কবিতার কথা

কবিতার কথা

০১.

আজকে বলে নয়, নতুন আঙ্গিক ও মননের কবিতা নিয়ে দেশে দেশে সমকালীন পাঠক মহলে বিরূপতা দেখা দিয়েছে যুগে যুগে। এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা সেকালেও ছিল না, আজকেও নেই। শুধু কাব্যক্ষেত্রে নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও নতুন ভাব, চিন্তা ও আঙ্গিকের শত্রু চিরকালই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

বিদেশের কথা বলে কাজ নেই। দেশেই রয়েছে এর বহু নজির। গত একশ বছরের মধ্যে আমাদের সাহিত্যে লেখক-পাঠকে যে-কয়বার দ্বন্দ্ব ঘটে গেছে, তাদের উল্লেখ মাত্রই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে।

মধুসূদন বড় ভরসায় বড় মুখ করে বলেছিলেন a real graduate তার মেঘনাদবধের টীকা লিখছেন। সে real graduate হেমচন্দ্রও অমিত্রাক্ষর ছন্দের গোড়ার কথাই বুঝতে পারেননি। মেঘনাদবধ বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের কোনো কদরই হয়নি উনিশ শতকে। মধুসূদনের প্রতিভা ও সৃষ্টি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধাও অর্জন করেনি কোনোদিন। মধুসূদনের ঠাই হল না। হেমচন্দ্র হলেন জাতীয় কবি, শ্রেষ্ঠ কবি, মহাকবি।

বঙ্কিমচন্দ্রের অশুদ্ধ ভাষা ও অশ্লীল উপাখ্যান সে-যুগে কী অবজ্ঞাই না লাভ করেছে! গুরুজনের নামে স্বরচিত উপন্যাস উৎসর্গ করে নীতবাগীশদের নিন্দা শুনতে হয়েছে তাকে।

সে যুগের আমেরিকা-ফেরৎ, বি-এ পাশ, ডেপুটি, কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার মাথা-মুণ্ড বুঝতে না পেরে বলেছেন অর্থহীন। প্রেমের অশ্লীল কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ দেশের লোকের চরিত্র নাশ করছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রভৃতি যদি তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য বলে থাকেন তবে বিস্মিত হবার কিছু থাকে না।

এমন যে বিহারীলাল, তিনিও জীবকালে পাত্তা পাননি। আর কার কথা বলব? শরৎচন্দ্র নজরুলের উপর এককালে যে ঝড়ঝাপ্টা গেছে, তা অনেকেরই স্মরণে আছে। কল্লোল যুগের বহুনিন্দিত গল্প-লিখিয়েরা চোখের সামনেই ভক্ত-হৃদয়ের পূজো পাচ্ছেন।

নতুন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন মাত্রেই প্রতিভার দান। ইচ্ছে করলেই কেউ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। দুনিয়াতে স্তরে স্তরে কোটি কোটি মানুষ এসেছে, গেছে। নতুন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করতে পেরেছে কয়জনে? ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্রব্য-সামগ্রীই হোক, রান্নাবান্নার কলাকৌশলই হোক, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে বা আচার-আচরণেই হোক, নতুন উদ্ভাবন সহজ কথা নয়। এতে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ সৃষ্টিশীল নয়, সৃষ্টি-পরিকল্পনা তাদের মধ্যে নেই। অবচেতন মনে সৃজনের কোনো প্রেরণা সুপ্ত যদিও বা থাকে, তা অনুকরণ স্পৃহাতেই রূপ নেয় এবং সার্থকতা খোঁজে।

মানুষের পুরোনোর প্রতি যত প্রীতি আছে, নতুনের প্রতি তত শ্রদ্ধা নেই। তাই সাধারণ মানুষ ঐতিহ্যপ্রিয়, প্রাচীনপন্থী ও রক্ষণশীল। তাদের পুরোনোর প্রতি যেমন মমতা ও শ্রদ্ধা থাকে, নতুনের প্রতি তেমনি থাকে ভীতি, বিরূপতা আর অবজ্ঞা। মানুষ যতটা পশ্চাত্মখী, সে পরিমাণে সম্মুখদৃষ্টিসম্পন্ন নয়। তাই ইতিহাসের সাক্ষ্য সত্ত্বেও মানুষ চিরকাল নতুনকে অভিনন্দিত না করে পুরাতনকে বন্দনা করেছে। ইতিহাস আমাদের বলেছে–কোনো নতুনই মানুষের অকল্যাণের জন্যে আসে না। অন্তত তা যে মানুষেরই অগ্রগতির নিশ্চিত ফল এবং ফেলে আসা দিনের চেয়ে যে না আসা দিনগুলোতে মানুষের বোধবুদ্ধির বেশি বিকাশ হবে–কেননা সামগ্রিকভাবে মানুষ প্রতিমুহূর্তেই উন্নত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, রুচি-বুদ্ধি-বোধির বিকাশ হচ্ছে–তা ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তবু আমাদের চৈতন্য হয় না। আমরা চিরকাল এ ব্যাপারে অর্থাৎ নতুন পুরাতনের দ্বন্দ্বে নির্বিচারে পুরাতনের পক্ষই সমর্থন করেছি। তবু কোনোদিন রোধ করা যায়নি নতুনের প্রতিষ্ঠা।

এতে দুটো তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এক. বোঝা যাচ্ছে নতুনের উদ্ভাবক সাধারণ মানুষের তুলনায় কত অসাধারণ। আর এজন্যেই সাধারণের পক্ষে সমকালীন প্রতিভার মূল্যায়ন ও মর্যাদা দান সম্ভব হয় না। তাদের চোখে সে বিদ্রোহী। দুই. মানুষের পশ্চাৎমুখিতা ও নতুনের প্রতি অশ্রদ্ধা এতই প্রবল যে এ ব্যাপারে তাদের বিচারশক্তি লোপ পায়, চোখ থেকেও তারা দৃষ্টিহীন। একটা অন্ধ সংস্কার-নির্ভর আবেগই তাদের একমাত্র অবলম্বন–যুক্তি-বুদ্ধি নয়।

শুধু সাহিত্য ব্যাপারেই নয়, ধর্ম ও রাষ্ট্র বিষয়েও তাই। রাজনীতিতে নেতৃত্ব মানার বা সামাজিক কাজে কর্তৃত্ব স্বীকার করার ব্যাপারে তাই অনেক সময়–যুক্তি নয়–অভিমানই দেয় বাধা। এ ব্যাপারে বয়োজ্যেষ্ঠের অভিমান আর মর্যাদাবোধও অনেকাংশে দায়ী।

.

০২.

যেখানে অজ্ঞতা, সেখানেই কল্পনার প্রশ্রয়। বিস্ময়ের উৎস এবং আশ্রয়ও তা-ই! আর যেখানে কল্পনা ও বিস্ময় সেখানেই উচ্ছ্বাস। বলা যায়, উচ্ছ্বাস ও কল্পনা বিস্ময়-বোধেরই সন্তান। অতিভাষণ উচ্ছ্বাসের নিত্যকালের সঙ্গী। এবার ভারতচন্দ্রের উক্তি স্মরণ করুন : সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর। ফল দাঁড়াল এই–লোকে দৈত্য, রাক্ষস, যক্ষ, ড্রাগন, পঙ্খিরাজঘোড়া, দেবলোক, জীন, পরী, গন্ধর্ব প্রভৃতি যেমন মনোরাজ্যে সৃষ্টি করেছে, তেমনি করেছে চন্দ্রে-সূর্যে-মেঘে-সমুদ্রে ব্যক্তিত্ব আরোপ। আমাদের রূপকথায়, উপকথায়, ইতিবৃত্তে, মহাকাব্যে, ধর্মশাস্ত্রে ও রোমান্সে তাই আদি মধ্যযুগে এর ছড়াছড়ি দেখতে পাচ্ছি। মধ্যযুগ আমরা বিশেষ অর্থে প্রয়োগ করছি, কেননা মধ্যযুগ সবদেশে ও সবজাতে সমকালীন নয়–এর শুরু ও শেষ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মানের উপর নির্ভরশীল।

মানুষের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিকাশ হল মানুষের বুদ্ধি ও বোধের। এর ফলে মানুষের মনে যুক্তিবাদের জন্ম হল। জন্ম হল বললে ভুল বলা হয়; বরং বলা যেতে পারে সুপ্তি থেকে জেগে উঠে বিশ্বাস-সংস্কারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হল, কেননা যুক্তিবাদই মনুষ্যত্ব। যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় মানুষের differentia হল যুক্তি-বুদ্ধি। বহুকাল চলল কেহ কারে নাহি। জিনে সমানে সমান অবস্থায়। অবশেষে বিজ্ঞান এসে সব তত্ত্ব ও কল্পনার, বিশ্বাস ও সংস্কারের গোড়ার কথা বেফাঁস করে দিল। আমরা দেখলাম সূর্য বামুন হয়ে মর্ত্যে নামতে পারে না; চাঁদ সুন্দরও নয়, প্রণয়ীও নয়। রাক্ষস, ড্রাগন, যক্ষ, দৈত্য দুনিয়ায় কোনোকালে ছিল না। সূর্য অস্তও যায় না, আবিরও ছড়ায় না। অরুণে-কমলে সখ্য নেই। চাঁদে-চকোরে প্রেম নেই, মেঘ বাম্পপুঞ্জ মাত্র ইন্দ্র-ঐরাবতের সঙ্গে তার সম্পর্কমাত্র নেই, বজ্র শয়তানও তাড়ায় না, দৈত্যও খেদায় না, বৃত্রকেও মারে না! এভাবে আমাদের কল্পনার তাসের ঘর ভেঙে পড়ল, স্বপ্নসৌধ জাদু-সৃষ্ট বস্তুর মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমরা–অজ্ঞরা অবাক হয়ে ভাবলাম–এসবের বিরুদ্ধে হাজারো বছর কাটিয়া গিয়াছে কেহ তো কহেনি কথা! আজ একি কথা শুনি–নেই! নেই, সত্যি কিছুই নেই–এ কারণে নাস্তিকের উল্লাসে, বন্ধন-মুক্তির স্বস্তিতে, মুক্তির আশ্বাসে, ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ততার আনন্দে, প্রসারিত জীবনের মুখরতায় মানুষ স্বচ্ছন্দ ও উচ্ছল হয়ে উঠল।

রূপকথা অচল হল, উপকথা উবে গেল, পুরাণ তলিয়ে গেল; কারণ তাদের কাঠামো যে উপাদানে তৈরি, ভোজবাজির মতো মন থেকে মুছে গেল সে-সব। তাই আজকের দিনে আর রূপকথা তৈরি হয় না, উপকথা বলবার লোক নেই, পুরাণ শুনবার ধৈর্য নেই। মানুষের যুগযুগান্তর লালিত বিশ্বাস ও সংস্কার ভেঙে চুরমার হল। আদি বা মধ্যযুগের সে-জগৎ নেই, তাই সে-জীবনও, নেই, তাতেই সে-সাহিত্য-শিল্প আর ধর্মবোধও নেই।

নতুন বিশ্বাসের অবলম্বন খুঁজে পেল, তাই নিয়ে সে নতুন করে গড়ছে স্বপ্নসৌধ, সাধের জগৎ, শখের ইমারত আর গরজের বুরুজ।

.

০৩.

স্থানিক, কালিক আর পাত্রিক বিবর্তনে সাহিত্যের রসকল্পে নয় শুধু, রূপকল্পেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বলেছি, মানুষের জীবনের তথা সাহিত্যের আদি ও মধ্য স্তর ছিল অজ্ঞতার যুগ; তাই কল্পনা, বিস্ময় এবং উচ্ছ্বাসই ছিল সাহিত্য-দেহের হাড় ও প্রাণ। কল্পনায় ভাটা পড়লে কল্প-সৃষ্ট বস্তুর মূল্য কমে যাবেই, বিস্ময় উবে গেলে বিস্ময়ের অবলম্বনও বাজে হয়ে যায়, আর কল্পনা-রূপ আধার না থাকলে আধেয় বিস্ময়ও পায় লোপ, কাজেই বিস্ময়জাত উচ্ছ্বাসের জন্মউৎসই যায় শুকিয়ে। আর এসবকিছুর উৎস ছিল হৃদয়বৃত্তি এবং তজ্জাত বোধি। মুক্তবুদ্ধি পাত্তা পায়নি সে যুগে।

বলেছি, উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অতিভাষণের যোগ নিত্যকালের। আগে ছন্দের পরিপ্রেক্ষিতে এ উক্তি যাচাই করা যাক। সমিল ছন্দের খাতিরে আমাদের সবসময় ভাব প্রকাশের পক্ষে অপ্রয়োজনীয়, এমনকি অবান্তর কথা যোগ করে দিতে হয়। মনে করা যাক, একটি চরণে একটি ভাব প্রায় অভিব্যক্তি লাভ করেছে, শুধু একটিমাত্র শব্দ বাকি। কিন্তু যেহেতু চরণে আর জায়গা নেই, সেজন্যে একটি শব্দ প্রয়োগের গরজে আমাকে একটি পুরো চরণ তৈরি করতে হয়। ফলে কতগুলো অপ্রয়োজনীয় শব্দ শুধু ধ্বনি ও ছন্দ রক্ষার খাতিরে জুড়ে দিতে হয়। উচ্ছ্বাসের ভাষা যেমন :

১. হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো
নাচেরে হৃদয় নাচেরে

২. আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।

৩. এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।
 পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর
সুন্দর হে সুন্দর। ….
এই তোমার পরশ-রাগে চিত্ত হল রঞ্জিত,
এই তোমারি মিলন-সুধা রইল প্রাণে সঞ্চিত।

৪. আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি
আমার যত বিত্ত প্রভু, আমার যত বাণী–
আমার চোখের চেয়ে দেখা আমার কানের শোনা,
আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা।

৫. আজি কী তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।
 মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী শরৎকালের প্রভাতে
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল তোমার কানন সভাতে।

৬. তোমার ছুটি নীল আকাশে, তোমার ছুটি মাঠে,
তোমার ছুটি থইহারা ওই দিঘির ঘাটে ঘাটে।
তোমার ছুটি তেঁতুল তলায়, গোলাবাড়ির কোণে,
তোমার ছুটি ঝোপে ঝাপে পারুল ডাঙার বনে।

মানুষের জ্ঞান-প্রজ্ঞা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ হৃদয়বৃত্তির আশ্রয় ত্যাগ করে বুদ্ধিবৃত্তির নিশ্চিত স্মরণ নিয়েছে। আজকের মানুষের বুদ্ধিনির্ভর। হৃদয়-ধর্ম জল-শোধন যন্ত্রের মতো বুদ্ধিকে আশ্রয় করে, বলা যায়-বুদ্ধির দ্বারা শোধিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এভাবে মিতালি ঘটেছে মন মস্তিষ্কের। আবেগও তাই উদ্বেগ বলে ভ্রম জন্মায়। মানবসভ্যতার তথা সাহিত্য-শিল্পের ক্রমবিবর্তনের ধারা এভাবে লক্ষ্য করেছিলেন বলেই লর্ড মেকলে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পুরানো রীতির কবিতার অপকর্ষ ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন।

বুদ্ধিবৃত্তিতে উচ্ছ্বাসের ঠাঁই নেই। কাজেই আমাদের কাব্যকলার ছন্দে ও বাক-পদ্ধতিতে পরিবর্তন না এসে পারে নি। বুদ্ধি লব্ধ তথ্য, বুদ্ধি-নির্ভর ভাষণ চটুল হতে পারে, সরস হতে পারে, বিদ্রুপাত্মক হতে পারে; দীপ্ত হতেও বাধা নেই, কিন্তু ললিত-মধুর, আবেগ-বিভোল হতে পারে না। নূপুরের দিন নেই, কাজেই শিঞ্জন শোনার আশা বিড়ম্বিত হবেই।

তাই আজকের কবিতা তথাকথিত ছন্দ বিহীন।

.

০৪.

শারীর প্রেমের উপর আগের যুগে মানুষ Divinity বা দিব্যতা আরোপ করে একপ্রকার আত্মবঞ্চনামূলক আত্মপ্রসাদ লাভ করত। যদিও মনে জানত–এ ফাঁকি, তবু মহত্ত্ব ও দিব্যতা আরোপ করে, একে নির্বিশেষ ভাবলোকে স্থাপিত করে, এর মহিমা ঘোষণা করে নিজেদের মহিমান্বিত করে তুলত। এতে সুখ ছিল কিনা জানিনে, তবে মুখরক্ষা হত! এ-যুগের বিজ্ঞান সব রহস্য বেফাঁস করে দিয়ে বলল, প্রেম আকাশের নয়, নিতান্ত পঙ্কজ। খগজ প্রেম শুধু ভুইয়ে লুটিয়ে পড়ল, তা নয়; বিজ্ঞান জানাল–এটা হচ্ছে জীবনের প্রবলতম প্রবৃত্তি, বিশেষ বয়সের ধর্ম, এবং সৃষ্টি প্রক্রিয়ারই অঙ্গ, একান্তই প্রাকৃতিক নিয়মের ফল। বিশেষ বয়সের পূর্বে বা পরে–অপর জীবের তো নয়-ই,–স্বাভাবিক মানুষেরও তা থাকে না। প্রেম-মহিমা তাই আর কথার সাগর মন্থন করে শব্দ চয়ন করে যোচ্ছাসে গাওয়া চলে না। তেমনি ভূতে যার বিশ্বাস নেই, তাকে ভূতের ভয় দেখাননা যায় না।

পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার যখন মিথ্যে হয়ে গেল, তখন পুরোনো রূপপ্রতীক কী সত্য থাকতে পারে? চাঁদ-সূর্যের গোপন তত্ত্ব জানার পরে তাদের সেবাকালীন স্বরূপে রূপপ্রতীক সৃষ্টি করা কী চলে? চকোর দেখিইনি, কাজেই চাঁদ-চকোরের উপমা দিতে আমার যুক্তি-বুদ্ধি বাধা দেবেই। ক্ষীণ মাঝার সঙ্গে কেশরী বা চুলের উপমা শুধু সেকালেই চলতে পারত; যেকালে বিশাল নথও নাকে শোভা পেত, পুরুষের কানে কুণ্ডল আর হাতে বালা মানাত ও পাজব-চন্দ্রহারে নারী লোম লাবণ্যে ললনা হয়ে উঠত!

আমাদের রুচির বিকাশ হয়েছে, সৌন্দর্যবোধ সূক্ষ্ম হয়েছে। তাই আদ্যিকালীন কাব্যে নারীর রূপ-বর্ণনায় রূপ প্রত্যক্ষ করা দূরে থাক, মানবীকেই পাওয়া যায় না। অদৃষ্ট খঞ্জনের মতো আঁখি, বাজের চক্ষুসদৃশ নাসা, হেমকুম্ভ স্তন, মৃণাল ভুজ, রামরম্ভাতরুর মতো উরু, কামধনুর মতো জ্ব, তীরের মতো পক্ষ্ম, ঘটের মতো নিতম্ব, পদ্মের মতো পা, শকুনির ন্যায় গ্রীবা, পদ্মকোরকের ন্যায় নাভি, মেঘবর্ণ চুল, কুঁচবর্ণ রঙ, দ্বিতীয়ার চাঁদের ন্যায় কপাল, বিম্বফলের ন্যায় অধরোষ্ঠ, প্রভৃতি এমন কী সুপ্রযুক্ত উপমা যে স্মরণ মাত্র সুন্দরীর রূপ-লাবণ্য অন্তরে শেলসম বিদ্ধ হয়ে থাকবে? স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের রূপবর্ণন পদ্ধতি কী একালে টিকল? সুন্দরীর রূপ-মহিমা একালীন ভাষায় একবার দেখলে পিছন ফিরে আবার দেখতে হয় বা একবার তাকালে চোখ ফিরানো যায় না বা বারবার তাকাবার মতো রূপ বললে কী বর্ণনার আর কিছু বাকি থাকে! কিম্বা, খঞ্জন-হরিণ-পদ্মের উল্লেখ না করে পটল-চেরা কী টানা টানা চোখ বললে কী কিছু কম বলা হয়! রুক্ষ চুলের সঙ্গে মেঘের তুলনা চলে, কিন্তু কালো চুল নিশ্চয়ই মেঘের বর্ণ নয়, তার চাইতে ভ্রমরকৃষ্ণ, চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা কিম্বা আলকাতরার, টেলিফোনের রিসিভারের, মোটরগাড়ির নয়া কালো টায়ারের বা প্লাস্টিকের কালো পাতের তুলনা আপাতত vulgar মনে হলেও অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত। কাক পোষা পাখি নয় যে কাকচক্ষু বললেই বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

অবশ্য পুরোনো রূপপ্রতীক মাত্রেই পুরোনো নয়, বেণীর সঙ্গে সাপের উপমা চিরনতুনই বটে! তেমনি চিরকালই উপমার অবলম্বন হয়ে থাকবে রাত্রির তমসা।

তাই বলে নতুন ভাব-চিন্তা-জ্ঞান-বস্তু পেলাম, অথচ নতুন অলঙ্কার তৈরি হবে না, এমন কথাই হতে পারে না। আগের কালে যেমন মানুষ নিজের জানা-ভুবন থেকে রূপ-প্রতীক সংগ্রহ করেছে, আজও তা-ই শুধু করা হচ্ছে। আগের মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জগৎ আজকের চেয়ে অনেক ছোট ছিল, তাই তার ভাষণে থাকত পরিমিত ও স্বল্প-পরিচিত এমনকি কল্পজাত রূপ প্রতীক। আজকের মানুষের পায়ের নিচে বিশাল ভুবন, মাথার উপরে বিস্তৃত জগৎ। আজ এদের সঙ্গে তার পরিচয় কত ঘনিষ্ঠ, কত স্পষ্ট! সে মুখ খুললেই কত কথা, কত চিত্র, কত রূপপ্রতীক এসে ভিড় জমায় স্মৃতির সরণিতে–জিহ্বার ডগায়, এদের সে অস্বীকার করে কীভাবে! কাকে ছেড়ে কাকে নেবে তা-ই দাঁড়ায় সমস্যা হয়ে! শুধু কী তাই, নতুন সূর্যের উদয়ে নতুন ভাব-চিন্তা আসবেই, তাকে রোধ করবে–সাধ্য কার! রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদীতে অনেক কবিতা রচনা করেছেন, ছন্দ একই হওয়া সত্ত্বেও ভাবে, ভাষায়, অর্থব্যঞ্জনায় ও ধ্বনি-মাধুর্যে পূর্বেকার পয়ার ত্রিপদীর সঙ্গে কী এদের তুলনা চলে? ভাবের ও চিন্তার বৈচিত্র্যে যে বাকভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে, এর চেয়ে আর উৎকৃষ্ট নজির আর কী দেওয়া যায়! আবার ভাব-চিন্তার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শুধু নবীনেরাই নন, রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদী ছেড়েছিলেন। কাজেই প্রয়োজনমতো প্রতিষ্ঠিত আঙ্গিকও বদলায়।

লঙ্ঘিয়ে সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে।

চলন্ত নৌকার কী চমৎকার বর্ণনা! কিন্তু কোনো অরসিক যদি বলে বসে কাঠের তৈরি নৌকায় চিত্ত কোথায়! তবে তো সকলি গরল ভেল। তেমনি চোখ হাসে মোর, বুক হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে–তখন আমদের কানে-মনে খটকা লাগে না। প্রশ্ন জাগে না যে খুন নাচতে পারে, হাসে কী করে? আকাশ আচ্ছন্ন করে মেঘ উঠলে তাকে নারীর এলোচুল বলতে আপত্তি থাকে না।-কে এসেছে কেশ এলায়ে কবরী এলায়ে? কিন্তু জীবনানন্দ দাস যখন লেখেন– রৌদ্র মাথা রেখে ধানক্ষেতে শুইয়ে আছ তখন আমাদের অবজ্ঞার অন্ত থাকে না। কিন্তু ভেবে দেখি না যে, আমাদের অতিপরিচিত একটি পুরোনো ভালো ইংরেজি কবিতায় অর্থাৎ Keats-এর Ode to Autumn-এধরনের প্রতীকই ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন–The (Autumn) sitting careless on a granary floor on a half reaped furrow. sound asleep Steady they laden head across a brook by a ciderpress, with patient look thou watchest the last oozings hours by hours to

আবার পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে উপমার এখন দেখছি আদর-কদর বেড়েই চলেছে। তাজমহল যখন কালের কপোলতলে একবিন্দু নয়নের জল কিংবা মেঘদূত কাব্যে মেঘ দূতরূপে বর্ণিত হয়, কিংবা অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অনুভূত হয়, তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না। কিন্তু উনিশ শতকে হলে জাগত!

আসল কথা, নতুন কিছু কানে-মনে খাপ খাওয়ানো সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। তাই কেউ সমকালীন সমাজে নতুন কিছু করে স্বীকৃতি পায় না। কিন্তু উত্তর-পুরুষ ঐ আওতায় লালিত হয় বলে তার কাছে এককালের বেয়াড়া নতুনও গা-সহা এবং কান-সহা হয়ে ওঠে শুধু নয়, রস কল্পনার সহায়কও হয়ে উঠে।

আজকের দিনে ঝলসানো রুটিস্বরূপ চাঁদ, বোমা, টর্পেডো, শুটনিক (এমনকি লাইকাও), কুইসলিং প্রভৃতি আমাদের রচনার রূপপ্রতীকরূপে ব্যবহৃত না হয়ে যেমন পারে না; তেমনি আমাদের নতুনতর ভাব, চিন্তা ও দৃষ্টির প্রভাবে বাকভঙ্গিও বদলাবে, তার সঙ্গে বদলাবে আটপৌরে ব্যবহারের শব্দের ব্যঞ্জনাও। বিবেকে বৃশ্চিক দংশন বা বিছার কামড় যদি সম্ভব হয়, তাহলে হৃদয় আমার ছেঁড়া কাঁথা আর তুমি তার মাঝে ছারপোকা–আজ যতই vulgar মনে হোক, আমাদের উত্তরপুরুষদের কাছে তা কদর পাবে। আগেকার যুগের রূপপ্রতীকগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে, বহু অদ্ভুত প্রতীক আমাদের চিত্তবিনোদনের সহায়ক হয়েছে,–চাঁদপানা মুখ যখন বলি তখন আমরা চাঁদের প্রভাটাই নিই, চাঁদের থালা-আকৃতি বাদ দিই। যোগ-বিয়োগ এত সহজ-সাধ্য নয়, অভ্যাসবশে যত সহজভাবে আমরা উপলব্ধি করি। রবীন্দ্রনাথের কৃপণ কবিতার রথী রাজভিখারিটি কোনো বাস্তব চিত্রের সঙ্গে মেলে না, কাজেই বাস্তব প্রতীক হতে পারে না, তবু ভালো কবিতা বলে এটি কদর পেয়ে আসছে।

জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ যেমন বদলাচ্ছে, অর্থাৎ নতুন মানুষকে ঠাই ছেড়ে দিয়ে পুরোনো মানুষ বিদায় নিচ্ছে,;তেমনি মানুষের ভাষা, সাহিত্য, শিল্প আর ভঙ্গিও বহতা নদীর মতো চিরকাল গড়িয়ে চলেছে, চলেছে এগিয়ে। কাজেই তাদের কোনো স্থায়ী নিগড়ে বেঁধে স্থির রাখা যাবে না। এ সহজ সত্যটি মনে মেনে নিলে আর কোনো দ্বিধা থাকে না। কেননা পৃথিবীটা পুরোনো বটে, কিন্তু তার জনপ্রবাহ নতুন। তাই তার অধিবাসীদের চোখে এ ভুবন চিরনতুন। জীবনযাত্রায় তারা নতুনভাবে আবিষ্কার করে জগৎকে, অনুভব করে জীবনকে, রচনা করে ভবন, বিকশিত হয় জীবন। এ চলার পথের উল্লাস কিংবা যন্ত্রণা, জিজ্ঞাসা কিংবা অভিজ্ঞতা অভিব্যক্তি পায় তাদের কাজে, কথায় অথবা লেখায়।

অতএব মানুষের মনটি তাজা আর অনুভূতি মাত্রই চিরনতুন। এই পুরোনো বিলাসী জগতের প্রতিবেশ প্রাণে প্রাণে যে-সাড়া জাগায়, চোখে-চোখে সুন্দরের যে-অঞ্জন মেখে দেয় তাতে হৃদয়-মন মুখর হয়ে ওঠে। সে-ই উচ্ছল আবেগই প্রকাশ পায় কবিতায়–নতুন মানুষের নতুন অনুভবের আনন্দ-বেদনা নবতর ভাষায়, ছন্দে ও রূপকল্পে প্রকাশিত হবে–এ-ই তো বাঞ্ছনীয় এবং স্বাভাবিক। নতুন অনুভবে যদি তিলে তিলে নতুন হয়ে নতুন তাৎপর্যে ও লাবণ্যে জগৎ ও জীবনকে উপলব্ধি ও উপভোগ করা না গেল, তা হলে চকিত ও চমকৃত করার অসামর্থ্যে পুরোনো পৃথিবী মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।