টুপু কখন আসবে

টুপু কখন আসবে

টুপু, টুপু, ওই শোনো লুলা আবার ডাকছে। তুমি জান না, যে-রাতে তোমার ঠাকুমা মারা যায় সেদিনও অমন করে ডেকেছিল। টুপু, তোমার ভয় করছে না? পালিয়ে এসো, আমার কাছে। এসো।

দোতলার পুব দিকের গোল বারান্দায় সকালের রোদ, চৌকো নকশার রেলিঙের ফাঁক দিয়ে লাল সিমেন্টে পড়েছে। কাঠের দোলনা ঘোড়ায় দুলতে দুলতে টুপু তাকাল দাদুর দিকে। আবার তাকাল নিজের ছায়াটার দিকে। ছায়াটা দুলছে। খুশিতে আরও জোরে টুপু নিজেকে দোলায়, ঢেউয়ের মতো ওঠা নামা করে কাঠের ঘোড়া।

দাদু, দ্যাখো দ্যাখো।

টুপুর কুচকুচে তারা দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।

আঙুল দিয়ে ছায়াটাকে সে দেখাল। দাদু আগের মতো চাকা-লাগানো চেয়ারটায় চুপ করে বসে। হাসে না, কথা বলে না, নড়াচড়া করে না। আস্তে আস্তে দুলুনি কমে এল টুপুর।

অ্যাই দাদু, কথা বল না কেন? শান্তাদিদি তো এখন চুল আঁচড়াচ্ছে, কেউ তো বকবে।

দাদু একভাবে বসে থাকে, কথা বলে না, নড়াচড়া করে না। টুপু আবার ঘোড়াটাকে দোল দিতে শুরু করল।

দাদু ঘোড়ায় চাপবে?

কথাগুলো ঢেউয়ে-ভাসা ব্লটিং কাগজের মতো ওঠা-নামা করতে কয়তে ডুবে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে টুপু নেমে বারান্দার অন্যধারে ছুটে গেল। সেখানে এইমাত্র একটা বোলতা উড়ছিল।

টুপু উঠো না রেলিঙে। বোলতা উড়ে গেছে। হয়তো এখন বুগেনভিলার খোকায় বসেছে। আছে কি গাছটা এখনও গেটের ওপর। তুমি যেখানে দাঁড়িয়েছ এখান থেকে তো গেটটা দেখা যায়। তোমার ঠাকুমা পুঁতেছিল, সে কি আর এখনও আছে। গাছ-ফুল-পাখি, রঙিন মাছ আর খোকা-খুকুদের সে বড়ো ভালোবাসত। না না, টুপু ওদিকটায় যেয়ো না, আমার চোখের আড়ালে যেয়ো না। আমি কিছু দেখতে পাই না তুমি কাছে না থাকলে। টুপু আকাশ এখন কি তোমার সোয়েটারের রঙের মতো নীল হয়েছে? এক বার দেখে আসবে লনের শিশিরে রোদুর কি তোমার চোখের থেকেও ঝিকমিকে? মাঠি খুঁড়ে ছোট্ট ছোট্ট ঢিপি করেছে কী কেঁচোরা? যদি করে থাকে তাহলে বুড়ো আঙুল দিয়ে ওগুলো ভেঙে দিয়ে এসো, দেখবে কী মজা লাগে। মাটিগুলো ঝুরঝুরে হয়ে হয়ে যায়। খানিকটা ওই মাটি এনে আমার চোখের সামনে উড়িয়ে দাও, আমি দেখব তোমার চুল না মাটি-কোনটা বেশি ঝুরো। না থাক, টুপু তুমি যেয়ো না, তাহলে ওরা তোমায় বকবে। ওরা তোমায় কেন যে আমার কাছে আসতে দেয় না! আমি কি তোমার কিছু ক্ষতি করতে পারি! টুপু এখন কেউ নেই, এই হচ্ছে সময়। তুমি এসো আমার কাছে। আর আসার সময় দেখে নিয়ে ফুরুস গাছে বুলবুলি এসেছে কি না। ওরা বছরে বছরে আসে।

খোঁজাখুঁজি করে বোলতাটাকে না পেয়ে টুপু ফিরে এল। ঘোড়ায় উঠতে যাবে—কী ভেবে উঠল না। গুটিগুটি দাদুর কাছে এসে দাঁড়াল।

তুমি কথা বল না কেন? বলতে পার না জিভ নেই বলে? কই হাঁ করো তো, করোনা। মুখের কাছে মুখ আনে টুপু, দাদুর চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ে।

তুমি হাঁ করতে পার না? তবে খাও কী করে?

টুপুর জিজ্ঞাসার উত্তরে চোখের পাতা ফেলা ছাড়া আর কিছু করে না দাদু। টুপু রেগে ওঠে। দাদুর হাত ধরে জোরে নাড়া দেয়। চেয়ারের হাতল থেকে ঝুলে পড়ে হাতটা।

খাও কী করে বলো-না? আমি কিন্তু চাইব না। সত্যি বলছি। আমি কি অসভ্য? না বলবে তো বয়ে গেল, যখন তুমি খাবে তখন ঠিক লুকিয়ে লুকিয়ে দেখব। সত্যি সত্যি দেখব কিন্তু?

খস খস চটির শব্দ আসে। টুপু দাদুর কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। শান্তা এল। মাজা গায়ের রং। পেকে-ওঠা ফোড়ার মতো টসটসে শরীর। পিঠের সাদা আঁচলটাকে মনে হয় একটা কঙ্কাল যেন শ্রান্ত হাত ঝুলিয়ে দিয়েছে। কমলা রঙের অর্গাণ্ডির ব্লাউজটা ক্ষতের ওপর নতুন গজানো চামড়ার থেকেও টানটান, তাই ব্রেসিয়ারটাকে দেখায় একখন্ড হাড়। শান্তার বয়স বোঝা যায় না। ওর গলার স্বর খসখসে ঠাণ্ডা। ওর হাতের নখ সরু আর রঙিন।

টুপু, এখানে কী?

দাদুর চেয়ারের পিছনে সরে এল টুপু। তালুর উলটোপিঠ কামড়ায় আর তাকিয়ে থাকে সে শান্তার চোখে।

এখন যাও, দাদু চান করবে।

টুপু চেয়ারের পিছন থেকে সরে দাঁড়াল। এইবার শান্তা চাকা লাগানো চেয়ারটাকে ঠেলে নিয়ে যাবে বাথরুমে।

আমি দেখব।

না দেখতে নেই।

শান্তা চলতে শুরু করল সামনে চেয়ার রেখে। কাচের মতো মসৃণ মেঝে, দরজায় চৌকাঠ নেই। তবু দুলে উঠল দাদুর শরীর। শান্তার গা ঘেঁষে চলতে চলতে টুপু দাদুর ঝুলন্ত হাতটাকে কোলের ওপর তুলে দিয়ে বলল, কেন দেখতে নেই?

ছোটোদের দেখতে নেই।

দাদু বুঝি ন্যাংটো হবে?

হেসে উঠল শান্তা। ঘাড় নামিয়ে দাদুর কানের কাছে মুখ আনল সে।

হ্যাঁগো বুড়ো, শুনলে কথাটা?

শান্তাকে হাসতে দেখে টুপু যেন বোঝে কথাটা খুব মজার বলেছে সে। বাথরুমের দরজাটা যখন শান্তা খুলছে তখন টুপু আবার বলল :

আমি দাদুকে ন্যাংটো দেখব।

না, দাদু রাগ করবে।

রাগ করবে, কেন?

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল শান্তা। টুপুর মুখে জিজ্ঞাসা আর অবাকের চিহ্নগুলো ভয়ে সমান হয়ে গেল। নিজ থেকেই সে পায়ে পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল। দরজা বন্ধ করে শান্তা তাকাল। দাদুও এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিল, পাহাড়ি পথে সমতলের মানুষ যেমন সবাধানে থেমে থেমে নামে। দাঁতে দাঁত ঘষে শান্তা প্রায় ছুটে এসে চড় মারল দাদুর গালে।

পাজি বুড়ো কোথাকার, অমন প্যাটপ্যাট করে এখনও কী দেখিস? দেখে কী করবি, মারবি? হাত তুলতে পারিস?

দাদুর হাতটা তুলে আবার ছেড়ে দেয় শান্তা। হাতটা চেয়ারের হাতলে খট করে পড়ল। দেখলি? যা খুশি তাই করতে পারি এখন, যা খুশি।

দাদুর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তা চুপ করে গেল। ধক ধক করে জ্বলছে। আস্তে আস্তে সরে এল চেয়ারের পিছনে।

টুপু, টুপু, দরজা ভেঙে তুমি আমার চোখের সামনে দাঁড়াও। তোমায় আমি সব কথা বলব। কবছর আগেও শুধু আমার জুতোর শব্দে এই বাড়িটা ভয় পেত। আজ দেখে যাও আমি মার খাচ্ছি। বাড়ির সবাই-তোমার বাবা-মা-কাকা-কাকি-এমনকী মালীটা পর্যন্ত জানে শান্তা আমায় অপমান করে, তবু কেউ ওকে বারণ করে না। আমি যখন চলাফেরা করতে পারতুম তখন ওদের ভয় পাওয়া দেখে কী খুশিই-না হয়েছি। আমি কি জানতুম এমন একটা দুর্ঘটনা ওত পেতে বসে থাকবে? অসহ্য। অসহ্য, টুপু, আবার আগের জীবন চাই। তুমি দরজা ভেঙে আমার সামনে দাঁড়াও। তোমায় আমি বলব, অনেক কথা বলব। এ-বাড়িতে একটাই সুন্দর মানুষ ছিল, তোমার ঠাকুমা।

জানো টুপু, শান্তা যখন মারে আমার লাগে না। সত্যি বলছি একটুও লাগে না। ব্যথা পাওয়া ভুলে গেছি। অনেক দিন কাঁদি না, অনেক দিন। তাই কি হয়! না টুপু, মিথ্যা বলছি। তোমার কাছে আমি কিছু লুকোব না, রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তুমি যখন ফুলের মতো ছোট্টটি হয়ে মায়ের বুকঘেঁষে আসসা, যখন লুলা তার নখের আওয়াজ অন্ধকারে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটিয়ে আমায় জানালা দিয়ে তাকায়, তখন কাঁদি। জল পড়ে আমার গাল বেয়ে বিছানায়, তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমোলে সব কিছু ভুলে যাই। ঘুম তাই আমার ভালো লাগে। তারপর সকালে যখন উঠি তখন আবার এই যন্ত্রণার শুরু। এমনি করে দিনের পর দিন বাঁচা-মরার মধ্য দিয়ে চলেছি। তবু শেষ বারের মতো এক বার চলাফেরা করতে চাই। আমার হাতটা দিয়ে শান্তার টুটি চেপে ধরতে চাই। আমি ঘুম চাই না।

অ্যাই বুড়ো, চোখ বুজে কী ভাবছিস?

চোখ খুলে দাদু সামনের আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর জামাটা খুলে নিল শান্তা। ট্রাউজার্সের বোতাম খুলতে খুলতে নাক সিঁটকে বলে উঠল :

আজও, আজও আবার! কেনা বাঁদি পেয়েছে যেন। থাকবি ননাংরা হয়ে, আমার কী।

বাঁ-হাতে জড়িয়ে দাদুকে তুলে ধরে ট্রাউজার্সটা খুলে নিল। বাথরুমের কোনায় সেটাকে ছুড়ে ফেলে দাদুকে ঠেলে দিল চেয়ার থেকে। মুখ থুবড়ে দাদু পড়ে গেল। তাকে জলের ঝারির নীচে হিঁচড়ে টেনে আনল শান্তা।

টুপু তুমি এক বার শুধু দেখে যাও, কিন্তু কিছু বোলো না। ছুটে এসে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর কোরো না। শান্তা জানে আমি কথা বলতে পারি না। লেখার জন্যে আঙুলটুকু পর্যন্ত নাড়তে পারি না, তবু ওর ভয় ঘোচে না। তাই ও আমায় মারে। অথচ আমিই ওকে এ-বাড়িতে আনি। তোমার ঠাকুমা পাগল হলে শান্তা নার্স হয়ে আসে। ওকে প্রথম থেকেই আমার ভালো লেগেছিল। তোমার ঠাকুমার অসুখের পর আমি মদ ছেড়েছিলুম। তুমি বড়ো হলে জানবে যে আমি খুব উদ্ধৃঙ্খল ছিলুম। হাতে প্রচুর টাকা ছিল আর খরচও করতুম। ঠাকুমা আমার জন্যেই সুখী হয়নি। কেন যে পারিনি ওকে সুখী করতে জানি না, বোধ হয় এইটেই ওর ভাগ্যে ছিল। কিংবা টুপু, এমনও তো হতে পারে—উদ্ধৃঙ্খলতা আমার স্বভাবে ছিল, আমার পূর্বপুরুষদের নামে গেরস্থঘরের বউ-ঝিরা কাঁপত, তাদের রক্ত তো আমার শরীরে আছে, আমি কেমন করে ভালো হব বল? কিন্তু আমার রক্ত তো তোমার শরীরেও আছে, তবে তুমি কী করে সুন্দর হলে। এ ভীষণ হেঁয়ালি। তুমি বলবে ঠাকুমা অসুখী হয়েছিল তার নিজের দোষেই। কী জানি, তার মনের খবর আমি পাইনি সেও আমায় দেয়নি। ফুল আর খোকা খুকুদের নিয়েই তার দিন কাটত। নিজের ছেলেরা বড়ো হলে পর সে প্রতিবেশীর বাচ্চাদের এনে আদর করত। টুপু, তুমি কাদের সঙ্গে এখন খেলা কর? তারা আজও আসে তো? ওদের নিয়ে এসো আমার কাছে। সুখী মুখ আমি দেখিনি টুপু।

শান্তা থাকত ঠাকুমার ঘরের লাগোয়া ছোট্ট ঘরটায়, যেটায় সে এখনও আছে। একদিন রাতে দেখলুম শান্তা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ভাবলুম বলি রাতে যেন ঘর থেকে না বেরোয়, রাত্রে লুলাকে ছেড়ে রাখা হয়। সাবধান করার জন্যই ওর কাছে গেছলুম। ও কিন্তু আমায় দেখে হাসল মাত্র, কথা কানেই তুলল না। যেন আমার যাবার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়েছিল। অন্ধকার বারান্দায় ঘর থেকে একচিলতে আলো এসে পড়েছে। তাতে ওর মুখের একদিকটা দেখতে পাচ্ছিলুম আর দূরে রাস্তার আলোয় আকাশটা পোড়া ইটের মতো দেখাচ্ছিল। শান্তা দাঁড়িয়েছিল আকাশের দিকে মুখ করে, ওকে আমি জড়িয়ে ধরলুম। অন্য কেউ হলে নিশ্চয় ভয় পেত, ও কিন্তু একটা শব্দও করল না। এরকম ঘটবে যেন জানত। আর কী অশ্চর্যভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে চলে গেল। একচিলতে আলোটা বন্ধ হয়ে গেল। বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকিনি কেননা লুলাকে তো জানি। সারাদিন অন্ধকার ঘরের মধ্যে থেকে আর মানুষ না দেখে ও শেখেনি মানুষ আর ইঁদুরের তফাত।

এরপর থেকে রোজ রাতে অপেক্ষা করতুম শান্তার জন্য। কিন্তু ওকে আর বারান্দায় দাঁড়াতে দেখতুম না। দিনের বেলায় কাছে আসত, কথা বলত, হাসত, আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যেত তখন তাকিয়ে থাকতুম ওর শরীরের দিকে। ও বুঝত তাই বার বার আসত আমার কাছে। টুপু, আমি বিশ্বাস করি না পৃথিবীতে এমন কোনো পুরুষ তখন ছিল যে না চাইত শান্তার শরীরটাকে ছুঁতে। সাদাঘোড়ার ঊরুতে জড়ানো কালো শিরার মতো শান্তা আমাকে চাবুক মেরে খেপিয়ে তুলেছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। রাত্রে ওর ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে ভয়ে ফিরে এসেছি। ভয় তোমার ঠাকুমাকে নয়, লুলাকে। তছনছ করতে ইচ্ছে করত শান্তাকে। কিন্তু পারতুম না লুলার জন্য।

অ্যাই বুড়ো, এখন কেমন লাগে?

শুকনো তোয়ালে দিয়ে দাদুর গলা ঘষতে ঘষতে শান্তা নাকে টোকা দিল।

কেমন লাগে, অ্যাঁ?

আবার টোকা দিল যেন সে শাড়ি থেকে ছারপোকা ফেলে দিচ্ছে। কৌতূহলী চোখে শান্তা একটুক্ষণ তাকায়, সত্যি সত্যি নাকটা পড়েছে কি না দেখার জন্য। পড়ল না, তাই বিরক্ত হয়ে সে দাদুর পা তুলে ধরে ট্রাউজার্স পরানোর জন্য।

টুপু, সেদিন রাতে যখন বারান্দায় চোখ পেতে অপেক্ষা করছিলুম তখন সারা বাড়ি নিঝুম, আকাশটায় ইটের রং আর তোমার ঠাকুমার ঘরে আলো জ্বলছিল। অপেক্ষা করতে করতে যখন ধৈর্যের সীমায় পৌঁছেছি তখন আলো নিভল। মনে হল, হঠাৎই মনে হল শান্তা আজ বারান্দায় দাঁড়াবে। চুপিচুপি এগিয়ে গেলুম। আজও যদি পালিয়ে যায় তাহলে আমিও ঘরে ঢুকব।

দরজায় টোকা দিলুম। সঙ্গে সঙ্গে ও দরজা খুলল। যেন শব্দটার প্রতীক্ষা করছিল। বলল, ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু আমি তাজা ছিলুম। ওর হাত ধরলুম। বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল কোনো আপত্তিই আমি শুনব না, হাত ছাড়িয়ে বলল, আসছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলুম। নীচের বাগান থেকে গন্ধ আসছিল হাসনুহানার। গাছটা ঠিক আমার নীচেই, ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করলুম। ঘুটঘুটে অন্ধকার, একহাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। টুপু, তুমি জান না, সে কী ভাষণ এক-একটা মুহূর্ত। ঠিক ঘুম আসার আগে, বন্ধ চোখের সামনে যেমন জমাট অন্ধকার গোল গোল হয়ে ফেটে পড়ে আর এক-একটা কালো স্তর আলতো হয়ে নেমে আসে চেতনায়, তার থেকেও ভয়ংকর আর সুখের ছিল অপেক্ষার সেই সময়টা।

ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করলুম ফুলগুলো কিংবা একটা পাতাও যদি দেখা যায়। দেখলুম মোমবাতির দুটো পোড়া সলতে যেন বাতাস পেয়ে জ্বলে জ্বলে উঠছে। বুঝলুম লুলা আমায় দিকে তাকিয়ে আছে। শুনেছ তো টুপু, লুলা একবার একটা চোরের টুটি ছিঁড়ে দিয়েছিল। ভয় করল আমার। ভুল হবে, মেরুদাঁড়া বেয়ে সাপের ছোবলের থেকেও দ্রুত একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। প্রথমেই মনে পড়ল—মৃত্যু। কী মৃত্যু, কেমন মৃত্যু তাও জানি না। মৃত্যু কথাটাই তো একটা গোটা কথা। তার ধরনধারণ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী। এই আমার অস্তিত্ব রয়েছে, মৃত্যু এল, তারপর আর আমি নেই। এই না-থাকার চিন্তাই তো টুপু পৃথিবীর সবথেকে বড় ভয়। এই ভয় যখন আমি পেলুম তখনই খস খস শব্দ উঠল পিছনে। লুলা সিমেন্টের ওপর হাঁটলে অমন শব্দ হয়। নীচে থেকে উঠে আসতে লুলার পাঁচ সেকেণ্ডও লাগবে না আর আমার ঘরে ছুটে যেতে ওইটুকু সময় দরকার। ছুটতে গিয়ে পড়ে গেলুম। সেই পড়াতেই শরীরের ডান দিকটায় পক্ষাঘাত ধরল। পরে জেনেছিলুম ওটা ছিল শান্তার চটির শব্দ। সে আমার কাছেই আসছিল।

দাদুর থুতনি তুলে ধরল শান্তা। ঝুনো নারকেলের মতো মাথাটা, অল্প কয়েকগাছি চুল। চিরুনি বোলাবার সময় খস খস শব্দ উঠল। বাথরুমের দরজার কাছে চেয়ারটা টেনে শান্তা বলল, এইবার বসে বসে ঝিমোও গে যাও।

চেয়ারে-বসা দাদুকে জোরে ঠেলে দিল শান্তা। সিধে ঘরের মাঝখানে এসে হঠাৎ পুরো একটা পাক খেয়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল চেয়ারটা। ঘরের আর এক কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সুব্রত—দাদুর ছোটোছেলে। মুখ ঘুরিয়ে দাদুকে দেখে সিগারেটটা ফেলে গোড়ালি দিয়ে হেঁতলাল, তারপর তাকাল বাথরুমের বন্ধ দরজাটার দিকে। কী ভেবে এগিয়ে গেল, ইতস্তত করল, তারপর দরজায় টোকা দিল। ভিতর থেকে সাড়া এল না। সুব্রত দরজায় কান পাতল। এতক্ষণে এক বারও সে তাকায়নি দাদুর দিকে। সে যে ঘরে আছে তাও বোধ হয় মনে নেই।

টুপু, আমার চেয়ারের চাকাটা খুব আলগা। শান্তা যখন ঠেলে দিল, সিধে জানলার শার্সিতে ধাক্কা লাগার বদলে হঠাৎ ঘুরে গেল, ঠিক যেমন করে আমার জীবনটাও ঘুরে গেল। বেপরোয়া উদ্ধৃঙ্খল ছিলুম, হঠাৎ পক্ষাঘাতে ডানদিকটা যখন পড়ে গেল তখন এমনি করেই হলদে দেয়ালটার দিকে এগিয়ে আসার মতো ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলুম। কিন্তু এক দিনেই এগোলুম না; তখনও জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলতুম, অর্ধেকটা শরীর নাড়াতে পারতুম, তখনও সবাই ভয় করত, মেনে চলত।

দেখাশুনা করার জন্য তোমার বাবা সুপ্রিয়লোক রাখতে চেয়েছিল, রাখতে দিইনি। শান্তাকেই আমার সেবার ভার দিয়েছিলুম। এর জন্য অবশ্য ওকে বেশি টাকা দিতে হত। তোমার ঠাকুমা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির, তখন আরও শান্ত হয়ে গেছিল, তার কাছে বেশিক্ষণ থাকার দরকার হত না শান্তার। আমরা কথা বলতুম। সাধারণ কথা, কিন্তু নিষ্ফল রাগে জ্বলে মরতুম। একদিন ওকে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে চেয়ার থেকে মুখ থুবড়ে পড়লাম। ব্যথায় কাতরে উঠব কিন্তু থেমে গেলুম শান্তার দিকে তাকিয়ে। মেঝের ওপর পড়ে ছিল আমার মুখ, নীচু থেকে শান্তাকে অদ্ভুত দেখাল। মনে হল শান্তার কাঁধ নেই, মুখটা নেমে এসেছে ওর পেটের মাঝখানে। আমি শিউরে উঠলুম, অথচ আনন্দ পেলুম। শান্তা তাড়াতাড়ি আমায় চেয়ারে বসিয়ে দিল। ধন্যবাদ দিলুম, ও কথা না বলে বেরিয়ে গেল।

রোজ সকালে শান্তা আমায় বারান্দার রোদুরে রেখে যেত। মাঝে মাঝে তোমার ঠাকুমা এসে দাঁড়াত। তাকিয়ে থাকত সে আকাশের দিকে, বাগানের দিকে। বিড়বিড় করে কী যেন বলত আর এধার-ওধার কাকে খুঁজত। একদিন শুনেছিলাম ওর কথা, লুলার খোঁজ করছে। কিন্তু ও একদম ভুলে গেছে যে দিনের বেলা লুলাকে অন্ধকার ঘরে বেঁধে রাখা হয়। টুপু, এই সময়ে বিলেত থেকে ফিরে এল তোমার কাকা সুব্রত। তোমার বাবার মতো অত হিসেবি মানুষ ও নয়। ওর ছোটোবেলা কেটেছে কার্শিয়াঙে মিশনারি বোর্ডিং-এ, কিন্তু কলকাতার অ্যাংলো পাড়ায় বেশিদিন ওর যৌবন কাটাতে দিতে ভরসা পেলুম না। অনেক সুন্দরী বাছাই করে তোমার কাকিমার সঙ্গে ওর বিয়ে দিলুম। বিয়ের এক মাস পরেই ওকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য বিলেত পাঠিয়ে দিই।

সুব্রত ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে শান্তাকে বদলে যেতে দেখলুম। ছোটোবউমা কেঁদে পড়ল ওকে বাড়ি থেকে তাড়াবার নালিশ জানিয়ে। কিন্তু তাড়াতে পারিনি। ভালো করে কথা বলতে পারি না, চলাফেরা করতে পারি না, শরীরটা আমার মরে আসছিল। অথচ তলপেট থেকে লকলকে শিখা উঠে আসত অজস্র ছুঁচলো মাথা নিয়ে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঝাঁঝরা করে দিত। তাতে মনে হত আমি বেঁচে আছি আগের মতো। আর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে শান্তা। ছোটোবউমা তারপরেও নালিশ করেছিল, হিংসে করেছিলুম নিজের ছেলেকে। শান্তাকে তাড়াবার কথা ভাবিনি, সুব্রতকে সরিয়ে দেবার জন্য ছোটোবউমাকে পরামর্শ দিলুম দিল্লিতে তার বাবাকে চিঠি দিতে। দেশে অনেক পাস করা বেকার ইঞ্জিনিয়ার আছে, কিন্তু কী জাদুমন্ত্রে জানি না সুব্রতর শ্বশুর বিলেতের ফেল-করা ইঞ্জিনিয়ার জামাইয়ের জন্য তেরোশো টাকার চাকরি ঠিক করে দিল। সুব্রত পাঞ্জাব চলে গেল বউকে নিয়ে।

খুট করে খুলে গেল বাথরুমের দরজা। সঙ্গে সঙ্গে নতুন ধরানো সিগারেটটাকে থেঁতলে সুব্রত জানলা থেকে ঘুরে দাঁড়াল। ওকে দেখেই শান্তা এক-পা পিছিয়ে মুখে অস্ফুট শব্দ করল। সুব্রত হাসল। ফর্সা চামড়া, লাল ঠোঁট, সাদা সারি দাঁত, ছিপছিপে ছ-ফুট শরীর, হাসলে ওকে সুন্দর দেখায়। এগিয়ে এসে দু-হাত রাখল শান্তার কাঁধে। শান্তা তখনও অবাক, কথা বলতে পারছে না।

কী, খুব অশ্চর্য তো?

শান্তাকে ঝাঁকুনি দিল সুব্রত। শান্তা কাঁধ থেকে হাত ঠেলে নামাবার চেষ্টা করায় সুব্রত আরও জোরে আঁকড়ে ধরল।

কখন এলে।

এইমাত্র, এখনও কারও সঙ্গে দেখা করিনি।

একা এলে?

হ্যাঁ, অনুকে সঙ্গে আনলুম না। অবশ্য তুমি এখানে যখন, বুঝতেই পারছ একা ছেড়ে দিতে চায়নি।

সুব্রত মুখ এগিয়ে আনল। শান্তা মাথা সরিয়ে নিল।

শান্তা, চলো আমার সঙ্গে।

হঠাৎ বলল সুব্রত গলার স্বরটা সর্দি ধরার মতো ঘড়ঘড়ে করে। কথা না বলে শান্তা তাকিয়ে রইল সুব্রতর চোখের দিকে। চোখের মণিটা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায় আর তাই বেঁধে রাখতে লাল শিরাগুলো হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। আবার বলল সুব্রত, চলো শান্তা আমার কাছে। বিশ্রী, বিশ্রী লাগছে অনুকে। একতাল কাদা রোজ যেন আমায় নোংরা করে দেয়। ওকে আমি ডিভোর্স করব, যাবে?

হাসল শান্তা। চোখ বন্ধ করে কী যেন সে ভাবতে শুরু করল। অধৈর্য হয়ে সুব্রত ওর হাত মুচড়ে ধরল।

লাগছে সুব্রত।

না, লাগছে না।

সুব্রত, তুমি এখন টায়ার্ড।

না, টায়ার্ড নই।

তুমি ক-দিন থাকবে?

ক-দিন থাকব সেটা কোনো কথা নয়। শুধু শুধুই হাজার মাইল পথ ভেঙে তোমার এই কথা শুনতে আসিনি। তা ছাড়া তোমার কাছে এলে আমি কেন, আটলান্টিক সাঁতরে-আসা মানুষও নিজেকে তাজা মনে করবে।

দপ দপ করতে থাকে সুব্রতর কপালের দু-পাশ। চোখের কোল ফুলে উঠেছে, গালের পেশি শক্ত। দূরে দাদুর দিকে তাকিয়ে শান্তা বলল, আমার এখনও অনেক কাজ বাকি আছে।

ও-বুড়োর জন্য আবার কাজ কী?

বাঃ, খাওয়াতে হবে না।

খুব দরদ দেখছি যে। খেতে একটু দেরি হলে মরে যাবে না, বুড়োর জান ভীষণ কড়া।

উনি তোমার বাবা।

সুব্রত গোটা শরীরের এমন ভঙ্গি করল যেন বলতে চায়, সে আবার কী! শান্তা মুখ টিপে হাসল। দাদুর কাছে যাবার জন্য সে এগিয়েছে, হ্যাঁচকা টানে তাকে থামিয়ে দিয়ে সুব্রত দাদুর সামনে এসে দাঁড়াল।

নড়তে পার না তাই, মেরেই ফেলতে। তাই না?

সুব্রত দাদুর থুতনির নীচে দুটো আঙুল দিয়ে মুখটা তুলে ধরল।

দাদু চোখ বন্ধ করল। শান্তা হেসে উঠল। সুব্রত ওর দিকে তাকিয়ে রইল। কুটি করে শান্তা বলল, অসভ্যের মতো দেখছ কী, দরজাটা খোলা রয়েছে না?

টুপু, টুপু, আজ সকাল থেকে লুলা ডাকছে। আজ তুমি বাগানে যেয়ো না। হয়তো লুলাকে বেঁধে রাখা হয়নি। হয়তো ওর ঘরের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করা হয়নি। চন্দ্রমল্লিকার গাছগুলো তো ওই দিকেই। হলুদ পাপড়িগুলো যদি তোমায় লোভ দেখায় লুলার এগিয়ে আসা নখের শব্দ যেন না শুনতে হয়। শুনতে পাইনি বারান্দা থেকে ঠাকুমার পড়ে যাওয়ার শব্দ। আমার বুকের ওপর শান্তা তখন হাঁপাচ্ছে। ওর মুখ দিয়ে কেমন একটা শব্দ উঠছিল, ভীষণ ভালো লাগছিল শুনতে। পাথর হয়ে বসেছিলুম, কথা বলিনি। আমার ভালো হাতটা দিয়ে ওকে চুঁইনি পর্যন্ত। ভিজে খড়ের মতো জ্বলছিল শরীরটা, জ্বালা করছিল চোখ। আমি দেখতে পাচ্ছিলুম না বারান্দায় কী ঘটছে। শান্তা তখন চুপিচুপি আমায় বলল, ভালোবাসি। আমার অর্ধেক স্থবির শরীরটাকে ও ভালোবাসে! হাত বাড়ালুম ওকে ধরবার জন্য। শান্তা আমার নাগালের বাইরে সরে গেল। আধমরা ইঁদুরের মতো বার বার বেঁচে উঠতে চাইলাম কিন্তু শান্তা বেড়ালের থাবার থেকেও নিরাসক্ত, নিষ্ঠুর। আমার তেষ্টা পেল, ঢোঁক গিলতে পারলুম না, সে-জোরটুকুও আমার ছিল না। শুধু নড়ে উঠল গলার নলিটা, আর শান্তা আস্তে আস্তে মুখটা এগিয়ে এনে তার ঠোঁট রাখল আমার গলায়। ও যদি তখন দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলত টুটিটা, বেঁচে যেতুম। তিল তিল করে এই পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকার থেকে, বেঁচে যেতুম। কিন্তু শান্তা তা করল না। শুধু বলল, ভালোবাসি। সেই সময়েই লুলা চিৎকার করে উঠল, ঠিক আজকের মতো। মনে পড়ল তোমার ঠাকুমা দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। জানলার দিকে তাকালুম। উঁচু জানলা, লুলা দাঁড়িয়ে উঠেছে গরাদের ফাঁকে থাবা রেখে। জিভ বার করে ও হাঁফাচ্ছে, মনে হল ঠাকুমার শাড়ির লালপাড় থরথর করে কাঁপছে। লুলা ঠোঁট চাটল। নোনতা গন্ধ যেন পেলুম। জানি না কেন পেলুম। কনকনে শীতের দিনে ঠাণ্ডাজলে কাউকে চান করতে দেখলে শীত লাগে, জানি না কেন লাগে। দু-হাতে আমার মুখটাকে ধরে শান্তা আবার বলল, ভালোবাসি। শিউরে উঠলুম ওর চোখ দেখে। শান্তা হাসছিল, মনে হল লুলাও বোধ হয় হাসছে। দেখবার জন্য ঘাড় ফেরাতে গেলুম, পারলুম না। শান্তার টুটি চেপে ধরার জন্য হাত তোলার চেষ্টা করলুম, হাত উঠল না। আমার শরীরের সুস্থ অংশটুকুকেও পঙ্গুতা গ্রাস করল। চিৎকার করে উঠতে চাইলুম, গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। আমার শরীর মরে গেল টুপু।

সকালে বাগানে যখন খুঁজে পেল তোমার ঠাকুমাকে তখন সবাই খোঁজ করল মৃত্যুর কারণ। অনুমান করল নানাজনে নানারকম। পুলিশ তার কর্তব্য করে গেল। শুনলুম ওরা রিপোর্টে লিখেছে—আত্মহত্যা। কিন্তু আমি জানি, এটা হত্যা। রাতে শান্তা ইচ্ছে করে দরজা খুলে রেখেছিল। বারান্দা থেকে এ-বাড়ির বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়, তাই তোমার ঠাকুমা ফাঁক পেলেই বারান্দায় এসে দাঁড়াত। সে-রাতেও ঘরের দরজা খোলা পেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। লুলার কথা ওর মনে ছিল না। ওকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিল লুলা। তোমার ঠাকুমার সুস্থবুদ্ধি বোধ হয় কয়েক মুহূর্তের জন্যই ফিরে এসেছিল, তাই সে বাঁচার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝি না আজও-ঘরে গিয়ে নিজেকে না বাঁচিয়ে কেন বাগানে লাফিয়ে পড়ল। তোমার ঠাকুমা ভুল করেছিল টুপু। মৃত্যু বড়ো ভয়ংকর, এক বার যে এর মুখোমুখি হয়েছে, বেঁচে থাকলেও সে কোনোদিন এই ভয়ংকরের ভয় থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে না। তোমার ঠাকুমা মরে গিয়ে হয়তো বেঁচে গেছে। আমিও ভয়কে দেখেছি। সেকথা আমি বলতে পারিনি। টুপু, মানুষ যেন কথা বলার ক্ষমতা না হারায়। লুলাকে তোমার বাবা মেরে ফেলতে চেয়েছিল, আমি ঘাড়টুকু নেড়েও সম্মতি জানাতে পারিনি। টুপু, মানুষ যেন পঙ্গু না হয়। ভেবেছিলুম শান্তা এরপর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু গেল না। এর একমাত্র কারণ সুপ্রিয়। হ্যাঁ টুপু, তোমার বাবা শান্তাকে চেয়েছিল বাড়িতে রাখতে।

এই দাদু।

চেয়ারের পেছন থেকে টুপু ঝুঁকে পড়ল। দু-হাতে চিবুক ধরে দাদুর মুখটা ঘুরিয়ে আনল। জ্বলজ্বল করে উঠল দাদুর চোখ।

ঘুমোচ্ছিলে? আমি তো ঘুমোচ্ছিলুম, হ্যাঁ সত্যি সত্যি ঘুম! মা বলল, টুপু দুপুর বেলা ঘর থেকে বেরিয়ো না, বাগানে রোদুরে যেয়ো না, দাদুর ঘরে যেয়ো না। তখন জান আমি চুপটি করে জেগে, তখনও ঘুমোইনি। তারপর কী হল জান?

টুপু প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল দাদুর কোলে। দু-চোখ বন্ধ করল দাদু।

টুপু এমনি করে সারাজীবন তুমি থাকো। উঠো না, সরে যেয়ো না। সকাল থেকে এখনও কিছু খাইনি। সুব্রত শান্তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, শান্তা ভুলে গেছে আমার খাওয়ার কথা। আর তো কেউ আসে না, খোঁজ করে না। টুপু তোমার মুখটা আরও কাছে আনো। দুধের গন্ধে আমার ছেলেবেলাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে, প্রথম ছেলে-কোলে তোমার ঠাকুমাকে মনে পড়ে। ছোটোবেলায় তোমার বাবাও এমনি করে আমার কোলে এসে পড়ত। সে হাসত, এখন সুপ্রিয় হাসে না। তাকে চুমু খেলেই মুখে দুধের গন্ধ লেগে থাকত। তখন মদ খেতুম, তবু মনে হত মুখ থেকে দুধের গন্ধটা উঠছে না। বিশ্রী লাগত, তাই আর কোনোদিন ছেলেদের কাছে আসতে দিইনি। কতদিন পরে পাচ্ছি সেই গন্ধ। সুপ্রিয়-সুব্রতকে সেই ছোট্টটি করে দেখতে পাচ্ছি। ওরা ছোটো, ওরা অপরিণত, বোঝে না কোন সর্বনাশ আঁকড়ে ধরছে।

এমনি করে বসে আছ কেন, বারান্দায় নিয়ে যাব?

দাদুর কোল থেকে উঠে পড়ল টুপু। দাদুর চোখের পাতা ঘন ঘন পড়ে। চেয়ারটাকে যখন ঘরের মাঝ পর্যন্ত টেনে আনল তখন ঘরে ঢুকল টুপুর মা। তাকে দেখামাত্র চেয়ার ছেড়ে জড়সড় হয়ে গেল টুপু। ওর পিছনে বড়োবউও বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী ভেবে ফিরে এল।

মা-র নেকলেস যেটা ছোটোবউকে দিয়েছিলেন, আজ দেখলুম শান্তার গলায়। ঠাকুরপোর সঙ্গে কোথায় যেন বেরোল। যখন আমি চেয়েছিলুম দিলেন না। একটা পাজি মেয়েমানুষের গলায় মা-র গয়না দেখলে কেড়ে নেওয়া উচিত নয়?

দশাসই বড়োবউয়ের নাকের ফুটো বড়ো হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে আবার বলল, আপনার ছেলে আমায় শাসিয়েছে জানেন, সে আমায় চাবকাবে বলেছে যদি শান্তার গায়ে হাত দিই। জানি ছেনালটার জন্য ওর খুব দরদ, কিন্তু সতীসাধ্বীর গয়না আমি ওর গায়ে উঠতে দোব না, এই বলে রাখলুম। আপনি তো ভালো করেই জানেন, ও-গয়নায় আমার দাবি সকলের আগে। ঠিক কি না বলুন?

চোখের জল মুছল বড়োবউ। আঁচলে নাক ঝেড়ে এধার-ওধার তাকাল, তারপর চুপিচুপি বলল, ঠাকুরপো ছোটোবউয়ের সব গয়না ওকে দিয়ে দেবে, দেখবেন এই আমি বলে রাখলুম। মা-র সেকেলে ভারী ভারী গয়না, তার দাম কত আজকের দিনে! ওগুলো যদি আমায় দিতেন তাহলে নষ্ট হত না। ঠাকুরপো যদি ওঁর মতো হিসেবি হত তাহলে ছোটোবউয়ের এই সব্বোনাশ ঘটত না।

সদ্য ডিমপাড়া মুরগির মতো বড়োবউ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টুপু বিকেল হয়ে গেল। বাগানে এখন ঠাণ্ডা ছায়া পড়েছে। তুমি কি সেই বোলতাটাকে এখনও খুঁজছ। তোমার খেলার সাথিদের নিয়ে এসো আমার কাছে। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার ঘুম পাচ্ছে টুপু। কখন আসবে, কখন আমায় বারান্দায় নিয়ে যাবে। বেলা পড়ে আসছে, অন্ধকার নেমে আসছে। আর যে কিছু দেখতে পাব না।

বারান্দায় সুপ্রিয় যখন পায়চারি শুরু করেছিল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। যখন আকাশে অর্ধেক তারা দেখা গেল, সে দাদুর ঘরে ঢুকল। আলো জ্বালল না, একেবারে চেয়ারের পাশে চলে গেল সে।

আমি ওকে তাড়াব। শুনছ, আমি ওকে তাড়াব। আর সহ্য করব না। আমার বউ-মেয়ে আছে, আমার বয়স হয়েছে। যতটা ভীতু ভাবে ততটা আমি নই একথা আজ বুঝিয়ে দোব। কী বল, পারব না? তাই করা উচিত নয় কি?

সুপ্রিয় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। শান্তার ঘরের সামনে ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়ল। দরজাটা বন্ধ, পর্দা ঝুলছে দরজার সামনে। সুপ্রিয় হাত বাড়িয়ে পর্দাটা ছোঁয়। হঠাৎ দাঁত দিয়ে পর্দাটাকে ছিড়তে শুরু করে।

টুপু তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ? এখন রাত কত? লুলা বাগানে ডেকে উঠল, ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। লুলা আজ সকাল থেকে ডাকছে। শান্তা এখনও ফেরেনি। ও আজ ফিরবে না। টুপু, তোমার বাবাকে দেখে সত্যি দুঃখু পাই। হয়তো সুপ্রিয় একদিন আত্মহত্যা করবে তবু শান্তাকে পাবে না, তাকে আমিও পাইনি। সুপ্রিয় স্বেচ্ছায় মরতে চায় কীসের জ্বালায়? এটা কি ওর স্বভাব? সুব্রত জানে সে একদিন মরবেই, তাই ভয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই দিনটার কথা ভেবে।

টুপু, শান্তা যদি আর না ফেরে, তাহলে আমি সেরে উঠব কি? যদি তাই হয় খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হবে, তাই না? শান্তা যেন আর না ফেরে। তুমি আর আমি শুধু থাকব, থাকবে বাগানটা আকাশটা, আর মাঝে মাঝে বোলতা কিংবা ফড়িং।

সিঁড়ি দিয়ে কে যেন উঠছে টুপু। শান্তা কি চটি পরে বেরিয়েছিল? কিন্তু শান্তা হবে কেন, সে তো আজ রাতে ফিরবে না। তাহলে কি লুলা? রাত্রে ও সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। বারান্দায় এসে মাথা নীচু করে কী যেন শোঁকে, জানলায় পা রেখে ঘরের মধ্যে তাকায়, চলে যাবার আগে দরজা আঁচড়ায়। টুপু, আমার ঘরের দরজাটা বোধ হয় খোলা। এ ঘরে শেষ এসেছিল সুপ্রিয়। সে চলে গেল শান্তার কথা ভাবতে ভাবতে। বন্ধ করে গেছে কি দরজাটা? কিন্তু বন্ধ করবে কেন, ওর কি তখন মনে ছিল লুলার কথা, তার মা-র কথা?

টুপু শব্দটা সিঁড়ি থেকে বারান্দায় উঠে এল যে! ওখান থেকে ঘরের দরজায় আসতে কতক্ষণ লাগবে? না, তার আগে জানলা দিয়ে দেখবে। অন্ধকার ঘরে চোখ সইয়ে নিতে দেরি হবে ওর। কত দেরি হবে? লুলা আসছে। শীতে-ফাটা চামড়া চুলকোনোর মতো ওর নখের শব্দটা এগিয়ে আসছে। জানলায় শব্দ হল কেন? তোমার ঠাকুমার ঘোমটার লালপাড়ে চুলের তেল লেগে বাসি রক্তের রং ধরত, লুলার জিভে কী লালপাড় জড়িয়ে আছে? কেউ এসে বন্ধ করে দেবে না এখন দরজাটা। আমাকেই বন্ধ করতে হবে, আমায় উঠতে হবে, আমায় বাঁচতে হবে। ওই ঝকঝকে বাঁকানো দাঁত, ফাঁকে ফাঁকে পচা মাংসের গন্ধ, ঠোঁট আর মাড়ির ভাঁজে জমে উঠছে লালা, আর তাই চেটে নেবার শব্দ। আমায় উঠতে হবে, দরজা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু আমার ক্ষমতা কই টুপু!

কিন্তু আমার রক্ত কেমন ছুটতে শুরু করেছে। আগুনের স্রোত যেন পুরোনো শিরার ময়লা–গুলোকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ঠেলে নামছে। হালকা হয়ে যাচ্ছি। টুপু, আমি ভোরের অন্ধকারের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছি। আমার হাত কাঁপছে, শরীর কাঁপছে। হঠাৎ এ কী হল আমার! তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছি কেন! টুপু, মনে হচ্ছে আমি বাঁচব, সুস্থ হয়ে বাঁচব। আমি মরতে চাই না। ইচ্ছে করছে এখন তোমার ঠাকুমাকে দেখতে, তার গায়ে হাত রেখে কথা বলতে, হাসাতে, রাগাতে। আমার দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে এখন বাগানে বেড়াতে চাই টুপু। দরজার কাছে খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর একদিন শুনেছিলুম, সেদিন লুলা ভেবে ভুল করেছিলুম। আঃ, এখন ওই শব্দটা যদি শান্তার চটির হয়! আমি বেঁচে যাব টুপু, আমি বেঁচে যাব।

হঠাৎ খুলে গেল দরজাটা। জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে লুলা গুঁড়ি মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকল। থমকে পিছিয়ে এল। চাপা স্বরে গরগর করে উঠল। সে এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। চেয়ারে বসা জমাট মূর্তিটা দূলে উঠেছে। লুলা আরও এগিয়ে এল। ওর পিঠের রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠেছে। কাঁপতে কাঁপতে দুটো হাত সামনে এগোল। ওদের ব্যবধান কমে আসছে।

হঠাৎ বিকট স্বরে দু-বার ডেকে উঠল লুলা। কুড়লের প্রচন্ড এক ঘায়ে যেন জমাট মূর্তিটা ভেঙে পড়ল চেয়ারে। লুলা এগিয়ে এসে শুকল ঝুলে-পড়া নিস্পন্দ হাতটা। শুকতে শুকতে হাত বেয়ে উঠে এল তার মুখ। গলার কাছে থমকে গেল তার দাঁত আর টুটির উপর কেঁপে উঠল নাক। লালা গড়িয়ে পড়ল কষ বেয়ে। আর টুটির ওপর থেকে চোখ বুজে তাই চাটতে চাটতে সুখে গরগর করে উঠল লুলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *