একটি মহাদেশের জন্য

একটি মহাদেশের জন্য

আগামীকাল মধ্যরাত্রে ট্রেনে এই মফস্সল শহর থেকে সরকারি কলেজের ইতিহাসের প্রধান ড. প্রফুল্ল ঘোষাল ও তাঁর স্ত্রী করবী চলে যাবেন। ট্রেনে চার ঘণ্টার পথ, বিহার সীমান্তে একটি ক্ষুদ্র কলেজে অধ্যক্ষের পদ নিয়ে যাচ্ছেন। বিকেল থেকে ওঁরা গোছগাছ করছেন। আসবাব এবং ব্যবহার্য জিনিস নামমাত্র। এখানে এসে যে আসবাব কিনেছিলেন সেগুলি ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন না। বইয়ের ব্যাক ও টেবিলটি দিয়ে যাবেন বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাইমারি বিভাগের হেডমিস্ট্রেস কুমারী গীতা বিশ্বাসকে; চৌকি ও টুল নেবে মুনসেফ অরুণ সোম; বেঞ্চ ও চেয়ারগুলি চেয়েছে এখানকার বৃহত্তম ওষুধের দোকান ও আড়তের মালিক পরিমল সাঁপুই; উকিল মৃগাঙ্ক বসুমল্লিক মৃদু হেসে মাথা নেড়েছে। দু-বছর এখানে থেকে ঘোষাল দম্পত্তির সঙ্গে এই ক-জনেরই শুধু পরিচয়।

বিকেল উতরে গেছে। ঘরে আলো জ্বলছে। প্রফুল্ল র্যাক থেকে বইগুলি নামিয়ে মেঝেয় রাখছেন। করবী সেগুলি গুছিয়ে একটা চটের থলিতে ভরছেন। প্রফুল্ল নাতিউচ্চ, বলিষ্ঠদেহী, কাঁচাপাকা অবিন্যস্ত চুলে মাথাভরা। চশমার কাচ পুরু। চোয়াল ভারী ও চওড়া। কথা বলেন ধীর ও মৃদু স্বরে; আচরণে শান্ত ও গম্ভীর। ছাত্ররা কলেজে ওঁকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে সরে যায়।

পরিচিত কয়জনেই সন্ধ্যা বেলায় শহরের প্রান্তবর্তী এই এক তলা বাড়িতে গল্প করতে আসে। যেদিন কেউ আসে না ওঁরা স্বামী-স্ত্রী বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাসন্তীর মা রাত্রির আহার ঢাকা দিয়ে রেখে গৃহে ফেরার সময় অস্ফুটে মা যাচ্ছি বলে চলে যায়। করবী তখন বলে, গেটটা বন্ধ করে যেয়ো। করবীর কণ্ঠস্বর মিষ্টি হাসিটিও। হাসলে দুই গালে টোল পড়ে। সে ছিপছিপে, দীর্ঘাঙ্গী, প্রফুল্লর সমানই লম্বা। বোধ হয় উচ্চতা লুকোবার জন্যই ঈষৎ কুঁজো হয়ে থাকে। চুল কিছু পেকেছে। শ্যামবর্ণ গাত্রত্বক তৈলমসৃণ ও উজ্জ্বল, দীর্ঘ চোখ জোড়ায় কিছুক্ষণ তাকালে দর্শক ক্লান্তি ও বিষাদ অনুভব করে। প্রথম স্বামী মারা যাবার দেড় বছরের মধ্যে ওর দুটি ছেলেই মারা যায়। বড়োটি বিমানবাহিনীতে শিক্ষার্থী পাইলট ছিল, পুনার কাছে তার বিমান ভেঙে পড়ে; ছোটোটি ডায়মণ্ডহারবারে কলেজ-বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে যায়। এর ছয় মাস পর করবী তার কলেজের সহপাঠী প্রফুল্ল ঘোষালকে বিয়ে করে এই মফসসল শহরে আসে।

এভাবে হবে না, জ কুঁচকে প্রফুল্ল বলল। বইগুলো বাঁধতে হবে, দড়ি আনি।

রান্নাঘরের পিছনে কলঘরসংলগ্ন অন্ধকার কুঠুরিটা অব্যবহৃত হঠাৎ দরকারি বিবিধ জিনিসে ভরা। সেখান থেকে প্রফুল্ল চেঁচিয়ে বলল, টর্চটা আননা তো, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

টর্চ নিয়ে আসার সময় করবীর মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল। রান্নাঘরে বাসন্তীর মা ব্যস্ত। কুঠুরির সামনে এসে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে করবী বলল, এই যে!

প্রফুল্ল পাশ থেকে নিঃসাড়ে দ্রুত ওর গলায় দড়ির ফাঁস পরিয়ে টান করে এঁটে ধরল। করবী ফাঁসটা আলগা করার চেষ্টায় দশ-বারো সেকেণ্ড টানাটানি করে ক্রমশ শিথিল হতে শুরু করল। প্রফুল্ল তখন চাপাস্বরে হেসে উঠে এটা চৌত্রিশ বলে ধীরে ধীরে ওকে ছেড়ে দিতেই করবী কাত হয়ে দেওয়ালে হেলে পড়ল। ঠিক এই সময়ই বাইরের বারান্দা থেকে উচ্চ পুরুষকণ্ঠে কে বলল, ডক্টর ঘোষাল আছেন নাকি?

প্রফুল্ল তাড়াতাড়ি বৈঠকখানার দিকে যেতে যেতে বলল, অরুণবাবু নাকি? আসুন আসুন।

প্রফুল্ল দরজা খুলে দিতেই টর্চ নিভিয়ে অরুণ সোম বলল, মিরাও সঙ্গে এল দেখা করে যেতে। বৈঠকখানার ভিতরে এসে বলল, ওরা কেউ আসেনি?

প্রফুল্ল একথার উত্তর না দিয়ে স্মিত হেসে মিরাকে বলল, আসুন, আপনি তো অনেক দিন পর এলেন। করবী বইগুলো গোছাচ্ছে, এখনি আসবে।

ঘোমটা আর একটু টেনে মিরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে তারপর প্রফুল্লকে বলল, রোজই আসব আসব করি কিন্তু বাচ্চাদের জ্বরজারি তো নিত্যি লেগেই আছে। এখানকার দুধ-জল কিছুই ওদের সহ্য হচ্ছে না। ছোটোটা কাল থেকে আবার পড়েছে পেটের অসুখে।

মিরার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ এবং ফ্যাসফেসে। সরু হাতে সোনার চুড়িগুলি এবং শাঁখাটি ঢলঢল করছে। সিঁথির চওড়া সিঁদুর ও কপালের টিপে ওর শুভ্র দেহের রক্তাল্পতা ও শীর্ণতা প্রকট। তুলনায় ছত্রিশ বছরের সুদর্শন অরুণকে অন্তত দশ বছরের ছোটো দেখায়। অরুণ প্রতিদিন ভোরে এক মাইল দৌড়ে এসে আধ সের দুধ খায়, রাতে ইংরেজি ডিটেক্টিভ বই পড়ে এবং নিয়মিত গল্প লিখে সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোয় পাঠায়, দু-একটি ছাপাও হয়েছে।

শুনেছেন তো আজকের ঘটনাটা? চেয়ারে বসে অরুণ বলল। প্রফুল্ল অবাক চোখে তাকাতেই সে উত্তেজিত হয়ে সিগারেট বার করল। স্টেশনের গায়েই সারি সারি দরমার তৈরি রিফিউজিদের যে-দোকানগুলো রয়েছে তার মধ্যে একটা চায়ের দোকানও আছে। প্রায় দেড় মাস আগে সেই দোকানদারের বউ থানায় গিয়ে বলে তার স্বামী তিন দিন যাবৎ নিখোঁজ। পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখল ওখানকার একটা যুবতী বিধবাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং দুই আর দুইয়ে চার ধরে নিয়ে ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা পড়ে। আজ সকালে দোকানের মাটির মেঝে খুঁড়ে দুটো লাশ পাওয়া গেছে। দুটোরই মাথার খুলির পিছন দিকটা চুরমার অর্থাৎ পিছন থেকে ভারী কিছু দিয়ে…

করবীকে ঢুকতে দেখে অরুণ থেমে গেল। সিগারেটের কাগজ ও তামাক প্রফুল্লর হাতে তুলে দিয়ে করবী হেসে মিরাকে বলল, বাচ্চারা কেমন আছে? আপনার শরীরও তো ভালো মনে হচ্ছে না।

শোনামাত্র খুশিতে নড়েচড়ে বসল মিরা। কিন্তু অরুণের বিরক্ত চোখে চোখ পড়ামাত্র নিরাসক্ত স্বরে বলল, আমি ভালোই আছি। কাল আপনারা চলে যাবেন তাই দেখা করতে এলুম।

অরুণ ইতিমধ্যে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। প্রফুল্ল মাথা নীচু করে সিগারেট বানাতে ব্যস্ত। অরুণ গলাখাঁকারি দিল। করবী বলল, গল্পটা শেষ না করা পর্যন্ত অরুণবাবু স্বস্তি পাবেন না, বরং শেষ করেই ফেলুন।

গল্প নয় মিসেস ঘোষাল, ফ্যাক্ট! আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। বউটাকে অ্যারেস্ট করে থানায় যখন ইন্টারোগেট করা হচ্ছে তখন আমি ছিলাম, এসডিও সাহেবও ছিলেন। নিজে থেকেই স্বীকার করল খুন করেছে। কী বীভৎস ব্যাপার ভাবুন! দোকানটার পিছনে একটা খুপরিতে থাকত আর খুন করে তারই তলায় মেঝের মাত্র দেড় হাত নীচে দুটো ডেডবডি পুঁতে রেখে দেড় মাস তার উপর শুয়েছে। ভাবতে পারেন? অথচ এমন কোয়ায়েটলি সব কথা বলে গেল যেন অরুণ যুৎসই উপমা খোঁজার জন্য মুহূর্তেক অবসর নিতেই মিরা বলল, পাপ কখনো কি চাপা থাকে!

প্রফুল্ল বলল, কার পাপ?

মিরার বসার ভঙ্গিটা কঠিন হয়ে গেল। মেঝের দিকে তাকিয়ে হাত মুঠো করল এবং কাঁপা গলায় বলল, কার আবার, স্বামীর পাপ।

আর যে খুন করল তার বুঝি পাপ হয় না।

চোখ তুলে করবীর দিকে এক বার তাকিয়ে মিরা একটু ভেবে বলল, কী জানি।

তিন জনের কেউ কিছুক্ষণ কথা বলল না। নীরবতা ভাঙার জন্য প্রফুল্ল বলল, অরুণবাবু কাল সকালেই ভারী মালগুলো স্টেশনে পাঠাব বুকিংয়ের জন্য। আপনার চৌকিটা নিতে কালই কিন্তু লোক পাঠাবেন।

অরুণ অন্যমনস্কের মতো মাথা কাত করল। বাইরে গেট খোলার শব্দ হল। গেট থেকে বারান্দা পর্যন্ত প্রায় পনেরো মিটার ইট-বাঁধানো পথের উপর দিযে জুতোর শব্দ এগিয়ে আসতেই অরুণ বলল, পরিমলবাবু।

দশাসই লম্বা মধ্যবয়সি পরিমল সাঁপুই ঘরে ঢুকেই বলল, উকিলবাবু, হেড দিদিমণি, ওরা এখনও আসেনি? একটু আগেই দোকান থেকে যেন দেখলুম দুজনকে রিকশায় আসতে।

শুনেই মুখ কালো হয়ে গেল অরুণের। বলল, আপনি বোধ হয় ভুল দেখেছেন।

আর যা-ই ভুল হোক অরুণবাবু, চোখের ভুল আমার হবে না। আগের মাসেও এক জোড়া বুনো শুয়োর মেরেছি পঞ্চাশ গজ দূর থেকে। আর দুটো চেনা মানুষকে পঞ্চাশ হাত দূর থেকে চিনতে পারব না? পরিমল শেষপর্যন্ত বিরক্তি চেপে রাখতে পারল না।

অরুণ জবাব দিল না। প্রফুল্ল বলল, আজ রোমহর্ষক একটা ব্যাপার নাকি শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে?

পরিমল তাচ্ছিল্যসূচক একটা শব্দ করে বলল, ওরকম আকছারই ঘটে। আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না, দোকানে একজনের আসার কথা। যেজন্য এসেছি বলে নিই, একটা বড়ো প্যাকিং বাক্সে মাল এসেছে, মজবুত খুব। আপনার দরকার লাগে যদি কাল পাঠিয়ে দেব।

ভীষণ দরকার, তাহলে দামি বইগুলো আর থলেয় ভরতে হয় না। করবী উৎসাহভরে বলল।

তাহলে চা খাওয়ান। পরিমল হাত বাড়িয়ে অরুণের সিগারেট প্যাকেটটা তুলে নিল।

রিকশার ভেঁপু বাজল রাস্তা থেকে। অরুণ চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে শরীরটাকে তুলে বাইরে তাকিয়েই আবার বসে পড়ল। পরিমল মুচকি হাসল। মিরা হাত মুঠো করে দেওয়ালে তাকিয়ে রইল।

প্রথমে ঘরে ঢুকল গীতা। ত্রিশের কাছাকাছি বয়স। বাল্যে পোলিওয় ডান পা-টি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ চিকিৎসায় সেরে উঠলেও এখন সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে। এই ঘাটতি অবশ্য দেহের অন্যান্য অংশ মনোরমভাবে পুষিয়ে দিয়েছে। মোটা জ্বয়ের নীচে ওর চোখ দুটি সতত চঞ্চল, ঠোঁট দুটি পুরু এবং টসটসে, নাক চাপা, গলায় রক্তাভ জড়ল। কণ্ঠস্বর ঈষৎ কর্কশ।

গীতার পিছনে পাঞ্জাবি ও ঢোলা পায়জামা পরা মৃগাঙ্ক, রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে বলল, আজ বড্ড গুমোট। ধনী বনেদি পরিবারের সন্তান, প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সি মৃগাঙ্ক স্থূলকায়, টকটকে গায়ের রং, মাথায় অল্প টাক পড়েছে।

ঠিক সময়েই এসেছে গীতা, চা করতে যাচ্ছিলাম আর অরুণবাবুও একটা খুনের গল্প বলছিলেন।

কী খুনের? বলেই গীতা খালি চেয়ারের দিকে এগোল।

বাঃ শোননি? করবী বিস্মিত স্বরে বলল। স্টেশনের ধারে এক চায়ের দোকানের মেঝে খুঁড়ে এক জোড়া লাশ পাওয়া গেছে!

না তো! কী ব্যাপার অরুণবাবু?

মিরা আচমকা উঠে করবীকে বলল, এইসব গল্প দু-বার শুনতে আমার ভালো লাগে না। চা করতে যাবেন তো চলুন, আমিও যাব।

মিরা এবং করবী ঘর ছেড়ে যাবার পরও সবাই ভিতরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল। মৃগাঙ্ক বলল, আমি অবশ্য শুনেছি, কিন্তু এইরকম বীভৎস নোংরা একটা ব্যাপার নিয়ে কোনো মহিলার সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছে হয়নি।

গলাখাঁকারি দিয়ে অরুণ তিক্তস্বরে বলল, এটা যে একটা বীভৎস ভালগার ব্যাপার তা আমি জানি। আমার পয়েন্ট হচ্ছে, একটি মেয়েমানুষ নিজের হাতে খুন-করা দুটি লাশের ওপর দেড় মাস শান্ত অচঞ্চল হয়ে কাটিয়ে দিল। কীভাবে সে পারল? ওই সময় সে নিজেই চায়ের দোকানটা চালিয়েছে, খদ্দেরদের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলেছে, ঝগড়া করেছে, স্বামীর খোঁজ পাচ্ছে না বলে অনেকের কাছে উদবেগ পর্যন্ত প্রকাশ করেছে।

প্রফুল্লর দিকে তাকিয়ে চাপা হেসে মৃগাঙ্ক বলল, এটাকে সাবজেক্ট করেই অরুণবাবু একটা গল্প লিখে ফেলতে পারবেন।

প্রফুল্ল বলল, মন্দ কী, গল্প হয় না অরুণবাবু?

অরুণ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। দ্বিধাজড়িত স্বরে সাবধানে বলল, হতে পারে। তবে এই দেড় মাস যেরকম স্বাভাবিকভাবে কাটিয়েছে তার একটা ব্যাখ্যা, মনের মধ্যে কী ঘটছিল, তার উৎপত্তি কোন উৎস থেকে, এসব না বোঝা পর্যন্ত এ ধরনের সাবজেক্ট নিয়ে গল্প লেখা যায় না।

আমাদের মধ্যে নরহত্যা কেউই বোধ হয় করেনি, তবে প্রাণী হত্যাকারী আছেন একজন। প্রফুল্ল ঘাড় নেড়ে সহাস্যে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, হত্যা করার পর মনের মধ্যে কী কী ব্যাপার ঘটে তিনিই বলতে পারবেন।

আমি কিন্তু মশা মাছি ছারপোকা ছাড়া জীবনে আর কিছু হত্যা করিনি। গীতা নকল গাম্ভীর্য দ্বারা আবহাওয়া লঘু করার চেষ্টা করল।

কিসসু ঘটে না। তখন একটা দারুণ একসাইটমেন্ট হয় বটে, তারপর যে-কে-সেই। পরিমল ঝুঁকে অরুণের সিগারেট প্যাকেট আবার তুলে নিল। জন্তুজানোয়ার মারা আর মানুষ খুন তো এক জিনিস নয়। মানুষ মারার উত্তেজনাটা অনেক দিন থাকে, হয়তো সারা জীবনই, যদি ধরা না পড়ে।

মৃগাঙ্ক মন্থর স্বরে কাউকে উদ্দেশ না করে বলল, এই উত্তেজনার উৎপত্তি কোন উৎস

থেকে?

ঘরটা চুপ করে রইল, এই সময় দূর থেকে পর পর তিন-চারটি বোমা ফাটার শব্দ এল। গীতা বলল, এই এক ব্যাপার শুরু হয়েছে, সন্ধের পর রোজ আওয়াজ করা। কী যে এর মানে, বুঝি না।

নড়েচড়ে বসল অরুণ। এসডিও সাহেবের কাছে শুনলাম, কাল বড়ো তালপুরে জমি দখলের আন্দোলন শুরু হচ্ছে। জোতদাররাও তৈরি আছে। অনেকগুলো লাশ পড়বে মনে হয়।

কাল মিসেস বসুমল্লিককে দেখলাম ফুটবল গ্রাউণ্ডের মিটিং-এ বক্তৃতা দিচ্ছেন। মাঠটা কিন্তু ভরে গেছল। গীতা এই বলে সপ্রশংস চোখে তাকাতে মৃগাঙ্কের মুখে বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল।

অরুণ জানে মৃগাঙ্ক তার স্ত্রীকে নিয়ে আলোচনা একদমই পছন্দ করে না। তাই বলল, পরশু ওঁকে সিদ্ধেশ্বরীতলায় বক্তৃতা দিতে দেখলাম। দারুণ বলেন, লোকেরা খুব মন দিয়ে শুনছিল। কালকে উনিও নাকি বড়ো তালপুরে যাবেন।

সেকী! না না বারণ করে দিন মৃগাঙ্কবাবু। গীতা উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, খুনোখুনি হতে পারে, বলা যায় না।

অরুণ বলল, আমি এরকম একজন ফিয়ারলেস ওম্যান উইথ স্ট্রং পার্সনালিটি—সত্যি বলছি, কখনো দেখিনি। শুনলাম, বটারহাটে সেদিন জমি দখলের যে মারপিট হল, উনি নাকি তখন কাছাকাছিই ছিলেন। যেমন স্পিরিটেড তেমনি পরিশ্রমও করেন দিনরাত। আচ্ছা, ক বছর জেল খেটেছেন উনি মৃগাঙ্কবাবু?

টর্চের ব্যাটারি দুটো বার করে মৃগাঙ্ক তখন খোলের ভিতরটা গভীর মনোযোগে পরীক্ষায় ব্যস্ত। জবাব দিল না। অরুণ খুশি হল এবং বিষগ্ন ভঙ্গিতে বলল, শুনেছি জেল থেকেই নাকি ওঁর শরীর ভেঙে যায়।

পরিমল চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। শেষ টান দিয়ে জানলার বাইরে ছুড়ে ফেলে হঠাৎ বলল, এটা একটা নেশা, বুঝলেন মুনসেফবাবু? পলিটিকসে অনেক ভয় আছে। শিকারে যাই কেন, যেহেতু সেখানে ভয় আছে। জানোয়ার আমাকেও মেরে দিতে পারে। ওই ভয় থেকেই তো আসে উত্তেজনা। তখন ঝাঁঝাঁ করে শরীরের মধ্যে রক্ত ছোটাছুটি করে, ভারি আরাম হয়, নেশা নেশা লাগে। তবে কী জানেন, শিকার তো আর রোজ রোজ করা হয় না। তাহলে আপনি কি বলতে চান, মিসেস বসুমল্লিক… অরুণ যোগ্য একটি শব্দের জন্য প্রফুল্লর দিকে তাকিয়ে দেখল প্রফুল্ল একদৃষ্টে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। তখন সে গীতার দিকে তাকাল।

আমার ধারণা, বাচ্চা থাকলে উনি এসব করতেন না। গীতা গলা নামিয়ে কথাগুলো বলার সময় মৃগাঙ্ক এবং পরিমলকে দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করতে দেখল।

ইয়েস, আমারও তাই মনে হয়, অরুণ হাঁফ ছেড়ে বলল। একটা ভ্যাকুয়াম ওঁর মধ্যে নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে, যেটাকে ভরাবার জন্য উনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

অরুণবাবু, গম্ভীর এবং নিস্পৃহ স্বরে মৃগাঙ্ক বলল, আমরা মোটামুটিভাবে শিক্ষিত এবং রুচির একটা স্তরেও পৌঁছেছি। আমরা নিশ্চয় কিছু কিছু বিধিনিষেধও মেনে থাকি, যেমন অপরের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে অযথা ও অনাবশ্যক আলোচনা প্রকাশ্যে না করা।

অরুণ সকলের মুখের দিকে তাকাল। গীতা বিস্মিত, প্রফুল্ল বিব্রত, পরিমল কৌতূহলী। মুখ নীচু করে অরুণ বলল, আই অ্যাম সরি, আমি মাপ চাইছি।

ঘরে অস্বস্তিকর একটা আবহাওয়ার সঞ্চার হয়েছে। কী করে সেটা কাটানো যায় চার জনেই তা নিয়ে মনে মনে ভাবছে। গীতা হঠাৎ বলে উঠল, এই যাঃ, যেজন্য আসা সেটাই বলা হয়নি এতক্ষণ। কাল রাতে আপনারা দুজন কিন্তু আমার ওখানে খাবেন।

আবার কেন ঝাট করা। প্রফুল্ল আড়ষ্টভঙ্গিতে ক্ষীণ আপত্তি জানাল।

হোক ঝঞ্ঝাট, এক বারই তো। আপনাদের রাতের রান্নার পাট আর তাহলে থাকবে না।

অরুণ ব্যস্ত হয়ে বলল, দিনেও থাকা উচিত নয়। সকালে তাহলে আমার ওখানেই দুটি ঝোল ভাত খেয়ে নেবেন।

না না অরুণবাবু, সকালে আমরা সময় পাব না। অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলার আছে। বইগুলো এখনও বাইরে পড়ে। তা ছাড়া ভারী মালপত্তর বিকেলের মধ্যেই স্টেশনে পাঠিয়ে দেব বুক করার জন্য। পরিমলবাবু আপনার প্যাকিং বাক্সটা কাল কখন পাঠাবেন?

পরিমল কিছু বলার আগে ঘরে ঢুকল করবী এবং মিরা। পিছনে ট্রে হাতে বাসন্তীর মা। ওর হাত থেকে ট্রে-টা নিয়ে টেবলে রাখতে রাখতে করবী বলল, অরুণবাবুর গল্প বলা হয়ে গেছে তো?

গল্প নয় মিসেস ঘোষাল, ফ্যাক্ট। অরুণ ঈষৎ আহত কণ্ঠে বলল, বরং এটার উপর রং দিয়ে একটা গল্প লেখা হতে পারে। আপনি ভাবতে পারেন, একজন স্ত্রীলোক তার স্বামী আর আরেক জন স্ত্রীলোকের মৃতদেহের দেড় হাত উপরে বিছানা পেতে দেড় মাস ধরে শুয়েছে। কী করে পারল? ইয়েস, মাত্র দেড় হাত!

অরুণ থামামাত্র মিরা চাপা কণ্ঠে বলল, এইসব খুনোখুনির গল্প কী করে যে আপনারা শোনেন! কেমন গা-শিরশির করে শুনলে।

মিরার কথাগুলো যেন শুনতে পায়নি এমনভাবে অরুণ বলে চলল— আমি নিজে সেই স্ত্রীলোকটিকে থানায় আজ দেখেছি। অতি স্বাভাবিক মনে হল। একদম উত্তেজনা নেই, ভয়ও নেই। ঘোমটা দিয়ে বসে, যা জিজ্ঞাসা করছে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। একদম নির্লিপ্ত। অথচ দেড় মাস ধরে অপরাধটা লুকিয়ে রেখেছিল, অ্যাকসিডেন্টালি ধরা না পড়লে তো জানাই যেত না।

কী করে খুনটা করল? গীতার কৌতূহলে কিঞ্চিৎ উত্তেজনাও প্রকাশ পেল।

আঃ। মিরা চায়ের কাপ নেবার জন্য করবীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আবার এইসব গল্প।

গীতা ঘাড় ফিরিয়ে মিরার দিকে তাকাল। অরুণ রাগে মুখ লাল করে, অনাবশ্যক গলা চড়িয়ে বলল, পিছন থেকে মাথায় কয়লা ভাঙার লোহা দিয়ে মেরেছিল।

থাক গে এসব আলোচনা। মৃগাঙ্ক হেসে বলল, মিসেস সসামের বোধ হয় ভালো লাগছে না।

সারারাত ধরে গর্তটা খোঁড়ে একটা শাবল দিয়ে।

আমি এখন চলি। দোকানে একজনের আসার কথা। বাক্সটা কাল পাঠিয়ে দেব। পরিমল খালি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ব্যস্ত হয়ে চলে গেল।

ছোটগর্ত, ওরই মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে বডি দুটোকে কোনোরকমে ভরে মাটিচাপা দিয়ে বিছানাটা পেতে ঢেকে রাখে।

ভালো কথা, প্রফুল্ল তাকাল করবীর দিকে। গীতা কাল আমাদের নেমন্তন্ন করেছে। রাত্রে।

ওমা, আমিও তো করবীদিকে রান্নাঘরে বললুম আমাদের ওখানে খাওয়ার জন্য, কাল রাতেই। মিরা উত্তেজিত হয়ে প্রফুল্লর দিকে তাকাল।

অরুণ দাঁতচাপা স্বরে বলল, মিস বিশ্বাস আগে বলেছেন এবং ড. ঘোষাল অ্যাকসেপ্টও করেছেন।

তোমাকে ওর হয়ে ওকালতি করতে হবে না। মিরা ক্ষিপ্তের চাহনিতে স্বামীকে বিদ্ধ করে রাখল কিছুক্ষণ। এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার জন্য গীতা ঝুঁকে মৃগাঙ্ককে বলল, আপনার তো বন্দুক আছে, শিকারটিকার করেন না?

মাঝে মাঝে বেরোই, তাও পাখিটাখি! আসলে আমি খুব ভীতু লোক তো… মৃগাঙ্ক এমনভাবে হেসে উঠল যেটা এখন বিদ্রুপের মতো ধ্বনিত হল। প্রফুল্ল আর করবী অসহায়ভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে লক্ষ করে অরুণ গোঁয়ারের মতো বলল, না, মিস বিশ্বাসের নেমন্তন্নই ওঁরা নেবেন, নেওয়া উচিতও।

কেন, আমার নেমন্তন্ন কী অপরাধ করল? আমি কি রাঁধতে জানি না ওঁর মতে, না লোকের সঙ্গে কথা বলতে কি মিশতে পারি না? বলতে বলতে মিরার ঠোঁটের দুই কোণে থুতু জমে ওঠে।

গীতা কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। প্রফুল্ল জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতে, কঠিন গলায় বলল, সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে একটু বেশিই ছেলেমানুষি হচ্ছে যেন। আমি বরং আমার নেমন্তন্ন উইথড্র করছি।

অরুণ ব্যস্ত হয়ে বলল, সেকী, তা কেন হবে!

আমার স্কুলের কিছু কাজ রয়ে গেছে, আজ চলি। গীতা উঠে দাঁড়াল। সাধারণভাবে হেসেই পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে সে তার পঙ্গু ডান পা টানতে টানতে বেরিয়ে গেল। ওর পায়ের শব্দ গেটের কাছে পৌঁছোবার আগেই মিরা দু-হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে বলে উঠল, তুমি চাও আমার অপমান, আমি বুঝতে পারি, সব বুঝতে পারি।

চুপ করো। কর্কশ স্বরে অরুণ ধমকে উঠল। হিংস্র দেখাচ্ছে ওকে। মিরা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। বাড়ি চলো। অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে কারুর দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিরা ভীত চোখে ঘরের তিনটি লোকের উপর দিয়ে চাহনি বুলিয়ে দ্রুত স্বামীর অনুসরণ করল।

প্রত্যাশিত অপ্রতিভতা কাটিয়ে মৃগাঙ্কই প্রথম কথা বলল, মিসেস সোম অরুণবাবুকে খুব ভয় করেন। তারপর হেসে বলল, অর্থাৎ পরিমল সাঁপুইয়ের যুক্তি অনুযায়ী নেশার ঘোরে আছেন।

প্রফুল্ল তামাক দিয়ে কাগজ পাকাতে পাকাতে মাথা নীচু করে বলল, এটা একটা গতানুগতিক ভয়। নেশা হবার মতো উত্তেজনা এতে নেই। নেশা হয় সেই ধরনের ভয়ে যা দিয়ে অনুভব করা যায় জীবনকে। আপনার কী মনে হয়?

প্রফুল্ল মুখ তুলে শান্ত চোখে মৃগাঙ্কের বদলে করবীর দিকে তাকাল। চেয়ারে বসে করবী। হাত-দুটি কোলের উপর দুর্বলভাবে রেখে ক্লান্তভাবে প্রফুল্লর দিকে তাকিয়ে।

মানুষের শ্রেষ্ঠ ভয় মৃত্যুভয়। সেটা সামনে এসে দাঁড়ালে তখনই শ্রেষ্ঠ জীবনযাপন সম্ভব। মৃগাঙ্ক নীচু স্বরে কথাগুলো বলে থামল এবং কয়েক মুহূর্ত পরই দ্রুত যোগ করল, কিন্তু ভয়েরও রকমফের আছে।

কীরকম? পুরু লেন্সের ওধারে চকচক করে উঠল প্রফুল্লর চোখ দুটি। মৃগাঙ্ক চুপ করে রইল।

আপনি কখনো ভয়ের মুখোমুখি হয়েছেন? প্রফুল্ল আবার বলল।

অস্পষ্ট স্বরে মৃগাঙ্ক বলল, আমার সন্তান নেই, হবার সম্ভাবনাও নেই।

করবীর জ কুঞ্চিত হল মৃগাঙ্কের কথায়। প্রফুল্ল দেশলাই জ্বালতে একটু দেরি করল। প্রথম ধোঁয়া ছেড়ে সে অনেকক্ষণ ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সেই স্ত্রীলোকটি দেড় মাসের প্রতিটি মুহূর্তে জীবনের স্বাদ পেয়েছে। আমার মনে হয় না অরুণবাবুর পক্ষে গল্প লেখা সম্ভব।

মৃগাঙ্কবাবু, আপনি তো আবার বিয়ে করতে পারেন। করবী ধীর সহানুভূতিসূচক স্বরে বলল।

না। মৃগাঙ্ক মাথা নেড়ে হাসল।

করবী বলল, আপনি কি ভয়টাকে জিইয়ে রাখতে চান, কিন্তু এটা তো মোটেই ভয় নয়। মৃত্যুর মতো এ ভয় অমোঘ নয়। ইচ্ছে করলেই আপনি এটা কাটিয়ে উঠতে পারেন।

মৃগাঙ্ক শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। বাসন্তীর মা দরজার বাইরে থেকে ফিসফিস করে কী বলতেই করবী বলল, কাল একটু সকাল সকাল এসো।

মৃগাঙ্ক চেয়ারে সিধে হয়ে টেবল থেকে টর্চটা নিয়ে কবজি তুলে ঘড়ি দেখল। মগাঙ্কবাবু বোধ হয় মানবিকতার শিকার হয়েছেন। প্রফুল্ল তার ভারী গলায় লঘু সুরে হেসে উঠল। কিন্তু আপনি কি অনুভব করেন না, এবার মানবিক বোধগুলোকে তাড়া করে হটাতে হটাতে তার ডায়মেনশনকে বাড়িয়ে এমন-কিছু জিনিসে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যাতে মনে হবে আমার মধ্যে গাঢ়-উষ্ণ একটা জীবন সবসময় নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে? এক ধরনের ফিজিকাল ভয়ের মধ্যে আমার মনে হয় সবসময় বাস করা উচিত, সেটা পরমাণু বোমই হোক আর কয়লা ভাঙার হাতুড়িই হোক। বেঁচে থাকার একটাই শেষ অবলম্বন।

মৃগাঙ্ক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার কথাগুলো আমি ভেবে দেখব। রাস্তায় বেরিয়ে মৃগাঙ্ক টর্চ জ্বালার আগে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর মিনিট পাঁচেক হেঁটে খালের অন্ধকার নির্জন বাঁধে পৌঁছে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ পর বাঁধ থেকে নেমে সে রওনা হল পরিমলের দোকানের উদ্দেশ।

রাস্তায় টিমটিমে ইলেকট্রিক আলোয় মৃগাঙ্ক দেখতে পায়নি, কাছাকাছি হতেই সে অবাক হয়ে বলল, একী, বাড়ি যাননি?

অরুণের হাঁটার ভঙ্গিতে মানকি বিপর্যয়ের বিধ্বস্ততা স্পষ্ট। কণ্ঠস্বরে আরও স্পষ্ট। মিস বিশ্বাসের কাছে অ্যাপোলজি চাইতে যাব ভাবছি, মিরার ব্যবহারের জন্য।

ওহ।

কিন্তু চাওয়াটা উচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আপনি এখন কোথায়। যাবেন? বাড়ি?

পরিমলবাবুর দোকানে যাব। মৃগাঙ্ক হাসল। এখন সেখানে যাওয়ার অর্থ অরুণ জানে। দোকানের পিছন দিকে একটা খুপরি আছে। রাত্রে সেখানে বসে পরিমল মদ খায়। তখন কেউ কেউ যায় সেখানে।

চলুন আমিও যাব।

মৃগাঙ্ক ইতস্তত করায় অরুণ অধৈর্য হয়ে বলল, এখন বাড়ি ফিরতে পারব না। আমার মাথার মধ্যে এখনও আগুন জ্বলছে। আপনি অনেক ভাগ্যবান যে আমার মতো স্ত্রী পাননি।

দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে ওরা খুপরিতে ঢুকল। পরিমলের মুখোমুখি বসে গোলগাল বেঁটে একটি লোক। বেশবাসে সম্পন্নতার পরিচয়, মুখে উদবেগ। ওদের দুজনকে দেখেই সে টেবিল থেকে হাতটা নামিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে পরিমলের দিকে তাকাল। পরিমল অস্বস্তিভরে এধার-ওধার তাকিয়ে তারপর স্ফুর্তিবাজের মতো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, আরে আসুন আসুন।

টেবিলের উপর অর্ধ নিঃশেষিত রামের একটি বড়ো বোতল ও দুটি সদ্য সমাপ্ত গ্লাস। টেবিলের নীচে কয়েকটি সোডার বোতল, দেওয়ালের ধারে পাঁচ-ছটি প্যাকিং বাক্স। ওরা দুজন তার উপর বসল। পরিমল উঠে তাক থেকে দুটি গ্লাস এনে মদ ঢালতে ঢালতে লোকটিকে বলল, মধু, সোডা খোল তারপর অরুণের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার?

অরুণ শুধু হাসল। মৃগাঙ্ক বলল, ওঁরটা একটু কম করে দিয়ে পরিমল, প্রথম দিনেই যেন গোলমাল করে না বসেন।

পরিমল ভ্রূ কুঁচকে কিছু বলতে যাচ্ছে, তার আগেই অরুণ ব্যস্ত হয়ে বলল, কলেজে পড়ার সময় কয়েক বার খেয়েছি, কোনো গোলমাল হয়নি।

বিয়ের পর নিশ্চয় খাননি? মৃগাঙ্ক গ্লাসটা পরিমলের হাত থেকে নেবার সময় মিটমিটিয়ে হাসল, অরুণ জবাব দিল না। হাত বাড়িয়ে সে টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিয়ে দুই চুমুকে শেষ করে ফ্যালফ্যাল চোখে সকলের দিকে তাকাল।

পরিমল বিরক্ত হয়ে বলল, কী ব্যাপার?

মিস বিশ্বাসের কাছে ক্ষমা চাইবেন বলে রাস্তায় এতক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিয়ে মৃগাঙ্ক বলল।

পরিমল অ্যা বলে অরুণের গ্লাসে আবার মদ ঢেলে দিল। ওরা কথা না বলে খেয়ে চলল। একসময় পরিমল বলল, এ আমার বাল্যবন্ধু মধুসূদন দাস।

লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে বুকে দুই মুঠো ঠেকিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

বস পরিমল তর্জনী নাড়িয়ে নির্দেশ জানাল।

টসটসে মুখ নিয়ে অরুণ তাকাল মধুসূদনের দিকে। তারপর পরিমলকে বলল, ইনি বড়ো তালপুরের জোতদার, তাই না?

মৃগাঙ্কর গ্লাসধরা মুঠোটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল, পরিমল অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল, মধুসূদন বিভ্রান্ত চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল টেবিলে।

আপনি কাল এসডিও সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আপনার বন্দুক আছে কিন্তু আরও চাই। আপনি গুলি চালিয়ে মানুষ মারলে রেহাই পাবেন। আপনাকে এক হাজার লোক ঘেরাও করে কুপিয়ে কুপিয়ে মারলে তারাও রেহাই পাবে। সবাই রেহাই পাবে, শুধু আমি ছাড়া। পাঠশালার পড়ুয়াদের মতো দুলে দুলে অরুণ বলে গেল। মৃগাঙ্ক ও পরিমল তখন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে।

মধু আমার বন্দুকটা নিতে এসেছে, আমাকেও। পরিমল মৃদুস্বরে বলল। কিন্তু স্পিংটা সারাতে, দিন পাঁচেক আগে কলকাতায় পাঠিয়েছি। ও বলছিল কোথাও থেকে বন্দুক জোগাড় করে দিতে!

অরুণ বলল, উকিলবাবুর তো আছে।

মৃগাঙ্ক অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল। পরিমলের গ্লাস ধরা মুঠোটা শক্ত হয়ে গেল। মধুসূদন বিভ্রান্ত চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে গ্লাসটা টেবলে নামিয়ে রাখল।

তোর বউকে কাল যেতে বারণ করিস। এখানে কাল অনেক কিছু ঘটতে পারে। পরিমল স্কুলজীবনের পর প্রকাশ্যে এই প্রথম মৃগাঙ্গকে তুই বলল।

অরুণ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ে যেতে যেতে টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সাবস্টিটিউট চলবে? উকিলবাবুর বউয়ের বদলে আমার বউ যদি ফিলডিং দেয়, আপত্তি আছে?

অরুণকে রূঢ়ভাবে টেনে তুলে পরিমল বসিয়ে দিল প্যাকিং বাক্সের উপর। মৃগাঙ্ক ধীর অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলল, বন্দুকটা কি এখুনি চাই?

মধুসূদন অস্বস্তিতে নড়েচড়ে গলাখাঁকারি দিয়ে পরিমলের দিকে তাকাল। অরুণ হাঁটুগেড়ে বসে মৃগাঙ্কের পা জড়িয়ে ধরল। আমার কিছু নেশা হয়নি মৃগাঙ্কবাবু, আমি বলছি সাবস্টিটিউট নেওয়ার অধিকার আছে। মিরা ক্যাচ-ট্যাচ ফেলবে না…জাস্ট ওয়ান বুলেট..আমি দাম দেব…

পরিমল ওকে টেনে তুলে বলল, এবার বাড়ি যান। আপনার নেশা হয়েছে। তারপর অরুণকে ঠেলতে ঠেলতে দরজার বাইরে এনে বলল, এবার বাড়ি যান। আপনার নেশা হয়েছে। অরুণকে তারপর বলল, হেঁটে যেতে পারবেন তো?

আমাকে আপনারা কী ভাবেন অ্যাঁ? একটা কাওয়ার্ড? আমি পারি, গীতা বিশ্বাসের সঙ্গে যা খুশি করতে পারি, কাউকে পরোয়া করি না। দেখবেন? পারি কি না দেখবেন?

অরুণ ঘুরে তাকিয়ে দেখল পরিমল নেই এবং দরজাটা বন্ধ। ঘাড় কাত করে সে কিছুক্ষণ একটানা ঝিঝির ডাক শুনল। চারদিকের অন্ধকারে চোখ বুলিয়ে, কাওয়ার্ডস, অল আর কাওয়ার্ডস। বলে ধমকে উঠে কুচকাওয়াজের কায়দায় বাড়ির রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। ওকে দেখে হতভম্ব মিরা যখন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না তখন কাঁধ থেকে কাল্পনিক রাইফেলটি নামিয়ে, হাঁটু ভেঙে বসে কাঁধে বাঁট রেখে, এক চোখ বুজে অনেকক্ষণ তাক করে অরুণ চিৎকার করে উঠল, দুম।

 

প্রফুল্ল আর করবী তখন বারান্দায় পাশাপাশি চেয়ারে বসে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। বাড়ির সব আলো নেবাননা। একসময় প্রফুল্ল আলতো স্পর্শ করল করবীর বাহু। করবী ঘাড় ফেরাল।

আর ভালো লাগে না।

প্রফুল্ল বলল, তোমার সাকসেস চব্বিশ, আমার চৌত্রিশ। তুমি কিন্তু একসময় এগিয়ে ছিলে।

সংখ্যা দিয়ে কী হবে। জানি তো এটা সত্যি নয়, শুধুই খেলামাত্র। সারাজীবনই এভাবে খেলা যায় না।

প্রফুল্ল হাত সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার যেন মনে হচ্ছে ভ্রমণ করার মতো আর কোনো মহাদেশ আমাদের জন্য অনাবিষ্কৃত নেই।

ক্লান্ত স্বরে করবী বলল, কিন্তু আমাদের বেরোতেই হবে, নইলে বাঁচা যাবে না। আমি ব্যবধান বাড়াতে চাই অতীতের সঙ্গে। নেকড়ের মতো ওরা খালি তাড়া করে, ধরতে পারলে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে।

এইসময় মৃগাঙ্ক তার শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে বন্দুকটা তুলে দেওয়ালে-টাঙানো নিজের ছবিটাকে তাক করছিল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আসা পায়ের শব্দ পেয়েই আলো নিবিয়ে সন্তর্পণে দরজার পাশে দাঁড়াল। বারান্দার অপর প্রান্তের ঘরটি ক্ষণপ্রভার। মৃগাঙ্ক আজ সারাদিন ওকে দেখেনি।

শীর্ণা বালিকার মতো দেহ, হাত দুটি দড়ির মতো ঝুলছে, মাথাটি এক পাশে হেলানো, মৃগাঙ্কের সামনে দিয়েই নিঃশব্দে চলে গেল নিজের ঘরে। বন্দুকটি বিছানার উপর রেখে জানলার ধারের ইজিচেয়ারটাতে দেহ এলিয়ে দিল মৃগাঙ্ক। ধীরে ধীরে চিন্তার মধ্যে সে ডুবে গিয়েছিল, হঠাৎ তার মনে হল ঘরে কে ঢুকছে।

তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে ক্ষণপ্রভার অবয়বটি চিনতে পারল। বন্দুকের বাক্স আলমারির নীচেই থাকে। মৃগাঙ্ক দেখল, ও নীচু হয়ে বাক্সটি টেনে বার করল। হাতে তুলেই বোধ হয় লঘু ভারের জন্য বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন চাপাস্বরে মৃগাঙ্ক বলল, আমি বার করে সরিয়ে রেখেছি। ওটা মধুসূধন দাসের লোক একটু পরে এসে নিয়ে যাবে।

কেন? তাতে আমাদের আন্দোলনের ক্ষতি হবে।

আমার কিছু আসে-যায় না।

ক্ষণপ্রভা বাক্সটা নামিয়ে রেখে মৃগাঙ্কের দিকে এগিয়ে এল। বন্দুকটা আমাদের দরকার। এখন তর্কাতর্কি করার সময় আমার নেই, কোথায় রেখেছ?

কী লাভ এইসবের দ্বারা তুমি পাবে? কাল তুমি মারা যেতে পার।

হ্যাঁ, ক্ষণপ্রভার ঝকঝকে দাঁত অন্ধকারেও মৃগাঙ্ক দেখতে পেল। মরার সম্ভাবনা কাল অনেকেরই আছে। তবে একটা শর্তে আমি যাওয়া বন্ধ করতে পারি।

কী শর্ত? মৃগাঙ্ক উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল।

সকলকে জানিয়ে দেব যে আমি বন্ধ্যা নই।

না না। মৃগাঙ্ক কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে উঠল, তা যদি কর আমি নিজে তোমায় গুলি করে মারব।

কী লাভ তার দ্বারা তুমি পাবে?

মৃগাঙ্ক অবসনের মতো বসে পড়ল। মাথা নাড়তে নাড়তে কাতর স্বরে বলল, বোঝাতে পারব না তা, বোঝানো যায় না। পুরুষ হলে বুঝতে পারতে।

আর তোমাকে পুরুষ করে রাখতে আমাকে সাজতে হয়েছে বন্ধ্যা।

মৃগাঙ্ক অস্ফুটে বলল, খাটের ওপর।

পরদিন সকালে মিরাকে হাসপাতালে পাঠাতে হল। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে অরুণ কলঘরে গিয়ে অর্ধদগ্ধ অচেতন দেহটি দেখতে পায়। ডাক্তার জানিয়েছে বাঁচবে কি না কাল বলা যাবে।

দুপুরে ক্ষণপ্রভা ফিরে আসে পুলিশের সঙ্গে। বড়ো তালপুর যাবার পথেই সে গ্রেফতার হয়েছে। মৃগাঙ্ক জামিনে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিল, ক্ষণপ্রভা রাজি হয়নি।

রাত্রে গীতার বাড়িতে আহারের পর প্রফুল্ল বলল, ভেবেছিলাম তোমার এখানেই গল্প করে বাকি সময়টা কাটিয়ে দুজনে স্টেশনে রওনা হব। মালপত্র তো সবই পাঠানো হয়ে গেছে।

গীতা বলল, তাহলে থেকে যান। ট্রেন তো মাঝরাতে, আমার কিছু অসুবিধা হবে না।

করবী মাথা নীচু করে তালুতে মৌরি বাছতে বাছতে বলল, পরিমলবাবু প্যাকিং কেসটা এমন সময় পাঠালেন যে বইগুলো ভরে পেরেক এঁটে সেটা অন্য জিনিসগুলোর সঙ্গে আর স্টেশনে পাঠানো গেল না। ওটার জন্যই আমাদের যেতে হবে। রিকশা বলা আছে, পৌনে বারোটায় তুলে নিয়ে যাবে।

তাহলে এখন বাড়ি ফিরে আপনাদের তো অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। চলুন সঙ্গে যাই, খানিকক্ষণ গল্প করে আসা যাবে। গীতা টেবিল থেকে টর্চটা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঝি-কে বলল, বেরোচ্ছি গো। ফিরতে দেরি হলে তুমি আর জেগে বসে থেকো না।

ওরা তিন জন প্রধানত মিরা ও অরুণের কথা বলাবলি করতে করতে পৌঁছে গেল। গেট বন্ধ, বাড়িটা অন্ধকার। তালা খুলে ওরা বসার ঘরে ঢুকল। ঘরের আলো জ্বলতেই গীতা কাঠের বাক্সটা দেখে বলল, বেশ বড়ো তো, একটা মানুষ প্রায় ধরে যেতে পারে।

করবী হেসে বলল, ছোটোখাটো মানুষ হলে ধরে যাবে তোমায় ধরবে না।

আমি এমন-কিছু বিরাট নই, ঠেলেঠুলে এর মধ্যে ঠিক এঁটে যাব। এই বলে গীতা প্যাকিং বাক্সটার উপর বসল এবং সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে উঠে বলল, উফ পেরেক। ঠিকমতো বসানো হয়নি।

মুঠোয় মৌরি রয়ে গেছে। করবী হাত বাড়িয়ে প্রফুল্লকে বলল, খাবে?

দু-আঙুলে মৌরি নিয়ে প্রফুল্ল বাক্সটার উপর ঝুঁকে লক্ষ করতে করতে বলল, তাই তো? তিন চারটে পেরেক দেখছি বেরিয়ে রয়েছে। পথে খোঁচা লাগতে পারে, খুলে বেরিয়ে যেতেও পারে।

লোহা-টোহা কিছু নেই? বসিয়ে দেওয়া উচিত, গীতা ঘরের এধার-ওধার তাকাল লোহার খোঁজে।

দেখি আছে কি না! প্রফুল্ল ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের পিছন দিকে চলে গেল এবং চেঁচিয়ে বলল, টর্চটা আননা তো, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

গীতা তোমার টর্চটা দিয়ে আসবে ভাই। মৃদু-শান্ত স্বরে করবী বলল, তারপর হাতের শেষ কয়েকটি মৌরি মুখে ছুড়ে দিল। গীতা বেরিয়ে যেতেই করবীর মুখ ধীরে ধীরে টসটসে হয়ে উঠল জ্বরগ্রস্তের মতো। দু-হাতে কপাল চেপে সে মাথা নীচু করে বসে রইল।

মিনিট পাঁচেক পর পায়ের শব্দে করবী মুখ তুলল। কয়লাভাঙা হাতুড়ি হাতে প্রফুল্ল দাঁড়িয়ে। ওর জিজ্ঞাসু চাহনির জবাবে প্রফুল্ল বলল, বাক্সটা এক বার খুলতে হবে। থলিটা আনো, বইগুলো তাতেই বরং ভরে নেওয়া যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *