তমস্বিনী

তমস্বিনী

কালীঘাটের মন্দিরে যেতে হয়েছিল। দুর্বল গলায় বলেছিলুম, দ্যাখো সপ্তাহে একটা মাত্র রবিবার, সেদিনও যদি…

জবাব এল, রবিবার না হলে তোমাকে ধরা যায় নাকি?

বললুম, আমাকে ধর্তব্যের মধ্যে না-ই আনলে। তোমার পুণ্যে আমারও তো অর্ধেক দাবি আছে, তুমিই যাও; আমি বরং…

বরং কী? প্রাণের বন্ধুরা আসবে, বারোটা পর্যন্ত আড্ডা চলবে, চা-সিগারেটের শ্রাদ্ধ হবে–এই তো? চালাকি নয়, অনেক কষ্টে আজ তোমায় ধরেছি। ওঠো।

উঠতে হল। রবিবারের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বার স্বর্গীয় বিলাসিতা, অলস সকালের আমেজ, দু-একজন বন্ধুবান্ধব এলে কিছুক্ষণ নিঃস্বার্থ পরচর্চা—সমস্তই গেল আজকের মতো। সান্ত্বনার বাণীও শুনতে পেলুম–সারাদিন তো আর কালীঘাটে বসে থাকতে হবে না, ঘণ্টা খানেক বাদেই ফিরে আসব।

ঘণ্টা খানেকের অর্থ আমি জানি। ফেরবার পথে দু-একজন আত্মীয়কে মনে পড়বে, অনেক দিন যাদের সঙ্গে দেখা হয় না। খুঁটিনাটি কেনাকাটাও বাদ পড়বে না। উদাস হয়ে এক লাইন ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করতেই ঝাঁঝালো স্বরে শোনা গেল, কী বললে?

খেয়াল ছিল না ও-পক্ষেরও ইংরেজি জানা আছে। সামলে নিয়ে বললুম, কিছু না, কিছু না। চলো বেরুনো যাক।

তারপর যথানিয়মে পুজো, পান্ডা, সিঁদুরের টিপ, ফুলের মালা। বেরিয়ে আসবার সময় বিরক্ত হয়ে ভাবছিলুম, লেখাপড়া যা-ই শিখুক, মা-ঠাকুরমার ট্র্যাডিশনকে মেয়েরা কোনো মতেই ছাড়তে রাজি নয়। দেখলুম ভিখারিদেরও ব্যবস্থা আছে, খুবসম্ভব তিন-চার টাকার নয়া পয়সায় ব্যাগ ভরতি করে আনা হয়েছে সঙ্গে।

কিন্তু চাওয়া যেখানে অনন্ত, সেখানে মধ্যবিত্ত গৃহিণীর দাক্ষিণ্য কতক্ষণ চলে? এক লাফে গাড়িতে উঠে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কী? এরপরে গায়ের জামা ছিঁড়ে দেবে।

আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলুম সেকথা ঠিক। এক বুড়ি ভিখারিনির দিকে আমার দৃষ্টি পড়েছিল। কোথায় যেন দেখেছি, মুখটাকে ভারি চেনা চেনা ঠেকল।

বুড়ির চোখ দুটোতে ঘোলাটে হলুদ রং, ছানি পড়েছে মনে হল। বাড়িয়ে দেওয়া শীর্ণ। হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। ভাঙা গলায় বললে, গরিবকে কিছু দিয়ে যান বাবা, মা কালী

আপনাকে হাজারগুণ ফিরিয়ে দেবেন।

মা কালী কী দেবেন না-দেবেন সেকথা ভাববার দরকার ছিল না। এতক্ষণ ভিখারিদের আমি কিছুই দিইনি, সে-দায়িত্ব স্ত্রীই নিয়েছিলেন। কিন্তু এইবার আমি পকেটে হাত দিলুম, একটা আধুলি আঙুলে ঠেকল, সেইটেই বের করে ফেলে দিলুম বুড়ির হাতে।

স্ত্রী বললেন, কী হচ্ছে? তুমি আবার দানসত্র খুলে বসলে নাকি? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক উজাড় করে দিয়েও কি ওদের খাঁই মেটাতে পারবে? ওঠো গাড়িতে।

বলবার দরকার ছিল না আধুলির প্রতিক্রিয়ায় তখন প্রাণান্ত হওয়ার উপক্রম। বিদ্যুদবেগে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বললুম, অ্যাক্সিডেন্ট না ঘটিয়ে যত জোরে পারো চালাও।

পুরোনো গাড়ির বেসুরো কর্কশ আওয়াজের সঙ্গে রাজাবাবু বড়োবাবু-র আর্তরব ঘূর্ণির মতো মিলিয়ে গেল।

কিন্তু ঘোলাটে হলুদ রঙের সেই ছানিপড়া চোখ, সেই কাঁপা হাতটা, সেই ভাঙা গলার আওয়াজ–মুখটা বড়ো বেশি চেনা চেনা ঠেকছে। কিছুতেই মনে করতে পারছি না, অথচ…

তারপর নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে, অলস মুহূর্তের ছেড়া ছেড়া চিন্তায়, রাত্রে ঘুম আসবার আগে ওই মুখোনাকে জীবনের কোনো একটা অন্ধকার কোনা থেকে আমি খুঁজে বার করতে চেয়েছি। খুব-একটা আগ্রহ নিয়ে নয়, অবসর সময়ে ক্রসওয়ার্ডের শব্দ খোঁজবার মতো, জিগস পাজল মেলাবার মতো। উত্তরটা না পেলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু কেমন একটা অতৃপ্তি যেন আছে।

চেনা আধচেনা কত মুখ ভিড় করে এল। অচেনারাও বাদ গেল না। কেউ এল কোনো ট্রেনের কামরার সহযাত্রিণী হয়ে, কেউ এল প্রবাসের কোনো হোটেলের পাশের ঘর থেকে, কাউকে মনে পড়ল কোনো তীর্থের ধর্মশালায়। কোনো কোনো মুখের সঙ্গে দু-একটা রেখা হয়তো মিলল, কিন্তু শেষপর্যন্ত কারও সঙ্গেই সম্পূর্ণ মেলাতে পারলুম না।

মিলল না, কিন্তু ছবি আনল। যেন একটা পিকচার গ্যালারির মধ্য দিয়ে চলতে চলতে আমি একটি মুখের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লুম।

পারুলকাকিমার ছবি। অনেক বেশি করে চেনা, অথচ সবচাইতে ঝাপসা। আর সেই অস্পষ্টতার আড়াল পারুলকাকিমা নিজেই সবচেয়ে বেশি করে টেনে দিয়েছিলেন।

তাহলে ফিরে যেতে হল নিজেদের গ্রামে। তখন যাওয়া খুব শক্ত ছিল না। একটা ধু-ধু নদী, তার নাম আড়িয়াল খাঁ। সেখানে ছোটো একটি স্টিমারঘাট। সেই ঘাটে নেমে নৌকো। নদী বেয়ে কয়েক মাইল চলা, তারপর বাঁ-দিকে খাল। তার হলদে জল হিজল আর বেতবনের ছায়ায় কালো। তাতে জোয়ার-ভাটার আসা-যাওয়া, মাঝে মাঝে থালার মতো ভেসে-ওঠা কাছিম, কখনো নৌকোর ভেতরে লাফিয়ে-পড়া দু-একটা ছোটো মাছ, গোটা সাতেক বাঁক, সুপুরি আর নারকেল গাছের ফাঁকে আমাদের চন্ডীমন্ডপ আর নাটমন্দির, দাঁড়ে কয়েকটা টান, লগিতে গোটা কয়েক খোঁচা—আমাদের বাড়ির ঘাট।

ভূগোলের হিসেবে কলকাতা থেকে হয়তো দুশো মাইলের কিছু বেশি। কিন্তু এখন গ্রহান্তরের ওপারে।

সেই গ্রাম। আমার কৈশোর। আর পারুলকাকিমা।

পারুলকাকিমাদের বাড়ি খালের ওপারে। একটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হত সেখানে। বাড়ির সামনে ছিল একটা থমথমে বাঁশবন। সেই বাঁশবনটার ভেতর দিয়ে যেতে দিনদুপুরেও কেমন ছমছম করত শরীর। হঠাৎ হাওয়া দিত এক-একটা, বাঁশের শুকনো পাতা পাক খেয়ে খেয়ে উড়তে থাকত, কাঁচা বাঁশের কেমন একটা গন্ধ ভেসে বেড়াত, হাওয়ার তালে তালে কটকট খড়খড় করে আওয়াজ উঠত। এই বাঁশবনের ভেতরেই একবার বিকেলে আমি একটা প্রকান্ড বনবেড়াল দেখেছিলুম। একটা শুকনো বাঁশের গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছিল সে, কড়কড় করে আওয়াজ হচ্ছিল আর নখের টানা টানা দাগ পড়ছিল বাঁশটাতে। আমার পায়ের শব্দে চমকে সে ফিরে তাকিয়েছিল আমার দিকে। লাল টুকটুকে মুখটাকে ফাঁক করে ফ্যাঁস করে আওয়াজ তুলেছিল একটা, তারপর এক লাফে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। আর এক বার ফান মাসের সকালে যখন বাঁশবনের এখানে-ওখানে গুচ্ছে গুচ্ছে ভাঁট ফুল ফুটেছে, তখন আমি ওখানে মস্ত একটা খরিশ গোখরোর সঙ্গে একটা বেজিকে লড়াই করতে দেখেছিলুম। বেজিটা যেন ফুলে আট গুণ হয়ে উঠেছিল, থেকে থেকে সাপটার রক্তে বাঁশের শুকনো পাতাগুলো রাঙা হয়ে গিয়েছিল।

গ্রামের পুরোনো দিঘি, তাদের পাড়ে পাড়ে চিতার ওপর মঠ দেওয়া। কত সকাল দুপুর সন্ধ্যায় রাতে সেইসব নির্জন দিঘির ধার দিয়ে গেছি, শীতের ভোরে চুরি করেছি খেজুররস কোনোদিন ভয় পাইনি। কিন্তু পারুলকাকিমাদের বাড়ির সেই বাঁশবনটা ভরা দিনের আলোতেও সারাশরীরে কেমন একটা শিরশিরানি বইয়ে দিত।

জোরপায়ে বাঁশবাগান পেরিয়ে যেতুম, তারপরেই দেখতে পেতুম বলরামকাকাকে।

একটা জলচৌকিতে বসে তামাক টানতেন। পাশেই বাঁধা আছে বাড়ির সাদা ছাগলটা বুড়ি হয়ে গেছে, তার দাড়ির রংটা পর্যন্ত লাল। বলরামকাকা তামাক খাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে হাত বোলাচ্ছেন তার গায়ে।

দেখেই জিজ্ঞেস করতেন, কী রে, কী চাই?

কিছু না।

ঘুরে বেড়াচ্ছিস শুধু শুধু? ইশকুল নেই? ইশকুল ছুটি।

কী ইশকুই হয়েছে সব! বলরামকাকা মুখটা বাঁকাতেন, লেখাপড়ার পাট তো উঠেই গেল দেশ থেকে। মাস্টারগুলো শুধু মাইনে নেবার জন্যেই মুখিয়ে রয়েছে সব। ছ্যাঃ!

বা রে, রবিবারেও ছুটি থাকবে না?

রেখে দে রবিবার। তোদের সব বারই সমান। লেখাপড়া কিছু করিস? কোটাকে নামিয়ে জলচৌকির আর একধারে ঠেকান দিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করতেন, তুই তো ক্লাস নাইনে পড়িস তাই নয়? আচ্ছা বল দিকি এই ধাঁধাটার মানে কী? দেবরাজ ময়া দৃষ্টং বারিবারণ মস্তকে, ভয়তি অর্ঘ্যপত্রাণি, অহং চ বনহস্তিনী?

আমি বিরস দৃষ্টিতে বলরামকাকার দিকে তাকিয়ে থাকতুম। এইরকম গোটা কয়েক সংস্কৃত উদ্ভট শ্লোকই লোকটার পুঁজি। কতদূর লেখাপড়া করেছেন জানি না, নীচের দিকের কয়েকটা ক্লাসেরও চৌহদ্দি পেরিয়েছেন বলে শুনিনি। কোনো কালে পাঠশালার পন্ডিতের মুখে এগুলো শুনে থাকবেন—এদের ভাঙিয়েই আমাদের জব্দ করতে চেষ্টা করেন।

শ্লোকটা এবং ওর ব্যাখ্যানা আরও অন্তত পঞ্চাশ বার আমি শুনেছি, কিন্তু বলরামকাকার সঙ্গে কথা বাড়াতে আমার প্রবৃত্তি হত না। আসল কথা, লোকটাকে আমার কোনোদিন ভালো লাগেনি। কেমন মনে হত ওই বাঁশবনটা পেরিয়েই আমি ওঁকে দেখতে পাই, আর ওই বাগানটার ভয়-ধরানো রহস্যের সঙ্গে বলরামকাকারও কোথাও কী-একটা সম্পর্ক আছে। ওঁর বাঁ-হাতের আঙুলগুলো কখনো স্থির থাকত না, সবসময় নড়ত; আর তাই দেখে আমার খামোকা মনে হত যেন কোথা থেকে একটা হাঁস চুরি করে খেয়ে বনবেড়ালটা শুকনো বাঁশের গায়ে ঘষে ঘষে নখে শান দিচ্ছে।

বলরামকাকার চোখ এক ধরনের অদ্ভুত খুশিতে পিটপিট করত।

কী রে, বলতে পারলিনে তো?

পারি। আপনার কাছেই শুনেছি অনেক বার।

শুনেছিস নাকি? ও! তাহলে এইটে কী বল তো?

আর একটা উদ্ভট শ্লোক এবং সেটাও পঞ্চাশ বার শোনা। বিরক্ত হয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই বলতেন, যাচ্ছিস কোথায়? ওই তো একটা মোড়া রয়েছে ওখানে, একটু বস-না, গল্প করি।

গল্প করার নোক বেশি তাঁর জুটত না। বলরামকাকা ঠিক অসামাজিক ছিলেন কি না জানি, কিন্তু গ্রামের লোক সাধ্যমতো তাঁকে এড়িয়ে চলত। তা ছাড়াও তিনি নাহয় সারাদিন হুঁকো হাতে বসে থাকতে পারেন—আর সকলেরই কিছু-না-কিছু কাজকর্ম আছে। কাজেই আমাদের কাউকে পেলে আর ছাড়তে চাইতেন না। আমাদের দারুণ খারাপ লাগত, কিন্তু এড়িয়ে চলার উপায় ছিল না, বসেই যেতে হত খানিকক্ষণ।

বলরামকাকা হুঁকোয় টান দিয়ে একটা উঁচুদরের আলোচনা শুরু করতে চাইতেন।

বল দিকি, শাস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কী?

ক্লাস নাইনে পড়ি, পৈতে হয়েছে অনেক দিন। জবাব দিতুম, বেদ।

হল না। শাস্ত্রের সেরা হচ্ছে তন্ত্র।

তর্ক করার বিদ্যে নেই, নিরুপায় ক্রোধ নিয়ে চুপ করে থাকতুম। আর বলরামকাকা গলা নামিয়ে বলে যেতেন, বুঝলি, তন্ত্র হচ্ছে সাধনার সবচেয়ে কঠিন রাস্তা, তাই ওর নাম হল বীরাচার। মানে, একমাত্র বীরেরাই ওই সাধনার অধিকারী। আর জপতপ, পুজো এসব হল দুর্বলের ধর্ম, সেইজন্য এদের পশ্বাচার বলে। সেইজন্যেই তো আমি তান্ত্রিক-হু-হুঁ!

আমি এক বার চোখ তুলে চেয়ে দেখতুম বলরামকাকার দিকে। তিনি তান্ত্রিক একথা বলে দিতে হয় না বাইরে থেকে। সবসময়েই হাঁটু পর্যন্ত একটা লালকাপড় পরে থাকেন, গলায় আর বাহুতে মোটা মোটা রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে খানিকটা গলানো সিঁদুর লেপটানো যেন রক্ত-মাখানো রয়েছে মনে হত। কিন্তু এতসব ভয়ংকর সাজপোশাকেও বলরামকাকাকে যথেষ্ট ভীতিকর বোধ হত না। রোগা, হাড়-বের-করা কালো চেহারা, শীতকালে হাঁপানির টানে কষ্ট পেতেন। সেই বয়সেই বঙ্কিমের কপালকুন্ডলা পড়া হয়ে গিয়েছিল আমার। বালিয়াড়ি শিখরে সেই দীর্ঘকায় মনুষ্যমূর্তির সঙ্গে বলরামকাকার সাদৃশ্য কল্পনা করা কঠিত হত। আমার শুধু ওঁর বাঁ-হাতের কালো কালো রোগা আঙুলগুলোকে পানিজোঁকের মতো কিলবিল করতে দেখে ঠিক ভয় করত না, একটা বিশ্রী অস্বস্তিতে শরীর শিরশিরিয়ে উঠত। জিজ্ঞেস করতুম, শবসাধনা করেছেন আপনি?

এখনও করিনি, কিন্তু করব। মুশকিল কী জানিস, তার বায়নাক্কা অনেক। চন্ডালের শব চাই, তার অপঘাতে মরা চাই, জুতমতো অমাবস্যার রাতে পাওয়া চাই, তার সঙ্গে আরও কিছু চাই। মানে সেসব তোকে বলা যাবে না। যদি কোনোদিন শিষ্য হস তখন জানতে পারবি। একগাল হাসতেন বলরামকাকা, কী রে, চ্যালা হবি আমার?

আপনি তো আগে সিদ্ধিলাভ করুন, তারপর দেখা যাবে।

ও, আমার কথায় বুঝি বিশ্বাস হল না? দাঁড়া, দেখবি, দেখবি। কোটায় টান দিতে গিয়েই দেখতেন আগুন নিবে গেছে। তখন ডাক ছাড়তেন, তারা, তারা। তারিণী—

দুটো কাজ হত একসঙ্গে। একদিকে ব্রহ্মময়ী ডাক পেতেন, অন্যদিকে বেরিয়ে আসতেন। তারামাসিমা। তারামাসিমা জিজ্ঞেস করতেন, কী হল? এত চেঁচামেচি কেন?

কলকেটা একটু বদলে দেবে?

সারাদিন তামাক খাওয়া আর বকবক করা—ভালোও লাগে!

কী আর করব বল? মিহি গলায় জবাব দিতেন বলরামকাকা, মানে ঠিক বকবক করা নয়, একটু তন্ত্র নিয়ে আলোচনা করছিলুম ওর সঙ্গে।

চুলোয় যাক তন্ত্র! তারামাসিমা কুটি করতেন, নিজে তো গোল্লায় গেছই, এই বাচ্চা ছেলেটারও মাথা খেতে চাও?

কালী— কালী! কী যে বল! বলরামকাকা নিবে যেতেন এসব কথা আবার কেন? যাও-না লক্ষীটি, চট করে একটু তামাক সেজে আনো।

এরই মধ্যে আমি লক্ষ করতুম, কখন দরজার সামনে পারুলকাকিমা এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রায়ই কোনো কথা বলতেন না; যেমন নিঃশব্দে এসে দাঁড়াতেন, তেমনিই আস্তে আস্তে ছায়ার মতো সরে যেতেন। কেন আসতেন, কী দেখে চলে যেতেন, সেকথা তিনিই শুধু বলতে পারেন।

পারুলকাকিমা বলরামকাকার স্ত্রী। বয়েস কত জানি না, কিন্তু বলরামকাকার পাশাপাশি অনেক বেশি ছেলেমানুষ বলে মনে হত তাঁকে। ছেলেপুলে ছিল না—রান্না করে, দাওয়া নিকিয়ে, ধান সেদ্ধ করে, চিড়ে কুটেই তাঁর দিন কাটত। তারামাসিমা ছিলেন তাঁরই দূর সম্পর্কের বোন। তারামাসিমা কী করে এই সংসারে এসেছিলেন জানি না, কী কাজ যে তিনি করতেন তাও বলতে পারি না। শুধু মনে হত বলরামকাকাকে তামাক জোগানোই তাঁর একটি মাত্র উদ্দেশ্য। যতদূর মনে পড়ে, আমি কোনোদিন পারুলকাকিমাকে তারামাসিমার সঙ্গে কথা কইতে পর্যন্ত দেখিনি।

পারুলকাকিমাকে সুন্দরী বলা যায় না, মোটামুটি শান্তশিষ্ট গেরস্থ মেয়ের চেহারা। কিন্তু তারামাসিমাকে এক বার দেখলে ভোলা শক্ত। আগুনের মতো গায়ের রং, টানা টানা চোখ, চুলের গোছা পিঠ ছাপিয়ে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। চোখের তারা দুটোয় কেমন একটা নীলচে আভা, মনে হত সে-দুটো সবসময় ঝকঝক করছে। আর আশ্চর্য রুক্ষ আর চড়া ছিল তাঁর গলার আওয়াজ। মেয়েদের অমন কঠিন নীরস স্বর জীবনে আমি কখনো শুনিনি।

মাকে বলতে শুনেছি— অতি বড়ো সুন্দরী না-পায় বর। তাই বিয়ের এক বছরের মধ্যে ওর সোয়ামিকে সাপে কাটল। তারামাসিমা ছিলেন বিধবা। খুবসম্ভব তিনকুলে কেউ ছিল না তাঁর, তাই আশ্রয় নিয়েছিলেন বলরামকাকার সংসারে। কিন্তু খুব চোটপাটেই থাকতেন। বলরামকাকাকে ঘন ঘন তামাকের জোগান দিতেন; ধমক দিয়ে বলতেন, রাতদিন হুঁকো মুখে বসে থাকা আর বকবকানি—পেটের ভাত হজম হয় কী করে?

হয়, হয়। আমি তান্ত্রিক, সাধনার জোরে সব করতে পারি।

ভ্রুকুটি করে তারামাসিমা বলতেন, মরণ!

আর কখনো কখনো দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতেন পারুলকাকিমা। স্থির শান্তদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন এঁদের দিকে। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে সরে যেতেন, কখনো-বা আমাকে ডেকে বলতেন, অন্তু আমার একটু কাজ করে দিবি?

বলরামকাকার বকুনির হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই আমি তৎক্ষণাৎ উঠে পড়তুম, চলে যেতুম বাড়ির ভেতরে।

পারুলকাকিমা আমাকে ডেকে নিয়ে যেতেন চিঠি লেখার জন্যে।

নিজে লেখাপড়া একেবারে জানতেন না তা নয়, কিন্তু হাতের লেখা ছিল কাঁচা আর বড়ো বড়ো। একখানা পোস্টকার্ডে কয়েক লাইনের বেশি ধরত না। আর আমি খুব খুদে খুদে অক্ষরে অনেক কথা লিখতে পারতুম—পোস্টকার্ডের দেড় পিঠেই একখানা এনভেলপের কাজ হয়ে যেত। শুধু পারুলকাকিমারই নয়, পাড়ার অনেকেরই চিঠি লেখায় আমার ডাক পড়ত।

বাড়ির ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে চিড়ের মোয়া, নারকেলের নাড় আর গঙ্গাজলি —এইসব খেতে দিতেন। খাওয়া হয়ে গেলে বলতেন, আমাকে একখানা চিঠি লিখে দে।

চিঠি লিখতেন তাঁর বাবার কাছে। গ্রাম খলিশাকোটা, জিলা বাখরগঞ্জ। আমি বাখরগঞ্জের বদলে বরিশাল লিখতুম। ইশকুলে পড়তে গিয়ে আমি জেনেছিলুম, আজকাল আর বাখরগঞ্জ লেখার রেওয়াজ নেই, বরিশাল লিখতে হয়।

কী লেখা হত চিঠিতে?

বাবা, তুমি এক বার অবশ্য আসিবে। আজ কতদিন তোমাকে দেখি না। আমারও সংসার ফেলিয়া যাইবার উপায় নাই। মরণ না হওয়া পর্যন্ত এখান হইতে আমি নিস্তার পাইব না। ইহারা আমাকে নিয়া যাইবে না।

এই পর্যন্ত লিখে আমার খারাপ লাগত। কলম থামিয়ে জিজ্ঞেস করতুম, আপনি কেন বাপের বাড়ি যান না কাকিমা? বলরামকাকাকে বললেই তো পারেন।

ও যাবে না।

কেন যাবেন না? কাজকর্ম তো কিছুই নেই, বসেই তো রয়েছেন রাতদিন।

একথা অনেক বার আমি জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু পারুলকাকিমা কোনোদিন জবাব দেননি। এড়িয়ে গিয়ে বরাবর বলেছেন, অত কথায় তোর কী দরকার? যা বলছি, লিখে যা।

এরই মধ্যে আমি দেখতুম তারামাসিমা উঠোন দিয়ে চলে যাচ্ছেন। যেতে যেতে চেয়ে দেখলেন আমাদের দিকে, রোদ লেগে চোখের নীলচে তারা দুটো তাঁর জ্বলে উঠল এক বার, যেন ছড়িয়ে পড়ল কয়েকটা আগুনের ফুলকি। মনে হয়েছে পারুলকাকিমা যেন এক বার দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলেন, যেন শ্বাস বন্ধ করে বসে রইলেন কয়েক সেকেণ্ড, তারপর তীব্র স্বরে ফিসফিসিয়ে বললেন, লিখে যা অন্তু, লিখে যা। তাড়াতাড়ি লেখ।

অস্বীকার করব না, বলরামকাকার সংসার নিয়ে একটা চাপা সন্দেহ আমার মনের মধ্যে ফেনিয়ে উঠছিল। আমি তখন সেই বয়েসে পা দিয়েছি, যখন জীবনের আর একটা উপকূল চোখের সামনে ছায়ার মতো ফুটে উঠেছে আর তার অস্পষ্ট আভাসের ওপর আমার মনের রং পড়ছে। আমি উপন্যাস পড়তে শুরু করেছি। মতিবিবি আর কপালকুন্ডলার সম্পর্ক অনেকটা অনুমান করতে পারি, বড়োদের কথাবার্তার ভেতর থেকে অনেক ইঙ্গিত তখন খুঁজে পাই। একদিন দুপুরে আমাদের বাড়িতে মেয়েদের আসর বসেছিল, আমি বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে শুনতে পেয়েছিলুম রায় বাড়ির রাঙাজেঠিমা চিৎকার করে বলছেন, পারুল বলেই সহ্য করে, আর কেউ হলে এতদিন ঝাঁটা মেরে ওই বলাকে…

আমাকে ঢুকতে দেখেই তিনি থেমে গিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন, অন্তু, যা এখান থেকে। মেয়েদের কথার ভেতর পুরুষমানুষের দাঁড়াতে নেই।

সেইদিন থেকে আমি অনেকটা সচেতন হয়ে উঠেছিলুম। কতগুলো ছায়া আমার সামনে রূপ নিতে লাগল। মানুষের মনের অরণ্য সেই প্রথম তার জটিল অন্ধকারে আমাকে আকর্ষণ করল। বলরামকাকাকে এর আগে আমার ভালো লাগত না, এরপর থেকে যেন তাঁর সম্পর্কে একটা তীব্র বিদ্বেষ আমি অনুভব করতে আরম্ভ করলুম। ডাকলেও আমি আর বসতুম না, কাজ আছে বলে জোরপায়ে পেরিয়ে যেতুম জায়গাটা। তারামাসিমা বিশেষ কথা বলতেন না আমার সঙ্গে, শুধু মনে হত তাঁর নীলচে উগ্র চোখ দুটো থেকে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে জ্বলে উঠত। বুঝতে পারতুম আমাকে তিনি পছন্দ করেন না।

হয়তো একটু কারণ ছিল। একবার শ্রাবণ মাসে আমাকে ডেকে বলেছিলেন, আজ সন্ধে বেলা এসে এক বার একটু মনসামঙ্গল পড়ে দিয়ে যাস তো। আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কাল থেকে, পড়তে পারছি না। ওদিকে সংক্রান্তি তো এসে গেল।

পয়লা শ্রাবণ থেকে আমাদের দেশে মনসামঙ্গল পড়বার রেওয়াজ। সংক্রান্তিতে মনসা পুজোর দিনে সে-পড়া শেষ করতে হয়। সন্ধের পরে ওই বাঁশবন পেরিয়ে এই বাড়িতে আসতে আমার প্রচুর আপত্তি ছিল, সংক্ষেপে বললুম, সন্ধের সময় আমার স্কুলের পড়া আছে, আমি আসতে পারব না।

তারামাসিমার নীলচে চোখ দুটো ধকধক করে উঠল। সেই অদ্ভুত কর্কশ গলায় বললেন, তা পারবি কেন? পারবি কেবল ঘণ্টার পর ঘণ্টা পারুলকাকিমার চিঠি লিখতে। তাতে তোর লেখাপড়ার একটুও ক্ষেতি হয় না।

আমি জবাব দিইনি। চলে আসতে আসতে দুটি মিষ্টি সম্ভাষণ শুনেছিলুম পিছন থেকে লক্ষ্মীছাড়া, বাঁদর।

বলরামকাকার বাড়িতে যাওয়ার জন্যে আমার যে বিন্দুমাত্রও আকর্ষণ ছিল তা নয়। ওদের সঙ্গে আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও ছিল না। কাকা ডাকতুম নিতান্তই গ্রাম সুবাদে। ওদের ওখানে আমার আসা-যাওয়াও বাড়ির লোকে পছন্দ করত না। আমিও ইচ্ছে করে যেতুম না, কিন্তু খাল পেরিয়ে কোথাও যেতে গেলেই বলরামকাকার বাড়ির ওপর দিয়ে পা বাড়াতে হত আর সঙ্গে সঙ্গেই ডাক পাড়তেন, এই শোন শোন, আয় এদিকে।

তারপরেই গোটা কতক উদ্ভট শ্লোক, স্কুলের পড়ানোর নিন্দে আর তন্ত্রশাস্ত্রের আলোচনা। কথা বলতে বলতে বাঁ-হাতের সেই পানিজোঁকের মতো লিকলিকে আঙুল দিয়ে গা চুলকোতেন। রোগা কালো কালো খড়িওড়া পায়ে নখের দাগ পড়ে যেত, ঠিক মনে হত। একটা বনবেড়াল হাঁস চুরি করে খেয়ে শুকনো বাঁশের ওপর আঁচড় কেটে কেটে থাবায় শান দিচ্ছে।

আর একটি রবিবারের ছুটি। ওই বাঁশবন ছাড়িয়ে চলেছি ওপারের এক বন্ধুর বাড়িতে। এক বার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলুম বলরামকাকা ওখানে বসে নেই, জলচৌকিও নেই। শুধু বাড়ির বাচ্চা রাখাল আক্তার বসে বসে গোরুর জাবনা কাটছে। চলে যাচ্ছি, পিছন থেকে ডাক শুনলুম, অন্তু।

দেখি পারুলকাকিমা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।

পারুলকাকিমা ডাকলে চলে যাওয়া যায় না। আমাকে ফিরতে হল। অর্ধচেতনভাবে আমি জানতুম, এই বাড়িতে দুটো দল আছে; একদিকে বলরামকাকা আর তারামাসিমা, আর একদিকে পারুলকাকিমা একা। আমিও মনে মনে পারুলকাকিমার সঙ্গে যোগ দিয়েছি, কিন্তু কেন দিয়েছি সে আমার নিজেরও জানা নেই। আর তারামাসিমা সেকথা জানে—তার চোখের দৃষ্টি দেখেই আমি তা বুঝতে পেরেছিলুম।

আমি কিছু বলবার আগেই পারুলকাকিমা বললেন, একটা চিঠি লিখে দিয়ে যাবি?

আচ্ছা।

তিন জনের এই বাড়িটি এমনিতেই নির্জন, আজকে আরও ফাঁকা ঠেকল। বলরামকাকাকে দেখতে পেলুম না, তারামাসিমাকেও নয়। দাওয়ায় বসে আমি জিজ্ঞেস করলুম, কাকা কোথায়?

একটু চুপ করে রইলেন পারুলকাকিমা। তারপর বললেন, শিষ্যবাড়ি গেছেন।

বছরে এক বার করে বলরামকাকা শিষ্যবাড়ি যেতেন। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে এই ভাগ্যটুকু তাঁর পাওয়া। রবিশাল-ফরিদপুরে ক-ঘর শিষ্য তাঁদের ছিল, এক বার করে সেসব জায়গায় ঘুরে আসতেন। যা পেতেন দু-হাতে কুড়িয়ে আনতেন। তারপর বাড়িতে বসে জমির ধান, পুকুরের মাছ আর রাতদিন তামাক টানা। এই মাস দেড়েকই যা-কিছু নড়েচড়ে বেড়াতেন তিনি। কিন্তু…

আমি বললুম, এসময় তো কাকা শিষ্যবাড়ি যান না।

পারুলকাকিমা বললেন, না গিয়ে উপায় ছিল না।

কথার স্বরে আমি চমকে উঠলুম। পারুলকাকিমার মুখের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেছে, চোয়ালের হাড় দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে হঠাৎ বলে উঠলেন, আমাকে খানিক বিষ এনে দিতে পারিস অন্তু?

কাকিমা!

তোকে আর চিঠি লিখতে হবে না, তুই যা।

আমি ভয় পেলুম। আমার মনে হল আসবার সময় বাঁশবনের ভেতর কেমন যেন একটা ভূতুড়ে হাওয়া দিচ্ছিল, বাঁশে-কঞ্চিতে কটকট খড়খড় করে আওয়াজ উঠছিল। কোথায় যেন একটা দাঁড়কাক রাক্ষুসে গলায় খা-খা-খা বলে ডেকে চলেছিল। আমি অনুভব করলুম বাঁশবাগান থেকে যেন কী-একটা অদ্ভুত ছায়া আমার সঙ্গে সঙ্গে এবাড়িতে চলে এসেছে। বাইরে আক্তার খস খস করে জাবনা কাটছিল, শুকনো হাওয়ায় সেই খড় কাটার আওয়াজ যেন বনবেড়ালের নখের আঁচড়ের মতো আমার কানে বাজতে লাগল।

আমি উঠে দাঁড়াতেই পারুলকাকিমা শক্ত করে আমার কাঁধটা চেপে ধরলেন। বললেন, তুই তো বড়ো হয়ে গেছিস, আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করতে পারিস?

কী বলতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু চোখ তুলেই নামিয়ে নিলুম আমি। পারুলকাকিমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তারামাসিমার চোখেও অত আগুন আমি কোনোদিন দেখিনি।

পরক্ষণেই আমার কাঁধে একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, যা, বেরো। আর কখনো এখানে আসিস নি। এবাড়িকে পিশাচে পেয়েচে, তোর রক্ত শুষে খেয়ে ফেলবে।

সেদিন আমি দেড় মাইল ঘুরে বাড়ি ফিরেছিলুম। ওই বাঁশবনের ভেতর দিয়ে সাঁকো পার হতে আর আমার সাহস হয়নি।

সারা গ্রামে ঝড় উঠল তার পরের দিন। খুন। খুন হয়েছেন তারামাসিমা।

গ্রামের বুনো পাড়ার দুজন লোক বাঁশি তৈরি করবার জন্যে তলতা বাঁশ কাটতে গিয়েছিল বাঁশবনে। বাগানের যে-দিকটাতে সচরাচর কেউ যায় না, যে-দিকটাতে বাঁশবনের সঙ্গে ঝোপঝাড় আর বেতবন মিশে একাকার হয়ে গেছে, যেখানে খালের কালো জল চওড়া হয়ে বাঁক নিয়েছে একটা, পাশের ঢালু জমিতে একটুখানি জলার মতো সৃষ্টি হয়ে অজস্র কলমির ফুল ফুটেছে আর গজিয়ে উঠেছে হোগলার জঙ্গল, সেখানে–

সেখানে দিনে-দুপুরেই নরম কাদার ভেতর থেকে দু-তিনটে শেয়াল কী-যেন টেনে তুলছিল। বুনোরা পাশে ডিঙি ভিড়োতেই শেয়ালেরা ছুটে পালাল। তখন দেখা গেল কলমির ফুল রক্তে মাখা, হোগলার বনে রক্তের ছিটে, জায়গায় জায়গায় কাদার রং পোড়া ইটের মতো লাল। আর দেখা গেল প্রায় উলঙ্গ একটা মানুষের শরীর। টকটক করছে গায়ের রং, এক মাথা ছড়ানো চুলের গদির ওপরে যেন শুয়ে আছে সে। তার দীর্ঘ সাদা গলাটার বারো আনা অংশ মুরগি জবাই করার মত নিপুণ হাতে কাটা।

তাদের আকাশ-ফাটানো চিৎকারের দু-মিনিটে গ্রামের সব লোক জড়ো হয়ে গেল সেখানে। আমাদের স্কুলে ছুটি হয়ে গেল, পোস্টমাস্টার ছুটে এলেন ডাকঘর বন্ধ করে, এলেন ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার রায় জ্যাঠা, এল দফাদার, এল চৌকিদার। আরও কয়েক ঘণ্টা পরে দলবল নিয়ে দেখা দিলেন গৌরনদী থানার দারোগা।

সেই দুঃস্বপ্নের মতো বীভৎস দিনটার প্রত্যেকটা মুহূর্ত পর্যন্ত যেন আজ মনে করতে পারি।

দারোগা লাশ দেখলেন, লোক তাড়িয়ে সেখানে পুলিশ চৌকিদারের পাহারা বসালেন, তারপর সোজা চলে গেলেন বলরামকাকার বাড়ি।

সেখানে নাকি পারুলকাকিমা বলেছিলেন, বলরামকাকা চার দিন হল শিষ্যবাড়ি গেছেন। রাতের বেলা তারামাসিমা কখন কেন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন আর ওই বাঁশবনেই-বা কেন গিয়েছিলেন তা তিনি জানেন না। তারামাসিমাকে কে খুন করতে পারে তাও তিনি বলতে পারেন না। তাঁদের কোনো শত্রু নেই। তারামাসিমা তাঁর দূর সম্পর্কের বোন— বালবিধবা। এ সংসারে পাঁচ-ছয় বছর ধরে আছেন, তাঁর স্বামীই অনাথা দেখে নিয়ে এসেছিলেন। না, কোনো ঝগড়াঝাঁটি ছিল না, তারামাসিমার সঙ্গে বাইরের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না তাও তাঁর জানা নেই।

আরও কার কার সব জবানবন্দি নিয়ে দারোগা চলে গেলেন। সঙ্গের নৌকোয় চলল কলাপাতা আর কয়লার গুঁড়ো দিয়ে জড়ানো একটা অদ্ভুত জিনিস। শুধু কলাপাতার ফাঁক দিয়ে তা থেকে খানিকটা জটবাঁধা এলোচুল বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। তারামাসিমার লাশ।

বলরামকাকা নাকি কী করে খবর পেয়ে দিন সাতেক পরে ফিরে এসেছিলেন। নৌকো থেকে নেমেই—কী সর্বনাশ হল বলে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পুরো তিন ঘণ্টা পরে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে।

দারোগা তাঁকেও ডেকে পাঠিয়েছিলেন গৌরনদী থানায়। বলরামকাকা কী বলে এলেন জানি না, দারোগাকে আরও বার দুই আমাদের গ্রামে দেখা গেল। তারপর সমস্ত ব্যাপারটাই ধামাচাপা পড়ল। আর গ্রামের লোকের মুখে নানা জল্পনা ক্রমে ফিকে হতে হতে শেষপর্যন্ত একেবারে মুছে গেল। তারামাসিমা বলে কোথাও যে কেউ ছিল, আর তার গলা কেটে খুন করে তাকে হোগলা-কলমির বনের তলায় পুঁতে দেওয়া হয়েছিল, সেই কথাটা পর্যন্ত হারিয়ে গেল গ্রাম থেকে।

আর আমার মনের সামনে ওই বাঁশবনটা যেন তার সমস্ত হিংস্র তাৎপর্যে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেই বনবেড়াল, সেই বেজির থাবায় খড়িশ গোখরোর রক্তমাখা ছেড়া ছেড়া শরীর, সেই দুপুরের ভূতুড়ে হাওয়ার শুকনো পাতা আর বাঁশের শব্দ, কখনো-বা ঘুণধরা বাঁশের ফুটো থেকে বাতাসের ধাক্কায় আর্তনাদের মতো একটা তীক্ষ্ণ ধ্বনি—সব মিলে একটা যোগফল টেনে আনল।

তারামাসিমার খুন।

এরপর থেকে ও-পথে চলাই আমি ছেড়ে দিলুম। নেহাত দরকার হলে দেড় মাইল ঘুরে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঠের সাঁকো পার হয়েছি, কিন্তু ওই বাঁশবন দিয়ে আর নয়। আমি জানতুম—যেকোনো নির্জন দুপুরে যেকোনো নিঃসঙ্গ বিকেলে একটা রাক্ষুসে দাঁড়কাক হঠাৎ খা-খা খা করে ডেকে উঠলে ওই বাগানের ভেতর তারামাসিমার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যেতে পারে। যে-তারামাসিমার গলার বারো আনা জবাই করার মতো কাটা, অথচ যার উগ্র নীল চোখ থেকে ঘৃণার হলকা ছুটে আসছে আমার দিকে।

এইখানেই পারুলকাকিমার সঙ্গে সম্পর্ক আমার শেষ হতে পারত। হল না।

আরও এক বছর পরে একটি রাত। এগারোটা বেজে গেছে, গ্রাম ঘুমিয়েছে অনেক আগেই। শুধু খালের ধারে ধারে চাপবাঁধা জোনাকি, দূরে দুটো-চারটে দপদপানো আলেয়া, কোথাও বাঁশের সাঁকোর ওপর এত রাতেও হঠাৎ কেউ পার হয়ে যাচ্ছে—তার টর্চের আলো। জলের শব্দ, নৌকোর শব্দ, খালের জলে নুয়ে-পড়া বনের ভেতর সাপ আর মাছের শব্দ, কুকুরের ডাক আর অনেক দূর থেকে চৌকিদারের আওয়াজ জাগো হো—জা-গো…।

আমি ঘাট থেকে খুলে নিয়েছি আমাদেরই একটা এক-মাল্লাই নৌকো। সেই নৌকোয় পারুলকাকিমা একা যাত্রী। আমি তাঁকে চুপি চুপি পৌঁছে দিতে চলেছি স্টিমারঘাটে। বলরামকাকা বেরিয়েছেন শিষ্যবাড়ি, সেই ফাঁকে কাকিমা এক বার মা-বাপকে দেখতে যাচ্ছেন।

আক্তারের হাতে চিঠি পাঠিয়ে আমাকে ডেকেছিলেন পারুলকাকিমা। যাব না বলে প্রতিজ্ঞা করেও না গিয়ে পারিনি। সেই দেড় মাইল পথ ঘুরেই আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলুম।

পারুলকাকিমা বলেছিলেন, তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু এরপরে আর কোনো দিন জ্বালাব না। এবার শুধু একটুখানি উপকার কর আমার। তুই আমায় স্টিমারঘাটে পৌঁছে দে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমি দত্তদের ঘাটলার কাছে হিজলতলায় দাঁড়িয়ে থাকব, তুই ডিঙি করে এসে আমায় তুলে নিবি।

আমার খটকা লেগেছিল, বাপের বাড়ি যাবেন, এত লুকিয়ে কষ্ট করে কেন? দরকার আছে। তুই বুঝতে পারবি না। আমি চুপ করে গিয়েছিলুম। পারুলকাকিমা আবার বলেছিলেন, তোর বুঝি সাহস হচ্ছে?

সাহস হচ্ছিল না সত্যি কথাই। বুঝতে পারছিলুম সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন গোলমেলে।

তবু সেকথা আমি বলতে পারিনি। একটু পরে জবাব দিয়েছিলুম, আচ্ছা আসব।

চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে চুরি করে ডিঙি নিয়ে এসেছিলুম। দূর থেকে দেখেছিলুম, দত্তদের হিজলতলায় অন্ধকারে একটা সাদা কাপড়পরা মূর্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক বারের জন্যে আমি চমকে উঠেছিলুম, এক বারের জন্যে মনে হয়েছিল কাছে গিয়ে যদি দেখি পারুলকাকিমার বদলে তারামাসিমাই ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন? যদি…

ঘাটে নৌকো ভিড়োতে প্রথমে আমার সাহস হয়নি। কিছুক্ষণ আমি ইতস্তত করেছিলুম। তারপর খালের পশ্চিম দিকে ডুবে-যাওয়া চাঁদের এক ঝলক রাঙা আলো হঠাৎ এসে হিজলতলায় পড়ল, আমি পারুলকাকিমাকে চিনতে পারলুম।

নৌকো কাছে এগিয়ে নিয়ে এলুম। সম্পূর্ণ পাড়ের কাছে আনবার আগেই পারুলকাকিমা এগিয়ে এলেন, উঠে পড়লেন পাটাতনে। শুধু একটি কথা বললেন, চল।

স্টিমারঘাটে যাব তো?

হুঁ, স্টিমারঘাট।

কিন্তু এত রাতে তো স্টিমার নেই।

সকালে আছে। রাতটা বসে থাকব ওখানেই।

খালের জলে জোয়ার-ভাটা থমথম করছিল। আমি বইঠাতে টান দিয়ে বললুম, কিন্তু কোথায় বসে থাকবেন কাকিমা? নদীর ধারে তো একটা চালাঘর ছাড়া কিছুই নেই। ঘাটবাবুর ঘর বন্ধ, সকালের আগে সে আসবে না।

চালাঘরেই বসে থাকব। নৌকোর ছইয়ে ঠেসান দিয়ে, হাতের ছোটো পুঁটলিটা কোলের ওপর রেখে পারুলকাকিমা বললেন, আমার কাছে এখন সব সমান।

বাপের বাড়ি যাওয়ার মতো গলার সুর এ নয়। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, খালের এই কালো জল যে-নদীতে গিয়ে পড়েছে, সে-নদী কোথায় কোন সমুদ্রে হারিয়ে গেছে সেকথা যেমন কেউ জানে না, তেমনি পারুলকাকিমার খলিশাকোটাও এই রাত্রে, এই অন্ধকারে যেখানে তলিয়ে আছে, বাখরগঞ্জ জেলার কোনো ভূগোল আজও তার সন্ধান পায়নি।

চমকে বইঠা তুলে নিয়ে আমি বললুম, পারুলকাকিমা, ফিরে চলুন।

না।

আমার ভয় করছে।

তবে তুই নেমে চলে যা। আমি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, নৌকো বাইতে জানি। আমিই নৌকো নিয়ে যাব।

এরপরে আর আমি কথা বাড়াইনি। খালের জলে ভাটার টান এসেছে, নৌকো এগিয়ে চলেছে, পশ্চিমের গাছপালার আড়ালে চাঁদ ডুব দিয়েছে। এখন জলের গন্ধ, কাদার গন্ধ, ভিজে গাছপালার গন্ধ, মাছের শব্দ, সাপের শব্দ, নৌকোর শব্দ, স্রোতের আওয়াজ, কুকুরের ডাক। চৌকিদারের হাঁক আর শোনা যায় না। আকাশে তারা জ্বলছে, ঝোপে জোনাকি জ্বলছে, কিন্তু বাঁশের সাঁকোর ওপর দিয়ে টর্চ হাতে আর কেউ পার হয়ে যাচ্ছে না।

এখন শুধু আমাদের ডিঙা। আমি, পারুলকাকিমা আর রাত্রির পৃথিবী।

বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে ওই অন্ধকারের ভেতরেও নদীর সাদা বুকটা সামনে জ্বলে উঠল। বইঠার আরও কয়েকটা টানে আমি একেবারে নদীর ভেতরে এসে পড়লুম। ঘুমন্ত গ্রামের ভেতর থেকে কুকুর ডেকে উঠল, নৌকোর সামনেই আমাকে চমকে দিয়ে পর পর দুটো শুশুক উলসে গেল।

নদীর ওপার নিশ্চিহ্ন, এপারের কালো কালো গাছপালার সার নিথর। কী আশ্চর্য রাত! এত বড়ো নদীর বুকেও এতটুকু হাওয়া নেই, চারদিক যেন নিশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। জলের ওপর অসংখ্য তারা দুলছে, ফুলছে। ভেঙে ভেঙে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাটার টানে নৌকো ছেড়ে দিয়ে হাল ধরে বসে আছি। যেন নদী নয়, অদৃষ্টের স্রোত আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে।

এতক্ষণ পরে পারুলকাকিমা আবার কথা কইলেন।

যেদিন সমস্ত রাত ওর রক্তমাখা কাপড় কেচেছিলুম, সে-রাতও এমনি…

আমার হাতের হাল কেঁপে উঠল, একটা দারুণ ঝাঁকুনি লাগল নৌকোয়। কোথা থেকে মস্ত একটা কাঠের গুড়ি এসে ডিঙিতে ধাক্কা দিয়েছে। আমি বললুম, পারুলকাকিমা?

পারুলকাকিমা প্রায় নিঃশব্দ গলায় বললেন, কী করব বল? তান্ত্রিক স্বামীর পুণ্যের ভাগ নিতে হবে না?

আমার মাথার ভেতরে বিদ্যুৎ চমকে গেল। তবে কি বলরামকাকাই তারামাসিমাকে…

পারুলকাকিমা জবাব দিলেন না।

কিন্তু বলরামকাকা যে শিষ্যবাড়িতে…

সন্ধে বেলা লুকিয়ে চলে এসেছিলেন। দিদিকে বলেছিলেন, তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে কিছুদিন রাখব যেখানে কেউ জানতে পারবে না। তন্ত্রসাধনার ফল ফলেছিল কিনা— দিদি যে ওঁর ভৈরবী হয়েছিল। পারুলকাকিমার গলায় কেউটে সাপের ফোঁসানির মতো আওয়াজ উঠতে লাগল, একজন না চাইতেই সন্তান পেল, তাই মরতে হল তাকে। আর একজন সাত বছর চেয়েও পেল না, তাই তাকে বেঁচে থাকতে হল। বেঁচে থাকতে হল মরবার সাহস নেই বলে।

এক মুহূর্তে সমস্ত জিনিসটা তার কুৎসিত উলঙ্গ সত্যটা নিয়ে আমার সামনে ফুটে উঠল। মনে হল নৌকো থেকে এখনি মাথা ঘুরে আমি পড়ে যাব জলের ভেতর। ঢেউয়ে ঢেউয়ে যে অসংখ্য তারা ফুলছিল, দুলছিল, ভেঙে ভেঙে একাকার হয়ে যাচ্ছিল—আমার চোখের সামনে তারা চাপ চাপ রক্তে পরিণত হয়ে গেল। আমি শুধু বিকৃত গলায় একটা চিৎকার করলুম।

পারুলকাকিমা আবার বললেন, অনেক বেশি পুণ্য নিয়ে ওবাড়িতে আমাকে জোর করে বাঁচতে হয়েছিল। এবার দেখব সব পুণ্যের বোঝা নামিয়ে মরে বাঁচতে পারি কি না। অন্তু, নৌকো পাড়ে ভিড়িয়ে দে।

সে কী কাকিমা! এ তো স্টিমারঘাট নয়!

তা হোক, এখানেই আমি নামব। স্টিমারের দরকার নেই, এখান দিয়ে গয়নার নৌকো যায়–তাতেই আমি চলে যাব।

পারুলকাকিমা, মেয়েরা তো গয়নার নৌকোয়।

কথা বাড়াসনি, আমাকে নামিয়ে দে এখানেই।

আপনার ভয় করবে না?

না, ভয় আমার কাউকে নেই।

আমি শেষ বার বললুম, পারুলকাকিমা, আপনি সত্যিই কি খলিশাকোটায় যাবেন?

পারুলকাকিমার শুকনো একটা হাসির আওয়াজ আমরা কানে এল। হ্যাঁ, খলিশাকোটাতেই আমি যাব।

আজ কত বছর পরে সেই দিনগুলোকে যখন ভাবছি, তখন আরও মনে পড়ছে, খলিশাকোটার পথ ওদিকে ছিল না। যে-স্রোত অজানা সমুদ্রে যায়, সেই স্রোতেই পারুলকাকিমা ভেসে গিয়েছিলেন। আর যে-জল এক বার চলে যায় সে যেমন কখনো ফেরে না, তেমনি পারুলকাকিমাও আর আমাদের গ্রামে কখনো ফিরে আসেননি।

শুধু আমি ভোর হওয়ার আগেই নিঃশব্দে ফিরে এসেছিলুম। বলরাম চক্রবর্তীর স্ত্রীর পালিয়ে-যাওয়া নিয়ে গ্রামে যে তুফান উঠেছিল, তাতে একটি কথাও আমি বলিনি।

তারপর আজ কালীঘাটে এই বুড়িকে আমি দেখলুম।

দুটো মুখের রেখায় কি মিল আছে? হয়তো আছে—হয়তো নেই।

পারুলকাকিমা কেন এসে শেষে ভিক্ষার জন্যে হাত পেতেছেন কালীঘাটে? তান্ত্রিক স্বামীর পুণ্যফলই কি শেষপর্যন্ত তাঁকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে?

মন মানতে চাইল না। যে-ঋণ শোধ করবার জন্যে পারুলকাকিমা সেই অন্ধকারের পথ বেছে নিয়েছিলেন, সেই ঋণ কি সারাজীবনেও তাঁর শোধ হবে না? হতে পারে না, এমন হতেই পারে না। তার চাইতে অন্ধকারের নদী বয়ে চলুক সমুদ্রে। সেই সমুদ্রে সব জল, সব প্রাণ, সব ঋণ মুক্তি পায়। পারুলকাকিমাও নিশ্চয় সেই সমুদ্রেই তাঁর বোঝা নামিয়ে দিতে পেরেছেন পেয়েছেন তাঁর ছুটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *