1 of 3

এখনই

এখ

সংবাদসমীক্ষা

অধ্যাপক সুদর্শন সেন বাইরের ঘরে বসে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তিনি নিজের পয়সা দিয়ে একটা ইংরেজি, একটা বাংলা, দুটো খবরের কাগজ রাখেন। এ ছাড়া আর একটি বাংলা কাগজে তিনি কখনও-সখনও প্রবন্ধাদি লিখে থাকেন বলে, পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সেই কাগজটা তাঁকে বিনামূল্যে দেয়।

এখন সকাল সাতটা। এখন থেকে সকাল নটা সাড়ে নটা পর্যন্ত তিনটে কাগজই তিনি প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন, ফটো-ক্যাপশন থেকে শেষ পৃষ্ঠার প্রিন্টার্স-লাইন আগাগোড়া উলটে পালটে পড়বেন। অনেক অসঙ্গতি, ভুল বার করবেন।

এই তো সেদিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি কটকটি বিস্কুট খেতে খেতে আরাম করে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দূরদর্শনে খেলা দেখছিলেন। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। এরকম অবস্থা যেকোনও সুস্থ মানুষের যেকোনও সময় হতে পারে। এ হল সাময়িক ব্ল্যাক-আউট।

মার্কিন রাষ্ট্রপতির এই হঠাৎ অজ্ঞান হওয়া, তা নিয়ে সারা পৃথিবী মাথা ঘামিয়েছে। সুদর্শনবাবুও মাথা ঘামিয়েছেন। কিন্তু সেটা একটু অন্য কারণে। তিনি যে কাগজ প্রতিদিন বিনামূল্যে পান, সেই কাগজে লিখেছে বুশসাহেব প্রেটজেল নামে ওষুধের ট্যাবলেট খেতে গিয়ে গলায় আটকে অজ্ঞান হয়ে যান।

মার্কিনিদের কটকটি বিস্কুটের নাম প্রেটজেল, এটা কোনও ওষুধের ট্যাবলেট নয়। যিনি অনুবাদ করেছেন, ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলেছেন। প্রবীণ অধ্যাপক এ ধরনের ভুল মোটেই বরদাস্ত করেন না।

সুদর্শনবাবু কাগজ পড়া থামিয়ে টেলিফোন করেন পত্রিকার সহকারী সম্পাদককে। সহকারী সম্পাদক রাজকমল রায় একদা অধ্যাপনা করতেন, সুদর্শনবাবুর সঙ্গে একই কলেজে পড়াতেন। পরে অধ্যাপনা ছেড়ে সাংবাদিকতায় চলে যান।

এই রাজকমলবাবুই মাঝেমধ্যে সুদর্শনকে দিয়ে নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লেখান। সংবাদ সাময়িকী জাতীয় রচনা সুদর্শন খুব ভাল লেখেন। তথ্যের প্রতি তাঁর কড়া দৃষ্টি, হেঁয়ালিহীন ভাষা।

প্রেসিডেন্ট বুশ অজ্ঞান হওয়ার সংবাদ খুব গুরুত্ব দিয়ে বেরিয়েছিল রাজকমলবাবুদের কাগজে এবং সেখানেই বলা হয়েছিল, ওষুধের ট্যাবলেট গলায় আটকে বুশসাহেব অজ্ঞান।

সুদর্শনবাবু তাঁর ওয়েবস্টারের বড় ডিকশনারিতে ওই প্রেটজেল শব্দের অর্থ ভাল করে যাচাই করে সেই সকালেই অনুজপ্রতিম রাজকমলকে ফোন করে বললেন, রাজকমল আজকের কাগজে ওটা কী করেছ?

বলা বাহুল্য, রাজকমল ব্যাপারটার দায় এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন, সুদর্শনবাবুকে অনুরোধ করলেন, দাদা চেপে যান। পাঠকেরা কেউ ওসব খেয়াল করবে না।

তা সুদর্শনবাবু ভাল করেই জানেন। বেশ কয়েক বছর আগে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান সুব্রত মুখার্জি বিদেশে ডিনারের আগে হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান। মৃত্যুর সময় তিনি অ্যাপেটাইজার খাচ্ছিলেন যার নাম হর্স-দ্য-অ্যাভুয়ার, ছোট বিস্কুটের ওপরে আচার বা চিজ বা একরত্তি খাদ্য, ফরাসি মুখরোচক। কিন্তু ওই হর্স শব্দটি বিভ্রান্ত করেছিল অনুবাদককে, পরদিন সকালে কাগজে ছাপা হল, ঘোড়ার মাংস গলায় ঠেকিয়া এয়ার মার্শালের মৃত্যু।

এই ঘটনার পর বহুকাল চলে গেছে, কিন্তু এখনও কোথাও কোথাও শোনা যায় এয়ার মার্শালের ঘোড়ার মাংসের হাড় গলায় ঠেকে মৃত্যু হয়েছিল। এরই সূত্র ধরে অনেকে এ রকমও মন্তব্য করেন। যে, বাঙালির ছেলের ওরকম অখাদ্যকুখাদ্য না খাওয়াই উচিত।

সে যা হোক, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় একটা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের সংবাদ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন অধ্যাপক সেন।

তিনটে কাগজে সংবাদটা তিন রকমভাবে বেরিয়েছে। ইংরেজি দৈনিকে খুবই ছোট করে খবরটি ছাপা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে মধ্য কলকাতায় এক পুরনো সমাজবিরোধীকে একটি অফিসে অগ্নিসংযোগের কালে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। এর কারণ জানা যায়নি, পুলিশি তদন্ত চলছে।

বাংলা কাগজগুলোর একটায় সংবাদটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা অবশ্য ঘটনাটি অন্যভাবে নিয়েছেন, তাঁদের সংবাদের ওপরে একটা ছোট হেডলাইন, পাগলের কীর্তি।

ঘটনার বিবরণ প্রায় একই রকম। তবে এই সংবাদটিতে দুষ্কৃতকারীকে পুরনো সমাজবিরোধী না বলে বুড়ো পাগল বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে উক্ত ব্যক্তি, যে ওই অফিসে আগুন লাগাতে গিয়েছিল, সে ওই অফিসেরই কর্তা ও মালিক।

এই দুটি সংবাদেই বলা হয়েছে যে গ্রেফতারের সময় উক্ত ব্যক্তির হাতে এক বোতল কেরোসিন ছিল।

তৃতীয় পত্রিকাটির একটু রঙচঙে খবরের দিকে ঝোঁক। এই পত্রিকাতেই রাজকমল আছেন এবং সুদর্শনবাবু লেখেন।

এই কাগজে বেশ বড় করে হেডলাইন দিয়ে ছাপা হয়েছে।

ছদ্মবেশী আতঙ্কবাদী পুলিশের জালে।

এই পত্রিকার সংবাদেও একটু ব্যতিক্রম দেখা গেল। এরা লিখেছে সন্ত্রাসবাদীর হাতে পেট্রলের টিন ছিল, সে পেট্রলে রাইটার্স বিল্ডিংস, হাওড়া স্টেশনের মতো বড়ো বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া যায়। পুরো ব্যাপারটা গোয়েন্দা পুলিশ দেখবে। প্রয়োজনে সি-বি-আই, মার্কিনি এফ-বি-আই, এমনকি ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া হবে।

তিনটে পত্রিকাই চায়ের টেবিলের ওপরে পাশাপাশি ফেলে এই সামান্য ব্যাপারটির একটি সামঞ্জস্য রচনা করার চেষ্টা করছিলেন অধ্যাপক সেন।

এটা তাঁর একটা বাতিক। সেই কবে ছোটবেলায় তাঁর জ্যাঠামশায় তাঁকে বলেছিলেন, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ–এই যেমন চার দিক, প্রত্যেক ঘটনার তেমনই চার দিক আছে। প্রথম, আমি যেমন জানি বা দেখেছি। দ্বিতীয়, তুমি যেমন জান বা দেখেছ। তৃতীয়, সে যেমন জানে বা দেখেছে। আর চতুর্থ দিক হল, সত্যিই যা ঘটেছে।

এই বয়সে এসে, প্রত্যহ সকালবেলা তিনটি খবরের কাগজের নানা রকম সংবাদ যাচাই করতে করতে জ্যাঠামশায়ের কথা মনে পড়ে যায় সুদর্শনবাবুর।

বহুকাল পরলোকহত জ্যাঠামশায়ের উপদেশ মনে রেখে খবরের কাগজ খুঁটিয়ে দেখেন সুদর্শনবাবু।

গরমিল সাধারণত বেশি দেখা যায় স্থানীয় সংবাদে। খুন-মারামারির বিবরণ এক এক কাগজ এক এক রকম ছাপে। সেগুলি বিশ্লেষণ করে ভালই সময় কাটে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের।

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ

তিনটি খবরের কাগজ পাশাপাশি বিছিয়ে আজ সকালে অধ্যাপক সুদর্শন সেন গভীর অভিনিবেশসহকারে অগ্নিসংযোগের একটা ঘটনার সমীক্ষা করছিলেন। রীতিমতো তুলনামূলক পর্যালোচনা।

এরকম ব্যাপারে তাঁর কৌতূহল যতটা, ধৈর্য ততোধিক। দুয়েকবার মূল ঘটনা অনুধাবন করবার জন্যে সশরীরে সংবাদের উৎসমূলে গিয়ে খোঁজখবর করেছেন। সব সময় অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি। অকুস্থলের লোকেরা তাঁকে সঙ্গত কারণেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে। একবার পুলিশের পাল্লায়ও পড়েছিলেন, কী প্রয়োজন, কেন এসব খোঁজ করছেন–এইসব প্রশ্ন।

সেটা ছিল একই পাড়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে সাংঘাতিক মারামারির ঘটনা। দলে জনাবিশেক জখম হয়েছিল, দশজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল, তার মধ্যে একজন, দু-কানকাটা বোঁচা নামে পরিচিত এক স্থানীয় মস্তান, মরণাপন্ন অবস্থায়।

সাধারণত ঠাকুমা-দিদিমারা শিশুর নাক একটু বেশি চ্যাপটা হলে সেই নবজাতককে বোঁচা নামে সম্বোধন করতে থাকেন, যে ডাকনাম সারাজীবন মানুষটার সঙ্গে লেপটে থাকে, এমন কী তার ভাল নাম যদি হয় শান্তনীল কিংবা অপরাজিত তবু লোকসমাজে তার পরিচয় হয় বোঁচা, বোঁচাদা কিংবা বোঁচাবাবু নামে। কেউ কেউ মোটা বোঁচা, কিংবা নেকা বোঁচাতেও পরিণত হয়।

এক্ষেত্রে সুদর্শনবাবু সমস্যার আরও গভীর প্রদেশে গিয়েছিলেন। কানকাটা বোঁচা কথাটা অধ্যাপক মহোদয়কে বিচলিত করেছিল। বোঁচা মানে যৎসামান্য নাক, তদুপরি কানকাটা, মাস্তান-ফাস্তান যাই হোক, নাক কান হীন মানুষটির জন্যে সরল প্রকৃতির দর্শনের অধ্যাপক সুদর্শন সেনের খুব মায়া হয়েছিল। খবরের কাগজে ঘটনার বিবরণ পাঠ করে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে কানকাটা বোঁচার খবর নিতে গিয়েছিলেন।

এলাকায় পুলিশের গোয়েন্দারা ঘোরাঘুরি করছিল, সুদর্শনবাবুর মহৎ উদ্দেশ্য তারা অনুধাবন করতে পারেনি, তাদের মনে সন্দেহ দেখা দেয়, তারা তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।

ভাগ্য ভাল যে ওই থানার এক দারোগা ছিল সুদর্শনবাবুর প্রাক্তন ছাত্র। ছাত্রজীবনে সুদর্শন স্যারের নানারকম খামখেয়ালিপনার বিষয় নিয়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সে নিজেও খুব হাসাহাসি করেছে।

একবার ক্লাসরুমে ঘরের ভেন্টিলেটারের চড়ুই পাখির বাসা থেকে পাখির ডিম মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়। সুদর্শনবাবু তখন পড়াচ্ছিলেন, ক্লাসে প্রায় দেড়শো ছাত্র–সব উপেক্ষা করে চড়ুই বাবা-মা প্রচণ্ড লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগল। পরের দিন বাজার থেকে একটা খুব ছোট মুরগির ডিম কিনে সেটা সুদর্শনবাবু রুমালে আলতো করে জড়িয়ে পকেটে নিয়ে কলেজে এলেন। তারপর একজন লম্বা ছাত্রকে অনুরোধ করে জানলায় উঠিয়ে ভেন্টিলেটারে চড়ুইয়ের বাসায় ডিমটা রেখে দেন। চড়ুই মা-বাবাকে ভোলানোর জন্যে এই ব্যবস্থা। ছাত্ররা কেউ কেউ বলেছিল, স্যার, চড়ুইয়ের এত বড় ডিম! চড়ুই মেনে নেবে না। আত্মসন্তুষ্ট অধ্যাপক সেদিন বলেছিলেন, ওই টুকু পাখি চড়ই, তার পক্ষে এই তারতম্য ধরা খুব সহজ হবে না।

সেদিনের সেই ছাত্র এখন দারোগা। তিনি এখন নিজের চেয়ারে বসে টেবিলের পাশে দাঁড়ানো এক ছিঁচকে চোরের হাত-পায়ের গিটে গিটে রুলার দিয়ে মারছিলেন। থানায় মারধর নিষেধ। একধরনের আসামিদের বলা থাকে, চেঁচাবি না। যদি বাইরে কেউ টের পায় থানার পিছনের গ্যারেজে নিয়ে ডাণ্ডা-ধোলাই দেব। তাই প্রহৃত আসামিটি বিনা বাক্যব্যয়ে নীরবে অশ্রুবিসর্জন করছিল।

এই সময়ে সুদর্শনবাবুকে নিয়ে গোয়েন্দাদের থানায় প্রবেশ। সেই চড়ুইয়ের বাসায় ডিম তুলে দেয়া লম্বা ছাত্রটি এখন দারোগা। তিনি এখন আসামিকে কেঁচকি দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। পিঠের নীচে যেখানে মেরুদণ্ডের শুরু, উত্তমাঙ্গ এবং অধমাঙ্গ শরীরের এই দুই অংশের সীমানা, সেখানে দক্ষ হাতে পেটালে যথাসময়ে প্রহৃত ব্যক্তির হেঁচকি উঠতে থাকে, এই হেঁচকি অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা থাকে। হেঁচকি তোলার এই মারকেই বলে কেঁচকি।

সুদর্শন স্যারকে দেখে কেঁচকি মার মুলতুবি রেখে তাড়াতাড়ি দারোগাবাবু এগিয়ে এলেন, স্যার, আপনি এখানে?

.

তিনটি কাগজের তিন রকম খবর পাশাপাশি বিশ্লেষণ করতে করতে আজ সুদর্শনবাবু পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা বেশ জটিল। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হল, এক বৃদ্ধ স্বহস্তে নিজের অফিসে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে আনাড়ির মতো ধরা পড়ে গিয়েছেন।

কিন্তু কেন তিনি এরকম করলেন? সুদর্শনবাবু ঠিক করলেন, ঘটনাস্থলে যাবেন। কী দুঃখে, কতটা দুঃখে সেই বৃদ্ধ নিজের অফিসে আগুন লাগাতে পারেন–সুদর্শনের সমবেদনাপূর্ণ বিশ্লেষণের জন্যে পরিপূর্ণ তথ্য প্রয়োজন। তিনি ঠিক করলেন, নিশ্চয় ঘটনাস্থলে যাবেন। কালকেই যাবেন।

এরপর একটু ভাবলেন। গেলে দেরি করা উচিত নয়। আজকেই যাওয়া উচিত। আবার ভাবছেন খোঁজখবর করতে গিয়ে আবার ঝামেলার মধ্যে না পড়েন। তিনি যে নিতান্তই মানবিক কৌতূহলবশত এধরনের খোঁজখবর নিচ্ছেন এ কথা সকলকে বোঝানো কঠিন।

ঠিক এই সময়ে সামনের দরজায় দ্রুত এবং ব্যস্ত করাঘাতে চিন্তায় ছেদ পড়ল অধ্যাপক সেনের। ধাক্কার চোটে দরজা ভেঙে যেতে পারে তাই তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন।

একতলার সামনের দিকের এই ঘরটা এ বাড়ির বাইরের ঘর। এখানেই অধ্যাপক সেন চা খান, খবরের কাগজ পড়েন, লেখাপড়া করেন। ছাত্র-ছাত্রীরা এলে তাদের সঙ্গে কথা বলেন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেন।

একতলা-দোতলার দু ঘর-দু ঘর ছোট চার ঘরের বাড়ি। রিটায়ার করার পর বাইরের ঘরটায় আশ্রয় নিয়েছেন সুদর্শনবাবু। শুধু স্নান-খাওয়া এবং শোয়ার জন্যে ভেতরে যান। ভেতরে গেলেই নানা ঝামেলা। এখুনি বাজারে যাও, ডাক্তার ডাক, না হলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে খবর দাও। এধরনের কাজ পছন্দ নয়, অবসরপ্রাপ্ত অকৃতদার অধ্যাপকের। ভ্রাতুস্পুত্রর সঙ্গে থাকেন। মাসের শেষে পেনশন থেকে চার হাজার টাকা ভ্রাতুস্পুত্রবধূর হাতে তুলে নিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে বাইরের ঘরে অবসরজীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন। সাধারণত কেউ তাঁকে বিশেষ ঘাঁটায় না। তিনি নিরিবিলিতেই থাকেন।

তবে একটা কাজ তাঁকে করতেই হয়। সেটা হল এই বাইরের ঘরের দরজা খোলা আর বন্ধ করা। কেউ এ বাড়িতে আসতে গেলে বা এ বাড়ি থেকে যেতে গেলে এই একটা দরজাই ভরসা।

যাচ্ছি। যাচ্ছি। বলে চেঁচিয়ে বাইরে যে ধাক্কা দিচ্ছিল তাকে নিবৃত্ত করে সুদর্শন গিয়ে বাইরের ঘরের দরজা খুললেন। সঙ্গে সঙ্গে জিনসের প্যান্ট এবং লাল-নীল স্ট্রাইপ শার্ট পরিহিতা এক উদ্ভিন্নযৌবনা অষ্টাদশী দুই হাতে তার নরম শরীরের মধ্যে সুদর্শনকে জাপটিয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, ও দেড়তলার মামা, দাদুকে যে পুলিশ নিয়ে গেছে।

দেড়তলার মামা

এই পর্বে প্রবেশের মুখে দেড়তলার মামা এবং আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলি পরিষ্কার করে না বললে পাঠক-পাঠিকার প্রতি অন্যায় করা হবে।

এই মাত্র প্রবীণ অধ্যাপককে দেড়তলার মামা সম্বোধন করে যে বিস্ৰস্তবসনা এই বাইরের ঘরে এবং কাহিনিতে প্রবেশ করল, তার নাম ঝিমলি, সেই ঝিমলির মাতামহের বাড়ির দেড়তলার ঘরে প্রথম জীবনে বেশ কয়েক বছর সুদর্শনবাবু ভাড়া ছিলেন। মফস্সল থেকে এম.এ. পাশ করে কলকাতায় এসে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময়ে দেড়তলার বড়সড় ঘরটিতে ডেরা বাঁধেন। অনেক পরে, সাত ঘাটের জল ঘেঁটে অবশেষে একসময় দোতলা বাড়িতে ঠাঁই জুটেছে।

তা, এই বাড়ির দোতলায় বাড়িওলা তারিণীবাবু থাকেন। দেড়তলা মানে মেজানিন ফ্লোরে সুদর্শনবাবু ছাড়াও একতলায় আরও দু-তিন ঘর ভাড়াটে ছিলেন। বাড়িটা মানিকতলা অঞ্চলে।

সুদর্শনবাবুর মনে আছে ও বাড়িতে কেউ তাঁকে নাম ধরে ডাকত না। তারিণীবাবু এবং তাঁর স্ত্রী তাঁকে একটু স্নেহের সঙ্গে দেড়তলার ছেলেটি বলতেন। তখনও বর্তমান ঝিমলির মা রমা বেশ ছোট, আট-দশ বছর বয়স হবে। সে সুদর্শনবাবুর খুব ন্যাওটা ছিল। দেড়তলার দাদার চারপাশে ঘুরঘুর করত।

চিরকুমার সুদর্শনবাবুর এখন মনে পড়লে হাসি পায়, রমা কলেজে পড়ার সময় একবার তার সঙ্গে বিয়ের তোড়জোড় হয়েছিল। সেই সময়েই প্রায় জোর করেই সুদর্শনবাবু ওখান থেকে উঠে একটা মেসে চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বাড়িওলা তারিণীবাবু সুদর্শনবাবুর নিয়মিত খোঁজখবর রেখেছেন, তা তিনি যেখানে যখন থেকেছেন। এমনকী সুদর্শনবাবুর কলেজেও গেছেন। দরকারে এবং অদরকারে। সুদর্শনবাবুকেও ও বাড়িতে যেতে হয়েছে। রমার বিয়ের আগে পর্যন্ত রমা তাঁকে নিয়মিত ভাইফোঁটা দিয়েছিল, শুধু যে সময় রমার সঙ্গে বিয়ের কথা উঠেছিল সেই দু-এক বছর বাদ দিয়ে।

এ ছাড়া নববর্ষ, বিজয়া দশমী, উৎসবে-অনুষ্ঠানে তারিণীবাবুর বাড়িতে অবারিত দ্বার সুদর্শনের।

তিরিশ পঁয়তিরিশ বছর কম সময় নয়। রমা বড় হল। রমার বিয়ে হল। তারিণীবাবুর স্ত্রীকে, যদিও বয়সের তেমন ব্যবধান ছিল না, সুদর্শন অন্যান্য ভাড়াটের দেখাদেখি মাসিমা বলতেন। সেই মাসির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে রমার বিয়ের বাজার করলেন। এমনকী রমার বিয়েতে সাত পাকের সময় পিড়ি পর্যন্ত ধরেছিলেন।

সেই রমা বিয়ে হয়ে দিল্লি চলে গেল। পরে একদিন বিধবা হয়ে শিশুকন্যা ঝিমলিকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এল। ঝিমলি একেবারে ছোটবেলার রমার মতো দেখতে, তারও একই দোষ, সেও সুদর্শনের খুব ন্যাওটা। কবে সুদর্শন তারিণীবাবুর বাড়ির দেড়তলায় থাকতেন সেই সূত্রে রমা তাঁকে দেড়তলার দাদা বলত, এখন রমার মেয়ে ঝিমলি তাঁকে দেড়তলার মামা বলে।

.

এতক্ষণ এ গল্পের আশেপাশের চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে অনেক কিছু বলা হল কিন্তু এই গল্প যাঁর জন্যে, এই গল্পের যিনি মূল ও মুখ্য চরিত্র সেই তারিণীবাবু সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয়নি।

এ কাহিনিতে তারিণীবাবুর পদবি বা উপাধি অপ্রয়োজনীয়। অশীতিপর সুস্থ, সচল, কর্মময় বাঙালি একালে বিরল। সেদিক থেকে তারিণীবাবু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।

মানিকতলার মোড়ের কাছে একটা ছোট বাড়ি আর বউবাজারের কালীবাড়ির পশ্চিমে একটা দুশো বছরের পুরনো গলিতে ভাঙা তিনতলা বাড়ির পুরো একতলা জুড়ে, তারিণীবাবুর পৈতৃক ব্যবসায় ভারত স্টেশনার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স।

চিরকাল অবশ্য এ নাম ছিল না, প্রথমে নাম ছিল, ইম্পিরিয়াল স্টেশনার্স। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নাম হয় ভিক্টরি সাপ্লায়ার্স। পরে চল্লিশের দশকে মুসলিম লিগের আমলে নাম পালটিয়ে করা হয়, মুন অ্যান্ড স্টার স্টেশনার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স। তবে গত পঞ্চাশ বছর ধরে ভারত স্টেশনার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স নামটি চলছে।

মধ্য কলকাতায় বিবাদী বাগের কাছাকাছি অঞ্চলে ওই রকম কোম্পানি অনেক আছে। এগুলি অধিকাংশই বাঙালি মধ্যবিত্তের পুরনো ব্যবসা। এদের কাজ হল বিভিন্ন সরকারি এবং সওদাগরি দপ্তরে অফিসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, কলম পেনসিল, আলপিন থেকে আলমারি–যা কিছু একটি অফিসের প্রয়োজনে লাগে এইসব সরবরাহ করা। ছোটখাটো ছাপার কাজ, ফর্ম, মেমো, প্যাড, ভিজিটিং কার্ড, এমনকী বার্ষিক রিপোর্ট পর্যন্ত এইসব কোম্পানির মাধ্যমে মুদ্রিত হয়।

সাদা বাংলায় এর নাম সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। এঁরা বাজার থেকে জিনিস সংগ্রহ করে বিভিন্ন অফিসে তাদের চাহিদামতো সরবরাহ করেন। কেনাবেচার মধ্যে যে ফারাক থাকে সেইটাই লাভ।

.

আজ সকালে হঠাৎ বিপর্যস্ত এবং উত্তেজিত অবস্থায় ঝিমলিকে বাড়িতে আসতে দেখে সুদর্শনবাবু বুঝলেন নিশ্চয়ই কিছু একটা বড় রকমের গোলমাল হয়েছে তারিণীবাবুর বাড়িতে।

 সোফায় বসিয়ে ভেতরের ঘর থেকে এক গেলাস জল এনে ঝিমলির হাতে দিয়ে বললেন, আগে জল খেয়ে নে। তারপর কী হয়েছে শুনছি।

গলা-পিঠ আর মুখের ঘাম রুমাল দিয়ে আলগোছে মুছে নিয়ে ঝিমলি বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে, দেড়তলার মামা। মা আমাকে তোমার কাছে পাঠাল।

মুখোমুখি বসে ঝিমলির মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শনবাবুর অনেকদিন আগের সব কথা মনে পড়ল। ঝিমলির মা রমা এই বয়সে ঠিক এই রকমই দেখতে ছিল। এই বয়সেই রমার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা উঠেছিল।

হাতের গেলাসের জলটা কিন্তু খেল না ঝিমলি। একটু বসেই উঠে পড়ল, সুদর্শনবাবুর হাত ধরে টানল। বলল, দেরি করা যাবে না। আমাদের খুব বিপদ। তুমি আমার সঙ্গে চলো। মা কী করবে বুঝতে পারছে না।

কী হয়েছে? কী করবে? আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না। ব্যাপারটা কী আগে বল তো?

 ঝিমলি বলল, সাংঘাতিক ব্যাপার। দাদুকে কাল পুলিশ ধরেছে।

অবাক হয়ে সুদর্শনবাবু বললেন, তারিণীবাবুকে পুলিশে ধরেছে? কেন?

আমরা তা জানি না, ঝিমলি বলল, তবে থানা থেকে খবর দিয়েছে, দাদু নাকি অফিসঘরে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই সময় তাঁকে লোকজনেরা ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

ঝিমলির কথা শুনে সুদর্শনবাবুর আজ একটু আগে পড়া অগ্নিসংযোগের সংবাদগুলি মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলিয়ে, খবরের কাগজ তিনটে হাতে নিয়ে তিনি ঝিমলির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন।

শেষ কথা

অধ্যাপক সুদর্শন সেনের বর্তমান বাসা থেকে তাঁর প্রাক্তন বাসা, ঝিমলির মাতামহ তারিণীবাবুর বাড়ি খুব দূরে নয়। ট্যাক্সিতে বড়জোর মিনিট দশেক লাগে।

ট্যাক্সি থেকে নামামাত্র ঝিমলি দৌড়ে গিয়ে মাকে খবর দিল যে, দেড়তলার মামা এসেছে।

রমা বোধহয় এতক্ষণ নীরবে চিন্তা করছিল। এবার অধ্যাপক সেনের আগমনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ ধরে হাউমাউ করার সুযোগ মেলেনি।

সুদর্শনবাবুরা আসবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ট্যাক্সির পিছনে একটি পুলিশভ্যান থামে। তার মধ্য থেকে তারিণীবাবুকে সঙ্গে করে একজন পুলিশ কর্মচারী নামেন। তিনি বাইরের ঘরে ঢুকে রমার কাছে তারিণীবাবুকে সমর্পণ করে বললেন, বুড়ো কর্তার মাথার গোলমাল হয়েছে। না হলে কেউ নিজের অফিসে আগুন লাগাতে যায়।

ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন, অধ্যাপক সেন একটু বিচলিত কণ্ঠে বললেন, বহু ধন্যবাদ। কিন্তু কোনও দিন কোথাও এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না যে, থানা থেকে মুক্ত আসামিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

এই কথা শুনে পুলিশের ভদ্রলোক নিজের বুকের একটা ব্যাজের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, দেখতে পাচ্ছেন না, জনসংযোগ সপ্তাহ চলছে? ভদ্রলোক রাগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন।

এদিকে তারিণীবাবুর ভয়াবহ বিধ্বস্ত অবস্থা। তাঁর এই সাতাত্তর বছর বয়সে জীবনের প্রথম হাজতবাস সে খুব সামান্য ব্যাপার নয়। মারধর না করুক, সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় মেঝেতে বসে, এক পাল চোর-গুণ্ডার সঙ্গে বেশ তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে।

 একটু বসে ধাতস্থ হয়ে বাথরুমে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে এলেন তারিণীবাবু। রমা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এরই মধ্যে আলু আর লুচি ভেজে ফেলেছে। তারিণীবাবু বাইরের ঘরে আসতে তাঁর সঙ্গে জলখাবার খেতে খেতে সুদর্শনবাবু সঙ্গে আনা খবরের কাগজ তিনটে তারিণীবাবুকে দেখিয়ে বললেন, আপনার কীর্তিকলাপ সবই এইসব কাগজে প্রকাশিত হয়েছে।

তারিণীবাবু ওই সংবাদ শুনে বিশেষ বিচলিত হলেন বলে মনে হল না। শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, নাম-ধাম কিছু দিয়েছে নাকি?

সুদর্শনবাবু বললেন, না তা নয়? কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী?

সুদর্শনবাবুর প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে তারিণীবাবু আবার প্রশ্ন করলেন, তোমরা জানলে কী করে?

সুদর্শনবাবু বললেন, আমাকে রমা জানিয়েছে। রমাকে জানিয়েছে বোধহয়…।

কথা শেষ হওয়ার আগে রমা বলল, আমাকে তো কেউ কিছু কাল বলেনি। হাসপাতালে ফোন করেছি। লালবাজারে ফোন করেছি। অবশেষে আজ সকালে খবর পেলাম তোমাকে পুলিশ ধরেছে।

পুলিশ ধরেছিল। তা ছেড়েও তো দিয়েছে। খুব জব্দ করা গেছে পুলিশকে।তারিণীবাবু হাসতে হাসতে বললেন।

মূল ঘটনাটা কী সেটা জানার জন্যে খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়লেন সুদর্শন। কিন্তু কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? চট করে কোনও কিছু তারিণীবাবু কবুল করবেন বলে মনে হচ্ছে না।

অবশ্য একটা সুবিধে হয়ে গেল, অন্য ভাবে।

একটু আগে ঝিমলি বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাজার থেকে ফিরে রান্নাঘরে বাজারটা নামিয়ে দিয়ে এসে সে বলল, দেড়তলার মামা, তুমি দুপুরে এখান থেকে খেয়ে যাবে। তারপর লোভ দেখাল, চিতলমাছের পেটি এনেছি। বড় বড় পেটি। দাদুর ফিরে আসা সেলিব্রেট করতে হবে।

.

দাদুর ফিরে আসা ভালই সেলিব্রেট করা হল।

রমা ভাল রান্না করে, একেবারে ওর মায়ের মতো। প্রথম যৌবনে প্রবাসের দিনে রমার মায়ের রান্না কারণে-অকারণে কতবার যে খেয়েছেন সুদর্শন। সেসব স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে।

আজ রমার রান্না মটরের ডাল ছড়ানো আদাবাটা মাখা লাউয়ের তরকারি, কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা টমাটো দিয়ে মাখো মাখো রাঙা আলু আর রাঙা কুমডোর যুগলবন্দি, হালকা সরষেবাটা দিয়ে চিতল মাছের ঝোল আর সব শেষে গুড়, লঙ্কা, গন্ধরাজ লেবুর রস আর খোসা ছাড়ানো সেদ্ধ কাঁচা তেঁতুলের অম্লমধুর স্বাদ, পুরো মধ্যাহ্নভোজন ব্যাপারটা অনির্বচনীয় করে তুলেছিল।

এই সুখাদ্যের জন্যেই হয়তো, তারিণীবাবু শেষ পাতে তেঁতুলের চাটনি চাটতে চাটতে সব কথা বলে ফেললেন।

সেসব কথা গুছিয়ে বলা যাবে না। সময়াভাব, স্থানাভাব আছে।

তা ছাড়া সব সময় সব কথা বলারও কোনও প্রয়োজন নেই।

এই কাহিনির জন্যে যেটুকু প্রয়োজন শুধুমাত্র সেটুকু বললেই যথেষ্ট।

আর দেরি নয়, এখ

আজ কিছুদিন হল তারিণীবাবুর ভারত সাপ্লায়ার্স কোম্পানির ব্যবসা ভাল চলছে না। এ জাতীয় সব ব্যবসারই এখন খারাপ অবস্থা।

ভারত সাপ্লায়ার্সের শতকরা নব্বই ভাগ কাজ সরকারি অফিসগুলির সঙ্গে।

আজ কয়েক বছর হল সরকারি অফিসগুলো থেকে বিলের পেমেন্ট পেতে খুব দেরি হচ্ছে। আগে সারা বছরের বিলের পেমেন্ট আর্থিক বছরের শেষে একত্রিশে মার্চের মধ্যে পাওয়া যেত। তারপরে আগের বছরের বিলের পেমেন্ট পরের বছরের মার্চ মাসে পাওয়া যেত।

আজকাল আর সেসব ব্যাপার নেই। কোন বিলের টাকা কবে পাওয়া যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

আগে যেমন এ বছরের বিল এ বছরেই পাওয়া যেত। না হলে, বড়জোর সামনের বছরে। কিন্তু আজকাল পাঁচ-সাত বছরেও বিল পাশ হয় না। তারিণীবাবুর হিসেব এরকম, তিনি এখনও চুরানব্বই-পঁচানব্বই সালের বিলের পেমেন্ট পাননি। কবে পাবেন জানেন না।

তার মানে সারা বছরের পেমেন্ট বাকি। ভারত সাপ্লায়ার্সের মাত্র দশ বারো জন কর্মচারির মাইনের টাকা সংগ্রহ করতেই তারিণীবাবু হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। দুয়েকটা বেসরকারি সংস্থার কাজ হাতে আছে, খোলা বাজারের কেনাকাটায় কিছু কমিশন থাকছে। কোনও রকমে চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারিণীবাবু, কিন্তু তাঁরও সাপ্লায়ার্স বোধহয় আর জোড়াতালি দিয়ে চলবে না।

তারিণীবাবুর অফিসের ম্যানেজার স্বর্ণেন্দু নামে এক বি.কম পাশ যুবক। বেশ চটপটে এবং কাজের ছিল ছেলেটা, কিন্তু সরকারি অফিসের বিল আদায়ে মোটেই সুবিধে করতে পারছে না। তা ছাড়া আজ কয়েক মাস হল তহমিনা নামে একটি লাজুক মেয়েকে এমপ্লয়মেন্ট টাইপিস্ট পদে নিযুক্ত করেছেন।

সারাদিন এই তহমিনার সঙ্গে স্বর্ণেন্দুর কী সব গুজগুজ, ফুসফুস। তার আর কোনও কাজেই মন নেই। তাকে দিয়ে বিল আদায়ের কাজ অসম্ভব।

 জগন্ময়বাবু আছেন পুরনো ক্যাশিয়ার। আগে তিনিও প্রয়োজনে বিলের তাগাদা দিতে যেতেন। কিন্তু কোমরে বাত হওয়ায় আজকাল আর বিশেষ হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। কোনও রকমে অফিসে এসে বসে থাকেন, আর সদাসর্বদা ছোট ছোট স্লিপে কী সব হিসেব করেন।

এ ছাড়া বাকি ছয়-সাতজন তারা সবাই ধান্দায় ঘুরছে। অধিকাংশই বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু কাউকে বলা যাবে না। কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বও দেওয়া যাবে না। এদিকে মাঝেমধ্যেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ করতে করতে সরকারি হারে মহার্ঘভাতা দাবি করে চেঁচায়। কোম্পানির টাকা কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে এরা যদি একটুও ভাবত।

ভাবতে হয় তারিণীবাবুকেই। তাই আজকাল তিনি নিজেই বিলের তাগাদায় যান। বিভিন্ন সরকারি অফিসে ঘোরেন।

সম্প্রতি সরকারি অফিসগুলিতে তাড়াতাড়ি কাজ হওয়ার একটা চেষ্টা চলেছে। কিন্তু বিল পেমেন্টের ক্ষেত্রে তাতে কোনও লাভ নেই। বিল পাশ হলে কী হবে, সরকারের ঘরে অর্থ না থাকলে বিলের টাকা আসবে কোথা থেকে।

আজকাল বিভিন্ন অফিসে একটা নতুন জিনিস দেখতে পাচ্ছেন তারিণীবাবু। খুব পছন্দ হয়েছে তাঁর।

জিনিসটা একটা বিজ্ঞপ্তি। বড় বড় হরফে হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি এবং উর্দুতে লেখা

আর দেরি নয়, এখনই।
যার যা করবার আছে
এখনই করে ফেলুন।

পোস্টারের মতো মুদ্রিত এই বিজ্ঞপ্তিগুলি একটা অফিসের দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় সেই অফিসের দুজন পিয়ন আঠা দিয়ে লাগাচ্ছিল। তাদের কাছে চাইতে তারা সানন্দে একটা পোস্টার তারিণীবাবুকে দিয়ে দিল।

পরের দিন সকাল সকাল অফিসে গিয়ে ভেতরের দিকে একটা দেয়ালে এই পোস্টারটি স্বহস্তে তারিণীবাবু লাগালেন। অফিসে এসে সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল।

তারিণীবাবু সবাইকে ঘুরে ঘুরে বললেন, বিজ্ঞপ্তিটা খেয়াল রাখবেন। হাতের কাজ মোটেই ফেলে রাখবেন না। যার যা কাজ এখনই করে ফেলুন। এখনই।

.

তারিণী কল্পনাও করতে পারেননি, এই বিজ্ঞপ্তির পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে।

তাঁর খাস আর্দালি রামলাল বছর খানেক হল দু মাসের ছুটি চাইছিল দেশে যাওয়ার জন্যে। ওই বিজ্ঞপ্তি দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে, অন্যান্যবারের মতো তারিণীবাবু যাতে বাধা দিতে না পারেন তাই কোনও রকম ঝুঁকি না নিয়ে টেবিলে একটি ছুটির দরখাস্ত রেখে দেশে রওনা হয়ে গেল।

এর অল্প পরেই আর একটা দরখাস্ত এল, তাতে যুগ্ম স্বাক্ষর স্বর্ণেন্দু এবং তহমিনার। দরখাস্তে লেখা আছে।

শ্রদ্ধেয় স্যার,
আর দেরি নয়, এখনই। বিজ্ঞপ্তি পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা এত দিন যা নিয়ে ইতস্তত করছিলাম সেই বিয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে যাচ্ছি। বিয়ে, হনিমুন ইত্যাদি বাবদ আমরা কেউ মাস দেড়েক অফিসে আসতে পারব না।
ছুটি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করি,
তহমিনা এবং স্বর্ণেন্দু।

.

এর পরে আরও সব দরখাস্ত। বিজ্ঞপ্তি পাঠ করে সবাই উজ্জীবিত হয়েছে যা করার আছে এখনই করে ফেলার জন্য। সবচেয়ে ভয়ানক চিঠি ক্যাশিয়ারবাবুর। সেই যে কাগজের টুকরোগুলোর কী সব খুচখাচ হিসেব রাখতেন, সেইসব হিসেব আলপিন দিয়ে গেঁথে সঙ্গে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন।

 কোম্পানির ক্যাশখাত অনুযায়ী নগদ যে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা থাকার কথা তাহার মধ্যে বেয়াল্লিশ হাজার টাকা আমি ইতিমধ্যে তছরুপ করেছি, হিসাব সঙ্গের স্লিপগুলিতে আছে। বাকি আটষট্টি হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে গেলাম। আমাকে খুঁজিবার চেষ্টা করিবেন না।

দুপুরের মধ্যে অফিস প্রায় ফাঁকা। যে চার-পাঁচজন ছিল তারা একজোট হয়ে তারিণীবাবুকে ঘেরাও দিল, সরকারি হারে মহার্ঘভাতা দিতে হবে, দিতেই হবে। আজ থেকেই দিতে হবে। তারা তারিণীবাবুকে দিয়ে কবুল করিয়ে অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টার পরে গেল।

ঘেরাও থাকা অবস্থায় চুপচাপ বসে বসে তারিণীবাবু নিজেও কী করবেন স্থির করে ফেলেন।

আজ এখনই করতে হবে, আর দেরি নয়।

কাজটি সাংঘাতিক। অগ্নিসংযোগ। আজ পঁচিশ বছর ধরে বছরে বছরে দশ হাজার টাকা করে ফায়ার ইনসিওরেন্স প্রিমিয়াম দিয়ে আসছেন। কখনও এক পয়সা উসুল হয়নি। এবার সুযোগ এসেছে, অফিস পুড়ে গেলে অগ্নিবিমাবাবদ লাখ পনেরো টাকা পাওয়া যাবে।

যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। অফিসের প্যাসেজে, চা করার সাজসরঞ্জাম, জনতা স্টোভ, কয়েক বোতল কেরোসিন তেল আছে। এক বোতল তেল নিয়ে দেয়ালে যেখানে আর দেরি নয়, পোস্টারটি সেঁটেছিলেন সেখানেই প্রথমে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগাতে যান। দুঃখের বিষয়, পাশের গঙ্গা কেমিক্যালস কোম্পানির দারোয়ান ব্যাপারটা দেখে ফেলে।

তারপর হইচই পুলিশ ইত্যাদি। তবে পুলিশ জেরা করার পরেও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তারিণীবাবু ইন্সিওরেন্সের টাকার জন্যে আগুন লাগাচ্ছিলেন। পুলিশ ভেবেছে, এটা বাণিজ্যে অসফল বৃদ্ধের পাগলামি।

.

তারিণীবাবুর কাহিনি শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। ঝিমলি গিয়ে বিকেলের চা করে নিয়ে এল।

চা খেয়ে ধীরে ধীরে সুদর্শন সেন বাড়ির দিকে ফিরলেন। তাঁর জীবনে এই প্রথম একটা সংবাদ যার চার দিকই তিনি দেখতে পেয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *