জুজুমারার বাঘ

জুজুমারার বাঘ — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

০১.

ওড়িশার সম্বলপুর শহর থেকে মহানদীর অন্য পাশে একটি পথ গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেঢ়াখোল। রেঢ়াগোল হয়ে আরও এগিয়ে গেলে পৌঁছনো যায় বড়কেরাছক হয়ে অঙ্কুলে। এটি ওড়িশার একটি বিখ্যাত বনাঞ্চল।

এই অঙ্গুল ডিভিশনেরই অধীনে পুরানাকোট, বাঘমুণ্ডা, টুকা, লবঙ্গী ইত্যাদি বিভিন্ন ফরেস্ট ব্লক। ঋজুদার দৌলতে এই সবের মধ্যে অনেক জায়গাতেই যাওয়ার সুযোগ আমার, তিতিরের এবং ভটকাইয়েরও হয়েছিল। তবে ওড়িশার এদিকটাতে আগে ঋজুদা যদিও এসেছিল, আমরা কেউই আসিনি।

সম্বলপুর শহরের নাম সমলেশ্বরীর মন্দিরেরই নামে। মস্ত বড় সাদারঙা মন্দির। সম্বলপুরের রাজারাই সমলেশ্বরীর এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মা দুর্গারই আরেক নাম সমলেশ্বরী। কটক শহরে আবার এই দেবীরই নাম চণ্ডী। কটকচণ্ডীর মন্দির বিখ্যাত সেখানে যে পথে কটকের মন্দির সেই পথের নামই মন্দিরের নামে কটকচণ্ডী রোড।

কটক শহরের রাস্তাঘাটের নামগুলো অদ্ভুত অদ্ভুত। তবে প্রত্যেকটি নামেরই মানে আছে। একটি পথের নাম বজ্ৰকপাটি রোড।

কটক শহর খুবই প্রাচীন শহর তো। প্রাচীন তার ঐতিহ্য। কলকাতা শহরের মতো স্বল্পদিনের এবং সর্বজ্ঞদের শহর নয় কটক।

সম্বলপুরের কাছেই কোল ইন্ডিয়ার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি মহানদী কোলফিল্ডস-এর সদর দপ্তর। ঋজুদার কী কাজ ছিল মহানদী কোলফিল্ডস-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শর্মা সাহেবের সঙ্গে। আমরা কলকাতা থেকে ট্রেনে গিয়ে ঝাড়সুগদাতে নেমে সেখান থেকে চমৎকার মসৃণ এবং চওড়া রাউরকেলা-সম্বলপুর এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে মহানদী কোলফিল্ডস-এর গেস্ট হাউসে গতকাল সকালেই এসে পৌঁছেছিলাম। চমৎকার গেস্ট হাউস। এয়ারকন্ডিশনড। খাওয়া-দাওয়া চমৎকার।

গতকাল সারাদিন ঋজুদা কাজ সেরেছে। তাই আজ সকালেই গাড়ি করে বেরিয়ে পড়েছিলাম ব্রেকফাস্টের পরে, অঙ্গুলে যাব বলে। কিন্তু দুপুরবেলা জুজুমারা আর চারমল-এর মাঝামাঝি হাইওয়ের উপরের একটি ধাবাতে খাওয়া সেরে বেরোবার দশ মিনিট পরেই দেখা গেল গাড়ির ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছে না। আসলে, চার্জ দিচ্ছিল না অনেকক্ষণ আগে থেকেই। না ড্রাইভার, না সামনের সিটে বসা ঋজুদা তা নজর করেছিল। গাড়ি থামিয়ে বনেট খুলে দেখা গেল যে দোষ ব্যাটারির নয়, অ্যাম্বাসাডর গাড়ির আর্মেচারই পুড়ে গেছে।

ড্রাইভার ত্রুষ্ণ দাস গোমড়ামুখে বলল, আর্মেচার সারাবার মতো মিস্ত্রি ওখানে এক রেঢ়াখোল ছাড়া অন্য কোথাওই নেই। তাই তাকে বাস বা ট্রাকে করে যেতে হবে আর্মেচার নিয়ে রেঢ়াখোল-এ। এই বিয়াল্লিশ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরেই।

যদিও মে মাসের শেষ, কিন্তু বৃষ্টি নেমে গেছে। সারা পৃথিবীর আবহাওয়াই ওলট-পালট হয়ে গেছে আমাদের অসীম লোভে। এই অন্যায়ের গুণাগার আমাদের তো গুনতে হবেই। আমাদের ছেলেমেয়েদেরও হবে।

ঋজুদা সব সময়েই বলে একথা।

ত্রুষ্ণ অঙ্গুলগামী বাসে চড়ে চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে, পাকা তাল-এর মতো দেখতে, তামার তার জড়ানো ভীষণ ভারী আর্মেচারটি দু’হাতে বয়ে নিয়ে কোঁত দিতে দিতে বাসে উঠে। এখন আমাদের কতক্ষণ হা কৃষ্ণ! হা কৃষ্ণ!’ করে প্রাণভোমরাহীন গাড়িতে বসে থাকতে হবে, তা কে জানে। ত্রুষ্ণ বলে গেছে, তার ফিরতে দু’ ঘণ্টাও হতে পারে আবার রাতও হয়ে যেতে পারে। অতএব…

সামনে-পিছনে এবং দু’পাশেই অত্যন্ত গভীর জঙ্গল কত বর্গকিলোমিটার হবে তা জানি না। তবে শ পাঁচেক কিলোমিটার তো হবেই স্বচ্ছন্দে। তার মধ্যে-মধ্যে নানা পাহাড়শ্রেণী। স্থানীয় লোকেরা বলে ‘পর্বত। ধাবাতে খেতে খেতে শুনছিলাম। আর কত বিচিত্ৰই না তাদের নাম সব। সাগমুলিয়া-গড়াখুল, বনতুলে-খকর, রেঙ্গানিকানি, যসুয়া–এই রকম। পর্বত বলে, কারণ আসল পর্বত, যেমন গাড়োয়াল বা কুমায়ুন বা সিকিমের হিমালয় তো দেখেনি এরা চর্মচোখে। তাই তিলকেই তাল মনে করে।

ঋজুদা বলল, আমরা জনবসতির খুব দূরে নেই। জুজুমারার থেকে একটুই এসেছি। চারমল পেরিয়ে পৌঁছতে হবে রেঢ়াখোলে।

জুজুমারা!

কী নামরে বাবা।

ভটকাই স্বগতোক্তি করল।

তিতির বলল, শেকসপিয়ার তো পড়নি তুমি ভটকাই। শেকসপিয়ার বলেছিলেন, ‘হোয়াটস ইন আ নেম।

শেকসপিয়ার তো আমি পড়িনি, তুমি কি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা তারাশঙ্কর বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েছ? রবীন্দ্রনাথও কি পড়েছ ভাল করে?

ঋজুদা বলল, এই শুরু হল তোদের খুনসুটি! তার পরে বলল তিতিরকে, শেকসপিয়ারের কথা বললি তুই তিতির, তাই মনে পড়ে গেল, ছেলেবেলায় বাংলা বইয়েতে শেকসপিয়ারের উল্লেখ থাকত ‘শেক্ষপিয়ার’ বলে আর জার্মান দার্শনিক ম্যাক্সমুলারের উল্লেখ থাকত ‘মোক্ষমুলার’ বলে।

আমরা হেসে উঠলাম ঋজুদার কথাতে।

ভটকাই বলল, কেন?

–কেন? তা কী করে বলব। তখন মানুষের ইংরেজি-জ্ঞান কম ছিল। পরাধীন ভারতে ইংরেজির যা পরাক্রম ছিল, স্বাধীন ভারতে তার চেয়ে একশো গুণ বেশি। তবে যে যেটুকু জানতেন তা তিনি ভালভাবেই জানতেন। এতকিছু জানতে গিয়ে সব গুবলেট করে ফেলেনি মানুষ। তাঁরা বাংলা জানতেন ভাল করে। তাঁদের মধ্যে ইংরেজি জানতেন খুব কম মানুষই। সে কারণেই হয়তো এমন সীমাবদ্ধতা দেখা যেত। তবে একথাও বলব যে, তখন রুই-কাতলার রাজত্ব ছিল, আজকের মতো খলসে আর পুঁটি ফরফর করে বেড়াত না চারদিকে।

তাই?

অবাক হয়ে বলল তিতির।

আমি প্রসঙ্গ বদলে বললাম, ঋজুদা এ অঞ্চলে তুমি কখনও শিকার করোনি?

বলতে গেলে, না-ই। এ অঞ্চলের গল্প শুনতাম কটকের চাঁদুবাবু আর অঙ্গুলের বিমলবাবুর কাছে। এইসব জঙ্গলের রোমহর্ষক সব গল্প বলতেন চাঁদুবাবু। গণ্ডার এবং বুনোমোষ ছিল না অবশ্য। কিন্তু হাতি, বাঘ, বাইসন মানে গাউর, চিতা, ভয়াবহ সব ভাল্লুক, ইয়া ইয়া দাঁতের বড়কা বড়কা শুয়োর, তোর কাঁধ সমান উঁচু কাঁটা ঝনঝনানো শজারু, নানা জাতের হরিণ এবং অ্যান্টেলোপ, ময়ূর, মুরগি, সবুজ হরিয়াল, গাঢ় নীলরঙা রক-পিজিয়ন, বড়কি এবং ছুটকি ধনেশ, ওড়িশাতে যাদের বলে কুচিলা-খাঁই এবং ভালিয়া-খাঁই।

তিতির বলল, মানে, গ্রেটার এবং লেসার হর্নবিল বলছ ঋজুকাকা?

-হ্যাঁ।

তবে এখানে ওদের এরকম অদ্ভুতুড়ে নাম কেন?

হোমিয়োপ্যাথিক ওষুধ নাকসভোমিকার ফল যে গাছে হয় তাদের ওড়িয়াতে বলে কুচিলা। আর ওই কুচিলা খুব ভালবেসে খায় এবং শীতকালে যখন সে গাছে ফল আসে তখন বড়কি ধনেশরা ওই গাছেতেই আড্ডা গাড়ে বলেই তাদের ওরা নাম দিয়েছে কুচিলা-খাঁই। ভালিয়াও এক রকমের গাছই। তবে কুচিলা গাছেদের চেয়ে অনেক ছোট হয় সে গাছ। পাহাড়ি এলাকাতে ঘন বনের মধ্যেই হয় এইসব গাছ। ছোটকি ধনেশ ভালিয়া ফল খেতে ভালবাসে বলেই ওদের নামও ভালিয়া-খাঁই। মানে, ভালিয়া খায় আর কী!

তবে কি আমার নাম হওয়া উচিত ছিল পান্তুয়া-খাঁই?

আমরা সবাই হেসে উঠলাম ভটকাইয়ের কথা শুনে।

তিতির বলল, সত্যি! তুমি যে কত্ব জানো ঋজুকাকা!

ঋজুদা হেসে বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে? একটু-আধটু জানা ভাল কিন্তু কেউ যদি সর্বজ্ঞ হয়ে যায় তবেই বড় বিপদ। প্রার্থনা করিস ঈশ্বরের কাছে, তা যেন কখনও না হই।

তারপরই বলল, বৃষ্টি তো থেমে গেছে। চল আমরা গিয়ে আম কুড়োই। পরে নুন-লঙ্কা জোগাড় করে রেলিশ করে খাওয়া যাবে।

পথের দু পাশে মস্ত মস্ত প্রাচীন আমগাছ আর প্রত্যেকটাই আমে ভরে আছে। মে মাসের শেষ। এখানে পৌঁছবার আগে দেখে এসেছি যে, গ্রামের কাছাকাছি সব জায়গাতে পথ-পাশের আমতলিতে ছোট-বড় অনেকেই আম পাড়তে আর আম কুড়োতে ব্যস্ত। অনেকে গাছে উঠেও পাড়ছে আম। দেখেছিলাম। অনেকে আবার জমিতে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে অথবা আঁকশি দিয়েও পাড়ছে। এখানে কাছাকাছি জনবসতি নেই বলেই গাছতলিতে মানুষ নেই। বৃষ্টি থামার পরে নানা রকম পাখি ডাকছে দু’ পাশের বন থেকে। যে-পাখিটা রাতের বেলা ভুতুড়ে গলাতে গুব-গুব গুব গুব করে ডাকে সে এই ভর দুপুরেই ডাকতে আরম্ভ করেছে। পাখিটার নাম জানতে হবে ঋজুদার কাছ থেকে।

তিতির বলল, ঋজুকাকা তোমার মধ্যে একজন চিরশিশু আছে বলেই তোমাকে আমাদের এত ভাল লাগে। তুমি বুড়ো হলে কখনও আম কুড়োবার কথা বলতেই পারতে না।

ঋজুদা বলল, এইটাই তো আমার রোগ। মহারোগ। বুড়ো আমি ইচ্ছে করলেও কোনওদিনও হতে পারব না। হয়তো পক-কেশ, লোলচর্ম হয়ে যাব কোনওদিন, হয়তো কেন, অবশ্যই হব, কারণ সকলেই হয়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ছেলেমানুষটিই থাকব। আঠারোই আমার চিরকালীন বয়স। সে বয়স আর বাড়বে না কোনওদিনও।

 ভটকাই বলল, তাই থেকো, তাই থেকো, এভার গ্রিন।

আমি বললাম, আমরা রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনীর নবযৌবনের দল’ হয়েই থাকব চিরটা কাল।

ঋজুদা বলল, তাই যেন থাকি।

অনেকগুলো আম কুড়োনো হয়ে গেলে একটা মস্ত আমগাছের নীচের বড় বড় কালো পাথরের উপরে আমরা গিয়ে ছড়িয়ে বসলাম উপরে নীচে। পাথরগুলো ভিজে ছিল। ভটকাই বুদ্ধি করে গিয়ে গাড়ির গ্লাভসবক্স খুলে হলুদ আর লাল কাপড় নিয়ে এসে পাথরগুলো ভাল করে মুছে দিল।

ঋজুদা একটা বড় পাথরে বসে পাইপটা ধরাল। এখন প্রায় আড়াইটে বাজে। দুপুর। বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশের মুখ ভার। মনে হচ্ছে যে-কোনও সময়েই আবার কেঁদে উঠতে পারে।

ভটকাই কাপড়গুলো গাড়িতে রেখে এসে ঋজুদাকে বলল, ঋজুদা, রুদ্র যে জিজ্ঞেস করল তোমাকে এই অঞ্চলে শিকারের কথা, তা তুমি তো কথাটা চেপেই গেলে।

চেপে গেলাম মানে?

–চেপে গেলে না? বললে, বলতে গেলে, না-ই। তার মানেটা কী হল? এরকম ঘোরপ্যাঁচের কথা তো বলে কমিউনিস্টরা। তুমিও কি কমিউনিস্ট?

কম অথবা বেশি, আমি কোনও অনিষ্টর মধ্যেই নেই। যারাই দেশের দশের ভাল করবে আমি তাদেরই দলে। সে ভাল, যে দলই করুক না কেন?

–এই ভটকাই। তুই ওকালতি পড়। তোর হবে। এমন জেরা তো ফৌজদারি আদালতের উকিলও করে না রে!

ফাজিল ভটকাই বলল, হাঃ হাঃ। এই লাইফটাই তো একটা ফৌজদারি আদালত।

আমরা সকলেই ওর কথাতে হেসে উঠলাম।

ঋজুদা বলল, রুদ্র ভট্রাইকে ধরে এবারে একটু চটকে দে তো।

মাঝে মাঝে, তবে বেশ অনেকক্ষণ বাদে বাদে এক একটি বাস বা ট্রাক বা প্রাইভেট গাড়ি আসছিল বা যাচ্ছিল জলভেজা মসৃণ পথের উপর ছিপছিপছিপ শব্দ তুলে। যানবাহন খুবই কম। এখনও শান্তি আছে কোথাও কোথাও। জেনে ভাল লাগে।

এই কদিন আগেই কাগজে পড়ছিলাম যে, এই পথেই অঙ্গুল থেকে সম্বলপুরে আসার সময়ে একটি যাত্রীবোঝাই বাসের গায়ে একটি একরা-বাইসন গুঁতো মেরে বাস-এর গায়ে ফুটো করে দিয়েছে। পুরো অঞ্চলটাই ঘন বনাবৃত নানা পাহাড়শ্রেণীর পাহারাতে, নানা নদী-নালার মালাতে এখনও বেশ আদিম আদিম আছে। বনের গাছগাছালির অধিকাংশও আদিম। বনবিভাগের লাগানো প্ল্যানটেশন নয়।

কী হল ঋজুদা? বলো। বলতে গেলে না-ই’-এর ব্যাখ্যা কিন্তু তুমি এখনও দিলে না।

ভটকাই বলল।

–হ্যাঁ।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, আমাদের পেছনে ফেলে-আসা জুজুমারার একটু আগে রেঙ্গানিকানি নামের একটি পাহাড়শ্রেণী আছে। তারই পাদদেশের ঘন জঙ্গলের লাগোয়া গ্রামে একটি cattle-lifter মেরেছিলাম বহু বছর আগে। মেরেছিলাম মানে, মারতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই বলেছিলাম শিকারের কথায়, বলতে গেলে না-ই।

বাধ্য হয়েছিলে মানে?

-মানে, নিজেই জিপ চালিয়ে যাচ্ছিলাম সম্বলপুর থেকে অঙ্গুল। জুজুমারার আগে হঠাৎই একটি আত্মহত্যাকামী ব্যর্থ-প্রেমিক বোকাপাঁঠা জিপকে বাইসনের মতো ঢু মারতে গিয়ে পা পিছলে চাকার নীচে পড়ে গিয়ে মারাত্মক রকম আহত হয়। সেই সময়টাতে আমি বামরাতে শাল জঙ্গলের ঠিকা নিয়ে জঙ্গলেই ক্যাম্প করে থাকি। সঙ্গী বলতে আমার সেবাদাস হাবা-গোবা কিন্তু নিজেকে সুপার ইনটেলিজেন্ট ভাবা, আতুপাতু ধল্ব। আমার কুক-কাম-ড্রাইভার-কাম-মুহুরি কাম-লোকাল গার্জিয়ান।

কী নাম বললে?

–আতুপাতু।

–আতুপাতু আবার কারও নাম হয় নাকি?

হবে না কেন? বাবা-মা ভালবেসে যে নাম রাখবেন সে নামই হয়।

 আমি বললাম, ভটকাই-ই বা কারও নাম হয় নাকি?

 ভটকাই তখন চুপ করে গেল।

তিতির বলল, ধল্বটা কী ব্যাপার?

–আহা, surname, পদবি। ওড়িয়া পদবি। আমাদের কারও কারও পদবি যদি দাড়িপা বা পোদ হতে পারে ধল্ব কী দোষ করল!

–তা ঠিকই।

তিতির বলল।

–তারপর বলল ঋজুদা।

ভটকাই বলল।

–মিনিট পাঁচেক আগেই তাকে স্টিয়ারিং ছেড়েছিলাম আমি, নইলে আমিই চালাচ্ছিলাম বামরা থেকেই। আর তারই মধ্যে সেই চালাক-পাঁঠা চাপা দিয়ে দিল এক বোকা-পাঁঠাকে। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন এসে ঘিরে ফেলল আমাদের। এই মারে কি সেই মারে। পাঁঠাটার দাম মিটিয়ে দিলেই মামলার নিষ্পত্তি হত, কিন্তু আতুপাতুর চ্যাটাং-চ্যাটাং কথাতে জনতা ক্ষেপে গেল। আর ভারতের সব জায়গার জনতাই হচ্ছে লাল পিঁপড়েদেরই মতো। একবার একজন কোথাও সেঁটে গেলে, অন্যরা সকলে কী ঘটেছে তা না জেনেই গায়ে পড়ে উড়ন-চাঁটি মেরে হাতের সুখ করে নিতে চায়। পাঁঠাটাও একেবারে মরে গেলে মামলার সহজ নিষ্পত্তি হত কিন্তু সে তো মরে তো নিই, মরবেও না। তার চিৎকার শুনে জনগণ বলতে লাগল, ‘ষড়া! সে খাসিটাকু খন্ডিয়া করিকি ছাড়ি দেলু।

-মানে?

তিতির বলল।

–মানে হল, অর্থাৎ শালা! খাসিটাকে আহত করে ছেড়ে দিল।

যখন অগণন উড়ন-চাঁটি আমার নিজের গায়ে-মাথায়ও বর্ষিত হয় হয় এমন সময়ে ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলল, ঋজুবাবু।

আহা! কানে যেন মধুবর্ষিত হল। ধড়ে প্রাণ এল।

 আতুপাতুও বত্রিশপাটি বিকশিত করে বলল, বাবু! হাড়িবন্ধু।

জনতা, বিনি-পয়সার উত্তেজনায় ভাঁটা পড়াতে মনমরা হয়ে গেল।

হাড়িবন্ধুর বাড়ি লবঙ্গীতে। সেখানে ফুটুদাদের সঙ্গে যখন যেতাম তখন সেই আমাদের সবরকম খিদমদগারি করত। সে জনতাকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার বহুমুখী প্রতিভা সম্বন্ধে কাঁকড়াবিছের গুঁড়ের মতো একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে শান্ত করল।

তার পরে জনতারই কথাতে জানা গেল যে, রেঙ্গানিকানি পাহাড়ের পাহাড়তলিতে কুচুয়া বলে একটি গ্রামে গত রাতেই একটা মস্ত চিতা খুব বড় একটা দুধেল গোরু মেরেছে। গোরুটার কিছু খেয়েও গেছে। মড়ি’র উপরে বসলে আজ তাকে হয়তো মারাও যাবে। তবে আশা কম। এবং গোরুর ‘মড়ি’তে বাঘের ফেরার আশা কম বলেই এই পাঁঠাটাকে কিনে কুচুয়া গ্রামের লোকেরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছিল। হাড়িবন্ধু এখন কুচুয়াতেই থাকে। কয়েক গুট জমি কিনে সে এখানেই বিয়ে করে থিতু হয়েছে।

–গুঁটটা কী জিনিস?

তিতির প্রশ্ন করল।

–গুঁট হচ্ছে ওড়িশার জমির পরিমাণ। আমাদের যেমন বিঘা।

–ও। বলো, ঋজুকাকা।

–চাষ-বাস করে হাড়িবন্ধু। তরি-তরকারিও ফলায়। জুজুমারা আর চারমল-এর হাটে বিক্রি করে। চলে যায় দিন কোনওমতে।

ঋজুদার পাইপটা একেবারেই নিভে গিয়েছিল। পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে ঋজুদা আবার শুরু করল–

যে গোরুটাকে মেরেছে চিতা, সেটা হাড়িবন্ধুর বড় সম্বন্ধীর। হাড়িবন্ধু সকলকে বোঝাল যে, এই অধম ভারী শিকারি। ওড়িশার বহু বনেই তাঁর পা পড়েছে। আজ সাক্ষাৎ মা সমলেশ্বরীই তাঁকে চিতা-নিধনের জন্য এই পথে চালান করেছেন এবং পাঁঠাটাও বোধ হয় তা জানতে পেরে জিপের গায়ের সঙ্গে নিজের গা ঠেকিয়ে দিয়ে এই কেলো করেছে।

আমি হাড়িবন্ধুর কথার প্রতিবাদ করে বললাম, তা কী করে হবে। আমাকে অঙ্গুলে গিয়ে আজ পৌঁছতেই হবে। ঠিকাদার মহাদেব ঘোষ আর বিমল ঘোষের সঙ্গে কাজ আছে। ওখানে কাজ সেরে ঢেনকানলেও যেতে হবে একবার।

কিন্তু কে শোনে কার কথা!

বাঁচবার জন্য বললাম, আমি কি সঙ্গে বন্দুক-রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছি নাকি? শুধু পিস্তলটা আছে বেল্টের সঙ্গে হোলস্টারে; প্রয়োজনে বেয়াদব মানুষ মারার জন্য। পিস্তল দিয়ে কি বাঘ মারা যায়?

হাড়িবন্ধু এবং তার সঙ্গীরা বলল, বহুতো বন্দুক অচ্ছি এটি। বন্দুকপাঁই কিচ্ছি। চিন্তা নাই। কিন্তু আপনাংকু রহিবাকু হেব্ব।

তারপর বলল, বন্দুক, রেঙ্গানিকানি পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশের গ্রামে গ্রামে অনেক আছে কিন্তু এমন শিকারি কেউ নেই যে ও চিতাকে মারতে পারে।

–কেন? একথা বললে আমি মানব কেন? এইসব জঙ্গল-পাহাড়ের গ্রামের যে-কোনও শিকারিই শহুরে নামীদামি শিকারিদের কানে ধরে শিকার শিখিয়ে দিতে পারে।

–চিতাটা সাধারণ চিতা নয়।

–মানে?

–মানে ওর গায়ে গুলি লাগলেও ওর কিচ্ছু হয় না। গুলি খেয়ে, পড়ে গিয়েও সে উঠে চলে যায়।

–এমন গুলিশোর চিতার কথা তো শুনিনি জন্মে।

তাকে যারাই মারতে গেছে তাদেরই নানা বিপদ ঘটেছে। প্রায় ছ মাস হল চিতাটা এই অঞ্চলে অত্যাচার করে যাচ্ছে কিন্তু বহু শিকারি চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। মা সমলেশ্বরীর যে কৃপাধন্য তাকে কি সাধারণ মানুষে মারতে পারে? এ চিতা সমলেশ্বরীর চিতা।

–তাহলে আমিই বা পারব কী করে!

ঋজুদা বলল, আমি বললাম, হাড়িবন্ধু অ্যান্ড কোম্পানিকে।

তারা বলল, আপনি তো স্থানীয় মানুষ নন। ওই চিতাকে মারতে পারলে আপনিই পারবেন।

ততক্ষণে পাঁঠাটাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে শুশ্রূষা করতে লাগল কেউ কেউ আর আমাদেরও জিপ থেকে নামিয়ে সসম্মানে চায়ের দোকানের সামনে বসিয়ে চা আর বিড়ি বড়া খাওয়াল জবরদস্তি করেই।

এদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও উপায় নেই দেখে আমি বললাম, গোরুর আধ-খাওয়া মড়ি’ যখন আছেই তখন আবার পাঁঠার জোগাড়ে গেলে কেন?

–চিতাটা তো আধ-খাওয়া মড়িতে বড় একটা আসে না। যদি বা আসেও, শিকারি কাছাকাছি থাকলে ঠিক বুঝতে পেরে ফিরে যায়।

-তাহলে তো পাঁঠা বেঁধে বসলেও ফিরেই যাবে।

হয়তো যাবে। তবু চেষ্টা করতে হবে।

কখনও কুকুর বেঁধে চেষ্টা করা হয়েছে কি?

না তো। কেন? কুকুর কেন?

বাঃ। চিতার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য কুকুর, বাঘের যেমন ঘোড়া। তাই জানো না এতদিনে হাড়িবন্ধু?

–না তো।

–তাহলে এখন বলো কী করতে হবে। এখানে থাকার জায়গা কী আছে? ডাকবাংলো-বনবাংলো কিছু আছে কি?

–আছে, তবে এখান থেকে দূরে। আমাদের গ্রামে থাকলে হয় না? হাড়িবন্ধুর এক সঙ্গী বলল।  

আরেকজন মাতব্বর বলল, ধ্যাৎ। বাবু কি আমাদের বাড়ি থাকতে পারবেন? বিজলি নেই, কমোড নেই, কী করে থাকবেন শহুরেবাবু? ওঁদের সবসময়ে গরম জল লাগে–গরম জলের মেসিনকে বলে গিসার–গরমে ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে লাগে ইয়ারকন্ডিশন। বাথরুমই নেই তার গিসার বা কমোড় কোথায় বসবে?

ঋজুদা বলল, শব্দটা কানে লেগে গেল, বুঝলি। ইয়ারকন্ডিশন। ইয়ার-দোস্তদের কন্ডিশনার থাকলে মন্দ হত না। যাই হোক, আমি ওদের অবাক করে দিয়ে বললাম, আমি তোমাদের বাড়িতেই থাকব। তবে আমাকে একটা আলাদা ঘর দিতে হবে।

–সে কোনও সমস্যা নয়।

হাড়িবন্ধুর সঙ্গীরা বলল।

কিন্তু পরক্ষণেই সমস্যায় পড়ে বলল, গা-ধেইবি, ঝাড়া-দেইবি কুয়াড়ে?

-মানে?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

-মানে, চান করবে, বাথরুম করবে কোথায়?

 বললাম, নদীতেই এবং জঙ্গলে, তোমরা যেমন কর। ‘মত্বে গুট্টে ঢাল্ব দেই দিবি, আউ কিছি লাগিবনি৷

ঢাল্বটা আবার কি জিনিস? ঢাল-তরোয়াল নিয়ে বাঘ মারতে যেতে চাইছিলে নাকি?

তিতির বলল।

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, নারে পাগলি! ওড়িয়াতে ঘটিকে বলে ঢাল্ব।

.

০২.

জিপে করে গিয়ে কুচুয়া গ্রামে পৌঁছে আমার ছোট ব্যাগটা নামিয়ে নিয়ে আতুপাতুকে বললাম জিপ নিয়ে অঙ্গুলে চলে যেতে। বিমলবাবু আর মহাদেব্বাবুকে দুটি চিঠি লিখে দিলাম। তখন ইনটারনেটের কথা ছেড়েই দে, ফ্যাক্স বা এস টি ডি-ও ছিল না। ফোন করতে হলে চারমল-এর পোস্ট অফিসে গিয়ে ট্রাঙ্ককল বুক করে বসে হাঁসফাঁস করতে হত। জুজুমারাতেও ফোন ছিল না। তখন সিঙ্গল লাইনের ট্রেনও ছিল না সম্বলপুর-অঙ্গুলের মধ্যে, ট্রেন তো এই সেদিন হল, বছর দুই। সুতরাং জিপই পাঠাতে হল। বাসেও পাঠাতে পারতাম ওকে কিন্তু জিপ নিয়ে গেলে জিপেই রাতে শুয়ে থাকতে পারবে এবং কাল দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবে ওদের উত্তরের চিঠি সঙ্গে নিয়ে। এই ভেবেই জিপ দিয়ে পাঠালাম।

কুচুয়া গ্রামটা ছোট। তবে বাসিন্দাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব জায়গা-জমি আছে। ভাগ-চাষি কেউ নেই তাই এই গ্রামের অবস্থা অন্য গ্রামের তুলনাতে বেশ ভালই। প্রায় সকলের বাড়িতেই হাঁস, ছাগল, গোরু আছে। চেঁকিও আছে একটি। গ্রামের সকলের ব্যবহারের জন্য। কীর্তন ও রামায়ণ পাঠের জন্যে একচালা আছে একটা। কখনও কখনও নাকি দোলে-দুর্গোৎসবে বা রজৌৎসবে অষ্টপ্রহর থেকে চব্বিশ ঘণ্টাও কীর্তন বা পালাগান বা রামায়ণ পাঠ হয়।

ওরা আমাকে গ্রামের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়ির বাইরের দিকের একটি ঘর ছেড়ে দিল। মাটিরই ঘর, মাটির মেঝে, মাটির দাওয়া, তবে সাপ-খোপের ভয়ের কারণে জমি থেকে বেশ উঁচু। প্রায়, কোমর সমান। একটা দরজা। তিনদিকে তিনটি জানলা। বাঁশের বাখারি দিয়ে বানানো খাট। তোশকের অভাবে খড়গাদা থেকে অনেকখানি খড় এনে পেতে দিল। তার উপরে একটি খয়েরি কালো কাজকরা সম্বলপুরী চাদর বিছিয়ে দিয়ে চারদিক দিয়ে গুঁজে দিল এমনই করে যে, সেটাই তুলোর বদলে খড়ের তৈরি তোশক হয়ে গেল।

-খড় দিয়েও তোশক হয় বুঝি?

তিতির বলল।

–হবে না কেন? এখন তো পশ্চিমের সব দেশেই হিটিং সিস্টেম হয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে ঠাণ্ডা তেমন বোঝাই যায় না। কিন্তু আগেকার দিনে অনেক দেশেই দেখেছি পাখির পালকের তোশক এবং লেপ, এমনকী বালিশ পর্যন্ত। কী নরম আর গরম কী বলব।

-তারপর? আগে বাড়ো।

ভটকাই অর্ডার করল ঋজুদাকে।

–ঘরের পাশেই একটা মস্ত শিমুল গাছ। তার ফুলফোঁটা তখনও শেষ হয়নি। তার অন্য পাশেই একটি ছোট পুকুর। পুকুরে হাঁসেরা প্যাঁক-প্যাঁক করে স্বগতোক্তি করতে করতে চরে বেড়াচ্ছে। তার ধারে ভেরা গাছের সারি। জারুল, পারুল, একটা মস্ত বড় কনকচাঁপার গাছ। মাদার। মে মাসের শেষে এখনও জারুলের ফিকে বেগুনিরঙা ফুল, পারুলের লাল ফুল আর মাদারের সিঁদুরে ফুলে বৃষ্টিস্নাত সবুজ বনের শাড়িতে যেন পাড় বসিয়েছে। একটা পাগলা কোকিল কোনও দলিল-দস্তাবেজহীন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে এই পৃথিবীতে বসন্তকে বারমাস্যা করে দেবার আর্জি নিয়ে তারস্বরে ডেকে চলেছে আর উঁচু রেঙ্গানিকানি পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশের গহন জঙ্গল থেকে তার এক পাগলা দোসরও সাড়া দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। ভাবখানা এমনই, যেন বলছে, লড়ে যাও। আমিও আছি সঙ্গে। করতে হবে। করতে হবে।

দুপুরের খাওয়ার তখনও অনেকই দেরি আছে। মনে হচ্ছে, আমার জন্য কুচুয়া গ্রামের মানুষেরা বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করছে। নানা রকম ফিসফিস গিসগিস শুনতে পাচ্ছি। আমি ওদের বাড়িতে আছি বলে ওরা এমন ভাব করছে যেন চিতা বাঘের যম তো নয়, ওদের আপদ চিতা বাঘটাকেই ওরা ঘরের মধ্যে এনে তুলেছে। এ তো ভারি অস্বস্তির ব্যাপার হল! ভাবছিলাম।

–তারপর?

আমি বললাম।

 ঋজুদা বলল, তারপর আমি চির-মারা গোরুর ‘মড়িটা দেখিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করলাম হাড়িবন্ধুকে। হাড়িবন্ধুর বড় সম্বন্ধী, যার গোরু মেরেছে চিতাটা সে নিজেই চলল আমার সঙ্গে।

শক্তসমর্থ মানুষটার মাথাভর্তি কাঁচা-পাকা চুল, মুখভর্তি গুণ্ডি-পান। বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে সে একটা কুড়ুল কাঁধে ফেলে নিল। জঙ্গলের মানুষদের এই স্বভাব। যাদের হাতিবাইসন থেকে বাঘ-ভাল্লুক-সাপ-খোপ সকলের সঙ্গেই বারো মাস ঘর করতে হয় তারা কিছু কিছু অলিখিত নিয়ম মেনে চলেই। যেমন নিতান্ত নিরুপায় না হলে খালি হাতে এবং একা জঙ্গলে যায় না, আলো ছাড়া রাতে কখনওই বেরোয় না, সে গ্রামের মধ্যে হলেও। জন্তু-জানোয়ার ছাড়াও ভূত-প্রেতের ভয়ও তো কম নয়। এই ভারতবর্ষের কথা তো আলো-ঝলমল কলকাতা শহরের বুকেই যারা সারা জীবন থাকেন, তাঁরা জানেন না।

গোরুটাকে মেরেছে সন্ধের আগে আগে। গ্রামের বাইরের ঘাসবনে যেখানে পাহাড়ের পা এসে পৌঁছেছে, সেখানে। মেরে, সেখান থেকে টানতে টানতে নিয়ে পাহাড়ে চড়ে গেছে। রক্তের দাগ প্রায় ধুয়ে গেছে আজ সকালের বৃষ্টিতে। তবে এত বড় গোরুটাকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার চিহ্ন অবশ্যই ছিল।

কিছুটা যেতেই একটা মিটকুনিয়া গাছের নীচের আগাছাহীন জমিতেই পায়ের দাগ পরিষ্কার দেখা গেল। উবু হয়ে বসে ভাল করে দেখেই বুঝলাম এ চিতা নয়, মস্ত বাঘ। মনে মনে বললাম, চমৎকার। এ তো গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

যে জন্তু তার সাধের দুধেল গোরুটিকে ধরেছে সে যে চিতা অথবা দেবী সমলেশ্বরীর চিতা নয়, পেল্লায় এক বাঘ সে খবর গোরুর মালিক জানে না। যেহেতু চিতাটাই এই অঞ্চলে অত্যাচার করছে, গোরুটি বিকেলে বাড়ি না ফেরাতে তারা তাকে খুঁজতেও যায়নি, ধরেই নিয়েছে যে এ কাজ ওই চিতারই।

গোরুটিকে নাকি রেঢ়াখখালের হাট থেকে গত গ্রীষ্মে হাড়িবন্ধুর বড় সম্বন্ধী কিনেছিল। তারপরই গোরুটা গাভিন হয়। এত দুধ, তার আর কোনও গোরুই দেয়নি নাকি আগে। বাড়িসুষ্ঠু লোক এবং কুকুর-বেড়ালও সাধ মিটিয়ে দুধ খাবার পর জুজুমারার চায়ের দোকানে বিক্রিও করত নাকি রোজ দু’ কেজি করে।

একটি বাচ্চা ছেলে এই জঙ্গলময় এলাকাতে রোজ দু’ মাইল হেঁটে যায় জুজুমারাতে সেই দুধ নিয়ে এবং হেঁটেই ফিরে আসে জুজুমারা থেকে। বিকেলের দুধটাই নিয়ে যায়। ছেলেটির ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়।

আমি বা তোরা যে কাজকে ‘দুঃসাহসিক’ বলে মনে করি তাই এখানকার জঙ্গল-পাহাড় ঘেরা গ্রামের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে পড়ে। এই বিপজ্জনক কাজের মধ্যে এরা বিন্দুমাত্র বাহাদুরিই দেখে না।

হাড়িবন্ধুর বড় সম্বন্ধীর নাম রাম। পায়ের দাগ যে বাঘের, তা না বলে, আমি রামকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কেউ কি চিতাটাকে দেখেছ?

–আমি দেখিনি। প্রথম যখন গোরু মারতে আরম্ভ করে মাস ছয়েক আগে, তখন ফাটা-রহমান দেখেছিল।

–ফাটা রহমান কে?

–সে খুব ভাল শিকারি। সে থাকে হাতিগির্জা পাহাড়ের কাছে। এখানে এসেছিল এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সেই মড়ি’ দেখে বলেছিল যে মস্ত চিতা।

–কোন হাতিগির্জা পাহাড়? বাঘঘমুণ্ডার কাছের?

–না বাবু! এ হাতিগির্জা রাজাবসার কাছে। ভারী পাহাড় বাবু। হাতিদের ডিপো।

–তা সে মারল না কেন?

–তাকে আমরা ধরে পড়েছিলাম। তবে তার হাতে সময় ছিল না তাই তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল মড়িটা দেখেই।

তারপর আমি রামকে জিজ্ঞেস করলাম, এবারে একটা কথা বলো। যেসব শিকারিরা ওই বাঘ মারতে এসেছে তারাও কেউ কি দেখেছে যে জানোয়ার গোর মারছে তাকে?

–তা বলতে পারব না। চার-পাঁচবার মাচায় বসেছিল দু-তিনজন শিকারি। কিন্তু সেই জানোয়ার একবারও আসেনি। তবে গ্রামের একটা বাচ্চা ছেলে গোরু চরাতে গিয়েছিল। তার গোরুকে ধরে চিতাতে। সেই কেবল দৌড়ে পালিয়ে এসে গ্রামের সকলকে বলে যে, একটা বড় বাঘ তার গোরুকে নিয়ে গেল। ও ছেলেমানুষ, তার আগে বাঘ কি চিতা কিছুই দেখেনি। তাই তার কথায় কেউ আমল দেয়নি।

–ছেলেটার বয়স কত?

 –তা সাত-আট হবে।

যদি কেউ দেখেই না থাকে জানোয়ারটাকে, সেই বাচ্চা ছেলেটি ছাড়া, তাহলে গুলি লাগছে না, বাঘটা যে চিতাবাঘই, গুলি লাগলেও চিতার কিছুই হচ্ছে না, এসব কথা রটল কী করে!

–গুলি তো করেইছে অনেকে। গুলিতে কিছু হয় না ওর।

–যেসব শিকারি গুলি করেছে তারাই তো বলেছে সেকথা। অন্য সাক্ষী কেউ কি আছে?

ঋজুদা বলল, আমি আবারও বললাম রামকে, বাঘটা যে চিতাবাঘই তা কি কেউ নিজচোখে দেখেছে?

–তা আমি বলতে পারব না।

রাম বলল।

এদিকে এত বড় চিতা আছে নাকি? আমার তো পায়ের থাবার দাগ দেখে মনে হল ওটা চিতা নয়, বড় বাঘ।

না, না বাবু ওটা চিতাই। এদিকের রেঙ্গানিকানি, দেওঝরন, যাদুলুসিন পর্বতে এত বড় বড় চিতাবাঘ আছে যে, তারা বাঘের চেয়েও বড়।

-তুমি কী বললে?

আমি জিজ্ঞাসা করলাম ঋজুদাকে।

 ঋজুদা বলল, আমি কী বলব। চুপ করেই রইলাম। ওরা জঙ্গলেরই মানুষ। ওদের অভিজ্ঞতা সারা জীবনের অভিজ্ঞতা। আমার মতো শহুরে শিকারি ওদের তুলনাতে কতটুকুইবা জানি। রাম যা বলছে তাই নিশ্চয়ই ঠিক।

–কিন্তু চিতা যত বড়ই হোক, চিতাবাঘের পায়ের থাবার দাগে আর বড় বাঘের পায়ের থাবার দাগের মধ্যে তফাত থাকে।

তিতির বলল।

–তা তো থাকেই। শিকারি মাত্রই তা জানেন। হাড়িবন্ধুর বড় সম্বন্ধী রাম তা জানতে পারে কিন্তু ওই অঞ্চলের শিকারি যারা এবং হাতিগির্জার সেই বিখ্যাত শিকারি ফাটা-রহমানও একথা বুঝতে পারল না থাবার দাগ দেখার পরও, তা হতে পারে না।

ঋজুদা বলল, ব্যাপারটা রহস্যময় ঠেকল কিন্তু রহস্যটা কীসের তা বুঝতে পারলাম না।

আর কিছুদূর যাবার পরই মড়িটা পাওয়া গেল। বড় বাঘ যেমন করে খায় তেমনই গোরুটার পেছন দিক থেকে খেয়েছে আগে। তারপর তলপেটে দুধের ওলান দুটো বাঁট-টাট সুষ্ঠু খেয়েছে। ডান উরু আর পেছনের সংযোগস্থল থেকেও খেয়েছে কিছুটা। এখানেও দাগ যতটুকু আছে, তাতে আমার মনে হল এ। গোরুখেকো চিতা নয়, বড় বাঘই।

চারদিকে নজর করে দেখলাম যে তেঁতরা, মিটকুনিয়া, রসসি, আম, বাঁশঝাড় এবং সেগুনের জঙ্গলই বেশি। জংলি তেঁতুল ও জামও আছে। আম এতই বেশি যে পাথর-টাথরের উপরে বাঘের প্রতীক্ষাতে রাতে বসাটা ভাল্লুকের কারণে অত্যন্তই বিপজ্জনক। কোনও নিষ্ঠাবতী বিধবা ভালুকী আমের ফলার করতে যদি চলে আসে তবে আমি তাতে বাদ সাধলে সে পেছন থেকে অতর্কিতে ফালাফালা করে দিতে পারে আমাকে। আমাদের দেশের বনে ভাল্লুকের মতো বদমেজাজি এবং আনপ্রেডিকটেবল বন্যপ্রাণী আর দুটি নেই। সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে সে যে-কোনও মানুষের নাক, কান, চোখ, ঠোঁট খুবলে নিতে পারলে বেজায় খুশি হয়। মানুষের নাক, কান, চোখ, ঠোঁট তার খাদ্যও নয় যে জম্পেশ করে খাবে। তবু শুধু ছেঁড়ার আনন্দেই সে ঘেঁড়ে। আর ভাল্লুকে যদি ছেড়ে, তবে কোনও প্লাস্টিক সার্জনের সাধ্য নেই যে সেই মানুষের বীভৎস মূর্তিকে তিনি মেরামত করেন।

তারপরে বল। তুমি আজকাল বড় ডিরেইলড হয়ে যাও গল্প বলতে বলতে ঋজুদা। হচ্ছিল চিতার গল্প, তার মধ্যে এসে পড়ল বাঘ এবং এখন আবার ভাল্লুক। তার উপরে প্লাস্টিক-সার্জন।

ঋজুদা হেসে বলল, বনের গল্প এরকমই হয়। এখানে সব কিছুই বিশ্বাসযোগ্য এবং কিছুই বিন্যস্ত নয়। এখানে আগে থেকে কিছুই ঠিক করে রাখা যায় না এবং ভবিষ্যৎও দেখা যায় না। প্রতি মুহূর্তেই বর্তমান এখানে অতীত হয়ে যায় যেমন, তেমন বর্তমান আবার ভবিষ্যতেও গড়িয়ে যায়।

– তাই তো দেখছি।

বিজ্ঞ ভটকাই বলল।

ঋজুদা পাইপটার ছাই ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলল, দাঁড়া। দাঁড়া। পাইপটা ভাল করে ভরে নিয়ে ভাল করে স্মৃতি হাতড়াই। যেসব কথা তোমাদের বলছি সে কী আজকের কথা।

ইতিমধ্যে রেঢ়াখোলের দিক থেকে একটা মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ মোটর সাইকেলে দু’জন লোক আসছে দেখা গেল, বৃষ্টিভেজা পথ দিয়ে, দু’ পাশের বৃষ্টিভেজা জঙ্গলে মোটর সাইকেলের ভটভটানি শব্দর জোর অনুরণন তুলে। মোটর সাইকেলটা ক্রমশ তার বেগ কমাতে কমাতে আসছিল। কাছে আসতেই, আমরা উৎসুক হয়ে তাকালাম। যে চালাচ্ছে, সে একজন হৃষ্টপুষ্ট মানুষ, আর তার পিছনে, চুলে কদমছাট লাগানো রোগাপটকা একজন মাঝবয়সি মানুষ বসে আছে। তার কাঁধে একটা থার্মোফ্লাস্ক ঝুলছে।

মোটর সাইকেলটা থামতেই ঋজুদা স্বগতোক্তি করল, হাড়িবন্ধু! তু কেমিতি জানিলু যে আম্মমানে এটি আসি।

আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি হেসে হাড়িবন্ধু নামের ব্যক্তিটি বলল, মু আউ কেমিতি জানিবি? রেঢ়াখোল যাইথিলি। সেটি আপনাংকু ড্রাইভার ত্রুষ্ণকু ভেটিল। তাই বাস থেকে নেমে মোড়ের দোকান থেকে আপনাদের জন্য একটু পান্তুয়া, কুচো, নিমকি আর চা নিয়ে এলাম। একটু আগেই বাসে করে আপনাদের সামনে দিয়ে গেছি। আপনাদের দেখে গেছি। ত্রুষ্ণ বলল যে, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে ফিরে আসবে আর্মেচার নিয়ে।

ভটকাই বলল, ফাসকেলাস কাম্ব করিলা ভাই হাড়িবন্ধু।

 তিতির বলল, হাউ থটফুল অ্যান্ড নাইস অফ হিম।

আমি বললাম, কী কো-ইনসিডেন্স! হাড়িবন্ধু কী করে জানল যে এখানে একজন পান্তুয়া-খাঁই আছে!

তারপর আমাদের চা আর নিমকি খাইয়ে, ঋজুদার কুশল নাকি সে আগেই মহানদী কোলফিল্ডস-এর গাড়ির ড্রাইভার ষ্ণ দাসের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল, তাই কুচুয়া গ্রামের সকলের কুশল জানিয়ে হাড়িবন্ধু আবার মোটর সাইকেলের পিছনে বসে ফিরে গেল। যাবার আগে জিজ্ঞেস করে গেল আমাদের আর কিছু সেবা করতে পারে কি না।

ঋজুদা বলল, আর কিছুই লাগবে না। চা আর নিমকি সত্যিই খুব ভাল খেলাম।

–বল, পান্তুয়াও।

ভটকাই বলল।

তারপর মোটর সাইকেল আরোহীকে দেখিয়ে ঋজুদা বলল, এই ভদ্রলোক কে? তোমার কেউ হয়?

না বাবু। ওঁর বাড়ি চারমল-এ। রেঢ়াখখালের মোড়ের চায়ের দোকানে বাবু চা খাচ্ছিলেন। আপনার কথা বলতেই উনি আমাকে নিয়ে এলেন এবং জুজুমারাতে নামিয়েও দেবেন বললেন। আপনার কথা এই অঞ্চলের সব মানুষই মনে রেখেছে, যদিও বহুদিন হয়ে গেছে। তখন আমি সবে বিয়ে করেছি ছেলেমেয়েও হয়নি আর এখন আমার ছেলে এবং মেয়ের ঘরেও নাতি-নাতনি হয়ে গেছে।

তারপরই চালকের পিছনের সিট-এ বসে দু হাত দু’দিকে তুলে দার্শনিকের মতো হাড়িবন্ধু বলল, সময় কী করে যায়। সত্যি! আমাদের এই জীবনটা বড়ই ছোট বাবু।

ঋজুদা মাথা নাড়ল।

তারপর মোটর সাইকেলটা আবার ভটভট করতে করতে চলে গেল।

 হাড়িবন্ধুর উচ্চারিত কথাগুলি পথের দু পাশের ঝাঁটি জঙ্গলে আর ভিতরের গভীর বনে হাওয়ার সঙ্গে হুটোপাটি করতে লাগল। কিছু কিছু কথা, কিছু কিছু মুহূর্ত ঘরের বাইরে, বনের মধ্যে, মনের মধ্যে-ভিতরে এমন করে আলোড়ন তোলে যে তা বলার নয়। আমরা সকলেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাড়িবন্ধুর হঠাৎ ছুঁড়ে দেওয়া কথা কটির গভীরতাতে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। এমনকী ভটকাই-এর মতো বাঁচালও চুপ করে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিতির বলল, এবারে ক্যাটল লিফটারটার গল্পটা শেষ কর ঋজুদা। গৌরচন্দ্রিকাটা বড্ডই লম্বা আর কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে।

ভটকাই বলল, ঠিক তাই। এবারে কাম টু দ্য পয়েন্ট, প্লিজ।

 ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। তারপর একটা আম গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শুরু করল আবার।

–রাম-এর কথা শুনে এবং ওই চিতা নামক বাঘের সম্বন্ধে যা-কিছু আগে শোনা গেছিল তাতে ওই জনশ্রুতির মধ্যে যে এক রহস্য আছে তা আমার মনে হচ্ছিল। সে রহস্য পরে উদঘাটিত হয়েছিল কিন্তু তোরা তো রহস্যগল্প শুনতে চাসনি আমার কাছে, চেয়েছিস শিকারের গল্পই শুনতে।

–হ্যাঁ। তাই তো!

–তাহলে শোন বলি। গোরুর মড়ি দেখে এবং তার আগে বাঘের থাবার দাগ দেখে আমার কোনও সন্দেহই ছিল না যে সেটা বাঘই, চিতা নয়। এবং তাই যদি হয় তাহলে মারা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। মানুষখেকো তো নয়, গোরু-খেকো। তা ছাড়া বাঘ wide hearted gentelman তাকে wide hearted মানুষেরই মতো মারা ভারি সহজ। এবং সহজ বলেই পশু-পাখির রাজা বাঘ এখন অবলুপ্তির পথে। চিতাগুলো ছিঁচকে। মিচকে শয়তান। মানুষের বসতির আশেপাশেই তাদের বাস বলে মানুষের অভ্যেসও তাদের জানা। তাই তাদের মারা অনেকই কঠিন। তা ছাড়া তারা মানুষই মারুক কি পশু, মারে রাতের বেলা। বাঘ বেপরোয়া। সে দিনের বেলাতেই বেশি মারে বলেই তাকে সহজে কাবু করতে পারে শিকারিরা।

.

০৩.

ভটকাই বলল, ও বাবা! আবারও দেখি অন্ধকার করে এল। আবার বৃষ্টি নামলেই চিত্তির। ও ঋজুদা, তোমার বাঘকে তাড়াতাড়ি মারো নইলে আমরা সবাই ভিজে বেড়াল হয়ে যাব যে!

ভটকাইয়ের কথাতে আমরা সকলে হেসে উঠলাম। ঋজুদাও।

তারপর ঋজুদা আবার শুরু করল।

রামকে বললাম, ফিরে যেতে গ্রামে, গিয়ে বন্দুক-রাইফেল যা কিছু হোক কী জোগাড় হল না হল দেখতে। আমি গিয়ে বেছে নেব। গুলিও যেন টাটকা থাকে। পিতলের ক্যাপে যদি সাদা স্যাঁতলা পড়ে গিয়ে থাকে তবে সেগুলি আদৌ ফুটবে না কি ফুটবে না তা ভগবানই বলতে পারেন।

একবার পালামৌর রাংকার জঙ্গলে একটা ভাল্লুকের হাতে মরতে মরতে বেঁচে গেছিলাম। তাই গুলি সম্বন্ধে আমার ভীষণই খুঁতখুঁতানি। সব শিকারিরই তা থাকা উচিত। যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরাই জানেন যে, নিজের আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি ছাড়া বড় জানোয়ার শিকার করতে যাওয়াটা অত্যন্তই বিপজ্জনক।

রাম বলল, আপনি খালি হাতে থাকবেন?

আমি হেসে বললাম, খালি হাতে তো নেই। হাতে তো পাইপ আছেই।

ও কিছু না বলে চলে গেল।

 গোরুর মড়িটা থেকে এগিয়ে গিয়ে একটি টিলা মতো জায়গাতে গিয়ে উঠে চারদিকটা ভাল করে নিরীক্ষণ করলাম আমি। রেঙ্গানিকানি পাহাড়শ্রেণী সুবিস্তৃত এবং বেশ উঁচু। তাতে হাতি সুষ্ঠু সব জানোয়ারই থাকার কথা। যেখানে পাহাড় শুরু হয়েছে তার দূরত্বে এবং উচ্চতাতেই বেশ কয়েকটি গুহা আছে। সেগুন গাছের ছায়াতে সেই সব গুহা গরমের দিনে এবং বর্ষাতেও বেশ আরামপ্রদও। পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরে তিরতির করে জল বয়ে যাচ্ছে একটি নালা দিয়ে। এর নামও হয়তো রেঙ্গানি বা কানি হবে। কুচুয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বলে হয়তো নাম কুচুয়াও হতে পারে। অথবা নালাটার নামই কুচুয়া, তাই হয়তো নালার ধারে পত্তনকরা বসতির নামও কুচুয়া হয়েছে।

তারপর একটু থেমে ঋজুদা বলল, আমাদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে একই নামের ছোট নদী, নালা ও গ্রাম যে কত আছে, তার ইয়ত্তা নেই। বড় নদীর সৌন্দর্য এবং ভয়াবহতার কথা ছেড়েই দিলাম, ছোট ছোট নদী-নালার যে কত বিচিত্র সৌন্দর্য, তা যার চোখ আছে সেই জানে। হাজারিবাগ জেলার ইটখোরি পিতিজ-এর পাশ দিয়ে যে পিতিজ নদী বয়ে গেছে তার একরকম সৌন্দর্য, ওড়িশার লবঙ্গীর পায়ের কাছ দিয়ে মাঠিয়াকুদু নালা বয়ে গেছে বা মধ্যপ্রদেশের সিধি জেলার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আশ্চর্য সুন্দর পুতানি বয়ে গেছে তার সৌন্দর্য বা হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্ক-এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া হারহাত নদীর সৌন্দর্যের কথা যাঁরা বার বার সেই সব নালার কাছে গেছেন শুধু তাঁরাই জানেন। সত্যি সত্যিই, এমন দেশটি কোথাও গেলে পাবে নাকো তুমি।

ভটকাই বলল, ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।

আমি আর তিতির সমস্বরে বললাম, এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।

ঋজুদা বলল, সত্যিই রে! আমাদের দেশের মতো এমন বৈচিত্র্যে ভরা, এমন ভয়ংকর, এমন সুন্দর আর একটিও দেশ নেই পৃথিবীতে। অনেক দেশেই তো পা পড়ল আমার। তোদেরও কম দেশে পা পড়ল না আমার সঙ্গে, বল?

তা সত্যি। তোমার দৌলতে আফ্রিকা, স্যেশেলস কত দেশই তো ঘুরে এলাম। এবং একাধিকবার।

তিতির বলল।

ভটকাই স্যেশেলস-এর কথা উঠতেই হঠাৎই উদাস হয়ে গিয়ে বলল, ভারত মহাসাগরের স্যেশেলস আইল্যান্ড-এর কেসটার মধুরেণ সমাপয়েৎ হল না, এই একটু দুঃখ রয়ে গেল। সেই মেমসাহেবকে, কোটি-কোটিপতি অপরূপ সুন্দরীকেও তুমি টাকা-কেন্নোর মতো দু আঙুলে টোকা মেরে হঠিয়ে দিলে ঋজুদা! আমার আর রুদ্রর এ জীবনে কখনও নিতবর হওয়া আর হবে না। হ্যাঁ ভাবি হো তো অ্যায়সা।

তারপর আমাকে বলল, যতই বলিস রুদ্র, তোর বই ‘ঋজুদার সঙ্গে স্যেশেলসে’র শেষটা তোর অন্যরকম করা উচিত ছিল।

আমি আর তিতির ভটকাই-এর আস্পর্ধাতে স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। ভাবলাম, ঋজুদা বুঝি হঠাৎ চটে উঠবে। কিন্তু না। ঋজুদা বলল, জ্যাঠামি করবি? না বাঘ শিকারের গল্পটা শুনবি? মাঝে মধ্যে ফাজলামি খারাপ লাগে না। তবে তুই মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়িয়ে যাস।

ইনকরিজিবল ভটকাই মাটির দিকে চোখ নামিয়ে ওর কাবলি স্যান্ডেলের মধ্যে পায়ের নখগুলো আগুপিছু করতে করতে বলল, আমি ফাজলামি করিনি। তোমার সঙ্গে তো আমার ফাজলামির সম্পর্ক নয়। আমি সিরিয়াসলি বলছি। ঋজুদা, তুমি বড়ই দাগা দিলে আমাদের।

এমন করেই বদমাইস ভটকাই কথাটা বলল যে, আমরা তো বটেই ঋজুদাও হো হো করে হেসে উঠল। বলল, তুই সার্কাসের ক্লাউন হয়ে যা, মানাবে ভাল।

–ঠিক আছে। আর কিছু বলছি না আমি। এখন ব্যাক টু কুচুয়া গ্রাম অ্যান্ড রেঙ্গানিকানি পাহাড় অ্যান্ড চিতা আর বাঘের গল্পে।

ভটকাই বলল।

তিতির বলল, শুরু করো ঋজুকাকা। এইখানে জঙ্গলের মধ্যের পথপাশের এই আম গাছতলির পাথরে বসে তোমার মুখ থেকে গল্পটা শুনতে যেরকম ভাল লাগছে তেমন কি আর চলন্ত গাড়িতে যেতে যেতে শুনতে ভাল লাগবে। ড্রাইভার ত্রুষ্ণ দাস তো চলে আসবে সূর্য ডোবার আগেই।

–কোথায় যেন ছিলাম?

ঋজুদা বলল। এই ভটকাই বাঁদরটা দিল সব গোলমাল করে।

ভটকাই-ই বলল, রেঙ্গানিকানি পাহাড়ের পাদদেশে একটা টিলার উপরে। পাহাড়ের গায়ে যে অনেকগুলি গুহা আছে, তাই দেখছিলে।

–হুঁ। ঠিকই বলেছিস।

প্রকাণ্ড ঘাসবনের মাঝে কয়েকটা তেঁতরা, রসসি ও মিটকুনিয়া গাছ। কখনও বোধহয় ক্লিয়ার-ফেলিং হয়েছিল। বনবিভাগ আর প্ল্যানটেশন করেনি। ঘাসবন হয়ে গেছে। মড়িটার চারদিকে ঘুরে দেখলাম। একটা পাকদণ্ডি জানোয়ার-চলা game track চলে গেছে ঘাস মাড়িয়ে, নদী পেরিয়ে সেই পাহাড়ের দিকে। সকালে বৃষ্টিটা না হলে ওই নালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই সবকিছু জানা যেত, কে যায়? কে আসে? কোনদিকে যায়। কিন্তু সব দাগ ধুয়ে গেছে।

ঠিক করলাম, ভরসা করতে পারি এমন বন্দুক বা রাইফেল একটা জোগাড় হলে বিকেলে এসে গোরুর মড়ির কাছের ঝাঁকড়া তেঁতরা গাছটাতে উঠে বসে থাকব। গাছটাতে ওঠবার পরেই বোঝা যাবে, তাতে বসে মড়ি দেখা যাবে কি না এবং দেখা গেলেও বাঘ মড়িতে এলে তাকে মারা যাবে কি না। গাছে না উঠে তা বলা যাবে না।

এখন যদিও শুক্লপক্ষ। হয়তো সপ্তমী অষ্টমী হবে। বাতের রুগি, নিষ্ঠাবতী হিন্দু বিধবা এবং মুসলমানেরা ছাড়া চাঁদের খবর আর কে রাখে! আর রাখে মধুচন্দ্রিমা যাপন করা নববিবাহিতারা। চাঁদের হিসাব আমার কাছে ছিল না। কিন্তু আকাশে মেঘ ছিল এবং এমন গুমোট করেছিল যে, মনে হচ্ছিল বিকালের দিকে আবারও বৃষ্টি নামতে পারে। বাঘের আস্তানা যদি ওই গুহার মধ্যেই হয় তবে বাঘ কোথা থেকে নেমে কোথা দিয়ে গোরুর মড়িতে আসতে পারে তার একটা আন্দাজ করে নিলাম। তারপর গ্রামের দিকে হেঁটে চললাম।

গ্রামের কাছে যখন পৌঁছে গেছি, সবুজ লুঙ্গি-পরা একজন মাঝবয়সি নোক, দেখলাম আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার ডান হাতে একটা পিতলের বদনা।

–বদনাটা কী জিনিস?

 তিতির জিজ্ঞেস করল।

মুসলমানদের ঘটি। সামনেটা সরু থাকে। দেখিসনি কখনও? দেখেছিস নিশ্চয়ই, লক্ষ করিসনি। দেখা আর লক্ষ করার মধ্যে তফাত আছে।

তারপর বলল ঋজুদা, লোকটা সম্ভবত প্রাকৃতিক প্রয়োজনে নালার দিকে চলেছে। সে আমার দিকে বিরক্তির সঙ্গে একটুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আপনাকেই চিতাটা মারার জন্য হাড়িবন্ধু ধরে নিয়ে এসেছে বুঝি বাবু?

হ্যাঁ। কিন্তু ওটা চিতা নয় বড় বাঘ।

–ওর রূপের কথা আল্লাই জানেন। কখন যে সে কোন ভেক ধরে। এখানের মানুষেরা বলে এটা সমলেশ্বরীর বাঘ।

–কেন বলে? জঙ্গলে তো ঠাকুরানিও আছেন। জঙ্গলের বাঘ যদি দেবীর কৃপাধন্য হয় তবে তাকে ঠাকুরানির বাঘ না বলে অতদূরের সম্বলপুর শহরের

অধিষ্ঠাত্রী দেবী সমলেশ্বরীর নামে কেন ডাকে মানুষে?

–আমি তো মুসলমান বাবু। এসব কথা গ্রামের কোনও হিন্দুকে জিজ্ঞেস করলে সেই বলতে পারবে। তবে এটুকু বলতে পারি যে, এই বাঘ আপনি মারতে পারবেন না। উলটে আপনারই বিপদ ঘটতে পারে।

ঋজুদা বলল, লোকটাকে আমার পছন্দ হল না। তারপর আমার বিপদের জন্য তার এত মাথাব্যথা আমার আরও পছন্দ হল না। কিন্তু মনের ভাব মনে রেখে বললাম, কেন?

–এই বাঘের গায়ে গুলি লাগলেও এ মরে না। বহু শিকারি গুলি করেছে। তাতে রক্ত পর্যন্ত বেরোয়নি।

–তাই? এতজনই যদি বাঘটাকে চাঁদমারি করল তা আমিও না হয় একটা গুলি ঠুকে দেখি।

–সে আপনার ইচ্ছে। জানটা তো আপনার নিজেরই।

–তা তো অবশ্যই।

ভালর জন্যই বললাম বাবু। কথাটা ভেবে দেখবেন।

সে কথার জবাব না দিয়ে আমি তাকে শুধোলাম, এই অঞ্চলে এই চিতা বা বাঘ বা ভূত এ পর্যন্ত কতগুলো গোরু-মোষ মেরেছে?

এদিকের গ্রামের মানুষ মোষ পোষে না। পোষে গোরু এবং বলদ। তা বহুতই মেরেছে। কোনও গোন-গুনতি নেই।

বাবাঃ। অতগুলো! তবে তো খুবই ক্ষতি হয়ে গেছে এদিকের লোকের। আমি বললাম।

–তা তো নিশ্চয়ই। কিন্তু কী আর করা যাবে।

এই বলেই লোকটা হাতের বদনাটা দোলাতে দোলাতে চলে গেল নালাটার দিকে।

–আপনার নাম কী?

–মহম্মদ জব্বার মহম্মদ।

–ও।

–এই নালাটার কী নাম?

-রেঙ্গানিকানি।

–ও।

এমন সময়ে ভটকাই বলল, একটা গোরু বা বলদ মরলে কত ক্ষতি হয়? মানে, কত টাকার?

টাকার হিসেবে ক্ষতি হয় অনেকই। এখানকার গ্রামের মানুষের কাছে একটি বলদের সঙ্গে হরিয়ানা বা পাঞ্জাবের গ্রামের একটি ট্রাক্টরের তুলনা করা চলে। তা ছাড়া, গোরু যদি বাঘে মারে, তবে আর্থিক ক্ষতিরও উপরে ইমোশনাল অর্থাৎ মানসিক ক্ষতিও তত কম হয় না। যেদিন গোরুটিকে প্রথম কিনে আনে গ্রামের কোনও মানুষ সেদিন তার পা ধুইয়ে তাকে চান করিয়ে সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তোলা হয়। সে যদি বাড়ির গাইয়ের বাছুর হয়, তবে তার সঙ্গে বাড়ির শিশুদের খেলার সাথীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গোরু হল গ্রামীণ মানুষের লক্ষ্মী। তার এই রকম রক্তাক্ত বিয়োগান্ত পরিণতিতে কারওরই তো সুখী হবার কথা নয়। এই গ্রামীণ ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে, আর ভারতবর্ষের অধিকাংশই তো এখনও গ্রামই, গোরু নিছক একটি প্রাণীমাত্রই নয়, সে পরিবারের সদস্যও। তাদের নাম থাকে, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা। বাড়ির বড় এবং ছোটরা সেই নামে তাকে ডাকে। আদর করে। তার এই রকম মৃত্যু মোটেই সুখপ্রদ ব্যাপার নয়।

ঋজুদা বলল।

আগে বাড়ো ঋজুদা। আবার ডিরেইলড হচ্ছ তুমি।

ভটকাই ঋজুদাকে ওয়ার্নিং দিল।

-তারপর?

তিতির বলল।

তারপর হাড়িবন্ধুদের বাড়িতে ফিরে গিয়ে দেখি তিনটি দোনলা বন্দুক জোগাড় হয়েছে। আরও একটি গাদা বন্দুক। একনলা। দোনলা বন্দুকের মধ্যে একটি ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স কোম্পানির, আঠাশ ইঞ্চি ব্যারেলের। বন্দুকটি এক জোতদারের। ডাকাতদের ভয় পাওয়াবার জন্য কেনা, তা দিয়ে একটি গুলিও সম্ভবত ছোঁড়া হয়নি। বন্দুকটির ব্রিচ ভেঙে আলোর দিকে ব্যারেল তুলে দেখলাম ব্যারেল একেবারে ঝকঝক করছে। খুবই যত্ন করে রাখা হয়েছে বন্দুকটিকে। এতই যত্ন করে যে মালিকের বোধহয় এটি ব্যবহার করে পুরনো করার কোনও অভিপ্রায়ই নেই। নিজের বাড়িতে ডাকাত পড়ুক তা কে আর চায়। শুনলাম, সেই জোতদারেরই সাত-সাতটি গোরু মেরেছে বাঘে।

গুলিগুলোও নতুন। দুটি প্লাস্টিক সেল-এর আমেরিকান কার্টিজও ছিল। লেথাল বল, ইংলিশ ইলি-কোম্পানির এবং ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স কোম্পানির এল. জি.।

অন্য দুটি বন্দুক মুঙ্গেরি, হ্যামার ট্রিগারওয়ালা। হ্যামার তুলে তারপর ট্রিগার টানতে হয়।

রামকে বললাম যে, জোতদারের বন্দুকটিই নেব। গুলির হয়তো প্রয়োজন হবে একটি কী দুটির কিন্তু নিলাম ছটি গুলি। তিনটি বল, তিনটি এল. জি.

রাম বলল, বহুত বড্ড বড্ড ডাবল বারা অচ্ছি এটি। গুট্টে বড় বারা মারি দেলে আম্মেমানে শিকার খাইথান্তি।

-মানে কি হল?

তিতির বলল।

বলে দে রুদ্র মেমসাহেবকে। এদিকে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশে বিশারদ অথচ ওড়িয়া অহমিয়া কিছুই জানে না। লজ্জার কথা।

আমি বললাম, এখানে খুব বড় বড়, মানে পেল্লায় বড় সব শুয়োর আছে। একটা বড় শুয়োর মেরে দিলে আমরা মাংস খেতে পারতাম।

তিতির বলল, শুয়োর। ম্যাগো!

আমি বললাম, হ্যাম, বেকন, সসেজ যখন খাও তখন বুঝি শুয়োর খাওয়া হয় না? দিশি শুয়োরের নামেই উঃ ম্যাগো।

ভটকাই বলল, শুয়োর যে ময়লা খায়!

–মোটেই না। বুনো শুয়োর ফল-মূল খায়। রামচন্দ্রও বন্য বরাহ খেতেন। তাও জানো না।

ঋজুদা বলল, বুনো শুয়োরের ভিন্দালু যা হয় না! আহা!

আমি বললাম, আবার সব গুলিয়ে দিচ্ছ তুমি ঋজুদা। আজ বড়ই গুবলেট করছ তুমি।

–হ্যাঁ। ফিরে যাই।

তারপর বলল, আমি রামকে জিজ্ঞেস করলাম, মহম্মদ জব্বার মহম্মদ লোকটা কে?

জব্বার? সে তো চামড়ার ব্যবসায়ী।

–এ গ্রামেই সে থাকে?

না তো৷ এখানে আসে যায়। আবু আলিরা একঘর মুসলমান থাকে কুচুয়াতে। সে কসাই। জুজুমারা এবং চারমলেও হাটের দিন খাসে কাটে আর বিক্রি করে। আবু আলিরই কী রকম রিস্তেদার হয় মহম্মদ জব্বার মহম্মদ। বাঘে বা চিতাতে গোরু মারলে সেই গোরুর চামড়া আবু ছাড়িয়ে রাখে, মহম্মদ জব্বার মহম্মদ এসে নিয়ে যায়।

–জব্বার কি ইদানীং একটু ঘন ঘন আসছে তোমাদের গ্রামে?

–হ্যাঁ তা তো আসবেই। গোরু তো মারা পড়ছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই। সেই চামড়ার সদগতি তো ওরাই করে। আমরা পোষা গোরুর চামড়া বিক্রি করি না কোনও দামও নিই না–অনেক সময় ওরা মরা গোরুর মাংসও কেটে নিয়ে বিক্রি করে আশপাশের মুসলমান গ্রামে।

–সে কী! হালাল না করা মাংস মুসলমানেরা খায় নাকি? তাদের ধর্মে তো মানা আছে।

–যেখানে বিক্রি করে সেখানে গিয়ে থোই বলে যে চিতাতে মারা গোরুর মাংস। বলে, হালাল-করা মাংসই।

ভটকাই বলল, বুঝবে মহম্মদ জব্বার মহম্মদ। এই পাপের জন্য গুনাহ লাগবে তার। দোজখ-এ যেতে হবে।

এই অবধি বলে ঋজুদা বলল, এবারে বসি একটু। পাইপ খাই একটু। কোথায় যে গেল মিস্টার ত্রুষ্ণ দাস।

–সে ঠিকই এসে যাবে। হাড়িবন্ধুর কাছে তো শুনলে। সে আসার আগে তুমি গল্পটা শেষ করো।

–হ্যাঁ। তবে মনে করিস তো রেঢ়াখখালে পৌঁছে বিমলবাবুকে একটা ফোন করে দিতে হবে। নইলে চিন্তা করবেন। বউদির হাতের রান্না তো খাসনি। খেলে বুঝবি।

একটা বড় কালো পাথরের উপরে বসে দু’ দিকে দু পা ছড়িয়ে দিয়ে ঋজুদা বলল, দুপুরে আমাকে খুব খাওয়াল রাম এবং হাড়িবন্ধুরা মিলে। খুব তৃপ্তি করে খেয়ে আমি বললাম এবারে ঘুম লাগাব একটা। চারটের সময়ে আমাকে তুলে দেবে।

-চা খাবেন তো?

–যদি খাওয়াও তো খাব।

.

০৪.

একটা টর্চ-এর কথা বলে রেখেছিলাম। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ চেয়েছিলাম কিন্তু তিন ব্যাটারির চেয়ে বড় জোগাড় করতে পারেনি ওরা। তবে টর্চটা ভাল। মানে, দেখতে ভাল। অন্ধকার হলেই বোঝা যাবে সত্যি সত্যিই কতখানি ভাল। দুটি গুলি, দু’ব্যারেলে ভরে এবং দুটি গুলি প্যান্টের পকেটে পুরে নিয়ে যখন বেরিয়ে পড়লাম তখন সোয়া চারটে বাজে। অকুস্থলে পৌঁছতে কম করে মিনিট কুড়ি লাগবে। সূর্য ডুবতে ডুবতে প্রায় ছটা বাজবে কিন্তু গোরুটাকে বাঘ যেখানে লুকিয়ে রেখেছে সেই জায়গাটা একটা দোলামতো। তা ছাড়া পশ্চিমেই জঙ্গলাবৃত রেঙ্গানিকানি পাহাড়শ্রেণীর সমান লম্বা এবং বেশ উঁচু পিঠ থাকাতে সূর্য অস্তে যাবার অনেক আগেই এই রঙ্গমঞ্চ, মানে যেখানে নাটক মঞ্চস্থ হবে, পশ্চিমের পাহাড়ের আড়ালে ডুবে যাবে তাই এই পাহাড়তলিতে অন্ধকার নেমে আসবে হয়তো পৌনে ছটা নাগাদ অথবা তারও আগে।

সূর্য অস্ত যাবার পরেও, আকাশে যদি মেঘ না থাকে তবে বনে-জঙ্গলে, প্রান্তরে অনেকক্ষণ অবধি আলোর আভাস থাকে। প্রথমে তার রং থাকে কমলা, তার পর বেগনে, তারও পর তার কোনও রং থাকে না কিন্তু তার আলোর আভাস বিলক্ষণই থাকে। অনেকক্ষণ। সেই আভাসই শটগান দিয়ে নিশানা নেবার পক্ষে অনেকই আলল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুপুর থেকে পরতের পর পরত কালো মেঘ সাজছে আকাশে। মনে হচ্ছে যেন বর্ষাকাল। সারা পৃথিবীর আবহাওয়ার বদল হওয়া শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হল। এখন, আমাদেরই নানা পাপের কারণে, বন-বিনাশের কারণে, গ্রীষ্মে বর্ষা, বর্ষায় গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মে শীত এবং শীতে গ্রীষ্ম। ঈশ্বরই জানেন, ভবিষ্যতে আরও কী ঘটবে অঘটন।

জায়গাটাতে পৌঁছে সকালে দেখে যাওয়া তেঁতরা গাছটাতে না বসে একটা মিটকুনিয়া গাছে উঠে বসলাম। কারণ, সেই গাছটাতে কাণ্ডর ফিট পনেরো উপরে দুটো বেশ মোটা ডালের সঙ্গমস্থলে বসার সুবিধা হবে। কাণ্ডতে হেলান দিয়েও বসা যাবে। সারারাত বসে থাকতে হবে কি না তাও তো অজানা। তাই বসার জায়গাটা একটু সুবিধাজনক হওয়া দরকার।

বাঘ যেদিক দিয়েই আসুক, মড়ির কাছে এলে তাকে আসার পথে দেখা যাবেই, যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে, মানে মেঘে ঢাকা না থাকে। বাঘের যাওয়া-আসার শব্দ বড় একটা শোনা যায় না। বনের খবর জেনেই তার যাতায়াতের আন্দাজ করতে হয়। তবে জায়গাটা ঘাসবনের মধ্যে বলেই সুবিধা। তবে একবার গাছের ঘন ছায়াতে দোলার মধ্যে ফেলে-রাখা মড়িতে বাঘ পৌঁছে গেলে বাঘকে আর দেখা যাবে না। খাওয়া শুরু করলে অবশ্য তার মড়মড় আর কটাং কটাং করে হাড় কামড়ানোর এবং চপ চপ করে মাংস চিবোনোর আওয়াজ নিস্তব্ধ রাতে ঠিকই শোনা যাবে। দেখা যদি নাও যায়, তাহলে আমাদের রামায়ণ-মহাভারতের মহাপুরুষেরা যেরকম শব্দভেদী বাণ মারতেন, তেমনই শব্দভেদী গুলি করতে হবে। কী করতে হবে না হবে, তা এখন ভেবে লাভ নেই। অবস্থা বুঝেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

তার পরে? থামলে কেন ঋজুকাকা?

তিতির বলল।

দাঁড়া। গলা তো শুকিয়ে গেছে। যা তো ভটকাই গাড়ি থেকে জলের বোতলটা নিয়ে আয় তো। গলাটা ভিজিয়ে পাইপটা আরেকবার ফিল করে নিয়ে শুরু করি।

ভটকাই গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, আর কতটুকু বাকি আছে গল্প শেষ হতে ঋজুদা? আর কি এক ‘ফিল’-এর?

ঋজুদা এবং আমরাও হেসে উঠলাম ওর কথাতে। পারেও বটে ভটকাই। এক গরাসের খাদ্য’, ‘এক ঘণ্টার পথ’, ‘এক ছিলিমের তামাক, এসব জানা ছিল কিন্তু পাইপের এক ফিল-এর গল্প’র কথাটা ভটকাই-এরই সৃষ্টি।

–ভটকাই দেখছি ফিলোলজিস্ট হয়ে উঠেছে রে!

 ঋজুদা বলল।

–ফিলোলজিস্ট হবে কি না জানি না তবে ঋজুদা দিনমানেই এখানে যা মশা, ফাইলেরিয়া ভটকাই-এর হতেই পারে। এগুলো ফালসিফোরাম-বাহী মশা নয় তো! ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে মাথাতে যা যন্ত্রণা হয় তার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল।

ঋজুদা বলল, এখানকার মশার কামড়ে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয় বলে শুনিনি। তবে সিমলিপাল, নেফার নামধাপা ইত্যাদি বনের মশারা ম্যালিগনান্ট ম্যালেরিয়ার জন্য কুখ্যাত। অঙ্গুল ডিভিশনের লবঙ্গীর জঙ্গল থেকে ফিরেও একবার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে পড়েছিলাম।

–কতবার হয়েছে যেন তোমার? ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া ঋজুদা?

ভটকাই বলল, ফিরে এসে।

 –কেন? তোরা শুনিসনি?

–তিনবার। ভটকাই জানবে কী করে! ও তো দু’দিনের বৈরাগী, ভাতকে বলে অন্ন। কতদিন হল ও চেনে তোমাকে!

তিতির ভটকাইকে এক গোল দিয়ে বলল।

ঋজুদার জল খাওয়া হলে ভটকাইও ঢক ঢক করে এক লিটার জলের বোতল থেকে জল খেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে দিল। জল খেয়ে, ইতিমধ্যেই নতুন টোব্যাকোতে ফিলকরা পাইপটাতে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বেলে ঋজুদা অনেকখানি ধোঁয়া ছাড়ল।

ভটকাই বলল, চলো, ফিনসে শুরু করো ঋজুদা। এতক্ষণে বাঘ বোধহয় এসে গেল।

ঋজুদা শুরু করল।

–আমাদের দেশের পাহাড়বন সন্ধে নামার আগের অনেকক্ষণ সময় পাখিদের কলকাকলিতে এমন করে ভরে ওঠে যে, ইচ্ছে করে সূর্যকে ডেকে বলি, আপনার অন্য কোথাও কাজ আছে কি? তাহলে সেরে আসুন বরং। তার পরে ফিরে আসুন। যাবার এত তাড়া কীসের?

পাখিদের তখন কত যে হাঁকাহাকি, ডাকাডাকি, কত মিটিংকনফারেন্স তা ভাল করে মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুক ভরে যায়। বিজ্ঞানীরা তো বটেই, আজকাল অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষই জোরের সঙ্গে বলেন যে, ভগবান-টগবান নেই। সব বোগাস। ঈশ্বরবাবু একসময়ে থেকে থাকলেও আমরা তাকে একেবারে ঝেটিয়ে বিদেয় করেছি। এখন কম্পিউটার আর ঈশ্বরবাবু সমার্থক। কিন্তু বনে-জঙ্গলে শিশুকাল থেকে ঘুরে ঘুরে আমিও বোধহয় গ্রাম্য, অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গেছি। নইলে ঈশ্বর যে নেই, একথা জোরের সঙ্গে বলতে পারি না কেন বল? কে এমন রং লাগাল বনে বনে, কে এতরকম পাখি, ফুল, প্রজাপতি, পোকামাকড়, পশুর সৃষ্টি করল; করে, তাদের প্রত্যেকের চেহারা-ছবি আলাদা করে, তাদের গলাতে এত বিভিন্ন রকম স্বর দিল? অতটুকু-টুকু পোকা-মাকড়কেও আমাদের যা কিছু আছে তার সবই দিল, শুধু ধর্মবোধটুকু ছাড়া? কী করে মানি বল যে, এত কোটি কোটি গ্রহনক্ষত্র নিচয় যার মন্ত্রবলে আবর্তিত হচ্ছে, যার যার কক্ষপথে যুগ যুগান্ত ধরে ঘুরে চলেছে সে কেউই নয়? এই পৃথিবীর দাম এই ব্রহ্মাণ্ডর প্রেক্ষিতে কতটুকু? আর এই পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা, এই সর্বজ্ঞজনেরা কি এই ব্রহ্মাণ্ডর সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মাথাতে উড়ন-চাঁটি মেরে বেড়াবার মতো জ্ঞানী হয়ে গেছি বলে মনে করিস তোরাও, এই ইয়ং-বেঙ্গলের প্রতিনিধিরা?

আমরা সকলেই চুপ করে রইলাম। বুঝলাম যে, ঋজুদাকে এখন কথাতে পেয়েছে। সকলকেই পায় কখনও কখনও। এখন বাদী-বিবাদী কোনও পক্ষ সমর্থন করতে যাওয়াটাই মূখামি।

কিছুক্ষণ সকলেই চুপ করে রইলাম।

তিতির বলল, সূর্য কি ডুবল অবশেষে ঋজুকাকা?

বাঘ কি এল?

ভটকাই বলল।

–হ্যাঁ। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই বৃষ্টি নামল। সঙ্গে দমক দমক হাওয়া। মে মাসের শেষেও রীতিমতো ঠাণ্ডা লাগতে লাগল। বন্দুকের নলটাকে নীচের দিকে করে যাতে বৃষ্টির জল নলের মধ্যে ঢুকে না যায় তাই, আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলাম। তখনও গাছের ছত্রছায়ায় আছি বলে জল মাথার উপরের দিক থেকে আসছিল না চারপাশ থেকে আসছিল কিন্তু গাছটা পুরো ভিজে গেলেই আসতে শুরু করবে।

-তারপর?

ভটকাই বলল।

মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ-এর আলোতে পাহাড়তলি আলোকিত হয়ে উঠছে। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু তারই কী রূপ। বৃষ্টিস্নাত গাছগাছালি যেন রুপোঝুরি হয়ে যাচ্ছে। গুহাগুলোর বাইরের কালো পাথরের স্তূপ ওই সাদা আলোতে ভারি রহস্যময় দেখাচ্ছে।

বাঘ তো বিড়াল পরিবারের সদস্য। ওরা এমনিতে জল পছন্দ করে না। শীতকালের রাতে যখন গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে টুপটুপিয়ে তখন দেখা যায় বাঘ জঙ্গল এড়িয়ে বনের পথের উপর দিয়ে হাঁটছে অথবা পথে বসে আছে। যতক্ষণ বৃষ্টি চলবে, ততক্ষণ বাঘ গুহাতেই সেঁধিয়ে থাকবে হয়তো। আধঘণ্টাটাক চলল বৃষ্টি। তারপরই আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। শুক্লপক্ষ, কিন্তু সপ্তমী বা অষ্টমী হবে। ছোট হলেও উঠল চাঁদ এবং বৃষ্টিশেষের মিশ্রগন্ধবাহী হাওয়াতে আন্দোলিত ডালে পাতায় বৃষ্টিভেজা বন প্রান্তরে পিছলে-যাওয়া চাঁদের আলো আর অন্ধকারের বাঘবন্দী খেলা শুরু হল।

এমন সময় একটা কোটরা হরিণ খুব ভয় পেয়ে ডাকতে ডাকতে পাহাড়তলিতে উত্তর থেকে দক্ষিণে দৌড়ে গেল পড়ি কি মরি করে। তার ধ্বাক্ ব্বাক্ ব্বা আওয়াজ বনে-পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলল। বৃষ্টির পরে বনের শব্দগ্রহণ ও শব্দপ্রেরণ ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায় তাই সেই ডাক দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে গেল। তারপরই দুটো প্যাঁচা কিচি-কিচি-কিচর-কিচর-কিচি আওয়াজ করে পাহাড়তলির আকাশে ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে ঝগড়া করতে লাগল।

তিতির বলল, প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি খাসা তোর চেঁচানি।

বাঃ। ম্যামসাহেবও দেহি বাংলা কইতাছে। ফাস্টোকিলাস। তুমারে একদিন শিদল শুঁটকি রান্না কইর‍্যা খাওইবার লাগব।

ভটকাই ফুট কাটল।

ঋজুদা বলল, সত্যিই যদি খাওয়াস তাহলে আমাকেও ডাকতে ভুলিস না ভটকাই।

আমি বললাম, তোরা ইন্টারাপট করার সময় পেলি না? বলল ঋজুদা।

–হ্যাঁ। প্যাঁচাঁদের ঝগড়া শেষ হতেই পাহাড়ের গা থেকে দুরগুম দুরগুম দুরগুম দুরগুম করে ডেকে উঠল সব প্যাঁচাঁদের ঠাকুরদা কালপ্যাঁচা। ওই প্যাঁচা যখন ডাকে তখন বুকের মধ্যে হাতুড়ি পড়তে থাকে। সে দেখতেও যেমন, তার ডাকও তেমন। সে ডাকের অনুরণন মিলিয়ে যেতে না যেতেই একজোড়া রেড-ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ টিটির-টি-টিটির-টি অথবা ডিড-উ-ডু-ইট ডিড-উ-ডু-ইট করে ডাকতে ডাকতে চাল-ধোয়া জলের মতো হালকা সাদা চাঁদের আলোর পাতলা আস্তরণ ভেদ করে তাদের লম্বা লম্বা পাগুলি ঝোলাতে ঝোলাতে দোলাতে দোলাতে ওই গুহাগুলোর দিক থেকে এদিকে আসতে লাগল। বুঝলাম, বাঘ এবারে গাত্রোত্থান করেছে। এবং যেমন ভেবেছিলাম, ওই গুহাগুলোরই একটার মধ্যে তার আস্তানা।

-তারপর?

আমরা সমস্বরে এবং রুদ্ধশ্বাসে বললাম।

–তার একটু পরই পাহাড়তলিতে ঘাসবনে আন্দোলন উঠল। বুঝলাম, বাঘ সোজা এদিকেই আসছে। এমন বীরদর্পে এবং throwing all caution to the winds কোনও বাঘকে তার মারা জানোয়ারের মড়িতে আসতে দেখিনি। এই বাঘ, তার মারা মড়িতে কখনও ফিরে আসে না বলে যে জনশ্রুতি আমাকে শোনানো হয়েছিল তা সর্বৈব মিথ্যা যে, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ রইল না এবং এই জনশ্রুতি কে বা কাদের বানানো সে সম্বন্ধেও একটা অস্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠেছিল আমার মনে।

তেঁতরা গাছটার নীচে এমনই অন্ধকার যে বাঘ সেখানে একবার ঢুকে পড়লে বাঘের উপরে চাঁদের আলো আর পড়বে না। বন্দুকে ক্ল্যাম্পও লাগানো নেই। থাকলে তিন ব্যাটারির টর্চটা ফিট করে নেওয়া যেত ব্যারেলের সঙ্গে। এই বোকা বাঘ যেভাবে আসছে সেই ভাবেই যদি এগিয়ে আসে একটুও সাবধানতা অবলম্বন করে, তবে সে গাছতলির অন্ধকারে সেঁধোবার আগেই তাকে গুলি করব বলে ঠিক করলাম। বাঘ যখন প্রায় একশো গজ মতো দূরে তখনও তার শরীর দেখা যাচ্ছিল না। ঘাসের মধ্যে ঘাসের মাথাগুলির নড়াচড়া দেখেই তার উচ্চতা এবং দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যাচ্ছিল মাত্র। মস্ত বড় বাঘ এবং হয়তো বুড়োও। নইলে বন্যপ্রাণী শিকার না করে দুধেল গোরুদের তার নিয়মিত খাদ্য তালিকাতে ঢোকাবেই বা সে কেন? অথবা কোনও আনাড়ি ও দায়িত্বজ্ঞানহীন শিকারির ছোঁড়া গুলিতে সে প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে।

-তারপর?

ভটকাই অধৈর্য হয়ে বলল।

তারপর আমি টর্চটাকে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে খুবই আস্তে আস্তে বন্দুকটাকে কাঁধে তুললাম যাতে সেই নড়াচড়া বাঘের চোখে না পড়ে। আমার ডান বাহুর সংযোগস্থলে বন্দুকের কুঁদোটাকে টাইট করে ধরে বাঁ হাতের পাতা দিয়ে লক-এর নীচে ধরে ডান হাত দিয়ে স্মল-অফ-দ্যবাট চেপে ধরে তর্জনী ট্রিগার গার্ডের উপরে ঠেকিয়ে রাখলাম। ডান হাতের বুড়ো আঙুল রইল সেফটি ক্যাচের উপরে।

একটু চুপ করে থেকে নিভে যাওয়া পাইপেই আরেক টান লাগিয়ে ঋজুদা বলল, বাঘের মাথাটা ঘাসবনকে চিরে আগে আগে আসছে। সব বাঘই তার সামনের দু’ কাঁধের মধ্যে শরীরটাকে ঝুলিয়ে দিয়ে যেমন ছন্দোবদ্ধ হয়ে হাঁটে তেমনি করেই হাঁটছে এও। তার শরীর বা মাথা দেখা যাবে না, ঘাসের আন্দোলন দেখেই আন্দাজ করে মারতে হবে এবং মারতে হবে সামান্য পরেই। বাঘের মনে, মড়ির কাছে যে তার বিপদ থাকতে পারে সে সম্বন্ধে আদৌ কোনও সন্দেহই জাগেনি দেখে অবাক হলাম আমি। সত্যিই কোনও বাঘকে এমন অদ্ভুত ডেয়ার-ডেভিল ব্যবহার করতে দেখিনি আগে। এ যেন আত্মহত্যা করবে বলে মনস্থির করেই এসেছে। কে জানে এর হয়তো খুবই খিদে পেয়েছে, অথবা প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে যে, তাও হতে পারে। যাই হোক, বাঘ যখন পনেরো গজ দূরে তখন তার মাথাটা এবং ঘাড়টা কোথায় হতে পারে, প্রায় মাটি থেকে সাড়ে তিন চার ফিট উচ্চতাতে সামান্য lead দিয়ে সেফটি ক্যাচ অন করেই ট্রিগার টানলাম।

-তারপর?

আমরা আবারও সমস্বরে প্রশ্ন করলাম।

–ডান দিকের ব্যারেলে লেথাল বল ছিল। ইংলিশ ইলি-কিক কোম্পানির। বলটা গিয়ে বাঘের শরীরের কোথায় লাগল তা বোঝা গেল না, মানে কানে, না ঘাড়ে, কিন্তু কোনও শব্দ না করে বাঘ ঘাসের মধ্যে ডুবে গেল।

–গুলি যে লাগলই তা জানলে কী করে। বাঘ তোমাকে ভড়কি দেওয়ার জন্যে যে ঘাসের মধ্যে মাটিতে বসে পড়েনি তাই বা কী করে জানলে?

ভটকাই বলল।

আমি বললাম, তুইও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠ, তখন গুলির শব্দ শুনেই বুঝতে পারবি গুলি গন্তব্যে পৌঁছল না ফাঁকাতে হাওয়া-কেটে বেরিয়ে গেল।

ঋজুদা আমাকে শুধরে দিয়ে বলল, গুলি গন্তব্যে না পৌঁছে আশপাশের কোনও solid object-এ, যেমন গাছ বা পাহাড়ে বা বাঁধে লাগলেও যে শব্দ হতে পারে তাতে শিকারির ভুল হতে পারে। কিন্তু সেখানে কোনও solid object ছিলই না। ফাঁকা মাঠ আর ঘাসবন। তাই গুলি যে লেগেছে, তা গুলির শব্দেই বুঝে নিতে কোনও অসুবিধে হয়নি।

-তারপর?

 –তারপর প্রায় আধঘণ্টা বসে থাকলাম গাছে।

-কেন? বাঘ যখন মরেইছে জানো তখন নেমে তখুনি গ্রামে চলে গেলে না কেন?

ভটকাই বলল।

বোকাইচন্দর এটা জেনে রাখ, যে, রাতের বেলা তো বটেই দিনের বেলাতেও বাঘকে মাচা থেকে গুলি করে কখনও মাচা থেকে নামতে নেই। এই সাবধানবাণী ব্যারিস্টার এবং বিখ্যাত শিকারি কুমুদ চৌধুরী মশায় বারংবার তাঁর নানা বইয়েতে লিখে গেছিলেন। তাই, ওটি আমাদের প্রজন্মর শিকারিদের দ্বিতীয় প্রকৃতি হয়ে গেছিল।

কুমুদ চৌধুরী কি বেঁচে আছেন?

না না। বাঘের হাতে না মারা গেলেও এতদিনে তিনি এমনিতেই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হতেন। উনি তো আজকের মানুষ নন। প্রমথ চৌধুরী, আশুতোষ চৌধুরীদের পরিবারের মানুষ, যে পরিবারের মানুষ ছিলেন জেনারেল জে এন চৌধুরী।

উনিও বাঘের হাতে মারা গেলেন? বলছ কি ঋজুকাকা?

তিতির বলল।

–হ্যাঁ। ঋজুদা বলল, একেই বলে ‘As luck would have it’ এবং বাঘকে গুলি করে মাচা থেকে নেমে সেই আহত বাঘের হাতেই মারা গেলেন। ওড়িশার কালাহান্ডির জঙ্গলে শিকারে গেছিলেন।

আমি বললাম, কুমুদ চৌধুরীর গল্প বাদ দিয়ে এবারে তোমার গল্পটি শেষ করবে ঋজুদা?

–আধঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও যখন কোনও রকম নড়াচাড়ার লক্ষণ দেখা গেল না তখন পকেট থেকে টর্চটা বের করে আলো ফেলে বাঘের শায়ীন অবস্থান সম্বন্ধে আরও নিশ্চিত হয়ে বাঁ বারেলের এল. জি. টি-ও ফায়ার করলাম। তাতেও কোনও নড়াচড়া হল না।

-তারপর?

বাঘ যে অবশ্যই মরেছে একথা নিশ্চিত জেনেও পকেটে রাখা অন্য দুটি গুলি বন্দুকে ভরে নিয়ে গাছ থেকে নেমে এলাম। তারপর বন্দুক রেডি পজিশানে ধরে বাঘের যেখানে শুয়ে থাকার কথা সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। তারপর ব্যারেল দিয়ে ঘাস সরিয়ে নিশ্চিত হলাম যে বাঘ মরে গেছে। টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম যে, লেথাল বলটা ঢুকে গেছে বাঘের ডান কানের মধ্যে দিয়ে একেবারে মস্তিষ্কে। তাই ২বেচারি বুঝতেও পারেনি যে, সে মরে গেল।

দ্বিতীয় গুলির শব্দ হওয়ার পরই গ্রামের মধ্যে উসখুসানি ফিসফিসানি শুরু হয়েছিল যে, তা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। আমি গ্রামে ফেরার পায়ে-চলা পথে মাঝামাঝি যেতেই দেখি জনা দশেক লোক দুটি হ্যাঁজাক জ্বালিয়ে হাতে লাঠি-সোটা টর্চ এবং দুটি বন্দুক নিয়ে এদিকে আসছে। তারা আমাকে দেখেই আনন্দে শোরগোল করে উঠল। তারপরে আমাকে হাড়িবন্ধুর জিম্মায় দিয়ে তার বড় সম্বন্ধী রাম এগিয়ে গেল অন্যদের সঙ্গে বাঘকে বয়ে আনতে। আজকে সারারাত উৎসব হবে গ্রামে।

-তারপর?

তারপর আর কী? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাঘের চামড়া ছাড়াতে পারে এমন কেউ কি আছে? তাহলে আমাকে আর রক্তাক্ত হতে হয় না।

-সে তো সব শিকারিই পারে কিন্তু আজ ভাগ্যক্রমে এক কসাই আছে। মহম্মদ জব্বার মহম্মদ।

আমি বললাম, সেই কি বাঘে মারা গোরুগুলোর চামড়াও ছাড়ায়?

–হ্যাঁ। ওই তো ছাড়ায়। ওর শালা আফজল মিঞাও আসে রেঢ়াখোল থেকে। একসঙ্গে অনেক চামড়া নিয়ে যায় টেম্পো ভাড়া করে।

–তোমাদের এই অঞ্চলে গত এক বছরে কত গোরু মেরেছে বাঘটা?

–ওঃ মেলাই। তার কি হিসাব আছে কোনও?

–এই বাঘ যে সমলেশ্বরীর বাঘ, ও বাঘ তো নয়, তোমরা তো বলেছিলে চিতা, তা তোমরা জানলে কী করে? প্রথমবার বাঘ গোরু মারার পরে সেই বাঘ মারতে কে বসেছিল মড়ির উপরে?

–মহম্মদ জব্বার মহম্মদের শালা আফজল মিঞা। সে তখন এখানেই ছিল। সেও খুব ভাল শিকারি। নামডাক আছে রেঢ়াখখালে। তার রাইফেলও আছে।

–সেই বলেছিল যে, গোরুখাদকটা চিতা এবং তার শরীরে গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেলেও তার কিছু হয় না। নইলে সে আফজল মিঞার গুলি খেয়েও চলে যেতে পারে?

–একথা সেই প্রথমবার বলেছিল?

–হ্যাঁ। সেই বলেছিল। এবং তার পরের বার যখন গোরু মারা পড়ে তখন মড়ির উপরে বসেছিল মহম্মদ জব্বার মহম্মদ। সেও ভাল শিকারি। যদিও গাদা বন্দুকে মারে। সেও তাই বলেছিল।

কী বলেছিল জব্বার?

বলেছিল যে, ওই বাঘ নিশ্চয়ই সমলেশ্বরী দেবীর বাঘ। একে মারা কোনও মানুষের কর্ম নয়। তবে মহম্মদ জব্বার মহম্মদের মাচার নীচে বাঘ আসেনি।

–আসেইনি? না সে নিজেই হাততালি দিয়ে বাঘকে ভাগিয়ে দিয়েছিল?

–কী বলছেন ঋজুবাবু?

–আচ্ছা! তার পরের বার কে বসেছিল এই বাঘ মারতে?

–আবু আলি। সে তো এই গ্রামেরই বাসিন্দা।

–সে কী করে?

–সে মহম্মদ জব্বার মহম্মদের তামাকের ব্যবসার পার্টনার। চারমল-এ দোকান আছে তার। সেও চিতাকে গুলি করেছিল কিন্তু চিতার কিছুই হয়নি।

-তারপর?

 আমরা বললাম।

ঋজুদা বলল, তারপর আর কী। ভারতবর্ষের সুন্দর অনেক দিক যেমন দেখেছিস নানা বনে বনে ঘুরে তেমনই আবার অন্য দিকটাও দ্যাখ। সরল মানুষগুলোকে কীভাবে ঠকিয়ে বাঘকে অক্ষত রেখে জব্বার আর তার শালা মিলে গোরুর চামড়াগুলো হাতিয়েছে। বাঘে মারা গোরুর চামড়ার জন্য কোনও দামও নেয়নি গ্রামবাসীরা। বুঝলি! যেখানে অজ্ঞতা, যেখানে অন্ধবিশ্বাস, তা সে সমলেশ্বরী দেবীর উপরেই হোক কি মহম্মদ জব্বার মহম্মদের উপরেই হোক, সেখানেই পীড়ন, সেখানেই অত্যাচার। বাঘে-খাওয়া গোরুগুলোর মাংসও ওরা হালাল করা-মাংস বলে চালিয়ে দিয়েছে জুজুমারা, চারমল এবং রেঢ়াখোলে অন্য ধর্মভীরু মুসলমানদের কাছে।

ভটকাই বলল, বাঘ আর কতটুকু ডেঞ্জারাস! দেখছি, মানুষ তো তার চেয়েও সরেস।

ঋজুদা বলল, আমার সামনে বাঘের নিন্দা কখনও করবি না। এত বড় মহৎ প্রাণের প্রাণী, এত বড় নির্জনতা-প্রিয় সন্ন্যাসী তুই কেদারবদ্ৰীতেও পাবি না। এই পৃথিবী থেকে বাঘ যদি সত্যিই হারিয়ে যায়, অনেক দেশেই তো গেছে ইতিমধ্যেই, সেদিনকার মতো দুঃখবহ দিনের কথা ভাবতে পর্যন্ত পারি না আমি।

–হারিয়ে যেতে আমরা দিলে তো! অত্ব সোজা নয়।

ভটকাই বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *