চারদিকে সকালের হলুদ-সোনা রোদ। এই রোদ যদি সবুজ-কাঁচা, ঈষৎ সিঁদুর, পূর্ণ পাকা (এইখানে গিনি সোনার রং) এবং অর্ধপাকা (এইখানে কিছু সবুজ ও কিছু হালকা হলুদ) এ রকম অজস্র ফলের ওপর পড়ত, ফলগুলোর উপরিস্তর, মানে, চোঁচা থেকে বের হতো প্রাণপূর্ণ বিভা। এক বড় শীতাতপ ঘরের মধ্যে টেবিলে টেবিলে সাজানো বিভিন্ন রকমের ফল। গাছ তার ফল কখনো নিজের শাখা-প্রশাখায় সাজায় না, কিন্তু ওই না-সাজানো আমাদের চোখে বেশি ভালো লাগে। যখনই মানুষের হাত প্রকৃতির মেজাজে লাগে, তখনই তা হয়ে ওঠে অসুন্দর। ফলের রং-বৈভবে চোখ তৃপ্ত, মন আহ্লাদিত হয়। কে না আহ্লাদিত হতে চায় এই জগৎ-সংসারে? এই বঙ্গদেশে অনেক রকম মেলা, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তার মধ্যে ফলমেলা এক বিশেষ আনন্দরস তৈরি করে। এ রকম মেলা অর্থ-হিসাবি সর্বশ্রেণীর মানুষের চোখ ও জিহ্বাকে একই সঙ্গে লোভী ও চঞ্চল করে এবং দর্শক নিজের অজান্তেই ‘বাহ’ বলে ওঠে। এই অস্ফুট ধ্বনি বিশেষ সংকেতবাহক।
উপস্থিত সমাজ, সুশীল সমাজ, সুজন সমাজ, নারী অধিকার কমিটি, কবিতা কর্মীদল, ছাতা নির্মাণ সমিতি, মানবাধিকার সংঘ, যৌনকর্মী সংঘ, ঝুটকাপড় ব্যবসায়ী কমিটি, এনজিও কমিটি—এই কলমচির হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে কমিটি ও সংঘগুলোর নাম লিখতে লিখতে। হাত ব্যথা কবে ভালো হবে, কে জানে! এ রকমই একটি সমাজের কর্মীদের এই ফলের মৌসুমে ব্যবসাভিত্তিক ভালোবাসা দেখা দেয়। বড় অরাজনৈতিক এই ভালোবাসা। এদের সদস্যরা মহাগ্রন্থ গীতা পড়ে থাকতে পারেন, না-ও পারেন; গীতায় কর্মফল নিয়ে বড় আশাসঞ্চারী কথা গীত হয়েছে। ফল বিক্রি এক সুন্দর কর্ম।
ওই সমাজ আমাদের বিখ্যাত শহর, দুর্গন্ধময় শহর, যানজটে নাকাল হওয়া শহরবাসীর শহর এবং মিছিল করা শহর ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ফলমেলার আয়োজন করেছে। খবরের কাগজ পাকা আম + জাম + লিচুর ছবির সঙ্গে এক সুন্দরীর মৃদু হাস্যময় ছবি ছেপে লিখেছে, ‘শুরু হয়েছে মধুমাস, বাহারি আয়োজন’। আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাহারি’ বলতে আসলে কী বোঝায়? আমি বলব, আমাকে এক মাস ভাবতে হবে। কেননা, টিভিতে মধ্যরাতের টক শোর কোনো টকারের, সুশীল সমাজের, রংমাখা নৃত্যময় কোনো বিজ্ঞাপনের ভাষা, কলাম-লেখকের কিংবা মন্ত্রিপরিষদের কারও কাছ থেকে, কিংবা বিরোধী দলের কোনো ত্যাগী নেতার অথবা অবসরপ্রাপ্ত কোনো জেনারেলের অথবা ফতোয়াদানকারী কোনো হুজুরের কাছ থেকে এ বিষয়ে না শুনে, না বুঝে আমি কিছু বলতেই পারব না ‘বাহারি’ বললে তার মধ্যে কত রকমের রং রংধনু তৈরি করে। বললে আমার কথা আদালত অবমাননা হতে পারে, কোনো বিজ্ঞ বিচারক ‘বিব্রত’ হতে পারেন।
দেশের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই মেলা উদ্বোধন করেছেন দুই দিন আগে। এই গরিব দেশের রাজধানীতে কিছু রোড আছে, যার ওপর দিয়ে ভিআইপিরা, মানে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চলাফেরা করেন। এই দেশে প্রতি মাসে বেড়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণের পদধ্বনি, শাখা-প্রশাখা; তাদের দেখলে আমাদের মতো সাধারণের চোখ বিষণ্ন না হয়ে খামোখা হেসে ওঠে। সেই হাসি কষ্টের, না আনন্দের—তা রাস্তার ট্রাফিক বলতে পারবেন। ট্রাফিকদের কর্মরহস্য সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে আমাদের রিকশাওয়ালারা এবং বিভিন্ন গাড়ির চালকেরা।
তো, আমরা শুনেছি, গুরুত্বপূর্ণ যখন সাজানো হরেক রকম ফলের এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ধীরপায়ে যাচ্ছিলেন বা যেতে হচ্ছিল, মিডিয়া ক্যামেরাম্যান-উইম্যানদের ‘প্লিজ, একটু দাঁড়ান, এক সেকেন্ড, একটা আম হাতে নেন, শুঁকে দেখেন, জাতীয় ফল কাঁঠালে হাত নেন, বরইগুলো কী ডাসা, এইগুলো দেশি শবরি’—এসব অনুরোধ শুনে তিনি প্র্যাকটিসে নিপুণ করে তৈরি করা হাসি দিয়ে ফল নাড়ছিলেন, দেখছিলেন এবং একটু দাঁড়াচ্ছিলেন—তখন ফ্লাস শুধু ফ্লাস; তখন সাদা আলোর ঝলকানিতে তাঁর আশপাশ ঘিরে রাখা মানুষগুলোর চোখমুখ ও শুয়ে থাকা ফলগুলো দেখাচ্ছিল উজ্জ্বল, প্রাণময়। চটকদার আলোয় আমরা বিভ্রান্ত হয়ে কত খুশি, কত ঠাটে রঙিন!
শুধু আম আর আম। এক শ রকমের আম। বড় কবিতাসুলভ নাম। ইঙ্গিতপূর্ণ নাম। রাধাভোগ আর কৃষ্ণভোগ পাশাপাশি রাখা। ‘ভোগ’ শব্দে অনেক বিবাদ হয়। তবে আমরা বিবাদে না গিয়ে বলতে পারি, দেশের মানুষ এক ভোগবাদী কালচারের খপ্পরে পড়ে নিজেদের রঙিন ফাঁপা বেলুনে ওড়াতে বড় ব্যস্ত। রাধা ও কৃষ্ণকে এই বঙ্গের কে না পাশাপাশি দেখতে চায়? আয়োজক সমিতির মনে ও চোখে প্রাচীন, নাকি আধুনিক প্রেমবোধ কেলাসিত? তবে এই বিন্যাস রুচিময়। আমরা ভাবতে পারি, ভেসে যাক নৌকা, যমুনায় দুজন তরুণ-তরুণী আজ আর তীরে ফিরবে না, অথবা তমালের ঘন ছায়াতলে ওরা দুজন বাহুবন্ধনে স্বর্গীয়। রানিভোগে এনার্জি বাল্বের সাদা আলো। আমশরীর থেকে চোখ স্নিগ্ধ করা আলো রাজভোগের শরীরে বিলাসে দীপ্তিময়। এই সহাবস্থান প্রজাস্বীকৃত। পাশে কলা আর কলা। আর এক লম্বা টেবিলে শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল। আরও অনেক রকমের দেশজ ফল থরে থরে টেবিলে টেবিলে সাজানো এবং প্রদর্শিত। প্রদর্শন ছাড়া কোনো কিছুই আজকাল আর গ্রাহ্য নয়।
কাঁঠাল ফলটির বিষয়ে কথা বলতে গেলে শ্রেয়-ভাষা ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। ‘বাঞ্ছনীয়’ বানান মুখে বলা বড় কঠিন। বা-এর পর কোন অক্ষর এবং তার সঙ্গে কোন অক্ষরের মিলন হলে ওই শব্দ পূর্ণরূপ পেতে থাকে, তা আসলেই কঠিন। এই বানানের লেখ্যরূপ দেখতে ভালো নয়। বা-এর পর দুই অক্ষরের এক জঙ্গল, শব্দটি কিন্তু বাক্যের অর্থে বড় ইমফ্যাসিস দাবি করে। আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল। নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই কাঁঠালের। মুখে মুখে জ্যামিতির কোনো রেখায় বা বৃত্তে হিসাব করা যাবে না। অনুমানে করা যেতে পারে। কেউ বলতে পারে, কাঁঠাল বৃত্তাকার। আবার এই কথার বিপরীতে একজন বলতে পারে, বৃত্তাকার কেন হবে, কাঁঠাল গোল এবং লম্বা, রাগবি খেলার বল যে রকম। তবে যারা রাগবি খেলে, তারা কাঁঠাল খায় কি না, বলা যাবে না। আমরা, মানে, এই মাটির মানুষেরা কোনো কোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অনুমান করে কত রক্তপাত করি, মিছিল করি, মিটিং করি এবং করি অনেক বিজয়-উৎসব। কাঁঠালের রূপ বাঙালির রাজনৈতিক মেজাজের মতো। তার শরীরে আছে প্রতিরোধমূলক ছোট ছোট পিরামিড সাইজের কাঁটা। এই ফল পাকলে ভেতরের শাঁস কী রসময়, কী নরম এবং মিষ্টি! বাঙালির হূদয়ে যেমন দয়া বাস করে, এই ফলের হূদয় দয়াময়। বাঙালির মন একবার বিগড়ে গেলে তা কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। কাঁঠাল যদি পচে যেতে থাকে, তাহলে আশপাশে থাকা যায় না। আমাদের পূর্বপুরুষ এই কিম্ভূত আকার ও মেজাজের ফলটি মনে হয় অনেক গবেষণা করে আমাদের জাতীয় ফল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। কাঁটা + নরম + মিষ্টি = বাঙালি বা কাঁঠাল। পূর্বপুরুষের প্রজ্ঞাকে, কর্মকে যে জাতি শ্রদ্ধা করে না, বিচার-বিশ্লেষণ করে না, সেই জাতির উন্নতি হয় না।
দুটি ফরসা, সহনীয় সুন্দর শিশু—বয়স সাত-আট হতে পারে, উচ্চতা জাতীয় ফল রাখা টেবিলের চেয়ে বেশ কম, টেবিলের উচ্চতা চার ফুটের মতো—তাদের চার চোখের সামনে উঁচু-নিচু ছোট-বড় টিলা, সারিবদ্ধ হলুদ কাঁঠাল। শিশু দুটির সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা—উচ্চতা পাঁচ ফুটের ওপরে, আনুমানিক পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হবে, গায়ের রং শ্যামলা—মনে হয়, তিনি শিশুদের মা। খয়েরি + হলুদ রঙের হার্ট চিত্রিত, মানে ‘লাভ’ সাইনপূর্ণ সালোয়ার-কামিজ পরা, চুল ছোট, নগরের মা; জাতীয় ফলের গায়ে ম্যানিকিউর করা নীল নখের নরম আঙুল, তর্জনী রেখে বললেন, ‘কিডস, দিজ আর জ্যাক ফ্রুটস, আওয়ার ন্যাশনাল ফ্রুট।’ ‘রিয়েলি, মম?’ মেয়েশিশুটি গ্রীবা ছোঁয়া কালো চুল দুলিয়ে, চোখে বিস্ময়, প্রশ্ন করে। ছেলেশিশুটি হাত বাড়িয়ে জ্যাক ফ্রুট ছুঁয়েই যেন এক তড়িতাঘাত, ‘উহ’ বলে হাত সরিয়ে নিল। বোনটি ছোট ভাইয়ের ব্যথার ভাষা শুনে বলল, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?’ আমরা শুনলাম এক সহজ শিশুকণ্ঠ : দ্য ফ্রুট ইজ থরনি।’
মিসেস জাকারিয়া তাঁর দুই সন্তানকে দেশজ ফল চেনাতে ফলমেলায় নিয়ে এসেছেন। উদ্যোগ মহৎ। উদ্যোগ নেওয়া হয় না বলে কত বড় বড় জাতীয় সম্ভাবনা অকালেই শেষ হয়ে যায়। তো, মিসেস জাকারিয়ার দুই সন্তান বিদেশি স্কুলে পড়ে, কিন্তু বাংলার কালচার তাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং আমৃত্যু যেন বঙ্গসংস্কৃতি থেকে প্যারাসাইটের মতো খসে না পড়ে, তার জন্য ওই শিশু দুটিকে—শিশুদের আপত্তি সত্ত্বেও—এই মেলায় তিনি নিয়ে এসেছেন। এবং এক একটি ফলের টেবিলের সামনে ওরা অন্য দর্শনার্থীদের সঙ্গে যাচ্ছে, দেখছে বিবিধ ফল। তাদের মা যেসব ফলের নাম জানেন না বা ফল চেনেন না, সেসব ফলের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াচ্ছেন না। মেয়েশিশুটি বৈঁচির সামনে দাঁড়িয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ফল?’ মিসেস জাকারিয়া জানেন না কী ফল। তিনি মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বৈঁচির কিছু ছবি তুলে বললেন, বাসায় গিয়ে বলব। মি. জাকারিয়াকে ছবি দেখিয়ে জানতে চাইবেন ফলের নাম কী।
মেয়েটি তার মাকে একসময় জিজ্ঞেস করে, এইখানে অ্যাপল নেই কেন। ব্ল্যাক গ্রেপ নেই কেন। শিশুর বড় সরল প্রশ্ন। মিসেস জাকারিয়া তাঁর মেয়েকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন, এই মেলা দেশি ফলের; অ্যাপল অ্যান্ড গ্রেপ বিদেশি ফল। শিশুটির জ্ঞান বৃদ্ধি হওয়ায় সে স্মিত হাসল।
একটি ফোন এল। মরক্কো চামড়ার খয়েরি ব্যাগের চেন খুলতে খুলতে ফোন বন্ধ হয়ে গেল। মিসেস জাকারিয়া দামি মুঠোফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে মিসড কলটি দেখলেন। একটু হাসলেন। মনকে বললেন, নটি, গতকালের দুপুরটা লাভলি ছিল। শিশুদের কৌতূহল বেশি, তাঁর মেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মম, হু ফোনড ইউ?’ তার মা হেসে—শিশুদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা তিনি জানেন— বললেন, ‘পারসোনাল কল। কারও ফোন এলে জিজ্ঞেস করতে হয় না, কে ফোন করেছিল।’ মেয়েটি তার মাকে বলল, ‘কেন, বাবার কোনো ফোন এলে তুমি তো বাবাকে জিজ্ঞেস করো, দেন?’ মিসেস জাকারিয়া এবারও হেসে, হাতে তখন একটি জামরুল, বললেন, ‘হাসবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ ইচ আদারকে জিজ্ঞেস করতে পারে।’ বলেই হাতের ফলটি দেখিয়ে মেয়েকে বললেন, ‘এই ফলটি কি চেন?’ দুটি শিশুর কেউই জামরুল চেনে না। ‘এই ফলের নাম জামরুল। ইউ নো, আমাদের গ্রামের বাড়িতে এই ফলের গাছ আছে।’
আবার ফোন এল। মিসেস জাকারিয়া ভেবেছিলেন, তার বিশেষ নটি ফোন করেছেন। ফোন হাতে নেওয়ার আগেই ভাবলেন, বিশেষ নটি পারসনকে বলবেন, আগামীকাল যেতে পারবেন না; গতকালের বিছানা এলোমেলো খুব এনজয় করেছে, আবার দুই দিন পর। না, তার ফোন নয়, মি. জাকারিয়ার ফোন। তিনি তাঁর নিজস্ব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে জানালেন, তাঁর মা-বাবা এসেছেন গ্রাম থেকে। আম, জাম, পানিফল, কচি তাল আর একটা বড় কাঁঠাল এনেছেন নাতিদের খাওয়ানোর জন্য; সব ফরমালিন-ফ্রি ফল, নিজেদের গাছের ফল, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বাসায় ফিরবেন মা-বাবার সঙ্গে লাঞ্চ করার জন্য। ‘আবার কাঁঠাল কেন? মা, আব্বা কখন আসছেন?’ তাঁর স্বামীকে কাঁঠাল বিষয়ে প্রশ্নটি তিনি কেন আচমকা করলেন, ভেবে পেলেন না। ছোট মেয়েটি তার মায়ের কথা শুনে বলল, ‘কে জ্যাক ফ্রুট এনেছে?’ ‘তোমার গ্র্যান্ড পা।’
মি. জাকারিয়া বউকে ফোন করে মেইল খুলেছিলেন। কোলাকুলি পার্টির ঘোর সমর্থক একজন বন্ধু কী একটা অ্যাটাচমেন্ট পাঠিয়েছেন। বিশেষ নোট লিখেছেন: হে মুলামুলি পার্টির প্রিয় বন্ধু, অ্যাটাচমেন্টটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বে। অনেক জ্ঞান হবে, আমাকে কে যেন পাঠিয়েছে, তুমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীল বলে লেখাটি পাঠালাম। আজকে রাতে ক্লাবে দেখা হবে। তোমার দুষ্টু মেয়েটি আসবে নাকি? আমরা স্পিকার আর সাংসদের আলাপকে আজ ব্ল্যাক লেবেল দিয়ে সেলিব্রেট করব।
মি. জাকারিয়া অ্যাটাচমেন্ট খুলে পড়লেন:
(তারিখ ০৫.০৬.২০১১)
স্পিকার: মাননীয় সাংসদ, আপনার প্রশ্ন উত্থাপন করুন।
সাংসদ: মাননীয় স্পিকার, আপনাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। দেশের লক্ষ্মীকে জানাই শতসহস্র সালাম। তিনি এ দেশের জন্য যে আত্মত্যাগ…
স্পিকার: আপনি প্রশ্ন করুন, মাননীয় সাংসদ।
সাংসদ: ধন্যবাদ, মাননীয় স্পিকার। আজ আমাদের দেশ ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ পরিচালনায় নিপুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে মাইলফলক স্থাপন করেছেন, তা যুগ যুগ ধরে…
স্পিকার: আপনি আপনার প্রশ্ন করুন, মাননীয় সাংসদ…
সাংসদ: জি, জি, মাননীয় স্পিকার। ধন্যবাদ। এই মহান সংসদে দাঁড়িয়ে আমি শুধু বলতে চাই, আমাদের দেশ ও জাতি এখন যে সোনার বাংলায় বাস করছে, যা একদিন স্বাধীনতার ঘোষক, এ দেশের স্বাধীনতার নায়ক, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা শুধু সম্ভব হয়েছে তাঁরই যোগ্য প্রতিনিধির কল্যাণে। নেত্রীর অসাধারণ নেতৃত্বে আজ সারা পৃথিবী অবাক হয়ে দেখছে এবং…
স্পিকার: প্রশ্ন করুন, প্রশ্ন করুন, মাননীয় সাংসদ। আপনি প্রশ্ন করুন।
সাংসদ: ধন্যবাদ, মাননীয় স্পিকার। ধন্যবাদ আপনাকে, এই মহান সংসদে আমাকে কথা বলার সময় ও সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমি এই মহান সংসদের সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার খালি একটি কথা বলার আছে। আজকে জনগণ যেভাবে জেগে উঠেছে, সোনার বাংলা বাস্তবায়নে যে প্রচেষ্টা, পরিকল্পনা ও উন্নতির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, তা…
স্পিকার: ধুৎ!!
পড়া শেষ হলে মি. জাকারিয়ার মনে হলো, একটা গ্রুপ নেমে পড়েছে তাঁর দলকে, দলের সরকারকে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত করতে। এই প্রচারণার মধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি লোকের হাত আছে। মি. জাকারিয়া নিচের তারিখ লিখে বন্ধুর কাছে পাঠালেন:
(তারিখ ০৫.০৬.২০০৫)
সাংসদ: ধন্যবাদ, মাননীয় স্পিকার। আজ আমাদের দেশ ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ এশিয়ার বাঘে পরিণত হচ্ছে। আমাদের দেশ পরিচালনায় নিপুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী যে মাইলফলক স্থাপন করেছেন, তা যুগ যুগ ধরে…
স্পিকার: আপনি আপনার প্রশ্ন করুন, মাননীয় সাংসদ…
সাংসদ: জি, জি, মাননীয় স্পিকার। ধন্যবাদ। এই মহান সংসদে দাঁড়িয়ে আমি শুধু বলতে চাই, আমাদের দেশ ও জাতি এখন যে বাংলাদেশে বাস করছে, যা একদিন স্বাধীনতার ঘোষক, এ দেশের স্বাধীনতার নায়ক, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা শুধু সম্ভব হয়েছে তাঁরই যোগ্য প্রতিনিধির কল্যাণে। নেত্রীর অসাধারণ নেতৃত্বে আজ সারা পৃথিবী অবাক হয়ে দেখছে এবং…
স্পিকার: প্রশ্ন করুন, প্রশ্ন করুন, মাননীয় সাংসদ। আপনি প্রশ্ন করুন।
সাংসদ: ধন্যবাদ, মাননীয় স্পিকার। ধন্যবাদ আপনাকে, এই মহান সংসদে আমাকে কথা বলার সময় ও সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমি এই মহান সংসদের সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার খালি একটি কথা বলার আছে। আজকে জনগণ যেভাবে জেগে উঠেছে, বাংলাদেশ বাস্তবায়নে যে প্রচেষ্টা, পরিকল্পনা ও উন্নতির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, তা…
স্পিকার: ধুৎ!!
মি. জাকারিয়া দুটো লেখারই প্রিন্ট নিলেন।
বাসায় ফিরে মি. জাকারিয়া খাবার টেবিলের ওপর স্পিকার ও সাংসদের সংলাপের কাগজ দুটি রাখলেন। তখনো তাঁর বউ ও বাচ্চারা বাসায় পৌঁছায়নি। তাঁর ইচ্ছা, খাওয়ার সময় দুটো বক্তব্যই পড়বেন। দুটোর বক্তব্য শোনার পর তিনি জানাবেন, তিনি তাঁর কোলাকুলি পার্টি করা বন্ধুকে লিখেছেন পরেরটা। তাঁর আব্বা ও বউ নিশ্চয়ই তাঁকে বাহবা দেবেন।
বাসার কাজের বুয়া মি. জাকারিয়াকে বললেন, তাঁর আব্বা-মা দোতলার গেস্টরুমে। তিনি জানতে চাইলেন, আব্বা ও মায়ের আনা আম, জাম, পানিফল, কচি তাল আর কাঁঠাল কোথায়। ফলগুলো রান্নাঘরে রাখা হয়েছে শুনে বললেন টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখতে। সাদা কাচের টেবিলের ওপর তাজা ফলগুলো দেখতে কী যে ভালো লাগবে, তাঁর ছেলেমেয়ে দুটি খুবই মজা পাবে, ইট উড বি এ গুড ফান ফর দেম।
মি. জাকারিয়া ‘মা’, ‘মা’ বলতে বলতে দোতলায় চলে গেলেন।
ফলগুলো আনার আগে বুয়া মি. জাকারিয়ার রাখা কাগজ দুটি পাশাপাশি রাখলেন। ফলগুলো কাগজের ওপর রাখলে ভালো হবে।
কলবেল বাজল। মিসেস জাকারিয়া ফলমেলা থেকে ফিরে এসেছেন। ড্রয়িংরুম থেকেই দেখলেন, টেবিলের ওপর অনেক ফল সাজানো। বড়, পাকা কাঁঠালটি মাঝখানে দুটো কাগজের ওপর। কাঁঠালের চারপাশে অন্যান্য ফল খুবই সুন্দর করে সাজানো। তাঁর ছেলেমেয়ে দুটি দৌড়ে এল টেবিলের কাছে। ‘ওয়াও, হোয়াট এ বিগ ফ্রুট, বাট কামিং ব্যাড স্মেল। মম, ডু ইউ গেট দ্যাট?’
মিসেস জাকারিয়া নাক ধরলেন। একটা পচা গন্ধ আসছে। কাঁঠালটা পেকে ফেটে গেছে। কাঁঠালের নিচের কাগজ দুটির লেখা হলদেটে রসে সিক্ত। দুটি শিশু প্রায় সমস্বরে তাদের মাকে বলল: ইজ ইট রিয়েলি আওয়ার ন্যাশনাল ফ্রুট?
কয়েকটি মাছি কাঁঠালের ফাটলে গণতান্ত্রিক আনন্দে ওড়াউড়ি করছে, কয়েকটি মাছি নিবিড় সুখে রস খাচ্ছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১১
Leave a Reply