এবং তারা ফিরে এল

এবং তারা ফিরে এল

কারখানায় নাইট ডিউটি সেরে এখন বাসে ফিরেই ফেলা দত্ত রাস্তার টিউবওয়েলে চানটা সেরে নেয়। তারপর ঘণ্টা তিনেক ঘুমোয়। টিউবওয়েলের পাশেই আস্তাকুঁড়। পাম্প করতে করতে হঠাৎ তার চোখে পড়ল। ঝুঁকে সে বস্তুটিকে নিরীক্ষণ করছে, তখন বারান্দা থেকে স্কুলমাস্টার অজিত ধরের বউ তা দেখে স্বামীকে ডেকে আনল। তিনি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, অত মন দিয়ে কী দেখছেন ফেলুবাবু?

ফেলা দত্ত গম্ভীর মুখে হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকল। তখন সরকারি ডিপো থেকে দুধ আনতে যাচ্ছিল সুব্রত মৈত্র। সে ওদের দুজনকে আস্তাকুঁড়ের ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

অবশেষে ফেলা দত্ত সাব্যস্ত করল, মনে হয় এ পাড়ারই কোনো ঘরে কেলেঙ্কারিটা হয়েছে। ছি ছি ছি! পঞ্চাশ বছর বয়স হতে চলল, এ জিনিস পাড়ায় এই প্রথম দেখলুম।

অজিত ধর মন্তব্য করল, খোঁজ করে বার করা উচিত। আচ্ছা, পুলিশে খবর দিতে হবে কি?

সুব্রত মৈত্র ডি-ফিল পাওয়ার পর থেকে স্ত্রীর নির্দেশে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। রুবির ধারণা পন্ডিত লোকেরা খুব গম্ভীর হয়। ড. মৈত্র যথোপযুক্ত গাম্ভীর্য সহকারে অভিমত দিল, ধরা না পড়লে পুলিশ কী করে বার করবে? আর এসব ব্যাপার মেয়েরাই ভালো ধরতে পারে। আগে ধরুন, তারপর পুলিশে খবর দিন। এই বলে সে দুধ আনতে চলে গেল।

হনহনিয়ে যাচ্ছিল ভেলোর মা। তিন বাড়িতে কাজ, বেশিক্ষণ দাঁড়াবার তার সময় নেই। শুধু বলে গেল—পাড়ার মেয়ে-বউদের ধরে ধরে এগজামিন করলেই তো ন্যাটা চুকে যায়।

খুবই চিন্তিত হয়ে অজিত ধর বাড়িতে ঢুকল। বড়োমেয়ে খুকিকে শুয়ে থাকতে দেখেই আঁতকে উঠল সে। কী ব্যাপার, শুয়ে এখনও?

বউ বলল, কাল থেকে তো ইনফ্লুয়েঞ্জা মতো হয়েছে। কেমন গা-টা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে।

না না, অজিত ধর চাপা চিৎকার করে উঠল, শোয়াটোয়া এখন চলবে না। বারান্দায় যাক, হাসুক, গান করুক, অসুখটসুখ এখন নয়। বিকেল হলেই সব বাড়ির মেয়েরা যখন ছাদে উঠবে তখন যেন স্কিপিং করে। মোটকথা আমার বাড়ির দিকে কেউ যেন সন্দেহের চোখে না তাকায়।

খুবই চিন্তিত হয়ে ফেলা দত্ত বাড়িতে ঢুকল। ব্যাপারটা বউকে বলমাত্র সে তড়বড়িয়ে বলল, তোমার সেজোছেলেকে ছাদে ওঠা বন্ধ করতে বলো। অজিত মাস্টারের মেয়েটার সঙ্গে তো আজকাল খুব ঠ্যাকার চলে, তারপর কোনদিন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ক্ষণ। কারখানায় যাহোক একটা কাজে ঢুকিয়ে দাও, কথা তো গেরাহ্যি কর না। তোক একটা লটঘট।

কাজ কি বললেই আজকাল পাওয়া যায়? ক্লান্তস্বরে ফেলা দত্ত বলল, সবাইকেই তো তেল দিচ্ছি।

দুধ নিয়ে ফিরেই সুব্রত মৈত্র শুনল, কী যেন একটা আস্তাকুঁড়ে পড়েছে, ভেলোর মা চাটুজ্জে গিন্নিকে বলছিল শুনলুম?

রুবির হাসি দেখে ড. মৈত্র বুঝল সবিস্তারে কিছু বলতে হবে না। কোন বাড়ির কেলেঙ্কারি বলে মনে হয়?

কী জানি, ভেলোর মা তো বলছিল মেয়ে-বউ সবাইকে এগজামিন করলেই বেরিয়ে পড়বে।

বউদেরও? তাহলে তো তুমিও পড়ে যাও এর মধ্যে। অবশ্য ডিস্টিংশন নিয়েই পাস করবে, ট্যাবলেট কাল পর্যন্ত তো চলবে?

তাই শুনে হেসে উঠতে উঠতে রুবি ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কাল কেন পরশু না? এখনও তো তিন দিন রয়েছে!

সেকী দুটো থাকার তো কথা!

দুজনে একুশ দিন ও একুশ ট্যাবলেটের হিসেব কষতে শুরু করল। এবং একসময়ে ফল বেরোলরুবি কোনো একদিন খেতে ভুলে গেছে। অতঃপর দুজনেই থমথমে মুখ নিয়ে বসে রইল।

ভেলোর মা কাজ সেরে চলে যাবার পরই চাটুজ্জেগিন্নি ছোটোবউয়ের ঘরে এসে ঢুকল।

শুনেছ তো কী কান্ড হয়েছে?

শুয়ে কাগজ পড়ছিল ছোটোবউ, উঠে বসে আঁচলটা স্ফীত মধ্যদেহের উপর বিছিয়ে দিল। তাইতে চাটুজ্জেগিন্নির কুঞ্চন ঘটল বার কয়েক।

আজকাল মেয়েরা তো ছেলেপুলে চায় না, তাই কত কী করে। এই দ্যাখো-না কোন বাড়ির মেয়ের কিত্তি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে।

বউয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন কেন মা, বিধবা কি কুমারীকীর্তিও তো হতে পারে?

তক্ক করা তোমার এক রোগ বাপু, কাপড় টেনে অত ঢাকাটুকি দেবার কী আছে অ্যাঁ, এত লজ্জা কীসের? যাও-না, এবাড়ি-ওবাড়ি একটু ঘুরে এসো। লোকে দেখুক। সবাই জানে এ পাড়ায় তুমিই একমাত্র পোয়াতি। যা সন্দেহবাতিক মন পোড়ারমুখো পাড়ার।

শাশুড়ি চলে যাবার পর ছোটোবউ রাগে গুম হয়ে বসে রইল। সকালের কলেজ থেকে ফেরার পথে থার্ড ইয়ারের স্নিগ্ধা ছোটোবউয়ের হাতছানি পেয়ে দোতলায় এল।

এ পাড়ায় আর কার বাচ্চা হবে বলতে পার?

ভেবেচিন্তে স্নিগ্ধা জানাল, সে বলতে অক্ষম। তবে গৌরীর মা-র হতে পারে, কেননা প্রতিবছরই তার হয়, আট বছর তিনি বিশ্রাম পাননি।

সকাল থেকেই গৌরীর মা অন্যমনস্ক। ছাদে কাপড় মেলতে এসে পাঁচিলে ভর দিয়ে একদৃষ্টে আস্তাকুঁড়ের দিকে তাকিয়ে রইল সে। গৌরীর বাবা ভাত খাচ্ছিল, তখন সে এক বার বলেছিল, যে-ই করুক, বেঁচে গেল।

তাই শুনে গৌরীর বাবা বলে, ওইসব করার শখ হচ্ছে বুঝি?

কেন হবে না, আমি কি পশু, আমি কি একটা বছরও ছাড় পাব না?

ওরে ব্বাবা, তুমি যে খুব আধুনিকা হয়েছ দেখছি, ডিভোর্স করবে না তো?

উপায় থাকলে করতুম।

এই বলার জন্য এঁটো হাতের চড় খেয়েছে গৌরীর মা। দুপুরে পাঁচিলে ভর দিয়ে আস্তাকুঁড়ের দিকে তাকিয়ে টপ টপ করে জল পড়ল তার চোখ দিয়ে।

বিকেলে ছাদে স্কিপিং করতে করতে খুকি টলে পড়ল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্য বাড়ির ছাদগুলো লক্ষ করতে করতে হঠাৎ তার মনে হল, তিন আর চারের-একের ফাঁক দিয়ে ছবিদের ছাদে কেউ নেই। প্রায়ই তো ছবি ওঠে, তবে নেই কেন আজ? ধীরে ধীরে সিধে হয়ে গেল খুকি উত্তেজনায়। তাহলে কি ওই! সাত-আট বছর আগে সে রোজ বিকেলে যেত ছবিদের বাড়ি। শাড়ি পরার সঙ্গে বাড়ির বাইরে যাওয়া কমে গেল। ছবির বাবার কী কারণে যেন চাকরি গেল, জেল হল। পাড়ায় রটল তহবিল তছরুপ করে ফাটকা খেলতে গিয়ে লোকটার সর্বনাশ হয়েছে। ওদের বাড়ি যাওয়া একদম বারণ হয়ে গেল। একদিন শুনল বাড়িওয়ালা মেরেছে আট মাসের বাকি ভাড়ার জন্য। তারপর মা মারা যেতেই পাঁচ ভাই-বোনের সংসার ছবির ঘাড়ে পড়ল! ওর বাবা প্রায়ই বাড়ি ফেরে না। ফিরলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাতাল হয়ে। একদিন পাড়ায় বলাবলি হল, ছবিকে গড়ের মাঠের দিকে সেজেগুজে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে রাত্রে।

জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে খুকির। তবু ছুটে এল সে স্নিগ্ধাদের বাড়ি। গৌরীসমেত আরও তিন-চারটি মেয়ে ছিল। তারা ঘিরে ধরে খুকির কাছ থেকে শুনল। তারপর সাব্যস্ত করল, চল, গিয়ে দেখা যাক।

হঠাৎ উটকোভাবে কি যাওয়া যায়, এত বছর যখন যাইনি!

যদি গিয়ে দেখি ছবির কেলেঙ্কারি নয় তাহলে আমাদের মুখ থাকবে কোথায়?

ওরা সবাই মনে মনে প্রার্থনা করল, কেলেঙ্কারি যেন ছবিরই হয়।

তাহলে গিয়ে বলি, আমরা সবাই রবীন্দ্র-জন্মােৎসব করব, তোকে গান গাইতে হবে। ছবি তো খুব ভালো গান গাইত।

কেন, ওর আবৃত্তিও কী সুন্দর ছিল। স্কুলে একবার প্রতিমাদি কী বলেছিল ওর সম্পর্কে। মনে আছে?

মাস খানেক আগে ওকে একবার দেখেছিলুম, ইস, কী রোগা হয়ে গেছে! গাল দুটো বসা, চোখ গত্তে ঢোকা, আমায় দেখে কেমন জড়সড় হয়ে হাসল। আগে কিন্তু খুব মিশুকে ছিল।

এ লাইনে গেলে এইরকমই হয়ে যায়। আমার তো মনে হয় খুকির আন্দাজই ঠিক।

আমারও তাই মনে হয়।

সকলেই বলল, আমারও।

তারপর দল বেঁধে ওরা ছবিদের বাড়িতে হাজির হল। এক তলায় একখানি ঘরে ছবিরা এখন থাকে। দোতলা থেকে বাড়িওয়ালা নামিয়ে দিয়েছে। তারা কথাও বলে না, উঁকি দিয়েও দেখে না। ঘরটা অন্ধকার। একটি মাত্র জানালা পগারের দিকে, এখন বন্ধ। দরজাটাও ভেজানো।

ছবির ভাই-বোনেদের দেখা যাচ্ছে না। সারা এক তলাটা ছমছমে ঠাণ্ডা, ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

কেউ নেই, চল ফিরে যাই। ফিসফিসিয়ে একজন বলল।

দরজায় তালা নেই যখন, কেউ থাকতেও পারে।

ঠেলে দেখব?

দ্যাখ।

অন্ধকার আর ভ্যাপসা গন্ধ প্রথমেই ওদের এক-পা পিছিয়ে দিল।

কিছু দেখা যাচ্ছে না যে!

আলোটা জ্বাল-না।

একজন ঘরে ঢুকে দেয়াল হাতড়ে সুইচ পেল। টিপতে জ্বলল না।

বাড়িওলা বোধহয় কানেকশন কেটে দিয়েছে।

মনে হচ্ছে কে যেন তক্তায় শুয়ে।

ধ্যাত, কে আবার এখন এইভাবে শুয়ে থাকবে?

সত্যি বলছি, দেখে আয় কেউ।

খুকি ঘরে ঢুকল। অন্ধকারে ঠোক্কর সামলাবার জন্য দু-হাত বাড়িয়ে এগোল। তারপরই প্রচন্ড ভয় তার চিৎকারটা টিপে ধরল। তক্তায় কেউ শুয়ে। তার কাঁধে খুকির হাত লেগেছে।

বাইরে থেকে তাগিদ এল, কী হল রে, দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

খুকি ঝুঁকে হাত বোলাল দেহটায়। ঠাণ্ডা নিথর। নাকের সামনে আঙুল রাখল। নিশ্বাস পড়ছে না। গালে হাত রাখল, চুপসে রয়েছে। ঠোঁট দুটো শুকনো। চোখের পাতা খোলা, কানের পিছনে আঁচিলটাও হাতে ঠেকল।

খুকি বেরিয়ে এসে বলল, ছবিটা মরে পড়ে রয়েছে রে! এবং তারা ফিরে এল সন্তর্পণে, দ্রুত পায়ে, নীরবে।

রাত্রে নাইট ডিউটিতে বোরোবার আগে ফেলা দত্ত টিউবওয়েল থেকে খাবার জল আনতে গিয়ে আস্তাকুঁড়ে ঝুঁকে দেখল। ভেলোর মা তখন যাচ্ছিল, বলল, এতক্ষণ কি আর পড়ে থাকে, কাক-কুকুরে হয়তো খেয়ে ফেলেছে, কি ধাঙড়ে নিয়ে গেছে।

ইডিয়ট গাড়ল কোথাকার ড. মৈত্র গজরে উঠল। রুবি মাথা নামিয়ে বসে। ডাক্তার বলল, হতে পারে ওই একদিনের ভুলের খেসারত দিতে হতে পারে। তখন তো নার্সিং হোমে গিয়ে, ওই যা হয়েছে আজ…

হয় যদি হবে। রুবি হঠাৎ ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো উদ্ধত হয়ে উঠল।

মাথা নামিয়ে মুচকি হেসে গৌরীর মা বলল, রাগ করব কেন, তুমি তো আর পর ভেবে মারনি। রাগ তো নিজের জনের উপরই লোক করে।

তাহলে শাড়িটা পরো, দেখি কেমন মানায়।

আগে আলোটা নিবোও বাপু।

ছ-মাসও তো বিয়ে হয়নি, এত তাড়াতাড়ি সংসারে আটকে পড়ার কী দরকার ছিল? চাটুজ্জেদের ছোটোবউ শান্ত গলায় অনুযোগ করল।

সময় কাটাবার একটা ব্যবস্থা হল, ভালোই তো।

কেন, সেজন্য তুমিই তো আছ।

আমি তো পুরোনো হয়ে যাব একসময়।

কিছুক্ষণ পর ছটোবউ ফিসফিসিয়ে বলল, আচ্ছা ওইরকম কিছু-একটা ব্যবস্থা করা যায় না? সাড়া না পেয়ে বুঝল স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *