এন্ড্রু কার্নেগি : অন্যদেরকেও ধনী করে তুলতেন

এন্ড্রু কার্নেগি : অন্যদেরকেও ধনী করে তুলতেন

এন্ড্রু কার্নেগি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তার পরিবারের দারিদ্র্যতাহেতু ডাক্তার বা ধাত্রীর পরিচর্যার সুযোগ পান নি। ঘণ্টায় দুই সেন্ট পারিশ্রমিক দিয়ে যার আয় শুরু, শেষপর্যন্ত তিনি উপার্জন করলেন মোট চল্লিশ কোটি ডলার।

ছেলেবেলায় এন্ড্রু মাকে প্রায়ই বলতেন, ‘মা, আমি একদিন ধনী হব, তখন তোমার সিল্কের পোশাক হবে, চাকরবাকর হবে, ঘোড়ার গাড়ি হবে।‘ তার বক্তব্য অনুসারে তার সমস্ত বুদ্ধি মা’র কাছ থেকেই পেয়েছেন। অবশ্য মার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই তাঁর জীবনের অন্যতম প্রেরণা। স্কটল্যান্ডের ডানফার্মালিনে যে ছোট্ট বাড়িটিতে এন্ড্রুরা প্রথম বাস করতেন তাতে মাত্র দুটি ঘর ছিল। নিচের তলায় বাবা তাঁতের কাজ করতেন আর ওপরের ঘরটিতে রান্নাবাড়া, খাওয়া থাকা সবই করতে হত।

কার্নেগি পরিবার যখন আমেরিকায় এল, বাবা টেবিলক্লথ বুনে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করতেন আর মা এক জুতো প্রস্তুতকারকের অধীনে কাজ করতেন। এন্ড্রুর পরার জামা ছিল মাত্র একটি। প্রতি রাতে মা সেটা ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিতেন। বয়স যখন বাইশ হল, এন্ড্রু মার কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, মা, যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন বিয়ে করবেন না। অবশ্যি তিনি তা করেন নি।

তিনি যখন বিয়ে করলেন তখন বয়স হয়েছিল বাহান্ন আর প্রথম সন্তান যখন জন্ম নিল তখন তার বয়স বাষট্টি। তার মা মারা যাওয়াতে এত গভীরভাবে দুঃখিত হয়েছিলেন যে, পনের বছর যাবত মা‘র নামোল্লেখও সহ্য করতে পারতেন না। মায়ের মতো দেখতে এক মহিলার বাড়ি বন্ধকী ঋণ তিনি পরিশোধ করে দিয়েছিলেন।

এন্ড্রু কার্নেগি ‘স্টিল কিং’ নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু স্টিল নির্মাণের ব্যাপারে তার হাজার হাজার কর্মচারী তার চেয়ে বেশি জানত। তিনি শুধু জানতেন কীভাবে মানুষকে পরিচালনা করতে হয় আর এটাই তাকে ধনী হতে সাহায্য করেছিল।

ছেলেবেলাতেই তিনি ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্ব দেবার কৌশল আয়ত্ব করেছিলেন। তাঁর মা খরগোস ধরেছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষুদ্র খরগোসটার খাবার যোগাড় করতে না পারায় একটা চমৎকার মতলব আঁটলেন। পাড়ার ছেলেদের বললেন, তারা যদি খরগোসের খাবার এনে দিতে পারে তা হলে তাদের সম্মানার্থে খরগোসের বাচ্চাদের নামকরণ করবেন। ঐ একই বুদ্ধিমত্তা তিনি তার ব্যবসায়ে লাগালেন। পেনসিলভানিয়া রেলরোডে তিনি স্টিলের রেল বিক্রি করতে ইচ্ছে করলেন। তিনি পিটসবার্গে একটা বৃহদাকার স্টিলের কারখানা তৈরি করে তৎকালীন পেনসিলভানিয়া রেল রোডের প্রেসিডেন্ট জে, এডগার টমসনের নামে এই স্টিল মিলের নামকরণ করলেন। স্বভাবতই মি. টমসন খুশি হয়ে প্রয়োজনীয় ইস্পাতের তৈরি রেলের অর্ডার দিলেন।

এন্ড্রু কার্নেগি পিটসবার্গে টেলিগ্রাফ বার্তাবাহকের একটা চাকুরি পেলেন। তার মাইনে ছিল দৈনিক পাঁচ সেন্ট। এটা তার কাছে এক পরমসৌভাগ্য বলে মনে হল। অল্পতেই তিনি ওই শহরের প্রতিটি বাণিজ্যিক এলাকার কারখানার নাম ঠিকানা আয়ত্ত করে ফেললেন। এরপরে তার বাসনা হল অপারেটর হবার। যার জন্য রাত জেগে টেলিগ্রাফি পড়তেন এবং খুব ভোরে দৌড়ে অফিসে পৌঁছেই টেলিগ্রাফের চাবি টেপার অভ্যাস করতেন। একদিন সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগটি এল। একদিন সকালে বিরাট সব খবরে টেলিগ্রাফের তার গরম হয়ে ওঠে। ফিলাডেলফিয়া থেকে ভয়ানক উত্তেজিত পরিস্থিতিতে পিটসবার্গের সাহায্য কামনা করছিল। তখন কোনো অপারেটর কর্তব্যরত ছিল না। এন্ড্রু কার্নেগি তখনি দৌড়ে গিয়ে সংবাদটা গ্রহণ করলেন এবং টেলিগ্রাফের মাধ্যমে যথাস্থানে পৌঁছে দিলেন। এ কাজটির জন্য তাকে অপারেটর করে বেতন দ্বিগুণ করা হল।

পরবর্তীতে তার অক্লান্ত কর্মক্ষমতা, সুচতুর বুদ্ধি বিবেক ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে ডিভিসনাল সুপারের প্রাইভেট সেক্রেটারিপদে পদোন্নতি দিলেন। এরপর একদিন রেলগাড়িতে হঠাৎ করে এক আবিষ্কারকের সঙ্গে সাক্ষাৎ তার সৌভাগ্যের দরজা খুলে দিল। আবিষ্কারক নিজের আবিষ্কৃত একটি স্পিলিং কারের মডেল তাকে দেখালেন। কার্নেগি অনুধাবন করতে পারলেন আবিষ্কারটি সম্ভাবনাময়। তিনি টাকা ধার করে ওই কাজে কিছু শেয়ার কিনলেন। এতে কোম্পানি তাকে ভালো লভ্যাংশ দিল এবং এভাবেই তার বিনিয়োগ থেকে বছরে পাঁচ হাজার আয় হল। একবার রেলপথে একটা কাঠের পুল পুড়ে গিয়েছিল। তখন কাঠের পুলের দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। এন্ড্রু কার্নেগি একটা কোম্পানি গঠন করে লোহার ব্রিজ তৈরি শুরু করলেন। এতে তার এত প্রচুর অর্থলাভ হতে থাকল যে তা তাকে অভিভূত করে দিল।

এভাবে তার অধ্যবসায় ও বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে অনেক উপরে উঠলেন কার্নেগি, বিস্তারিত হলেন চমৎকার ও সুন্দরভাবে। এর মূলে অসাধারণ ভাগ্য ছিল তার সহায়। তারা কয়েক বন্ধু মিলে পশ্চিম পেনসিলভানিয়ায় চল্লিশ হাজার ডলার দিয়ে একটি তৈলখনির কারখানা কিনলেন এবং একবছরের মধ্যে দশ লক্ষ ডলার আয় করলেন। কার্নেগির সাতাশ বছর বয়সে তার সাপ্তাহিক আয় এসে দাঁড়িয়েছিল এক হাজার ডলারে। ১৮৬২ সাল আমেরিকায় এক বিপ্লবের সূচনা হল। এক বিস্ময়কর যুগে তখন আমেরিকা প্রবেশোনুখ। কার্নেগির ইস্পাতের অগ্নিকুণ্ড থেকে ক্রমাগত ধূম্ররাশি উদগীরণ হতে থাকল-কার্নেগি উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করলেন। অবশেষে তিনি বিপুল ধনরাশি উপার্জন করলেন যা মানবজাতির ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কেউ কল্পনাও করে নি। এসব ধনরাশি উপার্জনের বেলায় তাকে বেশি কঠোর পরিশ্রম অবশ্য করতে হয় নি। তিনি নিজেকে এমন সব সহকারী দ্বারা পরিবেষ্টিত রাখতেন যারা তার চাইতে বেশি জানতেন। কার্নেগি তার অংশীদারের লাভের অংশ পুরোপুরি দিতেন। তিনি যত কোটিপতি তৈরি করেছিলেন যা এ যাবৎ আর কেউ তা পারেন নি।

জীবনে মাত্র চার বছর স্কুলে গিয়েছিলেন কার্নেগি। তা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি ভ্রমণকাহিনী, রচনা ও জীবনী এবং অর্থনীতির বই লিখেছেন। তিনি পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে ষাট মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন এবং শিক্ষার অগ্রগতির জন্য দিয়েছিলেন প্রায় আশি মিলিয়ন ডলার। তিনি গির্জায় সাত হাজারেরও বেশি পাইপ অর্গান দান করেন। তিনি তিনশত পঁয়ষট্টি মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন। তার অর্থরাশি দান করার সর্বোত্তম উপায় তাকে কে বলে দিতে পারে তাই নিয়ে খবরের কাগজে প্রতিযোগিতা চলত এবং পুরস্কার ঘোষণা করা হত। অথচ এন্ড্রু কার্নেগি বিবৃত করেছিলেন যে, ধনী হয়ে মরাটা এক চরম অপমান ও লজ্জাকর ব্যাপার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *