জ্যোতির্ময়ী গুহ

জ্যোতির্ময়ী গুহ

গত কয়েকদিন ধরেই অদ্ভুত ফোন আসছে। ভুতুড়ে ফোন। কে একজন বিনা ভূমিকায় জিজ্ঞেস করেন, জুতির্ময়ী গুহা বলে কাউকে চিনেন? ভাষা এবং গলার টোন থেকে বোঝা যায় ভদ্রলোক বাঙালি নয়, কিন্তু বাংলা বলতে পারেন। জুতির্ময়ী গুহা বলে কারুকে চিনেন? ভোর সাড়ে ছটায়, রাত আটটায় অফিস থেকে ফিরে সবে জিরোতে বসেছি তখন, কখনও আবার রাত দশটায়, খেয়ে উঠেছি হয়তো, ছেলে এসে বলল, বাবা তোমার ফোন। সেই এক কথা, এক প্রশ্ন। একদিন সব সীমা ছাড়িয়ে গেল। রাত সাড়ে বারোটায়—ঝনঝন ঝনঝন ভয়ে আঁতকে উঠেছি। ধর ফোন ধর। কোত্থেকে আবার কী সংবাদ এল রে বাবা। শাশুডি হার্টের রোগী। শ্বশুরের হাইপ্রেশার। শেষ মামাটি আজ তিনমাস হল। কিডনির রোগে শয্যাগত। যে কোনো জায়গা থেকেই ফোন আসতে পারে। তোক করে উঠেছি। নিজের বুকের দবদবানি নিজেই শুনতে পাচ্ছি।

হ্যালো।

সুরঞ্জনবাবু!

হ্যাঁ, বলছি।

জুতির্ময়ী গুহাকে চিনেন? …

একে ভুতুড়ে ফোন ছাড়া কী বলব বলুন তো।

প্রায় তেড়ে উঠি ঘুমে ভারী গলায়।

কী ভেবেছেন বলুন তো! কে আপনি? বারবার এক কথা। কতবার আপনাকে বলব জ্যোতির্ময়ী-ফয়ী কাউকে আমি চিনি না।

কিন্তু উনি যে বলছেন উনি আপনাকে চিনেন! অনেক কষ্ট করে আপনার ফোন নোম্বার বার করেছি। সারা টেলিফোন গাইডে আর কুনও সুরোঞ্জন করচৌধুরী নাই। কোতবার নোম্বর পালটেছে, ওয়ান-নাইন ফাইভ ওয়ান ফোন করে করে… উনি বলছেন উনি আপনার ভাঞ্জা।

মানে?

সরি? উনি বলছেন আপনি উনার ভাইপো।

মানে উনি আমার পিসিমা? সরি আমার কোনো পিসিমা নেই। জ্যোতির্ময়ী গুহ বলে তো কেউ নয়ই, আর আমাকে বিরক্ত করবেন না ফর গডস সেক।

ফর গডস সেক আপনি একবার আসুন। একজন লেডির শেষ ইচ্ছা। তিনি আপনার আন্ট নোন কি না জানি না, কিন্তু কারু না কারুর আন্ট তো বোটে। বোলছেন যোখন। …

কী অদ্ভুত যুক্তি!

কিন্তু শুনতে পেলাম আমি বলছি, সম্ভবত হাল ছেড়ে দিয়ে, অল রাইট, বলুন আপনার ঠিকানা।

তিন বাই এক গুরুসোদয় দত্ত রোড। বালিগঞ্জ। …

আমি একেবারে আপাদমস্তক চমকে উঠেছি।

একটা সময় পর্যন্ত, সম্ভবত বারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনের এক গুরুসদয় দত্ত রোড ছিল আমারই, আমাদেরই ঠিকানা। সে এক বিশাল বাড়ি। বেশ কয়েক পুরুষের বাড়বৃদ্ধি চিন্তা করে তৈরি করা। ঠাকুরদা তিন ভাই। প্রত্যেকেরই যথেষ্ট পরিমাণ ছেলেমেয়ে। মেজো ঠাকুরদার ছেলে আমার বাবারা তিন ভাই এক বোন। একটা সময় এল যখন ওই বিশাল বাড়ি মেরামত করবার সাধ্য বাবাদের রইল না। দুই প্রজন্মের যে তফাত সেটাও বেশ বড়ো হয়ে দেখা দিল। তখনই সর্বসম্মতিক্রমে ওই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এ ঘটনা আমার বারো বছর বয়সের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা। শুধু আমরা কেন, শুনেছি বাড়ি বিক্রির বছর দুই পরেই হার্ট অ্যাটাকে একজন, সেরিব্রাল অ্যাটাকে একজন, আমার দুই ঠাকুরদা গত হন। বাকি দুজন আগেই গিয়েছিলেন। বেশি কথা কি আমার বাবার নিজের বোনই শকে মারা যান। হঠাৎ স্ট্রোক। পিসিমার আমি এবং আমার পিসিমা বড়োই প্রিয় সে সময়টায়। সারা দিনমান তাঁর রান্নাঘরেই কাটত। ওরই মধ্যে সুরোর জন্য ভালো জিনিসটা, পছন্দের জিনিসটা তুলে রাখা ওঁর বাতিক ছিল। তাতে অশান্তিও কম হত না। কেন না আমার আর এক ভাই ও এক বোন ছিল।

কোথায় গেল সে-সব দিন, সে-সব রাত। সেসব মানঅভিমান, রাগারাগি। ছড়িয়ে পড়েছি সবাই এখানে ওখানে সেখানে। আমার নিজের ভাই সুজন মারা গেছে, বোন থাকে দিল্লির উপকণ্ঠে। বাবার দুই ভাই, অর্থাৎ দুই জ্যাঠা কবে গত হয়েছে। বাবা-মা গেছেনই। অন্য ঠাকুর্দাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একেবারেই ছিন্ন। যখন সবাই এক ছাদের তলায় ছিলুম তখন সম্পর্ক জ্যান্ত ছিল। ভাই বোন! এক একজনের বিয়েতে কী ঘটা! কী মজা! কে এখন কোন কোণে বাসা বেঁধেছে জানি না। জানতে খুব একটা উৎসাহও নেই! আর! নিজেই অবসর নিলুম এ বছর, কে আর ঠিকানা মনে রাখে। এমত অবস্থায় জ্যোতির্ময়ী গুহ, পিসিমা আবার তিনের এক গুরুসদয়ের প্রাচীন ভিটেয় আবিভূর্ত হলেন? আমি তাঁর ভাইপো? বলছেন একজন অবাঙালি? ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে তো!

আমরা থাকি স্টেশন রোড, চন্দননগর। গুরুসদয়ের বাড়ি বিক্রি হয়ে যাবার পর আমরা চলে যাই দমদম। ভাই সুজন বড়োসড়ো ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিল, অবধারিতভাবে চলে গেল সব পথ এসে মিলে গেল শেষে যেখানে সেই মেন্টিং পট আমেরিকা মহাদেশে। সেখানে ওয়াশিংটনের এক রাস্তায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে। বিয়ে হয়নি, ভাগ্যিস! এ ঘটনার জের আমরা কেউ কাটাতে পারিনি। মা মারা গেলেন দু বছরের মধ্যে। বাবা তাড়াতাড়ি বোনের বিয়ে দিয়েদিলেন। দমদমের বাড়ি বিক্রি করে চলে এলুম শ্বশুরবাড়ির দেশ চন্দননগরে, নিরিবিলিতে। তা এখন, দমদমও যা চন্দননগরও তা। বাবা যদ্দিন ছিলেন তদ্দিন অবশ্য শান্ত, সুন্দর স্ট্র্যান্ড, ফরাসি স্থাপত্যের সৌন্দর্য এ সবের মধ্যে দিয়ে একটা চলনসই শান্তি পেয়েছিলেন।

কত বছর কেটে গেল চন্দননগর যাতায়াত করছি। উলটো মুখে যাই বলে ট্রেনের অফিস-টাইম-ভিড় খুব একটা পাইনি। অ্যাম্বিশন ছিল না, বর্ধমান ট্রেজারি অফিসেই কাটিয়ে দিলুম সারা জীবন। নোংরা ঘিঞ্জি অফিস, ফাইলে ফাইলে ধুলোয় ধুলোয় একেক্কার। নিজের ঘরটুকুর আবডাল সরলেই নরক। তবু ওখান থেকে নড়িনি। ভাইয়ের উচ্চাকাঙক্ষার কথা মনে পড়ত, বিদেশ-বিভুঁইয়ে একলা-একলা মর্মান্তিক মৃত্যু। বেশ আছি, তা ছাড়া সুজনের ক্যালিই কি আমার কোনো দিন ছিল?

ঠিক করি, আর দেরি নয়। পরদিন সম্ভব হল না। কিন্তু তার পরদিনই কলকাতাগামী লোকালে চড়ে বসলুম। কে এই জ্যোতির্ময়ী গুহ? কোন ঠাকুর্দার বংশের? নাকি পিসতুতো, মাসতুতো, মামাতো! এঁদের সবার কবেই বিয়ে থা হয়ে গেছে, কত দুরে এখন তাঁদের ফ্যামিলি! বৎসরান্তে একবারও দেখা হয় না, মনেও পড়ে না। এক পিসিমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার স্কুলে ফাইনাল ইয়ার। দমদম থেকে কদমতলায় তাঁদের বাড়ি যেতে যেতেই দিন কাবার। বেলাবেলি ফিরে আসা হয়েছিল।

ভেতর ভেতর একটা প্রবল উত্তেজনা হচ্ছে। পিসিমা বলে নয়, গুরুসদয় বলে। যতদূর মনে পড়ে কোনো সেনগুপ্তরা বাড়িটা কিনেছিলেন। খুব না হলেও বেশ ধনী। অত বড়ো পাঁচ কাঠার ওপর তিনতলা বাড়ি, তার ওপর তিন চার কাঠার বাগান, কিনতে তো পেরেছিলেন! না সারিয়ে ও বাড়িতে আর থাকাও যেত না। বাবার মুখেই শুনেছি—আগেকার দিনের সব পঙ্খের দেয়াল। তাতে বড়ো বড়ো জায়গা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, কড়িকাঠে ঘুণ, যখন তখন চুনবালির চাঙড় খসে পড়ত। ছাদ লিক করা শত চেষ্টাতেও বন্ধ করা যায়নি। মেঝেতে জায়গায় জায়গায় বড়ো ফাটল। জ্যাঠা বলতেন, মেটিরিয়াল ভালো দ্যায়নি আর কি! ঠাকুরদা তাড়াহুড়ো করে বন্ধুর ছেলেকে দিয়ে করালেন। দেখলেন না শুনলেন না

ট্রেনের ফাঁকা কামরায় বসে আকাশপাতাল ভাবি। সেনগুপ্ত তো বাঙালিই হয়। বড়োজোর পূর্ববঙ্গ। কারু না কারুর আন্ট তো বটেই…। পরিষ্কার অবাঙালি টান ও উচ্চারণ। যেসব বিহারি, উত্তরপ্রদেশীয়, পাঞ্জাবিরা দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে বাস করতে করতে ভাষাটাকে গলায় তুলে নিয়েছেন, কিন্তু মিড় গমক রপ্ত হয়নি তাঁদেরই মতো। তবে বাড়িটা আবার হাত বদল হয়ে গেল? অতখানি জায়গা। বহুতল উঠতেই পারে। ভাবতে বুকের ভেতরটা কেমন টনটন করে উঠল! অভিমানেই হয়তো, এই এতদিনেও ও দিকে যাইনি। সেই বিশাল বিশাল উঁচু সিলিংয়ের ঘর, লম্বা ডাঁটির পাখা, চুন বালি খসা দেয়াল, লাল সবুজ পেটেন্ট স্টোনের মেঝেতে জায়গায় জায়গায় ফাটল, চওড়া দালান, বিরাট খাবার টেবিল, তার ওপর গামছার নেট টাঙিয়ে আমরা পিংপং খেলতুম! গাড়ি বারান্দার ধারগুলোয় কত গাছ! বারোমেসে ফুল, মরশুমি ফুল… কে যে যত্ন করত আজও জানি না। আমার চন্দননগরের বাড়ির টবে সেসব ফুল কিছুতেই ফোঁটাতে পারিনি। সপ্তমুখী জবা কুঁড়ি হয়ে হয়েই ঝরে যায়। জুইয়ের লতাটাই ফনফন করে বাড়ছে, দু চারটে ফুল ফুটতে না ফুটতেই শেষ। আমার স্ত্রী বলে, দূর, তার চেয়ে তুমি নয়নতারা আর বোম ফুল লাগাও। বলব কি! তাও আমার ভাগ্যে থাকে না। থাকবে কী করে? শিখিনি তো কী করে রাখতে হয়। চারা পুঁতে দু-চারদিন একটু দেখাশোনা করেই খালাস।

গুরুসদয়ের সেই চুন বালি খসা বালির মেজাজই আলাদা। যেন ইংরেজ বিতাড়িত ওয়াজেদ আলি শাহ মেটিয়াবুরুজে এসে উঠেছেন। আমাদের কখনও মনে হয়নি বাড়িটা বাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। বড়োরাই এসব ভাবতেন। দালানের বাঁকে, বারান্দার কোণে, ছাদের পাঁচিলে, এ কাকার খাটের তলায়, ও ঠাকুমার আলমারির পেছনে আমাদের জন্যে কত যে হেমেন্দ্রকুমার রায়, ঘনাদা, শার্লক হোমস, জিম করবেট ওত পেতে থাকত! সিলিং থেকে দেয়ালের খসা ছালচামড়ার ছোপছাপে, মেঝের ফাটলে আমাদের জন্যে রহস্য ঝুলে থাকত, স্বপ্ন উঁচিয়ে থাকত! সেই গুরুসদয় ফ্ল্যাটবাড়ি? কৃপণ বারান্দা, কৃপণতর রান্নাঘর, বাথরুম, হয়তো আজকালকার কেতার ড্রয়িং ডাইনিং একত্রে করতে গিয়ে ঘরগুলো দশ বাই দশ। তারপরেই একটু আশা জাগে ওখানে রইস লোকেরাই থাকবেন। তাঁদের অন্তত ষোলো বাই ষোলো চাই। বারান্দার কৃপণতাও তাঁদের পছন্দ হবার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে তাঁরা বারান্দায় বসে সান্ধ্য চুমুকগুলো দেবেন কী করে? রান্নাঘরে অত গ্যাজেটসই বা ধরবে কেন?

এই সব ছাইপাঁশের সঙ্গে সঙ্গে তুতো ভাইবোনেদের ছোটোবেলাকার মুখ মনে পড়ে। স্মৃতিতে সবাই সার দিয়ে দাঁড়ায়। এই দেখছি, এই উধাও, যেন ভোজবাজি। আমাদের এখনকার বয়সের চেয়ে অনেক ছোটো মা বাবা কাকা কাকিমা জ্যাঠা জেঠিমাদেরও দেখতে পাই। পিসিমার মুখ মনে পড়ে। এখন ভেবে দেখতে গেলে এঁরা অনেকেই যুবক যুবতিই ছিলেন। কিন্তু আমরা সবসময় তাঁদের বড়ো অর্থাৎ বয়স্ক ভেবে এসেছি। এখন আমরা বুড়ো হতে ভয় পাই, কিন্তু তখন ঠাকুরদার শুকনো গাল, ঠাকুরমার ফোকলা হাসি—এসব কী ভালো লাগত! অদ্ভুত!

ট্যাক্সি ড্রাইভারকে থামতে বলি। অন্তত বছর কুড়ি এদিকে আসিনি। সব কেমন বদলে গেছে। অত চওড়া রাস্তাটাকে সরু লাগছে। একটা বিরাট ভ্যাটের ওপর চারপাশে জঞ্জালের স্থূপ। দুর্গন্ধ ঢিবির ওপরে কুকুর বেড়ালের মোচ্ছ। এবার আমাকে নেমে খুঁজতে হবে। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে সুতরাং হাঁটতে থাকি। এবং হঠাৎ-ই চোখে পড়ে যায় গুরুসদয় দত্ত রোড। চিনতে পারিনি, তবু চিনেছিলাম। এ যে কী রকম অনুভূতি আমি বলে বোঝাতে পারব না। সেই একই গাড়ি বারান্দা। কিন্তু এখন বাহারি গ্রীলে ঢাকা সবটা। ওপরে লাল মতো দেখতে ঢালু ছাদ। সদর দরজা আগাগোড়া ঝকঝকে পালিশ। সেই বাড়ি কিন্তু পুরো সাদা ধবধবে, স্নো হোয়াইটের দেশ থেকে বুঝি উঠে এসেছে। নিয়মিত এ বাড়ির রং ফেরানো হয় নিশ্চয়, এতটুকু বৃষ্টির শ্যাওলা পর্যন্ত নেই। আগাগোড়া রইস, শুধু রইসই নয়, আরও কিছু। কোথা থেকে যে নেমে এসেছে? স্বর্গ থেকে? না স্বপ্ন থেকে?

সামনে দাঁড়িয়ে দারোয়ান। তাকে ছোটো টুকরো কাগজে নিজের নাম লিখে দিতে হল। সে সেটাকে চালান করল ভেতরে অন্য হাতে। পাঁচ মিনিট… ছ মিনিট… তারপরেই সেলাম করে দরজা খুলে দিল দারোয়ান। আমি আমাদের সেই পুরোনো চওড়া গলিপথের মধ্যে ঢুকলুম আটচল্লিশ বছর পরে।

মাথাটা এরা ঢেকেছে। জায়গায় জায়গায় কাচের মতো বড়ো বড়ো ফাইবারের চতুর্ভুজ। মধ্য দিনের আলো মৃদুতর হয়ে ঢুকছে গলিটায়। নানারকম কুচো পাথর দিয়ে তলাটা বাঁধানো। লোকটি আমাকে প্রথম দরজা ছাড়িয়ে দ্বিতীয় দরজার দিকে নিয়ে গেল। আমি জানি এটা অন্দরের দরজা। অর্থাৎ বৈঠকখানা, বড়ো জেঠুর ল লাইব্রেরি, হলঘর এগুলো আমার দেখা হবে না। ঢুকি ভেতর মহলের ঢাকা দালানে। সমস্ত একই আছে তবু বদলে গেছে। লাল সিমেন্টের জায়গায় গোলাপি আভার নিষ্কলঙ্ক শ্বেতপাথর। দূরে দূরে একটা করে ছোট্ট কালো রুইতন। সিঁড়িটার ধাপ এখন অনেক নীচু নীচু। আকারটা পালটে গেছে। দুটো মোচড় দিয়ে উঠেছে সিঁড়িটা। একই রকম মার্বেলের। পাশের রেলিং-এর ওপরের পাত ঝকঝকে পেতলের।

এই সিঁড়ির তলায়, সাদা ধবধবে ধুতি আর মেরজাই পরে ততোধিক ধবধবে, প্রায়-গোলাপি মার্বেলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া গাত্রবর্ণের প্রশান্ত চেহারার এক বৃদ্ধ। একটু মোটা। চুলগুলো যেটুকু আছে ধবধবে, বাকিটুকু টাক।

বললেন, আসেন সুরোঞ্জনবাবু। আমি ভীষ্ম বরজাতিয়া।

হাতজোড়, মুখে প্রশান্ত হাসি। হাসির উলটো পিঠে যেন একটা আশ্চর্য বিষণ্ণ গাম্ভীর্য।

ভীষ্মনাথ না বিশ্বনাথ প্রথমটা আমি বুঝতে পারিনি। পরে খেয়াল হল ভীষ্মর মটা উনি উচ্চারণ করেছিলেন। জীবনে প্রথম শুনলাম এই নাম।

সিঁড়ি বেয়ে উঠি। উনি ওঠেন অবলীলায় ধুতি পরে, আমি উঠি হোঁচট খেতে খেতে ট্রাউজার্স পরে। কেননা আমার পায়ে এখন আটচল্লিশ বছর আগেকার ছন্দ। সিঁড়িটা বদলে যাওয়ায় সেই অভ্যাস ধাক্কা খাচ্ছে। ছন্দভঙ্গ হচ্ছে।

ওপরে উঠি। বেশ কিছু ধবধবে মহিলা ও পুরুষ শান্ত কৌতূহলের দৃষ্টিতে আমাকে দেখেন। কেউই ঠিক যুবা বয়সের নয়। মহিলারা সাদা জমির ওপর লেসের পাড় দেওয়া শাড়ি সামনে আঁচল করে পরেছেন, কোমরে রুপোর চাবির গোছা, পরিষ্কার চুল আঁচড়ে বাঁধা। পুরুষরা পরেছে একই রকমের ধুতি ও মেরজাই।

দোতলায় উঠে আর নিজের বাড়ি চিনতে পারি না। এঁরা বোধহয় ঘরের মাঝের দেওয়ালগুলো ভেঙে একেবারে রিমডেল করে নিয়েছেন সব। ঘরের মধ্যে দিয়ে ঘর তার মধ্যে দিয়ে দালান, তারপরে আবার ঘর… যেন গোলকধাঁধা। কোনোটাই শোবার ঘর না। উঁচু তক্তপোশে গদির বিছানা, পাশে তাকিয়া… সম্ভবত কাজের জন্য। পেতলের পিকদান। ফাইল ক্যাবিনেট। ছোটো টেবিল সেক্রেটারিয়েট টেবিল। এই ভাবেই অবশেষে যে ঘরে এসে পৌঁছেই সেটা বোধহয় এঁদের অন্দরের বসার ঘর। দেয়ালে দেয়ালে পৌরাণিক কাহিনির ছবি সব। ভীষ্মনাথ খুব খাতির করে আমাকে একটি দোলনায় বসালেন। অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি ট্রেতে লম্বা সাদা পাথরের গ্লাসে পানীয় এল। ভীষ্মনাথ একটি গ্লাস আমার হাতে তুলে দিলেন, আর একটি নিজে নিলেন। বললেন, পিজিয়ে, খান।

দরকার ছিল না।–আমি বলি, আমি এ সময়ে…

এখোন আপনার লাঞ্চ টাইম এঁরা জানেন,–আশেপাশে মহিলাদের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।

মহিলারা নিঃশব্দে নমস্কার করলেন।

আমি কী বলব ভেবে পাই না। এঁরা জানেন মানে কী? মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন হচ্ছে না কি? সর্বনাশ! চিনি না জানি না। আর যাঁর নিবন্ধে আমার আসা সেই জ্যোতির্ময়ী গুহ কোথায়? তাঁকে দেখব এবং দেখা দেব বলেই তো ছুটে এসেছি। যতটা না এই অচেনা মহিলার টানে, তার চেয়েও বেশি রহস্যের টানে। এখনও আমার মনে হচ্ছে একটা রূপকথার মতো কিছুর মধ্যে ঢুকে পড়েছি।

ভীষ্মনাথ যেন আমার মনের কথা পড়তে পারলেন, বললেন, শরবতটা পিয়ে নিন, অনেক দূর থেকে আসা হচ্ছে তো!

কী করি! শরবতটা পিয়েই নিই। ভারি সুন্দর, সুস্বাদু, তবে একটু গুরুপাকও বটে! এই সব হজম করে করেই বোধহয় এঁদের এমন চিকন গোলাপি চেহারা। তা ওঁর থেকে আমার পানের স্পিড ছিল অনেক বেশি, কেননা শরবতের চেয়ে জ্যোতির্ময়ীতেই আমার আগ্রহ বেশি। উনি একবার শান্ত সুরে বললেন, ধীর সে, ধীর সে…।

আমি বলি, উনি কোথায়?

কে? আপনার আন্ট?

না, মানে জ্যোতির্ময়ী গুহ।

হচ্ছে চলুন।

একটা নাতিবৃহৎ ঢাকা দালান পার হতে হল। দু-একজন মহিলা নিঃশব্দে সরে গেলেন। হয়তো কৌতূহল ছিল, কিন্তু আমার অস্বস্তি লাগবে ভেবে। তারপর যে ঘরটাতে ঢুকলুম সেটার আপাদমস্তক আমার চেনা। যদিও তার ছালচামড়া ছাড়িয়ে আইভরি প্লাস্টিক পেইন্ট আর মাৰ্বল, যদিও জানলাগুলোয় রঙের বদলে মেহগনি পালিশ। কিন্তু সেই প্রিয় খড়খড়ি, লম্বা লম্বা গরাদ দেওয়া প্রায় দরজার মতো লম্বা লম্বা জানলা। লম্বালম্বি ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড ঝুলছে সেগুলো থেকে। এখন আড় করা হয়েছে, মেঝেতে তাই আলো ছায়া। সে আলোর আলোও খুব সুন্দর। সে ছায়ার ছায়াও যেন অলৌকিক। এবং বড়ো ঠাকুমার সেই ঘরে, বড়ো ঠাকুমারই উঁচু পালঙ্কের ওপরে সাদা ধবধবে মোটা বিছানায় শুয়ে রয়েছেন একজন। এঁদেরই মতো ধবধবে বৃদ্ধা। তাঁর অনেক বয়স। শুষ্ক কুঞ্চিত দেহ, ছোটো করে ছাঁটা সামান্য রুপোলি চুল। তা সত্ত্বেও আমার চিনতে কোনো অসুবিধে হল না ইনি আমার নিজস্ব, একেবারে বাবার সহোদরা পিসিমা যিনি আমার বারো বছর বয়সে মারা গেছেন। বিস্ময়ের ধাক্কায় প্রথমটা কথা বলতে পারিনি, তারপর কোথা থেকে যে আমার মধ্যে থেকে পিসিমার বারো বছরের পুরো উঠে এল আমি জানি না। চারপাশের সমস্ত অপরিচিত লোক, অপরিচিত পরিবেশ, আমার বয়স, পিসিমার বয়স সব বিস্মৃত হয়ে আমি পালঙ্কের দিকে প্রায় ছুটে গেলুম, দু-হাত বাড়িয়ে বললুম, পিসিমা। আমার চোখ টনটন করছিল।

ক্ষীণকণ্ঠে উনি বললেন, চিনতে পেরেছিস তাহলে?

তুমি কী করে—এখানে… আমার… আমি কোনো কথা কোনো অনুভূতিকেই রূপ দিতে পারি না।

ভেবেছিলি মরে নিশ্চিন্দি হয়ে গেছি, না রে? …

আমি কিছু বলতে পারি না।

ভীষ্ম বরজাতিয়া কেমন একরকম দুঃখের হাসি হেসে বললেন, ভাইয়া, আপনাকে একটা কাহানি সুনাই। এই যে দেখছেন সুরিয়মহল, জানেন একসময়ে এ ছিল করচৌধুরীদের হাতে। তাঁরা এটা বেচে দ্যান সেনগুপ্তদের। সেনগুপ্তরা এসে শুনতে পান এ বাড়িতে আতমা আছে, তো তাঁরা মাস ছয়েক পরেই বাড়িটা বেচে দ্যান আমাদের, বরজাতিয়াদের। সোস্তায় পেয়ে যাই।

আমি বরজাতিয়াদের বোড়ো ভাই, আতমা ভয় করি না। সুনা ছিল ছায়া দেখা যায় এ বাড়িতে, রাতের বেলা ঘোরে, দীপ জ্বালে, আবার নিভায়। আমি খুঁজতে খুঁজতে এই ভাঙা বাড়ির গুদাম ঘরে পুরোনো কাঠ, টিন, বোরাউরা, আরও কোতো জঞ্জালের মধ্যে উনাকে খুঁজে পাই। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বললেন, ভাইজি, এ আমার বাস্তুভিটা, বাপ-পিতামহ, আমি, আমার ভাইবোনেরা, ভাইপো-ভাইঝিরা সোব এখানে জন্ম নিয়েছি, কোলোজন মারা গেছেন, এখানে আমার বিয়ে হল, বেওয়া হয়ে দুই বছরের মধ্যে এখানেই ফিরে এলাম। কোলোজনকে মানুষ করেছি, ভাইপো-ভাইঝিদের, বোনপো-বোনঝিদের, এঁদের সোংসার সামহাল দিয়েছি, এই ভিটা বই কিছু জানি না, চিনি না। ওরা সব বেচেবুচে দিল, আমাকেও তো তাহলে বেচেই দিল, না কী? তাই আমি এখানে মাটি কামড়ে রয়েছি। আপনাদেরও সোংসার সামলাবো, আমাকে… দাসী রাখুন। ভাইয়া পুরা ছয় মাস উনি এখানে লুকিয়ে ছিলেন। গুদাম ঘরে চাল-ডাল-আলু-কেরোসিন লুকিয়ে রাখতেন। খিড়কির দরজার ডুপ্লিকেট চাবি ওঁর কাছে ছিল। সাঁঝ ঘন হলে কনও কনও দিন ঘরে ঘরে ঘুরতেন, ছাদে যেতেন, কখনও কখুনও বাইরে ভি। ভাইসাব আমি তোখন বুঝে নিলুম কি ইনিই এ সূরিয়মহলের সুরিয়। তাই আমরা ওঁকে আদর করে রেখেছি। এতদিন ওঁরই কাছে বাংলা শিখলাম, কোতো কী জানলাম। কিন্তু কুনও দিন উনি ভাই-বহেন, ভাঞ্জা-ভাঞ্জি কারু খোঁজ তো কোরেননি। আজ এতদিন পর উনার নব্বই পার হল উনি সুরোঞ্জন করচৌধুরীর তালাশ করছেন… তাই…

পিসিমার শুকনো হাতে আমি হাত বুলিয়ে দিতে থাকি, চোখ দিয়ে জল ঝরছে, উনি দ্বিগুণ মমতায় আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দ্যান। হাতগুলো এতকাল পরেও সেই একই রকম তুলতুলে, সুখস্পর্শ আছে।

ওরা তোদের বুঝিয়েছিল আমি মরে গেছি। না রে?

নব্বই বছরের পিসিমার কণ্ঠ ক্ষীণ হলেও আশ্চর্য স্পষ্ট।

আমি কিছু বলি না। ভেতরে ভেতরে একটা কষ্ট, একটা ক্ষোভ জমা হতে থাকে।

আর কী-ই বা বলবে বল! যাবার সময়ে আমাকে খুঁজে পেল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে রে সুরো। কেলেঙ্কারির ভয়ে খালি থানাপুলিশ, ছবিছাবাটাই করেনি। তারপর মানুষের আর কী বলবার থাকে বল!

হঠাৎ দেখি ভারে ভারে খাবার আসছে। কয়েকজন নীরব মহিলা নিশ্ৰুপে একটা টেবিল বসিয়ে দিয়ে গেলেন, ভীষ্মনাথ একটা চেয়ারে। খাটের দিকে মুখ ফেরানো চেয়ারের।

ভীষ্ম বললেন, দুপুর হল। লাঞ্চের সময়। খেয়ে নিন ভাইয়া, আপনার আন্টজি এসব বলে বলে করিয়েছেন। মছলি-গোস্ত এ সব তো আমাদের ঘোরে ঢোকে না। একটু কষ্ট হোবে আপনার।

আমি একবার আপত্তি পর্যন্ত করতে পারলুম না। একজন হাতে জল ঢেলে দিলেন। হাত ধুয়ে যা পারি খেয়ে নিলুম। কতদিন আগেকার রান্না সব! অপূর্ব স্বাদ ছিল পিসিমার রান্নার। এখন নিজের জিভের স্বাদকুঁড়ি বোদা হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও বুঝি নিখুঁত রেসিপি দিয়ে তৈরি হয়েছে এ সব। অনেক রকম। এঁরা কি জানতেন, পিসিমা কি জানতেন আমি আজই আসব? আশ্চর্য! আমি মিষ্টি খেতে পারতুম না, তাই পিসিমা রসে দেবার আগে আমার জন্য খাবার-দাবার তুলে রাখতেন। আজও দেখি সেই রসে না দেওয়া খাজা।

আমার খাওয়ার পর দুজন মহিলা দেখলুম পিসিমাকে খাওয়াতে এলেন। দুধ মিষ্টি এই সব খাদ্য। আর তখনই বুঝতে পারলুম পিসিমা চলচ্ছক্তিরহিত। ভাবতে থাকি, ভাবতে থাকি। কীভাবে ওঁকে, আমরা নিজের পিসিমাকে এই পরাশ্রয় থেকে নিয়ে যাব। গাড়িতে হবে না। অ্যাম্বুলেন্স চাই। সে না হয় হল। কিন্তু আমাদের চন্দননগরের বাড়িতে শোবার ঘর মাত্র দুটো। একটাতে আমরা থাকি। আরেকটাতে বাবা থাকতেন নাতিকে নিয়ে। এখন বাবা চলে গেছেন। নাতিরই ঘর হয়ে গেছে সেটা। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা বসে, স্টিরিও চলে, ধূমপানও চলে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে এলেই শোবার অসুবিধা হয়। আমাকে নীচের বৈঠকখানায় নেমে যেতে হয়। ছেলেরও বছর আঠাশ বয়স হল। চাকরিবাকরি করছে। বিয়ে দিলেই হয়। এর মধ্যে কোথায় এই চলচ্ছক্তিহীন বৃদ্ধাকে নিয়ে তুলব? কিন্তু এসব ভেবে তো লাভ নেই। নিয়ে আমাকে যেতেই হবে। এতদিন পরে মুতা পিসিমার পুনরুজ্জীবন ও পুনরাবির্ভাবে আমার স্ত্রীর মনের অবস্থাই বা কী হবে ভাবতেও ভয় পাচ্ছি। এঁকে তো সেবাযত্নও করতে হবে, শয্যাশায়ী যখন। মনে মনে দ্রুত একটা হিসেব কষে নিই। দুবেলা দুজন আয়া রাখলে দৈনিক 120 টাকা, শুধু নাইটে রাখলে 60 টাকা মিনিমাম। আর যদি তুতিয়ে পাতিয়ে সারা দিনের জন্য কাউকে রাখা যায়। মাসে এতগুলো টাকা আসবে কোত্থেকে? এটাই বড়ো খরচ। তা নয় তো উনি কী-ই খান আর কী-ই বা পরেন। ছেলের কাছ থেকে আমি কিছু চাই না, সে নিজে থেকে যা দেয়, দেয়। আমার অবসরোত্তর পাওনাগন্ডার অঙ্ক নেহাত খারাপ নয়, কিন্তু সরকার সুদ কমিয়ে দেওয়ার জন্য অন্য পেনশনারদের মতো আমিও মুশকিলে পড়েছি। একটা এফ. ডি. ভাঙাতেই হবে। আমরা দুজন না হয় বৈঠকখানাতেই শোব। বাইরে গ্রিল ঘেরা যে বারান্দাটুকু আছে ওখানেই অতিথি আপ্যায়ন…

ঘুমিয়ে পড়লি নাকি কে সুরো? পিসিমা খুব অল্প অল্প করে খাচ্ছিলেন। থেমে থেমে। এবার জিজ্ঞেস করলেন। সেবাকারিণী মহিলা দুটি স্মিতমুখে আমার দিকে চেয়ে আছেন।

বলি, না, তোমার খাবার সময়ে কথা বলতে চাইছিলুম না। তোমার তো আবার…

তোর মনে আছে?–পিসিমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খাবার সময়ে কথা বলে ফেললে পিসিমার আর খাওয়া হত না। মায়ের তাই কঠোর নির্দেশ ছিল দিনে রাতে কোনো সময়েই যেন আমরা পিসিমার খাবার সময়ে ঘুরঘুর না করি।

আমার দাদারা দিদিরা কেউ কি বেঁচে আছে? হ্যাঁ রে?

না পিসিমা।

সুজু কী করছে?

কী বলব? বলি—ও তো আমেরিকায়।

তাই বল, আর নীলি?

নীলি মানে নীলাঞ্জনা, আমার বোন। নামগুলি পিসিমারই দেওয়া।

তোমার নীলি এখন ঠাকুমা দিদিমা হয়ে গেছে পিসিমা।

নিদন্ত মুখে বড়ো তৃপ্তির হাসি হাসলেন উনি। বললেন, সে হয়তো তুইও হয়েছিস! কিন্তু আমার কাছে তোরা সেই নীলি, সেই সুরো, সেই সুজু… দিনরাত খুনসুটি করছে আর সালিশির জন্যে রান্নাঘরে ভিড় করছে। বউদির কাছে বকুনিও তো কম খেতিস না।

যা বলেছ!

আরও কিছুক্ষণ পুরোনো দিনের গল্প হল। তারপর শুশ্রুষাকারিণী মহিলারা বললেন, এবার মায়ির বিশ্রামের সময় হল।

খাওয়ার সময়ে ওঁরা পিসিমাকে উঠিয়ে বসিয়েছিলেন। আমি প্রণাম করি, পিসিমা, আজ তাহলে আসি!

আয়, খেদহীন প্রসন্নতার হাসি হাসলেন।

ভীষ্মনাথ বরজাতিয়া আর তাঁর অন্তঃপুরের মহিলারা কোথায় ছিলেন জানি না, একে একে আবির্ভুত হলেন সবাই। ভীষ্ম আমার হাত দুটি ধরে বললেন, বহোৎ বহোৎ সুক্রিয়া ভাইসাব, আপনাকে কোত্তোদিন কোতো রাত ফোন করে বিরক্ত করেছি। কিন্তু দেখছেন তো ভুল কিছু বোলেনি। আসেন।

দালানে দু ধারে মহিলারা দাঁড়িয়ে যেন আমার বিদায় জানাচ্ছেন। ভীষ্মনাথ আমার পাশে যেন কৃতজ্ঞতার প্রতিমূর্তি। সংকোচে বলি, আমার কিছুদিন সময় দিন ভাইসাব। ব্যবস্থাদি করে…

সোময়? বেবস্থা?—উনি ঈষৎ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। সিঁড়ি এসে গেছে। উনি থেমে গেছেন। আমি বলি, পিসিমাকে নিয়ে যাবার একটা…

মুখ থেকে বিস্ময় সরে যায়। উনি বলেন, আন্টজি কুথাও যাচ্ছেন না ভাইসাব। উনি যেতেও চান না। আপনাকে বললাম কিনা জুতির্ময়ী দেবী এ বাড়ির আতমা। আতমা তখনই দেহ ছাড়ে… যোখন… হাতজোড় করে বললেন—সোময় এসে যায়। আপনাকে দেখতে চেয়েছিলেন, দেখলেন, বাস।

আমার ভেতরটা স্তব্ধ হয়ে আছে। আমি সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকি। নীচের দালানেও কিছু মহিলা, কিন্তু ভদ্রলোক। কেউ কোনো কথা বলেন না, শুধু একটা সৌজন্যের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন, নমস্তে করেন। দরজার কাছে এসে বলি, আপনাদের ফোন নম্বরটা? ভীষ্মনাথ হাসলেন, কথা বললেন না।

মাঝে মাঝে দেখে যাবো পিসিমাকে।

উনি ডাইনে বাঁয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন।

বিপুল কিন্তু নম্র চেহারার এক ভদ্রমহিলাও দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর দিকে চেয়ে নিবেদন করি, মাঝে মাঝে, ধরুন, মাসে একবার।

উনি কথা বললেন না। মুখের ভাবে কেমন একটা শেষ কথা বলার সংকল্প। ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়লেন।

বেরিয়ে আসি। পেছনে সূর্যমহলের ফটক বন্ধ হয়ে যায়। দারোয়ান কেঠো ভঙ্গিতে সেলাম ঠোকে। আমি ফেরার রাস্তা ধরি। আমির আলি অ্যাভেনিউ-তে এসে বেকবাগান-হাওড়া মিনি। সিট পাই পেছনে, হাওড়া পৌঁছেই, ব্যান্ডেল লোকাল ধরি। সামনে একজন সিগারেট ফুঁকতে থাকেন, আশেপাশে ভিড় বাড়তে থাকে। সত্যিই তো আমার কী অধিকার… বরজাতিয়াদের ফোন নাম্বার গাইডে থাকলে খুঁজে বার করাই যায়… কিন্তু সত্যি, যিনি নিরুদ্দিষ্ট হলে খুঁজে বার করতে

পেরে মৃত্যুর কথা রটনা করে দিয়েছি… ফেরিওয়ালারা ওঠে, মার্কামারা ডাক–চুপচাপ বসে থেকে টুকটাক চালান দাদারা…চাটনি লজেন্স…এর মধ্যে আছে আমলা হরীতকী জোয়ান…বিটনুন, …বড়োরা রটালেন আমরাও বিশ্বাস করে নিলুম জ্বলজ্যান্ত মানুষটা…ঝালমোড়ি, ঝালমোড়ি, কেষ্টদার বিখ্যাত ঝালমোড়ি। ঝাল পাবেন, মুড়িও পাবেন। মজা ফাউ, মজা ফাউ… দু মলাটের মাঝখানে দেড়শো জোক দাদা…দেড়শো… এক ছেলে তার মাকে বলছে, মা, বাবা এবার ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে! মা বলছে দূর, তোর বাবা আমার সামনেই দাঁড়াতে পারে না… দেড়শো জোক… সোসায়টিতে বলুন—লেডিদের কদর পাবেন… পিসিমার দিন ঘনিয়ে এসেছে…ওঁরা কি মৃত্যুসংবাদটাও? চারদিকে এত মানুষ এত কোলাহল এত ঘামের গন্ধ, এত রং, ধুলো, লম্বা গোল চৌকো তেকোনা কতরকম মুখ… কিন্তু সবই কেমন অবাস্তব লাগে। যেন স্বপ্ন দেখছি। এক্ষুনি স্বপ্ন ভেঙে যাবে, সত্যিকারের বাস্তবে জেগে উঠব——গোলাপি ঘর, সাদা সাদা প্রৌঢ় প্রৌঢ়া, পালঙ্কের ওপর কিংবদন্তি বৃদ্ধা যিনি নাকি বাড়ি বিক্রির শকে মারা গিয়েছিলেন। নববুই বছরের জ্যোতির্ময়ী গুহ, আমার নিজস্ব পিসিমা যাঁর নাম-পদবি কিছু আমি জানতুমই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *