ঐতিহ্যবোধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

ঐতিহ্যবোধ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র

এতকাল ধরে মানুষ ঐতিহ্যবোধের মহিমা কীর্তন করে এসেছে। ঐতিহ্য-চেতনা মানুষকে এগিয়ে চলার বা আত্মোন্নয়নের প্রেরণা দেয়, এ তো সবারই জানা কথা। কেননা এ অনুভূত সত্য–সেদিক দিয়ে কম-বেশি স্বতঃসিদ্ধ। পূর্বপুরুষের গৌরব থাকলে মানুষ তা বজায় রাখার এবং গ্লানি থাকলে তা আত্মপ্রতিষ্ঠার তথা কৃতির ও কীর্তির গৌরব দিয়ে ঢেকে রাখার কিংবা মুছে ফেলার প্রেরণা বোধ করে–এ-ই সাধারণের বিশ্বাস। কাজেই জীবনে প্রেরণার উৎসরূপে মানুষ পারিবারিক ও জাতীয় ঐতিহ্য স্মরণে রাখবার ও আচরণে প্রকাশ করবার প্রয়াস পায়। তাই ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যবোধ মানুষের কাছে খুব মূল্যবান। একে ব্যক্তিক ও জাতিক জীবন-সাধনায় প্রেরণার উৎস, কর্মপ্রচেষ্টার ভিত্তি ও জীবনযাত্রার অবলম্বন হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি এর নতুন মূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। নতুন দৃষ্টির তৌলে একে যাচাই করে এর ওজন, উপযোগ ও মূল্য নির্ধারণ হয়ে উঠেছে অপরিহার্য। কেননা আজকাল এটিই মানুষের মনোবেদনা ও মানসিক লাঞ্ছনার অন্যতম প্রধান কারণ। এককালের অমৃত একালে বিষে পরিণতি লাভ করছে, সেকালের বর একালে শাপে রূপান্তরিত হচ্ছে। কেন এবং কেমন করে তা-ই বলছি।

আগেরকার দিনে সাধারণত ধর্মীয় গোষ্ঠী ও গো-চেতনা ছিল, আর ছিল রাজা ও রাজ্য। কাজেই সে-যুগে অধিকাংশ দেশে বা রাজ্যে নির্বিশেষ ও অবাধ নাগরিকতা (সিটিজেনশিপ) ছিল না। রাজা যে-মতে বিশ্বাসী ছিলেন, সে-মতবাদীরাই ছিল দেশের বা রাজ্যের শাসকজাতি। অন্যেরা ছিল শাসিত। কাজেই বিভিন্ন ধর্ম বা মতবাদীর মিলনে এক জাতি গড়ে উঠতে পারেনি। এরূপ ক্ষেত্রে স্ব স্ব ঐতিহ্য-প্রীতি বিভিন্ন জাতিগুলোকে নিজেদের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার প্রেরণা দিত। এ চেতনা শাসক-শাসিতে কিংবা বিভিন্ন ধর্মবাদী প্রতিবেশীতে দ্বেষ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টির কারণ হত বটে; কিন্তু স্বাজাত্যাভিমান ও স্বাতন্ত্রবোধ তাতে আরো প্রবল ও প্রখর হয়ে উঠত। ফলে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক শক্তি সঞ্চয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ আকাঙ্ক্ষাও হত তীব্রতর। ইত্যাকার উত্তেজনা ও উদ্দীপনা জাতিগুলোকে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করত। একসময়ে দাসত্ব-মুক্তও করত। অবশ্য বৈষয়িক ক্ষতি ও পীড়ন থেকে বাঁচতে পারত না। যাহোক সে-যুগ আর নেই, কাজেই সে-যুগের সমস্যাও নেই। কিন্তু তার জের রয়ে গেছে। সে-কথাই এখানে আলোচ্য।

আগেকার যুগে জাতীয়তার ভিত্তি ছিল ধর্ম, বর্তমান যুগে হয়েছে রাষ্ট্র এবং এটি একান্তভাবে রাষ্ট্রান্তর্গত ভূ-নির্ভর। কাজেই আজকের জাতি গড়ে ওঠে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, মতবাদী ও নানা গোত্রীয় লোকের সমবায়ে। ফলে সাধারণ না হলে কোনো মত, আদর্শ, ঐতিহ্য কিংবা নীতি সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া সম্ভব নয়। কেননা প্রত্যেক মানুষের স্ব স্ব ধর্ম, ঐতিহ্য ও গোত্রপ্রীতি রয়েছে, আরো রয়েছে পরশ্রীকাতরতা। সেজন্যে একের ধার্মিক, ঐতিহ্যিক ও গৌত্রিক আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রতি অপরের স্বাভাবিক বিরূপতাও আছে। একেরটা অপরে পসন্দ করে না, তাই সহ্যও করতে চায় না।

তাই কোনো প্রবল পক্ষ যদি নিজের ধার্মিক কিংবা সাংস্কৃতিক আদর্শ অন্যদের উপর নিছক ভোটের জোরে চাপায়, তাহলে অন্যদের মন ভাঙে। সেই মনঃপীড়া কায়িক নির্যাতনের চাইতে গুরুতর এবং তাতে যে-ক্ষতি হয় তার সঙ্গে কোনো ব্যবহারিক ক্ষতির তুলনা হয় না। কেননা মানুষ ধনে-প্রাণে মরতে রাজি হলেও হতে পারে, কিন্তু মনে মরতে কখনো প্রস্তুত থাকে না।

কয়েকটি দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। জার্মানির ইহুদীদের অন্য কোনো স্বদেশ ছিল না, তারা পুরুষানুক্রমে জার্মান। জনে না হলেও ধনে-মানে তারাই ছিল প্রবল ও প্রধান। কিন্তু সংখ্যাগুরু খ্রীস্টান জার্মানদের কাছে তাদের ধার্মিক ও ঐতিহ্যিক প্রতিপত্তি ছিল না। তাই তারা ছিল মনে কাঙাল। স্বদেশ ও রাষ্ট্রিক স্বজাতির প্রতি তাদের জাগে বিদেশী ও বিজাতিসুলভ বিরূপতা। ফলে জার্মানির স্বার্থ আর তাদের স্বার্থ এক রইল না। প্রথম মহাযুদ্ধে তাই তারা চরম আত্মরতি ও দেশদ্রোহিতা দেখিয়েছে। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মূলত দোষ এদের নয়; দোষ আবেষ্টনীর ও সংখ্যাগুরু খ্রীস্টান জার্মানদের। স্বতন্ত্র ধর্ম, সংস্কৃতি ও গৌত্রিক ঐতিহ্য-প্রীতিই ইহুদীদের মনে, দেশের প্রতি বিরাগ জাগিয়েছিল।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারত-রাষ্ট্রে প্রবলপক্ষের ঐতিহ্যানুগ পতাকা ও লাঞ্ছন গ্রহণ আর বিশুদ্ধ হিন্দিবরণ অহিন্দু ভারতবাসীর মনে নিশ্চয়ই বিরূপতা সৃষ্টি করেছে। যদি রাষ্ট্রের পতাকা চরকা চিহ্নিত হত কিম্বা লাঞ্ছনটি হিন্দুর ধর্ম ও ঐতিহ্য-নিরপেক্ষ হত অথবা গান্ধীজীর হিন্দুস্তানী রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হত, তাহলে অহিন্দুও আন্তরিকভাবে হিন্দুর স্বজাতি ও স্বদেশী হয়ে উঠতে পারত। যাদের সহজে আপন করা যেত, এভাবে সংখ্যাগুরুর আত্মরতির ছিদ্রপথে তারা হয়ে রইল পর। কোনোকিছু বিশেষ এক পক্ষের ঐতিহ্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রেরণার উৎস হলেই বুঝতে হবে তা অপর পক্ষগুলোর বেদনার কারণ হয়েছে। এ তো নেহাত সহজবোধের কথা। কেননা একে যেখানে নিজের গোত্রীয় গৌরবময় ঐতিহ্যের ও আদর্শের সন্ধান পেয়ে সগর্বে জেগে উঠে, অপরে সেখানে নিজেদের খুঁজে না পেয়ে, নিজেদের আগ্রহ ও আবেগের অবলম্বন না পেয়ে হতাশ হয়। রাষ্ট্রিক, শাসনতান্ত্রিক কিংবা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কোনো একপক্ষের গোত্রীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থাকলে সুইটজারল্যান্ড কোনোক্রমেই এমন উদার ও আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারত না। সে অবস্থায় হয়তো গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেশটি টিকতই না। অথচ সেদেশে যারা বাস করে তাদের কারুর কারুর দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো বিশ্বনন্দিত ঐতিহ্য রয়েছে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল কথা অধিকারের সমতাবিধান–সে সামঞ্জস্য অবশ্যই মানসিক হওয়া চাই। সমাজ ও শাসন সংক্রান্ত আদর্শের বিভিন্নতার কোনো বিশেষ মানস প্রতিক্রিয়া নেই–কারণ, তা একান্তভাবে দলভিত্তিক। একই পরিবারের বিভিন্ন পরিজন বিভিন্ন দলভুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু ধর্ম, ঐতিহ্য প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের Sentiment ভিন্ন প্রকৃতির এবং মানুষের মানস-সত্তায় এর প্রভাব অপরিমেয়। কাজেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলীয় রাজনীতি ও আদর্শ চলতে পারে, কিন্তু কোনো একপক্ষের ধর্মীয় ও গোত্রীয় আদর্শ কিংবা ঐতিহ্যের আধিপত্য চলতে পারে না। এ-যুগে রাষ্ট্রের দুর্বলতা ও সর্বনাশ যদি কোথাও লুকিয়ে থাকে তবে তা এই ধর্ম, গোত্র ও ঐতিহ্যপ্রীতিপ্রসূত গোঁড়ামির মধ্যেই। এতে অগ্রগতি এবং উন্নতিও ব্যাহত হয়। এ-যুগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যা-কিছু হবে, তা সর্বজনীন আগ্রহ ও আবেগের প্রতীকই হবে। নইলে মানস-দ্বন্দ্বের আর তার থেকে বিপদকালে বিপদ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবেই। কাজেই এ-যুগের সাধনা পুরাতনের নিছক জের টানাতে নয়, নতুনেরও প্রতিষ্ঠায়—-নিছক ঐতিহ্যানুসরণে নয়, ঐতিহ্য সৃজনে। এ-যুগের শান্তি ও নিরাপত্তা কোনো বিশেষ গোত্রের গৌরববোধে নেই, রয়েছে রাষ্ট্রভিত্তিক জাতি গড়ে তোলার মধ্যেই। আর এক হিসেবে সর্বজনীন মিলনক্ষেত্রে স্ব স্ব গোত্র ও ঐতিহ্যপ্রীতির উগ্র প্রকাশ সংকীর্ণতা, আত্মরতি ও আদিম গোত্রীয় মনোভাবেরই পরিচায়ক। এটি পশ্চাদুখিতারও প্রমাণ। পরমতসহিষ্ণুতা ও উদারতাই এ-যুগের সাধ্য। ক্ষতি স্বীকারের শক্তিতেই মনুষ্যত্বের প্রকাশ, আর বরণ করবার সামর্থ্যেই সংস্কৃতির পরিমাপ। আছে তো রইলই, যা নেই তা অর্জনের প্রয়াসই তো জীবন-সাধনা। প্রাণের স্ফূর্তি, মনের মুক্তি এবং মানের বৃদ্ধি এভাবেই সম্ভব, আর এ-যুগে তা প্রয়োজনও। এ-যুগ স্বাতন্ত্রবোধের নয়, সাকুল্য বোধের–বিযুক্তির নয়, সংযুক্তির। আভিজাত্য গর্বের নয়, গণসংযোগের। ব্যষ্টির নয়, সমষ্টির। পুরোনো দিয়ে ঘট ভরে রাখলে নতুনকে কিছুতেই ঘরে তোলা যাবে না। তাই জীর্ণ পুরোনোকে বর্জন করে সার্থক নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি চাই। ঐকিক মৌলিকের মাহাত্ম্য যা-ই থাক না কেন, এ-যুগে মানব-মহিমা যৌগিক সামগ্রিকতায় অভিব্যক্ত। ব্যষ্টির বাসনা নয়, সমষ্টির প্রয়োজন মিটানোই যুব্রত। জনে জনে জনতা হয় বটে কিন্তু তা অকেজো; গণভোটে হয় গণনেতা, তার শক্তির সীমা নেই।

ব্যক্তিক স্বার্থ আলাদা হওয়া সত্ত্বেও যেমন প্রীতিপূর্ণ পারিবারিক ও সামাজিক যৌথজীবন অকৃত্রিম এবং বাস্তব; তেমনি ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পৃথক হলেও ভেদবুদ্ধিহীন একক রাষ্ট্রিক জাতীয় জীবন গড়ে তোলা সম্ভব।