কবি – ০২

কবি – ২

দায়ে পডিয়া মহাদেব প্রস্তাবটায় সম্মতি না দিয়া পারিল না।
মোহন্ত সুদুর্লভ আশীৰ্বাদ করিয়া তাহাকে কল্পতরুর তলায় বসাইয়া দিলেন এবং চারিদিকে প্ৰমত্ত জনতা। অত:পর সম্মত না হইয়া উপায় কি! কিন্তু আর একজন চুলি ও দোয়ারের প্রয়োজন। ঠিক এই সময়েই নিতাইচরণের আবির্ভাব। সে জোড়হাতে পরম বিনয়সহকারে শুদ্ধ ভাষায় নিবেদন করিল-প্রভু, অধীনের নিবেদন আছে—আপনাদের সি-চরণে।
অন্ত কেহ কিছু বলিবার পূর্বেই মহাদেব কবিয়ালই বলিয়া উঠিল—এই যে, এই যে আমাদের নেতাইচরণ রয়েছে; তবে আর ভাবনা কি? নেতাই বেশ পারবে দোয়ারকি করতে। কি রে, পারবি না?
নিতাইয়ের গুণাগুণ কবিয়ালরা জানিত, কবিগান যেখানেই হউক, সে গিয়া ওই দোয়ারদের দলে মিশিয়া বসিয়া পড়িত, কখনও কাঁসি বাজাইত—আর দোয়ারের কাজে তো প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত বেগার দিয়া যাইত।
বাবুদলের মধ্যে একজন কলিকাতার চাকরি করেন, ময়লা কাপড়-জামার গাদার মধ্যে তিনি ধোপন্থরস্ত পাটকর বস্ত্রের মতই শোভমান ছিলেন। চালটিও তাহার বেশ ভারিন্ধী, তিনি খুব উচুদরের ধারাভারী পৃষ্ঠপোষকের মত করুণামিশ্রিত বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন—বল কি, অ্যাঁ? নেতাইচরণের আমাদের এত গুণ! A poet! বাহবা, বাহবা রে নিতাই! তা লেগে যা রে বেটা, লেগে যা। আর দেরি নয়—আরম্ভ ক’রে দাও তা হ’লে। তিনি হাতঘড়িটা দেখিবার চেষ্টা করির বলিলেন—এখনই তো তোমার— ক’টা রাজল?
কে একজন ফস করিয়া দেশলাইয়ের একটা কাঠি জালিরা আগাইয়া ধরিল।
ভদ্রলোক বিরক্ত হইয়া হাতটা সরাইয়া লইয়া বলিলেন—আঃ! দরকার নেই আলোর। রেডিয়ম দেওয়া আছে, অন্ধকারে দেখা যাবে।
ভূতনাথ এত সব রেডিয়ম-ফেডিয়মের ধার ধারে না, সে হি-হি করিয়া হাসিয়া নিতাইকেই বলিল—লে রে বেটা, লে; তাই কাক কেটেই আজ অমাবস্যে হোক। কাক—কাকই সই! তোর গানই শুনি!
নিতাই মনে মনে আহত হইলেও মুখে কিছু বলিল না। ওদিকে তখন আসরে ঢোলে কাঠি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, কুড় তাক কুড় তাক কুড়ুম-কুড়ম।
নিতাই দোয়ারকি করিতে লাগিয়া গেল। আপন দোয়ারের সহিত কবিওয়ালার কবিগানের পাল্লা। সুতরাং পাল্লা বা প্রতিযোগিতাট হইতেছিল আপোসমূলক—অত্যন্ত ঠাণ্ড রকমের। তীব্রতা অথবা উষ্ণতা মোটেই সঞ্চারিত হইতেছিল না। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠিল দুই ধরণের। যাহারা উহাদের মধ্যে তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তাহার বলিল—দূর দূর। ভিজে ভাতের মত গান। এই শোনে! সাঁট ক’রে পাল্লা হচ্ছে! চল বাড়ী যাই। দুই চার জন আবার উঠিয়াও গেল। –
অপর দল বলিল—মহাদেবের দোয়ারও বেশ ভাল কবিয়াল মাইরি! বেশ কবিয়াল, ভাল কবিয়াল! টকাটক জবাব দিচ্ছে।
নিতাইচরণের প্রশংসাও হইতেছিল। প্রশংসা পাইবার মত নিতাইচরণের মূলধন আছে। তাহার গলাথানি বড় ভাল। তাহার উপর ফোড়নও দিতেছে চমৎকার। মহাদেবের দোয়ারকে পিছনে ফেলিয়া নিজে স্বাধীনভাবে দুই-চার কলি গাহিবার জন্য সে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছে।
বাবুর ইহাতে তাহাকে উৎসাহ দিলেন—বলিহারি বেটা, বলিহারি! বলিহারি!
নিতাইয়ের স্বজন ও বন্ধুজনে বলিল—আচ্ছ, আচ্ছা!
এক কোণে মেয়েদের জটলা। এ মেয়েরা সবাই ব্রাত্য সমাজের। তাহদেরও বিস্ময়ের সীমা নাই, নিতাইয়ের পরম বন্ধু স্টেশনের পয়েণ্টসম্যান রাজালাল বায়েনের বউ হাসিয়া প্রায় গড়াইয়া পড়িতেছে—ও মা গো! নেতাইয়ের প্যাটে প্যাটে এত! ও মা গো!
তাহার পাশেই বসিয়া রাজার বউয়ের বোন, ষোল-সতের বছরের মেয়েটি, পাশের গ্রামের বউ—সে বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছে, সে মধ্যে মধ্যে বিরক্ত হইয়া বলিতেছে—না ভাই, খালি হাসছিস তু! শোন কেনে!
রাজ বন্ধু-গৌরবে অদূরে বসিয়া ক্রমাগত তুলিতেছিল, সে হাসিয়া বলিল- দেখতা হ্যায় ঠাকুরঝি? ওস্তাদ কেয়সা গান টাটা হ্যায়, দেখতা?
রাজা এই শ্যালিকাটিকে বলে—ঠাকুরঝি! নিতাইও তাহাকে বলে—ঠাকুরঝি। শ্বশুরবাড়ী অর্থাৎ পাশের গ্রাম হইতে সে নিত্য দুধ বেচিতে আসে। নিতাই নিজেও তাহার কাছে এক পোয় করিয়া দুধের ‘রোজ’ লইয়া থাকে! এই কারণেই মেয়েটির বিস্ময় এত বেশী। যে লোককে মানুষ চেনে, তাহার মধ্য হইতে অকস্মাৎ এক অপরিচিত জনকে আত্মপ্রকাশ করিতে দেখিলে বিস্ময়ে মানুষ এমনই হতবাক হইয়া যায়।
নিতাইয়ের কিন্তু তখন এদিকে চাহিয়া দেখিবার অবসর ছিল না। সে তখন প্রচণ্ড উৎসাহে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে, উৎসাহের প্রাবল্যে সে গল্পের উটের মত নাসিকা-প্রবেশের পথে মাথা গলাইয়া দিল এবং নিজেই সে স্বাধীনভাবে গান আরম্ভ করিল। আ-করিয়া রাগিণী টানিয়া মহাদেবের দোয়ারের রচিত ধুটাকে পর্যন্ত পাটাইয়া দিয়া সেই সুরে ছলে নিজেই নূতন ধুয়া ধরিয়া দিল। এবং নিজের সুন্দর কণ্ঠের প্রসাদে তাহাকে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করিয়াও ফেলিল।
মহাদেবের দোয়ার, সে-ই প্রকৃত একপক্ষের পাল্লাদার ওস্তাদ। সে আপত্তি তুলিয়া বলিয়া উঠিল—অ্যাই! ও কি? ও কি গাইছ তুমি? অ্যাই—নেতাই! অ্যাই!
নিতাই সে কথা গ্রাহই করিল না। বা হাতখানিতে কান ঢাকিয়া ডান হাতখানি খুখু নিবারণের জন্য মুখের সম্মুখে ধরিয়া গান গাহিয়াই চলিল। সম্মুখের দিকে অল্প একটু ঝুকিয়া তালে তালে মৃদু নাচিতে নাচিতে সে তখন গাহিতেছিল—

হুজুর-ভদ্দ পঞ্চজন                    রয়েছেন যখন
সুবিচার হবে নিশ্চয় তখন—
জানি জানি—

বাবুরা খুব বাহবা দিলেন—বহুৎ আচ্ছা! বাহব! বাহবা! নেতাই বলছে ভাল!
সাধারণ শ্রোতারাও বলিল—ভাল। ভাল। ভাল হে।
নিতাই ধাঁ করিয়া লাফ মারিয়া ঘুরিয়া ঢুলীটাকে ধমক দিয়া বলিল—অ্যা-ই কাটছে। সঙ্গে সঙ্গে সে তাল দেখাইয়া হাতে তালি দিয়া বাজনার বোল বলিতে আরম্ভ করিল—ধিকড় তা-তা-ধেনতা—তা-তা-ধেনতা—গুড়-গুড় তা-তা-থিয়া—ধিকড়;–হাঁ–! বলিয়া সে তাহার নূতন স্বরচিত ধুয়াটায় ফিরিয়া আসিল—

ক-য়ে কালী কপালিনী—খ-য়ে খপ্লরধারিণী,
গ-য়ে গোমাতা সুরভি—গণেশজননী—
কণ্ঠে দাও মা বাণী।

একপাশে কতকগুলি অর্ধশিক্ষিত ছোকরা বসিয়া ছিল—তাহারা হি-হি করিয়া হাসিয়া উঠিল।
একজন বলিল—গ-য়ে গরু, ছ-য়ে ছাগল, ভ-য়ে ভেড়া। বহুৎ আচ্ছা!
হাস্যধ্বনির রোল উঠিয়া গেল।
নিতাই সঙ্গে সঙ্গে খাড় দাঁড়াইল, তারপর হাস্যধ্বনি অল্প শাস্ত হইতেই বলিল—বলি দোয়ারগণ!
মহাদেবের দোয়ার রাগ করিয়া বসিয়া ছিল, অপর কোনো দোয়ারও ছিল না। কেহই সাড়া দিল না। নিতাইও উত্তরের প্রত্যাশ না করিয়াই বলিল–দোয়ারগণ! গোমাত শুনে সবাই হাসছে! বলছে, গ-য়ে গরু, ছ-য়ে ছাগল, ভ-য়ে ভেড়া!
ঢুলীট এবার বলিল—হ্যাঁ!
—আচ্ছ —বলিয়া সে ছড়ার স্বরে আরম্ভ করিল—

গো-মাতা শুনিয়া সবে হাস্য করে।
দীন নিতাইচরণ বলছে জোড়করে—

বলিয়া হাত দুইটি জোড় করিয়া একবার চারিদিক ঘুরিয়া লইল। বন্ধু রাজা পরম উৎসাহে বলিয়া উঠিল—বহুৎ আচ্ছ ওস্তাদ।
কিন্তু নিতাই তখন চোখে স্পষ্ট করিয়া কিছু দেখিতেছিল না, রাজাকেও সে লক্ষ্য করিল না,
সে আপন মনে ছড়াতেই বলিয়া গেল—

শুনুন মহাশয় দীনের নিবেদন।
গো কিম্বা গরু তুচ্ছ নয় কথন।।
গাভী ভগবতী, ষাঁড় শিবের বাহন।
মুরভির শাপে মজে কত রাজন॥

রব উঠিল—ভাল! ভাল! ঢুলীটা ঢোলে কাঠি দিল—ভূডুম!
নিতাই বলিল—

শাস্ত্রের সার কথা আরও বলে যাই।
গো-ধন তুল্য ধন ভূ-ভারতে নাই।।
তেঁই গোলকপতি—বিষ্ণু বনমালী।
ব্রজধামে করলেন গরুর রাখালী॥

নিতাইয়ের এই উপস্থিত জবাবে সকলে অবাক হইয়া গেল। ছন্দে বাঁধিয়া এমন ত্বরিত এবং যুক্তিসম্পন্ন জবাব দেওয়া তো সহজ কথা নয়। বন্ধু রাজা পর্যন্ত হতবাক; রাজার বউয়ের হাসি থামিয়া গিয়াছে; ঠাকুরঝির অবগুণ্ঠন খসিয়া পড়িয়াছে—দেহের বেশবাসও অসম্বৃত।
নিতাইয়ের তখনো শেষ হয় নাই, সে বলিল—

তা ছাড়া মশাই—আছে আরও মানে—
গো মানে পৃথিবী শুধান পণ্ডিত জনে ॥

এবার বাবুরাও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া উঠিলেন। আসরের লোকের হরিধ্বনি দিয়া উঠিল।
নিতাই বিজয়গর্বে ঢুলীটাকে বলিল–বাজাও।
এতক্ষণে সকলে নড়িয়া চড়িয়া বসিল, রাজা একবার ফিরিয়া স্ত্রী ও ঠাকুরঝির দিকে চাহিয়া হাসিল—অর্থাৎ, দেখ! স্ত্রী বিস্ময়ে মুগ্ধ হাসি হাসিয়া বলিল—তা বটে বাপু।
তরুণী ঠাকুরঝিটির কিন্তু তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটে নাই। সে বিপুল বিস্ময়ে শিথিল-চৈতন্তের মত নিতাইয়ের দিকে চাহিয়া ছিল। রাজা তাহার অসম্বৃতবাস বিম্মিত ভঙ্গি দেখিয়া বিরক্ত হইয়া উঠিল, রূঢ়স্বরে বলিল—অ্যাই! ও ঠাকুরঝি! মাথায় কাপড় দে।
রাজার স্ত্রী একটারর ঠেলা দিয়া বলিল—মরণ, সাড় নাই মেয়ের!
ঠাকুরঝি এবার জিভ কাটিয়া কাপড় টানিয়া মাথায় দিয়া বলিল—আচ্ছা গাইছে বাপু ওস্তাদ।
ওদিকে বাবুদের মহলেও বিস্ময়ের সীমা ছিল না। সেই কলিকাতা-প্রবাসী চাকুরে বাবুটি পর্যন্ত স্বীকার করিলেন—yes । এ রীতিমত একটা বিস্ময়। Son of Dom—অ্যাঁ–He is a poet !’
দুর্দান্ত ভূতনাথ ক্রুদ্ধ হইলে রুদ্র, তুষ্ট হইলে আশুতোষ—মানসিক অবস্থার এই দুই দূরতম প্রান্তে অতি সহজেই সে গঞ্জিকাপ্রসাদে বোমমার্গে নিমেষমধ্যেই যাওয়া-আসা করিয়া থাকে, সে একেবারে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিল। সে বলিল—ধুকুড়ির ভেতর খাস চাল রে বাবা! রত্ন রে—একটা রত্ন-মানিকের বেটা মানিক! বলিহারি রে!
মোহন্ত হাসিয়া বলিলেন—আমার পাগলী বেটর খেয়াল বাবা; নিতাইকে বড় করতে মা আমার নোটনকে তাড়িয়েছেন।
ইহার পরই আরম্ভ হইল মহাদেবের পালা। মহাদেব পাকা প্রাচীন কবিয়াল। ব্যাপারটা দেখিয়া শুনিয়া ক্রুদ্ধ ভ্ৰকুটি করিয়া গান ধরিল—ব্যঙ্গে, রঙ্গে, গালি-গালাজে নিতাইকে শূলবিদ্ধ করিয়া তিলে তিলে বধ করিতে আরম্ভ করিল। তাহার সরস, অশ্লীলতা-ঘেষা গালি-গালাজে সমস্ত আসরট হাস্যরোলে মুখর হইয়া উঠিল। নিতাই আসরে বসিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিল, এবং মনে মনে গালি-গালাজের জবাব খুঁজিতেছিল।

কিন্তু ক্ষুণ্ণ হ’ল রাজা। সে মিলিটারী মেজাজের লোক, বন্ধুকে গালি-গালাজগুলা তাহার, অসহ্য হইয়া উঠিল। সে আসর হইতে উঠিয়া খানিকটা মেলার মধ্যে ঘুরিবার জন্য চলিয়া গেল। রাজার স্ত্রী প্রচুর হাসিতেছিল। ঠাকুরঝি মেয়েটি কিন্তু অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছে, সেও এবার বিরক্ত ভরে বলিল—হাসিস না দিদি! এমনি ক’রে গাল দেয় মানুষকে!
মহাদেব ছড়া বলিতেছিল—

সুবুদ্ধি ডোমের পোয়ের কুবুদ্ধি ধরিল।
ডোম কাটারি ফেলে দিয়ে কবি করতে আইল।।
ও-বেটার বাবা ছিল সিঁদেল চোর, কর্তা-বাবা ঠ্যাঙাড়ে।
মাতামহ ডাকাত বেটার-দ্বীপাস্তরে মরে ॥
সেই বংশের ছেলে বেটা কবি করবি তুই।
ডোমের ছাওয়াল রত্নাকর, চিংড়ির পোনা রুই।

একজন ফোড়ন দিল—

অল্পজলই ভাল চিংড়ির—বেশী জলে যাস না।
দোয়ারেরা পরমোৎসাহে মহাদেবের নূতন ধুয়াটা গাহিল—
আঁস্তাকুড়ের এঁটোপাতা—স্বগ্‌গে যাবার আশা—গো!
ফরাৎ ক’রে উড়ল পাতা—স্বগ্‌গে যাবার আশা গো!
হয়রে কলি—কিই বা বলি –
গরুড় হবেন মশা গো—স্বগ্‌গে যাবার আশা গো।

অকস্মাৎ মহাদেব বলিয়া উঠিল—আঃ, জালাতন রে বাপু! বলিয়াই সে আপনার পায়ে একটা চড় মারিয়া বসিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই গাহিল—

পায়েতে কামড়ায় মশা—মারিলাম চাপড়।
গোলকেতে বিষ্ণু কাঁদেন–চড়িবেন কার উপর!

মহাদেবের দোয়ার—যাহাকে নাকচ করিয়া নিতাই কবিয়াল হইয়াছে—সে-ই এবার ফোড়ন দিয়া উঠিল—চটাৎ চড়ের সয় না ভর, স্বগ্‌গে যাবার আশা গো।
ইহার পর রাত্রি যত অগ্রসর হইল, মহাদেবের তাগুব উতই বাড়িয়া গেল। শ্লীল-অশ্লীল গালি-গালাজে নিতাইকে সে বিপর্যন্ত করিয়া দিল। মহাদেবের এই শূল প্রতিরোধের ক্ষমতা নিতাইয়ের ছিল না। কিন্তু তাহার বাহাদুরি এই যে জর্জর ক্ষতবিক্ষত হইয়াও সে ধরাশায়ী হইল না। খাড়া থাকিয়া হাসিমুথেই সব সহ্য করিল। সে গালি-গালাজের উত্তরে কেবল ছড়া কাটিয়া বলিল—

ওস্তাদ তুমি বাপের সমান তোমাকে করি মান্য।
তুমি আমাকে দিচ্ছ গাল, ধন্য হে তুমি ধন্য।।
তোমার হয়েছে ভীমরতি—আমার কিন্তু আছে মতি তোমার চরণে।
ডঙ্কা মেরেই জবাব দিব—কোনই ভয় করি না মনে।।

লোকের কিন্তু তখন এ বিনীত মিষ্ট রস উপভোগ করিবার মত অবস্থা নয়। মহাদেব গালি-গালাজের মত্তরসে আসরকে মাতাল করিয়া দিয়া গিয়াছে, এবং মহাদেবের তুলনায় নিতাই সত্যই নিম্প্রভ। সুতরাং তাহার হার হইল। তাহাতে অবশ্য নিতাইয়ের কোন গ্লানি ছিল না। বরং সে অকস্মাৎ নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বলিয়াই অনুভব করিল।
পাল্লার শেষে সে বাবুদের প্রণাম করিয়া করজোড়ে সবিনয়ে বলিল—স্থজীরগণ, অধীন মুখ্য ছোট নোক—
তাহাকে কথা শেষ করিতে না দিয়াই বাবুরা বলিলেন—না না। খুব ভাল, ভাল গেয়েছিল তুই। বহুত আচ্ছ, বহুত আচ্ছা!
প্রচণ্ড উৎসাহে তাহার পিঠে কয়েকটা সাংঘাতিক চপেটাঘাত করিয়া ভূতনাথ বলিল–জিতা রহো, টাটা রহো রে বেটা। জিতা রহো!
চাকুরে বাবুট করুণামিশ্রিত প্রশংসার হাসি হাসিয়া বার বার বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন—ইউ আর এ পোয়েট, অ্যাঁ! এ পোয়েট! ইউ আর এ পোয়েট!
কথাটার অর্থ বুঝিতে না পারিয়া নিতাই বিনীত সপ্রশ্নভঙ্গিতে বাবুর দিকে চাহিয়া বলিল— আজ্ঞে?
বাবু বলিলেন—তুই তো একজন কবি রে।
নিতাই লজ্জিত হইয়া মাথা নীচু করিয়া মাটির দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর সে মহাদেবকে বলিল—মার্জনা করবেন ওস্তাদ। আমি অধম। বলতে গেলে আমি মশকই বটে।
মহাদেব অবশ্য প্রতিপক্ষের এ বিনয়ে লজ্জিত হইল না, সে বরং নিতাইয়ের বিনয়ে খুশী হইয়াই বলিল–আমার দলে তুই দোয়ারকি কর রে। এর পর নিজেই দল বাঁধতে পারবি। তা ছাড়া তোর গলাথানি খুব মিষ্টি।
নিতাই মনে মনে একটু রূঢ় অথচ রসিকতাসম্মত জবাব খুঁজিতেছিল; মহাদেবের গালিগালাজের মধ্যে জাতি তুলিয়া এবং বাপ-পিতামহ তুলিয়া গালি-গালাজগুলি তাহার বুকে কাঁটার মত বিঁধিয়াছিল। কিন্তু কোন উত্তর দিবার পূর্বেই পিছন হইতে দশ-বিশজন একসঙ্গে ডাকিল—নেতাইচরণ, নেতাইচরণ! ওহে!
ডাক শুনিয়া নিতাইচরণ পুলকিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। আজই সে ‘নিতে’ ‘নেতা’ ‘নিতো’ ‘নেতাই’ হইতে নিতাইচরণ হইয়া উঠিয়াছে। যাহারা ডাকিতেছিল, তাহার অদূরবর্তী বাবুদের দেখাইয়া বলিল—বাবুর ডাকছেন। মোহন্ত ডাকছেন।
মোহন্তজী চণ্ডীর প্রসাদী একগাছি সিন্দূরলিপ্ত বেলপাতার মালা তাহার মাথায় আলগোছা ফেলিয়া দিয়া বলিলেন—বা বা, খুব ভাল। মা তোমার উন্নতি করবেন। মায়ের মেলায় একরাত্রি গাওনা তোমার বাঁধা বরাদ্দ রইল। সুন্দর গলা তোমার!
চাকুরে বাবু নিতাইয়ের পিঠ চাপড়াইয়া বলিলেন—একটা মেডেল তোকে দেওয়া হবে! তারপর হাসিয়া আবার বলিলেন—You are a poet! অ্যা! এ একটা বিস্ময়!
নিতাই দিশাহারা হইয়া গেল। কি করিবে, কি বলিবে, কিছুই ঠাওর করিতে পারিল না। বাবু বলিলেন–কিন্তু খবরদার, আপন গুষ্টির মত চুরি-ডাকাতি করবি না। তুই বেটা কবি— a poet!
হাতজোড় করিয়া এবার নিতাই বলিল—আজ্ঞে প্ৰভু! চুরি জীবনে আমি করি নাই। মিছে কথাও আমি বলি না হুজুর, নেশা পর্যন্ত আমি করি না। জাত-জ্ঞাত-মা-ভাইয়ের সঙ্গেও এইজন্যে বনে না আমার। ঘর তো ঘর, আমি পাড়া পর্যন্ত ত্যাজ্য করেছি একরকম। আমি থাকি ইস্টশনে রাজন পয়েণ্টসম্যানের কাছে। কুলিগিরি ক’রে খাই।
এ গ্রামের চোর, সাধু, ভাল মন, সমস্ত কিছুই ভূতনাথের নখদর্পণে, সে সঙ্গে সঙ্গে নিতাইকে সমর্থন করিয়া বলিল—হাজারোবার। সাচ্চ সাধু আচ্ছা আদমী নিতাই।
নিতাই আবার বলিল—এই মা-চণ্ডীর সামনে দাঁড়িয়ে বলছি। মিছে বলি তো বজ্জাঘাত হবে আমার মাথায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *