গুগুনোগুম্বারের দেশে

গুগুনোগুম্বারের দেশে — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

আমরা। পথ। হারিয়েছি।

কথা তিনটে কেটে কেটে, ওজন করে করে, থেমে থেমে, যেন নিজের মনেই বলল ঋজুদা।

আমরা একটা কোপির উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোপি হল এক ধরনের পাহাড়। তখন ভর-দুপুর। সামনে দূরদিগন্তে কতগুলো ইয়ালো-ফিভার অ্যাকাসিয়া গাছের জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া আর কোনো বড় গাছ বা পাহাড় বা অন্য কিছুই নেই। বিরাট দলে জেব্রারা চরে বেড়াচ্ছে বাঁ দিকে। ডান দিকে একদল থমসনস গ্যাজেল। হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। ভুষুণ্ডা আর টেডি মহম্মদ মাথা নিচু করে ল্যাব্রাডর গান-ডগের মতো মাটি শুঁকে-শুঁকে পথের গন্ধ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে হাজার-হাজার মাইল সাভানা ঘাসের রাজ্যে। নীচে আমাদের ছাইরঙা ল্যাণ্ড-রোভার গাড়িটা ট্রেলারের মধ্যে তাঁবু এবং অন্যান্য সাজসরঞ্জাম সমেত স্তব্ধ হয়ে রয়েছে কোপির ছায়ায়।

আমি ঋজুদার মুখের দিকে চাইলাম।

খাকি, গোর্খা টুপিটা খুলে ফেলেছে ঋজুদা। মাথার চুলগুলো হাওয়ায় এলোমলো হচ্ছে। দাঁতে-ধরা পাইপ থেকে পোড়া তামাকের মিষ্টি গন্ধভরা ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে পেছনে। কপালের রেখাগুলো গম্ভীর হয়ে ফুটে উঠেছে।

আমি মনে-মনে একটু-আগে-শোনা ঋজুদার কথা ক’টি আবৃত্তি করলাম।

 আমরা। পথ। হারিয়েছি।

এবং করেই, ঐ সামান্য তিনটি কথার ভয়াবহতা প্রথমবার বুঝতে পারলাম।

ঋজুদা আফ্রিকাতে আমাকে আনতে চায়নি। মা-বাবারও প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। সব আমারই দোষ। আমিই নাছোড়বান্দা হয়ে ঋজুদার হাতে-পায়ে ধরে এসেছি।

ভুষুণ্ডা আর টেডি আস্তে-আস্তে ফিরে আসছে আবার গাড়ির দিকে। ঋজুদা ওদের ফিরে আসতে দেখে কোপি থেকে নীচে নামতে লাগল। আমিও পিছন-পিছন নামলাম। আমরা যখন ল্যাণ্ড-রোভারের কাছে গিয়ে পৌঁছেছি তখন ওরাও ফিরে এল। ওদের মুখ শুকনো। মুখে ওরা কিছুই বলল না।

ঋজুদা গাড়ির পকেট থেকে ম্যাপটা বের করে, বনেটের উপর বিছিয়ে দিয়ে ঝুঁকে পড়ল তার উপর। পড়েই, আমাকে বলল, দ্যাখ তো রুদ্র, ট্রেলারের এবং জীপের পেছনে সবসুন্ধু ক’টা জেরিক্যান আছে আমাদের। আর এঞ্জিনের সুইচ টিপে দ্যাখ গাড়ির ট্যাঙ্কে আর কত পেট্রল আছে।

আমি পেট্রলের হিসেব করতে লাগলাম। ঋজুদা ম্যাপ দেখতে লাগল। তেলের অবস্থা দেখে, জেরিকান গুনে, হিসেব করে বললাম, হাজার কিমি যাওয়ার মতো তেল আছে আর।

ঋজুদা বলল, বলিস কী রে? তাহলে তো অনেকই তেল আছে?

তারপরই, ঐ অবস্থাতে ও আমার দিকে ফিরে বলল, আর তোর তেল? ফুরোয়নি তো এখনও?

আমি ফ্যাকাসে মুখে স্মার্ট হবার চেষ্টা করে বললাম, মোটেই না। আমার তেল অত সহজে ফুরোয় না।

আমি বুঝলাম, ঋজুদা আমাকে সাহস দিচ্ছে। আসলে আমি জানি যে, আফ্রিকার এই তেরো হাজার বর্গকিমির সাভানা ঘাসবনে পথ-হারানো আমাদের পক্ষে মোটে হাজার মাইল যাওয়ার মতো তেল থাকা মোটেই ভরসার কথা নয়।

ঋজুদার গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ভুষুণ্ডা মাটিতে বসে দাঁত দিয়ে ঘাস কাটছিল। টেডি পেছনের গাড়ির মাডগার্ডে হেলান দিয়ে উদাস চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

ঋজুদা বলল, লেটস্ গো।

আমি বললাম, কোন দিকে?

ঋজুদা বলল, ডিউ নর্থ।

তারপর গাড়ির বাঁ দিকের দরজা খুলে উঠতে-উঠতে বলল, তুই-ই চালা। আমি একটু পাইপ খেয়ে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে নিই।

ভুষুণ্ডা আর টেডি পেছনে বসল।

সুইচ টিপে গীয়ারে দিলাম গাড়ি। তারপর একটু লাফাতে-লাফাতে হলুদ সোনালি হাঁটু সমান ঘাসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের ল্যাও-রোভার।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি ঋজুদাকে একটি কাজের ভার দিয়েছিলেন। সেরেঙ্গেটির ঘাসবন ও গোরোংগোরো আগ্নেয়গিরির উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে যেসব চোরাশিকারীরা আছে তাদের সম্বন্ধে একটি পেপার সাবমিট করতে হবে ঋজুদাকে। এই অভিযানের সব খরচ জুগিয়েছেন সোসাইটি। পূর্ব আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ান সরকার ঋজুদাকে সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছেন। নিজেদের প্রয়োজন এবং প্রাণরক্ষার জন্যে আমরা যে-কোনো জানোয়ার শিকার করতে পারব। চোরাশিকারীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে যদি আমাদের প্রাণসংশয় হয় তবে আমরা তাদের উপর গুলিও চালাতে পারি। তার জন্যে কাউকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না!

কিন্তু এর মধ্যে কথা একটাই। সমুদ্রে যেমন একা নৌকো, এই ঘাসের সমুদ্রেও তেমনই একা আমরা, একেবারেই একা।

বোম্ব্বে থেকে প্লেনে ডার-এস-সালামে এসেছিলাম, সেশেলস্ আইল্যাণ্ডস্ হয়ে। তারপর ডার-এস-সালাম থেকে কিলিমানজারো এয়ারপোর্টে। মাউন্ট কিলিমানজারোর কাছের সেই এয়ারপোর্ট থেকে ছোট প্লেনে করে এসে পৌঁছেছিলাম সেরোনারাতে। সেখানেই আমাদের জন্যে এই ল্যান্ড-রোভার, মালপত্র এবং ভুষুণ্ডা ও টেডি অপেক্ষা করছিল। তিনমাস আগে আরুশাতে এসে ঋজুদা ভুষুণ্ডা ও টেডিকে ইন্টারভ্যু করে মালপত্রের লিস্ট বানিয়ে ওখানে দিয়ে এসেছিল। ওরা দুজনই ল্যাও-রোভারটা চালিয়ে নিয়ে এসেছে আরুশা থেকে লেক মনিয়ারা এবং গোয়রাংগোরো হয়ে, সেরোনারাতে।

মোটে দশদিন বয়স হয়েছে আমাদের এই অভিযানের। গোলমালটা ভুষুণ্ডাই করেছে। ওরই ভুল নির্দেশে গত কদিনে আমরা ক্রমাগত আড়াই হাজার মাইল গাড়ি চালিয়েছি। এখন দেখা যাচ্ছে যে আমরা একটি বৃত্তেই ঘুরে বেড়িয়েছি। চোরাশিকারীদের সঙ্গে একবারও মোলাকাত হয়নি, কিন্তু একটি হাতির দল আমাদের খুবই বিপদে ফেলেছিল। যা পেট্রল ছিল তাতে আমাদের গোয়রাংগোরোতে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল সহজেই অভিযানের পর্ব শেষ করে। ওখানে পেট্রল স্টেশান আছে। যে-পথ ধরে ট্যুরিস্টরা যান, স্বাভাবিক কারণেই সেই পথে আমরা যাইনি। কারণ চোরা শিকারীরা ঐ পথের ধারেকাছেও থাকে না; বা আসে না। টুরিস্টরা যে-পথে যান সেও সেই রকমই। ধু-ধু, হাজার-হাজার মাইল ঘাসবনে একটি সরু ছাইরঙা ফিতের মতো পথ চলে গেছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আমরা তাতেও না গিয়ে ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে ম্যাপ দেখে এবং ভুষুণ্ডা ও টেডির সাহায্যে গাড়ি চালাচ্ছি।

ভুষুণ্ডা চিরদিন এই সাভানা রাজ্যেই শিকারীদের কুলির কাজ করেছে। পায়ে হেঁটে মাসের পর মাস এই ঘাসবনে কাটিয়েছে প্রতি বছর। এইসব অঞ্চল নিজের হাতের রেখার মতোই জানা ওর। অথচ আশ্চর্য! ভুষুণ্ডাই এ-রকম ভুল করল!

কম্পাসের কাটাতে চোখ রেখে স্টীয়ারিং সোজা করে শক্ত হাতে ধরে অ্যাকসিলারেটরে সমান চাপ রেখে চালাচ্ছি আমি। তিরিশ মাইলের বেশি গতি নেই। বেশি জোরে চালানোতে বিপদ আছে। হঠাৎ ওয়ার্ট-হগদের গর্তে পড়ে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এই ওয়ার্ট-হগগুলো অদ্ভুত জানোয়ার! অনেকটা আমাদের দেশের শুয়োরের মতো দেখতে। কিন্তু অন্যরকম। ওরা যখন দৌড়োয়, ওদের লেজগুলো তখন উঁচু হয়ে থাকে আর লেজের ডগার কালো চুলগুলো পতাকার মতো ওড়ে। ওরা মাটিতে দাঁত দিয়ে বড়-বড় গর্ত করে এবং তার মধ্যেই থাকে–ঐ গর্তে শেয়াল ও হায়নারাও আস্তানা গাড়ে মাঝে মাঝে। ঘাসের মধ্যে কোথায় যে ও-রকম গর্ত আছে আগে থাকতে বোঝা যায় না–তাই খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়।

 কেউ কোনো কথা বলছে না। গাড়ি চলছে, পিছনে ধুলোর হালকা মেঘ উড়িয়ে। এখানের ধুলো আমাদের দেশের ধুলোর মতো মিষ্টি নয়। আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত নানারকম ধাতব পদার্থ মিশে আছে মনে হয় এইসব জায়গার ধুলোয়। ধুলোর রঙও কেমন লালচে-কালচে সিমেন্টের মতো। ভীষণ ভারী। নাকে কানে ঢুকলে জ্বালা করতে থাকে।

গাড়ির দুদিকেই নানারকম জানোয়ার ও পাখি দেখা যাচ্ছে। ডাইনে বাঁয়ে। কত যে জানোয়ার তার হিসেব করতে বসলে হাজার পেরিয়ে লক্ষে পৌঁছনো কঠিন নয়। দলে দলে থমসনস গ্যাজেল, গ্রান্টস গ্যাজেল, টোপী, এলাণ্ড, জেব্রা, ওয়াইল্ড-বীস্ট। চুপি-চুপি শেয়াল। রাতের বেলায় বুক-হিম-করা-হাসির হয়না। কোথাও বা একলা সেক্রেটারি বার্ড মাথার ঝাঁকড়া পালকের টুপি নাড়িয়ে বিজ্ঞের মতো একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছে। কোথাও ম্যারাবু সারস। কোথাও একা বা দোকা উটপাখি বাঁইবাঁই করে লম্বা লম্বা ন্যাড়া পায়ে দৌড়ে যাচ্ছে। জিরাফগুলো এমন করে দৌড়োয় যে, দেখলে হাসি পায়। মনে, হয় ওদের পাগুলো বুঝি হাঁটু থেকে খুলে বেরিয়ে যাবে যখন-তখন।

প্রথম দু-তিন দিন অত-সব জানোয়ার দেখে আমার উত্তেজনার শেষ ছিল না। এখন মনে হচ্ছে যে, যেন চিরদিন আমি আফ্রিকাতেই ছিলাম। জানোয়ার দেখে-দেখে ঘেন্না ধরে গেল। সিংহও দেখেছি পাঁচবার এই কদিনে দিনের বেলা। উদলা মাঠে। তারাও একা নয়; সপরিবারে। আমাদের দিকে অবাক চোখে দূর থেকে চেয়ে থেকেছে।

ঋজুদা বলল, কত কিলোমিটার এলি রে?

আমি গাড়ির মিটার দেখে বললাম, সত্তর কিলোমিটার।

 ঋজুদা ঘড়ি দেখে বলল, দু’ঘন্টায়! তারপর নিজের মনেই বলল, নট ব্যাড।

এদিকে সূর্য আস্তে-আস্তে পশ্চিমে হেলছে। এখানে গাছগাছালি নেই, তাই ছায়া দেখে বেলা বোঝা যায় না।

দূরদিগন্তে হঠাৎ একটি নীল পাহাড়ের রেখা ফুটে উঠল।

টেডি বিড়বিড় করে বলল, মারিয়াবো। মারিয়াবো।

তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, পোলে পোলে : পোলে সানা।

ঋজুদা বলল, পোলে পোলে কেন? কী হল টেডি?

সোয়াহিলি ভাষায় ‘পোলে পোলে’র বাংলা মানে হচ্ছে আস্তে আস্তে।

টেডি বলল, মাসাইরা থাকে ঐ পাহাড়ের নীচে। ওদিকে যেতে সাবধান। ওয়াণ্ডারাবোরাও চলে আসে মাঝে মাঝে।

ভুষুণ্ডার চোয়াল শক্ত। ও কথা বলছিল না কোনো।

ওদের দুজনের মধ্যে ভুয়া অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে, কম কথা বলে; টেডির চেয়ে ভাল ইংরিজিতে বাতচিত্ চালায় আমাদের সঙ্গে। টেডির চেয়ে অনেক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও। টেডির স্বভাবটা ছেলেমানুষের মতো, কিন্তু সে সাড়ে ছ’ফিট লম্বা। ওর হাতের আঙুলগুলো কলার কাঁদির মতো। আর ভুষুণ্ডা বেঁটেখাটো, কার্পেটের মতো ঘন ঠাসবুনুনির কোঁকড়া চুল মাথায়। পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর জিনের প্যান্টের পকেট থেকে বের করে সিগারেট খায়। টেডি সিগারেট খায় না; নস্যি নেয়। ওর সেই নস্যি আবার মাঝে-মাঝে হাওয়াতে উড়ে এসে আমাদের নাকে আচমকা পড়ে দারুণ হাঁচায়।

পরশু দিন একটা থমসনস গ্যাজেলের বাচ্চাকে শেয়ালের মুখ থেকে বাঁচিয়েছিলাম আমরা। তাকে হাভারস্যাকের মধ্যে রেখেছি। শুধু মুখটা বের করে সে চকচকে চোখে চেয়ে থাকে। হরিণ-ছানাটার নাম রেখেছি আমি কারিব্যু। সোয়াহিলি ভাষায় কারিব্যু মানে স্বাগতম। সেই ছোট্ট হরিণটা বেদম হাঁচতে শুরু করে দিলে হঠাৎ।

ঋজুদা পিছন ফিরে টেডিকে বলল, টেডি, তোমার নস্যি ওর নাকে গেছে। হাঁচতে-হাঁচতে মরার চেয়ে হায়নার হাতে মরা কারিব্যুর পক্ষে অনেক সুখের ছিল।

টেডি ঋজুদার কথায় হেসে উঠে বাচ্চাটাকে আদর করে বলল, নুজরি, নুজরি।

 মানে, ভালই আছে, ভালই আছে; কিছুই হয়নি ওর।

 তারপরই বলে উঠল, কোনো মরাই সুখের নয় বানা। সে হেঁচেই মরো, আর নেচেই মরো। এই যেমন আমাদের এখানের ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে মরা।

ওর কথা শুনে ঋজুদা হেসে উঠল। আফ্রিকার এই ঘাসের সমুদ্রে পথ হারিয়ে যাওয়ার পরও এত হাসি আসছে কী করে ঋজুদার তা ঋজুদাই জানে। তাছাড়া, এই ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে মরা ব্যাপারটা হাসির নয় মোটেই।

সেরেঙ্গেটিতে খুব সেৎসি মাছি। বড় বড় কালো কালো মাছি। আমাকে পরশু একটা কামড়েছিল। অসহ্য লাগে কামড়ালে। কলকাতার একশোটা মশা একেবারে কামড়ালেও বোধহয় অমন লাগত না।

এই সেৎসি মাছির কামড়ে এক রকমের অসুখ হয় আফ্রিকাতে। তাকে ওরা সোয়াহিলিতে বলে নাগানা। ইংরিজিতে বলে ইয়ালো-ফিভার। রুগীর খুব জ্বর হয়, শরীর হলুদ হয়ে যায়, মাথার গোলমাল দেখা দেয়, আর রুগী পড়ে-পড়ে শুধুই ঘুমোয়। তাই এই অসুখের আরেক নাম স্লিপিং-সিকনেস। অনেকরকম সেৎসি মাছি আছে এখানে। সব মাছি কামড়ালেই যে এই অসুখ হবে এমন নয়, কিন্তু কামড়াবার আগে তাদের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেখানোর কথা বলা তো যায় না মাছিদের।

এই ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে মরার অসুখকে টেডিরা যমের মতো ভয় পায়।

ঋজুদা আর আমিও আফ্রিকাতে আসবার আগে খিদিরপুরে গিয়ে ইয়ালো-ফিভারের প্রতিষেধক ইনজেকশান নিয়ে এসেছিলাম। ভীষণ লেগেছিল তখন। কিন্তু সেৎসি মাছি যখন সত্যি-সত্যি কামড়াল তখন মনে হয়েছিল যে, ইনজেকশানের ব্যথা কিছুই নয়।

উচ্চারণ সেৎসি যদিও, কিন্তু বানানটা গোলমেলে। ইংরিজি বানান হচ্ছে Tsetse।

আসলে, এখানে এসে অবধি দেখছি বানান নিয়ে বড়ই গণ্ডগোল। গোরোংগোরো বলছে উচ্চারণের সময়, কিন্তু বানান লিখছে NGORONGORO। সোয়াহিলি শব্দের উচ্চারণে প্রথম অক্ষর যেখানে-সেখানে লোপাট হয়ে যাচ্ছে; যেন তারা বেওয়ারিশ।

এইসব ভাবতে-ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, হঠাৎ ঋজুদা আমার স্টীয়ারিং ধরা হাতের ওপরে হাত ছোঁয়াল। ব্রেকে পা দিলাম। ঐ মারিয়াবো পাহাড়শ্রেণীর সামনে এক জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। মানুষ আছে? ঘাসবনে আগুনও লাগতে পারে। কিন্তু বনে আগুন লাগার ধোঁয়া অন্যরকম হয়। জায়গাটা মাইল দশেক দূরে।

ঋজুদা বলল, গাড়ি থামা।

বললাম, এগোব না আর?

 ঋজুদা বলল, গাধা!

ভাগ্যিস ভুষুণ্ডা আর টেডি বাংলা জানে না।

আমি বললাম, এগোবে না কেন?

ঋজুদা বলল, পাহাড়ের কাছ থেকে আমাদের গাড়ি সহজেই দেখতে পাবে ওরা। ওই সেরেঙ্গেটিতে আইনত কোনো মানুষের থাকার কথা নয়। যারা ওখানে উনুন ধরিয়েছে বা অন্য কিছুর জন্যে আগুন জ্বেলেছে তারা নিশ্চয়ই আইন মানে না। আমরা ওখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধের অন্ধকার নেমে আসবে। আজ এখানেই ক্যাম্প করা যাক। আসন্ন রাতে এগোনো ঠিক হবে না।

নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, তুই কী বলিস রুদ্র?

আমি বললাম, ওরা আমাদের দেখেই যদি থাকে, তাহলেও তো রাতের বেলা আক্রমণ করতে পারে।

ঋজুদা আমার দিকে ফিরে বলল, রুদ্রবাবু একটু ভয় পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে যেন!

আমি বললাম, ভয় নয়, সাবধানতার কথা বলছি।

ঋজুদা বলল, দেখে থাকতেও পারে, না-ও দেখে থাকতে পারে। তবে যদি দেখে থাকে, তাহলেও আক্রমণও করতে পারে। এবং সেই জন্যে রাতে আমাদের সজাগ থাকতে হবে; পালা করে পাহারা দিতে হবে। আক্রমণ করতে গেলে তাদেরও তো এই দশ মাইল ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে আসতে হবে। তাই পাহাড় থেকে এই দূরেই তাঁবু ফেলতে চাই। এলে তাদের দূর থেকে দেখা যাবে।

আমি বললাম, ঠিক আছে।

 তারপর ঋজুদা আর টেডি নীচের ঘাস পরিষ্কার করে তাঁবু খাটাতে লেগে গেল।

আমি আর ভুষুণ্ডা চায়ের জল বসিয়ে দিলাম স্টোভে। এখানে খুব সাবধানে আগুন-টাগুন জ্বালতে হয়। যখন-তখন ঘাসে আগুন লেগে যেতে পারে।

তাঁবু খাটাতে-খাটাতে ঋজুদা বলল, চা-ই কর রুদ্র। রাতে বরং খাওয়া যাবে।

 তারপর বলল, তুই প্রথম রাতে জাগবি, না শেষ রাতে?

আমি বললাম, একবার ঘুমিয়ে পড়ল ঠাণ্ডাতে মাঝরাতে ঘুম ছাড়ে না চোখ। আমি প্রথম রাতে জাগি; তুমি শেষ রাতে।

তারপর শুধোলাম, কটা অবধি জাগব আমি?

ঋজুদা বলল, বারোটা অবধি জাগিস। খেয়েদেয়ে আমরা তো নটার মধ্যেই শুয়ে পড়ব সব শেষ করে। নটা থেকে বারোটা, তিন ঘন্টা ঘুমুলেই বাকি রাত জাগতে পারব আমি। রুদ্রবাবু বলে ব্যাপার। তাকে কি বেশি কষ্ট দেওয়া যায়। অনার্ড গেস্ট। ক্যালকেশিয়ান মাখনবাবু!

আমি বললাম, ঋজুদা! অনেক বছর আগেও আমাকে যা বলতে, এখনও তাইই বলবে এটা কিন্তু ঠিক নয়।

ঋজুদা বলল, আলবত বলব, আজীবন বলব; তোর যখন আশি বছর বয়স হবে তখনও বলব, অবশ্য যদি তখন আমি বেঁচে থাকি।

হঠাৎ-হঠাৎ এই সব কথায় আমার মন বড় খারাপ হয়ে যায়। ঋজুদার সঙ্গে গত কয়েক বছর বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এমনই দশা হয়েছে আমার যে, ভাবলেও দম বন্ধ হয়ে আসে।

ঋজুদা না থাকলে আমার কী হবে?

কলকাতায় আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সেখানে যে আকাশ দেখা যায় না। তারা, চাঁদ, সূর্য কিছুই দেখা যায় না। সেখানে কখন ভোর হয় কেউই খোঁজ রাখে না তার। সন্ধে, চুপিসারে দিগন্তে দিগন্তে আলোছায়ার কত দারুণ দারুণ ছবি এঁকে রোজ কেমন করে নিত্যনতুন হয়ে আসে, অথবা চলে-যাওয়া দিনের সঙ্গে ফিরে-আসা রাতের কোন্ আঙিনাতে কেমন করে দেখা হয় রোজ-রোজ, তার খবরও কেউই নেয় না। হাওয়ায় সেখানে ডিজেল আর কয়লার ধোঁয়া, সেখানে গাছ থেকে একটি পাতা খসে পড়ার যে সুস্পষ্ট আওয়াজ তা কেউই শোনে না, শুনতে পায় না; পায় না জানতে শিশিরের পায়ের শব্দ, দুপুরের একলা ভীরু পাখির চিকনগলার ডাক, অথবা ভোরের পাখিদের গানও শোনে না সেখানে কেউ। ফুলের গন্ধ পায় না নাকে। তাদের নাক, কান, চোখ সব অকেজো, অব্যবহৃত যন্ত্রের মতোই তারা মিছিমিছি বয়ে বেড়ায়। তাদের মন আটকে থাকে পাশের বাড়িতে, গলির মোড়ে, অফিসের ঘর অথবা রাস্তার ভিড়ে। দিগন্তরেখা কাকে বলে, বিস্তৃতি বা ব্যাপ্তি কী, উদারতা কোথায় অনুভব করা যায় এসব কিছুরই খবর জানে না শহরের মানুষ। অথচ আমাদের সকলেরই হাতের কত কাছে এই সবই ছিল এবং আজও আছে তা ঋজুদা যদি এমন করে আমাকে হাতে ধরে না চেনাত, না বোঝাত, তাহলে বুঝতাম বা চিনতাম কি কখনও? ঋজুদাই তো হাত ধরে নিয়ে এসে এই আশ্চর্য আনন্দের, অনাবিল, সুন্দর, সুগন্ধি বনের কাকলিমুখর জগতে, প্রকৃতিমায়ের কোলে এনে বসিয়ে আমাকে আসল মজার উৎস, আসল আনন্দের ফোয়ারার খোঁজ দিয়েছে।

আমি যে ঋজুদার কাছ থেকে কী পেয়েছি তা আমার ক্লাসের কোনো বন্ধুই জানবে না। ভাবতেও পারে না ওরা। সেই কারণেই শুধু আমিই জানি, ঋজুদা কখনও থাকব না বললে কেন আমার এত পাগল-পাগল লাগে।

এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। পশ্চিমাকাশে আস্তে আস্তে নিচু হয়ে সূর্যটা একটা বিরাট কমলা-রঙা বলের মতো ঘাসের হলুদ দিগন্তকে কমলা আলোর বন্যায় ভাসিয়ে মিলিয়ে গেল। কিন্তু তারপরও বহুক্ষণ গাঢ় ও ফিকে গোলাপির আভা লেগে রইল আকাশময়।

ঘাস পরিষ্কার করে নিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তারই চারপাশে বসেছি আমরা চারজনে। ভুষুণ্ডা আমাদের পথপ্রদর্শক, অন্য কাজ করতে বললে বিরক্ত ও অপমানিত বোধ করে। আমরা বলিও না। টেডি রান্না চাপিয়েছে। আমি থমসন্স গ্যাজেলের বাচ্চাটাকে কোলে করে বসে আছি। ওর গলার কাছের শেয়ালের কামড়ের ঘা এখনও শুকোয়নি। খুব ভাল করে লাল মার্কুরিওক্রোম লাগিয়ে দিয়েছিল টেডি।

ঋজুদা যখন আরুশাতে এসেছিল তখন ওর একজন আফ্রিকান বন্ধু একটা মীরশ্যাম্ পাইপ উপহার দিয়েছিলেন। আরুশাতে একটি কোম্পানি আছে, তারা মীরশ্যাম্ কাদা দিয়ে পাইপ, অ্যাশট্রে, ফুলদানি ইত্যাদি বানায়। মীরশ্যাম্ আসলে সমুদ্রের এক বিশেষ রকম কাদা। এ দিয়ে তৈরি পাইপের রঙ বদলাতে থাকে খাওয়ার সময়, আগুনের তাপের সঙ্গে সঙ্গে। অগনন ব্ল্যাকউড-এর লেখা শিকারের বইয়ে প্রথম এই মীরশ্যাম পাইপের কথা পড়ি আমি।

টেডি সকলের জন্যে একটিই পদ রান্না করেছে। খিচুড়ির মতো। কিন্তু ঠিক আমাদের খিচুড়ির মতো নয়। ওরা সোয়াহিলি ভাষায় বলে, উগালি। ভুট্টার দানার মধ্যে গ্রান্টস্ গ্যাজেলের মাংস দিয়ে সেই উগালি রান্না হচ্ছে। দারুণ গন্ধ ছেড়েছে। খিদেও পেয়েছে ভীষণ। একটি গ্রান্টস গ্যাজেল ও একটি থমসন্স গ্যাজেল শিকার করে আমরা তাদের মাংস স্মোকড করে নিয়েছি। ট্রেলারের মধ্যে বস্তা করে রাখা আছে সে-মাংস।

পাইপের তামাকের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে হাওয়ায় আর মীরশ্যাম্ পাইপের রঙ বদলানো দেখছি। ভুষুণ্ডা ম্যাপটা খুলে ঋজুদার সঙ্গে কথা বলছে। মাঝে-মাঝে সোয়াহিলিতেও বলছে। এখানে আসার আগেই ঋজুদা সোয়াহিলি শিখে নিয়েছে মোটামুটি। আমাকেও একটা বই দিয়েছিল, কিন্তু কয়েকটা শব্দ ছাড়া বেশি শিখিনি আমি। বড় খটমট শব্দগুলো। জাম্বো মানে হ্যালো, সিম্বা মানে সিংহ, টেম্বো মানে হাতি, চুই মানে লেপার্ড। কারো সঙ্গে দেখা হলে ইংরিজিতে যেমন আমরা বলি হ্যালো বা আমেরিকান-ইংরিজিতে হাই! সোয়াহিলিতে সেই সম্বোধনকে বলে জাম্বো! আমি যদি কাউকে বলি জাম্বো, সে উত্তরে বলবে সিজাম্বো।

শীত বেশ বেশি। যদিও এখন জুলাই মাস, কিন্তু আফ্রিকাতে এখন শীতকাল। হাজার-হাজার মাইল ঘাসবনের উপর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে আসছে হু-হু করে। আমার উইণ্ডচিটারের কলারের কোনাটা পতপত্ করে উড়ছে। ঋজুদার জার্কিনের বুকপকেট থেকে টোবাকোর পাউচটা উঁকি মারছে আর ডানদিকের নীচের পকেটের মধ্যে পয়েন্ট থ্রি কোস্ট পিস্তলটা পোঁটলা হয়ে আছে।

কথাবার্তা শুনে মনে হল, ভুষুণ্ডার আপত্তি আছে ভীষণ মারিয়াবো পাহাড়ের দিকে যেতে। ও বলছে, ওদিকে চোরাশিকারীদের এত বড় আস্তানা আছে এবং ওদের কাছে এতরকম অস্ত্র-শস্ত্র আছে যে, আমাদের ওরা গুলিতে ভেজে নিয়ে খেয়ে ফেলবে বেমালুম।

ঋজুদা জেদ করছে, আজ রাতে কোনো ঘটনা না ঘটলে কাল সকালে আমরা ওদিকেই যাব।

ঋজুদার সিদ্ধান্তে ভুষুণ্ডা বেশ অসন্তুষ্ট হল। যে-লোক গাইডের কথা না শুনে নিজের মতেই চলে, তার গাইডের দরকার কী? এই কথা বলল ভুষুণ্ডা বেশ জোর গলায়।

তার উত্তরে ঋজুদা বলল, যে গাইড সেরেঙ্গেটির মধ্যে রাস্তা ও দিক হারিয়ে ফেলে তেমন গাইড থাকা-না-থাকা সমান।

ঋজুদা কখনও এমন করে কথা বলে না কাউকে। তাই অবাক হলাম। তারপর আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে ঋজুদা ভুষুণ্ডাকে বলল, ইচ্ছে করলে, যে-কোনো জায়গাতে, যে-কোনোদিন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারো।

এই কথা শুনে আমি ভয়ও পেলাম, চমকে উঠলাম।

ভুষুণ্ডা ঠাণ্ডা চোখে ঋজুদার দিকে চাইল।

ঋজুদা ভুষুণ্ডার চোখের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে, ভুষুণ্ডার চোখে নিজের চোখ দিয়ে এক বালতি বরফ জল ঢেলে দিল।

ব্যাপার বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। এসে বিদেশ-বিভুঁই, হাজার-হাজার মাইল জনমানবহীন হিংস্র জানোয়ারে, নানারকম দুর্দান্ত উপজাতিতে এবং সাংঘাতিক সব চোরাশিকারীতে ভরা আফ্রিকার বন-জঙ্গলে স্থানীয় গাইড ছাড়া আমরা কী করে চলব তা ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। গাইড থাকতেও পথ হারালাম। আর গাইড না থাকলে যে কী হবে! এদিকে তেলও বেশি নেই সঙ্গে। তেল ফুরোলে ত গাড়ি ফেলে রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু কোনদিকে যাব? হাজার-হাজার মাইল তো আর পায়ে হেঁটে যেতে পারব না! খাওয়ার জলের অভাবে তো এমনিতেই মরে যাব, খাবারের অভাবে যদি না-ও মরি।

ঋজুদাকে বললাম, ঋজুদা, তুমি রেগে গেছ, কিন্তু কাজটা কি ভাল হচ্ছে? ভেবে দ্যাখো।

ঋজুদা বলল, খুব ভাল হচ্ছে। তুই পাকামি না করে রান্নার কতদূর দ্যাখ। দরকার হলে টেডিকে সাহায্য কর একটু।

আমি চুপ করে গেলাম। ভাবলাম, সাহায্য আর কী করব? রাঁধছে তো শুধু উগালি। তাও প্রায় হয়ে এসেছে।

আমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেল। ভুষুণ্ডা গাড়িতেই শোয়। টেডি ভীষণ লম্বা বলে গাড়িতে শুতে পারে না। ছোট তাঁবুটাতে শোয় ও। আমি আর ঋজুদা শুই বড় তাঁবুটাতে। আজ আমি শোব না এখন। পাহারা দিতে হবে। তাই রাইফেলে গুলি ভরে, টুপি পরে আমি তাঁবুর বাইরে আগুনের পাশে ক্যাম্প-চেয়ারে বসলাম। বাইরে যদি শীত বেশি লাগে, তবে মাঝে-মাঝে ল্যান্ড-রোভারের সামনের সীটেও গিয়ে বসব।

ঋজুদা বলল, কিছু দেখতে পেলে আমাকে ডাকিস। আর ঠিক রাত বারোটাতে তুলে দিস আমাকে।

বললাম, আচ্ছা।

ঋজুদা পরদা ঠেলে তাঁবুর মধ্যে গিয়ে ঢুকল। আমি ক্যাম্পচেয়ারে বসে জুতোসুদ্ধ পা-দুটো লম্বা করে আগুনের দিকে ছড়িয়ে দিলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই টেডি মহম্মদের নাক-ডাকার আওয়াজ সেই প্রায়-নিস্তব্ধ রাতের ঘাসবনে বিকট হয়ে উঠল। সেই ডাকের কী আরোহণ অবরোহণ, কত গমক আর গিটকিরি। টেপ-রেকর্ডার আছে সঙ্গে, কিন্তু তাতে টেডির নাক-ডাকার আওয়াজ টেপ করলে ঋজুদা মার লাগাবে। তাঁবুর মধ্যে, পিস্তলের গুলি খুলে আবার পিস্তল কক করার শব্দ শুনলাম। রি-লোড করে পিস্তল কক করল ঋজুদা, তার শব্দ শুনলাম। রোজ শোবার সময় মাথার বালিশের নীচে পিস্তলটাকে রাখে ঋজুদা। আর সারাদিন জার্কিনের কোটের পকেটে।

গাড়ির মধ্যে ভুষুণ্ডা ঘুমুচ্ছে। কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে নড়াচড়ার উসখুস আওয়াজ।

আধ ঘন্টা পর শুধু টেডির নাকডাকার আওয়াজ ছাড়া অন্য আর কোনো আওয়াজই রইল না।

একটু পরে আগুনটা ফিসফিস করে কী যেন বলে নিভে গেল। কাঠের না যে অনেকক্ষণ জ্বলবে। কটন ওয়েস্ট-এর সঙ্গে পোড়া মবিল মিশিয়ে তার সঙ্গে টুকিটাকি ও ঘাসটাস ফেলে আগুন করা হয়েছিল। কাল থেকে আগুন জ্বালারও কিছু রইল না। সঙ্গে কোরোসিনের স্টোভ আছে অবশ্য, তাতেই রান্না হবে।

উপরে তারাভরা আকাশ। এখন একটু চাঁদও উঠেছে। হাওয়াটা আরও জোর হয়েছে। হঠাৎ পিছন দিক থেকে হাঃ হাঃ হাঃ করে বুকের ভিতরে চমক তুলে হায়না ডেকে উঠল। তারপর ঘাসের মধ্যে খসখস করে তাদের এদিকে এগিয়ে আসবার শব্দ পেলাম।

কারিব্যুর ঘা-টা এখনও পুরো শুকোয়নি। হয়তো রক্তের গন্ধ পেয়ে থাকবে হায়নাগুলো। পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা ওদের দিকে ফেললাম। ওরা কিছুক্ষণ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।

হঠাৎ কী একটা জন্তু উড়তে-উড়তে, লাফাতে-লাফাতে এদিকে আসতে লাগল। জানোয়ারটা ছোট। কী জন্তু যে, তা বুঝতে পারলাম না। সামনে থেকে টর্চ ফেললাম। দেখলাম লোমওয়ালা একটা জানোয়ার–আমাদের দেশের বড় হিমালয়ান কাঠবিড়ালির মতো অনেকটা–গায়ের রঙ যদিও অন্যরকম। আর যেই সেই জানোয়ারটা আমাদের তাঁবুকে পাশে রেখে, তাঁবু দেখে ঘাবড়ে গিয়ে উড়ে সরে যেতে গেল তখন পাশ থেকে আলো ফেলতেই চোখ জ্বলে উঠল জ্বলজ্বল করে। কিন্তু একটা চোখ। অথচ যখন সামনাসামনি আলো ফেলেছিলাম তখন একবারও জ্বলেনি চোখ দুটো। কী জন্তু কে জানে? কাল জিজ্ঞেস করতে হবে ঋজুদাকে। এমন কিছু আমাদের দেশের জঙ্গলে দেখিনি, আফ্রিকাতে আছে বলে পড়িওনি।

উড়ে-যাওয়া জন্তুটা যে-দিকে মিলিয়ে গেল সেই দিকে চেয়েছিলাম, এমন সময় দূর থেকে বারবার সিংহের গর্জন ভেসে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ পরই পায়ে-পায়ে জোর খুরের শব্দ তুলে ওয়াইল্ড বীস্টদের বিরাট একটি দল তাঁবুর দুশো গজের মধ্যে দিয়ে শিশির-ভেজা মাটির গন্ধ উড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। সিংহের দল বোধহয় তাড়া করেছে ওদের।

ঠাণ্ডা লাগছিল বেশ। গিয়ে ল্যাণ্ড-রোভারের সামনের দরজা খুলে বসলাম। ভুষুণ্ডা গাঢ় ঘুমে আছে মনে হল। কোনো সাড়াশব্দই নেই।

মারিয়াবো পাহাড়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে-থাকতে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখতে যাব কটা বাজে, এমন সময় মনে হল, মারিয়াবো পাহাড়ের দিক থেকে কী একটা জানোয়ার আসছে এদিকে। একলা জানোয়ারটা বেশ কাছে এসে গেছে। তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে নেমে গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে খুব ভাল করে তাকালাম ওদিকে।

আশ্চর্য! জানোয়ার তো নয়! মনে হচ্ছে মানুষ। দুবার চোখ কচলে নিলাম। পৃথিবীর মানুষ এ-রকম হয়? কী লম্বা! প্রায় সাত ফিটের মতো হবে। চলে আসছে সোজা হয়ে আমাদের তাঁবুর দিকে অদ্ভুত পোশাক তার। হাতে একটা বিরাট লম্বা লাঠি।

টর্চ ফেলব কি-না ভাবলাম একবার। তারপর ভাবলাম, ঋজুদাকে ডাকি। আরেকবার ভাবলাম, ঘড়িটা দেখি কটা বেজেছে; কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। কে যেন আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল। আমার সারা শরীর অসাড় হয়ে গেল। এই কি তবে টেডির ঊনকুলুকুলু? সেদিন রাতে টেডি আমাকে এই গল্প বলেছিল।

লোকটি যখন আরো কাছে এসে গেছে তখন কানের কাছে হঠাৎ কে যেন ফিসফিস করে বলল, মাসাই চীফ। গ্রেট ট্রাবল্। শূট হিম্। কিল হিম্।

এক পলকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, ভুষুণ্ডা গাড়ির ভিতরে সোজা শক্ত হয়ে বসে উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে ঐদিকেই তাকিয়ে আছে।

রাইফেলটা কাঁধে তুললাম। কাঁধে তুলতে অনেকক্ষণ সময় লাগল। তারপরে রাইফেল স্টেডি পজিশানে ধরে ট্রিগারের দিকে হাত বাড়ালাম। ঠিক সেই অবস্থাতে আমার হঠাৎ মনে হল যে, মানুষটা অন্য মহাদেশের অজানা ভাষা-বলা কোনো অদ্ভুত মানুষ বটে, বিকট দেখতে বটে, কিন্তু সে তো আমার কোন ক্ষতি করেনি। সে চোরাশিকারী কি না, তাও জানি না। ঠাণ্ডা মাথায় একজন মানুষকে গুলি করে মারতে পারব কি আমি? আমার হাত কাঁপবে না?

ভুষুণ্ডা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, য়ু ডোন্ট কিল, হি কিল যু।

 আমি ট্রিগারে হাত ছোঁওয়ালাম।

 ততক্ষণে মানুষটা প্রায় এসে গেছে। সে সোজা আমারই দিকে আসছে।

কী সাহস! এই রাতে, এইরকম হিংস-জানোয়ারে ভরা রাতে একা-একা শুধু একটা লাঠি হাতে দূর থেকে হেঁটে আসার কথা ভেবেই আমার শরীর খারাপ লাগতে লাগল। লোকটা দেখতে পেয়েছে যে, তার বুক লক্ষ করে আমি রাইফেল তুলেছি। তবু তার ভ্রূক্ষেপমাত্র নেই। পৃথিবীর কোনো মানুষ তার ক্ষতি করতে পারে এমন কথা বোধহয় তার ভাবনারও বাইরে।

তবে? লোকটা কি পৃথিবীর মানুষ নয়? ঊনকুলুকুলু?

এ কী! লোকটা যে এসে গেল! লালচে-কানো ভারী মোটা কাপড়ের পোশাক, লুঙ্গির মতো অনেকটা; বুকের কাছে গিট দিয়ে বাঁধা। আরেক খণ্ড ঐরকম কাপড় চাদরের মত জড়ানো বুকে কাঁধে। ডান হাতে ওটা লাঠি নয়, একটা বর্শা, তার সাত ফিট মাথা ছাড়িয়ে আরো উঁচু হয়ে আছে। কোমরে বাঁধা আছে একটা প্রকাণ্ড দা। গলায়, কানে, অদ্ভুত সব বড় বড় রঙিন পাথরের আর হাড়ের গয়না। চাঁদের ফিকে আলোতেও তার মুখ আর কপালের রঙিন আঁকিবুঁকি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

রাইফেল ধরেই আছি, লোকটাও এগিয়েই আসছে, আসছে; এসে গেল।

ভুষুণ্ডা গাড়ির ভিতর থেকে আবার চাপা গলায় বলল, কিল হিম, য়ু ফুলিশ বয়।

আমাকে বয় বলতেই রেগে গিয়ে যেন হুঁশ ফিরে পেলাম। আর হুঁশ ফিরে পেয়েই, যেই ট্রিগার টানতে যাব, তার আগেই লোকটা আমার রাইফেলটাকে ঠিক মাঝখানে তার দারুণ লম্বা মিশকালো হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেলে ডান দিকে ঠেলে তুলে সরিয়ে দিল। আর সেই অবস্থাতেই, নলের মুখ থেকে আগুনের ঝলকের সঙ্গে গুলিটা বেরিয়ে গেল আধো-অন্ধকারে। রাইফেলের গুলির সেই আওয়াজ শূন্য প্রান্তরে ছড়িয়ে গেল হু-হু হাওয়ার সঙ্গে হাঃ হাঃ হাঃ করে, যেন আমাকেই ঠাট্টা করে।

লোকটা রাইফেলের নলটা ধরেই ছিল। নলটা ঐ অবস্থাতেই ধরে থেকে আমার চোখে সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। কী ভয়াবহ জ্বলন্ত দৃষ্টি। কীরকম খোদাই করা কালো মুখ!

তারপরই, এক ঝটকায় রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে সে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এমন সময় ঋজুদা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা ডান কাঁধের সামনে তুলে বলল, জাম্বো।

লোকটাও বলল, জাম্বো!

বলেই পিচিক করে, প্রায় আমার মুখের উপরেই, একগাদা থুতু ফেলল।

তারপর কাটা-কাটা সংক্ষিপ্ত গম্ভীর স্বরে ছোট্ট ছোট্ট শব্দে ঋজুদার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সেই ভাষা সোয়াহিলি নয়। হয়তো মাসাইদের ভাষা।

ঋজুদা তাকে ক্যাম্প-চেয়ার পেতে বসাল। তারপর তাঁবুর ভিতরে গিয়ে এক টিন কনডেনসড মিল্ক আর একটা আয়না এনে মাসাই চীফকে উপহার দিল। কাউকে উপহার দেবে বলে, নতুন চকচকে আয়না যে ঋজুদা সঙ্গে করে আনতে পারে আফ্রিকার বনেও, তা আমার জানার কথা ছিল না।

এমন সময় মারিয়াবো পাহাড় যেদিকে, সেই দিক থেকে বহু লোকের গলার চিৎকার এবং দ্রিদিম, দ্রিদিম, দ্রিদিম গম্ভীর, গায়ে কাঁটা দেওয়া মাদলের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। লোকগুলো মাঝে মাঝে একসঙ্গে বুক কাঁপানো চিৎকার করে উঠছিল।

ঋজুদা এসে আমাকে বলল, তুই একটা ইডিয়ট। আমাকে ডাকলি না কেন? কে তোকে গুলি করতে বলল? দ্যাখ তো এখন কী কাণ্ড বাধালি।

তারপরই বলল, এক্ষুনি ক্ষমা চা তুই মাসাই-সর্দারের কাছে। ওরা আমাদের বন্ধু। শত্রু নয়।

হাত-পা সব ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। আমরা এই কজন আর ওরা কত লোক। ওরা বর্শা দিয়েই সিংহ শিকার করে শুনেছি, তার উপর বিষাক্ত তীরও আছে ওদের। আমার তলপেট গুড়গুড় করছিল ভয়ে। দূরের মাদলের শব্দে আর চিৎকারে। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে, হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলাম আমি।

ঋজুদা কী যেন বলল মাসাই-সর্দারকে। শুধু দুটো শব্দ উচ্চারণ করল। এবং সর্দার সঙ্গে সঙ্গে আরেকবার পিচিক করে থুতু ফেলে একটু থুতু নিজের ডান হাতের তেলোতে নিয়ে দুহাতের পাতা ভাল করে ভিজিয়ে আমার মুখটাকে দুহাত দিয়ে ধরল। আমার মনে হল, সিংহের মুখে নেংটি ইঁদুর পড়েছে। আমার মুখটা দুহাতে ধরা অবস্থাতেই সর্দার আমার মাথার ঠিক মধ্যিখানে আবার সশব্দে থুতু ফেলল। কী দুর্গন্ধ! গা গুলিয়ে উঠল আমার। এর চেয়ে এদের তীর খেয়ে মরাও ভাল ছিল।

ঋজুদার উপর ভীষণ রাগ হতে লাগল। একে তো হাঁটুগেড়ে বসিয়ে ক্ষমা চাওয়াল, তারপর থুতু খাওয়াল। এখন থুতু দিয়ে চান করাল।

ততক্ষণে ভুষুণ্ডা এবং টেডি মহম্মদও চলে এসেছে। কিন্তু অন্ধকারে দিগন্তে অসংখ্য মশাল জ্বেলে রংবেরং-এর ঢাল পালক-লাগানো বল্লম হাতে শয়ে শয়ে মাসাইরা এগিয়ে আসছে আমাদের তাঁবুর দিকে।

ওদের আসতে দেখেই ঋজুদার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে সর্দার ল্যাও-রোভারের বনেটের উপরে উঠে দাঁড়াল সাবধানে। টর্চ দিয়ে আকাশে আলো ফেলে-ফেলে সেই আগন্তুক লোকদের যেন কী ইশারা করল। তারপর ডান হাত তুলে বলল, মারিয়াবো, সিরিঙ্গেট, মিগুংগা; নীয়ারাবোরো।

বলেই, পিচিক করে আরেকবার থুতু ফেলে এক লাফ দিয়ে গাড়ির বনেট থেকে নামল। সঙ্গে সঙ্গেই আগন্তুক লোকগুলো দূর থেকেই হৈ-চৈ করতে করতে ফিরে যেতে লাগল, যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে। কী সব বলতে বলতে।

ঋজুদা আমাকে বলল, রুদ্র, এখানে তো স্নানের জল নেই। আমার হ্যাভারস্যাকে বড় এক শিশি ওডিকোলন আছে। বুকে মাথায় মেখে শুয়ে পড় গিয়ে। তোর আর থাকতে হবে না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা হয়েছে।

মুখ নিচু করে রাইফেলটা যেখানে পড়ে ছিল, সেখানে গিয়ে সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে তাঁবুর মধ্যে গিয়ে ওডিকোলনের শিশি উপুড় করেও কিছুই সুরাহা হল না। সেই দুর্গন্ধ আরো বেড়েই গেল।

শুনেছিলাম, মাসাইরা নাকি শুধু রক্ত আর দুধ খেয়ে থাকে। তাই বোধহয় ওদের থুতুতে এ-রকম দুর্গন্ধ!

উত্তেজনায় ও দুর্গন্ধে ঘুম আসছিল না, তবুও ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ঋজুদা কোনোদিনও আমাকে ইডিয়ট বলেনি। আজই প্রথম বলল। কিন্তু এতই ভয় পেয়েছিলাম আর উত্তেজিত হয়েছিলাম যে, এত বড় অপমানটাও সর্দারের থুতুর সঙ্গে হজম করে ফেললাম।

শুয়ে শুয়ে সর্দারের মুখটা মনে করছিলাম। ঋজুদা বলেছিল, মাসাই চীফ-এর নাম নাইরোবি সর্দার।

.

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি ঋজুদা নিজেই ব্রেকফাস্ট বানিয়ে ফেলেছে। কণ্ডেন্সড মিল্ক জলে গুলে, গরম করে নাইরোবি সর্দারকে আদর করে খেতে দিল। সঙ্গে ওয়াইল্ডবীস্টের রোস্ট।

সর্দার শুধুই দুধ খেল, কিন্তু মুখ দেখে মনে হল ঐ টিনের দুধ তার মোটেই ভাল ঠেকল না।

সর্দার বলল, আমরা কাঁচা দুধ খাই, আর রক্ত খাই টাটকা। তোমরা যখন যাচ্ছই আমাদের ওখানে, তখন তোমাদেরও খাওয়াব।

বলে কী রে? কাল থুতু মেখেছি মুখে-মাথায়, আজ আবার কাঁচা রক্ত খেতে হবে। ঋজুদার সঙ্গে আফ্রিকাতে না এলেই ভাল হত!

ভুষুণ্ডা, দেখলাম, একটু দূরে-দূরেই থাকছে। কথাবার্তা বিশেষ বলছে না। যদিও এই অঞ্চলের সব ভাষা ভালই জানে। ঋজুদা যে ওর সাহায্য ছাড়াই মাসাই-সর্দারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে পারবে সে-কথা ও বোধহয় আগে বুঝতে পারেনি। সে কথা বুঝে খুব খুশি হয়েছে বলে মনে হল না ভুষুণ্ডা। ঋজুদাকে এখনও বলাই হয়নি যে, আমাকে ‘ফুলিশ বয়’ বলে, কাল ভুষুণ্ডাই গুলি করতে বলেছিল। নইলে আমি সর্দারের দিকে রাইফেল তুলতামই না।

টেডি খুব কাজ-কর্ম করছে। নাইরোবি সর্দার দয়া করে টেডিকে একটু নস্যি দিল। আমাদের কাছে একটু, কিন্তু টেডি আর সর্দারের নাক যত বড় তাদের নাকের ফুটোটাও তত বড়। একশো গ্রাম করে নস্যি দিব্যি ঢুকে গেল এক-এক নাকে। যেটুকু উড়ে এল হাওয়ায় তাতেই হাঁচতে লাগল ঋজুদা। আমিও।

খাওয়া-দাওয়া হতেই তাঁবু টাবু সব হাতে-হাতে উঠিয়ে ফেললাম আমরা। মালপত্র গুছিয়ে গাড়িতে তুলে দিলাম।

ঋজুদা বলল, চল, আমরা এখন নাইরোবি সর্দারের গ্রামে যাব। ওর সঙ্গে দেখা না-হলে আমরা জলের অভাবে নিশ্চয়ই মারা যেতাম। পথও খুঁজে পেতাম না। আমাদের যিনি গাইড, ভু-বাবু, তার ভূগোলের জ্ঞান মনে হচ্ছে তোরই মতো। কী করে গাইড হল কে জানে?

আমি বললাম, জানো তো, কাল রাতে ভুষুণ্ডাই আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে বলেছিল সর্দারকে।

ঋজুদা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কী ভাবল, তারপর বলল, হয়তো ভয় পেয়েছিল। ভুল করেছিল ভুষুণ্ডা।

তারপর বলল, এখন ও নিয়ে আর আলোচনা করিস না। ভুষুণ্ডা শুনতে পাবে।

আমি বললাম, শুনতে পেলেই বা কী? এখানে বাংলাই তো সকলের কাছে হিব্রু-ল্যাটিন। বাংলাতে আমরা যা খুশি তাই বলতে পারি।

ঋজুদা বলল, কারেক্ট।

তারপর বলল, তবে পুরোপুরিই বাংলা বলিস–আর্ধেক ইংরিজি, আর্ধেক বাংলার খিচুড়ি নয়। ইংরিজি বুঝে যাবে ও!

বললাম, আচ্ছা। 

সবাই গাড়িতে উঠলাম। নাইরোবি সর্দার বনেটের উপরই বসল, দুহাত দিয়ে দু’দিক ধরে। সে এতই লম্বা-চওড়া যে, ভিতরে আঁটল না। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ঋজুদা, উইন্ডস্ক্রীন ভরে আছে লাল পোশাকের, নস্যি-কালো, নাইরোবি সর্দার।

কী করে যে গাড়ি চালাবে ঋজুদা জানি না। অবশ্য এখানে পথ দেখার কিছু নেই। দেখলাম, ঋজুদা ডানদিকের জানালা দিয়ে মুখ বের করে গাড়ি স্টার্ট করল।

গাড়িতে আমরা সকলেই চুপচাপ। উইন্ডস্ক্রীনটা একটু উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল হাওয়া আসার জন্যে। বনেটের উপর সর্দার বসে থাকায় খুবই আস্তে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল–জোরে চালালে আমাদের গাড়ির তলাতেই পড়ে মারা যাবে সর্দার, তখন আর দেখতে হবে না–কাল রাতের মতো দ্রিদিম দ্রিদিম হুলা হুলা সব দৌড়ে আসবে।

আমি বললাম, আমরা যে রাস্তা ভুলে গেছি, আমাদের ঠিক রাস্তা বাতলে দেবে কে? সর্দার?

ঋজুদা বলল, হ্যাঁ। তা নয়তো আর যাচ্ছি কেন? তাছাড়া, তেলের সঙ্গে জলও কমে এসেছে আমাদের। পাহাড়ের ঝর্না থেকে জল ভরে নেব। আবারও যে রাস্তা ভুল হবে না বা অন্য কোনো বিপদ হবে না তা কে বলতে পারে?

ঋজুদাকে শুধোলাম, নাইরোবি তো একটা শহরের নাম। কেনিয়াতে না শহরটা? শুনেছি, খুব সুন্দর শহর। তাই না? তবে সেই শহরের নামে এই সর্দারের নাম হল কী করে?

ঋজুদা বলল, মাসাই ভাষাতে, নাইরোবি কথাটার মানে হচ্ছে খুব ঠাণ্ডা। নাইরোবি শহরটা আমাদের দার্জিলিঙের মতো। খুব ঠাণ্ডা, পাহাড়ি শহর। একসময় ওখানে মাসাইরাই থাকত। জার্মান আর ইংরেজদের দেশের মতো আবহাওয়া বলে সেই সাদা চামড়ার বিদেশীরা ওদের ওখান থেকে তাড়িয়ে দিল। কিন্তু নামটা এখনও নাইরোবিই রয়ে গেছে।

তা তো হল। কিন্তু সর্দারের নাম নাইরোবি কেন? আমি বললাম।

 কী জানি? হয়তো মেজাজ খুব ঠাণ্ডা বলে। নইলে, তুই গুলি চালিয়ে দেওয়ার পরও আমাদের ক্ষমা করার কথা ছিল না।

ঋজুদা বলল।

তারপরই বলল, আচ্ছা, অত কাছ থেকে তুই মিস্ করলি কী করে? তোর হাত তো মোটামুটি ভালই। অবশ্য ভাগ্যিস মিস্ করেছিলি, নইলে আর কাউকে বেঁচে ফিরতে হত না।

আমি বললাম, সত্যিই মানুষটা সর্দার। ভয় কাকে বলে জানে না। মাথাও দারুণ ঠাণ্ডা। রাইফেল ওর বুকের দিকে এইম করে ধরেছিলাম, তবুও ডোন্টকেয়ার করে সোজা হেঁটে এল আমারই দিকে–যেন আমার রাইফেলটা খেলনা রাইফেল, তারপর রাইফেলের নলটাকে ধরে ঘুরিয়ে দিল। ঘাবড়ে গিয়েই আমি ট্রিগার টিপে ফেলেছিলাম।

ঋজুদা বলল, চমৎকার! দারুণ লোককেই পাহারাদার রেখেছিলাম আমি।

আমি বললাম, তোমার ভু-বাবু যে ক্রমাগত আমাকে বলে যাচ্ছিলেন, মারো, মারো, ওকে মেরে ফেলল। ওকে না মারলে আমরা সকলে মরব।

ঋজুদা চুপ করে থাকল। কোনো কথা বলল না।

এদিকে সর্দার আরেকবার নস্যি নিল বনেটে বসা অবস্থাতেই। আর উইন্ডস্ক্রীন যে তুলে রাখা হয়েছিল তার ফাঁক দিয়ে নস্যি উড়ে এল হাওয়ার সঙ্গে। কী বিকট গন্ধ আর কী কড়া নস্যি রে বাবা! হাঁচতে হাঁচতে আমার চোখে জল এসে গেল।

ঋজুদা আর টেডি হাসতে লাগল আমার অবস্থা দেখে।

 দূর থেকে মাসাই গ্রামটা দেখা যাচ্ছিল মারিয়াবো পাহাড়ের নীচে। গোল-গোল বিরাট সব খড়ের ঘর। খড়ে ছাওয়া বিরাট গোয়াল। এখন ফাঁকা। মেয়েরাও দারুণ লম্বা। সকলেই নানারকম পাথর ও হাড়ের গয়না পরেছে। ওদের গায়ের রঙ গাঢ় বাদামি, পোশাক সকলেরই হাতে-বোনা লাল গরম কাপড়ের, প্রায় কম্বলের মতো। কাঠের তৈরি বালতি ও নানারকম পাত্র দিয়ে ওরা কাজ-কর্ম করছে। অল্প ক’জন পুরুষ আমাদের দেখে এগিয়ে এল।

ঋজুদা বলল, ঐ যে গোল ঘরগুলো দেখছিস, ওগুলোকে বলে বোমা।

 বোমা! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

 ঋজুদা বলল, হ্যাঁ। আর ঐ গোয়ালঘরগুলোর নাম, ক্রাল।

ল্যাণ্ড-রোভার থামতেই জলের পাত্রগুলো নামিয়ে দেওয়া হল। টেডি গ্রামের মাসাইদের সঙ্গে চলে গেল ঝর্নার দিকে।

আমরা নামতেই আমাদের বিরাট-বিরাট পেঁপে আর কলা খেতে দিল ওরা। তারপর একটা কালো বাছুরকে ধরে নিয়ে এল। তার গলার শিরাতে দড়ি পরিয়ে দিয়ে একটুকরো কাঠ দিয়ে টার্নিকেট করে একটা শিরাকে একজন ফুলিয়ে দিল। তখন অন্যজন একটা ছোট তীর মারল কাছ থেকে–অমনি ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠতে লাগল ফোয়ারার মতো। আরেকজন একটা কাঠের জামবাটিতে সেই রক্ত ধরতে লাগল। বাটিটা ভরে গেল, একজন গিয়ে মাটি থেকে একমুঠো ধুলো তুলে থুতু দিয়ে সেই ধুলো তীরের সূক্ষ্ম ফুটোতে ঘষে দিল। তারপর ঠেলে ঢুকিয়ে দিল শিরাটাকে ভিতরে। চামড়াতে ঢেকে গেল সঙ্গে সঙ্গে শিরাটা, রক্তও বন্ধ হয়ে গেল। বাছুরটা লাফাতে লাফাতে খোঁয়াড়ে চলে গেল। প্রাণে না মেরেও দারুণ কায়দায় ওর রক্ত বের করে নিল এরা।

কিন্তু আমি বোধহয় প্রাণে বাঁচলাম না। সেই কাঠের বাটিতে ফেনা-ওঠা তাজা রক্ত এনে একটা লোক সামনেই দাঁড়াল। আমি বয়সে সবচেয়ে ছোট বলে আদর করে আমাকেই সবচেয়ে আগে খেতে দিল। অন্য একজন লোক দুহাতের পাতায় থুতু ফেলে ভাল করে ঘষে সেই পাত্রটিকে সসম্মানে হাতে নিয়ে এসে ইঙ্গিতে চুমুক দিতে বলল।

আমি ইতস্তত করছিলাম। ভুষুণ্ডা বলল, না খেলে এরা অপমানিত হবে এবং দাওয়ের এক কোপে তোমার মুণ্ডু শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে।

ঋজুদাও ভুষুণ্ডার কথায় মাথা নাড়ল।

আর কথা না বাড়িয়ে আমি বাটিতে চুমুক দিলাম। ফেনা-ওঠা টাটকা বাছুরের রক্ত। এক চুমুকে খেয়ে দেখলাম যে, তখনও বেঁচে আছি। মনে হল আমিও যেন ওদেরই মতো লম্বা হয়ে গেলাম, গায়ে জোর বেড়ে গেল অনেক। কিন্তু, ভীষণ বমি পাচ্ছিল।

আমার পর ঋজুদা, আর ভুষুণ্ডাও খেল। টেডি জল নিয়ে আসেনি এখনও। সময় লাগবে। তাই ওকে খেতে হল না। বেঁচে গেল।

নাইরোবি সর্দার উবু হয়ে মাটিতে বসে মাটির উপরেই একটা তীর দিয়ে একে একে ঋজুদাকে রাস্তা বোঝাতে লাগল। ভুষুণ্ডা একটু দূরে দাঁড়িয়ে তার জিনের ট্রাউজারের দুপকেটে দুহাত ঢুকিয়ে মনোযোগের সঙ্গে দেখতে লাগল। ঋজুদা কম্পাস বের করে একটা সাদা কাগজে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে কী-সব লিখতে লাগল।

যে লোকটি আমাকে রক্ত খাওয়াল তার সঙ্গে একটু ভাব করার ইচ্ছে হল। ভুষুণ্ডাকে বললাম, আমাকে সাহায্য করতে। ভুষুণ্ডা ভাঙা-ভাঙা মাসাইতে ওকে নাম জিজ্ঞেস করল।

লোকটা পিচিক করে থুতু ফেলে কয়েকটা শব্দ করল পরপর।

 ভুষুণ্ডা হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে লোকটাও।

বললাম, হসির কী হল?

ভুষুণ্ডা বলল, ও এখন পুরনো নামটা বদলে ফেলেছে, কিন্তু নতুন নাম এখনও রাখেনি। কাল রাখবে। নতুন নাম কী হবে ঠিক করেনি। আজ ভেবে ঠিক করবে।

আমি বললাম, কী ঠাট্টা করছ ভুষুণ্ডা। নাম আবার নতুন-পুরনো হয় নাকি?

 ভুষুণ্ডা বলল, ঠাট্টা? না, না, ঠাট্টা নয়। তুমি বানাকে জিজ্ঞেস করো, বানা জানে। বলে, ঋজুদাকে দেখাল।

তারপর বলল, মাসাইরা, ইচ্ছেমতো নিজেদের নাম বদলায়, জামাকাপড় পাল্টাবার মত। একটা নাম পুরনো হয়ে গেলেই সেটা বাতিল করে মনোমতো নতুন নামে ডাকে নিজেকে।

আমি বললাম, ওরা তো সাপের মতো। খোলস বদলায়।

ভুষুণ্ডা কোমর দুলিয়ে ওর হাঁটুর নীচে নেমে আসা দুটি লম্বা-লম্বা হাত দুলিয়ে কলার মতো চওড়া চোয়ালের ধবধবে সাদা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হিকহিক করে হেসে উঠল। বলল, জব্বর বলেছ, জব্বর বলেছ!

মাসাইরা সাপের মতোই, খোলস বদলায়, নাম বদলায়।

আমাদের ক্লাসের এক বন্ধুর নাম নিয়ে বড় দুঃখ। ওর দাদু নাম দিয়েছিলেন ব্যোমশংকর। তা ওর একেবারেই পছন্দ নয়। ও মাসাই হলে কেমন সহজে নামটা পাল্টে ফেলতে পারত।

দূর থেকে টেডিকে আসতে দেখা গেল। ওরা চার-পাঁচজন জল বয়ে নিয়ে আসছে। ড্রামে এবং চামড়ার ছাগলে। পেছনে পেছনে একপাল ছেলেমেয়ে এবং কয়েকটা ছাগল।

ছাগল দেখে আমার কারিব্যুর কথা মনে হল। কারিব্যুকে একটু দুধ খাইয়ে নেওয়া যায়। টেডির সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের একজনকে বলে ভুষুণ্ডা একটা ছাগলকে ধরে কারিব্যুকে তার দুধ খাওয়াতে গেল। কারিব্যুর আপত্তি তো ছিলই, তার উপরে সেই পাজি ছাগলিটা পাগলির মতো এক লাথি মেরে দিল কারিব্যুর গায়ে।

ঋজুদা বলল, তুই বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলবি দেখছি। আমরা যেভাবে দিন কাটাচ্ছি তাতে ওকে বাঁচানো এমনিতেই মুশকিল হবে। তার চেয়ে তুই সর্দারকে প্রেজেন্ট করে যা, ওদের ক্রালে থাকবে। অন্যান্য গোরু বাছুরের সঙ্গে দিব্যি বড় হয়ে উঠবে কারিব্যু।

আমি বললাম, ছাগলের দুধ খাচ্ছে না যে ও!

ঋজুদা বলল, সকালে তুই পলতে করে অত কন্ডেন্সড মিল্ক খাওয়ালি, তাই পেট ভরা। খিদে পেলে খুবই খাবে।

আমি আর টেডি মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলাম। তারপর নাইরোবি সর্দারের হাতে দিলাম কারিব্যুকে। ওর পিঠের ঘা-টা তখনও লাল হয়ে ছিল। ভাল হয়ে উঠলেও ওর পিঠে গভীর দাগ থেকে যাবে। থমসনস গ্যাজেলদের গায়ের রঙ ভারী সুন্দর হালকা বাদামি–তার উপর কালো ডোরা, তলপেটটা সাদা। ওর পিঠের ঐ দাগ বিচ্ছিরি দেখাবে ও বড় হলে।

নাইরোবি সর্দারের কথায় কোথা থেকে একজন দৌড়ে এসে কীসব পাতা-টাতা বেটে এনে কারিব্যুর ঘায়ে লাগিয়ে দিল। সর্দার বলল, কারিব্যু এখন থেকে আমাদের গোরু-বাছুরের সঙ্গেই চরে বেড়াবে।

ঋজুদা বলল, এবার আমরা উঠব।

সর্দার বলল, দাঁড়াও। বলে, ঋজুদার হাতে একটা গোল হলুদ পাথর দিল। বলল, কখনও প্রয়োজন হলে কোনো মাসাইকে এই পাথরটি দেখালে সে তোমাকে সবরকম সাহায্য করবে। এটাকে সাবধানে রেখো।

সর্দার এবং অন্যান্যরা সার বেঁধে দাঁড়াল। আমরা সকলে হাত তুলে ওদের ধন্যবাদ জানালাম। বাচ্চারা ভিড় করে গাড়িটা দেখছিল। মনে হল, ওরা কখনও গাড়ি দেখেনি আগে। রওয়ানা হবার আগে, দুহাতে আমার মুখটা আদর করে ধরে পিচিক করে আমার মাথায় থুতু দিল সর্দার।

আমি গদগদ ভাব দেখিয়ে হাসলাম।

ঋজুদা বিড় বিড় করে বলল, তোকে যা পছন্দ করেছে সর্দার, হয়তো জামাই-ই করবে। রাজি না হলেই মুণ্ডু কাটা যাবে কিন্তু।

ভয়ে আমি কুঁকড়ে গেলাম।

স্টীয়ারিং-এ আমিই বসলাম এবারে। ঋজুদা পাশে বসল ম্যাপটা হাঁটুতে ছড়িয়ে। ভুষুণ্ডা ঋজুদার পিছনে বসে ঋজুদার কাঁধের উপর দিয়ে ম্যাপটা দেখছিল। বুঝতে পেরে ঋজুদা বলল, ম্যাপটা ভাল করে বুঝে নাও ভুষুণ্ডা। এর পরেও রাস্তা ভুল হলে কিন্তু তোমার নামে সেরোনারাতে আমি রিপোর্ট করতে বাধ্য হব। বলে, ম্যাপটাকে হাতে নিল।

ট্রেলারে জলের ড্রামের সঙ্গে পেট্রলের জেরিক্যানের ঠোকাঠুকি লেগে টংটং শব্দ হচ্ছিল। ঋজুদা গাড়ি থামাতে বলে নিজে নামল। নেমে টেডিকে বকল। ওরকম করে রেখেছে বলে। তারপর আমিও নেমে ঋজুদা ও টেডির সঙ্গে হাত লাগিয়ে, সব ঠিকঠাক করে রেখে আবার বেঁধে-ছেঁদে নিলাম। ভুষুণ্ডা ম্যাপ দেখছিল। নামল না।

ঋজুদার কথামতো কম্পাসের কাঁটা দেখে চালিয়ে মাইল দশেক আসার পর যেন একটা পায়ে-চলা পথের মতো দেখা গেল ঘাসের মধ্যে মধ্যে। সবসময় যে ব্যবহার করা হয় এমন নয়। তবে ঘাসের চেহারা, রঙ আর আশেপাশের চিহ্ন দেখে মনে হয় এইখান দিয়ে মাঝে-মাঝে মানুষ পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করে।

ঋজুদা বলল, ঐ পথের চিহ্নকে দুচাকার মধ্যে রেখে গাড়ি চালাতে।

সেই মতোই চালাতে লাগলাম।

একটু আগে একদল বুনো কুকুরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারা প্রথমে গাড়ির দিকে দৌড়ে এসেছিল। পরে, কী ভেবে আবার ফিরে গেল। আফ্রিকার জঙ্গলে এমন হিংস্র জানোয়ার আর নেই। আমাদের দেশেও নেই।

আজ অন্য কোনো জানোয়ারই দেখলাম না মারিয়াবো থেকে রওনা হবার পর। বুনো কুকুর যে অঞ্চলে থাকে সেখান থেকে অন্য সব জানোয়ার পালিয়ে যায় শুনেছিলাম। মনে হল, সেই কারণেই বোধহয় কোনো জানোয়ারের টিকি দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ বুঁউউউ আওয়াজ করে একটা সেৎসী মাছি উড়ে এল জানালার ফাঁক দিয়ে। ভুষুণ্ডা সেৎসীকে দারুণ ভয় পায়। ভয় টেডিও পায় তবে ভুষুণ্ডার মতো নয়।

ওরা দুজনেই দাঁড়িয়ে উঠে মাছিটাকে যার যার টুপি দিয়ে ধরার এবং মারার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারল না। মাছিটা ঠক করে এসে উইন্ডস্ক্রীনে পড়ে, ডানা দুটো নাড়তে লাগল। সেৎসী মাছি যে কী জোরে ডানা নাড়ে এবং একটা ডানার উপর দিয়ে অন্য ডানাটা কীভাবে ঘুরোয় তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

ঋজুদা গোর্খা টুপি দিয়ে এক বাড়ি মারতেই মাছিটা নীচে পড়ল।

আমি বললাম, এবারে তোমরা শান্ত হয়ে বোসো। সেৎসী মরেছে।

মরেছে? সেৎসী, অত সহজে?

বলেই, টেডি হেসে উঠল। বলল, সেৎসী মাছির দশটা জীবন। একটা নয়। বলেই, আমার আর ঋজুদার মধ্য দিয়ে ঝুঁকে আমাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকা মাছিটাকে তুলে নিয়ে তার ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করল টেনে। তারপর বলল, এইবার বলা চলে যে, বাবু মরেছেন। এর এক সেকেন্ড আগেও বলা যেত না যে মরেছেন। এঁরা সহজ জিনিস নন।

ঋজুদা আর আমি হাসলাম। মুণ্ড-ছেঁড়া সেৎসী-হাতে টেডির বক্তৃতা শুনে।

 ঋজুদা বলল, আজ রাত থেকে কিন্তু আমরা খুবই বিপজ্জনক এলাকাতে থাকব। এখানে ওয়াণ্ডারাবো শিকারীরা থাকে। সামনে একটা ছোট্ট লেক আছে। ম্যাপে এই লেকের হদিস নেই। খুব ছোট্ট সোডা লেক। তার চারপাশে লেরাই জঙ্গল। ওয়াণ্ডারাবো শিকারীরা ঐ জঙ্গলের গভীরে লুকিয়ে থাকে এবং শিকার করে। প্রতি শীতে ওরা হাতি গণ্ডার এবং অন্যান্য জানোয়ার মারতে আসে। নাইরোবি সর্দার ওদের কথা বলেছে আমাকে।

আমি বললাম, ওয়াণ্ডারাবো কী দিয়ে হাতি মারে? হেভি রাইফেল্স ওরা পায় কোথায়?

ঋজুদা বলল, রাইফেল দিয়ে তো মারে না, মারে ছোট্ট-ছোট্ট বিষ-মাখানো তীর দিয়ে।

ঐ বিষ কোথায় পায় ওরা?

ঋজুদা বলল, তুই কখনও জলপাই গাছ দেখেছিস?

আমি বললাম, হ্যাঁ আমার মামা বাড়ির বাগানেই তো ছিল।

জঙ্গলের মধ্যে জলপাইয়ের মতো একরকমের গাছ হয়। এই জাতের সব গাছই যে বিষাক্ত হয় এমন নয়। কিছু কিছু গাছের এই বিষ থাকে। গাছগুলোকে দেখতে শুকিয়ে-যাওয়া জলপাই গাছের মতো। এদের বটানিকাল নাম অ্যাপোকানথেরা ফ্রিস্টিওরাম। জংলি ওয়াণ্ডারাবোরা ঐ গাছের নীচে পিঁপড়ে, কি ইঁদুর না কাঠবেড়ালিকে মরে পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারে যে, বিষ আছে। তারপর সেই গাছের ডাল আর শেকড়গুলো সেদ্ধ করে ক্বাথ বানিয়ে, ঘন করে তাই বিক্রি করে দেয় ওরা চোরাশিকারীদের কাছে। এই গাছে লাল গোল-গোল ফল হয়। তা দিয়ে খুব ভাল জ্যামও তৈরি হয়। জানিস? জ্যাম তো তোর প্রিয়।

হঠাৎ ঋজুদা চেঁচিয়ে উঠল, সাবধান, সাবধান।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, একটা বিরাট দুখড়্গ গণ্ডার জোরে ছুটে আসছে, ডান দিক থেকে আমাদের গাড়ি লক্ষ করে। গাড়ির পেছনে ট্রেলার থাকায় খুব একটা জোরে গাড়ি চালানো যায় না। গণ্ডারের হাত থেকে বাঁচার মতো জোরে তো নয়ই। গণ্ডারটার কী হল, কে জানে। কোথা থেকে যে হঠাৎ উদয় হল তাও আশ্চর্য! ঘাসের মধ্যে কি শুয়ে ছিল?

ঋজুদাকে রীতিমত চিন্তিত দেখাল। আবার বলল, সাবধান রুদ্র, খুব সাবধান।

 গণ্ডারটার তখনও পাঁচশো গজ দূরে ছিল।

ঋজুদ তাড়াতাড়ি নেমে রাইফেলটা তুলে, ভয় দেখাবার জন্যেই চার-পা-তুলে-ছুটে আসা গণ্ডারটার পায়ের সামনে মাটিতে একটা গুলি করল। ধুলোঘাস সব ছিটকে উঠল, কিন্তু গণ্ডার ভয় পেল না।

ঋজুদা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বলল, গাড়ির মুখটা ওর দিকে ঘোরা তো। শিগগির।

আমি স্টীয়ারিং ঘুরিয়ে, খুব জোরে এঞ্জিনকে রেস্ করালাম আর যত জোরে পারি ডাবল-হর্ন একসঙ্গে বাজিয়ে দিয়ে ওর দিকেই এগিয়ে চললাম। এত দিনের মধ্যে এই প্রথম হর্ন বাজালাম গাড়ির। গণ্ডারটা তো জোরে দৌড়ে আসছিলই, আমিও ঐ দিকে জোরে গাড়ি চালিয়ে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটা আর গণ্ডারটা একেবারে মুখোমুখি এসে গেল। উইন্ডস্ক্রীন তুলে, তার ফাঁক দিয়ে রাইফেল বের করে ঋজুদা তৈরি হয়ে ছিল। নিজেদের বাঁচাতে হলেই একান্ত গুলি করবে, নইলে নয়।

আমিও যেমন ধুলো উড়িয়ে হঠাৎ ব্রেক করে গাড়িটাকে দাঁড় করালাম, গণ্ডারটাও তার গাদাগোব্দা খুরের পায়ের ব্রেক কষিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। কান দুটো খাড়া, নাকের উপর পর-পর দুটো খড়্গ, গায়ের চামড়া দেখে মনে হয় যেন কোনো স্থপতি কালচে-লালচে পাথর খোদাই করে থাকে-থাকে তৈরি করেছেন তাকে। তার চোখ দুটো তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। আগে হর্ন বাজিয়েছিলাম, এঞ্জিন রেস করেছিলাম, এখন শুধু অ্যাকসিলারেটরে পা ছুঁইয়ে এঞ্জিন স্টার্টে রাখলাম।

ঋজুদা রাইফেলের ফ্রন্টসাইটের মধ্যে চোখ লাগিয়ে রাইফেলটা ধরে আছে গণ্ডারটার কপাল তাক করে। সকলে চুপ, স্তব্ধ; কী হয় কী হয় ভাব।

ঠিক সেই সময় টেডি হঠাৎ বলে উঠল, একটু নস্যি দিয়ে দেব ওর নাকে? নস্যি নাকে গেলেই সঙ্গে-সঙ্গে পালাবে ব্যাটা। বলেই বাঁ হাতের তেলোতে তার চ্যাপ্টা কৌটো থেকে নস্যি ঢেলে, আমার আর ঋজুদার মধ্যের ফাঁক দিয়ে গলে উইণ্ডস্ক্রীনের মধ্যে দিয়ে, শরীরের অর্ধেকটা সড়াত করে বের করে গণ্ডারের নাক লক্ষ করে হাতের তেলোতে ফুঁ দিতে গেল।

কিন্তু ওর কোমরের বেল্ট ধরে, এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঋজুদা বলল, টেডি!

টেডি টানের চোটে পিছিয়ে এল।

 ঋজুদা গম্ভীর গলায় বলল, ঐ দ্যাখো।

বলতেই, গণ্ডারটা আস্তে-আস্তে ঘুরে আমাদের দিকে পিছন ফিরল। পিছন ফিরতেই দেখি লেজটা তুলে আছে গণ্ডারটা, আর তার ঠিক লেজের নীচে একটা এক-ফুটের মতো লম্বা তীর গাঁথা।

গণ্ডারটা আমাদের সকলের চোখের সামনে কয়েক পা হেঁটে গেল উল্টোদিকে। তারপর কয়েক পা হেঁটে গিয়েই ধপ করে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে।

আমরা গাড়ি ছেড়ে সকলেই নামলাম। টেডি নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, ওয়াণ্ডারাবো। ওয়াণ্ডারাবো।

অতবড় একটা জানোয়ার, কত তার গায়ে জোর, তাকে ওয়াণ্ডারাবো শিকারী তার শরীরের সবচেয়ে নরম জায়গাতে বিষতীর মেরে ঘায়েল করেছে।

টেডি গিয়ে গণ্ডারটার সামনে দাঁড়াতেই, সে একবার ওঠবার শেষ চেষ্টা করল। কিন্তু তারপরই শেষবারের মতো শুয়ে পড়ল ধুলো উড়িয়ে।

গণ্ডারটার ওজন আমাদের ল্যাণ্ড-রোভারটার চেয়েও বেশি হবে। তার খড়্গ কেটে বিক্রি করলে, সেই খড়্গ গুঁড়ো করে কারা কোন্ ওষুধ বানাবে–তাই তাকে মরতে হল এক-আকাশ রোদ আর হাওয়ার মধ্যে।

তারপর অনেকক্ষণ আমরা সকলে চুপ করে থাকলাম। হয়তো না-জেনেই, মরে-যাওয়া গণ্ডারটাকে সম্মান জানাবার জন্যে।

টেডি বলল, ওয়াণ্ডারাবোরা কাছেই আছে। এই তীর বেশিক্ষণ আগে ছোঁড়েনি। বলেই, উঠে গিয়ে গণ্ডারটার চারপাশে ঘুরে ভাল করে বুঝে নিয়ে বাঁ হাতে গণ্ডারের লেজটা তুলে, ডান হাত দিয়ে একটানে তীরটা বের করে নিয়ে এল।

ঋজুদা সেটাকে ভাল করে পরীক্ষা করে একটা টেস্ট-টিউবে তীরের গায়ে লাগা বিষমাখা রক্ত রেখে, টিউবটাকে তুলোয় জড়িয়ে একটা বাক্সে রাখল সেটাকে।

গণ্ডারটা ওখানেই পড়ে রইল। ওয়াণ্ডারাবো শিকারীরা ওকে খুঁজে পাবে হয়তো। না-পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া, খুঁজে পেলেও তারা গাড়ির চাকার দাগ দেখে ভয় পেয়ে এদিকে হয়তো না-ও আসতে পারে। ওরা না এলে, শকুনরা আসবে। প্রথমে চোখ দুটো ঠুকরে খাবে। তারপর রোদে, হাওয়ায় গণ্ডারের ঐ শক্ত চামড়াও গলে যাবে একদিন। দিনে রাতে শকুনের, শেয়ালের আর হায়নার ভোজ হবে এখানে।

আমাদের সকলেরই মন খারাপ হয়ে গেল ভীষণ। ভুষুণ্ডা বলল, এখানেই কাছাকাছি আমরা আজ ক্যাম্প করে থাকলে ওয়াণ্ডারাবোদের সঙ্গে দেখা হতে পারে। গণ্ডার যখন মেরেইছে, তখন তার খড়্গ না-কেটে তারা ফিরে যাবে না নিশ্চয়ই। তারা পায়ের দাগ দেখে-দেখে এখানে এসে পৌঁছবেই।

ঋজুদা কী একটু ভাবল। তারপর বলল, নাঃ থাক। আমরা এগিয়ে যাব।

টেডি এক-নাক নস্যি নিল গণ্ডারটার পিঠের উপর থেবড়ে বসে।

ঋজুদা পাইপ ধরিয়ে বলল, রুদ্র, ওই রাইফেলটা গণ্ডারের গায়ে শুইয়ে রেখে পোজ দিয়ে দাঁড়া, আমি একটা ছবি তুলি তোর। ছবির নীচে লিখে দেব : মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। কী বলিস?

আমি বললাম, মোটেই না।

ঋজুদা বলল, এখনও ভেবে দ্যাখ, একটা দারুণ চান্স ছিল কিন্তু কলকাতায় ফিরে বন্ধুদের গুল মারবার। ছবি থাকলে তো আর তাদের বিশ্বাস না-করে উপায় নেই?

আমি বললাম, ছবি তুলে দাও, তবে খালি হাতে। এই বেচারি গণ্ডারটার একটা ছবি থাকুক আমার কাছে।

ভুষুণ্ডা সিগারেটে টান লাগিয়ে ঋজুদাকে বলল, এইখানেই ক্যাম্প করার কথাটা আরেকবার ভেবে দেখলে পারতেন।

ঋজুদা বলল, দেখেছি ভেবে। চলো, এগিয়েই যাই।

ভুষুণ্ডা গররাজি গলায় বলল, আপনি যা বলবেন।

গণ্ডারটাকে ওখানে ফেলে রেখেই আবার রওনা হলাম।

গাড়ি চালাতে চালাতে আমি ভেবেছিলাম, অজানা কোনো কারণে আর ভুষুণ্ডার মধ্যে কেমন যেন বনিবনার অভাব হচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগছে না আমার।

ঘন্টা-দেড়েক গাড়ি চালাবার পর দূরে লেরাই জঙ্গলের আভাস ফুটে উঠল। এদিকে সেৎসী মাছি বেশি। কিন্তু লেরাই জঙ্গল দেখতে খুব ভাল। এই অ্যাকাসিয়া গাছগুলোর গা আর ডালপালা একটা মিষ্টি হলদে-সবুজ রঙের হয়। মনে হয়, শ্যাওলা পড়েছে। কিন্তু তা নয়, গাছের রঙই ও-রকম। সোয়াহিলিতে বড় বড় হাত-ছড়ানো অ্যাকাসিয়া গাছগুলোকে বলে মিগুংগা। আর হলুদ মিগুংগা হলে বলে লেরাই। লেরাই-জঙ্গল জলের কাছাকাছি হয়। তাই যেখানেই লেরাই-জঙ্গল থাকে, তার আশেপাশে অন্যান্য নানারকম জঙ্গলও থাকে। জন্তু-জানোয়ারের ভিড়ও থাকে। অ্যাকাসিয়া অনেক রকমের হয়। ঋজুদা বলছিল। ছাতার মতো অ্যাকাসিয়াগুলোকে বলে আমব্রেলা অ্যাকাসিয়া। তাছাড়া আছে অ্যাকাসিয়া টরটিলিস। গাম্মিফ্লোরা। অ্যাকাসিয়া আবিসিনিকা। অ্যালবিজিয়া বলে একরকমের গাছ আছে, পাঁচদিন আগে দেখেছিলাম, সেগুলোর পাতাগুলোই কাঁটার মতো। ওয়েট-আ-বিট থর্ন নামেও একরকমের কাঁটাগাছ হয় এখানে।

দুপুরের খাওয়ার জন্যে কোথাও থামিনি আমরা।

বিকেল চারটে নাগাদ লেরাই-জঙ্গলের কোলে পৌঁছে গেলাম। ঋজুদা গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে দূরের লেকটাকে দেখল। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম সেদিকে। এ-রকম কোনো কিছুই দেখিনি এর আগে। লেকটার আশপাশের ডাঙা অদ্ভুত নীলচে ও ছাই-রঙা। জল নেই বেশি, কিন্তু জল যেখানে আছে সেইদিকেও তাকানো যায় না, জলের ঠিক কাছাকাছি এমন উজ্জ্বল চকচকে কাচের মতো কোনো জিনিসের আস্তরণ পড়ে রয়েছে যে চোখ চাওয়া যায় না। চোখে ধাঁধা লাগে। মনে হয়, বরফ পড়েছে বুঝি।

তাঁবু খাঁটিয়ে টেডি রান্নার বন্দোবস্ত করতে লাগল। আমি আর ঋজুদা জায়গাটা ভাল করে দেখার জন্যে বেরোলাম।

ঋজুদা বলল, রাইফেলটা সঙ্গে নিয়ে নে।

ভুষুণ্ডা বলল, আমি কি সঙ্গে যাব?

ঋজুদা বলল, না! তুমি তার চেয়ে বরং টেডির কাছেই থাকো। বন্দুক রেখো হাতের কাছে।

তাঁবু থেকে এখন আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি।

হঠাৎ সামনে পথের বাঁকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে চমৎকার কারুকাজ করা শিংওয়ালা খয়েরি-রঙা একদল হরিণ দেখলাম। এই হরিণ কখনও দেখিনি আফ্রিকাতে আসার পর। দিনের শেষ রোদ পশ্চিম থেকে গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে এসে পড়েছে হরিণগুলোর গায়ে। কী চমৎকার যে দেখাচ্ছে!

আমাদের দেখতে পেয়েই হরিণগুলোর চমক ভাঙল। ছত্রভঙ্গ হয়ে ওরা লাফাতে-লাফাতে চলে গেল পুবের অন্ধকারে। ওরা যখন তাড়াতাড়ি দৌড়ে যাচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, ওরা যেন উড়ে যাচ্ছে।

ঋজুদা বলল, এদের নাম ইম্পালা।

 এই ইম্পালা! কত পড়েছি এদের কথা!

গতকাল রাতে যে ছোট জানোয়ারটা উড়ে-লাফিয়ে চলছিল, যার চোখ জ্বলেনি সামনে থেকে, কিন্তু পাশ থেকে একটা চোখ টর্চের আলোয় জ্বলেছিল, সেই জানোয়ারটা কী জানোয়ার তা ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলাম।

ভাল করে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ঋজুদা তার বিবরণ জানল আমার কাছ থেকে। তারপর হেসে বলল, বুঝেছি, বুঝেছি। ওগুলো হচ্ছে লাফানো-খরগোশ। আসলে কিন্তু ওড়ে না, এমন করে লাফায়, যেমন এই ইম্পালারাও লাফায়, যেন মনে হয় উড়েই যাচ্ছে। আমাদের দেশে ফ্লাইং-স্কুইরেল আছে, কিন্তু সে-কাঠবিড়ালি সত্যিই ওড়ে। লাফানি-খরগোশ শুধু লাফায়ই। আর ঐ আরেকটা মজা। ওদের চোখে এমন কোনো ব্যাপার আছে যে, সামনে থেকে অন্ধকারে আলো ফেললে একটা চোখও জ্বলে না। অথচ পাশ থেকে ফেলে সেই পাশের চোখটা জ্বলে ওঠে। এইরকম খরগোশ শুধু এখানেই দেখা যায়।

আমরা যখন হাঁটছিলাম, তখন এদিক-ওদিকে মাটিতে, ভাল করে নজর করে যাচ্ছিলাম। শুধু জংলি জানোয়ার নয়, তাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হিংস্র ওয়াণ্ডারাবো শিকারীরা এ জঙ্গলে আছে। আড়াল থেকে একটি বিষ-মাখানো তীর ছুঁড়ে দেবে, ব্যস্-স টলে পড়ে যেতে হবে। গণ্ডারটার প্রচণ্ড প্রাণশক্তি, তাই বেঁচে ছিল অনেকক্ষণ। মানুষদের মারলে সঙ্গে সঙ্গেই শেষ।

একটা ঝাঁকড়া ওয়েট-আ-বিট থর্ন গাছের নীচে ছোট্ট একটি বাদামি হরিণছানা দাঁড়িয়ে ছিল। ঋজুদা দেখতে পায়নি। আমি ঋজুদার হাতে হাত দিয়ে ঐদিকে দেখালাম। ফিসফিস করে বললাম, দ্যাখো দ্যাখো, কী সুন্দর হরিণছানাটা।  

ঋজুদা ভাল করে দেখে বলল, এটা হরিণছানা নয় রে, এ এক জাতের হরিণ। ওরা বড় হয়েও ঐটুকুই থাকে। ওড়িশা জঙ্গলে কতবার তো মাউস-ডিয়ার দেখেছিস। এগুলো ঐরকমই। এদের নাম ডিক-ডিক্। এই জাতের হরিণ কেবল আফ্রিকাতেই পাওয়া যায়।

মনে-মনে উচ্চারণ করলাম দুবার। ডিক-ডিক। কী সুন্দর নামটা।

আলো পড়ে আসছিল। ঋজুদা বলল, এখন আর দেরি না করাই ভাল। তাঁবু থেকে মাইলখানেক চলে এসেছি। চল, এখন ফিরে যাই। কাল আমরা চান করব লেকে এসে, কী বল?

আমি বললাম, দারুণ হবে। শেষ চান করেছিলাম সেরোনারাতে। কত্ত দিন আগে।

আমরা ফেরবার সময় অন্য রাস্তায় এলাম। এ-রাস্তাটাও লোকের পাশ দিয়েই গেছে, তবে আমরা আরো গভীরে গভীরে। সামনেই একটা বাঁক। বাঁকের মুখটাতে আসতেই আমার মনে হল একটা লোক যেন পথ থেকে জঙ্গলে সরে গেল। ঋজুদা পশ্চিমে তাকিয়ে দারুণ আফ্রিকান সূর্যাস্ত দেখছিল, অ্যাকাসিয়া গাছের পটভূমিতে লাল হওয়া আকাশে।

হঠাৎ ঋজুদা মুখ ঘুরিয়ে বলল, কোনো মানুষ জঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। তুই শব্দ পাচ্ছিস?

আমি কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলাম না।

ঋজুদা রাইফেলটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে নিল।

যেখান থেকে লোকটাকে সরে যেতে দেখেছিলাম, সেইখানে এসে পৌঁছতেই নরম মাটিতে তার পায়ের দাগ দেখা গেল। প্রকাণ্ড দুটি পায়ের ছাপ। ছাপের গভীরতা দেখে মনে হচ্ছে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পথের বাঁ দিকে কোনো জিনিসকে লক্ষ করছিল।

বাঁ দিকে মুখ তুলতে যাচ্ছিলাম। ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, লোকটা যেদিকে গেছে সেইদিকে তুই রাইফেল তুলে রেডি হয়ে খুব সাবধানে দ্যাখ। কিছু দেখতে পেলেই আমাকে বলিস।

আমি ঐদিকটা দেখছি।

একটু পর ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, দ্যাখ রুদ্র, এদিকে দ্যাখ।

ঋজুদার কথামতো ঐদিকে তাকিয়ে দেখলাম, পথ থেকে হাতদশেক উপরে একটা মিগুংগা গাছের দুটো ডালের মাঝখানে রক্তাক্ত ইম্পালা হরিণের আধখানা শরীর ঝুলছে। আর সেই গাছের উপরেই, অন্য দুটি ডাল যেখানে মিলেছে সেইখানে পথের দিকে পিছন ফিরে বসে একটি প্রকাণ্ড চিতাবাঘ, তার মুখে সেই হরিণের মাংস। চিতাটার পিঠে একটা তীর গেঁথে আছে।

আমরা আর-একটু এগিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখলাম। চিতাটা ততক্ষণে মরে গেছে। কিন্তু মরে গেলেও গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে না। এমনভাবে দুটি ডালের মাঝখানে তার শরীর আটকে আছে যে, পড়ে যাবেও না।

আমি বললাম, লোকটা যদি আমাদের দেখে থাকে?

 ঋজুদা বলল, তুই তো দেখেছিস এক ঝলক। কেমন দেখতে বল তো?

আমি বললাম, দারুণ লম্বা, সবুজ আর লাল ছোপছোপ কাঙ্গার মতো লুঙ্গি পরা, গায়ে সবুজ চাদর, হাতে তীর-ধনুক।

ঋজুদা উত্তেজিত হয়ে গেছিল, বলল, তোকে দেখেছিল?

বললাম, মনে হয় না। ও বোধহয় এমনিতেই দৌড়ে চলে যাচ্ছিল।

ঋজুদা বলল, ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আয়। আর কথাবার্তা বলিস না।

আমরা যখন তাঁবুর কাছে এলাম তখন অন্ধকার প্রায় নেমে এসেছে। তার সঙ্গে শীতটাও। টেডি খুব বড় করে আগুন জ্বেলেছে। এখানে শুকনো কাঠকুটোর অভাব নেই কোনো। আগুনের আভায় চারদিক লাল হয়ে উঠেছে।

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন টেডির কফি তৈরি। বিস্কুট আর কফি দিল ও আমাদের। রান্নাও চড়িয়ে দিয়েছে। আজও উগালি।

ভুষুণ্ডাকে কিন্তু দেখা গেল না কোথাও। ঋজুদা জিজ্ঞেস করাতে টেডি বলল, সে তো আপনাদের পিছনে-পিছনে গেল। কেন, দেখা হয়নি?

কিছুক্ষণ পর একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেল। এবং তারও কিছুক্ষণ পর দুটি বড় বড় ফেজেন্ট হাতে ঝুলিয়ে এল ভুষুণ্ডা। এসে বলল, ওয়াইল্ডবীস্ট আর গ্রান্টস গ্যাজেল খেয়ে খেয়ে মুখে অরুচি ধরে গেছিল। তাই আনলাম। এক্ষুনি ছাড়িয়ে দিচ্ছি, রোস্ট করবে টেডি।

ঋজুদা বলল, ভুষুণ্ডা, তুমি ভালভাবেই জানো যে, এখানে চোরা শিকারীরা আছে, তবুও তুমি গুলি করলে কেন আমাকে জিজ্ঞেস না করে? এটা কি শিকার করার সময়, না জায়গা? গুলির শব্দ শুনলেই তো ওরা সব সরে যাবে, সাবধান হয়ে যাবে। তাতে তো আমাদেরই বিপদ। একথা কি তোমাকে শেখাতে হবে? তুমি এসব জানো না তা তো নয়।

ভুষুণ্ডা লজ্জিত হয়ে বলল, সরি। আমি অতটা ভাবিনি। আপনাদের খাওয়ার যাতে কষ্ট না হয় সেই ভেবেই মেরেছিলাম।

ঋজুদা বলল, আফ্রিকার বন-বাদাড়ে এত কষ্ট করে আমরা খাওয়ার সুখ করতে আসিনি। আমাদের দেশে আমরা ভাল-মন্দ খেতে পাই। সেরোনারাতে, গোরোংগোরোতে অথবা ডার-এস-সালাম বা আরুশাতে গেলেও খেতে পাব। ভবিষ্যতে তুমি এসব কোরো না। তাছাড়া তুমি আমাদের সঙ্গে এসেছ বিশেষ কারণে। আমাদের খাওয়ার কষ্ট নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে।

তারপরই কথা ঘুরিয়ে ঋজুদা বলল, এসো তো দেখি, এই জঙ্গলের আর লেকের একটা ম্যাপ বানিয়ে ফেলি দুজনে আগুনের পাশে বসে।

ভুষুণ্ডা ছুরি হাতে করে উবু হয়ে বসে ফেজেন্ট দুটোর পালক ছাড়াতে-ছাড়াতে বলল, কী হবে ম্যাপ দিয়ে? এই জঙ্গল আমার মুখস্থ। কাল আমি চোরাশিকারীদের ডেরায় নিয়ে যাব আপনাদের। একেবারে হাতে-নাতে ধরিয়ে দেব। তাহলেই তো হল। তবে খুব সাবধানে যাবেন। তীর মারতে ওদের সময় লাগে না।

ঋজুদা একাই ম্যাপ বানাতে বসে গেল, কফি খেতে খেতে।

তারপর ভুষুণ্ডার দিকে চেয়ে বলল, ওয়াণ্ডারাবোদের ভয় আমাকে দেখিও না। কোনো-কিছুর ভয়ই দেখিও না।

ভুষুণ্ডা যেন একটু অবাক হল। তারপর ঋজুদাকে বলল, আপনার সাহস সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নেই কোনো। আপনার মতো সাহসী লোক কমই আছে।

ঋজুদা চুপ করে গেল।

 ভুষুণ্ডার কথাটাতে, মনে হল, একটু ঠাট্টা মেশানো ছিল।

কফিটা শেষ করেই ঋজুদা বলল, কাল পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকব।

ভুষুণ্ডা মুখ না-ঘুরিয়েই বলল, তাইই হবে। কাল ওয়াণ্ডারাবোদের সঙ্গে মোলাকাত হবে আপনার।

ঋজুদা বলল, ক্যাম্পে থাকবে টেডি। লাঞ্চ বানিয়ে রাখবে সকলের জন্যে।

টেডি বলল, সে কী? আমিও সঙ্গে যাব। আমিও যাব।

ঋজুদা মুখ নিচু করে কম্পাস আর কাগজ-পেনসিল নিয়ে কাজ করতে করতে বলল, আমি যেমন বলেছি, তেমনই করবে। আমার কথা অমান্য করবে না কেউ। বুঝেছ?

টেডি মুখ নিচু করে বলল, বুঝেছি।

 ভুষুণ্ডা টেডির দিকে মুখটা একটু ফেরাল। আগুনের আভায় মনে হল, ভুষুণ্ডার মুখে এক অদ্ভুত হাসি লেগে আছে।

আমার, কেন জানি না, বড়ই অস্বস্তি লাগছে। কিছু একটা ঘটবে।

.

কিছুতেই ঘুম আসছিল না।

তীর-খাওয়া গণ্ডারটা আর বড় চিতাবাঘটার কথা বারবার মনে পড়ছিল আমার। আমার গায়ে তীর লাগলে কী হবে তাই-ই ভাবছিলাম। মানুষদের তীর মারলে কোথায় মারে ওয়াণ্ডারাবোরা? যে-কোনো জায়গাতে মারলেই হল। রক্তের সঙ্গে তীরের ফলার যোগাযোগ ঘটলেই কাজ শেষ। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হবে। ওদের তীরগুলো কিন্তু ছোট। ছ ইঞ্চি থেকে এক ফুট।

একবার মনে হল, কেন যে বাহাদুরি করতে এলাম এই আফ্রিকাতে! না এলেই ভাল হত!

টেডি আজ আগুনের পাশে বসে ফেজেন্টের রোস্ট বানাতে বানাতে পিগমিদের গল্প বলছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট মানুষ ওরা। গভীর জঙ্গলে পাতার কুঁড়েতে থাকে। আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকার জঙ্গলে পিগমিদের সঙ্গে টেডি ছিল অনেকদিন এক জার্মান সাহেবের সঙ্গে শিকারে গিয়ে। পিগমিদের সবচেয়ে বড় দেবতা খনভাম-এর কথা বলছিল ও।

তাঁবুর বাইরে লেকের দিক থেকে ও জঙ্গলের গভীর থেকে নানা অচেনা জন্তু-জানোয়ার এবং রাতচরা পাখিদের ডাক ভেসে আসছিল। তারা আমার অচেনা বলেই ভয় করছিল। আমাদের দেশে হলে এইরকম ভয় করত না। কাছেই লেক আছে বলে এখানে ঠাণ্ডাও অনেক বেশি। কম্বলটা ভাল করে গুঁজে নিলাম পিঠের নীচে।

টেডি বলছিল প্রতিদিন যখন সূর্য মরে যায়, তখন খনভাম একটা বিরাট থলের মধ্যে তারাদের টুকরো-টাকরাগুলো সব ভরে নেন, তারপর সেই তারাদের টুকরোগুলো নিভে যাওয়া সূর্যের মধ্যে ছুঁড়ে দেন, যাতে সূর্য পরদিন ভোরে আবার জ্বলে ওঠে তার নিজের সমস্ত স্বাভাবিক উত্তাপের সঙ্গে।

খনভাম আসলে একজন শিকারী। শিকারী পরিচয়টাই তাঁর আসল পরিচয়। বিরাট-দুটো সাপকে বেঁধে তাঁর ধনুক তৈরি করেছিলেন তিনি। বৃষ্টি-শেষে যখন আকাশে রামধনু দেখি আমরা আসলে সেটা রামধনু নয়, খনভামের ধনুক। পৃথিবীর মানুষদের কাছে খনভাম কোনো ছোট জানোয়ারের রূপ ধরে দেখা দেন, নয়তো হাতি হয়ে। আকাশে যে বাজের শব্দ শুনি আমরা, সেটাও বাজ নয়। খনভাম কথা বললে ঐরকম আওয়াজ হয়। খনভামের গলার স্বরই বাজপড়ার শব্দ।

দারুণ লাগছিল আমার। কিন্তু আগুনের পাশে বসে টেডির গল্প শুনতে-শুনতে আমার গা-ছমছমও করছিল। কঙ্গো উপত্যকার অন্ধকার গভীর জঙ্গল, যেখানে গোরিলারা থাকে, খনভামও থাকেন, সেখানেই যেন চলে গেছিলাম।

খনভামের চেলা আছেন অনেক। তাঁরা সব নানা দৈত্যদানো। সন্ধের পর পিগমিদের পাতার কুঁড়ের সামনে আগুন জ্বালিয়ে বসে আজকের রাতের মতোই এইসব দৈত্য-দানোর গল্প করত পিগমিদের সঙ্গে টেডি, তার সাহেবের জন্যে রান্না করতে করতে। এখন যেমন আমাদের জন্যে করছে।

একরকমের দানো আছেন, তাঁর নাম গুগুনোগুম্বার। তিনি কেবল আস্ত-আস্ত গিলে খান ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের। আরেকজন বামন-দানো আছেন, তাঁর নাম ওগরিগাওয়া বিবিকাওয়া। তিনি সাপের বা অন্য কোনো সরীসৃপের মূর্তি ধরে দেখা দেন।

তাঁবুর মধ্যে ক্যাম্পখাটে শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবছি। বাইরে আগুনটা পুটপাট করে জ্বলছে। একরকমের পোকা উড়ছে অন্ধকারে আশ্চর্য একটানা মৃদু ঝরঝর শব্দ করে। মনে হচ্ছে, যেন দূরে ঝর্না বইছে কোনো। আকাশে একটু চাঁদ উঠেছে। ফিকে চাঁদের আলো তাঁবুর দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে এসে পড়েছে। দরজাটা দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে। ঋজুদা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমার চোখে ঘুম নেই। টেডি একা শুয়েছে অন্য তাঁবুতে। ভুষুণ্ডা গাড়ির কাচটাচ বন্ধ করে। যেমন রোজ শোয়।

হঠাৎ খুবই কাছ থেকে একটা সিংহ ডেকে উঠল দড়াম করে। তারপরই শুরু হল সাংঘাতিক কাণ্ড। চারদিক থেকে প্রায় গোটা আটেক সিংহ তাঁবু দুটোকে ঘিরে প্রচণ্ড হুমহাম শুরু করে দিল। ট্রেলারের উপরে ত্রিপল-ঢাকা গ্রান্টস গ্যাজেল আর ওয়াইল্ডবীস্ট-এর স্মোক করা মাংস ছিল। সেগুলোর গন্ধ পেয়ে ওরা ট্রেলারের উপর চড়ে বসল। ওদের থাবাতে চচ্চড় শব্দ করে ট্রেলারের উপরের ত্রিপল ছিঁড়ে গেল শুনতে পেলাম। চতুর্দিকে সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রচণ্ড গর্জন করতে-করতে, আমাদের আর তাদের মধ্যে তাঁবুর পাতলা পর্দা শুধু। বেচারি টেডি কি বেঁচে আছে? না সিংহরা তাকে খেয়েই ফেলল? কিন্তু টেডির কাছে তো বন্দুক আছে, সে গুলি করছে না কেন? চেঁচামেচিতে ঋজুদার ঘুম চটে গেল। সত্যি। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোয় ঋজুদা।

আমি ভাবলাম, ঋজুদা উঠে আমাকেও উঠিয়ে নিয়ে সিংহ মারবে এবং তাড়াবে। এবং এই ফাঁকে কম্বলের তলায় শুয়ে শুয়ে আমার জীবনের প্রথম সিংহ-শিকার হয়ে যাবে। কিন্তু ঋজুদা উঠে বোতল থেকে একটু জল খেল, তারপর আবার কম্বলের মধ্যে ঢুকতে-ঢুকতে বলল, ব্যাটারা বড় জ্বালাচ্ছে তো। বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

আমি হাঁ করে একবার ঋজুদার দিকে তাকিয়ে তারপর ক্যাম্পকটে সোজা হয়ে উঠে বসে, আবার হাঁ করে তাঁবুর ফাঁককরা দরজা দিয়ে সজাগ চোখে চেয়ে রইলাম।

একটা প্রকাণ্ড সিংহের মাথা তাঁবুর ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম। এ কী? সে যে তাঁবুর ভিতরে কী আছে তা ঠাহর করে দেখছে ভিতরে উঁকি মেরে। মানুষের গন্ধ পেয়েছে নিশ্চয়ই। তাড়াতাড়ি রাইফেল বাগিয়ে ধরে আমি সেইদিকেই চেয়ে রইলাম। কিন্তু সিংহটা সরছেই না। থাবা গেড়ে গ্যাঁট হয়ে বসে হেঁড়ে মাথাটা তাঁবুর দরজায় লাগিয়ে রেখে দেখছে আমাকে।

সেই চাউনি আর সহ্য করতে না পেরে আমি পাঁচ ব্যাটারির বড় টর্চটা জ্বেলে তার মুখে ফেললাম। আগুনের ভাঁটার মতো চোখ দুটো জ্বলতে লাগল আলো পড়ে। আর ঠিক সেই সময় মর, হতভাগা বলে, ঋজুদা তার এক পাটি চটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে সোজা সিংহটার নাক লক্ষ করে ছুঁড়ে দিল।

নাকের উপর সোজা গিয়ে লাগল চটিটা। আমার হৃৎপিণ্ডটা থেমে গেল। রাইফেল-ধরা হাত ঘেমে উঠল। কিন্তু সিংহরাজ ফোঁয়াও করে একটা ছোট্ট হঠাৎ-আওয়াজ করেই পরক্ষণেই ক্রমাগত হুঁয়াও হঁয়াও করে ডাকতে ডাকতে সরে গেল।

কতক্ষণ যে ওরা ছিল জানি না। শেষকালে সিংহের ডাকের মধ্যেই, মানে ডাক শুনতে শুনতেই, ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। আমার চারপাশে পাঁচ-দশ হাতের মধ্যে এক ডজন সিংহকে ঘুরে বেড়াতে দিয়ে আফ্রিকার নিবিড় জঙ্গলে যে কেউ তাঁবুর মধ্যে নির্বিকারে ঘুমোতে পারবে একথা আগে কল্পনাও করতে পারিনি। ধন্য ঋজুদা।

ঘুম ভাঙল শয়ে-শয়ে স্টার্লিং পাখিদের কিচিরমিচিরে। লেকের পশ্চিমদিক থেকে ফ্লেমিংগোদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ফ্লেমিংগো ছাড়া লেকে আর কোন পাখি ছিল না। কাল বিকেলেই লক্ষ করেছিলাম।

এই স্টার্লিং পাখিগুলো ভারী সুন্দর দেখতে। উজ্জ্বল নীল, গাঢ় কমলা আর সাদায় মেশা ছোট-ছোট মুঠি-ভরা পাখি। ওরা যেখানেই থাকে, সেখানটাই সরগরম করে রাখে। আমাদের দেশের ময়নার মতো ওরাও খুব নকলবাজ। অন্য যে-কোনো পাখির এবং মানুষের গলার স্বর হুবহু নকল করে ওরা। তাই আফ্রিকাতে অনেকেই বাড়িতে পোষেন এই সুন্দর পাখি।

টেডি বলল, গুটেন মর্গেন।

এদিকে জার্মানদের দাপট বেশি ছিল বলে এরা সকলেই ভাঙা-ভাঙা ইংরিজির মতো জার্মানও জানে। গুটেন মনে হচ্ছে জার্মান গুড মর্নিং।

আমি বললাম, গুটেন মর্গেন, তুমি বেঁচে আছো?

টেডি হেসে বলল, প্রায় মরে যাবারই অবস্থা হয়েছিল কাল সিম্বাদের জন্যে। রাইফেলধারীরা তো দিব্যি ঘুমোলে। আমার কাছে একটা শটগান। তা দিয়ে কটা সিম্বা মারব? আমার পুরো নস্যির কৌটোটা কাল শেষই হয়ে গেছে। হাতের তেলোতে নস্যি রেখে তাঁবুর দরজা-জানলা দিয়ে ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে সব নস্যিই শেষ। এখন কী যে করব জানি না।

ঋজুদা বলল, কোনো চিন্তা নেই। আমার পাইপের টোব্যাকো গুঁড়ো করে এই লেকের সোডা কৃস্টাল নিয়ে গুঁড়ো করে মিশিয়ে নাও, দারুণ নস্যি হয়ে যাবে। তুমি জানো তো, সবচেয়ে ভাল নস্যি বানাতে এইসব সোডা লেকের কদর কতখানি?

তারপরই আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা বেরোচ্ছি রুদ্র। এখন গল্প করার সময় নেই। ভুষুণ্ডা তৈরি হয়ে নাও।

ভুষুণ্ডা তার টুপির ব্যাণ্ডে কতগুলো নীলচে জংলি ফুল লাগাচ্ছিল। বলল, আমি তৈরিই আছি।

দেখতে-দেখতে টেডি আমাদের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিল। ক্রীমক্র্যাকার বিস্কুটের উপর কালকের ভুষুণ্ডার মারা ফেজেন্টের লিভার সাজিয়ে সঙ্গে নাইরোবি-সর্দারের-দেওয়া মারিয়াবো-পাহাড়ের ইয়া-ইয়া মোটা কলা। তারপর কফি।

ঘড়িতে তখন ঠিক আটটা বাজে। আমরা সারাদিনের মতো তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ডাইরি, নোট-বই, ক্যামেরা, টেলিফোটো লেন্স, রাইফেল, জলের বোতল, দূরবিন–এইসব চাপাল ঋজুদা আমার ঘাড়ে। নিজের ঘাড়েও অবশ্য কম জিনিস উঠল না। হেভি ফোর-ফিফটি ফোর হান্ড্রেড রাইফেলটা টেডির হেপাজতে রেখে দিল ঋজুদা। লাইট থার্টি ও সিক্স ম্যানলিকার শুনার রাইফেলটা পিঠের স্লিং-এ ঝুলিয়ে নিয়েছে। আমার হাতে দিয়েছে শটগান। ভুষুণ্ডাকে দিয়েছে খাওয়ার হ্যাভারস্যাক আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস।

আমরা রওনা হলাম। সিংগল ফর্মেশানে। টেডি হাত নেড়ে টা-টা করল।

যেতে যেতে ঋজুদাকে ঠাট্টা করে বললাম, প্রেজেন্ট-ট্রেজেন্টস নিয়েছ তো? দেবে না ওদের?

 ঋজুদা ঠাট্টা না করে বলল, ওদের সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয়ই দেব। প্রথম দেখা হবে, আর উপহার দেব না। এ কি একটা কথা হল?

আমি বললাম, তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু যাদের সঙ্গে প্রথম দেখা নয়, অনেক পুরনো দেখা, তাদের জন্যেও তো কিছু প্রেজেন্ট আনতে পারতে।

ঋজুদা বলল, তারা কারা?

বললাম, এই যেমন আমি!

 ঋজুদা গম্ভীর মুখে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দারুণ একটা চকোলেট দিল আমাকে।

আমি বললাম, এটা কী? পেলে কোথায়? এরকম তো কলকাতায় কখনও দেখিনি।

ঋজুদা বলল, দেখবার তো কথা নয়। এটা সুইটজারল্যান্ডে তৈরি। তোরই জন্যে ডার-এস-সালামে কিনেছিলাম। ছেলেমানুষ!

ঋজুদা!

ঋজুদা বলল, আহা! রাগ করিস কেন? পুরোটা না-হয় না-ই খেলি। অর্ধেকটা আমায় দে।

আমি চকোলেটটাকে তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজে রেখে, আর দু’ভাগ ঋজুদা আর ভুষুণ্ডাকে দিলাম। ঋজুদা নিজের ভাগটা একেবারেই মুখে পুরে দিল। কিন্তু ভুষুণ্ডা বলল, ও খাবে না। ফেরত দিল আমাকে।

অসভ্য! আমার খুব রাগ হল। আমিও মাসাই হলে ওর ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিতাম এতক্ষণে! বেঁচে গেল জোর।

আমরা তখনো একটু ফাঁকায়-ফাঁকায় চলেছি। ঋজুদাকে বললাম, তুমি তো উপহার নিয়ে যাচ্ছ ওদের জন্যে। নাইরোবি সর্দারকেও তো উপহার দিলে। ওয়াণ্ডারাবোরা যদি তোমাকে বিষের তীর উপহার দেয়?

ঋজুদা হাসল। বলল, আমরা গান্ধী-চৈতন্যের দেশের লোক। ওরা তীর মারলেও, আমরা ভালবাসবই।

আমি হেসে বললাম, তোমাকে কিছুই বিশ্বাস নেই। সারারাত ভয়ে আমার ঘুম হল না, চারদিকে সিংহরা হুড়ুম-দাড়ুম করে বেড়াল আর তারই মধ্যে তুমি কী করে যে বেমালুম ঘুমোলে তা তুমিই জানো। তার উপর অতবড় একটা সিংহকে কেউ যে রাবারের চটি ছুঁড়ে মারতে পারে তা কোনো লোকে বিশ্বাস করবে?

ঋজুদা বলল, রুদ্র, তুই বড্ড কথা বলছিস। একদম চুপচাপ। সারা রাস্তাতে আর একটাও কথা বললে বিপদ হবে। এত বকবক করিস কেন?

ভুষুণ্ডা, মনে হল, মুখ টিপে হাসল।

আমার রাগ হল। কিন্তু চুপ করে গেলাম। বাইরের লোকের সামনে ঋজুদা এমন করে প্রেস্টিজ পাংচার করে দেয় যখন-তখন যে, বলার নয়। ভীষণ খারাপ।

আমাকে কথা বলার জন্যে বকেই, নিজেই সঙ্গে সঙ্গে বলল, আঃ, সামনে চেয়ে দ্যাখ, কী সুন্দর দৃশ্য।

আমি দেখলাম। কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য করলাম না। কথা বলব না আর।

ভুষুণ্ডা আগে-আগে চলেছে। লেকটাকে পাশে রেখে, কোনাকুনি তার পাড় বেয়ে পেরিয়ে এলাম আমরা। এই সব লেক পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম আর সোডিয়ামের জন্যে বিখ্যাত। ঋজুদা বলছিল, সোডার সোয়াহিল। নাম হচ্ছে মাগাডি। মাগাডি নামেই কেনিয়াতে খুব বড় একটা সোডা লেক আছে। সেরোনারার কাছে একটা ছোট লেক আছে এরকম। তার নাম লেক লাগাজা।

আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। একদল বেবুন আমাদের দেখে দাঁতমুখ বের করে, বিশ্রী মুখভঙ্গি করে, চেঁচামেচি শুরু করে দিল। চারতলা বাড়ির সমান উঁচু একটা জিরাফ লেরাই গাছের পাশে দাঁড়িয়ে মগডালের পাতা খাচ্ছিল, আমাদের দেখতে পেয়েই ছুট লাগাল ল্যাগব্যাগ করতে করতে। একটু পরেই একটা ডিকডিক দৌড়ে গেল জঙ্গলের গভীরে। কালকের ডিকডিকটাও হতে পারে। ডিকডিক নাকি খুব বেশি দেখা যায় না। ঋজুদা কালকে বলছিল।

ভুষুণ্ডা বড়-বড় পা ফেলে মুখ নিচু করে আগে-আগে চলেছে। ভুষুণ্ডার পিছনে ঋজুদা। তার পিছনে আমি।

ঋজুদা অর্ডার দিয়েছে, মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনটা ভাল করে দেখতে। কিন্তু ঘাড়ের উপর এত মালপত্র যে, ঘাড় ঘোরাতেই পারছি না। মনে হচ্ছে, স্পণ্ডিলাইটিস হয়েছে। একদিক দিয়ে অবশ্য ভালই হয়েছে। আমার পুরো পিছন দিকটাই মালপত্র ঢাকা। পায়ে অ্যাঙ্কল বুট। হাঁটুর ঠিক পিছনে না মারলে তীর কোথাওই আমার লাগবে না। ঋজুদা জেনেশুনেই আমাকে এই বর্ম পরিয়ে পিছনে দিয়েছে কি-না, কে জানে?

একটা ঢালু জায়গা পেরোতেই আমরা গভীর জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়লাম। এবারে সত্যিই ভয় করছে। আধ ঘন্টাখানেক চলেছি আমরা, এমন সময় সামনের জঙ্গলের মধ্যে থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখলাম।

ঋজুদা আমার দিকে তাকাল। আমি ঋজুদার দিকে।

তারপর বন্দুকে গুলি ভরে নিলাম। ঋজুদা রাইফেলটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাতে নিল।

ভুষুণ্ডা ধোঁয়া দেখে কিছু বলবে, ভেবেছিল ঋজুদা। কিন্তু ভুষুণ্ডা কিছুই না বলে সেই ধোঁয়ার দিকেই এগিয়ে চলল এঁকেবেঁকে। ভুষুণ্ডার হাতে কোনো অস্ত্র নেই। ওর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একেই বলে সাহস! হাতে বন্দুক রাইফেল থাকলে তো অনেক বীরত্বই দেখানো যায়।

ভুষুণ্ডা সত্যিই যে কত ভাল গাইড তা এবারে বোঝা যাচ্ছে! কী সহজে ও চলেছে। দোমড়ানো ঘাস, ভাঙা গাছের ডাল, ছেঁড়া পাতা–এই সবের চিহ্ন দেখে ও লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে এঁকে-বেঁকে। মাঝে-মাঝে পিছিয়ে এসে ডাইনে-বাঁয়ে গিয়ে নতুন পথ ধরছে। আমরা ওকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছি। এবারে জঙ্গল আরও গভীর। বড়-বড় লতা। ফুল ধরেছে তাতে।

হঠাৎ ভুষুণ্ডা দুহাত দুদিকে কাঁধের সমান্তরালে ছড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, পোলে, পোলে।

ঋজুদা বাঁ হাতটা উপরে তুলে পিছনে-আসা আমার উদ্দেশে বলল, পোলে, পোলে।

আমি চলার গতি আস্তে করলাম।

এই পরিবেশে ঋজুদাও যেন ইংরেজি বাংলা সব ভুলে গেছে। নইলে ভুষুণ্ডার মতো নিজেও পোলে, পোলে বলত না।

ভুষুণ্ডা আর ঋজুদা আমার থেকে হাত-দশেক সামনে ছিল। ওরা দুজন ফিসফিস করে কী বলাবলি করল। তারপর ইশারাতে আমাকে ডাকল।

এগিয়ে যেতেই ভুষুণ্ডা আবার এগিয়ে গিয়েই একটা উৎরাইতে নামতে লাগল। একটু নামতেই নাকে পচাগন্ধ এল আর সেই গন্ধ আসার সঙ্গে-সঙ্গে দেখলাম সামনেই ধোঁয়া উড়ছে গাছপালার আড়ালে।

তারপরই যা দেখলাম, তার জন্যে একেবারেই তৈরি ছিলাম না। সেরকম কিছু যেন কখনও কাউকে দেখতে না হয়।

কতকগুলো পাশাপাশি কুঁড়েঘর, খড়ের। তার সামনে একটা বড় আগুন তখনও জ্বলছে। তিরতির করে একটা নদী বয়ে চলেছে সেই ঘরগুলোর পাশ দিয়ে। ঘরগুলোর সামনে বড় বড় কাঠের খোঁটার সঙ্গে বাঁধা দড়িতে প্রায় একশো জানোয়ারের রক্তমাংস লেগে-থাকা চামড়া ঝুলছে। তার মধ্যে জেব্রা, ওয়াইল্ডবীস্ট, ইম্পালা, গ্রান্টস ও থমসনস গ্যাজেল, এলান্ড, টোপি, বুশবাক, ওয়াটার বাক, বুনো মোষ-সবকিছুর চামড়াই আছে। সমস্ত জায়গাটা রক্তে-মাংসে বমি-ওঠা দুর্গন্ধে যেন নরক হয়ে আছে একেবারে।

আমরা অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলাম গাছ-গাছালির আড়াল থেকে। আগুনটা নিশ্চয়ই কাল রাতের। এখন নিভে এসেছে। একজনকেও দেখা গেল না ওখানে। ওরা সারারাত কাজ করে এখন বোধহয় ঘুমোচ্ছে।

রাইফেলটা তাক করে ঋজুদা এবারে আগে গেল। তারপর ভুষুণ্ডা। ভুষুণ্ডার পেছনে আমি।

ঋজুদা আমাকে ডেকে বলল, তুই বন্দুক তৈরি রেখে বাঁ দিকে যা, আমি ডান দিকে যাচ্ছি। আমরা জায়গামত গিয়ে দাঁড়ালে ভুষুণ্ডা তুমি এইখান থেকে জোরে-জোরে কথা বলবে।

ওয়াণ্ডারাবোদের ডেরায় এসে খালি হাতে দাঁড়িয়ে কথা বলা আর আত্মহত্যা করা একই ব্যাপার। কিন্তু ভুষুণ্ডা একটুও ভয় পেল না। আমার মনে হল ঋজুদা যেন চাইছে ভুষুণ্ডার বিপদ ঘটুক।

আমরা সরে দাঁড়াতেই ভুষুণ্ডা অজানা ভাষায় জোরে জোরে কথা বলতে লাগল। আমার মনে হল মেশিনগান থেকে গুলি ছুটছে ট্যা-র‍্যা র‍্যা-র‍্যা-রা-ট্যা-র‍্যা করে। কী অদ্ভুত ভাষা রে বাবা!

কিন্তু তবুও ঐ কুঁড়েঘর থেকে কেউই বেরোল না। যখন একজনও বেরোল না, তখন ঋজুদা হাত দিয়ে ইশারা করল আমাকে। আমরা দুজনে রাইফেল ও বন্দুক তৈরি রেখে আস্তে আস্তে কুঁড়েঘরগুলোর দিকে দুদিক থেকে এগিয়ে গেলাম। ভুষুণ্ডা আমাদের আগে-আগে ডোন্ট কেয়ারভাবে খালি হাতে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধের মালপত্র সব আগুনের পাশে নামিয়ে রেখে নিভু নিভু আগুনের মধ্যে একটা কাঠি ঢুকিয়ে আগুন জ্বেলে সিগারেট ধরাল। তারপর আগুনের পাশেই ফেলে রাখা একটা বিরাট তালগাছের গুঁড়িতে বসে আরামে সিগারেট টানতে টানতে কুঁড়েঘরগুলোর দিকে পিছন ফিরে আমাদের দেখতে লাগল।

তখনও যখন কাউকে দেখা গেল না, তখন আমরা সাবধানে সামনের কুঁড়ের মধ্যে ঢুকলাম। কুঁড়ের মধ্যে বস্তা বস্তা নুন, ফিটকিরি, নানারকম ছুরি ও বড় বড় অনেক লোহার তারের গোলা দেখতে পেলাম।

ঋজুদা বলল, লাইন। এগুলোকে স্নেয়ার বলে। তারের ফাঁদ। এই তার বেঁধে রাখে জানোয়ারদের যাতায়াতের পথে জালের মতো। একসঙ্গে অনেক জানোয়ারকে ধরতে পারে এবং মারতে পারে এরা এমন করে।

আমি ফিসফিস করে বললাম, তা তো বুঝলাম, কিন্তু ওরা সব গেল কোথায়?

সব পালিয়েছে। কাল রাতে ভু-বাবুর বন্দুকের গুলির আওয়াজ শুনেই বোধহয় ওরা বুঝেছিল।

আমি বললাম, পালিয়ে যাবে কোথায়? চলো, আমরা ফিরে গিয়ে গাড়ি নিয়ে ওদের ধাওয়া করি। এই জঙ্গল পেরিয়ে তো ওদের ফাঁকা জায়গা দিয়ে অনেকটাই যেতে হবে। তারপরে না-হয় আবার জঙ্গল পাবে।

ঋজুদা বলল, তা ঠিক। কিন্তু আমরা তো ওদের সঙ্গে লড়াই করতে আসিনি। ওদের ধরতেও আসিনি। এসেছি ওদের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে। এই কুঁড়েঘরগুলো ভাল করে খুঁজলে ওদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যাবে। কয়েকদিন ভুষুণ্ডা না হয় গাড়ির কাছেই তাঁবুতে থাকবে। টেডিকে এখানে ডেকে আনাব। তারপর দিন-কয়েক এখানে ওদের থাকার রকম-সকম দেখব। তাতে ওরা কোন পথ দিয়ে আসে যায়, কী কী জানোয়ার বেশি মারে, কেমন করে মারে, কেমন করে চামড়া শুকোয়, কী খায় ওরা, কেমন ভাবে থাকে, কীভাবে টন-টন স্মোকড-করা মাংস পাচারই বা করে বিক্রির জন্যে–এসব জানতে পারব।

ভুষুণ্ডা সিগারেট খেতে খেতে বলল, পাখিরা উড়ে গেছে

 ঋজুদা বলল, তাই তো দেখছি।

বাঁদিকের কোনায় একটা বড় ঘর ছিল। তার মধ্যে ঢুকে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। দেখি, বিরাট-বিরাট হাতির দাঁত শোয়ানো আছে মাটিতে। হাতির লেজের চুল কেটে গোছ করে রাখা হয়েছে। অনেকগুলো হাতির পা হাঁটুর নীচ থেকে কেটে মাংস কুরে বের করে তার মধ্যে ঘাস পুরে রেখেছে।

আমি বললাম, ঈসস।

ঋজুদা বলল, হাতির লেজের চুল দিয়ে সুন্দর বালা তৈরি হয়। আর পা দিয়ে হয় মোড়া বা টেবিল। দাঁত দিয়ে তো অনেক কিছুই হয়। বল তো ঐ দাঁতটার দাম কত হবে আন্দাজ?

আমি বললাম, দশ হাজার টাকা?

ঋজুদা বলল, কম করে দু’লাখ টাকা।

 দুলাখ! বলো কী?।

হ্যাঁ। কম করে। তারপরেই বলল, কী বুঝলি? বুঝলি কিছু?

আমি বললাম, হ্যাঁ। দু’লাখ।

ঋজুদা বলল, তা নয়। এতগুলো দাঁত ওরা এভাবে ছেড়ে যাবে না। ওরা আসলে চলে যায়নি। আশেপাশেই আছে হয়তো। আমাদের দেখছে আড়াল থেকে। এখানে কম করে দশ-বারো লাখ টাকার হাতির দাঁতই আছে শুধু। অন্য চামড়া-টামড়ার কথা ছেড়ে দে। ওরা নিশ্চয়ই যায়নি। খুব হুঁশিয়ার রুদ্র। এক মিনিটও অসাবধান হবি না। তাছাড়া, এই ভুষুণ্ডাকে আমার কেমন যেন লাগছে। প্রথম দিন থেকেই। কী যে ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি আর ঋজুদা ঐ বড় কুঁড়েটা থেকে মাথা নিচু করে বেরোব, ঠিক সেই সময় খট করে কী একটা জিনিস এসে লাগল ঘরের খুঁটিতে।

তাকিয়ে দেখি, একটা লম্বা তীর। আর তার পিছনের পালকের কাছে এক টুকরো শুকনো সাদাটে তালপাতা বাঁধা। ঋজুদা তাড়াতাড়ি তালপাতাটা একটানে খুলে নিয়ে পড়ল। পড়েই, আমার হাতে দিয়েই, আমার হাত ধরে ঘরটার ভিতর দিকে সরে এল।

দেখলাম, তালপাতার টুকরোটার উপরে কোনো গাছের ডাল বা আঙুল রক্তে ভিজিয়ে কেউ বিচ্ছিরি হাতের লেখাতে এবড়ো-খেবড়ো করে ইংরেজিতে লিখেছে : SURRENDER OR DIE।

আমি বললাম, বেরোব এখান থেকে?

ঋজুদা বলল, একদম নয়।

আমার বুকের মধ্যে ঢিবঢিব করছিল। বললাম, দু’হাত উপরে তুলে বেরোব? সারেণ্ডার করবে?

ঋজুদা পাইপের ছাই ঝেড়ে নিল একটু, তারপর বলল, তোর লজ্জা করল না ওকথা বলতে?

তারপরই বলল, ভুষুণ্ডাকে দেখতে পাচ্ছিস? নিচু হয়ে দ্যাখ তো।

 নিচু হয়ে দেখলাম। ভুষুণ্ডা যেখানে বসে ছিল, সেখানে নেই তো। বললাম, না। দেখতে তো পাচ্ছি না। ।

হুমম্! ঋজুদা বলল।

ঘরটার মুখের ডান দিক থেকে–যাতে আমাদের রাইফেল বন্দুকের সামনে না পড়তে হয়, এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন লোক জোরে-জোরে চারটে উদ্ভট শব্দ উচ্চারণ করল।

ঋজুদা তার উত্তরে ঐরকমই উদ্ভট উচ্চারণ করেই যেদিক থেকে শব্দটা এসেছিল, সেইদিকে রাইফেলের ব্যারেল ঘুরিয়ে খড়ের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে গুলি চালিয়ে দিল। দিয়েই আমাকে বলল, তুই ডাইনে, বাঁয়ে ও পিছনেও গুলি কর থেমে-থেমে খড়ের দেওয়ালের এপাশ থেকে।

বলেই, পাইপের আগুনটা ঢেলে দিল খড়ের দেওয়ালের উপর। দেখতে-দেখতে ঘরটাতে আগুন ধরে গেল।

আমি বললাম, ঋজুদা, কী করছ? আমরা পুড়ে মরব?

ঋজুদা বলল, দারুণ ধোঁয়াতে ঢেকে গেলেই আমরা বাঁচতে পারব ওদের বিষের তীরের হাত থেকে। নইলে আর বেঁচে ফিরতে হবে না। এইটুকু বলেই, ঋজুদাও ঘরের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে রাইফেল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে লাগল বাইরের দিক লক্ষ করে। গুলির তোড়ে খোলা দরজার সামনে এসে যে কেউ আমাদের তীর মারবে সে-উপায় ছিল না ওদের।

এদিকে এমনই ধোঁয়া হয়ে গেছে ভিতরে যে, নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। চালেও আগুন লাগো-লাগো। চালে আগুন লাগলে আগুন চাপা পড়েই মরতে হবে। আর উপায় নেই।

আমি ভেবেছিলাম, ঋজুদা পেছন দিয়ে খড়ের দেওয়াল ফাঁক করে পালাবে। কিন্তু তা না করে এই ঘরের লাগোয়া যে ঘর আছে সেই দিকের দেওয়ালের খড়ে রাইফেলের ব্যারেল দিয়ে ফুটো করল। আমিও টেনে-টেনে খড় সরালাম। আগুনে চড়চড় করে খড় পোড়ার শব্দ হু হু হাওয়ায় শোনা যাচ্ছিল। সামনে থেকে কারা যেন খুব চেঁচিয়ে কথা বলছে। চারদিকে এত তাপ আর ধোঁয়া যে আমরাই কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বাইরের লোকেরাও নিশ্চয়ই পাচ্ছে না।

দেওয়ালটা ফুটো হতেই ঋজুদা ফুটো দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে পড়ল। আমিও পিছন পিছন। ঐ ঘরেও তখন আগুন লেগে গেছিল। ঋজুদা দৌড়ে গিয়ে আবার সেই ঘরের দেওয়াল অমনি করে ফুটো করতে-করতে আমাকে লাইটারটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, এই ঘরের চারদিকের দেওয়ালে আগুন লাগিয়ে দে। আমরা যখন সেই ঘর পেরিয়ে তার পাশের ঘরে ঢুকলাম তখন দু’নম্বর ঘরটাও দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। এমনি করে সমস্ত জায়গাটা জতুগৃহের মতো জ্বলছে। আগুনে-পোড়া নানা মাংস ও চামড়ার উৎকট গন্ধে মনে হচ্ছে যেন একটা বিরাট শ্মশানে এসে পড়েছি।

বাইরে বেরিয়ে ঐ শেষ ঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল ঋজুদা। ধোঁয়াতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছিল আমাদের। কাশিও পাচ্ছিল ভীষণ। ভয়ে কাশতে পারছিলাম না। কোন দিকে যাব আমরা ভাবছি, ঠিক সেই সময় দুটো লোক তীরধনুক হাতে নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে দৌড়ে গেল প্রথম কুঁড়েটার দিকে, যেখানে হাতির দাঁত ছিল। তারপর কী মনে করে ওরা আবার দৌড়ে ফিরে এল, বোধহয় ভেবেছিল, আমরা ঐ প্রথম কুঁড়েটার পিছন দিকেই বেরোব। অথবা আগুনে ঝলসে গেছি। এবারও লোকগুলো আমাদের দেখতে পায়নি–আমরা দেওয়ালের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে ছিলাম–তাছাড়া ওখানে যে থাকতে পারি আমরা তা ওদের ধারণারও বাইরে ছিল। কিন্তু দুটো লোকের মধ্যে পিছনের লোকটা পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতেও থমকে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে, বাঁ দিকে তাকাল আমাদের মুখে। কুচকুচে কালো, মোটা-মোটা ঠোঁটে, গুঁড়িগুড়ি চুলে লোকটাকে ভয়াবহ দেখাচ্ছিল।

মুহূর্তের মধ্যে ও ধনুকটা আমাদের দিকে ঘোরাল, আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার বন্দুক থেকে, যেন আমার অজান্তেই গুলি বেরিয়ে গেল। বোধহয় এল-জি ভরা ছিল। গুলি আর দেখাদেখির সময় ছিল না। যে গুলি পাচ্ছিলাম তাই-ই ভরছিলাম অনেকক্ষণ থেকে। চার হাত দূর থেকে বুকে অ্যালফাম্যাক্স-এর এল-জি খেয়ে লোকটা পড়ে গেল। হাতের ধনুক-তীর হাতেই রইল।

আমি গুলি করতে-না-করতেই ঋজুদা বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়ে অন্য লোকটাকে গুলি করল রাইফেল দিয়ে। সে ততক্ষণে ফিরে দাঁড়িয়ে তীর ছুঁড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তীরটা গিয়ে লাগল ঋজুদার গায়ে নয়, আমার গুলি-খেয়ে-পড়ে-যাওয়া লোকটারই গায়ে।

আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোকটার বুক রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এল; ঠোঁটটা নড়ল, কপালে ঘাম ভরে এল। আমি খুনী! মানুষ মারলাম আমি! এক্ষুনি একজন মানুষকে মেরে ফেললাম।

ঋজুদা আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়েই বলল, দৌড়ো। ওরা গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে হয়তো।

দৌড়তে-দৌড়তে ভাবছিলাম যে, হয়তো শুনতে পায়নি ওরা–আগুনের জন্যে যা শব্দ হচ্ছে চতুর্দিকে, আর ধোঁয়া। ওরা নিশ্চয়ই কিছু দেখতেও পায়নি।

আমরা দৌড়তে-দৌড়তে এসে লেকের পাশে পৌঁছলাম, কিন্তু ফাঁকা জায়গায় না। বেরিয়ে লেরাই জঙ্গলের নীচে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে বসে রইলাম। লেকটা পেরিয়ে একটু গিয়েই আমাদের তাঁবু। টেডি নিশ্চয়ই আমাদের জন্যে উৎকণ্ঠার সঙ্গে একা একা অপেক্ষা করছে সেখানে খাওয়ার বন্দোবস্ত করে। আজও উগালি? দুসস।

আমি ফিসফিস করে ঋজুদাকে বললাম, ভুষুণ্ডাকে খালি হাতে আনা আমাদের উচিত হয়নি। ওরা বোধহয় ভুষুণ্ডাকে মেরে ফেলেছে এতক্ষণে।

ঋজুদা বলল, বোধহয় না। দেখাই যাক। তারপর আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল, খুব সময়মতো গুলিটা করেছিলি তুই। লোকটা ধনুকের ছিলাতে টান দিয়েছিল, আর এক সেকেন্ড দেরি হলে… ওয়েল-ডান।

আমি বললাম, ঈসস, মানুষ মারলাম!

ঋজুদা বলল, শখ করে তো আর মারিসনি। তাছাড়া ওরা জঘন্য অপরাধ করছে। আমাদের মেরেও তো ফেলত একটু হলে। না মারলে, আমরা নিজেরাই মরতাম! করার তো কিছু ছিল না।

ওখানে বসে-বসেই দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের পিছনে বহুদূরে জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে কালো ধোয়ার কুণ্ডলী আর ভস্মীভূত রেড-ওট ঘাস উড়ছে আকাশে। ফ্লেমিংগোগুলো তাদের শরীরের গোলাপি ছায়া ফেলে জলে, অদ্ভুত উদাস স্বরে ডাকছে। জলের উপরে তাদের গলার স্বর ভেসে যাচ্ছে অনেক দূর অবধি।

আমি বললাম, ওরা যেই জানবে যে আমরা ওদের দুজনকে মেরে পালিয়ে গেছি তখন প্রতিশোধ নিতে তাঁবুতে যাবে না তো! আমাদের মেরে নিশ্চিত হবে হয়তো ওরা।

ঋজুদা বলল, অত সাহস হবে না। এ যাত্রা ওরা হয়তো পালিয়েই যাবে। যারা নিজেরা অন্যায় করে এবং জানে যে তারা অন্যায় করছে, তাদের মেরুদণ্ডে জোর থাকে না। সাহসের অভাব হয় ওদের। যে কারণে বড়-বড় যুদ্ধেও দেখা যায় যে, অনেক বেশি বলশালী হয়েও যে-দেশ অন্যায় করে তারা হেরে যায় যাদের উপর অন্যায় করা হয়েছে সেই দেশের সৈন্যদের মনের জোরের কাছে। অন্যায় যারা করে, তারা একটা জায়গায়, একটা সময়ে পৌঁছে ভীরু হয়ে যায়ই। মানুষ অন্য সকলকেই ঠকাতে পারে, পারে না কেবল নিজের বিবেককে। যদি সে মানুষ হয়!

আমরা ওখানে প্রায় দুঘন্টা চুপ করে বসে রইলাম। লেকের অন্য পাশে যে পথটা তাঁবুর দিকে গেছে তা দিয়ে একদল এলাণ্ড আর টোপি এন্টেলোপ চলে গেল। এই টোপিগুলো বেশ বড় হয়। আমাদের দেশের শম্বরের মতো, তবে শিং বড় হয় না। শরীরের সঙ্গে যেখানে পা মিলেছে সেখানটা কেমন নীল রঙের হয়–আর শরীরটা খয়েরি। এলাণ্ড-ও বেশ বড় হয়।

তারা চলে যাবার পর একটা মস্তবড় বেবুন-পরিবার চলে গেল কিরখির করে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে। কিন্তু কোনো মানুষকেই দেখা গেল না। এদিকে বেলা অনেক হয়েছে। কী করে যে এত সময় কেটে গেল বোঝাই গেল না। এতক্ষণ ঋজুদাও পাইপ খায়নি, পাছে ওয়াণ্ডারাবোরা ধোঁয়া দেখতে পায়।

আমরা এবার উঠে সাবধানে এগোলাম। আস্তে-আস্তে সমস্ত পথটা পেরোলাম। লেকটা পেরিয়ে এলাম, আবার লেরাই জঙ্গল, তারপর দূর থেকে তাঁবুটা দেখা গেল। এবারে পুরো তাঁবুটাই দেখা যাচ্ছে। তাঁবুর বাইরে আগুনের উপর বাসন ছড়ানো আছে। কিন্তু আগুন নিভে গেছে। টেডি বোধহয় খাবার গরম করবে আমরা ফিরলে।

হঠাৎ ঋজুদা বলল, ল্যাণ্ড-রোভার?

আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম! কোথায় গেল? আমাদের ট্রেলারসুদ্ধ ল্যাণ্ড-রোভার?

ঋজুদার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, যা ভেবেছিলাম! তারপরই বলল, চাবিটা তুই নিজের কাছে রাখিসনি? কাল তো তুই-ই গাড়ি চালিয়ে এসেছিলি?

আমি বললাম, আমাদের কাছেই তো ছিল। কাল সন্ধেবেলায় ভুষুণ্ডা চেয়ে নিয়েছিল। ড্রাইভিং সীট-এর দরজা বাইরে থেকে লক্ করে শোবে বলে–যাতে সিংহটিংহ এলে ভয় না থাকে। সিংহ ত’ এসেওছিল রাতে।

ঋজুদা এবারে দৌড়তে লাগল তাঁবুর দিকে। আমিও পিছনে পিছনে।

 আমি ডাকলাম, টেডি, টেডি!

টেডিও কি ভুষুণ্ডার মতো বিশ্বাসঘাতকতা করল আমাদের সঙ্গে? কত ভাল টেডি! কত সুন্দর গল্প বলবে বলেছিল আমাকে ও আজ রাতে।

টেডি বাইরে কোথাওই নেই। তাঁবুর ভিতরেও নেই; আমাদের তাঁবুর ভিতরে ঢুকে দেখলাম, কারা যেন সব লণ্ডভণ্ড করেছে। ঋজুদার কাগজপত্র, অন্যান্য জিনিস, আমাদের বন্দুক-রাইফেলের গুলি যা তাঁবুতে ছিল সবই নিয়ে গেছে তারা। ঋজুদার ফোর-ফিফটি ফোর হান্ড্রেড রাইফেলটা পর্যন্ত। আমাদের খাবার-দাবার, বন্দুক, রাইফেলের গুলির বাক্স, পেট্রল, আরও সমস্ত জিনিসপত্র যা ট্রেলারের ভিতরে রাখা ছিল সবই গেছে ট্রেলারের সঙ্গে।

ঋজুদা বলল, রাইফেল নিয়েছে বটে, কিন্তু লকটা আমার কাছে। ও দিয়ে গুলি ছুঁড়তে পারবে না।

কিন্তু টেডি? টেডি কোথায় গেল? টেডিও কি আমাদের শত্রুপক্ষ? ঋজুদা এত বোকা! যখন ওদের ইন্টারভ্যু করে আরুশাতে এসে তিন মাস আগে সিলেক্ট করে তখন ওদের সম্বন্ধে ভাল করে খোঁজখবরও নেয়নি?

আমাদের তাঁবু থেকে বেরিয়ে তাঁবুর পিছনে যেতেই, আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন গলার কাছে উঠে এল। টেডি হাত-পা ছড়িয়ে আছে। যেন তার কিছুই হয়নি। যেন ও ঘুমোচ্ছে। শুধু একটা ছোট্ট তীর গেঁথে রয়েছে ওর গলাতে।

ঋজুদা এসে আমার পাশে দাঁড়াল। বলল, ভুষুণ্ডা!

বলেই, তাঁবুর সামনে এসে নিচু হয়ে ধুলোর মধ্যে কী যেন খুঁজতে লাগল। নিজের মনেই বলল, ঠিক।

আমি বললাম, কী?

ঋজুদা বলল, ভুষুণ্ডা টেডিকে মেরে ফেলার পর ওয়াণ্ডারাবোরা ওর সংকেতে এখানে আসে। তারপর ল্যাণ্ড-রোভার ও ট্রেলারে চড়ে ভুষুণ্ডার সঙ্গে পালিয়ে যায়। কয়েকজনকে রেখে যায় হয়তো আমাদের শেষ করে মালপত্র নিয়ে হাঁটা-পথে যাওয়ার জন্যে।

কী সাংঘাতিক! এখন আমার কী করব ঋজুদা? আমি একেবারে ভেঙে পড়ে বললাম।

ঋজুদা বলল, দাঁড়া! দাঁড়া। ভয় পাস না। কিন্তু আগে টেডিকে কবর দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। নইলে রাতে হায়না আর শেয়ালে বেচারাকে ছিঁড়ে খাবে। কিন্তু এখানের মাটি যে খুব শক্ত।

আমি আর ঋজুদা টেডিকে বয়ে নিয়ে গেলাম লেকের কাছে। তাঁবুর খোঁটা গাড়বার শাবল দিয়ে আমরা দুজনে মিলে কয়েক ঘন্টা ধরে একটা বড় গর্ত করলাম। তারপর টেডিকে তার মধ্যে শুইয়ে, জঙ্গল থেকে অনেক ফুল তুলে এনে উপরে ছড়িয়ে দিলাম। আমরা যখন টেডিকে কবর দিচ্ছিলাম তখন ওয়াণ্ডারাবোদের আর কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না।

পশ্চিমাকাশে একটা দারুণ গোলাপি রঙ ছড়িয়ে গেছিল। রঙটা কাল খুব খুশির মনে হয়েছিল। আজ মনে হল বড় দুঃখের।

একটা সাদা কাগজে বড় বড় করে ঋজুদা লিখল, টেডি মহম্মদ, আমাদের বিশ্বস্ত, আমুদে, সাহসী বন্ধু, এইখানে শুয়ে আছে। তার নীচে লিখল, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি অপারেশন : ওয়াণ্ডারাবো ওয়ান। তারও নীচে তারিখ দিয়ে লিখে দিল, ঋজু বোস অ্যাণ্ড রুদ্র রায়চৌধুরী।

আমি ভাবছিলাম, আমাদের বন্ধু টেডি এখানেই শুয়ে থাকবে। শীতের শিশির পড়বে ওর কবরের উপর। স্টার্লিং পাখিরা কিচিরমিচির করে গান গাইবে কানের কাছে। নরম পায়ে ডিকডিক হরিণ হেঁটে যাবে। বর্ষাকালে ফিসফিস করে বৃষ্টি আলতো করে হাত ছোঁয়াবে ওর গায়ে। রামধনু-হাতে খনভাম্ এসে দেখে যাবেন টেডিকে। বাজ পড়ার শব্দ হয়ে কথা বলবেন টেডির সঙ্গে। হয়তো কোনো গাঢ় অন্ধকার রাতে গুগুনোগুম্বার অথবা ওগরিগাওয়া বিবিকাওয়া চুপিসারে কোনো কুচকুচে কালো লোমশ জানোয়ারের মূর্তি ধরে এসে টেডির কবরের কাছে থাবা গেড়ে বসে ওকে পাহারা দেবেন।

পশ্চিমে অল্প ক’টি অ্যাকাসিয়া গাছের পাহারায়, ধু-ধু দিগন্তের উপরে সূর্য হারিয়ে গেল আজ। টেডিও হারিয়ে গেল। চিরদিনের মতো।

আমার চোখ জলে ভরে এল।

.

কাল রাতে আমাদের ঘুম হয়নি। ঘুমোবার সাহসও হয়নি। ঋজুদা ম্যাপ নিয়ে আঁকিবুঁকি করেছিল তাঁবুর সামনে বসে, আর বই পড়েছিল। আমাকে তাঁবুর মধ্যে ঘুমুতে বলেছিল বটে, কিন্তু একটু করে শুয়েছি আর ঋজুদার কাছে এসে বসেছি বারবার আগুনের সামনে।

কাল রাতেও সিংহগুলো এসে হাজির হয়েছিল। কিন্তু দূর দিয়ে চলে গেছিল। ওরা বোধহয় কোনো বড় জানোয়ার, মোষ অথবা টোপি মেরে থাকবে। বেশ শান্ত-সভ্য ছিল সে-রাতে। আমাদের কাল কিছুই খাওয়া হয়নি। খাওয়ার মতো মনের অবস্থাও ছিল না। আজ সকালে জিনিসপত্র হাতড়ে বিস্কুটের টিন বেরুল। সেই বিস্কুট আর কফি খেলাম আমরা।

আমি বললাম, কী হবে ঋজুদা! চলো আমরা মারিয়াবো পাহাড়ের দিকে যাই নাইরোবি সর্দারের গ্রামে। তাও তো এখান থেকে ষাট সত্তর মাইল কম করে। জলও তো সব ট্রেলারেই ছিল। জল পাব কী করে? তার চেয়ে চলো ফিরে যাই।

ঋজুদা আমার চোখে চোখ রেখে বলল, এখানে আমরা কেন এসেছিলাম?

আমি ঋজুদার চোখে তাকিয়ে লজ্জা পেলাম। মুখ নিচু করে বললাম, তা ঠিক।

ঋজুদা বলল, ভুলে যাস্ না রুদ্র যে, তুই মানুষ! মানুষ মনের জোরে কী না পারে, কী না করতে পারে? একা একা পালতোলা নৌকোতে মানুষ সমুদ্র পেরোয়নি? মরুভূমি পেরোয়নি পায়ে হেঁটে? এইসব জায়গায় যখন প্রথম ইংরেজ ও জার্মান পর্যটকরা আসেন, শিকারীরা আসেন, বিজ্ঞানীরা আসেন, তাঁরা কি গাড়ি করে এসেছিলেন? এই অঞ্চলেই একজন জার্মান প্রজাপতি-সংগ্রাহক একা-একা প্রজাপতি খুঁজতে এসে রিফটভ্যালিতে মানুষের হাড় কুড়িয়ে পেয়ে ফিরে গিয়ে বার্লিন মিউজিয়ামে জমা করেন। তার থেকে আবিষ্কার হয় ওলডুভাই গর্জ-এর। ডঃ লিকি সস্ত্রীক এসে বছরের পর বছর এইরকমই জায়গায়, তাঁবু খাঁটিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চালান সেখানে। আবিষ্কৃত হয় কত নতুন তথ্য, কত কী জানতে পারেন।

একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, রুদ্র, তুই না অ্যাডভেঞ্চারের লোভে প্রায় জোর করেই আমার সঙ্গে এসেছিলি আফ্রিকায়? এরই মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের শখ মিটে গেল! তোর বয়সি গুজরাটি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি ছেলেরা বিদেশ-বিভুঁইতে একা একা ব্যবসা করতে চলে আসে। দেখলি তো ডার-এস-সালাম-এ, আরুশাতে কত ভারতীয় ব্যবসা করছে। তার মধ্যে বাঙালি দেখলি একজনও?

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, তুই তাহলে আমার সঙ্গে এলি কেন? আমি তো এখানে ছেলেখেলা করতে আসিনি। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেই এসেছি।

ঋজুদার হাঁটুতে হাত দিলাম। বললাম, আমাকে ক্ষমা করো। বলো, আমরা এখন কী করব?

ঋজুদা আমার হাতে হাত রেখে বলল, আমরা এখন জীপের চাকার দাগ ধরে এগোব। প্রথমত, ওরা কোথায় যায় তা দেখতে চাই আমি। আমি যে কাজে এসেছি তার জন্যে ওদের চলাচলের পথ জানা দরকার। দ্বিতীয়ত, ওরা ট্রেলারটা কিছুদূর গিয়েই ছেড়ে দেবে। কারণ ট্রেলার নিয়ে জোরে গাড়ি চালাতে পারবে না। ট্রেলারটা পেলে আমরা মালপত্র পেয়ে যাব। ঐসব মাল ওরা ভয়ে নেবে না- পাছে চোরাই মাল সন্দেহে পুলিস ওদের ধরে।

আমি বললাম, তুমি কি পায়ে হেঁটে ওদের গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে?

ঋজুদা বলল, তা পারব, যদিও সময় লাগবে। তাছাড়া ভুষুণ্ডার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে। আসলে ও তো কর্মচারী। এই যে সব লোক দেখছিস, এই সব নানা চোরাশিকারীর দল, ভুষুণ্ডার মতো অর্ধশিক্ষিত লোকেরা, সব এক বিরাট দলের মধ্যে আছে। এই সব দলকে চালায় খুব ধনী ব্যবসায়ীরা। তাদের অন্য ব্যবসার আড়ালে এটাও তাদের একটা লাভের ব্যবসা। আমি যে কাজে এসেছি, তা সফল হলে, অনেক রাঘববোয়ালের মাথা ধরে টান পড়বে। তাই তারা আগেভাগেই বুদ্ধি করে ভুষুণ্ডাকে আমার দলে ভিড়িয়ে দিয়েছিল। সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছিল, ভূত আর ঝাড়বে কী করে বল্ ওঝা? ভুষুণ্ডা একা-লোক নয়। ও এক বিরাট চক্রের একটি যন্ত্র মাত্র। ও তো সামান্য চাকর। আমার দরকার ভুষুণ্ডার মালিকদের। ফয়সালা তাদেরই সঙ্গে। তবে ভুষুণ্ডার সঙ্গেও বোঝাপড়া করতে হবে টেডির কারণে। টেডির মৃত্যুর প্রতিশোধ এই আফ্রিকার জঙ্গলেই আমি নেব।

আমি বললাম, চলো তাহলে, আর দেরি কেন?

ঋজুদা উঠল। দুজনের হ্যাভারস্যাকে যা-যা অবশ্য-প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়া যায় তা ভরে নিয়ে, দুজনের কাঁধে দুটি জলের ছাগল উঠিয়ে ভাল করে বেঁধে নিয়ে আমরা রওনা হলাম নিরুদ্দেশ যাত্রায়। পিছনে পড়ে রইল তাঁবু দুটো– আমাদের ক্যাম্প-কট, বিছানা, জুতো জামা, অনেক কিছু জিনিস, যা বইবার সামর্থ্য আমাদের নেই। আর পড়ে রইল টেডি, চিরদিনের জন্যেই পড়ে রইল।

ল্যাণ্ড-রোভার আর ট্রেলারের চাকার দাগ দেখে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। মাইল দুয়েক আসার পর পিছনের সব-কিছু ধুধু মাঠের রোদের তাপে আর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এখন আমরা আবার ঘাসের সমুদ্রে এসে পড়লাম। কম্পাসই সম্বল এখন। আর সূর্য। এই সাভানা। পৃথিবীর এক ভৌগোলিক আশ্চর্য!

সারাদিনে হেঁটে আমরা কত মাইল এলাম বলা মুশকিল, কিন্তু আমরা এখনও ল্যাণ্ড-রোভারের চাকার দাগ হারাইনি। মাঝে একবার গোলমাল হয়ে গেছিল দুপুরের দিকে। তারপর ঋজুদা আবার খুঁজে পেয়েছিল। যেদিকে চোখ যায় শুধু ধু-ধু হলুদ ঘাসের প্রান্তর। একটাও গাছ নেই, ঘর নেই, বাড়ি নেই, মানুষ নেই-শুধু জানোয়ারের মেলা। সেৎসী মাছির জন্যে এখানে মাসাইরাও বিশেষ গরু চরাতে পারে না। বসবাস করতে পারে না রাইফেল বন্দুকধারী মানুষও। এমনই সাংঘাতিক এই মৃত্যুবাহী মাছিরা।

সন্ধের আগে-আগে আমরা কিছুটা ঘাস পরিষ্কার করে জিনিসপত্র নামিয়ে বসলাম। এক টিন ককটেল সসেজ বেরোল। কফি এখনও আছে। কফি আর সসেজ খেয়ে, হ্যাভারস্যাকে মাথা দিয়ে রাইফেল পাশে রেখে কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়লাম দুজনে। পাশাপাশি! রাতে ভাল ঠাণ্ডা পড়বে।

আস্তে-আস্তে তারারা ফুটে উঠল। কাল থেকে আজ চাঁদের জোর বেশি। দিনভর হেঁটে দুজনেই খুব ক্লান্ত ছিলাম। ঋজুদা তো কাল রাতে একটুও ঘুমোয়নি। তাই দুজনেই শুতে না শুতেই ঘুমোলাম।

মাঝরাতে কী যেন একটা শব্দে আমি চমকে উঠলাম। মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝি। হঠাৎ হাজার-হাজার খুরের জোর শব্দে ঘুম-চোখে উঠে বসে দেখি, ঋজুদা আমাদের দুজনেরই পাঁচ ব্যাটারির টর্চ দুটো জ্বালিয়ে রেখেছে সামনে। আর সেই আলোতে দূরে দেখা যাচ্ছে হাজার-হাজার জানোয়ার জোরে ছুটে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে প্রচণ্ড শব্দে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে।

আমি ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, কী ব্যাপার?

 কিন্তু আমার গলার স্বর গলার মধ্যেই মরে গেল। এত আওয়াজ!

অনেকক্ষণ, কতক্ষণ ধরে যে ওরা দৌড়ে গেল তার হিসেব করতে পারলাম না। শব্দ থামলে দেখা গেল, ধুলোর মেঘে আকাশের চাঁদ-তারা সব ঢেকে যাওয়ার যোগাড়।

ঋজুদা বলল, আশ্চর্য! এই সময় তো মাইগ্রেশনের সময় নয়! ওরা এমন করে দৌড়ে গেল কেন? কোনো আগ্নেয়গিরি কি জেগে উঠল? নিশ্চয়ই কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটবে। নইলে এ-রকম হত না।

কত হাজার জানোয়ার যে ছিল বলতে পারব না। লক্ষও হতে পারে। জেব্রা, ওয়াইল্ডবীস্ট আর গ্যাজেলস।

ঋজুদা বলল, আমরা এতক্ষণে কিমা হয়ে মিশে যেতাম ওদের পায়ে-পায়ে। দূর থেকে শব্দ শুনে উঠে পড়ে ভাগ্যিস দুটো টর্চ একসঙ্গে জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাতে লেগেছিলাম। তাতেই সামনে যারা আসছিল তারা দয়া করে পথ একটু পালটাল। নইলে পুরো দলটাই আমাদের উপর দিয়ে চলে যেত।

আমি বললাম, ঋজুদা! ল্যাণ্ড-রোভারের চাকার দাগ তো আর দেখা যাবে না। ওরা বোধহয় কয়েক মাইল জায়গা একেবারে সাদা করে দিয়ে গেছে পায়ে-পায়ে। তাই না?

ঋজুদা বলল, ঠিক বলেছিস তো? আমার তো খেয়ালই হয়নি।

বললাম, এখন কী করবে তবে?

ঋজুদা বলল, ঘুমুব। নে, শুয়ে পড়। আর মনে কর, তোদের বাড়ির দক্ষিণের ঘরে, গ্রিল-দেওয়া জানালার পাশে ডানলোপিলোর বিছানায় ধবধবে সাদা চাদরে ঘুমিয়ে আছিস। ঠিক ছ’টার সময় জনার্দন ট্রেতে করে ফলের রস এনে বলবে, ওঠো গো দাদাবাবু! আর কত ঘুমোবে?

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, তুমিও সেইরকম ভাবো।

বলে, দুজনেই শুয়ে পড়লাম।

ভোর হল শকুনের চিৎকারে। আমাদের চারধারে বড় বড় বিশ্রী দেখতে লাল-মাথা প্রায় একশো শকুন উড়ছে, বসছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে হাঁটছে। আমরা কি মরে গেছি? নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলাম, না তো! দিব্যি নিশ্বাস পড়ছে। ঋজুদা দেখলাম ছবি তুলছে শকুনগুলোর।

আমি উঠে বসতেই ঋজুদা বলল, আশ্চর্য! এরা কি আমাদের মড়া ভাবল! ব্যাপারটা কী বল তো?

আমার মনে পড়ল টেডি বলেছিল একটা প্রবাদের কথা। শকুন যদি কোনো জীবন্ত মানুষের তিন দিকে ঘিরে থাকে তাহলে সে মানুষ তিন দিনের মধ্যে মরে যায়। শকুনগুলো আমাদের চারদিক ঘিরে রয়েছে।

ঋজুদাকে এই কথা বলতেই সে বলল, তোর লেখাপড়া শেখা বৃথা হয়েছে।

বলেই, গুলিভরা শটগানটা তুলে নিয়ে দুমদাম করে দুদিকে দুটো গুলি করে দিল। দুটো শকুন উল্টে পড়ল। অন্য শকুনগুলো সঙ্গে-সঙ্গে বিচ্ছিরি চিৎকার করে উড়ে গেল।

ঋজুদা বলল, চল তো এই ভাগাড় থেকে পালাই। বলে মালপত্র উঠিয়ে নিয়ে অন্যদিকে চলল। পিছন-পিছন আমি।

আমরা একটু দূরে গিয়ে, ঘাস পরিষ্কার করে, খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত করছি, এমন সময় দেখি অন্য শকুনগুলো ঐ দুটো মরা শকুনকে খেতে লেগেছে।

ঋজুদা সেইদিকে একদৃষ্টে চেয়ে গম্ভীরভাবে বলল, এদের দেখে আমার মানুষদের কথা মনে পড়ছে। সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা এই শকুনগুলোর মতো।  

আমি বিস্কুটের টিন বের করলাম। নাইরোবি সর্দারের দেওয়া দুটো কলা ছিল। মুখ ধোওয়া, দাঁত মাজা, সব ভুলে গেছি। জল কোথায়? খাওয়ার জলই যেটুকু আছে তাতে কদিন চলবে ঠিক নেই। ঋজুদাকে কলা ও বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে কফির জল চড়ালাম, কফির খালি টিনে।

ঋজুদা বাইনাকুলারটাকে তুলে নিয়ে চোখে লাগিয়ে এদিকে-ওদিকে দেখতে লাগল। আমি খেতে-খেতে ফুটন্ত জলের দিকে লক্ষ রাখলাম।

হঠাৎ ঋজুদা বাইনাকুলারটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ভাল করে দ্যাখ তো, রুদ্র। কিছু দেখতে পাস কি না?

ফোকাসিং নবটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ভাল করে দেখে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। জাইস-এর বাইনাকুলার। খুবই পাওয়ারফুল। তাতে দেখলাম দূরদিগন্তের একটি জায়গায় একটু সবুজ-সবুজ ভাব–যেন জঙ্গল আছে, আর তার ঠিক সামনে একটা ল্যাণ্ড-রোভার ট্রেলার সুদ্ধু!

বাইনাকুলারটা নামিয়ে খালি চোখে কিছুই দেখতে পেলাম না।

ঋজুদা বলল, কী দেখলি?

আমি বললাম, দেখলাম।

ঋজুদা বলল, তবে এবার খেয়েদেয়ে চল্। যাওয়া যাক।

খাওয়া শেষ করে আমরা আবার মালপত্র কাঁধে নিয়ে রওনা হলাম।

ট্রেলারটা ভুষুণ্ডা ছেড়ে যাছে ভেবেছিলাম। ঋজুদা তেমনই বলেছিল। কিন্তু জীপটাও যখন ট্রেলারের সঙ্গে আছে তখন ব্যাপারটা কী বোঝা যাচ্ছে না মোটেই। ওরা কি তবে ওখানেই আছে? গাড়ির কাছে? নাকি গাড়ি এবং ট্রেলার হজম করতে পারবে না বলে পথেই ফেলে গেছে।

একটু যেতেই হঠাৎ গুড়-গুড়-গুড় একটা শব্দ শুনতে পেলাম। চারধারে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না আমি। ঋজুদা আকাশে তাকাতে বলল। তাকিয়ে দেখি, এক-এঞ্জিনের একটা সাদা আর হলুদ রঙের মোনোপ্লেন উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছে।

ঋজুদা তাড়াতাড়ি মালপত্র নামিয়ে রেখে তারা জামার কলারের নীচে ভাঁজ করে রাখা লাল সিল্কের রুমালটা জোরে জোরে নাড়তে লাগল। আমিও ক্যামেরা-মোড়া হলুদ কাপড়ের টুকরোটাকে পতাকার মতো ওড়াতে লাগলাম হাওয়াতে। কিন্তু প্লেনটা আমাদের দেখতে পেল বলে মনে হল না। যেমন যাচ্ছিল, তেমনই উড়ে চলল। দেখতে-দেখতে একটি ছোট্ট হলুদ-সাদা পাখির মতো দিগন্তে হারিয়ে গেল প্লেনটা।

আমরা আবার মালপত্র তুলে নিয়ে এগোলাম।

কিছুদূর যাওয়ার পর খালি চোখেই গাড়িটাকে দেখা গেল দিগন্তে একটা গুবরে পোকার মতো। আমরা এগিয়ে চললাম। ঘন্টাখানেক হাঁটার পর গাড়িটার কাছাকাছি এসে ঋজুদা বলল, এবারে একসঙ্গে নয়। তুই বাঁ দিকে চলে যা, আমি ডান দিকে যাচ্ছি। গুলি ভরে নে তোর শটগানে। কোনো লোক দেখলেই গুলি চালাবি। ওদের তীর যতখানি দূরে পৌঁছতে পারে সেই দূরত্বে পৌঁছনোর অনেক আগেই গুলি চালাবি। আর কোনো খাতির নেই। কোনো রিস্ক নিবি না। খুব সাবধান। ওরা গাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। তাহলে একেবারে কাছে না-যাওয়া অবধি কিন্তু বুঝতেই পারবি না।

সুতরাং খুউব সাবধান!

আমরা ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে ঋজুদা আরেকবার বাইনাকুলার দিয়ে ভাল করে দেখে নিল, গাড়িটা এবং তার চারপাশ।

তারপর বলল, গুড লাক্, রুদ্র।

আমরা দুজনে দুদিকে ছড়িয়ে যেতে লাগলাম। ক্রমশ দুজনের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগল। যখন আমি গাড়িটা থেকে দুশো গজ দূরে তখন আমার দিকে লক্ষ করে গাড়ির দিক থেকে কেউ গুলি ছুঁড়ল। আমি কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। গাদা-বন্দুকের গুলি। আমার সামনে পড়ল গুলিটা। ধুলো উড়ে গেল। আমি গুলি করার আগেই ঋজুদার রাইফেলের গুলির আওয়াজ হল। আমি দৌড়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম এবার। আমার শটগান-এর এফেক্টিভ রেঞ্জ একশো গজ। তার চেয়ে বেশি দূর থেকে গুলি করে লাভ নেই। আরও একবার গুলি হল। এবার দেখতে পেলাম, দুজন লোক একজন লোককে বয়ে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাবার চেষ্টা করছে। ঐ লোকটার গায়ে নিশ্চয়ই ঋজুদার গুলি লেগেছে। আমি এবারে গুলি করলাম এল-জি দিয়ে। দুটো লোকের মধ্যে একটা লোক পড়ে গেল। তখন বাকি লোকটা তাকে ও অন্য লোকটিকে ফেলে খুব জোরে দৌড়ে পালাল। লোকটার দৌড়নোর ধরন ও জামাকাপড় দেখে মনে হল যে, সে ভুষুণ্ডা। আমার ভুলও হতে পারে। অল্পক্ষণের মধ্যেই যে লোকটি দৌড়চ্ছিল সে পিছনের নিবিড় জঙ্গলে পৌঁছে চোখের আড়াল হয়ে গেল।

আমি আর ঋজুদা প্রায় এক সঙ্গেই দৌড়ে গিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছলাম। ঋজুদা ট্রেলারের উপর উঠে গাড়ির ভিতরটা ভাল করে দেখে নিল। তারপর মাটিতে শুয়ে থাকা লোক দুটোর দিকে এগিয়ে এল। আমি ঐ দিকেই যাচ্ছিলাম। এমন সময় সাঁ করে একটা তীর ছুটে এল আমার দিকে। যে-লোকটা গুলিতে ধরাশায়ী হয়েছিল সে-ই তীরটা ছুঁড়েছিল। কিন্তু শুয়ে-শুয়ে ছোঁড়ার জন্যেই হোক, বা যে কারণেই হোক, তীরটা আমার মাথার অনেক উপরে দিয়ে চলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঋজুদার রাইফেলের গুলি লোকটাকে স্তব্ধ করে দিল। লোকটা একটু নড়ে উঠে পা দুটো টান-টান করে ছড়িয়ে দিল। তীরধনুক-ধরা হাত দুটো দুদিকে আছড়ে পড়ল ঘাসের উপর।

আমরা গিয়ে লোক দুটোর কাছে দাঁড়ালাম। প্রথম লোকটি, যাকে বাকি দুজন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, ততক্ষণে মরে গেছে। ঋজুদার রাইফেলের গুলি তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। দ্বিতীয় লোকটিও মারা যাবে এক্ষুনি। আমরা কাছে যেতেই বিড়বিড় করে কী বলল।

ঋজুদা ওয়াটার-বটল খুলে তার মুখে জল ঢেলে দিল। এক ঢোক খেল সে। তারপরই মুখটা বন্ধ হয়ে গেল, কষ বেয়ে জল গড়িয়ে গেল, মাথাটা একপাশে এলিয়ে গেল। দুটি খোলা চোখ স্থির হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে রইল।

আমার গা বমি-বমি লাগছিল। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।

ঋজুদা বলল, বেচারিরা! ওরা কেউ নয়। যারা ওদের আড়ালে থাকে চিরদিন, তাদের মারতে পারলে তবেই হত।

তাড়াতাড়ি ট্রেলারের উপরের দড়ি কেটে কয়েক টিন খাবার বের করে নিল ঋজুদা। পাইপের টোব্যাকো, দেশলাই এবং রাইফেল ও বন্দুকের গুলিও। তারপর বলল, আর নষ্ট করার মতো সময় নেই। চল রুদ্র। 

আমরা দৌড়ে চললাম যেদিকে ঐ লোকটা দৌড়ে গেছিল সেদিকে।

দৌড়তে-দৌড়তে আমি ঋজুদাকে শুধোলাম, ভুষুণ্ডা?

ঋজুদা ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ। মুখে কোনো কথা বলল না।

জঙ্গলের কিনারাতে দৌড়ে যেতেই পরিষ্কার দেখা গেল একটা পায়ে-চলা পথ। আমরা সেই পথের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক সেইসময় কে যেন আবার গুলি করল অনেক দূর থেকে গাদা-বন্দুক দিয়ে। সিসের গুলিটা ঠক্ করে আমাদের একেবারে সামনে একটা বড় গাছের গুঁড়িতে এসে আটকে না গেলে কী হত বলা যায় না।

আমরা শব্দ লক্ষ করে দৌড়লাম! পথ ছেড়ে।

কিন্তু শব্দটা যেদিক থেকে এসেছিল সেইদিকে দৌড়ে গিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম। এমনকী কারো পায়ের চিহ্নও নয়। তবে কি গাছ থেকে কেউ গুলি ছড়ল? ভুষুণ্ডা কি এই জঙ্গলে একা, না সঙ্গে আরো লোক আছে? কিছুটা এগিয়ে যাবার পরই সামনে একটু দোলা-মতো জায়গা দেখলাম। সেখানে চাপ চাপ ঘাস হয়েছে সবুজ। বর্ষাকালে নিশ্চয়ই জলে ভরা থাকে জায়গাটা। সেই জায়গাটাতে নেমে গেল ঋজুদা, তারপর আমাকে ইশারাতে ডেকে নামতে বলল। সেই দোলার মধ্যে থেকে একটা প্রকাণ্ড বড় গাছ উঠেছে। ফিকাস্ গাছ। ঋজুদা আমাকে আগে উঠতে ইশারা করল, আমার পিছনে-পিছনে নিজে উঠল। আমরা কুড়ি ফুট মতো উঠে দুটি বড় ডাল দেখে পাশাপাশি বসলাম। ঐ মালপত্র নিয়ে গাছে ওঠা সহজ কথা নয়। কিন্তু আমাদের তো সবই গেছে–এখন এই সবেধন নীলমণি যা আছে তা খোয়ালে বাঁচাই মুশকিল হবে। তাই এগুলোকে কাঁধছাড়া করা যাচ্ছে না এক মুহূর্তও।

কারো মুখে কথা নেই কোনো। আমরা দুজনে দুদিকে দেখছি। হঠাৎ নীচের সবুজ দোলা থেকে প্রচণ্ড জোরে কে যেন শিস দিল। এত জোরে হল শব্দটা যে, মনে হলো কোনো গাড়ির টায়ার পাংচার হল বুঝি।

ঋজুদা চমকে উঠল। মনে হল, একটু ভয়ও পেল। ভয় পেতে তাকে বড় একটা দেখিনি। পরমুহূর্তেই বলল, তোর কাছে এক নম্বর কি দুনম্বর শটস আছে?

আমি হ্যাভারস্যাকে হাত ঢুকিয়ে বের করলাম একটা দু’নম্বর গুলি!

ঋজুদা বলল, তোর বন্দুকের ডান ব্যারেলে ভরে রাখ। এক্ষুনি।

ডান ব্যারেল থেকে এল-জি বের করে শটস ভরে নিলাম। ঠিক সেই সময় আবার শব্দটা হল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না।

কিছুক্ষণ পর সেই শব্দটা দূরে, জঙ্গলের গভীরে শুনলাম। আমরা যেদিক থেকে এলাম সেদিকে।

ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, গুলি আবার বদলে নিয়ে বোস।

ঐ গাছে বসেই লক্ষ করলাম যে, আমাদের বাঁ দিকে, জঙ্গলের প্রায় গায়ে একটা প্রকাণ্ড কোপি আছে। বিরাট-বিরাট বড় বড় কালো পাথর আর গুহায় ভরা টিলার মতো। এমন অদ্ভূত টিলা আমাদের দেশে দেখা যায় না।

আমি ঋজুদাকে ইশারাতে দেখালাম। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ঐদিকে, তারপর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ঋজুদার।

কী একটা ছোট কাঠবিড়ালির মতো জানোয়ার সামনের একটা গাছে উঠছিল, নামছিল। ছাই আর সবুজ-সাদা রঙ, ন্যাড়া মুখটা।

ঋজুদাকে দেখালাম ঐ দিকে। ঋজুদা বলল, ওটা কাঠবিড়ালি নয়। একটা পাখি। ওদের নাম গো এওয়ে। ওদের ডাক শুনলে মনে হয় বলছে, গো-এওয়ে, গো-এওয়ে।

আমি বললাম, ও তো তাহলে আমাদের চলে যেতে বলছে?

ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, আপাতত এখানেই শুয়ে ঘুমো। এত মোটা-মোটা ডাল। খাটের চেয়েও চওড়া। তবে দেখিস, নাক ডাকাস না যেন।

দুপুরে কোনো আওয়াজ পেলাম না কারও। গাছের ডালে বসেই ক্যানড স্যামন খেলাম আমরা। আর জল।

আমার অধৈর্য লাগছিল। গাছের ডালে ঘন্টার পর ঘন্টা বাঁদরের মতো বসে থেকে কী লাভ?

এদিকে ভুষুণ্ডা কত মাইল ভিতরে চলে গেছে এতক্ষণে! ঋজুদা কী যে করে, কেন যে করে, সে-সব আমার বোঝা ভার। মাঝে-মাঝে বিরক্তি লাগে। মুখে বলেও না কিছু যে, মতলবটা কী তার!

বিকেলে যখন আলো পড়ে এল তখন আস্তে-আস্তে আমরা গাছ থেকে নামলাম। ঋজুদা বলল, একদম শব্দ করবি না। আর আলোও জ্বালাবি না।

বাইরের বিস্তীর্ণ মাঠে যদিও তখন অনেক আলো, বনের ভিতরে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। নানা জাতের হরিণ, পাখি ও বেলুনের ডাকে জঙ্গল সরগরম। সেৎসী মাছির পাখার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে বনাঞ্জা প্লেনের এঞ্জিনের শব্দের মতো।

ঋজুদা আস্তে-আস্তে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে গাড়ির দিকে। কিন্তু যে-পথ দিয়ে এসেছিলাম তা থেকে প্রায় তিন-চারশো গজ বাঁ দিক দিয়ে একেবারে গভীর জঙ্গলের ভিতরে-ভিতরে চলেছি আমরা। সামনেই একটা নদী আছে। জলের কুলকুল শব্দ আসছে। আর-একটু এগোতেই খুব জোর হাপুস-হুপুস শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল, হাতির দল বোধহয় নদীতে নেমেছে। জলের কাছাকাছি এসে সামান্য আলোয় দেখলাম। জলের মধ্যে এক-দেড় হাত লম্বা মতো কী কতগুলো লালচে-লালচে ফোলা-ফোলা জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাসছে আর মাঝে-মাঝে তাদের গা থেকে ফোয়ারার মতো জল ছিটকে উঠছে।

এমন জিনিস আমাদের দেশে কখনও দেখিনি আমি। অবাক হয়ে জলের পাড়ে দাঁড়িয়ে বোঝবার চেষ্টা করছিলাম, ওগুলো কী জানোয়ার।

এমন সময় ঋজুদা আমার কাঁধে জোরে চাপ দিয়ে বলল, এগিয়ে চল। দাঁড়াস না।

আমি ফিসফিস করে একেবারে ঋজুদার কানের সঙ্গে কান লাগিয়ে বললাম, কী? কুমির?

ঋজুদা বলল, হিপোপটেমাস্। জলহস্তী! পালিয়ে চল্।

আমি তাড়াতাড়ি পা চালাতে চালাতে ভাবলাম, কত বড় জানোয়ার–অথচ সমস্ত শরীরটা জলে ডুবিয়ে শুধু নাকটা বের করে রয়েছে, যেমন কুমিরেরা করে। জলহস্তী উভচর জানোয়ার। তবে জল বেশি ভালবাসে।

আমরা জঙ্গল আর রেড-ওট ঘাসের বনের সীমানাতে এসে ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে পড়লাম। ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, অন্ধকার হয়ে গেলে আমি একা গাড়ির কাছে যাব। চাবিটা গাড়িতেই লাগানো আছে দেখেছিলাম। তারপর হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে সোজা চলে যাব আস্তে আস্তে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, ভুষুণ্ডা পথের আশেপাশে কোনো গাছে বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে অপেক্ষা করছে। ও জানে যে, আমরা গাড়ির লোভ ছাড়তে পারব না। সারা দিন ওকে খুঁজে না-পেয়ে আমরা ঠিক ফিরে যাব গাড়িতে। এবং হয়তো গাড়িতেই থাকব রাতে। অথবা গাড়ি নিয়েই চলে যাব একেবারে। যা পেট্রল আছে আমাদের, তাতে গোরোংগোরো আগ্নেয়গিরির কাছে মাসাইদের বস্তিতেও চলে যেতে পারব। একবার যদি বড় রাস্তায় উঠতে পারি, তাহলে অন্য গাড়ির দেখা পাবই। আর পেলে, সেরোনারাতে খবর চলে যাবে। তখন কোনো অসুবিধা হবে না আর। যে কারণে আমি যাচ্ছি তোকে এখানে একা রেখে, সেই কারণটা হচ্ছে এই যে, ভুষুণ্ডা গাড়ির কাছেও গিয়ে পৌঁছে থাকতে পারে দিনে-দিনেই। ও হয়তো গাড়ির মধ্যেই অপেক্ষা করছে। কারণ ও জানে যে, ও যা করেছে এতদিন, এবং টেডিকে অকারণে খুন করেছে–সেই সবের শাস্তি ওকে পেতেই হবে যদি আমার অথবা তোর দুজনের মধ্যে একজনও বেঁচে ফিরি। তাই ও আমাদের ছেড়ে পালাতে পারবে না। আমরা বেঁচে-ফেরা মানে ওর সর্বনাশ। ওদের পুরো দলেরই সর্বনাশ! ও বোধহয় ভেবেছিল, টেডি ছাড়া, গাড়ি ছাড়া আমরা সিংহ আর সেৎসীদের হাতে সেরেঙ্গটিতেই মরে যাব। আমরা যে পায়ে হেঁটে ওর পিছু নেব এমন কথা ও ভাবতেও পারেনি। ও এখন নানা কারণে মরিয়া হয়ে আছে। ও যদি গাড়িতেই গিয়ে থাকে, আমি নিজেই যেতে চাই। তোকে পাঠানো ঠিক হবে না।

ঠিক এমন সময় আমাদের অনেক ডান দিকে তিন-চারজন লোকের উত্তেজিত গলা শুনলাম। তাদের মধ্যে কী নিয়ে যেন তর্ক লেগেছে। ওদের মধ্যেই কেউ বকা দেওয়াতে ওরা সব চুপ করে গেল।

ঋজুদা যেন কী ভাবল। তারপর বলল, নাঃ। ওরা অনেকে আছে। তুইই যা রুদ্র। খুব সাবধানে অনেকখানি বাঁ দিকে গিয়ে আস্তে-আস্তে গাড়িতে পৌঁছবি। গাড়িতে যদি কাউকে দেখতে পাস তবে সঙ্গে-সঙ্গে গুলি চালাবি। আর কাউকে দেখতে না পেলে গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে, গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা গাড়ি চালাবি। এক সেকেণ্ডও দেরি করবি না। তারপর গাড়ি চালিয়ে চলে যাবি। একেবারে মাইল দশেক গিয়ে গাড়ি থামিয়ে, গাড়ির কাচ-টাচ সব বন্ধ করে, খাওয়া-দাওয়া করে গাড়িতেই বসে থাকবি। গাড়ির মুখটা এদিকে ঘুরিয়ে রাখিস। যদি এরা আমাকে ঘায়েল করতে পারে, তবেই তোর কথা ভাববে।

আমি বললাম, ঋজুদা, খুব সাবধান। তোমাকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার।

ঋজুদা বলল, যে কম্যাণ্ডার, তার কথা শুনতে হয়। গুড লাক্। বী আ ব্রেভ ম্যান। ঊ্য আর নো মোর আ বয়।

আমি আস্তে আস্তে ভুতুড়ে চাঁদের আলোতে ভুতুড়ে ছায়ার মতো আড়াল ছেড়ে ঘাসবনে উঠে গেলাম। তারপর বাঁ দিকে আরও কিছুদূর চলে গিয়ে খুব আস্তে-আস্তে গাড়ির দিকে এগোতে লাগলাম।

সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় মেঘে ঢেকে গেল আকাশ। এত মেঘ যে কোন্ দিগন্তে লুকিয়ে ছিল কে জানে? হয়তো খনভাম ভুষুণ্ডা আর তার সঙ্গীদের মিছিমিছি এত জানোয়ার মারার কারণে দারুণ চটে গিয়ে চাঁদকে ঢেকে দিলেন মেঘে যাতে আমাকে ওরা দেখতে না পায়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেলে ঋজুদাও ওদের আর দেখতে পাবে না। মহা মুশকিলে পড়া গেল। ঠাণ্ডা-ভিজে হাওয়া বইতে লাগল আর মেঘের মধ্যে গুড়গুড় করে বাজের ডাক শোনা যেতে লাগল। খনভাম কথা বলছেন। এখন খনভামের গলার স্বর, টেডি, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? আমরা তোমার মৃত্যুর বদলা নিতে এসেছি।

আহা! টেডি মানুষটা বড় সরল আর ধার্মিক ছিল।

কতক্ষণ পর আমি আন্দাজে গাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছলাম তা নিজেই জানি না। অন্ধকারে যতটুকু দেখা যায় তাতে ভাল করে দেখে নিলাম দূর থেকে। কান খাড়া করে শুনলাম কোনো আওয়াজ পাই কি না। হায়নার দল এসে সেই মরা লোক দুটোকে খাচ্ছে। দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই তারা হাঃ হাঃ হাঃ করে বুককাঁপানো হাসি হেসে উঠল।

কিন্তু নাঃ। হায়নার আওয়াজ ছাড়া কোনোই আওয়াজ নেই।

আফ্রিকার হায়নারা যে শুধু মরা মানুষ বা পশুর মাংসই খায়, তাই নয়; তারা দল বেঁধে বুনো কুকুরদের মতো শিকারও করে। যদিও শিকারের কায়দাটা অন্যরকম। তাই আফ্রিকান হায়নারা সিংহের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়। খুব সাবধানে বন্দুকের ট্রিগার-গার্ডে আঙুল ছুঁইয়ে আস্তে-আস্তে গাড়ির দিকে এগোতে লাগলাম।

গাড়ির দরজাটা আস্তে করে খুলে, দরজাটা বন্ধ না করে লাগিয়ে রাখলাম। যাতে, শব্দ না হয় কোনো। তারপর অন্ধকারেই সুইচটার সঙ্গে চাবি আছে কি না হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে দেখলাম।

একবার খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকাল। ড্যাশবোর্ডের আলো জ্বালিয়ে তেল দেখলাম। আমার গলা শুকিয়ে গেল। তেল একেবারেই নেই। পিছনের জ্যারিকেনে হয়তো আছে, যদি-না ওরা তা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে; কিন্তু এখন তো তেল থাকলেও ঢালা যাবে না! ড্যাশবোর্ডের আলো জ্বালাবার পরই আমার খেয়াল হল যে, ওই আলোর সঙ্গে সাইড লাইটও নিশ্চয়ই জ্বলে উঠেছিল বাইরে। ওরা তাহলে জেনে গেছে যে, গাড়িতে কেউ ঢুকেছে।

আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাল। আমি মাথা নামিয়ে নিলাম। ঠিক এমনি সময়ে গাড়ির নীচ থেকেই যেন সেই দুপুরে শোনা শব্দটা আবার শুনলাম, হিসসসস। যেন গাড়ির টায়ার পাংচার হল। আমি চমকে উঠলাম। বন্দুকটা শক্ত করে ধরলাম। জানোয়ারটা যে কী তা ঋজুদা একবারও বলেনি। দৈত্য-দানো নয় তো! গুগুনোগুম্বার বা ওগরিকাওয়া বিবিকাওয়া কোনো আশ্চর্য জানোয়ারের রূপ ধরে আসেনি তো এই দুযোগের রাতে?

এখন গাড়ি চালিয়ে চলে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। জেরিক্যান থেকে তেল ঢাললেও শব্দ হবে অনেক। কী করব বুঝতে না পেরে আমি সামনের উইন্ডস্ক্রীনের নবটা ঘুরিয়ে যাতে বন্দুকের নল বের করা যায় ততটুকু তুলে, চুপ করে বসে রইলাম। এবারে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করল ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছিল। একবার খুব জোর করে বিদ্যুৎ চমকাল। আর আমি মাথা নামানোর আগেই দেখলাম, চারজন লোক গাড়ির বেশ কাছে চলে এসেছে। ওরা দৌড়ে আসছে নিঃশব্দে।

বন্দুকের নলটা বাইরে বের করে বাঁ হাতের তেলোর উপরে রাখলাম; যাতে শব্দ না হয়। ট্রিগার-গার্ডেও হাত ছুঁইয়ে রইলাম।

বিদ্যুতের আলোতে দেখেছিলাম যে, ওদের তিনজনের হাতে তীর-ধনুক ও একজনের হাতে বন্দুক আছে। ওদের দেখে হায়নাগুলো আবার ডেকে উঠল। কিন্তু ভোজ ছেড়ে নড়ল না।

ওরা আরও একটু কাছে আসুক, একেবারে সিওর রেঞ্জের মধ্যে, আমি ব্যারেল ঘুরিয়ে একসঙ্গে দুটি ব্যারেলই ফায়ার করব।

সাঁত করে হঠাৎ একটা শব্দ শুনলাম। একটা হায়না সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। বুঝলাম, বিষের তীর ছুঁড়ছে ওয়াণ্ডারাবোরা। সঙ্গে-সঙ্গে অন্যান্য হায়নাগুলো পড়ি-কি-মরি করে পালাল। লোকগুলো প্রায় এসে গেছে, ঠিক সেই সময় হিসসসস শব্দটা আবার শুনলাম গাড়ির তলা থেকে। তারপরই কিছু বোঝার আগেই লোকগুলো চোঁ-চা দৌড় লাগাল যে দিক থেকে এসেছিল সেই দিকে। আর গাড়ির তলা থেকে একটা কিছু যেন ব্যালস্টিক মিসাইলের মতো গতি আর শব্দে লোকগুলোর দিকে ধেয়ে গেল।

কী যে হল, কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি।

লোকগুলো ভয় পেয়ে শোরগোল করে উঠল। এবং অন্ধকারের মধ্যেও শব্দ শুনে মনে হল, যেন ওদের মধ্যে একজন ধুপ করে পড়ে গেল মাটিতে। অন্যরা কিন্তু দৌড়েই চলে যেতে লাগল। এদিকে আর এলই না। মিনিট দশেক পরেই গভীর বৃষ্টিভেজা অন্ধকারে জঙ্গলের দিক থেকে একটা রাইফেলের আওয়াজ পেলাম। এবং তার একটু পরই একটা গাদা-বন্দুকের আওয়াজ। তারপরই সব চুপচাপ।

ঋজুদার কি কিছু হল?

আধ ঘন্টা, এক ঘন্টা, দুঘন্টা কাটল! ওদিক থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। এমনি সময় হঠাৎ গাড়ির পিছন দিক থেকে হাতির ডাক শুনতে পেলাম, প্যাঁ-এ-এ-এ করে।

আমি মুখ ফিরিয়ে পিছন ফিরে দেখি আমার পিছনে স্লেট-কালো ভেজা আকাশের পটভূমিতে একটা ঘন কালো চলমান পাহাড়শ্রেণী এগিয়ে আসছে। ওদিকে গুলির শব্দের পর ঋজুদারও কোনো খবর নেই। এদিকে আমার এই অবস্থা! গাড়িটা যদি দুমড়ে মুচড়ে খেলনার মতো ভেঙে দিয়ে যায় তাতেও কিছু করার নেই। আমি ভয়ে আর পিছনে তাকালামই না। সামনে তাকিয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম। এই শটগান দিয়ে হাতিদের সামনে কিছুই করার নেই। আমার সামনে গুলি খেয়ে মরা দু-দুটো মানুষ পড়ে আছে। তাদের ফুলে-ওঠা মৃতদেহ হায়নারা খেয়ে গেছে খুবলে খুবলে। আরেকটা মানুষ পড়ে গেছে আরো সামনে। সে কেন পড়ল, বেঁচে আছে কি না তাও জানি না। কী জিনিস যে গাড়ির তলা থেকে ছুটে গেল তাও অজানা। যে হিসসসস শব্দ করেছিল, সেই কি? জানোয়ারটা কী? তাদেরই মধ্যে পড়ে আছে বিষ-তীর-খাওয়া একটা হায়না। আর পিছনে ছুটে আসছে হাতির দল।

আশ্চর্য! হাতিগুলো গাড়িটাকে মধ্যে রেখে দুপাশ দিয়ে আমার সামনে এল। সমস্ত দিক গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেল। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। উইন্ডস্ক্রীনের সামনেই যে হাতিটা দাঁড়িয়ে ছিল সেটা একটা দাঁতাল। তার দাঁতটা এত বড় যে, গাড়ির ছাদটা সেই দাঁতের মাঝামাঝি পড়ছিল। নীচে প্রায় মাটিতে লুটোচ্ছিল সেই দাঁত। আমার মনে হল, ঐ হাতিটা যে-কোনো চকমিলানো দোতলা বাড়ির সমান।

হাতির দল নানারকম শব্দ করছিল শুঁড় দিয়ে–ফোঁসফোঁস, ফোঁ ফাঁ করে। শুঁড় হেলাচ্ছিল, দোলাচ্ছিল। গাড়ির বনেট আর উইন্ডস্ক্রীন আর ট্রেলারের উপরে শুড় বোলাচ্ছিল। মিনিট দশেক তারা গাড়িটাকে এরকম করতে থাকল। ভাগ্যিস নাইরোবি সর্দারের কলা আর পেঁপে শেষ হয়ে গেছিল, নইলে মুশকিল ছিল আমার। ভুষুণ্ডা আর টেডির উগালির ভুট্টা ও আমাদের চালডালও সব তাঁবুতেই পড়ে আছে। ওসব খাবার যদি ট্রেলারে থাকত, তবে খুবই বিপদ হত।

এর পরই একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হল। হাতিগুলো ঐ লোকগুলোর মৃতদেহ দুটি শুঁড়ে তুলে নিয়ে লোফালুফি করতে লাগল। করতে করতে ক্রমশই সামনের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। যত দূরে যেতে লাগল গাড়ি থেকে, ততই তাদের পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। বৃষ্টির মধ্যে তাদের জলে-ভেজা যুদ্ধজাহাজের মত শরীরগুলো বিদ্যুতের আলোয় চকচক করে উঠছিল।

ঘটনার পর ঘটনাতে স্তম্ভিত মন্ত্রমুগ্ধ আমি ভাবছিলাম, এ সবই হয়তো খনভামের কীর্তি। নইলে কেন হাতিগুলো আমার কোনো ক্ষতি করল না। তার বদলে, যে-বীভৎস দৃশ্য আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হচ্ছিল না, তারা সেই দৃশ্যও আমার চোখের সামনে থেকে শুঁড়ে-শুঁড়ে সরিয়ে নিয়ে গেল কেন?

.

গাড়ির মধ্যে বসে-বসে ঘুম পেয়ে গেল। এত বেশি উত্তেজিত ও ক্লান্ত ছিলাম যে, খিদের কথা মনেও এল না। ওয়াটার বটল থেকে একটু জল খেলাম, তারপর নিজের জীবনের, ঋজুদার জীবনের সব দায়িত্ব খনভাম-এর উপর চাপিয়ে দিয়ে পা-ছড়িয়ে, বন্দুকটার নল বাইরে করে বসে রইলাম, টুপিটা চেপে মাথায় বসিয়ে। গাড়ির ভিতরটাই এত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে, ফ্রিজ-এর মধ্যে বসে আছি। বাইরে না জানি আজ কী ঠাণ্ডা! ঋজুদা এখন কী করছে, বেঁচে আছে কি না কে জানে? ঋজুদা যদি কাল সকালবেলাতে ফিরে না আসে, তাহলে আমি কী করব, কী কী করা উচিত–ভাবতে পারছিলাম না। কিন্তু ভাবতে হচ্ছিল।

এবারে পর-পর যেসব ঘটনা ঘটল, চোখের সামনে যত মৃত্যু ঘটতে দেখলাম, এবং আশ্চর্য–নিজেও ঘটালাম, এর পর ঋজুদা অথবা আমি মরে গেলেও অবাক হবার কিছু নেই।

দেখতে-দেখতে চোখের সামনে ভোর হয়ে এল। বনে-জঙ্গলে, নদীতে-পাহাড়ে সূর্য-আসা আর সূর্য-যাওয়া প্রতিদিনের যে কত বড় দুটি ঘটনা যাঁদের চোখ-কান আছে তাঁরাই জানেন। কত আশ্চর্য রঙের হেরি-খেলা, কত রাগ-রাগিনীর আলাপ, কত শিল্পীর তুলির আঁচড়, কত শান্ত নরম, আলতো গন্ধ সব মিলিয়ে-মিশিয়ে যিনি সব গায়কের গায়ক, সব শিল্পীর শিল্পী, সব সুগন্ধের গন্ধরাজ, তিনিই এই পৃথিবী-ঘরের বাতি নেভান, বাতি জ্বালান। ঘরের বাইরে এলেই, দেশে এবং এই বিদেশেও তাঁকেই দেখি, দেখতে পাই। ঋজুদা যেমন আমাকে শিখিয়েছে, তেমনই আমি আকাশ বাতাস জল স্থল পাখি হরিণ মানুষ ফড়িং–এই সবের মধ্যেই তাঁকে দেখি।

ভোর হয়েছে কিন্তু সূর্য এখনও মেঘে ঢাকা। অন্ধকার কেটেছে প্রায় পনেরো মিনিট। ঋজুদা তবু এল না। এবার যা করার নিজেকেই বুদ্ধি করে করতে হবে। কম্যাণ্ডারের এতক্ষণে ফিরে আসা উচিত ছিল।

গাড়ির দরজা খুলে চাবিটা পকেটে নিলাম। এই চাবি হাতছাড়া করাতেই ভুষুণ্ডা এমন একটা লং-রোপ পেয়ে গেছিল। লোডেড বন্দুক কাঁধে আবার জঙ্গলের দিকে চলতে লাগলাম। কাল যেখান দিয়ে বেরিয়েছিলাম সেই দিকে। সাবধানে জঙ্গলের কিনারা, কিনারার আশেপাশের গাছ ইত্যাদি দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল কতগুলো শকুন উড়ছে বসছে, কামড়া-কামড়ি করছে রেড-ওট ঘাসের বন যেখানে ঢালু হয়ে জঙ্গলে নেমেছে সেইখানে।

আমার বুকটা ধক্ করে উঠল। কী দেখব কে জানে?

আর একটু এগোতেই দেখি, কালকে হাতিরা সেই মৃতদেহগুলিকে এখানে এনে ফেলেছে আর শকুনরা ভোজে লেগেছে, হায়নাদের পর।

তাড়াতাড়ি সরে এলাম। সরে আসার সময় লক্ষ করলাম যে, কালকে যে কোপিটা দেখেছিলাম তার উপরেও দুটো শকুন উড়ছে চক্রাকারে। ঐদিকে চেয়ে আমার মন যেন কেমন করে উঠল। এমনই করে। যাঁরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরেন, তাঁরা জানেন একেই বলে সিক্সথ সেন্স। এর কোনো ব্যাখ্যা নেই; ব্যাখ্যা হয় না।

আমি আস্তে-আস্তে কোপির দিকেই চলতে লাগলাম। সামনের বনে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা। মনে হচ্ছে, মৃত হাত বুলিয়ে গেছে এর উপর। কতগুলো বেবুন চিৎকার করছে আর একদল ব্যাবলার ও থ্র্যাশার সরগরম করে রেখেছে জঙ্গল, বৃষ্টি ধরে যাওয়ার আনন্দে।

কোপির নীচে পৌঁছেই আমি চমকে উঠলাম। চাপ-চাপ রক্ত পড়ে জমে রয়েছে পাথরের উপর। তারপর রক্তের ছড়া চলে গেছে ভিতরে। বৃষ্টিতে যা ধুয়ে গেছে তা গেছে খোলা জায়গায়। যা ধোয়নি তা জমে আছে।

রক্তের দাগ দেখে উপরে উঠতে লাগলাম। একটু গিয়েই, যে সার্ডিনের টিন খুলে আমরা কাল দুপুরে গাছের উপর বসে খেয়েছিলাম, সেই খালি টিনটা উল্টে পড়ে আছে দেখলাম। শকুনগুলো ঘুরে-ঘুরে উড়ছিল উপরে।

আমি বন্দুকটা সামনে ধরে, একটা বড় পাথরের আড়ালে শরীরটা লুকিয়ে ডাকলাম, ঋজুদা! ঋজুদা।

কোনো উত্তর পেলাম না। কিন্তু ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেল ঋজুদা কি…? নাকি ভুষুণ্ডাদের ডেরায় এসে পড়েছি আমি?

এমন সময় কারা যেন আসছে উপর থেকে শুনলাম। জুতো পায়েও নয়, খালি পায়েও নয়; যেন নুপুর পায়ে কারা নেমে আসছে। আরও ভয় পেয়ে গেলাম আমি। এ কী ব্যাপার। বন্দুকটা ওদের আসার পথে ধরে আমি তৈরি হয়ে রইলাম। ঠিক সেই সময় পাঁচটা আফ্রিকান স্ট্রাইপড জ্যাকেল একসঙ্গে হুড়োহুড়ি করে নেমে এল উপর থেকে। ওদের পায়ের নখের শব্দ পাথরের উপর ঐরকম শোনাচ্ছিল।

আমাকে দেখতে পেয়েই দুটো শেয়াল দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এল। পাছে গুলি করলে শব্দ হয়, তাই ট্রিগার গার্ডে হাত রেখে ব্যারেল দিয়ে গুঁতো দিলাম ওদের। তাতেও কাজ না হলে গুলি করতে বাধ্য হতাম।

গ-র-র–গরররর করতে করতে ওরা নেমে গিয়ে পাথরের আড়ালে যেখানে রক্ত জমে ছিল, সেইখানে হুড়োমুড়ি করে চাটতে লাগল।

আমি আরও এক ধাপ উঠে গিয়ে ডাকলাম, ঋজুদা! তুমি সাড়া দাও। ঋজুদা!

এমন সময় মনে হল কেউ বলল, আমি। আয়।

এত ক্ষীণ যে, ভাল করে শুনতে পেলাম না। মনে হল ভুল শুনলাম না তো!

আবারও যেন শুনলাম, আয়

একপাশে ঘেঁষে, বন্দুক রেডি করেই, পাথরটা টপকে বাঁক নিলাম। নিয়েই…

ঋজুদার বাঁ পায়ে ঊরুর কাছে গুলি লেগেছে। গাদা বন্দুকের গুলি। বড় সীসার একটা তাল। পায়ের হাড় ভেঙে গেছে কি না কে জানে! রক্তে সারা জায়গাটা থকথক করছে। ঋজুদার ঠোঁট ফ্যাকাসে নীলচে। আমাকে দেখে আমার দিকে হাত তুলল। আমি হাতটা হাতে নিয়ে খুব করে ঘষে দিলাম। তারপর বললাম, ভুষুণ্ডা?

ঋজুদা ডান হাতটা তুলে হাতের পাতাটা নাড়ল।

ফাস্ট-এইড বাক্সটা হ্যাভারস্যাক থেকে বের করে ডেটল আর মারকিওক্রোমের শিশি আর তুলো বের করতে করতে বললাম, ডেড?

ঋজুদা ফিসফিস করে বলল, পালিয়ে গেছে। আমি মিস করেছিলাম। এত অন্ধকার হয়ে গেল! মিস করলাম।

ভুষুণ্ডা কোথায়? আমি শুধোলাম।

ঋজুদা বলল, বোধহয় চলে গেছে। চলে না গেলে ও আমাকে শেষ করে যেত। ওর গুলিতে আমি যে পড়ে গেছি, তা ও দেখেছে।

আমি যখন ঋজুদার ট্রাউজারটা কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলে ঋজুদাকে ড্রেস করছিলাম, তখন ঋজুদা আমার এল-জি ভরা বন্দুকটা দুহাতে ধরে পাথরের পথের দিকে চোখ রাখছিল।

আমি বললাম, শেয়ালরা তোমাকে কিছু করেনি তো?

নাঃ। তুই না এলে করত হয়তো। শকুনরাও করত। ওরা ঠিক টের পায়।

পা-টা একেবারে থেঁতলে গেছে গুলিতে। কত যে টিসু আর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে তা ভগবানই জানেন। আধঘন্টা লাগল ঋজুদাকে ড্রেস করতে। তারপর দুটো কোডোপাইরিন খাইয়ে বললাম, ঋজুদা, তুমি এখানে থাকো। আমি গাড়িতে জেরিক্যান থেকে তেল ভরে, গাড়িটা কোপির যত কাছে আনতে পারি তত কাছে এনে তোমাকে তুলে নেব।

ঋজুদা বলল, ভুষুণ্ডা যদি চলে না গিয়ে থাকে তবে তো গাড়ির আওয়াজ শুনেই এসে তোকে মারবে।

আমি বললাম, এখন তো আর রাত নয়, দিন। আমি তোমার থার্টি-ও-সিক্স রাইফেলটা নিয়ে যাচ্ছি। এখানে শর্ট রেঞ্জে বন্দুক অনেক বেশি এফেকটিভ। দুব্যারেল এল-জি পোরা থাকল। তুমি এটা বুকের উপর নিয়ে শুয়ে থাকো।

ঋজুদার হ্যাভারস্যাকটাকে ঠিকঠাক করে বালিশের মতো করে দিলাম। তাতে একটু আরাম হল। তারপর রাইফেলের ম্যাগাজিন ভর্তি করে চেম্বারেও একটা গুলি ঠেলে দিয়ে সেফটি ক্যাচে হাত রেখে আমি নেমে গেলাম।

নিজের অজান্তে আমার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল। চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগল। না-ঘুমোবার জন্যে নয়, প্রতিহিংসায়। তারপরই চোখ দুটি ভিজে এল আমার। ঋজুদার সামনে পারিনি। ঋজুদা কষ্ট পেত।

এখন পরিষ্কার দিনের আলো। আজ সকালে ভুষুণ্ডা যদি পাঁচশো গজের মধ্যেও তার চেহারা একবার আমাকে দেখায় তাহলে অস্ট্রিয়ায় তৈরি এই ম্যানকিলার শুনার রাইফেলের সফট-নোজড গুলি তার বুকের পাঁজর চুরমার করে দেবে। ঋজুদার কাছে রাইফেল চালানো কতটুকু শিখেছি তার পরীক্ষা হবে আজ।

কোপি থেকে নামতে নামতে দাঁতে দাঁত চেপে আমি বললাম, ভুষুণ্ডা! তোমার আজ শেষ দিন।

ফাঁকায় বেরিয়ে আমি হরিণের মতো দৌড়ে যেতে লাগলাম গাড়ির দিকে। হরিণ যেমন কিছুটা দৌড়ে যায়, তারপর থেমে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, আমিও সেরকম করছিলাম। অবশ্য শিকারী ঠিক ঐ থমকে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই হরিণকে গুলি করে। ভাবছিলাম, ভুষুণ্ডা যদি এখনও থেকে থাকে তাহলে গুলি করে আমাকে আবার হরিণ না বানিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন বন্দুকের ও তীরের পাল্লার বাইরে চলে গেলাম, তখন হেঁটে যেতে লাগলাম পিছনে তাকাতে তাকাতে।

রাইফেলটাকে গাড়ির বনেটের উপর শুইয়ে রেখে পিছনে গিয়ে দুটি জেরিক্যান থেকে তেল ঢাললাম ট্যাঙ্কে। মাঝে-মাঝেই ঐদিকে দেখছিলাম। নাঃ। কোনো লোকজনই নেই।

রাইফেলটা ভিতরে তুলে নিয়ে, সুইচ টিপতেই গাড়ি কথা বলল। বড় মিষ্টি লাগল সেই কথা! তারপর গীয়ারে ফেলে এগিয়ে চললাম কোপিটার দিকে। কাছে গিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে রাখলাম। ট্রেলার থাকলে গাড়ি ব্যাক করতে ভারী অসুবিধা হয়।

ভাল করে চারপাশ দেখে নিয়ে রাইফেল হাতে দৌড়ে উঠে গেলাম। গিয়ে দেখি, ঋজুদা নিজেই ওঠবার চেষ্টা করছে, কিন্তু চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গেল। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল মুখ।

আমি বললাম, কী করছ? চলো, আমার কাঁধের নীচে তোমার পিঠটা লাগাও। বলে, ঋজুদাকে কাঁধের ওপর নিয়ে খুব সাবধানে নামতে লাগলাম। ঐ অবস্থাতেও ঋজুদা শটগানটা দুহাতে ধরে ব্যারেলটা সামনে করে রাখল।

কোপির নীচে এসে দেখলাম, নাঃ, কেউ কোথাও নেই। ঋজুদাকে গাড়ি অবধি নিয়ে বাঁ দিকের দরজা খুললাম। কিন্তু ঋজুদা বলল, আমি তো বসতে পারব না ঐভাবে!

তবে? কোথায় বসলে সুবিধে হবে তোমার?

ঋজুদা বলল, আমি তো এখন একটা বোঝা। যার নিজের হাত-পায়ে জোর নেই, সে বোঝা ছাড়া কী? আমাকে ট্রেলারের উপর উঠিয়ে দে। টেলারে শুয়ে গেলেই যেতে পারব।

আমি বললাম, সে কী? ধুলো লাগবে, ঝাঁকুনি লাগবে। ঝাঁকুনিতে আরও রক্ত বেরোবে।

ঋজুদা হাসবার চেষ্টা করল। বলল, উপায় কী বল? নইলে তো আমাকে এখানে রেখে তোর একাই চলে যেতে হয়। এই ভাল, রোদ পোয়াতে-পোয়াতে, ঘুমোতে-ঘুমোতে দিব্যি যাব।

আমি পিছনের সীট খুলে তার গদি দুটো এনে ট্রেলারের মালপত্রের উপরে পেতে দিলাম। তারপর ঋজুদাকে যতখানি আরাম দেওয়া যায় দিয়ে গুলিভরা শটগান, জলের বোতল, ব্রাণ্ডির বোতল, হ্যাভারস্যাক সব হাতের কাছে রেখে, রাইফেলটা নিয়ে আমি ড্রাইভিং সীটে উঠে বসলাম।

গাড়ি স্টার্ট করে, একটু পরই টপ-গীয়ারে ফেলে দিলাম, যাতে তেল কম পোড়ে। কিন্তু ঋজুদার যাতে কম ঝাঁকুনি লাগে সেই জন্যে খুব সাবধানে আস্তেই চালাতে লাগলাম।

সামনে যতদূর চোখ যায় ঘাসবন। এখন মেঘ কেটে গেছে। পনেরো ডিগ্রী ইস্ট এবং ডিউ সাউথ-এর বেয়ারিং নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি। মাঝে-মাঝে কম্পাস ও ম্যাপ দেখছি।

জঙ্গলে এসে ল্যাণ্ড-রোভার বা জীপে বা গাড়িতে সামনের সীটে আমি একা এই প্রথম। হয় ঋজুদা চালায়, আমি পাশে বসি, নয় আমি চালাই, ঋজুদা পাশে বসে। আজ ঋজুদা ট্রেলারে শুয়ে আছে। খুব তাড়াতাড়ি কোনো ভাল হাসপাতালে ঋজুদাকে দেখাতে না পারলে গ্যাংগ্রিন সেট করে যাবে। পা-টা হয়তো কেটে বাদই দিতে হবে। কে জানে? ঋজুদা, লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, ভাবাই যায় না। ঋজুদাকে বাঁচানো যাবে না আর?

আমি আর ভাবতে পারছিলাম না।

মাঝে একবার গাড়ি থামিয়ে ঋজুদার পা আবার ড্রেসিং করে দিলাম। ট্রেলারের ঝাঁকুনিতে বেশ রক্ত বের হচ্ছে। মুখে কিছু বলছে না ঋজুদা, কিন্তু মুখের চেহারা দেখেই বুঝছি যে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। গায়ে হু-হু করছে জ্বর। চোখ দুটো জবাফুলের মতো লাল। ট্রেলারের উপর সবুজ কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে তবুও আমার সঙ্গে দু-একটা রসিকতা করতে ছাড়ছে না।

ম্যাপটা একবার দেখিয়ে নিলাম ভাল করে। যদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে তবে কে আমাকে গাইড করবে!

ঋজুদা বলল, ঠিকই যাচ্ছিস। আমরা তো আর তাঁবুগুলো কালেক্ট করতে আগের জায়গায় যাব না–সোজাই চলে যাব। যাতে গোরোংগোরা-সেরোনারার মেইন রাস্তাতে পড়তে পারি।

তারপর বলল, তাঁবুগুলো তুলতে মোট দশ মাইল মতো ঘোরা হত, কিন্তু ওখানে আমার অবস্থার কারণ ছাড়াও অন্য কারণেও যাওয়া ঠিক নয়। ওয়াণ্ডারাবোরা যে আবার ওখানে ফিরে এসে ম্যাসাকার শুরু করেনি তা আমরা জানছি কী করে?

দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম ও ঋজুদার পরিচর্যার জন্য থামলাম আর-একবার। ঋজুদার গায়ে জ্বর, তবু আমি চীজ দিয়ে চায়ের বিস্কুট, মালটি-ভিটামিন ট্যাবলেট আর ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলাম ওকে।

ট্রেলারের তলায় হেলান দিয়ে উদাস চোখে দূরে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

হঠাৎ ঋজুদা গায়ে অত দিয়ে বলল, কী ভাবছিস? আমি মরে যাব? দূর বোকা! আমি যখন মরব, তখন আমার সুন্দর দেশেই মরব। বিদেশে মরতে যাব কোন দুঃখে। তাছাড়া, এখন মরলে তো চলবে না আমার রুদ্র। ভুষুণ্ডার অ্যাকাউন্ট সেটল করতে আমাকে আবার আফ্রিকাতে আসতেই হবে। হয়তো এখানে নয়, অন্য কোনোখানে। সেবার একেবারে একা-একা শুধু ভুষুণ্ডার সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই আসতে হবে। আফ্রিকার যে-প্রান্তেই সে থাক না কেন, খুঁজে বের করতেই হবে। তা যদি না পারি, তাহলে হেরে গিয়ে হেরে থেকে বেঁচে লাভ কী? সে বাঁচা কি বাঁচা?

আমি বললাম, সেবার আমাকে সঙ্গে আনবে তো?

ঋজুদা হাসল। বলল, পরের কথা পরে। এখন ভাল করে খেয়ে নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট কর। পা-টা যদি কেটে বাদই দিয়ে দেয়, তাহলে তো তোর উপর নির্ভর করতেই হবে। আর সেইজন্যেই কি মতলব করছিস যে, সাধের পা-টা আমার বাদই যাক?

আমি ঋজুদার পাইপটা ভাল করে পরিষ্কার করে ভরে লাইটারটা হাতের কাছে দিয়ে সামনে যেতে-যেতে বললাম, আচ্ছা ঋজুদা, আমরা যখন কাল দুপুরে ঐ দোলামতো জায়গাটাতে বসেছিলাম তখন হিসসসস করে খুব জোরে কী একটা জানোয়ার ডেকেছিল? তুমি আমাকে গুলি বদলাতে বলেছিলে, মনে আছে?

ঋজুদা পাইপে আগুন জ্বালাতে-জ্বালাতে বলল, আছে। ঐ আওয়াজের মতো ভয়ের জিনিস আফ্রিকার বনে-জঙ্গলে খুব কমই আছে। এক ধরনের সাপ। প্রকাণ্ড বড়, আর বিষধর। নাম গাব্বুন ভাইপার। আমাদের দেশের শঙ্খচূড়ের চেয়েও মারাত্মক। যদি কাউকে কামড়াবে বলে ঠিক করে, তাহলে দুমাইল যেতেও পিছপা হয় না। অনেকখানি উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে ছোবল মারে।

আমার গা শিরশির করছিল, তখন মনে পড়েছিল যে, ঐ সাপকেই গাড়ির নীচে নিয়ে আমি কাল রাতে অতক্ষণ ছিলাম। ঋজুদাকে বললাম, কী করে সাপটা আমাকে বাঁচিয়েছিল আক্রমণকারীদের হাত থেকে।

ঋজুদা সব শুনে খুবই অবাক হল।

আমি স্টীয়ারিং-এ গিয়ে বসলাম।

এখন দুপাশে আবার অনেক জানোয়ার দেখা যাচ্ছে। শ’য়ে শ’য়ে থমসনস ও গ্রান্টস গ্যাজেল, টোপি, ওয়াইন্ডবীস্ট, ওয়ার্টহগস, জেব্রা। জিরাফ আর উটপাখি কম।

খুব বড় একদল মোষের সঙ্গেও দেখা হল। আফ্রিকাতে বলে, ওয়াটার বাফেলো। জলে-কাদায় ওয়ালোয়িং করে ওরা। সব দেশের মোষই করে। বিরাট দেখতে মোষগুলো গায়ের রঙ বাদামি কালো। মোটা মোটা ঘন লোম। তবে শিংগুলো আমাদের দেশের জংলি মোষের মতো অত ছড়ানো নয়।

মাঝে-মাঝে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখছি। ঋজুদা ঠিক আছে কি না। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বাঁ হাতটা চোখের উপরে রেখে চোখ আড়াল করে ডান হাতে বন্দুকটার স্মল অব দ্যা বাট ধরে শুয়ে আছে ঋজুদা। খাওয়ার সময় জ্বরটা বেশ বেশি দেখেছিলাম। যে-চরিত্রের লোক ঋজুদা, যতক্ষণ না অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ নিজে মুখে একবারও বলবে না যে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। জ্বর আরো বেড়েছে।

বড় অসহায় লাগছে আমার। আজ সন্ধে অবধি গাড়ি চালানোর পর কাল কতখানি তেল অবশিষ্ট থাকবে জানি না। আর জেরিক্যান নেই। কী হল তা ভুষুণ্ডাই বলতে পারে। যে বেয়ারিং-এ যাচ্ছি তাতে গোরোংগোরো আগ্নেয়গিরি আর সেরোনারার মধ্যের পথটার কাছাকাছি আমাদের পৌঁছে যাওয়ার কথা। এখন কী হবে, কে জানে? ঋজুদাকে তাড়াতাড়ি কোনো হাসপাতালে না নিয়ে যেতে পারলে বাঁচানোই যাবে না। আর কিছুক্ষণ পর থেকেই গ্যাংগ্রিন সেট করবে।

স্টীয়ারিং ধরে সোজা বসে আছি। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ঘুমে। কাল রাতে ঘুম হয়নি সামান্য তন্দ্রা এসেছিল শুধু শেষ রাতে। মারাত্মক ভুল। সেই তাকেই চিরঘুম করে দিতে পারত ভুষুণ্ডা। কী পাজি লোকটা। কে ভেবেছিল ও অমন চরিত্রের মানুষ? কেবলই ভুষুণ্ডার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আমার। আর টেডি? হ্যাঁ, টেডির মুখটাও। ওর মুখের উপর এখন অনেক মাটি!

ঘন্টাদুয়েক চলার পর একবার দাঁড়িয়ে পড়ে ঋজুদাকে দেখে নিলাম। চুপ করে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। কাছে গিয়ে বললাম, কেমন আছ ঋজুদা?

ঋজুদা চোখ খুলে হাসল একটু। বলল, ফাইন।

তারপরই বলল, চল রুদ্র। জোরে চল। থামলি কেন?

আমি দুটো ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিলাম ঋজুদাকে। তারপর আবার স্টীয়ারিং-এ বসলাম। ভয়ে আমার তলপেট গুড়গুড় করতে লাগল। ঋজুদা একেবারেই ভাল নেই। নইলে আমাকে জোরে চলার কথা বলত না। পা-টার দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ চলার পর ঠক করে একটা আওয়াজ শুনলাম উইন্ডস্ক্রীনের বাইরে। তারপরই ভিতরে। দুটো সেৎসী মাছি ঢুকে পড়েছে। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে আমার টুপি দিয়ে ও দুটোকে মারতে যাব ঠিক এমন সময় পিছন থেকে ঋজুদার গলা শুনলাম যেন। যেন আমাকে ডাকছে!

তাড়াতাড়ি গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দৌড়ে যেতেই ঋজুদা বলল, রুদ্র, রুদ্র, তাড়াতাড়ি আয় বলেই উঠে বসার চেষ্টা করে পড়ে গেল।

আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। জানোয়ারের সঙ্গে বন্দুক-রাইফেল নিয়ে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু এদের সঙ্গে আমি কী করে লড়ব? রক্তপিশাচ মাছিগুলো। থিকথিক করছে ঋজুদার পায়ে। আর শুঁড় ঢুকিয়ে রক্ত টানছে।

আমাকে একটাই কামড়েছিল ঐ মাছি। যখন হুলটা ঢোকায়, তখন সাংঘাতিক লাগে, তারপর মনে হয়, কেউ সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে রক্ত টানছে। কামড়াবার অনেকক্ষণ পর অবধি জায়গাটা জ্বালা করতে থাকে অসম্ভব। একটা মাছি! আর এখানে অগুনতি।

আমি পাগলের মতো করতে লাগলাম। হাত দিয়ে, টুপি দিয়ে যা পারি, তাই দিয়ে। কিন্তু ওরা ঠিকই বলেছিল, সেৎসীদের দশটা জীবন। আমাকেও কামড়াতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আমিও অজ্ঞান হয়ে যাব। আর ঋজুদার যে কী হচ্ছে তা সে নিজেও হয়তো জানে না।

হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। গাড়ির পিছনের সীটে টেডির বিরাট মাপের ডিসপোজালের ওভারকোটটা পড়েছিল। দৌড়ে গিয়ে ওটা নিয়ে এলাম। তারপর কোমরের বেল্ট থেকে ছুরি দিয়ে চেঁছে ফেলে, টুপি দিয়ে হাওয়া করতে করতে ঋজুদাকে ওভারকোটটা দিয়ে ঢেকে দিলাম পুরো। ঢাকবার সময় লক্ষ করলাম, ঋজুদার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে।

বললাম, ঋজুদা, কেমন আছ?

ঋজুদা প্রথমে উত্তর দিল না। তারপর অনেকক্ষণ পর, যেন অনেকদূর থেকে বলল, ফাইন।

তাড়াতাড়ি দুহাত এলোপাতাড়ি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমি স্টীয়ারিংয়ে বসে যত জোরে গাড়ি যেতে পারে তত জোরে অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিলাম। ভয় ছিল, ঝাঁকুনিতে ঋজুদা ট্রেলার থেকে পড়ে না যায়। কী ভাবে যে গাড়ি চালাচ্ছি তা আমিই জানি। এত মাছি ঢুকে গেছে। কিন্তু ঐ মাছির এলাকা না পেরোলে আমরা এদের হাতেই মারা পড়ব।

আধ ঘন্টা জোরে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে থামলাম। প্রথমে গাড়ির মধ্যে যে কটা মাছি ঢুকে আমাকে আক্রমণ করেছিল তাদের মারলাম। শুধু মারলামই না। এদের কামড়ে এতই যন্ত্রণা হয় যে, সত্যিই এদের মেরে ধড় থেকে মুণ্ডুটা টেনে আলাদা না করলে, মনে হয় প্রতিহিংসা ঠিকমতো নেওয়া হল না। এখন বুঝতে পারছি, কেন এই হাজার-হাজার মাইল ঘাসবন এমন জনমানবশূন্য। এখানকার জংলি জানোয়ারেরা আদিমকাল থেকে এখানে থাকতে থাকতে এই মাছিদের কামড়ে ইমিউন্ হয়ে গেছে। প্রকৃতিই ওদের এমন করে দিয়েছে, নইলে এখানে ওরা থাকত কী করে?

দরজা খুলে নেমে আবার ঋজুদার কাছে গেলাম। বোধহয় জ্ঞান নেই। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। বারবার ডাকলাম। অনেকক্ষণ পর যেন আমার নাম ধরে সাড়া দিল একবার।

আমি কী করব? এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে। এত জ্বরে ঋজুদা বাইরের ঠাণ্ডায় কী করে শোবে?

সেদিনকার মতো ঐখানেই থাকব ঠিক করলাম। এখন যা-কিছু করার, সিদ্ধান্ত নেবার, সব আমাকেই করতে হবে।

ঋজুদার গা থেকে টেডির ওভারকোট সরিয়ে দিলাম। চারটে মাছি তখনও তার নীচে ছিল। রক্ত খেয়ে ফুলে বোলতার মতো হয়ে গেছে প্রায়। সেই চারটেকে মারা কঠিন হল না। নড়বার ক্ষমতা ছিল না ওদের। আমি জ্যান্ত অবস্থাতেই ওদের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করলাম।

তারপর হাত ধুয়ে এসে ঋজুদার জন্যে খাবার বানাতে বসলাম। শক্ত কিছু খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। এদিকে গরম কিছু দেব তারও উপায় নেই। না আছে সঙ্গে স্টোভ, না কোনো জ্বালানি। ট্রেলারের কোণ থেকে একটা প্যাকিং বাক্স বের করে সেটাকে ভেঙে ঘাস পরিষ্কার করে একটু আগুন করলাম। কফির জল চাপিয়ে, তার মধ্যে ক্রীমক্র্যাকার বিস্কুট দিয়ে দিলাম গোটা ছয়েক। সেগুলো গলে গেলে তার মধ্যে এক চামচ কফি দিলাম। দুধ ছিল না। আমার হাভারস্যাকে যে ওষুধ-ব্র্যাণ্ডি ছিল তার চার চামক ঢেলে দিলাম সেই মগে। তারপর ভাল নেড়ে ঋজুদার কাছে গিয়ে তার মাথাটা কোলে নিলাম। ঋজুদা অনেক কষ্টে চোখ খুলল। বললাম, মাছিরা আর নেই। এবারে খেয়ে নাও।

ঋজুদা হাত নেড়ে অনিচ্ছা জানাল।

আমি ছাড়ালাম না। বললাম, খেতেই হবে। জোর করে মগটাকে ঠোঁটের কাছে ধরলাম।

একটু-একটু করে চুমুক দিতে দিতে ঋজুটা পুরোটা চোখ খুলল। খাওয়া শেষ হলে আমি তুলে বসালাম ঋজুদাকে। বললাম, পাইপ খাবে না? তুমি কতক্ষণ পাইপ খাওনি, ঐজন্যেই তো এত খারাপ লাগছে তোমার। যার যা অভ্যেস। আমি ভরে দেব?

ঋজুদা একটু হাসল। তারপর মাথা নাড়ল।

হাভারস্যাকের পকেট থেকে পাইপটা বের করে নতুন তামাকে ভরে দিলাম।

কয়েক টান দিয়েই ঋজুদাকে অনেক স্বাভাবিক দেখাল। হ্যাভারস্যাকে হেলান দিয়ে বসে বলল, পা-টা একটু তুলে দে তো রুদ্র।

তুলে দিলাম। ঋজুদা আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, জানিস, আমার বন্ধুরা বিয়ে করিনি বলে কত ভয় দেখিয়েছে। বলেছে-

কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল ঋজুদার। তবু টেনে টেনে বলল, বলেছে যে, আমাকে দেখার কেউ নেই। থাকবে না।

তারপর একটু পর বলল, ওরা ভুল। একেবারে ভুল।

দম নিয়ে পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে ঋজুদা বলল, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন যে, আত্মীয়তা দু’রকমের হয়। রক্তসূত্রের আর ব্যবহারিক সূত্রের। প্রথম আত্মীয়তার বাঁধনে কোনো বাহাদুরি নেই, চমক নেই। কেউ রাজার ছেলে, কেউ ভিখিরির মেয়ে। কিন্তু তোর-আমার আত্মীয়তার গর্ব আছে। তুই আমার জঙ্গলের বন্ধু। তুই আমার সেভিয়ার।

একটু দম নিয়ে বলল, বড় ভাল ছেলে রে তুই। বলে, আমার চুল এলোমেলো করে দিল বাঁ হাত দিয়ে।

আমার চোখ জলে ভরে এল। মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আমি।

তারপর আমিও খেয়ে নিলাম ঐ কফি আর বিস্কুট। ঋজুদা কথা বলছিল দেখে আমার খুব ভাল লাগছিল। খাওয়ার পর টেডির বড় ওভারকোটটার কোনায় ট্রেলারের ত্রিপলের দড়ি বেঁধে তাঁবুর মতো ঋজুদার মাথার উপরে টাঙিয়ে দিলাম, যাতে ঠাণ্ডা না লাগে রাতে।

পশ্চিমাকাশে শেষ-সূর্যের গোলাপি মাখামাখি হয়ে ছিল। দুটি ম্যারাবুও সারস উড়ে যাচ্ছিল ডানা মেলে। হলুদ-মাথা বড় বড় কতগুলো ফেজেন্ট দৌড়ে যাচ্ছিল সিঙ্গল ফর্মেশানে দূর দিয়ে। আমাদের ডান দিক থেকে সিংহের ডাক ভেসে এল কয়েকবার।

আজও রাত জাগতে হবে। ঋজুদার পাশে ট্রেলারের উপর মাঝে-মাঝে শুয়ে নেব। অন্য সময় গাড়ির চারপাশে পায়চারি করব। ঋজুদার পায়ের এই রক্তের গন্ধ হয়তো অনেক জানোয়ারকে ডেকে আনবে। সকালবেলার শেয়ালগুলোর মতন। বোধহয় শুক্লা অষ্টমী কি নবমী, চাঁদটা ভালই উঠবে সন্ধের পরে।

সূর্য ডুবে যেতেই রাইফেল ও বন্দুকে গুলি ভরে হাতের কাছে ঠিক করে রেখে ঋজুদাকে কম্বল মুড়ে ভাল করে শুইয়ে দিলাম আরো দুটো ঘুমের বড়ি খাইয়ে। আর কিছু দেবার মতো নেই। তার আগে পা-টা আবার ডেটল দিয়ে ধুইয়ে, ওষুধ লাগিয়ে দিলাম।

ঋজুদার এখন যা অবস্থা তাতে প্রয়োজন হলেও বন্দুক রাইফেল কিছুই ছুঁড়তে পারবে না। তাছাড়া একটু আগেই বন্দুক লোড করার সময় প্রথম জানতে পারলাম যে, গুলিও ফুরিয়ে এসেছে। অনেক গুলি তাঁবু থেকে ভুষুণ্ডা এবং তার ওয়াণ্ডারাবো বন্ধুরা নিয়ে গেছিল। তাছাড়া আমরা তো আর শিকারে আসিনি। তাই খুব বেশি গুলি এবারে আনেওনি ঋজুদা।

বন্দুকের গুলি দু’ব্যারেলে দুটো পোরার পর আর চারটে আছে। আমার উইণ্ডচিটারের পকেটে রেখেছি সে কটাকে। আর থার্টি ও সিক্স রাইফেলের ম্যাগাজিনে ও ব্যারেলের দুটো গুলি বাদ দিয়ে আর আছে তিনটি গুলি। ফোর ফিফটি হান্ড্রেড রাইফেলটাকে ভুষুণ্ডা তাঁবু থেকে নিয়ে গেছিল কিন্তু ঋজুদা ওটা তাঁবুতে রেখে যাবার আগে তার লকটা খুলে নিয়ে নিজের হ্যাভারস্যাকে রেখেছিল। খালি স্টক আর ব্যারেল নিয়ে গেলে তো গুলি ছুঁড়তে পারবে না। আর সে কারণেই ঋজুদা এখনও বেঁচে আছে। ভুষুণ্ডার হাতে গাদা-বন্দুক না থেকে যদি ঐ রাইফেল থাকত তবে গুলি লাগার সঙ্গে-সঙ্গে শকেই মরে যেত ঋজুদা।

অন্ধকার হয়ে আসতে আসতে-না-আসতেই চাঁদ উঠল। তারা ফুটল। সিংহগুলোর ডাক ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। এখন আর ওরা ডাকছে না, আস্তে-আস্তে এগিয়ে আসছে এদিকে। সবসুদ্ধ গোটা সাতেক আছে। আরও কাছে আসতে দেখলাম দুটো সিংহ, দুটো সিংহী আর তিনটে বাচ্চা। একেবারে ছোট বাচ্চা নয়, মাস চারেকের হবে।

গুলি করলে আক্রমণ করতে পারে। তাছাড়া ওরা বিপদ না ঘটালে গুলি করবই বা কেন? আমি একা। গুলি নেই বেশি। তারপর রাত। তাই রাইফেল না তুলে আমি বড় টর্চ দুটো ওদের দিকে ফেললাম। বণ্ড-এর টর্চ। পাঁচ ব্যাটারির। খুব সুন্দর আলো হয়।

সামনের সিংহী দুটো আলোতে থমকে দাঁড়াল। তারপর টর্চ দুটো নিয়ে আমি নাইরোবি সর্দার যেমন করেছিল গাড়ির বনেটের উপর দাঁড়িয়ে, তেমনি ট্রেলারের উপর দাঁড়িয়ে আলো নিয়ে মশালের মত কাটাকুটি করতে লাগলাম উপরে-নীচে।

সিংহগুলো কিছুক্ষণ গরগরর করে ফিরে গেল। আসলে ওরা ব্যাপারটা কী তাইই বোধহয় দেখতে এসেছিল। কেউ যদি ঘুম ভেঙে উঠে তার বাড়ির উঠোনে একটা মস্ত গাছ হয়েছে দেখতে পায়, তো অবাক হবে না? ওদেরও সেই অবস্থা। নিজেদের আদিগন্ত ঘাসবনে অদ্ভুত এই নতুন চাকা লাগানো জন্তুটা কী তাই বোধ করি ভাল করে দেখতে এসেছিল।

পেঁচা ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল ঘাস-ইঁদুরের খোঁজে। ঘাসের মধ্যে এদিক ওদিক সরসর, শিরশির আওয়াজ শুনতে লাগলাম। রাতের প্রাণীরা সব জেগেছে। সাপ, ইঁদুর, নানারকম পোকা, পেঁচা, খরগোশ। দূর দিয়ে একদল ওয়ার্ট-হগ মাটিতে ধপধপ আওয়াজ করে দৌড়ে চলে গেল। চাঁদের আলো পরিষ্কার হলে দেখা গেল আমাদের সামনে অনেক দূরে মস্ত একটা ওয়াইল্ডবীস্টের দল চরে বেড়াচ্ছে।

বসে থাকতে-থাকতে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ে থাকব। আচমকা ঘুম ভাঙতে, ঘড়িতে দেখি বারোটা বাজে। তার মানে বেশ ভালই ঘুমিয়েছিলাম, রাইফেল-বন্দুক পাশে থেকে। ভুষুণ্ডার লোকেরা এতদূরে পায়ে হেঁটে আমাদের কাছে আসতে পারবে না, কিন্তু জন্তু-জানোয়ার আসতে পারত। ঘুমোনো খুব অন্যায় হয়েছে। শিশির পড়েছে খুব। হলুদ ঘাসের সাভানা-সমুদ্রকে কুয়াশায় চাঁদের আলোয় শিশিরে মিলেমিশে মাঝরাতে কেমন নীলচে-নীলচে দেখাচ্ছে।

আমি ঋজুদার কপালে হাত দিলাম। জ্বর ঝাঁঝাঁ করছে। কাল যদি আমরা রাস্তায় পৌঁছতে না পারি বা কোনো উপায় না হয় তাহলে ঋজুদাকে এখানেই রেখে যেতে হবে। ঋজুদাকে রেখে গেলেও আমি যে যেতে পারব, তারও কোনো স্থিরতা নেই। এই প্রসন্ন অথচ নিষ্ঠুর, তেরো হাজার বর্গমাইল ঘাসের মরুভূমিতে জলের অভাবে খাবারের অভাবে তিল-তিল করে শুকিয়ে মরে যাব। ভুষুণ্ডা। ভুষুণ্ডাই এর জন্যে দায়ী। ওক্কে, ভুষুণ্ডা! দেখা হবে।

আমি ট্রেলার থেকে নেমে আবার একটু আগুন করলাম। ঠাণ্ডায় আমার নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। কান দুটো আর নাকটা ঠাণ্ডায় এমন হয়ে গেছে যে, মনে হচ্ছে কেউ বুঝি কেটেই নিয়ে গেছে।

আবার কফি বানিয়ে দুটো বিস্কুট গুড়া করে, তাতে ব্র্যাণ্ডি ঢেলে ঋজুদাকে জাগিয়ে তুললাম।

ঋজুদা বলল, কে? গদাধর? ভাল আছিস? চিঠি যা এসেছে, আমাকে দে।

আমি চমকে উঠলাম। ঋজুদা ভুল বকছে নাকি? কলকাতায় তার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাট যে দেখাশোনা করে, সেই বহুদিনের বিশ্বস্ত পুরনো লোক গদাধর। যার জন্যে আমরা বনবিবির বনে গেছিলাম, সে।

আমি বললাম, ঋজুদা! আমি! আমি রুদ্র!

ও। রুদ্র। সেই গানটা শোনাবি একটু।

 কোন্ গান ঋজুদা?

সেই গানটা রে। ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা, তুই বড় ভাল গাস গানটা।

আমি বললাম, এইটা খেয়ে নাও ঋজুদা। অনেক ঘন্টা হয়ে গেছে আগের বার খাওয়ার পরে।

ঋজুদা প্রতিবাদ না করে খেল। তারপর আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল, রুদ্র, তুই আমাকে এখানে ফেলে রেখে যাস না রে। মরেও যদি যাই, তাহলেও দেশে কিন্তু নিয়ে যাস আমাকে। আমাকে কবর দিতে বলিস আমাদের দেশের কোনো সুন্দর জঙ্গলে, আমারই প্রিয় কোনো জায়গায়। তুই তা সবই জানিস।

আমি বললাম, আঃ ঋজুদা! পাইপ খাও। খাবে?

 ঋজুদা মাথা নাড়ল। বলল, না, ঘুমোব।

আমি আর-একটা ঘুমের বড়ি দিলাম ঋজুদাকে। কম্বল ভাল করে গুঁজে দিলাম গলায়, ঘাড়ে। নাড়াতে গিয়ে দেখি, ফুলে শক্ত হয়ে গেছে পা-টা। আমার ঘুমটুম সব উবে গেল। জল চড়ানোই ছিল, তাই কফি খেলাম একটু। গা-টা গরম হল।

তারপর অনেকক্ষণ পায়চারি করলাম রাইফেল কাঁধে গাড়ির চারদিকে। কিন্তু হঠাৎ মনে হল, এখন এনার্জি নষ্ট করা ঠিক নয়। কী যে লেখা আছে কপালে ভগবানই জানেন। হয়তো এনার্জির শেষ বিন্দুটুকুও প্রয়োজন হবে ভীষণভাবে।

ঋজুদার পাশে গিয়ে ট্রেলারে বসলাম। চারধারে নীলচে চাঁদের স্বপ্ন-স্বপ্ন আলো হলুদ ঘাসবনে ছড়িয়ে আছে। বসার আগে চারধার ভাল করে দেখে নিলাম। নাঃ, কিছুই নেই কোথাও।

নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুঃস্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠলাম। আঁ-আ-আ-আ করে এক সাংঘাতিক চিৎকারে। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি আমার প্রায় গায়ের উপরে কটা বিদঘুঁটে জানোয়ার বসে আছে আর ঋজুদার পা কামড়ে ধরেছে আর একটা। আর ট্রেলারের তিন পাশে কম করে আরও আট-দশটা জানোয়ার দাঁত বের করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার সংবিৎ ফিরতেই বন্দুকটা তুলে নিয়ে, ব্যারেল দিয়ে, যে জানোয়ারটা ঋজুদার পা কামড়ে ধরেছে তাকে ঠেলা মারলাম–পাছে গুলি করলে গুলি ঋজুদারই গায়ে লাগে। ঠেলা মারতেই সে মাথা তুলল–সঙ্গে-সঙ্গে তার মাথার সঙ্গে প্রায় ব্যারেল ঠেকিয়ে গুলি করে দিলাম। হায়নাটা টাল সামলাতে না পেরে পিছন দিকে উলটে ট্রেলারের বাইরে পড়ে গেল। গুলির শব্দে আমার কাছেই যে হায়নাটা ছিল সে চমকে গিয়ে লাফ মারল নীচে। তাকেও গুলি করলাম অন্য ব্যারেলের গুলি দিয়ে। সে-ও পড়ে গেল। কিন্তু কী সাংঘাতিক এই আফ্রিকান হায়নাগুলো, প্রায় বুনো কুকুরেরই মতো, চারধার থেকে লাফিয়ে ট্রেলারে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল একের পর এক।

বন্দুকের দু’ব্যারেলেই গুলি শেষ। এবার আমি থার্টি ও সিক্স রাইফেলটা তুলে নিয়ে ট্রেলারের উপর উঠে দাঁড়ালাম, যাতে তিন দিকেই ভাল করে দেখা যায়। ওরা না গেলে ঋজুদার পায়ের দিকে যেতে পারছি না। হায়নার চোয়ালের মতো শক্ত চোয়াল কম জানোয়ারের আছে। হাঙরের মতো তারা হাড় কেটে নিতে পারে কামড়ে। ঋজুদার গোড়ালির একটু উপরে কামড়েছিল হায়নাটা।

হায়নাগুলো লাফাচ্ছে আর ট্রেলারে ওঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ধাক্কা মারছে ট্রেলারে। ট্রেলারটা কেঁপে উঠছে বারবার।

প্রথমে কয়েকবার গুলি বাঁচাবার জন্যে আমি ব্যারেল দিয়েই বাড়ি মারলাম ওদের মুখে, মাথায়। কিন্তু সামলানো যাচ্ছে না। ওরা ক্রমাগত লাফাচ্ছে। ঋজুদার পায়ের রক্তের গন্ধ পেয়ে এসেছে ওরা। একটাকে ঠেকাই তো আর একটা উঠে পড়ে। যখন কিছুতেই ঠেকাতে পারছি না, তখন বাধ্য হয়ে গুলি করতে লাগলাম। থার্টি ও সিক্স-এর বোল্ট খুলি, আর গুলি করি। দেখতে দেখতে ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেল। আমার মাথায় খুন চেপে গেছিল। মানুষের সহ্যশক্তির একটা সীমা থাকে। সেই সীমা এরা পার করিয়ে দিয়েছিল। তখনও আরো দুটো হয়না আস্ত ছিল, তাদের বিক্রম তখনও কমেনি। মৃত সঙ্গীদের শরীরের উপর দিয়ে লাফিয়ে উঠতে কী মনে করে, তারা থেমে গিয়ে টাটকা রক্তের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে নিজেদের সঙ্গীদেরই খেতে শুরু করল। ট্রেলারের চারধারে অনেকগুলো মরা হায়না, হাঁ করে পড়ে আছে। সে-দৃশ্য দেখা যায় না, ওদের গায়ের দুর্গন্ধে ওখানে টেকাও অসম্ভব। আমি এক লাফে ট্রেলার থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট করে গাড়িটাকে আধ মাইলটাক দূরে নিয়ে গেলাম। তারপর দৌড়ে নেমে গেলাম ঋজুদার কাছে।

ঋজুদা, আশ্চর্য, পাইপ খাচ্ছিল।

আমি যেতেই বলল, কানের কাছে যা কালীপুজোর আওয়াজ করলি, তাতে তো ওয়েস্টার্ন ছবির হীরোরাও শুনলে লজ্জা পেত।

ঋজুদা কথা বলছে দেখে খুব খুশি হয়ে আমি বললাম, ধ্যুত। তারপরই বললাম, কতখানি কামড়েছে?

ঋজুদা বলল, মার্করিওক্রোম আর ডেটল লাগা। ব্যাটা মাংসই খুবলাতে গেছিল। ভাগ্যিস চেঁচিয়েছিলাম। বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। তুই না উঠলে আমাকে জ্যান্তই খেত।

আমি বললাম, দেখি পা-টা দাও।

ঋজুদা বলল, একে কম্বল, তার পরে ফ্লানেলের ট্রাউজার, তার নীচে মোজা; ব্যাটা সুবিধা করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। টর্চ দিয়ে দ্যাখ তো রুদ্র।

আমি টর্চ দিয়ে দেখে ওষুধ আর ডেটল লাগিয়ে বললাম, কলকাতায় ফিরে তোমার ডান পায়ের জন্যে একটা পুজো দিও।

ঋজুদা হাসল। তারপর আমাকে শুধোল, গুলি কতগুলো আছে?

বললাম, রাইফেলের গুলি তিনটে, বন্দুকের দুটো।

হুঁ। আমার ডান পকেট থেকে পিস্তলটা বের কর তো। এ-যাত্রায় আমার দ্বারা তোর আর কোনো সাহায্যই হবে না। পারলে আমি তো নিজেই গুলি করতে পারতাম হায়নাটাকে। আমি পারলাম না। পারি না…

বলেই থেমে গেল।

আমার ভীষণ কষ্ট হল।

পিস্তলটা লোডেড ছিল। আটটা গুলি আছে এতে। কোমরের বেল্টের সঙ্গে বেঁধে নিলাম আমি। যে-কটা গুলি ছিল, বন্দুক এবং রাইফেলে লোড করে সেফটি ঠিক করে রাখলাম।

বললাম, দেখো, আমি কিন্তু আর একটুও ঘুমোব না। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোও এবারে সকাল অবধি।

ঋজুদা ফিস ফিস করে বলল, তুই তো কম ক্লান্ত নোস। ছেলেমানুষ।

 বলেই বলল, সরি, উ আর নট। আই অ্যাপলোজাইজ।

আমি হাসলাম। কাঁধে হাত রেখে বললাম, ঘুমোও ঋজুদা।

.

ভোর হল। বনে-জঙ্গলে ভোর মানেই দ্বিধা আর অনিশ্চয়তার অবসান। আমি তাড়াতাড়ি ঋজুদার জন্যে শুধু একটু কফি করে দিলাম। খাবার সব শেষ।

ঋজুদা আমার দিকে একবার তাকাল কফির কাপটা হাতে নিয়ে। হাভারস্যাকে হেলান দিয়ে উঠে বসতে গেল, কিন্তু পারল না। দেখলাম জ্বরটা আবার বেড়েছে। প্রায় বেহুঁশ।

আমিও একটু কফি খেয়ে গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট করে, কম্পাস দেখে, বেয়ারিং ঠিক করে চললাম গাড়ি চালিয়ে। কোথায় যাচ্ছি জানি না, এই চলার শেষে কী আছে তাও জানি না। জানি না, বড় রাস্তায় গিয়ে পড়তে পারব কিনা। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে, আজকের মধ্যে যদি ঋজুদাকে হাসপাতালে নেওয়া না যায়, তাহলে বাঁচানোই যাবে না আর।

সকাল সাড়ে-আটটা নাগাদ চোঁ চোঁ আওয়াজ করে গাড়িটা বন্ধ হয়ে গেল। তেল শেষ হল বোধহয়। মিটার সেই কথাই বলছে। গাড়ি থামিয়ে ট্রেলারে গেলাম। জেরিক্যান ভাল করে পরীক্ষা করে দেখি জেরিক্যানের তলাটা ফুটো। কবে ফুটো হয়েছে, কেমন করে হয়েছে তা এখন জানার উপায় নেই। ভুষুণ্ডা ইচ্ছে করেই প্যাক করার সময় হয়তো খালি টিন ভরেছিল।

এখন আর কিছু করার নেই। গাড়ি আর চলবে না। ট্রেলারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। জেরিক্যানটা নামিয়ে দেখি একটা খুব বড় আগামা গিরগিটি দৌড়ে গেল পায়ের সামনে দিয়ে। এই গিরগিটিগুলো দারুণ দেখতে। নীল শরীর, লাল গলা, আর মাথাটাও খুব সুন্দর। টেডি আমাকে চিনিয়েছিল।

গাড়িটা থেমে থাকায় ঋজুদা বলল, কী হল রুদ্র?

আমি বললাম, তেল শেষ হয়ে গেল ঋজুদা।

ওঃ। ঋজুদা বলল।

আমি বললাম, তোমাকে একা রেখে আমি একটু দেখে আসব? দূরে যেন মনে হচ্ছে গরু চরছে।

ঋজুদা বলল, বাইনাকুলার দিয়ে ভাল করে দ্যাখ।

বাইনাকুলার দিয়ে দেখে মনে হল, গরুই। আফ্রিকাতে তো নীল গাই নেই। দূর থেকে ভুলও হতে পারে। হয়তো কোনো হরিণ এখানকার বা বুনো মোষ। এখানের গরুদের রঙ লাল ও কালো। গায়ে লোমও অনেক।

ঋজুদা বলল, সাবধানে যাবি। আমার জন্যে চিন্তা করিস না। জলের বোতলটা সঙ্গে নিয়ে যা।

আমি কোমর থেকে পিস্তলটা খুলে ঋজুদাকে দিয়ে দিলাম। বললাম, একা থাকবে, সঙ্গে রাখো।

ঋজুদা আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর নিল।

কপালে হাত দিয়ে বললাম, এখন কেমন আছ?

ঋজুদা হাসল কষ্ট করে। তারপর বলল, ফাইন।

ফাইনই বটে, ভাবলাম আমি। রাইফেলটা কাঁধে ঝুলিয়ে, জলের বোতলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

হাঁটছি তো হাঁটছিই, যতই হাঁটছি ততই যেন গরুগুলো দূরে-দূরে সরে যাচ্ছে। আশ্চর্য। তাছাড়া গরুদের কাছে কোনো রাখাল দেখব ভেবেছিলাম, কিন্তু কাউকেই দেখা গেল না। গরুগুলো সত্যিই গরু না গুগুনোগুম্বার, বা ওগরিকাওয়া বিবিকাওয়া, তা বোঝা গেল না। সেই নির্জন, নিস্তব্ধ, হু-হু হাওয়া, ঘাসবনে ভরদুপুরে মনে নানান আজগুবি চিন্তা আসে। নিজেকে এত অসহায় লাগতে লাগল ঋজুদার কথা ভেবে যে, বলার নয়। বারোটা বাজে। আমাদের ল্যাণ্ড-রোভার আর ট্রেলার দেখাই যাচ্ছে না অনেকক্ষণ হল। সঙ্গে যদিও কম্পাস এনেছি তবু হারাবার ভয় করছে। এ যে সমুদ্র। বেরিয়েছিলাম পৌনে ন’টায়, সোয়া তিন ঘন্টা ক্রমাগত হেঁটেও গরুদের কাছে পৌঁছনো গেল না, কাউকে দেখাও গেল না। আশ্চর্য!

আমার গা ছমছম করতে লাগল। পিছু ফিরলাম আমি।

ক্লান্ত লাগছিল। তিনদিন হল বিশেষ কিছুই খাইনি। ঘুমও প্রায় নেই। শরীরে যেন জোর পাচ্ছি না আর। সবচেয়ে বড় কথা, মনটাও ধীরে-ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে। তাহলে কি আমাকে আর ঋজুদাকে এইখানেই শকুন, শেয়াল আর হায়নার খাবার হয়ে থেকে যেতে হবে? পরে যদি কেউ এদিকে আসে তাহলে হয়তো আমাদের গাড়ি ল্যাণ্ড-রোভার আর কঙ্কাল দেখতে পেয়ে, গাড়ির কাগজপত্র নেড়ে-চেড়ে আমাদের কথা জানতে পারে। অবশ্য যদি হাতি কি গণ্ডার কি বুনোমানুষ ওগুলো অক্ষত রাখে।

আরও ঘন্টাখানেক হাঁটার পর দূর থেকে ট্রেলার সুদ্ধু ল্যাণ্ড-রোভারটাকে একটা ছোট্ট পোকার মতো মনে হচ্ছিল। আরও এগোবার পর দেখতে পেলাম কতগুলো পাখি গাড়িটার কাছে উড়ছে। ছোট-ছোট কালো পাখি।

আমি এবার বেশ জোরে যেতে লাগলাম। আরও ঘন্টাখানেক লাগবে পৌঁছতে। পাখিগুলো আস্তে-আস্তে বড় হতে লাগল। আরও কিছুদিন যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম সেগুলো শকুন।

শকুন? কী করছে অতগুলো শকুন ঋজুদার কাছে? ঋজুদা কি…?

আমি যত জোরে পারি দৌড়তে লাগলাম। রাইফেলটা হাতে নিয়ে আর-একটু এগিয়েই আমি রাইফেলটা উপরে তুলে একটা গুলি করলাম। ভাবলাম, শব্দে যদি উড়ে পালায়।

টেডি বলেছিল, যদি জীবন্ত কোনো লোককে শকুন তিন দিকে ঘিরে থাকে, তবে সে মারা যায়। আমাকে আর ঋজুদাকে শকুনরা দুদিন আগে চারদিকে ঘিরেছিল।

শকুনগুলো উপরে উঠে ঘুরতে লাগল। অনেকগুলো। তারপরই আবার নেমে এল নীচে। আর-একটু এগিয়েই আবার গুলি করলাম। কিন্তু এবারেও চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল না একটাও।

কাছে গিয়ে দেখি, গাড়ির ছাদে শকুন, ট্রেলারের উপর চার পাঁচটি শকুন এবং ট্রেলারের তিন পাশে দশ-বারোটা বিরাট বড়-বড় তীক্ষ্ণ ঠোঁট আর বিশ্রী গলার শকুন।

ওরা যেন ঝুঁকে পড়ে সকলে মিলে ঋজুদার নাড়ি দেখছে। নাড়ি থেমে গেলেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে ঋজুদার উপর।

আমার গায়ে কাঁটা দিল। শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। আর সহ্য করতে না পেরে মাটিতে বসা একটা বড় শকুনের দিকে রাইফেল তুললাম। গুলিটা শকুনটাকে ছিটকে ফেলল কিছুটা দূরে। আমি দৌড়ে গিয়ে ওটাকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিলাম। গাড়ি তো আর চলবে না। গাড়ির কাছে মরে পড়ে থাকলে আমাদেরই মুশকিল।

সঙ্গীর হাল এবং আমার রণমূর্তি দেখে বোধহয় একটু ভয় পেল ওরা। উড়ে গিয়ে সব জমায়েত হল মৃত সঙ্গীর কাছে।

কানের এত কাছে রাইফেলের আওয়াজেও উঠল না ঋজুদা। আমি দৌড়ে গিয়ে ডাকলাম, ঋজুদা, ঋজুদা।

ঋজুদা কথা বলল না কোনো। মুখের উপর চাপা দিয়ে রাখা টুপিটা সরিয়ে দেখলাম, চোখ বন্ধ। একেবারেই অজ্ঞান। গায়ে ভীষণ জ্বর।

রাইফেলের গুলি আর রইল না। এখন থাকার মধ্যে শটগানের দুটো গুলি মাত্র। প্রয়োজন হলেও ঋজুদাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারব না। আমি সত্যিই জানি না, এবার কী করব। আমার বড়ই ভয় করছে।

এদিকে বেলা পড়ে এসেছে। খিদে-তেষ্টা সবই পেয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুরই হুঁশ নেই।

আমার একার জন্যেই একটু জল গরম করে কফি করলাম, আর কিছুই নেই। কফি খেয়ে, লম্বা রাতের জন্যে তৈরি হতে লাগলাম। ঋজুদার একেবারেই জ্ঞান নেই। কিন্তু নাড়ি আছে। খুব অস্পষ্ট ধুকপুক আওয়াজ হচ্ছে। কিছু খাওয়ানোই গেল না। ব্যাগ থেকে ব্র্যাওি-ওষুধটা নিয়ে একটু ঢেলে দিলাম জোর করে দাঁত ফাঁক করে। কিন্তু খেতে পারল না, কষ বেয়ে গড়িয়ে গেল। তাড়াতাড়ি মুছে দিলাম।

অন্ধকার হয়ে এল। তারা ফুটলো একে একে। চাঁদ উঠেছে সূর্য যাবার আগেই। আমি বসে আছি ট্রেলারের উপর। ভাবছিলাম রাইফেলের গুলিগুলো শকুনদের উপর নষ্ট করলাম মিছিমিছি। আজ রাতে যদি হায়নারা আসে? অথবা আরও হিংস্র কোনো জানোয়ার?

কাল রাতের কথা মনে হতেই আমার বুক কেঁপে উঠল। আজ আর ঘুমোব না। ঘুমোলে হয়তো ঋজুদাকে টেনে নিয়েই চলে যাবে ওরা। যে করেই হোক আমাকে আজ সারা রাত জেগে থাকতে হবে।

রাত এগারোটা বাজল। দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে রইলাম, মাথায় টুপি দিয়ে। বড় শীত বাইরে, ঋজুদার গায়ে ভাল করে কম্বল মুড়ে দিয়েছি। মাথার উপরে টেডির ওভারকোটের তাঁবুও খাঁটিয়ে দিয়েছি। রক্তে, ধুলোয়, শিশিরে কম্বলটার অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়ে গেছিল। তাই আমার কম্বলটা দিয়েছি আজ।

আমি স্বপ্ন দেখছিলাম, ঋজুদা আমাদের বাড়ি এসেছে কলকাতায়। মা ঋজুদার জন্যে পাটিসাপ্টা পিঠে করেছেন, আর কড়াইশুঁটির চপ। মায়ের কী একটা কথায় ঋজুদা খুব হাসছে। মা-ও খুব হাসছেন। আমিও। মায়ের শোবার ঘরের আলোগুলো জ্বলছে। মা সোফাতে বসে, আমি আর ঋজুদা খাটে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছে ঋজুদা। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

ভীষণ ঘুমোচ্ছিলাম আমি। কে যেন আমার ঘুম ভাঙাল গায়ে হাত দিয়ে। তাড়াতাড়ি চমকে উঠে, হাতে-ধরা বন্দুকটা শক্ত করে ধরেই আমি চোখ খুললাম। দেখি, ট্রেলারের তিনপাশে পাঁচজন সাতফুট লম্বা মাসাই যোদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে, হাতে বল্লম ও কোমরে দা। ওদের বলে মোরান।

আমি ঘোর কাটিয়ে বললাম, জাম্বো।

ওদের মধ্যে একজন বোধহয় সোয়াহিলী জানে। সে বলল, সিজাম্বো!

বলেই, সকলেই প্রায় একই সঙ্গে পিচিক পিচিক করে থুতু ফেলল। বর্শার সঙ্গে পা জড়িয়ে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি ঋজুদাকে দেখিয়ে বাংলায় বললাম, এঁকে বাঁচাতে পারো ভাই?

তারপর বোঝাবার জন্যে ঋজুদার পা-টা খুলে দেখালাম। পেটে হাত দিয়ে বললাম খাবারও নেই।

ওরা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। আবার পিচিক পিচিক্ করে থুতু ফেলল।

হঠাৎ আমার মনে হল, নাইরোবি সর্দারের দেওয়া হলুদ গোল পাথরটার কথা। ঋজুদা আমাকেই রাখতে দিয়েছিল সেটা। তাড়াতাড়ি আমি পকেট হাতড়ে সেটা বের করে ওদের দেখালাম। বললাম, নাইরোবি সর্দার দিয়েছে। নাইরোবি। নাইরোবি। দুবার বললাম।

ওরা পাথরটা হাতে নিয়ে, ভাল করে দেখে, সকলে একসঙ্গে কী সব বলে উঠল।

দুজন মাসাই দুটো হাত পাশে ঝুলিয়ে রেখেই সোজা উপরে লাফিয়ে উঠল তিন চার ফুট। তারপর হাতের মধ্যে থুতু ফেলে দুহাতে থুতু ঘষে আমার মুখটা দুহাতে ধরল। বোধহয় আদর করে দিল।

প্রথম দিন নাইরোবি সর্দার এমন করাতে আমার বড় ঘেন্না হয়েছিল। ওডিকোলন ঢেলে শুয়েছিলাম। আজ এই রাতে কিন্তু বড় ভাল লাগল। বড় ভালমানুষ ওরা, ভারী সহজ, সরল।

দেখতে-দেখতে দুটো বল্লমের মধ্যে একজনের লাল কম্বল কায়দা করে বেঁধে একটা স্ট্রেচার-মতো করে ফেলল ওরা। তারপর ঋজুদাকে তার উপর শুইয়ে, কম্বল দিয়ে ঢেকে, কাঁধে তুলে নিয়ে আমাকে ইঙ্গিতে বলল, চলো।

ঋজুদার পিস্তলটা একজন আমার হাতে দিল। আমি কোমরে রাখলাম সেটা। বন্দুকটা হাতে নিলাম।

ওরা শনশন করে হাঁটতে লাগল।

ভিজে চাঁদের আলোর মধ্যে সেই ধু-ধু ঘাসের বনে সাত ফুট লম্বা লাল পোশাকের মাসাইদের গুগুনোগুম্বার বা ওগরিকাওয়া-বিবিকাওয়া বলে মনে হচ্ছিল আমার।

এরাও কি আমাদের সঙ্গে ভুষুণ্ডার মতো বিশ্বাসঘাতকতা করবে?

যারা ঋজুদাকে বইছিল তারা আগে-আগে প্রায় দৌড়ে চলল।

মেরানদের মধ্যে যে সর্দার গোছের, সে আবার পিচিক্ করে থুতু ফেলে আমাকে কী যেন দুমদাম বলল। মানে বুঝলাম না।

যুদ্ধ করলেই আহত হয় কেউ-কেউ। ওরা যোদ্ধার জাত। জড়িবুটি, তুকতাক এবং বনজ-ভেষজ দিয়ে আহতের চিকিৎসা ওরা নিশ্চয়ই জানে। জানে কি না আমি জানি না। এই মুহূর্তে আমি জানি যে, আমি ভীষণ খুশি। এত কিছুর পরে, এত ঘটনার পরে, এই মনখারাপ-করা নির্জনতার মধ্যে মানুষের মুখ দেখে।

হাড়গোড় আর পাথরের গয়না-পরা, লাল-হলুদ রঙে মুখে কপালে আঁকিবুকি কাটা, টাটকা-রক্ত-খাওয়া কতগুলো স্বাধীন সাহসী, বড় মনের মানুষদের পিছনে-পিছনে ছোট্ট শহুরে মনের ছোট্ট ভীরু আমি ছোট-ছোট পা ফেলে চলতে লাগলাম।

দূর থেকে ওদের ড্রামের শব্দের মতো গুমগুম্ করে সিংহ ডেকে উঠল। বারবার ডাকতে লাগল। আর একটা বড় পেঁচা আমাদের মাথার উপরে ঘুরে ঘুরে, উড়ে উড়ে, সঙ্গে-সঙ্গে চলতে লাগল। ডাকতে লাগল, কিঁচি কিঁচি কিঁচর…।

গুগুনোগুম্বারের দেশের দুজন দৈত্যের মতো মানুষের কাঁধের উপর আমার ঋজুদার ঠাণ্ডা, নিথর শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে, দুলতে দুলতে যেন সেই নীলচে চাঁদের আলোয় ভেসে উড়ে চলল এই আদিম আফ্রিকার কুয়াশা-ঘেরা রহস্যময় দিগন্তের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *