1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ১৬

চিলেকোঠার সেপাই – ১৬

বুড়ো হয় গেলেন, তাও আপনের ইশ হলো না জামাই মানুষ, জামায়ের লাকান থাকেন। কোটে কেটা মার খালো, কোটে কেটা কার সাথে ঝগড়া-বিবাদ করে-সোগলির প্যাগনা কি আপনার ঘাড়তই তোলা লাগবো? তোমাক কই বাপু, সারাটা জেবন মানুষটা হামাক জুল্যা পুড়া কিছু খুলো না!
হ্যারিকেনের লালচে হলদে আলোয় কৈ মাছের কাটা বাছতে বাছতে আনোয়ার জালাল মাস্টারের বৌয়ের সংলাপ শোনে। জালাল মাস্টারকেও শুনতে হয়। তার স্ত্রীর বাক্যে সম্বোধন করা হয়েছে ২জনকেই। ভাত খেতে আনোয়ারের ভালোই লাগছে। লতায় পাতায় জড়ানা দূর সম্পর্কের এই ফুফুটা তার রাধে ভালো। তার কথা শুনতে শুনতে মনে হয় অন্যের জিভে সুখ দেওয়ার ব্যবস্থা করে নিজের জিভের সুখ ফুফু উসুল করে অন্যভাবে। জিভটা তার ভয়ানক সচল, ঘণ্টা খানেক হলো ফুফু তার সামনে আসছে, যাচ্ছে,-এর মধ্যে একনাগাড়ে ৫ মিনিটও বিরতি দেয়নি। আবার জালাউদ্দিনকেও আনোয়ার কখনো এতোটা বাকবিমুখ দাখেনি। স্বামীর এই নীরবতায় জালালউদিনের স্ত্রীর উৎসাহ মাঝে মাঝে বাড়ে, তখন তার কথা বেরিয়ে আসে তীব্র বেগে। আবার স্বামীর ঔদাসীন্যে মাঝে মাঝে তার রাগ হয়, তাতেও কথার বেগ বাড়ে।
‘খয়বার গাজীর সাথে আপনে সামাল দিব্যার পারবেন? এ্যাঁ, তুমিই কও তো বাবা? তাই বলে শয়ে শয়ে বিঘা জমির মালিক, যমুনার চর যেটি যা উঠবো ব্যামাক নিবো তাই। তাক আঁটো করবার চান আপনে? কোটে বলে মহারাজ আর কোটে কলাগাছ। আপনার সাহসটা এ্যাঁনা বেশি, বুদ্ধিটা যদি তার এক আনাও থাকলোনি তো—।’
জালাল মাস্টার আস্তে করে বলে, ‘খয়বার গাজীক আঁটো করে কেটা? সকল গ্রামবাসীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধন করার জন্যে তিনি অস্থির তার সাথে আমার কিসের কলহ? কিসের বিবাদ? –
বিবাদ আপনে পাকান আসমানের মধ্যে আপনে টেকির পাড় দিবার চান।-বাবা, মাছ আরেকটা দেই? আনোয়ারের পাতে আরেকটা পাবদা মাছ দিয়ে ফুফু তার অসমাপ্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেয়, এই চেংটু ছোড়া গোলামের পয়দা গোলাম, এটা অতো লাফ পাড়ে কিসক? খয়বার গাজী এ্যাঁর পিছে লাগছে, এটাক শ্যাম্ব না করা তাই ছাড়বো? গাজীর ব্যাটার ভয়ে তার বাপ, তার জন্মদাতা বাপ তাক জায়গা দেয় না, সেই চেংটুক আপনে ঘরত তোলেন। এই সোস্বাদ পালে খয়বার গাজী আপনার কি দশা করবো তা জানেন?
জালালউদ্দিন একটু হাসি মুখ করে, মোসাম্মৎ রহিমা খাতুন, তোমার প্রথম কর্তব্য নিজের অজ্ঞতা দূর করা। না দেখ্যা, না শুন্যা, খালি আন্দাজে কথাবার্তা কলে বিবেচনার পরিচয় দেওয়া হয় না।
নাম ধরে ডাকায় রহিমা খাতুন লজ্জামিশ্ৰিত সুখে ও রাগে স্বামীকে ধমকায়, বুড়া হলেন আপনার আক্কেল হলো না। চ্যাংড়া প্যাংড়ার সামনে কি কয় না কয়- তার কথা আর শেষ হয় না, আঠালো শব্দে এই নিঃসন্তান প্রৌঢ়ার কণ্ঠ জড়িয়ে আসে, পান-খাওয়া ঠোঁটের কালচে খয়েরি কোণ দুটো বাঁকা হয়, বাঁকা হয়েই থাকে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে জালাল মাস্টার, নাদু আমাকে খুব ধরছিলো। এবার বর্ষ খুব প্রবল হলো তো, নাদুর একটা ঘর হেল্যা গেছে। গত বছর বড়ো ব্যাটার বিবাহ দিলো, ঘরের এক কোণে কলাপাতার বেড়া তুল্যা পুত্র পুত্রবধূ থাকে, আর বাকি কয় হাত জায়গাত থাকে নাদু, নাদুর পরিবার দুটা ব্যাটা, ছোটো বেটিও থাকে। নাদু কয়, সরকার, আপনার গোয়াল তো খালি থাকে, বকনাট মরার পর আর গোরু কিনলেন না, এড়াটাও বেচলেন, গোয়াল সাফ সুতরা করা নিয়া চেংটু কয়টা দিন থাকবো। ধান মাড়াইয়ের কামটা হলেই মিয়াবড়িত থাকা খ্যাড় নিয়া নতুন ঘর তুলমু। এই কয়টা দিন চেংটুক এ্যাঁনা জায়গা দেন।—তা কি করি। কল্যাম, থাকো বাপু বিপদে আপদে আশ্রয় দান মানুষের ধর্ম। না কি কও আনোয়ার?
এই বিবৃতিতে নিরঙ্কুশ আস্থা স্থাপন করা রহিমা খাতুনের পক্ষে মুশকিল। অবিশ্বাসে তার স্বর মৃদু হয়, বর্ষ গেছে চার মাস হলো, এই কয়টা মাস তারা থাকবার পারলো নাদুর বড়োব্যাটা বিয়া করছে এক বছরের উপরে, মরা একটা বিটিও হলো তার; আর এখন জায়গা নাজাই পড়ে চেংটুর, না?
জালাল মাস্টার এখন নীরব। দুধ দিয়ে কলা দিয়ে গুড় দিয়ে ভাত মাখার কাজে সে একাগ্রচিত্ত। রহিমা খাতুনের অবিশ্বাসী কণ্ঠ ক্রমে চড়া হয়। চেংটুকে রাত্রিবেলা থাকতে দিয়েছে কেন সে কি বুঝতে পারে না? খয়বার গাজীর লোক তাকে যে কোনো সময়ে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে—এ কথাটা কে না বোঝে? নেহায়েৎ মিয়াদের জমিতে থাকে, তাই দিনে দুপুরে তাকে তুলে নেওয়াটা দেখতে খারাপ লাগে, নইলে খয়বার গাজীর কাছে এটা কি কোনো শক্ত কাজ? খয়বার গাজীকে সে তার স্বামীর চেয়ে অনেক ভালোভাবে চেনে। তার আপন খালুর চাচাতো ভগ্নীপতির মামাতো বোনের শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে খয়বার কি তার মামা হয় না? খয়বার মামুর সম্পত্তির কথা, প্রতাপের কথা তারা শুনে আসছে জন্মের পর থেকে। তার সঙ্গে লাগতে যায় কোথাকার গোলামের বাচ্চা গোলাম চেংটু পরামাণিক। আবার সেই ছোড়ার সর্দার হয়েছে জালাল মাস্টার। চেন্টুর শয়তানিটা তার চোখে পড়ে না? তার মামার ভাইপো, সেও তো তার মামাতো ভাই হলো, তাকে কুকুর লেলিয়ে দেয় যে শয়তান সে কি-না নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করতে এসেছে তারই বাড়িতে? স্বামীর জন্য পান সাজতে সাজতে রহিমা খাতুন বিড়বিড় করে, খয়বার মিয়া হাজার হলেও একজন মানী মানুষ। আপনে যে এতোদিন মাস্টারি করলেন সেই ইস্কুলের জমি দান করছিলো কেটা? খয়বার গাজীর বাপ না? খয়বার মিয়ার বাপ ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলো পুরা তিরিশ বছর। তাই নিজেও চেয়ারম্যানগিরি করছে দশ বছর; চেংটু লাগে তার সাথে?
জালাল মাস্টার বলে, ‘আরে মানী মানুষ, ভালো বংশের সন্তান, ঐ কারণেই মিটমাট করা ফালান দরকার। বোঝে না, গায়ের চাষাভুষারা কেমন বেয়াদব হয় উঠতিছে। চাষার রাগ, জাহেল মানুষের রাগ হলে কি হয় কেউ কবার পারে? তখন তোমার মামুই বেইজ্জত হবো! হবো না?
হলে হোক। রহিমা খাতুন ভাত খাবার থালা বাসন তোলে, তক্তপোষে বিছানা মাদুর, দস্তরখান তুলে ঝাড়ে আর বলে, তাই মানুষ হলো একখান বদের হাড্‌ডি! খয়বার গাজীক আমি চিনি না? আত্মীয় হলে কি হয়, হক কথা কতে দোষ কি? তাই কতো মানষের সর্বনাশ করছে তার ল্যাখাজোকা নাই। কতো মানুষ তাক শাপমণি দিছে! এই অঞ্চলের গরিব মানষের গোরু তাই সব নিয়া রাখছে চরের মধ্যে। এই মানুষের কিছু হলে আপনের কি? রহিমা খাতুনের এই পক্ষ পরিবর্তনে আনোয়ার হা হয়ে যায়। জালাল মাস্টার বলে, ‘খয়বার মিয়া অন্যায় যদি করা থাকে তো তাক ভালো করা বুঝায়া কলেই তাই বুঝবো। মানী মানুষটার বেইজ্জত করা কি সৎ কাম হবো?
বেইজ্জত কনকি? রহিমা খ্যাক করে ওঠে, মানষের সাথে তাই যা ব্যবহার করতিছে, সুযোগ পালে মানষে তাক পিস্যা খাবো, ছেচা খাবো। কল্যাম, এই কথাটা কল্যাম। দ্যাখেন, ঠিক হয় নাকি দ্যাখেন।’
উত্তেজিত হও কিসক? খয়বার মিয়া জেদি মানুষ। বড়োমানষের ব্যাটা, বড়োমানষের নাতি, শৈশবকাল থাকা যা কামনা করছে তাই তার হাতোত আসছে। জেদী হবো না? তাক সৎ পরামর্শ দিবার মতো মানুষের বড়ো অভাব!’
আপনের পরামর্শ তাই নিবো? আপনাক দুইটা পয়সার দাম দেয়? তার মান-সম্মানইজ্জত নিয়া আপনের লাগে কিসক, কন?
আনোয়ার জটিলতার মধ্যে পড়ে। জালাল মাস্টার খয়বার গাজীর মান-সম্মান নিয়ে এতো মাথা ঘামায় কেন? রহিমা খাতুন হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বাবা রাত হছে, তোমায় চাচা চাচী আবার অস্থির হয় পড়বো। এই মানষের পাল্লায় পড়লে রাত ভর খালি গল্পোই করবো! আজ খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। বারান্দা থেকে নিচে নামতেই মনে হলো যেন সর-পড়া পুকুরে লাফ দেওয়া হলো। জালাল মাস্টার বৌকে ডাকে, ক্যাগো, দুয়ার দাও। একটু আগায়া দিয়া আসি৷ না না, আপনি যান। আমি একাই যেতে পারবো। আনোয়ার ভদ্রতা করে বলে বটে কিন্তু বাইরে বেশ অন্ধকার। চাঁদ উঠেই ডুবে গেছে, তারার আলো ততো স্পষ্ট নয় বলে উঠোনের শূন্যতা তবু একটু সহনীয়। চাঁদের আলো থাকলে এই উঠান থেকে শুরু করে সামনের শূন্য ধানজমি পর্যন্ত খ খ করতো। অন্ধকারের জন্য ফাঁকা ফাকা ঠেকে না, কিন্তু আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত বিপুল জায়গা জুড়ে ঘোরতর অনিশ্চয়তা।
বারান্দার ওপর থেকে রহিমা খাতুন বলে, কিষানপাট কেউ নাই? নিওড়ের মধ্যে হাঁটাহাটি করা অ্যাস আপনে দম নিবার পারবেন? তখন বুকত তাল মালিশ করবো কেটা? তামামটা দিন হামি চোকির সাথে পিঠ ঠেকাবার পারি নাই, আবার রাত ভরা আপনের খেদমত করা নাগবো? হামার নিন্দা পাড়া নাগে না?
আনোয়ার বিব্রত হয়, আপনার শরীর খারাপ, আপনি বরং শুয়ে পড়েন।’ এই সময় অন্ধকারে খড়ের গাদার আড়াল থেকে শোনা যায়, ‘আপনে ঘরত থাকেন, হামি যাই।’
‘কেটা? কথা কয় কেটা? রহিমা খাতুন চমকে ওঠে, কেটা গো? হামি চাচী। গায়ে কথা-জড়ানো চেংটু এগিয়ে আসে। ‘তুই’ ছু আনোয়ারকে দেখিয়ে চেন্টু বলে, তাই একলা যাবো, তাই উঠা আসলাম। চেংটুর কথায় জালালউদ্দিন হা হা করে ওঠে, ‘তুই যাবু? তোর প্যাট কানা করা দিবো না? তোর সাহস বেশি হছে, না?
রহিমা খাতুন শান্ত গলায় হুকুম দেয়, চেংটুই যা। চ্যাংড়াক ঘরোত দিয়া আয়। দেরি করিস না বাবা!

রাত্রি ১০টায় মনে হচ্ছে গভীর রাত্রি। জালাল মাস্টারের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি যেতে ছোটোখাটো একটা গ্রাম পেরোতে হয়। এই গোটা গ্রাম জুড়ে ওদের আত্মীয়স্বজন, ওদেরই জ্ঞাতিগুষ্টি। বাড়িঘর সব হাতের ডানদিকে। বেশির ভাগই টিনের ঘর, মাঝে মাঝে একতলা দালান। কারো কারো বৈঠকখানায় খড়ের পুরু ছাউনি। তারার খুব আবছা আলোয় রাস্তা কোথাও চওড়া হয়ে যায়, কোথাও গাছপালার ছায়া পড়ায় সঙ্কীর্ণ হতে হতে পরিণত হয়েছে সরু রেখায়। মাঝে মাঝে কারো বাশঝাড়ের কয়েকটা বাঁশ নুয়ে পড়ায় একেকটা তোরণের মতো হয়েছে। বাঁদিকের জমির কোথাও কোথাও ধান কাটা হয়ে গেছে, সেখানে কেবল কুয়াশা। কোনো কোনো জমিতে মরিচ গাছ। ডানদিকের উঠানগুলোতে লাল মরিচ বিছানো, টিনের ছাদে ছাদে পাকা মরিচের লাল রঙ, লাল রঙের বিছানা। অন্ধকারেও লাল রঙ একটু আলাদা। অন্ধকারের কালো রঙ ও মরিচের লাল রঙ ছাপিয়ে ওঠে ভয়াবহ নীরবতা, এই গ্রামে কি ঝিঝি পোকাও ডাকে না? চেংটু হেঁটে যাচ্ছে সামনে, গায়ে তার টুটাফাটা কাঁথা, এই কথার নিচে একটুও না কেঁপে কি করে যে শীত ঠেকায় সে-ই জানে। এই সব কাথায় দুর্গন্ধের আর শেষ থাকে না। নিজের নাকটাকে আনোয়ার এখন পর্যন্ত ঠিক আয়ত্তে আনতে পারেনি, ইচ্ছা করেই তাই সে একটু তফাতে হাঁটে। কোনো কোনো বাড়ির উঠান থেকে নতুন সেদ্ধ-করা ধানের গন্ধ পাকা মরিচ বা অন্য কেনো কিছুর গন্ধের সঙ্গে মিশে এদিক ওদিক ভাসে। এই শীত, এই বিচিত্র গন্ধ, এই আবছা আলো—সব কিছুই নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা যেতো। কিন্তু চেংটুর সাঙ্ঘাতিক নীরবতাকে জেদ বলে মনে হওয়ায় আনোয়ারের সারা শরীরে তেতো স্বাদ। তার রাগ হয়। চেংটুক এই জেদ কি শোষিত মানুষের ডিফেন্স? আনোয়ারকে সে তার প্রতিপক্ষের লোক ভাবে নাকি? কেন? আদর্শ কিংবা রাজনীতি যদি ছেড়েও দেওয়া যায়,–সবাই শেষ পর্যন্ত এসব বহন করতে পারে না,-কিন্তু আনোয়ারের রুচির ওপর তো তার আস্থা থাকা উচিত। খয়বার গাজীর মতো আনোয়ার কি কখনো কোনো নিঃস্ব মানুষকে সর্বস্বাস্ত করার ফন্দি আঁটতে পারে? মিয়াবাড়ির ছেলে বলে সে কি চেংটুর কাছে সন্দেহজনক চরিত্র? তাহলে মাস্টার? জালাল মাস্টারের কাছে আশ্রয় চাইতে চেষ্ট্রর ভয় হয় না। জালালউদ্দিন কি খয়বার গাজীর ইজ্জতের বাহার ঠিক রাখার জন্য উদগীব নয়? চরম সঙ্কটের সময় সে কি চেন্টুর পক্ষে থাকবে? তবে? রাজনৈতিক শিক্ষা নাই বলে চাষা ও দিনমজুর মানুষ চিনতে ভুল করে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আনোয়ারের ক্ষোভ দূর করতে পারে না। ক্ষুব্ধ শরীরে হাটতে হাটতে সে শোনে, কেটা যায়?
ডানদিকে জুম্মার ঘরের পাকা দালান। দালানের উঁচু বারান্দায় বসে-থাকা ১টি মানুষের অস্পষ্ট কাঠামো। কয়েক পলক পর বোঝা যায় লোকটি অজু করছে। বদন হাতে রেখে লোকটি ফের জিগ্যেস করে, কেটা যায় গো! চেংটু জবাব দেয়, হামরা হুজুর।’
হামরা কারা? লোকটির মোটা স্বর একটু সন্দেহপ্রবণও বটে, নাদুর ব্যাটা না? কোটে যাস? চেংটু থামে না, এমনকি তার পদক্ষেপও ধীরগতি হয় না।
বদনা হাতে লোকটি জানতে চায়, সাথে কেটা রে? দাঁড়িয়ে আনোয়ার জবাব দেয়, জী, আমার নাম আনোয়ার।’ চেংটু চাপা গলায় বলে, পাও চালান ভাইজান। চেচিয়ে আনোয়ারের পরিচয় দেয়, বড়োমিয়ার নাতি।’
লোকটি শব্দ করে কুলকুচো করে। এর মধ্যে ওরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। হাটতে হাটতে আনোয়ার বলে, কে চেংটু? ‘কারী সায়েব। ‘কে? ‘কারী সায়েব। জুম্মাঘরেত থাকে। কোরান শরীফ পড়ে। এক বছরের উপরে মোয়াজ্জিন গেছে বাড়িত, কারী সায়েব আজানও দেয়। কয়েক পা হেঁটে চেন্টু বলে, এমনি মানুষ ভালো। কিন্তু দোষের মধ্যে ঐ একটাই।’ বলতে বলতে সে হাসে, ‘খালি কথা কয়। হয় কোরান শরীফ পড়বো, না হলে কথা কবো। মুখ বন্ধ হয় না। একবার টাডনেত যাবো, কথা কতে কতে মটর চল্যা গেছে, দিশা পায় নাই। বাকসো সামান আছিলো মটরের মদ্যে, আর পায় নাই। চেংটু বেশ জোরে হাসে, আনোয়ারও হাসে। একটু বেশিই হাসে।
সেই হাসিটা ঠোঁটে সেঁটে রেখে বা দিকে তাকালে দ্যাখা যায় বেশ বড়ো একটা মজা পুকুর। পুকুরটা আনোয়ার ভালো করে চেনে, এর নাম বৈরাগীর দিঘি। বৈরাগীর দিঘির পর বিঘা তিনেক চাষের জমি, তারপর অন্ধকারে সুযোগ পেয়ে এই জমি যেন হঠাৎ করে ফেঁপে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। না। ভুলটা আনোয়ারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভাঙে। অন্ধকার রাত্রে বৈরাগীর ভিটার বটগাছের অদ্ভুত জবুথবু চেহারা হয়েছে! দিনের বেলা এই গাছের কি গম্ভীর মূর্তি। চারদিকে ছড়ানো শিকড়বাকড়ের মধ্যে তার বিস্তৃত ও বর্ধমান রূপ দেখে সবাই মোহিত ও ভীত হয়ে পড়ে। পুরো সাড়ে তিন বিঘা জমি গ্রাস করার পরও তার থামবার লক্ষণ নাই, সে কেবল বেড়েই চলেছে। আরো তিন বিঘা জমি পেরিয়ে এই দিঘি পর্যন্ত পৌঁছলে হয়তো তার সম্প্রসারণের পিপাসা মিটবে। জমাট-বাধা অন্ধকার আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লে আনোয়ারের চোখে বটগাছের চেহারা নির্দিষ্ট আকার পায়। সমস্ত শরীরটাকে গুটিয়ে ফেলে বটগাছ যেন ঘুমাচ্ছে। নিশ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা তার শরীরে স্পষ্ট। প্রাচীন বটবৃক্ষের এই বিশ্রামের দৃশ্যে অভিভূত আনোয়ার একটু পিছিয়ে পড়েছিলো। চেন্টু বলে, পাও চালান। পা চালিয়ে চেন্টুর পাশে এসে পড়লে সে জিগ্যেস করে, আপনে ঢাকাত যাবেন কোন দিন?
ঠিক নাই। কয়েকদিন থাকবো, বেশ কয়েকদিন। কেন? না, এমনি!’ কিছুক্ষণ পর চেংটু ফের জানতে চায়, জালাল মিয়া কয় আপনে বলে সংগ্রামের একজন নেতা? ইস্কুল কলেজের চ্যাংড়া প্যাংড়া আপনাক খুব মানে, না? মিছিল বার করলেই তো পুলিশ গুলি করে। ছাত্রগোরে ভয়ডর নাই, না?
এই চাষা ছেলেটির কাছে তাকে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে জালাল মাস্টারের ওপর তার রাগ হয়। জালাল মাস্টার হয়তো তাকে ভালোই বাসে। জালাল মাস্টার আবার খয়বার গাজীর জন্যে তাকে ব্যবহার করছে না তো? আসল কথাটা বলা দরকার। কিন্তু কি করে বলবে? সে জবাব দেয়, রাজনীতি তো করিই। কিন্তু নেতাগোছের কেউ নই। নেতা হওয়ার জন্য আমরা রাজনীতি করি না।’
তাহলে? কিসের জন্যে করেন? চেংটুর এই প্রশ্নে কোনো শ্লেষ নাই, তার কথার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় যে, নেতৃত্ব অর্জন ছাড়া রাজনীতিতে তৎপর লোকজনের আর কি লক্ষ্য থাকতে পারে সে জানে না। এই লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করার মধ্যে চেংটু দোষেরও কিছু দেখতে পায় না।
আনোয়ার বলে, রাজনীতি ছাড়া মানুষ ভালোভাবে বাচতে পারে না। রাজনীতি ছাড়া মানুষ ঐক্যবদ্ধ, মানে একতাবদ্ধ, মানে একজোট হবে কি করে? কিসের জোরে? একজোট না হলে ধরে খয়বার গাজীর মতো লোকদের তোমরা ঠেকাতে পারবে?—খুব চেষ্টা করেও কথাগুলো এর চেয়ে সহজ করে বলা গেলো না। আর কিভাবে কথাটা পরিষ্কার করা যায় আনোয়ার তাই ভাবে। কিন্তু তার কথার মাঝখানে চেংটু বলে, ‘আলিবক্স ভাই কয়, আর বেশিদিন লাগবো না। হামাগোরে গাওত হামরা বিচার বসামু!
‘আলিবক্স?
‘চেনেন না, না? সিন্দুরিয়া চরের। শঙ্করপুর চেনেন তো? শঙ্করপুর ভাঙলে পরে পুবে সিন্দুরিয়া চরে উঠছে। মাদারগঞ্জ কলেজত পড়ে। সিন্দুরিয়াত আদালত বসছিলো, মেলা কিষানপাট জড়ো করা ডাকাত-মারা চরত গেছিলো। যাগোরে গোরু চুরি হছিলো, সোগলিক নিয়া গেছিলো, সোগলি ঠিক করছিলো খয়বার গাজীর বাগান থাকা গোরু নিয়া গোরুর মালিকগোরে ফেরত দিবো।’
পারেনি?’
না। খয়বার গাজীর মানুষ মেলা, হাতিয়ারও মেলা। আলিবক্স ভাই কুলাবার পারে নাই, নাও নিয়া আবার সর্যা গেছে। তবে চেংটু এতে হতাশ নয়। কয়বার ঠেকাবো কন? এই শালা খয়বার গাজী মানষের পয়দা না। কতো গরিব মানুষের উজিওজগার তাই বন্ধ করা দিছে! গোরু হারালে চাষামানুষ কাম করবার পারে? হামরা আর বিচার করমু। অর ভাইয়ের ব্যাটা আফসার গাজী, মিয়াবাড়ির অশিদুল, ফকিরবাড়ির ফরিদ,-সোগলির বিচার হবো। আফসার শালা আছে খালি মাগীমানষের পাছত, চাষাভূষার ঘরত এ্যাঁন সুন্দর মাগীমানুষ দেখলে তাই খালি ফাল পড়ে। আর শালা অশিদুল করে কি জানেন?—এক জমিত কাকো তাই দুই তিনবারের বেশি বর্গ করবার দিবো না। শালা এক জমি পাঁচজনের কাছে বর্গ দেয়, বর্গাদাররা কাইজা করে অশিদ মিয়া মজা মারে। তাই—। চেংটু হঠাৎ থেমে যায়। তার কি মনে পড়ে গেছে যে, রশিদুল হক লোকটি আনোয়ারের বাপের চাচাতো ভাইও বটে? আরে বাবা, তাতে আনোয়ারের কি? রশীদ মিয়া পুরা টাউট, ঢাকায় গিয়ে আনোয়ারের মাকে পটিয়ে ১০০টা টাকা বাগিয়ে এনেছিলো, সেই ব্যথা আম্মা এখন পর্যন্ত তুলতে পারেনি।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, কারা বিচার করবে?
হামরাই। হামি আলিবক্স ভাইয়েক কছি, বৈরাগীর ভিটার বটগাছের তলাত আদালত বসবো, বিচার হবো ওটি!
আনোয়ার উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে, সত্যি?
হামি মিছা কথা কইনা ভাইজান চেংটুর গলায় তলানি পড়ে। সে ফের চুপ করে যায়। আনোয়ারকে সে ঠিক বুঝতে পারে না কেন? নিজেকে ঠিকমতো প্রকাশ করার জন্যে আনোয়ার ছটফট করে, নানাভাবে সে শব্দ খোজে, বাক্য ঠিক করে, কিন্তু কিছুঁতেই সম্পূর্ণ তৈরী হতে পারে না। এইরকম ভাবতে ভাবতে একবার বলে, বিচার করাই দরকার। আমাদের দলের ছেলেরা, এইতো কাছেই, সিরাজগঞ্জ মহকুমা চেনো?-সিরাজগঞ্জের গ্রামে গণআদালত করেছে। কিন্তু এখানে তো আবার ভদ্রলোক, মানে জোতদার, মানে অবস্থাপন্ন লোক বেশি, এখানে গণআদালত করা কি সুবিধা হবে?
না, এটি বড়োলোক বেশি কৈ? এই কয়টা ঘরই আপনার চোখত পড়ছে? মাঠের ঐপারে তো সোগলি হামাগোরে চাষাভূষার গাও। ঐ যে বটগাছের ঐপারে জমি– ‘ বটগাছের মাথার দিকে তাকিয়ে চেংটু হঠাৎ নীরব হয় এবং থমকে দাঁড়ায়। আনোয়ার জিগ্যেস করে, কি হলো?
চুপ করেন!
চারদিকে ভয়াবহ নীরবতা। চেংটুর চোখ বটগাছের মাথার ওপর। সুতরাং সেদিকেই না তাকিয়ে আনোয়ারের উপায় নাই। সেখানে কি? কুয়াশা টাঙানো বটগাছ যেন সমস্ত প্রান্তর জুড়ে রাজত্ব করে। তার চোখের পলক পড়ে না। বটগাছের ঝাঁকড়া মাথায় চেংটু কি দেখছে? টিনের কি খড়ের চাল ও উঠান থেকে পাকা মরিচের গন্ধ আসছিলো, সুযোগ পেয়ে তাও শালা উধাও। সেদ্ধ-করা ধানের সুবাসও কি হাওয়া হয়ে গেলো? কান দুটোও মনে হয় বটগাছ দ্যাখার কজে নিয়োজিত। এখন যাবতীয় আওয়াজ লুপ্ত। গাছ থেকে শিশিরবিন্দু পড়ার মৃদু, অতিমৃদু ধ্বনিটুকুও লুফে নেয় শীতের শুকনা মাটি। আনোয়ারের বুকে টিপটপ আওয়াজ হয়, তাও তার সমস্ত বোধের বাইরেই থাকে। এইভাবে কতোক্ষণ কেটে গেছে আনোয়ার জানে না। হঠাৎ শুনলো, চলেন।
কোনো কথা না বলে দুজনে চলতে শুরু করলে চেন্টু বলে, উড়া গেলো, দেখলেন? কি?
দেখলেন না? ঐ পুবকোণের মগডাল থাকা একটা উড়াল দিলো, সোজা উত্তরের মুখে গেলো, দেখলেন না?
কি গেলো? কি?’
চেন্টু চুপ করে থাকে, আনোয়ার অস্থির হয়ে ওঠে, কি?
আত্রে নাম নেওয়া হয় না, আত্রে তেনাগোরে নাম নেওয়া মানা।
আনোয়ারের সারা গা ছমছম করে উঠলো। চেংটুর পিঠে ডান হাত রেখে তার কাঁথা খামচে ধরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, ‘জীন?
চেন্টু বলে, কল্যাম না? আতোত নাম নেওয়া হয় না। হাটতে হাঁটতে আনোয়ারের মুখের দিকে তাকায়, ভয় পালেন?
না? আনোয়ার একটু হাসার চেষ্টা করলে তার মুখের অসহায়ত্ব আরো প্রকট হয়, তবে অন্ধকারে তাও অদৃশ্যই থাকে। কিন্তু তার পিঠের ওপর আনোয়ারের হাত চেষ্ট্রকে সব বুঝিয়ে দেয়। চেংটু নরম করে বলে, ভয় করেন কিসক? কিছু কবে না। এটিকার পুরানা বাসেন্দা। কাকো কিছু কয় না।
শুকনা কাটা-কাটা টোক গিলে আনোয়ার বলে, থাকলে তো বলবো’ অশরীরী জীবের অস্তিত্বের প্রতি আনোয়ারের এই অবিশ্বাস ঘোষণা এতো ক্ষীণ যে, প্রায় শোনাই যায় না। অথবা শুনতে পারলেও চেন্টু পাত্তা দেয় না। খুব স্বাভাবিক গলায় সে বলে, অনেকদিনের বাসেন্দা। মুরুব্বিরা কয়, তার সবই ভালো, যতো কিছুই হোক এটিই থাকে। নড়ে না। খালি বিবাদ দেখলে তার গাও জ্বলে। বিবাদ তাই সহ্য করবার পারে না।
বিবাদ ?
ছু বিবাদ! গায়ের মদ্যে গোলমাল কি ঝগড়া-কাজিয়া, বিবাদ-বিসম্বাদ, লাঠালাঠি, মারামারির দিশা পালে উত্তরের মুখে তাই উড়াল দেয়!
উত্তরে?
ছু ছোটো থাকতে দাদার কাছে শুনছি চান্দের পয়লা সাত দিনের মধ্যে বৈরাগীর ভিটার বটৰিরিক্ষের এই পুরানা বাসেন্দা উত্তরের মুখে উড়াল দিলে গায়ের মানুষ ভয়ে সিটকা নাগছে, বড়োলোকরা মিলাদ দিছে, শিরনি দিছে, মানত করছে। জুম্বার ঘরত নফল নামাজ পড়ছে।
এবার হবে না?
আপনাগোরে বাড়িত একবার ডাকাত পড়ছিলো, আপনার দাদার আমলে। হুনছি তার সাতদিন আগে পুরানা বাসেন্দা এই জায়গা ছাড়া চলা গেছিলো।’
‘তো এবার মিলাদ দেবে না? নফল নামাজ পড়বে না? আনোয়ার বেশ সহজ হয়ে আসছে, তার কথায় ভয়ের জায়গায় ঠাট্টার একটুখানি ঝাপ্টা লক্ষ করা যায়, মিলাদ না দিলে আবার ঝগড়া বিবাদ লাগতে পারে না?
চেংটু বলে, কেউ দেখলে তো দেখছে কেটা? আপনেও তো দেখলেন না?
তুমি দেখেছে। তুমি বললেই সবাই জানবে। কাল তুমি সবাইকে বলবে না? চেন্টু হটতে হাটতে বলে, হামার গরজ? চেষ্ট্র ফের চুপ করে থাকে। ১টা ২টো ৩টে ৪টে ৫টা ৬টা ৭টা ৮টা কদম ফেলা হয়, ছেলেটা আর কথাই বলে না। এদিকে মানুষের কথা ছাড়া আনোয়ারের গতি নাই, ওপরে তাকাতে সে ইতস্তত করে: কি জানি মাথার ওপর বিশাল শূন্যতায় কেউ হয়তো দীর্ঘ অগ্নিময় উড়াল দিচ্ছে। সেই উড়ালের হিসহিস ধ্বনি না শোনার জন্যে কানজোড়া তার বন্ধ রাখা দরকার। চেন্টুটা দিব্যি সামনে সামনে হেঁটে চলেছে, এর পরেও তার পাটলে না। চেন্টুর কথায় যা হয়নি, ওর নীরবতায় বটগাছের অশরীর জীব প্রতি মুহুর্তে আকৃতি পাওয়ার পায়তার করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অদৃশ্য বলে সেগুলোকে হাত পা মুণ্ডু বলে সনাক্ত করা যায় না। কিন্তু চেন্টুর এই নীরবতা অব্যাহত থাকলে আনোয়ারের সামনে সশরীরে আসতে জীনের আর কতোক্ষণ আনোয়ারের রাগ হয়, অশিক্ষিত মূৰ্খ ছোকরা কুসংস্কারের ডিপো। কিন্তু বিভ্রম দ্যাখার জন্যে চেংটুর ওপর এই রাগ তেমন জমে না। বরং প্রতিটি নীরব পদক্ষেপে তার নিজেরই জীন দ্যাখার সম্ভাবনা বেড়ে চলে। তখন চেংটুর দ্যাখা এই বিভ্রম থেকে রেহাই পাবার জন্য শ্লেষখচিত কণ্ঠে আনোয়ার বলে, ‘জীন উড়াল দিলো, সবাইকে খবর দিতে হবে না? ঝগড়া বিবাদ হলে সকলেরই বিপদ।
কিসক? চেংটুর কথায় পাল্টা ক্রোধ। ঠাট্টাবিদ্রুপ বোঝা এই ইডিয়টটার সাধ্যের বাইরে। ঠাট্টার জবাবে রাগ না করে করবেটা কি? সে বলে, ‘সোগলির বিপদ হবো কিসক? হামাগোরে আবার বিপদ কি? হামাগোরে জমি নাই, জিরাত নাই, ঘর নাই, ভিটা নাই, ধান নাই মরিচ নাই,-বিপদ বিসস্বাদ হলে হামাগোরে নোকসান কি?
জীনের উড়াল দেওয়ায় বিভ্রমটার ওপর কতো আস্থা থাকার ফলে ছোকরা পরম বিশ্বাসের সঙ্গে এরকম ভবিষ্যৎ বাণী ছাড়ে। আনোয়ারের পক্ষে এখন এমনকি সামনে তাকানো পর্যন্ত মুশকিল। উত্তর কোনদিকে দিক জানা থাকলে চোখে সামলানো সহজ হতো। এখন মনে হয় শালা সবদিকই উত্তর! সবদিকেই বৈরাগীর ভিটার পুরনো বাসিন্দার দীর্ঘ উড়াল। প্রায় জোর করে আনোয়ার বলে, দ্যাখে চেন্টু জীন টিন কোনো কথা নয়। কিছু করতে হলে নিজেদেরই করতে হয়। জীন কি সাহায্য করতে পারে? খুব জোর দিয়ে বললেও ওপরদিকে তাকাবার মতো বল আনোয়ার পায় না।
চেন্টু বলে, সাহায্য করবো কিসক? আগুনের জানতো, তাই সোম্বাদ পায় আগে। ২জনে ফের চুপচাপ হাঁটে। আপনে? হঠাৎ চেংটুর গলা শুনে চমকে উঠে আনোয়ার চোখ বন্ধ করে, এক পলকের জন্য মনে হয়, উড়াল-দেওয়া জীন কি ডাঙায় এসে নামলো? তবে মুহুর্তের মধ্যে কাঁঠালতলায় গায়ে শাল জড়ানো এবং মাথা ও কানে মাঙ্কি ক্যাপ পরা বড়োচাচাকে চিনতে পেরে আনোয়ার বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ে। এবার সে মহা ডাটে তাকায় ওপরের দিকে। ওপরে কাঁঠালগাছের ঝাঁকড়া মাথা। আর কি? কুয়াশার মসলিন মোড়ানো তারা বসানো আকাশ। শীতের রাত্রে গ্রামের আকাশ বড়ো মোলায়েম।
বড়োচাচা বলে, এতো রাত করলি?
এই শীতের রাত্রে বড়োচাচা একা দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রতীক্ষা করছে। বড়োচাচা কাউকে ডেকে বলে, তুই এখন যা। রাত হছে।’
আবার কে? ভাঙা দালানের স্তুপের আড়ালে কে দাঁড়িয়ে রয়েছে? ১টা হাফ-হাতা জামার ওপর হাতজোড়া বুকে আড়াআড়িভাবে রেখে লোকটা শীত ঠেকাবার চেষ্টা করছে। বড়োচাচার লম্বা চওড়া কাঠামোটার পেছনে যেতে যেতে এবং ইচ্ছামতো উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম-আকাশের সবদিক দেখতে দেখতে আনোয়ার শোনে যে, লোকটা চেংটুকে বলছে, তুই আসছস? মাস্টারের বাড়িতে তোক রাখা হলো কিসক? তোর বুকের বল বেশি বাড়ছে, না? এই সব বাক্যের আওয়াজ চাপা, কিন্তু স্বর বেশ ভারি। এ তো নাদু পরামাণিক নাদু এতোক্ষণ ধরে পাহারা দিচ্ছিলো বড়োচাচাকে। আর তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে এলো নাদুর ছেলে। চেংটুর কাছ থেকে ভালো করে বিদায় করে বিদায় নেওয়া দরকার। পেছনে তাকালে চোখে পড়ে যে, বাপ ব্যাটা ২জনে ২দিকে চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চেংটু জোড়াপুকুর পার হয়ে গেলো। আবছা আলোয় মনে হয় চেংটু যেন পায়ে পাল খাটিয়ে নিয়েছে। না, তার ছায়া পর্যন্ত এখন দ্যাখা যাচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *