কাঙ্গপোকপি

কাঙ্গপোকপি — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ

ঋজুদা নেই?

 গদাধরদা দরজা খুলতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তা তিনি নেই তো কী, আমি তো আচি। ভিতরে এইস্যে বইস্যো দিকি। তা এতদিন কোতায় পাইলে গেচিলে তুমি, রুদ্দ বাবু?

পাইলে কেন যাব? ময়না মাসি তো এখন মাইসোরে থাকে। তিতিমিতির জঙ্গলে ঘুরে এলাম এবারের ছুটিতে। কেন? ঋজুদা তোমাকে বলেনি?

হ্যাঁ, আমি তো তেনার ইয়ার কিনা! দিনের মধ্যে কতো কন সাড়ে তিন খানা। মানে, বাক্যি। আমিও কি মনিষ্যি? এই তোমরা এলেই দেকি তেনার মুকে খই ফোটে! বিশেষ করে, ভটকাই বাবু। ইসস, কী সাহস! কী সাহস!

ওর কথা ছাড়ো।

ঋজুদাকে জন্মদিনে প্রণাম করতে এসেও সেই মীরজাফরের প্রশংসা শোনার একটুও ইচ্ছে আমার ছিল না।

কী খাবে বলো?

গদাধরদা বলল!

ঋজুদা গেছে কোথায়?

তা তো বলতে পারবনি। তবে একজন মাদ্রাজি ব্রাহ্মণ ফোন কইরেছিলেন, তাই তিনি গেছেন তার সইঙ্গে দেকা কইরতে।

মাদ্রাজি ব্রাহ্মণ তা তুমি জানলে কী করে?

 আচ্ছা, আমি কি আর মাদ্রাজি জানি? দাদাবাবুই ফোন নামিয়ে রেখে বললেন যে, কাল রাতে একজন মাদ্রাজি ব্রাহ্মণ বাড়িতে খাবেন। পুজো-আচ্চা করে চান-টান সেরে যেন ভাল কইরে রান্না করি।

শোন, মাদ্রাজি বলে কোনও ভাষা নেই। ম্যাড্রাসের মানুষেরা যে ভাষাতে কথা বলে তার নাম, তামিল।

তা এখন বলো দেকি, তাকে খাওয়াবেটা কী?

তা, কীসের মাংস ভালবাসেন তা তো জানি না। কালই সকালে দাদাবাবুকে জিজ্ঞেস করে নে, তাপ্পরই ঠিক হবে।

মাদ্রাজি ব্রাহ্মণ মাংস খান না কোনওরকমই। তুমি বরং ধোঁকার ডালনা, ছানার ডালনা, পটল-পোস্ত, কাঁচা কলাইয়ের ডাল, বেগুন-বাসন্তী, কুমড়োর ফুলভাজা, কচি ঝিঙের টক এই সবই কোরো। খেয়ে তার মাথা ঘুরে যাবে। তুমিই তো ঋজুদার মা এবং বউ। দেখো, ঋজুদার ইজ্জৎ রেখো। আজকাল তোমার রান্না থার্ডক্লাস হয়ে যাচ্ছে।

গদাধরা চটে উঠে বলল, কী করে জাইনলে?

আবার কী করে। বহুদিন তো খাওয়াও না। আসলে কেমন যে রাঁধতে তাই তো ভুলে গেছি!

অ! তাইলে তুমিও কাল রেতে চইলে এসো।

ঋজুদা নেমন্তন্ন না করলেও আসাটা কি ঠিক হবে?

 গদাধরদা হেসে ফেলল।

বলল, ঢং তো দেকি শিকেচো অনেকই। দাদাবাবুর অপেক্কাতেইতো রইয়েচো। যেদিন আস সেদিনই তো ফ্রিজে যা কিছু থাকে সবই সাবড়ে দিয়ে যাও। পাইরলে আমাকে সুদু খেইয়ে ফেল, তার…

আমি হেসে ফেললাম। বাণ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি জেনে খুশি হলাম।

বললাম, তা হলে উঠি। ওহহ, দেখেছ, তোমাকেই প্রণাম করতে ভুলে গেছি। বলেই, গদাধরদাকে নিচু হয়ে প্রণাম করতে গেলাম।

আহা করো কী! কর কী! দাঁড়াও, ব্যাপারটা কী? দাঁড়াও, পাটা ধুয়ে আসি।

আহা। তুমি হলে গিয়ে গুরুর গুরু। তা ছাড়া তুমি পা-ই যদি ধোবে তবে আর পদধূলি পাব কী করে?

বলেই, প্রণাম করলাম।

দেকো তো! দেকো তো! ছেলেটা কতা শোনেনা মোট্টে। বলেই বলল, চুপটি কইরে বস। আমি ক্ষীরের তক্তি, চন্দ্রপুলি আর কুচো নিমকি নে আসতেচি।

কালোজিরে আর শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো দিয়েছ তো নিমকিতে ভাল করে? ময়ান দিয়েছ?

হ্যাঁরে বাবা, হ্যাঁ। তিনকাল গে এককালে ঠেইকল আর উনি এইচেন আমাকে রান্না শেকাতে!

গদাধর ভিতরে যেতে না যেতেই ঋজুদার ড্রয়িংরুমের ডানদিকের জানালার দিকের কোণে যে গোলাকৃতি একটি ঝকঝকে বার্নিশ করা টেবিল আছে; সাদা ইটালিয়ান মাৰ্বল ট-এর; সেই টেবিলের উপরে উজ্জ্বল লালরঙের গোলাকৃতি একটি জিনিস চোখে পড়ল। অমন সুন্দর উজ্জ্বল লালরং আমি কখনওই দেখিনি। জিনিসটার উপরে সূক্ষ্ম রুপোর জালের ওড়িশি কাজ করা একটি ঢাকনি। সেটিও গোলাকৃতি। উঠে গিয়ে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করব জিনিসটি, ঠিক এমনই সময়ে কলিংবেলটা বাজল। গদাধরদা ভেতরে থাকায় আমিই গিয়ে দরজাটা খুললাম। আর খুলেই দেখি, ভটকাই। এবং তার পিছনে ঋজুদা।

কী রে? কতক্ষণ? তা আদর আপ্যায়ন করেছে গদাধর ঠিকমতো?

হচ্ছে, হচ্ছে। আমি বললাম।

 বিরক্তি গোপন করে।

ভটকাই তা হলে ঋজুদার এত কাছের মানুষ হয়ে গেছে যে, আমি জানি না আর ঋজুদা ভটকাইকে নিয়ে…। ওই মাদ্রাজি ব্রাহ্মণের সঙ্গে নতুন কোনও রহস্য বা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ যে মাখামাখি হয়ে আছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই রইল না আমার। এবং ওই রহস্যময় সুন্দর লাল গোলাকৃতি জিনিসটির সঙ্গে ওই মাদ্রাজি ব্রাহ্মণের নিশ্চয়ই কোনও যোগাযোগও আছে।

মুখ গম্ভীর দেখেই ঋজুদা মন পড়ে নিয়ে বলল, তুই তো কলকাতায় ছিলি না। এলি কবে?

আজই সকালে।

তাই বল। তুই নেই জানি, তাই ভটকাইকে আর তিতিরকে আসতে বলেছিলাম। আমি অন্য জায়গাতে গেছিলাম। ভটকাই-এর সঙ্গে আমার একসঙ্গে ঢোকাটা নেহাতই কাকতালীয়।

আমি আশ্বস্ত হয়ে বললাম, তাই বলো! ঘরে ঢুকেই বুঝেছি যে, ওই নবাগন্তুক মাদ্রাজি ব্রাহ্মণ আর ওই লাল বলের সঙ্গে নতুন কোনও রহস্য বা অ্যাডভেঞ্চার দানা বাঁধছে। আর তিতিরদের ফোন খারাপ।

লাল বল?

 ঋজুদা অবাক হয়ে শুধোল।

হ্যাঁ।

আমি এমফ্যাটিক্যালি বললাম, লাল বল।

 আমিতো জানি না। কোথায়?

ওই দ্যাখো।

 ঋজুদা নিজের টিল্টিং-চেয়ারটাতে বসতে যাচ্ছিল কিন্তু বলটা দেখেই, না-বসে সেদিকে এগিয়ে গেল। ইতিমধ্যে গদাধরদাও আমার জন্যে ট্রেতে সাজিয়ে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল।

তাকে দেখতে পেয়েই ঋজুদা জিজ্ঞেস করল, এটা কী জিনিস, গদাধর? কে দিল এটা? তোমাকে আর কতদিন বলব যে, কখনও অচেনা মানুষদের কাছ থেকে কোনও জিনিস নেবে না, রাখবেও না বাড়িতে। এটা যে একটা টাইম-বম্ব নয়, তাই বা এখুনি জানা যাবে কী করে?

আমি চণ্ডীগড়ে ছিলুম তো গতবছর পুজোর মধ্যে। ঠিক এমনি একটি টাইমবম্ব দিয়েই টেররিস্টরা একটি পুরো বাড়ি উড়িয়ে দিয়েছিল। আমারই চোখের সামনে। হাউ ডেঞ্জারাস! ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করতে হচ্ছে।

ভটকাই অত্যন্ত উত্তেজিত গলাতে বলল।

গদাধরদা কথার মধ্যে কথা বলে উঠল, যা কখনওই করে না সে। বলল, এটা তো এই ভটকাই বাবুই কিছুক্ষণ আগে দে গেল। বইলে গেল, রেখে দাও গদাধরদা, আমি এই একুনি আসতিচি…

ঋজুদা চাপা বিরক্তির সঙ্গে বলল, ভটকাই? কী ওটা?

 ভটকাই একটুও না-ঘাবড়ে বলল, পৃথিবীর চৌত্রিশতম বিস্ময়।

 ব্যাপারটা কী?

ঋজুদা আবারও শুধোল। অসীম কৌতূহলের এবং বিরক্তির সঙ্গে।

এর পেছনে ভটকাই-এর কোনও ষড়যন্ত্র আছে এবং সেটা আমারই বিরুদ্ধে যে, এমন একটা সন্দেহও আমার মনে হঠাৎই উঁকি দিয়ে গেল। কিন্তু কোনও কথা না বলে আমি মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে ক্ষীরের পুলি খেতে লাগলাম।

ঋজুদা উঠে গেল জিনিসটার কাছে। রূপোর জালের ঢাকনাটা খুলল। খুলেই, হো হো করে হেসে উঠল। হাসতেই থাকল। এমন হাসি ঋজুদাকে বহুদিন হাসতে দেখিনি। ঋজুদার হাসি শুনে আমি খাওয়া থামিয়ে উঠে দৌড়ে গেলাম সেই জিনিসটার কাছে। দেখি, ওই বস্তুটির ওপরে ছোট্ট একটি লাল কাগজের টুকরো আঠা দিয়ে সাঁটা আছে। তার ওপর লাল কালিতে লেখা, মিস্টার রুদ্র রায়। লাল কাগজ এবং লাল কালি বলেই দূর থেকে ঠাহর হয়নি।

ঋজুদা তখনও হাসছিল। কিন্তু আমি কিছুই বুঝলাম না।

হাসি থামতে ঋজুদা বলল, ভটকাই, তুই বড় কৃতঘ্ন। এই রুদ্রই তোর জন্য অনেক ওকালতি করেছিল আমার কাছে। রুদ্রর জন্যই তুই ‘নিনিকুমারীর বাঘ’ মারার অ্যাডভেঞ্চারে আমাদের সঙ্গী হয়েছিলি, আর ‘সুফকর’-এও গেছিলি আমাদের সঙ্গে। সেই রুদ্রর সঙ্গে তোর এমন ব্যবহার করাটা মোটেই ভাল হচ্ছে না। তোর মতো কৃতঘ্ন বাঙালিদের জন্যেই বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মতো মানুষকেও সাঁওতালদের সঙ্গে কাটাতে হয়েছিল, শেষ-জীবনটা।

ভটকাই তার উত্তরে হঠাৎ একটি গানের কলি আমারই দিকে চেয়ে, ডানহাতের তিন আঙুল নেড়ে নেড়ে গেয়ে উঠল, আদর যতন করিতে যেমন সে বাঁধনে যেন ছিড়োনা। আমি জগতের কাছে ঘৃণ্য হয়েছি, তুমি যেন ঘৃণা কোরো না।

এটা আবার কী গান?

 ঋজুদা হেসে ফেলে বলল।

আঙুরবালা দাসীর গান। আমার ঠাকুমার মাথাতে যন্ত্রণা হলেই পুরনো ঘি মালিশ করতেন মাথায়, ব্যাব্যাগো! কী দুজ্ঞন্দ! আর তখন কলের গানে ওই গানটি শুনতেন।

আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ওই বস্তুটি কী?

ভটকাই বলল, ওটি হচ্ছেন গিয়ে তুমিই! বুয়েচ। ওটা একটি ফল। ওর নাম মাকাল ফল। অত সুন্দর কিছু দেখেছ কি আগে? আশ্চর্য সুন্দর, কিন্তু কোনও কাজেই লাগে না কারও। না খাওয়া যায়, না ফুটবল খেলা যায়, না তরকারি হয়, না টক হয়। কথায়ই বলে না, জামাই একটি মাকাল ফল! এই ফলেরই আরেক নাম, রুদ্র রায়।

ঋজুদা বলল, রাগ করছিস কেন, রুদ্র? আমরা সকলেই জানি, তুই নিজেও জানিস তুই কী? কিন্তু তুই ভটকাই-এর সেন্স অব হিউমারটা অ্যাপ্রিসিয়েট কর।

আমি বললাম, বাট হোয়াই অলওয়েজ অ্যাট মাই কস্ট?

ভটকাই বলল, বিকজ মাকাল ফল ইজ কস্টলি, অলমোস্ট অ্যাজ কস্টলি অ্যাজ য়ু আর।

পেলি কোথায় এটাকে?

এবারে ঋজুদা শুধোল।

কোথায় আবার? আমার রুটস যেখানে, সেখান থেকেই। সেই কেষ্টলগর সিটিতে। চুর্ণী নদীর পারের এক বড়লোকের ভেঙে পড়া বাগানবাড়ির লাগোয়া অবহেলিত নির্জনে একলাই বাগান আলো করে শোভা পাচ্ছিল। সংগ্রহ করেছি অনেকই দিন। মনিমাসিমার ডিপ ফ্রিজে রাখা ছিল। যাতে চেকনাই না নষ্ট হয়।

আশ্চর্য! মাকাল ফল, কিন্তু আমিও আগে দেখিনি কখনও। এত বনে-জঙ্গলে ঘুরেছি। ঋজুদা বলল।

তুমি চিনবে কী করে? মাকালেই মাকাল চেনে!

 ভটকাই ফুট কাটল।

আমার খাওয়া শেষ হলে বললাম, এই মাদ্রাজি ব্রাহ্মণটি কে? একটি রহস্য-রহস্য গন্ধ পাচ্ছি যেন।

ঋজুদা বলল, অনুমান মিথ্যে নয়, তবে এবারে যদি যেতে রাজি হই তবে মিশনটি এতই বিপজ্জনক যে, তোমাদের কাউকেই নেব কি না আদৌ, তা ভেবে দেখতে হবে।

ভটকাই বলল, রামকৃষ্ণ মিশন না চ্যারিটি মিশন তা আমি জানি না, কিন্তু আমাদের না নিলে আমরা তোমার দরজার সামনে অনশন করব বলে দিচ্ছি। প্রথমে দাঁড়ানো-অনশন, তারপর বসা-অনশন। না হলে শোওয়া-অনশন। মিশনটা কী? আর ওই মাদ্রাজি ব্রাহ্মণটিই বা কে?

ঋজুদা বলল, আমার আজকে এক্ষুনি একবার বেরুতে হবে। তোরা কাল সন্ধে সাতটার মধ্যে চলে আয়। কেদাণ্ডারামাইয়া মশাই আসবেন সাড়ে সাতটাতে। আলিপুরে ওঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন।

উনি কে?

 উনি কর্ণাটকের ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ।

 তোমার সঙ্গে কী?

কিছু নয়, কিছু হতে পারে। ওরই বড় সম্বন্ধী হচ্ছেন ভেঙ্কটরামাইয়া মশায়। নাম শুনিসনি? ভারত বিখ্যাত ভীনাবাদক। উনি আমার বহু দিনের বন্ধু। গতমাসে রবীন্দ্র সরোবরের কাছের থিয়াগারাজা হলে রসিকারঞ্জনা সভার একটি অনুষ্ঠানে উনি বাজালেন। সেখানে গেছিলাম ওঁর বাজনা শুনতে। ওঁরই নিমন্ত্রণে। বাজনা শেষ হলে, যখন ব্যাকস্টেজে ওঁকে কনগ্রাচুলেট করতে গেছি, তখনই উনি বললেন ভীরাপ্পান-এর দৌরাত্ম্যের কথা এবং ওর ভগ্নীপতি কেদারামাইয়া মশায়কে উনি ওঁর সমস্যার কথা শুনে আমার কথা বলেছেন। এখন আমি যদি রাজি থাকি, তো আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে তিনি ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা আসবেন।

ভেঙ্কটরামাইয়া মশায় বড় গুণী মানুষ, তা ছাড়া কেসটা খুবই বিপজ্জনক হলেও খুবই ইনটারেস্টিংও। যাই হোক, এখন আমার তাড়া আছে। তোরা ইচ্ছে করলে বসতে পারিস। বাঘ সংক্রান্ত ভিডিও ফিল্মগুলো এতদিনে ফেরত পেলাম, সনৎদার কাছ থেকে। দেখবি তো, বসে দেখতে পারিস। গদাধরতো আছেই। আর বাড়িটা তো তোদেরই! বুড়ো বয়সে কবে যে তোরা আমাকেই বের করে দিবি বাড়ি থেকে, তোরাই জানিস।

আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছ, দাঁড়াও! প্রণাম করতেই তো আসা, প্রণামটা অন্তত করতে দাও। আজ না তোমার জন্মদিন।

ভটকাইও বলল, ভুলেই মেরে দিয়েছিলুম। মাকাল ফল নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলুম।

বাস বাস। আর নয়। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।

ঋজুদা আমাদের মাথায় হাত রেখে বেরিয়ে পড়ল।

বলল, গদাধর, ওদের দেখো!

আমি বললাম, আশ্চর্য! ঋজুদার জন্মদিনে তিতির…

তিনি তো বাবা মায়ের সঙ্গে এবার গোয়াতে গেছেন। সেখান থেকে বম্বে ফিরে মনে হয়, মহাবালেশ্বর যাবেন। সেখান থেকে বেস ক্যাম্প করে ছত্রপতি শিবাজির দুর্গগুলো দেখবেন। এক এক করে। মায় সামুদ্রিক দুর্গ জিঞ্জিরা পর্যন্ত।

ঋজুদা বেরিয়ে যাবার পরে ভটকাই বলল, ঈশ্বর কিছু লোককে কপাল দিয়ে পাঠান। সত্যি! ভীষণ একচোখো ভদ্রলোক। যাই বলিস, আর তাই বলিস, রুদ্র। নইলে আমরা ঋজুদার ঘাড়ে চেপে ছাড়া কোথাওই যেতে পারি না আর তিতির কেমন…বলেই চোখ, ঠোঁট ও জিভ এই তিন প্রত্যঙ্গের সাহায্যে টাক করে একটা শব্দ করল, যা শুধু ভটকাইই করতে পারে। মেয়েরা তেঁতুল বা চালতা খেয়ে এমন শব্দ করে বটে; কিন্তু, কোনও ছেলেকে, ভটকাই ছাড়া এমন শব্দ করতে শুনিনি।

.

সকালে ঋজুদা প্রত্যেককেই ফোন করেছিল। বিকেল চারটেতে ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে ডেকেছে। কোল্লেগাল-এ যাবে, এমন মর্মে তামিলনাড়ু আর কর্ণাটক সরকারের যৌথ আবেদন মঞ্জুর করে ঋজুদা তার বন্ধু অনীকদার অফিস থেকে ফ্যাক্স পাঠিয়ে দিয়েছে। এই দুই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সেক্রেটারিরা নাকি ঋজুদার অ্যাকসেপটেন্স পেয়ে ফোন করেছিলেন ঋজুদাকে।

বিশপ লেফ্রয় রোডে যখন গিয়ে পৌঁছলাম চারটে বাজতে দুমিনিটে, দেখি তিতির ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে এবং বসে আছে ঋজুদার সঙ্গে। বসবার ঘরে। গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটাতে যখন গাং গাং করে চারটে বাজল, ঠিক তখনই ভটকাই ঢুকল। হাতে একটা প্রায় তিন কেজি ইলিশ মাছ নিয়ে। ঘড়ির দিকে বাঁহাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, দ্যাখ, দেখে শেখ। একেই বলে, অন টাইম।

ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে বলল, ব্যাপারটা কী! মোহনবাগানের সাপোর্টারের হাতে ইলিশ। অবাক করলি তুই।

বড়মামা দিলেন। জুট মিলের ম্যানেজার তো! বাড়ির জন্যও এনেছেন। আর তোমার নাম করেও একটা। ঋজুদার সঙ্গে সুফকর-এ পড়ে খুব ভাল লেগেছে কি না। ঋজু বোসের ফ্যান হয়ে গেছে একেবারে। তাই তোমার জন্য এই নৈবেদ্য। কোথায় গেলে গদাধরদা? এই নাও গো। দেকো, কী এইনিচি তোমার জইন্যে।

বলেই, গলা তুলে চেঁচাল।

এই এনু বলে, ভটকে দাদা।

ভেতর থেকে গদাধরদা সাড়া দিল।

শুধু ঋজুদাকেই নয়, গদাধরদাকেও ভটকাই কাবু করেছে ভালমতো। কিছু আছে ছেলেটার মধ্যে। তুকতাকও জানতে পারে!

গদাধরদা আসতেই ভটকাই বলল, তোমার রুইদ্দবাবু বলার আগে আমিই বলতিচি, রাতে আমরা খেইয়ে যাব কিন্তুক। আকাশে মেঘ কইরেচে দেকেচো তো! ভাজা মুগডালের ভুনি খিচুরি, মধ্যে চিনাবাদাম, কিসমিস দিয়ে; আর ইলিশমাছ ভাজা। কড়কড়ে করে। শুকনো লঙ্কা আর পিয়াজি ভাইজতি ভুলে যেওনি যেন আবার।

তুমি যে এক্কেবারে রুইদ্দবাবু হইয়েচো গো ভটকেদাদা।

তা না হয়ে কি পারি, গদাধরদা? আমি যে তেনারই চ্যালা। আর ঋজুদা হলেন গে আমাদের সক্কলের মহাগুরু। বুইজলে কিনা!

ঋজুদা হেসে উঠল ভটকাই-এর কথার ভঙ্গিতে।

সত্যি! নর্থ ক্যালকাটার এই ছেলেটা ঋজুদার চরিত্রটাই পাল্টে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। ভটকাই-এর প্রতি কথাতেই এত হাসির কী আছে ঋজুদার, তা কে জানে!

তোরা কে কোন কাগজ পড়িস রে? বাংলা?

বর্তমান। আমি বললাম।

তিতির বলল, আমি বাংলা কাগজ পড়িই না। শুধুই, দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া পড়ি।

অন্যায় করিস। ঋজুদা বলল।

একাধিক না রাখলেও অন্তত একটা বাংলা কাগজ রাখা উচিত প্রত্যেক শিক্ষিত বাঙালির বাড়িতেই। স্থানীয় একটা ইংরিজি কাগজও।

ভটকাই বলল, আমাদের বাড়িতে দ্য স্টেটসম্যান আর আনন্দবাজার রাখা হয়। আমার মেজদাদুর তো বাথরুমই হত না প্রথম থেকে শেষ অবধি আনন্দবাজার না পড়লে।

ভটকাই বলল।

তিতির হেসে উঠল, ওর কথা শুনে। বলল, মিল্ক অফ ম্যাগনেসিয়ার কমপিটিটর না কি? আনন্দবাজার?

দেশে-বিদেশেতে পড়েছি যে, সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের বাবা ‘দ্য স্টেটসম্যান’ থেকে ‘প্রিন্টেড অ্যান্ড পাবলিশড বাই অবধি না পড়লে তাঁর দিনটাই নষ্ট হয়ে যেত। বিশেষ বিশেষ কাগজ সম্বন্ধে অনেকের এমন দুর্বলতা থাকেই। কথাটা ঠাট্টা নয়।

ঋজুদা বলল।

যে কারণে তুমি কাগজের খোঁজ করছিলে ঋজুদা, গতকাল, মানে বনধ’-এর দিনের আনন্দবাজারের কপি নিয়ে এসেছি। এই কারণেই তো জিজ্ঞেস করছিলে?

হ্যাঁ, ভেরি স্মার্ট অফ য়ু। কিন্তু কেটে আনতে গেলি কেন? আমিও তো আনন্দবাজারই রাখি।

তবুও নিয়ে এলুম। সাবধানের মার নেই। ভটকাই বলল।

তা এনেছিস যখন, তুই-ই ওদের পড়ে শুনিয়ে দে খবরটি। এটিই হচ্ছে লেটেস্ট খবর ভীরাপ্পানের ওপরে। গতকাল ‘বনধ’ না হলে পেয়ে যেতাম ডিটেইলড খবর, ফ্যাক্স-এ। মাইসোর ও কোয়েম্বাটোর থেকে।

বলেই বলল, ও ভাল কথা, মিস্টার এন. কৃষ্ণমূর্তি ফোন করেছিলেন আজ সকালেই। মানে পশ্চিমবঙ্গের চিফ-সেক্রেটারি। চমৎকার বাংলা বলেন ভদ্রলোক। খুব ভাল লাগল। বললেন, ওঁকেও নাকি কর্ণাটক আর তামিলনাড়ুর চিফ সেক্রেটারিরা ইনফর্ম করে রেখেছেন।

তারপর গম্ভীর মুখে ঋজুদা বলল, আমার কিন্তু বেশ চিন্তা হচ্ছে। ভাবছি এবার তোদের কারোকেই নিয়ে যাব না সঙ্গে। ইট উইল বি ভেরি ভেরি রিস্কি। এতখানি ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। পুলিশ, বি. এস. এফ. কম্যান্ডোদের ব্যাটেলিয়ানের পর ব্যাটেলিয়ান, দুটি রাজ্যের সব শক্তিকেই যে বিফল করে দিচ্ছে, তার মুখে তোদের এগিয়ে দেওয়া যায় না। দুপক্ষেরই কত লোক মারা গেছে, তা জানিস?

একথা শুনেই ভটকাই সটান ঋজুদার পায়ের সামনে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ল দুহাত জড়ো করে, ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ স্টাইলে।

ঋজুদা বিরক্ত হল। হঠাৎই ভীষণ চটে উঠে বলল, সবসময় সবকিছু ভাল লাগে না ভটকাই। খুব সীরিয়াস একটা ব্যাপার নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। তা ছাড়া এবারে যদি কারোকে নিতেও হয় সঙ্গে, তোকে নেওয়া আউট অফ দ্য কোয়েশ্চেন। তুই এ পর্যন্ত শুধু ‘নিনিকুমারীর বাঘ’ মারতেই গেছিস আমাদের সঙ্গে। ওইটিই তোর মেইডেন ভেঞ্চার। ভীরাপ্পানের সামনে যেতে হলে যেমন অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন তা হয়তো রুদ্র আর তিতিরের কিছুটা আছে, কারণ ওরা আফ্রিকাতে আমার সঙ্গে গেছিল। রুদ্র তো দুবার গেছিল, এবং প্রথমবার তো বলতে গেলে ওই আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী চোরাশিকারিদের ওরা মোকাবিলা করেছে আফ্রিকাতে। আজকের এই মিটিংটা শিক্ষার মধ্যে পড়ে তাই আজকে ডেকেছি তোকে। তবে, তোকে তো নয়ই, তোদের কাউকেই এবার সঙ্গে নাও নিতে পারি। এ ভীষণই বিপজ্জনক ব্যাপার। এবার আমি নিজেই বেঁচে ফিরে আসব কিনা তারই কোনও স্থিরতা নেই। অথচ, স্বদেশের ব্যাপার। বিদেশের ডাকে তাদের সমস্যার সমাধান করে এসে নিজের দেশের আকুল আহ্বান পাবার পরও যদি না যাই, তাহলে সবাই আমাকে ভীতু ভাববে। বলবে, ঋজু বোস একটা হোক্স। স্পেন্টফায়ার। কিন্তু একা যে ঝুঁকি নেওয়া যায়, তোমাদের সঙ্গে করে সে ঝুঁকি নেওয়া যায় না। তোমরা তিনজনেই ছেলেমানুষ। কত সুন্দর জীবন পড়ে আছে তোমাদের সামনে। প্রত্যেকেরই সামনে। তা ছাড়া একটাই জীবন! যে জীবন নিয়ে তোমাদের প্রত্যেকেরই অনেক কিছু করার আছে। বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে তোমরা ভীরাপ্পানের এ. কে. ফর্টিসেভেন রাইফেলের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হবে, তা আমি হতে দিতে পারি না। তা ছাড়া, তোমাদের মা বাবার কাছেই বা আমি মুখ দেখাব কেমন করে? যদি নিজে বেঁচেও ফিরি? না, না। তা হয় না।

ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধতা নেমে এল। ঋজুদার এই স্নাবিংটার খুবই দরকার ছিল ভটকাই-এর। কিছুদিন ও এখন ঠাণ্ডা থাকবে। বড্ডই বেড়ে গেছিল। তবে, আমারও মন খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গেই যখন নিয়ে যাবে না, তখন এই মিটিংকনফারেন্সের কী দরকার ছিল? তিতিরের মুখও ব্যাজার হয়েছে দেখলাম।

ঋজুদাই নীরবতা ভেঙে একটু পরে বলল, কী রে! পড় ভটকাই। যে কাটিংটা এনেছিস, আনন্দবাজারের।

প্রচণ্ড ঝড়ে ডানা-ভাঙা পাখির মতো অবস্থাটা সামলে উঠতে সময় নিল একটু ভটকাই। কিন্তু, উঠল সামলে। উঠে, মানুষ যেমন করে শোকসভাতে শোকপ্রস্তাব পাঠ করে, তেমন করে, আনন্দবাজারের কাটিংটা সামনে ধরে গম্ভীর গলাতে আস্তে আস্তে পড়তে লাগল:

আনন্দবাজার পত্রিকা।
৭ই জুন, ১৯৯৩

ভীরাপ্পানের আরও ছয় সাগরেদ ধৃত
ব্যাঙ্গালোর, ৬ জুন–চন্দনকাঠের কুখ্যাত চোরাচালানকারী ভীরাপ্পানের আরও ৬ সাগরেদকে গতকাল গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই ছ’জনের মধ্যে ভীরাপ্পানের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী রয়েছে। এই লোকটি ভীরাপ্পানের দলকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত। মালে মহাদেশ্বর পাহাড় অঞ্চলের একটি মন্দিরের এক পুরোহিতকেও আটক করেছে পুলিশ। পুলিশের সন্দেহ, এই পুরোহিতের সঙ্গে ভীরাপ্পানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এবং মাঝে মধ্যেই তাদের দেখা হত। কাল এই ছ’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ বড় রকম সাফল্য পেয়েছে।

মহীশূর জেলার কোল্লেগাল তালুক থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করার ফলে এ পর্যন্ত ভীরাপ্পানের মোট ১৭ সাগরেদ ধরা পড়ল। গত সপ্তাহেই আটক করা হয়েছে ১১ জনকে। মূল্যবান চন্দনকাঠ চুরি কিংবা হাতির দাঁতের জন্য চোরাগোপ্তা হাতি শিকারের কাজে এরা নানাভাবে সাহায্য করত। যে পুরোহিতকে আজ পুলিশ গ্রেফতার করেছে সে মালে মহাদেশ্বর পাহাড়ের কাছে টালাবেট্টার নবগ্রহ মন্দিরের। ওই মন্দিরের কাছেই ২৪ মে ভীরাপ্পানের দল পুলিশের টহলদার দলকে আক্রমণ করে ৬ জন পুলিশকর্মীকে খুন করে। ভীরাপ্পানের আটক সাগরেদদের থানা হাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে পুলিশ।

ইতিমধ্যে ৫০০ আধাফৌজ কালকেই মালে মহাদেশ্বর পাহাড়ে পৌঁছে গিয়েছেন। পথে তাঁদের বিপুল সংবর্ধনা জানান স্থানীয় মানুষ। সেখানে পৌঁছে সীমান্তরক্ষীবাহিনীর (বি. এস. এফ) কম্যান্ড টাস্ক ফোর্স অফিসারের সঙ্গে বসে ‘অপারেশনের কৌশল মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছেন। তাঁদের লক্ষ্য, ভয়ঙ্কর চন্দন-দস্যু জঙ্গলের পোকা ভীরাপ্পানকে যেন তেন প্রকারেণ ধরা।

অপারেশনের সময় আধাফৌজ এবং টাস্কফোর্সের চলাচল অবাধ করতে সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ২০ জুন পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে গ্রামবাসীদের গতিবিধির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মালে মহাদেশ্বর পাহাড় এবং তামিলনাড়ু সীমান্তের দিকে যাওয়ার সমস্ত বেসরকারি বাসও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

.

ভটকাই-এর পড়া শেষ হলে, তিতির বলল, এখন ভীরাপ্পান কোণঠাসা হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। এর কিছুদিন আগেও তো ওর চ্যালা-চামুণ্ডা কিছু মারা পড়েছিল পুলিশের হাতে। হি ইজ লুজিং গ্রাউন্ড গ্র্যাজুয়ালি।

আমার সন্দেহ আছে।

ঋজুদা বলল।

যারা মারা গেছে, তারা যে ভীরাপ্পানেরই লোক, এর প্রমাণ কী? এমন এমন সিচ্যুয়েশনে দুপক্ষই ভুল করে, অনেক সময় ইচ্ছে করে প্রেসকে ভুল খবর দেয়। ভুল জেনেও, তা ঠিক বলে দাবি করে। হাওয়াটা কোনদিকে বইছে, তা এখানে বসে খবরের কাগজ পড়ে বোঝা সম্ভব নয়। স্পট-এ যাওয়া দরকার। আর্মচেয়ার কনসার্ভেসানের মতোই, আর্মচেয়ার–জার্নালিজমের মতোই, তা হবে থিওরিটিক্যালি এক্সারসাইজ। দুপক্ষরই প্রত্যেক দাবি ও পাল্টা দাবির সত্য খুব ভাল করে যাচাই করে দেখতে হবে, নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে।

তিতির বলল, মাঝে মাঝেই খবরের কাগজে পড়ি বটে, কিন্তু আসলে এই মানুষটা কে? কোথায় থাকে? কী করে? তামিলনাড়ু আর কর্ণাটক সরকারের যৌথ প্রচেষ্টাতেই তাকে ধরা বা মারা কেন যে সম্ভব হল না এতদিনেও, তা তো আমার বোধগম্য হয় না।

হয়তো তোর বুদ্ধির অকুলান বলেই।

ঋজুদা বলল।

আমাদের একটু বলো না ভীরাপ্পান সম্বন্ধে, ঋজুকাকা। তুমি যেমন আমাদের গার্জেন, আমরাও তোমার গার্জেন। সব শুনে-টুনেই ঠিক করব তোমাকে একা একা সেখানে যেতে দেওয়া আদৌ ঠিক হবে কি না!

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, আচ্ছা কল করবার মতলবে আছিস তো তোরা। দ্য টেবিল ইজ টার্নড়, ইট অ্যাপিয়ার্স।

সে তুমি যাই বলো। আগে তো শুনি। তারপরই আমরা ডিসাইড করব। লোকটার পুরোনাম কী? বয়স কত?

বয়স? কত হবে? এখন হবে, এই চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মতো। পাঁচশো বুনো হাতি মেরেছে ওর দল, দাঁতের জন্য। রুআহা-র ভুষুণ্ডারাও লজ্জা পাবে ভীরাপ্পানের কাছে। আর কত কোটি টাকার চন্দনকাঠও যে পাচার করেছে তার সঠিক হিসেব কেউই জানে না। তবে মানুষটাকে ধরার ও মারার জন্য দুই রাজ্যের কম্যান্ডো ট্রেনিং-নেওয়া পুলিশ অফিসারেরা, বি. এস. এফ-এর জওয়ানরা, ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডস, এমনকী ইন্দো-টিবেটান বর্ডার ফোর্সের বাঘা বাঘা জওয়ানরা আর অফিসাররাও শুধু ঘোলই খাননি, অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন তার হাতে। কিন্তু এত করেও ভীরাপ্পানকে ধরা যাচ্ছে না। কিছুদিন হল ভীরাপ্পানের যেখানে বিচরণভূমি, সেই অঞ্চলে, একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে, যাতায়াতের সব পথ রুদ্ধ করে, সমস্তরকম সরবরাহ বন্ধ করে, ওকে প্রাণে মারার উপক্রম করা হচ্ছে। তবুও ভীরাপ্পান ধরা পড়ছে তো নাই, মাঝে মধ্যেই নানাভাবে দুঃসাহসিক ফন্দি-ফিকির করে, হাজারের ওপর নানা ফৌজকে বুন্ধু বানাচ্ছে, তাদের অফিসারদের সুষ্ঠু মেরে দিচ্ছে।

এত সব ফৌজ মিলেও কেন ধরতে বা মারতে পারছে না ওকে, ঋজুদা?

কারণটা কী বা কী কী হতে পারে, তোরাই বল।

গদাধরকে ঢুকতে দেখেই থেমে গিয়ে তাকে বলল ঋজুদা, এতক্ষণে মনে পড়ল তোমার গদাধর? শুধু কি কথাতে পেট ভরে? এরা যে খিদেতে মরছে। ভটকাই-এর মুখের দিকেই একবারটি চেয়ে দেখো তুমি।

এট্টু দেরি হয়ে গেল দাদাবাবু। পেটিসগুলান ঠাণ্ডা মেরে গেচিল কি না! তাই এট্ট গরম কইরে নে এলাম।

পেটিস না, প্যাটিস গদাধরদা।

ওই হল। আর সঙ্গে পেটিটিরিও আচে। নাও। দাদা-দিদিরা সব ভাল কইরে খাও দিকিনি। আমি চা আইনতেচি বড় টি-পটে করি।

পেটিটিরিটা কী ব্যাপার?

তিতির অবাক হয়ে ঋজুদাকে শুধোল।

ঋজুদা হেসে বলল, পেস্ট্রি। ফ্লুরি’ থেকে প্যাটিস আর পেস্ট্রি আনছে গদাধর গত কুড়ি বছর হল, কিন্তু পেটিস আর পেটিটিরি’ যেই কে সেই রয়ে গেল। বদলাল না একটুও। গদাধর মানুষটা একেবারে ওরিজিনাল।

সামান্য একটু উন্নতি হয়েছে। আমি বললাম। আগে বলত, কেকুরি-পেটুরি–মানে, কেক ও প্যাস্ট্রি।

তিতির আর ভটকাই হেসে উঠল।

ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে বলল, নে নে। তোরা তুলে নে, কোয়ার্টার প্লেটে করে। ফর্ক নে, ন্যাপকিন নে। তারপর পাইপে একটা টান দিয়ে বলল, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলি না।

ভটকাই একটা চকোলেট-কেকের পুরোটা একেবারেই মুখে পুরে দিয়েছিল। তাই সাঁতার না-জানা মানুষ যেমন জলে পড়ে খাবি খায়, তেমন করে খাবি খেতে খেতে কেকটাকে কজা করার চেষ্টা করতে করতেই বলল, আমি বলব?

বল।

আমার মনে হয়, এত পুলিশ-টুলিশের মধ্যে একজনও আসলে নিজে মরতে রাজি নয় বলেই মারতে বা ধরতে পারেনি ওরা ভীরাপ্পনকে, আজ অবধিও। আমায় নিয়ে চলো ঋজুদা, আমি ঠিক মেরে দেব। নিজে মরতে রাজি না থাকলে কি অমন দুর্ধর্ষ কাউকে মারা যায়? এত হাজার ফোর্স গেলে হবে কী? আমি বাজি ফেলতে পারি, এদের মধ্যে একজনও নিজে মরতে রাজি নয়। একজনও নয়। ডেডিকেশন চাই, জেদ চাই, করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে অ্যাটিচুড চাই।

আমি বা তুই মরতে রাজি থাকলে অথবা না-থাকলেও ভীরাপ্পান যে আমাদের ঠিকই মেরে দেবে, সে বিষয়ে ভীরাপ্পানের অথবা আমারও কোনওই সন্দেহ নেই। এমন কথা হচ্ছে, ভীরাপ্পন নিজে মরে কি না? তার মরার বিশেষ ইচ্ছে আছে বলে মনে হচ্ছে না। আর ওকে জীবিতাবস্থায় ধরার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ধরা পড়বে পড়বে হলেও হয়তো সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করবে।

তারপরই বলল, আরও কী কী কারণ হতে পারে, রুদ্র? তিতির? ভটকাই অ্যাটলিস্ট মেড আ পয়েন্ট। ভটকাই-এর উত্তরটা অন্তত একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়। ‘ আমি বললাম, আমার মনে হয়, ভীরাপ্পান জঙ্গলের পোকা। তোমারই মতো ও বনজঙ্গলকে খুব ভাল করেই চেনে। বিশেষ করে, ওর নিজের এলাকার বনজঙ্গলকে। তাই গেরিলাযুদ্ধে ওকে কোনও ফোর্স, পুলিশের ব্যাটেলিয়ান, এমনকী কম্যান্ডোরাও কিছু করতে পারছে না। যে-মানুষ জঙ্গলকে জানে, ক্যামোফ্লেজিং জানে, যে তার নিজের এলাকার পাহাড়, নদী, নালা, পথ, সঁড়িপথ, উপত্যকা, অববাহিকা এবং মালভূমিকে নিজের হাতের রেখার মতোই, মায়ের মুখের মতোই চেনে; তার সঙ্গে টক্কর তারই মতো জবরদস্ত, দুঃসাহসী অন্য কোনও মানুষই একমাত্র দিতে পারে। এবং সহজেই অনুমেয় যে, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীরা সব ট্রাডিশন ভেঙে তোমাকে নিমন্ত্রণ করাতে পুলিশ, বি. এস. এফ এবং অন্যান্য নানা ক্র্যাক-ফোর্সের অফিসার ও জওয়ানরা বনবিভাগের হোমরা-চোমরারা অত্যন্তই অপমানিত হবেন। কিন্তু এসব ভাল করে জেনে ওঁরা তোমার শরণাপন্ন হয়েছেন। ব্যাপার অত্যন্তই গুরুতর। এই যুদ্ধটা, মনে হয়, কোনও আর্মির সঙ্গে আর্মির যুদ্ধ নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিরই যুদ্ধ। আফ্রিকার চোরাশিকারি ভুষুণ্ডার কথা, অ্যালবিনোর রহস্যভেদের কথা, নিনিকুমারীর বাঘ এবং তোমার অন্যান্য সমস্ত অভিযানের কথা ভারতের এবং বিদেশের সমস্ত বড় কাগজে এবং টি. ভিতেও যেভাবে প্রচারিত হয়েছে তাতে আমাদের দেশের এবং হয়তো বিদেশেরও যে কোনও শিক্ষিত মানুষের কাছেই তুমি আর অপরিচিত নও। তাই বিপদে মধুসূদন তোমাকে ডেকে শেষ চেষ্টা করে দেখতে চান ওঁরা।

পরিচিতি-টিতির কথা জানি না। ওসব ফালতু ব্যাপার। নাম-যশ। আমি যে অতিমানবও নই তা আমার মতো ভাল আর কেউই জানে না। তবে তুই হয়তো ঠিকই বলেছিস। নীলগিরি হিল–এ মানে মাইসোর থেকে উটি, (যাকে এখন উধাগামঙ্গলম বলা হয়) আর উটি থেকে কোয়েম্বাটোরের মধ্যবর্তী জঙ্গলে ছেলেবেলাতে জ্যেঠুমণির সঙ্গে অনেকই শিকার করেছি। একটা বনপথ গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কোয়েম্বাটোর থেকে মাইসোর চলে গেছে, ‘উটি’কে পাশ কাটিয়ে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, বুঝলি, সেই জঙ্গলের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ এখনও আমার চোখে আর নাকে লেগে আছে, সব জঙ্গলই সুগন্ধি, কিন্তু নীলগিরির নীলপাহাড়ের মাইলের পর মাইল চন্দনবনের যে কী স্নিগ্ধ সুগন্ধ; বিশেষ করে বৃষ্টি হলে, তার তুলনাই নেই।

বান্দিপুরটা ঠিক কোথায়? বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্ক?

তিতির শুধোল।

মাইসোর থেকে উটিতে যাবার পথেই পড়ে। নীলগিরি পাহাড় শ্রেণী শুরু হবার আগে। বান্দিপুর; মুদুমালাই সব।

আর, পেরিয়ার ন্যাশনাল পার্ক?

 ভটকাই শুধোল।

বান্দিপুর পড়ে কর্ণাটকে আর পেরিয়ার তামিলনাড়ুতে। অগণ্য হাতির আবাসস্থল এইসব অঞ্চল। আসলে ভীরাপ্পানের এলাকা হচ্ছে এইরকম। প্যাডটা দে তো তিতির, টেবিল থেকে। আর একটা কলম দে, তোদের একটা রাফ-স্কেচ করে দেখাচ্ছি।

তিতির প্যাডটা এগিয়ে দিল আর ড্রয়ার খুলে একটা ব্লা কলম এগিয়ে দিল। ঋজুদা নিঃশব্দে একটা ম্যাপ এঁকে দিল। নিঃশব্দে এজন্য বলছি, এইসব দুর্মূল্য জার্মান কলমে কোনওই শব্দ হয় না, লেখার সময়ে। আর কলমই হচ্ছে ঋজুদার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, একথা তার দেশ-বিদেশের অগণ্য বন্ধু-বান্ধব-অনুরাগীরা জানেন বলেই, সকলেই ঋজুদাকে কলমই উপহার দেন। আর ঋজুদার সবচেয়ে প্রিয় কলম হচ্ছে–ব্লা। উচ্চারণটা ওইরকম। লিখলে MONT BLANC, জার্মান ভাষায়।

-মঁ-ব্লা, না?

তিতির শুধোল।

 হ্যাঁ।

 মানে কী শব্দটার ঋজুদার? কোন দিশি কলম ওটা?

ভটকাই শুধোল।

সুইটজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়ার নাম MONT BLANC, তবে উচ্চারণটা ম-ব্লা।

একদিন ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত জাতীয়তাবাদী জাত জার্মানরা, অন্য দেশ সুইটজারল্যান্ডের চূড়োর নামে তাদের নিজেদের তৈরি ঝর্না কলমের নাম রাখতে গেল কেন?

ঋজুদা হেসে বলেছিল, ওরে বোকাইচন্দর। সুইজারল্যান্ড একটা আলাদা দেশ হতে পারে বটে, কিন্তু সুইস’দের আলাদা কোনও ভাষা নেই। ভাষা হিসেবে সুইজারল্যান্ডের আধখানিতে জার্মান চলে, অন্য আধখানিতে চলে ফরাসি। যদিও ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট নেই কোনও। যে কোনও স্যুইসের সঙ্গে আলাপ হলে তুই জিজ্ঞেস করতে পারিস, আপনি কি স্যুইস-জার্মান? না সুইস-ফ্রেঞ্চ? সুইজারল্যান্ডে একটি গিরিবর্ত আছে, তার নাম পিও। শীতকালে সেখানে স্কিইং-এ উৎসাহীদের মেলা বসে যায়। সেই পিও পাস-এর একদিকে জার্মান ভাষাভাষীরা বাস করে আর অন্যদিকে ফরাসি। যদিও ধরাবাঁধা কোনও নিয়ম নেই।

আমার মন- মঁ-ব্লা কলমটা থেকে অনেক দূরে চলে গেছিল মুহূর্তের মধ্যে। ঋজুদার গলার স্বরে চমক ভাঙল। ঋজুদা বলল, এই দ্যাখ।

আমরা তিনজনে খেতে খেতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম প্যাডটার ওপরে। ঋজুদা সেই ফাঁকে একটা চিকেন-প্যাটিস তুলে নিল। মিষ্টি তেমন পছন্দ করে না ঋজুদা, নোনতাই বেশি পছন্দ করে।

আমরা দেখলাম ম্যাপটাকে।

দেখছিস তো! এই হচ্ছে কর্ণাটক রাজ্য, আর এই হচ্ছে তার রাজধানী মাইসোর। এই দ্যাখ যেখানে কর্ণাটকের সীমানা এসে তামিলনাড়ুর সঙ্গে মিশেছে, তার কাছেই এই কোল্লেগাল। উটি বা উধাগামঙ্গলম, তামিলনাড়ুতে। কিন্তু ওখানে পৌঁছতে হলে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোর হয়েও যাওয়া যায়, সেখান থেকেই কাছে হয়, আবার মাইসোর হয়েও আসা যায়, বান্দিপুর ন্যাশনাল পার্ক হয়ে। বান্দিপুরের পরেই পাহাড় আরম্ভ হয়েছে। পাহাড়ের পর পাহাড়। নীল তাদের গায়ের রং, তাই তাদের নাম নীলগিরি। এই নীলগিরিতেই যত দৌরাত্ম ভীরাপ্পানের।

লোকটা এরকম হল কী করে? পাঁচশো হাতি মারা কি চাট্টিখানি কথা! আর মারলই বা কী করে? একা একা?

তিতির বলল।

একা মারেনিরে। আসলে ভীরাপ্পানের যখন ন’ বছর বয়স ছিল তখনই সে ওই অঞ্চলের কুখ্যাত চোরাশিকারির দল জেভিয়ার গুণ্ডাদের দলে নাম লেখায়।

মানুষটা তা হলে তো খুনি টাইপের বলতে হবে। ওই শিশুবয়স থেকেই ওইরকম ছিল।

নারে। যখন শিশু ছিল তখন ওও অন্য দশটা শিশুর মতোই ছিল। অতি গরিব মা-বাবার ঘরের বড় ছেলে। তার তিনটি বোন এবং দুটি ভাই। বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো ছেলে। ঘরে খাবার নেই যে খাবে, অবস্থা নেই যে পড়াশোনা করবে, কী করবে, আর? দলে জুটে গেছিল।

পাইপটা নিভে গেছিল ঋজুদার। দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে নিয়ে গম্ভীর মুখে পাইপটাতে একটা টান লাগিয়ে বলল, ভীরাপ্পানেরা যখন মস্ত বড় দানবীয় চেহারা নিয়ে আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন তাকে মারবার জন্য পুলিশ, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, কম্যান্ডো সবকিছুকে নিয়োগ করি আমরা। অথচ, আমাদের একটু সহানুভূতি, একটু মায়া-মমতা, একটু ঔদার্য, সময়মতো খরচ করে ওই শিশু ভীরাপ্পানকেই সমাজের কতবড় উপকারী করে তুলতে পারতাম। দোষটা আসলে ভীরাপ্পানের একার নয়; দোষটা এই সমাজব্যবস্থার, এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের, এই পঙ্গপালের মতো, গিনিপিগের মতো, তেলাপোকার মতো, প্রতিমুহূর্তে জিওমেট্রিক্যাল প্রগ্রেশনে বাড়তে-থাকা জনসংখ্যার। ভীরাপ্পান আমাদেরই তৈরি করা চরিত্র, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। সে আকাশ থেকে পড়েনি।

আমরা সকলেই চুপ করে রইলাম অনেকক্ষণ ঋজুদার কথা শুনে।

 ঋজুদার মধ্যের এই গুণটা আমাকে প্রথম দিন থেকেই মুগ্ধ করে। সাধে কি ঋজুদার চামচাগিরি করি? কোনও মানুষকেই সহজে বাতিল করতে চায় না ঋজুদা। করে না। ফলটা দেখেই উত্তেজিত হয় নাবীজটা খুঁজতে চায়। সবসময়ই।

ভটকাই অগুনতি প্যাটিস ও পেস্ট্রি সাঁটিয়ে, ভুড়ি যব ঠাণ্ডা, মুড়ি তব ঠাণ্ডা নীতির জাজ্বল্যমান উদাহরণ হয়ে, খুশি খুশি গলায় বলল, আমাদের আরও বলো ঋজুদা ভীরাপ্পান সম্বন্ধে। দারুণ একটা ক্যারেকটার। যাই বলো, আর তাই বলো!

জন্মেছিল ও উনিশশো সাতচল্লিশে। কর্ণাটকের মহীশূর জেলার গোপীনাথম নামের একটি গ্রামে। তামিলনাড়ুর সীমান্ত থেকে দেড়শো মাইল মতো দূরে। ওর এক ভাইয়ের নাম অর্জুনান। সে এখন তামিলনাড়ুর জেলে রয়েছে। চিদাম্বরম নামক একজন ফরেস্ট রেঞ্জারকে খুন করার অভিযোগে সে অভিযুক্ত। কিন্তু, অনেকেই আবার বলেন যে, চিদাম্বরমকে খুন করেছে আসলে ভীরাপ্পানই। তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে না পেরেই তার ভাইকে ভরে দেওয়া হয়েছে জেলে। অবশ্য এমনতো আকছারই ঘটছে দেশের সব আনাচে-কানাচেই!

তুমি যে বললে, ভীরাপ্পান চন্দনকাঠের চোরাকারবারি। আমরাও তো বিভিন্ন কাগজে তেমনই পড়েছি।

তিতির শুধোল।

হ্যাঁ, এখন তাই। আগে ও জেভিয়ার গুণ্ডাদের হাতি মারা দলে ছিল। শ পাঁচেক হাতি জেভিয়ার গুণ্ডাদের দল নাকি সাবাড় করে দিয়েছে, গত তিনযুগে। ভেবে দেখ একবার।

এ তো গুগুনোম্বারের দেশ-এর আর রুআহা-এর টুর্নাডো-ভুষুণ্ডাদেরও হার মানালো দেখছি।

 তিতির বলল।

তবে দেখতে দেখতে হাতি মারার ব্যবসা বন্ধই হতে বসল এখানে, যখন থেকে ভারতবর্ষ থেকে হাতির দাঁত রপ্তানির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। আসলে মেরেছিল ওই দল শ পাঁচেকেরও বেশি হাতি। প্রকৃত সংখ্যা জানার কোনও উপায় ছিল না। কেন ছিল না, তারও একটা লজ্জাকর কারণ ছিল। নিয়ম ছিল, যদি কোনও রেঞ্জে একটিও হাতি, চোরাশিকারিদের হাতে মারা যায় তবে সেই রেঞ্জ-এর রেঞ্জারের সঙ্গে সঙ্গে চাকরি যাবে। ফলে, বুঝতেই পারছিস, রেঞ্জারেরা নিজের নিজের ঘাড় বাঁচাবার জন্যই হাতি শিকারের খবর যাতে উপরওয়ালাদের কাছে না পৌঁছয়, তা দেখত। তাই পাঁচশো সংখ্যাটা যদি অফিসিয়াল সংখ্যা হয়, তবে প্রকৃত সংখ্যাটা স্বভাবতই তার চেয়ে অনেকই বেশি ছিল।

আসলে ঠিক কোন অঞ্চলে ভীরাপ্পানের দৌরাত্ম চলছে, এখন?

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ঋজুদাকে।

এখন তো সে কাল্লাটির গভীর জঙ্গলে ডেরা করেছে। সেখানে কারও পক্ষেই আর পৌঁছবার কোনও উপায় নেই। চারদিকেই জমি-মাইন পেতে রেখেছে সে। যদি সেখানেও তাকে ধরবার জন্য মাইনের ও সম্ভবত সমস্ত প্রতিরোধের বাধা পেরিয়ে কেউ পৌঁছতেও পারে তবে সে জঙ্গলের আরও গভীরে পালিয়ে যাবে সত্যমঙ্গলম-এর দিকে। ভীরাপ্পান যাকে বলে, জঙ্গলের পোকা। একমাত্র অন্য কোনও জঙ্গলের পোকাই তার সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। সাধারণ পুলিশ বা বি.এস.এফ দিয়ে হবে না।

কেউই কি যেতে পারেনি আজ পর্যন্ত, সত্যমঙ্গলম-এ?

পুলিশের এস. গোপালকৃষ্ণনই একমাত্র মানুষ, যিনি ভীরাপ্পানের খোঁজে ওই জঙ্গলে একবার গেছিলেন, এবং মাইনে ‘আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এপ্রিল মাসের ন তারিখে এক বাসভর্তি তামিলনাড়ুর রাজ্যের টাস্ক ফোর্স-এর পুলিশকে নেতৃত্ব দিয়ে যখন উনি নিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের ভীরাপ্পানের সত্যমঙ্গলম-এর ডেরার দিকে, তখনই ভীরাপ্পানের মাইনে, তাঁদের পুরো বাসটিই উড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই বাইশজন দক্ষ ও সাহসী পুলিশের মৃত্যু ঘটে। গোপালকৃষ্ণন নিজে যদিও কোনওক্রমে প্রাণে বাঁচেন কিন্তু সাংঘাতিক রকম আহত হন। নইলে, এপ্রিল মাসের ন তারিখে আহত হবার পর জুন মাসের আজ অবধিও তাঁকে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হত না।

এ পর্যন্ত কত জন পুলিশ ভীরাপ্পানের হাতে মারা গেছে?

ভটকাই শুধোল।

তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটক রাজ্য পুলিশের এবং অন্যান্য ফোর্সেরও কত মানুষ যে ভীরাপ্পানের হাতে প্রাণ দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। অথচ ভীরাপ্পান কিন্তু আজও বন-জঙ্গলের মানুষদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। গরিবদের সবরকম সাহায্য করে ভীরাপ্পান। তার বয়স্কা মা-বাবাকে দেখে সবদিক দিয়ে তার তিন বোন আর দুভাইকেও দেখে। তার দুঃসাহস প্রায় কিংবদন্তির রূপ নিয়েছে ওই অঞ্চলে ইংল্যান্ডের রবিন হুডেরই মতো।

ভীরাপ্পানের ফ্যামিলি নেই?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, মাত্রই বছর দুয়েক আগে বিয়ে করেছে ভীরাপ্পান। তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল। শিশুও ভূমিষ্ঠ হল। যে ভীরাপ্পানকে ধরবার জন্য হাজার সশস্ত্র পুলিশের দিনে রাতের চব্বিশ ঘণ্টা চোখে ঘুম নেই, সে-ই শহরের হাসপাতালে গিয়ে সকলকে বুদু বানিয়ে তার স্ত্রী ও শিশুকে দেখে এল। এতেই প্রমাণিত হয় যে, ভীরাপ্পান নিজে যে শুধু দুঃসাহসী তাই নয়, সমাজের সব স্তরেই তার হিতার্থী বন্ধু এবং সহযোগী আছে। নইলে, এমন অঘটন সম্ভব হত না। আসলে আমার মনে হয়, ভীরাপ্পানও হয়তো আফ্রিকার ভুষুণ্ডারই মতো কোনও নেপথ্যচারী টর্নাডোর ক্রীড়নক। সেই লোকটা হয়তো সমাজের ওপরতলার অত্যন্ত সচ্ছল তোক। দিব্যি আরামে আছে। খাচ্ছে দাচ্ছে, মৌজ ওড়াচ্ছে, ব্যাঙ্গালোর, কি মাইসোর কি কোয়েম্বাটোর কি মাদ্রাজে বসে।

সত্যি! ফ্যান্টাসটিক।

ভটকাই উত্তেজিত গলায় বলে উঠল।

বলেই, তাৎক্ষণিক স্বরচিত একটা ছড়া আওড়ে দিল:

শোনো, শোনো, মিস্টার ভীরাপ্পান।
 আমিও যে মিস্টার ভটকাই,
 ভেবোনা আমাকে তুমি পোলাপান
 দুই হাতে, হাতে-নাতে পিপিণ্ডি চটকাই।
দেখা হলে কী করে যে ঘাড়খানি মটকাই।
আমি ভটকাই। চটকাই। হাই-ফাই।

ঋজুদা হেসে ফেলল। তিতিরও। আমি একটুও হাসলাম না। হাসা যেত, যদি ছড়াটা, ছড়া পদবাচ্য হত। এমন কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা যারা করে, তারা অন্যদের তো আনন্দ দিতেই পারে না, উলটে নিজেদেরই ছোট করে। হচ্ছিল কী রকম সিরিয়াস কথা, তার মধ্যে বাগবাজারি চ্যাংড়ামি! কোনও মানে হয়!

ঋজুদা বলল, রুদ্রর আদৌ পছন্দ হয়নি তোর ছড়া, ভটকাই। আমারও যে খুব একটা পছন্দ হয়েছে তা নয়। তবে, আমি বোধহয় তোদের বোর করতে শুরু করেছিলাম–সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই বিরতিটা, খুবই টাইমলি এনেছে ভটকাই।

এমন সময়ে ফোনটা বাজল। রিসিভারটা তুলে নিয়েই ঋজুদা বলল, ইয়েস।

 ইয়েস। গুড ইভনিং। নমস্কার।

ও আই সি! দ্যাট আর্লি। অন সানডে? গুড হেভেনস্! হুইচ ডে ইজ টুডে? টুইসডে!..ইয়া!..ইয়া? আই কোয়াইট সি ইওর পয়েন্ট…নো নো, প্লিজ ডোন্ট ওয়্যারি বাউট দ্যাট। বাট ইট মাস্ট বি কেপ্ট আ সিক্রেট। দ্য হোল থিং। নো গভর্নমেন্ট ভেহিকে। নো রিসেপশান। নো বডি শুড নো। নোবডি। প্লিজ, মেক ইট ডাবলি শিওর।…নো। নো। নান অফ ইওর অ্যারেঞ্জমেন্ট প্লিজ। এভরিথিং শুড বি ডিসক্রিট–আটারলি ডিসক্রিট। আই রিপিট। ডু য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড? ইয়েস, প্লিজ থ্যাঙ্ক বোথ দ্য চিফ মিনিসটারস অন মাই বিহাফ।..ইয়া। আই উইল গিভ ইউ দ্য ফ্লাইট নাম্বার-ইয়েস। অন দ্য ডায়রেকট লাইন। ইয়েস। অন দি আনলিস্টেড ওয়ান।–অ্যাট ইওর রেসিডেন্স।…ইয়া।

গুড নাইট। নমস্কার।

ফোনটা নামিয়েই ঋজুদা বলল, রুদ্র, গিয়ে দেখতো গদাধর খিচুড়িটা চাপিয়ে দিল কি না। না, আজকে খিচুড়ি-ইলিশমাছ ভাজাটা বাদ দিতে হবে।

বাদ? খিচুড়ি?

গভীর আশাভঙ্গের সঙ্গে ভটকাই বলল।

হ্যাঁ। তবে ক্যানসেল হচ্ছে না। আগামী কাল তোমরা সকলে পৌনে-সাতটায় আসবে। তারপর খিচুড়ি ইলিশমাছ খেয়ে, রাত দশটার মধ্যে বাড়ি যাবে।

আমি উঠতে যাব, এমন সময়ে গদাধরদা নিজেই কাশ্মীরি কাঠের ট্রেতে, সুন্দর হালকা মেহেন্দি-রঙা ম্যাটের ওপরে চাপিয়ে, প্রবাল-রঙা টি-কোজিতে মোড়া বড় চায়ের পটটি আর বোন-চায়নার কাপ ডিস সাজিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তিতিরের জন্য আলাদা একটি ফিকে হলুদ-রঙা গ্লাসে দুধ, ড্রিঙ্কিং-চকোলেট মেশানো।

ঋজুদা বলল, গদাধর, সৈন্যদলকে এখন বিদায় করো দুধ আর চা খাইয়ে। কাল রাতে খাওয়া-দাওয়া হবে। ভাজাভুজির পদ দু একটি বেশি কোরো। ভাজা ছাড়া খিচুড়ি জমে না।

কাঁটালের বিচি ভাজা খাব, ঋজুকাকা।

আদুরে গলাতে, তিতির আবদার করল।

 দাঁড়াও মা। কাঁটাল তো এখন গোরুর খাইদ্য। দেকি, পাই কি না।

গদাধরদা বলল।

 ভটকাই বলল, তোমার বয়সই হল চার কুড়ি, কিন্তু বুদ্ধি বলে কিছুই হলোনি গো গদাধরদা। এতদিনে এও জানলিনে গো! কাঁটালের বিচি আলাদা কিনতে পাওয়া যায়। আমিই নে আসবখন।

এই দাদাটা বড্ডই ভ্যাজ-ভ্যাজর করে। কই? রুদ্র বাবুকে তো এতদিন ধরে। দেইকতিচি, তিনি তো আমার সঙ্গে কইনো…।

আমি বললাম, গদাধরদা, তুমিও তেমনই। তোমার রুদ্রবাবু এই একটাই হয়েছিল। তুমি তার জোড়া পাবে কোত্থেকে!

একটা লাখ কথার এক কথা বলে ফেলেছিস রুদ্র। তুই যে এই পৃথিবীতে একটা মাত্রই–এই জ্ঞানটা তোর হয়েছে জেনে ভাল লাগল। একটা মাত্র যে কী? কোন চিজ, সেটা আর বললাম না।

তিতির বলল, তুমি রবিবারে যাচ্ছ, ঋজুকাকা?

ঋজুদা অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। তিতিরের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিতে নিতে বলল, উ? হু! তাই তো যেতে হবে দেখতে পাচ্ছি।

একাই যাবে? ভটকাই শুধোল।

চায়ে একবার চুমুক দিয়ে বলল ঋজুদা, এখনও তো সেইরকমই ঠিক আছে।

ভটকাই এর আশায় ছাই পড়ল। কে কে যাবে, সে বিষয়ে ঋজুদা মুখ খুলল না।

আমরা কেউই আর কোনও কথা বললাম না।

মিনিট পাঁচেক পর সকলে একসঙ্গেই বেরোলাম।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভটকাই বলল, তিতির তোর গাড়িতে একটা ছোট্ট লিফট দিবি?

ছোট্ট লিফট মানে? তুই তো থাকিস বাগবাজারে আর রুদ্র…।

আরে না না। অতদূরে যেতে হবে না। আমি আর রুদ্র একটু ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের পাশে ডাকাতে কালীর কাছে নেমে যাব।

কেন?

পুজো দেব, পাঁচসিকে, পাঁচসিকের।

কীসের পুজো?

ঋজুদার মন গলানোর পুজো! ভীরাপ্পানের কাছে ঋজুদাকে একলা ছেড়ে দেওয়াটা কি তোদের উচিত? আমি না-হয় রংরুট, অনভিজ্ঞ; আফ্রিকার অ্যাডভেঞ্চারে কোয়ালিফাই করিনি। কিন্তু তোরা? তোরা কি মানুষ? ঋজুদা যদি আর না ফেরে? ভাবিস না যে, সেন্টু দিচ্ছি। আমার সত্যিই চিন্তা হচ্ছে। ঋজুদার মন গললে, তবে না…

তিতির বলল, আমি পুজো-ফুজো জীবনে দিইনি। মূর্তি-পুজোতে আমার বিশ্বাস নেই। তবে, আমি গাড়িতে বসে থাকব, তোরা আমার নামেও পাঁচ সিকের পুজো চড়িয়ে দিস। সত্যি! ব্যাপারটা বেশ চিন্তারই হয়ে দাঁড়াল।

.

আমরা, মানে আমি আর তিতির, সাড়ে ছ’টার পরই পৌঁছে গেছিলাম বিশপ লেফ্রয় রোডে। ঋজুদা নেই। গধাধরদা বলল, কোতা গেচে কী করে জাইনব। গতরাতেও তো ঘুমটুম নেই। অনেক বইপত্তর মেলে বসচেলো আর টেলিফোনের পর টেলিফোন কইরতেচেল। রাত জেগে কারা টেলিফোনে কতা কয়, কে জানেরে বাবা। তাপ্পর সেই ভোরবেলা বেইরে গেচে চান করে শুধু এক কাপ চা খেইয়ে, আর দ্যাকো দিকি, একনও ফেরার নাম নেই।

তিতির বলল, পৌনে সাতটার মধ্যে ঠিক ফিরে আসবে। দেখো তুমি।

আমি বললাম, ঋজুদা বলে, কথা দিলে, আমার ডেডবডি আমার কথা রাখবে। আমি যদি নিজে নাও রাখতে পারি। কোনওদিনও তিরিশ সেকেন্ডও দেরি করতে দেখিনি ঋজুদাকে জাপানের ট্রেনগুলোর মতো।

সাতটা বেজে সাঁয়ত্রিশ। এমন সময়ে দরজার বেলটা বাজল। গদাধরদা বসবার ঘরেই ছিল। তাই, গদাধরদাই দরজা খুলতে গেল। দরজা খুললও। মনে হল, কার সঙ্গে কী কথা বলল। পরক্ষণেই প্রায় দৌড়ে ফিরে এসে বলল, একটা তিলক-পরা মাদ্রাজি ব্রাহ্মণ কী সব দুর্বোদ্দ ভাষায় কতা কইচে গো। তোমরা যেয়ে দ্যাকো দিকি। আমি চনু কিচিনে।

তিতির আর আমি, দুজনেই গেলাম। দেখি সারা কপালে পাথালি করে মোটা সাদা আর লাল চন্দনের তিলক কাটা, সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা, পায়ে একসাইজ বড় একটি চটি পরে, হাতের বোতাম খোলা সাদা টুইলের শার্ট পরে, কাঁধে পাট করে সাদা-খোলের নীল-পাড়ের চাদর ফেলে, এক দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক, দুহাত জড়ো করে নমস্কার করে বললেন, নমস্কার।

তিতির বলল, মিস্টার বোস ইজ নট ইন। প্লিজ কাম ইন। হি উইল বি হিয়ার এনি মোমেন্ট।

সেই ভদ্রলোক বললেন, ইয়ানি ওরু পেরেয়া মেরুগাম।

আমি বললাম, সরি। উই ডোনট স্পিক তামিল।

এই কথা বলতে বলতেই আমি চিনে ফেললাম অ-ভদ্রলোককে। এবং তাঁর গলার স্বরকে। তিতির তখনও চিনতে পারেনি। ইতিমধ্যে ঋজুদাও এসে পৌঁছে গেল। এবং কিছু বলবার আগেই ভদ্রলোক ঋজুদাকে বললেন, ভান্নামে নানপারাএ নেনাইডু এরুক্কেরাথা?

ঋজুদা আমাদের অবাক করে দিয়ে বললে, আপ্নে হেথু ভান্থেরকাল?

তারপর আমরা সকলে ভিতরে ঢুকলাম একই সঙ্গে। ভিতরে ঢুকেই অ-ভদ্রলোক আবার বললেন, ইয়ানি ওরু পেরেয়া মেরুগাম।

বলেই, যেন পরিত্রাণ পেয়ে পরিষ্কার বাংলাতে বললেন, রাত জেগে শিখেছিলাম অনেকই। কিন্তু এই একটা সেনটেনসই যে কেন ঘুরে ফিরে আসছে। অন্যগুলো যে কোথায় হাপিস হয়ে গেল।

ঋজুদা হেসে উঠে বলল, মানেটা বলে দে ওদের, ভটকাই।

ভটকাই বলল, মানে হচ্ছে, হাতি খুব বড় জানোয়ার।

তিতির শুনেই হেসে একেবারে গড়িয়ে পড়ল। বলল, শুধু হাতি খুব বড় জানোয়ার এই বাক্যটাই মনে থাকল কেন তোমার?

তা কী করব! হাতি-শিকারি নিয়ে কারবার এবারে, হাতিকে প্রিডমিন্যান্স না দিলে কি চলে?

পরক্ষণেই ঋজুদার দিকে ঘুরে বলল, দেখো ঋজুদা! তোমার জন্যে ন্যাড়া হলাম ম্যাড্রাসি সাজলাম, এর পরেও নেবে না আমাকে?

ঋজুদা হো হো করে হেসে ফেলল, অনেকক্ষণ ধরে হাসতেই থাকল, এমন করে হাসতে দেখিনি বহুদিন ঋজুদাকে।

হাসল বটে, কিন্তু উত্তর দিল না ভটকাই-এর কাকুতি-মাখা প্রশ্নর। সেও বড় শক্ত ঠাঁই।

ভটকাই চুপসে গিয়ে, ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে লাগল।

ভেকটা কিন্তু ভালই ধরেছে। প্রথমে তো আমরাই চিনতে পারিনি। ঋজুদাও হয়তো পারেনি প্রথমে।

ঋজুদা বলল, তোর ঘড়ি-পরার রকমটা শুধু ঠিক হয়নি। হয় একটা ট্যাঁক ঘড়ি জোগাড় কর, নয়, ঘড়িটার ডায়ালটা ভিতর দিকে করে পর। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী যেমন করে ঘড়ি পরতেন। অধিকাংশ টামিলিয়ানরাই, কেন জানি না, ওরকম করে ঘড়ি পরতেই পছন্দ করেন।

বলেই বলল, তা তুই হাতি খুব বড় জানোয়ার-এ এসে আটকে গেলি কেন?

কী করব! আমার স্মৃতিশক্তি হচ্ছে বেগ-বেগা।

সেটা আবার কী?

তিতিরই শুধোল।

 তাও জানিস না? কতরকমের মেমারি হয় জানিস?

স্মৃতিশক্তির আবার রকম কী?

তিতির বলল, অবাক হওয়া গলায়।

আছে আছে। শোন তবে। চাররকমের মেমারি হয়। (১) চির-চিরা (২) চির-বেগা (৩) বেগ-চিরা (৪) বেগ-বেগা। আমার মস্তিষ্কে সবকিছুই বেগে প্রবেশ করে এবং তা মুহূর্তের মধ্যে আবার সমান বেগে বেরিয়ে যায়। মুখস্থ করতেও সময় লাগে না, ভুলে যেতেও নয়। তাই আমার স্মৃতি শক্তি, বেগ-বেগা।

চির-চিরা মানে কী? সেটার কী বিশেষত্ব?

চিরচিরা মানে হল, মাথায় ঢুকতে বহুতই সময় নেয়, কিন্তু মগজে একবার যদি ঢুকে গেল, তো সেখানেই পাথর হয়ে রয়ে গেল। হোল লাইফ। নট নড়ননট চড়ন, নট কিছু।

আর চির-বেগা?

সেটিই হল, সবচেয়ে খারাপ। মগজে ঢোকাতে ঢোকাতে জীবন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু, যদি বা অবশেষে ঢুকল; তাও ঢোকামাত্রই সুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল।

তিতির মুখস্থ করে নিল। চির-চিরা, বেগ-বেগা, বেগ-চিরা, চির-বেগা।

আজ বৃষ্টি নেমেছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। খিচুড়িটা জমবে ভাল। কিন্তু এক কাপ করে চা তো খাবি?

ঋজুদা বলল।

 মন্দ হয় না। আমি বললাম।

তিতির বলল, আমি কিন্তু কিছু না।

ভটকাই বলল, আমি গিয়ে গদাধরদাকে আরও একটু ভড়কে দিয়ে কড়কে আসি। আমাকে দেখেই তো পালিয়েছে, রান্নাঘরে। তাই না?

তিতির হেসে বলল, হার্ট-ফেল করে মারাই যাচ্ছিল প্রায়। কী যে করোনা তুমি!

ভটকাই ভিতরে চলে গেল এবং পরমুহূর্তেই ভয়ঙ্কর ভীত গদাধরদা দৌড়ে বসবার ঘরে ঢুকে বলল, ওই মাদ্রাজিটাকে কিচিনে কে পাইটে দেল? সেখানে গে আমাকে আন্ড্রে-পান্ড্রে কী সব বলতিচে, আবার ধমকও মারতিচে

ঋজুদা হেসে বলল, তোমার এতখানি বয়স হল, গাঁয়ের মানুষ তুমি। সং চিনতে পারলে না গো গদাধর? কেমন ধারা লোক? ভাল করে চেয়ে দ্যাখো দেখি। একে কি তুমি চেনো না?

পূর্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকার পর সান্দাকফুতে সূর্যোদয়ের মতো আস্তে আস্তে, গদাধরদার মুখে আলো ফুটতে লাগল। তারপর, স্বস্তির হাসিতে তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই স্বগতোক্তির মতো বেরিয়ে এল মুখ থেকে একটি মাত্র শব্দ। বিচ্ছু! হায়! হায়! কী বিচ্ছু ছেলে গো! বলার সঙ্গে সঙ্গেই, হাতে-ধরা পেতলের হাতাখানি দিয়ে মারল ভটকাই-এর ন্যাড়া মাথাতে, আলতো এক ঠোক্কর।

মেরেই, ঋজুদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আজ এই বইলে দিনু। তোমার ভবিষ্যৎ বহুতই খারাপ দাদাবাবু।

কেন? হঠাৎ এমন অলুক্ষণে কথা কেন?

 কেন আবার! তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।

 বলেই, গদাধরদা অন্তর্হিত হল।

গদাধরদার বলার ভঙ্গি শুনে, হেসে ফেলল, ঋজুদা।

উরি বাবারে! কী গরম রে। চাঁদি ফেটে গেল গো। বলে, চেঁচিয়ে উঠল ভটকাই, হাতার বাড়ি খেয়ে। পেতলের হাতাটা ভারীও কম নয়।

 ঋজুদা বলল, তিতির তুই গিয়ে চায়ের কথাটা বলে আয়।

সত্যি! ভটকাইটা সবকিছু গুবলেট করে দিল। যা-তা একটা।

আমি বললাম।

 ঋজুদা বলল, যাই বলিস, ভটকাই-এর কিন্তু খুব রেডি-উইট আছে। জীবনে মানুষের এই গুণটি খুবই কাজে লাগে।

ঋজুদার মুড গুড দেখে বললাম, আমরা সকলেই কি যাচ্ছি আগামী রবিবারে? ঋজুদা? আজ তো বুধবার হয়ে গেল।…গোছগাছ…।

ঋজুদা বলল, এখনও মনস্থির করে উঠতে পারিনি। আমার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না, এই ডেঞ্জারাস মিশনে তোদের নিয়ে যাবার। তবে এটাও ঠিক যে, এবারে আমরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামে থাকব না কিন্তু, রণকৌশলটা আমাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যদি পারি, তবে বাতলে দেব ওঁদের। আমাদের ভূমিকা এবার গোয়েন্দা এবং স্ট্রাটেজিস্ট-এর। তবে, একেবারে ফ্রন্টে তোমাদের যেতে দেব না–প্রয়োজন যদি পড়ে, আমি একাই যাব। এ নিয়ে যদি কোনওরকম গাঁইগুঁই করো, তা হলে, তোমাদের ওখানেই ছেড়ে রেখে আমি ফিরে আসব।

ঠি আচে।

ভটকাই বলল।

খুব উত্তেজিত হয়ে যখন তাড়াতাড়ি কথা বলে ভটকাই, তখন এমনি করেই শেষের অক্ষরটা ফেলে দৌড়য়। ঠিককে বলে, ঠি।

তা হলে। আমরা যাচ্ছি?

 তিতির বলল।

ভটকাই থাম্বস-আপ করল।

.

রুদ্র, তুমি!

তিতিরই এসে দরজা খুলল। কোনওদিনই খোলে না। সম্ভবত বাড়িতে এখন কেউই নেই।

কী ব্যাপার? হঠাৎ না বলে কয়ে?

তুমি যে এমন ভি. আই. পি. যে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে তোমার কাছে আসা যাবে না?

তোমার মতো সকলেই যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া যখন তখন আসে, তবে সুদূর ভবিষ্যতে কোনওদিনও ভি. আই. পি. হবার সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও তা আর হওয়া হবে না। তাই আর কী। বুঝলে রুদ্র! প্রত্যেকেরই জীবনে পার্সোনাল-টাইম ম্যানেজমেন্টটাই হচ্ছে আসল জিনিস। ওটি যিনি করতে না পারেন, তাঁর পক্ষে কিছুই হয়ে-ওঠা আদৌ সম্ভব নয়। সময় নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আমি রাজি নই।

তিতিরের জ্ঞান’-এর কোনও জবাব না দিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। ঋজুদাকে দেখতে যাব। উডল্যান্ডস-এ।

উডল্যান্ডস-এ! কেন? ঋজুদার কী হয়েছে? আমি তো কিছু জানি না। হার্ট অ্যাটাক?

মধ্যপ্রদেশে অতগুলো দিন ভটকাই-এর সঙ্গদোষে কাটাবার সময়েও যদি হার্ট-অ্যাটাক না হয়ে থাকে, তবে ঋজুদার তা হবার সম্ভাবনা আছে বলে তো মনে হয় না। ক্যালকাটা-ফিভার। খুব মাথার যন্ত্রণা, একশো পাঁচ জ্বর। কষ্ট পাচ্ছে খুবই।

তা বলে নার্সিংহোমে! আমাকে ফোন করল না কেন? আমরা এতজনে আছি কী করতে তা হলে? বাড়িতেই তো রাখা যেত।

আরে আমিও কি আর আগে জানতাম। গদাধরদা নাকি আমাদের খবর দেওয়ার কথা বলেও ছিল। ঋজুদাই নাকি বারণ করেছিল। বলেছিল, আমার পরীক্ষা, পড়াশোনার ক্ষতি হবে। দু। পড়াশোনা করে যেন উল্টে দিচ্ছি একেবারে।

‘উডল্যান্ডস’-এ নিয়ে গেল কে, বিশপ লেফ্রয় রোড থেকে?

প্রতিবেশীরাই! আবার কে? অরামাসি নিজেও নাকি গেছিলেন। মন্টু কাকাদের ফ্ল্যাটও তো পাশের ব্লকেই।

ও হ্যাঁ! তাই তো। কিন্তু এখন আছে কেমন? ঋজুদা?

তাই দেখতেই তো যাওয়া! নাও, এখন আর কথা বাড়িও না। আমি বসছি। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। তোমার এখান থেকে ভটকাইকে কি একটা ফোন করতে পারি? আসার আগেও করেছিলাম। বাড়ি ছিল না। টিকিট কাটতে গেছে নাকি রবীন্দ্রসদনে। ওর মা বললেন।

সেখানে কী? কীসের টিকিট? ‘দক্ষিণী’র প্রাক্তনী থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘অরূপরতন’ করছে। এর আগে নাকি বিদ্যাভবনেও দেখেছে ও একবার, কবিপক্ষে। কী দেখেছে, তা ওই জানে! একেবারে উচ্ছ্বসিত! বিশেষ করে অর্পিতা বলে একটি মেয়ের অভিনয়ের– সে সুদক্ষিণার চরিত্রে নাকি দারুণ অভিনয় করেছে।

আমাদের দেখাবে না? সত্যি, অরূপরতন-এর মতো নাটক আজকাল দেখাই যায় না।

না দেখিয়ে কি সে ছাড়বে? কান ঝালপালা করে দিল। ওর অর্পিতাদির মতো অভিনয় নাকি স্মিতা পাটিলও করতে পারত না। সম্ভবত আমাদের জন্যেই কাটতে গেছে টিকিট। দেবাশিস রায়চৌধুরীর পরিচালনা।

তুমি বোসো রুদ্র। আমি এক মিনিটে আসছি। দাঁড়াও, মাকে একটা ফোন করে দিই। মা অবশ্য, অরামাসিদের বাড়িতেই গেছেন। এখন বাড়িতে কেউই নেই।

তিতির ফোনটা করেই, ভিতরে চলে যেতেই, ফোনটা বেজে উঠল। তিনবার বাজবার পরও যখন তিতির ধরতে এল না, তখন আমি তুললাম, ফোনটা।

হ্যালো।

কী রে! আমি ঠিক জানতাম, তুই এখন তিতিরের সঙ্গে ঝিং-চ্যাক সাদা মারুতিতে করে নগর-পরিক্রমাতে বেরোবি। তাই আন্দাজিফাই করেই তোকে ধরলাম।

দ্যাখ ভটকাই, সবসময় ইয়ার্কি ভাল লাগে না। ঋজুদার ক্যালকাটা-ফিভার হয়েছে। উডল্যান্ডস-এ আছে। তোকে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। তোরও কি আমাদের সঙ্গে যাওয়াটা কর্তব্য নয়? কর্তব্যজ্ঞান বলে তো কোনও কিছুই…

আমিও এগজ্যাক্টলি সেই কথাটাই ভাবছিলাম, মানে তোর কোনও কর্তব্যজ্ঞান নেই, সেই কথা। ভিজিটিং-আওয়ার্স প্রায় শেষ হতে চলল, আর ঋজু বোসের ওরিজিনাল এবং ফেভারিট চামচেদের কারও দেখা পর্যন্ত নেই! তোরা কি মানুষ? অকৃতজ্ঞের দল সব! ছিঃ ছিঃ!

মানে?

 হতভম্ব হয়ে বললাম।

 মানে, আমি উডল্যান্ডস থেকেই বলছি। তাড়াতাড়ি আয়। আমার পক্ষে দুজন রোগীকে একা সামলানো অসম্ভব। একজন অনর্গল অক্সোনিয়ান অ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে আবৃত্তি করে চলেছেন, ধুম জ্বরের মধ্যে ঘোরে, হয় ওয়াল্ট হুইটম্যান নইলে রবার্ট ফ্রস্ট। মধ্যে মধ্যে সুকুমার রায়ও অবশ্য আওড়াচ্ছেন: হলদে সবুজ ওরাংওটাং/ ইট পাটকেল চিৎ- পটাং। আর আরেকজন বিশুদ্ধ দোকনো বাংলায় কুঁই পেড়ে, কন্টিনিউয়াসলি কেঁদে চলেছেন, কী হবে গো আমার? ও ভটকেদাদা। তিনি চইলে যেতিচেন গো! হায়! হায়! আমার কী হবে গো! দাদাবাবু গোওওও!

কে?

 আবার কে! তোমাকে খিচুড়ি খাইয়ে যিনি গোবর বাইনেচেন।

 গদাধরদা?

আজ্ঞে। তেনার জন্যেও একগাচি নার্স ঠিক কইরতে হবে। সঙ্গে মালকড়ি নে এস। চঞ্চল করি। আমি বাবা গরিবের ঘরের মেইলে! শরীর দে যেটুকু করার নিশ্চয় কইর্যে দেবোকন। কিন্তু পয়সা কুয়াড়ে মিলিব?

গদাধরা আবার সেখানে গিয়ে নাটক করছে কেন?

সেটা তোমার পেয়ারের গদাধরদাকেই নিজে এসে জিজ্ঞেস করো। নার্সরা দুজনকে নিয়েই একেবারে নাজেহাল। নেহাত বিশ্ববিখ্যাত ঋজু বোস। অন্য কেউ হলে, দুজনকেই বের করে দিত, নার্সিংহোম থেকে। ঋজুদা অত্যন্ত খারাপ পেশেন্ট। মা বাবার একমাত্র সন্তান তো। ছেলেবেলাতে বোধহয় স্পয়েল্ট-চাইল্ড ছিল।

তুই থাম। আমি আর তিতির আসছি এখনই। কোনও ভয় নেই তো রে ভটকাই?

না। তবে অসুখ মানেই তো সুখের অভাব। জ্বর ভাল ঠিকই হবে, তবে ভোগান্তি আছে। ভয় নেই কিন্তু ভয় আছেও। আজকাল কোনও রোগীই রোগে মরে না, ওষুধে মরে। আরও একটা ভয় আছে। সেটা শুধু ঋজুদারই নয়, আমাদেরও। ভীরাপ্পানের ভয়।

কোন ভীরাপ্পান?

যার কথা তুমি ভাবছ চাঁদু। দাক্ষিণাত্যের কোল্লেগাল-এর জঙ্গলের, হাতির দাঁতের, চন্দনকাঠের চোরাচালানকারী। চন্দনকাঠেই এবার চিতা সাজছে আমাদের সকলের। একেবারে রাজা-রাজড়ার মতো মারা যাবে। খাসা! এবার দেখব তোমার আর নেকু-পুষু-মুনু তিতিরের বাহাদুরি। গুগুনোগুম্বারের দেশে আর রুআহার ভুষুণ্ডা, কোল্লেগালের ভীরাপ্পানের কাছে, যাকে তোদের ভাষায় পোলাপান বলে; তাই। কিন্তু সেখানে হয়তো যাওয়াই হবে না। অলরেডি অন্য এক নেমন্তন্ন পৌঁছে গেছে ঋজুদার কাছে। এবং…

এবং কী?

অধীর আগ্রহের সঙ্গে আমি, রুদ্ধশ্বাসে শুধোলাম।

পিচিক করে, পুব-আফ্রিকার মাসাই উপজাতিদের থুতু ফেলার মতো একটা শব্দ করে একটু হাসল ভটকাই। তারপর বলল, শনৈঃ শনৈঃ বৎস। শনৈঃ শনৈঃ। ক্রমশ প্রকাশ্য। অত তাড়াহুড়ো কীসের?

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ভাবছিলাম যে, খাল কেটে কুমির তো আমিই এনেছি। এখন ভটকাই-ই হচ্ছে আমার আর তিতিরের সবচেয়ে বড় প্রবলেম। নিনিকুমারীর বাঘ মারতে ওকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াতে ওড়িয়াটাও শিখে গেছে একটু একটু। গদাধরদার কাছ থেকে দক্ষিণ বাংলার ভাষার টান-টোনও রপ্ত করেছে। তার সঙ্গে আবার সংস্কৃত মিশিয়ে দিচ্ছে মাঝেমাঝে। ঋজুদার হাতে-পায়ে ধরে, কত চেষ্টা চরিত্তির করে ওকে আমাদের দলে ঢুকিয়েছিলাম, আর এখন ওই আমাদের ওপর হরওয়াক্ত ছড়ি ঘোরাচ্ছে। ঋজুদার প্রশ্রয়েই এটা ঘটেছে। খুবই অভিমান হয় মাঝে মাঝে, ঋজুদার ওপরে, এই জন্যে। এইরকম আলটস্কা সিনিয়রদের সুপারসিড করার দৃষ্টান্ত সরকারি চাকরিতেও বেশি দেখা যায় না।

সাধে কি ছোটঠাকুমা বলেন, রুদদুররে, ভুলেও কক্কনও বাঙালির উপগার করিসনি দাদু। তোর ছোটদাদুকেও তো চোকের উপরে দেকলি! কি পায়শ্চেত্তটা করলে!

কী যে বাদলা চলেছে কলকাতায় প্রায় একমাস হল যে, মনই ভাল লাগে না। মা শান্তিনিকেতনে গেছিলেন। বলছিলেন, এমন খরা সেখানে বহুদিন হয়নি। বাগানের গাছগাছালি বাঁচিয়ে রাখাই দায়। ম্যাগনোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা গাছটা, নতুন মালীর গাফিলতিতে মরে গেছে। তবে এই খরারই কারণে আবার জ্যাকারান্ডা আর বোগেনভেলিয়াদের ডালে ডালে রঙের মারদাঙ্গা লেগে গেছে।

ভটকাই বলে, এমনটিই তো হবার কতা। একটা ডেবিট হলেই একটা ক্রেডিট হতেই হবে। একেই বলে ডাবল-এন্ট্রি।

শান্তিনিকেতন এবারে নাকি বৃষ্টির ব্যাপারে একেবারে একটা দ্বীপের মতো হয়ে রয়েছে। ঊষর দ্বীপ। বীরভূমে শেষের দিকে বন্যা হয়ে গেল, কিন্তু শান্তিনিকেতন খটখট করছে।

মা গত সাতদিন কলকাতাতে না-থাকাতে বাড়ি আগলাতে হয়েছে, ফোন ধরতে হয়েছে। বাবা দিল্লিতে গেছেন মাসের গোড়াতে। সেখান থেকে বম্বে হয়ে ফিরবেন। সে কারণেই ঋজুদার কাছে একদিনও যেতে পারিনি। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরও উডল্যান্ডস থেকে ছাড়া পেয়ে ঋজুদা নয়নামাসির বাড়িতে গিয়ে ছিল আরও সাতদিন। সেখানে নয়নামাসি অফিস থেকে সাতদিন ছুটি নিয়ে ঋজুদাকে খাইয়ে-দাইয়ে, ক্লাসিকাল, রবীন্দ্র সংগীত আর পুরাতনী গানের রেকর্ড আর ক্যাসেট শুনিয়ে, শরীরে মনে একেবারে ফিট করে, বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে।

ফোনে, ঋজুদা বলছিল, এখন জগিং-ফিট হয়েছে, ফাইটিং-ফিট হতে এখনও আর দিন সাতেক লাগবে।

কোল্লেগাল বা মালে মহাদেশ্বর বা সত্যমঙ্গলম-এর পাহাড় জঙ্গলে আমাদের যাওয়া যে হবে না, সে খবরটা ঋজুদা অসুস্থ হবার আগেই পেয়ে গেছিল। ভটকাই তো জানতই। আমি আর তিতিরই জানতাম না। তবে মনমরা হবারও কিছু নেই। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই।

তামিলনাড়ু আর কর্ণাটকের পুলিশের বড়কর্তারা আর বি. এস. এফ.-এর বড়কর্তারাও প্রথমে ঋজুদাকে আকুল আহ্বান জানিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঘটনাপরম্পরা তাঁদের আয়ত্তে এসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরাই প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রবিভাগে, ঋজুদার যাওয়া নিয়ে। তাঁদের বক্তব্য এতজনের প্রাণহানির পরে, এত কাণ্ডের পরে, মিডিয়ার হাতে এত অপমান নিন্দামন্দ সহ্য করার পর যখন তাঁরা ভীরাপ্পান এবং তার দলবলকে প্রায় নিজেদের কজার মধ্যে এনেই ফেলেছেন, তখন কলকাতার ঋজু বোস এসে তাঁদের ওপর ছড়ি ঘোরাবেন এটা ওঁদের পক্ষে লজ্জাকর তো বটেই, একেবারেই দৃষ্টিকটু। আগে ডাকলেও না-হয় হতো। ইটস টু লেট ইন দ্য ডে।

ওদের যুক্তিটা অবশ্যই গ্রাহ্য। অন্যায় কিছু বলেননি ওঁরা। তা ছাড়া, সাফল্য যখন প্রায় হাতের মুঠোতে এসেছে তখন ওঁদের চটানো বা ওঁদের মনে আঘাত দেওয়ার মতো কিছু করা, উপরওয়ালারা ন্যায্য কারণেই ভাল বলে মনে করেননি। ঋজুদার সঙ্গে নাকি দুই রাজ্যের চিফ-সেক্রেটারিরাই কথা বলেছেন, ব্যাপারটা বুঝিয়ে। ঋজুদা যাতে কিছু মনে না করে। সে সম্বন্ধেও চেষ্টার ত্রুটি করেননি ওঁরা। অবশ্য ঋজুদা তো আর সেখানে যাওয়ার জন্য লালায়িত ছিল না। তাঁদের অনুরোধেই যাচ্ছিল। তাই মনে করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

.

নীলগিরির পাঁচ কে. জি সবচেয়ে ভাল চা এসেছে। মহীশূরের চন্দনকাঠের একটি চমৎকার কার্ড-টেবিলও পাঠিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু, ঋজুদা যে শুধু তাস খেলে না তাই নয়, তাস খেলা আদৌ পছন্দও করে না; তা না জেনেই। চমৎকার টেবিলটা নয়নামাসির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ঋজুদা। ওঁরা সবাই তাস-পাগল। চাও পাঠিয়েছে সকলকেই। আমাদের বাড়িতেও এসেছে এক প্যাকেট। তা ছাড়া, ঋজুদার কাছে তো খাওয়াই যায় যখন তখন। তবে, ঋজুদা নিজে নীলগিরি বা আসামের চা পছন্দ করে না। মকাইবাড়ির চা খায়। নয়তো লপচু–দার্জিলিং-এর। পাঙ্খবাড়ির খাড়াপথের পাশের মকাইবাড়ির চা-বাগানের মালিক, রসিক, শিকারি এবং ঋজুদার বন্ধু ব্যানার্জি-জেঠুরা প্রতি দুমাস অন্তর ঋজুদার জন্য চা পাঠান।

যেদিন দক্ষিণ ভারত থেকে যেতে হবে না খবরটি আসে, ঠিক সেদিনই অন্য একটি খবরও এসে যায়, মণিপুর থেকে। আসলে, মণিপুর রাজ্যের মোরে’ থেকে। যেখান থেকে ডাক এসেছে সেই জায়গাটার নামই মোরে। ইংরেজি বানান MOREH! মোরে আর মরে উচ্চারণটা এক বলে প্রথমটায় আমরা খুব হাসাহাসি করেছিলাম, মরে যেতে হবে বলে। মোরে’ মণিপুর আর বার্মার সীমান্তবর্তী গ্রাম। গ্রামই নাকি ছিল আগে। এখন মস্ত জায়গা। মোরের পরেই একফালি নো-ম্যানস ল্যান্ড। তারপরই বার্মার একটি নদীর একটি সরু শাখা নদী। তার ওপরে একটি ব্রিজ। লোহার। তারও পরে আবার কিছুটা নো-ম্যানস ল্যান্ড। তারপরেই বার্মা, এখন মায়নমার সীমান্তর গ্রাম, নাম তামু।

এই মোরেতেই খুন হয়েছেন দিন পনেরো আগে মণিপুর রাজ পরিবারের একজন রাজপুরুষ, অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে। এবং সেই খুনের তিনদিন আগেই তাঁর মোরের বাড়ি থেকেই খোয়া গেছে একটি পারিবারিক, সেরিমনিয়াল তরোয়াল, যা সেই ভদ্রলোকের পূর্বপুরুষেরা বংশপরম্পরায় ব্যবহার করতেন, বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে। সেই তরোয়ালটি আবার দুদিন পরে পাওয়া গেছে সে বাড়িরই বাগানের একটি নীলফুলফোঁটা বড় কেসিয়া গাছের তলাতে। কেউ মাটি খুঁড়ে পুঁতে রেখেছিল সেটাকে। কিন্তু রহস্যের সেখানেই শেষ নয়। সেই তরোয়ালের হাতলের ঠিক নীচেই বসান ছিল, একটা প্রকাণ্ড চুনী। মানে, রুবি। যার দাম, আজকের দিনে, কম করে কোটি টাকারও বেশি।

এই মৃত্যুরই কিনারা করার অনুরোধ জানিয়ে মণিপুরের রাজ পরিবারের এক দূর সম্পর্কের শরিক, পাঠিয়েছেন, মিস্টার তম্বি সিংকে। মিস্টার তম্বি সিং কলকাতাতে ঋজুদার সাহায্য চাইতেই ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছেন এবং হোটেলে ঋজুদার ডাকের অপেক্ষাতেই কাল থেকে বসে আছেন। মণিপুরে বসে ঋজুদার কথা জানা সম্ভব ছিল না। কিন্তু, অন্য সূত্রে তম্বি সিংরা শুনেছিলেন, ঋজুদার কথা। আসলে, তিনিও ঋজুদাকে চেনেন না। কলকাতা থেকে ঋজুদার পরিচিত এক মণিপুরি ভদ্রলোক মিস্টার পিশাক সিং যখন অল্পদিন আগেই ওই ঘটনার সময়ে মণিপুরে গেছিলেন, তখন তিনিই শিকারি, অ্যাডভেঞ্চারার এবং প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঋজুদার কথা জানান ওঁদের। এবং তাঁর কথা শুনেই তম্বি সিং ফাস্ট অ্যাভেইলেবল ফ্লাইট ধরে ইম্ফল থেকে কলকাতা চলে আসেন।

টেলিফোনে মি. তম্বি সিং-এর সঙ্গে ঋজুদার কথাবার্তা আগেই হয়ে গেছে। কিন্তু ঋজুদা অসুস্থ হয়ে পড়াতে সব গুবলেট হয়ে গেল। নিজের বাড়িতে না-ফেরা অবধি দেখা করা সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছিল, ঋজুদা। তাই ফিরে গিয়ে আবার এসেছেন উনি। গতকাল। আজকে রাতেই মিস্টার সিং আসবেন ঋজুদার ফ্ল্যাটে। ঋজুদা মণিপুরে যেতে রাজি হয়েছে এবং আমাদের সকলকেই যে ঋজুদা নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে এই আনন্দে আমরা সকলেই ডগমগ। বিশেষ করে, ভটকাই। তবে ঋজুদা বলেছে, মণিপুর চমৎকার জায়গা, তোদের দেখা হবে বলেই নিয়ে যাচ্ছি। গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে নয়।

ঋজুদার কথামতো আমরা সকলেই সোমবারে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বিশপ লেফ্রয় রোডে পৌঁছে গেছি। মিস্টার তম্বি সিং আসবেন ছটার সময়ে। উনি ডিনার খাবেন না। ঋজুদা যদিও বলেছিলেন খেতে। ওঁর নাকি ইন্দোনেশিয়ার কনসাল মি. ডি. কে. নাগের সঙ্গে কী কাজ আছে। ডিনারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি নেই তা অবশ্য বলেননি, ঋজুদার সঙ্গে ডিনার খেতে পারবেন না তাই শুধু জানিয়েছেন।

আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে। আজকে সস্তার ওপর দিয়ে সেরেছে গদাধরদা। পেঁয়াজি, পাতলা পাতলা করে কাটা বেগুনের বেগুনি–বেসন দিয়ে কড়া করে ভাজা। কুমড়োর ফুল ভাজা। আর চা।

ঘড়িতে যখন ছ’টা বাজতে পাঁচ মিনিট তখন ভটকাই একবার দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে দেখে এল। নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গেছিল আমার আর ঋজুদার সঙ্গে সেটা অন্য ব্যাপার ছিল, তা বলে খুনের কিনারা করতে যাওয়া! ন্যাচারলি অত্যন্ত উত্তেজিত এবং উন্মুখ হয়ে আছে সে।

ঋজুদা বলল, তুই দেখি আমাদের ম্যাডার মতন।

কে ম্যাডা? যার নামে ম্যাডাক্স স্কোয়ার? যেখানে জমজমাট পুজো হয়?

তিতির বলল, নামটা ম্যাডাক্স স্কোয়ার নয়, ম্যাডক্স স্কোয়ার।

নারে, না। আমাদের একটি আইরিশ ফক্স-টেরিআর কুকুর ছিল। সাদাতে কালোতে মেশানো রং। কী বুদ্ধি যে ছিল তার, আর কী চঞ্চল, তা কী বলব। জেঠুমণি যখনই অফিস থেকে আসতেন তখনই ম্যাডা পথের সব গাড়ির হর্ন-এর মধ্যে জ্যেঠুমণির গাড়ির হর্ন ঠিক চিনে নিতে পারত আর উত্তেজিত হয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে ঘর বারান্দা করত বার বার এবং তারপরই এক ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গারাজে চলে যেত। বাড়ির ভেতর দিক থেকে গারাজে ঢোকার একটি দরজা ছিল।–সেই দরজা দিয়েই জেঠুমণি গাড়ি গারাজ করে, দোতলাতে উঠে আসতেন। গারাজ খোলা মাত্রই ম্যাডা গারাজে ঢুকে গাড়ির সামনে লাফাতে থাকত। এমনি করেই তো একদিন গাড়ির তলাতে পরে ডান পাটা ভেঙেই গেল।

তিতির বলল, আচ্ছা ঋজুদা, তুমি বুঝি কুকুর ভালবাস না?

আমি বললাম, তোমরা আর কতদিন চেন ঋজুদাকে? বহুদিন আগে ঋজুদা যখন ওড়িশার জঙ্গলে ক্যাম্প করে থাকত, কাঠের ঠিকাদারি করত, তখন ঋজুদার সাত সাতটি কুকুর ছিল। আর তাদের নাম কী ছিল, জানো?

ভটকাই শুধোল, কী?

সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি।

তিতির হেসে উঠল। বলল, শুদ্ধ না কোমল?

আমি বললাম, সাত স্বরেই তো কোমল পর্দা লাগে না। শুদ্ধ স্বরগুলি ছিল পুরুষ আর কোমল স্বরগুলি মেয়ে।

ঋজুদাও হেসে উঠল, পুরনো কথা হঠাৎ মনে পড়িয়ে দেওয়াতে।

আমি অনেকদিন পরে একহাত নিলাম ভটকাইকে, তিতিরকেই বা নয় কেন! দুজনকেই।

তারপরই জ্যাঠার মতো বললাম, সে কি আজকের কথারে? ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’তে লিখেছি সেসব কথা। ঋজুদাকে নিয়ে সেই তো আমার প্রথম বই। তখন আমার কতই বা বয়স!

তিতির হেসে বলল, হ্যাঁ, তুমি তো এখন বুড়োই হয়ে গেছ রুদ্র। তোমার বয়সের কি আর গাছ-পাথর আছে?

বুড়ো নই, বুড়ো নই; অভিজ্ঞ! এক্সপিরিয়েন্সড।

 রাইট।

বলল, ঋজুদা! পাইপে দেশলাই ঠুকে।

একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল, রুদ্রকে তোরা মাঝেমাঝে যে হেনস্থা করিস এবং ও সবসময় হাসিমুখে তোদের সহ্যও করে, সেটা ওর মহত্ত্বই বলতে হবে। সত্যিই, আমার আর রুদ্রর পার্টনারশিপ তো কমদিনের হল না! আর ঋজুদা কাহিনী লিখে, বলতে গেলে রুদ্রই তো আমাকে ফেমাস করল। যদিও ফেমাস হতে চাইনি আমি। এ এক বিড়ম্বনা!

ঘড়ির দিকে একবার চেয়েই ভটকাই আবার এক দৌড়ে বারান্দাতে গেল, ঋজুদার জ্যেঠুমণির ম্যাডার মতন। গিয়েই রানিং কমেন্টারি দিতে লাগল কন্টেসা ক্লাসিক সাদা রং। এক্ষুনি পৌঁছল। মিস্টার তম্বি সিং নামলেন। ড্রাইভার দরজা খুলে দিল।

বাবা! এ যে দেখি পুরো সাহেব।

বলেই, ঘরে এল। বলল, ওঁর বড় ভাইকে সঙ্গে আনলেন না?

বড় ভাই?

ঋজুদা একটু তাকাল অবাক হয়ে, ভটকাই-এর দিকে।

হ্যাঁ। হম্বির তো তম্বির বড় ভাইই হওয়ার কথা। হম্বিতম্বি বলেই তো জানি কথাটা আমরা।

আমরা সকলেই হো হো করে হেসে উঠলাম। এবং গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটাতে ছ’টা বাজার শব্দ আরম্ভ হতে না হতেই কলিং বেলটা বাজল।

আমিই খুলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ঋজুদা হাত দিয়ে ইশারাতে মানা করে, নিজেই গিয়ে দরজাটা খুলল, বলল, গুড ইভনিং মিস্টার তম্বি। কাম অন ইন।

ভারতীয়দের সঙ্গে সচরাচর ইংরেজি বলে না ঋজুদা। কারণ, সে, মানে দূরদর্শনের খবরের হিন্দি নয়; হিন্দুস্তানি, মারাঠি, ওড়িয়া, হো, সাঁওতালি, মুণ্ডারি, নেপালি, ইত্যাদি অনেক ভাষাই ভাল বলতে পারে। কিন্তু যে-সব ভারতীয়, বাঙালিদের মধ্যেও তাদের সংখ্যা বড় কম নয়, দেশ স্বাধীন হবার চল্লিশ বছর পরও ইংরিজি বলে শ্লাঘা বোধ করেন, তাদের সঙ্গে ইংরেজিই বলে। সেইসব মানুষেরা ইংরেজি না-জানা মানুষের কাছে, নীচ প্রবৃত্তিতে, আপার-হ্যান্ড নিতে চান ইংরেজি বলে। কিন্তু অপাত্রকে আপার-হ্যান্ড দেবে, এমন পাত্রই ঋজুদা নয়।

মিস্টার তম্বি বললেন, অ্যাম আই অন টাইম, মিস্টার বোস?

 রাইট অন টাইম। ইওর হাইনেস।

হেসে বলল, ঋজুদা। রাজা রাজড়াদের দিন শেষ হয়ে গেছে তা ভাল করে জেনেও। এবং এই মানুষটি শুধুমাত্র দূতই! তাও সত্যি সত্যিই কোনও রাজার দূত কিনা, সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ না হয়েও। ঋজুদার মতো খুশি করতে, কম মানুষই পারে। আবার দুখী করার বেলাতেও এই কথাটাই সমান ভাবে খাটে।

তারপর আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে মিস্টার সিং-এর আলাপ করিয়ে দিল। সিনিয়ারিটি অনুযায়ী। আগে আমার সঙ্গে, তারপর তিতিরের সঙ্গে এবং সবশেষে ভটকাই-এর সঙ্গে।

চোখ দিয়ে ইশারা করে ভটকাইকে বললাম, একেই বলে প্রোটোকল। তোর মতো অভব্যদের ঋজুদাকে দেখে শেখা উচিত।

ও! আগের কাজ আগে।

 বলেই, তম্বি সিং ওঁর জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক গোছা প্লেনের টিকিট বার করে ঋজুদাকে দিলেন। বললেন, আগামী রোববারের। সকালের ফ্লাইট। রিটার্ন ওপেন আছে। তারপর একটা মোটা খাম।

ঋজুদা অবাক হয়ে বলল, এতে কী আছে?

 পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। অন অ্যাকাউন্ট। পাঁচশো টাকার নোট।

তা ক্যাশ কেন? আপনি জানেন তো যে, দশহাজারের চেয়ে বেশি টাকা ক্যাশ-এ পেমেন্ট করলে, ইনকাম ট্যাক্সে বাদ পাওয়া যায় না খরচ হিসাবে?

সেসব আমার, বলেই, একটু বিব্রত হয়ে বললেন, রসিদ দিতে হবে না।

 রসিদ আমি দেবই, তা আপনি রাখুন আর ছিঁড়েই ফেলুন।

বলে, ঋজুদা ড্রয়ার খুলে প্যাড বের করে রসিদ লিখে দিল। রেভেন্যু স্ট্যাম্প লাগানোই ছিল।

মিস্টার তম্বি সিং আমাদের দিকে একে একে চেয়ে বললেন, এঁরাই তা হলে ফেমাস ঋজু বোসের ফেমাস অ্যাসিস্ট্যান্টস–ঋজু বোস অ্যান্ড কোম্পানি।

ঋজুদা হাসল। বলল, রাইট য়ু আর। আমাকে ইনফেমাস এমনকী নটোরিয়াসও বলতে পারেন, কিন্তু এঁদের প্রত্যেককেই ফেমাস বলেই জানবেন। ইন দেয়ার ওওন রাইটস।

এবারে বলুন, কী খাবেন? হোয়াট ক্যান আই অফার ঝু? বাট আই অ্যাম সরি আই ডু নট হ্যাভ এনি হার্ড ড্রিঙ্কস।

না, না। কিছু না। কাজের কথা সেরে নিই তাড়াতাড়ি।

ঠিক আছে।

ওঁকে মধ্যের সিঙ্গল সোফাটাতে আরাম করে বসতে দিল, ঋজুদা। আসলে, এই সোফাটার মুখোমুখি ঋজুদার রিক্লাইনিং চেয়ারটার বাঁ পাশের সাইড টেবিলের ওপরেই রাখা থাকে টেবিল লাইটটা। আলোটা এই চেয়ারে যে-ই বসবেন, তাঁরই মুখের ওপরে পড়বে। তা ছাড়া, রাতের বেলা ঘরের অন্য অনেক আলো তো থাকেই। ওই আলোটা দিনের বেলাতেও পড়াশোনার জন্য ব্যবহার করে ঋজুদা। মাথার পেছনে, বাঁ পাশে থাকে। কোনও নবাগন্তুক এলে এই উপরি আলো কাজে লাগে। মনস্তত্ববিদেরা, পুলিশ অফিসারদের মধ্যে যাঁরা জেরা করেন, তাঁরা সকলেই এমন আলোর ব্যবহার জানেন।

মাথার টুপিটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন মিস্টার সিং। সঙ্গে সঙ্গে আমি সেটা খুলে নিয়ে, হ্যাট-স্ট্যান্ডে রেখে এলাম।

উনি বললেন, থ্যাঙ্ক য়ু। তারপর একটি পলমল সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমাদের অফার করে, নিজে ধরালেন একটি। নিজের লাইটার দিয়েই। বললেন, এইই আমার দোষ। এই অ্যাডিকশনটাকে ছাড়তে পারলাম না। অবশ্য অ্যাডিকশান বলতে এই একটিই।

ঋজুদা হেসে বলল, ছোটখাটো অ্যাডিকশন দু একটি থাকা ভাল।নইলে তা এড়াতে গিয়ে অনেকগুলি বড়র খপ্পরে পড়তে হয়।

তা ঠিক।

 বলেই, মি. সিং হাসলেন।

 হাসিটা আমাদের মতন না। অনভ্যস্ত কানে, হঃ, হঃ হঃ শোনায়। নেপালি বা দার্জিলিং বা গ্যাঙটকের মানুষেরা কিন্তু এরকম হাসেন না। মেঘালয়ের খাসিরাও এমন করে হাসেন না। হয়তো মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশের মানুষদের হাসির ধরনটা একটু অন্য ধরনের। হতেই পারে। এত বড় দেশ আমাদের। কত বৈচিত্র্য!

বলুন এবার, আপনার যা বলার।

ঋজুদা বলল, ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট গলাতে।

 হ্যাঁ।

শুরু করলেন তম্বি সিং।

ইংরিজি মোটামুটি বলেন। উচ্চারণটাও মোটামুটি। তবে মাঝেমাঝেই কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণে বোঝা যায় যে, ইনি কোন অঞ্চলের মানুষ। যেমন, পশ্চিমবাংলার, হরিয়ানার, পাঞ্জাবের, বিহারের, ওড়িশার এবং তামিলনাড়ুর মানুষদের ইংরেজি শুনলেই বোঝা যায়।

মণিপুরের রাজপরিবারের একজন রাজা, লাইহারোবা সিং ছিলেন নিঃসন্তান। ইবোহাল সিং তাঁরই ভাইপো। তিনি প্রায় আমারই সমবয়সী। আমরা অত্যন্ত বন্ধু ছিলাম। তাঁকেই কে বা কারা খুন করে, তাঁর মোরে’র বাংলোতে, আগস্টের…।

ঋজুদা বলল, তারিখটা তো আমাকে জানিয়েছেনই!

কী ভাবে খুনটা হয়?

গলায় ফাঁস দিয়ে।

 দিনে না রাতে?

রাতে। গভীর রাতে।

 সন্ধেরাতে যে নয়, সে সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিত হলেন কী করে?

না, না, আমি নিশ্চিত নই। পুলিশের তাই ধারণা।

আই সি!

কোথায় হয় খুনটা?

ওঁর স্টাডিতে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন, ওঁর স্টাডিতেই থাকতেন বেশির ভাগ সময়।

স্টাডিতে কী করতেন?

পড়াশুনা করতেন। ভিডিও ক্যাসেট দেখতেন। মিউজিক সিস্টেমে গান বাজনা শুনতেন, বই পড়তেন, পুরনো অ্যালবাম দেখতেন। ওঁর সখের শেষ ছিল না। ভাল হুইস্কি খেতেন। রাতে হুইস্কি, দিনে জিন।

কতখানি খেতেন?

 আধ বোতল করে।

দুপুরে এবং রাতে?

ইয়েস। কেন? বেশি মনে হচ্ছে?

না, না। রাজারাজড়াদের ব্যাপার-স্যাপার তো একটু আলাদা হবেই। আমার ইনকুইজিটিভনেস ক্ষমা করবেন।

ওঁর পরিবারে কে কে ছিলেন?

কেউই নয়। উনিও ব্যাচেলরই ছিলেন। ওঁর কাকারই মতো।

আই সি। তা উনি কোনও উইল করে গেছিলেন? ওঁর সম্পত্তি ওঁর অবর্তমানে কে পাবে?

উইল করে গেছিলেন বলে তো জানা নেই! তবে আচ্চাও হয়তো কিছু জানে এ বিষয়ে।

আচ্চাও কে?

ওই আচ্চাওই দেখাশোনা করত, ইবোহালের। প্রাইভেট সেক্রেটারির মতো ছিল। সবসময়ের সঙ্গী ছিল। আমাদের সঙ্গে শিকারেও যেত। আচ্চাও গান-বেয়ারারকে গান-বেয়ারার, ড্রাইভারকে ড্রাইভার, শেফকে শেফ ছিল। হ্যাঁ, মি. বোস, আচ্চাও দারুণ ভাল রান্নাও করে। সে সবই ছিল ইবোহালের-নয়নের মণি।

তার মানে, মিস্টার ইবোহাল সিং ডায়েড ইন্টেস্টেড।

ইয়েস মি. বোস। আমরা যতটুকু জানি, তাতে ইবোহাল কোনও উইল রেখে যাননি। আর উইল করলে তো এক্সিকুটার করত আমাকেই।

সে-সম্বন্ধে আপনি নিঃসন্দেহ হলেন কী করে?

তার কোনও প্রমাণ দিতে হয়তো পারব না, তবে আমিই তো ছিলাম ওঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ। ওঁর বাড়িতেই থাকতাম মাসের মধ্যে প্রায় পনেরো দিন। কিন্তু, যেদিন খুনটা হয় সেদিন আমি ইম্ফলে ছিলাম।

ঋজুদা চুপ করে একটুক্ষণ কী ভাবল। তারপর বলল, এক কাপ চা কি আপনি…।

না, না। মেনি থ্যাঙ্কস।

তারপর ঋজুদা বলল, মি. ইবোহাল সিং-এর পরিবার কি মণিপুরের রাজ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত, না কি যোগসুত্রটা তেমন নিকট নয়?

না না, ঠিক তেমন নিকট নয়। বলছি।

ভদ্রলোক একটু থেমে থেমে প্রম্পটারের প্রম্পট শুনে, পার্ট-ভুলে যাওয়া

অভিনেতা যেমন করে কথা বলেন, তেমনি করে কথা বলছিলেন।

ইবোহালের ঠাকুর্দার অবস্থা খুব ভাল ছিল। রাজ পরিবারের লোকেদের সঙ্গে দহরম-মহরম ছিল। ওঁদের পুরুষদের সঙ্গে পোলো খেলতেন। একটু থেমে বললেন, আপনি কি জানেন মিস্টার বোস, যে, ‘পোলো’ খেলাটা মণিপুর রাজ্যেই প্রথম হত? আজকালকার সাইকেল পোলো-ফোলোর মতো ইন্নোভেটিভ ব্যাপার নয়–আসল পোলো৷ ঘোড়ায় চড়ে।

সে কী? ইটস আ নিউজ। আমার তো ধারণা ছিল যে, জয়পুর, যোধপুর, গোয়ালিয়র ইত্যাদি উত্তর ভারতের সব রাজা-রাজড়াই ভারতে পোলো খেলার পত্তনকারী।

তিতির বলল, অবাক হওয়া গলাতে।

ঋজুদা বলল, আমিও তাই জানতাম।

না, তা নয়। দেশ স্বাধীন হবার পর উত্তর ভারতীয়রাই বলতে গেলে এদেশের রাজা–এবং মাঝে মাঝে দক্ষিণ ভারতীয়রাও, এমনকী ফর আ চেঞ্জ কখনও কখনও পশ্চিম ভারতীয়রাও; কিন্তু আমরা পূর্বাঞ্চলের হতভাগা মানুষেরা তো আজও প্ৰজাই রয়ে গেলাম। আমরা আর স্বাধীন হলাম না। পোলোর মতো আরও অনেক কিছুই আছে যা অন্য প্রদেশীয়রা আমাদের কাছ থেকেই শিখেছিল, সে কথা অনেকেই জানেন না। জানলেও স্বীকার করেন না। দেখলেন তো, আপনার মতো পৃথিবী-ঘোরা উচ্চশিক্ষিত মানুষও জানতেন না, এই পোলোর ব্যাপারটা।

ঋজুদা ইতিবাচক ঘাড় নাড়ল।

তারপরই বলল, পুলিশ কী বলছে?

কী সম্বন্ধে?

যেন চমকে উঠে বললেন, মিস্টার তম্বি সিং।

ও না। পুলিশ আবার কী বলবে? আমাদের সব জায়গার পুলিশ যা বলে, তাই। বলেছে। যে বা যারা খুন করেছে, তারা নিশ্চয়ই আগে থাকতেই ম্যানেজ করেছে পুলিশকে। এ কি আর ইংল্যান্ডের পুলিশ?

না। তা নয়। ভারতেও অনেক সৎ ও দক্ষ পুলিশ অফিসার আছেন। সব বিভাগেই আছেন। তবে এটা ঠিক যে, সতোর সঙ্গে ভারতের মাটির যোগ ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। কিন্তু তবু বলব, আপনার কি ধারণা, ইংল্যান্ডের সব পুলিশেরাই সৎ? সাদা চামড়াদের মধ্যে কালো চামড়াদের দোষ সংক্রামিত হয়? আমি তো বলব, সব দোষই হয়তো আমরা পেয়েছি ওদেরই কাছ থেকে।

জানি না। বাট আই বেগ টু ডিফার।

তম্বি সিং বললেন।

 আপনি কি ইংল্যান্ডেই পড়াশুনো করেছেন?

 হ্যাঁ।

কোথায়?

অক্সফোর্ডে।

 কোন কলেজে?

বললাম তো, অক্সফোর্ডে।

আই সি।

 বলেই, ঋজুদা প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল।

তারপর বলুন, পুলিশ কী বলছে? আপনার কি মনে হয়? আর মোটিভ? এই খুনের উদ্দেশ্য কী হতে পারে? ওঁকে খুন করে কে বা কারা লাভবান হতে পারেন? ওঁর শত্ৰু কি ছিল কেউ? অন্যান্যদের মধ্যে ওঁর কাছের লোকজন কারা ছিলেন? ইম্ফলে বাড়ি থাকা সত্ত্বেও উনি মোরেতে কেন থাকতেন? ‘মোরে’ ইম্ফল থেকে একশো কিমির চেয়েও দূর হবে। বিশেষ করে, এখন মণিপুরের মধ্যে যা সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ চলছে এবং তার বেশিটাই তো জানি মোরেরই দিকে– মানে, প্যালেল আর মোরের মাঝামাঝি–তবুও উনি এই সময়ে মোরেতেই পড়ে রইলেন কেন? ইম্ফলেও যদি থাকার জায়গা থেকে থাকে।

আমরা তো বটেই, মনে হল মিস্টার তম্বি সিং-ও যেন একটু অবাক হলেন, ঋজুদার কথা শুনে।

তম্বি সিং বললেন, আপনি কি গেছেন কখনও, মণিপুরে?

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, বহুবার। প্রথমবার যাই, উনিশশো ছাপ্পান্নতে। তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। তারপরেও, বহুবার গেছি। মণিপুরের ইম্ফল, নাগাল্যান্ডের কোহিমা, ডিমাপুর, মোককচুঙ, মাও, বার্মার তামু, ত্রিপুরার আগরতলা, গারো পাহাড়ের তুরা, মেঘালয়ের শিলং, জয়ন্তী এবং..

বাস। বাস। ওরে বাস।

 বললেন মিস্টার তম্বি সিং।

বলেই বললেন, তবে তো একেবারে ঠিক লোকের কাছেই এসেছি। আমার বরাত খুব ভাল বলতে হবে। অন্ধের মতো কিছুই হাতড়ে বেড়াতে হবে না আপনাকে, মণিপুরে গিয়ে। আই মাস্ট থ্যাঙ্ক পিশাক সিং। আপনার কথা আমাদের বলেছেন বলে।

বলেই, আরেকটি সিগারেট ধরালেন। পুরনোটি অনেকক্ষণ আগেই অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়েছিলেন।

তারপর বললেন, আপনি আমাকে যেসব প্রশ্ন করলেন, ইনফ্যাক্ট, সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার জন্যই তো আপনাকে যাওয়ার নেমন্তন্ন নিয়ে এসেছি। আসলে…আমরা একেবারেই পিরপ্লেক্সড। আমার মেয়ে সানাহানবি তো কেঁদে কেঁদে রোগা হয়ে গেল। ইবোহাল ওজ ভেরি ফন্ড অব হার।

হ্যাঁ, সেটাও আমি জানতে চাই। ওঁর সম্বন্ধে যা কিছু জানেন, সবই জানতে চাই।

ইবোহাল ওজ আ হি-ম্যান। আ লেডিজ ম্যান। সব বয়সী মহিলারাই ইবোহালকে এক বিশেষ চোখে দেখত। পাঁচ বছর থেকে পঁচাশি বছর অবধি।

মি. সিং, একটা প্রশ্ন করব? আপনার নিজের কী ইন্টারেস্ট, এই রহস্যভেদ করে? ইবোহাল সিং-এর মৃত্যুতে তাঁর প্রিয় বন্ধু হিসেবে আপনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন এবং সেইজন্যই কি আপনি চান যে, প্রকৃত খুনি বা খুনিরা ধরা পড়ুক? না, অন্য কোনও কারণও আছে?

তম্বি সিং অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একবার মুখ ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে আমার, তিতিরের ও ভটকাই-এর মুখের দিকে দেখলেন।

ঋজুদা পাইপের ছাইটা ঝেড়ে ফেলে বলল, এরা প্রত্যেকেই আমার সম্পূর্ণ আস্থাভাজন। এবং এরাই আমার সহকারী। আপনি নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে বলুন, যা বলতে চান।

ব্যাপারটা কি জানেন?

বলেই সিগারেট একটি বড় টান লাগালেন তম্বি সিং।

ব্যাপারটা হচ্ছে, অ্যাজ ব্যাড লাক উড হ্যাভ ইট, পুলিশে কিনারা করতে–পারাতে, জানাশোনা এবং স্থানীয় মানুষের সন্দেহটা আমার ওপরেই এসে পড়েছে। শুধু বন্ধুত্বের টানেতেই নয়, নিজেকে মিথ্যে দুর্নাম থেকে বাঁচাতেও আপনার কাছে ছুটে আসতে হয়েছে। এ ছাড়া, সত্যি কথা বলতে কী আমার আর কোনও…।

হঠাৎ মনে হল যে, তিনি ভেঙে পড়বেন–উনি বললেন, আমি গরিব মানুষ…।

ঋজুদা বলল, ভেরি স্ট্রেঞ্জ। অথচ আপনিই…

হ্যাঁ। অফ অল পার্সনস, আমিই। কারণ, আমার মতো ভাল আর কেউই জানে না যে, আমি আমার প্রিয়তম বন্ধু ইবোহালকে খুন করিনি। আমরা কত শিকার করেছি ছেলেবেলা থেকে দুজনে, একসঙ্গে, লকটাক লেকে–পাখি, নাচুনে-হরিণ। থেংনোপালের, কাঙ্গপোকপির, তাদুবীর জঙ্গলে বাঘ, হরিণ, চিতা। কত পোলো খেলেছি প্রথম যৌবন থেকে। ইবোহাল, আমার স্ত্রীর আর একমাত্র মেয়ে সানাহানবির এমনই প্রিয় ছিল যে, নিন্দুকেরা বলত, যে আমার স্ত্রীর দুই স্বামী।

কিন্তু আমিও যদি খুনের কিনারা না করতে পারি? তাহলে তো আপনার ওপর যারা সন্দেহ করছে, সেই সন্দেহ থেকেই যাবে। এমনকী তা হয়তো বেড়েও যাবে। তখন তো বিপদ আপনারই বাড়বে।

না না, আমি জানি যে, আপনি ঠিকই পারবেন কিনারা করতে। আপনিই পারেন, আমার মান বাঁচাতে। আপনি ছাড়া আর কেউই পারবেন না।

আপনার কি খুনি বলে কাউকে সন্দেহ হয়?

ঋজুদা বলল।

কী করে বলি, নিশ্চিত না হয়ে। তবে আমার ফেইন্ট সন্দেহ হয় যে, ইবোহালের সম্পত্তি ও অন্য কাউকে দেবে বলে ভাবছিল এবং কথাটা হয়তো আচ্চাও জেনে যায়। আচ্চাও হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ভেবেছিল যে, ইবোহাল যেহেতু নিঃসন্তান এবং আচ্চাওকে পুত্রসম ভালবাসে, তাই ওর যা কিছু আছে, সবই সে আচ্চাওকে দিয়ে যাবে। কিছুদিন হল হাঁপানিতে কষ্ট পাচ্ছিল খুব। শরীর ভাল যাচ্ছিল না। একদিন ইবোহাল আচ্চাওর সামনেই আমার মেয়ে সানাহানবিকে বলে যে, শিগগিরই সে উইল করবে। সেটা শোনার পর থেকেই আচ্চাও-এর খুব রাগ জন্মেছিল ইবোহালের ওপরে। তাই মনে হয়, সেই রাগেই…

যখন এই কথা ইবোহাল সিং বলেন তখন কি আপনি সামনে ছিলেন?

 না। আমি সামনে ছিলাম না।

 তবে আপনি একথা জানলেন কী করে? আপনার মেয়ে সানাহানবি কি আপনাকে বলেছিল?

না, সানাহানবি কিছুই বলেনি। সে অন্য ধরনের মেয়ে। তাকে দেখলেই আপনিই বুঝতে পারবেন সে কী! আমাকে দেখে মেয়ে সম্বন্ধে ধারণা করবেন না কোনও।

তবে কে বলল আপনাকে? আচ্চাও সিং?

না। সেও বলেনি। সেও খুব চাপা ছেলে। আত্মসম্মানজ্ঞানী।

তবে আপনি জানলেন কী করে?

ইবোহালের খাস-বেয়ারা বার্মিজ উ-মঙ্গ বলেছিল।

সে কি তখন সামনে ছিল?

সামনে ছিল কি না জানি না। তবে না থাকলে…

ওর সামনে এমন একটা ডেলিকেট ও গোপনীয় কথা মিস্টার ইবোহাল সিং বলবেন বলে আপনার বিশ্বাস হয়?

আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কী এসে যায়? আসলে, আমাকে আপনি জেরা করবেন না। করলে, এ কেস-এর সমাধান আপনি করতে পারবেন না। আমি দূত হয়ে এসেছি আপনার যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে। ইম্ফলে গিয়ে, মোরেতে গিয়ে, কাঙ্গপোকপিতে গিয়ে, আপনি যত খুশি প্রশ্ন করবেন, যত লোককে ইচ্ছে। আমি এখনও ইবোহালের মৃত্যুর শকটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমাকে মাপ করবেন।

ঠিক আছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করব না। আপনার নিজের যা খুশি, তাই বলুন।

ও হ্যাঁ। কিছুদিন হল, শুনেছি, একজন খুব বড়লোক ব্যবসায়ী আচ্চাওকে তাঁর ব্যবসার কাজে লাগাবেন বলে খুব ভাল মাইনে-পাতির লোভ দেখাচ্ছিলেন। হয়তো, আচ্চাওকে, ওঁকে ছেড়ে যেতে নিরস্ত করার জন্যই ইবোহাল ওইরকম বলেছিল। সম্পত্তি দেবে না, এই ভয় দেখিয়েছিল। অবশ্য দেবে যে, একথাও কখনও কাউকে বলেনি। আচ্চাওকেও বলেছিল বলে মনে হয় না আমার। হয়তো ইবোহাল আচ্চাওকে প্রেসারইজ করছিল যাতে ব্যবসা করতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়ল না মারে। এখন মরা মানুষের কাছ থেকে তো আর নতুন করে কথা বের করা যাবে না।

না। তা যাবে না। এই ব্যবসায়ীটি কোথায় থাকেন?

ইম্ফলেই। মস্ত বড়লোক। নাম, থাঙ্গজম সিং লংজু।

ঋজুদা বলল, আচ্চাও ওরিজিনালি কোন চাকরিতে ঢুকেছিল? ড্রাইভার হিসেবে? গান-বেয়ারার হিসেবে? না, ইবোহাল সিং-এর ভ্যালে হিসেবে?

না, না। আচ্চাও তো শিক্ষিত। পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডও ভাল। ছেলেবেলায় ওর মা বাবা একই সঙ্গে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলে কাকারা সম্পত্তি ঠকিয়ে নেয়। এক মাসি দেখাশোনা করতেন ওকে। তবে তাঁর অবস্থা ভাল ছিল না। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেছিল ও। ইবোহাল ওকে প্রথমে এস্টেট ম্যানেজার হিসেবে অ্যাপয়েন্ট করেছিল। ধীরে ধীরে ও হয়ে উঠল ইবোহালের, যাকে বলে, হিন্দিতে দোস্ত!-ইয়ার!–একেবারে মাথায় চড়িয়েছিল ইবোহাল তাকে।

এখন আচ্চাও সিং কোথায়?

 সে পালিয়ে গেছে। তাকে পাওয়া গেলে তো অনেক কিছুই জানা যেত।

সে পালিয়ে গেলে তো পুলিশ তাকেই সন্দেহ করবে প্রথমে এবং সে সন্দেহ তো অমূলক নয়!

শুধু সন্দেহ করলে তো হবে না। প্রমাণ সাবুদ তো চাই। আর অন্য প্রমাণের মধ্যে রুবিটাও পড়বে। সেটা যার কাছে পাওয়া যাবে, যদি যায়, নব্বইভাগ সন্দেহ তার উপরই পড়বে খুনি বলে।

তাই?

ঋজুদা বলল। কিছু মনে করবেন না মিস্টার সিং। আপনার মেয়ে, আচ্চাওকে কী চোখে দেখত?

মেয়েদের দেখার কথা কে বলতে পারে মিস্টার বোস?

ঋজুদা বলল, আমি তো পারিই না। আমি তো ব্যাচেলার।

হেসে ফেললেন, মিস্টার সিং।

আচ্চাও, ওর ঘনিষ্ঠদের নাকি বলেছে, পালাবার আগে, যে তার এত ভালমানুষ মালিককে কে বা কারা খুন করল তা সে খুঁজে বের করবেই। নইলে ওর শান্তি নেই।

আমি বলে উঠলাম, সম্পত্তিই যদি না পায়, তবে তা করে আচ্চাও সিং-এর লাভ?

লাভ?

 বলেই, তম্বি সিং থেমে গেলেন।

বললেন, ফিনান্সিয়াল লাভ তো কিছু দেখছি না। টাকাটা সকলের কাছে বড় নাও হতে পারে। হয়তো অন্য কোনও মোটিভ থাকতে পারে এর পেছনে। আপনি গোয়েন্দা, আপনিই ভাল বুঝবেন, আমার চেয়ে।

হাতঘড়ির দিকে চাইলেন একবার তম্বি সিং। ঘড়িটা–সোনার। ইতিমধ্যে গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকে সাড়ে ছ’টা বাজল।

বাঃ। আপনার ঘড়িটা কিন্তু দারুণ।

ঋজুদা বলল।

হ্যাঁ। ইবোহালই আমাকে কিনে দিয়েছিল। দুজনে একসঙ্গে যখন সুইজারল্যান্ডে গেছিলাম। ইবোহালের এক সুইস বন্ধু প্রায় জোর করেই ওকে কিনতে বলল। ওতো একটা কিনলই, আমাকেও একটা আইডেনটিকাল পিস কিনে দিল।

ভটকাই হঠাৎ বলল, কী বললেন? মিস্টার ইবোহাল সিং-এর সুইস বন্ধু?

ইয়েস। দ্যাটস রাইট।

 ভটকাই তার দুটি চোখ তম্বি সিং-এর দুচোখে ফোকাস করে রেখে শুধোল, সেই বন্ধু স্যুইস-ফ্রেঞ্চ না সুইস-জার্মান? না স্যুইস-ইটালিয়ান?

আই বেগ ইওর পাৰ্ডন?

 ঘাবড়ে গিয়ে শুধোলেন তম্বি সিং।

 তারপরই বললেন, সুইস ফ্রেন্ড। মানে, সুইজারল্যান্ডের লোক।

বুঝেছি, সরি স্যার, ফর দ্য ইনটারাপশন।

ভটকাই বলল।

আমি এবার উঠতে পারি? আমি কাল চলে যাচ্ছি। রবিবার সকালে আমি এয়ারপোর্টে থাকব, আপনাদের রিসিভ করতে।

থাকার বন্দোবস্ত কোথায় করেছেন?

সার্কিট হাউসেই। আমার বাড়িতেও থাকতে পারতেন। কিন্তু আপনাদের দেখাশোনা করবে কে? আমার বাড়িতে তো অন্য কেউই থাকেন না। আমার স্ত্রী তো গত হয়েছেন, চারবছর হল। আর সানাহানবিও রয়েছে এখন কাঙ্গপোকপিতে, তার এগ্রিকালচারাল ফার্মে। ফার্মিং করে, ঘোড়ায় চড়ে, শিকার করে। সানাহাবি ভাল পোলোও খেলে। আসল ব্যবসা হয়েছে এখন কুকুর-ব্রিড করানো। ছেলেবেলা থেকেই কুকুর ভালবাসত খুব। এখন কুকুরেরই ব্যবসা হয়েছে।

কাঙ্গপোকপি!

কী দারুণ নামটা! তাই না?

তিতির বলল।

ভটকাই বলল, জায়গার নাম? কাঙ্গপোকপি?

তম্বি সিং কিছু বলার আগেই ঋজুদা বলল, হ্যাঁ। মণিপুর থেকে যে পথটা পাহাড় আর গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে নাগাল্যান্ডের দিকে, সেই পথেই কাঙ্গপোকপি পড়ে। তাদূবী, মাও, জুকুমা, খুজামা এই সব নামের জায়গা আছে না আশেপাশে? মাওতেই বোধহয় বর্ডার, নাগাল্যান্ডের? আর কী চমৎকার সে নৈসর্গিক সৌন্দর্য! অনেকেই বলেন, ওই পথের দৃশ্য, জম্মু থেকে শ্রীনগরে যাওয়ার দৃশ্যের মতোই সুন্দর। এখন তো কাশ্মীর যাবার উপায় নেই, ওখানে গিয়েই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নিতে পারবি।

তম্বি সিং আমাদের দিকে ফিরে বললেন, আসুন। আসুন। আপনাদের সব দেখাব! কিন্তু আপনারা এমন সময়েই যাচ্ছেন। এখন তো মণিপুরে গোলমাল, সাংঘাতিক।

ঋজুদা বলল, তা ঠিক। গোলমাল তো মোরের দিকেই বেশি। চূড়াচান্দপুর বা কাঙ্গপোকপির দিকেও কি তেমন গোলমাল আছে? তা ছাড়া আপনার বন্ধুর হত্যা-রহস্যের সমাধান তো গোলমালের জন্যে বসে থাকবে না।

না। তা নয়। ওদিকে এখনও গোলমাল নেই, কিন্তু না থাকলেও লাগতে কতক্ষণ?

তম্বি সিং, ঋজুদা মণিপুর সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে দেখেই যেন মনমরা হয়ে বললেন।

আপনার মেয়ের বিয়ে দেননি, মিস্টার সিং?

আমি কি দেব? আজকালকার মেয়েরা কি আর বাবা মায়ের ইচ্ছেতে বিয়ে করে? তা ছাড়া, আমাদের সমাজও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। মেয়েরাই মালিক সেখানকার। কাজেকর্মেও তারা এগিয়ে। মেয়েরাই তো সর্বেসর্বা মণিপুরে। মণিপুরে কেন, সব পূর্বী-পাহাড়েই।

তিতির বলল, চলুন। আগে তো গিয়ে পৌঁছই। তারপর যদি আপনার মেয়ের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পাই, তবে সেখানেই থেকে যেতে পারি।

বলেই, ভটকাই আর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেল-ডমিনেটেড পৃথিবী আর ভাল লাগে না।

কাঙ্গপোকপির ফার্মহাউসে সানাহানবি একা থাকেন?

তিতির শুধোল। উৎসুক হয়ে।

হ্যাঁ। সানাহানবি একাই একশো পুরুষের সমান। তা ছাড়া, ওর কুকুরেরাও থাকে। ফার্মের দেখাশোনা, কুকুর ও ঘোড়ার দেখাশোনা করার লোকেরাও থাকে। কুকুরের খুব শখ ওর। পৃথিবীর সব ভাল কুকুর আছে ওর কাছে। কুকুরের বাচ্চা বিক্রি করে। ঘোড়াও আছে। তবে, বেড়াল ওর ভারী অপছন্দের।

কী কী কুকুর আছে?

 ঋজুদা শুধোল। কুকুর সম্বন্ধে আপনি কি কিছু জানেন? জানলে নাম বলুন না। কোন কুকুর নেই? আমি তো অত জানি না।

কথাটা খুব কনফিডেন্টলি বললেন তম্বি সিং। ভেবেছিলেন, এবার জব্দ করতে পারবেন ঋজুদাকে।

ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে হাতে ধরে বলল, সালুকি আছে?

 সালুকি?

তম্বি সিং অবাক হয়ে বললেন।

সালুকি আবার কী কুকুর, আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম। মানে, আমরা সকলেই।

তম্বি সিং বললেন, হ্যাঁ। সালুকিও আছে।

ঋজুদা উত্তেজিত হয়ে বলল, বলেন কী সিং সাহেব। যিনি সালুকি ব্রিড করান তিনি যে সে ডগ লাভার নন। কলকাতাতেই আমার জানাশোনার মধ্যে একজোড়া সালুকি ছিল একমাত্র সনৎদার–সনৎ দত্ত, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের– আর কারও কাছেই সালুকি দেখিনি। সে তো কোটিপতিদের কুকুর। যাই হোক, কাঙ্গপোকপিতে যেতেই হবে, আপনার মেয়ের ফার্মে। শুধু এদের সালুকি দেখাতেই।

সে তো আমার সৌভাগ্য। সানাহানবিরও সৌভাগ্য। তা হলে আজকে আমি উঠি। রবিবার সকালে দেখা হবে এয়ারপোর্টে। তখন দিনের পর দিন আপনাদের প্রশ্নেরই জবাব দেব, সকলে মিলে।

ওকে। বলল, ঋজুদা।

আমরা সকলে মিস্টার তম্বি সিংকে পৌঁছে দিলাম, সিঁড়ির মুখ অবধি। তারপর আমি আর ভটকাই ওঁকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিলাম। ভটকাই-এর অতি উৎসাহ দেখে মনে হল, সানাহানবির কথা শুনেই ও নানা কল্পনার জাল বুনতে শুরু করেছে। যাকে বলে, ইমাজিনিং থিংগস।

বললাম, কী রে?

 ভটকাই বলল, মাকাল ফল যাবে এবার, ইম ফল।

বসার ঘরে ঢুকে ভটকাই বলল, কেস খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে।

এখন থেকেই ভাব ভাল করে। প্রতিদিন রাতে ইম্ফলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, কার কী মনে হচ্ছে তা নিয়ে। অনেক মাথা একসঙ্গে হলে সুবিধে হবে।

আমি বললাম, নাও হতে পারে। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।

তারপর বললাম, ইন্দোনেশিয়ার কনসাল মিস্টার ডি. কে. নাগকে আমি চিনি। ইলে যেন কীসের ব্যবসা ছিল। সেগুন কাঠ না, কীসের যেন। সম্ভবত, ওই মোরেতেই। দ্বিজেন মেসোমশাই খুব ভাল বার্মিজ বলতে পারেন। ইন্দোনেশিয়ান তো পারেনই। আসলে ওঁরা রেঙ্গুনেই মানুষ–চলে এসেছিলেন নাকি পঞ্চাশের দশকে।

তাই? ফোন নাম্বার মনে আছে?

মনে নেই। তবে, মায়ের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছি এখুনি।

 জান তবে।

পুশ-বাটন ফোনের ডায়াল টিপে আমি মায়ের কাছ থেকে দ্বিজেন মেসোর নাম্বার নিয়ে সেই নাম্বার ডায়াল করলাম। একজন মহিলা ধরলেন। বললেন, উনি বাড়ি নেই। ঋজুদার বাড়ির ফোন নাম্বারটা দিয়ে আমি রিং-ব্যাক করতে বললাম।

তোর মেসো কীরকম লোক?

আপন মেসো নয়। মায়ের বন্ধুর স্বামী। তবে বিজলি মাসি মারা গেছেন বেশ কয়েকবছর আগে।

প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে ঋজুদা বলল, আগামীকাল সকালে উঠেই তিতির আর রুদ্র কোনচৌকির খামারে যাবি, ভটকাইকে নিয়ে। পিস্তলে ওর হাতটা ঠিক করাবি। প্রয়োজন হোক আর না হোক। তোমার লাইসেন্সেই গুলি তুলবে ইস্ট-ইন্ডিয়া আর্মস থেকে, তিতির। আমার আর রুদ্রর ওভারড্রন অ্যাকাউন্ট। অন্তত একশো-দেড়শো গুলি ছোঁড়াবে। আর যা যা প্যাক করার তা নিয়ে নেবে। তোমরা তো সবাই ভেটারান। তবে মানুষখেকো বাঘ শিকারের আয়োজন একরকম, আর খুনের গোয়েন্দাগিরি আরেকরকম।

বলেই বলল, রুদ্র, আমাদের বাক্সটা নিতে ভুলবি না।

সেই অ্যালবিনোর সময়ের বাক্সটা তো?

হ্যাঁ। তবে, মাইনাস ট্রানজিস্টার।

 ইতিমধ্যেই ফোনটা বাজল।

ঋজুদা খপ করে রিসিভার তুলে বলল, এক সেকেন্ড ধরুন। বলেই বলল, রুদ্র, তোর ফোন।

হ্যাঁ। দ্বিজেন মেসোমশাই? আপনার সঙ্গে ঋজুদা একটু কথা বলবেন।

কে?

ঋজুদা। ঋজু বোস।

 কী ব্যাপার রে? তিনি তো বিখ্যাত লোক।

নমস্কার।

ঋজুদা ফোনটা ধরে বলল।

মানে, একটা প্রশ্ন করার জন্য একটু বিরক্ত করছি। আপনি কি ইম্ফলের মিস্টার তম্বি সিংকে চেনেন? হ্যাঁ…হ্যাঁ…তাই তো বললেন। …না, আমার সঙ্গে একটু আগেই আলাপ হল। আপনার কাছে যাচ্ছেন বললেন, আর রুদ্র বলল, আপনি ওর মেসোমশাই।

তারপর হাসল, ঋজুদা। কী কারণে, কে জানে!

আমি পরশু, তরশু একবার রুদ্রকে পাঠাব আপনার কাছে। যা বলার ওই গিয়ে বলবে। একটা অনুরোধ। আমি যে আপনাকে ফোন করেছিলাম বা রুদ্র বা আমি যে আপনাকে চিনি, সেকথাও ওঁকে বলবার দরকার নেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার বন্ধু যখন নন…। ফাইন।… খুব ভাল লাগল, আপনার সঙ্গে কথা বলে। নমস্কার।

ঋজুদা ফোনটা নামিয়ে রাখল।

তারপর বলল, তাহলে আজকের মতো এই থাক। আবার দেখা হবে শুক্রবার রাতে। ছ’টার সময়। সেদিন এখানেই খেয়ে যেও। বাঙালি পাঁঠার কালিয়া আর গদাধরদার হলুদ-রঙা কিসমিস বাদাম দেওয়া মিষ্টি পোলাও।

ভটকাই বলল, খুনের তদন্ত করতে যাব শুক্রবারের একরাত পরেই, নেপালচন্দ্রর রাবড়ি হবে না? মাথা খুলবে কী করে? ওরা দুজন তো পড়াশোনাতে ভাল–আমারই শুধু মাথা-মোটা। অন্তত আমার জন্য গদাধরদাকে বন্দোবস্ত করে রাখতে বোলো।

কোথাকার রাবড়ি বললি? শর্মার?

ছিঃ ছিঃ। ও রাবড়ি হিন্দুস্থানিদের খাদ্য। নেপালচন্দ্রর। মেফেয়ার রোডের নেপালচন্দ্রর। ছোট্ট দোকান হলে কী হয়। নেপালে গোপাল করে।

শুক্রবার ছ’টার মধ্যেই জমায়েত হয়েছিলাম আমরা, বিশপ লেফ্রয় রোডে। কিন্তু, তখন ঋজুদাই ছিল না। গদাধরদাকে পটিয়ে-পাটিয়ে চায়ের বন্দোবস্ত করেছিল ভটকাই, এমন সময় ঋজুদা ঢুকল। পাক্কা বারো মিনিট লেট। এমনটি হয় না কখনওই।

বলল, সরি। তোরা ক্ষমা করে দিস।

চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল ঋজুদাকে।

ভটকাই বলল, দিলাম। কিন্তু তোমার হম্বিতম্বি সিং, জালি লোক হচ্ছে।

হম্বি কোথায় পেলি? তম্বি বল।

হ্যাঁ। জালি-তম্বি।

শোন। এখন আমার অনেক কাজ আছে। এখন মিটিং ডিসমিসড। রবিবারে তিতির আর রুদ্র চাইলে এখানে আসতে পারিস। কিন্তু, সময়মতো। এলে আমার সঙ্গেই যেতে পারিস। ভটকাই, তুই কী করে যাবি? এয়ারপোর্টে?

শ্যামবাজারের মাথা মুড়িয়ে যশোর রোড ধরে নেব। আমার যাওয়ার জন্য তুমি চিন্তা করো না। আমি তো অন্য গ্রহের বাসিন্দা।

তা তো ধরবি। কিন্তু যাবি কীসে?

 কেন? বাসে। আমার সঙ্গে মাল বলতে আর কী?

আমি বললাম, তুমি নিজেই তো যথেষ্ট।

 তা ঠিক। তুইও মাল। তবে ‘মা’ আর ‘ল’ এর মধ্যে কিছু একটা মিসিং। এই যা।

কী? মিসিং মানে?

কেন? ‘কা। কা’ মিসিং ইন-বিটুইন’। তোদের ইংরেজি কায়দাতে বললে।

এখন ইয়ার্কি করার সময় নেই ভটকাই। শোন, একটা ট্যাক্সি নিয়ে আসবি এয়ারপোর্টে। প্লেন ছাড়ার সময়ের অন্তত পঞ্চাশ মিনিট আগে দমদমে পৌঁছবি।

পিস্তল ইত্যাদি কী করে নেবে, ঋজুদা?

সে সর তোদের চিন্তা করতে হবে না। এয়ারপোর্টের ম্যানেজারকে বলা আছে। আমার সাইলেন্সারওয়ালাটা আর রুদ্ররটা নিলেই চলবে। পাইলটের কাছে জমা দিতে হবে। তোদের আর নিতে লাগবে না। রহস্যের জট ছড়াতে বুদ্ধি যতটা লাগে, গুলিগোলা ততটা লাগে না। বলেই বলল, আচ্ছা রুদ্র, তোর কনসাল মেসো মিঃ নাগ কী বললেন, তা তো বললি না।

আমি খুব লজ্জিত হয়ে বললাম, ইস ঋজুদা। তোমাকে বলতেই ভুলে গেছি। বিচ্ছিরি ব্যাপার। দ্বিজেন মেসোমশাই মারা গেছেন।

মারা গেছেন!

বলিস কী রে!

 ঋজুদা বলল, দুঃখিত গলাতে।

মার্ডার?

লাফিয়ে উঠল রংরুট গোয়েন্দা, ভটকাই। গুলি করেছিল? নাকি ইবোহাল সিং-এরই মতো গলায় ফাঁস?

হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেছেন। ভটকাই-এর গোয়েন্দাগিরির উদ্দীপনাতে জল ঢেলে দিয়ে আমি বললাম।

তম্বি সিং-এর সঙ্গে দেখা হয়নি ওঁর? সেদিন রাতে?

ঋজুদা শুধোল।

তা তো বলতে পারলেন না ওঁর ভাইঝি। দ্বিজেন মেসোমশাইয়ের তো ছেলেমেয়ে ছিল না। শুনলাম ওঁর ভাইঝিই সব দেখাশোনা করেন। উনি ঠিক বলতে পারলেন না।

আই সি। খবরটা জানতে পারিস না। কোনওক্রমেই?

আমি ঋজুদার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, পারি না তা নয়, পারি। তবে বোঝ তো। কাজের বাড়ি।

একটা কাজ করতে পারবি যাবার আগে?

 ঋজুদা বলল।

কী কাজ? বলো?

 মি. নাগের কীসের ব্যবসা ছিল মণিপুরে আর ওঁর ব্যবসার অ্যাসোসিয়েটস কেউ আছেন কি না ওখানে? এবং থাকলে, তার নাম, ঠিকানা ফোন নাম্বার যদি জোগাড় করে আনতে পারিস তো খুব কাজে লাগবে। পারবি? প্লেনে দিলেও হবে। আমাদের ব্যাড লাক বলতে হবে। কবে ঘটল এই অঘটন?

তম্বি সিং যেদিন এসেছিলেন তোমার কাছে, তার পরের পরের দিন। ভুল আমারই। পরদিনই যাওয়া উচিত ছিল ওঁর কাছে, আমার।

.

প্লেনটা যখন উচ্চতা কমিয়ে দিয়েছে, যদিও ল্যান্ডিং-এর এখনও দেরি আছে একটু, হঠাৎ দুটি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সেটা যখন হঠাৎ মণিপুর উপত্যকার উপর থেকে নীচে উঁকি মারে, তখন একেবারে চমকে উঠতে হয়। মনে হয়, এই বুঝি, ছোটবেলা থেকে কল্পনা করা সাংগ্রিলা! কী সুন্দর পাহাড়-ঘেরা একটি উপত্যকা।

ঋজুদা জানলা দিয়ে নীচে চেয়ে বলল, শরতের শেষে হেমন্তে এলে দেখতে হয় মণিপুরের সৌন্দর্য। মাইলের পর মাইল নিয়ে সোনালি ধানের শিষ দুলছে হৈমন্তী হাওয়ায়। কী যেন সেই গানটা রে, তিতির? সেই লক্ষ্মী বন্দনার গানটা?

কিছু মনে থাকে না আমার, আজকাল।

ও? তিতির বলল। সেটা তো রুদ্র তোমাকে শুনিয়েছিল।

রাইট। গা’ত রুদ্র, গানটা।

এ কী! প্লেনের মধ্যে!

 বিব্রত হয়ে আমি বললাম।

না গাইবি তো, কথাগুলো মনে করিয়ে দে অন্তত।

হ্যাঁ। তা পারি।

এসো সোনার বরণ রানী গো, এসো শঙ্খমল করে,
 এসো মা লক্ষ্মী, বোস মা লক্ষ্মী, থাকো মা লক্ষ্মী ঘরে।

 তারপর আরও অনেক আছে।

হ্যাঁ জানি। অন্যমনস্ক গলাতে ঋজুদা বলল।

আমি বুঝলাম যে, ভাবনাতে পেয়েছে।

প্লেনটা নামছে, নামছে, নামছে, নামছে, ওই নেমে গেল। ছোট এয়ারপোর্ট। তারপর যখন ট্যাক্সিং করে গিয়ে পার্কিংস্নটে দাঁড়াল, তখন তিতিরই প্রথম দেখতে পেয়ে বলল, ওই যে মিস্টার তম্বি সিং।

পাশে কে দাঁড়িয়ে রে? প্যারাগন অফ বিউটিযে! হুবহু লেডি ডায়না।

 তিতিরই বলল।

আরে সাব্বাস! জীবন সার্থক। আহা! কি হেরিনু জীবননাথ! এযে মাধুরী দীক্ষিত, পূজা ভাট আর পল্লব যোশীকে এক শিলনোড়াতে মিহি করে বেটে চৈত্রমাসের রোদে বড়ি বানিয়ে শুকোতে দিলে যা হতো, তাই। হে প্রভু, গোবিন্দজী, তোমার এ কী লীলা!

ঋজুদা বলল, কী যাত্রা শুরু করলি ভটকাই, নামতে না নামতেই?

বেঁটে জালি-তম্বির এমন কিউট মেয়ে। ভাবা যায় না। চিন্তা করো একবার। সলিলকি করে চলল ভটকাই।

আঃ। কী হচ্ছে ভটকাই। থার্ড ক্লাস হিন্দি ছবি দেখা বন্ধ কর এবারে একটু। তোর রুচি আর ভোকাবুলিরি দিনে দিনে যা হচ্ছে।

আমি বললাম।

নাও। এবার বক্তৃতা থামিয়ে নামো প্লেন থেকে। নইলে তম্বি সিং আমাদের না দেখে সত্যি সত্যিই হম্বি করবেন। অতগুলো টাকা দিয়ে টিকিট কেনা!

 তিতির বলল।

প্লেন থেকে বেরোতেই মেয়েটির দিকে চোখ পড়তেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সৌন্দর্যের নিজেরও আলাদা একটা দাম আছে। এমনকী কোনও গুণরহিত সৌন্দর্যেরও। পহিলে দর্শনধারী, পিছলে গুণবিচারী, কথাতেই বলে। সত্যি! এই মেয়েটি কে, এখনও তা জানা নেই, কিন্তু সত্যিই অবিশ্বাস্যরকম সুন্দরী। আর এমন এলিগেন্ট।–এলিগেটের বাংলা প্রতিশব্দ জানি না। ভটকাই জানলেও জানতে পারে। পরনে সবুজ আর নীলে মেশানো একটা স্কার্ট। ভারী সুন্দর দুটি পা।

সমারসেট মম-এর কেকস অ্যান্ড এল উপন্যাসে পড়েছিলাম, য়ু অলওয়েজ ওয়্যার আ পেয়ার অফ বিউটিফুল লেগস। মনে পড়ে গেল।

বাক্যিটা মনে গেঁথে ছিল। আজ এই সকালবেলাতেই মন ভাল করা আলোর মধ্যে, সেই অবচেতনে গেঁথে-থাকা বাক্যিটা, হঠাৎই ফুলের মতো ফুটে উঠল।

একটি ফিকে-হলুদ ব্লাউজের টপ। মাথায় একটি হলুদ-সবুজ-ফুল-ফুল প্রিন্টেড কটনের টুপি। হাওয়ায় কাঁপছে। চোখে সানগ্লাস ক্যাঁটক্যাটে কালো না–ওই যে নতুন বেরিয়েছে যেগুলো কী যেন নাম? আলোর তীব্রতার সঙ্গে সঙ্গে রং বদলায়–সেই কাঁচের। কাঁচ তো নয়, প্লাস্টিকের। তিতির বলতে পারবে। আজকাল আমিও সব ভুলে যাচ্ছি।

ঋজুদা আগে নামল। তার পেছনেই মিস্টার ভটকাই। যেন ওই সেকেন্ড ইন কম্যান্ড–সেলফ-অ্যাপয়েন্টেড। তার পেছনে শাড়ি পরা, ডেইনটি, তিতির সেন। এবং সবচেয়ে পেছনে, বদখত্ রুদ্র রায়। ঋজুদার ওরিজিনাল সাকরেদ, অথচ ভটকাই-এর ভাষাতে: একসময়ের ঝাঁ-চকচক, দিল-ধড়কান, নতুন মডেলের অবসলিট হয়ে যাওয়া নিষ্প্রভ, রংচটা আজকের ছ্যাকরা গাড়ি। ছিঃ।

পরিচয়পর্ব শেষ হবার পরে আমরা টারমিনাস-এর বাইরে এলাম। ইয়েস। ভটকাইয়ের কথাই ঠিক। ইনিই জালি-তম্বির কন্যা, সানাহানবি দেবী।

ছোট্ট বাড়িটা। মানে টারমিনাস বিল্ডিং। ইন্দোর, বাগডোগরা বা শিলচরের চেয়েও ছোট। তম্বি সিং সাহেব একটি টাটা-সিয়েরা গাড়ি নিয়ে এসেছেন আর তার মেয়ে নিজে চালিয়ে এসেছেন একটি নীল-রঙা পুরনো মডেলের অ্যামবাসাডর।

তম্বি সিং বললেন, সার্কিট হাউসেই আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন উনি। কিন্তু, কন্যা বলেছেন মান্যগণ্য অতিথিদের ওখানে ওঠানো যাবে না। মাতৃতান্ত্রিক মণিপুরে যে মেয়েদের কথাই শেষ কথা।

সানাহানবি বললেন, কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-টন্ত্রী এলে যেমন সার্কিট হাউস রাতারাতি ভোল পাল্টে দিয়ে ঢেলে সাজান হয়, চক্ষুলজ্জাহীন ভাবে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে; তেমন হলেও কথা ছিল। তার চেয়ে, মৈরাঙ্গের পথে ওঁদের, আংকল ইবোহাল সিংএরই একটি নিভৃত বাগানবাড়ি আছে। অনেকবছর আগে ওঁদের পূর্বপুরুষেরা শুটিং লজ হিসাবে ব্যবহার করতেন, যখন এইসব জায়গাতে জঙ্গল ছিল। সেখানেই আপনাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। একটি বাবুর্চি আছে। বদরপুরী মুসলমান। তার হাতের রান্না যা…

উনি বললেন যা, তাতে মনে হল, তার হাতের রান্না একবার খেলেই হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। গুলি বা ডাণ্ডা কিছুই খেতে হবে না।

ওই বাংলার ঘরগুলিও সুন্দরভাবে ফার্নিশড। ওয়েলস্টকড বার…কোনওরকম কষ্টই হবে না আপনাদের।

ঋজুদা বলল, আমি কালেভদ্রে খাই ওসব। অকেশান, টকেশানে! আর এরা তো সব ছেলেমানুষ। ওসব না থাকলেও কোনওই ক্ষতি ছিল না।

ভটকাই নিচু গলাতে বলল, যাতে ঋজুদা শুনতে না পায়, পোলাপান! পোলাপান! তিনখান!

সানাহানবি বললেন, চলুনই তো। গিয়ে দেখবেন। তারপর পছন্দ না হলে কাঙ্গপোকপিতে আমার ফার্মেই না হয় থাকবেন। গরিবখানাতে। ছটি বেডরুম আছে। কষ্ট হবে না।

আমরা তো এখানে আরাম করতে আসিনি।

আমি বললাম।

আহা। তা তো জানিই। তবে, দেয়ারস নাথিং রং ইন মিক্সিং ওয়ার্ক উইথ প্লেজার। আরাম করেই যদি কাজের কাজটা করা যায়, তা হলে ক্ষতিটা কী?

ভটকাই ওয়ালট-ডিজনির মিকি-মাউসের মতো উত্তেজিত হয়ে, লাফালাফি শুরু করেছে।

ঋজুদা সানাহানবির গাড়িতে গিয়ে উঠল। বাঁদিকের দরজা খুলে। এমন কিছু গরম নেই এখন। তবে আকাশে মেঘ করলে বাইরে গুমোট হবে। এখন চমৎকার হাওয়া আছে বাইরে। এখনও সেপ্টেম্বরে পৌঁছয়নি বছর, কিন্তু আকাশ আর রোদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, পুজো এসে গেছে। পথপাশের কৃষ্ণচূড়া আর অমলতাসের গাছে গাছে কানাকানি করছে সে হাওয়া।

মিস্টার তম্বি সিং-এর টাটা-সিয়েরাতে আমরা তিনজন। শোফার-ড্রিন এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়ি। তিতির সামনে বসে প্রায় হারিয়েই গেছে অতবড় সিটটাতে। আর মনমরা ভটকাই, চোর-চোর মুখ করে বসে আছে আমার আর তম্বি সিং-এর মধ্যে। আহা, ছোঁড়ার খুব ইচ্ছে ছিল লেডি ডাইয়ের গাড়িতে যায়।

রাজকুমারীর গা দিয়ে কী দারুণ একটা গন্ধ বেরুচ্ছিল র‍্যা? তিতির? কী সেন্ট মেখে ছিল র‍্যা?

ফিসফিসে গলায় বলল ভটকাই, বাগবাজারি বাংলাতে।

 তিতির হাসল। প্রায় নিঃশব্দে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, আদিখ্যেতা কোরো, ভটকাই। আমরা একটা সিরিয়াস কাজে এসেছি। ওই পারফুমের নাম হল, রেড ডোর।

আমি বললাম, ইংরিজিতি কথা বলো, তিতির। অভদ্রতা হচ্ছে। উনি ভাবছেন আমরা হয়তো কোনও চক্রান্ত করছি।

ভটকাই বলল, আমরা তিনজন যেখানে, সেখানেই তো একটি চক্কর। চক্কান্ত হতে কতক্ষণ?

আচ্ছা, আর কতদূর?

 তিতির শুধোল, যেন, হাঁপিয়ে গিয়ে, ইংরেজিতে।

অতবড় টাটা সিয়েরা, তাও বেশ জোরে চলছিল, আর রাজকুমারী সানাহানবি এত জোরে গাড়ি চালিয়ে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলেন, যে ওঁর গাড়িকে এখন আর দেখাই যাচ্ছে না।

তম্বি সিং বললেন, আরও মিনিট পনেরো।

 বাবা। তবে তো বেশ দূর আছে। অনেক পথ। ভটকাই বলল।

মোরে’টা কোনদিকে? যেখানে মিস্টার ইবোহাল সিং খুন হয়েছেন?

তিতির শুধোল।

ওঃ। সে তো এই পথেরই অন্য দিকে। আমরা যেদিকে যাচ্ছি, তার উল্টোপথ। এবং বেশ দূরেও। ইম্ফল থেকে একশো দশ কিলোমিটার। তাও পথে গভীর জঙ্গল আর থেংনোপালের ঘাট পেরোতে হবে, ছ’ হাজার ফিট উঁচু, ইম্ফল থেকে ঊনসত্তর কিমি–ওই পথেই টেররিস্টদের দারুণ ঝামেলা। থেংনোপাল খুব উঁচু। মেঘেদের চেয়েও উঁচু। যখন যাবেন দেখবেন মেঘেরা আপনাদের পায়ে চুমু খাচ্ছে।

টেররিস্টরা কারা এখানে? কীসের কারণে টেররিজম? কী চান ওঁরা?

সে অনেক কথা। বলব এখন পরে। আগে পৌঁছন তো জায়গামতো। রিল্যাক্স করুন।

যখন পৌঁছল ওরা, দেখল ছোট্ট হলেও অত্যন্ত সাজানো গোছানো চমৎকার একটি বাংলো। কটি বেডরুম আছে তা বোঝা গেল না, তবে পাঁচ ছ’টি তো হবেই। কম করে।

ঋজুদা আগেই পৌঁছে বারান্দার সাদা রং করা বেতের চেয়ারে বসে ততক্ষণে পায়ের ওপর পা তুলে পাইপ খাচ্ছে। আর সানাহানবি দেবী সামনে বসে ঋজুদাকে চা ঢেলে দিচ্ছে টি-পট থেকে। জাপানিজ টি-সেট, সবুজের ওপর কমলা-রঙা ড্রাগন আঁকা। টি পটের ওপরে কাশ্মীরী কিন্তু খুব দামি টি-কোজি।

না। দেখেই মনে হল, রাজা ইবোহাল সিং-এর শুধু পয়সাই ছিল না, রুচিও ছিল। একটা ক্লাস-এর ব্যাপার ছিল ভদ্রলোকের মধ্যে, শুধুমাত্র বড়লোক হলেই যা থাকে না। ব্যাচেলার হলে কী হয়, বাড়ির বারান্দাতে পা দিয়েই টবে টবে নানা ফুল, পাতা, ঝাড়, ক্রোটন, অর্কিড, সাকুলেন্টস, ক্যাকটাই, বাগানের গাছপালা, দারুণ ট্রিম করা লন, তারপর ফার্নিচারের রং, অ্যারেঞ্জমেন্ট, ঘরে না ঢুকেই ঘরের ফার্নিশিং-এর রুচি, বিভিন্ন প্যাস্টেল রঙা কুশন কভারের রং দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হয়, কোনও আর্টিস্টের বাড়ি–এবং অত্যন্ত বিত্তবান আর্টিস্ট-এর।

তিতির ফিসফিস করে এই কথাই বলছিল, আমাকে।

আমাদের চা খাওয়ার আগে ভিতরে ঢুকে ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম, আমাদের তিনটি বেডরুম, সব দেখিয়ে দিলেন সানাহানবি দেবী। বদরপুরী মুসলমান, সাদা দাড়িওয়ালা, একেবারে সাদা উর্দি পরা রজ্জাক মিঞা, (তিতিরের ভাষায়, ইন ইস্ম্যাকুলেট লিভারেজ-এ), বাবুর্চির সঙ্গে এবং দুজন মণিপুরি অভিজ্ঞ, বয়স্ক বেয়ারা, একজন নাগা দারোয়ান এবং দুজন কুকি মালীর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিলেন সানাহানবি দেবী। সবাইকে বললেন, দেখো, যেন মেহমানদের কোনওরকম অসুবিধেই না হয়। বলেই বললেন, আমি কিন্তু এবার যাব মিস্টার বোস। আপনি তো জানেনই কাঙ্গপোকপি কতদূর এখান থেকে। বাবার কাছে এবং এদের কাছেও আমার ফোন নাম্বার আছে। আপনাদের সঙ্গে টাটা-সিয়েরাটা থাকবে। শোফার ড্রিভন। যখন যেখানে খুশি যাবেন আপনারা। আর আজ যদি এক্ষুনি মোরে যেতে চান, প্লেস অ্যান্ড সাইট অফ মার্ডার দেখতে, তা হলে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়ুন। ওই পথে কিন্তু আজকাল ভীষণ বিপদ। নানারকম বিপদ। রাত হয়ে গেলে প্রাণ বাঁচিয়ে ফেরাই মুশকিল হবে। এখন মণিপুরে যে-রকম টারময়েল চলছে, এই সময়ে বাবা আপনাদের যে কেন এখানে আসতে বললেন তা আমার মাথাতেই আসছে না।

ঋজুদা বলল, আজকে গেলে আমি একাই যাব। ওরা এখানে থাকুক সাইটসিয়িং করে বেড়াক–ঘুরে টুরে দেখুক। এর মধ্যে ওদের একদিন মৈরাঙ্গ, থৈবী-খাম্বার জায়গা, তারপর লেক লকটাক ইত্যাদি সব দেখিয়ে আনব। আর কাঙ্গপোকপিতে যেতেই হবে একবার, অন্য কুকুর না হোক, আপনার সালুকিদের দেখতে অবশ্যই যেতে হবে।

কিন্তু আমার মন ভারী খারাপ হয়ে আছে। আমার বড় প্রিয় কুকুর টাইগার মরে গেল।

কবে?

 তা দিনকুড়ি হল। আঙ্কল ইবোহাল-এর মৃত্যুর কদিন পরই।

 কী কুকুর?

গ্রেট-ডেন।

ইসস

বলল, ঋজুদা।

তারপর বলল, কুকুর ভালেবাসলেও এই কারণেই কুকুর পুষি না। ঈশ্বরের উচিত ছিল কুকুরদের মানুষের চেয়ে বেশি আয়ু দেওয়া।

বাঃ। খুব ভাল বলেছেন। সত্যিই তাই।

 যাই হোক। আসুন আপনারা কাঙ্গপোকপিতে। আই উইল বি ডিলাইটেড। বলেই, আমাদের সবাইকে নরম করে বাই’ বলে, ডানহাতের তিনখানা আঙুল নাড়লেন। আর মিস্টার তম্বি সিংকে বললেন, বাই ড্যাড। লুক আফটার ইওর গেস্টস ওয়েল। অ্যান্ড ইউ শুড টক টু মি এভরি নাইট।

তম্বি সিং মাথা নাড়লেন।

আমি ভাবলাম, বাবা অক্সফোর্ড আর মেয়ে কি হারভার্ড এর? এই ইংরেজ সাহেব ও আমেরিকান মিসিবাবার পাশে তো দিশি লোকজনের প্রাণান্তকর অবস্থা!

একটু পরে মিস্টার তম্বি সিংও চলে গেলেন, বিদায় নিয়ে, তাঁর বাড়িতে। বললেন, বিকেলে ফোন করবেন চারটে নাগাদ। তবে মোরে আজ না যাওয়াই ভাল। গিয়েই গাড়িটা পাঠিয়ে দেবেন বলেই, চলে গেলেন।

ওরা চলে গেলে, আমরা সবাই বারান্দায় বসলাম। ভটকাই-এর ভাষায়, ‘জমিয়ে’ চা খেতে।

ঋজুদা বলল, ভটকাই, আমাকে আর এক কাপ চা। এও তো দার্জিলিং-এর। কিন্তু কোন বাগানের বলতো? বড় দুঃখ হচ্ছে রে, বুঝলি, এই দুর্দিনে এমন কাপ্তান রাজার সঙ্গে তার জীবদ্দশাতে আলাপ হল না!

ভটকাই বলল, আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, টাটা-সিয়েরা গাড়িটার ড্রাইভার বাঙালি। নাম যোগেন। ঢাকার বাঙাল। ওর বাবা পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল হয়ে আগরতলাতে এসে আশ্রয় নেয়। পড়াশোনা বেশিদূর করেনি। তবে স্কুল-ফাইনালটা চার-গড়ানে পেরিয়েছিল। তারপর ফিলিম ডিরেকটর হবার খুব শখ হয়। ধবধবে পায়জামা আর ডোরাকাটা আলখাল্লার মতো পাঞ্জাবি পরে। সুযোগ পেলেই একটা সিগারেট ধরায়। লোকমুখে খবর পায় যে, ইম্ফলে বোম্বের কোনও ফিল্ম কোম্পানি এসেছে শুটিং করতে। রেখা আর রাখী দুজনেই এসেছে আর অমিতাভ বচ্চনও। বাবার ছিটকাপড়ের দোকানের ক্যাশ ভেঙে যা পায় তাই হাতিয়ে নিয়েই ইম্ফলে চলে আসে। ইম্ফলে ট্রেন নেই–অনেকই ঘুর পথে বাসে, ট্রেনে এসে যখন আধমরা হয়ে ইম্ফলে পৌঁছয়, তখন ফিলিম পার্টি শুটিং শেষ করে চলে গেছে। তারপর আর ফেরা হয় না। ফিলিম-ডিরেকটর না হতে পেরে গাড়ির ড্রাইভার হয়।

ঋজুদা বলল, লাঞ্চের জন্য তাড়া দেবার দরকার নেই। আজকের দিনটা আমরা। রিল্যাক্স করব। বাড়িটা তোরা ঘুরে টুরে দ্যাখ। আমি ততক্ষণে দারোয়ান, মালী, বেয়ারা, এদের সঙ্গে আলাপ করে দেখি। ইবোহাল সিং-এর মৃত্যুতে এরা যে কেউই বিশেষ খুশি হয়নি তা এদের চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নতুন মনিবকে যে খুব একটা পছন্দ, তাও মনে হচ্ছে না। কিন্তু কী করবে? বড় বড় আমলারাই, আই. এ. এস সেক্রেটারিরাই মন্ত্রী বদলালে, সরকার বদলালে, নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলতে বাধ্য হয়, আর এরা তো কোন ছার। সেই ম্যাক্সিম আছে না একটা দ্য কিং ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিং–পৃথিবীর সব চাকরেরই এটাই কোড অফ কনডাক্ট। বড়, ছোট সকলেরই। পঁচিশ হাজারি থেকে পাঁচশো পানেওয়ালার। তা তারা স্বীকার করুক আর নাই করুক। তবে এদের মধ্যেও যদিবা সততা কৃতজ্ঞতা আশা করলেও করতে পারিস, যতই ওপরে উঠবি, ততই তা কমে যাবে, মেরুদণ্ডর হাড় ততই পাবদা মাছের কাঁটার মতো পাতলা ফিনফিনে হচ্ছে; দেখতে পাবি। তা ছাড়াও মিস্টার ইবোহাল সিং সাধারণ ভাবে মারা যাননি। ভটকাই-এর ভাষাতে, এই হম্বিতম্বিরা রাতারাতি মালিক বনে গেছেন। এদের প্রত্যেকের মুখেই বিরক্তি এবং ঘেন্না চাপা দিয়ে রাখা একরকমের প্রসন্নতা দেখলি না? হম্বিতম্বিদের খুবই মান্য করছে এমন দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু এ হচ্ছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা। এদের মধ্যে প্রত্যেকেই এই খুনের কিনারা হোক এটাই চায় এবং ঠিক মতো হ্যাঁন্ডেল করতে পারলে এদের প্রত্যেকেই আমাদের এজেন্টের কাজ করবে। তবে আমার দৃঢ় ধারণা এদের মধ্যে দু-একজন ডাবল এজেন্টও থাকবে। হম্বিতম্বিরা আগে থেকে সে সম্বন্ধে সাবধান হয়ে ওই বন্দোবস্ত অবশ্য পাকা করে রেখেছে। এবং তা যদি হয়, তবে যোগেনের পক্ষেই তা হবার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা।

কেন?

তিতির বলল।

 প্রথমত, ও বাঙালি। ওর পক্ষে আমাদের প্রত্যেকটি কথাই বোঝা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, আমরা মীরজাফরের দেশের লোক। না-খেটে বসে বসে খাবার মতো সুখ কল্পনা, আমাদের মতো আর কারও নেই। নইলে কি আর পুরো কলকাতা শহরটা, পশ্চিমবঙ্গটাকেই বেচে দিই! অবাঙালিদের যত টাকাই থাকুক না কেন, তাদের রক্তে বসে বসে কুঁজোর থেকে জল গড়িয়ে খেয়ে বাঁচব এমন লজ্জাকর অ্যামবিশান কারওই নেই।

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, ফর এ চেঞ্জ, তুই এক্কেরে ঠিক কইছস।

তিতির বলল, ইংরেজি অক্ষরমালার আদ্যক্ষর ‘A’ অক্ষরটির উচ্চারণ এ নয়, আ। যদিও কোনও ইংরেজকে বলো বা যে কোনও শিক্ষিত পশ্চিমীকেও যে, আই অ্যাম এ গুড বয় তিনি হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন।

ভটকাইকে অপ্রতিভ করতে পারে, এমন শক্তি তিনলোকের কোনও লোকেই কেউ জন্মায়নি এখনও।

ভটকাই বলল, আমাদের বেঙ্গলি মিডিয়াম স্কুলে A-কে ‘আ’ বলে না, এই বলে। তোমাদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে কি কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই? খামতি নেই? আমরা বলি চানঘর, আমরা বলি পায়খানা আর ইংরেজিতে তোমাদের শেখায়, জেন্টস রুম’, ‘লেডিজ রুম’ ‘টয়লেট’, শাওয়ার’, ‘লু’, ‘ওয়াশরুম’, ‘থ্রোন’ ইত্যাদি। খেয়ে দেয়ে কাজ না থাকলে ওরকম বাহুল্য করা শোভা পায়। আমরা ভাই গরিব। আমাদের কথাবার্তাও সাদাসিধে। তা ছাড়া যে দেশে রাজা রানিরা এখনও আছেন, আর যুবরানি? যে দেশে লেডি ডায়নার মতো সুন্দরী যুবরানি, সে। দেশে ‘কমোড’কে কি ‘থ্রোন’ বলা উচিত? ব্যাড টেস্ট। আমাদের ওসব বালাই নেই। কমোড় বিদেশি জিনিস। কমোড ব্যবহার করলে আর্থরাইটিস হয়; গেঁটে বাত। আমাদের পায়খানা, ওড়িশা টাইপ। এই ভাল।

এইসব কি খুব গুড টেস্টের কথা হল, ভটকাই? তোর ভাঁড়ামো এবার বন্ধ কর। আমরা এখানে ভাঁড়ামো করতে আসিনি। সব ব্যাপারের একটা লিমিট আছে।

ভটকাই, সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে দুকান ধরে বসে পড়ল বারান্দাতেই। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মালী ও বেয়ারারা এমনকী দারোয়ানও দেখতে পেল।

এই জন্যেই বলে, লজ্জা, মান, ভয় তিন থাকতে নয়। বাকিটার মানে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন। ভটকাই-এর উন্নতি ঠেকিয়ে রাখে এমন কোনও শক্তিই নেই। বিশেষ করে, আমাদের দেশে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, চাকরি, রাজনীতি, ব্যবসা, যে পথই ও বেছে নিক না কেন, ওকে রুখনেওয়ালা কেউই নেই। চক্ষুলজ্জা, আত্মসম্মান, মেরুদণ্ডহীনতা উন্নতির পথের এই প্রতিবন্ধকতার সবকটিই ও জয় করেছে। মালিকের, সে যেই মালিক তোক না কেন, পা-চাটার কমপিটিশনে, গিনেস বুক অফ রেকর্ডস-এ নাম উঠতে পারে ওর।

ঋজুদা গম্ভীর হয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।

আমার খুব আনন্দ হল। ঋজুদাই আমাদের গার্জেন, লিডার। ঋজুদা অনেকক্ষণ পর, এই প্রথম ভটকাইকে স্নাবিং করল।

ভটকাই বকুনি খাওয়াতে আমি আর তিতির খুশি হয়েছিলাম।

 আমরা বারান্দাতেই বসে রইলাম।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই যোগেন ড্রাইভার টাটা-সিয়েরা নিয়ে চলে এল। বলল, চলেন স্যার। মোরে পৌঁছতে পৌঁছতেই রাত হইয়া যাইব গিয়া। সাতটার পরে যাইতেই দিব না পুলিশে। আর মিলিটারি। উদিকে যে বড়ই গণ্ডগোল।

দাঁড়াও, দাঁড়াও, খাওয়া দাওয়া করে আজকে রাজবাড়ি দেখব। কাল যাব এখন ভোর ভোর। তোমরা তাড়িয়ে দিতে চাও তো দেবে। আমাদের কাজ কী? কাজে তো এসেছেন বড় সাহেব।

তা তুমি ভাষাটা এখনও বদলাওনি দেখছি যোগেন বাবু।

 আর বাবু ক্যান? ক্যান বদলামু? দ্যাশ বদলাইছি নেহরু সাহেবের গদিতে বসনের লোভে, বাধ্য হইয়া, ডেরেস (ড্রেস) পাল্টাইছি ফিলিমস্টার বা ডিরেক্টর হস্যু বইল্যা। আর ভাষাটাও যদি বদলাইয়া ফ্যালাই তো যোগেন কুণ্ডুর রইলডা কী?

ঠিক আছে ভাই। তুমিও একটু বিশ্রাম করো। আমরা খেয়েই বেরোব।

হঠাৎ ভটকাই বলল, আমার খুব পান্তুয়া খেতে ইচ্ছে করছে। এখানে পাওয়া যাবে?

ক্যান যাব না? আমারই মতো কত রিফিউজি বাঙালি আইস্যা ইখানে সেটল করছে। ঘোষেগো দোকান আছে। তাগো বাড়ি আছিল বরিশালে–ঝালকাটি। ফার্স্ট ক্লাস মিষ্টি বানায়। আমাগো দ্যাশও তো ছিল বরিশালে।

তা এই নাও। বলেই, ভটকাই একটি একশো টাকার নোট বার করল হিপ পকেট থেকে, আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়ে। তারপর বলল, পান্তুয়া খেতে তুমি ভালবাস তো ভাই? যোগেন?

আমারও ফার্স্ট ফেভারিট। তা হলে আপনি পঞ্চাশ টাকার পান্তুয়াই নিয়ে আসুন। আর আমার পেটটা ব্যথা করছে–এই একটা ওষুধ। লিখে দিচ্ছি। বলেই, বুক পকেট থেকে একটা স্লিপ প্যাড বের করে, বুক পকেট থেকেই বলপয়েন্ট পেন বের করে, কী একটা ওষুধের নাম লিখল।

তিতির পাশ থেকে উঁকি মারল।

ভটকাই বলল, এই নিন ভাই, এখুনি নিয়ে আসুন! দোকান কি দূরে?

আবার আপনে–আজ্ঞা ক্যান, তুমি কইরাই বইলেন। কমফর্টেবল লাগে। দুকান দূর, মানে, এই মাইল পাঁচেক হইব। বাজারে।

তা চলুন, আমিও যাই। বাজারটা দেখে আসব। পেটুক মানুষ তো। বাগবাজারের রসগোল্লার নাম শুনেছেন? আমি সেই বাগবাজারের ছেলে তো। মিষ্টির যম।

বলেই, গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

ড্রাইভার যোগেন কুণ্ডু বললেন, আপনে চমচম খাইছেন, কখনও স্যার? বরিশালের ব্যারনের’ ম্যাঙ্গো সিরাপ দেওয়া শরবৎ?

না তো।

লাইফে কিছু মিস করছেন। আমার ওয়াইফ তো…

ওরা গাড়ির দিকে চলে গেল।

তিতির বলল, বরিশালের লোকেরা স্ত্রীকে সবসময় ওয়াইফ কেন বলে জানো রুদ্র?

আমি বললাম, বরিশাল জায়গাটাই তো দ্বীপের মতো। আগে সবকিছুই ইমপোর্ট করতে হত। এক ডাব নারকেল, ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ এবং অন্য নানা মাছ ও কুমির ছাড়া। প্রথম বউ হয়তো, ইংল্যান্ড থেকে ইমপোর্ট করেছিল। তপনমামাকে জিজ্ঞেস করব।

তপনমামাটা কে?

আরে সোনাকাকুর শালা তো, তপন রায়চৌধুরী, অক্সফোর্ডের।

সোনাকাকুটা কে?

হিস্টরিয়ান ডঃ সুরেন সেনের বড় ছেলে, শৈলেন সেন। ইনকাম ট্যাক্সের চিফ কমিশনার ছিলেন। বরিশালের মানুষদের ওরিজিনালিটি সম্বন্ধে তপনমামার নানা লেখা আছে। পড়লে, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে।

এমন সময় ঋজুদা ভেতর থেকে বেরিয়ে এল।

 বলল, ভটকাই কোথায়?

গাড়ি নিয়ে পান্তুয়া আর কী ওষুধ কিনতে গেল।

 পান্তুয়া? ওষুধ? বলেই ঋজুদা বলল, হুমম।

কাছে এসে চেয়ারে বসল একবার, তারপর বলল, চল বাগানে ওই চেরি। গাছটার নীচের বেঞ্চে গিয়ে বসি।

ভটকাই কোথায় যেতে পারে বলো তো?

তিতির শুধোল।

কোনও মতলবে গেছে। এমনি এমনি যায়নি। যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে, ও তোদের মধ্যে সবচেয়ে আগে অ্যাকটিভ হয়েছে।

অ্যাকটিভ? কী ব্যাপারে?

 যে ব্যাপারে এসেছি এখানে, সেই ব্যাপারে। ও ফিরলেই বোঝা যাবে।

বাগানে পৌঁছে চেরি গাছটার তলার বেঞ্চে বসে, ঋজুদা বলল, এবারে বল, তোরা কে কী ভেবেছিস।

আমি বললাম, আসলে তো মোরেতে যেতে হবে। তাছাড়া খুনের এতদিন পরে গিয়ে ক্ল বিশেষ কি আর পাওয়া যাবে? কিন্তু আমার মনে হয়, আচ্চাও সিং-এর সঙ্গে দেখা করাটা সবচেয়ে জরুরি।

ঠিক।

আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। মিস্টার তম্বি সিং খুনের কিনারা করতে তোমাকে নিয়ে এসে, তোমাকে কেন ফ্রি-হ্যান্ড দিচ্ছেন না?

তিতির বলল, মনে হচ্ছে আমারও যে দিচ্ছেন না। নইলে, তোমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা জিজ্ঞেস না করে, আমাদের শহর থেকে দূরে এখানে এনে তোলার মানে কী হল?

আমার মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করেই আমাদের এই শুটিং-লজে এনে ওঠানো হয়েছে, যাতে আমাদের ইচ্ছে মতো ঘোরাফেরা করতে না পারিবাজার, দোকান, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, পাঁচ মাইল দূরে।

ওই সব সম্বন্ধে খোঁজ করতেই গেছে ভটকাই। পান্তুয়াটা উপলক্ষ মাত্র। তবে, ওষুধের মধ্যে অন্য রহস্য আছে। কী হয়েছে ওর? কিছু কি সত্যিই হয়েছে?

না তো। আমরা তো জানি না। ড্রাইভার যোগেন কুণ্ডুকে দেখেই ওর পান্তুয়া খাবার শখ যেমন উথলে উঠল, তেমনি ওষুধ খাওয়ারও।

যাকগে, আসুক ও। তারপরই জানা যাবে। এখন বল, তোরা দুজনে আর কী ভাবলি।

তম্বি সিং লোকটা হয়তো সত্যিই মিথ্যেবাদী। ভটকাই-এর ভাষাতে, জালি।

কেন?

সুইজারল্যান্ডের বন্ধুর কথা বলছিল না? যাঁরাই সুইজারল্যান্ডে বা ইউরোপের কোথাওই গেছেন, তাঁরাই জানেন যে, SWITZERLAND-এর উচ্চারণটা সুইটজারল্যান্ড–যদিও ‘ট’-এর উচ্চারণ খুব সংক্ষিপ্ত। কেউই বলে না, সুইজারল্যান্ড। কিন্তু উনি বারবার বলছিলেন।

তিতির বলল।

তা ছাড়া ভটকাই যখন জিজ্ঞেস করল তম্বি সিংকে যে, আপনার বন্ধু সুইস-ফ্রেঞ্চ না সুইস-জার্মান তখন তম্বি সিং ভ্যাবলারামের মতো ভটকাই-এর প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে বলল, সুইস-ফ্রেন্ড।

আমি বললাম।

ঋজুদা মনোযোগ সহকারে পাইপ ধরাচ্ছিল। তামাক ভরা সেরে বলল, এসব ছাড়াও অনেক মিথ্যে আছে। প্রথমত, তম্বি অক্সফোর্ডে পড়েনইনি। কারণ, যাঁরাই অক্সফোর্ডে পড়েছেন বা না পড়লেও অক্সফোর্ডে বেড়াতে গেছেন, তাঁরাই জানেন যে, অক্সফোর্ড, যাদবপুর বা কলকাতা কিংবা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কোনও একটি ব্যাপার নয় যে, নিজস্ব বাড়ি, নিজস্ব ক্যাম্পাস, নিজস্ব হস্টেল নিয়েই তা ‘ স্বয়ংসম্পূর্ণ। অগণ্য কলেজ আছে, অক্সফোর্ডে। আলাদা আলাদা। সব মিলিয়েই, অক্সফোর্ড। মি. সিং অক্সফোর্ডে পড়েছেন অথচ কলেজের নাম না বলে শুধুই বারে বারে বলছেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি। তা ছাড়া ওঁর ইংরেজি উচ্চারণের সঙ্গে অক্সোনিয়ান অ্যাকসেন্টের বিন্দুবিসর্গও মিল নেই। যদিও এখন অক্সফোর্ডেও অ্যামেরিকান অ্যাকসেন্ট ঢুকে গেছে।

তিতির বলল, সানাহানবি কোথায় পড়েছে? স্টেটস-এর হার্ভার্ড-এ? তুমি তো ওর সঙ্গে এলে।

মুণ্ডু। অ্যামেরিকান কায়দা-কানুন তো স্টার টিভির বিজ্ঞাপন আর বোলড এন্ড দ্য বিউটিফুল সিরিয়াল দেখলেই যে কেউ শিখে নিতে পারে। আমার মনে হয়, ও পড়েছে শিলং-এর ভাল কোনও কনভেন্টে। তারপরে, শিলং-এরই কোনও কলেজে। ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করিনি, কারণ জলজ্যান্ত মিথ্যে শুনলে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। বয়স তো হচ্ছে অথচ গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে মাথায় রক্ত চড়ানো আর আত্মহত্যা করা, একই কথা।

ঋজুদা বলল।

তোমার কী মনে হয় ওদের সম্বন্ধে? ঋজুদা?

মনে তো অনেক কিছুই হয়। তবে আচ্চাও সিংকে দেখা দরকার, কথা বলা দরকার, এক্ষুনি মোরে যাওয়া দরকার। কাঙ্গপোকপিতে গিয়েও সানাহানবির কুকুর ব্রিডিং-এর ধরন-ধারণ এবং তার মধ্যে মিথ্যে আছে কি না তাও জানা দরকার, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। স্থানীয় মানুষদের সঙ্গেও কথা বলা খুব জরুরি। এই খুন নিয়ে পুরো অঞ্চলেই শোরগোল পড়ে গেছে। আচ্চাও সিং-এর ওপরেও তো তম্বির সন্দেহ। সেই তো আমাদের প্রথম কুয়ারি। তবে, একটা জিনিস আমাকে খুব ধাক্কা দিচ্ছে, তা এদের স্বচ্ছলতা, অ্যাফ্লুয়েন্স। মণিপুরের মতো ছোট্ট একটি রাজ্যের এবং তাও রাজত্ব চলে যাবার পরও ইবোহাল সিং-এর এত স্বচ্ছলতা আসে কোথা থেকে? এমন স্বচ্ছলতা!

ঠিক। আমারও তাই মনে হচ্ছিল।

 মিস্টার তম্বি হঠাৎ বড়লোক হয়েছে যে, তা তাঁর দিকে একনজরে তাকালেই বোঝা যায়। উনি আদতে হয়তো বড়লোক ননও। আপস্টার্ট। সব দিক দিয়েই।

কেন? আমি আর তিতির একসঙ্গে বললাম।

সেই রাতে যে পোশাকে আমার কাছে এসেছিলেন, সেই পোশাকে তিনটি খুঁত ছিল।

কী কী?

প্রথমত, তার জুতোটা কলকাতার চিনে দোকানের। এবং সদ্য কেনা। হয়তো সেদিনই সকালে। তার টুপিটা মাথা থেকে খোলার সময়ই আমি লক্ষ করেছিলাম লন্ডনের বিখ্যাত শপিং-সেন্টার অক্সফোর্ড স্ট্রিটের একটি টুপির দোকান থেকে কেনা এবং টুপিটাও ওর নিজের নয়। কমপক্ষে দু সাইজ বড়। এবং বহুব্যবহৃত। সম্ভবত মৃত ইবোহাল সিং-এর। তাঁর ট্রাউজার পর্যন্ত মৃত্যুর পরে বেহাত করেছেন কি না কে জানে। এ ছাড়াও, অনেক সাধারণ, গরিব পাহাড়ি মানুষদের মতো তম্বি সিং পাইপ খান। ডানহিল বা মিরশ্যাম বা পিটারসন বা অন্য কোনও ব্রান্ডের পাইপ নয়। স্থানীয় কাঠ থেকে বানানো, তামা বা পেতলের তাপ্পি মারা পাইপ, যা নানা জাতের দিশি তামাক এবং অনেক সময়ে তার মধ্যে আফিং বা অন্য কোনও মাদকের চূর্ণ মিশিয়ে এঁরা খান। ওঁর লাইটারটা উনি যেভাবে ধরে পলমল সিগারেটে আগুন ধরাচ্ছিলেন, তা অনেক বছর পাইপ খাওয়া যাঁদের অভ্যেস, তাঁদের পক্ষেই মানানসই। তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার, উনি যদি সিগারেট স্মোকারই হতেন এবং যত ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছিলেন তাতে ওর তর্জনী ও মধ্যমাতে একটু হলদেটে ছোপ লাগতই। তা ছিল না, ওঁর এই দুটি আঙ্গুলে। আরও একটা কথা, যারা ওঁর মতো চেইন-স্মোকার তাঁরা পলমল এর মতো দামি এবং বিদেশি রোস্টেড সিগারেট অমন ক্যাজুয়ালি আধখানা খেয়েই অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতেন না। এসবই ওঁর বড়লোকির শো। এগজিবিশনিজম্। আসলে উনি বড়লোক নন। আসল বড়লোক ছিলেন ইবোহাল সিং। অথচ, তাঁর বড়লোকিরও কোনও ব্যাখ্যা এখনও আমরা পাইনি। এই নির্জন বাংলো থেকে চলে যেতে না পারলে কাজ কিছুই এগোবে না। ইম্ফল আমার চেনা জায়গা। চেনাজানা মানুষও আছেন একাধিক। আমার যাতে অসুবিধে হয় কাজের, সেই জন্যই হয়তো সার্কিট হাউসে না রেখে এইখানে উঠিয়েছে আমাদের। যাকগে, টেলিফোনটা কোথায় আছে? তোরা কি দেখেছিস?

হ্যাঁ। ড্রয়িংরুমের বড় সোফার ডান পাশে আছে।

চল তবে। টেলিফোন ডিরেক্টরি কি আছে? দেখেছিস?

না, সেটা তা দেখলাম না।

 বাংলোর দিকে যেতে যেতেই ঋজুদা বলল, ইচ্ছে করেই হয়তো সরিয়ে রেখেছে।

বারান্দাতে উঠতেই একজন বেয়ারা এসে সেলাম জানাল। তাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, টেলিফোন ডিরেক্টরি নেই।

কোথায় গেল?

 তিতির শুধোল।

 গতকালই মিসিবাবা নিয়ে গেছেন বদলে নতুন ডিরেক্টরি আনবেন বলে।

 ও। তা তোমার সাহেবের ফোন নাম্বার কত?

কোন সাহেবের?

তম্বি সিং-এর।

 ও। তম্বি সিং-এর? লেখা আছে। কথা বলবেন স্যার? ফোন লাগিয়ে দিচ্ছি।

এখান থেকে তোমার পুরনো মনিব ইবোহাল সিং সাহেবের মোরের বাড়িতে কথা বলা যাবে?

পুরনো মনিব কেন স্যার? উনিই তো আসল মনিব, আমাদের। মিসিবাবাও আমাদের মনিব নন। উনি বলেছেন, নতুন মনিব যিনি হবেন, তাঁকে অনুরোধ করবেন আমাদের রাখতে। কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে? সাহেবই তো চলে গেলেন। আমাদের মাইনে দেবার সামর্থ্য, নতুন মনিব যেই হোন না কেন, তাঁর থাকবে কি? সাহেবের মতো মনিবই বা পাব কোত্থেকে? নতুন মনিব কে হবেন, তা তো কেউই জানে না এখনও।

আমাদের সকলের মনেই উৎকণ্ঠা এখন। সাহেব কাকে যে তাঁর সম্পত্তি দিয়ে গেছেন তা যতদিন না জানা যাচ্ছে…

তাই?

 হ্যাঁ স্যার।

এই যোগেন ড্রাইভারকে কি নতুন রাখা হয়েছে?

 তা তো জানি না স্যার।

 টাটা-সিয়েরা গাড়িটা কতদিনের?

 ওটা তো আমাদের সাহেবের গাড়ি নয়?

 তবে কার গাড়ি?

 জানি না। ওই গাড়ি ও ড্রাইভারকে আজই প্রথম দেখলাম।

 তাই না কি? ঋজুদা অবাক গলাতে বলল।

এখন তোমার সাহেবের মোরের বাংলোতে কে থাকে?

আমরা ঠিক জানি না। শুনেছি, সাহেবের বহু পুরনো খাস বেয়ারা আছে উ মঙ্গ। বার্মিজ। আর কারা থাকে, জানি না।

ঋজুদা সোফাটাতে বসে ডায়াল ঘুরিয়ে একটা নাম্বার চাইল। এখনও এখানে বোধহয় ম্যানুয়ালই আছে টেলিফোনে। অন্তত এনকোয়ারিতে, তাই আছে। ভাবলাম আমি।

ঋজুদার চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়ে গেল।

বলল, চিনতে পারছেন গলা?

 তারপর বলল, ঋজু বোস।

তারপর খুব জোরে হেসে উঠল ঋজুদা। বলল, একটা কাজে এসেছি। উঠেছি নাগাল্যান্ডের রাস্তাতে দ্য রিট্রিট-এ।

ওদিক থেকে যিনি কথা বলছিলেন তিনি একসঙ্গে নিশ্চয়ই অনেক কথা বললেন।

ঋজুদা হেসে বলল, বিকেলে আপনার গাড়ি নিয়ে আসবেন, ঠিক চারটেতে। তারপর আপনার সঙ্গে বেরিয়ে কথা হবে। আপনার নিজের কোনও গাড়ি নিয়ে আসবেন না। আচ্ছা, একটা কাজ করবেন বরং। একটা ভাড়া করা গাড়ি পাঠাবেন। ড্রাইভার যেন আপনার বাড়ির পাড়াটা চেনে। বাড়ি চেনার দরকার নেই। হ্যাঁ। না। আপনার ওখানে গিয়েই বলল সব। ওকে। ওক্কে। সি য়ু। ও আর একটা কথা। ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার যেন আপনার নামও না জানে। দেখবেন। আপনার কোনও লোককে দিয়ে ভাড়া করাবেন। ডিসক্রিট রাখবেন ব্যাপারটা।

কথাবার্তা সব ইংরেজিতেই হচ্ছিল এবং বেয়ারারা ধারে কাছে ছিল না।

 ফোন শেষ হতে না হতেই শ্রীমান ভটকাই এসে হাজির, মস্ত এক হাঁড়ি নিয়ে।

ঘরে ঢুকেই বলল, ইংরেজিতে, দিস হাঁড়ি শ্যাল নট বি হ্যাঁন্ডেড ওভার টু এনি ওয়ান। ইট নিডস সাম ডক্টরিং।

ঋজুদার চোখে হাসি খেলে গেল। আমাদের দিকে চেয়ে যেন নীরবে বলল, কী রে? কী বলেছিলাম তোদের?

ভটকাইকে বলল, কী যেন নাম ড্রাইভারের?

যোগেন কুণ্ডু।

হ্যাঁ, ওকে গিয়ে বলে দে যে, তোরা ঠিক সাড়ে তিনটের সময়ে বেরোবি। রাজবাড়ি দেখবি। ইম্ফলের সব বাজার দেখবি।

তারপর বলল, এখন কেনার দরকার নেই। তবে, ফিরে যাবার আগের দিন, তোদের একটা করে লাইঝাম্পি কিনে দেব। কলকাতার শীতের পক্ষে আইডিয়াল। নরমও। কিন্তু, তোরা থংগল বাজারের দিকে যাবি না আজকে।

ড্রাইভারকে সাড়ে তিনটের সময় বেরোব, একথা বলব কেন?

ভটকাই বলল।

 আরও আগে যেতে চাস তোরা?

 হ্যাঁ। এখানে বসে থেকে কী করব?

তবে তাই যা। তবে খেয়ে দেয়ে বেরোবার সময় সকলকেই বলে যাবি যে, আমার শরীরটা খারাপ। আমি বিশ্রাম নেব।

কী হয়েছে যদি জিজ্ঞেস করে?

ভটকাই শুধোল।

ঋজুদা জবাব দিল না।

পৈটিক গোলমাল বলব তো!

নিজেই বলল, ভটকাই।

ঋজুদা হাসল।

তিতির বলল, আবার পোয়েটিক গোলমাল বোলো না।

 খাবার লাগাতে বলল। কী রাঁধল কে জানে! কিছু তো জিজ্ঞেসও করল না। এ আচ্ছা রাজা-রাজকুমারীর পাল্লায় পড়লাম যা হোক!

বলেই বলল, তোরা যে যাবি গাড়ি নিয়ে, তা তম্বি সিং আসবেন কখন?

 যাবার আগে ফোন করে দিবি, যে তোরা ডিনারের আগে ফিরবি। উনি যদি আসেন তো ওই সময়েই যেন আসেন। তার আগে আসার দরকার নেই। আমি যে আলাদা বেরোব, তাও বলার দরকার নেই।

কথা শেষ না হবার আগেই, ওঁরই ফোন এল।

 ঋজুদা বলল, এই তো লাঞ্চ লাগাতে বলেছি। লাঞ্চের পরই ওদের নিয়ে শহরে বেরোব। কাল কখন ‘মোরে’ রওয়ানা হওয়া যেতে পারে? কী বলছেন? ব্রেকফাস্টের পরে? দেরি হয়ে যাবে না? কারণ, ওখানে গিয়ে তো…। ও হবে না বলেছেন? তা হলে তাই হবে। আপনি কি রাতে আসছেন? চেষ্টা করবেন? ঠিক আছে। না, না। ফার্স্ট ক্লাস বন্দোবস্ত। কোনওই অসুবিধে নেই।

এখানে মাছের একটু অসুবিধে। পুকুরের মাছ। তা ছাড়া এমনিতে বৈষ্ণব জায়গা। তবে নাগা, কুকি আরও বাইশটি উপজাতিরও বাস মণিপুরে। চারিদিকেই তো পাহাড়। মিজোরাম, নাগা হিলস, বার্মার পাহাড়, চীন, আগরতলা; মেঘালয় পাহাড়ই পাহাড়। মণিপুরও তো সবই প্রায় পাহাড়, মধ্যের এই উপত্যকা ছাড়া। অধিকাংশই খ্রিস্টান। তাঁরা তো সবই খান। সাপ, ব্যাঙ, কুকুর, বাঘও খান বলে শুনেছিলাম, কোহিমাতে যখন যাই। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। তবে মিথ্যে বলার কোনও কারণ ছিল না, যিনি বলেছিলেন তাঁর।

মুরগি, সর্ষে দিয়ে রান্না; মাটন-বিরিয়ানি, কোর্মা, দারুণ অড়হরের ডাল, বেগুন ভাজা, কুড়মুড়ে করে আলু ভাজা, খাঁটি গাওয়া ঘি, মিহি চাল, বলল, এখানকার স্পেশ্যালিটি; পাহাড়ি নদীতে ধরা কুচো মাছের টক। সঙ্গে আনা কালাকাঁদ ছিল। তারপর ভটকাই-এর আনা পান্তুয়া তো অবশ্যই। জমিয়ে খাওয়া হলে, ভটকাই একজন বেয়ারাকে বলল, পান্তুয়ার হাঁড়িটা ফ্রিজ থেকে নিয়ে এসো তো বাবা। আমার আবার খাওয়ার আধঘন্টাটাক পরে গোটা চারেক মিষ্টি না খেলে হয় না। খাওয়ার পরে মিষ্টি খাওয়াটা উত্তর কলকাতার ট্র্যাডিশান। বাঙালরা এসবের খোঁজ রাখে না।

ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে বলল, আমি একটু ঘরে গিয়ে ইজি-চেয়ারে গড়িয়ে নেব। বুদ্ধির গোড়াতে ধোঁয়া দেওয়া দরকার। তা হলে, তোরা সময়মতোই বেরোস।

যাওয়ার আগে দেখা করব, তোমার সঙ্গে।

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, তুমি রেস্ট করো, তিতির। আমরা আধঘণ্টা পরে বেরোব।

তারপর আমার আর ভটকাই-এর জন্য যে ঘর বরাদ্দ ছিল সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে ভটকাই পকেট থেকে ডালকোলাক্সের পাতা বের করল। দু পাতা।

কী করবি?

দ্যাখই না। বহরমপুরের হনুমানের দলকে ঘায়েল করেছিলাম এই দিয়ে, তার টিকটিকি, যোগেন কুণ্ডু। বঙ্গসন্তান। বজরঙ্গবলী কাত হয়ে গেল, আর এ তো ফিনফিনে বঙ্গজ-ফড়িং।

করবিটা কী?

গোটা কুড়ি বড়ি হবে পার্গেটিভ-এর। বেসিন থেকে ভাল করে হাত ধুয়ে এসে টুথপিক এর উল্টোদিক দিয়ে পান্তুয়াগুলো ফুটো করে তার মধ্যে দুটো করে ডালকোলাক্সের বড়ি ঠেলে ঠেলে ভরে দিতে লাগল। দশটা পান্তুয়া ডকটরড হয়ে গেলে সেগুলো প্লেটে রাখল। হাঁড়িটা এনে বলল, নে! তোরও চারটে খেতে হবে। আমি তো চারটে খাবই।

ভরা পেটে! আমি মরে যাব ভটকাই।

তুই এত সহজে মরবি? কাঙ্গপোকপির লেডি ডাই-এর সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত না করে কারোই মরা চলবে না। খা, খা! বলেই, অত বড় বড় পান্তুয়া একটা একটা করে আমার মুখে পুরে দিতে লাগল। যেন, দিদি শাশুড়ি এসেছেন আমার!

যাই হোক, আটটা দুজনে মিলে, ভটকাই-এর ভাষাতে সাঁটাবার পর, বাকি দশটা, অনেকখানি রসে ছেড়ে দেওয়া হল, হাঁড়িতে। হাঁড়িটা একটু নাড়িয়ে ভটকাই রসটা চারিয়ে দিল। পান্তুয়াগুলো খুশিতে জড়ামরি করে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

ভটকাই বলল, যোগেন কুণ্ডু মহাপেটুক আছে। মিষ্টির দোকানেই টেস্ট নিয়েছি। বাঙাল মাত্রই গুচ্ছের খায় তোর মতো। এই পান্তুয়া যদি গোটা দুয়েকও খায় তবেই আর কালকে ডিউটিতে আসতে পারবে না। গোটা চারেক খেলে তো দুদিন কাত। মানে, আটটা ট্যাবলেট।

করছিস কী? ওর বাড়িতে যদি বাচ্চা কাচ্চা থাকে?

নেই রে নেই। ভটকাইচন্দ্র কি শিশুবধ করে মহাপাতক হবে? সব খবর নিয়েছি।

একটু অসোয়াস্তিতে পড়বে এই আর কী।

 অসোয়াস্তি কী? বল, অস্বস্তি।

 থাম তো তুই। একে বলে সমীকরণ। আমাকে বেশি বাংলা শেখাস না। কৃষ্ণ থেকে কেষ্ট যেমন, বুয়েচিস।

তিতির সময়মতো তৈরি হয়ে এল। শাড়িটা ছেড়ে সালোয়ার কামিজ পরেছে। আমরাও বেরোলাম। কোমরে আমার যন্ত্রটা নিয়ে নিলাম। গুলিভরা একটা ম্যাগাজিন। অন্যটা হিপপকেটে।

ঋজুদাকে বলে গেলাম, যাবার সময়ে।

 ঋজুদা বলল, ড্রাইভারের কী যেন নাম? বলিস আমার পেটে ব্যথা।

ঠিক আছে। নাম যোগেন কুণ্ডু।

ভটকাই সেরিমনিয়াসলি পান্তুয়ার হাঁড়িটা যোগেন বাবুকে দিয়ে বলল, যোগেন দাদা। রাতে তুমি ও বৌদি এগুলো শেষ করে দিও। এগুলোও এই ব্যাটা রুদ্র সেঁটে দিচ্ছিল, অনেক কষ্টে বাঁচিয়েছি। সত্যি বলছি, পুরো ইন্ডিয়া ঘুরেছি আমি। কিন্তু এক মুসৌরি আর বাংলাদেশের বরিশাল ছাড়া এমন মিষ্টি আর খাইনি।

বরিশালে গেছেন না কি, আপনি? কন কী?

উত্তেজিত হয়ে যোগেন বলল।

কথা ঘুরিয়ে ভটকাই বলল, আমার বাবা টুরিজম-এর অফিসার ছিলেন তো। সব জায়গায় ফ্যামিলিয়ারাইজেশান ট্যুর করতে হত।

সেটা কী?

 মানে, সড়গড় হবার জন্য। ফ্যামিলিয়ারিটি শব্দটার মানে বোঝেন তো? ইংরেজি শব্দ।

না বোঝনোর কী আছে? ফ্যামিলি আর ম্যালোরি। মধ্যপদলোপী শব্দ। আমিও বুঝি না, এমন জিনিসই নাই মশয়!

তিতির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

 পান্তুয়ার হাঁড়িটা সযত্নে গ্লাভস বক্স-এ ঢুকিয়ে শ্যাময় লেদার এর হলুদ কাঁচ মোছা কাপড়-টাপড় দিয়ে টাইট করে বসিয়ে, তিতিরকে দরজা খুলে বসালেন, যোগেনবাবু। তারপর আমাদের উঠতে বলে বললেন, কয়েন এইবার। যামু কই?

যা যা আছে দেখবার শহরে। সব জায়গাতেই যাব। তবে সাড়ে আটটার মধ্যেই ফিরতে হবে।

তবে প্রথমে চলেন, আই. এন. এ. মেমোরিয়ালে। ন্যাতাজি সুভাষ বোসের আই. এন. এ.র লগে ব্রিটিশদের যুদ্ধ হইছিল হেইখানে। গুলির দাগও এহনও আছে টিনের চালে। এই রাস্তায় সোজা একটু যাইয়াই বাঁদিকে ঘুরুম। মৈরাঙ্গেই আছে তা। সিখানেই তো থৈবী–খাম্বারও জায়গা। থৈবী আছিল রাজকুমারী, আমাগো সানাহানবি দেবীর মতো সুন্দরী। আর খাম্বা আছিল অর্ডিনারি। আমাগো মতো বদখত্ আর কী! কিন্তু মহা ফাইটার। অমিতাভ বচ্চনের থিক্যাও বড় ফাইটার। বীর। দুজনের পেরেম হইয়া গেল। তা রাজকুমারীর ইচ্ছা হইলে কি অইব? রাজা দিলে তো বিয়া?

তারপর?

ভটকাই শুধোল।

 তারপর আর কী! যা হওনের তাই হইল।

কী?

 আরে মশয়, ভাল লাভ স্টোরির এন্ডে কি বিয়া হয়, নাকি? না কোনদিন হইছে, তাই কয়েন? লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট, রাধাকৃষ্ণ? পেরেম যদি সাচ্চা হয়, বুঝলেন মশয়, তবে বিয়া অইতেই পারে না। বিয়া যেই অইব’–বিয়ার ফুল ফুটব, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের ফুল ফাইটব।

ফাটবে মানে?

 আমি একটু অবাক হয়ে বললাম।

ফাইটব মানে, ফাইট করনের কথা কই নাই; ফাইট্যা যাইব গিয়া। ফট্টাস কইর‍্যা ফাইট্যা যাইব। আমি নিজে বিয়া কইর‍্যা দেখছি না! অ্যারে কয় ভুক্তভুগী।

এবারে গাড়ি স্টার্ট করলে হয় না?

তিতির বলল।

হ্যাঁ। হ্যাঁ। সরি, আমি বড় বেশি কথা কই। এই অইল আমার পেধান দোষ। আমার ওয়াইফে হক্কল সময়ই কয় আমারে।

.

থাঙ্গজম সিং লংজুর সঙ্গে ঋজু বোসের আলাপ, আশির দশকের শেষেশেষি থেকে। থংগল বাজারের কমলা টাইওয়ালার শালা শ্যামানন্দ সাঙ্গেনারিয়ার একটা রহস্য সমাধান করে দিয়েছিল। তাঁর স্ত্রীর বহু লক্ষ টাকার গয়না; হিরেই বেশি, চুরি যাওয়াতে ঋজু বোসকে এনেছিল ইম্ফলে। তখন ঋজু বোসের এত নামডাকও ছিল না। তখন এই থাঙ্গজম সিং লংজু এবং মিস্টার পুরকায়স্থ বলে এক ভদ্রলোকের সাহায্যে এবং মোরে এবং তামুর পুলিশদেরও সাহায্যে সেই গয়নার প্রায় ষাট অংশ উদ্ধার হয়েছিল। তখন থাঙ্গজম সিং-এর অবস্থা ছিল অতি সাধারণ। মোরেতে একটি কাঠচেরাই এর কল ছিল। সামান্য ঠিকাদারিও করতেন।

সেই থেকে ইম্ফলের মানুষদের খুব ভক্তি ঋজু বোসের ওপর এই কারণে যে, চুরি যাওয়া সম্পত্তির মূল্য যাই হোক না কেন, ঋজু বোস শুধু তার যা ‘ফি’ তাই চেয়েছিল। প্লাস খরচাখরচ। তার বেশি এক পয়সাও চায়ওনি, নেয়ওনি। থাঙ্গজম সিং লংজু ছিল ঋজু বোসের এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বন্ধু, অনীক সেনের মক্কেল। সেই সুবাদে কলকাতাতেই আলাপ হয়। তারপর যখন কমলার কাজে ইম্ফলে আসেন, তখন সেই আলাপ আরও গম্ভীর হয়।

ঋজু বোস পৌনে চারটেতে বেরিয়েছিলেন, বাংলো থেকে। গাড়িটা যতই এগোতে লাগল, ততই নানা কথা মনে হতে লাগল ঋজু বোসের। নানা চিন্তা। কারণ, তম্বি সিং-এর কথাবার্তা শুনে, তার মুখে ইবোহাল সিং-এর বৈভবের কথা শুনে, তার মৈরাঙ্গ রোডের দ্য রিট্রিট বাংলোতে থেকে এবং সানাহাবিকে দেখেও তাদের জীবনযাত্রার একটা ধারণা করে নিয়ে ঋজু বোস নিশ্চিত যে, মণিপুরের মতো ছোট্ট জায়গাতে এমন কিছু ব্যবসা বা শিল্প এদের থাকতেই পারে না যার দ্বারা এমন ভাবে, টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কাদের মতোই স্বচ্ছল জীবনযাপন করতে পারেন ওঁরা। রাজা লাইহারোবাও তো মারা গেছেন কবে। প্রিভি পাস পেলেও এবং আদৌ পেলে কতই বা পেতেন। তা থেকে… কোনওই সন্দেহই নেই যে, ইবোহাল সিংও ব্যক্তি হিসাবে ভাল হলেও, যা শুনেছেন তাঁর কর্মচারীদের কাছ থেকে; তাঁর রোজগারটা হয়তো ছিল মুখ্যত চোরাচালান থেকেই। কোনও কর্মচারীই, কর্মচারী কেন, স্ত্রীসুদ্ধ পরিবারের মানুষেরাও মালিক বা গৃহস্বামীর রোজগারের সূত্র নিয়ে মাথা ঘামান না। যে রোজগার করে আনে, সেই ভগবান। টাকার চেয়ে বড় মান-সম্মান-ভালবাসা-প্রতিপত্তির ধারক বাহক, আজ আর কিছুই নেই।

অমন সুন্দর বাংলো ও প্রাসাদোপম বাড়ি থাকতেও উনি মোরেতে গিয়ে পড়ে থাকতেন না, যদি-না মোরে বর্মার সীমান্তে হত। এই অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ-নেপালেরই মতো চোরাচালান এত জলভাত যে, এই সীমান্তের মানুষ ও পুলিশ অবহেলায় এপার ওপার হয়। চোরাচালানকারীদের স্বর্গরাজ্য এ। রাতের অন্ধকারে মালবাহকেরা, যাদের অধিকাংশই মেয়ে; ইলেকট্রনিক গুডস, মাদক দ্রব্য এবং অন্যান্য কম ভারী অথচ দামি জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যায়, চোরা পথে। আর ভারী জিনিস তো দু পক্ষেরই চেকপোস্ট পেরিয়ে দুপক্ষের যোগসাজশেই ট্রাকে করেই পারাপার হয়ে যায়। সরকার সবই জানেন। যখন আর. ডি. এক্স-এর বিস্ফোরণে অগণ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণ যায়, যখন মারাত্মক এ. কে. ফর্টি সেভেনের গুলিতে ঝাঁঝরা হয় মহিলা ও শিশুর শরীর; তখন সব সীমান্তের নেতারাই একটু নড়েচড়ে বসেন মাত্র।

থাঙ্গজম সিং লংজুর বাড়ির বেশ কিছুটা দূরেই গাড়িটা ছেড়ে দিলেন, ঋজু বোস। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, অপেক্ষা করবে কি না? ঋজু তাকে মানা করে, চলে যেতে বলে, জিজ্ঞেস করলেন, ভাড়া কত?

ভাড়া তো দিয়ে দিয়েছে।

কে দিল?

 নাম তো জানি না।

ও, তাহলে রণবীর শর্মাই দিয়েছে। ইচ্ছে করেই একটা বানানো নাম, ড্রাইভারকে শুনিয়ে বললেন উনি। ইসস, এত করে মানা করলাম।

তা হবে। ড্রাইভার বলল।

তম্বি সিং-এর আমন্ত্রণ পাবার পর থেকেই এটা বুঝে ছিলেন ঋজু বোস যে, এই কেসটা সোজা কেস নয়। কেউ বা কারা কলকাতা থেকে বিখ্যাত গোয়েন্দা এনে তাঁদের চক্রান্তটা যে চক্রান্ত নয়, এটাই প্রমাণ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এবং এটা বুঝতে পারার পর থেকেই, চক্রান্তকারীদের মুখোশ খোলার জন্য জেদ চেপে গেছে ঋজু বোসের।

ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল কি না, তা দেখে নিয়ে ঋজু খুব আস্তে আস্তে হেঁটে থাঙ্গজ সিং-এর খুব উঁচু কম্পাউন্ডওয়ালা, বাগানওয়ালা বাড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়াতেই উর্দিপরা দারোয়ান গেট খুলল। থাঙ্গজম সিং-এর অবস্থার উন্নতি এই ক’বছরে এতখানি হয়েছে দেখে অবাক হলেন ঋজু বোস। খুবই আনন্দের কথা।

থাঙ্গজম সিং বাইরে এসে আপ্যায়ন করলেন। পাশে, একজন গুণ্ডামতো লোক। তাঁর পুত্রবধূও এলেন। পুত্র বাড়িতে ছিলেন না। মনে হয়, সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে।

ঋজু বললেন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। একটু প্রাইভেসির দরকার।

চলুন। চলুন। ভিতরে চলুন। নাকি, ছাদে গিয়ে বসবেন?

তাই চলুন।

কী খাবেন? 

কিছু না। এক কাপ চা, দুধ চিনি ছাড়া।

সেই লোকটাও পায়ে পায়ে ওপরে এসেছিল। আলাপ করিয়ে দিলেন থাঙ্গজম সিং। বললেন, এর নাম হাঞ্জো সিং।

হ্যান্ডশেক করে ঋজু বোস বললেন, ওঃ, আচ্ছা।

হ্যাঞ্জোকেই চায়ের কথা বলে, নীচে চলে যেতে বলে, মোটা কুশন লাগানো চেয়ারে বসিয়ে, তারপর নিজে বসে বললেন, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্যে? ও, তার আগে বলি, আমার ওয়াঙ্গোইর এগ্রিকালচারাল ফার্ম থেকে আনারস এসেছে আজ। গোটা কয়েক দিয়ে দেব যাবার সময়ে। কলকাতা নিয়ে যাবেন। কালই কি চলে যাচ্ছেন? এই শেষ ক্রপ। এ বছরে আর হবে না।

কবে যাচ্ছি, তা আমি নিজেই জানি না। তবে, সঙ্গে আমার সৈন্যদল আছে যে। আপনার আনারসদের সসম্মানে এখানেই শেষ করবে তারা। কলকাতা অবধি পৌঁছবে বলে মনে হয় না।

বলেই বলল, আপনি ইবোহাল সিংকে চেনেন?

 মণিপুরে ইবোহাল সিংকে কে না চেনে! দ্য মোস্ট প্রিন্সলি পার্সন উইদাউট বিয়িং আ রিয়্যাল প্রিন্স। হাসতে হাসতে বললেন, থাঙ্গজম সি।

রিয়্যাল প্রিন্স নন কেন?

 রাজপরিবারের কেউই তো ওঁকে আত্মীয় বলে মানেন না। সেলফ-অ্যাক্লেইমড প্রিন্স। প্রিন্স লাইহারোবা নিজেই যে প্রিন্স ছিলেন, তারই কোনও প্রমাণ নেই।

বলেই বললেন, ও বুঝেছি। আপনি ইবোহাল সিং-এর মার্ডারের তদন্তেই এসেছেন। সত্যি! এই সোজা কথাটা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। তা হলে তো এবারে খুনির আর নিস্তার নেই।

কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে ঋজু বোস বললেন, মানুষ কেমন ছিলেন? উনি?

কে? ইবোহাল সিং? চমৎকার। মানুষ খারাপ, ইবোহাল সম্বন্ধে কেউই বলবেন না এ কথা। কিন্তু যে পরিমাণ টাকা তিনি দুহাতে খরচ করতেন সে টাকাটা যে আসত কোত্থেকে, সেও একটা রহস্য।

আপনি তম্বি সিংকে চেনেন?

 হঃ।

হাসলেন, থাঙ্গজম সিং। ইবোহালেরই মতন, তম্বিকে চেনে না এমন মানুষও ইম্ফলে একজনও নেই।

তিনি কেমন মানুষ?

ওটা একটা মানুষই নয়। ওটা একটা সাঙ্গাই। সারাজীবন ফুমডির ওপরে নেচে বেড়াল।

তাই? বলেই হেসে উঠলেন ঋজু বোস।

হ্যাঁ। ওটা একটা থার্ডরেট মোসাহেব, একটা বাফুন, ক্লাউন একটা।

করেন কী? জীবিকাটা কী?

মোসাহেবি, আবার কী? চিরদিন ওই জীবিকাই। একটা আত্মসম্মানজ্ঞানহীন জানোয়ার।

এই বাক্যটি উচ্চারিত হবার পরে থাঙ্গজম সিং এবং ঋজু বোস দুজনেই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

তারপর ঋজু বোস বললেন, মোসাহেবি করে এত টাকা? কাঙ্গপোকপিতে তো শুনেছি তাঁর মেয়ে সানাহানবির ফার্ম আছে। সেখানে কুকুর ব্রিড করান উনি। সালুকি কুকুরও ব্রিড করেন। সালুকি কুকুর সম্বন্ধে কি কিছু জানেন আপনি, মিস্টার সিং।

জানি না বোস সাহেব, আর জানতে চাইও না। আমার একটি নাগা কুকুর আছে, মোককচুং থেকে নিয়ে এসেছিলাম। সে ওইসব সালুকি-ফালুকির গলার নলি ছিঁড়ে দেবে। সারাদিন অন্ধকার ঘর-এ বন্ধ করে রাখি, রাতে গেট বন্ধ করার পর ছেড়ে দিই। যমরাজেরও সাহস হবে না ঢুকতে, সন্ধের পরে। ইনফ্যাক্ট, আমার স্ত্রীকে তাই তো দুপুরবেলাতে নিয়ে গেল যমে।

ও। তাই! ভীষণ খারাপ লাগল শুনে। আই অ্যাম সরি। ভারী চমৎকার মহিলা ছিলেন। আমাকে ইরোম্বা খাইয়েছিলেন মনে আছে। কী হয়েছিল মিসেস সিং-এর?

এমন স্বামীর সঙ্গে পঁচিশ বছর ঘর করার পরও কিছু হবার দরকার আছে কি? এই এক অসুখই তো যথেষ্ট। মরল, সেই অশান্তিতেই।

 সানাহানবিকে দেখেছেন আপনি? মিস্টার বোস?

হ্যাঁ। এয়ারপোর্টে এসেছিল তো।

লেডি ডায়ানার মতো দেখতে না অনেকটা?

হ্যাঁ। তাই তো আলোচনা করছিল ওরা সকলে।

 সকলে মানে?

 মানে, আমার সাকরেদরা। সৈন্যদল।

ইংরেজের মেয়ে হলে তো ইংরেজের মতো দেখতে হবেই।

সে কি সানাহানবি তম্বি সিং-এর মেয়ে নয়?

বাবার নামটা ধার নেওয়া। জন হাচিনসন বলে এখানে একজন ইংরেজ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। সে ওই মোরের কাছেই মারা যায় জাপানিদের বোমাতে। তার ছেলে কেনেথ। ব্যাচেলার। লম্বা চওড়া হ্যান্ডসাম পুরুষ৷ নটিংহামশায়ারে দেশ ছিল। যায়নি কখনও। লেখাপড়া করেনি কিছুই। কিন্তু মানুষ ভাল ছিল। খুব ভাল শিকারিও ছিল। প্রথম জীবনে লেক লকটাক-এ মাছের ব্যবসা করত এবং একটা আনারসের ফার্মও নিয়ে ছিল। তবে ফার্মটা বিরাটই করেছিল। এখনও লোকে একনামে চেনে কেনেথ ফার্ম বললেই। তম্বি ছিল ওই কেনেথ হাচিনসনেরই আনারস ফার্মের একজন সুপারভাইজার। তম্বির স্ত্রী ছিল পরমাসুন্দরী নাগা মেয়ে। নাগারা লম্বা হয়। নাগাদের মধ্যে যে কী অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে-পুরুষ হয়, তা সমতলের লোকেরা জানে না।

তম্বি ছিল একটি অপদার্থ, সবদিক দিয়েই। সারাদিন নেশা করে পড়ে থাকত। বলতে গেলে, ওর স্ত্রীই ওর কাজটা সামলে দিত। তারপর…গল্প উপন্যাসে যেমন পড়া যায় আর কী! কেনেথের রূপ পেয়েছে মেয়েটা আর মায়ের রূপ এবং চরিত্র, দুটোই। তম্বির স্ত্রী লেইমাথেইমা ছিল পরমাসুন্দরী, কিন্তু অত্যন্ত বাজে চরিত্রের মেয়ে। তম্বির স্ত্রী মারা যাবার পরে কেনেথ আনারসের ফার্ম বন্ধ করে দিয়ে এসে কাঙ্গপোকপিতে কুকুরের ব্যবসা আরম্ভ করে।

তা তম্বি সিং তো ভাল ইংরিজি বলেন।

 ভাল? আপনিও ভাল বলছেন, মিস্টার বোস? আশ্চর্য!

 অক্সফোর্ডে নাকি পড়াশোনা করেছেন উনি?

হাঃ! সত্যি! আপনিও দেখি…। ওর মাথার গোলমাল আছে। তা বেড়েছে। এখন, বিশেষ করে ইবোহাল সিং-এর মৃত্যুর পরে। সানাহানবির সঙ্গে ইডিয়ট তম্বিই আলাপ করিয়ে দেয় ইবোহাল সিং-এর। এখন সে মেয়ে যদি ইবোহালের সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারে তবে বাবাকে লাথি মেরে তাড়াবে। অবশ্য, এমনিতেই তো মারে। তম্বি সিং এখন খাবে কী? এতদিন তো ইবোহালের মোসাহেবি করে দিব্যি চালিয়েছে। এখন? সেই চিন্তাতেই পাগলের মতো হয়ে গেছে। দোষ নেই বেচারির। এতদিন সাহেবের কাজ করেছে। কিছু ইংরেজি শিখবে বইকী। আমাদের চেয়ে অনেকই ভাল শিখেছে। সাহেবি আদব কায়দাও শিখে নিয়েছে অনেক। দোষ, চাল-চালিয়াতি। কিন্তু শুধু ইংরেজি বলতে পারলেই তো জানোয়ার মানুষ হয়ে যায় না।

ওঁর সম্বন্ধে আর কী জানেন? আপনি?

 ঋজু বোস বললেন।

আর কী বলব। তবে বলব মানুষটা বোকা হতে পারে কিন্তু খারাপ নয়। ইবোহালকে ও খুন করেছে বা খুন করিয়েছে তা আমার অন্তত মনে হয় না। অত ষড়যন্ত্র ওর ওই মাথাতে আঁটবার মতো মাথা নিয়ে ও জন্মায়নি। নইলে আজীবন অপদস্থ হয়। তা ছাড়া, ওর মেয়ে সানাহানবির হাতে বেচারি রীতিমত অত্যাচারিত। স্ত্রীর হাতেও কম অত্যাচারিত হয়নি। লোকটা কুঁড়ে ছিল। যে কোনও মাতৃতান্ত্রিক রাজ্যেই দেখতে পাবেন যে গড়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি উদ্যমী। নানা অশান্তির জন্যেই তো ও ওর স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ইবোহালের সঙ্গেই থাকত, চামচেগিরি করত। ওকে অনুকম্পাও করে সকলে, আমিও করি, আবার ওর বিরুদ্ধে তেমন ব্যক্তিগত অভিযোগ খুব কম মানুষেরই আছে।

এবারে বলুন তো আচ্চাও সিংকে চিনতেন?

আ-চ্চা-ও! চিনব না? হিরের টুকরো ছেলে।

 ওকেই তো সব সম্পত্তি দিয়ে যেতেন ইবোহাল সিং। বেঁচে থাকলে।

 মানে, আচ্চাও সিংকে? তাই না? ঋজু বোস বললেন।

হ্যাঁ, হয়তো বেঁচে থাকলে।

বেঁচে আর থাকলেন কই?

তবে আচ্চাও একেবারেই নির্লোভ ছেলে। ওর বাবা একজন রাজপুরোহিত ছিলেন। যদিও রাজাদের রমরমা তখন বিশেষ ছিল না। এরকম সৎ ও সর্বগুণসম্পন্ন ছেলে সারা মণিপুরে আছে কি না সন্দেহ। কাউকে বলবেন না আপনি। ভেবেছিলাম, আমারই মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেব। আলাপ পরিচয়ও আছে। আচ্চাওকে আমার মেয়েরও ভাল লাগে। ভাল লাগার মতোই ছেলে। ও ইবোহালের সম্পত্তি পেল কি পেল না তাতে কী গেল এল? আমার যা আছে, তাতে ওদের চলে যাবে। তা ছাড়া আচ্চাও তো শ্বশুরের পয়সাতে বসে খাবার ছেলে নয়, অত্যন্ত সম্মানজ্ঞান তার। পরিশ্রমীও। তা ছাড়া, শিক্ষিত বলে এতটুকু অহংকার নেই। কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেছিল ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে–আই এ. এস.-এ বসলে সহজেই শিডিউল্ড ট্রাইবের কোটাতে পেয়েও যেত। কিন্তু ও মণিপুরের ছেলেদের শিক্ষিত করে তুলবে বলেই, ওই পরীক্ষাতে বসেনি। তাছাড়া ওই সব চাকরিতে একবার বহাল হলে সারা ভারতেই ঘুরে বেড়াতে হয়। শুধুমাত্র মণিপুরের জন্যই অনেক কিছু করবে বলেই সে বড় শহরের লোভ আর কনস্যুমারিজ-এ না ভুলে পরীক্ষা পাশ করেই ফিরে এসেছিল। কিন্তু এসেই ইবোহালের খপ্পরে পড়েছিল। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমার। ভেবেছিলাম, ওকে আমি একটা ভাল স্কুল করে দেব। আমার মেয়েও ইংরেজিতে বি. এ. করেছে। গৌহাটির কটন কলেজ থেকে। ওদের মতামত, রুচি ইত্যাদিতেও অনেকই মিল।

আপনার মেয়ে কোথায়?

সে কোহিমাতে গেছে এক বন্ধুর বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে। আজ তো সোমবার এ সপ্তাহের শেষেই ফিরে আসবে। আজই সকালে গেছে নিজে গাড়ি চালিয়ে।

আপনার মেয়ের নাম কী?

 থৈবী।

বাঃ! সুন্দর নাম তো।

 তা সুন্দর! কিন্তু দেবী না হয়ে যদি অসুরী হয়। সেই ভয়।

 আচ্চাও কোথায় আছে এখন?

আরে সেই হয়েছে মুশকিল। তাই যদি জানতাম তো গোল ছিল কী?

ওকে একবার ধরতে পারলেই তো জামিন দেবে না। আর সানাহানবির প্ল্যানটা বোধহয় সেরকমই। মিথ্যে সাক্ষী জোগাড় করে পুলিশকে ইনফ্লুয়েন্স করে নিরপরাধকে ফাঁসি দেওয়ানো বা সারাজীবন কারাদণ্ড দেওয়া শুধু এ দেশে কেন, পৃথিবীর সমস্ত দেশেই কঠিন নয়। নন-বেইলেবল অফেন্স তো! বেচারা নিরপরাধ একেবারে। আমার মেয়ে থৈবী তো কেঁদে সারা। আমিই তাই জোর করে পাঠালাম, বিয়ে খেয়ে আসতে। তা ছাড়া ও কোথায় গা ঢাকা দিয়েছে তা তো জানি না। কেউই জানে না, সে কোথায়। জানলে তো ওকে কলকাতাতে, নয় দিল্লি, বম্বেতে, কোথাও চালান করে লুকিয়ে রাখতাম।

আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো আমাকে, মিস্টার ইবোহাল সিং যে উইল করে যাননি, প্রমাণ কী? সকলেই কী করে ধরে নিল যে, হি ডায়েড ইন্টেস্টেট। ওঁর কোনও সলিসিটর ছিল না?

সলিসিটর ছিল না। উকিল ছিল, এক বুড়ো। উখরুল-এ বাড়ি। নাম ছাওবি সিং। নামটা ভুলও হতে পারে।

হুমম।

 আই সি। উখরুল-এ কোথায় বাড়ি ছিল?

তা আমি জানি না। তা দিয়ে আপনিই বা কী করবেন?

শেলফ-ড্রিন কার ভাড়া পাওয়া যায়? কোনও কোম্পানি আছে? এখানে?

ঋজু বোস তারপর শুধোলেন, থাঙ্গজম সিংকে।

কেন? কী করবেন? আমার পাঁচখানা গাড়ি। ছেলে একখানা ব্যবহার করে। মারুতি ওয়ান থাউজ্যান্ড। মেয়ের সাদা মারুতি। আর তিনখানা আমার নিজের ডিসপোজাল-এ। একটা কনটেসা, একটা ফিয়াট এন. ই. ইলেভেন হান্ড্রেড, আর একটা মারুতি-জিপসি। যেটা দরকার, সেটা নিয়ে যান। সেন সাহেবের বন্ধু আপনি। আপনাকে খাতির করা মানে তাঁকেই খাতির করা।

সেন সাহেব কি এখনও আপনার কাজ দেখেন? অডিট, ট্যাক্স-ট্যাক্স?

আসলে, যাতায়াতেই অনেক সময় লেগে যায়। ওঁর ছেলেরাই এসে অডিট করত। তাদেরও যাতায়াত, হোটেল বিল মিলে অনেক হয়ে যেত। আর উনি এত ব্যস্ত লোক! দিল্লি বোম্বেতেই তো থাকেন মাসের পনেরো দিন। তাই গৌহাটিতেই ঢনঢনিয়া বলে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে দিয়েছি, সব কাজ। সেই ঠেকা দেয়। তবে বড় গাড্ডাতে পড়লে সেন সাহেবকে ডাকতে হয় বইকী।

তাই? কতদিন উনি আসেননি ইম্ফলে?

তা, বছর পাঁচেক।

উকিল, ডাক্তার আর গাইয়ে বাজিয়েদের না আসার কী আছে? বেশি ফিস দিলেই আসবেন।

ঋজু বোস বললেন, ইচ্ছে করে।

সব উকিল, ডাক্তার, গাইয়ে বাজিয়েকেই কি এক দলে ফেলা যায়, বোস সাহেব? সব প্রফেশানেই একসেপশন আছে। থাকে। হয়তো আপনাদের প্রফেশানেও আছে। সেন সাহেবকে টাকা বা অন্য কিছু দিয়ে কিনতে পারে না যে কেউ। তিনি ফিয়ার্সলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট মানুষ। ট্রলি প্রফেশনাল। মাটির মানুষ। তবে কেউ তার লেজে পা দিলে তখনি শুধু বুঝবেন উনি কী দিয়ে তৈরি। আগে নয়। আমার কাজ এখন উনি নিয়মিত করুন আর নাই করুন, আই স্টিল অ্যাম অ্যান অ্যাডমায়ারার অফ হিম। কলকাতায় যদি ন মাসে ছ’মাসেও যাই তবেও অবশ্যই ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আর তেমন গণ্ডগোল পাকালে ধরে পাকড়ে নিয়ে আসি। আসেনও। বেশি ফিসের জন্যে নয়। ফর ওল্ড টাইমস সেক।

থাঙ্গজম সিং-এর বউমা নিজে ট্রেতে করে চা আর পেঁয়াজি ভেজে নিয়ে এলেন।

ঋজু বোস বললেন, থ্যাঙ্ক য়ু।

সফিস্টিকেটেড মেয়ে ও। গৌহাটিতে পড়াশোনা করেছে কনভেন্টে। তবে বি. এ. পরীক্ষা শেষ করেনি। ব্যস, তারপরই বিয়ে। বি. এ পরীক্ষাটা দেওয়া আর হল না। তাতে কিছু এসে যায় না। যমুনা তো আর চাকরি করতে যাচ্ছে না।

সে তো ঠিকই। তোমার নাম যমুনা? বউমা মাথা হেলাল হেসে। হাসিটা বিষঃ এবং জোর-করা বলে মনে হল। ভুলও হতে পারে মনে হওয়াটা।

চা খেয়ে পাইপটা ধরিয়ে ঋজু বোস বললেন, এবার উঠব। শুধু একটা কথা। আচ্চাও কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?

আমার ধারণা, ইম্ফলেই।

মোরে ছোট্ট জায়গা। ওখানে লুকিয়ে থাকা সহজ নয়।

পুলিশ কি ওকেই সন্দেহ করে খালাস? আর কাউকে সন্দেহ করেনি?

আর কাকে করবে? সন্দেহভাজন বলে তো আর কাউকে মনে হয় না।

কেন? সানাহানবি? বা তম্বি সিং?

ঋজু বোস বললেন।

ওদের কী ইন্টারেস্ট?

 তা, আমি কী করে জানব?

আপনাদের মানে, স্থানীয় মানুষদের আর কাউকে সন্দেহ হয় খুনি বলে?

সন্দেহ তো অনেকেই হয়, কিন্তু সন্দেহ হলেই বা কি? খুন করাটা প্রমাণ তো করতে হবে। আর আসল তো হচ্ছে সেই রুবিটা। যেই খুন করুক, রুবিটা সমেত তাকে তো ধরতে হবে।

কেন?

ঋজু বোস অবাক হয়ে বললেন।

এ তো কমনসেন্স। সে খুন করেছে সে কি অত বোকা? আরে, সে রুবি কবে হয়তো বার্মাতে পাচার হয়ে গেছে। নদী পেরুলেই তামু। তামু মানেই বার্মা। বা, নাগাল্যান্ডে। নাগাল্যান্ড থেকে ডিমাপুর হয়ে ভারতের কোনও প্রান্তে; তার ঠিক আছে! বম্বের জহুরিদের মহল্লাতে বিক্রি হয়ে গিয়ে মিডল ইস্ট-এর কোনও শেখের গলার হারের লকেট হয়ে ঝুলছে এতদিনে সে রুবি, তা কে জানে!

রুবিটার দাম কত হবে?

হঃ। হঃ। দাম? সেইটাই তো কথা। কত মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলার তা কেউই জানে না। সবই তো শোনা কথা। আমরা কি আর দেখেছি? থংগল বাজারের শেঠ মগনলাল জহুরিকে নাকি একবার দেখিয়েছিল, ইবোহাল সিং। শুনেছি, বছর বিশেক আগে। মগনলালও তখন রেঙ্গুন থেকে রিফিউজি হয়ে এসেছিল। রেঙ্গুনে অনেক দামি দামি বার্মিজ রুবি দেখেছে সে। কিন্তু ও রুবির দামের কোনও অনুমান করা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি।

আচ্ছা, আচ্চাও সিং ছাড়া আর বাইরের কেউ হতে পারে কি খুনি? কাউকেই সন্দেহ বা অ্যারেস্টও করেনি কি পুলিশ?ইবোহাল সিং-এর চাকর বাকরেরাও তো ছিল মোরেতে। তাদের ওপরে সন্দেহ হয়নি পুলিশের?

ইবোহাল সিং-এর খাস বেয়ারা ছাড়া সবাইকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। আচ্চাও গা ঢাকা দেওয়াতে পুলিশের সন্দেহ আচ্চাও এর উপরেই গিয়ে পড়েছে। শিক্ষিত মানুষ হয়েও ও যে এমন কেন গা-ঢাকা দিতে গেল, তা ওই জানে।

ইবোহাল সিং খুন হবার সঙ্গে সঙ্গেই আচ্চাও গা-ঢাকা দিয়েছিল কি?

প্রায় তাইই বলা যায়। যেদিন সকালে ইবোহাল সিং-এর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়, সেদিন থেকেই সে নিখোঁজ।

পুলিশ আসার পর? নাকি সেই রাতেই?

তা জানি না। ওকে কেউই দেখেনি। ঠিক কখন যায়, তা কেউই জানে না।

আপনি এত জানলেন কী করে?

ঋজু বোস জিজ্ঞেস করলেন, সিংকে।

জানাই আমার কাজ, মিস্টার বোস। ব্যবসাদারদের সবকিছু জানতে হয়। তা ছাড়া আমার বিজনেস কনট্যাক্টস নেই, মোরেতে? তামুতেও আছে।

তা ঠিক।

ঋজু বোস বললেন।

আচ্ছা তরোয়ালটা কে খুঁজে পায়?

 তরোয়াল?

হ্যাঁ। যে তরোয়ালে রুবিটা লাগানো ছিল?

 কে যে এসব গাঁজাখুরি গল্প বলেছে আপনাকে, কে জানে?

 তম্বি সিং। সাধারণের সন্দেহ না কি তাঁরই উপরে পড়েছে?

নিজেকে ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট মনে করে, বিশেষ করে তাঁরা; যাঁরা ইম্পর্ট্যান্ট নন। লোকে সন্দেহ আদৌ করছে না। তবে পুলিশে করতে পারে।

কেন?

ওকে চোর বানানো সোজা, তাই। ও তো মামলা লড়তে পারবে না। আর সেটা একটা স্টান্টও হবে। সাধারণ লোকে যা অভাবিত তা ঘটলে পরেই পুলকিত হয়। যা ভাবিত, তা ঘটলে চমকপ্রদ হয় না ব্যাপারটা। পুলিশেরা এসব মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার ভালই বোঝে। ওকে অ্যারেস্ট করে লটকে দেওয়া সবচেয়ে সোজা। ওর মেয়েও ওকে সাহায্য করতে আসবে না।

হুমম!

 ঋজু বোস বললেন।

আপনি ঠিকই বলেছেন। তম্বি সিং-এর বিপদ আচ্চাওরই মতো। এরা যে মুরুব্বিহীন।

আপনি মুরুব্বি হন না, মিস্টার সিং? চোখের সামনে এমন অন্যায় ঘটবে, নিরপরাধ শাস্তি পাবে আর আপনার মতন এত রিসোর্সফুল মানুষ তা চোখ বন্ধ করে দেখবেন?

হঃ। হঃ। হঃ করে অনেকক্ষণ হাসলেন, থাঙ্গজম সিং।

বললেন, বোস সাহেব, আপনার ডায়ালগটা যাত্রার ডায়ালগের মতো শোনাচ্ছে। আপনিও তো মুরুব্বি হতে পারেন। আপনিই বা আমার চেয়ে কম রিসোর্সফুল কীসে? আপনার মনও নরম। আপনি ন্যায়নিষ্ঠও। আপনি নন কেন?

ঋজু বোস বললেন, এই সব মহৎ ব্যাপার শুধুমাত্র ঘরের মধ্যেই আলোচনার এবং চায়ের কাপের তলানিরই মতো আলোচনা শেষে দূরে ছুঁড়ে ফেলার। এ নিয়ে লড়তে গেলে তো ডন কীয়টে (Quixot) হতে হবে। সাড়ে পাঁচ হাজার কোটির স্ক্যামের কিনারা হল না, হবেও না হয়তো, প্রধানমন্ত্রী ঘুষ নিয়েছেন কি নেননি, তাও প্রাঞ্জল হল না আর এক কোটি টাকা দামের একটা রুবি কোথায় গেল বা ক’জন নগণ্য সাধারণ নিরপরাধ লোক জেলে পচে মরল, এসব কথা স্বাধীন ভারতে কোনও দায়িত্বশীল নাগরিকের ভাবনার আদৌ নয়।

থাঙ্গজম সিং বললেন, হঃ। দিলেন সন্ধেটাই মাটি করে। এখন একটু হুইস্কি খাব। সময় হয়েছে অনেকক্ষণ। খাবেন নাকি একটু, আমার সঙ্গে? খুব ভাল ব্রান্ড দিয়েছে একজন। ব্লু-লেবেল।

ব্লু-লেবেল? বাবাঃ! লানডান এর হিথ্রো এয়ারপোর্টেই তো তার দাম শুনে অজ্ঞান হবার জোগাড় হয়েছিল আমার।

এটা ইম্ফল। কী চান আপনি? বাঘের দুধ চান তো তাও খাওয়াব। কেন আপনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে এসেছেন জানি না। আপনার ফিস দিচ্ছে কে? তম্বি সিং? সে তো নিজে খেতে পায় না। এ রহস্য সমাধানের নয়। আমি আজ রাতেই সেন সাহেবকে ফোন করছি। যাতে এই ওয়াইল্ড-গুজ-চেজ থেকে আপনাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন, তিনি। আপনার ফিস আসলে কে জোগাচ্ছে সেটাও নতুন রহস্য। এবং কী উদ্দেশ্যে জোগাচ্ছে সেটাও গভীরতর রহস্য।

ঋজু বোস হঠাৎ বললেন, চলি। অনেক উপকার হল আপনার এখানে এসে। কেসটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

এখন কি বুঝলেন কিছু? হঃ। হঃ।

 বুঝিনি। আপনি বুঝতে সাহায্য তো করলেন কিছুটা। এই বা কম কী?

 আবার আসবেন। ফোন করবেন। এখন মণিপুরের যা অবস্থা কেউই বাড়ি না-ফেরা অবধি নিশ্চিন্তি নেই। কোথায় কখন থাকেন জানিয়ে রাখবেন আপনার হ্যোয়ারাবাউটস। যখনই গাড়ির দরকার হবে, জানাবেন।

কার-রেন্টাল কোম্পানির নামটা?

ঋজু বোস শুধোলেন।

আরে ইম্ফল কি বম্বে কলকাতা নাকি? শোফার-ড্রিভন গাড়িই বা ক’গণ্ডা আছে? পয়সা কি বেশি হয়েছে আপনার? গাড়ির জন্যে আমাকেই ফোন করবেন। আর যদি বিবেকে কামড়ায়, তাহলে না হয় তেলটা নিজেই ভরে নেবেন। গাড়ি আমি পাঠিয়ে দেব, ড্রাইভার সুষ্ঠু। সেন সাহেব জানলে কী বলবেন?

ড্রাইভারের দরকার নেই আমার।

আরে স্যার, এত জানেন আর এটুকু জানেন না? আজকাল টেররিস্টদের খুবই ঝামেলা চলছে। কোথায় যেতে কোথায় গিয়ে পড়বেন। তা ছাড়া, আমার সবকটা গাড়িই এক-হাতে রাখি। মানে, এক-একজন ড্রাইভার একেকটা গাড়ি চালায় পাঁচ হাত হলে গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। আপনি না জানলে, কে জানবে। আমার কোনওই অসুবিধা হবে না-যতক্ষণ খুশি, যতদিন খুশি রাখবেন গাড়ি। আমার কাছে আপনি হলেন, ভি. ভি. আই. পি। বুঝলেন কিনা স্যার!

থ্যাঙ্ক য়ু, সিং সাহেব।

বলেই উঠলেন ঋজু বোস।

চলুন, আমি যাই গেট অবধি।

আরে আপনি বসুন। মৌজের সময় আপনার।

কোথায় গেলে যমুনা?

থাঙ্গজম সাহেব বললেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ। যমুনাই পৌঁছে দেবে। আপনি ব্লু-লেবেল খুলুন।

যা বলেন। তাস খেলি না, জুয়া খেলি না, পুজো-আচ্চা করি আর একটু সন্ধেবেলা…। এবারে ইলেকশানে দাঁড়াব। বোঝেন তো, একটু ইমেজের কথাও ভাবতে হয়–সব জায়গায় গিয়ে তো সব কিছু সম্ভব নয়।

ঋজু বোস বললেন, তাতো বটেই! এখন ইমেজই তো সব। ইমেজ নিয়ে সকলেই মাথা ঘামায়, কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়াতে চায় না কেউই। এটাই দুঃখের।

যমুনা গেট অবধি পৌঁছে দিল। মেয়েটি অত্যন্ত সপ্রতিভ কিন্তু মুখ দেখে মনে হল যেন ভীষণই অসুখী। কোনও আনন্দই নেই।

তোমার স্বামী কোথায় যমুনা? কী যেন নাম? ভুলে গেছি।

ও কাজে গেছে।

ফেরেনি এখনও?

না। এই তো বেরুল। বোধহয় কালকে ফিরবে। কালও নাও ফিরতে পারে।

 সে কী! এ কেমন কাজ? যায় কোথায়? তোমাকেও বলে না?

সে কথার উত্তর না দিয়ে যমুনা বলল, কোথায় যায় বলে তো যায় না। যা দিনকাল।

হুমম। বললেন ঋজু বোস।

আমি অনেকবার এসেছি ইম্ফলে। তবে তোমার শ্বশুরের সঙ্গে অবশ্য বেশিদিনের আলাপ নয়। ন-দশ বছরের।

তাই? যমুনা বলল।

 মনে মনে ভাবলেন, এই কবে ফিরবে তা পর্যন্ত বলে না-যাওয়া আশ্চর্যের বই কী! কী রকম কাজ? আর এই রকম পরিস্থিতিতে।

তোমার শ্বশুরমশাই-এর কাছে যে ভদ্রলোককে দেখলাম, তিনি কোথায় গেলেন মিস্টার হাঞ্জো না কী যেন নাম?

সেও আমার স্বামীর সঙ্গে গেছে। ও আমার শ্বশুরমশায়ের বডিগার্ড। আজকে ওর সঙ্গে কেন গেল কে জানে!

চিন্তা কোরো না। চলি যমুনা। ভাল থেকো।

 ঋজু বোস বললেন।

কেন জানেন না, ঋজু বোসের মনটা এই মেয়েটির জন্যে ভারী হয়ে উঠল। এত বৈভব, এত বড় বাড়ি, এত গাড়ি, কিন্তু মনে সুখ বা শান্তি কিছুই নেই।

গেট দিয়ে বাইরে বেরুবার পূর্বমুহূর্তে একবার, অভ্যেসবশে পেছনে চাইলেন। দেখলেন, ছাদের আলসের পাশ থেকে একটি ছায়ামূর্তি হঠাৎ সরে গেল।

থাঙ্গজম সিং? ঋজু বোসকে নজর করছিল? কিন্তু কেন? কে জানে?

ঋজু বোস বাইরে বেরিয়ে ভাবলেন, একটু হেঁটে গিয়ে মোড় থেকে সাইকেল রিকশা ধরে থংগল বাজারে গিয়ে কমলা টাঁইওয়ালার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। দেখা যাক, ও কী বলে। তা ছাড়া, বিপদে-আপদে ওর সাহায্যও নিতে হতে পারে। থাঙ্গজম সিং এর হাবভাব বোলচালে একটা মাতব্বরি আছে। মাতব্বরি, ঋজু বোস একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। সে মাতব্বরি যেই করুক না কেন!

সাইকেল রিকশাতে উঠতে যাবেন, এমন সময়ে দেখলেন টাটা-সিয়েরা গাড়িটা, যে গাড়িতে ওঁরা সকালে এয়ারপোর্ট থেকে দ্য রিট্রিট পৌঁছেছিলেন, আসছে থাঙ্গজম সিং-এর বাড়ির দিকেই। সামনের সিটেই ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন তম্বি সিং। আর সেই বাঙালি যোগেন ড্রাইভারই গাড়ি চালাচ্ছে।

তার মানে, রুদ্ররা, বাংলোয় ফিরে গেছে। এবং গাড়িটা থাঙ্গজম সিং-এর।

ওরা দেখতে পাননি ঋজুকে।

গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই ঋজু রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন, হিন্দিতে, ভারী চমৎকার গাড়ি! কার গাড়ি হে?

আবার কার? থাঙ্গজম সিং লংজুর। এ-গলিতে যে সব গাড়ি ঢোকে সবই তো তারই।

যে গরিব সে বড়লোককে গালাগালি করে যে সুখ পায়, তার সেই সুখের কোনও তুলনা নেই। সেই সুখ দিয়ে দুবেলা মাখোমাখো করে ভাতও খাওয়া যায়। তবে সেই গালাগালি যে সবসময়ই অমূলক, এমনও নয়।

কী করেন ভদ্রলোক? মানে, যার গাড়ি।

কী না করেন তাই বলুন! আর ওকে ভদ্রলোকে বলবেন না বাবু।

কেন? তোমাদের এত রাগ কেন? ওঁর ওপরে?

 রাগ হবে না? থাঙ্গজম সিং তো রিকশাই চালাত আমাদেরই মতো ক’ বছর আগে। এখন রিকশা দেখলে তার উপরেই গাড়ি চড়িয়ে দেয়। যে মানুষ নিজের অতীত এত সহজে ভুলে যায়, তাকে কি গোবিন্দজি কখনও ক্ষমা করতে পারেন?

গরিব অবস্থা থেকে যদি ভদ্রলোক বড়লোক হয়ে থাকেন নিজের চেষ্টাতে, মেহনতে; এতে তো তোমাদের গর্বই হওয়া উচিত। তুমিও একদিন এমন বড়লোক হতে পার।

আমার দরকার নেই। ফুঃ। খাটনি! মেহনত! তা হলে আর এত কথা বলব কেন। স্মাগলিং-এর পয়সা।

আন্দাজে কি এমন অনুযোগ করা ভাল?

আন্দাজে? আপনি বেড়াতে এসেছেন না কাজে? কী জানেন স্যার আপনি? এতে কী না করতে হয়? এত টাকা এত ক্ষমতা তাও কি শান্তি আছে? শুনছি এবার ভোটে দাঁড়াবে। সারা ভারতেই এমন নেতাই তো এখন বেশি। নইলে দেশের অবস্থা কি এমন হত বাবু?

তা যা বলেছ ভাই। এবার একটু জোরে চলো। থংগল-বাজারে যাব। হাতে সময় কম।

থংগল বাজারে পৌঁছে রিকশাওয়ালাকে দশটাকার নোট দিল একটা ঋজু।

লম্বা সেলাম দিল রিকশাওয়ালা। বলল, গোবিন্দজি আপনার ভাল করবেন। গরিবের কষ্ট বোঝেন আপনি।

নীচে কিরানার দোকান, উপরে বাড়ি। কমলা টাঁইওয়ালা দোকানে ছিল না। তার বড় ছেলে ছিল, পবন। আদর করে বসাল। বলল, কী খাবেন? ঠাণ্ডা না গরম? এলেন কবে? কাজে না বেড়াতে? একটু খবর তো দেবেন আগে।

বাবা কোথায়?

বাবা তো গেছেন ডিমাপুরে। কোহিমাতেও কাজ আছে একটু। ফিরতে ফিরতে রবিবার।

একটু কাজেই এসেছি পবন। মোরেতে যে ইবোহাল সিং খুন হল, সে সম্বন্ধে বাজারে লোকে কী বলছে?

ও, আপনি ভার নিয়েছেন? কিন্তু আনল কে আপনাকে?

তম্বি সিং!

 এও তো এক নতুন রহস্য। আগে এ রহস্যই সমাধান করুন।

করব। তার আগে বলো, বাজারে…

বাজারের লোকের কথা শুনলে তো পাগল হয়ে যাবেন। কতরকম কথাই যে শুনছি। এমন মুখরোচক আলোচনা। যার যা খুশি বলছে। তবে, আমার অনেক সাপ্লায়ার আছে মোরের। কিছু লটর-পটর কামতো আমাদেরও করতে হয়। তবে আমরা খুন-খারাপির মধ্যে নেই স্যার। আমরা যেখানে দুটো পয়সা কামিয়ে নিতে পারি কামাই। আর সব শালাই যখন কামাচ্ছে তখন না কামানোটাই তো বোকামি। বার্মা থেকে বার্মীদের লাথি খেয়ে প্রায় এক কাপড়ে, এখানে একদিন আস্তানা গেড়েছিল দাদু। এখন যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি–এখান থেকেও লাথি খেয়ে কবে উদ্বাস্তু হতে হবে, কে বলতে পারে? আসাম থেকে চলে যেতে হয় নি কি, আমাদের কত রিস্তেদারের? সেদিক দিয়ে স্যার পশ্চিমবাংগাল, জ্যোতিবাবুর রাজ্য হচ্ছে বেস্ট। ওতো ছোট রাজস্থান। আপনাদের মতো এমন চুপচাপ, সহ্যশক্তি-ওয়ালা, নন-ইন্টারফেয়ারিং জাত আর ইন্ডিয়াতে নেই। খালি কাজকর্ম করেন না, এই দোষ আপনাদের। আপনি একসেপশান অবশ্য। বেওসাদারের স্বর্গ হচ্ছে পশ্চিমবাংগাল। পিতাজি তো সাচমুচ শোচতে আছেন কলকাতাই চলিয়ে যাবেন। এখানের সব পাট উঠিয়ে। টাকা পয়সাও সব হুন্ডি করিয়ে ওলরেডি পাঠিয়েই দিয়েছেন–যেটুকু ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল না থাকলেই নয়, সেটুকুই রেখে। অবস্থা দিনকে দিন যা হচ্ছে–যা ওরাজকতা–তাতে এখানে সোব গরবর-সরবর হয়ে যাবে মনে হয়।

পবনের সলিলকি শেষ হলে ঋজু বোস বললেন, ইবোহাল সিং-এর খুন সম্বন্ধে বাজারে কী শুনছ এবারে বলল।

আস্তে স্যার। আস্তে বলুন। দিনকাল খুবই খারাপ। কেউ জানতে পারলে আপনার জানকা খতরা হয়ে যাবে। স্মাগলিং এতো বেড়ে গেছে আজকাল যে বলার নয়। সবরকম আর্মস ও অমনিশানভি আসছে। জান বাঁচানো মুশকিল।

ঋজু বোস ভাবছিলেন, পবন নিজের গলার স্বর শুনতে খুব ভালবাসে। অবশ্য অধিকাংশ মানুষই তাই বাসেন।

বললেন, তাই?

না তো কী বলতেছি। চুপচাপ থাকবেন। আগের জমানা নেই স্যার।

লোকে কী বলছে বাজারে, তা বলবে না?

শুনতেছি, যে একটা রুবি নিয়েই আসল মামলা। মার্ডার কেন হল সে তা নিয়ে ভি নানা কোথা শুনতেছি–কে করাল তা নিয়ে ভি, কে করল একচুয়ালে সেও ভি, কিন্তু কোনটা সাচ কোনটা ঝুট, তা জানব কী কোরে বোলেন? ওই রুবিটা যদি বর্ডার পেরিয়ে চলে গিয়ে না থাকে তবে ওটা যার কাছে পাওয়া যাবে, সেই ফাঁসবে। সেই আসল কালপ্রিট। লোকটা দারু পিতাথা বহুতই–মগর জিন্দগিমে কভি কিসিসে উঁচু জবান সে বাত নেহি কিয়ে থে–এহি থা বিউটি।

একটু থেমে বলল, যেদিন মার্ডার হল, সেদিনের এক দুদিন আগে থাঙ্গজম সিং-এর লেড়কি আর তম্বি সিং-এর লেড়কি সানাহানবি হায়! হায়! কেয়া খাবসুরতি হ্যায় ওহি লেড়কি! দোনো মিলকে ইবোহাল সিংকো পাস গয়িথী।

মোরেতে? কেন?

ম্যায় কৈসে জানু স্যার?

 সানাহানবি তো যাতিহি থী, মাহিনামে এক দো দফে। উনকি হিস্ট্রি জিওগ্রাফি আপকি মালুম না হ্যায়? মগর হাঁ, লেড়কি হোতি তো অ্যায়সাই। বি আর চোপড়া কি অফারভি ফেক দি থি উনোনে। আমির খান কি এগেনস্ট মে লিড রোল মিলে থি। তব ভি। আহা, পুরি মণিপুরকি প্রাইড হ্যায় উ লেড়কি! প্রাইড! যাঁহা ভি যাতি হ্যায়, ভিড় জম যাতি হ্যায়।

ঔর থাঙ্গজম সিং কি লেড়কি?

উনকি বাঁতে ছোড়িয়ে। য্যাইসা বাপ গন্ধা, ওইসি লেড়কি ভি গন্ধী। পাইসাকে লিয়ে উতো আপনি বাপকো ভি খা যায়েগা। সিয়ারাম! সিয়ারাম!

মুসলমানেরা তওবা! তওবা! বলে যে ভাবে দুকানে দু হাতের থাবা ঠেকায়, তেমন ভাবে বলল, পবন।

তম্বি সিং লোকটা কেমন?

ইডিয়ট হ্যায় শালা! সিধসাধা বিলকুল। মগর ইডিয়ট। ইবোহাল সিংকা চামচা থা। পিনেমে জবরদস্ত, কামমে ফসসস্ হামারা তো লাগতা উও বেচারা ভি মার্ডার হো যায়েগা। মার্ডার কি বারেমে উও আদমি কুছ জরুর জানতা তোগা। অ্যায়সা তো হ্যায় আদমি, ভেলেভালা। সাচমুচ। পাগলভি হ্যায়, লাগতা থোরা। মগর, আদমি জাদা লালচি নেহি হ্যায়। খানা-পিনা ঔর বট মিল জানেসেই খুশ।

তম্বি সিং তো ড্রিঙ্ক করে না।

 ঋজু বোস বললেন।

তম্বি সিং? বলেই, জোরে হেসে উঠল, পবন টাঁইওয়ালা।

তারপর বলল, আপ বোস সাহাব অজীব বাঁতে করতে হ্যায়। এখানের মানুষের খবর আমার কাছ থেকেই শুনুন। ও ব্যাটাকে মনে হয় কেউ ফাঁসিয়েছে এই মামলাতে, ওর ঘাড়ে বন্দুক রেখে নিজের ফায়দা উঠিয়েছে। এখন জান দিয়ে দাম না দিতে হয় বেচারাকে।

ওই রুবিটার দাম কত হবে?

 উও চিজ কোই দিখা হ্যায় থোরি!

এই বাজারের কোন জুহুরি নাকি দেখেছিল?

জি হাঁ। মগর ও বুড়ুয়া কব গুজর গ্যয়ে। মগর, শুনা তো থা কুছ কড়োয়রা রুপিয়া হোগা। আপ মার্ডারার কা পিছা নেহি করকে রুবিকো পিছে যাইয়ে। আপকি কাম শর্টকার্ট হো যায়গা। মগর, বহত সামালকে রহিয়েগা। টেররিজমকি ওজেসে ইতনা আর্মস-অ্যামুনিশান সব আদমিকো হাঁথোমে আ পঁহুছা, চারোতরফ বহল গ্যায়া, আপনা আপনা জান বঁচাকে চলনাহি মুশকিল কা কাম হো গয়া। হামলোগনেত স্যার, দুকান সাত বাজি বন্ধ কর দেকে; খা-পি কে শো যায় গা। ফিন সুবে সাত বাজি খুলেগা। না মর্নিং-ওয়াক–না কুছ। তবিয়তই গড়বড়া গিয়া স্যার। তো আভূভি বলিয়ে, ঠাহরে হুয়ে কাঁহা আপ?

দ্যা রিট্রিটি মে, কোহিমার পথে। ইবোহালের বাংলোয়। আমার একটা ভাল ট্যাক্সি লাগবে পবন। ডেইলি-বেসিসে। ভাল কন্ডিশনের, ভাল-গাড়ি। ড্রাইভার না হলেও চলবে।

কোনও লারাতে ফেঁসে যাবে না তো স্যার?

 আমি তো লফরাবাজিতে নেই পবন। তোমরা তা ভাল করেই জান।

 তবে নিয়ে যান, আমার সাডুভাই-এর গাড়ি। সে আমেরিকা গেছে, হাওয়াইয়ান আইল্যান্ডে পাইন-অ্যাপল ক্যানিং-এর কোলাবরেশানের ধান্দায়। ওখানে ডোল মান্ডি বলে এক সাহেবের বিরাট ফার্ম আছে। সবকিছু মেশিনে হয়, যদি…সেই ধান্দায়। এখানের আনারসও তো কিছু কম নয়। তার নতুন মারুতি ডেলিভারি পেয়েছি, মাত্র কাল। এখনও গারাজ নাম্বার লাগানো। রেজিষ্ট্রি যদিও হয়ে গেছে, নাম্বার প্লেট করা হয়নি। নীল মারুতি-ভ্যান। তেলও ভরা আছে ফুলট্যাঙ্ক। যতদিন খুশি ব্যবহার করুন। ড্রাইভার দিতে পারতাম। কিন্তু ভাল ড্রাইভার নেই। নতুন গাড়ি, খারাপ করে দেবে। আমাদের ভি কুছ কাম আছে কলকাতাতে, সেন সাহেবের কাছে। গৌহাটির ইনকামট্যাক্সের কমিশনার সাহেবের কাছে টু সিক্সটি ফোরের পিটিশান পড়ে আছে একটা। সেন সাহেব ছাড়া আর কাউকে দিয়ে হোবে না। ফাইলিং করতে ভি লেট হয়ে গেছে অনেকদিন। ডিলে কোনডোনেশানের বেপার ভি আছে।

ইনকামট্যাক্সের আমি কিছু বুঝি না। ওসব তুমি একটি চিঠিতে লিখে দিয়ে দিও। আমি নিজে পৌঁছে দেব। নয়তো, ফোনে কথা বলে নিও। অনীকের সঙ্গে।

ঋজু বোস বলল, এবারে লক্ষ্মী ছেলে, তুমি আমাকে মণিপুরের চিফ সেক্রেটারি আর আই, জি, সাহেবের বাড়ি আর অফিসের ফোন নাম্বারটা লিখে দাও তো। আমার কাছে টেলিফোন ডিরেক্টরি নেই।

আমার কাছে স্পেয়ার আছে এক কপি। আজই তো নতুন ডিরেক্টরি এল। আনতেই গেছিলাম, তো, দুটোই লিয়ে এলম। একটা গদিতে থাকবে। আর একটা বাড়িতে। আপনি নিয়ে যান। কাম হয়ে গেলে, যাওয়ার আগে দিলেই হবে।

তো তোমার গাড়ি কই? তোমার বাবা কিছু বলবেন না তো?

কী যে বলেন স্যার। আমরা বানিয়া হচ্ছি। আপনার জন্যে যাই করি না কেন। সব পরে পুষিয়ে লিব। কামকা আদমিকো খাতিরদারি করনা বাপদাদানে বচপনসে শিখলায়। আপনার জন্যে না করলে আমার নোকরি খেয়ে লিবে পিতাজি আর বুড়ুয়া ভি।

অব চোলেন স্যার।

মারুতি ভ্যানটা ওদের দোকানের গদির পেছনে যে ফাঁকা জায়গা আছে যেখানে চাল ডাল চিনি খোল-ভূষি-মশলার বস্তা ডাঁই করা থাকে; ওরা তো হোলসেলার; সেখানেই পার্ক করা ছিল। চাবিটা দিয়ে দিল পবন। বলল, আইয়ে স্যার। মেরা সাডুভাইকি খুশনসিবি যো আপহিকি হাতোসে গাড়ি বউনি হো রহি হ্যায়।

গাড়িতে স্টার্ট দিলেন, ঋজু বোস।

পবন বলল, নমস্তে স্যার। ঠাণ্ডা-গরম কুছ ভি নেহি লেকে আপ চল্ দেতে হেঁ, উসকি লিয়ে ভি হামকো ডাঁটেগা পিতাজি।

ঋজু বোস আস্তে গাড়ি চালিয়ে, বেরিয়ে এলেন ওদের কম্পাউন্ড থেকে। ভাবছিলেন, এই মারোয়াড়ি জাতটাকে যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর নিজের মতন, তাঁরা ভাল করে জানেন, জাতটার এই রকেটের মতন উত্থানের রহস্য। গুণ, কিছু কম নেই এই জাতের। সেই সব গুণের কিছু অন্তত বাঙালিরা শিখতে পারলে, আমাদের অনেকটাই উন্নতি হত। ব্যবসাতেও ব্যবহার, সময়ানুবর্তিতা, কথার দাম, এবং অবিশ্বাস্যরকম পরিশ্রম করার ক্ষমতার গুণেই ওঁরা এত উন্নতি করেছেন। আমরা বাঙালিরা এঁদের গুণগুলোর কথা একবারও বিবেচনা না করে দোষগুলো নিয়েই চর্চা করে আজকে নিজেদের ভিখিরি বানিয়েছি। এ লজ্জা আমাদের রাখার জায়গা নেই; লজ্জাবোধ বলে যদি আমাদের কিছুমাত্রও এখনও থেকে থাকে।

পেছন থেকে হঠাৎ পবন ডাকল, বোস সাব। বোস সাব।

তাড়াতাড়ি ব্রেকে পা দিয়ে গাড়ি দাঁড় করাতেই পবন পেছন থেকে দৌড়ে এসে বলল, আপনাকে এখানে কমিশান করে কোন পার্টি এনেছে? মানে, আপনার ফিস দেবে, কোন পার্টি?

তম্বি সিং। বললামই তো!

তম্বি সিং! সইত্যানাশ হো গ্যায়া। আভি তো হামকোভি ডিটেকটিভ বননা হ্যায়। আপকি ফিসতো গ্যায়াই, জানভি যানে শকতা হ্যায়। হামলোঁগোকা নেহিতো দুসরা কিসিকো আপ জারা পুছনে শকতা থা, হিয়া আনেকা পহিলে। যো আদমি আপকো জান-পুছকর লেতে আয়ে হুয়ে হ্যায়, উসকো জরুর কুছ মতলব হ্যায়। বেক। মগর ঊ্য হ্যায় কওন? পিতাজি আনেসেই আপকো পাস ভেজেগা। হামকো রোজ ফোন কিজিয়েগা একদফে, জরুরত কুছ পড়ে ইয়া নেহি৷ বহত চিন্তামে ডাল দিয়া আপ মুঝকো।

.

রাতে, খেতে বসে, ঋজুদা বলল, একটা ব্লাইন্ড ডিসিশান নিতে হবে। কাল কাকভোরে কাঙ্গপোকপিতে যাব, না মোরেতে? এই দু জায়গাতেই যাওয়াটা সমান দরকার। যাক, গাড়ির সমস্যা যে মিটেছে, এটাই মস্ত বড় কথা।

তুমি এত দেরি করলে! চিন্তা করছিলাম আমরা। ফোন ডিরেক্টরিটা থাকলেও…সেটাও তো সরিয়ে ফেলেছে।

সরায়নি, ফোন ডিরেক্টরি সত্যিই বদলাতে পাঠিয়েছিল। নতুনটা আনবার জন্যে।

কী করে জানলে?

জেনেছি।

খাওয়া দাওয়ার পর তিতির বলল, দু জায়গাতে যাওয়াই সমান দরকার হলে, টস্কর ভটকাই। হেড হলে মোরে, আর টেল হলে কাঙ্গপোকপি।

ডিনার চমৎকার করেছিল। ওয়েস্টার্ন। মুলিংগাটানি স্যুপ। তিতির দেখেই মুখ ভেটকেছিল। ও দেখতে পারে না। মাছের মেয়োনিজ। কী মাছের বোঝা গেল না। ভেটকিও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। চিকেন রোস্ট। পাইন্যাপল–পাই। সঙ্গে ব্রেড-রোলস, ক্রোঁশো এবং টোস্ট। যার যা খুশি।

এত সুন্দর রোল আর ক্রোঁশো কোথায় তৈরি হয়?

 …বাবুর্চিকে শুধোলো তিতির।

শিলং-এর পাইনউড হোটেলের বেকারি ডিপার্টমেন্টের একজন চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে ডাংজাথাং সাহেবের সঙ্গে পার্টনারশিপে বেকারি করেছেন। চিজ স্ট্র, নানারকম কেক, ব্ল্যাকফরেস্ট, প্যাটিস, কলকাতার কুকিজার’ থেকেও একজনকে ভাগিয়ে এনেছে। খুব ভাল বানাচ্ছে সব। ওদিকে আইজল, নাগালান্ডের কোহিমা এবং ডিমাপুর; বার্মার তামু, পান্থ, মিন্থ, থংডুট এবং পংবীন পর্যন্ত চালান যাচ্ছে। মণিপুরের মধ্যেও কম চাহিদা নেই।

বাঃ। ঋজুদা বলল। তারপর বলল, টসটা কর ভটকাই।

সঙ্গে সঙ্গে বারান্দাতে আলোর নীচে দাঁড়িয়ে টস করল ভটকাই। টেল হল। অতএব, কাঙ্গপোকপি।

তিতির বলল, ইচ্ছে করে টেল ফেলেছে। ওর প্রথম থেকেই কাঙ্গপোকপিতেই যাবার ইচ্ছে।

ভটকাই রেগে বলল, বেশ তো। তোমরা ফের করো, নতুন করে।

 চল, বসার ঘরে গিয়ে বসি।

 চলো।

 বলল, ঋজুদা, কোথায় গেলে? কাদের সঙ্গে দেখা করলে? কী বুঝছ?

যতই বোঝার চেষ্টা করছি ততই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। মিস্টার তম্বির ওয়ার্থ নাকি পাঁচ পয়সাও নয়। ওঁর পেছনে অন্য কেউ আছেন। তিনি পুরো ইস্যুটাকে কনফিউজ করে দেবার জন্যেই আমাকে এখানে ডেকেছেন, যাতে তাঁর সুবিধে হয়। আজ না হয় কাল পুলিশ আমার সঙ্গে যোগযোগ করবেই, কারণ, কৃষ্ণমূর্তি সাহেব এখানের চিফ-সেক্রেটারিকে টেলেক্স পাঠিয়ে দিয়েছেন।

এত উপর মহলে হল্লা হলে কেস আবার গুবলেট হয়ে যাবে না তো? আসল তো নিচুমহল।

ভটকাই বলল।

সেটা অবশ্য ঠিক। কিন্তু উপায়ই বা কী ছিল? যাতে আসল অপরাধীকে ধরা পুলিশের পক্ষেও অসুবিধের হয়, অথবা পুলিশদের ভুল বা ইচ্ছে করে ভুল সিদ্ধান্ত যাতে আমার ভুল সিদ্ধান্তে আরও পাকা-পোক্ত হয়, সে জন্যেই আমাকে ডাকা। তম্বি সিংকেও মেরে দিতে পারে, যে আসলে তাকে পাঠিয়েছিল আমার কাছে, সে।

তম্বি সিং যে আসল লোক নয়, এটা কিন্তু আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল। মনে আছে, তোমার? কলকাতাতে তুমি যখন রশিদের কথা ওঠালে, তখন তম্বি সিং বললেন, যে টাকা পাঠিয়েছে তার রশিদের দরকার নেই। যখন বললে যে, দশহাজারের বেশি কোনও খরচ ইনকামট্যাক্সে মানবে না, তখনও উনি বললেন, ও যার ব্যাপার সে বুঝবে।

আমি বললাম।

ঋজুদা হাসল। বলল, মনে আছে।

 তিতির বলল, এই কেসে আর ফিস টিস-এর কথা তোমার ভুলে যেতে হবে। এখন মানে মানে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফেরাই যথেষ্ট সকলের। বিশেষ করে, ঋজুদার। বেঁচে থাকলে অনেক গোয়েন্দাগিরি, শিকার ও অ্যাডভেঞ্চার হবে।

ভটকাই বলল, ছিঃ ছিঃ। একি শুনি মন্থরার মুখে? তুই কি ঋজুদারই সাগরেদ? ওপেন রিটার্ন টিকিট তো পকেটেই আছে। একটা কাজ করতে এসে শেষ না দেখে আমি অন্তত যাব না। ইচ্ছে করলে, তোমরা সকলে চলে যেতে পারো আমি একাই রয়ে যাব ঋজুদার সঙ্গে। রুদ্রর পিস্তলটা শুধু চাই। আমাদের বাগবাজারে একটাও দশতলা বাড়ি নেই কিন্তু তোরা কি জানিস যে, কলকাতা থেকে যত মাউন্টেনিয়র পাহাড় চড়তে যায়, তাদের মেজরিটিই আসে বাগবাজার থেকেই, তোদের সাউথ ক্যালকাটা থেকে নয়। অ্যাডভেঞ্চারের! বিপদের গন্ধ যখন পেয়েছি তখন পুলিশের কুকুরের মতো আমি তার পিছু নেব। যা কপালে আছে তা হবে।

ঋজুদা বলল, রাত সাড়ে দশটা। এবারে সকলেই শুয়ে পড়। আমরা ঠিক সাড়ে চারটেতে বেরোব। বাবুর্চিকে বলে রাখ চারটেতে চা চাই। তার ওঠার দরকার নেই। নাইটওয়াচম্যান ঘরে পৌঁছে দিলেই হবে।

শুধুই চা? একটু বিস্কুটও না?

 ভটকাই বলল।

 ঠিক আছে। শুধুই বিস্কিট। গুড নাইট। কাল কথা হবে। সময় লাগবে কাঙ্গপোকপি পৌঁছতে।

সকালে বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখি রীতিমতো, যাকে বলে ক্যালামিটি। ভটকাইচন্দ্রর ডান পাটি তার খাটের নীচে মশারি ভেদ করে ঝুলে রয়েছে, বাঁ পাটি খাটের ভিতরে আর তার মাথাটি, মাথাতো নয়, যেন আন্দামানের একটি দুষ্প্রাপ্য সাদা কচ্ছপ, মশারির সঙ্গে সেঁটে রয়েছে। সাধু বাংলাতে যাকে বলে, অঙ্গাঙ্গীভাবে। আর ভটকাই জালে পড়া চিতাবাঘের মতো ফাঁসফোঁসস শব্দ করে যাচ্ছে সমানে, দুখানা হাত আর মশারিতেই আটকে-যাওয়া একখানি পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে।

ব্যাপারটা বুঝতে আমার সামান্য সময় লাগল এবং বুঝতে পেরেই হো হো করে হেসে উঠলাম আমি।

ভটকাই একটা সংক্ষিপ্ত বাক্য, উড়নতুবড়ির মতো আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। তার অর্থ, আমি ছাড়া, অথবা যিনি জঙ্গল মহল না পড়েছেন, আর কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব ছিল না। বাক্যটা হল খদ্দাকারেকছস। অর্থাৎ খবর্দার কাউরে যদি কইছস। জঙ্গল মহল-এর মাইরেন এবং মাইরেননা গল্পে জামাই বাবুর ডায়ালগ। জামাইবাবু ঘুমের মধ্যেও পান খেতেন–তাই তাঁর সব কথাই অমন জড়িয়ে যেত।

ভটকাই নিজের বাগবাজারত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে, বিপদে পড়ে সেই বাঙালপতিরই শরণাপন্ন হল।

আমি এসে মশারির ফাঁস থেকে উদ্ধার করে বললাম, আরও স্টান্ট দেবার জন্যে, তামিল ব্রাহ্মণ সাজবার জন্যে ন্যাড়া হতে যাও।

ওর ন্যাড়া মাথাতে দু তিন মিলিমিটার মতো চুল গজিয়ে গেছিল–শুয়োরের চুলের মতো খোঁচা খোঁচা; মোটা চুল। যেমন বুদ্ধির বাহার তেমনিই চুলের। ন্যাড়া হওয়ার পর কিছুদিন মশারি থেকে দূরে থাকাই ভাল। তখন মশারি, মশার অরি না হয়ে ন্যাড়ার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

 প্রথম প্রাতেই এমন কেলো করলি। ছিঃ।

 আমি বললাম।

ভোরবেলা চা দিয়ে বেয়ারা দরজাতে ধাক্কা দিল। তিতির চা খায় না। তাই ভটকাই তিতিরের ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে গাইতে লাগল, ভোর হল দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে।

যখন গাড়িতে উঠছি আমরা, তখনও অন্ধকার। সবে আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। পাখি ডাকছে বাগান থেকে। নানারকম। তার মধ্যে ব্যবলার, থ্রাশার, বুলবুলি, টুনটুনি, শালিক এবং দাঁড় কাকেঁদের গলাই প্রধান। পেছনের ফাঁকা হয়ে যাওয়া জঙ্গল থেকে বনমোরগ। হঠাৎ একটা ময়ুর ডেকে উঠল, বুকের মধ্যে চমক তুলে। এখনই বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব একটা। দিনরাত্রের এই সময়টাতেই পৃথিবী সবচাইতে শান্ত, স্নিগ্ধ, সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশায় ভরা। রোদ উঠে গেলেই কারও আশা পূরবে, কারও আশা ভাঙবে। এই সময়টা আমার তাই সবচেয়ে ভাল লাগে।

ভটকাই আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, জানি কী ভাবছিস। আমি রোজ এই সময় উত্তর কলকাতার পথে পথে হেঁটে বেড়াই। ঘুম-ভাঙার আগে কলকাতার জীবন দেখতে দারুণ লাগে আমার। চোখে কেতুর-লেগে থাকা কলকাতা।

ঋজুদা বলেছিল, সকলের ব্যাগও সঙ্গে নিয়ে নিতে। কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই। কাল রাতেই বাবুর্চি বেয়ারাদের বকশিস টকশিসও দিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আমরা ফিরলে তখনই রান্না-বান্নার কথা বলব। কবে কখন ফিরব তার ঠিক নেই। আমরা যাচ্ছি লকটাক-এ। সেখান থেকে কোথায় যাব তাও জানা নেই।

গাড়িতে উঠতে যাব ঠিক এমন সময়ে ফোনটা বাজল। তিতিরই দৌড়ে গেল। ফোন ধরেই চেঁচিয়ে বলল, ঋজুদা তোমার ফোন।

এই সময়ে?

ভুরু কোঁচকাল ঋজুদা। তারপর ফোন ধরে এসে, মারুতি ভ্যানে উঠে পড়ে, সামনের, বাঁদিকের সিটে বসল। বলল, রুদ্র তুইই চালা। আর ভটকাই, তোর রসিকতা এখন কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ রাখ।

গাড়ি স্টার্ট করে, কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে পথে পড়তেই ঋজুদা বলল, ব্যাড নিউজ…

কী? তিতির শুধোল।

তম্বি সিং…

তম্বি সিং মার্ডারড?

ভটকাই প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল।

না। তম্বি সিং ফোন করেছিলেন যে, ইবোবা সিংকে কে বা কারা কাল মধ্যরাতে মোরের পথে থেংনোপালের ঘাটিতে হঠাৎ একটি বাঁকে, রোড ব্লক সেট করে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। গাড়িটাও প্রায় খরচের খাতায়। খুন করেছে।

লোকটা কে? ইবোবা সিং?

থাঙ্গজম সিং-এর ছেলে।

 থাঙ্গজম সিং? সে আবার কে?

 থৈবী দেবীর বাবা।

থৈবী দেবী? সেই বা কে? থৈবী-খাম্বার কথা তো শুনেছি, সে তো… তুমিও হেঁয়ালি করছ ঋজুদা।

তিতির বলল।

না হেঁয়ালি নয়। এর নামও সেই লেজেন্ডারি রাজকুমারীর নামেই রাখা হয়েছে।

যাঃ বাবা। কী হেঁয়ালিরে।

হুঁ।

ঋজুদা আপন মনে বলল।

ফোনটা করল কে?

আমি বললাম।

তম্বি সিংই।

তিনি জানলেন কখন? কোত্থেকে। তিনি এখন কোথায়?

জানি না কোত্থেকে ফোন করলেন। কিন্তু তিনি খুব প্যানিকি হয়ে গেছেন। গলা শুনেই মনে হল, প্রকৃতিস্থও নেই। সারারাত হয়তো মদ-টদ খেয়েছেন।

তার মানে, খবরটা আগেই পেয়েছিলেন?

হতে পারে। তবে এখুনি তো জানা যাবে না। হাঞ্জো সিংও মারা গেছে।

এরা কারা? মানে, এই ইবোবা সিং, থৈবী সিং, থাঙ্গজম সিং? হাঞ্জো সিং?

পরে জানবি। এখন একটু ভাবতে দে আমাকে। গাড়িটা একটা মোড়ে এসে পৌঁছতে আমি বললাম, এবারে ডানদিকে না বাঁদিকে? কোনদিকে টার্ন নেব, ঋজুদা।

সোজা, সোজা। সোজা যা। তারপর ভাল করে শুনে নে। সামনে পাঁচ ছ’ কিলোমিটার গিয়েই আরেকটা মোড় পাবি। বাঁদিকে যাবি, সেখান থেকে দশ কিমি মতো যাবার পরই কাঙ্গলোটংবি। সেখান থেকে সোজা গেলে কাঙ্গপোকপি, বাইশ তেইশ কিলোমিটার মতো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর জঙ্গল আরম্ভ হবে। আগে এই সমস্ত জায়গাই, যেখানে আমরা রয়েছি সেই দ্য রিট্রিট-এ, তার পাশেও অত্যন্ত গভীর জঙ্গল ছিল। আশ্চর্য! এমন একটা রাজ্য নেই ভারতবর্ষে, যেখানে বনজঙ্গল শেষ না করা হয়েছে। ভাবলেও কষ্ট হয়।

ভটকাই বলল, কাঙ্গপোকপি থেকে কোহিমা কত দূর?

কাঙ্গপোকপি থেকে?

 হ্যাঁ?

কত আর বড়জোর একশো কি.মি. হবে।

 আর মাও? নাগাল্যান্ডের বর্ডার?

মাও হবে পঁচাশি ছিয়াশি কিমি মতো।

আর, কোহিমা থেকে ডিমাপুর কতদূরে?

 চুয়াত্তর পঁচাত্তর কিমি হবে। মুখস্থ করে রেখেছি কি? ডিমাপুর তো সমতলে। রেল স্টেশন আছে। কোহিমা থেকে ডিফু নদীকে বাঁ পাশে রেখে, পথটা বাঁক নিতে নিতে কোহিমাতে পৌঁছয়। সেই পথটুকু ভারী সুন্দর।

বলেই চুপ করে গেল।

শোন, তোদের একটা কথা বলে রাখি। এখুনি বলা দরকার। কাঙ্গপোকপিতে সানাহানবির ফার্মে গিয়ে থৈবী দেবী বলে একজন মেয়ের সঙ্গে দেখা হতে পারে তোদের। আমিও তাকে দেখিনি কখনও। মানে, না থৈবীকে না ইবোবাকে। সানাহানবির মতোই হবে হয়তো বয়স মেয়েটির। তবে দেখা যে হবেই, এমনও জোর করে বলতে পারি না। কারণ, তার এখন কোহিমাতে থাকার কথা। তবে মন বলছে, হবে। আমি বা তোরা কেউই তার কথা জানি বা জানিস তা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করবি না। বুঝেছিস। আর তিতির, তুই তার সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব করে রাখিস। যে থৈবী দেবীর কথা বলছি, তার দাদাই খুন হয়েছে গত রাতে। সে খবরটা সে হয়তো পেয়েও গেছে। নাও পেতে পারে। কিন্তু খুন হবার সম্ভাবনার কথা তার জানা আছে সম্ভবত! বেচারি যমুনা।

যমুনা আবার কে?

আছে। আছে। তোরা কি সকলকেই চিনিস? থৈবী যদি খবরটা কাঙ্গপোকপিতে পেয়ে থাকে, তবে রওনা হয়ে হয়তো ইম্ফলে এতক্ষণে চলে গেছে। এখনও কিছু সম্বন্ধেই শিওর নই। দেখি কোনও সাদা মারুতি কি দেখলাম আমরা? আমাদের ক্রস করে যেতে, ইম্ফলের দিকে?

না তো! আমি এমফ্যাটিকালি বললাম।

এমন সুন্দর সকালে একটা মৃত্যুর কথা শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেছিল। মৃত্যু, সে যার মৃত্যুই হোক না কেন, মনকে ব্যথিত করেই। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ফর হুম দ্য বেল টোলস উপন্যাসের আগে আছে না? For Whom the bell tolls, the bell tolls for thee! প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুর মধ্যেই আমাদের প্রত্যেকের মৃত্যুই নিহিত আছে।

সালুকি কুকুর সম্বন্ধে তুমি কিন্তু কিছুই বলোনি ঋজুদা, এখনও আমাদের।

আরম্ভ হল এভার-ইনকুইজিটিভ ভটকাই-এর অন্তহীন প্রশ্নবাণ। এই সুন্দর সকালে মৃত্যু থেকে ও পালাতে চাইছিল আসলে।

সালুকি হচ্ছে, কুকুরদের রাজা। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস আর সালুকির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের আবিষ্কারে দেখা গেছে যে, আদিমতম গুহাগাত্রের আঁকা ছবিতে, কবরের উপরে খোদিত ছবিতে, সালুকিদের ছবিও রয়েছে। তারাই হয়তো কুকুরদের আদিপুরুষ। খ্রিস্টপূর্ব দু-হাজার থেকে সাত-হাজার শতাব্দীতেও যে এরা ছিল তারও প্রমাণ আছে। এমনকী খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ধর্মপুস্তক বাইবেলেও, যেখানেই কুকুরের কথা আছে, সেখানেই ধরে নেওয়া হয় যে, সালুকির কথাই বলা হচ্ছে। লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চির পৃথিবী বিখ্যাত ছবি, দা লাস্ট সাপার-এও সালুকিদের ছবি আছে। মুসলমানরা কুকুর আর শুয়োরকে হারাম’ বলেনকারণ, তারা নোংরা। এই দুই প্রাণী সম্বন্ধে তাঁদের ধর্মীয় অনুশাসনে নানা বিধিনিষেধ আছে। এই হারাম থেকেই হারামজাদা শব্দের উদ্ভব। কিন্তু সালুকির বেলা ইসলামেও ব্যতিক্রম করা হয়েছে। সালুকিরা শেখদের নিজের তাঁবুতে স্থান পেয়েছিল। এমনকী মিশরের ফারাওদের মতোই এদেরও মমি রাখা আছে। নীলনদ-এর উত্তরভাগের অসংখ্য প্রাচীন কবরের মধ্যেও নানা জাতের সালুকির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে। ক্যাসপিয়ান সি থেকে সাহারা, মিশর, অ্যারেবিয়া, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, অ্যানাথলিয়া এবং পারসিয়া পর্যন্ত এদের পাওয়া যেত, সেই সুপ্রাচীন কালেও।

তা এই কুকুর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেল কী করে?

তিতির শুধোল।

যে করে সমস্ত ভাল বা খারাপ জিনিসই ছড়িয়ে যায়।

 তবু বলো না, বিশদ করে।

যতদূর আমি খোঁজ রাখি, অবশ্য বইপড়া বিদ্যায়; তাতে জেনেছি যে, আঠারশো চল্লিশ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্যার হ্যাঁমিলটন স্মিথ, একটি সালুকি কুকুরী নিয়ে আসেন ইংল্যান্ডে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে। একটা পুরুষ সালুকির কথাও শোনা যায়, ওই সময়েই লানডান-এর রিজেন্ট পার্ক চিড়িয়াখানাতে ছিল বলে। সমসময়েই, আরও একটি কুকুর ছিল চ্যাটসওয়ার্থ-এর ডিউক অফ ডেভনশায়ারের কাছে। এমনি করে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের সেই সময়কার ইংল্যান্ডে বলা হত পারসিয়ান গ্রে হাউন্ড। পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যে ইংরেজ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অফিসারদের কাছ থেকে এই কুকুর সম্বন্ধে ব্রিটেন ওয়াকিবহাল হয়।

একটা সময়ে, পৃথিবীতে ব্রিটেন আর জার্মানি যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, মেধাবী এবং প্রতিভাবান জাত বলে স্বীকৃত হয়েছিল এবং দুঃখজনক হলেও যার অমোঘ পরিণতি সংঘাত; সেই সময়ের ইতিহাস নাড়াচাড়া করলেই তোরা দেখতে পাবি যে, যে-কোনও জাত যখন বড় হয়, তখন সেই সব জাতের বড়ত্বর মাপ শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনৈতিক সাফল্যের পরিমণ্ডলের এবং মাপ দিয়েই চিহ্নিত হয় না। ফুল, পাখি, প্রজাপতি, কুকুরের প্রতি আগ্রহ থেকে তা পুরাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, দর্শন এই সমস্ত বিষয়েই উপচে গিয়ে পরিব্যাপ্ত হয়। সভ্যতা ব্যাপারটা জীবনের কোনও এক বিশেষ ক্ষেত্রে কোনওদিন আবদ্ধ থাকেনি। থাকে না। যাঁরা অগ্রগণ্য, তাঁরা জীবনের সমস্ত টুকরো-টাকরাতেও অগ্রগণ্য হন।

আমাদের দেশ শাসন করতে এসে ইংরেজ আই. সি. এস. অফিসাররা আমাদের দেশের গহন গভীরে গিয়ে আমাদের আদিবাসীদের তত্ত্ব-তালাশ করে, ফুল পাখি, প্রজাপতি, জন্তু-জানোয়ার, উদ্ভিদ ও প্রাণীবিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁদের গভীরতা ও তীক্ষ্ণ মেধার স্বাক্ষর যেমন রেখে গেছেন তাঁদের লেখা বিভিন্ন জেলার গেজেটিয়ারে, তেমন গত চল্লিশ বছরেই কোনও আই. এ. এস. অফিসারের কাছ থেকে তো পেলাম না। যাঁরা পারেন, তাঁরা শাসন যেমন করতে পারেন, ভালওবাসতে পারেন। আর যাঁরা ভালবাসতে শিখেছেন, যত্ন করতে শিখেছেন, তাঁরা নিজের জিনিস আর পরের জিনিসে তফাত করতে ভুলে যান। জার্মান মিশনারিরা যা কাজ করে গেছেন ভারতের নানা আদিবাসীদের সম্বন্ধে, যেমন ফাদার হফম্যান; তেমন মিশনারিদের দেখা কি আজকাল পাওয়া যায়?

তুমি বড় বুড়ো বুড়ো ভাব করছ আজকাল, ঋজুদা।

বুড়োরা যেমন এ যুগের সবকিছুই খারাপ দেখে–সবসময়েই আমাদের সময়ে এই ছিল, আমাদের সময়ে ওই ছিল,এখনকার ছেলে-ছোকরা খারাপ, তাদের পোশাক খারাপ, তাদের বুদ্ধি খারাপ, তাদের বড়দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই, তাদের মাইকেল জ্যাকসন, উষা উথুপ, মাধুরী দীক্ষিত, রূপা গাঙ্গুলি সবাই খারাপ ইত্যাদি ইত্যাদি…তুমি তেমনই কর আজকাল। তুমিও কি বুড়ো হচ্ছ না কি?

আমি বললাম।

বার্ধক্য এমনই জিনিস যে, কারোকেই কোনও গেসসসওয়ার্ক-এর সুযোগ দেয় না। সে তো আসবেই একদিন না একদিন। আটকানো তো যাবে না। তবে যখন আসে, তখন তার পদধ্বনি ঘরে বাইরে সকলেই শুনতে পায়। প্রার্থনা করিস, যেন যতদিন সম্ভব তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি। আর যখন আসবেও, যেন তার সঙ্গে লাঠালাঠি না করে গলাগলি করে দিন কাটাতে পারি।

তিতির বলল, ভাগ্যিস তুমি ওর মধ্যে গুরুর নামটাও ধরোনি। তা হলে নিজের বুমেরাংয়ে তো নিজেই কাৎ হয়ে যেতে, ঋজুকাকা। আমাদের সব গুরুরাই খারাপ, এ কথা আর যেই হোক, তুমি বলতে পারো না।

সকলেই হেসে উঠলাম আমরা।

ঋজুদা বলল, আমরা একটু বেশি আগে বেরিয়ে পড়েছি, বুঝলি। একজন মহিলার এবং তরুণীর বাড়িতে আগে না জানিয়ে চারজন আগন্তুকের পক্ষে ব্রেকফাস্ট টাইমের আগে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হওয়া যায় না। একটু আস্তে চালা রুদ্র। আমরা কাঙ্গপোকপিতে পথপাশের কোনও চায়ের দোকানে, গরম গরম জিলিপি বা সিঙ্গারা বা কচুরি দিয়ে গরম চা খেয়ে তারপই সানাহানবির ফার্মে যাব।

জিলিপি-সিঙ্গারা পাওয়া যাবে? এইসব অঞ্চলে?

জিলিপি-সিঙ্গারা না হলেও চায়ের সঙ্গে অন্য কিছু মিষ্টি ও নোনতা অবশ্যই পাওয়া যাবে। যেখানেই পথ, সেখানেই সর্দারজি; সেখানেই ধাবা। আর বাবা থাকলেই কিছু না কিছু খাবার। যে সময়ের যেমন। যাই বলিস, অনেকদিন হয়ে গেল পুরনো-মবিলে ভাজা সিঙ্গারা খাইনি। মাঝে মাঝে অখাদ্য-কুখাদ্য না খেলে ইস্যুনিটি বাড়ে না। গদাধর সূর্যমুখীর তেলের রান্না খাইয়ে খাইয়ে জিবের স্বাদই দিয়েছে খারাপ করে। পুরনো, ব্যবহৃত-মোজাতে ছাঁকা এবং কাঠের গুঁড়ো মেশানো চায়ের গুঁড়োর চা, পুরনো-মবিলে ভাজা কচুরি সিঙ্গারা এবং জিলিপি, এ সব স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে মাঝে মাঝে অবশ্যই খাওয়ার দরকার।

যা বলেছ ঋজুদা! সবসময় এই তিতিরের মতো পুতুপুতু–এখানে খাব না, ওখানে খাব না, এটা খাব না; সেটা খাব না–এদের নিয়ে বেরোনোই যায় না। সাধে কি শাস্ত্রে বলেছে, পথি নারী বিবর্জিতা! আমরা বাবা গরিব পাড়ার লোক। সকালে উঠে ম্যানাদার দোকান থেকে সারাদিনের পোড়া কালো বাসি তেলে ভাজা এক টাকার হাতে-গরম তেলে ভাজা খেয়ে নিই। ব্যসস। সারাদিন আর খাওয়ার খরচাই নেই। গরিব দেশের গরিব পাড়ার এই হচ্ছে প্রধান খাদ্য। তোমরা ইংজিরিতে যাকে বল স্টেপল ফুড।

সেকী? তাতেই সারাদিন?

তিতির অবাক হয়ে শুধোল ভটকাইকে।

না। তারপরই জল খেতে হবে দু’গ্লাস। খেলেই পেট একেবারে ভরে যাবে, টইটম্বুর ভরে থাকবে সারাটা দিন। আইঢাই করবে পেরান।

সে কী? কীসে?

কেন? অম্বলে। দিশি লাইফ-সেভিং ড্রাগে ভেজাল পাবে, কিন্তু অম্বলে নয়। পিওর বেঙ্গলি অম্বলে। র‍্যানটাক, পলিক্রল, জেলুসিল এম. পি. এস, কোনও অ্যানটাসিডের বাবার সাধ্য নেই যে, সেই বিশুদ্ধ অম্বলের কাছে ট্যাঁ-ফোঁ করে।

হো হো করে হেসে উঠল, ঋজুদা।

তারপরই গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, ওখানে পৌঁছে তো কথাবার্তা বলার সুবিধে হবে না। তা ছাড়া তেমন বুঝলে, সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্গপোকপি ছেড়ে আমাদের অ্যাবাউট টার্ন করে মোরে তে চলে যেতে হতে পারে। সানাহানবির কাছে বড় জাতের কুকুর কী আছে, একটু ভাল করে খোঁজ করিস তো।

বড় জাতের কুকুর মানে? অ্যালসেশিয়ান?

আমি বললাম।

তার চেয়েও বড় জাতের কুকুর আরও অনেক আছে।

 যেমন?

 কুকুরদের সাধারণত ছটি ভাগে ভাগ করা হয়। ধর, স্পোর্টিং ডগস, হাউন্ডস… দ্য হাউন্ডস অফ দ্য বাস্কারভিল, শালর্ক হোমস।

ভটকাই বলে উঠল।

আঃ। শোন না।

তিতির ধমকাল, ভটকাইকে।

 হাউন্ড, ওয়ার্কিং–ডগস…

মানে? চাকরি করে, ওয়ার্কিং-গার্লসদের মতো?

আঃ ভটকাই, আমি বললাম।

ওয়ার্কিং ডগস, টেরিয়ারস, টয়েজ…

টয়েজ? খেলনা? খেলনা কুকুর?

হ্যাঁরে বাবা। শোন না। এবং নন-স্পোর্টিং ডগস। এই ছয় ভাগ, ব্রডলি।

 তা বড় কুকুর বলতে তুমি কী বলছ?

সবই বলছি। ধর, সেইন্ট বার্নাডস, জার্মান শেফার্ড ডগস, জায়ান্ট শ্লোজার নাম শুনেই বুঝছিস জার্মান, গ্রেট-ডেন, কুলি (রাফ), মাস্টিফ; কত কুকুর আছে! একটু নজর করবি। বুঝলি।

কেন বলছ?

সে পরে বলব।

কাঙ্গপোকপি পৌঁছে পথের উপরেই সত্যিই চমৎকার একটি ধাবা কাম দোকান পাওয়া গেল। আস্তে গাড়ি চালিয়ে আসাতে এখন সাড়ে সাতটা বেজেছে। অবশ্য ঘাটের রাস্তা, তা ছাড়া পুরোটাই জঙ্গলের মধ্যে মধ্যেও। এমনিতেও ইচ্ছে করলেও খুব একটা জোরে চালানো যেত না। তার ওপরে ইচ্ছে করেই আস্তে চালিয়েছি। বালুসাই আর বড় বড় লুচি আর বেদম ঝাল-আলুর তরকারি খাওয়া হল। ভটকাই-এর ভাষায়, জমিয়ে। তিতির খেল একগ্লাস দুধ আর একটি বালুসাই। অ্যাজ ইউজুয়াল।

আমরা যখন গাড়িতে বসেই চা খাচ্ছি, বেশি-দুধে ফোঁটানো বেশি চিনি দেওয়া চা, হঠাৎ একটি সাদা মারুতি গাড়ি উল্টোদিক থেকে এসে খুব জোরে আমাদের পাশকাটিয়ে বেরিয়ে গেল, ইম্ফলের দিকে। ছেলেদের মতো ছোট করে ছাঁটা চুলের এক মহিলা একাই ছিলেন গাড়িতে। মনে তো হল, মহিলাই।

ভটকাই বলল, কী দিনকাল পড়ল। খিটক্যাল! না পোশাকে চেনার জো আছে, না চুলে। হাবেভাবে তো নয়ই! ভারতবর্ষও ইউনিসেক্সের দেশ হয়ে গেল র‍্যা! আমাদের সময়ের, বলেই, ঋজুদার দিকে তাকিয়ে বলল; মেয়েরা কত বিনয়ী, নম্র-সভ্য, ছিল। মেয়েদের মেয়ে বলে চিনতে পুরুষদেরও কোনও অসুবিধে ছিল না।

ঋজুদা হঠাৎ বলল, যে গাড়িটা গেল, সে গাড়ির নম্বরটা পড়তে পারলি?

না। ভটকাই বলল।

 তা পারবি কেন? সবসময় এত কথা বললে কি কনসেন্ট্রেশান থাকে কোনও কিছুতেই? তুই দিনে দিনে অপদার্থ হয়ে উঠছিস। তোকে নিয়ে আর কোথাও আসব না।

ভটকাই উত্তর না দিয়ে মুখ নামিয়ে চুপ করে চা খেতে লাগল।

আমি নেমে গিয়ে পয়সা দিয়ে এলাম দোকানে। ছেলেটাকে বকশিসও দিলাম পাঁচটাকা।

ও অবাক হয়ে চেয়ে বলল, ক্যা করেগা?

 তুম লেগা। হাসিতে মুখ ভরে গেল ওর।

 মণিপুর আর নাগাল্যান্ডের মাঝের কাঙ্গপোকপির আশ্চর্য সুন্দর সকালের আলোও স্নান হয়ে গেল; সেই সুন্দর হাসিতে।

মনে মনে নিজেই বললাম, আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে। নিঃস্বার্থভাবে মানুষের ভাল করলে, ভাল হয়ই। ওর সুন্দর হাসি আর আমার সুন্দর ভাবনাটা অন্য কেউই দেখতে বা জানতে পারল না।

ঋজুদা বলল, চল। আটটা পনেরো। এখন যাওয়া যাক আস্তে আস্তে।

দোকানেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলাম সানাহানবি দেবীর ফার্মের কথা। তা দোকানদার এবং আরও দু একজন ট্রাক ড্রাইভার বলল, সানাহানবি হানাহানবি নামকি কোই বাংলা হিয়া নেই হ্যায়। ফার্মভি নেই হ্যায়। মগর হাচিনসান সাবকো বাংলো ওর বাগিচ্যা হ্যায়। কুত্তে পালতি হ্যায় মেমসাব, বহত কিসিমকি। সাব তো গুজর গ্যায়া। মেমসাব হ্যায়।

কত আগে পড়বে বাংলো? এখান থেকে?

জাদা সে জাদা আধা-মিল। ডায়নে পড়েগা। রাস্তা ছোড়কর থোরাসা উতারনা পড়েগা উত্রাইমে। থোরা সা। মগর, রাস্তামে সাবকো নাম লিখা হুয়া বোর্ড মিলেগি আপকো।

বহত সুক্রিয়া।

 পৌঁছে বোঝা গেল, সত্যিই দেখবার মতো বাড়িটা, মানে বাংলোটা–আর তেমনই বাগান। ইবোহাল সিং খুন না হলেও এবং সেই খুনের রহস্যের কিনারা ঋজুদা করতে না পারলেও, শুধু এই বাংলোটি দেখবার জন্যেই কাঙ্গপোকপিতে আসা সার্থক। ছাদের উপরে একটি টেরাস–তাতেও যে কতরকমের লতা ও ঝাড়, পনসাটিয়া, ফার্ন, ক্রোটন, অর্কিড; কতরকমের যে ফুল আছে এখনও অর্কিডে, গরম পেরিয়ে গেলেও! সাকুলেন্টস ও অন্য জায়গা থেকে ক্যাকটাই; টবে রাখা।

সানাহানবি দেবী পথের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। দেবী তো কতজনারই নামে থাকে! তাকে সত্যিই দেবীর মতোই দেখতে। সকালের সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তার কোমর-ছাপানো চুলে। সুপুরুষ ইংরেজ সাহেব আর পরমা সুন্দরী নাগা মহিলার কন্যার রূপ যে কতখানি সুন্দর হতে পারে, তা যাঁরা না দেখেছেন সানাহানবিকে তা তাঁরা অনুমানও করতে পারবেন না। শুধু সানাহানবিকেও দেখার জন্যে কাঙ্গপোকপিতে যাওয়া যেতে পারে কলকাতা থেকে। তার বাংলো না দেখতে পেলেও।

সানাহানবি গাড়ি দেখেই উপর থেকে নেমে এসে পর্চ-এ রিসিভ করলেন। বললেন, আপনারা একেবারে ব্রেকফাস্টের সময়েই এসেছেন। তবে আমি খেয়ে নিয়েছি আজ তাড়াতাড়ি। একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে।

কী?

ঋজুদা শুধোল।

 আমার এক বান্ধবী, বান্ধবী বলব না, বলব ওল্ড অ্যাকোয়েন্টে–ইম্ফল থেকে কাল দুপুরে এসে পৌঁছেছিল এখানে। থাকবে বলে, তিনচার দিন। কিন্তু খুব ভোরে ফোন এল ইম্ফল থেকে–ওর বাবার কাছ থেকে, যে ওর দাদাকে কেউ মার্ডার করেছে, গত রাতে।

মাই গুডনেস! কোথায়? কী ভাবে?

কীভাবে হয়েছে তা তো এখনও ডিটেইলস-এ জানা যায়নি। তবে, হয়েছে মোরেতে নয়, থেংনোপালে। উঁচু পাহাড়ের জংলি রাস্তাতে। বেচারি! পাগলের মতো অবস্থা। জোর করে কিছু খাইয়ে দিলাম। সারা দিনে খাওয়া হয় না হয়। খেয়েই, ঝড়ের মতো গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।

ওঁর বাবা কী করেন? তিতির শুধোল।

ওঁর বাবার নানারকম ব্যবসা আছে। নাম থাঙ্গজম সিং। ভেরি ওয়েল-অফ। ইম্ফলে সকলেই এক ডাকে চেনেন।

ওঁর টাটা-সিয়েরা গাড়িটা নিয়েই কি আপনারা আমাদের রিসিভ করতে ইম্ফল এয়ারপোর্টে এসেছিলেন?

ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।

অপ্রতিভ হয়ে গেল, অত্যন্ত সপ্রতিভ সানাহানবি। ঢোঁক গিলে বলল, হ্যাঁ।

বলেই বলল, আপনি কী করে জানলেন? খুবই আশ্চর্য তো! তা ছাড়া আপনাদের আসার ব্যাপারে আমার কোনও ভূমিকা নেই। নেহাত আমার সৎবাবার সম্মানার্থে…। গাড়িটা বাবাই চেয়েছিলেন থাঙ্গজম সিং সাহেবের কাছ থেকে। তা ছাড়া বাবাকে কেউ পাঠিয়েছিল আপনাকে আনতে। সে যে কে, তা বাবা আমাকে কিছুতেই বললেন না। আপনাদের একহাজার টাকাও ফিস দিতে পারবেন না উনি, সে সামর্থ্য ওঁর নেই। তাই, আপনাদের থাকা-খাওয়ার ব্যাপারটা বাবার সম্মানরক্ষার্থেই আমি আমার দায়িত্ব বলে কাঁধে তুলে নিয়েছি।

আমি তো গোয়েন্দা। আমাকে অনেক কিছুই জানতে হয়, যা অন্যে জানে না। এটা আমার এক্সপার্টিস-এর অঙ্গ।

আপনার বন্ধু না অ্যাকোয়েন্টেসের নাম নিশ্চয়ই থৈবী দেবী। তাই না?

ভেরী স্ট্রেঞ্জ! আপনি তাও জানেন?

আরও অপ্রতিভ হয়ে বলল, সানাহানবি।

 সাদা মারুতি-ডিলাক্স এখুনি চালিয়ে গেলেন। উনিই তো! কিন্তু আপনার বন্ধু, সরি অ্যাকোয়েন্টেসের সঙ্গে একজন কাউকে দিয়ে দিলেন না কেন? এই রকম মানসিক অবস্থাতে এতখানি পাহাড় জঙ্গলের পথে একা গাড়ি চালিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?

ঠিক বলেছেন আপনি, মিস্টার বোস। আমি অনেক করে বলেওছিলাম। কিছুতেই রাজি হলো না থৈবী। দ্যাট ওজ ভেরি স্ট্রেঞ্জ। কেন যে অত জেদ করল। আমার মাইনে করা ড্রাইভার নেই বটে, কিন্তু আমার লোকজনের মধ্যে দুজন আছে, যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে এবং আমার বাবার আমল থেকেই গাড়ি চালায়, ভালই চালায়।

থৈবীর দাদার নাম কী?

ইবোবা সিং।

উনি কি থাঙ্গজম সিং-এর ব্যবসার পার্টনার?

 হ্যাঁ। একই ছেলে তো।

আর থৈবী দেবী?

হ্যাঁ, থৈবীও পার্টনার। যদিও থৈবী একবছরের ছোট ইবোবা সিং-এর থেকে। তবু থৈবীই আগে পার্টনার হয়েছে। তবে ইবোবা পার্টনার হওয়ার পর থৈবীর অংশ থেকেই অর্ধেক ইবোকাকে দিয়েছেন, ওঁর বাবা। থাঙ্গজম সিং মানুষটি একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। মণিপুরের মাতৃতান্ত্রিক পরিবেশে উনি একা হাতেই পিতৃতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টাতে আছেন। মানুষটির সঙ্গে আমার অনেক ব্যাপারে অমিল থাকলেও ভদ্রলোক যে সেলফ-মেড ও ভাবনা চিন্তাতে ওরিজিনাল এ জন্যে আমি ওঁকে এক ধরনের শ্রদ্ধাও করি। জানি না, শব্দটা শ্রদ্ধাই কিনা। আমার ভোকাবুলারি খুব পুওর। ভদ্রলোকের বন্ধুবান্ধবও বিশেষ নেই। একাই সময় কাটান। শুধু কাজ নিয়েই থাকেন। টাকা আরও টাকা। এই তাঁর সাধনা।

ভদ্রলোকের মধ্যে একটি মাফিয়া-মাফিয়া ভাব আছে বলে হয় না আপনার?

ঋজুদা বলল।

এগজ্যাক্টলি। আশ্চর্য! আপনি কী করে জানলেন? এই শব্দটা আমার মনে এসেছে বহুবার, কিন্তু প্রকাশ করার সাহস হয়নি। আমার কেন জানি না, একটু শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব থাকলেও ভয়ও করে ভদ্রলোককে। এড়িয়ে চলি। যতদূর পারা যায়।

ইবোবা সিং-এর বিয়ে তো হয়েছে! ওর স্ত্রী যমুনা, মেয়ে কী রকম?

যমুনা? আপনি তাকেও চেনেন? মাই গুডনেস! ও, শি ইজ আ ভেরি সুইট গার্ল। পুওর গার্ল।

হোয়াই পুওর?

বেচারি ওই পরিবারের পরিবেশে একেবারেই বেমানান। ও তো মিজো। শিক্ষিত মেয়ে। ওর মা মারা যান, ওর খুবই ছেলেবেলাতে। ও মামার বাড়িতেই মানুষ-গৌহাটিতে– কটন কলেজে পড়ত। কিন্তু বাবা মিজোরামেই থাকতেন। আর্মির কর্নেল ছিলেন। হি টুক টু ড্রিংকস। মদে খেল তাঁকে। এখন প্যারালিসিস হয়ে পড়ে আছেন। যমুনার এক মামা ছিলেন ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে। বলতে গেলে সেই মামাই গার্জেন। এবং, মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত সৎ ছিলেন। যমুনার ওপর তার মামার বাড়ির প্রভাব পড়েছিল। আর, সেজন্যই মনে হয় যমুনা এত ভাল মেয়ে হয়েছিল। যমুনার সেই মামা যখন কিছুদিনের জন্যে ইম্ফলে পোস্টেড হন, তখন থাঙ্গজম সিং প্রায় জবরদস্তি করেই এই বিয়েটা দেন। ইবোবা ছেলে খারাপ নয়। ও ওর মায়ের মতো হয়েছে। উদার মনের। দয়ালু। কর্মচারীদের বেশি মাইনে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিল। এই সব কারণেই বাবার সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকত বেচারির। যমুনার সবসময়েই মনে অশান্তি ছিল, এই কারণে। এখন তা আরও বাড়ল।

ঋজুদা চওড়া বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে পাইপ ধরাল।

আপনাদের জন্যে ব্রেকফাস্টে কী বানাতে বলব, বলুন।

সানাহানবি বলল।

ভটকাই বলল, ব্রেকফাস্ট আমরা খেয়ে এসেছি।

তা বললে কি হয়! আমার ডিপ ফ্রিজে খুব ভাল সসেজ, সালামি, বেকন এবং হ্যাম আছে। কাঙ্গপোকপির রোড আইল্যান্ড মুরগির ডিমের সঙ্গে খেয়ে দেখুন। সারা দিনে আর লাঞ্চ করতে হবে না।

ঋজুদা বলল, দ্যাটস নট আ ব্যাড আইডিয়া। আমার অন্তত, লাঞ্চ করার সময়ও আজ হবে না হয়তো।

ফাইন। সানাহানবি বলল।

তারপর বলল, ডিম, কার কীরকম হবে বলুন, প্লিজ

। বলেই, কাকে যেন ডাকল, কুলা সিং।

সুন্দর সাদা উর্দিপরা বাবুর্চি এসে দাঁড়াল। সাদা চুল, কিন্তু দাড়ি গোঁফ নেই। বোঝা গেল, হাচিনসন সাহেবের আমলের লোক।

ঋজুদা বলল, আমার ওয়াটার-পোচ।

আমি বললাম, বয়েলড; আন্ডারডান।

ভটকাই বলল, মামলেট, বলেই বলল, সরি, ওমলেট।

 তিতির বলল, আমার জন্যে স্ক্র্যাম্বলড।

একটা বড় ওমলেটও করতে বলি। কুলা সিং দারুণ ওমলেট করে, টোম্যাটো, পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা, আনারস, বাতাবি লেবু, চিজ আর মাশরুম মিশিয়ে। নাগাল্যান্ডের মাশরুম। আমি মাশরুমের চাষও শুরু করেছি। নিও-রিচদের মধ্যে ভাল কুকুরের চাহিদা নেই। আর এখন অধিকাংশ বড়লোকই তো তাই। সালুকি অথবা হুইপেট বা কুভাজস বা ড্যান্ডি ডিনমন্ট টেরিয়ার বা ভিজলা বা বরজোই-এর নামই শোনেনি এরা কেউ। টয়ের মধ্যেও খালি পিকিঙ্গিজ, বা শিউয়াহুয়ার বা পমেনারিয়ানের নাম জানে, কিন্তু, মালটিজ, জ্যাপানিজ, চিন, বা আফেনস্পিনসারের নাম শুনলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এখন যদি কাউকে চাওচাও বা লাসা-আপসোর কথা বলি, তো ভাবে, মঙ্গল গ্রহের জীবের নাম বলছি। না; সব ব্যবসারই একটা টার্নিং-পয়েন্ট থাকে। আমি ফুলের, অর্কিডের আর মাশরুমের ব্যবসাতেই চলে যাব। কুকুরের ব্যবসা আর চলবে না। সালুকির দাম এরা কী বুঝবে, বলুন?

ওরে বাবা! নাম শুনেই তো খিদে বেড়ে গেল। বানাতে বলুন ওমলেট। আর আমার বেকনটা একেবারে ক্রিসপ হবে। কুড়মুড়ে।

ভটকাই বলল।

 হাউ নাইস অফ য়ু। য়ু আর আ ডার্লিং। প্লিজ ট্রিট মাই হাউজ অ্যাজ ইওর ওন।

সানাহানবি বলল।

তিতির আর আমি ভর্ৎসনার চোখে তাকালাম ভটকাই-এর দিকে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।

সানাহানবি বলল, কুকুরের ব্যবসা আর করব না ঠিক করেছি, কারণ, আমার টাইগারই মরে গেল! কিছুতেই বাঁচাতে পারলাম না। ইম্ফল থেকে ভেটকে এনেছিলাম। তার আগে কোহিমাতেও দেখিয়ে ছিলাম। এক্স-রে টা করা গেল না, এইটেই দুঃখ রয়ে গেল।

কেন করা গেল না?

যেদিন নিয়ে যাই, সেদিন ইম্ফলের ভেট-এর মেশিনটা কাজ করছিল না। ভেবেছিলাম, পরের রবিবার নিয়ে যাব কিন্তু পরের রবিবারের আগেই যে সে মরে যাবে, জানব কী করে?

অসুবিধে কী ছিল?

খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল। গিলতেই পারছিল না কিছু প্রথম কদিন। তারপর গিলতে পারলেও খেতে চাইছিল না। পনেরো দিনের মধ্যে যে কুকুরটা মারা যাবে, কী করে জানব। ও ছিল আমার সঙ্গী। আমার ভাঙ্গা পুরনো অ্যামবাসাডার গাড়িতে করে যে পাহাড়ে-জঙ্গলে হুট হাট করে ইম্ফল মোরে কোহিমা বা ডিমাপুরে বা মোকচুং চলে যেতাম, সে তো ওদেরই ভরসাতে। পেছনে ওরা থাকলে কেউ ভয়ে আমার দিকে তাকাতই না। গাড়ির কাছেই আসত না।

কী কুকুর? তিতির শুধোল।

 গ্রেট-ডেন।

ছবি দেখবেন? আসুন ড্রইংরুমে।

ওরা ড্রইং রুমে ঢুকে দেখল সত্যিই! টাইগার যেমন নাম, তেমনি বাঘই! তার পাশে সানাহানবি দাঁড়িয়ে। ফেডেড জিনস আর হলুদ ফ্রেড-পেরি গেঞ্জি গায়ে। বয়স আরও অনেক কম ছিল।

আসুন! দেখাই, কোথায় কবর দিয়েছি ওকে।

সবাই মিলে কয়েকটি করে সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের গায়ে গায়ে নামলাম আমরা কিছুটা। অন্যান্য পাহাড়েরই মতো এখানে টেরাসিং কালটিভেশান বা গার্ডেনিং হয়। দেখলাম, একটা মস্ত বটলব্রাশ গাছের গোড়াতে মাটি তখনও আলগা আছে। তার পাশে একটা ঝাঁকড়া চেরি গাছ, অন্য পাশে একটা মস্ত কদম।

সানাহানবি বললেন, মাৰ্বল-ট্যাব বানাতে দিয়েছি। এলেই, বাঁধিয়ে লাগাব। মাই টাইগার স্লিপস হিয়ার। আসলে ট্যাবটা আজই এসে যাবে কোহিমা থেকে। আনিয়েই বাঁধাব ভেবেছিলাম কবরটা, কিন্তু থৈবী চলে যাবার আগে বারবার মানা করে গেল। বলল, ওও থাকতে চায় ট্যাব বসাবার সময়ে। ও ফিরে আসা অবধি যেন না বাঁধাই গ্রেভটা বা ট্যাবটা না বসাই।

কেন?

ঋজুদা অন্যমনস্ক গলাতে বলল, পাইপ কামড়াতে কামড়াতে। ঠিক বুঝলাম না। ওও টাইগারকে খুবই ভালবাসত। আঙ্কল ইবোহালের মৃত্যুর দুদিন আগে, আমি ওঁর বাড়িতে গেছিলাম, মোরেতে। থৈবী গেছিল আমার সঙ্গে। টাইগারও গেছিল সঙ্গে। আমি কাউকেই খাওয়াতে দিই না টাইগারকে। নিজে হাতেই খাওয়াই কিন্তু বার্মার তামু থেকে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে গেল

সেদিন…

থৈবী যায়নি আপনার সঙ্গে? বার্মার মুতে?

না। আচ্চাও সিং-এর সঙ্গে গেছিলাম। আপনি আচ্চাও সিং-এর কথা কী জানেন? আঙ্কল ইবোহাল-এর মৃত্যুর পর থেকে সেও নিখোঁজ, কেউ মার্ডার করল নাতো! বড় চিন্তা হয় আমার, ওর জন্যে।

আচ্চাও সিং-এর কথা শুনেছি। আপনার দুর্ভাবনা অমূলক নয়।

থৈবী বলেছিল, টেক-ইওর টাইম। হাঞ্জো আছে, আমি আছি, আমরা টাইগারকে খাওয়াব।

হাঞ্জো কে?

 হাঞ্জো সিং। মাসলম্যান। থৈবীর বাবার বডি-গার্ড। অনেকসময় থৈবীর সঙ্গেও থাকে। কোমরে রিভলভার নিয়ে। বড়লোকদের সঙ্গে অনেকসময়েই মোটা টাকা থাকে তো ব্যবসার জন্যে। ব্যবসার তো নানারকম হয়!

মোরে থেকে আমি ফিরে আসার পরই লক্ষ করলাম যে টাইগার যেন কেমন করছে। নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। কিছু খেতে চাইছে না। ক্রমশ দুর্বল

কে খাইয়েছিল, টাইগারকে?

ঋজুদা জিজ্ঞেস করল। হাঞ্জো কোথাও গেছিল কাজে। থৈবীও আঙ্কল ইবোহালের কাছে আটকে পড়েছিল। তবে খাওয়ানো হয়েছিল, ঠিক সময়েই।

কেউ বিষটিষ খাওয়ায়নি তো!

 তিতির বলল।

নানা। সে সব টেস্ট তো করিয়েছি। কোহিমাতে গেছিলাম। কিন্তু ভেট সে দিন ডিমপুরে গেছিলেন। যেদিন রাতে মারা গেল সেদিনই সন্ধেবেলা ইম্ফল থেকে অন্য ভেটকে নিয়ে থৈবী নিজে এল। ভেট, দেখে বললেন, আর কিছু করার সময় নেই। আমিও বুঝতে পারিনি, যে সবকিছু, দিন-পনেরোর মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

ভেট কী বললেন? রোগটা কী?

 উনি তো বললেন, দুটি রোগে একসঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে, টাইগার।

কী? কী?

 আপনি কি বললে বুঝবেন?

 সানাহানবি বলল, ঋজুদাকে।

 ভেট-এর মতো নয়, কিন্তু আপনি যেমন কুকুর ভালবাসেন আমিও একসময়ে–এই রুদ্র জানে সে কথা। তখন কুকুরদের অসুখ-বিসুখ নিয়ে কিছু পড়াশুনো করতে হয়েছিল। কারণ, আমি থাকতাম ওড়িশার গভীর জঙ্গলের মধ্যে, যেখানে ভেটারানারি ডাক্তার পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। বড় শহরের দূরত্ব ছিল অনেকই।

ও আই সি! তা ভেট বললেন, ইনফেকশাস পাপিলোমাটোসিস-এ আক্রান্ত হয়েছে টাইগার। তা ছাড়া উনি সন্দেহ করেছিলেন, টাইগারের গলাতে একটা টিউমার হয়েছে। সম্ভবত, ম্যালিগনান্ট। এবং মোরেতে খাওয়ার পর থেকেই যে অস্বস্তি, সেটা নেহাতই কো-ইনসিডেন্টাল। রোগটা আগেই হয়েছিল। সেইদিন দুপুর থেকেই অ্যাগ্রাভেটেড হয়েছিল। এরকম হয়, অনেকসময়।

বায়োপসি কি করা হয়েছিল?

না, সেও আর হল কই!

ডাক্তারের নাম ঠিকানাটা আমাকে দেবেন?

হ্যাঁ। কার্ডটাই দিয়ে দিচ্ছি। তাঁর চেম্বার, ইম্ফলের পাওনা বাজারে। থাকেন মইরাঙ্গখম-এ।

আমি বরাবর কোহিমার ভেটকেই দেখাই। কিন্তু অ্যাজ ব্যাডলাক উড হ্যাভ ইট, ডিমাপুরে গিয়ে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। এখনও উনি ওখানের নার্সিংহোমেই আছেন। ফোনেও কথা বলতে পারেন ইচ্ছে করলে। ইম্ফলের ভেট-এর সঙ্গে।

টাইগারকে তো আর পাওয়া যাবে না। মিছিমিছি এখন ব্রেকফাস্টটা নষ্ট কেন করি! ব্রেকফাস্টের পরে তো আমি চলেই যাব। আজকালের মধ্যে দেখাই করে নেব, ওঁর সঙ্গে। ডিটেইলস-এ আলোচনা করে নেব। টাইগার যখন এতই প্রিয় ছিল আপনার।

এই কথাতে সানাহানবির দুচোখ জলে ভরে এল।

কুকুর পোষা ছেড়ে দিয়েছি এইজন্যেই। ঈশ্বরের উচিত ছিল কুকুরকে হাতি অথবা তিমি মাছের আয়ু দেওয়া, যাতে একাধিক মালিককে রওয়ানা করিয়ে দিয়ে তবেই নিজেরা যায়, পরপারে।

ঋজুদা বলল।

ফিরে এসে, ডাইনিং রুমের দারুণ ঝকঝকে বাদামি-লালচে রঙা মেহগিনি কাঠের ডাইনিং-টেবিলে বসে মণিপুরি ম্যাটের উপরে বোন-চায়নার প্লেটে স্বাদু ডিম এবং ওমলেট, হ্যাম আর বেকন দিয়ে কড়া টোস্টের সঙ্গে খেতে খেতে, আমরা আরও অনেক কথা বলছিলাম।

ঋজুদা আমাদের বলল, তিতির আর রুদ্র এখানেই থেকে যা বরং, দু একদিন। সানাহানবিকে কম্পানি দে। আমি আর ভটকাই ফিরে আসব, কাল পরশুর মধ্যেই।

আমি বুঝলাম, আমাদের থাকাটা নিছক বেড়াবার বা সানাহানবিকে কম্পানি দেবার জন্যেই নয়, এর পেছনে গূঢ় কারণ আছে।

দুবার করে ব্রেকফাস্টের পরে, আমরা যখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছি, তখন সানাহানবি বলল, আপনারা আমার কেনেল দেখলেন না? যা দেখতে আসা।

ঋজুদা বলল, আমার একটু তাড়া আছে। আমি ফিরে এসে দেখব। তিতির আর রুদ্রকে রেখে গেলাম। আপনার স্পেয়ার বেডরুম আছে তো?

স্পেয়ার বেডরুম? আমার বাড়িতে ছ’টি বেডরুম। আগেই তো বলেছি। বাবার বন্ধুরা আসতেন শিকারে, কত কত জায়গা থেকে। আসামের চা বাগানের প্ল্যান্টার্সরা, কলকাতার ও ব্যাঙ্গালোরের রেসিং-ক্রাউড, কোহিমা ও ইম্ফল, আইজল, তুরার; শিলঙের বন্ধুরা। তখন কুড়িটি ল্যাব্রাডর গান-ডগ ছিল আমাদের। দশটি গোন্ডেন-রিট্টিভার। শিকার কুড়িয়ে আনার জন্যে। এই সেদিনও, কাঙ্গপোকপির বড় রাস্তার উপরে নাগা ও কুকিরা বসে ভেনিসন বিক্রি করত। বাঁশের উপর পেছনের দু পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত। যে যেখান থেকে চাইত, কেটে দিত। পৃথিবীটাই অন্যরকম ছিল ক’বছর আগেও। চোখের সামনে সব কেমন বদলে গেল। ভাবা যায় না। জঙ্গলই সাফ হয়ে গেল।

আমরা ফিরে আসি, জমিয়ে আড্ডা দেব আর তখনই শুনব হাচিনসন সাহেবের পুরনো দিনের সেইসব কথা।

আমি আর তিতির ঋজুদা আর ভটকাইকে মারুতি ভ্যান অবধি পৌঁছে দিতে এগিয়ে গেলাম। সানাহানবি গেল তার ফার্মের তদারকিতে। বলে গেল যে, টাইগারের গ্রেভ-ইয়ার্ডের পাশ দিয়ে আরও উৎরাইতে নেমে গেলেও ওকে খুঁজে পাব আমরা।

ঋজুদা বলল, সাবধানে থাকিস। আর মেয়েটার উপরে নজর রাখিস।

নজর রাখিস মানে?

মানে, ও কী করে না করে। ওর কাছে কে আসে না আসে। ফোনেও ও কারও সঙ্গে কথা বলে কি না বলে। তা ছাড়া…

তা ছাড়া কী ঋজুদা? তিতির শুধোল।

তা ছাড়া মেয়েটাকে পাহারাও দিস। ওরও বিপদ হতে পারে। আরেকটা কথা। সারা রাত টাইগারের কবরের দিকে নজর রাখবি। ওখানে কোনও ঘটনা ঘটতে পারে। ওই কবরের কাছে যেই আসুক তাকে আটকাবি–। কিন্তু সানাহানবি নিজে গেলে না আটকে, ও কী করে তা দেখবি। অন্য কেউ গেলে, সানাহানবিকে জাগিয়ে দিয়ে, সকলে মিলে সেখানে যাবি।

কে আসবে টাইগারের কবরে? কেন আসবে?

আরেঃ। যা বলছি শোন না! কেউ নাও আসতে পারে আদৌ। কেন আসবে, তা আমি নিজেও জানি না। এখন আমাকে দেরি না করিয়ে, যা বলছি; তা করিস।

গাড়িতে উঠে এবারে ঋজুদা ড্রাইভিং-সিটে বসল। বলল, ভটকাই এবারে ফিরে গিয়ে গাড়ি চালানোটা ভাল করে শিখে নিতে হবে কিন্তু। সাইকেল চালাতে ও সাঁতার কাটতে জানিস তো?

জানি না? ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার, বাটারফ্লাই-স্ট্রোক, ফ্রি-স্টাইল যা বলবে।

 তারপরই বলল, ঋজুদা, ভেনিসন কী? ওই সানাহানবি যা বলল?

ওঃ, তুই জানিস না বুঝি? ভেনিসন মানে হচ্ছে, হরিণ জাতীয় প্রাণীর মাংস। আগে ভেনিসন বলতে শিকার করা মাংসকেই বোঝাত। এখনও ভেনিসন, ইংল্যান্ডের ও আমেরিকার সব বড় বড় হোটেল রেস্তোরাঁতেই পাওয়া যায়।

দশ কিমির মতোও যায়নি ওরা, এমন সময় দেখা গেল, সেই টাটা-সিয়েরাটা আসছে। তবে গাড়ি চালাচ্ছে অন্য একজন ড্রাইভার। পাশে বসে আছে, যোগেন

পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সময়ে, যোগেন ড্রাইভার হাত-পা ছুঁড়ে একটা আর্তনাদ করে উঠল এবং ওদের গাড়িও জোরে ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঋজুদাও দাঁড় করাল মারুতি ভ্যান। টাটা-সিয়েরাটা ব্যাক করে এল এ-গাড়ির পাশে।

যোগেন বলল, বড়বাবু, মানে আমার সাহেব আপনেরে ধইর‍্যা লইয়া যাইতে পাঠাইলেন। ও বাংলোয় না পাইয়া আপনাগো খুঁজে বাইরাইছি। আপনারা আইতেছেন কোথনে?

যোগেনের কথার জবাব না দিয়ে ঋজুদা বলল, বড়বাবু মানে?

বড়বাবু মানে, থাঙ্গজম সিং সাহেব।

 সেকী! তোমার মালিক তো থম্বি সিং বলেই জানতাম।

 নানা। তিনি ফস-স-স-স। তিনি মালিক হইতে যাইবেন কীসের লইগ্যা? বড়বাবুর একমাত্র ছাওয়াল ইবোবা সিং, কাল রাতে মার্ডার হইয়া গ্যাছে গিয়া। সেই খুনের তদন্তর ভার দ্যাওনের লইগ্যা বড়বাবু পাঠাইছেন আমারে। নইলে আমার আর কি আসার অবস্থা আছে বাবু? হায়। হায়। ভটকাবাবু যা খাওয়া কাল খাওয়াইলেন! পেরাণে যে বাঁইচ্যা আছি, তাই ঢের। আমার বউডায়তে গড়াগড়ি দিতাছে। এই ড্রাইভার আপনাগো চিনে না বইল্যাই কুনোক্রমে পাশে বইস্যা আইছি। তা ছাড়া, মার্ডার বইল্যা কথা। হায় হায়। এ কী হইল কন দেহি? আমরা গাড়ি ঘুরাইয়া লইয়া আগে আগে যাইতাছি, আপনে আসেন আমাগো পিছে পিছে।

শোনো ভাই যোগেন। আমি সোজা যাচ্ছি থেংনোপালের দিকে। তুমি গিয়ে তোমার বড়বাবুকে সেখানেই আসতে বলল।

বডি তো পোস্টমর্টেমের লইগ্যা ইম্ফলেই লইয়া আইছে পুলিশে।

যোগেন বলল।

মর্গটা কোথায়?

আসেন না পিছে পিছে, চিনাইয়া দিতাছি। আমরাও তো যাইতাছি মর্গেই।

আমরা পরে আসব। এখন আমার একবার মোরেতে যেতেই হবে। থেংনোপাল হয়েই তো যাব। যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরেই, তোমার বাবুর বাড়িতে পৌঁছব সোজা। আর যদি দেরি হয়ে যায় তো কাল সকালে যাব।

বাড়ি কি আপনি চিনেন? আজই আইয়্যা যান। দাহটাহ হইতে সময়তো লাগব। তার শ্বশুর আইব না আইজল থিক্যা। তার তো আবার প্যারালিছিস। আইব ক্যামনে? পোস্ট মর্টেমও কত সময় লাগব, কে জানে!

হ্যাঁ। বাড়ি আমি চিনি। তোমাদের দিদিমণি ফিরেছেন?

 দিদিমণিরেও চিনেন না কি আপনি? ইতো ম্যাজিক দেখতাছি। সানাহানবি দেবী নন কিন্তুক…

হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। থৈবী দেবী। তিনি কোথায়?

 তিনি তো সোজা থেংনোপালেই চইল্যা যাইতেছিলেন। ইম্ফলের পেট্রল পাম্প থিকা বড়বাবুরে একখান ফোন কইর‍্যা দিয়া।

বড়বাবু কোথায়?

উনি আছেন বাড়িতেই। পাথর হইয়া গেছেন গিয়া বাবু। এক্কেরে পাথর। হায়। হায়। একখান মাত্র পোলা আছিল।

ঠিক আছে। আমরা ঘুরে আসছি।

ঋজুদা জোরে একসিলেটরে চাপ দিল এবারে। যেখানে রাতে থাকা হয়েছিল সেই দ্য রিট্রিট বাংলোটার একদিকে কাঙ্গপোকপি, কোহিমা; আর অন্য দিকে মোরে। মধ্যে ইম্ফল। তবে মোরে যেতে হলে ইম্ফল পেরিয়ে প্রায় তিরিশ কিমি গিয়া লাংথাবাল পড়বে। লাংথাবালের পরে ওয়াইথু। তারপর থৌবল, প্যালেল। প্যালেল ইন্ডিয়ান আর্মির শেষ চেকপোস্ট। প্যালেলের পরে থেংনোপাল। ছ’ হাজার ফিটের বেশি উঁচু। থেংনোপালের পরে লোকাচো আর লোকাচোর পরেই মোরে। মোরের ওপাশে নো-ম্যানস ল্যান্ড আর তামুরও এপাশে। দুই দেশের মধ্যে পাঁচ কি.মি. নো-ম্যান্স ল্যান্ড। মধ্যে দিয়ে একটি ছিপছিপে নদী বইছে ঘন সেগুনবনের মধ্যে দিয়ে। চিউইন নদীর একটি শাখা নদী। ওই অঞ্চলের মানুষেরা বলে বার্মা নদী। বার্মার তামু থেকে মান্দালয় দেড়শো কিমি মতন।

অনেকক্ষণ একটানা বলে থামল ঋজুদা।

থেংনোপাল জায়গাটা ভারী সুন্দর। কিন্তু খুন হওয়া লাশ দেখতে গেলে সৌন্দর্য দেখার মন আর থাকে না। রাস্তার উপরে আরও কয়েকজন উৎসাহী ভ্যাগাবন্ড দাঁড়িয়ে বসে কাল রাতের খুন নিয়ে আলোচনা করছে। গাড়িটা রাখা আছে রাস্তার পাশে। লক করা। লাশ নিয়ে গেছে মর্গ-এ। গাড়িটার পাশে চারজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের হাতে লাঠি। দুজনের হাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের ম্যাগাজিন রাইফেল।

ওরা যেন কিছু জানে না এমনি করে, কীসের ভিড় হে? বলে, গাড়ি থামিয়ে নামল।

ভিড় হয়েছে, ও হচ্ছে বলে, পথপাশের বড় বড় দুটি গাছতলাতে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান ও আনারস আর বাতাবি লেবু নিয়ে বসে গেছে। দুটি মেয়ে। পথচারী মানুষ ও গাড়ির যাত্রীদের জন্যে।

গাড়িটার চারদিকে একবার ঘুরে এসে ঋজুদা বলল, চল ভটকাই, মোরে যাই।

কাঙ্গপোকপি থেকে লোকাচো হয়ে, মোরে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দুটো হয়ে গেল। খুব জোরে চালালেও প্রায় অচেনা জায়গার পাহাড়ি পথ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সময় লাগেই। তা ছাড়া, শেষ সেই কবে এসেছে!

সোজা থানাতে গিয়েই উঠল ঋজুদা। থানায় ঢুকে নিজের আইডেনটিটি কার্ডটা দেখাল। থানার ও. সি হাসলেন। বললেন, এ সব এখানে মান্য নয়। তখন ঋজুদা বলল, হোম সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলব। লাইন লাগিয়ে দিন।

প্রথমে বিশ্বাস করলেন না অফিসার।

 ঋজুদা তখন বললেন, ডি. জি’র সঙ্গে কথা বলব।

তাতে অফিসার নরম হয়ে বললেন, কী চান আপনি?

আমি ইবোহাল সিং-এর বাংলোটা ঘুরে দেখতে চাই। কোন ঘরে খুন হয়েছিলেন? আপনাদের ডিটেকটিভ ডির্পাটমেন্টের ফাইন্ডিংস কী? কাউকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে কি?

চলুন দেখিয়ে আনছি। যা জানি, বলছিও।

 থানার ও.সি. এবং ছ’জন পুলিশ চললেন, ওদের জিপ নিয়ে।

মোরের বাংলোটা দ্যা রিট্রিট-এর চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু কমপ্যাক্ট। ছোট বাগান। চওড়া বারান্দা তিনদিকে। বাংলোটা একটা টিলার উপরে। বাড়ি বলতে স্টাডিটাই আসল। প্রায় হাজার স্কোয়ার ফিটের মতন–ডুপ্লে-উপরেও আরও হাজার ফিট। এরকম বাড়ি দেখেনি ঋজুদাও আগে। আর মেজেনিন ফ্লোরে বেডরুম। একটাই বেডরুম। স্টাডির একতলাতে থ্রি-টিয়ার-স্লিপারের মতন দুটি বাঙ্ক করা আছে। অতিথি এলে বোধহয় শোন রাতে। ব্যবস্থা দেখে, কোনও অপরিচিত অতিথি এখানে আসতেন বলে মনে হয় না। এককোণে ডানলোপিলোর গদি থাক করে রাখা আছে। ওই বাঙ্কের উপর গদি বিছিয়ে দেওয়া হয়। ডাইনিংরুমটা, মেজিনিন ফ্লোরের অন্য দিকে, তার সঙ্গেই কিচেন। কিচেনেরই পেছনে একটা স্পাইরাল সিঁড়ি, যা দিয়ে বেয়ারাবাবুর্চিরা যাতায়াত করে বাংলোতে, তাদের কোয়ার্টার থেকে। তাদের কোয়ার্টার, মেইন গেট-এর দুপাশে। যে খুন করেছে ইবোহাল সিংকে সে সম্ভবত ওই স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়েই উঠে এসেছে। তখন বাবুর্চি বেয়ারারা হয়তো ছিলও না কেউ। ওই ঢোকার পথটি সম্ভবত বাবুর্চি বেয়ারারা বাইরে থেকেই বন্ধ করত। চাবি হয়তো তাদের কারও কাছেই থাকত। খুনি, তার মানে, এই বাংলার সবকিছুই জানত। আঁটঘাট। এখানে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বাবুর্চি বেয়ারাদের সঙ্গে সাঁটও হতে পারে। পাছে তার জুতোর বা পায়ের ছাপ পড়ে মেঝেতে, সেইজন্য ইবোহাল সিং সাহেবেরই ডাকব্যাকের ওভার-শ্যটি গলিয়ে নিয়েছিল, নিজের জুতোর উপরে। তার মানে, সে এও জানত যে, শু-র‍্যাকটি কোথায়? রাবারের ওভার-শুটি কোথায় রাখা থাকত? রাত তখন বারোটা হবে। ইবোহাল সিং তখন টেবিলে বসে পড়ছিলেন। নয়তো, চিঠি লিখছিলেন। তাঁর টেবিলের পেছনেই ছিল বিরাট খোলা জানালা। এবং ওইদিকে বারান্দা ছিল না। জানালার প্রায় পনেরো ফিট নীচে বাগান এবং লন। খুনি, সাহেবের পেছনে, যে টিল্টিং চেয়ারটা আছে; সেটা পুরো হেলানোর পরও যে তিনচার ফিট জায়গা ছিল জানালা আর চেয়ারের মধ্যে, সেখানে দাঁড়িয়েই সিং সাহেবের গলাতে নাইলনের দড়ির ফাঁস পরিয়ে দিয়ে, নিজে সেই দড়ির অন্যপ্রান্ত ধরে গরাদহীন জানালা দিয়ে ঝুলে পড়ে। তারপর লাফিয়ে নামে বাগানে। দড়ির উপরে নিজের শরীরের ভার পুরোটাই ততক্ষণই দিয়ে রাখে যতক্ষণ না ইবোহাল সিং-এর প্রাণ নিশ্চিতই না বেরোয়। প্রাণ বেরোবার আগে তিনি দমবন্ধ হওয়াতে হাত-পা ছোঁড়েন। কিন্তু দুটি পাই টেবিলের তলাতে থাকাতে বের করতে পারেননি। হাতের ঝটকানিতে বাঁ পাশে রাখা লাইটটা শব্দ করে মাটিতে পড়ে যায়। তাঁর বেডরুমের বারান্দাতে শুয়ে-থাকা চল্লিশ বছরের পুরনো বার্মিজ বেয়ারা, সেই শব্দ শুনে প্রথমটা হকচকিয়ে যায়। বুঝতে পারে না কী হল! পরক্ষণেই, যখন দৌড়ে আসে স্টাডিতে, ততক্ষণে উনি মারা গেছেন। গলার ফাঁসটা পরানোই ছিল। দড়ির অপরপ্রান্ত ঝুলছিল জানালা দিয়ে। বাগানে লুটিয়েছিল। একটা বাঁশের মই, কাঁচা-বাঁশ কেটে বানানো, লাগানো ছিল বাগানের দেওয়ালে। সেই মই বেয়েই শর্টেস্ট ডিসস্ট্যান্সের মধ্যে বাংলোর কম্পাউন্ডের ওপারে পৌঁছে যায় খুনি। স্টাডি থেকে তার বাগানে লাফিয়ে পড়া, মই দিয়ে ওঠা এবং ওপাশে রাস্তাতে লাফিয়ে পড়ার চিহ্ন স্পষ্ট ছিল ভেজা মাটিতে। কারণ, বছরে এই সময়ে এ-অঞ্চলে প্রায় রোজই বৃষ্টি হয়।

নাইটওয়াচম্যান আলাদা কেউই ছিল না কোনওদিনই।

দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরেই দারোয়ান ও বেয়ারা বাবুর্চিরা, জোরে একটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায়। খাস-বেয়ারা গাড়িটাকে দেখেও, কিন্তু গাড়ির মডেল বলতে পারে না, মেকও বলতে পারে না। সে ও সব জানেও না। শুধু নাকি বলে, বড় বড় লাল আলো ছিল পেছনে। উঁচু উঁচু। এমন আলো কোনও গাড়ির; ও আগে দেখেনি। কী রঙের গাড়ি? জিজ্ঞেস করাতে সে সঠিক বলতে পারেনি। বয়সও অনেক। রাতে ভাল দেখেও না।

পুলিশ অফিসারকে ঋজুদা জিজ্ঞাসা করলেন অন্য সকলকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে, এই খাস-বেয়ারা কেন করা হয়নি?

ও চল্লিশ বছরের লোক। স্থানীয় সব মানুষই চেনে একে বহুদিন থেকে। এর সততা নিয়ে কারোই কোনও সন্দেহ নেই। বুড়োর সংসারে কেউ নেই, মানে স্ত্রী গত হয়েছে বহুদিন আগে। ও বার্মিজ। তামু আর মান্দালয়ের মাঝের এক গ্রামে বাড়ি। একটিই মাত্র মেয়ে। বিবাহিত। সেও খুবই স্বচ্ছল। বুড়ো, সিং-সাহেবকে ছেড়ে যায় না কোনওদিনই। মেয়েই আসে প্রতি বছর, বার্মিজ নববর্ষের সময়ে। নানা উপহার দিয়ে যায় বাবাকে। মেয়েও নিঃসন্তান। খাস বেয়ারা সব সন্দেহের অতীত এবং বৃদ্ধ বলেই একে অ্যারেস্ট করা হয়নি।

ঋজুদা বলল, ওকে আমি একটু আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। আপনারা ফিরে যান আমরা যাচ্ছি এখুনি। চা খাওয়াবেন তো? আপনাদের আই.জির কাছে আমার কথা জানতে পাবেনই। আপনার আতিথেয়তার কথাও, মানে, চা খাইয়েছেন যে, তখন আমিও ওঁকে জানাব।

জিপটা চলে গেল, ঋজুদা ভটকাইকে পেছনে বসতে বলে, বুড়োকে সামনে বসাল মারুতি ভ্যানের। বুড়োর বয়সের গাছ-পাথর নেই। কিন্তু এক ধরনের জ্ঞানী বুড়ো থাকে, সব জাতেই, চৈনিক কনফুসিয়াসের মতো, যাদের বয়স চল্লিশও হতে পারে, একশো দশও হতে পারে। যাদের চেহারাতে বয়সজনিত কোনও পার্থক্যই হয় না।

ভটকাই ভাবছিল, এ বুড়ো সেই জাতের বুড়ো।

 তোমার নাম কী?

ঋজুদা শুধোল।

 উ-মঙ্গ।

তুমি ইবোহাল সিং সাহেবকে কত দিন জানো?

 আজকে পঞ্চাশ বছরের বেশি আছি ওঁর সঙ্গে। তখন আমার তিরিশ বছর বয়স। জওয়ান। উনি ছাড়া তো আমার কেউই ছিল না। আমি ছাড়াও ওর কেউ ছিল না। ছিল, একজন ছিল। সে তো পালিয়ে গেছে।

সে কে? আচ্চাও সিং?

 উ-মঙ্গ-এর ঘুমন্ত চোখে যেন ঝিলিক লাগল আচ্চাও-এর নামে।

বলল, চেনেন আপনি তাঁকে?

 নামে জানি। সানাহানবিকেও জানি। আচ্চাও সিং মানুষ কেমন?

মানুষ তো ভালই সাহেব। কিন্তু রক্ত বড় গরম।

যথা?

ওই। এমনিই বললাম।

খোলসা করে বলো?

 আচ্চাও সিং নাগাদের ভালবাসত।

আর তোমার সাহেব?

 তিনিও। সানাহানবিকে তো তিনি মেয়ের মতোই ভালবাসতেন।

আচ্চাও-এর কিন্তু খুব বিপদ, উ-মঙ্গ।

আমাকে বলছেন আপনি? জানি আমি।

আচ্চাওকে খবর পাঠাতে হবে ও যেন এখন ভুলেও এদিকে না আসে। এলে সারাজীবন গারদে কাটাতে হবে।

ঋজুদা বলল।

বুড়ো উ-মঙ্গ কী বলতে যাচ্ছিল, থেমে গিয়ে বলল, তাকে আমি কি খবর পাঠাব? কোথায় পাঠাব? আমি কি জানি, সে কোথায় গেছে?

তুমি ছাড়া আর কেউ যে জানে না উ-মঙ্গ, সে কথা আমি জানি। তোমার ভয় নেই, আমিও তোমারই মতো আচ্চাও এর বন্ধু। সানাহানবির বন্ধু। আমি শত্রু নই। ইবোহাল সিংকে যে খুন করেছে, তাকে আমি খুঁজে বের করবই। তুমি নিশ্চিত থেকো। এই খুনটা কে করতে পারে বলে তোমার মনে হয়, উ-মঙ্গ?

আপনার কী মনে হয়?

উ-মঙ্গ প্রশ্ন করল উলটে। বলল, আমি সহায়-সম্বলহীন গরিব লোক। এখন প্রায় জরাগ্রস্তও। আমার বিপদ হলে কে দেখবে সাহেব?

আচ্চাওই দেখবে। আচ্চাও না দেখলে সানাহানবি দেখবে। সেও না দেখলে আমি দেখব উ-মঙ্গ।

আপনি? বিশ্বাস করব কী করে?

তোমার অভিজ্ঞতা দিয়েই বিশ্বাস করতে হবে উ-মঙ্গ। বিশ্বাস করার যখন অন্য কিছুই থাকে না তখন নিজের বুদ্ধি দিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিশ্বাসযোগ্যতার অন্য কোনও আমানত আমার কাছে নেই। আমারও মনে হয় যে, আমি জানি কে খুন করেছে, কিন্তু সে নিজের জন্যে খুন করেনি। তাকে দিয়ে খুন করানো হয়েছে।

চমকে গেল উ-মঙ্গ। পিচুটি-পড়া চোখ দুখানি যেন চকচক করে উঠল। বুড়ো মাথা নাড়ল। বলল, শুনলাম আজ সকালে তো ইবোবা সিং, থাঙ্গজম সিংয়ের ছেলেটাও খুন হয়েছে থেংনোপালে। কী যে দিনকাল হল!

ঋজুদা বলল, তুমি আর চিন্তা করে কী করবে? এই টাকাটা রাখো। এটা পাঁচশো টাকার নোট। তোমার জন্যে নয়। তুমি আজই কাউকে দিয়ে আচ্চাওকে খবর পাঠাও। আমার মনে হয় যে, তোমার মেয়ের বাড়িতেই সে আছে। তাকে খবর পাঠাও আমার পরিচয় দিয়ে। এই নাও একটা কার্ড। বোলো যে, আমি ইবোহাল সিং-এর খুনি যে কে, তা খুঁজে বার করবই। খবর না দিলে, সে যেন

এদিকে একেবারেই না আসে।

আমার মেয়ে আসছে কাল।

 কেন?

আমার অবস্থা শুনে আমাকে নিয়ে যেতে আসছে। কার কাছে থাকব আমি এখানে? চলবে কী করে?

তুমি এখন গেলে খুনি ধরা যাবে না উ-মঙ্গ। আচ্চাও-এর উপকারও হবে না। ওদের বিয়েটাও তোমার খাওয়া হবে না। মেয়ে আসছে, ভাল হয়েছে। মেয়ের মুখেই সব খবর পাঠাও।

আরও একটা কথা।

কী?

 তম্বি সিং মানুষটা কেমন?

 মানুষ ভাল। কিন্তু, একটা ছাগল। চিরদিনের ছাগল। ওর ছাগলামির জন্যে ওও না খুন হয়ে যায় যে-কোনওদিন। চিন্তা হয় ওর জন্যেও। কত বছরের জানাশোনা আমার, এদের সকলের সঙ্গেই। যাবে তো একদিন সকলেই। কিন্তু যাওয়ার তো একটা রকম আছে।

উ-মঙ্গ, থাঙ্গজম সিং-এর মেয়ে থৈবী সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা?

ওটা একটা ডাইনি।

যে রুবিটা ইবোহাল সিং-এর তরোয়ালে লাগানো ছিল তা কতবড় ছিল?

ও বাবা! এত্ত বড়। বছরের একদিনই তো বের হত। আমিই তো পালিশ করতাম তরোয়াল।

তরোয়ালটাকে সরাল কে? আর, ওই রুবির কথা জানত কি সকলেই?

রুবির কথা? না। সকলে জানত না। আচ্চাও জানত, সানাহানবি জানত, তম্বি জানত, আর জানত থৈবী।

থৈবী জানল কী করে?

গত মাস ছয়েক হল, ও খুব ঘনঘনই আসত।

 সানাহানবির সঙ্গে?

কখনও কখনও কখনও একাও আসত। আচ্চাও-এর সঙ্গে দহরম-মহরম এর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আচ্চাও আর সানাহানবি ছেলেবেলার সঙ্গী। হাচিনসন সাহেবও আচ্চাওকে খুবই ভালবাসতেন। বড় আত্মসম্মানজ্ঞানী ছেলে আচ্চাও। থৈবীকে পাত্তা দিত না। আপনি দেখেছেন আচ্চাও সিংকে?

না।

ওরকম সুপুরুষ মণিপুরে কমই আছে।

ঋজুদা বলল, উ-মঙ্গ আর দুটো কথা তোমাকে বলতে হবে, আমাকে। সত্যি করে। আচ্চাও আর সানহানবির ভালর জন্যেই। প্রথমত, তোমাকে পুলিশে যদি ডাকে অথবা আদালতে, তুমি জবানবন্দি ও সাক্ষী দিতে অবশ্যই যাবে। জানবে, আমারই নির্দেশে তোমাকে ডাকা হচ্ছে। কোনও ভয় কোরো না। এখানে ডি. জি. এবং হোম-সেক্রেটারিকেও আমি চিনি। তা ছাড়া তুমি তো নির্দোষ। তুমি জানো।

আমিতো নিজেই যেতাম। কিন্তু ওই থৈবী! প্রথমে ও আমাকে টাকার লোভ দেখিয়েছিল। পঁচিশ হাজার টাকা। সাহেব, সারাজীবন তামু আর মোরে করলাম। হেরাফেরি করে টাকা কামালে কি সারাজীবন এই খাস-বেয়ারা হয়ে পড়ে থাকি? টাকার লোভ আমার নেই। ছিল না এক সময়ে, তা বলব না। কিন্তু টাকার লোভ করতে গিয়ে আমার স্ত্রীকে হারাই আমি। টাকা মানুষকে কিছুই দিতে পারে না। সারাজীবন টাকার মধ্যে বাস করে এই কথাই বুঝেছি, বুঝেছি জীবনের শেষে এসে।…

তোমার মালিক হেরাফেরি করতেন না কি একেবারে?নইলে মোরেতে এসে…

মিথ্যে কথা বলব না। করতেন হয়তো, তবে একটা বয়স পর্যন্ত। তারপর বহু টাকা করার পর সব ছেড়ে দিলেন। মানুষটার যে শিক্ষা ছিল সাহেব। টাকা, শিক্ষিত মানুষের হাতে এলে তার নানা ভাল ব্যবহার হয়, অশিক্ষিত মানুষের হাতে টাকা গেলে তারা রাবণ হয়ে ওঠে। শিক্ষা বলতে, ছাপের শিক্ষা বলছি না। আজকাল তো ছাপে ছাপে অস্থির। কিন্তু ছাপছাড়া হাচিনসন সাহেব, ছাপওয়ালা আমার সাহেব বা আচ্চাও-এর মতো মানুষ আজকাল দেখি কোথায়? সানাহানবির মতো মেয়ে? থৈবী নাম হওয়া উচিত ওরই, রাজ কুমারী থৈবী। যেমন চেহারা, তেমন ব্যবহার; সত্যিই রাজকুমারী! তা, থাঙ্গজম সিং-এর ডাইনি মেয়ের নাম হল থৈবী। আরও একটা কথা। আমার সাহেব ইবোহাল সিং মোরেতে পড়েছিলেন, অন্য কারণে। টাকার জন্যে নয়। উনি একজন বার্মিজ মেয়েকে ভালবেসেছিলেন, খুব অল্প বয়স থেকেই। কিন্তু মেয়েটি তাকে বিয়ে করেনি। তার নাম, উবাথিন। এখন মান্দালয়ে মস্ত বড় ব্যবসায়ীর বউ সে। সে প্রতিবছর বুদ্ধ-পূর্ণিমার দিনে তামুর প্যাগোডাতে পুজো দিতে আসে। যখন আসে, তখন মোরেতে এসে সাহেবের সঙ্গে একটা দিন কাটিয়ে যায়। গল্প করে, খায়-দায়। তার চার ছেলে মেয়ে। বড় বড় হয়ে গেছে সব। তারাও সকলে আসে। তার স্বামীও আসেন।

উ-মঙ্গ একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার বয়স হল আশির ওপর। কম তো দেখলাম না। এই পৃথিবীতে কে যে কীসের জন্যে কী করে, কে যে কী চায়, কেন চায়; এ সব আজও বুঝে উঠতে পারলাম না। যে কোনও মানুষকে ভাল অথবা মন্দ বলার আগে দশবার বিচার করা উচিত। নিজের ভুলের কথা ভাবা উচিত।

ঠিক।

ঋজুদা বলল।

 তারপর বলল, চলি উ-মঙ্গ।

 বলে, ঋজুদা নমস্কার করল বুড়োকে। ভটকাইকে বলল, প্রণাম কর।

 ভটকাই মনে মনে বিরক্ত হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

উ-মঙ্গ অভিভূত হয়ে গেল, মনে হল। চোখ মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, আমার সাহেবের খুনিকে ধরিয়ে দাও। তারপর আমি তোমাকে ইরোম্বা খাওয়াব একদিন। নিজে বেঁধে।

ঋজুদার জিভে যেন জল এল। বলল, ইরোম্বা! আঃ। কতদিন খাইনি। উ-মঙ্গ, জব্বর করে ঝাল দিয়ো কিন্তু।

উ-মঙ্গকে নামিয়ে দিয়ে ভটকাইরা এসে পুলিশ স্টেশনে চা খেল।

 ঋজুদা বলল অফিসারকে, আমি নিজে হয়তো আসতে পারব না। একে পাঠাব, সঙ্গে আরও দুজনকে। ওদের একটু বার্মার মুটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবেন স্যার– প্যাগোডা, বাজার, যদি টুকটাক কিছু শপিং করে। স্যুভেনির হিসেবে।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আমাদের যাওয়া-আসার উপরে কোনও বিধি-নিষেধ নেই। দুপক্ষেরই। ঝগড়া যা, নিউ দিল্লি আর রেঙ্গুনের মধ্যে। আমাদের মধ্যে ঝগড়া নেই। বলেই বললেন, স্যার ডি.জি. সাহেবের পি.এ. দুবার ফোন করেছিলেন আপনাকে। আমি এক্ষুনি জিপ পাঠাচ্ছিলাম, আপনার কাছে।

আমাকে? আমি তো এখনও যোগাযোগ করিনি।

না। উনি বললেন কলকাতা থেকে চিফ-সেক্রেটারি কারও ফোন পেয়ে হোম-সেক্রেটারিকে বলেছেন, উনি ডি. জি. সাহেবকে বলেছেন। মণিপুর পুলিশ এখন ইবোহাল সিং আর ইবোবা সিং-এর খুনিকে ছেড়ে আপনাকেই গোরু-খোঁজা করে বেড়াচ্ছে।

লাগান ফোন। নাম কী, ডি. জি. সাহেবের?

স্যার আমরা আদার ব্যাপারী। জাহাজের খবর কি রাখি? ডি. আই. জি-ই আমাদের ভগবান। তার উপরে আই. জি. তারও উপরে ডি. জি.। তবে শুনেছি। যে, তিনি অন্য ক্যাডারের। মানে, মণিপুরের নন।

লাইন মেলাতে প্রথমেই পি. এ. কথা বললেন, তারপর ডি.জি. নিজে।

ঋজুদা বলল, গুড আফটারনুন। তারপরই হাসি।

তারপর ইংরেজিতে বলল, ইওর অফিসার হিয়ার হ্যাঁজ এক্সটেনডেড অল হেলপ টু মি। থ্যাঙ্ক য়ু ভেরি মাচ। আই শ্যাল সি য়ু দিস ইভনিং অ্যাট ইওর রেসিডেন্স। হোয়াট টাইম ডু ঝু গো টু বেড? নো, নো, বিকজ আই মে বি লেট।

থ্যাঙ্ক য়ু ভেরি মাচ। নো নো, নট টু নাইট। উই উইল হ্যাভ ডিনার আফটারওয়ার্ডস। বাট নট টু নাইট। থ্যাঙ্ক য়ু।

থ্যাঙ্ক য়ু।

 ফেরার পথে, যেখানে মারুতি ওয়ান থাউজ্যান্ডটা ছিল পথের উপরে, খুনের জায়গাতে, সেখানেই মারুতি ভ্যানটা রেখে, ঋজুদা একা ডানদিকের একটা সঁড়িপথ দিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেল, ভটকাইকে একা বসিয়ে রেখে। এদিকে সন্ধে প্রায় হয়ে এল। ভয় করতে লাগল ভটকাই-এর।

ঋজুদা ফিরে এল যখন, তখন সঙ্গে একজন স্থানীয়, বয়স্ক মানুষ এগিয়ে দিয়ে গেল। ভ্যানটা স্টার্ট করে নিজেই বলল, একজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এলাম। এঁর নাম রঘুমণি সিং। জোতদার। থেংনোপালে একবার একটা ম্যান-ইটিং টাইগার বেরিয়েছিল। তখন সেই বাঘ মারতে এসে রঘুমণি সিং-এর বাড়িতেই ছিলাম। এখানেই। সেই থেকেই বন্ধুত্ব।

একটু চুপ করে থেকে ভটকাই বলল, ঋজুদা ইরোম্বা কী জিনিস?

ওঃ। ইরোম্বা? শুঁটকি মাছের এক দারুণ মণিপুরি প্রিপারেশান। ভাল কথা, আমরা কলকাতা ফেরার আগে মনে করিয়ে দিস আমাকে, তিতিরকে একটা পারিজাত-পারিং কিনে দেব।

সেটা কী বস্তু?

মণিপুরি মেয়েদের গলার গয়না। এখানে এসেও ওকে একটা পারিজাত-পারিং কিনে না-দেওয়াটা অন্যায় হবে।

.

ডি. জি. সাহেবের বাড়ির সামনে গাড়ির মেলা লেগে গেছিল। আই. জি. ক্রাইম, আই. জি. বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সেস, আরও কে কে।

যখন ওদের নীল মারুতি ভ্যানটা বেরোল, তার পেছনে পেছনে একটা সাদা-রঙা মারুতি জিপসিও বেরোল। তার পেছনে পেছনে একটা পুলিশের জিপ।

পুলিশের জিপটাকে মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে ঋজুদা থংগলবাজারে পৌঁছেই পবন টাঁইওয়ালাদের দোকানের সামনে পি পি করে হর্ন বাজাতে লাগল। তখন রাত এগারোটা বাজে। ওরা শুয়ে পড়েছিল। দোতলার বারান্দাতে পবন এসে দাঁড়াতেই ঋজুদা বলল, এত রাতে বিরক্ত করার জন্যে মাপ করে দাও, পবন। তোমার সাড়ভাই-এর গাড়ি অক্ষত অবস্থাতে ফেরত দিয়ে দিলাম। পেট্রল ট্যাঙ্ক ফুল করা আছে, যেমন ছিল। পরে যখন আসব তখন কথা হবে। তাড়াতাড়ি কাউকে পাঠাও। চাবিটা দেব।

পবন নিজেই নেমে এল। ধুতির উপরে হাতকাটা গেঞ্জি পরে ছিল। ডানহাতের চারখানা আঙুল নেড়ে পবন বলল, হুয়া কা সাব, বলিয়ে না? ফিন খুন হুয়া থাঙ্গজম সিংকো নেক লেড়কা, ইবোবা সিং। ই ক্যা হো গ্যায়া ইম্ফল কা?

ঋজুদা বলল, সব বাতায় গা। আইস্তা, আইস্তা। আভিতক ম্যায়ভি অন্ধাই হুঁ।

ঋজুদা আর ভটকাই সাদা মারুতি জিপসিতে এসে বসল। সার্জেন্ট এসে ঋজুদাকে বলল, মে উই গো ব্যাক স্যার?

প্লিজ। থ্যাঙ্ক য়ু ভেরি মাচ।

 জিপসিটা বড় রাস্তায় পড়তেই ঋজুদা বলল, এই গাড়িগুলো দারুণ। শুধু সামনের সিটগুলো যদি একটু বেশি বড় করত। লম্বা-চওড়া মানুষের পক্ষে দূরের পথ ড্রাইভ করে যেতে একটু কষ্ট হয়।

ভটকাই অধৈর্য হয়ে গেছিল। বলল, কী হল বলো না ঋজুদা। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

শনৈঃ শনৈঃ।

ভটকাই-এর কথাই ভটকাইকে গিলিয়ে দিল ঋজুদা। তোকে এখন সব বললে আবার তিতির আর রুদ্রকে দুবার করে বলতে হবে। তা ছাড়া বলার সময় এখনও আসেনি।

সানাহানবিই মেইন কালপ্রিট। অত সুন্দরী যে মেয়ে, তার মন কখনও সুন্দর হয়? কী মিষ্টি মিষ্টি কথা। কী কায়দা দাঁড়ানোর, হাসির; লেডি ডাই। তবে এ কথা ঠিক যে প্রিন্সেস ডায়ানার ডাবল বলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গাতে গিয়েই ও দু নম্বরী করতে পারে। রূপও ওরকম আবার মানুষও ভাল হবে, তা কী হয়?

আচ্ছা ঋজুদা, ডায়নাকে প্রিন্সেস ডাই বলে কেন সকলে? এতই ভালবাসে তো মরতে বলে কেন?

গাধারে! ডায়ানা শব্দটির ইংরিজি উচ্চারণ ডাইআনা। তাই, নামের প্রথমটুকু ওরা বলে, ভালবেসে বলে, প্রিন্সেস ডাই।

ও। তাই বলো। অনেকদিন পরে এ একটা হল স্টক। বাগবাজারে রকে গিয়ে মন্টেদের তাক লাগিয়ে দেব।

আচ্ছা, তোমার যোগেন ড্রাইভারকে কেমন মনে হয়? ওতো পাই।

স্পাই কি না জানি না। কিন্তু আগে পেটটা পুরো ঠিক হোক বেচারার, তারপর ওর কথা। ওকে যা শাস্তি তুই দিয়েছিস, তাতো গারদবাসের চেয়েও বেশি।

আচ্ছা, একটা কথা অন্তত বলো? রুবিটা কোথায় আছে এখন? বার্মাতে পাচার হয়ে গেছে? আমার তো মনে হচ্ছে উ-মঙ্গ-এর মেয়ের বাড়িতে আছে।

তা হবে হয়তো। তুই যখন বলছিস। তার আগে বল যে, হিরে দামি না রুবি। দামি?

হিরে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামি এ কথা আর কে না জানে!

ভুল কথা। বড় রুবির মতন দামি আর কোনও পাথরই নেই এই গ্রহে। তবে বড় রুবি পাওয়া ভারী দুষ্কর। ভাল রুবির রং কী রকম হয় জানিস?

কীরকম?

ঠিক পায়রার রক্তের মতন লাল।

পায়রার রক্তের লাল আবার অন্যরকম লাল না কি?

হ্যাঁ। লালের কতরকম হয়! চোখ খুলে দেখলেই দেখতে পাবি। কত রকমের সবুজ, কতরকমের হলুদও হয়।

এই সব পাথর কোথায় পাওয়া যায় ঋজুদা?

গাছে তো পাথর ফলে না। মাটির নীচে পাওয়া যায়, নানারকম প্রস্তরীভূত স্তরের ফাঁকে ফাঁকে। সোনা, রুপা, প্লাটিনাম, কয়লা, মানে, ব্ল্যাক-ডায়মন্ড, গ্রাফাইট, ব্রিসস্টোন, হিরে, এইসব হচ্ছে কার্বন মিনারেলস। আবার বেরিল, এমারাল্ড, অ্যাকুয়ামেরিন এ সব হচ্ছে বেরিলিয়াম মিনারেলস। ইউরেনিয়াম মিনারালস-এর মধ্যে আবার আছে পিচব্লেড, টর্বেনাইট। রুবি, স্যাফায়ার, করাম এ সব হচ্ছে অ্যালুমিনা মিনারেলস। ওপাল-ওনিক্স, ক্রাইসোপ্রেস, কার্নেশিয়ান, আগাটে এই সব আবার হচ্ছে চালসেডনি ভ্যারাইটির। আমার টোপাজ, গার্নেট আর কারনেশিয়ানের রং সবচেয়ে সুন্দর লাগে। এমারেল্ড, অ্যাকুয়ামেরিন এবং জারকন-এর হালকা ও গাঢ় সবজে রংও খুব ভাল লাগে।

আরও পাথর আছে?

আরও কতরকম আছে? আমি আর কতটুকু জানি। তোর সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে অরুণবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। জিওলজিস্ট। কত কী জানতে পারবি। তবে বার্মা কিন্তু রুবির জন্যে বিখ্যাত। বার্মাতে মোগক বলে একটা জায়গা আছে, সেখানকার রুবি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দামি। যে রুবি নিয়ে এ কাণ্ড সেটা হয়তো খুব সম্ভব মোগক-রুবি। কলকাতা পি. সি. চন্দ্রর বড়বাবু শ্রীজওহরলাল চন্দ্র দেখলেই বলতে পারবেন। বার্মার রুবির মতন শ্রীলঙ্কার স্যাফায়ার, দক্ষিণ আফ্রিকার কিম্বারলির হিরে, ট্রানসভাল-এর কোরান্ডাম, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস-এর ওপাল, ব্রাজিলের কোয়ার্টজ এ সব বিখ্যাত। এত কি আর মনে রাখা যায়, না আমি জিওলজির ছাত্র?

এগুলোর বাংলা নাম কী?

এই রে! এ সব দামি দামি জিনিসের খবর বড়লোকেরাই জানে। আমার মায়ের দুকানে দুটি মুক্তো, তাও ঝুটো ছিল কিনা জানি না, ছাড়া আর কিছুই তো নিজে চোখে দেখিনি। মুক্তো মাটির নীচে হয় না, জলে, সমুদ্রে হয়, ঝিনুকের মধ্যে। গরিবের ছেলেকে এ সব এমব্যারাসিং কথা জিজ্ঞেস করিস কীসের জন্যে?

আচ্ছা, তা হলে ইবোহাল সিং-এর সব সম্পত্তি কে পাবে? উইলের কোনও হদিস কি পেলে?

নাছোড়বান্দা ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, না।

 ভটকাই বুঝল যে চেপে যাচ্ছে।

 আচ্ছা ঋজুদা উ-মঙ্গ মানে কী?

বর্মী ভাষায় বড়দের বলে উ, ছোটদের বলে মাও আর সমবয়সিদের বলে কো। বুঝেছিস।

বুঝেছি। মানে উ-ঋজু, কো-তিতির, আর মাও-পটলা।

 পটলাটা কে?

 আমার পিসতুতো ভাই। চার বছরের ছোট।

ও। বর্মি ভাষায় র অক্ষরটা নেই–মানে ‘R’-এর উচ্চারণ করতে পারে না ওরা। রুদ্রকে বলবে উদ্র, রামকে বলবে ইয়াম। সাহেবরা যেমন অ বলতে পারে না।

পারে না? ভটকাই অবাক হয়ে শুধোল।

পারে কি? তা হলে তো ইংরেজরা বর্ধমানকে বর্ধমানই বলত, বার্ডোয়ান বলত কি? অনিতা বা অমিতাভ বলতে পারে কোনও ইংরেজ?

পাঞ্জাবিরাও পারে না। ভটকাই বলল।

অনিতাকে সাহেবরা বলবে অ্যানিটা, অমিতাভকে অ্যামিটাভ।

ভটকাই বলল, আর পাঞ্জাবিরা বলবে, আনিতা, আমিতাভ।

ঠিক।

তারপরই পেটে হাত দিয়ে বলল, ঋজুদা বারোটা বাজে। পেটটা পিঠের সঙ্গে লেগে গেছে। যা খিদে পেয়েছে না। এখন গিয়ে কাঙ্গপোকপিতে সানাহানবিদের বিরক্ত করবে? তার চেয়ে চলো দ্যা রিট্রিট-এ থেকে যাই রাতটা।

বিরক্ত কাউকেই করা ঠিক নয়।

 তবে রাতটা কাটাবে কোথায়?

চল, কাঙ্গলোটোংবীর কোনও ধাবাতে চৌপায়াতে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিই। রুটি আর আন্ডা তড়কা খেয়ে। কাল সকালে যাব কাঙ্গপোকপিতে।

যা বলবে তুমি। কিন্তু আবার আন্ডা? পেটে মুরগি ডাকবে যে।

তোর যা খুশি খাস।

পালক-পনির খাব।

একটা জিনিস ভাল হল যে, গাড়িটা নতুন। চিনবে না সহজে। মারুতি ভ্যানটা হয়তো চিনে গেছিল।

কারা? কাদের কথা বলছ?

যারা আমাদের চিনতে চায়। খাওয়া দাওয়ার পর দড়ির খাঁটিয়াতে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতে ভটকাই একটা বড় হাই তুলল।

কীরে। কী হল?

নাঃ। ভাবছিলাম, দ্যা রিট্রিট-এর ডানলোপিলো লাগানো বিছানাগুলো কী আরামের। গিজারও ছিল। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে চান করলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেত।

কী হল? এরই মধ্যে ক্লান্তি? রুদ্র আর তিতির তো তিনদিন তিনরাত কিছু না খেয়ে একটুও না ঘুমিয়ে লড়ে গেছে, রুআহাতে, আর তুই..

ছারপোকা।

 ছারপোকা, মাছি, মশা এইসব বাহ্যিক অসুবিধাই যে মানিয়ে নিতে না পারে সে কি সাধক হতে পারে? গোয়েন্দাগিরি হচ্ছে একটা বিশেষ সাধনা। বুঝেছিস?

ভটকাই পাশ ফিরে শুতে শুতে দেখল যে, ঋজুদা চৌপায়ার উপরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পাইপ খাচ্ছে আর পথের পাশের মস্ত কদম গাছটার দিকে চেয়ে কী সব ভাবছে। একমনে।

ভটকাই ঋজুদাকে পুরোপুরি চেনে না। চিনলে জানত যে, ঋজুদা আজকের রাতটা চিন্তা করেই কাটিয়ে দেবে। জ্যামিতি, অ্যালজাবরা, এরিথমেটিক, স্ট্যাটিসটিকস, সব মস্তিষ্কের কম্পিউটারে জ্বলবে আর নিভবে। নিভবে আর জ্বলবে।

ভটকাই-এর খুবই ইচ্ছে করে যে, ঋজুদার শাগরেদ হয়। কিন্তু ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেল। আর চিন্তা করা গেল না।

.

আগামীকাল দ্বিজেন মেসোর শ্রাদ্ধ। রাসবিহারী অ্যাভিনিউতেই হবে। থাকলে যেতাম। আমাকে কেন জানি না, উনি বিশেষ ভালবাসতেন। ওঁর একটা ডজ কিংগসওয়ে গাড়ি ছিল, হালকা হলুদ রঙা। গাড়িটা আমাকে চালাতে দিতেন, যখন আমি বেশ ছোট, তখনই।

আজ পূর্ণিমা। বালিশের তলা থেকে হাতঘড়িটা বার করে দেখলাম। রাত সাড়ে বারোটা। বাইরে ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। হাচিনসন সাহেবের ফার্ম হাউসের যেখানে যেখানে ফাঁকা জায়গা আছে, গাছ গাছালির ছায়া নেই, সেই সব জায়গা রুপোঝুরি। ছায়া বসে আছে এখানে ওখানে, ঘাপটি মেরে, বাঘের বা চিতার মতো। আর আলো-ছায়ার সাদা কালো ছড়িয়ে গেছে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া উপত্যকায়। বাঁদিকে, নাগাল্যান্ডের দিকে।

প্রকৃতির কোনও ভাগ নেই, দাগ নেই, চেকপোস্ট নেই, সে আদিগন্ত, বিস্তৃত, উদাত্ত। মানুষই তার ভাষা, তার গায়ের রং, তার আচার ব্যবহারের পার্থক্য দিয়ে প্রকৃতির চোখে গড়ে তুলেছে নানা বিভেদ। চেকপোস্ট বসিয়ে রাজ্যকে ভাগ করেছে, প্রকৃতির মধ্যে। সীমানা চিহ্ন দিয়ে দেশকে ভাগ করেছে, দেশের সঙ্গে।

কিছুদূরেই মাও’। যেখান থেকে নাগাল্যান্ড আরম্ভ। জানলা খুলে আমি দাঁড়িয়েছিলাম, সানাহানবির প্রিয় কুকুর টাইগারের কবরের দিকে চেয়ে। তিতির শুয়েছে সানাহানবির লাগোয়া ঘরে। আমার ঘরটা দূরে।

অল্প অল্প হাওয়াতে আন্দোলিত হচ্ছে গাছগাছালির হাত, হাতের আঙুল। নানা গড়নের ছায়ারা কালোতে আলপনা আঁকছে আলোর চাদরে। না, সন্দেহজনক কিছুই এ পর্যন্ত দেখা যায়নি কবরের কাছে।

জানলাটা খোলা রেখেই শুয়ে পড়লাম আবার। ঘুমের মধ্যেও কান সজাগ থাকে আমার। ঋজুদার কল্যাণে নানা জায়গার জঙ্গল পাহাড়ে তৃণভূমিতে রাতের পর রাত কাটিয়ে, আমার ইন্দ্রিয়গুলোর ধার বেড়ে গেছে অনেক। চোখ, কান, নাকের ক্ষমতা তো বহুগুণান্বিত হয়েছেই, অসাধারণ হয়েছে ষষ্ঠবোধের ক্ষমতা। এ বারবার অনুভব করে পরীক্ষিত সত্য হয়ে গেছে। তাই আবার ঘুমিয়ে পড়লেও আমি জানি, সামান্যতম শব্দতেও আমার ঘুম ভেঙে যাবে। এমনকী কবরের দিকে শব্দহীন পায়ে কেউ এগোলেও আমি জেগে যাব। অনেক মানুষখেকো বাঘের মোকাবিলা করে আমি নিজেও মানুষখেকো বাঘের মতো সাবধানি ও সজাগ হয়ে গেছি।

বেচারি ভটকাই এখন কোথায় কে জানে! ঋজুদার খপ্পরে আমরা এখন অভ্যস্ত। ওর সময় লাগবে অনেক।

***

ভটকাই অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ পেটের পাশে আচমকা খোঁচা খেয়ে চোখ মেলল। দেখল, ঋজুদা তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ঋজুদা বলল, উঠে পড়। এখুনি ভোর হবে। চোখমুখ ধুয়ে, চা খেয়ে তৈরি হয়ে নে। এখুনি তোকে বাস ধরে যেতে হবে ইম্ফলে।

ইম্ফলে?

হ্যাঁ।

কেন?

এত প্রশ্ন করিস কেন? যা বলছি শোন। এই নে, চা খেয়ে এই চিঠিটা নিয়ে যাবি পুলিশের ডি. জি-র বাড়িতে। আমার একটা কার্ডও রইল। এই কার্ডটা দেখাবি, যদি কেউ ছেলেমানুষ বলে ঢুকতে না দেয়। তারপ জি. ডি-এর হাতে এই চিঠিটা দিবি। সিল করা আছে।

ইম্ফল যাব আবার? পথে দ্যা রিট্রিট-এ নেমে পড়ে একটা ফোন করে দিলে হত না।

না। হত না। যা বলছি তাই কর। চিঠি দিয়ে আবার বাসে করেই ফিরে আসবি হাচিনসন-এর বাংলোতে। গাড়িটা যদি চালাতে পারতিস তবে জিপসিটা নিয়েই যেতে পারতিস। যতদিন না ভাল গাড়ি চালাতে শিখছিস, ভাল হিন্দি আর ইংরিজি বলতে শিখছিস তোকে নিয়ে আর কোথাও আসব না। তিতিরকে দেখতে? কতগুলো ভাষা জানে। ওই সব ভাষা কি স্কুলে শিখেছে? রামকৃষ্ণ মিশনে শিখেছে, তারপর ওই ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ভাষাগুলো রপ্ত করেছে। ইচ্ছা থাকা চাই। তা তো নয়। খালি সমানে লোকের পেছনে লাগবি, ভাঁড়ামো করবি আর ভাববি সেইটেই সবচেয়ে বাহাদুরির। এই নে, একশো টাকা রাখ। খিদে তো পাবেই। ইম্ফলে কোনও দোকানে ভাল করে করে খেয়ে নিয়ে তারপর বাসে উঠিস। কোহিমার বাসে উঠবি। টিকিট কাটবি ‘মোরাং’-এর, কিন্তু নেমে যাবি কাঙ্গপোকপিতে।

টাকা তো আমার কাছে আছে। মোরাং’-এর টিকিট কাটব কেন?

কেউ যাতে আগে থেকে বুঝতে না পারে তুই কাঙ্গপোকপিতে আসছিস সেই বাসে তো আমাদের ভাল চায় না এমন কেউও থাকতে পারে। মাথা দিয়েছেন ঈশ্বর, মাথাটাকে খাটা। যত খাটাবি মাথা তত খাটবে। এই একটিই যন্ত্র আছে দুনিয়াতে, যা খাটনিতে তেজি হয়, ঝিমিয়ে পড়ে না।

ঋজুদা, তুমি রাতে কোথায় গেছিলে? আমি দুটো নাগাদ একবার ঘুম ভেঙে উঠেছিলাম। দেখলাম তুমি নেই। মারুতি জিপসিটাও নেই।

আর বলিস না। গেছিলাম ‘দ্য রিট্রিট’-এর কাছেই। দেখলি না, পথের উপরে একটা এস. টি. ডি, আই.এস.ডি-র দোকান ছিল। সেখানে গেছিলাম কলকাতায় ফোন করতে।

কাকে?

সনৎদাকে। গ্রেড ডেন কুকুর এবং তাদের অসুখ বিসুখ সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল।

 জিজ্ঞেস? রাত আড়াইটায়?

কী আর করা যাবে! রেগে একেবারে কাঁই। তারপর যখন বললাম, ইম্ফল থেকে বলছি, তখন রাগ পড়ল। তবে যা জানার, জানা হল। এই বড় কথা।

আর? আর কাকে করলে ফোন?

 গদাধরটার কথা মনে হচ্ছিল খুব। তাকেও করলাম একটা।

রাত আড়াইটাতে? সেও তো হার্টফেল করে মরতে পারত।

না, না, তার অভ্যেস আছে। কিন্তু মনে যা হয়েছিল, তাই।

কী?

জ্বর হয়েছে গদাধরের। বেশ ভাল জ্বর। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে এখান থেকে। আমি ছাড়া গদাধরের কে আছে বল আর? সারাটা জীবন, বিয়ে-থা করল না। আমার সেবাতেই কাটিয়ে দিল। তাকে আমি না দেখলে অত্যন্ত অন্যায় কাজ হবে।

তা ঠিকই বলেছ।

 বলল বটে ভটকাই, কিন্তু মনে মনে মোটেই খুশি হল না। সাঙ্গাই, অর্থাৎ নাচুনে হরিণ দেখা হয়নি এখনও, লাকটাক লেক-এ যাওয়া হয়নি, সেই হ্রদের উপরে উদ্ভিদের ভাসমান গালচে, ফুমডি দেখা হয়নি। বার্মার মুও দেখা হল না। আরও কত কী। মনে হচ্ছে যাত্রাটা একবারেই ভাল হয়নি।

তারপর বলল, ওই যে বাস আসছে। আমি তবে যাই।

 চা খেলি না?

না এখনও তো অন্ধকার আছে। ইম্ফলে গিয়েই খাব এখন, কাজ সেরে।

.

ভটকাই ফিরে এল সকাল দশটা নাগাদ। আমার আর তিতিরের কোনও কথার উত্তর না দিয়ে সোজা ঘরে গিয়ে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল।

ঋজুদা ফিরল তার ঘণ্টা দুয়েক পরে, সাদা মারুতি জিপসি নিয়ে। তবে সেদিন নয়। তার পরদিন। চিন্তাতে ফেলেছিল আমাদের। গাড়ি বদল কখন হয়েছে জানি না। ভটকাই হয়তো জানত। কিন্তু পাকা গোয়েন্দার মতো সব কিছুই চেপে গেছে, আমাদের কাছে।

হর্ন বাজিয়ে গাড়ি নিয়ে বাংলোর ভিতরে ঢুকতেই, আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম, ঋজুদার দিকে।

বললাম, কী ব্যাপার ঋজুদা? কী হল? ভটকাই কোথায় গেছিল, তুমিই বা কোথা থেকে এলে? ছিলে কোথায়?

ভটকাই ফিরে এসেছে?

হ্যাঁ। গতকাল, দশটা নাগাদ, সকালে। আর ফিরে থেকে এমন হাবভাব করছে, যেন রাজ্য জয় করে এসেছে। আর, কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলছে, শনৈঃ শনৈঃ।

ঋজুদা হাসল। তারপর, গাড়ি থেকে নেমে বাংলোর দিকে যেতে যেতে বলল, বলব পরে সব। এখনও আসলে বলার মতো কিছুই হয়নি। এখানে কি কিছু ঘটেছে, কাল এবং পরশু রাতে?

আমি মাথা নাড়লাম।

চল। ঘরে গিয়ে চানটান করে রেস্ট করি। খুব ক্লান্ত লাগছে। বিকেলে আবার বেরোব।

.

বিকেল থাকতেই আমি আর ঋজুদা বেরোলাম–সাদা মারুতি জিপসিতে।

 ঋজুদা বলল, তুইই চালা রুদ্র। আমি একটু পাইপ খাই আর ভাবি।

 কোথায় যাব এখন?

অনেক জায়গাতে। প্রথমে যাব থাঙ্গজম সিং-এর বাড়ি, পাওনা বাজারে। বেচারার একমাত্র ছেলেটা খুন হয়ে গেল। ভদ্রতার খাতিরেও যাওয়া দরকার। তা ছাড়া গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে তো পরশু সকালেই যোগেনকে পাঠিয়েছিল।

ইম্ফলের পাওনা বাজারের কাছে পৌঁছতে, ঋজুদার নির্দেশে ডাইনে বাঁয়ে করতে করতে বিরাট কম্পাউন্ডওয়ালা আর উঁচু দেওয়াল দেওয়া একটা বিরাট বাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। ইম্ফল শহরে যে এতরকম গাড়ি আছে, তা ওখানে না এলে জানতাম না। কত লোকই গেছেন, সমবেদনা জানাতে। জিপসিটা দূরে পার্ক করিয়ে রেখে আমরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখলাম, বিরাট লম্বা চওড়া একজন গুণ্ডামতো মানুষ, প্রকাণ্ড ড্রয়িংরুমের মধ্যের মস্ত একটি সোফাতে বসে আছেন, আর অগণ্য মানুষ তাঁর চারদিকে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

এই আপনার আসার সময় হল, বোস সাহেব?

কী করব। হাতের যে কাজ নিয়েছি সেটা শেষ না করে যে আসতে পারছিলাম না।

সেই কাজ শেষ হয়ে গেছে?

পুরো নয়। প্রায়।

বলেন কী?

হ্যাঁ।

কনগ্রাচুলেশানস। আমার এই অবস্থাতেও…

 ঋজুদা বলল, আপনার পুত্রবধূ কোথায়?

 তারপরই বলল, সমবেদনা জানাবার ভাষা আমার নেই সিং সাহেব।

অন্যমনস্ক গলায় মিস্টার সিং বললেন, হ্যাঁ ডাকছি। বলে, কাকে যেন কী বললেন, মণিপুরিতে। সম্ভবত কোনও আত্মীয়কে।

আলুথালু বেশে একজন অল্পবয়সি মহিলা ঘরে এলেন। বুঝলাম যে ইনিই ইবোবা সিং-এর স্ত্রী যমুনা। ঋজুদাকে সে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। যমুনার চেহারাতে ভারী একটা শান্ত শ্ৰী আছে। সানাহানবি একধরনের সুন্দরী আর যমুনা অন্যধরনের। সৌন্দর্যেরও কতরকম থাকে। সত্যি।

ঋজুদা এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত দিল। ঘরের সকলে এই অপরিচিত ঋজুদাকে দেখে, ইবোবা সিং-এর স্ত্রীর শোক কেন উথলে উঠল তা বুঝতে না পেরে, অবাক চোখে যমুনা, ঋজুদা এবং থাঙ্গজম সিং-এর দিকে চেয়ে রইল। ফিসফিস করে কী সব বলাবলি করতে লাগল।

থাঙ্গজম সিং বললেন হাঞ্জোও..শুনেছেন তো! একেকজনের গায়ে, কম করে কুড়িটা গুলি লেগেছিল। গভর্নমেন্ট কী যে করছে, কে জানে! মানুষের পক্ষে তো ঘরের বাইরে বার হওয়া অসম্ভব। মোরের কাঠগোদাম থেকে কয়েক লক্ষ টাকার সেগুনের লগ পাচার হয়ে গেছে বার্মাতে, এই খবর পেয়েই হাঞ্জো আর ইবোবাকে পাঠালাম–তাদের সঙ্গে রিভলভারও ছিল। কিন্তু তা বের করার সময় পেল কই। থেংনোপালের ঘাটিতে একটা হেয়ারপিন বেন্ড পেরোনোর পরেই, রোড ব্লক। আর কী ব্যাপার বোঝার আগেই, গুলিতে মারুতি ওয়ান থাউজ্যান্ড ঝাঁঝরা হয়ে গেল। আমার একমাত্র ছেলে–বোস সাহেব।…কত কী ভেবেছিলাম। একটা লিমিটেড কোম্পানি করব। কলকাতা থেকে অনীক সেন সাহেবকে…।

এতবড় লম্বাচওড়া গুণ্ডার মতো মানুষটা, হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন। ২৫৪

ঋজুদা ওর কাছে গিয়ে, কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দু একদিনের মধ্যে আমি আবার আসব। কী করবেন বলুন? ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস।

ওদের কাছে বিদায় নিয়ে ঋজুদা বেরিয়ে এল। আমার চোখের সামনে প্রকাণ্ড ঝাড়লণ্ঠন জ্বালা, আলো ঝলমল পিওর বার্মাটিকের আসবাবে ভরা, ঐশ্বর্যের প্রতিমূর্তি, ওই বসবার ঘরে–সেই সন্তানহারা বাবার মূর্তিটা চিরজীবনের মতো আঁকা হয়ে গেল।

গেট অবধিও যাইনি, এমন সময়ে যোগেন কুণ্ডু দৌড়ে এল। টাটা সিয়েরা গাড়িতে সে অন্য দুজন ড্রাইভারের সঙ্গে বসে গল্প করছিল। দৌড়ে এসে বলল, সেদিন না-আইয়া ভালই করছেন। দাহ হইতে হইতে আজ ভোর। পোস্টমর্টেম-টর্টেম–পুলিশের যা হ্যাঁপা। অবশ্য এক দিক দিয়া ভালই হইছে– বৌদির মামা, যে নাকি গুয়াহাটিতে ইনক্যামটাক্সো কষেন, তিনিও দাহর আগে আগে আইস্যা পৌঁছাইয়া গেলেন।

তোমার পেট কেমন আছে, যোগেন বাবু?

আমি বললাম।

 হ। এহনে ভালই কম। তবে প্যাটের কথা ভাবনের সময় কই কন? তবে একটা ডিসিশিন লইয়া লিছি। আমার ওয়াইফেরেও কইয়া দিছি যে, লাইফে ঘোষেগো দুকান থিক্যা আর কোনও মিষ্টিই কিনুম না। আমার ওয়াইফতো এখনও এক্কেরে ন্যাতাইয়া আছে দেহি। বিচারি! অবলা জীব!

বলেই, ঋজুদাকে বলল, আপনাগো অবস্থা কেমন। তাই কহেন দেহি।

একই রকম। আর কী হবে! ঋজুদা, বলেই, চুপ করে, সামান্য বিরক্তির সঙ্গে আমার দিকে চেয়েছিল। আমি বললাম, এক যাত্রায় পৃথক ফল তো হয় না।

ভালবেসে কি পান্তুয়াই যে খাওয়ালেন,যোগেন বাবু! যুধিষ্ঠির ঋজু বোসও মিথ্যে কথা বলল, পাণ্ডব বংশকে বাঁচাতে।

আমাদের জিপসি অবধি পায়ে হেঁটে পৌঁছে দিয়ে যোগেন বলল, বাসরে! ঘণ্টায় ঘণ্টায় গাড়ি বদলাইতে আছেন দেহি আপনারা। ব্যাপারটা কী?

আরে ভাড়ার গাড়ি, বোঝো তো। যখন যেমন দেয়। আমাদের কি আর বাছাবাছির উপায় আছে? তবে ড্রাইভার ছাড়া তো। ভাড়াটা একটু কম পড়ে, আর মারুতিতে তেলের খরচ নেই বললেই চলে। এই আর কী!

বড় রাস্তায় পড়তেই ঋজুদা বলল, জোরে চালা। আর, কোনও গাড়ি আমাদের ফলো করছে কি না তা দেখবি মাঝে মাঝেই, রিয়ার-ভিউ মিরারে। ভুলে যাস না। মিরারটা তো তোর দিকেই ঘোরানো।

যাব কোথায়?

 চল না। জোরে চল। বলব।

 মিনিট সাতেক চালাবার পরই ঋজুদা বলল, সামনে ওই যে, বাঁদিকে প্রকাণ্ড কম্পাউন্ডওয়ালা বাংলোটা–আলো জ্বলছে গেটের দুপাশে। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, ওর ভিতরে ঢোকা। গেটে স্লো করিস গাড়ি। সিকিউরিটির খুব কড়াকড়ি, টেররিস্টদের যা দৌরাত্ম।

এটা কার বাড়ি?

ডি.জি. অফ পুলিশ। ডিরেক্টর জেনারেল।

এটি ডি.জি-র বাড়ি। বাড়িতেও পুরোদস্তুর অফিস একটি। পি. বি. এক্স বোর্ড থেকে শুরু করে, সব কিছু। এঁদের চব্বিশ ঘণ্টাই কাজ।

কাম ইন, কাম ইন, বলে দাঁড়িয়ে উঠে আপ্যায়ন করলেন ডি.জি.। দেখলে মনে ‘ হয়, ইংরিজির অ্যাবসেন্ড-মাইন্ডেড প্রফেসর। বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিসম্পন্ন। পুলিশ বললে আমাদের মনে যে ছবি ফুটে ওঠে, তার সঙ্গে কোনওই মিল নেই।

ঋজুদা জিজ্ঞেস করল, উ-মঙ্গ কি আজ মোরে থেকে এসেছে, তম্বি সিং-এর বাড়িতে?

হ্যাঁ, এসেছে। বিকেলের বাসে। ইওর গেস ইর্জ হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট।

 তম্বি সিং কি বাড়িতেই আছেন, না কাঙ্গপোকপির দিকে বেরিয়ে পড়েছেন?

আজ বোধহয় বেরোতে পারবেন না। কারণ উ-মঙ্গ-এর বাসই পৌঁছেছে। বিকেলে। আমার মনে হয় আগামীকাল দুপুরের দিকে বেরোবে। আমার লোক। ওদের কনস্ট্যান্টলি ওয়াচ করছে। হয়তো থাঙ্গজম সিং-এর সঙ্গে দেখা করবে। তার কোনও গাড়িও নেবে হয়তো। নয়তো, ভাড়া গাড়ি। এবং ওরা কাঙ্গলোটংবী থেকে হেঁটে যেতে পারবে না রাতের বেলা। মনে হয়, কাঙ্গপোকপি থেকেই। যাবার চেষ্টা করবে। দুজনেরই তো পায়ে আর্থারাইটিস। বয়স তো কম হল না।

বয়স হল বটে, কিন্তু লোভ তো কমল না।

 হাসলেন ডি. জি.। বললেন, দেখা যাক কী করে ওরা। ওরা এখান থেকে রওয়ানা হলেই, কাঙ্গপোকপিতে আপনাদের ফোন করে দেব।

ঋজুদা বলল, তম্বি সিং এবং উ-মঙ্গ দুজনের কারোই যেন মৃত্যু না হয় পুলিশের গুলিতে। স্ট্রিক্ট ইনস্ট্রাকশন দিয়ে রাখবেন।

ইয়েস। ইয়েস। দেওয়া আছে। প্লিজ ডোন্ট ওয়ারি। ডি. জি. বললেন, ইবোবা সিং-এর মার্ডারটা সম্বন্ধে আপনার কোনও হাঞ্চ আছে? বোস সাহেব? আপনি যদি বলেন তো ওই কেসটাও আপনাকে…

না না। ওতো আপনারাও ভাল করেই জানেন যে টেররিস্টদের কাজ। কোনও পার্সোনাল লিঙ্কস ছিল না হয়ত। নেহাতই ভুল করে মেরেছে। যুদ্ধ যখন আরম্ভ হয়, তখন গুলিগোলা ছোঁড়ার পেছনে কোনও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য থাকে না। পুরো ব্যাপারটা ইমপারসোনাল হয়ে ওঠে। ব্যাড লাক। তা ছাড়া আপনি তো জানেন যে, আমি এখানে এসেছি রুবিটা খুঁজে বের করতে, আর রাজা ইবোহাল সিং-এর খুনের তদন্ত করতে।

আ! বোস সাহেব। ডোন্ট কল হিম আ রাজা। হি ওয়াজ অ্যান ইমপোস্টর রাইট ফ্রম দ্যা বিগিনিং।

বাট হিজ ম্যানারস, অ্যান্ড লাইফস্টাইল ওয়ার ভেরি মাচ লাইক আ রাজা। হি ওয়াজ অ্যান অ্যারিস্টোক্রাটবাই হোয়াটেভার নেম ইউ মে কল হিম।

ঋজুদা ডি. জি-র অফার করা চায়ে এক চুমুক দিয়ে বলল, একটা কথা, এখানের মানে, এই খুন প্রসঙ্গে যাঁরাই জড়িত, তাঁরা প্রত্যেকেই জেনে আশ্চর্য হচ্ছেন হয়তো যে, মণিপুর ও নাগাল্যান্ড এমনকী বার্মার তামু ইত্যাদি জায়গাও এত ভাল করে জানলাম কী করে। এতে বাহাদুরি কিছুই নেই কারণ, নানা সূত্রে উনিশশো ছাপান্ন থেকে সত্তরের দশকের গোড়া অবধি আমি প্রায় বার দশেক এসেছি এখানে। একবার এসেছিলাম মণিপুর বার্মা এবং নাগাল্যান্ড, এই দুই প্রদেশ এবং এক দেশে যার বিচরণ ছিল, এমন এক নরখাদক বাঘ মারতে। অবশ্যই একা আসিনি। সঙ্গে আরও নানাজনে এসেছিলেন। তাদের নামোল্লেখ করছি না। কারণ, করলে, আপনি বোর হবেন প্রথমত, এবং দ্বিতীয়ত ভাবতেও পারেন যে, নেমড্রপিং করছি।

ডি. জি. হেসে বললেন, নেমড্রপিং করেন তাঁরাই, যাঁরা নিজেরা নন-এনটিটি। আপনি কোন দুঃখে নেমড্রপিং করতে যাবেন?

ঋজুদা হেসে বলল, সেই সব সময়েই আলাপ হয়েছিল থেংনোপাল-এর অত্যন্ত অবস্থাপন্ন চাষি রঘুমণি এবং আরও কত অগণ্য মানুষের সঙ্গে। থংগল-বাজার ও পাওনা বাজার এবং খইরামবন্দবাজারের বহু ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এই তথ্যটা, আমাকে যে নিয়োগ করেছেন, তিনি আগে জানলে হয়তো, প্রকৃত খুনিকে ধরবার জন্যে, নিজে অপাপবিদ্ধ বলে নিজেকে প্রমাণ করার জন্যে, ওভার কনভিডেন্ট হয়ে আমাকে ডেকে এনে নিজের বিপদ ঘটাতেন না।

আপনাকে আপ্যায়ন করেছেন কে? যদি আপত্তি না থাকে তা জানতে পারি কি, মিস্টার বোস?

প্রথমত, আপত্তি আছে স্বাভাবিক কারণে, তাঁর নাম এখনই জানাতে। দ্বিতীয়ত, আমার কাছে যিনি গেছিলেন প্রকৃত নিয়োগকারীর একজন দূত মাত্র। তিনি আসলে কার হয়ে সে কাজটি করেছিলেন, সে সম্বন্ধে এখনও আমি নিঃসংশয় নই। তবে নিঃসংশয় হব। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আপনার সহযোগিতার খুবই প্রয়োজন হবে, কারণ আমার মনে হওয়া, অর্থাৎ ASSUMPTIONS-কে সত্যে পরিণত করতে পারবে, আপনার বিভাগের অফিসারদের জেরাই! অপরাধী সবসময়েই মিথ্যা বলবে, অপরাধ অস্বীকার করবে, কিন্তু আমার দেওয়া Clueগুলো নিয়ে আপনার অফিসারেরা যদি সিরিয়াসলি, ওঁদের পেশাদারি যোগ্যতা এবং সততা, আই রিপিট স্যার, সততা, যদি সতোর সঙ্গে এগোন, তা হলে আমার কাজ আর বারো ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

তারপরই থেমে বলল, আশা করি, আপনার সঙ্গে আমার আগের মিটিং-এ যে কটি অনুরোধ করেছিলাম, তা ঠিকঠাক পালন করবার জন্যে আপনার অফিসারদের বলে দিয়েছিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে। এবং এমন সিক্রেসির সঙ্গে তা করা হয়েছে যে, ক্রাইম ডিটেকশনের যে সব অফিসারেরা সাধারণত এই সব কাজে যুক্ত থাকেন, তাঁদের পর্যন্ত জানানো হয়নি। য়ু মে রেস্ট অ্যাসিওরড, মিস্টার বোস। দিনে রাতের চব্বিশ ঘণ্টা…

আরও চব্বিশ ঘণ্টা লাগবে না।…

আমার আই. জি. ক্রাইম কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না?

না, না, তা রাখছেন। ওঁর নিজের রাখার প্রয়োজন নেই। যাঁদের রাখার, তাঁরা রাখছেন।

তবু, যখনই দরকার হবে আমাকে ফোন করবেন। যদি কোনও কারণে আমাকে পান তবে আমার পি. এ-কে জানাবেন। আপনার কথা তাকে সবই বলা আছে। উনি জানেনও, সঙ্গে সঙ্গে কাজ হবে। আমি না থাকলে আমার ডায়রেক্ট লাইনের কল উনিই ওঠাবেন। দিনে রাতে দুজনে থাকেন। টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স। আপনি শুধু বলবেন আর. বি. বলছি–ডি. জি-কে এই মেসেজটা দিয়ে দেবেন।

থ্যাঙ্ক য়ু স্যার।

ঋজুদা বলল।

.

ঋজুদা ঘুম থেকে উঠল, প্রায় আটটাতে। এমনটি কখনওই করে না। গতরাতে যদিও আমাদের পৌঁছতে এমন কিছু দেরি হয়নি, কাঙ্গপোকপিতে।

গতরাতে ইম্ফল আসবার সময়ে আমরা মৈরাঙ্গখম-এ তম্বি সিং-এর সঙ্গে ও দেখা করে এসেছিলাম। সে এক অভিজ্ঞতা।

না বলে-কয়ে যাওয়াতে তম্বি সিং চমকে গেলেন। এই তম্বি সিং সেই শহুরে তম্বি সিং নন। একেবারেই অন্য তম্বি সিং। ঋজুদা তাঁর ভেকটা কলকাতায় প্রথম দর্শনেই ধরে ফেলেছিল যে তা এখন বোঝা গেল।

পরনে এখন ধুতি তাঁর। গায়ে ছিটের একটা বগল-ছেঁড়া শার্ট। হাতে, পাহাড়িদের মতো পাইপ। তামার তার দিয়ে বাঁধা, ঋজুদা যেমন বলেছিল, থুথুতে-তামাকে একাকার। কখনও বোধহয় পাইপটা পরিষ্কারও করেন না তম্বি সিং, পাইপ ক্লিনার দিয়ে। টেবলের ওপরে একটা বোতল। লালরঙা কিছু তার মধ্যে। পানীয়। তম্বি সিং-এর উলটোদিকের চেয়ারে বসে একজন বুড়ো চেকচেক লুঙ্গি-পরা। মাথায় বার্মিজ টুপি। গায়ে লাল-রঙা হাফশার্ট।

ঋজুদাকে দেখেই, দুজনেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন।

বয়সও হয়েছে দুজনেরই। মনে হচ্ছে, আর্থারাইটিসও আছে।

ঋজুদা ফিসফিস করে বলল।

তম্বি সিং-এর উলটোদিকে-বসা সেই বুড়োকে ঋজুদা বলল, আমার কাজটা কি করেছ? কী উ-মঙ্গ, শরীর ভাল তো?

না কাজটা করিনি। সেই জন্যেই তো মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে এখানে চলে এলাম।

তোমার উপরে ইবোহাল সিং-এর বাড়ির জিম্মা, আর তুমি…।

না। এখানে এলাম, কারণ, কাজ নেই সেখানে। তম্বি সিং-এরও শরীরটা ভাল। আসার আরও একটা কারণ, থাঙ্গজম সিং-এর সঙ্গে দেখা করা। এত বড় শোক! আর জানাশোনা তো আমাদের সঙ্গে কম দিনের নয়! একটা মাত্র ছেলে, এরকম…

ভালই করেছ।

তা, মোরের বাড়ি এখন দেখছে কে?

আমার এক ভাইপোকে রেখে এসেছি। ঝাড়পোঁছ করবে। আর কাউকে যে ঠিক করব পয়সা দিয়ে, উপায় তারও নেই। বাড়ির মালিক যে কে, তাইতো জানি না। আমি টাকাই বা পাব কোথা থেকে?

ঋজুদা কী যেন বলতে গেছিল, বলতে গিয়েই থেমে গেল। উ-মঙ্গ নামক বার্মিজ লোক্টা ঋজুদার দিকে চোখ তুলে চাইল।

তা হলে আমি চলি। তোমরাও বেরোবে। সাড়ে সাতটা তো বাজে।

এই ছেলেটা কে? আপনার ছেলে?

না, না, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। এও গোয়েন্দা।

আর সেদিন যাঁকে এনেছিলেন?

 উ-মঙ্গ বলল।

সেও। তারপরে বলল, চলি। তোমরা বেরোবে না?

ইচ্ছে করেই দেরি করে যাব একটু। যাতে ভিড় কমে। এ সব দুর্গন্ধ পানীয় খেয়ে দশজনের সামনে শোকের বাড়িতে যেতে চাই না।

ঠিক।

আমার কেস-এর সলুশানের কী হল? কাঙ্গপোকপিতে যত্ন-আত্তির ত্রুটি হচ্ছে না তো? তম্বি সিং বললেন।

বিন্দুমাত্র না।

হ্যাঁ। পাইপে একটা টান দিয়ে তম্বি সিং বলল, হয়। যত্ন-আত্তি সকলেরই হয়। নিজের বাপের ছাড়া।

বলেই বলল, একটু ভাল তামাক দিন তো মি: বোস আপনার। কী তামাক এটা? ভারী সুগন্ধ ছাড়ছে তো!

হ্যাঁ, কিন্তু আমি যে তামাকটা খাই, সেটা পাইনি বলেই এটা খাচ্ছি। এইটা, যে-মানুষেরা কাছে থাকেন তাঁদের খুশির জন্যে যতটা খাওয়া, তাঁর নিজের জন্য ততটা নয়।

তাই? নাম কী এই তামাকের?

অ্যাম্ফোরা। ডাচ তামাক।

সেটা কোথায়?

ডাচ আবার কোন দেশ?

 ডাচ কোনও দেশের নাম নয়?

না না। ডাচ মানে, হল্যান্ডের মানুষ, জিনিস।

ও, আই সি।

 বার্মিজ লোকটা কড়া এবং খুব কটুগন্ধের সিগার খাচ্ছিল।

আমার অবাক লাগল, তম্বি সিং-এর পোশাক ও রাজাগিরির এমন হঠাৎ পরিবর্তন সম্বন্ধে ঋজুদা একটিও প্রশ্ন করল না দেখে।

চলি আমরা তা হলে।

 ঋজুদা বলল।

আচ্ছা।

এবারও দুজনে একসঙ্গে উঠে দাঁড়াতে গেল।

ঋজুদা মানা করল।

.

আজ দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর, আমরা সকলে মিলে কোহিমাতে গেছিলাম। নাগাল্যান্ডের রাজধানী। মাও’তে বর্ডার পেরিয়ে। সিকিওরিটির বড় কড়াকড়ি, বর্ডারে। অদ্ভুত অদ্ভুত নাম সব এদিকের জায়গাগুলোর। গভীর জঙ্গল, পাহাড়, উপত্যকা আর শুধুই মিলিটারি, চারদিকে। নাগা টেররিজমও চলছে আজ প্রায় পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর হয়ে গেল। এখন মণিপুরে নাগা কুকিদের লড়াই জোরদার হয়েছে। কুকিরাও বাধ্য হয়ে টেররিস্ট হয়েছে।

ভটকাই বলল, কী সব নাম রে বাবা!

মারান, মাও, খুজামা, জুকুমা, কিগওয়েমা, তারপরে কোহিমা।

কোহিমাতে পৌঁছে সিমেটরি দেখতে গেলাম আমরা। কবরখানা। বাচ্চাবাচ্চা সব ইংরেজ, স্কটিশ, ওয়েলস ছেলেদের কবরে, তাদের মা-বাবারা যা লিখে পাঠিয়েছেন এবং লেখা আছে স্মৃতি ফলকে, মাৰ্বল ট্যাবে তা পড়লে, চোখে জল আসে।

ঋজুদা বলল, এইরকম সিমেটরি এবং এর চেয়ে অনেকেই বড় আছে। ইলেও। পারলে, দেখিস।

ভটকাই বলল, তোরা তো দেখলিই না এখনও, ‘মোরে’র পথের দুপাশে কত ট্যাঙ্ক পড়ে আছে দুপক্ষেরই। জাপানিরা তো প্রায় ডিমাপুর অবধি পৌঁছে গেছিল। সেখানেই তো রেইল-হেড। পৌঁছতে পারলে আর কথাই ছিল না। দুপক্ষেরই কত সৈন্য মরেছে তখন, আর মরেছে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে বার্মা থেকে যারা ওই পথেই মান্দালয় হয়ে, তামু হয়ে, মোরে হয়ে বার্মা ছেড়ে পালিয়ে আসতে চেয়েছিল, প্রাণ নিয়ে। গুলিতে, বোমাতে, মাইনে মরেছে অগণ্য মানুষ। তার চেয়েও বেশি মরেছে পথে, অসুখে, খিদেতে, জলের অভাবে।

সানাহানবি বলল, এইসব কবরখানা দেখে একটা কথাই মনে হয় বারে বারে, যুদ্ধ করে মূর্খরা। সে নিজের ঘরের মধ্যে যুদ্ধই হোক আর সিভিল ওয়ারই তোক অথবা একদেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধই হোক। এখনও যদি মানুষের শিক্ষা সম্পূর্ণ না হয়ে থাকে, তো আর হবে না কোনওদিনও।

ঠিকই!

ঋজুদা বলল।

 ফিরে আসার সময়ে, দারুণ মেঘ করে বৃষ্টি এল। আর সে বৃষ্টির কী শোভা! নাগাল্যান্ডের এলাকা তখনও ছাড়াইনি আমরা, একটা জায়গাতে পৌঁছেই তীব্র সুগন্ধে, যেন চমকে উঠলাম সকলে।

এ কী?

তীব্র চিৎকার করে উঠল ভটকাই। ওর চিৎকারে আমাদের হার্ট ফেল হবার জোগাড় হল।

কীসের গন্ধ?

 তিতির শুধোল, সানাহানবিকে। মারুতি জিপসিটা সেই চালাচ্ছিল।

পেছন থেকে ঋজুদা বলল, চাঁপা।

আমি বললাম, কী চাঁপা?

কনকচাঁপা।

কনকচাঁপা? দেখি। দেখি বলে, ভটকাই এমন করে তার ঘাড় সারসের মতো লম্বা করল, যে মনে হল ছিঁড়েই যাবে। তারপর ঘাড় ভিতরে করে বলল, সেই ছেলেবেলাতে পড়েছিলুম বাঁশবনের কাছে, ভঁড়োশেয়ালি নাচে, তার গোঁফজোড়াটি পাকা, তার মাথায় কনকচাঁপা।

তারপরই বলল, আমাদের বাড়ির দুজ্ঞন্দ চাঁপাকে নিয়ে একবার এই চাঁপার গন্ধ শুকিয়ে নিয়ে যেতেই হবে।

দুজ্ঞন্দ চাঁপা মানে?

তিতির বলল।

আমাদের ঠিকে ঝি। ঈসসরে, কী দুষ্মন্দ যে হতে পারে, তা না শুকলে বিশ্বাস করবি না। তার মাথায় দুষ্মন্দ। তার গায়ে দুষ্মন্দ, তার শাড়িতে দুগ্নন্দ…

থাম। থাম। বললাম আমি।

ভটকাই-এর এই দোষ। আরম্ভটা ভালই করে, কিন্তু কোথায় যে থামতে হবে তা জানে না।

তিতির, সানাহানবিকে ইংরিজিতে অনুবাদ করে করে, ভটকাইয়ের রসিকতা বুঝিয়ে দিচ্ছিল। আর সানাহানবি হেসে কুটোপাটি হচ্ছিল।

হাসলে যে সানাহানবিকে কী সুন্দরই দেখায়!

সকলের হাসি থামলে সানাহানবি বলল, আরও মাসখানেক আগে এলে কদমফুলের গন্ধ পেতে। মাইলের পর মাইল কদমের বন আছে, এই সব বনে। পাগল হয়ে যেতে তা হলে। মিস্টার হাচিনসন আমার মাকে ডাকতেন কাডাম্বা’ বলে। কাড়াম্বা’ মানে, স্যাংস্ক্রিট কডম্ব। উচ্চারণ করতে পারতেন না তো ঠিক মতো।

ভটকাই হেসে উঠল। বিড়বিড়িয়ে বলল, গোয়েন্দাগিরিতে ফেল করলাম বটে আমরা তবে কনকচাঁপা আর কদম্বগাছের স্বপ্ন নিয়ে ফিরে যাব। খালি হাতে যে যাব না তাই বা কম কী!

বিকেল বেলাটা, দুপুরের হেভি-লাঞ্চের পরে আমি আর ভটকাই ঘুমিয়ে কাটালাম। কাজ থাকলে ঋজুদা বলত। তবে ঋজুদা সানাহানবিকে নিয়ে লাঞ্চের পরই ফার্মে গেছিল। ঘুমের মাঝে আমি একবার বাথরুমে গেছিলাম। বিছানাতে ফেরার সময়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখি, অনেক নীচে ঋজুদা আর সানাহানবি সাদা রং করা একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আছে, উপত্যকার কাছে। তাদের গায়ের কাছ দিয়ে বয়ে বয়ে চলেছে একটা পাহাড়ি ঝোরা। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর গাছগাছালি থেকে টুপটাপ জল ঝরছে। ঋজুদাই মনে হল কথা বলছে, সানাহানবি শুনছে। হলুদরঙা প্রজাপতি উড়ছে একঝাঁক।

আমার মন বলল, একটা হেস্তনেস্ত হতে চলেছে। আমাদের আসাটা ব্যর্থ হবে। কারণ, আমি যেন ঋজুদাকে একবার বলতেও শুনলাম তিতিরকে, দুপুরে ভাল করে ঘুমিয়ে নে তিতির, রাত জাগতে হতে পারে। ঘুম থেকে উঠে, আমি আর ভটকাই বারান্দাতে বসে আছি। চায়ের সময় হয়ে গেছে। অথচ নেতা না এলে চা খাওয়ার কথা বলাও যাচ্ছে না। ভটকাই বিড়বিড় করে নিজের মনেই একটার পর একটা কল্পিত খাবারের নাম বলে চলেছে, যা এই বৃষ্টিভেজা পূর্ব-পার্বতী কাঙ্গপোকপির বারান্দায় বসে চা-এর সঙ্গে খাওয়া চলে। ঠিক সেই সময়ে খুব জোরে একটা গাড়ি মোরম বিছানো পথে টায়ারের শব্দ তুলে এসে ঢুকল। আমি আর ভটকাই সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পিস্তলটা বালিশের নীচে রেখে দুপুরে ঘুমিয়ে ছিলাম। দৌড়ে গেলাম সেটাকে আনতে। ফিরেই দেখি, একটি সাদা মারুতি। মারুতি পার্ক করে থৈবী দৈবী নামলেন। একটা সাদা শাড়ি। উস্কোখুস্কো চুল। লাল চোখ।

থৈবী বললেন ইংরেজিতে, সানাহানবি কোথায়? আপনারা কারা?

আমি বললাম, আমরা মিস্টার ঋজু বোসের সঙ্গে এসেছি। মিস্টার বোস আর সানাহানবি ফার্মে গেছেন। আপনি বসুন না ড্রয়িংরুমে। লোকজনদের ডাকব কি?

এমন সময় তিতির তার ঘর থেকে বেরুলো। শাড়ি পরে। একটা হলুদের উপর হালকা সাদা পোলকা ডট-এর মুর্শিদাবাদ সিল্ক-এর শাড়ি। গায়ে সাদা ব্লাউজ। হাত কাটা।

বলল, হাই।

হাই, বলল থৈবী। বলেই বলল, মাই নেম ইজ থৈ..

আমি বললাম, আপনার বিষয়ে, আপনার পরিবারের লোক-এর বিষয়ে আমরা সকলেই জানি। মিস্টার বোস তো খবরটা শোনার পর আপনাদের বাড়িও গেছিলেন।

থৈবী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, উইল সামওয়ান টেল দ্যা কুক টু ব্রিঙ্গ মি আ পটফুল অফ কফি।

তিতির বলল, আমি নিয়ে আসছি। আপনি বসুন। আমার নাম তিতির সেন। আমিও মিস্টার বোসের সঙ্গেই এসেছি।

ও।

আমি বললাম, দেখে মনে হচ্ছে সারারাত আপনার ঘুম হয়নি।

না। হবে কী করে? হওয়ার কথা তো নয়। আমার বউদিটা! এত ভাল মেয়ে। বেচারি।

আর বাবার কথাও তো ভাববার।

ভটকাই বলল, তার বাগবাজারি হিন্দিতে। এত হিন্দি ফিল্ম দেখে, তবুও হিন্দি উচ্চারণটা ঠিক করতে পারল না।

থৈবী দেবী বললেন, না, বাবার কথা আলাদা। বাবা মানুষ নন। মানুষের দুঃখকষ্ট তাঁকে ছোঁয় না।

বলছেন, সুপারম্যান?

 তা আমি জানি না। তুষারমানবও হতে পারেন।

 ইয়েতি?

ভটকাই বলল।

আমি ওর হাঁটুতে চিমটি কেটে চুপ করতে বললাম। কোন কথার পিঠে কোন কথা বলতে হয় সেটুকুও শিখল না।

থৈবী দেবীর মুখে শেষ-বেলার সিঁদুরে আলো এসে পড়েছিল, সেদিন যেমন পড়েছিল সানাহানবির মুখে। কী বীভৎস দানবীর মতো দেখাচ্ছিল থৈবীকে। যতই বড়লোক হোক, যতই বাড়িতে ছ’খানা গাড়ি থাকুক না কেন, ঐশ্বর্য মানুষকে কিছু দিতে পারে। সব নয়। চেহারা, ব্যবহার, চালচলন, চরিত্র এই সব মিলিয়েই সম্ৰান্ততার সৃষ্টি হয়। শুধু টাকা, শুধু সম্পত্তি, শুধু যশ, যা ন্যায্যমূল্যে পাওয়া হয়নি, তা আর যাই দিক, সম্ভ্রান্ত কোনও মানুষকেই দিতে পারে না। তার জ্বলন্ত উদাহরণ চোখের সামনে এই থৈবী দেবী।

তিতির নিজে ট্রেতে করে কফির কাপ আর বিস্কিট নিয়ে আসছিল। পেছনে পেছনে কুলা সিং।

থৈবী বলল, টাইগারের কবরে কি মাৰ্বল ফলকটা বসে গেছে?

তিতিরই বলল, না, না আপনার জন্যেই তো উনি অপেক্ষা করছেন। তা ছাড়া, শুনলাম মাৰ্বল-ট্যাবটা আসেওনি। যা শুরু হয়েছে সারা মণিপুর জুড়ে।

তা ঠিক। আপনারা বহিরাগত। আপনাদের উচিত, যত তাড়াতাড়ি পারেন এখান থেকে চলে যাওয়া। পারলে, আজই চলে যান ইম্ফল। যাতে প্লেন ধরে কলকাতা পৌঁছতে পারেন।

আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছিল যে, তাইতো যাচ্ছি। কিন্তু ঋজুদার ট্রেনিং, প্রাণ যাবে তো, মুখ দিয়ে কথা বেরোবে না। তিতির আর ভটকাইও যা জানে না, তা থৈবী দেবীকে বলতে যাব কেন? আর উনি তো আমাদের বিদেয় করতে পারলেই বাঁচেন।

ইতিমধ্যে ঋজুদা আর সানাহানবি ফিরে এল। সারা দুপুর দুজনে কী যে এত কথা বলল, কে জানে। কিন্তু সানাহানবির চোখ দুটি তখনও ভিজে ছিল। বোঝাই গেল যে, একটু আগেই কাঁদছিল।

কিন্তু কেন?

 কিন্তু কেন? কথা না বলে আমি তিতিরের মুখের দিকে তাকালাম।

কিন্তু কেন? কথা না বলে ভটকাই, আমার মুখের দিকে তাকাল।

 কিন্তু কেন? কথা না বলে আমি ঋজুদার মুখের দিকে তাকালাম, কারণ ঋজুদাকে আমিই সবচেয়ে বেশি দিন থেকে জানি।

কিন্তু আমিও এই প্রথমবার, ঋজুদার চোখের ভাষা পড়তে পড়লাম না।

সানাহানবিকে দেখতে পেয়েই থৈবী উঠে দাঁড়াল। সানাহানবি তার ওভারশুটা তারের পাপোষের উপরেই খুলে রেখে, বড় বড় পায়ে এগিয়ে এল থৈবীর দিকে। তারপর দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। একজন কাঁদতে লাগল, গ্রাম্য অশিক্ষিত রমণীর মতো চিৎকার করে, প্রেতিনীর মতো। আর অন্যজন দেবীর মতো; নিরুচ্চারে।

আমি তিতির আর ভটকাই একটু হাঁটতে বেরোলাম।

ভটকাই বলল, জানিস তো, ঋজুদা বলছিল যে, এখানে থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের চলে যেতে হবে।

কেন? গদাধরদার অসুখের জন্যে?

সেজন্যে তো বটেই, তবে শুধু সেই জন্যেই নয়।

তার মানে?

মানে, মণিপুরের অবস্থা প্রতিদিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ রীতিমতো অরাজক অবস্থা হয়ে যাবে। মানে, সেই গোপাল ভাঁড়ের গল্পের মতো অবস্থা আর কী। কে দেখবে মান্নার জাত? কে দেয় কার পেছনে হাত।

আঃ। ভটকাই। মেয়েদের সামনে কী ভাবে কথা বলতে হয়, তাও শিখলে না।

 তিতির বলল।

তোমরা কখন যে কী ভেক ধরো, তা বোঝা আমার মতো মাথামোটা মানুষের কর্ম নয়। চাকরি পাওয়ার বেলাতে ছেলে। আহা-তে রুদ্রর চেয়ে কোনও অংশে কম ছেলে নও। অথচ আবার ট্রামের সিটের বেলাতে, ঘোরতর মেয়ে। তোমাদের তল পাওয়া ভার।

আমি বললাম, পৃথিবীতে এত ও এতরকম ঝগড়া চলছে তার মধ্যে বাতাসের গলায় দড়ি দিয়ে এমন কাজিয়ার দরকার কী আছে? বন্ধ কর। ওই শোন কতরকম পাখি ডাকছে।

ভটকাই চটেই ছিল। বলল, হু। শোন তোর স্বপ্নের পাখির ডাক। পাখি-ফাখি আর আছে না কি? সব মেরে আর খেয়ে হাপিস করে দিয়েছে।

ভটকাই বলল, কেন জানি না, প্রথম দর্শন থেকেই আমার ওই ডাইনিকেই সন্দেহ হচ্ছে। তোদের হচ্ছে না কারও?

আমাদেরও হচ্ছে নিশ্চয়ই, কাউকে না কাউকে, তবে সেটা তোর মতের সঙ্গে মিলতে নাও পারে।

ভটকাই বলল, তোমার কী গেসস, তিতির?

আমার কেন জানি না…

কী? বলেই ফেল না। নিজেদের মধ্যেও আলোচনা না করলে এসে লাভ কী হল। ঋজুদাকে তো একাই আসতে দেওয়া উচিত ছিল তা হলে।

হয়তো তাই ছিল। আমরা কোন উপকারে আসছি ঋজুকাকার?

আহা, ঝেড়ে কাশো না। তোমার কাকে সন্দেহ হয়?

তোমার লেডি ডাই, সানাহানবিকে।

 আর রুদ্র, তোর?

আমার তো কোনও চয়েসই রইল না। এবার তো ঋজুদা তোকে গোয়েন্দা বানাবার জন্যে তোকেই সবচেয়ে বেশি ইম্পট্যান্স দিচ্ছে, তোর সঙ্গে শলাপরমার্শ করছে, তুইই ভাল জানবি।

ন্যাকামি না করে, বলবি? তোর মতো হিঃ আর দুটো নেই।

‘হিঃ’ মানে, হিংসুক আর কী?

তাতো বলবিই। ছিলি বাগবাজারের রকবাজ, ঋজুদার হাতে পায়ে ধরে দলে ভেড়ালাম। এমন করেই তো বন্ধুকৃত্য করবি।

আচ্ছা ইয়ে তো তুই। বলবি কি না বল?

আমার সন্দেহ হয় তোর জালি-তম্বিকে। সেই যেদিন কলকাতায় গেছিলেন, সেইদিন থেকেই।

হুঁ, আচ্ছা এবার মনে মনে ভাব। আমাদের প্রত্যেকেরই এই মনে হওয়ার মধ্যে কোথায় কোথায় ফাঁক থাকতে পারে।

তিতির বলল, ওক্কে!

আমরা বাংলোতে ফিরে গিয়ে দেখলাম সানাহানবি আর থৈবী, থৈবীর ঘরের মধ্যেই ছিল।

এক কাপ করে চা খেয়ে আবার একটু হাঁটতে বেরুলাম। ঋজুদাও সঙ্গে এল।

ঋজুদা বলল, ভটকাই, তুই আমার সঙ্গে থাকবি। তিতির আর রুদ্র ফিরে যাবে বাংলোতে। রুদ্র, তুই তোর পিস্তলটা তিতিরকে দিয়ে দিবি। তিতির, তুই যদি দেখিস যে, সানাহানবি বা থৈবীর কোনও ক্ষতি করতে আসছে কেউ, সে তোর কোনও পরিচিত লোক হলেও, সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালাতে দ্বিধা করবি না। আর তোর ঘর থেকে সন্ধের পর থেকেই কবরটার দিকে নজর রাখবি।

সন্ধের পর থেকেই চাঁদ যা জোর হবে। তোর দেখতে কোনও অসুবিধা হবে না।

ভটকাই বলল।

আকাশের অবস্থা দেখেছিস। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে এবং সে বৃষ্টি চলবে সারারাত।

ঋজুদা বলল।

 কী করে বুঝলে?

 ভটকাই শুধোল।

এখন বেশি কথা বলার সময় নয়। যা বলছি শুনতে দে ওদের। যদি কবরটা কেউ খুঁড়তে আসে তা হলে নজর রাখবি। কিছু বলবি না। কবরটা খুঁড়ে ওরা গ্রেট-ডেন কুকুরটাকে বের করবে। কী যেন নাম তার?

টাইগার।

ভটকাই বলল।

হ্যাঁ, টাইগার। টাইগারকে খুঁড়ে বের করলে বিচ্ছিরি পচা গন্ধ বেরুবে না?

ভটকাই আবারও বলল।

তা, বেরুবে। কিন্তু তুই চুপ করবি ভটকাই? তবুও তখনও তাদের কিছু বলবি না। যখন তারা কুকুরটার গলা অথবা পেট চিরে ফেলার আয়োজন করবে তখনই তিতির আর রুদ্র, উপরে নয় কিন্তু তাদের খুব কাছে, মাটিতে গুলি করবি। তাদের ওয়ার্নিং দেবারও কোনও দরকার নেই। বাড়ির চাকর-বাকরদেরও কিছু বলার দরকার নেই। আমার ধারণা, যারা আসবে তারা রাত এগারোটার পরে আসবে। পিস্তলটা কে নিবি, ঠিক করে নিস।

কেনেলে অতগুলো কুকুর, তারা কি লম্ফঝম্প করবে না? ডাকবে না? তাতেই তো পালাবে আগন্তুকেরা।

না। আজ রাতে কোনও কুকুরই যাতে না ডাকে, তার বন্দোবস্ত আমি করে রেখেছি। তা নিয়ে কারওই চিন্তা নেই। তোরা এবারে যা, সন্ধে হয়ে এল। তোরা তো ভাল বাবুর্চির খানা খাবি, পেটে কিল দিয়ে জেগে থাকতে হবে ভটকাই-এর।

তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করলে কী বলব?

তিতির শুধোল।

বলবি, আমরা বিশেষ কাজে ইম্ফলে গেছি। যা রুদ্র, জিপসিটা নিয়ে আয় বাড়ি থেকে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই রুদ্র জিপসি নিয়ে এলে, ঋজুদা উঠে বসে ভটকাইকে উঠে পড়তে বলল।

ভটকাই বলল, রাতে ঠাণ্ডা লাগবে না? সোয়েটারটা নিয়ে আসব?

 কিছু আনবে না। খিদে-তৃষ্ণা-গরম-ঠাণ্ডা এ সব থাকলে গোয়েন্দা হবার শিক্ষানবিশি করা যায় না। বুঝেছ!

.

আমি আর তিতির বাংলোয় ফিরে গল্প ফাঁদলাম যে, ঋজুদারা হাইওয়ের উপরের এস. টি. ডি. বুথ থেকে কলকাতাতে গদাধরদার খোঁজ নিতে গেছে। যদি তার জ্বর ভাল না হয়ে গিয়ে থাকে তবে হয়তো সোজা ইম্ফলেই যাবে, কালকের টিকিটের বন্দোবস্ত করতে।

কালকেই!

খুব হতাশ ও আশাভঙ্গতার গলাতে বলল, সানাহানবি।

 বলেই, থৈবীকে কী যেন বলতে গিয়ে, থেমে গিয়ে বলল, যদিও বয়সে আমার চেয়ে অনেকই বড় হবেন, কিন্তু মিস্টার ঋজু বোসের প্রেমেই পড়ে গেছি আমি।

তিতির হেসে বলল, নো ওয়ান্ডার। অনেকেই পড়েন।

থৈবী দুঃখের মধ্যেই হেসে উঠল।

 সানাহানবি হাসল না। ওর চোয়ালদুটি শক্ত হয়ে এল।

.

ভটকাইকে না-খেয়ে থাকতে হয়নি। জিপসি নিয়ে কাংলোটোংবির সেই ধাবাতে আজকে আন্ডা কারী আর তড়কা-রোটি খেয়েছিল ওরা। তারপর কাংলোটংবী আর কাঙ্গপোকপির মধ্যে, হাচিনসনন’স লজ-এর কাছেই একটা সরু কাঁচা পথের মধ্যে ঢুকিয়ে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে জিপসিটাকে পার্ক করে, ঋজুদা ভটকাইকে সঙ্গে করে এগোল। ঋজুদার ভবিষ্যদ্বাণী আজ ফলেনি। আকাশে এখনও ফুটফুটে জ্যোৎস্না। ঋজুদা বলল, চল, আলো থাকতে থাকতে আমরা নীচে নেমে যাই। তোকে পদে পদে আছাড় খেয়ে নাক-দাঁত ভাঙতে হবে না।

সাবধানে নামতে নামতে ভটকাই বলল, এখন কী হবে, ঋজুদা?

আলো থাকলেও, পিছল কম নয়; পাথুরে মাটিতে।

ঋজুদা বলল শনৈঃ, শনৈঃ।

ভটকাই নিজের কথাগুলো, এই যাত্রায় দুবার গিলল।

যে-বেঞ্চে ঋজুদা আর সানাহানবি বসেছিল বিকেলে, সেই বেঞ্চ অবধি পৌঁছেই, ভটকাই ভীষণ হাঁপাতে লাগল। ধাবার খাওয়া ততক্ষণে হজম হয়ে গেছে।

ঋজুদা বলল, তোকে দেখে মনে হচ্ছে, তুই আমার জ্যাঠামশাই। কম খাবি। শিকারই বল, গোয়েন্দাগিরিই বল, চাই কি ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যেই বল, কম খাওয়াটা খুবই জরুরি। বিকাম আ বিলিভার ইন কোয়ালিটি, নট ইন কোয়ানটিটি। এই বেঞ্চটাতে ইচ্ছে করলে শুয়ে থাকতে পারিস। তোর সাদা জামাটা খুলে, খালি গায়ে শুয়ে পড়।

এ মাঃ! ভেজা যে!

তা হলে, বসে থাক। কারণ, জামাটা খুলতেই হবে। চাঁদের আলো যদি এমনই থাকে, তবে রুদ্রও তোকে দেখতে পাবে বাংলা থেকে। সাদা রঙের মতো এমন সহজে দৃষ্টিগোচর আর কিছু তো নেই।

কেন? সাদা মন? আমার মতন। সেটাতো কারও চোখে পড়ে না! সাদা জামাটাই শুধু পড়ে।

আমরাও তো তোমাদের দেখছিলাম। দুপুরে।

আমাদের?

হ্যাঁ। তোমাকে আর সানাহানবিকে। তোমরা যখন দুপুরে এই বেঞ্চটাকে বসে, সারা দুপুর গল্প করছিলে।

ঋজুদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, তাই?

ইয়েস।

ভটকাই বলল, আচ্ছা ঋজুদা এখানে টেররিজম চলছে–এত দৌরাত্ম্য টেরটিরস্টদের, কেন?

সেতো অনেক লম্বা কাহিনী রে। নাগাল্যান্ডে তো ছিলই। আমরা যখন স্কুলের ছাত্র, প্রায় তখন থেকেই বলা হত, insurgency। নাগারা আলাদা রাজ্য চেয়ে টেররিজম শুরু করেছিল। এবং তার পেছনে চীনের ও বার্মারও হয়তো মদত ছিল। আজকে যে সারা ভারত জুড়ে এই বিচ্ছিন্নতাবাদ, ভারতবর্ষ যে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার মুখে, তার জন্যে কিন্তু ইংরেজরাই দায়ী। স্বাধীনতা তারা দিয়ে গেছিল বটে এবং সেই দেশকে টুকরো করা স্বাধীনতা নেবার জন্যে নেতাদের আকুলি বিকুলিও কম ছিল না, কিন্তু সেই খণ্ড স্বাধীনতার মধ্যে, তোর পান্তুয়ার মধ্যে লুকিয়ে রাখা ডালকুলাক্স-এরই মতো; খণ্ড-বীজ লুকোনো ছিল। ওরা বলত, ডিভাইড অ্যান্ড রুল।

অবশ্য এখনকার সন্ত্রাসবাদীরা অধুনা ভারতবর্ষকেও একই অপবাদ দেয়। তবে এই এখনকার মারামারিটা নাগা আর কুকিদের মধ্যে। কুকিরা যাযাবর ছিল। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে পাহাড়ে বসতি গড়ত। ওদের কোনও কোনও প্রবক্তারা বলেন যে, চীন হিলস থেকে ১৮৩০-১৮৪০ নাগাদ ওরা মণিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে এসে বসে। তবে কুকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পছন্দ করে। নাগাদের মতো বিরাট গ্রাম কুকিদের মধ্যে পাবি না।

এই গোলমালটার বাড়াবাড়ি হয়েছে জুন মাসের গোড়া থেকে, নাগাদের এন. এস. সি. এন. আছে, ন্যাশনালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড, মুইডা ফ্যাকশন। কুকিরা কিন্তু কোনওদিনই এমন দাবি করেনি যে, তাঁদের আলাদা রাজ্য চাই। মণিপুরের মতো। নাগাল্যান্ডেও অনেক কুকি আছে। কুকিদের নাগাল্যান্ডের অন্যতম উপজাতি বলে স্বীকারও করা হয়। নাগা ও কুকিরা অধিকাংশই কিন্তু খ্রিস্টান। যাই হোক, তেসরা জুন ওনথুলেট হাওকিপকে, যিনি একজন কুকি স্কুলমাস্টার ছিলেন, নাগারা বলজাঙ্গ বলে একটা গ্রামে খুন করে, তুলে নিয়ে গিয়ে। নাগারা বলছেন যে, এন. এস. সি. এন. (নাগা সন্ত্রাসবাদীদল) আর কে. এন. এ. (কুকি ন্যাশনালিস্ট আর্মি) কুকিদের সন্ত্রাসবাদী দলের মধ্যে লড়াইয়ে হাওকিপ খুন হন। যাই হোক, এই খুনের পরে কুকি ছাত্ররা মণিপুরের চান্ডেল জেলাতে (যার মধ্যে মোরেও পড়ে) বনধ ডাকে পরদিন এবং তখন থেকেই এই গণ্ডগোল বাড়তে থাকে। প্রতিদিনই এই গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়ছে। মাস দুয়েকের মধ্যে মণিপুরেই প্রায় একশো মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত যে কত হয়েছে, কত মানুষ গৃহহীন হয়েছে; তার ইয়ত্তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা এই গোলমালের পরিবেশে চাষবাসও করতে পারছে না এবং মণিপুর মূলত কৃষি রাজ্য–তোদের বলছিলাম নামণিপুরকে আগে বলত দ্যা গ্রানারি অফ দি ইস্ট–পারছে না বলেই দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়বে বৃষ্টির পরই। যখন ধান কাটবার সময় তখন ধানই থাকবে না ক্ষেতে।

এখন পর্যন্ত নাগাল্যান্ডে গোলমাল ছড়ায়নি। নাগাল্যান্ড শান্তিপূর্ণই আছে। কিন্তু নাগারা এইভাবে কুকি নিধন করতে থাকলে, কুকিরাও তার বদলা নিতে থাকলে, কতদিন পাশাপাশি রাজ্য নাগাল্যান্ড এই তাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে, তাতে আমার বিশেষ সন্দেহ আছে।

শুনে তো ভটকাইচন্দ্রর চোখের ঘুম চলে গেল। ও বলল, চতুর্দিকেই তো রোড ব্লক। কোথাও যাওয়া আসার উপায়ও তো নেই।

হ্যাঁ। এই সব নানা কারণে এবং গদাধরের অসুখের কারণেও আমি ঠিক করেছি, কাল পরশুই ফিরে যাব।

ভটকাই বলল, আচ্ছা ঋজুদা, আচ্চাও সিং-এর ব্যাপারটা কী বলে মনে হয় তোমার?

আসলে ইবোহাল সিং এবং আচ্চাও সিং নাগা টেররিস্টদের সঙ্গে ছিল। ইবোহালের পরেই যে ওর পালা, তা ও বুঝেছিল বলেই বার্মাতে পালিয়ে গেছিল। পরে বলব ও সব তোদের। এখনও সময় হয়নি। এই মার্ডারগুলো আমার মনে হয় স্মাগলিং-এর কারণে যতটা, ততটাই রাজনৈতিক কারণে।

একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, একটু আগেই ভাবছিলাম উনিশ শো ছাপান্নতে যখন প্রথমবার এখানে এসেছিলাম–মা, বাবা, দাশগুপ্ত কাকা, কাকিমা, সেন জেঠু, জেঠিমা, পিক হোটেলে ছিলাম। শীতকাল, সঙ্গে নেপালদাও ছিলেন। কী সুন্দর, শান্ত, শান্তির ছবির মতোই না ছিল এই শহর। আসলে, বুঝলি ভটকাই, আমরা নিজেরাই কোনও সুন্দর কিছুর যোগ্য নেই। ইঁদুরের মতো নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে করে এখন নিজেদেরই জায়গা নেই থাকবার, খাদ্য নেই খাবার, গাছ নেই ছায়াতে বসবার বা তার কাঠ জ্বেলে রান্না করবার বা আগুন পোহাবার। অথচ তুই পশ্চিমি দেশের অনেক জায়গাতেই দেখবি, বিশেষ করে ইয়ারোপে এক-একটি শহর, এক-একটি গ্রাম, পঞ্চাশ ষাট বছর আগে যেমন ছিল, তা থেকে খুব একটা বেশি বদলায়নি। সব মানুষেরই যে সুবুদ্ধি থাকে তা নয়। কিন্তু সেই সব দেশে আইনের শাসন কায়েম আছে। দুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা আইন মানতে বাধ্য হয়। তা ছাড়া জনসংখ্যা শুয়োর বা ইঁদুরের মতো না বাড়াতে, মানুষ এখনও মানুষের জীবন যাপন করার সুযোগ পায়। আমাদের এই স্বাধীনতা পাওয়ার চল্লিশ বছর পরে, আমরা পরম নির্লজ্জতার সঙ্গে প্রমাণ করেছি যে, আমরা স্বাধীন আফগানিস্থান বা জায়রে বা উগান্ডার মানুষদের চেয়ে খুব বেশি উঁচুদরের মানুষ নই। দিল্লি শহর, আর কিছু ফ্লাইওভার আর আলো-জ্বলা ব্রিজ, এমনকী অ্যাটম-বোমাও একটা দেশের অগ্রগতির পরিচায়ক নয়। তার পরিচায়ক একজন গড়পড়তা মানুষ। তার শিক্ষা, তার, রুচি, তার চরিত্র, তার মানসিকতা, আমার, তোর, গদাধরের মতো সাধারণ সব মানুষের মানসিকতা। উচ্চাশা।

আমরা তো আর দশ কুড়ি বছরের মধ্যে ফেঁসে গিয়ে বেঁচে যাব। তোদের জন্যে যে কী অভিশাপ, কী দুঃস্বপ্ন আমরা রেখে যাচ্ছি, সে কথা ভাবলে আত্মহত্যা করে মরে যেতে ইচ্ছে হয়।

ভটকাই-এর চোখ জ্বালা করছিল। এতখানি উত্তেজিত বিক্ষুব্ধ ও দুঃখিত হয়েছিল ও, ঋজুদার হৃদয়-মথিত এ সব কথা শুনে, যে হয়তো ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেলত। কোনওক্রমে মুখটা ঘুরিয়ে, সামলে নিল।

তারপর একটু পরে, ঋজুদার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, শান্ত হও ঋজুদা। তোমার কথা আমি বুঝেছি। তোমার কথা আমরা, আমি, রুদ্র, তিতির, আমরা বুঝি, বুঝব। আমরা মানুষের মতো মানুষ হব, ঋজুদা। তুমি দেখো, শুধু মানুষের চেহারার মানুষ নয়, মানুষের মতো মানুষ। যে-মানুষে একটা দেশকে গড়ে তোলে, তুমি দেখো। তোমার আশীর্বাদের অপমান আমরা করব না।

আধঘণ্টার মধ্যেই চাঁদ আবার নেমে গেল এবং এমন মেঘ করল যে পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা ঋজুদাকেও দেখতে পাচ্ছিল না ভটকাই।

ঋজুদা পাইপটা ভরে ভটকাইকে বলল, আমার পেছনে, ডানপাশে দাঁড়িয়ে, আমাকে একটু কভার করত। লাইটারের আলো দেখা যাবে নইলে। পাইপের আগুনটা শুধু ধরাবার সময় দেখা যায়। ধরে গেলে, আগুনটা সোজা উপর থেকে ছাড়া, দেখাই যায় না। পাইপ ধরিয়ে ঋজুদা বলল, তুই ইচ্ছে করলে রিল্যাক্স করতে পারিস। আমি তো আছিই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন ঝড় বৃষ্টি আরম্ভ হল যে, বলার নয়। আর ঘন ঘন বিদ্যুৎচমক একে চারিদিকে ঝড়ের দমকে দমকে দোলা খাওয়া এই সব পর্বতবেষ্টিত বন পাহাড়ে উপত্যকার গভীর অরণ্যানী তার উপর আবার এই ইম্ফল-কোহিমা বার্মা এ সব নামের মধ্যেই এমন সব গুপ্ত উত্তেজনা লুকিয়ে আছে যে, বাজ পড়ার শব্দে ভটকাই কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

ঘণ্টা খানেক অমনি চলার পরও যখন দুর্যোগ থামার লক্ষণ দেখা গেল না, তখন ঋজুদা বলল, চল, আমরা আস্তে আস্তে বাংলোর দিকে এগোই। এখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারিস। যা তর্জন-গর্জন চলছে, আধমাইলের মধ্যেও আমাদের কথা কেউ শুনতে পাবে না।

এত তাড়াতাড়ি উপরে যাবে?

হ্যাঁ। এই ওয়েদারের অ্যাডভান্টেজ নিতে পারে, যারা আসবে, তারা। এই আবহাওয়ার আড়ালে আধঘণ্টার মধ্যেই কাজ হাসিল করে চলে যেতে পারলে কোন বোকা সারা রাত অপেক্ষা করে? তা ছাড়া, ওরা তো জানে না, যে কুকুরদের আমি ঘুম পাড়িয়ে রাখার বন্দোবস্ত করেছি। ওদের সবচেয়ে বড় ভয় তো কুকুরেরাই। যারা আসবে তারা তো জানে না, আমি তাদের মতলব আগেই জেনে গেছি। চাইকি, তারা কবরখোঁড়ার কলংকটা আমাদেরই উপরে চাপিয়ে দিতে পারে। কারণ, আমরাই এখানে আগন্তুক।

থৈবী দেবী যখনই এসে পৌঁছল সন্ধের মুখে মুখে তখনই জানি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ভটকাই বলল।

তোর থৈবীর উপরে এত রাগ কেন?

রাগ হবে না? ওর চেহারা দেখলেই তো মনে হয় ও নরকের জীব।

তা হলে তোর মনটা অন্যে সহজে দেখতে পায় না বলে আর দুঃখ করিস। কেন? যা-কিছুই দেখতে সুন্দর, তাই কি সুন্দর?

ভটকাই-এর মনের খটকাটা আরও বেড়ে গেল। ওর এখন পাগল-পাগল লাগছে। প্রত্যেকটা মানুষকেই সন্দেহ হচ্ছে এদের মধ্যে কে যে কে, আর কে যে না, তা ঋজুদা কেন তাড়াতাড়ি বলে দিচ্ছে না তা ওর বুদ্ধিতে কুলোচ্ছে না। পোষা কুকুর। সে মরল। কবর হল। সে কবরে স্মৃতিফলক পড়বে। এই সময়ে সেই কবর খুঁড়তেই বা এল কারা? পুলিশের সন্দেহ হলে, কবর থেকে ডেড বডি এক্সহিউম করে পরীক্ষা চালায় নতুন করে তা ও শুনেছে। কিন্তু কুকুরের ডেডবডি নিয়ে, একী?

ওরা পায়ে পায়ে প্রায় অর্ধেক পথ উঠে গেছে। যখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখন কেনেলটাকে দেখা যাচ্ছে, এক সারি নিচু লম্বা ঘর। বাংলোটা–আলোঝলমল নানা শৌখিন গাছগাছালির মধ্যে মধ্যে দারুণ দেখাচ্ছে। কে যেন স্টিরিও চালিয়েছে। কার আবার চিত্তে এত সুখ হল? কী চিৎকাররে বাবা!

কোন পাগলে চিৎকার করে, ঋজুদা?

চুপ কর। মাইকেল জ্যাকসন।

সেডা আবার কেডা? খালি গায়ে, ভিজে ঝোড়ো কাকের মতো, ভটকাই বলল।

আঃ। কথা বলিস না এখন।

সর্বনাশ হয়ে গেল ঋজুদা।

কী হল? সাপে কামড়াল না কি? দেখি দাঁড়া।

না না। টিকিটগুলো। বিভাস চক্রবর্তীর মাধব-মালঞ্চী কইন্যা আর উষা গাঙ্গুলীর হোলি-র। সব গেল। দক্ষিণী’র অরূপরতনের টিকিটও ছিল। সেও। ছ্যাঃ। ছ্যাঃ।

টিকিট কেউ সঙ্গে করে আনে? ইডিয়ট।

আমি তো ইডিয়টই। নইলে অন্যেরা যখন সাইকেল স্যাকসন শোনে সোফায় বসে বসে, চা খেতে খেতে, তখন আমার এমন–হুঁ।

সাইকেল নয়, মাইকেল! স্যাকসন নয়, জ্যাকসন।

ভটকাই-এর এই কথার সঙ্গে সঙ্গে, টক্ করে একটা শব্দ হল উপর থেকে।

ঋজুদা, বাঁ হাত দিয়ে ভটকাই-এর গলা টিপে ধরল।

ভটকাই দু হাতে দু কান ধরে বোঝাল যে, আর কথা নয়। আর একটু, মানে গজ বিশেক উঠে, ঋজুদা একটা বড় ঝোপের আড়ালে একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে পড়ল। নিজের সাধের প্যান্টটার দিকে একবার করুণ চোখে চেয়ে, ভটকাইও শুয়ে পড়ল।

আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাতেই, দেখা গেল, দুজন লোকে মিলে সত্যি সত্যিই কবরটাকে খুঁড়ছে। বৃষ্টিতে মাটি আরও নরম হয়ে গেছে বলে, সুবিধে যেমন হচ্ছে ওদের, তেমন মাটি ভারী হয়ে গেছে বলে মাটি সরাতে কষ্টও হচ্ছে।

ঠোঁটে আঙুল দিয়ে কথা বলতে বারণ করে দিয়ে, ঋজুদা দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে দুই হাতের তেলের মধ্যে মুখটি রেখে সেদিকে চেয়ে রইল। প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টাতে তারা মাটি সরিয়ে সম্ভবত কুকুরটার নাগাল পেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কুকুরটাকে বের না করে, দুজনে একটি ঝোপের আড়ালে এসে, ভটকাইদের দিকে পিছন করে, যাতে বাংলা থেকে দেখা না যায়, দুটো পাথরে বসে, দেশলাই জ্বালাল। দুজনের মধ্যে একটা লোককে ভটকাই-এর চেনা চেনা মনে হল। যে ধাবাতে আজ সন্ধেতে খেয়েছিল, সেই ধাবাতেই লোকটাও ওদের পাশে বসে খাচ্ছিল। কোনও ট্রাকের ড্রাইভার হবে। ভেবেছিল, ভটকাই।

লোকদুটো আরেকবার দেশলাই জ্বালল। একটা বোতল থেকে সাদা জল খাচ্ছিল ওরা। একজন সম্ভবত পাইপ খাচ্ছে। ওই লোকটার কথাই ভাবছিল ভটকাই। অন্যজন বোধহয় সিগারেট খাচ্ছে। টানের সঙ্গে সঙ্গে আগুনটা জোর হচ্ছে আর কম হচ্ছে।

গায়ে একটু জোর করে নিয়ে, ততক্ষণে বৃষ্টিটাও ধরে গেছে; লোকদুটো আরও উঠে গিয়ে, কবর থেকে কুকুরটাকে তুলল। একজন নীচে নেমে গেল কোমর-সমান গর্তে, অন্যজন সম্ভবত কুকুরের পায়ের দিকটা ধরে টেনে হেঁচড়ে তাকে উপরে তুলল। তোলর পরে কুকুরটার শরীরে আধখানা আবার কবরের মধ্যে ঢুকে গেল। আবারও দশ মিনিট কসরত করে তারা তুলল, কুকুরটাকে। তোলার পর কবরের পাশে লম্বা করে শুইয়ে, মাটিতে শোয়ানো ঝোলা থেকে কী যেন বের করল। জিনিসটা কী, তা প্রথমে বুঝতে পারল না ভটকাই। তারপরই একবার বিদ্যুৎ-চমকে বুঝতে পারল যে, একটা দা। সেইটা দিয়ে একজন কুকুরটাকে কাটতে গেল।

ঠিক সেই সময়ে ঋজুদা ভটকাইকে বলল, সিগন্যাল।

ভটকাই-এর পকেটে একটা টিনের কটকটি রাখতে দিয়েছিল, ঋজুদা। আগেই বলে রেখেছিল যে, যখন বলবে, সমানে বাজিয়ে যেতে হবে। উঠে পড়ে পকেট থেকে কটকটি বের করে, কটকটি ব্যাঙ হয়ে গেল ও। এবং ঋজুদার সঙ্গে উপরে উঠে ওই দিকে এগোতে লাগল।

.

কটকটির আওয়াজ এই বৃষ্টিভেজা নিঝুম পরিবেশে কতদূরে যে ছড়িয়ে গেল, তা বলার নয়। এবং ওই শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বাংলো থেকে সুতীব্র সার্চ লাইট একের পর এক জ্বলে উঠে, সমস্ত জায়গাটাকে আলোকিত করে দিল। প্রতি ঘরে ঘরেও আলো জ্বলে উঠল। বাড়ির সমস্ত কাজের লোকজনও যে যা পেয়েছে হাতের কাছে, লাঠি, দা, বল্লম নিয়ে, বেরিয়ে এল।

আমি আর তিতির দেখলাম যে হতভম্ব হয়ে গিয়ে একজন লোক ঝোলা থেকে কী একটা বের করতেই ঋজুদা গুলি করল, তার গোড়ালি থেকে এক হাত পেছনে। আমিও গুলি করলাম, ওদের কাছেই। এবং এদিক থেকে আমি পিস্তল ও টর্চ হাতে নিয়ে এবং ওদিক থেকে ঋজুদা আর পেছনে পেছনে খালি গায়ে নাদুবাগানো, ফরসা, ভটকাই বাবু এগিয়ে আসতে লাগল।

ঋজুদা গলা তুলে বলল, ওটা হাত থেকে ফেলে দিন মিস্টার তম্বি সিং।

তম্বি সিং?

চমকে গেল, ভটকাই।

তম্বি সিং তার চেয়েও বেশি চমকে গিয়ে, পেছনে ফিরে তাকাল, ঋজুদার পিস্তলটার দিকে।

ততক্ষণে ভটকাইরা ওদের কাছে পৌঁছে গেছে। আমিও কাছে চলে এসেছি।

ঋজুদা বলল, পিস্তলটা ফেলে দিন মিস্টার সিং। প্লিজ।

হঃ হাঃ হঃ হঃ করে, অদ্ভুত এক অট্টহাসি হেসে উঠলেন মিস্টার তম্বি সিং। বললেন, মিস্টার বোস। য়ু হ্যাভ ডান আ ফাইন জব। বাট য়ু উইল নট গেট মি।

 বলেই, গাছের গোড়ায় যে বোতলটা রাখা ছিল, সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

ডোন্ট মুভ মিস্টার সিং। আমি আপনাকে ওটা দিচ্ছি। বলেই বলল, ভটকাই, বোতলটা মিস্টার সিংকে দে। বি কেয়ারফুল মিস্টার সিং। ডোন্ট ট্রাই টু বি ফানি। তা হলে মাথার ঘিলু উড়ে যাবে।

হঃ। হঃ। হঃ। আমার মাথাতে যদি ঘিলুই থাকবে তা হলে কি আমার জীবনের এই অবস্থা হয়? ভটকাই বোতলটা নিয়ে, ওঁর হাতে দিল। ওঁর হাত থেকে পিস্তলটা নিতে যেতেই উনি হিন্দিতে বললেন, খবরদার ছোকরা, আমি জিন্দা থাকতে আমার হাত থেকে পিস্তল কেউ নিতে পারবে না। এটা শেষ করেনি। আমি নিজেই দেব।

ঋজুদা আমাকে বলল, রুদ্র, য়ু টেক কেয়ার অফ দ্যা আদার গাই।

উ-মঙ্গ?

 ভটকাই বলল।

 ভটকাই উ-মঙ্গকে চেনে দেখে আমি অবাক হলাম। ভটকাই গুটি গুটি আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে সানাহানবি, থৈবী ও তিতিরও এসে দাঁড়িয়েছে একটু দূরে। টাইগারের দুর্গন্ধ গলিত দেহ দেখে সানাহানবি আর থৈবী দেবী নতুন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

ঋজুদা সানাহানবিকে বলল, হ্যাভ য়ু ফোনড দ্য নাম্বার আই গেভ অ্য?

ইয়া।

থ্যাঙ্ক য়ু।

তোমরা সবাই এখন ঘরে যাও। ওরা এক্ষুনি এসে পড়বে।

ওরা কারা?

তম্বি সিং বলল।

পুলিশ।

 পুলিশ, বলেই আবার হাসল হঃ হঃ হঃ করে।

 সানাহাবিরা ফিরে গেল। শুধু আমরা রইলাম। আর কাজের লোকজন। তম্বি সিং আর উ-মঙ্গ দুজনেই ভাগাভাগি করে ওই সাদা জল খাচ্ছিল।

এমন সময় পি-পাঁ পি-পাঁ করে বাঁশি বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এল। এবং ঠিক সেই সময়েই পিস্তল-ধরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই একই সঙ্গে দুটি গুলির শব্দ হল। এবং কিছু বোঝার আগেই, আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। এবং মিস্টার তম্বি সিংও। ভটকাই বাঘের মতো সাহসে, খালি হাতে, তম্বি সিং-এর উপরে লাফিয়ে পড়ে তাকে চেপে রেখে, তার পাশে পড়ে থাকা পিস্তলটা তুলে নিয়ে, রাগের চোটে পিস্তলের বাঁটের এক বাড়ি মারল, তার মাথায়। বলল, নিমক হারাম। তুই আমার বন্ধুকে…এত্ব সাহস। তোর মাথা আমি কচুর শাক দিয়ে রান্না করে খাব।

তম্বি সিং-এর গুলিটা আমার ডান বাহু ছুঁয়ে চলে গিয়ে বাংলোর একটি থামে লেগে ছিটকে গিয়ে, বৃষ্টির জল জমানোর জন্যে রাখা একটা টিনের ড্রামে গিয়ে আঘাত করায়, সেই ড্রাম ফুটো হয়ে, তীরের বেগে জল পড়তে লাগল। আসলে তম্বি মারতে চেয়েছিল উ-মঙ্গকে। তারপরে নিজেকে মারত। কিন্তু ওর গুলি বেরুবার আগের মুহূর্তে ঋজুদার নির্ভুল নিশানাতে করা গুলি গিয়ে তম্বির কবজিতে লাগে–আর লাগার ফলেই উ-মঙ্গ বেঁচে গেল এ-যাত্রা। এবং হয়তো আমিও।

গুলির শব্দ শুনে সানাহানবিরা বেরিয়ে আসতে আসতেই পুলিশও এসে গেল। আমাকে ও তম্বি সিংকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে মেয়েরা চেঁচামেচি করে উঠল। মেয়েরা বলতে, থৈবী এবং সানাহানবি। তিতির নয়।

পুলিশের অফিসারকে ঋজুদা বললেন, এদের দুজনকে অ্যারেস্ট করুন। লোকাল ডাক্তারকে এখুনি ধরে নিয়ে আসুন নিয়ারেস্ট হসপিটাল থেকে এবং অপারেশনের সব সরঞ্জাম, নার্সসমেত; এখানেই আনানোর বন্দোবস্ত করুন। ওয়্যারলেসে খবর পাঠান। ইমিডিয়েটলি।

আমি ততক্ষণে উঠে বসেছিলাম। তম্বি সিংও। শুনলাম ঋজুদা বলছে, সানাহানবিকে, আই অ্যাম সরি। আই হ্যাভ টু টেক দেম ইনসাইড। ইওর বিউটিফুল বাংলো উইল বি ব্লাডি।

সানাহানবি নিচু স্বরে বলল, লেট ইট বি। আই কুড নট কেয়ারলেস। অ্যাট লিস্ট, আই অ্যাম লাকি দ্যাট আই অ্যাম নট ব্লাডি ইনসাইড মি।

বলেই একটু থেমে, প্রায় কেঁদে বলল, ইট রিয়্যালি হার্টস; হার্টস। অ্যান্ড আই ট্রিটেড দিস ম্যান অ্যাজ মাই ফাদার।

ঋজুদা পুলিশ অফিসারকে বললেন, দশজন আর্মড পুলিশকে দিন, কুকুরটাকে পাহারা দেবার জন্য, যতখন না ভেট আসছেন ইম্ফল থেকে।

রাইট স্যার।

অফিসার বললেন।

ডি. আই. জি. ক্রাইম আসছেন?

হ্যাঁ, স্যার। মেসেজ তো পৌঁছে গেছে। উনি পথেই এই মেসেজ-এর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। আমার তো মনে হয়, মিনিট পনেরোর মধ্যে এসে পৌঁছবেন।

আমাকে এবং তম্বিকে ধরে ধরে বাড়ির লোকেরাই নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসালেন। আমি বললাম, বারান্দাতে বসি। রক্ত পড়ে কার্পেট নষ্ট হবে, সোফা নষ্ট হবে।

ঋজুদা বলল, বারান্দাতে বসলে গুলি খেয়ে মরতে পারিস। তুই তো পারিসই, আমরা সকলেই পারি। পুলিশ যেমন খবর পেয়েছে, তম্বি সিং এর মালিকেরাও খবর পেয়েছে। ভেতরে চল।

সানাহানবি বলল, কী যে বলেন! আমার জন্যে আপনার প্রাণটাই যাচ্ছিল আর আমার কার্পেট আর সোফাই কি বেশি দামি হল, প্রাণের চেয়ে?

সানাহানবির কাছে প্রক্সিভন ছিল। তাই দুটো করে ঋজুদা খাইয়ে দিল আমাকে ও তম্বি সিংকে। রক্তে চ্যাটচ্যাট করছে শরীর।

ঋজুদা বলল, কী খাবেন মিস্টার সিং? যে কোনও ভাল জিনিসের নাম করুন। সবই আছে সানাহানবির কাছে। চা খাবেন? কফি? অন্য কিছু?

হুইস্কি আছে? মিস্টার বোস? স্কচ হুইস্কি? আপনাকে সেদিন আমি মিথ্যে বলেছিলাম।

আপনাকে আমি খুব ভাল জিনিস পাঠিয়ে দেব, আমার বন্ধু অনীক সেনের কাছ থেকে নিয়ে।

কোথায়? জেলে? হঃ। হঃ। হঃ।

হ্যাঁ। প্রয়োজন হলে জেলেও।

 মিস্টার সিং হাসলেন। বললেন, আপনার মতো প্রেমিক দেখা যায় না। গুলি করে, জেলে পাঠিয়ে; তাও আবার স্বপ্ন পূরণ করবেন বলছেন।

ঋজুদাই সানাহানবি ও থৈবীকে বলে, কীসের যেন একটা বোতল তম্বি সিংকে আর অন্য একটি বোতল উ-মঙ্গকে আনিয়ে দিল। উ-মঙ্গ-এর তখনও শক কাটেনি। তম্বি সিং যে তাকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল একটু আগে, এ কথা সে যেন বিশ্বাসও করতে পারছিল না।

সে বলল, আমার কিছু চাই না এ সব। বিষ থাকলে সানাহানবি, বিষ এনে দাও একটু আমাকে।

.

এখন রাত কত, কে জানে! ভোর হতে বেশি দেরি নেই। ডি. আই. জি. ক্রাইম, কোহিমার ভেটেরিনারি সার্জন, মি. হোর্কেকেসিমা, উখরুলের বৃদ্ধ উকিল…জরাগ্রস্ত মিস্টার ছাওবি সিং–আরও অনেকে এসেছেন। ডি. আই. জি. মি. আলুয়ালিয়া, পাঞ্জাবের লোক। কে. পি. এস. গিলের অধীনে চাকরি করেছেন। তাঁর একজন ব্লু-আইড বয়, তাই মণিপুরের ডি. জি. বিশেষ তদ্বির করে ওঁকে আনিয়েছেন এখানে। উনি হয়তো শিগগির নতুন পদ, ডি. আই. জি. টেররিস্ট কন্ট্রোল-এর দায়িত্ব নেবেন।

মি. আলুয়ালিয়া বললেন, আমার চেয়েও বেশি ইন্টারেস্ট অন্যদের। আপনি সামিং-আপ করুন, মি. বোস। ওঃ। এই যে আপনাদের টিকিট। ওক্কে করা আছে। কালকের।

ঋজুদা সেগুলো নিয়ে বুক পকেটে রেখে বলল, ধন্যবাদ।

প্রথমে বলুন, রুবিটার কথা।

ঘরে সকলেই বসে ছিলেন। আমি, ভটকাই, তিতির, সানাহানবি, থৈবী দেবী ছাড়াও পুলিশের নানা অফিসার এবং ভেট। দরজার সামনে ভিড় করেছিল কাজের লোকজন। এবং বাংলোর চারপাশ ঘিরে ছিল সেমি-অটোমেটিক ওয়েপন নিয়ে কমপক্ষে দশটি পুলিশের গাড়ি। এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স ভ্যানও দাঁড়িয়েছিল বাইরে।

ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, দেখুন, প্রথমেই মি. তম্বি সিং আমার মনে সন্দেহ ঢুকিয়েছিলেন যে, তিনি নিজে মালিক নন। তাই এখানে এসেই আমার প্রথম কাজ খুঁজে বের করা, তাঁর আসল মালিককে। সানাহানবির উপরে অন্য যে-কোনও মানুষেরই সন্দেহ হতে পারত। কিন্তু আমি ফেস-রিডিং কিছুটা করতে পারি না, শাস্ত্র পড়ে নয়। শিশুকাল থেকেই উৎসাহ ছিল এ ব্যাপারে তারপর সারা পৃথিবীর অগণ্য দেশের অগণ্য নারী পুরুষের সঙ্গে মেশার অভিজ্ঞতাও আমাকে সাহায্য করেছে। অনেক জ্যোতিষিও যা না বলতে পারবেন, আমি হয়তো শুধুমাত্র মুখ দেখেই, একজন মানুষ সম্বন্ধে তার চেয়ে বেশি বলতে না পারলেও, বুঝতে পারি।

এতগুলো ভাল ভাল কথা নিজের সম্বন্ধে একসঙ্গে বলে ফেলে ঋজুদাকে ক্লান্ত ও লজ্জিত দেখাচ্ছিল। নিজের প্রশংসা নিজে করা অথবা ধূর্তামি দেখিয়ে অন্যদের দিয়ে কাজ করানোর বিদ্যা ঋজুদার তো জানা নেইই, বরং এ সব তীব্রভাবে অপছন্দই করে।

এটাতো আপনারই ধারণা, বোস সাহেব।

রাইট। শুধুমাত্র ধারণাই। কিন্তু সমস্ত বিজ্ঞান, সমস্ত সিদ্ধান্তের জন্মই তো নিছকই কোনও এক একাধিক জনের ধারণা থেকেই। এই ধারণা শব্দটা ফেলে দেওয়ার নয়। এটি একটি বীজ, যা থেকে মহীরূহ জন্মায়।

আমিই বললাম, ঋজুদাকে যাতে নিজমুখে উত্তর দিতে না হয়, সে জন্যে।

 থাঙ্গজম সিং-এর কাছে গিয়েই, আমার প্রথমে যা মনে হয়েছিল তা এই যে, মানুষটা গত কয়েক বছরে বদলে গেছেন অনেকই। ওর স্ত্রীকেও আমি জানতাম। মানে, যখন আগে ওর সঙ্গে আলাপিত হয়েছিলাম। মহীয়সী, ধার্মিক, নম্র মহিলা। মনে হয় যে, সেই মহিলার প্রভাব থাঙ্গজম সিং-এর স্বাভাবিক প্রকৃতির মধ্যের খারাপ, বন্য, লোভী ও নিষ্ঠুর দিকটাকে প্রতিমুহূর্তেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলেই হয়তো, এইরকম বদলে গেলেন মানুষটা।

হঠাৎই থৈবী সিং বলে উঠলেন, আপনি ঠিক বলেছেন দাদা। আপনি জ্যোতিষির চেয়ে অনেক ভাল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। তা ছাড়া মানুষকে বোঝার ক্ষমতা আপনার অসাধারণ!

আমরা ঘর সুদ্ধ সকলেই চমকে উঠলাম, থৈবী সিং-এর কথা শুনে।

ঋজুদা বললেন, তোমার বাবা সম্বন্ধে আমার অ্যাসেসমেন্ট যে ঠিক তা তোমার কাছ থেকে শুনে, আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল থৈবী। ধন্যবাদ।

একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম যে, থাঙ্গজম সিং, তম্বি সিংকে মানুষ বলেই গণ্য করেন না। বললেন, ও লোকটা একটা ক্লাউন, একটা বাফুন।

তারপর পাইপে আরেক টান দিয়ে বলল, তোমার বাবুর্চিকে আমাদের একটু চা দিতে বলতে পারো সানাহানবি? সময় তো বেশি বাকি নেই। আলো ফুটলেই আমরা বেরুব।

অনেক মানুষই ক্লাউন বা বাফুন কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই জীবনের এবং সংসারের হাতে মার খেয়ে এমন হয়ে যান। যাঁরা এমন ভাবে বাফুন বা ক্লাউন হয়ে ওঠেন, তাঁদের প্রতি অনুকম্পা, ক্ষমা, এবং দয়া থাকা উচিত।

কার? সমাজের?

ডি. আই. জি. সাহেব প্রচণ্ড বোদ্ধার মতো বললেন।

ঋজুদার উচিত, সোজা কেসটার তলাতে চলে গিয়ে যা বলার বলে দেওয়া, অথচ এটাও ঠিক যে, খুনের মোটিভ ব্যাখ্যা করতে খুনির এবং যে খুন হয়েছে। তার, খুনির সাহায্যকারীদের সকলেরই মনস্তত্ত্বর ব্যাখ্যারও দরকার। কিন্তু এই ডি. আই. জি-র বোধহয় অত ধৈর্য-টৈর্য নেই।

ঋজুদা বলল, সমাজ তো একটা ধারণা-বিশেষ। আমি মানুষের কথা বলছি। অনেক মানুষে মিলে মিশে যাই করে, তাই সমাজ-স্বীকৃত; সামাজিক।

তারপর বলল, ভটকাই অধৈর্য গলাতে বলল।

তম্বি সিংকে যেমন থাঙ্গজম সিং মনুষ্যেতর জীব বলে গণ্য করেন, তেমনি ইবোহাল সিং-এর উপরও দেখলাম ওর প্রচণ্ড রাগ এবং ঘৃণা। বললেন, ও তো রাজাই নয়, রাজ পরিবারের আস্তাবলের কোনও সহিসের সঙ্গেও ওর কোনওদিন আত্মীয়তা ছিল না। তম্বি যেমন ওর চামচে ছিল ইবোহালের বাবাও ছিল তেমনই রাজা লাইহারোবার চামচে। সেই সুবাদে কাকা বলত।

যা মনে হয়েছিল আমার, থাঙ্গজম সিং-এর কথা শুনে; তা হল, দেখতে শুনতে ভাল ছিল ইবোহাল, বুদ্ধিমান ছিল, পড়াশোনাতেও ভাল ছিল। অথচ বিনয়ের বদলে এদেশের নিরানব্বই ভাগ শিক্ষিত মানুষেরই মধ্যে যা থাকেই, অর্থহীন অন্ধ অহং, লজ্জাকর একধরনের গর্ব; তা ইবোহালের ছিল না, সে গান বেয়ারার থেকে সহিস, কুক থেকে ম্যানেজার, ম্যানেজার থেকে সেক্রেটারি, সব কাজই করতে পারত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে–যেমন করত আচ্চাও সিং, ইবোহালের জন্যে। এবং সে কারণে, রাজা লাইহারোবারই মতো সম্ভবত ইবোহালেরও আচ্চা সিং-এর উপরে এক বিশেষ দুর্বলতা ছিল…

এবং দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই আচ্চাও সিং…

 ডি. আই. জি. সাহেব বললেন…

 ঋজুদা থেমে, তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, আপনি তো তা হলে কেসের সশান করেই ফেলেছেন। আমরা তা হলে চা টা এলেই খেয়ে উঠে পড়ি।

ডি. আই. জি. সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আই বেগ ইওর আনকন্ডিশনাল পার্ডন স্যার। আপনি বলুন। আর আমি ইন্টারাপট করব না।

ইন্টারাপট অবশ্যই করবেন। না হলে, জিনিসটা পরিষ্কার না হলে, চার্জ ফ্রেম কী করে? আসামিদের দায়রাতে সোর্পদ করবেন কী করে?

রাইট স্যার।

পুলিশের টেপ রেকর্ডারটা নিঃশব্দে ঘুরছিল যে, এটা ডি. আই. জি. সাহেব ভুলে গেছিলেন। ভটকাই-এর সামনে রাখা আমাদের টেপ-রেকর্ডারও ঘুরছিল। দেখতে ছোট, কিন্তু মাইক্রো-ক্যাসেট ভরা যায়। বহুক্ষণ টেপ করা যায়। জাপান থেকে মিস্টার নাকাটাসো, ঋজুদার জাপানি মক্কেল পাঠিয়েছে ঋজুদাকে, কাজের সুবিধার জন্যে।

সানাহানবি বলল, বলুন মিস্টার বোস। থৈবী বলল, ইবোহাল আংকল-এর মার্ডার আর রুবিটা চুরি যাওয়া তো একদিনেই ঘটেনি। তরোয়ালটা তো কদিন আগে চুরি গেছিল। বাগান থেকে যখন পাওয়া গেল, তখন দেখা গেল যে, রুবিটা নেই। ইবোহাল আংকল-এর মার্ডার তো তার কদিন পরে হল।

দ্যাটস রাইট।

তা এমন করলেন কেন, আংকল তম্বি আর উ-মঙ্গ? পুলিশকে ধোঁকা দেবার জন্যেই কি?

না।

তবে?

রুবিটা চুরি করেছিল তম্বি আর উ-মঙ্গ, সানাহানবি সেদিন মোরেতে গেছিল টাইগারকে নিয়ে। সাধারণত সঙ্গে সাদা বুলটেরিয়ার ‘জিম’ যায়। থৈবী সেদিন বড় গাড়ি নিয়ে গেছিল বলেই একটু চেঞ্জ হবে বলে, টাইগারকে নিয়ে গেছিল সঙ্গে, সানাহানবি। আর ঠিক সেইদিনই তরোয়ালটা খুঁজে পাওয়া যায় বাগানে, পোঁতা অবস্থায়। টাইগারকে দেখে তম্বির মাথাতে রুবিটাকে টাইগারের পেটে চালান করে দেওয়ার কথা আসে। টাইগারের শরীর এমনিতেই ভাল যাচ্ছিল না। খিদে কম ছিল। বয়সও হয়ে গেছিল মরার মতো। কি মানুষ আর কি কুকুর মরার বয়সে পৌঁছলে তাকে কোনও না কোনও ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মরতেই হয়, এর কোনও ব্যতিক্রম হয় না। সেই সুযোগটাও ওরা নিয়েছিল। সানাহানবি যখন আচ্চাও-এর সঙ্গে তামুতে বেড়াতে গেল তখন থৈবী টাইগারকে খাওয়ানোর ভার নিয়েছিল। না থৈবী?

হ্যাঁ।

বলেই, থৈবী রুমাল দিয়ে নাক মুছল।

 কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত খাওয়াওনি টাইগারকে?

সানাহানবি চমকে উঠল। কী। একটা চাপা অভিব্যক্তি করল। আর সঙ্গে সঙ্গে থৈবী, সানাহানবির হাত ধরে কেঁদে উঠল।

না। থৈবীর এ ব্যাপারে কোনও দোষ নেই। বলতে গেলে, চক্রান্ত করেই তম্বি আর উ-মঙ্গ যত্ন করে খাওয়াবে বলে এবং ইবোহাল সাহেব ডাকছে বলে ওকে ভিতরে পাঠিয়ে, কাণ্ডটা ঘটায়।

কাণ্ডটা ঘটাল কী করে?

 তিতির শুধোল।

গ্রেট গেন কুকুর তো কম বড় নয়! বাঘেরই মতো। বিস্তারিত না জানিয়ে, শত্রু কুকুরকে পাথর খাইয়ে মারবে বলে–এই প্রক্রিয়া ভেট-এর কাছ থেকে জেনে নিয়ে তম্বি ভেটকে দুশোটাকা ঘুষ দিয়ে এসেছিল। এদিকে টাইগারের মতো বড় কুকুরও, অতবড় রুবিটা গিলতে পারেনি। যতখানি ঠেলতে পেরেছিল তম্বি এবং উ-মঙ্গ ততখানিই গেছিল এবং এমন একটা জায়গাতে গিয়ে আটকে গেছিল যাতে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল না বটে, কোনও খাবারও নামতে পারছিল না। ওরা জানত যে, কয়েকদিনের মধ্যেই টাইগার মরবে এবং মরলে ফার্মেরই মধ্যে কবর দেবে সানাহানবি, আর তখন ধীরে-সুস্থে সময় বুঝে, টাইগারের বডি কবর থেকে তুলে রুবিটাকে কেটে বের করে নেবে।

কিন্তু থৈবী ভিতরে চলে গেছিল কেন, নিজে টাইগারকে না খাইয়ে?

আমি বললাম।

 ইবোহাল সিং দুপুরে ভদকা খেতেন অ্যাঙ্গোডুরা বিটার্স দিয়ে। তার মধ্যে আবার মণিপুরের তীব্র গন্ধ-ওয়ালা গোঁড় লেবুর একটি স্লাইস ফেলে দিতেন। তার মধ্যে একটি কাঁচা লঙ্কা ভেঙে দু টুকরো করে, সিডলেস অবস্থাতে গ্লাসের মধ্যে ফেলে দিতেন।

তাতে কী হত?

ডি. আই. জি. সাহেব, উদ্বেগের সঙ্গে শুধোলেন।

আমার মনে হল যে, উনি নিশ্চয়ই ওই পানীয় ইস্তেমাল করেন।

ঋজুদা বলল, কাঁচা লঙ্কা আর গোঁড় লেবুর গন্ধ, ইটালিয়ান অ্যাঙ্গোঁরা বিটার্স-এর সঙ্গে মিশে রীতিমতো এক গান্ধর্ব সুগন্ধর পায়দা করত। তা, এইসব বানিয়ে দিত আচ্চাও। ইবোহালের শরীরে রাজরক্ত না থাকলেও অনেক রাজাকে সে কান ধরে ‘রইসি’ শেখাতে পারত। থৈবীকে ভিতরে পাঠিয়েছিল, তম্বি, ইবোহালকে ড্রিংঙ্ক ফিক্স করে দিতে। তারপর থৈবীকেও অফার করেছিল ইবোহাল। থৈবী বেশি খায়নি হয়তো ছোট-পেগ দুয়েক–কিন্তু সেই সময়টুকুই তম্বি আর উ-মঙ্গ-এর পক্ষে যথেষ্ট ছিল।

তারপর?

 সানাহানবি যখন কাঙ্গপোকপিতে ফিরে এল, তখন বুঝতে পারল যে, টাইগার অসুস্থ। কিছু খেতে পারছে না। তখন কোহিমা থেকে ভেটকে ডেকে পাঠাল না কেন?

ভটকাই বলল।

তম্বি, রুবিটা’ গিলিয়ে দেওয়ার পরদিনই ইম্ফলের ভেট সাহেবকে ‘ভেট’ পাঠাল। দুটো বড় বড় মোরগ, দু বোতল বার্মিজ মদ এবং পাঁচশো টাকা। লিখে দিল যে, রাতের বাসে গিয়ে দেখা করবে। রাতে গিয়ে আরও পাঁচশো টাকা দিয়ে ভেটকে বলে এল, কাঙ্গপোকপি থেকে একটা কল আসতে পারে। যেও, তবে যদি বোঝো যে, সে কুকুর কোনও কিছু গিলেছে এবং সেই জন্যেই খেতে পারছে না, তবে অন্য কিছু হয়েছে বলে দিয়ে চলে এসো। এক্স-রে করতে বললে বলবে, মেশিন খারাপ। ফিরে এলে, আবারও হাজার টাকা পাবে। পারলে, এমন কিছু করো, যাতে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় কুকুর। ভেট বলেছিল, এমনিতেই অনেক অন্যায় করছি। সেটা আমি করতে পারব না। তম্বি বুঝিয়েছিল কেসটা খুবই গণ্ডগোলের–ফেরার সময় পথে মার্ডার হয়ে যাবে। যদি তোমাকে ডাকে তুমি যাবে না কথা দিলে, তোমাকে আরও হাজার টাকা আমি কালই লোক মারফত পাঠিয়ে দেব। ভেবে দেখ। A Bird in hand is as good as two in the bush। ভেট টোপ খেলেন। ভবিষ্যতে কোনও টাকা পাওয়া যাবে না যাবে–তা ছাড়া নতুন এক ছোকরা, গৌহাটি থেকে পাশ করে এসে থংগলবাজারে চেম্বার খুলেছে, এমনিতেই রুজি রোজগার খুবই কমে গেছে।

নতুন ভেট যে এসেছে, সে কুকি। এসেছিল যে, তাও জানত তম্বি। তম্বি সিংকে যত ভোলেভালা মানুষে ভাবে, তা নয়। এক কোটি টাকার জিনিস হস্তগত হলে বোকারও বুদ্ধি খুলে যায়। সে ন্যাশানাল সোস্যালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড–মুইভা ফ্যাকশানের (সংক্ষেপে এন. এস. সি. এন) নামে প্যাড ছাপিয়ে, সেই প্যাডে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখে দেয় যে, ইম্ফল শহরের মধ্যে প্র্যাকটিস করতে পার। যদি শহরের বাইরে যাও, বিশেষ করে কাঙ্গলোটোংবীর দিকে তা হলে, তোমার মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে। ইচ্ছা করে কাঙ্গপোকপি লেখেনি। ওই সব অঞ্চলই নাগাল্যান্ডে যাওয়ার পথেই পড়ে। অতএব সানাহানবি যে তাকে নিয়ে যাবে, সে পথও বন্ধ করে রেখেছিল। কোহিমার একমাত্র ভেট ওযে ডিমাপুরে গিয়ে মারাত্মক হার্ট-অ্যাটাকে শয্যাশায়ী থাকবেন আরও মাসখানেক, তাও তম্বি খোঁজ নিয়ে রেখেছিল। অতএব বিনা চিকিৎসাতে নয়, ভুয়া চিকিৎসাতে মারা গেল, টাইগার। ইম্ফলের ভেট এসেছিলেন। তম্বির টাকাও হজম করেছিলেন এবং থৈবীর দেওয়া মোটা টাকাও। সানাহানবি এবং থৈবী টাইগারকে বাঁচাবার চেষ্টার কোনও কসুর করেনি।

আচ্ছা রুবিটা যে টাইগারকে গেলানো হয়েছে, তা তোমার মনে এল কীভাবে?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

কুকুরদের নানারকম রোগ হয়। ইনফেকশাস ডিজিজ। এর মধ্যে আছে ভাইরাল ডিজিজ, রিকেটসিয়াল ডিজিজ, ফাঙ্গাল ডিজিজ। আবার নন ইনফেকসাস ডিজিজের মধ্যে আছে..

আরে, তুমি শর্টকার্টে বলো। ভটকাই বলল।

তবে শোন, বলেইছি তো তোদের যে, ইম্ফলের ভেট বলে গেছিলেন যে, টাইগারের পাপিলোমাটোসিস হয়েছে। তখনই আমার সন্দেহ হয়। তখন আমি রাত দুটোতে কলকাতাতে সনৎদাকে ফোন করে শিওর হই পাপিলোমাটোসিস হয় বাচ্চা কুকুরদের। দেখবি এখন জেরার মুখে পড়ে ভেট বাবাজি সবই স্বীকার করে নেবেন। পুলিশের জেরা যে কী জিনিস তা তো সকলে জানে না। মারধোরের বাবা তা! এই জেরা ব্যাপারটা এঁরা একটা আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।

আপনি এত ডিটেইলস-এ এ সব জানলেন কী করে, মিস্টার বোস?

 ডি. আই. জি. বললেন।

 ডিটেইলসগুলো আমার অনুমান। সঠিক তথ্য আপনাদের জেরা আর মারের মুখে বেরিয়ে আসবে। তবে আমার কনক্ল্যশানে কোনও ভুল নেই। ডিটেইলসে পনেরো থেকে কুড়ি শতাংশ ভুল বেরোবে হয়তো, কিন্তু ডিসিশান হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট।

তম্বি সিং উ-মঙ্গকে মারতে গেল কেন, গুলি ছুঁড়ে? মত্ত অবস্থাতে ছিল বলে?

হ্যাঁ। আমাদের সামনে মারতে যাওয়া, মত্ততারই কারণে। তবে উ-মঙ্গকে ও আজই মারত এবং এই ফার্মেরই মধ্যে। নীচে গিয়ে। হয়তো ওই ঝোরার পাশের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতেই। তারপর পা দিয়ে ডেডবডি ঠেলে ফেলে দিত জলে। উ-মঙ্গকে ও ব্যবহার করেছিল। আরেকজনকেও করেছিল, সে হাঞ্জো। ওরা যখন টাইগারকে রুবিটা গেলাচ্ছিল তখন হাঞ্জোকে বলেছিল, থৈবী মেম সাহেবের বা সাহেবের খিদমদগারী করতে। ওদের নোকরি বাঁচাতে। ওকে মদ খাওয়ার জন্যে কুড়ি টাকা দিয়েছিল। ব্যাপারটা ওরা উ-মঙ্গের কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে করেছিল। রুবি রহস্যের কথা হাঞ্জো জানত না।

তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু তম্বি আর উ-মঙ্গ ইবোহাল সিংকে খুন করল কখন?

তিতির বলল।

ঋজুদা চায়ের কাপটা তুলে নিল। একটা বড় চুমুক দিল। সকলেই চায়ে চুমুক দিলেন। ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে তম্বি সিং এবং উ-মঙ্গকে নিয়ে গেছে, একটু আগে। পেছনে পেছনে গেছে প্রিজন ভ্যান। আমাকে এখানেই চিকিৎসা করে পেইনকিলার ও অন্য ইনজেকশান দিয়ে, হাতটাকে ব্যান্ডেজের একটি স্লিং লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছেন ডাক্তার। ওষুধও দিয়ে গেছেন, চারঘণ্টা অন্তর খেতে। ব্যথা বাড়লেও খাবার জন্যে একটা ওষুধ দিয়ে গেছেন। বাকিটা কলকাতাতে গিয়ে হবে।

ঋজুদা আরও এক চুমুক চা খেয়ে, পাইপটা ধরিয়ে দু তিনটি বড় টান লাগিয়ে বলল, তম্বি সিং বা উ-মঙ্গ খুন করেনি ইবোহাল সিংকে।

ওরা খুন করেনি?

ঘরের মধ্যে আমাদের সম্মিলিত রুদ্ধ করে রাখা শ্বাস, একসঙ্গে পড়ল।

ঋজুদা বলল।

তারপরই থৈবীর দিকে ফিরে বলল, তোমাদের বাড়িতে যে পুলিশ সার্চ করেছিল তন্ন তন্ন করে, ইবোহাল সিং-এর তরোয়াল নিখোঁজ হওয়ার পরে রুবির খোঁজে–তা কি তুমি জানতে?

সানাহানবি চমকে উঠে তাকাল, থৈবীর দিকে।

থৈবী মুখ নামিয়ে জানাল, হ্যাঁ।

কাউকে জানাওনি কেন?

 লজ্জায়।

 লজ্জা কীসের? থাঙ্গজম সিং-এর মতো অবস্থাপন্ন মানুষ তো এক কোটি টাকার জন্যে বন্ধুস্থানীয় মানুষের রুবি চুরি করতে যেতেন না। এই সার্চ করানো ব্যাপারটা ইবোহাল সিংই করিয়েছিলেন, পুলিশকে ইনফ্লুয়েন্স করে। এবং থাঙ্গজম সিং যে চুরি করেননি, তা জেনেও।

তবে? কেন?

রুবি চুরি যাওয়ার সাতদিন আগে ইবোহাল সিং ইম্ফলে এসেছিলেন। সেখানে থংগল বাজারের এক মদের দোকানে ওদের মধ্যে প্রচণ্ড কথা কাটাকাটি হয়। দোকানের নাম আমি বলে দেব। জেরাতেও বলবেন, থাঙ্গজম সিং। ইবোহাল সিং নাকি বলেন যে, চাকর-বাকরের পয়সা হলেই কি তারা বাবুর সমান হয়ে যেতে পারে? না যায়?

কেন? এ কথা উনি বললেন কেন?

থাঙ্গজম সিং নাকি বছর পঁয়ত্রিশ আগে সত্যিই চাকরের কাজ করতেন ইবোহাল সিং-এর কাছে। তম্বি সিং এবং উ-মঙ্গ তা জানে। এই কথাতে থাঙ্গজম সিং নাকি বলেন, যে নাম-ভাঁড়িয়ে রাজা, সে আবার রাজা না কি? আর যা করে তুমি বড়লোক আমিও তো তাই করেই বড়লোক। বাইরের ভড়ং আমাদের যাই থাক। এই রাগেই ইবোহাল চুরির দায়ে থাঙ্গজম সিং-এর বাড়ি সার্চ করিয়ে তার বদলা নেয়। তবে থাঙ্গজম বাড়ির চাকর বাকর সকলকে মোটা টাকা দিয়ে, কথাটা যাতে প্রচার না হয়, তার সর্বতোভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু বাড়ির আশেপাশের মানুষেরা জেনে তাকে টিটকিরি দিতে থাকেন। থৈবী ও তার দাদা ইবোবা এবং ইবোবার স্ত্রী যমুনাকেও এর জন্যে অনেক অপমান সইতে হয়। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে থাঙ্গজম সিং হাঞ্জোকে দিয়ে খুন করান ইবোহাল সিংকে। তা ছাড়া অন্য কারণও ছিল। তা আমি ডি. জি-কে জানাব।

ঋজুদা এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে থৈবী একটি আর্তনাদ করে সোফা থেকে মূর্ছা গিয়ে কার্পেটে পড়ে গেল।

ঋজুদা দাঁড়িয়ে উঠে বলল, স্মেলিং-সল্ট আছে, সানাহানবি? থাকলে এক্ষুনি দাও। না থাকলে গরম দুধের সঙ্গে দু চামচ ব্র্যান্ডি দিয়ে খাইয়ে দাও। ও ঠিক হয়ে যাবে।

ডি.আই.জি বললেন, হাঞ্জো কী করে খুন করল, ইবোহাল সিংকে?

ওকে নিয়ে গেছিল পুরনো ড্রাইভার ইরাবন্ত সিং। রাতের বেলা, স্টিল-গ্রে মারুতি ওয়ান থাউজ্যান্ড নিয়ে। ড্রাইভার জানত না, যাবার উদ্দেশ্য। তবে সন্দেহ একটু করে, যখন গাড়িটা বাড়ির ভিতরে না ঢুকিয়ে ইরাবন্ত সিংকে বাজার থেকে খাওয়া দাওয়া করে এসে বাড়ির বাইরের দেওয়ালের পাশে একটি বিশেষ জায়গাতে দাঁড় করিয়ে রেখে, ঘুমিয়ে থাকতে বলে। বলে, ওর ফিরতে রাত হবে। বলে, ইবোহাল সাহেবকে বিরক্ত করতে চায় না। ওর কাজ আছে উ-মঙ্গ এর সঙ্গে। উ-মঙ্গ-এর সঙ্গে আগেই টেলিফোনে যুক্তি করে রাখে। তম্বি সিং তখন ইম্ফলে ছিল। একটা ঝাঁকড়া কাঁঠাল গাছের গা বেয়ে কম্পাউন্ডের ভিতরে নামে হাঞ্জো সিং। হাঞ্জো এমনিতেই দাগি খুনি। সবরকম খুন-জখমে সিদ্ধহস্ত। আপনাদের রেকর্ডস ও বার্মা পুলিশের রেকর্ডস দেখলে ওর সম্বন্ধে জানতে পারবেন। ওইরকম লোক বলেই বডিগার্ড হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন থাঙ্গজম সিং।

তারপর?

তারপর, উ-মঙ্গ তাকে, সে যেখানে শোয়; সেখানে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে রাখে। নিজে গিয়ে খেয়ে আসে। সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের সব আলো নিভে গেলে, ফিরে আসে। ইবোহাল তখনও পড়েছিলেন। ইবোহাল যে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ এবং তাঁর সম্বন্ধে যে যাই বলুক, তিনি যে ও সব বাজে ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন– তা আমার মনে হয় না। আমার ভুল হতে পারে না, এমন নয়–কিন্তু আমি জোর দিয়ে বলব যে, মনে হয় না। তারপর কী করে খুন করে, তা তো ভটকাইই তোদের বলেছে।

ডি.আই.জি. সাহেবও বললেন, হ্যাঁ। আমার কাছেও সেই রিপোর্ট আছে। তবে ইবোহাল সাহেবের ওভারশটা পরে অপকর্মটি করাতে পুলিশ পিরপ্লেক্সড হয়ে গেছিল।

ভাল করে চারদিকে দেখলে, ভিজে মাটিতে, বাগানের অন্য প্রান্তে যেখানে ওই ভারী শরীর নিয়ে হাঞ্জো লাফিয়ে পড়েছিল, সেখানে তার পায়ের চামড়ার জুতো পরা দাগ খুঁজে পেতে পারত। যত্ন নিয়ে খোঁজেনি। থাক, হাঞ্জো নিজেই যখন নেই, তখন এই আলোচনা অনর্থক। কিন্তু ছাঁচটি আমি প্লাস্টার অফ প্যারিসে তুলে রেখেছি–যা তো রুদ্র। আমার স্যুটকেস থেকে নিয়ে এনে দে ডি.আই.জি. সাহেবকে। ফোটোও ভোলা আছে। হত্যাকারী কে, তা স্থিরীকৃত না হলে তো বহুবছর ধরে অগণ্য মানুষের হয়রানি হবে।

তা ঠিক।

ব্র্যান্ডি মেশানো দুধ খেয়ে থৈবী আবার উঠে বসেছে, কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে, ও যেন ভাল না হলেই খুশি হত।

থৈবী যেন বহুদূর থেকে কথা বলছে, এমনভাবে বলল, তা হলে বাবার তো জেল হয়ে যাবে।

নাও হতে পারে। কিছু মনে কোরো না থৈবী, এই দেশে কেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই যাদের পয়সা আছে, তাদের জেল প্রায়ই হয় না, ফাঁসিও হয় না। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা থেকে বড় বড় ফৌজদারি উকিল, ব্যারিস্টার নিয়ে আসতে বলবে। তাঁদের সওয়ালের ভারে এই ছোট জায়গার জজ সাহেব এবং আমার দেওয়া তথ্য-প্রমাণ ধুলোর মতো উড়ে যাবে। তবে জেল হবে তম্বি সিং-এর আর উ-মঙ্গ-এর, অবশ্যই। তাদের বাঁচাবার তো কেউই নেই! এদেশের জেল গরিবরাই চিরদিন ভরে এসেছে।

আমার ভাই ইবোবা সিংকে কে খুন করেছে?

ওঁরা তো টেররিস্টদের গুলিতে মারা গেছেন। তা ছাড়া থৈবী, আমি তো এসেছিলাম ইবোহাল সিং-এর মৃত্যুর তদন্ত করতে। টেররিস্টদের গুলিতে মারা যাবার সম্ভাবনাই বেশি। রোড-ব্লকও তো করে রেখেছিল তারা।

থৈবী কী যেন ভাবছিল। কথা বলল না।

ঋজুদা বলল, তোমার বাবা, তিন তিনটে হঠকারিতা করেছিলেন, যে জন্যে আমার সন্দেহ জোরদার হল। (১) তম্বি সিংকে আমার কাছে পাঠানো উচিত হয়নি ওঁর। তম্বি সিং-এর পটভূমি, অবস্থা এবং আরও সবকিছু তাঁর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলে শুধু আমি কেন, এই এরাও বুঝেছিল। পঞ্চাশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স ওর পক্ষে দেওয়া যে সম্ভব নয়, এমন সন্দেহ প্রথমেই হয়েছিল। (২) উনি ওঁর বাড়িতে পুলিশের তল্লাসির খবরটা আমার কাছে চেপে গিয়ে ভাল করেননি। বিশেষত আমাকে যখন আগে থেকেই চিনতেন। অথচ আমি যমুনার মুখের বিষাদ দেখেই বুঝেছিলাম যে এ বাড়িতে তাকে বিষণ্ণ করার মতো কিছু ঘটেছে। (৩) ইরাবন্ত সিং, পুরনো ড্রাইভারকে সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে দিয়ে আমাদেরই জন্যে বাঙালি ড্রাইভার যোগেনকে রাখা উচিত হয়নি। বাঙালিরা গরিব সন্দেহ নেই, কিন্তু এখনও খুঁজলে অন্য প্রদেশীয়দের তুলনাতে বাঙালিদের মধ্যেই সমানুষের সংখ্যা বেশি হবে। যোগেন বেশি কথা বলে, গরিব; কিন্তু অসৎ নয় সে। পয়সার জন্যে আমাদের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করতে রাজি হয়নি। এটাই সৌভাগ্যের কথা যে পয়সা এখনও সব মানুষকে কিনতে পারে না। (৪) নতুন মারুতি ওয়ান থাউজ্যান্ড এর স্টিল-গ্রে রংকে কেউ কাঁটক্যাটে লাল রং করায় না, প্রায় রাতারাতি। এতেও আমার সন্দেহ হয়। তা ছাড়া আমি ইরাবন্ত সিং-এর বাড়িও গেছিলাম। তাকে টাকা দিয়ে এবং জেলের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে জবানবন্দিও নিয়ে এসেছি যে, সে তোমার বাবার আদেশে হাঞ্জো সিংকে সঙ্গে নিয়ে সেই রাতে ‘মোরে’তে গেছিল–এবং চারঘণ্টা বাজারে খেয়ে দেয়ে আড্ডা মেরে, হাঞ্জোর নির্দেশমতো গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল বাংলোর বাইরে রাত বারোটা অবধি। তারপর দেওয়াল টপকে লাফিয়ে-আসা হাঞ্জোকে নিয়ে ফিরে আসা ছাড়া, অন্য কোনও কাজও তার ছিল না। তোমার বাবা তার মুখ বন্ধ করার জন্যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তাও সে কবুল করেছে।

ভটকাই বলল, আচ্ছা ঋজুদা, উ-মঙ্গ যদি খুনের কথা জানতই, তবে তাকে অ্যারেস্ট করা দূরে থাক, তাকে জেরা করার জন্যেও পুলিশে ধরে কেন নিয়ে গেল না, তাতে আমার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছে না।

তোর বুদ্ধি নেই, তাই। পুলিশেরা ইচ্ছে করেই তা করেনি। আর কেন করেনি তা ডি. আই. জি. সাহেবকে বল, যেন তদন্ত করে অপরাধীদের সাসপেন্ড করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশান নেন স্যাক করেন।

তিতির বলল, ইবোহাল সিং-এর সম্পত্তি কে পাবে? আর রুবিটা?

রুবিটা টেবলের পরে রাখা ছিল। ভাল করে ধুয়ে, স্পিরিট দিয়ে মুছে রেখেছিলেন ভেট।

এই ভেট-এরও শাস্তি হবে। জেরার মুখে সব স্বীকার করবেন। বুদ্ধিমান হলে, প্রথমেই স্বীকার করবেন। তা ছাড়া, সানাহানবি তুমি টাইগারের মৃত্যুর জন্যে ওঁর উপরে ড্যামেজ স্যুটও ফাইল করবে। যাতে ড্যামেজ দিতে গিয়ে বাড়ি, ঘর বিক্রি করে তাকেও ইম্ফল ছেড়ে চলে যেতে হয়। দুর্নীতি যে সমাজের কোন স্তরে, কোন মহল্লাতে না পৌঁছেছে এখন, তা ঈশ্বরই জানেন। এমন না হলে, দুর্নীতি আর চোরাচালান আর খুন আরও বাড়বে। রসাতলে যাবে পুরো দেশ।

এই চোরাচালানের টাকা শেষ অবধি কোথায় যায়, ঋজুকাকা?

 তিতির শুধোল।

দেশের যেখানেই চোরাচালানি জিনিস কিনিস, তা সুগন্ধ সাবান বা পারফুম বা টেপ-ডেক বা ভি. সি. আরই হোক, তা ফিরে আসছে এ. কে. ফর্টিসেভেন রাইফেল, গোলা বারুদ আর আর. ডি. এক্স, বিস্ফোরক, বোমা, রিমোট কন্ট্রোল; এই সব হয়ে। এ কথা শিক্ষিত মানুষেরাই বোঝে না তা সাধারণদের দোষ দিয়ে লাভ কী। চোরাচালানের পথে যা কিছু আসে–থৈবী তোমার বাবার ব্লু-লেবেল হুইস্কি থেকে আরম্ভ করে তোমার নেইল পালিশ–হেয়ার-ড্রায়ার, জাপানিজ সিল্কের শাড়ি, সব কিছুইতা ব্যবহার যারা করেন, তাঁরা সমান অপরাধী। আমার এই অ্যাস্ফোরা তামাকও! আমিও…

হঠাৎ থেমে ঋজুদা বলল, একী। ভোর হয়ে গেল যে! এবার আমরা বেরিয়ে পড়ব, সানাহানবি। আরেক কাপ করে চা কি হবে? সঙ্গে দুটো করে বিস্কিট?

সানাহানবি উঠে পড়ে বলল, একেবারে ক্রিসপ, গরম গরম চিজ-টোস্ট করে দিচ্ছি আপনাদের।

যা দাও। বড় চিন্তায় আছি, আমার গদাধরের জন্যে।

কলিং বেল টিপতেই বাবুর্চি এসে দাঁড়াল। অর্ডার দিয়ে দিল সানাহানবি।

তিতির বলল, বললে না তো মিস্টার ইবোহাল সিং-এর সব সম্পত্তির, এই রুবিটা সুষ্ঠু কে মালিক হবে?

ঋজুদা বলল, আমি মালিক হলে কি তুই খুশি হতিস? 

হতাম না? ওরকম দুটো বাংলো। নদী পেরুলেই বার্মা? ব্যাঙ্কে কত টাকা কে জানে! ওই রকম সব ফার্নিচার, ক্রকারী, কাটলারি…দ্যা রিট্রিট!

থাম থাম। এ সবের তো শেষ নেইরে। জীবনে সত্যিকারের শিক্ষা যাদের আছে, তারা প্লেইন-লিভিং হাই-থিংকিং-এ বিশ্বাস করে। আনন্দ তাতেই। আড়ম্বরে আনন্দ নেই। তবে না। আমি পাব না। এ সব পাবে, সানাহানবি।

ঘর সুষ্ঠু লোক একসঙ্গে বলে উঠল, সানাহানবি?

সানাহানবি আর থৈবী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

হ্যাঁ, তোরা ভাবছিস যে, আচ্চাও সিংকে দিয়ে গেছেন ইবোহাল সিং সাহেব?। লাইহারোবা সিং-এর, অকৃতদার কাকার সম্পত্তি পেয়ে নিজের জীবনেই একটা সত্য ইবোহাল সিং জেনে গেছিলেন, হয়তো, নিজে শিক্ষিত ছিলেন বলেই যে, পড়ে-পাওয়া ধন আর বসে-খাওয়া জীবন মানুষকে নষ্ট করে দেয়। যতটুকু মানুষ সৎ পরিশ্রমে পায়, সেইটুকুর স্বাদই আলাদা, সেটুকুই শেষ পর্যন্ত থাকে। আর থাকে মান-সম্মান। এই সত্য বুঝতে দেরি হয় মানুষের, কিন্তু এইটাই সত্য। আচ্চাও সিং ভাল ছেলে এবং ইবোহাল সিং তাঁকে সত্যিই ভালবাসতেন বলে জাগতিক সম্পত্তি দিয়ে যাননি। তাঁর মনের মতো গড়ে দিয়ে গেছিলেন তাঁকে, সেইটাই সবচেয়ে বড় সম্পত্তি। চিরদিনের সম্পত্তি।

বলেই বলল, ডি. আই. জি. সাহেবকে, বলুন স্যার, আর কোনও প্রশ্ন আছে। আপনার? ক্যাসেটটাও বোধহয় ভরে এল। অনেক কথাই বাকি রইল। ডি. জি-কে চিঠি লিখে জানাব।

ওয়েলকাম।

তারপর ঋজুদা বলল, আমার একটা অনুরোধ। এই টাকাটা তম্বি সিংকে ফেরত দেবেন–এ টাকা তিনি তাঁর মামলার খরচ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। যদিও টাকাটা থাঙ্গজম সিং-এর, কিন্তু এখন এর মালিক আমি। রসিদও দিয়েছি। মোট পঞ্চাশ হাজার থেকে আমাদের খরচ হয়েছে পনেরোশ ছাপান্ন টাকাকী করে ভটকাই?

ইয়েস। ইনক্লডিং, কস্ট আফ পান্তুয়া অ্যান্ড ডালকুলাক্স।

 কত আছে হাতে?

দাঁড়াও। ক্যালকুলেটরটা বের কর না, রুদ্র।

ভটকাই উত্তেজিত হয়ে বলল।

 তিতির হেসে বলল, আটচল্লিশ হাজার চারশো চুয়াল্লিশ।

 একটা খাম, সানাহানবি।

 সানাহানবি উঠে গেল, খাম আনতে।

একটা রসিদ…।

 ডি.আই.জি. সাহেব বললেন, এতো ট্রেজারিতে জমা পড়বে না। আমি পার্সোনাল রসিদ দিয়ে সানাহানবি মেমসাহেবকে দিয়ে উইটনেস করিয়ে নিচ্ছি।

ঠিক আছে। সকলেরই যখন বাঁচার চেষ্টা করার অধিকার আছে, তখন তম্বি সিংই বা করবে না কেন? তবে উ-মঙ্গ-এর প্রতি আমার কোনও সিমপ্যাথি নেই। ও শুধু চোরই নয়, মিথ্যেবাদী, লোভী, চক্রান্তকারী। উ-মঙ্গ মেরে ফেলতে পারত তম্বিকে, রুবিটা হাতাবার পর। বিরাশির বুড়োরও যখন লোভের নিবৃত্তি হল না, ও থাকুক বাকি জীবনটা জেলে।

আমার বাবা যদি পালিয়ে গিয়ে থাকেন?

 থৈবী প্রশ্ন করল।

পালাবার সম্ভাবনা নেই, থৈবী। তোমার বাবাকে পুলিশ মনে হয়, রাত বারোটা নাগাদ অ্যারেস্ট করেছেন।

সেকী! তা হলে যমুনা যে বাড়িতে একা আছে।

ও, এই যমুনা। ভারী ভাল মেয়ে, তোমার মতো থৈবী। তোমার বাবাকে তোমরা বাঁচাতে পারো। ভাল উকিল দিয়ে দেখো। আইনের অনেক ফাঁক-ফোকর থাকে। কিন্তু বাঁচাতে পারলে, ওঁকে সৎপথে চালিত কোরো। সভাবে কাজ করে, মাথা উঁচু করে কোটি কোটি মানুষ সব রকম বৃত্তিতে, আজও বেঁচে আছে। উনিই বা পারবেন না কেন? তোমার বাবার জীবনের সবচেয়ে বড় সুকৃতি তুমি এবং যমুনা। তোমার দাদাকে আমি দেখিনি, মিশিনি; বলতে পারব না তাই তার সম্বন্ধে।

দাদা খুব ভাল ছেলে। এই সব কারণেই বাবার সঙ্গে বনত না দাদার। দাদার মৃত্যুর রহস্য ভেদ করার ভার আপনি কি নেবেন? কলকাতায় কদিন থেকে ফিরে এসে?

ভেবে দেখব। তুমি ফোন কোরো।

নাম্বার?

সব আছে সানাহানবির কাছে। তুমি ডি. জি-র সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। তিনিই বলবেন, যা বলার।

সানাহানবি খাম নিয়ে ফিরে এল। মুখ নিচু করে বলল, কী প্রমাণ যে, আমিই ইবোহাল আংকল এর সব সম্পত্তির মালিক?

উইল আছে। উখরুলের উকিল একজন এগজিক্টর এবং তম্বি সিং নিজে আরেকজন।

তম্বি সিং? চমকে উঠল সানাহানবি এবং থৈবীও।

ডি. আই.জি. সাহেব, আপনি উইলটার একটা প্রোবেট করিয়ে নেবেন উকিল দিয়ে, কারণ ওই বুড়ো উকিলের শরীরের অবস্থা ভাল নয়। ওঁর পক্ষে দু একদিনের বেশি ইম্ফলে থাকাও সম্ভব নয়। ডি. জি. সব জানেন। জবানবন্দি নিয়ে ও প্রবেট করিয়ে ওঁকে ছেড়ে দেবেন।

ততক্ষণে চা আর চিজ টোস্ট এসে গেছে। রোদও উঠে গেছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। একটু দূরের ন্যাশানাল হাইওয়ে দিয়ে কোহিমা ও ইম্ফলের দিকে গাড়ি বাস ও ট্রাকের যাতায়াতের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সানাহানবি ও থৈবী সকলের প্লেটে প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে আবার বসল।

 ঋজুদা বলল, কনগ্রাচুলেশনস!

সানাহানবি, লেডি ডাই; মুখ নিচু করে এমন একটা স্মাইল দিল, ভটকাই-এর ভাষাতে, যে রিয়্যাল লেডি ডাইও লজ্জা পেতেন দেখলে।

একটা ফোন করো থৈবী, যমুনাকে।

ঠিক বলেছেন।

থৈবী বলল।

ফোনের ডায়াল যখন থৈবী ঘঘারাচ্ছিল, ঋজুদা বলল, টাইগারকে নতুন করে কবর দিয়েই তোমরা দুজনেই চলে যাও ইম্ফলে, তারপর যমুনাকে গৌহাটি পাঠিয়ে দাও।

ও যেতে চায় না।

ওর বাবার কাছে?

 বাবার কাছেও নয়।

বাবার প্যারালিসিস। ও না দেখলে, কে দেখবে?

ও ওর বাবাকে ঘেন্না করে।

ও ভগবান! এ কোন পৃথিবীতে বাস করছি আমরা!

ভটকাই হঠাৎ বলল, আচ্ছা ঋজুদা, তুমি আমাকে দিয়ে উ-মঙ্গকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করালে কেন?

ঋজুদা হেসে উঠল।

বলল, সরি। করিয়েছিলাম, যাতে ধূর্ত, ভণ্ড, পাজি, লোভী উ-মঙ্গ বুঝতে না পারে যে, ওর আসল রূপ আমি ধরে ফেলেছি।

তোর প্রণামটা ও খেয়েছিল। বল?

একটা চিজ টোস্ট মুখে দিয়ে ঋজুদা বলল, তা হলে যমুনাকে তোমরা তোমাদের সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসো। কদিন তোমরা তিনজনে একসঙ্গে থাক, মজা করো। জীবনটা তোমাদেরই। আর, মাত্র একটাই জীবন। কালো মেঘ আসে, ভেসে যায়, আবার সকাল হয়, ফুল ফোটে, পাখি ডাকে। দুঃখ, কষ্ট, আঘাত, শোক, জীবন থাকলেই থাকে। তা সত্ত্বেও বাঁচতে হবে। বাঁচবে। আনন্দে বাঁচবে তোমরা থ্রি কমরেডস।

বলেই, চায়ে বড় একটা চুমুক দিয়েই ঋজুদা উঠে পড়ে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দাতে এল। বলল আঃ। কী সুন্দর সকালটা!

সকলেই সঙ্গে সঙ্গে এলেন।

 সানাহানবিকে, এই রুবিটা ইম্ফলের ব্যাঙ্কের লকারে রাখতে সাহায্য করবেন একটু আপনি। আজই। ঋজুদা বলল।

নিশ্চয়। ডি. আই. জি. বললেন।

যতদিন না উনি উঠিয়ে নিতে বলছেন, ততদিন আর্ম-পিকেটও থাকবে এ বাড়িতে। কোনও চিন্তা নেই আপনার। এয়ারপোর্ট অবধি আপনাদের সঙ্গেও দুটি জিপ যাবে এসকর্ট হিসেবে।

ডি.আই.জি. বললেন।

ফাইন।

 হাতঘড়ির দিকে একবার চেয়ে নিয়ে ঋজুদা বলল, তা হলে আমরা এগোই। এই রুদ্র, জিপসিটা যে পড়ে রইল সেই কোন বাদাড়ে? যা তো, সেটাকে নিয়ে আয়। চাবিটা নিয়ে যা।

আমি হেসে উঠলাম। বললাম, চল ভটকাই। চল কলকাতা এবারে, দেখিস এবারে তোকে কেমন চটকাই।

ঋজুদা বলল, প্লেন থেকে নেমে ভটকাই-এর প্রথম কাজ মোটর-ট্রেনিং স্কুলে গিয়ে ভর্তি হওয়া।

বাংলো থেকে বেরিয়ে ভটকাই বলল, আমার মনে হচ্ছে ঋজুদা সব কথা খোলসা করে বলল না এখনও।

বলেনিই তো। আর বলবেই বা কেন? খুনিকে ধরা, চুরি-যাওয়া রুবির হদিস করা; এ সব তো পুলিশেরই কাজ। তাদের কি চামচে করে তুলে পায়েস খাইয়ে দেওয়া কাজ ঋজুদার? তা ছাড়া আরও একটা কারণ আছে।

কী?

তা হলে আমাদের পরীক্ষাটা নেবে কীভাবে? আমি তোকে বলে দিলাম কলকাতাতে ফিরে আমাদেরই বলবে ইবোবা সিংকে কে বা কারা মারল তা বুদ্ধি খাঁটিয়ে খুঁজে বের করতে। ঋজুদাই যদি সব করবে, তবে আমরা কি শোভা?

তাই?

ইয়েস স্যার। তা ছাড়া মদের দোকানের ঝগড়াই শুধু নয়, বাড়ি তল্লাশিও নয়; আমার ধারণা ইবোহাল সিং-এর খুন, ইবোবা সিংয়ের মৃত্যু এবং আচ্চাও সিং-এর বার্মাতে পালিয়ে যাওয়ার পেছনে নাগা ও কুকি টেররিস্টদেরও হাত আছে। ইবোহাল সিং নাগাদের মদত দিতেন আর থাঙ্গজম সিং কুকিদের। ঋজুদা সেটা ভাল করেই জানে। কিন্তু এই কথা অত লোকের সামনে বলাতে অনেকই অসুবিধা ছিল। কারণ, ইস্যুটা পোলিটিক্যাল। এই কথাই নিশ্চয়ই পরে লিখবে ডি.জি-কে, দেখিস।

মারুতি জিপসিটা কোথায় ছিল, তা ভটকাই জানত। সেই জায়গাতে পৌঁছে দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠে, জিপসিটা ব্যাক করে বড় রাস্তাতে পড়ে হাচিনসন’স লজ’-এর দিকে মুখ ঘোরাতে যাব জিপসির, এমন সময় ভটকাই বলল, একটু আগেই কাঙ্গপোকপির সেই ধাবা। চল, দুটো করে পোড়া মবিলে ভাজা জিলিপি আর কচুরি লড়িয়ে আসি। আলুর তরকারিটার যা স্বাদ না! ইসস। নিশ্চয়ই দাদ চুলকোতে চুলকোতে ঝোলের মধ্যে দাদের ঝাল দিয়ে দেয়।

ইস। স্টুপিড। সকালবেলা, এমন একটা সবদিক দিয়ে সুন্দর সকালবেলা, আর তুই…

কাঙ্গপোকপির ধাবাতে পৌঁছেই তাড়াতাড়ি অর্ডার দিয়ে দিল ভটকাই নেমে। আমি জিপসিটা সরিয়ে নিয়ে একটা মস্ত সেগুনগাছের নীচে রাখলাম ওটাকে। খাবার এলে, গাড়িতে বসেই খেলাম। তারপর চাও। বেশি দুধ, বেশি চিনি দিয়ে।

সানাহানবির বাড়ির এত ভাল চায়ের স্বাদটা এতক্ষণ মুখে লেগে ছিল। দিলি সব মাটি করে।

হ্যাঁরে। একদিন সবই মাটি হয়। এই নে মর্নিং নিউজপেপার। ইংলিশ।

কাগজের নামটা ভাল করে পড়ার আগেই ভটকাই ছোঁ মেরে কাগজটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিল। চায়ের গ্লাস থেকে চা চলকে পড়ল আমার জিনস-এর উপরে।

চটে গিয়ে বললাম, কী হল? এটা?

আরে সেই লোকটাও মার্ডারড?

কে?

 আরে ঋজুদার পুরনো বন্ধু। থেংনোপালের পাহাড়ের জোতদার রঘুমণি সিং। যেখানে ইবোবা সিংদের রোড ব্লক করে মারা হয়েছে, তার কাছেই তার বাড়ি।

আমি বললাম। হুমম।

বাবাঃ। তুইও দেখি দিল হুম্ হুম করছিস–ঋজুদা স্টাইলে।

ভটকাই বলল।

না। ব্যাপারটা সিরিয়াস। এই খুনের বদলা আবার কাল অন্যেরা নেবে। আসলে এই মণিপুরের এই নাগা এবং কুকিদের বিরোধের সঙ্গে অগণ্য বড়লোক ও গরিব শান্তিপ্রিয় মণিপুরিও জড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কারণ, অগণ্য মানুষের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আছে একদলের সুরক্ষা এবং অন্যদলের বিনাশের পিছনে। বড়ই চিন্তার কথারে ভটকাই। এমনি করে ভারতবর্ষ টুকরো টুকরো হয়ে যাবার পথেই এগিয়ে চলেছে।

আমি জানতাম।

কী জানতিস?

 ছাগলের দুধ খেয়ে, চরকা কেটে, খদ্দর পরে আর নেহরু সাহেব আর জিন্না সাহেবের জ্বালাময়ী ইংরিজি বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে যে স্বাধীনতা এসেছিল, তা থাকবার নয়। স্বাধীনতা, রক্তর মূল্যে না কিনলে সে স্বাধীনতা বাঁচিয়ে রাখা ভারী মুশকিল। ঠাকুমার হাতের মোয়া নয় এ, যে হাত ঘোরালি আর ঠাকুমা তোর হাতে তুলে দিল। বাংলাদেশের মানুষ বুকের রক্ত আর নারীর সম্মানের মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। দেখিস, ওরা স্বাধীনতার দাম বুঝবেন।

হুমম।

ভটকাই বলল, তুই দিচ্ছিস বটে গুরু। একেই বলে গুরু গুড় আর চেলা চিনি।

 মানে কী হল?

মানে জানিস না? বিখ্যাত হিন্দি প্রবচন রে। মানে, গুরু যে সে গুড়ই রয়ে গেল, কিন্তু চেলা যে, সে সুপারফাইন চিনি হয়ে বেরিয়ে গেল।

আমি বললাম, কী জানি। গদাধরাতো ঋজুদাকে বলে, তোকে দেখিয়েই, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।

আমরা লজ-এর ভিতরে জিপসিটা ঢুকিয়ে দিতেই, ঋজুদা আর তিতির তাদের ব্যাগ হাতে করে এগিয়ে গেল। পেছনে পেছনে অন্যরা। সানাহানবি, থৈবী, ডি.আই.জি. সাহেব এবং তাঁর অগণ্য চেলা-চামুণ্ডারা।

ঋজুদা বলল আমাদের, যা, নেমে তোদের ব্যাগ তোল। অনেক সময় লাগবে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে।

সকলেই এখন গাড়িতে উঠেছি। ঋজুদা পাশে বসেছে, তিতির চালাবে। আমরা পেছনে। সানাহানবি ঋজুদার কাছে এসে স্বগতোক্তির মতো বলল, আবার কবে আসবেন?

আমি বুঝলাম, যে এই প্রশ্নর মধ্যে, অনেকই প্রশ্ন জড়িয়ে-মড়িয়ে ছিল।

 ঋজুদা কাঁধ শ্রাগ করে বলল, (কখনওই করে না। অবাক হলাম আমরা, ঋজুদার এই অধঃপতন দেখে) যাওয়াটা সোজা, ফিরে আসাটাই ভারী কঠিন।

বলেই, এক মুহূর্তের জন্যে বিষণ্ণ ও উদাস হয়ে গেল। সানাহানবি ও থৈবীকে বাই বলে, তিতির জিপসিটা ব্যাক করল। তারপর ড্রাইভের কোনাতে ঘুরিয়ে নেবার পর, সকলে মিলে হাত নাড়লাম। ওরাও হাত নাড়ল। সানাহানবির সুন্দর, শিষ্ট, বিশিষ্ট, সম্ভ্রান্ত দাঁড়িয়ে-থাকার ভঙ্গিটি, আমাদের সকলেরই চোখের মণিতে, চিরদিনের মতো আঁকা রইল।

জিপসির চাকা পিচ-এর পথে পড়েই জোরে ঘুরতে লাগল। হঠাৎ ভটকাই গেয়ে উঠল,

তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে
তখন ছিলেম বহুদূরে কীসের অন্বেষণে।
কুলে যখন এলেম ফিরে তখন অস্ত শিখরশিরে
চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে।
আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।

 বাঃ! ভারী ভাল গাস তো তুই, ভটকাই!

 ঋজুদা নিজের মনেই বলল।

ভটকাই রঘুমণি সিং খুন হবার খবর-ছাপা খবরের কাগজটা, ঋজুদার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ঋজুদা।

আমি এক টানে কাগজটা ওর হাত থেকে নিয়ে তার উপর চেপে বসলাম।

ভটকাই আমার চোখের দিকে চেয়ে আমার চোখের ভাষা বুঝল।

ঋজুদা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, কী?

ভটকাই বলল, কিছু না।

আমি বললাম, গানটা শেষ কর না।

 ঋজুদা কিছু বলল না।

 ভটকাই আবার ধরল:

লিখন তোমার বিনিসুতোর শিউলিফুলের মালা,
 বাণী যে তার সোনায় ছোঁওয়া অরুণ-আলোয় ঢালা–
এল আমার ক্লান্ত হাতে, ফুল-ঝরানো শীতের রাতে।
 কুহেলিকায় মন্থর কোন মৌন সমীরণে।
তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে,
 তুমি আমায়…….

আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমাদের যে কী দশা হত!

ভটকাই বলল, কী আবার হত! কাকে-চিলে ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলত।

জিপসিটা জোরে চলছিল। চারদিকের বন-পাহাড়ের সকালবেলার গন্ধ, সকালবেলার আলো, হু হু করে কলুষহীন হাওয়া আসছে, উড়ে যাওয়া পাখির চিকন স্বর……।

তিতিরের, আমার, ভটাকই-এর এবং হয়তো ঋজুদারও, সানাহানবির কথা মনে পড়ছিল খুবই। পৃথিবীটা ছোট্ট হলে; পায়ে হেঁটেই একে অন্যের কাছে এমন সুগন্ধি সকালবেলায় পৌঁছতে পারলে, কী ভালই না হত!

ভাবছিলাম আমি।

(এই উপন্যাসের পটভূমি বাস্তব কিন্তু প্রত্যেকটি চরিত্রই কাল্পনিক।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *