1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ৪৯

চিলেকোঠার সেপাই – ৪৯

রাত্রে খাওয়াবে বলে ওসমানকে জাগাবার চেষ্টা করে ওরা হাল ছেড়ে দিলো। আনোয়ার ভয় পায়, ওসমান ঘুমের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেলো না তো?
করমালি অবশ্য ঘাবড়ায় না, খিদা পালে নিজেই চেতন পাবো। ভাত তো টেবিলের উপর থাকলেই, তাই চেতন পালে ভাত খাওয়াইয়া ওষুদপতি দিয়া হামি শুতমু। আপনে যান ভাইজান কতোক্ষণ বস্যা থাকবেন? কয়েকদিন থেকে রাত্রে অবশ্য করমালিই থাকে। কিন্তু আজ ওসমানের কপাল ব্যান্ডেজ, ঠোঁট ফুলে ঢোল। যে কাণ্ডটা করলো আজ, এরপর শুধু করমালির ভরসায় কি আনোয়ার বাড়ি যেতে পারে?
আপনে যান! করমালি ফের ভরসা দেয়, আত হলো। মনে হয় তামান আত তাই নিন্দ পাড়বো।
সারা রাত ঘুমাবে? তুমি বুঝলে কি করে?
আনোয়ারের ছেলেমানুষি প্রশ্নে করমালি পরিণত চোখ করে হাসে। এই হাসিতে ভরসা আছে, প্রশ্ৰয়ও আছে।-আনোয়ার তার ওপর ওসমানের দায়িত্ব দিয়ে দিব্যি বাড়ি যেতে পারে। আনোয়ারের খুব ঘুম পাচ্ছে, শরীর দারুণ ক্লান্ত। করমলিটা ভাগ্যিস এসেছিলো ও না থাকলে ওসমান তাকে লাশ নিয়ে বসে থাকার দশা করে ছাড়তো। করমালির ওপর কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে আনোয়ার তার চাকরির খবর দেয়। ভাইয়া গতকাল তাকে জানিয়েছে-ভাইয়ার বন্ধুর অফিসে চাকরি, আনোয়ার চাইছিলো একেবারে চূড়ান্ত নিয়োগ-পত্র নিয়ে করমালিকে জানাবে। কিন্তু উপচে-ওঠা কৃতজ্ঞতাবোধ সামলাতে না পেরে এখনি বলে ফেললো। করমালি পরশু কাজে যোগ দিতে পারবে। পরশু তো বরিবার, তাহলে তার পরদিন। কাজ এমন কিছু নয়। কেরানীদের ঘর থেকে সায়েবের ঘরে কাগজপত্র, ফাইল নিয়ে আসাযাওয়া করা। মতিঝিলের সেই অফিসে ঘর মোটে আড়াইটে, সুতরাং আসা-যাওয়ার পরিধিও কম। মাঝে মাঝে চা তৈরি করতে হবে। চা তৈরি করা শিখতে করমালির কতোক্ষণ আর লাগবে? একটু লেখাপড়া জানা থাকলে ভালো হতো। করমালি নাম দস্তখত করতে পারে না?–তাতে আপাতত কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, পরে আনোয়ার তাকে খানিকটা লেখাপড়া শিখিয়ে দেবে। একবার কাজ শিখতে পারলে এ অফিস থেকে ও অফিস যাও, বেতন বাড়িয়ে নাও মতিঝিলে সায়েব সুবো থেকে শুরু করে পিওন চাপরাশি পর্যন্ত এই নিয়মে চলে। ওখানে লোকে চাকরি নেয় মালপানি কামাবার উদ্দেশ্যে। যতো পারো, যেভাবে পারো, টাকা বানাও! করমালিও কিছুদিন পর বেশি বেতনে অন্য অফিসে যেতে পারবে। চাকরিই ওর জন্য ভালো। এই পা নিয়ে চাষবাসের কাজ করবে সে কি করে? আর ওকে জমি বর্গাই বা দেবে কে? আর এখন গ্রামে দেখলেই আফসার গাজীর লোক ওকে নির্ঘাত পুলিসে ধরিয়ে দেবে।
করমালি চুপচাপ শোনে আর উসখুস করে। অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে বলে, কিন্তু ভাইজান, হামার তো বাড়িত যাওয়া নাগে!
বাড়ি? গ্রামে যাবে? কবে?
দুই চারদিনের মদ্যে গেলে ভালো হয়। অনেকদিন হয় বাড়িছাড়া-।
যাও। কাজে জয়েন করে সপ্তাহখানেক পর তিনচারদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে এসো। অফিসে বলো যে বাড়িতে সবাইকে বলে আসা হয়নি, বিছানাপত্র আনতে হবে।’
বিছানা?
আচ্ছা, বিছানা না হয় আমি ব্যবস্থা করবো। এই ঘরেই থাকবে। মেঝেতে অসুবিধা হবে?
না ভাইজান, দালানের মদ্যে মেঝেও যা, চৌকিও তাই। কথা সেটা নয়। বাড়িতে গেলে হামি তো আর আসবার পারমু না!
মানে? তোমার চাকরি ঠিক করলাম যে!
ঢাকাত বস্যা চাকরি করলে হামাগোরে পোষাবো, কন?
বাড়ির জন্য মন খারাপ করে? আনোয়ারের রাগ হয়, বাড়ির জন্যে এরকম স্যাঁতসেঁতে টান হলো এদের প্রধান রোগ, এই পিছুটান থাকলে এদের দিয়ে কি হবে?
ফাপরের কথা কন? ফাপর তো এ্যাঁনা নাগেই। তাই বলা ফাপরে অস্থির হলে হামাগোরে চলে? ধান কাটার সময় খিয়ার অঞ্চলে গেলে কয়টা মাস কোটে কোটে থাকি, তখন কি বাড়িঘরের উদিশ থাকে?
তাহলে? তাহলে বাড়ি যাবে কেন?
গাওত যাওয়া নাগবো না ভাইজান? গাওত বলে ওদিক কেয়ামত হবা নাগছে গো! গাজীগোরে শরীলেত এ্যাঁনা বাড়ি পড়ছে, বুঝলেন না? আবার শুনি ভোট নাকি হবো? সরকার পাটিও তারা, আবার অন্য পাটিও তারাই। ভোট হলে তামাম গাও খালি খচ্যা বেড়াবো। বৈরাগীর ভিটার বটগাছের ডাল ভাঙা হছে, পুরানা বাসিন্দা এখন তামাম গাওদের মদ্যে খালি নাফ পড়বা নাগছে!
‘তো তুমি এখন গিয়ে কি করবে? তোমাকে তো পুলিস ধরবে। বুঝতে পাচ্ছে না কেন?
আরো মেলা মানষের নামে তো মামলা করছে। সোগলির সাথে থাকলে বল পাওয়া যায়। ধরেন, হামরা চাষাভুষা মানুষ, একলা এই দালানের মদ্যে বস্যা থাকলে ক্যামকা ঠেকে। গায়ের মদ্যে অরা কেয়ামত করে, বুড়া বাপটকে ম্যারাই ফালালো নাকি?
আনোয়ার চুপচাপ ওসমানের উপুড়-হওয়া ঘুমন্ত শরীরের ওঠানামা দ্যাখে। করমালি আস্তে আস্তে বলে,ভাইজান, কোদ করলেন?
ক্রুদ্ধ না হলেও বিরক্ত তো হয়েছেই। ভাইয়াকে এতো করে বলে এর চাকরির ব্যবস্থা করে দিলো, লোকটা পাত্তাই দিলো না। ছোটো অপমানবোধটা সে চেপে রাখতে পারলো না, না, রাগ করবো কেন? কয়েকটা মাস পরে আমিও তোমার সঙ্গে যেতাম। গ্রামে তো আমারও কাজ আছে করমালি!
করমালি ওসমানের মশারি টাঙায়। ঘরে মশা গুনগুন করছে, রাস্তায় রিকশার টুংটং আওয়াজের স্পষ্টতায় রাত বাড়ে। করমালি বলে, এই ভাইজান ভালো না হলে আপনে যান কেমন কর‍্যা?
আনোয়ার উঠে দাঁড়ায়, ১২টা থেকে কারফ্যু। এখন রওয়ানা হলে কারফ্যুর আগে আগে ওয়ারি পৌঁছতে পারবে।
ঠিক আছে। তুমি যাও। কালকেই যেতে পারো। ওসমান সেরে উঠলে কিংবা হাসপাতালে ওর একটা ব্যবস্থা করে কয়েক মাস পার আমিও যাবো।
দরজা টরজা ঠিতমতো বন্ধ করা এবং ওসমান জেগে উঠলে তাকে পথ্য ও ওষুধ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আনোয়ার বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি দিকের দরজায় দাঁড়িয়ে ফের করমালির দিকে মুখ করে দাঁড়ায়, ইচ্ছা হলো আর এই অসুস্থ লোকটাকে ফেলে রেখে চলে গেলাম, তা তো হয় না করমালি। হুট করে চলে গেলে কোনো কাজ হয়?
না ভাইজান। করমালি আনোয়ারের সঙ্গে একমত, হুট করা নিজের মানুষ ত্যাগ করা আপনে যাবেন ক্যামন করা দ্যাখেন না, গা ছাড়া এটি থাকতে হামার কেমন উটকা উটকা ঠেকে!
পরদিন ওসমানের ঘুম ভাঙে সকাল ৮টা দিকে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে করমালি মেঝেতে গড়িয়ে খুমিয়ে পড়েছিলো। রাত্রে মাঝে মাঝে তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো, চমকে চমকে উঠে দেখছিলো ওসমানের দিকে। না, মিহি সুরে নাক ডাকছিলো ওসমানের। খুব ভোরে উঠে ছাদে মুখ ধুয়ে করমালি ফের বসেছিলো মেঝেতে। ওসমানের জাগরণের প্রতীক্ষায় বসে থাকতে থাকতে তার ভয় হচ্ছিলো, মানুষটার সঙ্গে দাখা না করেই তাকে বাড়ির দিকে রওয়ান হতে না হয়! করমালি অবশ্য ইচ্ছা করলে আরো কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারে। কিন্তু তাহলে এখানে চাকরি নেওয়ার জন্য আনোয়ার নতুন করে চাপ দেওয়ার সুযোগ পায়। এখন করমালি কি তাই পারে? বৈরাগীর ভিটার বাস্তচু্যত জীন গ্রামে কঁপিয়ে পড়েছে, সব তছনছ করে দিচ্ছে, এই সময় দালানের ভেতর সে বসে থাকে কোন আঞ্চেলে? আনোয়ারের কথা সে রাখে কিভাবে? আনোয়ার ভাইজান মানুষ খুব ভালো। মিয়ারা বলো, গাজীর বলো,-ভদরলোকদের মধ্যে এরকম মানুষ মেলে নাগো দাখো না, কাল রাত্রে করমালি চলে যাবে শুনে কতো রাগ করলো, আবার বেরিয়ে রাস্তা থেকে ফের মশা তাড়াবার কয়েল এন জ্বলিয়ে দিয়ে গেলো, ওসমানের মশারি টাঙিয়ে দিলে, মশা তো তোমাকে একলা পেয়ে সব রক্ত খেয়ে ফেলবে।’-না বাপু, এরকম ভালোমানুষ পাওয়া যায় না। বন্ধুর রোগ নিয়ে তার মাথা এখন গরম, করমালির ছটফটানি সে বুঝবে কিভাবে?-সকালবেলা মেঝেতে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে করমালির চোখ জড়িয়ে আসছিলো। কি, চেংটুর সঙ্গে সে হেঁটে চলেছে কোন নতুন চরের ভেতর দিয়ে। শীতকালের সর-পড়া যমুনায় বুদবুদ উঠেছে। চেন্টু বলছে, একটা খাপি জাল হলে পাঙাস ধরা গেলোনি রে! যমুনার ভেতর বড় পাঙাস ঘাই মারে। খাই মারার শব্দে তন্দ্রা ছিঁড়ে গেলে করমালি দ্যাখে, ওসমান খুব শব্দ করে হাই তুলছে।
চেতন পালেন, ভাইজন? খুব নিন্দ পাড়ছেন গো! ওঠেন, মুখ ধুয়া নাশতা করেন।
জড়ানো গলায় ও খুষি-খাওয়া-ফোলা ঠোঁটে ওসমান কি বলে করমালি বুঝতে পারে না। কি কন, ভাইজান? খিদা নাগছে?
আনোয়ার ঢুকে বলে, হ্যাঁলো ওসমান ঘুম ভাঙলো? এখন ফ্রেশ তো? ওসমান বড়োঁ বড়ো চোখে তাকালে তার চোখের গাঢ় লাল ও খয়েরি রেখাগুলোর রঙ পানসে মনে হয়। এতোহ্মণ ঘুমিয়ে কি তার চোখের অস্থির রক্তচিহ্ন মুছে গেছে?-চমৎকার আনোয়ারের বুক কাপে, ওসমান বোধহয় ভালো হয়ে গেলো! প্রচণ্ড আঘাত বা দুর্ঘটনার লুপ্তশ্ৰুতি ফিরে পাওয়ার কতো গল্প শোনা যায়। ওমসানের কি তাই হলো? কাঁপতে কাঁপতে আনোয়ার বলে, ওসমান ওঠে। মুখ ধুয়ে নাও। চলো আজ একটু বাইরে যাবো। রেক্সে যাবে?
অদ্ভুত ভঙ্গি করে ওসমানে হাসে, চলেন। আপনার গায়ে বুলেট লেগেছে কোথায়? আনোয়ার ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে। ওসমান কি তাকে চিনতেও পাচ্ছে না? তাহলে? সে কি ওসমানের অপরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হলো? করমালি চলে যাচ্ছে। আনোয়ার তো এখন থেকে এখানেই থাকবে। যার কাছে একবার অপরিচিত তার সঙ্গে কাটলে কিভাবে?
মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় আসন পেতে বসে ওসমান বলে, চা খেয়ে চলেন। করমালি নিচে হোটেল থেকে নানরুটি, কলেজির ভুনা তরকারি ও চা এনে দিলে আস্তে আস্তে সব খায়। তার ঠোঁটের ফেলাটা একটু কমেছে, তবে খেতে এখনো কষ্ট হচ্ছে।
এদিকে করমালির ট্রেন বেলা ১২টায়। আনোয়ার তাকে তাগাদা দেয়, করমালি তুমি যাও। গাড়িতে জায়গা না পেলে মুশকিল হবে।’
তাহলে চলেন ভাই।’ বলতে বলতে তক্তপোষ থেকে নেমে ওসমান স্যাণ্ডেল পায়ে দেয়। ছাদে পেচ্ছাব করে এসে জামা গায়ে দেয়, চলেন, আমি রেডি। খিজির তো আরো সকালে বেরুতে বলে গেছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলেন।’
বসো কোথায় যাবে? আনোয়ার ধমক দিলে ওসমান মিনমিন করে, রাগ করেন কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তো আমাকে ডাকলেন না কেন? চলেন। এখনো টাইম আছে।
করমালি ফ্যালফ্যাল করে সব দ্যাখে। আনোয়ার পকেট থেকে টাকা বার করে তার হাতে দেয়, রাখো।’
ট্যাকা দিলেন? করমালি ইতস্তত করলে আনোয়ার বলে, ‘ট্রেনের টিকেট করতে হবে। রাস্তায় খাওয়া দাওয়া—।’
আর পাঁচটা টাকা দিলে ভালো হলোনি ভাইজান। ঢাকা থাকা যামু, বাড়িত ধরেন ছোল পোলগুল্যান আছে, বুড়া বাপ আছে। কিছু খরচ করার হাউস করছিলাম।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আনোয়ার ছোট্রো করে হাসে, ‘এই অবস্থাতেও তোমার হাউস? তোমার গ্রামে নাকি কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে, এর মধ্যে তোমার হাউস আসে কোথেকে? আনোয়ারের এই বিরক্তির কোনো মানে করমালি বুঝতে পারে না। আফসার গাজী গ্রামে কেয়ামত শুরু করেছে বলে গ্রামবাসীরা কি সখ আহলাদ সব বিসর্জন দেবে? এর চেয়ে ভালো অবস্থা আবার ছিলো কবে?
‘নাও।’ আনোয়ার এবার ১০ টাকার ১টা নোট তার হাতে দিলে করমালি ৫টা টাকা ফেরত দেয়, পাঁচ টাকা হলেই হবো। বাপজানের একখান তবন আর ভাইসতাগোরে গোঞ্জি নিমু। কয়টা কলা নিমু ভাইজান। চেংট্রর বাপের হাতে কলা কয়টা দিলে বুড়ার ব্যাটা এ্যাঁনা খুশি হবো। গাড়ির টিকেট তো করমু না, আর পাঁচ টাকা হলেই হবো।
আরে নিয়ে যাও। ট্রেনের টিকেট করবে না কেন?
গাড়িত উঠি কতো, হামাগোরে টিকেট করা লাগে না ভাইজান। করমালি এবার তোলে ওসমানের প্রসঙ্গ, ভাইজানের অসুখ মনে হয় বাড়তিছে। আজ দ্যাখেন আপনাকে চিনবার পারতিছে না?
অসুখ বাড়বে কেন? আঠারো ঘণ্টা ঘুমিয়েছে, এখন একটু অন্যরকম তো লাগবেই। তুমি যাও। তোমার আবার কেনাকাটা আছে, ট্রেন ফেল করবে। যাও।’
তো যাই ভাইজান! যায়া না হয় খবর দিমু। করমালি দরজায় পৌঁছলে ওসমান দাঁড়ায় তার পেছনে, চলেন। তাড়াতাড়ি চলেন।
সিঁড়ির ধাপে পা রেখে করমালি ফিরে তাকায় ওসমানের দিকে, আপনে শুয়্যা থাকেন ভাইজান। আল্লা বাচালে আনোয়ার ভায়ের সাথে হামাগোরে গাওত একবার আসেন।
‘আঃ! করমালি, ফের দাঁড়াচ্ছে কেন? ওসমানের অবস্থা বুঝতে পাচ্ছে না? বলতে বলতে আনোয়ার দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ওসমানের ঘাড়ে হাত রেখে তাকে একরকম ঠেলে বসিয়ে দেয় তক্তপোষের ওপর। তারপর বন্ধ দরজায় ভেতরের দিকে কড়ায় তালা লাগাতে লাগাতে ওসমানের মিনতি শোনে, আমাকে বাইরে যেতে দিন না ভাই। খিজির ওয়েট করছে, জানেন তো মাটিতে ও পা ঠেকাতে পারে না। বেচারা কতক্ষণ ঝুলবে?
ওসমানের পাশে বসলে আনোয়ারের চোখে পড়ে বিছানার প্রান্তে ৫ টাকার নেট, টাকাটা উড়ে যাচ্ছিলো, আনোয়ার ধরে ফেলে। হ্যাঁ, করমালির ঐ নোটটাই। করমালি কখন যে টাকাটা রেখে দিলো আনোয়ার বুঝতেই পারলো না। করমালির বিদায়ের মুহুর্তে তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করার আওয়াজ এতোক্ষণ পর কর্কশ হয়ে বাজছে। আনোয়ার ছাদে গিয়ে রেলিঙে ঝুঁকে নিচের রাস্ত দ্যাখে। করমালিকে ডেকে এই টাকাটা দিতে পারলে ভালো হয়। সে না হয় সে নাদু পরামাণিকের হাতে টাকাটা তুলে দিতো।
রাস্তায় রিকশার সারি। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে নতুন রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যের রিকশা এসে অপেক্ষা করছে লাইন ধরে। রিকশার লাইনের ওপার ল্যাম্পোস্টের নিচে পান বিড়ি সিলেটের দোকান। এর একটু দূরে টিনের ডাস্টবিনের পাশে ঝগড়া করছে নেড়ি কুও ও ধুমসি কুওা। আরেকটু দূরে রিকশায় উঠে হুড ঢেকে দিচ্ছে ১ তরুণী। এইসবেরও সামনে ইলেকট্রিক তারের ঝাঁকের নিচে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে করমালি। আনোয়ার ডাকে, করমালি! ও করমালি!
কিন্তু রাস্তায় স্কুটার, রিকশা, নারায়ণগঞ্জগামী বাস, পথচারী মানুষ এবং ঝগড়ায় মত্ত কুকুরদের সমবেত ধ্বনিতে তার স্বর চাপা পড়ে। করমালি ফিরেও তাকায় না, খোড়াতে খোড়াতে চলে যাচ্ছে জনসন রোডের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *