার গ্রামে গ্রামে যে তার রংবেরঙের ছবি দেখেছে।

ঝপ ঝপ ঝপাস। পাশ দিয়ে বারো দাঁড়ের একখানা ছিপ বেরিয়ে যাচ্ছে। মেঘনার জল থেকে উঠে আসা প্রেতমূর্তির মতো একদল অস্থিসার মানুষ দুর্বল হাতে দাঁড় টেনে চলেছে। বড়ো ভাউলখানা দেখে বারো জোড়া কালি-মাখানো চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

সমস্বরে প্রশ্ন এল, চাল আছে নৌকায়?

না।

ধান আছে?

না।

বারো জোড়া হাতের দাঁড়ের টানে ছিপ এসে ভিড়ল ভাউলির গায়ে। পাটাতনের ভেতর থেকে দু-তিনটে ল্যাজার ফলা ঝিকিয়ে উঠল একসঙ্গে।

ধান-চাল থাকে তো না দিয়ে এক-পা এগুতে পারবে না।

হালের মুখে ফরিদ মাঝির পেশি কঠিন হয়ে উঠেছে। হুশিয়ার। নৌকায় সব জেনানা। ধান-চালের দরকার থাকে অন্য তল্লাটে যাও, একটা দানাও মিলবে না এখানে।

পৈতে আঁকড়ে ধরে নরোত্তম দুর্গানাম জপছে, নৌকার ভেতর থেকে উঠেছে মেয়েদের কান্না। কিন্তু একটি বার ভেতরে উঁকি দিয়েই বারো জোড়া চোখের আগুন নিবে গেল মুহূর্তের মধ্যে।

জাহান্নামে যাও। বারোটি কণ্ঠে চাপা অভিসম্পাত। ঝপ ঝপ ঝপাস। বারো দাঁড়ের ছিপ স্রোতের টানে দিগন্তে মিলিয়ে গেল।

নরোত্তমের ঠোঁট তখনও থরথর করে কাঁপছে। বড়ো রক্ষা পাওয়া গেছে এ যাত্রা। প্রাণে আর বল ছিল না, বুকের রক্ত শুকিয়ে গিয়েছিল একেবারে। ল্যাজা দিয়ে ফুড়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলে মা বলতেও নেই, বাপ বলতেও নেই।

ব্যাটারা ডাকাত নিশ্চয়।

কুশ্রী কুৎসিত মুখে ফরিদ ভয়ংকর একটা হাসি হাসল।

হ্যাঁ ঠাকুর, ওরা ডাকাত। তোমার মতো সাধু-ফকির নয়।

সাধু-ফকির কথাটা কানে গিয়ে লাগে। সন্দিগ্ধ চোখে ফরিদের দিকে তাকাল নরোত্তম। হ্যাঁ, ঠাট্টাই করছে। কিন্তু যা বলে বলেই যাক, উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি।

পালে জোর বাতাস লেগেছে, তরতর করে ঢেউ কেটে বেরিয়ে চলেছে নৌকো। চরের ওপর সাদা কাশবনে চখাচিখ উড়ছে। বহু দূরে কোথা থেকে ভেসে আসছে ঢাকের অস্পষ্ট শব্দ। আজ থেকে কি মহাপুজোর বোধন লাগল?

ওপরে নির্মেঘ নীল আকাশ। বাংলাদেশের শরৎ যেন তার স্নিগ্ধ নীলাঞ্জন আঁখি মেলে দিয়েছে। সোনার শরৎ। ঘরে ঘরে নতুন ধান, নবান্নের শুভ সম্ভাবনা। ফুলে আর পাতায় পদ্মদিঘির জল দেখা যায় না। শিশির আর শেফালি ফুলের গন্ধ মেখে বাংলার মাটি যেন শারদীয়া পূজামন্ডপ।

কিন্তু সে কোন বাংলা? কবেকার বাংলা, কত শতাব্দী আগেকার? এখানে মেঘনার জল কালীয়নাগের নিশ্বাসে কালো হয়ে গেছে। এখানে মড়কে জর্জরিত বাংলার বুক থেকে গৃহচ্যুত গৃহলক্ষীরা পণ্য হতে চলেছে শহরের গণিকাপল্লিতে। অভিশপ্ত শরৎ, দুঃস্বপ্নের শরৎ। ভিখারি মহেশ্বরের গৃহিণী আজ কুলত্যাগিনী।

নৌকোর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সুখী দাঁড়িয়েছে নরোত্তমের পাশে। তার দু-গাল বেয়ে টপ টপ করে চোখের জল পড়ছে।

কী রে সুখী, হল কী তোর?

ঠাকুরমশাই, ছেড়ে দাও আমাকে। দোহাই তোমার, আমাকে ছেড়ে দাও। দু-হাতে নরোত্তমের পা জড়িয়ে ধরেছে সুখী। আমি তীর্থ দর্শন করতে চাই না, আমি কলকাতায় যেতে চাই না। আমাকে বাবার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এসো।

আহা-হা, কেন পাগলামি করিস? সন্ত্রস্ত হয়ে টেনে পা সরিয়ে নিলে নরোত্তম।

বাপের কাছে ফিরে যাবি? কী করবি সেখানে গিয়ে? না-খেয়ে শুকিয়ে মরবি যে।

মরি মরব, আমার সেই ভালো ঠাকুরমশাই। আমি কলকাতায় যাব না, আমাকে ছেড়ে দাও আমি চলে যাই।

ছেড়ে দেব! সুখীর অসংগত আবদারে বিস্ফারিত চোখে নরোত্তম তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। দেড়শো টাকা বাপকে গুনে দিয়ে তবে মেয়েটিকে আনতে হয়েছে। সেই দেড়শো টাকা সুদে-আসলে একেবারে বরবাদ হয়ে যাবে। যতই ধর্মে মতি থাকুক-না, নরোত্তম দাতাকর্ণের পোষ্যপুত্র নয়।

সুখীর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল পড়ল নরোত্তমের পায়ের উপর। কী উষ্ণ জলটা, সমস্ত শরীর তার স্পর্শে যেন চমকে উঠেছে। অপূর্ব সুন্দর সুখীর মুখোনা। নরোত্তমের মনটা হঠাৎ যেন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

অনেক দূরে নদীর ওপারে গ্রামের আভাস। কত আশা, কত স্বপ্ন দিয়ে গড়া মানুষের আশ্রয়। কিন্তু কী আছে ওখানে? রিক্ত ধানের মরাই ভেঙে মাটিতে পড়েছে। উড়ছে শকুন। ওইখানে ফিরে যেতে চায় সুখী। কী করবে গিয়ে? আরও দশজনের মতো না-খেয়ে ছটফট করে মরে যাবে নয়তো মেঘনার জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সমস্ত দুঃখের অবসান করবে। তার চাইতে…

আচ্ছা, এখন চুপ করে বোস তো গিয়ে। ঘাটে নৌকো লাগুক তারপর দেখা যাবে।

কিন্তু ঘাট কোথায়! নদী চলেছে তো চলেইছে! বাঁকের পর বাঁক ঘুরছে, পেছনে ফেলে যাচ্ছে খাড়া পাড়ি, ভেঙেপড়া গ্রাম। সন্ধ্যার আগে আর কোনো বাজার বা গঞ্জ পাওয়া যাবে না।

নৌকার ভেতরে কোলাহলের বিরাম নেই। সুমতি কাঁদছে, সরলার ছেলেটা চিৎকার করছে। এক-গা দগদগে ঘা নিয়ে ছেলেটা বাঁচবে না, কবে যে চোখ উলটে শেষ হয়ে যাবে তাও ঠিক নেই। তবু অসীম মমতায় সরলা ওই বিকৃত শিশুটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে আছে। বিরক্তিতে নরোত্তমের সমস্ত মনটা বিস্বাদ আর বর্ণহীন হয়ে যায়। ওদিকে মালিনী সুর টেনে কৃষ্ণযাত্রার গান ধরেছে। দলের মধ্যে ওই মেয়েটা যা একটু হাসিখুশি—নিজের সম্বন্ধে ভাবনা নেই, দুশ্চিন্তাও নেই কিছু। অল্পবয়সে বিধবা হওয়ার পরে গাঁয়ের অনেকগুলো ছেলের সে মাথা খেয়েছে এইরকম জনশ্রুতি শুনতে পাওয়া যায়। তাকে আনবার জন্যে নরোত্তমের বেশি কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়নি, এককথাতেই সে প্রসন্নমুখে নৌকায় উঠে এসেছে।

কালো রূপে মোর মজিল যে মন, ঝাঁপ দেব কালো যমুনায়…

মালিনী বেরিয়ে এসে বসেছে ঠিক নরোত্তমের পাশটিতে।

জলের রংটি দেখেছ ঠাকুর? ঠিক যেন কালো যমুনা।

হ্যাঁ।

আমি রাধা হলে ঠিক ওই জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়তাম। অপূর্ব একটা ভঙ্গি করে হাসল মালিনী, তারপর, ঠাকুরের যে বাক্যি হরে গেল! আমার মুখের দিকে এক বার তাকালেও দোষ নাকি?

না না, অমন কথা কে বলে? জোর করেই হাসবার চেষ্টা করলে নরোত্তম, কিন্তু মতলবটা কী।

একটা পান খাওয়াতে পারো না? সকাল থেকে পান না খেয়ে মাথা ধরে গেল যে।

এখন কোথায় পাবে পান? একটা ঘাট আসুক, তারপরে যা হয় ব্যবস্থা করা যাবে।

তুমি বড়ো বেরসিক ঠাকুর। আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। চটুল একটা কটাক্ষপাত করে লীলায়িত ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল মালিনী।

নরোত্তম একটার পর একটা বিড়ি টেনে চলেছে বিষণ্ণ মুখে। সুখীর জন্যেই ভাবনা। মেয়েটা চুপ করে বসে নির্নিমেষ চোখ মেলে চেয়ে থাকে জলের দিকে। সরলা, সুমতি কিংবা অন্যান্য মেয়েদের জন্যে চিন্তার কিছু নেই। যতই হট্টগোল করুক, শেষপর্যন্ত নির্বিঘ্নেই ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া চলবে। কিন্তু সুখীকে বিশ্বাস নেই, ওর চোখের জলকে বিশ্বাস নেই। যখন-তখন ঝাঁপ দিয়ে পড়তে পারে মেঘনার কালো জলের মধ্যে, ঘটাতে পারে একটা কেলেঙ্কারি কান্ড।

তাই নরোত্তম আগে থেকেই সুখীর জন্যে একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছে। গোলাম মহম্মদের সঙ্গে কথা হয়েছে তার।

আরও দুটো বাঁক পেরোলেই কাশীপাড়ার চক। সেখানে ঘন কাশবনের ওপারে কী আছে দেখা যায় না। আর সেইখানেই খালের মাথায় মিলিটারি কলোনির ঠিকাদারের নৌকা থাকবার

কিন্তু মনের দিক থেকে কেমন যেন জোর পায় না সে। সুখীর কথা ভাবলেই একটা অন্যায়, একটা বিচিত্র অপরাধবোধ এসে যেন তাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। মেয়েটার মুখোনা সত্যিই ভারি সুন্দর, নরোত্তমের মাঝে মাঝে লোভ হয়, এক-একটা দুর্বল মুহূর্তে ভাবে…

হঠাৎ নৌকোর মধ্যে সরলার তুমুল চিৎকার। কলহের কলরোল নয়, বুকফাটা ডুকরে কান্না।

কী হয়েছে, হল কী ওখানে? ডাকাত পড়ল নাকি?

না। মালিনীর গলা ভেসে এসেছে, না! সরলার ছেলে মরে গেছে।

কান্না আর হট্টগোল। তবু নরোত্তমের মনটা খুশি হয়ে উঠেছে, যেন একটা ভার নেমে গেছে চেতনার ওপর থেকে। ছেলেটা মরে গেছে, বোঝা কমেছে একটা। একে একে সবগুলো ছেলেপিলে অমনি করে মরে শেষ হয়ে যেতে পারে না? নৌকার ভার কমে, শান্তি ফিরে আসে অনেকখানি। তা ছাড়া চিরযৌবনের রাজ্যে সবৎসার চাইতে অবৎসার কদর বেশি।

মরা ছেলেটাকে সরলা বুক থেকে নামাতে চাচ্ছে না। আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদছে। কাঁদুক। শহরের আলোয় ওই কান্না মিলিয়ে যেতে কতক্ষণ লাগবে? সেখানে চিরবসন্তের দেশ। রাত্রির অপ্সরাদের চোখে কখনো জল দেখতে পায় না কেউ।

আর ফরিদ তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তুফানের কোনো সংকেত নেই সেখানে, কিন্তু তার মনের প্রান্তে কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। একটা-কিছু ভাবছে, কিন্তু স্পষ্ট কোনো রূপ দিতে পারছে না।

তীর্থযাত্রীদের নৌকো চলেছে কালীঘাটে দেবতা দর্শনে। কুবেরের পূজামন্ডপে নতুন কালের নতুন বলি। কনট্রাক্টের টাকায় কেঁপে উঠেছে নারীমাংসের কসাইখানা। নরোত্তমের মতো পরহিতব্রতীর সান্ত্বনা দালালির কয়েকটা টাকা ছাড়া আর কিছুই নয়।

মাথার ওপরে শরতের নির্মল নীলিমা। দূরে বোধনের বাজনা। অকালবোধন নয়, আকাল বোধন। কিন্তু কে জাগবে এই বোধনমন্ত্রে? চৌরঙ্গির হোটেলে সে আজ রং-মাখানো মুখে মদের গেলাসে চুমুক দিয়েছে।

বাঁকের পর বাঁক ঘুরে চলেছে নৌকো। দূরে যেখানে ঘূর্ণি হাওয়ায় লালবালি উড়ছে, ওইখানে কাশীপাড়ার কাশবন। আস্তে আস্তে নৌকো এসে ভিড়ল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখলে নরোত্তম, দূরে মিলিটারি কলোনির ঠিকাদারের নৌকোর মাস্তুল ঠিক আছে।

সুখী, সুখী!

প্রত্যাশায় সমুজ্জ্বল মুখে সুখী এসে দাঁড়াল। গালের দু-পাশে শুকিয়ে-যাওয়া অশ্রুর চিহ্ন। নরোত্তম কানে কানে বললে, এখানে তোকে নামিয়ে দিলে চলে যেতে পারবি? নদীর পাড় দিয়েই সোজা রাস্তা।

অগ্র-পশ্চাৎ ভাববার মতো মনের অবস্থা নয় সুখীর। সমস্ত প্রাণ তার চিৎকার করে কাঁদছে। বাবাকে ছেড়ে সে থাকতে পারে না, থাকতে পারে না তার ছোটোভাইটিকে ছেড়ে। না-খেয়ে যদি মরতে হয় সবাই একসঙ্গেই মরবে, তবু সে যাবে না কলকাতায়। মা কালী দর্শন করে তার কোনো লাভ নেই।

ঘন জঙ্গল আর কাশবন, ওপারে দৃষ্টি চলে। নরোত্তম বললে, চল, তোকে পথ দেখিয়ে দিয়ে আসি। নদীর ধারে উঠলেই সোজা সড়ক।

কাশবনের মধ্যে অদৃশ্য হল দুজনে। নরোত্তম বললে, একটু দাঁড়াও মাঝি ভাই, আমি আসছি।

কিন্তু ফরিদ নিদারুণ ভয়ে চমকে উঠেছে। সমস্ত মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। এ কী? কী করছে সে? যে-অস্ত্রে শান দিচ্ছে এতদিন, সে-অস্ত্র কি ওর নিজের গলাতেই এসে লাগতে পারে না? গ্রামে তারও স্ত্রী আছে, মেয়ে আছে, ছেলের বউ আছে। আজ যদি সে মরে যায়, কাল টাকায় লোভে আর একজন যে এমনি করে তাদের নিয়ে মেঘনা পারি দেবে না, কে বলতে পারে? ফরিদের সমস্ত শিরা-স্নায়ুর মধ্যে আগুন জ্বলে গেল। নরোত্তম ঠাকুরের মতো লোকের অভাব হয় না কোথাও কোনোদিন।

ভয়ংকর মুখোনাকে আরও ভয়ংকর করে ফরিদ হাঁক দিলে মাল্লাদের।

রহিম, কামাল, এদিকে আয় দেখি। তামাক সাজ তো এক ছিলিম।

কাশবনের ওপারে রহস্যময় নীরবতা। হঠাৎ সেই নীরবতা ভেঙে সুখীর আর্ত চিৎকার, ছাড়ো ছাড়ো, বাঁচাও আমাকে…

চমকে ফরিদের হাত থেকে আগুনসুদ্ধ কলকেটা পড়ে গেল মেঘনার জলের মধ্যে। এ কার কান্না? মনে হল তার মেয়েই যেন চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে। তার মেয়ে, তার স্ত্রী, আরও কত জন।

কিন্তু পরক্ষণেই সব নিস্তব্ধ। আর কাশবন ঠেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসছে নরোত্তম।

মাঝি, মাঝি, শিগগির নৌকো ছেড়ে দাও। মস্ত কুমির। কাশবন থেকে বেরিয়ে সুখীকে মুখে নিয়ে জলে নেমে গেল।

মেয়েরা একসঙ্গে আতঙ্কে কিলবিল করে উঠেছে। এমনকী সরলার কান্না পর্যন্ত গিয়েছে থেমে।

কুমির?

হ্যাঁ হ্যাঁ, মস্ত কুমির। গোলাম মহম্মদের দেওয়া নোটগুলো ট্যাঁকে খুঁজতে খুঁজতে নরোত্তম লাফিয়ে উঠে পড়ল নৌকাতে, আর এখানে দাঁড়িয়ে কাজ নেই। হায় হায়, সুখীর কপালে এই ছিল!

ছইয়ের উপর থেকে লম্বা একখানা লগি টেনে নিল ফরিদ। কুৎসিত মুখে একটা অমানুষিক হাসি হাসল, কত বড়ো কুমির ঠাকুরমশাই? কী নাম?

নরোত্তম কিছু-একটা জবাব দেওয়ার আগেই প্রচন্ড বেগে লগির ধারালো খোঁচা তার চোখে এসে লাগল। উলটে নৌকো থেকে কাদা আর বালির মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল নরোত্তম। একটা চোখ কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছে, আর একটা অন্ধ হয়ে গেছে কচকচে বালিতে।

ভাউলি নৌকো ততক্ষণে অথই জলে। দূর থেকে ফরিদের করকরে গলা কানে ভেসে এল, এতখানি সহ্য হয় না ঠাকুরমশাই। না-খেয়ে মরে তো মরুক, তবু গাঁয়ের মেয়ে গাঁয়েই ফিরিয়ে নিয়ে যাব।

মূৰ্ছিতের মতো একরাশ জল-কাদার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে রইল নরোত্তম। ওঠবার চেষ্টা করছে, কিন্তু উঠতে পারছে না। ওদিকে অদূরে জলের মধ্যে ভেসে উঠেছে পোড়া কাঠের মতো একখানা প্রকান্ড মুখ, তার দুটো চোখে জ্বলন্ত ক্ষুধা নিয়ে নরোত্তমকে লক্ষ করছে। অন্ধ না-হলে নরোত্তম দেখতে পেত ওটা সত্যি সত্যিই কুমির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *