চোখের ওপর ভোজবাজি

চোখের ওপর ভোজবাজি

সবার উপরে মানুষ সত্য—ঘোরতর সত্যি কথা। উপরওয়ালা যে প্রচণ্ডভাবে অমোঘ, তা কে না জানে? কিন্তু মানুষ আর কতক্ষণ উপরে থাকতে পারে? উপরের মানুষটির কতক্ষণ আর উপরি উপায়ের সুযোগ থাকে? নিজের কর্মদোষে আপনার থেকেই কখন নীচে নেমে পড়ে।

আমরা তো হর্ষবর্ধনকে অদ্বিতীয় বলেই জানতাম, কিন্তু তিনি যে নিজগুণে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করবেন, কবতে পারেন, তা কখনো আমার ধারণার মধ্যে ছিল না।

ধারণাটা পালটালো ওঁর গিন্নীর কথায়। যেতেই তিনি ভীষণ খাপপা হয়ে কথাটা জানালেন আমায়। আর বললেন যে, অ্যাদ্দিন লোকটা বেশ চৌকোস ছিল, কিন্তু আপনার সঙ্গে মেশবার পর থেকেই নাকি কেমন ধারা যেন ভোতা মেরে যাচ্ছে। বুদ্ধিশুদ্ধি বলতে কিছু নেই আর কিন্তু আমাকে তো বেশ ধারালো বলেই আমি জানতাম …মৃদু প্রতিবাদের ছলে বলি : উনি যেমন ধার দিয়ে ধারালো, তেমনি ধার নেবার বেলায় আমার তো আর জুডি হয় না।

ধারালো লোকের ধার ঘেঁষতে নেই কখনো। পাশ থেকে ফোডন কাটে গোবরা। ধারে ধারে ঘষাঘষি হয়ে ধার ক্ষয়ে ভোতা মরে যায় শেষ য। তাই হয়েছে গিয়ে দাদার।

তারপর সমস্ত কথা জানতে পারলাম সবিশেষ। হর্ষবর্ধনের চোখের ওপর ভোজবাজিটা ঘটে গেল কেমন করে! যেন কোন যাদুকরের মায়দণ্ডেই হাওয়া হয়ে গেল গাড়িটা!

হয়েছিল কী, হর্ষবর্ধন গত সকালে চুল ছাঁটতে গেছলেন পাড়ার কাছাকাছি এক সেলুনে।

সেলুনে কাল ভীড় ছিল বেজায়। তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে খানিকক্ষণ।

অপেক্ষমান হর্ষবর্ধনের সামনে কতকগুলো বই এনে ধরে দিল সেলুনওলা–চুপচাপ বসে থাকরেন কেন বাবু! এই বইগুলো দেখুন ততক্ষণ নেড়েচেডে। আপনার আগে তো আরো জনাতিনেক রয়েছেন, তাঁদের ছাঁটাই শেষ হলেই তাবপর আপনাকে ধরব।

বইগুলো নিয়ে তিনি নাড়াচাড়া করছেন এমন সময় অপরিচিত একজন এসে তার পাশে বসল—

নমস্কার হর্ষবর্ধনবাবু! বলেই এক নমস্কার ঠুকল তাঁকে।

নমস–কার! প্রতিধ্বনির সুরে বললেও লোকটা যে কে তা কিন্তু তার আদৌ ঠাওর হয় না।

আপনি আমাকে চিনবেন না মশাই! আপনার প্রায় প্রতিবেশীই বলতে গেলে। দুটো গলির ওধারে আমি থাকি। তবে আপনাকে আমি বেশ চিনি। আপনি আমাদের পাড়ার। শীর্ষস্থানীয়। কে না চেনে আপনাকে?

না না! কী যে বলেন, আমি…আমি নিতান্ত সামান্য লোক। অপরের দ্বারা স্তৃত। হয়ে হর্ষবর্ধন কেমন অপ্রস্তুত বোধ করেন।

আপনি অসামান্য, আপনি অসাধারণ। জানেন, পাড়ার ছেলে বুড়ো সকলে, ইতর ভদ্র সবাই আমরা, আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করি? বলে লোকটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে: এই দেখুন না, আপনাকে এই সেলুনে ঢুকতে দেখে আমিও এখানে দাড়ি কামাতে এলাম। নইলে নিজের বাড়িতেই তো কামাই রোজ। নিজের হাতেই কামাই।

আমি চুল ছাঁটতে এসেছি। হর্ষবর্ধন কথাটা উড়িয়ে দিতে চান। নিজের দৃষ্টান্তস্বরূপ হওয়াটা যেন তার তেমন পছন্দ হয় না।

বলেই তিনি বইগুলো ভদ্ৰলোকের দিকে এগিয়ে দেন—পড়তে দিয়েছে এগুলো। দেরি হবে এখানে চুল ছাঁটবার, দাড়ি কামাবার। হাত খালি নেই কারো—দেখছেন তো! পড়ুন এগুলো ততক্ষণ।

এসব তো রহস্য রোমাঞ্চের বই। দেখেশুনে নাক সিটকান ভদ্রলোক : ভুতুড়ে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প যততা। পড়লে মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে। কেন যে রাখে এগুলো এখানে কে জানে!

ওই জন্যেই বোধহয়। হর্ষবর্ধন বালান : মাথার চুল খাড়া হয়ে থাকলে ছাঁটবার পক্ষেও ওদের সুবিধা হয় হয়ত।

একটা গভীর রহস্যের রোমাঞ্চকর সমাধান করে ওঁকে যেন একটু সহ্যই দেখা যায়।

তা যা বলেছেন। তাঁর কথায় সায় দেন ভদ্রলোক : এই এলাকায় এই একটাই তো ভাল সেলুন! তবে এই বড় রাস্তার ওপরে, পাড়ার থেকে অনেকটা দূর—রোজ রোজ আর কে এখানে দাড়ি কামাতে আসছে বলুন! এধার দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনাকে ঢুকতে দেখলাম বলেই না…তা, আর গাড়িটা কোথায় রাখলেন?

গাড়ি! গাড়ি কই আমার! হর্ষবর্ধন নিজের দাড়িতে হাত বুলোন—গাড়ি নেই বলেই তো এত ঝামেলা, দুবেলা গিন্নী বাড়ি মাথায় করছেন সেইজন্যে! গাড়ি আর পাচ্ছি কোথায়!

সে কী! আপনি পাচ্ছেন না গাড়ি? ভদ্রলোক রীতিমতন সবিস্ময়।

কই আর পাচ্ছি মশাই! তিন বছর হলো দরখাস্ত দিয়ে বসে আছি…তবে এবার একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এতদিনে আমার নাম লিস্টির মাথায় এসেছে। সবার ওপরে আমার নাম দেখে এলাম সেদিন। এইবার পাবো মনে হয়।

পেলেও পেতে পারেন। ভরসা দেন ভদ্রলোক মাথায় মাথায় হলেই পাওয়া যায় কিনা?

হ্যাঁ, এজেন্টও সেই কথা বলল। বলল যে, আপনার গাড়ি পৌঁছে গেছে ডকে, দু-একদিনের মধ্যেই মাল খালাস হয়ে আসবে। দিন দুই বাদে এসে দাম চুকিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারবেন, বলল এজেন্ট।

আপনি ভাগ্যবান। উল্লসিত হন ভদ্রলোক, কী গাড়ি বলুন তো?

ফিয়াট তো বলল। হর্ষবর্ধন জানানঃ ফিয়াট না—কী যেন!

ফিয়া—ট! উপচে ওঠা উৎসাহ হঠাৎ যেন চুপসে গেল লোকটার—ফিয়াট।

কিরকম গাড়ি মশাই? হর্ষবর্ধন জানতে উদগ্রীব।

যাছছেতাই! ফিয়াট না বলে আপনি ফায়ারও বলতে পারেন।

তার মানে?

ফীয়ার মানে ভয়। ভয়ঙ্কর গাড়ি মশাই।

সে কী! তবে যে খুব ভালো গাড়ি বলল এজেন্ট?

ওরকম বলে ওরা। বেচতে পারলেই তো ওদের কমিশন। মোটামূটি লাভ।

তাই নাকি?

বেশ বড়ো গাড়িই তো পেয়েছেন? বিগ ফিয়াট, নাকি বেবি ফিয়াট? জানতে চান ভদ্রলোক।

না, তেমনটা নাকি বড় হবে না, বলল লোকটা। তবে নেহাত ছোটও নয় তাবলে। মাঝামাঝি সাইজের বলেছে এজেন্ট।

কজন চাপবার লোক বাড়িতে আপনার?

তিনজন আমল। আমি আমার গিন্নী আর আমার ভাই গোবরা—এই তো। ড্রাইভারকে ধরে জনা চারেক স্বচ্ছন্দে যেতে পাবে, সেইরকম জানা গেল।

কুলিয়ে যাবে তাহলে আপনাদের।

তা যাবে। গোবরা ড্রাইভারেব পাশেই বসবে না হয়, তাতে কী হয়েছে। আমরা কর্তা গিন্নী দুজনায় ভেবে বসব দুজনে। অবশ্যি, আমরা একটু ভাটার দিকে, তাহলেও মোটামুটি আমাদের চলে যাবে মনে হয়।

মোটামুটিই হন আর পাতলাপাতলিই হন, আপনাদের চলে যাবে বুঝলাম। বলার সময় ভদ্রলোকের মুখ বেশ ভার হয়—-তবে গাড়িটা যদি চলে—তবেই না!

কেন, গাড়ি কি চলবে না নাকি?

কেন চলবে না! চালালেই চলবে। ঠেলেঠুলে চালাতে হবে। ঠেলেঠুলে চালালে কী না চলে বলুন? বাড়িতে আপনারা কজনা আছেন বললেন? ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে অবশ্যি সে তো ধর্তব্যের বাইরে, কেননা, সে তো স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকবে। কজনা আছেন বললেন আপনারা?

আমি, আমার বৌ, আমার ভাই—তাছাড়া একটা বাচ্চা চাকর—এই চারজন।

চারজনা মিলে ঠেললে গাড়ি চলবেনা আবার! চারজনায় চার্জ করলে, বলে, ঠেলেঠুলে হাতিকেও চালিয়ে দেওয়া যায়।

ঠেলেঠুলে নিয়ে যেতে হবে গাড়ি, তার মানে? ঠেলাগাড়ি নাকি মশাই? অবাক হন হর্ষবর্ধন।

না না, তা কেন? মোটর গাড়িই, আর, দম দিয়ে চালাবার মত না হলেও, একটু উদ্যম লাগবে বইকি!… তবে একটু ঠেলা আছে। তিনি বিশদ করেন—

ঐ গোড়াতেই যা একটু ঠেলতে হবে। তারপর একবার ইঞ্জিন চালু হয়ে গেলে গড গড করে গড়িয়ে চলবে গাড়ি। এগুলোর অ্যাকসেলেটার ততো ভালো নয় কি না, তাই এরকমটা। আপনার থেকে স্টার্ট নেয় না তাই।

নতুন গাড়ির এমন দশা কেন মশাই? হর্ষবর্ধন জিজ্ঞাসু।

নতুন গাড়ি কি এদেশে পাঠায় নাকি ওরা? সব সেকেণ্ডহ্যাণ্ড। জানান ভদ্রলোক : বলে সেকেণ্ডহ্যাণ্ড, আসলে কতো হাত ঘুরে এসেছে কে জানে! তাকেই আনকোরা বলে চালায় এখানে বাজারে।

এই রকম! জানতাম না তো। হর্ষবর্ধনকে একটু ম্রিয়মাণ দেখা যায়। ওদের শো রুমে ঐ ফিয়াট ছিল আরো দু-একখানা। এজেন্ট ভদ্রলোক নমুনা দেখালেন আমায়—ঝকঝকে নতুন—খাসা চমৎকার দেখতে কিন্তু।

ঐ ওপর ওপর। সমঝদারের হাসি হাসেন ভদ্রলোক। -উপরে চাকন-চিকন ভিতরে খড়ের আঁটি। উপরটা ঝকঝকে, ভিতরটা ঝরঝরে। একটু দম নিয়ে তিনি নবোদ্যমে লাগেন আবার—তা ছাড়া এই গাড়িগুলোর আরেকটা দোষ এই যে পেট্রল কনজাম্পসন বড্ড বেশি। পেট্রল খায় খুব।

তা খা। খাইয়ে লোকেদের আমরা পছন্দ করি। আমরাও খুব খাই মশাই।

শুধুই কি পেট্রল? তাছাড়া হোঁচোট—?

হোঁচোট? হর্ষবর্ধন বুঝতে পারেন না। চোট খান হঠাৎ।

যেতে যেতে হোঁচট খায় যে গাড়ি। ভয়ঙ্কর স্কিড্‌ করে।

ছাগলছানা সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই বুঝি? হর্ষবর্ধন শুধান : চাপা দিয়ে চলে যায় বলছেন তাই?

ছাগলছানা পাচ্ছেন কোথা থেকে? ভদ্রলোক হতবাক।

ঐ যে বললেন ইসকিড? ইকিড মানে তো ছাগলছানা। বিড এ ম্যান গো টু দি ইসকি। পড়িনি নাকি ফাস্টবুকে?

ছাগলছানা অব্দি যে তাঁর বিদ্যের দৌড় সেকথা অম্লানবদনে প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধা করেন না।

না না। সে তো হলো গিয়ে কিড। এটা স্কিড। তার মানে, যেতে যেযে হঠাৎ লাফিয়ে যায় গাড়িটা। টক করে বেটরে গিয়ে পড়ে। বেঘোরে মানুষ খুন করেও বসে মাঝে মাঝে।

অ্যাঁ? আঁতকে ওঠেন হর্ষবর্ধন।

মারাত্মক গাড়ি মশাই—তবে আর বলছি কী!

কী সর্বনাশ!

সর্বনাশ–বলতে! গাড়ির ব্রেকটাই আসলে খারাপ। হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেবে আপনাকে। রাস্তায় যত খুন জখম হবে আপনার গাড়ির তলায়, তার খেসারত গুনতে গুনতে দুদিনেই আপনি ফতুর হয়ে যাবেন।

লাখ লাখ টাকা ফাঁক হয়ে যাবে ঐ গাড়ির জন্যেই? আপনি বলছেন?

ঐ ব্রেকের জন্যই ব্রোক হতে হবে আপনাকে শেষতক। ভদ্রলোকের শেষ কথা।

ব্রোক হবার আগেই যেন ব্রেক ডাউন হয় হর্ষবর্ধনের, ভেঙে পড়েন তিনি-শুনেই না!

আর কলিশন হলেই তো হয়েছে। যদি আর কোনো গাড়ি কি ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে একটু ধাক্কা লাগে তাহলেই ভেঙে তক্ষুনি চুরমার! যা ঠুনকো গাড়ি মশাই!

তাহলে আমরাও তো খতম্ হয়ে যাবো সেই সঙ্গে?

খতম না হলেও জখম তো বটেই। তবে গাড়িটা কিনেই ইনসিওর করিয়ে নেবেন, আপনারাও লাইফ ইনসিওর করে রাখবেন নিজেদের—তাহলেই কোনো ভয় নেইকো আর। দুদিকই রক্ষা পাবে তাহলে। কোম্পানির থেকে দুটোরই খেসারত পেয়ে যাবেন তখন।

মারা গিয়ে ঢাকা পাওয়ার কোনো মানে হয়? তাঁর কথায় হর্ষবর্ধন তেমন ভরসা পান না : আর নাই যদি বা মরি, কেবল হাত পা-ই হারাই—কিন্তু তা হারিয়ে অর্থলাভ করাটা কি একটা লাভ নাকি?

সেটা দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য। যে যেমনটা দ্যাখে। কেউ টাকা উপায় করার জন্য সারা জীবন ব্যয় করে। কেউ বা জীবন রক্ষা করতে গিয়ে দু হাতে টাকা ওড়ায়। যার যেমন অভিরুচি।

ইস্! ফেঁসে গিয়েছিলাম তো আবেকটু হলেই। ফাসিয়ে দিয়েছিল গাড়িটা। কী ভাগ্যি আপনার সঙ্গে দেখা হলো আজ, আপনি বাঁচিয়ে দিলেন মশায়। আমাকেও—আমার টাকাকেও।

না না, তাতে কী হয়েছে। আপনি ঘাবড়াবেন না। চাপবার জন্যে কি আর গাড়ি? তার জন্যে তো ট্যাক্সিই রয়েছে। রাস্তায় পা দিয়েই যদি ট্যাক্সি পাওয়া যায় তার চেয়ে ভালো আর হয় না। আর তা সস্তাও ঢের। আর এধারে দেখুন, এসব গাড়ির পেছনে ধৰ্চাটা কম নাকি? ঠুনকো গাড়ি, পচা কলকজা, একটুতেই বিকল। আর্ধেক দিন কারখানার গ্যারেজেই পড়ে থাকবে—তারপর মেরামত হয়ে এলেও, দুদিনেই আবার যে কে সেই।

এমন গাড়িতে আমার কাজ নেই। এ গাড়ি আমি নেব না।

না না, নেবেন না কেন? বললাম না, চাপবার জন্য তো গাড়ি নয়। গাড়ি হচ্ছে বাড়ির শোভা, বাড়ির ইজ্জৎ বাড়াবার। বাড়ির মনে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে পাড়াপড়শীর কাছে মান বেড়ে যায় কতো।

আমার গিন্নীও সেই কথা বলেন বটে। বলেন যে, একটা গাড়ি নেই বলে পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখানো যাচ্ছে না।

ঠিকই বলেন তিনি। বাড়ি গাড়ি এসব তো লোককে দেখানোর জন্যেই মশাই! দেখে যাতে পাড়ার সবার চোখ টাটায়। তবে এ যা গাড়ি—চোখে আঙুল দিয়ে তো দেখানো যাবে না পড়শীদের। বলেন ভদ্রলোক : তেমন করে দেখাতে গেলে তো তাদের চাপা দিয়ে দেখাতে হয়। নিদেন চাপা না দিলেও, গা ঘেঁষে গিয়ে কি গায়ে কাদা ছিটিয়ে গেলেও চলে, কিন্তু তাতো আর এ গাড়িতে সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, পড়শীদের কানে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারেন বটে।

কানে আঙুল দিয়ে? তিনি অবাক হন? সে আবার কী রকম দেখানো?

হ্যাঁ, ঐ ঘচাং ঘচ্‌! ঐটা করতে পারেন বটে। ঐ ঘচাং ঘচ্‌।

ঘচাং ঘচ্‌?

হ্যাঁ। আপনারা চারজন আছেন বললেন না? কর্তা, গিন্নী, দেওর আর বাড়ির চাকর, চারজন তো রয়েছেন। বাড়ির দেউড়িতে থাকবে তো গাড়ি, গাড়ির চার দরজায় আপনারা চারজনা দাঁড়াবেন। তারপর ঐ ঘচাং ঘচ্‌।

ঘচাং ঘচটা কী মশাই? বারংবার শুনে বিরক্ত হন হর্ষবর্ধন।

আপনারা চারজনায় মিলে গাড়ির চারটে দরজা কেবল খুলুন আর লাগান—ঘন্টায় ঘণ্টায়—ঘণ্টার পর ঘণ্টা! ঘচাং ঘচঘচাং ঘচ…ঘচাং ঘচ…চলতে থাকুক পরম্পয। রীতিমতন কানে আঙুল দিয়ে টের পেতে হবে পড়শীদের…যে হ্যাঁ, গাড়ি একখানা আছে বটে পাড়ায়। চালান সারাদিন ঐ ঘচাং ঘচ।

কিন্তু নাহক ঘচাং ঘচ করাটা কি ভালো?

তাহলে ঘচাং ঘচের ফাঁকে ফাঁকে প্যাঁ পোঁ চালাবেন। তাও করতে পারেন ইচ্ছে করলে–সেও মন্দ নয় কিছু।

প্যাঁ পোঁ? একটু যেন ভড়কেই যান তিনি।

হ্যাঁ। ঐ প্যাঁ পোঁ, গাড়ির সবকিছু বাজে হলেও ওর হর্নটা কিন্তু নিখুঁত। সেটাও বেশ বাজে। মাঝে মাঝে তাই বাজান। চলুক ঐ পা পোঁ আর ঘচাং ঘচ্‌।

দূর মশাই ঘচাং ঘচ। আমি এক্ষুনি চললাম অর্ডার ক্যানসেল করতে—অমন ঘচাং ঘচে গাড়ি চাই নে আমার।

চুল না হেঁটেই তীর বেগে বেরিয়ে পড়লেন হর্ষবর্ধন। বাড়ি ফিরলেন গাড়ি খারিজ করে দিয়ে তারপর।

না গিন্নী! ঘচাং ঘচ করা পোষাল না আমার পক্ষে!

বলে বাড়ি ফিরে গিন্নীর কাছে পাড়তে গেছেন গাড়ির কথাটা, তিনি তো বাড়ি মাথায় করে তুললেন। কতর বোকামির বহর মাপতে না পেরে কিছু আর বাকী রাখলেন না তাঁর।

বৌয়ের বকুনি খেয়ে আজ সকালেই আবার তিনি মুখ চুন করে গেছেন সেই এজেন্টের কাছে—গাড়িটা চাই মশাই! আমি মত পালটেছি আমার।

গাড়ি আর কোথায়! আপনি অর্ডার ক্যানসেল করে যাবার পর যিনি দু-নম্বরে হিলেন—আপনার ঠিক পরেই ছিলেন যিনি-পেয়ে গেছেন গাড়িটা। ঐ যে তিনি ডেলিভারি নিয়ে বেরিয়ে আসছেন এখন। তিনি দেখিয়ে দেন—তবে যদি বলেন, আপনার নাম আমি দ্বিতীয় স্থানে রাখতে পাবি অতঃপর। এব পবেব পব যে গাড়ি আসবে সেইটা আপনি পাবেন। ফেব আবার তিন বছরের ধাক্কা হয়ত বা।

হর্ষবর্ধনের চোখের ওপর দিয়ে প্যাঁ প্যোঁ করতে করতে চলে গেল গাড়িটা। তাঁর মুখ দিয়ে বেরুতে শোনা যায় শুধু—সেই ভদ্রলোক দেখছ সেলুনের আলাপী কালকের সেই ঘচাং ঘচ্‌…!

অ-দ্বিতীয় সেই ভদ্রলোককে দেখে আপন মনেই তিনি খচখচ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *