গো-দেওতা কা দেশ

গো-দেওতা কা দেশ

দিনটাও ছিল বেজায় গরম, মেজাজটাও ছিল নিতান্ত চড়া। রাত না পোহাতেই বিবির সাথে ঝগড়া হওয়ায় প্রতিজ্ঞা করিলাম : আজ বাসায় থাকিব না; সারাদিন বাহিরে থাকিয়া বিবিকে একটু শাস্তি দিব।

কিন্তু যাই-ই বা কোথায় ছাই! জামা-কাপড় লইয়া আড়চোখে বিবির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া লইলাম। বিবি ভ্রুক্ষেপও করিল না। রাগ আমার আরও বাড়িয়া গেল। জোরে জোরে পা ফেলিয়া রাস্তায় নামিয়া পড়িলাম।

বন্ধু রশিদের বাসায় আসিয়া দেখিলাম ও প্রচণ্ড আড্ডা, বিষম কোলাহল। আমাকে দেখিয়া সবাই একযোগে চিৎকার করিয়া উঠিল : চল, নৌকা ভ্রমণে যাওয়া যাক।

বাড়ির বাহিরে সারাদিন, চাই কি সারা সপ্তাহে, কাটাইয়া দিবার যে কোন সুযোগে আমার আনন্দিত হইবার কথা। কিন্তু নৌকা ভ্রমণের কথা শুনিয়া আমি শিহরিয়া উঠিলাম।

ছেলে বেলা এক বেটা গণক বলিয়াছিল যে, আমার মৃত্যু পানিতে ডুবিয়া! সেই হইতে আমি নদী তো চুলায় যাক, পুকুরে গোসল করিতাম না।

তারপর কলিকাতায় আসিয়া পুকুরের বদলে পানির কলের সুবন্দোবস্ত দেখিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়াছিলাম।

নিতান্ত দায়ে ঠেকিয়া একবার বর্ষাকালে পল্লীগ্রামের বাড়িতে যাইতে হইয়াছিল; প্রায় পনর হাত প্রশস্ত এক নদীর খেয়া পার হইতে গিয়া অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া খোদার নাম লইয়া নৌকায় উঠিলাম। পাঁচ ছয় জন আরোহীর ঠিক মাঝখানে দাঁড়াইয়া আল্লাহর নাম যপ করিতে লাগিলাম। কিন্তু নৌকা যেই মাঝ নদীতে গিয়া পড়িল, অমনি হাঁটু দু’টি ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে লাগিল। আমি মূৰ্ছিত হইয়া পড়িলাম।

নৌকা ভ্রমণের কথা শুনিয়া আমার সে কথা মনে পড়িয়া গা কাঁটা দিয়া উঠিল। মনটা নিতান্ত দমিয়া গেল।

কি করিব ভাবিতে লাগিলাম।

কিন্তু আমার জি হইয়াছিল বিবিকে শাস্তি দিতেই হইবে! কেন সে আসিবার সময় আমাকে বাধা দিল না? তাকে শাস্তি দিবার জন্য আমি আত্মহত্যা করিতেও প্রস্তুত আছি। কাজেই নিশ্চিত মৃত্যু জানিয়াও আমি বন্ধুদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলিলাম : নৌকা-ভ্রমণে যাইব।

এই বেফাঁস কথাটা বলিয়া ফেলিয়া মনটাই খারাপ হইয়া গেল। বন্ধুরা নৌকা-যাত্রার বিধি-ব্যবস্থার কথা আলোচনা করিতে লাগিল। আমার কিছুই ভাল লাগিল না।

বিকালে প্রস্তুত থাকিতে উপদিষ্ট হইয়া আমি মাতালের মতো টলিতে টলিতে বিদায় হইলাম।

বাসায় ফিরিয়া বিবিকে শুনাইয়া চিৎকার করিয়া আমার এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা চাকরকে জ্ঞাপন করিলাম। বিবির উদ্দেশ্যে রান্না-ঘরের দরজার দিকে দুই একটা কটাক্ষও করিলাম।

কিন্তু সে রান্নাঘর হইতে বাহির হইল না।

রান্নাঘরের সম্মুখ দিয়া বার সাতেক হাঁটাহাঁটি করিলাম, তথাপি সে একবার চাহিয়া দেখিল না। ছুরি হারাইয়া যাওয়ার ভান করিয়া বঁটিতে পেন্সিল কাটিবার জন্য রান্নাঘরে গেলাম এবং বঁটি খুঁজিয়া না পাওয়াতে বিবির কাছে জিজ্ঞাসা করিলাম। তথাপি সে কথা বলিল না, কেবল ইঙ্গিতে পার্শ্ববর্তী বঁটিটা দেখাইয়া দিল।

পেন্সিল কাটিবার কোনও দরকার ছিল না, ছুরিও সশরীরে টেবিলের উপর বিরাজ করিতেছিল। সুতরাং রান্নাঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম!

এইবার ঘরে আসিয়া পেন্সিলটা দূরে নিক্ষেপ করিয়া প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলাম। বিছানায় চিৎ হইয়া শুইয়া-শুইয়া ভাবিতে লাগিলাম। চোখের পানিতে বালিশ ভিজিতে লাগিল।

আমি নৌকা-ভ্রমণে গিয়া পানিতে ডুবিয়া মরিলে বিবি কাঁদিবে কিনা, আবার বিবাহ করিবে কি না, করিলে কতদিন পরে করিবে, এবং কাকে করিবে, এই লইয়া মনে বিষম তোলপাড় আরম্ভ হইল।

চোখ বুজিয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলাম।

.

দুই

বন্ধু আসিয়া বাহির হইতে হাঁকাহাকি আরম্ভ করিল।

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাহির হইলাম। চল, বলিয়া বন্ধুরা রওয়ানা হইল।

আমার তখনও নাওয়া হয় নাই। ক্ষুধা তৃষ্ণায় বুক ফাটিয়া যাইতেছিল।

তথাপি তাদের পিছু লইলাম; অনাহারের কথা তাদের জানাইলাম না। অল্পক্ষণ পরেই যে পানিতে ডুবিয়া মরিবে, তার আর আহার অনাহার কি?

অফিস আর বাসা, বাসা আর অফিস- ইহাই আমার যাতায়াতের স্থান। সুতরাং বর্ষায় গঙ্গা যে সাগর হইয়া বসিয়া আছে, সে খবর আমার জানা ছিল না।

মাথা হইতে পা পর্যন্ত ঝিম্ ঝিম্ করিতে লাগিল।

বন্ধুরা বিরাট হল্লা করিয়া নৌকায় উঠিল।

আমি নিতান্ত অন্যমনস্ক হইয়া তখনও তীরেই দাঁড়াইয়াছিলাম। ডাকাডাকিতে চমক ভাঙিল।

আমি উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে শেষ চুম্বন দিয়া আল্লাহর নাম করিতে করিতে, ফাঁসির আসামী যেমন করিয়া মঞ্চে আরোহণ করে ঠিক তেমনি করিয়া নৌকায় আরোহণ করিলাম।

নৌকা চলিতে লাগিল।

বন্ধুরা গান করিতে লাগিল, কি কোলাহল করিতে লাগিল আমার ঠিক মনে নাই। বোধ হয় গানই হইবে। কারণ গানের আয়োজন করা হইয়াছিল।

আমার সেদিকে লক্ষ্য ছিল না। আমি আকাশের দিকে চাহিয়াছিলাম।

দেখিলাম : পশ্চিমাকাশে মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘের মধ্যে আমি আজরাইল ফেরেশতার মুখ দেখিতে পাইলাম, তিনি আমার দিকে অঙ্গুলি সংকেত করিয়া তার চরদিগকে কি বলিতেছেন।

ব্যাপার কি বুঝিতে আমার বাকি রহিল না।

বন্ধুদের কোলাহলে আমার ধ্যানভঙ্গ হইল।

দেখিলাম : তারা সবাই চিৎকার করিতেছে। সবারই মুখে আতংক ফুটিয়া উঠিয়াছে। নৌকা বিষম দুলিতেছে।

বুঝিলাম : ঝড় উঠিয়াছে। নৌকা তীরে ভিড়াইবার জন্য সবাই মাঝিকে গালাগালি করিয়া উপদেশ বর্ষণ করিতেছে।

আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম; সুতরাং গোলমালে যোগ দিলাম না।

ঝড়ের বেগ বাড়িয়া গেল। বন্ধুরা কাপড়-চোপড় খুলিয়া পানিতে ঝাপাইয়া পড়িবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল।

আমি নিরুদ্বেগে বসিয়া রহিলাম।

একটা প্রকাণ্ড ধমকা হাওয়া আসিয়া নৌকা উল্টাইয়া ফেলিল। বন্ধুরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলিয়া পানিতে ঝাঁপ দিল।

আমি একটুও নড়িলাম না। সাঁতার দিবারও চেষ্টা করিলাম না; কারণ ও বিদ্যা আমার জানা ছিল না।

আমি ধীরে ধীরে তলাইয়া যাইতে লাগিলাম।

কিন্তু মরিলাম না।

কিসের ধাক্কায় আবার ভাসিয়া উঠিলাম। উপরের দিকে চাহিয়া আকাশ দেখিলাম, চারিদিকে চাহিয়া অনন্ত জলরাশি দেখিলাম, কিন্তু কোথাও কোন জন-প্রাণী দেখিতে পাইলাম না।

পানির স্রোতে ভাসিয়া চলিলাম।

কতক্ষণ, কতদিন বা কতমাস সেইভাবে ভাসিয়া গেলাম, ঠিক স্মরণে পড়িল না।

হঠাৎ নিজের অনাহারের কথা মনে পড়িল। তৃষ্ণা বোধ করিলাম।

পানিতেই ভাসিতেছিলাম, সুতরাং পানির অভাব ছিলো না; ঠোঁট খুলিয়া এক ঢোক পানি গিলিয়া ফেলিলাম।

একি! এত চমৎকার পানি! একেবারে দুধের মতো স্বাদ।

আমি মাথা উঁচু করিয়া ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিলাম; কেবল স্বাদই নহে, রংও দুধের মতো।

অবাক হইয়া গেলাম। এ কোন দেশে আসিলাম, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।

ভাসিয়া যাইতে লাগিলাম।

আরও কতদিন ভাসিয়া গেলাম, তার হিসাব নাই।

অবশেষে একদিন হঠাৎ শরীরে কিসের ধাক্কা লাগিল।

আমি হাত দিয়া দেখিলাম ও শক্ত জিনিস, হয়তো বা পাথর হইবে। ফিরিয়া দেখিলাম, পাথর ত বটেই, তা ছাড়া খানিক দূরে স্থলও দেখা যাইতেছে।

আমি পায়ে ভর করিলাম। মাটি ঠেকিল। হাঁটিয়া কুলের দিকে অগ্রসর হইলাম। নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম। বহু কষ্টে পা টানিয়া টানিয়া দুগ্ধ-সাগর অতিক্রম করিয়া তীরে উঠিলাম।

দেখিলাম : পাথরের দেশ। পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে দুধের নহর বহিয়া সাগরে পড়িতেছে।

সেই নহর উজাইয়া আমি আরও অগ্রসর হইলাম। দেখিলাম পালে পালে গরু এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করিতেছে। আমি অবাক হইয়া গেলাম এতসব গরু কার?

আরও অগ্রসর হইলাম। কিন্তু একজন মানুষও দেখিতে পাইলাম না।

গুরুগুলি আমাকে দেখিয়া পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল।

আমি অবলা গো-জাতির এই ভাব দর্শনে বিস্মিত হইলাম।

হঠাৎ পাল হইতে একটা গাভী আমার দিকে অগ্রসর হইয়া কথা বলিতে লাগিলো। বিশুদ্ধ হিন্দি ভাষায় আমাকে বলিল : তুমি দেখিতেছ মানুষ জাতি। তুমি কি করিয়া আজও বাঁচিয়া আছ বাবা?

আমি গভীর বিশুদ্ধ হিন্দী কথায় অবাক হইলাম।

বলিলাম : বাঁচিয়া থাকিব না কেন? কি হইয়াছে? তোমার এ প্রশ্নের উত্তর কি?

গাভী হাসিয়া বলিল : তুমি দেখিতেছি কিছু জান না। আচ্ছা, তুমি কোনদেশী লোক, বাবা?

বলিলাম : আমি বাংলাদেশের লোক।

সমস্ত গরু একযোগে হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল। গাভী দন্তবিকাশ করিয়া বলিল : আপনি। তবে ‘আনন্দবাজার’-এর দেশের লোক।

আমি আরও আশ্চর্য হইয়া বলিলাম : আনন্দবাজার’-এর দেশ কেমন?

গাভী বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফোরিত করিয়া বলিল : আনন্দবাজার’! কেন, ‘আনন্দবাজার চেন না? ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা। আহা, সেই কাগজের সম্পাদক আমাদের জাতির রক্ষা করিবার জন্য কাগজে কত আন্দোলনই না করিয়াছেন।

–বলিয়া বৃদ্ধ গাভী ‘আনন্দবাজার’-সম্পাদকদের উদ্দেশ্যে নমস্কার করিবার জন্য সামনের দুইটা পা কপালে ঠেকাইবার চেষ্টা করিয়া পড়িয়া গেল।

আমি অসহ্য কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করিলাম : এদেশে কি মানুষ নাই?

গাভী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল : সেই কথাইত তোমাকে বলিতে চাহিয়াছিলাম। আচ্ছা, চল আমাদের দলপতির নিকট। তিনিই সব কথা তোমাকে খুলিয়া বলিবেন।

–বলিয়া আমাকে লইয়া সে অগ্রসর হইল।

সমস্ত গরু আমাদের পিছু লইল।

অগ্রসর হইতে-হইতে দেখিলাম : চারিদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল গরু আর গরু! হাজার লক্ষ কোটি কি পদার্থ হইবে তা অনুমান করা গেল না।

আমার বিস্ময় বাড়িতে লাগিল।

গাভী আমাকে তাদের সরদারের নিকট হাজির করিল।

দেখিলাম : সরদার একটা বৃদ্ধ বলদ। তার কপালে চন্দনের ত্রিশুল ও মাথায় টিকি আছে এবং একটা বন্য লতা সামনের দু’পায়ের ভিতর দিয়া শরীর বেষ্টন করিয়া বুঝি বা পৈতার কাজ করিতেছে।

গাভী সরদারের দিকে অগ্রসর হইয়া বলিল : প্রভু, ‘আনন্দবাজার’র দেশের একটা লোক কি অজ্ঞাত উপায়ে আজও বাঁচিয়া আছে কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।

বলদ আসন হইতে উঠিয়া আমাকে প্রণাম করিল। আমি আমার অভ্যাসমত এক হাত তুলিয়া সালামের ভঙ্গিতে প্রত্যাভিবাদ করিলাম।

বলদ গাভীর দিকে চাহিয়া ইঙ্গিত করিল। তারপর আমার দিকে চাহিয়া বলিল : তুমি কোন জাত?

আমি বললাম : মুসলমান।

বলদের রোমাঞ্চ হইল।

চতুর্দিকে সমস্ত গরুর পাল হইতে ‘অনার্য’ ‘ম্লচ্ছ’ বলিয়া চিৎকার উঠিল।

গাভীটা “আমার জাত গিয়াছে গো, মুচুনমানটাকে আমি চুঁইয়া ফেলিয়াছি। কাশীও ডুবিয়া গিয়াছে। হায় হায়, আমি কোথায় গিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিব গো”-বলিয়া সম্মুখের একটা পা কপালে ঠেকাইবার চেষ্টা করিয়া কাঁদিতে লাগিল।

আমি অবাক হইয়া চারিদিকে তাকাইতে লাগিলাম। দেখিলাম : ক্ষিপ্ত বঁড়গুলো শিং বাকাইয়া আমাকে গুতাইতে আসিতেছে।

আমি বিপদ গণিলাম।

হঠাৎ শুনিলাম, সরদার বলদটা উচ্চস্বরে চিৎকার করিয়া বলিল : বৎসগণ, এই আর্যভূমিতে একটিমাত্র মানুষ বাঁচিয়া আছে। সে আর্য হোক অনার্য হোক তাকে মারা যায় না। মানবজাতিকে নির্মূল করা উচিত নয়। তোমরা শিং সামলাও।

সমস্ত গরু শিং সংযত করিল।

আমি বাঁচিয়া গেলাম।

সরদার আমার দিকে চাহিয়া বলিল : বৎস, তোমাদের জাত আমাদের গোজাতি ধ্বংস করিবার অনেক চেষ্টা করিয়াছে। তথাপি আজ তোমাকে আমরা ক্ষমা করিলাম। আর্যভূমিতে বুদ্ধ, চৈতন্য, গান্ধি প্রভৃতি অনেক মহাপুরুষ ক্ষমা ও প্রেম প্রচার করিয়াছেন। তাদের সম্মানের জন্য আমরা শত্রুকেও ক্ষমা করিলাম। তোমার কোনও ভয় নেই।

আমি সাহস পাইয়া বলিলাম : সরদার, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। আমি এ কোন দেশে আসিয়াছি?

বলদ বলিল : এ-জায়গার নাম ছিল হিমালয়। ভারতবর্ষ বাসের অযোগ্য হইয়া যাওয়ায় আমরা এই পর্বতে আশ্রয় লইয়াছি।

আমি অধিকতর বিস্মিত হইয়া বলিলাম! ভারতবর্ষ বাসের অযোগ্য হইয়া গেল কিরূপে?

বলদ বলিল : সমস্ত দেশ দুধে ডুবিয়া গিয়াছে।

আমি স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম : ভারতের মানুষেরা সব গেল কোথায়?

বলদ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল : সব মরিয়া গিয়াছে।

আমি শিহরিয়া উঠিলাম! অতিকষ্টে বলিলাম : কিরূপে?

বলদ বলিল : তবে বসিয়া শোন।

.

তিন

আমি মাটিতে বসিয়া পড়িলাম।

বলদ বলিতে লাগিল : এই দেশে হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্ম-সম্প্রদায় বাস করিত। ইংরেজ নামে–

বাধা দিয়া আমি বলিলাম : সে-কথা আমি জানি।

বলদ ঈষৎ উষ্ণ হইয়া বলিল : বাধা দিও না, শুনিয়া যাও।

আমি অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিলাম।

বলদ আরম্ভ করিল : ইংরাজ নামে এক বিদেশী জাতি এই দেশ শাসন করিত। তারা এদেশের উপর সুবিচার করিত না। তাই হিন্দু-মুসলমান একযোগে ইংরাজের হাত হইতে দেশ উদ্ধার করিবার জন্য স্বরাজ আন্দোলন আরম্ভ করিল। দেশ সুদ্ধ লোক ইংরাজের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়া উঠিল। ইংরাজের রাজত্ব যায় আর-কি!

এমন সময় ইংরাজ হিন্দুদের কয়েকজনকে ডাকিয়া কানে-কানে কি বলিল! হিন্দুদের মধ্যে আর্যসমাজ নামে এক দল বাহির হইল। তারা চিৎকার করিয়া হিন্দুদিগকে বলিতে লাগিল : ইংরাজ গো-মাতার হত্যসাধন করে বলিয়াই ত আজ আমরা ইংরাজ তাড়াইবার চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু আমাদের সঙ্গীরাই যে গো-হত্যা করে, তাদের আমরা কি করিব?

হিন্দুরা ফিরিয়া দাঁড়াইল। বলিল : তাই তো!

মুসলমানদিগকে বলিল : তোমরা যদি এদেশে থাকিতে চাও তবে গরু খাওয়া ছাড়। অন্যথায় ইংরেজের সঙ্গে একই জাহাজে চড়িয়া পশ্চিমের দিকে সাগর পাড়ি দাও।

মুলমান বলিল : বাঃ রে? আমরা বুঝি এদেশের কেউ নই? কেন আমরা এদেশ ছাড়িয়া যাইব?

হিন্দুরা বলিল : এদেশ না ছাড়, গরু খাওয়া ছাড়।

মুসলমান জাতটা ছিল বড় একগুয়ে; আমাদের ধ্বংস করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্যে।

তারা বাকিয়া বসিল। বলিল : আমরা গরু খাওয়া ছাড়িব না, এদেশও ছাড়িব না। কারণ গরু আমাদের খাদ্য এবং এদেশ আমাদের জন্মভূমি।

হিন্দুরাও রাগিয়া গেল! বলিল : তবে রে বেটারা! আমাদের দেশে বাস করিয়া আমাদেরই সঙ্গে আড়ি। জলে বাস করিয়া কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া? ইংরাজ তাড়াইবার আগে তোদেরই এদেশ হইতে তাড়াইব।

মুসলমানরাও বলিল : আস তবে, আজ একহাত হইয়া যাক্। উভয় দলে সাজ সাজ সাড়া পড়িয়া গেল।

গো-রক্ষা আন্দোলনের প্রবর্তক আর্যসমাজীরা হিন্দুদিগকে বলিল : সবাই মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে গেলে গো-মাতার সেবার অসুবিধা হইবে। তোমরা যুদ্ধে যাও, আমরা গরুর ঘাস কাটি।

হিন্দুরা দেখিল : কথা মন্দ নয়। যে গো-দেবতার জন্য যুদ্ধ, তার সেবার ত্রুটি হইলে। দেবতাও অসন্তুষ্ট হইবেন, যুদ্ধ করাও ব্যর্থ হইবে।

হিন্দুরা বলিল : তথাস্তু।

আর্যরা গরুর ঘাস কাটিতে গেল।

হিন্দুরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতরণ করিল।

ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হইল! দিনরাত অবিরাম লড়াই চলিতে লাগিল।

ইংরাজ দেখিল : এভাবে রাজ্য শাসন করা চলে না। অতএব তারা পুলিশ দিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা করিতে লাগিল।

যুদ্ধক্ষেত্রের আশ-পাশে ঘাস কাটা নিরাপদ নয় মনে করিয়া এবং যোদ্ধাগণের হস্তচ্যুত তরবারি গো-দেবতার গায়ে লাগিয়া গো-হত্যা পাপের অনুষ্ঠান হইতে পারে ভয়ে, আর্য-সমাজীরা ভারতের সমস্ত গরু লইয়া বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বোডিং-এ আশ্রয় লইল।

ইংরাজ তার সমস্ত সৈন্য-সামন্ত লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত থাকিল। সুতরাং খুব শান্তির সঙ্গেই যুদ্ধ চলিতে লাগিল। প্রত্যহ লক্ষ লক্ষ লোক নিহত হইতে লাগিল। অবশেষে উভয় পক্ষের সকলেই নিহত হইল, একজন লোকও বাঁচিয়া রহিল না।

সুতরাং যুদ্ধ থামিয়া গেল।

স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইল দেখিয়া ইংরাজ নিশ্চিন্ত আনন্দে ক্লাবে ফিরিয়া গেল।

কিন্তু অধিকদিন আরামে কাটিল না। ত্রিশকোটি লাশ যখন একসঙ্গে পচিতে আরম্ভ করিল, তখন তা হইতে অসহ্য দুর্গন্ধ বাহির হইল।

ইংরাজ নাক বন্ধ করিয়া এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করিতে লাগিল। নাকে এসেন্সের ছিপি চব্বিশ ঘণ্টাই ঢুকাইয়া রাখিল। কিন্তু কোনও ফল হইল না।

কতক দুর্গন্ধে, কতক কলেরায়, অল্পদিনেই সমস্ত ইংরাজও মরিয়া গেল। আর্য সমাজীরা ইতিমধ্যে আমাদিগকে লইয়া কাশীর মন্দিরে আশ্রয় লইল। কাশী নিতান্ত পূণ্যস্থান, তাই সেখানে দুর্গন্ধ প্রবেশ করিল না। আমাদিগকে লইয়া সেখানে আর্যরা নিশ্চিন্তে বাস করিতে লাগিল।

কিছুদিন গেল এইভাবে।

ইংরাজ ও মুসলমানদের অনুপস্থিতিতে প্রত্যহ লক্ষ লক্ষ করিয়া আমাদের বংশবৃদ্ধি হইতে লাগিল।

দুধের আতিশয্যে আমাদের পরিবারদের বাঁট ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

কিন্তু দোয়াইবার বা খাইবার লোকের নিতান্ত অভাব।

মুষ্টিমেয় আর্য আর কত দুধ খাইবে?

দুধের টাটানিতে আমাদের পরিবার’রা ছটফট করিতে লাগিল। নিরুপায় হইয়া তাহারা মাটিতে, গাছের গুঁড়িতে বাঁট ঘষিতে লাগিল। তাতে প্রচুর দুধ বাহির হইয়া গেল। সকলে যৎকিঞ্চিত আরাম পাইল।

.

চার

সেই হইতে ঐ উপায়ে দুধ বাহির করা চলিতে লাগিল।

ফলে যা হইল, তা আমরাও আগে কল্পনা করি নাই। অসংখ্য গাভীর দুধে নগর শহর, পল্লী-পাথার ভাসিয়া যাইতে লাগিল। জলের স্রোতের মতো দুগ্ধ প্রবাহিত হইয়া নদী-নালা, খাল-বিল সমস্তই ভরিয়া গেল। সে সমস্তেও যখন আর ধরিল না তখন ক্রমে দেশ ডুবিয়া যাইতে লাগিল।

ক্রমে কাশীতেও বাস করা অসম্ভব হইল। সমস্ত বাড়িঘর দুধে ডুবিয়া গেল।

আর্য সমাজীরা বলিল : চল, পাহাড়ে গিয়া চড়ি।

আমরা সকলে দুধের সাগরে সাঁতার কাটিতে-কাটিতে হিমালয় পর্বতের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।

মানুষজাতি আমাদের মতো কষ্টসহিষ্ণু নয়। পথে এক এক করিয়া সমস্ত আর্য দুধের সাগরে ডুবিয়া মরিল।

আমরা বহুকষ্টে এই পাহাড়ে চড়িয়া আত্মরক্ষা করিলাম।

সেই হইতে পাহাড়ে চড়িয়া বাস করিতেছি; কিন্তু দুধের পরিমাণ যেভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পাইতেছে তাতে অতি শীঘ্র পর্বতও ডুবিয়া যাইবে। তখন আমরা কোথায় যাইব তা ভাবিয়া নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িয়াছি। তোমার আসিবার আগে আমরা সে কথাই আলোচনা করিতেছিলাম। ঐ যে দুধের বান আসিতেছে। সতর্ক হও।

–বলিতে বলিতে বলদ খাড়া হইয়া উঠিল।

আমি ভয় পাইয়া পিছন ফিরিলাম। দেখিলাম : দুধের বিরাট ঢেউ পর্বত প্রমাণ উঁচু হইয়া আমাদের দিকে আসিতেছে।

বলদ এক লাফে দশ হাত দূরে ছিটকাইয়া পড়িল এবং লেজ তুলিয়া দৌড় মারিল।

আমি নড়িবার অবসর পাইলাম না। প্রকাণ্ড একটা ঢেউ আসিয়া আমাকে তলাইয়া ফেলিল।

আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া গেল।

আমি কথা বলিবার চেষ্টা করিয়া গোঙাইয়া উঠিলাম।

আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।

দেখিলাম : সেই প্রচণ্ড গরমে আমি তিন-চারটা লেপ-চাপা পড়িয়া আছি! ঘামে সর্বশরীর ভিজিয়া গিয়াছে। আমার স্বপ্নের আমেজ তখনও কাটে নাই। ব্যাপার কি ভাবিতে লাগিলাম।

হঠাৎ স্ত্রীর খিলখিল হাসিতে আমার তন্দ্রা ছুটিয়া গেল। ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম।

স্ত্রী হাসিতে হাসিতে বলিল : রাগ করিয়া নৌকা-ভ্রমণে যাওয়া হইতেছিল বুঝি? নাও আর রাগের সুবিধা হইল না। গোসল করিয়া ভাত খাও।

–বলিয়া একখানা কাগজ হাতে দিল।

দেখিলাম রশিদ লিখিয়াছে : গায়ক সুরেন বাবুর অসুখ হওয়ায় আজ নৌকা-ভ্রমণ স্থগিত রাখা হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *