একটি আষাঢ়ে চিন্তা

একটি আষাঢ়ে চিন্তা

মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি বিকাশের মূলে যৌন সংযমের দান অনেকখানি। বলতে গেলে যৌন নিয়ন্ত্রণই সমাজ সংস্থার ভিত্তি। এই যৌনজীবন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপন এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ ও আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করা সম্ভব ও সহজ হয়েছিল।

এ উদ্দেশ্যেই অপ্রতিরোধ্য ও অপরিহার্য জৈবিক প্রয়োজন ও সৃষ্টিসম্ভব প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের ঘৃণা–সে কারণে লজ্জা-জাগানো আবশ্যিক হয়ে ওঠে।

দেহ-মনের বিকাশ ও স্বাস্থ্যের জন্যেও এর প্রয়োজন ছিল। কেননা, যোগ-সাধনায় এই যৌন সংযমই মূল সাধ্য। পরবর্তীকালে যোগতত্ত্ববিদ বলেছেন, যদি স্বাস্থ্য, দীর্ঘজীবন ও কায়াসাধনায় সিদ্ধি পেতে চাও তাহলে রমণ করবে

মাসে এক বছরে বারো
আরো যত কমাইতে পারো।

আজকের দিনেও কামুকতা ঘৃণ্য এবং লাম্পট্যই মানুষের চরিত্রে মুখ্য দোষ বলে বিবেচিত। এটিরই রূপক রয়েছে শামীয় (Semetic) পুরাণে ও ধর্মগ্রন্থে।

আদম-হাওয়া ছিলেন স্বর্গে। তাদের লজ্জা ছিল না, ছিল না কোনো গ্লানি বা পাপবোধ। তাঁরা নারী-পুরুষ হলেও যৌন-সম্পর্ক তাদের ছিল না। যৌনতা ছিল তাদের অজ্ঞাত। যৌনবোধ তখনো তাঁদের অনুভবের বাইরে। এঁরা একে অপরের সাথীমাত্র। আদমের নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গিনী হিসেবেই হাওয়ার সৃষ্টি–আদমের প্রতি জেহোভার প্রথম অনুগ্রহ তাঁর প্রথম উপহার। বোঝা যাচ্ছে, নারী সৃষ্টির পরিকল্পনা জেহোভার আদৌ ছিল না। আদমের আনন্দ সহচরীরূপেই হাওয়ার উদ্ভব এবং জেহোভার দ্বিতীয় চিন্তার দান।

স্বর্গে আদম-হাওয়া ছিলেন বন্ধ্যা, উলঙ্গ ও লজ্জাহীন। কেননা রতি-রমণ ছিল তাদের অজ্ঞাত। সর্পরূপী শয়তান গিয়ে প্রভাবিত ও প্রলুব্ধ করল হাওয়াকে। উল্লেখ্য যে, সাপ কামবিষের ও প্রজনন শক্তির প্রতীক। শয়তানের সর্পবেশ ধারণ সে-কারণেই। সে খাওয়া নিষিদ্ধ জ্ঞানবৃক্ষের ফল। এ জ্ঞান নিশ্চয়ই যৌনবোধ। কেননা এ ফল ভক্ষণের পর তাদের যে-বোধ জাগল তা দেহ-চেতনা। সে-কারণেই তারা বৃক্ষপত্রে আবৃত করলেন তাঁদের দেহের যৌনাবেগ জাগাতে সমর্থ তেমন স্থানগুলো।

রূপকের আবরণ উন্মোচন করলে বোঝা যায়, এই গল্পে আদি মানব-মানবীতে যৌনবোধের উদয়-রহস্য বিবৃত। কায়িক সান্নিধ্যে ও স্পর্শে যৌনবোধের দীক্ষা হল উভয়ের। তারপর চিত্ত স্থৈর্যের প্রয়োজনে তারা দেহে দেন আবরণ। এই সচেতন সংযম-প্রয়াসই অভ্যস্ত লজ্জা ও সংকোচের রূপ নেয়। জীবজগতে নারীই রজস্বলা হয় সৃষ্টির প্রয়োজনে। কাজেই যৌনাবেগ প্রাকৃতিক নিয়মেই অপ্রতিরোধ্য হয় নারীতে। এজন্যেই হাওয়াই হলেন কামের প্রথম শিকার-কামবিমোহিতা। সেই থেকে নারী দোযখের দ্বার।

যৌনবোধে জাগ্রত নর-নারীকে নবাবিষ্কৃত সুখ-রহস্য ও নবলব্ধ অনুভূতি আকুল করেছিল। সুখ-উল্লাসে তারা তখন আত্মহারা। যৌনতায় নিমগ্ন মুগ্ধ মানব-মানবীর এই অসংযত কামচর্চা জেহোভা সহ্য করেননি। অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত আদি মানব-মানবী বিক্ষিপ্ত হলেন মর্তে। স্বর্গচ্যুত নর-নারী হলেন সৃষ্টিশীল। রমণ ও প্রজননই ছিল তাঁদের অবশিষ্ট জীবনের ব্রত ও কর্তব্য। অতএব তাদের অপরাধ যৌনবোধ আর পরিণাম হচ্ছে মর্তে বাস, রমণ ও প্রজনন। নইলে তারা চিরকাল থাকতেন স্বর্গে এবং থাকতেন বন্ধ্যা ও লজ্জাহীন এবং হতেন অমর। কাজেই স্বর্গ ও মর্ত্যে পার্থক্য যৌনবোধহীনতা ও যৌনতা। স্বর্গ আনন্দ ও আরামের এবং অজরামরতার, মর্ত্য দুঃখ ও যন্ত্রণার এবং জরামৃত্যুর। অতএব, যৌনবোধহীনতাই স্বর্গ-সুখ আর যৌনতাই দুর্ভোগের আকর। যৌনতা তাই ঘৃণার ও লজ্জার। কাম-বিমুক্তিই ব্রহ্মচর্য ও বৈরাগ্য তথা পবিত্রতা, চিত্তশুদ্ধি ও অধ্যাত্মসিদ্ধির সোপান। যে-যৌনতার কারণে আদি মানব-মানবীর স্বর্গচ্যুতি, মর্তে বাস ও মরণশীলতা এবং যে পাপের দুর্ভোগ কেয়ামত অবধি তাঁদের সন্তানদেরও পোহাতে হবে, সে-যৌনতা ঘৃণ্য না হয়ে পারে না। তাই শামীয় ধারণায় লাম্পট্য ও অসতীত্বই সবচেয়ে বড় পাপ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

পার্থিব জীবনেও মানুষের আদি পাপের উৎস এই কামুকতা। কাবিল-জীবনে পাপ এই কাম থেকেই উদ্ভূত। কাম থেকেই কাবিলের ঈর্ষার জন্ম, আর ঈর্ষা থেকেই আসে হাবিল-হত্যার প্রেরণা। সে-থেকেই কামানল আর রূপবহ্নি সংযম-সতর্কতা সত্ত্বেও পোড়াচ্ছে হৃদয়, দগ্ধ করছে গৃহ, পুড়ছে ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, রাজ্য ও সমাজ। সে-সব কথা অঙ্গারের অক্ষরে লেখা রয়েছে। রূপকথায়, কাব্যে, উপাখ্যানে ও ইতিহাসে এবং গানে, গাথায়, চিত্রে, নৃত্যে, নাটকে, ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যে। এই সর্বভুক অগ্নির দহনের কথা বলে বলেই গাইয়ে-বাজিয়ে-লিখিয়ে-আঁকিয়ে চিরকাল কাঁদিয়েছেন, চিরকাল জ্বালিয়েছেন মানুষকে। আজো মানুষ তেমনি জ্বলছে, তেমনি কাঁদছে এবং . চিরকাল জ্বলবে আর কাঁদবে। মানব সৃষ্টির সঙ্গে তার শুরু আর প্রলয়ে হবে তার শেষ। যৌনবোধ ও যৌনতা জৈবিক বলেই এর নিয়ন্ত্রণ সমস্যাও জটিল এবং দুঃসাধ্য। তাই বলে মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে ভাগ্যের হাতে-প্রকৃতির খেয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল না। এই জ্বালা ও কান্না, এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত প্রতিরোধ-লক্ষ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে যৌনজীবন। মানুষের এই শুভবাঞ্ছ অনেকখানি সাফল্য পেয়েছে বিবাহ-বন্ধনে। এভাবে মানুষে মানুষে গড়ে উঠেছে দাম্পত্য ও আত্মীয়তা এবং সে-সূত্রে গড়ে উঠেছে পরিবার, পরিজন, গ্রাম, গোত্র ও সমাজ। সমাজ পেয়েছে স্থিতি ও শৃঙখলা। বেশ্যাবৃত্তিও হয়েছে দাম্পত্য সম্পর্কের পরিপূরক এবং সে-সূত্রে সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার সহায়ক।

পুরুষ-ভোগ্য নারীর সতীত্বের ধারণাও এর পরোক্ষ ফল। নারীর একনিষ্ঠতাই সতীত্ব। পুরুষের এমন সংযম ও একনিষ্ঠতার প্রয়োজন নেই। তারা বয়েস কালে দোষ যা করে, তা নিন্দনীয় হলেও তেমন ঘৃণ্য ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ নয়। পুরুষ-প্রধান সমাজে পুরুষ নিজেদের জন্যে এ সুবিধেটুকু রেখেছে। নারী তার কাছে সোনা-রুপার মতো মূল্যবান ভোগ্যসম্পদ। সব মূল্যবান সম্পদই অপরের লোলুপতা ও অপহরণ-বৃত্তি জাগায়। তাই নারীকে লোভীর লোলুপ ও লুব্ধ দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হয়। তার একনিষ্ঠতা না থাকলে মালিকের স্বার্থে ও চিত্তে ঘা লাগে। এই এক-লগ্নতা তথা মালিক-নিষ্ঠার নাম সতীত্ব।

যৌনজীবনের এই সামাজিক ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণ মানুষের পক্ষে শুভই হয়েছে। দুনিয়াব্যাপী সভ্য ও বর্বর মানুষের হৃদয়-বৃত্তির বিকাশ ও প্রকাশ সম্ভব হয়েছে এই নিয়ন্ত্রণের ফলেই। সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নৃত্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে মানুষ মূলত তার এই বাধাপ্রাপ্ত যৌন-বৃত্তিরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, স্থূল ও সূক্ষ্ম, অমার্জিত ও পরিশ্রুত অভিব্যক্তি দিয়েছে। এভাবে কামের উন্নয়ন ও উত্তরণ ঘটেছে প্রেমে। এই যৌন অনুভূতি চেতন ও অবচেতন বোধে রূপচেতনা ও অনুরাগরূপে মানুষের চিত্তলোকে মহিমান্বিত বিভায় আত্মপ্রকাশ করেছে।

সহজেই বোঝা যায়, অবাধ কামচর্চা মানুষের অনুভব-উপলব্ধির জগৎ কিছুতেই প্রসারিত করতে পারত না। এ বাধা তাই আশীর্বাদ, এ সংযম তাই কাম্য; এ নিয়ন্ত্রণ তাই সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের মুখ্য মাধ্যম হয়েছে।

বলতে গেলে সর্বপ্রকার কলার আয়োজনই ভালো লাগার ও পেতে চাওয়ার অভিব্যক্তি দানের জন্যে এবং কাম্যজন থেকে ব্যবধানের ও বিচ্ছেদের কিংবা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণাকে ধ্বনিত করার জন্যে। তাই দুনিয়ার সব শ্রেষ্ঠ কলাই বিরহজাত-বিরহবোধের দান। বিরহের ও অপ্রাপ্তির বেদনা ও কান্নাই ধ্বনিত হয়েছে সর্বত্র। এজন্যেই শৃঙ্গাররসই আদি, অকৃত্রিম ও সর্বহৃদয়বেদ্য রস।

ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞানের অনুসরণে বলা চলে, অবদমিত যৌনবোধ মানুষের চিন্তায়, কর্মে ও অনুভবে রূপ পায়। অন্যকথায় মানুষের জীবনে যা-কিছু অভিব্যক্তি পায়, তার অনেকখানিই যৌনবোধের, যৌনবিকৃতির কিংবা নির্বিঘ্ন যৌনজীবনের দান।

বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে এও হয়তো বলা যায় যে, মানুষের জীবন যতখানি রক্ত-মাংসের তথা দৈহিক বা জৈবিক, ততখানি ভাব-চিন্তা-জ্ঞান ও হিতবোধ লব্ধ নয়। অর্থাৎ মানুষের জীবনের ভাব-চিন্তা-কর্মের যতখানি প্রাকৃতিক, এতকালের অনুশীলনেও মানুষ তার সিকিভাগও কৃত্রিম তথা স্বসৃষ্ট করতে পারেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *