গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

কালো ফুটো সাদা ফুটো

কালো ফুটো সাদা ফুটো

না, না, মাপ করবেন। দোহাই আপনাদের। আজ আর পেড়াপিড়ি করবেন না। আজ ওঁকে এই নিয়ে বিরক্ত করতে পারব না—

ছুটির দিন। একটু সকাল থেকেই আড্ডা ঘরে সবাই জমায়েত হয়েছি। টঙের ঘরের তিনিও নেমে এসে তাঁর মৌরসি কেদারাটা দখল করে বসেছেন।

এই সময়ে বারান্দা থেকে নীচের দিকে কাকে না কাদের উদ্দেশ করে গৌরের ওই চেঁচামেচি ভাল লাগে!

চেঁচামেচিটা কেন, কাকে উদ্দেশ করে তাও তো বোঝা যাচ্ছে না।

ওদিকে মৌরসি কেদারায় তাঁর মেজাজটাই না এই সাত সকালে বিগড়ে যায়।

প্রায় ধমকের সুরে গৌরকে তাই ডাকতে হল, এই, কী হচ্ছে কী? কার সঙ্গে কী জন্য অমন চেঁচামেচি করছিস?

আর কার সঙ্গে? গৌর বারান্দার রেলিং থেকে আমাদের দিকে ফিরে বিরক্ত গলায় বললে, সক্কাল বেলাই কী ঝামেলা দেখ দিকি!

এইটুকু বলেই আবার বারান্দার থেকে নীচের দিকে মুখ নামিয়ে একসঙ্গে বিরক্তি আর কাতরতা মিশিয়ে বললে, বললাম তো—আজ কিছু হওয়া সম্ভব নয়। আপনারা বরং আপনাদের নাম ঠিকানা রেখে গিয়ে পরের রবিবারে আসুন—হ্যাঁ, হ্যাঁ পরের—ওঁকে না আগে থেকে না জানিয়ে—–

ভেতর থেকে আবার আমাদের গলা ছেড়ে গৌরকে ডেকে ব্যাপারটা জানবার চেষ্টা করতে হল, শোন শোন, গৌর, শোন। ব্যাপারটা হয়েছে কী! এই সাত সকালে কার সঙ্গে চেচামেচি করছিস! কে ওরা? কী চায়?

কে ওরা? কী চায়? গৌর একেবারে গনগনে মেজাজে বললে, সব পত্রপত্রিকার প্রতিনিধি। এসেছেন দুর-দুরান্তর থেকে ঘনাদার ইন্টারভিউ মানে সাক্ষাৎকার নিতে। তাও কি কাছে পিঠের কোথাও থেকে? একজন এসেছে হলদিয়ার কাছের কোন গ্রাম থেকে, আর-একজন দুর্গাপুর থেকে, আর একজনরা বিহারের দানাপুর থেকে।

উৎসাহ খুব? আমাদের স্বীকার করতেই হল—তা কী নিয়ে ইন্টারভিউ মানে সাক্ষাৎকার তারা চায়?

কী নিয়ে আবার! গৌর আমাদের ওপরেই বিরক্ত হয়ে বললে, সাক্ষাৎকার কী নিয়ে হয় তা জানো না? এই আপনি কোথায় জন্মেছেন, পড়াশুনা কী করেছেন, আপনার বাড়িঘর কোথায়, কে আছে সেখানে কী খেতে ভালবাসেন!

এইসব নিয়ে বকিয়ে ঘনাদাকে জ্বালাতন করবে? আমরা ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললাম, এ সাক্ষাৎকারে ওদের লাভ কী?

লাভ—যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হল তাঁকে নিয়ে বিনা খরচে অতি সহজে কাগজের খানিকটা পাতা ভরানো। গৌর তেতো গলায় বোঝালে, আজকাল এই এক নতুন কায়দা হয়েছে কাগজের কদর বাড়াবার। যাদের লেখা জোগাড় করা শক্ত তাদের সাক্ষাৎকার নাও। না দিয়ে পার পাওয়া সহজ নয়।

তা যে নয়, নীচের চেঁচামেচির মাত্রা চড়ে যাওয়া থেকেই তা তখন বোঝা যাচ্ছে। নীচে থেকে নানা পর্দার গলায় ডাক আসছে, ও মশাই শুনুন না, একবার শুনেই যান না।

কী করা যায় বলো তো, গৌর অসহায় ভাবে আমাদের দিকে তাকাল। ঠিক কী করা যায় ভেবে না পেয়ে আমরাও যখন সমান অসহায় তখন সমস্যাটা যাঁকে নিয়ে উপায়টা তিনিই বাতলালেন।

শোনো হে, শোনো! বলে ঘনাদা আমাদের জানালেন, ওই ইন্টারভিউ-এর জন্যে তিন দল এসেছে বলছ? বেশ ভাল কথা। ওই তিন দলকে একটা প্রস্তাব জানিয়ে বলো তা মানলে ওদেরই—ওরা একটা সাক্ষাৎকার পেতে পারে।

সাক্ষাৎকার পেতে পারে? ঘনাদা নিজেই কথা দিচ্ছেন? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী প্রস্তাব, ঘনাদা?

প্রস্তাব এই যে, ঘনাদা ব্যাখ্যা করে শোনালেন, সাক্ষাৎকার আমি এক দলকেই দেব। আর শুধু একটা মাত্র প্রশ্নের বিষয়ে। এখন ওরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করুক,

কোন দলের কোন প্রশ্ন নিয়ে ওরা সাক্ষাৎকার চায়। ওরা যদি নিজেদের মধ্যে সে বোঝাপড়া না করতে পারে তাহলে সব সাক্ষাৎকার বাতিল।

ঘনাদার প্রস্তাবটা ভালই ছিল। কিন্তু সেটা যে সত্যি কাজ দেবে তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম, নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করেই তিন দল তাদের সুযোগটা নষ্ট করে করবে।

কিন্তু তা হল না। সবই হারাবার চেয়ে কিছু পাওয়াই যে ভাল বুঝে তিন দল এক হয়ে একটি প্রশ্ন নিয়েই ঘনাদার ইন্টারভিউ নিতে নীচে থেকে আমাদের আড্ডা ঘরে উঠে এল। এদিকে ওদিকে সুবিধা মতো বসে একটু তোতলামি নিয়েই তাদের প্রশ্নটা জানাল।

প্রশ্ন শুনে আমরা খুশিই হলাম বলতে পারি। যা ভয় করেছিলাম সেরকম সৃষ্টি ছাড়া কোনও প্রশ্ন নয়। তার বদলে নিতান্ত সরল সহজ একটা জিজ্ঞাসা। সেটা হল এই যে সারাজীবনে ঘনাদা তো দুনিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্য করেছে তাঁকে কোন জায়গা? সব চেয়ে আশ্চর্য করেছে কোন জায়গা?

ঘনাদা যেভাবে প্রশ্নটা নিজের মুখে আবার উচ্চারণ করে শোনালেন মনে হল উত্তরটা দিতে তাঁকে বেশ ভাবতে হবে।

কিন্তু না। প্রশ্নটা নিজে আউড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তরটা তিনি শুনিয়ে দিলেন—ঘুঘুডাঙা।

ঘুঘুডাঙ্গা!

ইন্টারভিউ নিতে আসা দল চুপ তো বটেই, আমরাও একেবারে হাঁ।

আমাদের অবস্থাটা ঠিক মতো অনুমান করে ঘনাদা এবার ব্যাখ্যা করে বললেন, শুধু ঘুঘুডাঙা শুনে অবশ্য বুঝতে কিছু পারবে না। জায়গাটা তেমন দূর কোথাও না হলেও নামকরা কোনও জায়গা নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে ঘুঘুডাঙা নামটাই খুব কম লোকের জানা আছে। হাওড়া থেকে লুপ লাইনে যেতে খানা জংশন ছাড়াবার কিছু পর বিরাট একটা ডাঙা পেরিয়ে যেতে হয়। ছোটখাটো ডাঙা তো নয়, মাঝে মাঝে দু-চারটে শাল পিয়ালের পাতলা জঙ্গল নিয়ে ডাঙাটা একনাগাড়ে অমন চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল ছড়ানো। নদী নালা নেই, শুধু এখানে সেখানে লাল কাঁকুরে মাটির ঢিবি নিয়ে জায়গাটার যেন আধা মরুভূমির মতো চেহারা।

এই নেহাত নিষ্ফলা সকল কাজের বার ডাঙা জমিটা আমার চেনা এক খেয়ালি ভদ্রলোক একেবারে জলের দরে শ-দেড়েক বিঘে কিনে সেখানে একটা বাংলো গোছের বাড়ি বানিয়ে ছিল। তার আশা ছিল এই নিষ্ফলা আধা-মরু ডাঙার অনেক নীচে কোথাও কোনও পাতাল-ধারার সন্ধান সে পাবে, আর কল্পনা ছিল যে তাই দিয়ে ওখানে এক নন্দনকানন বানিয়ে তুলবে। ডাঙা জমিটা কিনে বাংলো বাড়িটার অর্ধেক তুলতে তুলতেই খেয়ালি মানুষটা মরে যায়! তার যারা ওয়ারিশন তারা এখন ঘনাদার লোককে জলের দরেই ও সম্পত্তি বেচে দিতে রাজি থাকলেও বহুদিন কোনও খরিদ্দার তাদের জোটেনি। সে সময়টা, শুধু নির্জনতার খাতিরে আমি মাঝে মাঝে সেখানকার সেই আধা তৈরি বাংলো বাড়িটা ভাড়া নিয়ে সেখানে গিয়ে কিছু দিনের জন্য থাকতাম। ও ডাঙা জমি যে প্রথম কিনেছিল সেই খেয়ালি মানুষটি জায়গাটার নাম দিয়েছিল নন্দন। আমিই তা বদলে ঘুঘুডাঙা নাম রেখেছিলাম।

সেবার যখন ঘুঘুডাঙার বাংলোয় যাই তখন বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। দেশে সেবার সব জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। শুধু ঘুঘুডাঙা একেবারে খটখটে শুকনো মরুভূমি। আকাশের মেঘগুলো যেন ওই অঞ্চলটা পার হবার সময় জল ঢালতে ভুলে যায়।

তবু শরতের গোড়ায় ওই ধু ধু লাল মাটির ডাঙারও কেমন একটা রূপ যেন খোলে। বিশেষ করে ভোরের আলোয় তার দিগন্ত ছোঁয়া শূন্যতারই একটা আলাদা আকর্ষণ আছে!

অনেক দূরের এক পুরো রেলস্টেশনও নয়, নম্বর দেওয়া হল্ট যাকে বলে, সেইরকম স্টেশনে বিকেলের আগে এক অখদ্যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে নেমে জাদুঘরে রাখবার মতো গোরুর গাড়িতে কখনও মেঠো কাঁচা রাস্তা কখনও সটান উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো পাথুরে ডাঙার ওপর দিয়ে প্রায় দু প্রহর গাড়ি চালিয়ে রাত এগারোটা নাগাদ আমার ঘুঘুডাঙার বাংলো বাড়িতে এসে পৌঁছই। বহু দূরের এক গাঁ থেকে এক মুনিস-চাষি চৌকিদার হিসাবে মাঝে মাঝে এসে এ বাংলোটা দেখাশুনো করে যায়। আগে থাকতে চিঠিতে খবর দেওয়ায় সে এসে হয়তো ঘরদোরগুলো একটু সাফসুফ করে খাটিয়াটাটিয়া পেতে শোবার বিছানাটিছানা একটু ঝেড়ে ঝুড়ে দিয়ে চলে গেছে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে আমার জন্য তার থাকার কথা নেই, সে থাকেনি। গোরুরগাড়ির গাড়োয়ানও আমায় পৌঁছে দিয়ে পরের দিন সকালে তার খেপ আছে বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

ওই ধু ধু ঘুঘুডাঙার আধভাঙা বাংলো বাড়িতে আমি একেবারে একা।

এই পর্যন্ত বলে ঘনাদা থেমে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে আমাদের সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কী ভাবছ সবাই? এরপর যা দেখব তা আশ্চর্য এক ভূতের কাণ্ডকারখানা? না। যা দেখেছি তা ভৌতিকের চেয়ে আরও আশ্চর্য ব্যাপার, কল্পনাও তার নাগাল পায় না এমন অবিশ্বাস্য রকম অদ্ভুত কিছু।

ঘনাদা আবার একটু থামলেন। আমরা প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে আছি। সারাদিনের ক্লান্তি। ঘনাদা বলতে শুরু করলেন, সঙ্গে আনা খাবারের সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ার পর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুমটা ভোর হতেই বোধহয় ভাঙল। কিন্তু এ কী রকম ভোর! ভোরের আলো এমন সবুজ হল কী করে। হ্যাঁ, সবুজ। একটু বেশি করে হলদে মেশানো একরকম অদ্ভুত সবুজ! বিছানা ছেড়ে এক লাফে উঠে চারিদিকে চেয়ে একেবারে হতভম্ব। এ কোথায় আমি আছি! এখন কি স্বপ্ন দেখছি তাহলে? না, স্বপ্ন নয়। নিজেকে চিমটি কেটে, নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘেঁচে পরীক্ষা করে বুঝলাম, আমি পুরোপুরি জেগে আছি। কিন্তু কোথায়? আমার চারিধারে ঘরের দেওয়াল কি মাথার ওপর ছাদ নেই! কেমন যেন কাঁচের মতোই স্বচ্ছ একরকম ঢাকনা। আমি সামনে একটু এগিয়ে যেতেই সে ঢাকনা আপনা থেকেই যেন অদৃশ্য কবজায় উঠে গেল।

কিন্তু তারপর সামনে এ কী দেখলাম? কোথায় সেই ধু ধু করা লাল কাঁকুরে ডাঙা! এ তো যেন বাঁধানো সমুদ্র তীরের খানিকটা। সমুদ্রের রঙ হলুদ মেশানো সবুজ, আর সমুদ্রের ধারে অসংখ্য গুহার মতো ফাঁকওয়ালা বিশাল এক চ্যাপ্টা নিচু দালান যার বিরাট ছাদটা মাপে একটা ছোটখাটো পার্কের মতো। আমাদের পৃথিবীর বড় বড় প্রাসাদের বাইরে কোনও বিশাল ছড়ানো বাগান থাকে—বিশাল ছড়ানো ছাদটা যেন তাই। কিন্তু সে পার্কের মতো ছাদে ওরা কারা? হ্যাঁ, নীচের অগুনতি গুহা-মুখ থেকে উঠেই তো সমুদ্রের জলে সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আর সেখান থেকে গুহা-মুখে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে ওদের। কিন্তু ওরা কী রকম প্রাণী? চেহারাটা কতকটা ঘেরাটোপে অক্টোপাসের মতো নয় কি? হ্যাঁ, অক্টোপাসই। তবে ঘেরাটোপের ওপরে চকচকে চোখ বসানো প্রকাণ্ড মাথাটার চারিধারে চারটে বাহুঁ, আর বাকি চারটে খাটো ঘাঘরার মত ঘেরাটোপের নীচে। সেগুলোয় ভর দিয়ে তাদের চলাফেরাই শুধু অদ্ভুত নয়, অদ্ভুত তাদের আরও অনেক কিছু। প্রথমত তাদের গায়ের রঙ। পার্কের মতো বিরাট চ্যাপ্টা প্রাসাদের ছাদে কিছু একটা জটলার ব্যাপার আছে বলে মনে হয়! অসংখ্য ঘেরাটোপ জড়ানো অক্টোপাস সেখানে জড়ো হয়েছে দেখা যাচ্ছে। নীচের সমুদ্র থেকে গুহা-মুখ দিয়ে দলে দলে যেমন আসছে ওপরের আকাশ থেকেও তেমনই বড় বড় বাদুড়ের মতো প্রাণীর পিঠে সওয়ার হয়ে আসছে আরও অনেকে। শুধু বাদুড়ের পিঠে চড়ে আসাটাই আশ্চর্য নয়। আশ্চর্য তাদের গায়ের রঙও। নীচের ছাদে যারা জড়ো হয়েছে তাদের মধ্যে চারটে নীল হলদে থাকলেও অধিকাংশই সবুজ রঙ-এর। কিন্তু হাঁসে চড়ে যারা আসছে ওরা সবাই ফিকে লাল। মনে হচ্ছে একটা খুব বড় গগাছের সমাবেশ এখানে হচ্ছে। কিন্তু কাদের সমাবেশ? কারা এরা? স্বপ্ন যদি না হয় তাহলে এ কী দেখছি।

হঠাৎ কপালে কী একটা ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় চমকে উঠে দেখলাম ঘেরাটোপ জড়ানো এক অক্টোপাস মূর্তি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মাথার ওপর থেকে কপালের দুধারের রগে কী একটা এঁটে দিয়েছে।

প্রথমে একটু মাথা ঝিম ঝিম। তারপরই স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ভয় পেয়ে নাযা তোমার মাথায় পরিয়ে দিয়েছি তাতে, তোমার নিজের ভাষা যা-ই হোক, আমাদের সব কথা তুমি নিজের ভাষাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারবে। এ কোনও অণুবশ যন্ত্রট নয়। যে যেখানকারই হোক, তোমার মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর মস্তিষ্কের যে-অংশের বিশেষ ক্ষমতায় পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের কৃত্রিম ভাষা মূল যথার্থ অর্থে অনুবাদ হয়ে যায়, আমাদের দুজনের মস্তিষ্কের সেই অংশই এ-যন্ত্রে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই জুড়ে দেওয়ার দরুন তোমার কথা আমি, আর আমার কথা তুমি ঠিক যেন নিজেদের ভাষায় বলা কথার মতোই বুঝতে পারছ। এখন তোমার মনে যে প্রশ্ন একটা উঠেছে তার উত্তর আগে দিচ্ছি, শোনো। তুমি যা দেখছ তা সত্যই এই জগতের এক মহাসমাজ। এ জগতের সব প্রান্তবাসী আমাদের সব জাতি উপজাতির প্রতিনিধি এখানে এ-জগতের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক চরম সিদ্ধান্ত নিতে চায়। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। তোমার মনের অন্য ক-টি প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে আগে দিয়ে নিচ্ছি। হ্যাঁ, তুমি যা ভেবেছ তাই। তোমাদের জগতের ফাইলাম মোলাস্ক-এর অক্টোপাসের মতো প্রাণীই এখানে সভ্যতার সবচেয়ে উঁচু ধাপে পৌঁছেছে। তোমাদের পৃথিবীতেও এই ফাইলাম মোলাস্ক-এর অক্টোপাস-এর মতো প্রাণীর মধ্যেও অনেক সম্ভাবনা যে আছে। তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং প্রকাণ্ড মাথায় বুদ্ধিটুদ্ধির পরিচয় থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সময় নেই তাই সে কথা এখন থাক। আমাদের এই মহাসমাবেশ কী জন্য তাই বলি। তোমাদের দেশের বাদুড়ের মতো প্রাণীর পিঠে চড়ে আমাদের একদল প্রতিনিধিকে আসতে দেখে তুমি অবাক হয়েছ। ভাবছ বাহন হিসেবে বেগবান যন্ত্র উদ্ভাবন করতে পারিনি বলেই আমরা আদিমকালের মতো অন্য প্রাণীই বাহন হিসাবে ব্যবহার করি। না, তা নয়। আমরা যন্ত্রবিদ্যায় প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে, যে বিজ্ঞান পরমাণু-বোমা দিয়ে সৃষ্টি ধ্বংস করতে চায়, তা রোধ করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। আজকের মহাসমাবেশও তাই নিয়ে। সময় নেই, নইলে আমাদের সব জাদুঘরে পারমাণবিক যুগের সমস্ত আশ্চর্য যন্ত্র তোমায় দেখাতাম। সেগুলো বাতিল করে এখন জাদুঘরে রাখা হয়েছে। আমাদের একদল এখন আর-সব যন্ত্র, এমন কী এই আমার ঘেরাটোপের মতো বস্ত্র বোনবার যন্ত্রও, বাতিল করে একেবারে আদিম প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আর-এক দল কিন্তু যন্ত্রের ওপর রাশ টেনে প্রকৃতির সঙ্গে সুর মেলানো জীবনের সঙ্গে তার একটা সামঞ্জস্য করতে চায়। আমরা আরও পিছিয়ে একেবারে সেই আদিম অবস্থায় ফিরে যাব, না যন্ত্রকে সরল স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে বেঁধে আর এক সভ্যতা সৃষ্টি করব এই প্রশ্নের আজ মীমাংসা হবে। এদিকে সময় যে একেবারে ফুরিয়ে এসেছে সে খেয়াল আমার নেই! আমি

বাধা দিয়ে বললাম, বারবার তুমি সময় নেই সময় নেই বলছ কেন বলো তো! কীসের সময় নেই।

সময় নেই আমাদের আলাপের। মাথার ভেতর শুনলাম, যা তুমি দেখছ শুনছ এসব কোথা থেকে কী করে সম্ভব হল তুমি নিশ্চয় ভাবছ। শোনো, তুমি যা দেখছ তা এক আশ্চর্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কালো ফুটোর জগতের মানুষ তুমি সাদা ফুটোর ভেতর দিয়ে আর-এক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাপার দেখতে পাচ্ছ। কালো ফুটোর কথা তুমি ভাল করে জানো। তোমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোমাদের মাঝে প্রতি সেকেন্ডে ১৮৬০০০ মাইল যে-আলোর গতি সেই আলো লক্ষ কোটি বছরে যা পার হতে পারে না, তোমাদের সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে আরও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে থাকতে পারে, তোমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কালো ফুটো থেকেই তার কিছু আভাস তোমরা বোধহয় পেয়েছ। কালো ফুটো এমন এক প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণের গর্ত যেখানে মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছাকাছি গ্রহ তারা সব কিছু এমন তলিয়ে যায়

যে সেখান থেকে আলো কি বেতার তরঙ্গও বাইরে আসতে পারে না।

গ্রহ নক্ষত্রের মতো সব কিছু যার মধ্যে তলিয়ে যায় সেই ফুটোর মধ্যেই কি তারা জমা হয়ে থাকে? না আর-এক দিকে আর-এক ফুটো আছে তাদের বার হবার? সেই রকম সাদা ফুটোর কথা যারা অনুমান করেছেন তাঁরা ভুল করেননি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে অন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যোগাযোগের এমনই কালো ফুটো আর সাদা ফুটো সত্যি আছে।

বিশ্ব নয়, নিখিল ব্ৰহ্মাণ্ডই বলি। সেই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের কোনও অজানা নিয়মে কিছুক্ষণের জন্য তোমাদের ব্রহ্মাণ্ডের সাদা ফুটো দিয়ে অন্য জগতের কিছুক্ষণের যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। তিন ডাইমেনশন বা মাপের জায়গায় চারের কি পঞ্চম ডাইমেনশন-এর কল্যাণে কিছুক্ষণের জন্য এক জায়গায় পরস্পরকে দু জগৎ ছুঁয়েই ফেলেছে। কিন্তু সে শুধু সামান্য একটু সময়ের জন্য। ওই দেখো, এখনই সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। বিদায় ক্ষণিকের বন্ধু, বিদায়।

মাথার ভেতর শব্দতরঙ্গ যেমন থামল, অদ্ভুত রঙের জগৎও তেমনই কিছুক্ষণের জন্য ঝাপসা হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। কই, কোথায় সেই সবুজ আলোর সভা অক্টোপাসের দেশ? এ তো সেই ধু ধু লাল মাটির মরু প্রান্তর।

আর আমি কি বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম? না, তা তো নয়, আমি ভাঙা বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছি। যা দেখছি কিছু তাহলে মিথ্যে নয়!

ঘনাদা চুপ করলেন।

সাক্ষাৎকার নিতে আসা একজন জিজ্ঞাসা করল, আপনার দু কপালে সাঁটা। যন্ত্রটা—সেটা খুলে নিয়ে গেছিল তো?

কিছু না বলে ঘনাদা শুধু ঠোঁটের ওপর তর্জনীটা চাপা দিলেন।

শিবু ব্যাখ্যা করে বলল, আপনাদের শুধু একটা প্রশ্ন করারই অনুমতি ছিল সেটা ভুলবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *