ঋজুদার সঙ্গে সুফকর-এ

ঋজুদার সঙ্গে সুফ্‌কর-এ – ঋজুদা – বুদ্ধদেব গুহ

গত রাতেই ঋজুদার সঙ্গে তিতির আর আমি নাগপুর থেকে ঋজুদার ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের বন্ধু পরিহার সাহেবের এক পরিচিতর জীপে করে কানহারে মুক্কি ফরেস্ট লজ-এ এসে উঠেছি সন্ধ্যের পর। ফরেস্ট লজটা ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম ডেভালাপমেন্ট কর্পোরেশনের, যেমন লজ ওঁরা নানা জঙ্গলেই বানিয়েছেন। সাম্প্রতিক অতীতে বানিয়েছেন পালামৌর বেতলাতেও। লজগুলি চমৎকার। তবে দোষের মধ্যে ভীষণ এক্সপেনসিভ। ঋজুদা যদি বনবিভাগের একটি বিশেষ সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে না আসত তবে এখানে আমাদের নিয়ে উঠত না। আমাদের সব খরচ অবশ্য ঋজুদা ব্যক্তিগতভাবেই দিচ্ছে।

এই লজটা সত্যিই চমৎকার। খাওয়ার ঘরটি দোতলার ওপরে। পুরো কাঁচ দিয়ে ঘেরা একপাশ। আর সে পাশেই জঙ্গল গভীর। একটি নদী বয়ে গেছে লজ-এর একেবারে পা ছুঁয়ে। বড় বড় সাদা পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে উচ্ছ্বসিত, উৎসারিত, চঞ্চল জল চলেছে। কলরোলে।

লজ-এর সামনে দিয়ে পথ চলে গেছে। বাঁ দিকে গেলে নানা জায়গা পেরিয়ে লতাপুর। ডানদিকে গেলে সোজা সুফকর গ্রাম–তার কিছু আগে ডানদিকে ঘুরে গেলে মোতিনালা। সেখানে কালো হলো নদী পেরুতে হয়। জব্বলপুরেও যাওয়া যায় সে নদী পেরিয়ে বাঁ দিকে গেলে–মান্দলা হয়ে। আবার কিলি হয়েও যাওয়া যায়, চিপি হয়ে। হাঁলো নদী পেরিয়ে। মালার পাশে পাশে অনেক দূর অবধি নর্মদা চলেছে। আশ্চর্য সুন্দর নদ নর্মদা।

রাতে অত্যন্ত ক্লান্ত থাকাতে বেশি কথাবার্তা হয়নি আর। আমি আর ভটকাই এক ঘরে শুয়ে পড়েছি গিয়ে। তিতির এক ঘরে। আর অন্য ঘরে ঋজুদা। প্রতিটি ঘরই নদীমুখো। চমৎকার অন্দরসজ্জা। সস্তা, স্থানীয় সব জিনিস দিয়ে করা হয়েছে, মাদুরের গালচে থেকে বাঁশের টেবল পর্যন্ত। প্রতি ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দা। মনে হয়, হাত বাড়ালেই হাত ছোঁওয়ানো যাবে। এখন কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ ওঠেনি এখনও। তারাদের নীলাভ আলোতে নদীর ফেনিল সাদা জল মাঝে মাঝেই ব্যথায় নীল হয়ে উঠছে। সামান্যক্ষণের জন্যে হলেও। নদীর নাম জানা হয়নি এখনও।

যে কোনও নদীই আমাকে বড় টানে। ইচ্ছে হয়, তার গতিপথ ধরে পাথরে পাথরে, বালিতে বালিতে পা ফেলে ফেলে চলে যাই তার সঙ্গে। দেখি, সে কোথায় যায়! তবে একথা বুঝি যে, পথের মতো নয় নদী। পথ কোথাওই থামে না। অন্য কোনও পথে গিয়েই মেশে। সেখান থেকে আবারও অন্যতর পথে। কিন্তু নদী, সে উপনদী, শাখানদী বা মূল নদী যাই হোক না কেন একসময়ে স্ফীত হতে হতে সাগরে গিয়ে থামেই। তাকে থামতেই হয়। তার চলা অনন্তকালের নয়। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালাতে আছে, ঋজুদা একদিন পড়ে শুনিয়েছিল আমাদের লবঙ্গীর জঙ্গলে যাওয়ার আগে ওড়িশার বাঘ্যমুণ্ডার বাংলোতে বসে; যে, হারিয়ে যাওয়া বা থেমে যাওয়া। মানেই মৃত্যু নয়; ফুরিয়ে যাওয়া নয়। এই থামার মধ্যেও একধরনের শান্ত সমর্পণ আছে, পূর্ণতা আছে। স্থবিরের চলা। গাছেদের চলার মতন। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এমন করে বলেননি। কিছুটা হয়তো ঋজুদার, আর কিছুটা আমার কষ্টকল্পনা।

যাই হোক কলকাতায় ফিরে বইটা জোগাড় করে পড়তে হবে জায়গাটি ভাল করে। উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে এতদিন পরে, ঋজুদা ঠিক কী বলেছিল তা মনে নেই।

সবই ভাল, কিন্তু মুশকিল হয়েছে ভটকাই প্রায় পার্মানেন্ট ফিচার হয়ে উঠেছে আমাদের দলে। ঋজুদা একটা সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র আমারই ছিল। তারপর ঋজুদাই তিতিরকে ইনট্রোস করল আফ্রিকাতে রুআহা অ্যাডভেঞ্চারের আগে। অ্যালবিনো, এমন কী আফ্রিকার গুগুনোগুরের দেশে পর্যন্ত আমিই ছিলাম ঋজুদার একমাত্র সঙ্গী। তারপর আমারই বন্ধু, বন্ধুও বলব না : বলব জাস্ট অ্যাকোয়েন্টেন্স; এই ভটকাইকে ঋজুদার প্রায় হাতে-পায়ে ধরে দলে নিতে রাজী করাই। নিনিকুমারীর বাঘ, যে বাঘ সাংঘাতিক মানুষখেকো হয়ে গেছিল, তাকে মারবার জন্যে যখন আমরা যাই ওড়িশার এক পূর্বতন করদ রাজ্যে, তখন ভটকাই প্রথমবার আমাদের সঙ্গী হয়। তারপর থেকে সেই যে ঋজুদার ঘাড়ে সিন্দবাদ দ্য সেইলার-এর মতো চেপে বসেছে আর নামার লক্ষণটি পর্যন্ত নেই। শুধু তাই নয়, ঋজুদাকে ও প্রায় মনোপলাইজ করেও ফেলেছে। কী জাদু যে করেছে তা ঐ জানে! কিন্তু এও মনে হচ্ছে ওই এখন ঋজুদার সবচেয়ে কাছের লোক। এ নিয়ে আমার আর তিতিরের রীতিমত গাত্রদাহ হচ্ছে আজকাল। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার, ঋজুদাকে মোটেই মান্যিগন্যি করে না সে। এমন ভাব করে যেন ঋজুদার সে ইয়ার-দোস্ত। গুগুনোগুম্বারের দেশ থেকে আহত ঋজুদাকে যদি বাঁচিয়ে না নিয়ে আসতে পারতাম দেশে, তবে কী করে হত তারপরের আরও এত সব অ্যাডভেঞ্চার?

ব্রেকফাস্টের পর আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঠিক সকাল নটাতে কাঁটায় কাঁটায়। সময়ের ব্যাপারে আমরা সেনাবাহিনীকেও হার মানাতে পারি। ঋজুদার নটা মানে, নটা বাজতে পাঁচ-এ আমাদের সকলের ঋজুদার কাছে। রিপোর্ট করতে হবে। সকাল নটা না হয়ে যদি রাত দুটো হয়, তবেও তাই। সবচেয়ে বড় কথা ঋজুদা গুড অ্যাডভটকাইস অ্যান্ড ব্যাড এগজাপল-এ বিশ্বাস করে না। প্রতিদিনই ঋজুদা আমরা রিপোর্ট করার আগেই নিজে পুরো তৈরি হয়ে বসে থাকে। ঋজুদার কাছে থেকে থেকে, তার সঙ্গে বহু অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে গিয়ে নিয়মানুবর্তিতা আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। ঋজুদা কখনও কখনও স্বগতোক্তির মতো বলে যে, যে মানুষ বা যে জাতির জীবনে নিয়মানুবর্তিতা নেই তার বা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। স্কুলেই যাও বা অফিসেই যাও, সভাতেই যাও বা গান শুনতেই যাও, গানের অনুষ্ঠান অথবা স্টাডি সার্কল যারই আয়োজন করো, অনুষ্ঠান যেন ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আরম্ভ হয়। যাঁরা পরে আসবেন তাঁদের ঢুকতে দিও না। সময় মতো প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিও। তাতে যা হয় হবে।

ভটকাই প্রথম প্রথম বলত, ওর শ্যামবাজারী ভোকাবুলারিতে বড় জ্ঞান দেয়রে মানুসটা।

কিন্তু এখন বলে, ঋজুদা আমার লাইফ-স্টাইল চেঞ্জ করে দিয়েছে র‍্যা। আমার গলির সবাই আমাকে দেখে ঘড়ি মিলোয় আজকাল। পঞ্চমী নামের একজন ঠিকে কাজের লোক, ঘোষবাবুদের বাড়ি ঠিকে কাজ করে; যে সেদিন আমাকে গলিতে দেখেই বলল, হেই যা গো! পৌনে-নটা বেইজে গেল গো! তুমি যে কালিজে বেইরে পইড়েচো গো দাদাবাবু।

ভটকাই-এর কথা শুনে আমরা হেসেছিলাম খুব।

ঋজুদা বলল, তুইই চালা রুদ্র। পাইপ নিয়ে এত ঝকমারী হয় যে জীপ বার বার থামাতে হয় নিজে চালালে।

ভটকাই ফুট কাটল, আহা! রুদ্র চালালেও যেন থামতে হয় না। তোমার পাইপ খাওয়ার দরকার কী? প্রতি পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড অন্তরই ত নিভে যায়! তার চেয়ে তুমি থেলো-হুঁকো খাও। হুঁকোর মাথাতে টিকে দিয়ে তার উপরে টিনের চাকতি ফুটো-ফুটো করে মাপ করে বসিয়ে দেব। ফাসক্লাস হবে।

জীপ স্টার্ট করে মুক্তি লজ থেকে ডান দিকে মোড় নিতেই নদীটার উপরের কংক্রীটের ব্রিজের উপরে এসে উঠলাম আমরা।

বাঃ।

আমার মুখ ফুটে বেরিয়ে গেল।

কী সুন্দর নদীটা। মেমসাহেবের গায়ের রঙের মতো সাদা বালি, নরম, পেলব শুয়ে রয়েছে স্রোতস্বিনীর দুপাশে। শীতের সকালের রোদে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। বড় বড় সাদা পাথর। বিজ্ঞ হনুমানের দল তাদের ব্লন্ড দাড়ি আর গায়ের চুল নিয়ে কী যেন এক জরুরী সভাতে বসেছে। এ ওর দাড়ি ও মাথার চুল থেকে সাবধানে সযত্নে উকুন বেছে বের করছে।

ভটকাই বলল, তোমার অফিসে ফোন করলে তোমার সেক্রেটারী যখন বলে যে, মিঃ বোস ইজ ইন কনফারেন্স ন্যাও তখন আমার এই ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

আমরা সকলে হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলাম। ঋজুদার মুখ থেকে হাসির তোড়ে পাইপ প্রায় ছিটকে বেরিয়ে গেল।

সকলের হাসি থামলে ঋজুদা বলল, কথাটা খুব একটা মন্দ বলিসনি ভটকাই। তিতির একটা ছবি তোলতো নেমে, আমাদের কনফারেন্স রুমের দেওয়ালে এনলার্জ করে বাঁধিয়ে রাখব। সত্যি! কনফারেন্স, মীটিং কথাগুলো চালু হয়েছে বটে। ঘরে বসে হয়তো কেউ মাসতুতো দিদির মেজছেলের মাধ্যমিকে ফেল হওয়া নিয়ে আলোচনা করছে আর জরুরী ব্যাপারে যাঁরা ফোন করছেন তাঁদের বলে দিচ্ছে সেক্রেটারী হি ইজ ইন আ কনফারেন্স। কনফারেন্স আর মীটিং এ না থাকলে যেন বড় সাহেব যে কেউ হয়েছে তা প্রমাণই হয় না। এমনই ভাব হয়েছে একটা আজকাল। কাজ করার চেয়ে কাজ দেখানোটাই অনেক বড় ব্যাপার হয়ে গেছে।

বাঃ ওগুলো কী ফুল ঋজুদা? পাথরের মধ্যে মধ্যে জলের গায়ে ফুটেছে। মাছ ধরছে একটা বুড়ো লোক। কী সুন্দর দেখাচ্ছে, না, ছবিটা এই শীতের সকালে?

ঋজুদা প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল হ্যাঁ। যা বলেছিস।

তিতির ছবি তুলে ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়েই সেদিকে চেয়ে রইল। যেখানে বুড়ো বসে মাছ ধরছিল।

ভটকাই বলল, কী মাছ পায় এখানে ওরা, ঋজুদা? আর বললে না, কী ফুল। ওগুলো?

ঋজুদা স্বপ্নোত্থিতর মতো বলল, ওগুলো গান্ধালা ফুল, আর ঐ যে দেখছিস ও পাশে, জলের কিনারায়, ওগুলোর নাম গাংগারিয়া। স্থানীয় নাম। এই নামেই জানি। ওদের বটানিকাল নাম বলতে পারব না।

আর মাছের নাম বললে না, কী মাছ ধরছে?

মাছ কী আর ধরছে? তবে মাছের নাম, পাড়হেন, সাওয়ার, এই সব। পাহাড়ী নদীতে হয় এই সব মাছ।

তা মাছ ধরছে না তো কী করছে ঐ বুড়ো?

ঋজুদা হাসল, হাঃ হাঃ করে।

 তারপর বলল, বড় হলে জানতে পাবি বৃদ্ধদের কতরকম কষ্ট থাকে। শুধু বৃদ্ধ কেন, সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই থাকে। সেই সব কষ্ট থেকে পালিয়ে আসার জন্যে মাছ ধরার বাহানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাথরের ওপর রোদে বসে থাকে, জলের শব্দ, রোদের চিকমিক, গাছ পাতা লতার শব্দ, মাছেদের হঠাৎ ডিগবাজী আর মাছরাঙার হঠাৎ ছোঁতে যখন চারদিকে হাজার হাজার হীরে ছিটকোতে থাকে তখন বুড়ো দু পা জোড়া করে বসে জহুরী বনে যায়। পিটপিট চোখে হীরে দেখে, পরখ করে, জিভ দিয়ে চাটে, নাক দিয়ে গন্ধ নেয়; হীরের ফুল দেখে, হীরের মাছ দেখে, তার সারা জীবনের দারিদ্র, শীত, খিদে সব ভুলে গিয়ে উষ্ণ রোদের মধ্যে বসে এক দারুণ সুখের দেশে চলে যায়। যে দেশে মৃত্যুর আগে তার যাওয়ার কোনও উপায়ই নেই।

তারপর বলল, যখনই দেখবি কোনও মানুষ একা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাৎনার দিকে চেয়ে আছে তখনই বুঝবি, ফাৎনা নড়াটা একটা বাহানা, ছুতো; মানুষটি অবশ্যই অন্য গভীর কিছুর সন্ধানে ঐ সাধনাতে বসেছেন। তার শিশু সন্তানের মুখ থেকে তার বৃদ্ধ বাবার মুখ, তার চাকরীর জায়গা, তার ফেলে-আসা খেলাধুলোর মাঠ, কোনও পরীক্ষায় তার ফেল করার দুঃখময় স্মৃতি, তার জীবনের পথ, সেই পথের গন্তব্য; কত কিছুই যে ফাত্রার সঙ্গে হাওয়ায় দুলতে থাকে চোখের সামনে, মনের সামনে তা যে মাছ ধরে, সেই শুধু জানে! আসলে বড় হলে বুঝতে পারবি যে সংসারে এই সত্যটাই মস্ত বড় সত্য। অ্যাপারেন্ট ইজ নট রিয়্যাল। নে, এবার চল।

বলেই বলল, এই বানজার নদীর মতো সুন্দরী নদী সত্যিই কম আছে। এখানের বানজার এর রূপ অনেকটা পালামৌ-এর লাবনবাংলোর কাছের কোয়েলের মতো। না, বানজার বোধ হয় আরও অনেক বেশি সুন্দরী। বানজার মেমসাহেব আর হাঁলো দিশিমেয়ে। একজন ফর্সা অন্যজন কালো। তবে রূপসী দুজনেই সমান।

তিতির বলল, এই তাঁবুগুলো কিসের?

এগুলো অ্যান রাইট-এর কোম্পানির তাঁবু।

কোন্ অ্যান রাইট?

 ভটকাই শুধোল।

 তুই যার কথা ভাবছিস, সেই।

 ঋজুদা বলল।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড-এর অ্যান রাইট?

ইয়েস স্যার।

আমি বললাম।

ওঁর কোম্পানি আছে। বিদেশিদের জানোয়ার দেখাতে নিয়ে আসেন। আগে বিহারের পালামৌয়ের বেতলা ন্যাশনাল পার্কেও ছিল। এখন মধ্যপ্রদেশের কানহা-কিসলি অঞ্চলে।

সামনের নদীটা কী নদী ঋজুদা?

এটাই তো হাঁলো রে!

আর কাহার মুক্তি ট্যুরিস্ট লজ-এর পাশে তো বাজার, তাই না?।

 হ্যাঁ। 

একটা বাঁক ঘুরতেই দূরে সুফকর-এর বন-বাংলোটা দেখা গেল। খড়ের চাল এর। ছবির মতো।

ঋজুদা বলল, দেখছিস তো রুদ্র।

বাঃ।

জীপের গতি কমিয়ে বললাম আমি। আমার মুখ থেকে ছিটকেই বেরিয়ে গেল শব্দটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

এই হচ্ছে সুফকর।

দারুণ।

 তিতির আর ভটকাই দুজনেই একসঙ্গে বলল।

অ্যান রাইট কি এখানে আসছেন নাকি? আছেন এখন?

আসতে পারেন। তবে সুফকর-এ নেই। থাকলে, কানহা অথবা চিপিতেই আছেন।

তুমি চেনো ওঁকে?

ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে পালামৌর বিভিন্ন জঙ্গলে অনেকবারই দেখেছি যখন শিকার করতে গেছেন। পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশকে।

ঋজুদা বলল।

সে কী! উনি শিকার করেন নাকি? উনি তো কনসার্ভেশানিস্ট। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফাণ্ডের একজন মাতব্বর তো।

তাতে কী? যাঁরা এক সময়ে ভাল শিকারী ছিলেন তাঁরাই সবচেয়ে ভাল কনসার্ভেশানিস্ট হন। নিয়ম মেনে শিকার করাটা কখনওই পৃথিবীর কোথাওই অপরাধ বলে গণ্য হয়নি। আজও হয় না। যে-কোনও ব্যাপারেই অনিয়মানুবর্তিতা আর বাড়াবাড়িই সব কিছু সর্বনাশের মূলে। ইংরেজ আমলে তো এমন কনসার্ভেশানের প্রয়োজন হয়নি। আমরা যেই স্বাধীন হলাম, সঙ্গে-সঙ্গে ভাবলাম অনিয়মানুবর্তিতাই স্বাধীনতার চরম প্রকাশ। অকাট্য প্রমাণ! ফলে, যা হবার তাই হল।

বোদ্ধা কাকু যে বলেন, শিকার করার মতো পাপ আর নেই? শিকারিরা ঘৃণ্য।

ভটকাই বলল।

বোদ্ধা কাকুটি কে?

বাঃ। বোদ্ধা কাকুকে চিনিস না? তাঁকে কেনা চেনে! কলকাতার অ্যানাদার আঁতেল!

তাই? তিতির বলল, ইমপ্রেসড হয়ে।

তাই।  

ভালই তো। এমন মানুষ দু-চারজন ধারে কাছে থাকলেও নিজেদের জ্ঞানের সঙ্গে তাঁদের জ্ঞানের ঠোকাঠুকি লেগে সকলেরই জ্ঞানের দীপ্তি বাড়ে।

ঋজুদা বলল।

হ্যাঁ, ঘৃণ্য শব্দটা অনেককেই ব্যবহার করতে দেখি আজকাল। অথচ ভদ্রলোকমাত্রেরই জানা উচিত যে, ঘৃণ্য শব্দটাই ঘৃণ্য। যাঁরা ঘৃণ্য শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁরাই ঘৃণ্য। তবে সব দেশেই অশিক্ষিত, সবজান্তা মানুষেরা অমন অনেক কিছুই বলেন। সকলের কথাই যদি শুনতে হয় তবে তো নিজেদেরই পাগল হয়ে যেতে হয়।

অ্যান রাইট একা যেতেন পালামৌতে? শিকারে?

একা কখনওই আমি দেখিনি। ওঁর স্বামী বব রাইট তখন বেঙ্গল পেপার মিল, (আনন্ডু উইল) কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ডালটনগঞ্জের এম এল বিশ্বাস অ্যান্ড কোম্পানি তাঁদের কাগজের কলের জন্যে বাঁশ সাপ্লাই করতেন। পালামৌ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্রতি বছরই ইজারা নিতেন ওঁরা, বাঁশ সাপ্লাই করার জন্যে। প্রতি বছর শীতকালে বব এবং অ্যান রাইট আসতেন শিকারে। একবার অ্যান রাইটকে দেখেছিলাম, জন নামের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গেও। যতদূর মনে পড়ে, শীতকালেই।

তুমি কী করতে যেতে?

আমিও শিকারেই যেতাম। ঢেঁকি তো ধান ভানতেই যাবে। যেতাম বিশ্বাসদেরই অতিথি হয়ে। আমার জন্যেও অন্য ফরেস্ট ব্লক এবং ফরেস্ট বাংলো বুক করা থাকত। শিকারের পারমিটও। রাইট-দম্পতির প্রিয় জায়গা ছিল গাড় আর মারুমার। তখন গাড়র বাংলো ছিল ছোট্ট। কোয়েল নদীর পাশে। নতুন বাংলোটা তো এই সেদিন হল।

ততক্ষণে জিপটা সুফকর-এর বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়ল।

ভটকাই বলল, চা তো আমাদের সঙ্গে ফ্লাস্কেই আছে। বাংলোর বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে তোমার সুফকর-এর সেই জোড়া বাঘের গল্পটা আমাদের বলতে হবে কিন্তু। ঊ্য প্রমিসড আস।

হ্যাঁ। তবে বাঘ তো আমার নয়। আমার কৃতিত্ব ও ব্যাপারে কিছুমাত্রই ছিল না। অকৃতিত্বও অবশ্য ছিল না। বলবখন।

তিতির বলল, না বললে কিন্তু কথার খেলাপ হবে। 

জীপটা থামতেই ঋজুদা নামল। আর নামতেই, চৌকিদার এসে সেলাম করল। চৌকিদারের কোয়াটার থেকে একজন বুড়ো মানুষ ফোকলা দাঁতে একগাল হেসে ঋজুদাকে বলল, পররনাম হুজৌর। 

ঋজুদা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, কেমন আছ হিরু পানকা?

ভাল হুজৌর। আপনি?

 চলে যাচ্ছে হিরু। ইঠা বাইগা আর দেবী সিং কেমন আছে?

কোনও খোঁজ জানি না হুজৌর। কতদিনের কথা! কে যে কোথায় চলে গেছে ছটকে-ছাটকে।

নাম দুটি চেনা চেনা লাগছে যেন! তিতির বলল।

বলেই বলল, মনে পড়েছে। কোনও উপন্যাসে এই চরিত্রদুটি আছে। তাই না?

আছে নাকি? হতে পারে। অনেকেই হয়তো চেনেন এঁদের। জঙ্গলের গভীরে যাঁরা ঘোরেন তাঁরা তো চিনবেনই।

তারপরই ঋজুদা আমাদের দিকে ঘুরে বলল, বুঝেছিস। সুফকর-এর জোড়া বাঘের নাটকে এই মানুষটিই প্রধান-চরিত্র ছিল। এই হিরু পানকা। আমি আসব খবর পেয়েই দেখা করতে এসেছে। দ্যাখ। হাউ নাইস অব হিম! আর কতদূর থেকে এসেছে! একসময়ে ওর বাড়ি ছিল এই সুফকর গ্রামেই। .এখন দূরে চলে যেতে হয়েছে কোর-এরিয়া ছেড়ে, উদ্বাস্তু হয়ে; বনবিভাগের নির্দেশে। পুরো এলাকাটাই তো টাইগার-প্রোজেক্ট নিয়ে নিয়েছে, খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে বৃহত্তর স্বার্থে।

একটু চুপ করে থেকে ঋজুদা বলল, আমরা পূর্ববঙ্গের মানুষ তো! উদ্বাস্তু হতে কেমন যে লাগে, তা বুঝি।

তিতির বেতের চৌকো বাস্কেটটা নামিয়ে ফ্লাস্ক খুলে চা ঢেলে দিল ঋজুদা ও আমাদের। ও নিজে তো এখনও দুগ্ধপোষ্য। তাও আবার সকালে ও বিকেলে ঘড়ি ধরে দুধ খায়।

আমরা সকলে ঋজুদার দু পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। ঋজুদা চা খেতে। খেতে পাইপটাতে তামাক পুরল। তারপর চা শেষ করে ধরাল পাইপটা।

ভটকাই অর্ডার করল, এই তোরা কথা বলবি না আর একটাও। স্টার্ট ঋজুদা।

ভটকাইয়ের দুঃসাহস কমবার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনকে দিন তা বেড়েই চলেছে। ঋজুদাকেও ও এমনভাবে ট্যাক্স করে, যেন মারাদোনার পায়ে বল পড়েছে! জানি, উপমাটা ভাল হল না। আমরা ওর সাহস দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাই। তিতিরের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে আলোচনাও হয় এই নিয়ে কিন্তু করার কিছুই নেই। ঋজুদাই ওকে লাই দিয়ে মাথায় চড়িয়েছে।

একরাশ ধোয়া ছাড়ল ঋজুদা। ইংলিশ গোল্ড-ব্লক টোব্যাকোর মিষ্টি গন্ধে ৩৬৪

ভরে গেল বারান্দাটা। ঋজুদার বন্ধু জ্যাক হিগিন্স আগে পাপুয়া আইল্যান্ডে থাকতেন। এখন লন্ডনেই থাকেন। তিনিই পাঠান ওই টোব্যাকো ওখান থেকে। প্রতি মাসে একটি করে পার্সেল আসে।

.

শুরু করল ঋজুদা। শীতকাল। জানুয়ারির শেষ। প্রতি বছরই জানুয়ারির শেষে একপশলা বৃষ্টি হয়ই ভারতের সব বনে জঙ্গলে। তোরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিস। আসলে এমন বৃষ্টি ঝড়-বাদল প্রত্যেকটা ঋতু পরিবর্তনের আগেই হয়। থুড়ি, বলা উচিত ছিল যে, হত। আজকাল তো কোথাওই আবহাওয়ার কোনওই মাথামুণ্ডু নেই। আমাদের নিজেদের কৃতিত্বও কম নয় এর পেছনে।

তারপর?

আগের রাতে প্রচণ্ড দুর্যোগ গেছিল। সকালেও ঝোড়ো কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে টিপটিপে বৃষ্টি। এই যে বাংলোর গেট-এর প্রায় সামনেই পাহাড়টা দেখছিস, যখনকার কথা বলছি; তখন এতে ঘন সেগুন-জঙ্গল ছিল। বছর কুড়ি হল ক্লিয়ার-ফেলিং করে এখানে নতুন শালের প্ল্যানটেশান করা হয়েছে। তখনকার সেই সেগুন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা গেম-ট্র্যাক, মানে জানোয়ার-চলা শুড়িপথ, পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এসেছিল। বাংলোর গেটের প্রায় কাছাকাছি এসে বাংলোটা এড়িয়ে গিয়ে পেছনের গভীর বনে ঢুকে গেছিল পথটা। তারপর সুফকর গ্রামের দিকে।

গ্রামে ফসল লাগলে হরিণ, শম্বর, বারাশিঙারা সব কুথি, চানা, তিল, মকাই এসব খেতে আসত ওই শুড়িপথ বেয়েই, সামনের দিকের ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড় থেকে।

তারপর? তিতির বলল।

সকালের চা-জলখাবার খেয়েছিলাম আগের রাতের বাসি খিচুড়ি, কড়কড়ে করে আলু ভাজা আর শুকনো লঙ্কার সঙ্গে। ব্রেকফাস্ট খাবার পরে এই বারান্দাতেই ইজিচেয়ারে বসে পাইপ টানছিলাম। হঠাৎ সেই মাতাল হাওয়া আর সুগন্ধি বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে একটি অদ্ভুত শব্দ আমার কানে এল। চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে, যেদিক থেকে শব্দটা এল মনে হল, সেদিকে তাকিয়ে দেখি একটি অতিকায় পুরুষ-বারাশিঙা ওই গেম-ট্র্যাক দিয়েই হড়বড়-খড়বড় করে নেমে আসছে আতঙ্কিত হয়ে।

প্রথমে ভেবেছিলাম জংলী কুকুর বা ঢোল, এই বুঝি তাড়া করেছে তাদের। কিন্তু সে ভুল তক্ষুনি ভেঙে গেল বড় বাঘের প্রলয়ংকর গর্জনে। বনজঙ্গল, ঝোড়ো হাওয়া, সুফকর বাংলো সব যেন থথর করে কেঁপে উঠল বনরাজের ওই গর্জনে। বাঘটা বোধহয় ওদেরই তাড়া করে আসছিল। বারাশিঙারা কাছে আসতেই দেখি, তাদের পেছনেই বাঘ। আর সে বাঘের কী প্রলয়ংকর মূর্তি।

চিন্তা কর একবার, জলখাবার খাবার পরে, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে, ইজিচেয়ারে বসে দিব্যি আরাম করে পাইপ টানছি যখন ঠিক তখনই এমন নিরবচ্ছিন্ন শান্তি-বিঘ্নকারী ঘটনাপ্রবাহ!

তুমি কী করলে?

কী কেলো রে বাবা! বলেই, ভটকাই শুধোল।

কী আর করব। খবরের কাগজের ভাষায়, যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তাই হয়ে ইজিচেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে ব্যাপারটা বোঝার জন্যে সেদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এবং ঠিক সেই সময়েই বাঘটা অন্য বারাশিঙাগুলোকে প্রায় ঝড়ের বেগে টপকে এসে অতিকায় প্রাচীন পুরুষ শিঙালটার ওপর লাফিয়ে উঠেই তার পিঠ ও পেটের মাঝামাঝি জায়গা একেবারে ফালাফালা করে দিল। যেন কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশেই!

অন্যরা দুদ্দাড় করে খুরে খুরে খটাখট শব্দ করে পাথুরে, পিছল, ঘাস-ঢাকা জমি পেরিয়ে প্রায় বাংলার গেটের পাশ দিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে উড়ে গেল, আর ঠিক সেই সময়েই বাঘটা শিঙালের পিঠ থেকে নেমেই পাশ থেকে কোনাকুনি এক লাফ মেরে তার ঘাড় কামড়ে টুটি টিপে মাটিতে পটকে দিল। এক পান খেয়েই তো অত বড় জানোয়ারটা শিঙের শাখা-প্রশাখা নিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে অসহায়ভাবে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তার নাকের পাটা ফুলে উঠল। চোখ দৃটি উজ্জ্বলতর হল। তারপরই দুটি চোখ যেন কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এল। জিভটা আগেই বেরিয়ে গেছিল। দাঁতে কামড়ানো ছিল। কিছুক্ষণ শ্বাসরুদ্ধ থাকার পর শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল।

বাঘটা, বারাশিঙাটা যতক্ষণ না মরে গেল ততক্ষণ ওর টুটি কামড়েই শুয়ে রইল ঘাড়ের পাশে। ঘাড়ের কাছে মুখ আর শরীরটা তার পেটের পাশে শুইয়ে, যেন তার সঙ্গে খুবই ভাব-ভালবাসার সম্পর্ক। বারাশিঙাটা নিস্পন্দ হয়নি তখনও। মৃত্যুর পরও অনেকক্ষণ রাইগার-মর্টিস-এর কারণে হাতে-পায়ে স্পন্দন থাকে। মানুষেরও থাকে, এমন হঠাৎ আঘাতে মৃত্যু হলে; মৃত্যুর সময়ে।

কিন্তু বাঘ সেজন্য অপেক্ষা না করে দাঁড়িয়ে উঠে পাহাড়ের দিকে চেয়ে এক প্রচণ্ড হুঙ্কার দিল। ভাবখানা, যেন বলে গেল, আমি এসেছিলাম। তা বলে, আমার খোঁজ করার সাহস যেন কারও না হয়!

পরমুহূর্তেই ওই গেম-ট্রাকেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে, বৃষ্টিভেজা ঘন সেগুনের নিবিড় বনের আড়ালে। পুরো ঘটনাটা ঘটে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। আমার তোদের বলতে যে সময় নিল তার অর্ধেক সময়ে।

তারপর?

বাঘের ঠিক এরকম হরকত্ আমি তার আগে তো বটেই, তার পরেও কোনওদিনও দেখিনি। বিস্ময়াভিভূত ভাবটা কেটে যেতেই চেয়ারে বসে পাইপটা ধরালাম।

হিরু পানকা তখন কোথায় ছিল? তিতির শুধোল।

হিরু পানকা সেদিন সকালে আজকেরই মতো চৌকিদারের ঘরেই বসে ছিল। সেই সময়ে এই বন-বাংলোর যে চৌকিদার ছিল তার নাম ছিল বহেড়া বাইগা। বেচারা কানে একটু কম শুনত আর জাতে ছিল বাইগা।

বহেড়া আর হিরু দুজনেই দৌড়ে এল আমার কাছে বারান্দাতে বাঘের ঐ তর্জন-গর্জন শুনে।

কী ব্যাপার? আমি শুধোলাম ওদের।

ওরা আতঙ্কিত গলায় সমস্বরে বলল, হুজৌর, এই বাঘটাকে মারতে না পারলে আমাদের সুফকর গ্রামে থাকাই মুশকিল হবে। গ্রামের পেছনের জঙ্গলে মোষের বাথান আছে পাহাড়ীদের। তাদের বাথানে দিন পনেরো আগে রাতে এসে বাথানের দরজা ভেঙে দিয়ে দু-দুটো মোষকে মারে, চারটেকে আহত করে ফেলে যায়। পরে, তাদের মধ্যে তিনটিই মরে যায়।

বলো কী? অতগুলো মোষ একসঙ্গে থাকতেও বাঘ অমন করতে পারল? বাঘকেও তাদের ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার কথা ছিল।

তার কারণ ছিল। মোষেদের তো নড়াচড়া করারই উপায় ছিল না কোনও। এমনই গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে তাদের রেখেছিল পাহাড়ীরা বাথানে। আপনারা, বাঙালিবাবুরা যেমন করে হাঁড়িতে কইমাছ নিয়ে যান।

তাই বলো!

 হিরু বলল, এই বাঘ দুটির মস্তী শেষ হতে-হতে আমরাই শেষ হয়ে যাব।

ওরা দুজনে যখন আমার সঙ্গে কথা বলছিল, তখন সুফকর গ্রাম থেকে গ্রামের পনেরো কুড়িজন মানুষ ওই হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা, দমক দমক উঁচ-ফুটোনো হাওয়া আর বৃষ্টি উপেক্ষা করে, লাইন করে বাংলোর হাতায় এসে ঢুকল।

সকলেই একই সঙ্গে কথা বলছে। কারও মুখে চুট্টা, কারও ঠোঁটের নীচে খৈনি, কারও হাতে থেলো হুঁকো। আমি সকলকেই বারান্দায় ভেতরে ডেকে বহেড়া বাইগাকে সকলের জন্য চা করতে বললাম। আদা, দারচিনি আর তেজপাতা দিয়ে। যা ঠাণ্ডা পড়েছিল না সেদিন! এখনও ভাবলে কুঁকড়ে যাই।

তারপর ঋজুদা স্বগতোক্তির মতো বলল, বুঝলি না, ওরাই তো আমাদের দেশের আসল মানুষ। আসল ভারতবাসী। ওরাই হনুমানকে দেবতা বলে পুজো করে। রামের নামে প্রাণ দিয়ে দিতে পারে। আমি তুই; আমরা এই দেশের কজন? রামচরিতমানস, রামায়ণ আর মহাভারতের শিক্ষাই ওদের একমাত্র শিক্ষা। বয়সে ছোট হলেও এমন কি শিশু এবং মেয়েদেরও পাকা পুরুষেরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। আত্মীয়স্বজনের মেয়েদেরও। আমাদের মতো চারপাতা ইংরিজি পড়ে তারা সবজান্তা আঁতেল হয় না। যা-কিছুই ভারতীয় তার সবকিছুকেই অস্বীকার করে নিজেদের অন্যরকম বলে প্রমাণ করতে সবসময়ে এমন ধড়ফড় করে না।

আমরা সকলেই চুপ করে রইলাম। ভটকাই ঋজুদা সম্বন্ধে অত কিছু জানে না। কিন্তু আমি আর তিতির জানি যে, স্বদেশ বা স্বদেশের মানুষের কথা উঠলেই ঋজুদার চোখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গলার স্বর গাঢ় ও গম্ভীর হয়ে ওঠে।

ঋজুদা বলল, জানিস, মাঝে-মাঝেই ভাবি, যদি ছেলেবেলা থেকেই শিকার না করতাম বনে-পাহাড়ে, নদী-বিলে, আমার এই বিরাট দেশের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে এমন কাছ থেকে সমান্তরাল জমিতে দাঁড়িয়ে মেশবার সুযোগ না হত, তবে হয়তো আমিও কলকাতা শহরে বাস করা অনেক ভারতীয় নামী দামি মানুষদেরই মতো স্বদেশের সঙ্গে কোনওরকম প্রকৃত সম্পর্করহিত হতাম। লজ্জাবোধ যে আমাদের নেই, তার জন্য লজ্জিত হতাম না, কর্তব্যবোধ যে রাখি না, সেজন্য বিবেকদংশিত হতাম না। তোরা সবাই, প্রত্যেকেই, পুরোপুরি দিশি-মানুষ হোস, বুঝলি রে! নিজের দেশকে ভাল করে জানিস। নিজের দেশের মানুষকে ভালবাসিস।

ওরা তারপর কী বলল? মানে, গাঁয়ের মানুষেরা?

তিতির শুধোল, ঋজুদাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে।

ওরা বলল, বাঘ একটা নয়, দুটো আছে।

ওই সময়ে দুটো কেন একসঙ্গে? পেয়ার?

সুফকর গ্রামের লোকেরা তারপরে সমস্বরে বলল, ওই বাঘ দুটোকে না মারা গেলে ছেলে-মেয়ে গাই-বলদ নিয়ে সুর গ্রামে থাকাই ওদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। মেরে যদি আমি দিতে পারি তো ওরা চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।

গ্রামের পাহান্ যে, সে সুন্দর সৌম্য পুরুষ। তার দুকানে পেতলের মাকড়ি। হাতে পেতলের বালা। বুনোট তুলোর জামা গায়ে। বহুবর্ণ চৌখুপি কাপড়ে বানানো সেই জামার আস্তরণ। হাতে তার কুচকুচে কালো থেলো হুঁকো। চুল সাদা ধবধবে। গোঁফ সল্ট-অ্যান্ড-পেপার। তার সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ আমার। পাহান বলল, আমার বয়স হল চার কুড়ি। এই বন-পাহাড়ে আজ অবধি অসংখ্য বাঘ দেখেছি, কিন্তু আমি বাঘেদের এই ধরনের হরকত কখনওই দেখিনি। অজীব বাত বোস সাহাব।

তুমি কী বললে ওদের উত্তরে? ঋজুদা?

কী আর বলব! বললাম, রাতে ওই মৃত বারাশিঙাটার ওপরে বসব এবং বাঘ মেরে দেব। আমার পারমিটে একটি বাঘ, একটি চিতা এবং একটি করে শম্বর ও বারাশিঙাও ছিল। আর বন-শুয়োরতো ছিলই, যত খুশি। তোমাদের এতবার করে আমাকে অনুরোধ করতে হবে না।

ওরা হাতজোড় করে বলল, যদি দয়া করেন।

লজ্জিত হয়ে আমি বললাম, দয়া-টয়ার কথা আসছে কিসে? আমি তো শিকার করতেই এসেছি। অবশ্য পারমিটে থাকলেই কী। কোনও শিকারীই পারমিটে যা থাকে তার সবই শিকার করেন না। অবশ্য শিকারও তো আর বাঁধা থাকে না। অনেক সময়ে এমনও হয় যে, পনেরোদিন আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারমিটে উল্লিখিত জানোয়ারের একটির সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারা যায় না। জানোয়ারদের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট লালবাজারের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট থেকেও অনেক দড়।

তুমি কিন্তু আবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছ। ভটকাই বলল।

 সরি।

বলো ঋজুদা, আগে বাড়ো।

পাহান, হিরু পানকা আর বহেড়া বাইগা প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল যে, এই বাঘ ও বাঘিনী কখনওই কোনও মড়িতে ফিরে আসে না। মড়িতেই যদি ফিরে আসত, তবে ওরা, যারা অনাদিকাল থেকে শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করছে, আর গাদা বন্দুক বা একনলা কার্তুজ-বন্দুক বা বিষমাখানো তীর নিয়ে; গাছে বসে কি এতদিনে জোড়া বাঘকে পটকে দিতে পারত না?

ওই বাঘ দুটো বনদেওতার বাঘ। পাহান বলল গম্ভীর গলাতে।

তারপর বলল, মানে, তাদের এতদিনের হরৎ দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। নইলে কেউই তাদের মারতে পারছে না কেন?

আমি চুপ করে শুনলাম। সংস্কার এমনই একটা জিনিস, অনেকটা গলায়-বেঁধা মাছের কাঁটার মতো; যখন যাবার তখন এমনিই যাবে। জোর করে তুলতে গেলেই চিত্তির!

তারপর ওদেরই মধ্যে একজন বলল, আরে! খামোখা তার-এ গিয়ে লাভ কী! কথা কম বলো! হুজৌরকে বলতে দাও। শোনো, উনি কী বলেন!!

আমি বললাম, তোমরা কী বলো তাই শুনি।

আমরা বলি, নরম মাটিতে বাঘের পায়ের দাগ এখনও টাটকা আছে। এখনই বাঘেদের পিছা করে তাদের মারা উচিত। যত মাইল যেতে হয়, সে যমের দুয়ারে যেতে হলেও গিয়ে এদের সামনা করা উচিত। নইলে এই দুই বাঘ মারা কোনদিনও সম্ভব হবে না। আমাদেরই উদ্বাস্তু হতে হবে। এদের এইরকম বদমায়েশি চলছে দীর্ঘদিন হল। গত বছরও নভেম্বর মাসে এরা এইরকম করেছে। নানু বাইগা তো মারাই গেল ওদের হাতে। নাগপুর থেকে মালহোত্রা সাহেব এসেছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও মারতে পারলেন না। ফিরে গেলেন কুড়ি দিন পরে।

আমি ইজিচেয়ারের ওপরে আবার সোজা হয়ে বসলাম। ইতিমধ্যে বহেড়া বাইগা তো চা নিয়ে এল সকলের জন্য।

তখন জানিনি যে, কথাটা এমন সত্যি হবে। ওই বাঘেদেরই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নির্বিঘ্ন করার জন্যে সেই সকালের অনেক সকাল পরে তাদের বাবা-ঠাকুরদাদার ভিটেমাটি ছেড়ে তাদের উদ্বাস্তু হয়েই চলে যেতে হবে! বললাম, তোমাদের এই গ্রামে কটা এবং কী কী বন্দুক আছে? পাশী কি বেপাশী? আমি ফরেস্টার সাহেব বা পুলিশ সাহেব, কাউকেই বলব না।

পাশী দোনলা বন্দুক আছে একমাত্র রাজুপ্রসাদের। কিন্তু সে তো ডাকাতের মোকাবিলার জন্যেই বন্দুক রাখে। বাঘের জন্যে তো নয়! সে বন্দুক দেবে না।

হিরু বলল।

তবে তার বন্দুক ডাকাতি করেই নিতে হবে। তার বন্দুক ছাড়া আর কারও আছে?

 আছে। কিন্তু বেপাশী। গাদা বন্দুকও আছে দুটি। কিন্তু তা দিয়ে পায়ে হেঁটে অমন দৃশমনের মতো জোড়া-বাঘকে চোট করতে কি সাহস হয়? এক চোট-এর বেশি তো করা যাবে না। তারপর? হায় রাম!

যা বললে তোমরা তাতে আমারও মনে হয় যে, এখুনি বেরিয়ে পড়ে বাঘেদের রাহান-সাহান-এর খবর করাটা অত্যন্ত দরকার। তোমরা এবারে যাও। রাজুপ্রসাদের বন্দুকটি ডাকাতি করেই হোক, আর যে করেই হোক, নিয়ে এসো। আর কার্তুজও। বল্ আর এল. জি. এনো শুধু। যে-কোনও বস্ হলেই চলবে। কনটাক্ট, রোটাক্স, লেথাল, স্ফেরিক্যাল। আলফামাক্স এর যদি থাকে, তাই আনবে। কার্তুজ যেন টাটকা হয়। বাজে কার্তুজ নিয়ে বাঘের পেছনে যাওয়া মানেই আত্মহত্যা করা। দাম আমি দিয়ে দেব, বলে দেবে রাজুপ্রসাদকে। দাম যদি না নিতে চায়, তা হলে পরে টাটকা কাট্রিজ পাঠিয়ে দেব কলকাতায় ফিরে।

আমার কথা শুনে পাহানের নির্দেশে ওরা সবাই চলে গেল তখনকার মতো।

পাহান বলল, আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

 তোমায় যেতে হবে না পাহান। বয়স হয়েছে।

 কিসের বয়স? মোটে তো আশি। যে বছর দুটো দাঁতাল হাতিতে লড়াই। হয়েছিল মোতিনালার ধারে, সে বছরেই তো জন্মেছিলাম আমি। আমি শরীরে এখনও পঁচিশ বছরের জোয়ানের বল রাখি। প্রমাণ চাও? পাঞ্জা লড়বে?

আমি বে-ইজ্জৎ হবার ভয়ে পেছিয়ে গিয়ে বললাম, তা ঠিক আছে। কিন্তু এই ঝড়-বৃষ্টি ঠাণ্ডাতে কী দরকার। তাছাড়া আমার কিন্তু কথা বলে সময় নষ্ট করার সময় নেই। আমি যাই। এবারে, তৈরি হই গিয়ে।

বলেই, ঘরের ভেতর যেতে গিয়েও বললাম, আমার সঙ্গে শুধু হিরু পানকা গেলেই হবে। রাজুপ্রসাদের বন্দুক না পেলেও চলবে। আমার কাছে তো এক্সট্রা ডাবল-ব্যারেল বন্দুক একটা আছেই। তবে বড় গুলি মাত্র দুটি রয়েছে। মুরগি, তিতির মারার জন্যেই বন্দুকটাকে এনেছিলাম। নইলে, বড় জানোয়ার তো রাইফেলেই মারি। আর কারোরই যাবার দরকার নেই।

পাহান বলল, না না, তা কী হয়। আমাদের গ্রামেরই তো এত বড় বিপদ। আমাদের তংক করে মারছে শয়তান দুটো। আর গ্রামেরই কেউ যাবে না, তা কী হয়! আমার নাতি অবশ্যই যাবে আপনার সঙ্গে হুজৌর। তার নাম হাজো। চিতার মতো ক্ষিপ্র সে। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ তার চোখ। বন্দুকে, তীর-ধনুকে তার আন্দাজ একেবারে নির্ভুল।

 আমি লোক বেশি বাড়াতে চাইছি না পাহান। পায়ে হেঁটে বাঘকে পিছা করে বাঘের বাড়িতে গিয়ে তাকে মারতে হবে। তাও একটি বাঘ নয়, দু-দুটি বাঘ। তুমি তো বোঝো সবই!তুমিও তো শিকারী কিছু ছোট মাপের নও! আমার চেয়ে অনেক বেশি তোমাদের অভিজ্ঞতা।

 সবই বুঝি। কিন্তু বড়জোর কী হবে, আমার নাতি হাজো মারা যাবে; এই তো! তা গেলে যাবে। আমার আরও চার নাতি আছে। শত্রুর সঙ্গে, অন্যায়ের সঙ্গে, দুশমনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে যদি কেউ মরেই তার জন্যে তো শোক করার কিছু নেই। আনন্দই করব আমরা। ও নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না হুজৌর। উলটে ভাবুন, আপনার যদি কিছু হয়? সুফকর গ্রামের মানুষ কারও কাছেই কি মুখ দেখাতে পারবে আর?

 আরে, আমার কিছুই হবে না। আমার মাংস বাঘের কেন, শকুনেরও অখাদ্য।

পাহান বলল, আমি আসছি একটু।  

ঠিক আছে।

ঘরে গিয়ে ফোর-ফিফটি ফোর হান্ড্রেড জেফ্রী নাম্বার টু ডাবল ব্যারেল রাইফেলটাকে একবার পুল-থু করে নিলাম। জার্কিন পরে নিলাম চামড়ার।

বৃষ্টি যদি চলতেই থাকে তবু যতক্ষণ না বাইরেটা ভিজে সপসপে হচ্ছে ততক্ষণ ভেতরটা গরম থাকবে। পাঁচ ব্যাটারির বন্ড-এর টর্চটাও ব্যাগে নিলাম। ফেরার তো কোনওই ঠিক নেই। কোমরের বেল্টের কাছে লাগানো হোলস্টারে আমার পিস্তলটাতে গুলি ভরে নিলাম। ম্যাগাজিনে। একটি বাদে। পুরো আটটি গুলি ভরলে অনেক সময় আটকে যায় গুলি। টুপি নিলাম। টোব্যাকোর পাউচ। পাইপ।

ততক্ষণে হিরুও তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্লায়ে গামবুট। তার ওপরে ডাকব্যাক-এর ওয়াটারপ্রুফ। তাকে হঠাৎই এমন সাহেব-রোগাক্রান্ত দেখে বললাম, এক্ষুনি ওসব ছেড়ে আসতে। খালি পায়েই যাওয়া ভাল। কারণ, হিরু এমনিতে জুতো কখনওই পরে না। ওই পোশাকে বনে ঢুকলে আধ মাইল দূর থেকেই জেনে যাবে বাঘেরা, মিঃ পাক্কা আসছেন তার জুতোর কপাত্ঠপাত শব্দে।

ইতিমধ্যে রাজুপ্রসাদের বন্দুক হাতে একটি ভারী সুন্দর ছেলে এসে হাজির। তার পেছনে-পেছনে অন্যরাও। ছেলেটির মাথায় বড়-বড় বাবরি চুল, ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। কেষ্ঠ ঠাকুরের মতো গায়ের রং। খুব ভাল কাম নাচে বোধ হয়। টিকলো নাক। টানা-টানা চোখ। তার পরনে ধুতি আর গায়ে একটি খাকি ফুলশার্ট। কারও দেওয়া। মুখে হাসি।

মনে হল, সবসময়ই ওই হাসিটি ও পরে থাকে।

পাহান বলল, এই আমার নাতি, হাজো।

ঘড়িতে দেখলাম প্রায় এগারোটা বাজে। আর কথা না বাড়িয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

গ্রামের লোকেরা বিদায় জানাতে পাহাড়ের কিছুটা পর্যন্ত এল সঙ্গে সঙ্গে।

.

সেই গেম-ট্র্যাকটাতে পড়তেই দেখা গেল যে একটি বাঘেরই পায়ের দাগ আছে সেখানে। খুব বড়, পুরুষ বাঘ। যাকে দেখেছি। একা এসেছে। এই বারাশিঙার দলকে প্রায় ধাওয়া করেই এসেছে বাঘটা বহুদূর থেকে। অথচ কেন যে, তা আদৌ বোঝা গেল না।

আমাদের বাঘ জানোয়ারদের দূর থেকে ধাওয়া করে, আফ্রিকার সিংহ বা চিতার মতো কখনওই মারে না। তাছাড়া, খাওয়ার জন্যে ধাওয়া যে আদৌ করেনি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। মারার পর খায় না এবং পরেও তারা কোনও মড়িতেই যদি ফিরে না আসে, তা হলে বুঝতে হবে মারার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই খাওয়া নয়। তাও যদি-বা বোঝা গেল যে, বাঘ ব্যতিক্রমী ব্যবহার করছে, তা বারাশিঙার দলই বা জঙ্গলের দুপাশে দলছুট হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে কেন গেল না? কোনও মাংসাশী জানোয়ার তাড়া করেছে বলেই যে তাদেরও লাইন করেই দৌড়ে পালাতে হবে, জঙ্গলের আইনে এমন বে-নিয়ম আছে বলেও তো কখনও জানিনি!

বাঘের ও বারাশিঙাদের পায়ের চিহ্ন দেখবার পর আমি, হিরু পানকা আর হাজো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে মুখে না বলে নিরুচ্চারে সেই কথাই বললাম।

একটু উঠেই পাহাড়টা ঢালু হয়ে গড়িয়ে নেমে গেছে একটি উপত্যকাতে। এখানে হয়তো আগে কোনও হরজাই জঙ্গল ছিল। কখনও ক্লিয়ার-ফেলিং হয়েছিল। তারপরই কোনও অজ্ঞাত কারণে অথবা হয়তো শম্বর-বারাশিঙার বিচরণভূমি করে গড়ে তোলার জন্যেই এখানে আর কোনও বড় গাছ লাগানো হয়নি বনবিভাগ থেকে।

একটু থেমে, নিভে যাওয়া পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে ঋজুদা বলল, তবে তোরা এত এত বন ঘুরে একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিস যে, বনবিভাগ কী করবেন না করবেন তার জন্যে বনদেবীর মাথাব্যথা নেই আদৌ। তিনি এলাকা ফাঁকা পেলেই নিপুণ জমিদারের মতো সঙ্গে সঙ্গে সেই এলাকার জবরদখল নিয়ে নেন। দিকে দিকে সবুজ আর লাল আর বেগুনির পতাকা তুলে দেন।

তারপর কী হল বলো?

বৃষ্টিভেজা নরম চাপ-চাপ দূর্বা ঘাসের আর ঘাসবনের ওপর দিয়ে, ভেতর দিয়ে, হাওয়া বয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য নদীর মতো। আর আমার সামনে দুই আদিবাসী শিকারী, তাদের সুন্দর সুঠাম শরীর নিয়ে সামনের মাটিতে চোখ রেখে সাবলীল ছন্দে হেঁটে যাচ্ছে একলয়ে, একতালে। মনে হচ্ছে, আমরা যেন কোনও অনাদিকালের শিকারযাত্রায় চলেছি। যেন প্রাগৈতিহাসিক দিনের কোনও গুহাগাত্রে সিঁদুরে-লাল রঙে আঁকা তিনজন শিকারি গুহা ছেড়ে নেমে এই শীতের বনের বৃষ্টিভেজা প্রান্তরে, বাঘের থাবা বা তার চলার চিহ্ন নয়; অন্য। কোনও ভয়াবহ প্রাগৈতিহাসিক অপদেবতারই পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলেছি, তাকে ধরাশায়ী করব বলে। যুগ-যুগান্ত ধরেই যেন চলেছি আমরা।

তারপর?

ঋজুদাকে থামতে দেখে আমি বললাম।

 বাঘ যদি সোজা যেত, তবে তার পথ শেষ হত গিয়ে প্রান্তর পেরিয়ে অন্য শুড়িপথে। আর পথ পেরুনোর পর, গভীর সেগুন জঙ্গলে। অথচ কোনও বাঘেরই স্বভাব নয় এমন আড়াল বর্জিত প্রান্তর দিয়ে দিনমানে হাঁটা। এই বাঘ আদৌ স্বাভাবিক নয় যে, তা বোঝাই যাচ্ছে।

হাজো হঠাৎ থেমে পড়ে আমার দিকে চাইল। তারপরই হাসল, একেবারে স্বর্গীয়, দেবদূলর্ভ হাসি। সঙ্গে-সঙ্গে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। হাওয়া থেমে গেল। যেন হাজোর হাসিতে খুশি হয়েই।

হাজো ডান দিকে ঘুরেই দ্রুত এগোল। এদিকে প্রান্তরটি মিশেছে গিয়ে একটি পাহাড়শ্রেণীর সানুদেশে। ইতিমধ্যে, দেখতে-দেখতে আমরা চার ঘণ্টা হেঁটে এসেছি প্রায়। এখন বেলা প্রায় দুটো বাজে। পদচিহ্ন দেখে এগোতে অনেক সময়ে এক মাইল পথ পেরোতেও বহু ঘণ্টা লেগে যায়। রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করার সময়েও তাই। চিহ্ন যখন লোপাট হয়ে যায়, তখন তাকে খুঁজে বের করতে সময় লাগে। মনোযোগ দিয়ে চেয়ে দেখতে হয়, উল্টোনো ঘাসে, ঝোপের ছেঁড়া পাতায়; রক্তের ফোঁটায়। চার ঘণ্টা পরে দূরত্ব অতিক্রান্ত হয় হয়তো এক কি.মি.।

হাজো এবার কথা বলল, ডান হাতের তর্জনী ঐ নীল পাহাড়শ্রেণীর দিকে নির্দেশ করে। বলল, বাঘ ঐ দিকেই গেছে। ঐ পাহাড়ে গুহাও আছে অনেক। ঐখানেই ডেরা ওদের।

এদিকে প্রান্তরে নেমে আসার পর থেকেই ঘন ঘাসের জন্যে বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না আর। ঘাসে-পাতায় তার চলে যাওয়ার ক্বচিৎ চিহ্ন। তার থাবার নীচে ঘাস বা মাটি উপড়ে বা উলটে যাওয়ার আভাস। এখন এমন করেই পিছু নিতে হবে।

আমি হতাশ হয়ে গেলাম।

ওদের দুজনকে বললাম, এইভাবে কি বাঘ শিকার হয়? তাও একটি নয়, দুটি। তোমরা একেবারে পাগলামি করছ। ঐ পাহাড়তলিতে পৌঁছে ঘন হরজাই বনের মধ্যে ঢুকতে-ঢুকতেই তো অন্ধকার হয়ে যাবে। আসলে সূর্য তো আজকে নেই। অন্ধকারে কোথায় পায়ের দাগ খুঁজতে যাবে? দেখাই তো যাবে না কিছু।

ওরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। হাজোর মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল।

উঠতি-যুবকেরা তাদের উৎসাহের বাড়াবাড়িতে এবং অভিজ্ঞতার অভাবেও বয়স্কদের অনেক সময়েই যেমন বোকা-বোকা বিদ্রূপ করে, সেইরকমই বিদ্রুপের হাসি। এতে অভিজ্ঞদের গা জ্বলে। ভটকাই-এর এ কথাটা জেনে রাখা উচিত। বিশেষ করে, ভটকাইএরই। আমি আর তিতির ঋজুদার এই কথাতে দ্রুত মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। তবে কি ভটকাইএর দিন ফুরোল? কথাটা ভেবেই বড় আনন্দ হল মনে।

হিরু পানকা কিন্তু কিছুই না বলে চুপ করে ঐ ঘন বন আর পাহাড়ের দিকেই চেয়ে রইল।

তুমি বকে দিলে না কেন? হাজোকে?

নির্লজ্জ ভটকাই ইন্টারাপ্ট করে বলল।

যে-সম্পর্কে সম্মান নেই সেখানে বকাঝকা করতে যাওয়া মানেই নিজেকে আরও অসম্মানিত করা।

হাজোর মুখ দেখে মনে হল, ও নিশ্চয়ই মনে করেছে যে, আমি ভয় পেয়েছি। ভয় যে আমি, এই অধম ঋজু বোস কখনও-কখনও পাইনি বা ভবিষ্যতেও পাব না এমন নয়। আমি তো অতিমানব নই! ভয়ের কারণ ঘটলে, ভয় বিলক্ষণই পাই। তবে বাহাদুরিপ্রবণতা, অবিমৃষ্যকারিতা আর সাহস তো এক কথা নয়।

কী বললে কথাটা? অবিমিস্ৰকারিতা?

তিতির শুধোল।

ভটকাই তিতিরকে স্নাব করে বলল, মিস্রি-ফিস্রি নয়। ষ এর ব্যাপার। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মেয়ে, তুমি ইন্টারাপ্ট কোরো না। বানানটা লিখে দেব। সংসদের বেঙ্গলি টু বেঙ্গলি অভিধানে দেখে নিয়ে আগে বাড়ো ঋজুদা।

ভটকাই সত্যিই একেবারে ইকরিজিবল হয়ে উঠছে। অথচ ঋজুদাও তেমন কিছুই বলে না। ভটকাইয়ের মধ্যে কোথায় যেন এক ধরনের অথরিটির ব্যাপারও আছে। মনে হয়, ঋজুদা সেটা সপ্রশংস চোখে দেখে। আমার ভয়টা সেই কারণেই। এতদিনের ঋজুদাকে কি রুদ্রর কাছ থেকে কেড়েই নেবে এই নন-ডেসক্রিপ্ট–ভটকাই, যাকে আমি এনে ঋজুদার কাছে হাজির করেছিলাম। এই নইলে বাঙালি। যার হাতে খায় তার হাতেই কামড়ায়।

হাজো যখন কথা শুনবে বলে মনে হল না, তখন হিরুকে শুধোলাম, কী করবে?

হিরু বলল, এমনি-এমনি ফিরে গেলে গাঁয়ের লোকে কী বলবে?

কী বলবে আমার দাদু, পাহান্?

 হাজো বলল। উত্তেজিত গলায়।

বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, বাঘ-বাঘিনী কি সেখানে বাঁধা আছে? না, গুহার সামনে থিতু হয়ে বসে আছে কখন তোমরা গিয়ে তাদের গুলি ঠুকবে সেই অপেক্ষায়? তোমাদের মধ্যপ্রদেশের বাঘেরা যে এমন গুলিভোর তা তো আগে জানা ছিল না।

হিরু বলল, না হুজৌর, সে কথা নয়। ফিরে গেলে, ওরা আপনাকে কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু আমাদের গাঁয়ে টেকাই দায় হবে টিটকিরির চোটে। আপনি তো চলে যাবেন সময় ফুরোলেই। রাজুপ্রসাদও আর কোনওদিন বন্দুক দেবে না হাজোকে। আপনার জন্যেই দিয়েছিল।

 টিটকিরি খাবে এই ভয়ে প্রাণটাই দেবে? টিটকিরি দেখছি বাঘের চেয়েও ভয়াবহ।

 আপনি সঙ্গে আছেন, প্রাণ নেয় কে? আগে তো মান হুজৌর। তার অনেক পরে তো জান।

কী করতে চাও এখন?

 এগিয়ে যেতে চাই। হাজো বলল।

বলেই বলল, আমি জানি, জঙ্গলে ঢোকার পরই পাহাড়ের পায়ের কাছে একটি দোলা মতো জায়গা আছে। গরমের সময়েও সেখানে জল থাকে। বাঘেরা সেখানে গলা ডুবিয়ে বসে থাকে। তার পরেই পাহাড়ে একটা গুহাও আছে। ওই বাঘ-বাঘিনী সম্ভবত ওখানেই থাকে। জলে, অন্য কোনও জানোয়ার এলে গুহার সামনের চ্যাটালো পাথরে বসে-বসেই ওরা দেখতে পায়, কোন জানোয়ার এল বা গেল। তারপর পাহাড় ঘুরে এসে পেছন দিক দিয়ে তাকে অনুসরণ করে।

শেষ কবে দেখেছ বাঘেদের ঐখানে। কখনও কি নিজ চোখে দেখেছ?

 মাত্র পাঁচদিন আগেই। আমার মামাবাড়ির পথ এই পাহাড়েরই তলে-তলে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সুফকর থেকে পাঁচ ক্রোশ পথ। সেদিন আমি মামাবাড়ি থেকে ফিরছিলাম। বেরোতে দেরী হওয়াতে বিকেল হয়ে গেছিল। পশ্চিমের আলো এসে পড়েছিল পুবে। সেই দিনশেষের নরম আলোতে দেখি বাঘ আর বাঘিনী ইয়া-ইয়া গোঁফ নিয়ে পাথরের ওপরে বসে-বসে কী যেন ভাবছে। মনে হচ্ছিল যেন, ছবি। এতটুকু নড়াচড়া নেই। আমি বলি কী, ওই জলে পৌঁছে যদি আমরা তার পাশে পায়ের দাগ দেখতে পাই তা হলেই তো বুঝতে পারব যে, যে-বাঘকে অনুসরণ করে আমরা এসেছি সেই বাঘই এই বাঘ কি না। মানে, মদ্দাটার পায়ের ছাপ যদি একইরকম হয়। বুঝলেন তো হুজৌর!

 মনে-মনে দ্রুত একটা হিসাব নিলাম সময়ের। হাজো যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তা হলে অন্ধকার নামার আগেই আমরা ঐ জায়গাটাতে পৌঁছতে পারব। যদি সুযোগ পাওয়া যায় একটা। না পেলে, না-হয় ফিরেই যাব। বৃষ্টি অনেকক্ষণই থেমে গেছে। ফিরে যেতে কোনও কষ্ট বা অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। টর্চ ওদের দুজনের কাছেও আছে।

 কী করবেন হুজৌর?

হিরু পানকা বলল।

চলো, হাজো কী বলছে দেখাই যাক।

জয়ের আনন্দে হাজার মুখ হাসিতে ভরে গেল।

 তোমরাও কি বারাশিঙাদেরই মতো প্রসেশন করেই বাঘের গুহাতে ঢুকতে চাইছিলে নাকি?

তিতির শুধোল।

ঋজুদা বলল, না, সে বিষয়েও পরামর্শ করে নিলাম। পাইপটা ধরিয়ে একবার বুদ্ধির গোড়াতে ধোঁয়াও দিয়ে নিলাম। ঠিক হল, প্রান্তর ছেড়ে জঙ্গলে ঢোকার অনেক আগেই আমরা তিন দিকে ছড়িয়ে যাব। ঐ বাঘের পায়ের দাগ আমরা তিনজনে দেখেছি। অতএব সেই দাগ দেখলেই চিনতে পারব। যদি ঐ বাঘটিই হয়, তবে আমরা তিনজনে সুবিধেমত তিনটি জায়গাতে, গাছেই হোক কি মাটিতে বা পাথরেই হোক, বসে চোখ-কান খোলা রেখে শুনব, দেখব। সুযোগ যদি পাওয়া যায় তবে গুলি করার চেষ্টাও করা হবে। কিন্তু ওখানে থাকব ঠিক রাত আটটা অবধিই। তার পরে এক মিনিটও নয়। জঙ্গলে গরু-খোঁজার মতো করে বাঘ খোঁজার অভ্যেস আমার নেই।

ওদের ঘড়ি ছিল না, আমার ছিল। ওদের বললাম, ঘড়ির রেডিয়াম লাগানো ডায়ালে আটটা বাজলেই আমি টি টি পাখির ডাক ডেকে উঠব। আর হাজো উত্তর দেবে পেঁচার ডাক ডেকে। হিরু উত্তর দেবে শুয়োরের ঘোঁতঘোঁতানি আওয়াজ করে। তারপর যে জায়গাতে আমরা প্রান্তর ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকব ঠিক সেই জায়গাতেই আবার ফিরে আসব। সেখান থেকে তিনজনে একসঙ্গে হয়ে সুফকরে ফেরার পথ ধরব।

.

আমরা যখন প্রান্তর ছেড়ে আলাদা হয়ে গেলাম তখন কী মনে হওয়াতে আমি ফিসফিস করে বললাম, তোমরা দুজনে বরং একসঙ্গেই থেকো। মাটিতে না বসে, কোনও গাছেই উঠো। তারপরই হাজোকে বললাম, যদি একেবারেই কাছে না পাও, পাশ থেকে না পাও, তবে গুলি মোটেই করবে না। একটি বাঘই যথেষ্ট। তার ওপর দুটি। এবং এদের যা মেজাজ! গুলির শব্দ শোনামাত্রই অন্যজন সঙ্গে-সঙ্গে আক্রমণ করতে পারে। গুলি করার আগেও ঘুণাক্ষরে আমাদের উপস্থিতি জানতে পেলেও আক্রমণ করতে পারে। গুলি করলে, বাঘ মরেছে যে, সে-বিষয়ে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে তারপরই নামবে গাছ থেকে।

ওরা মাথা নেড়ে আমার কথাতে সায় দিল। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হল ওরা দুজনে একসঙ্গে থাকলে সঙ্কেতটা কী হবে তা বলা হল না। তখন আর সময়ও ছিল না নতুন করে কিছু বলার।

.

ওরা দুজনে একসঙ্গে বাঁদিকে গেল আর আমি ডানদিকে। বনের মধ্যে অনেকখানি ডানদিকে গিয়ে পাহাড়ের একেবারে কোল ঘেঁষে ওই জলাটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

তখনও সন্ধ্যে হতে ঘণ্টাখানেক বাকি কিন্তু নানা পাখি ও জন্তু-জানোয়ারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। খুব সাবধানে মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজতে খুঁজতে এবং মাটির ওপরে মনোমতো বসার জায়গা নজর করতে-করতে এগোচ্ছিলাম। রাইফেলটাতে গুলি ভরে নিলেও রাইফেল ডান হাতে ধরা এবং ডান কাঁধের ওপরেই রাখা ছিল।

জায়গাটা দেখলে মনে হয়, চিতাবাঘের আসল জায়গা। বড় বাঘের নয়। ভাবছিলাম, হাজো চিতাবাঘই দেখেনি তো? জোড়ে? চিতাবাঘকে বড় বাঘ বলে ভুল করছে না তো?

অবশ্য ওরা বনশিশু। বনই ওদের খেলাঘর, বনই সব। আমি ভুল করতে পারি, কিন্তু হাজো কি ভুল করবে?

একটু পরেই হঠাৎই নরম মাটিতে একটি বাঘিনীর পায়ের দাগ দেখলাম। বেশ বড় বাঘিনী। এবং তার একটু পরেই বাঘেরও। এবং সেই বাঘটারই। আমার হৃৎপিণ্ড অর্ধেক ভয়ে এবং অর্ধেক আনন্দে বন্ধ হয়ে গেল। নাঃ, হাজো ভুল করেনি!

কোথায় উঠে বসা যায় ভাবছি, ঠিক সেই সময়েই চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ে একটি অসন গাছের ডালে একটি মাচা বাঁধা। এবং সেটি আদৌ পুরনো নয়, কাঠগুলো টাটকা-কাটা। আশ্চর্য! সেই মাচার একটি খুঁটির উপরিভাগ থেকে একটি বড় থামোফ্লাস্ক নীচে ঝুলে আছে। মাচাটা একদিকে বেঁকেও গেছে অনেকখানি। কোনও কিছুর ভারে! খুবই চিন্তায় পড়লাম। রাইফেলটা এক হাতেই রেডি-পজিশানে ধরে এগোতে লাগলাম সেদিকে।

গাছটার ঠিক পেছনেই, একটি বড় কালো পাথর ছিল, ল্যানটানার ঝোপে প্রায় আধ-ঢাকা হয়ে। সেই পাথরটির ওপরে উঠতে-উঠতে ভাবছিলাম যে, যে-জঙ্গলে বাঘ আছে সেখানে এইরকমভাবে গাধার মতো মাচা কেউ বানায়? বাঘ তো এই পাথরে উঠে, আমি যেদিক দিয়ে উঠছি, অথবা পেছন দিক দিয়ে; সহজেই মাচায় বসা শিকারিকে নামিয়ে নিতে অথবা মাচাতেই খতম করে দিতে পারে। যদি সে চায়।

মাচাটা দৃষ্টিগোচর হতেই আমার মাথা ঘুরে গেল। দেখি, তার একপাশে একটি কম্বল, একটু রক্তও লেগে আছে তাতে। রক্তাক্ত জায়গাটা তখনও ভেজা। একটি থ্রি-ফিফটিন রাইফেল, ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স কোম্পানির।

রাইফেলের বোপ্টটি আস্তে করে খুলে দেখলাম, চেম্বারের মধ্যে একটি ফোঁটা-কার্তুজ। ম্যাগাজিনে আরও চারটে গুলি আছে।

গা-ছমছম করে উঠল।

রাইফেলটি যথাস্থানে নামিয়ে রেখে থামোসটা কাঁধে ঝুলিয়ে যতখানি নিঃশব্দে পারি মাচার দিকে পেছন ফিরতেই, ভয়ে প্রায় চিৎকারই করে উঠতাম, কী করে যে সামলে নিলাম জানি না। এখনও দৃশ্যটার কথা ভাবলে নিজেই নিজের কাঁধ চাপড়াই।

কী দেখলে কী? তিতির উৎকণ্ঠিত হয়ে জিগ্যেস করল।

দেখি, সার্জের কুর্তা আর কালো-পাজামা পরা একজন মানুষ চিত হয়ে শুয়ে আছেন পাহাড়ের দিকে ল্যানটানার ঝোপের ভেতরে। তাঁর হাঁ-করা মুখটি আকাশের দিকে করা। আর তাঁর মাথার বাঁদিকে এবং ঘাড়ে বাঘের দাঁতের দাগ আর চারটি ফুটো। রক্তে পুরো জায়গাটা থিকথিক করছে। কোনও খানদানি ঘরের সৌখিন শিকারী। তবে যুবক নয়। মধ্যবয়সী। শেখার বয়সে শেখেননি। অথচ তোদের বোদ্ধাকাকু যাই বলুন, না-শিখে এসব খেলা, খেলার নয়। শিক্ষানবিশির চেয়ে, অভিজ্ঞতার চেয়ে, শখের পরিমাণ বেশি থাকাতেই বোধ হয় এই বিপত্তি।

ব্যাপারটা কতক্ষণ ঘটেছে তা নির্ভুলভাবে অনুমান করা যাচ্ছে না। আমি চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ওঁর বুকের শুকনো জায়গাতে হাত ছুঁইয়ে দেখলাম যে, বুক ওই ঠাণ্ডায় তখনও গরমই আছে। বহুমূল্য শাহতুষ-এর আলোয়ানটি ছিন্নভিন্ন হয়ে কোমরে আর পায়ে জড়িয়ে রয়েছে।  

ঘটনা তা হলে বেশিক্ষণ ঘটেনি! মাচার নীচে কিন্তু বাঘের থাবার দাগ নেই। শুধুই বাঘিনীর। রক্ত, মাটিতে কোথাওই দেখলাম না। তবে কি গুলি লাগেনি? নাকি রক্ত বেয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ার আগেই এইসব মুহূর্তবাহী ঘটনাসমূহ ঘটে গেছে পর পর?

এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে দ্রুত। এই পরিবেশে, এই নতুন, হঠাৎ-জানা পরিস্থিতিতে হিরু বা হাজোর সঙ্গে যে কথা বলব তারও কোনও সম্ভাবনা নেই। কী করে কী ঘটল এবং কী ঘটবে, সেই চিন্তায় রীতিমত ঘেমে উঠলাম।

ভেরি গুড। জমে গেছে ঋজুদা। আগে বাড়ো। ঔর আগে।

ঐ টেনশানের মধ্যেও সকলকে চমকে দিয়ে বলে উঠল ভটকাই।

কী ইয়ার্কি হচ্ছে ভটকাই?

আমি আর তিতির একসঙ্গেই বললাম।

ঋজুদা ভটকাইয়ের বাধা পেয়ে চুপ করে গিয়ে, নিভে-যাওয়া পাইপটাতে দেশলাই ঠুকে দুবার ভুড়ভুড়ক করে টান লাগাল। মুখ দেখে মনে হল, এই বিরতিতে খুশিই হয়েছে যেন। অনেকক্ষণ ধরে বলছে তো!

আবার শুরু করল ঋজুদা একটু পরে।

হাজোবৰ্ণিত গুহাটার আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের একটি খাঁজে, যে-খাঁজটিকে ওপরের গুহা বা তারও সামনের পাথরটি থেকে দেখা যাবে না, সেখানে উঠে বসলাম। মাটি থেকে দশ ফিট মতো ওপরে। বসে, রাইফেলটাকে কোলে শুইয়ে থামোফ্লাস্কটি পাশে রেখে, স্ট্যাচু হয়ে গেলাম।

ঠিক সেই সময়েই আমার শরীরে একটা ঝাঁকুনি এল। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম আমি। আর তার সঙ্গে ঠাণ্ডা ঘাম। এতক্ষণ হাঁটাতে, গরমে ঘেমে গেছিলাম। শীত লাগে চলা থামালে। কিন্তু সেই শীত আসার আগেই এই হঠাৎ হিমেল ঘামে ভিজে গেলাম নতুন করে। কে জানে কেন!

বেশ কিছুক্ষণ পরে কাঁপুনিটা ছাড়ল। তার একটু পরই মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে বৃষ্টিভেজা জানুয়ারির শীত এসে দুকানের পেছন মোচড়াতে লাগল। খুব আস্তে বাঁ হাতটি তুলে টুপিটাকে চেপে বসালাম মাথার ওপরে। এমন সময়ে হঠাৎই একটি হাওয়া বইতে শুরু করল পশ্চিম থেকে পুবে। প্রান্তর থেকে গুহার দিকে। মনে হতে লাগল, হিমকণা বয়ে আনছে হাওয়াটা।

জায়গাটাতে অগণ্য বড় বড় হরজাই গাছ মাথার ওপরে চন্দ্রাতপের সৃষ্টি করেছিল। মনে হচ্ছিল, যেন কোনও অডিটোরিয়ামের ভেতরে বসে আছি। দূরে, জঙ্গলের ফাঁক-ফোকর দিয়ে প্রান্তরের দিক থেকে একটু উজলার আভাস আসছে। সেটিই যেন স্টেজ। সন্ধের আগে সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণীর সানুদেশের এই বনস্থলীর মধ্যে যে কোন্ পুজোর আগমনী বাজছে, তা কে বলবে! আগমনী না বিসর্জন? সেই পুজোর ঘণ্টা কানে বাজে না, বুকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজে। তবে এই পুজো কাপালিকের পুজোরই মতো। বড় ভয় করে এই অদেখা বনদেবতার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর এই সংহারমূর্তি দেখে।

ভদ্রলোক কি একাই এসেছিলেন? তাঁর সঙ্গী কি কেউই ছিল না? সঙ্গীকেও কি বাঘ বা বাঘিনী…?

ভাবছিলাম, কিন্তু ভাবতেও ভয় করছে। মাঝে-মাঝেই মনে হচ্ছে ওই বারাশিঙার দল বোধ হয় অস্বাভাবিক বা আধিভৌতিক কোনও ব্যাপার। আমাদের ছলে বলে এখানে নিয়ে আসার জন্যেই বোধ হয় ওই ঘটনা কেউ ঘটিয়েছিল। ফিরে গিয়ে সুফকর-এ হয়তো শুনব, যে বারাশিঙাটি মরে পড়ে ছিল সেও উঠে পড়ে দৌড়ে বনে চলে গেছে। শুকিয়ে গেছে তার ক্ষত। মুছে গেছে তার গা থেকে রক্তের দাগ। কে জানে!

হিরু আর হাজো যে কোনদিকে আছে ঠাহর করা যাচ্ছে না। অবশ্য আমি যে খাঁজে বসেছিলাম সেখান থেকে বেশিদূর দেখাও যায় না। মুরগি, ময়ূর, তিতির, খুদে-খুদে বটেরের ঝাঁক, কোটরা হরিণ, জোড়া ভালুক, সঙ্গে কালো ফুটবলের মতো দুটি ছানা; শম্বরের একটি দল, মস্ত শিঙাল একটি, মাঝারি শিঙাল একটি আর পাঁচটি মেয়ে-শম্বর সবাই জল খেয়ে চলে গেল।

শীতকালে কোনও জানোয়ারদেরই এমন তাড়াতাড়ি তৃষ্ণা পায় না। কে জানে! প্রকৃতির কথা, আবহাওয়ার কথা এরা সব আগেভাগেই বুঝতে পারে। বৃষ্টি থেমে গেছে। এর পরে হয়তো দুযোগ আসবে। যে-কোনও কারণেই হোক তারা সকলেই অন্ধকার হওয়ার আগেই এসেছে।

দূর থেকে একটি চিতাবাঘ ডাকল। তারপর পাহাড়ের ওপর থেকে হনুমানের হু-হা আওয়াজ ভেসে এল। মনে হচ্ছে পাহাড়ের ওপরে কোনও সমতল মালভূমি আছে।

তারপরেই, বুঝলি, ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। একে কৃষ্ণপক্ষের রাত, তায় আকাশে একটি তারা পর্যন্ত নেই। রাত যত অন্ধকারই হোক না কেন, খোলা জায়গায় তবুও একরকমের চাপা আলোর উদ্ভাস থাকেই। গাঁ-গঞ্জের, জঙ্গল-পাহাড়ের মানুষমাত্রই তা জানেন। কিন্তু এতো ভোলা জায়গা নয়! এ যে জঙ্গলের শামিয়ানার নীচে ঘোরান্ধকারে বসে থাকা!

অন্ধকার চোখে মুখে যেন থাপ্পড় মারছে। দুটি পেঁচা ডাকতে-ডাকতে ঝগড়া করতে করতে অন্ধকার ছেড়ে আলোর দিকে উড়ে গেল। হিরুর সংকেত নয় তো? না, এখন তো সবে সাড়ে পাঁচটা!

প্রান্তরের ওপরে দুটি টিটি পাখি টিটিরটি-টিটিটিটি-টিট্টিটি করে ডাকতে ডাকতে উড়ে বেড়াতে লাগল। কী দেখেছে, তা ওরাই জানে।

বাঘেরা যদি ঐ গুহাতেই থেকে থাকে তবে তারা মালভূমিতে উঠে না গেলে এদিক দিয়েই নামবে মনে হয়। জলের এপাশটা তাদের পায়ের দাগে-দাগে ভরা। বড় বড় গাছে তাদের নখের আঁচড়ের দাগ। আর বাঘেদের শরীরে যে তীব্র গন্ধ আছে, তারই নিশান দিকে-দিকে।

একটি পাহাড়ি ঈগল ওপরের মালভূমির কোণে উঁচু গাছ থেকে উড়ে এসে একটি প্রাচীন শিমুলের ডালে বসল। যখন বসল তখন আর দেখা গেল না। কিন্তু বোঝা গেল তাদের ডানার বিশেষ শব্দে এবং গলার কর্কশ পৌনঃপুনিক তীক্ষ্ণ বাঁশিতে। ডানদিক থেকে, জমাটবাঁধা নিকষকালো তীব্র মিষ্ট-কটু-গন্ধী অন্ধকারকে হঠাৎ নাড়িয়ে দিয়ে একটা কোটরা, তার ভয়ার্ত ব্বাক-ব্যাক ডাকে তার ভয়কে জঙ্গলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিয়ে, চারিয়ে দিয়ে, দৌড়ে চলে গেল জঙ্গলের গভীরে। জলের ধার থেকে।

তারপরেই একেবারে চুপচাপ। কোনওই শব্দ নেই। কে বা কারা যেন বনের সব শব্দ ও গন্ধ চুরি করে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেল।

কতক্ষণ সময় কাটল, বোঝা গেল না এমনিতে। তবে আমার হাত-ঘড়ির ডায়ালের রেডিয়ামে তখন সাতটা দেখাচ্ছিল। ঘড়ির দিক থেকে চোখ তুলেছি সবে, এমন সময়ে হঠাৎই আমার মাথার ঠিক ওপরের পাথর থেকে একটি নুড়ি, পাথরে-পাথরে গড়িয়ে একেবারে নাকের সামনে দিয়ে গিয়ে নীচে পড়ল। গড়িয়ে যাওয়ার সময়ে শব্দ হয়েছিল কিন্তু নরম মাটিতে পড়াতে শব্দ হল না।

আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। নিজেই নিজের মুণ্ডপাত করতে লাগলাম।

অনেক ভুল ইতিমধ্যেই হয়ে গেছিল।

 প্রথমত, এই ঘন ছায়াচ্ছন্ন চন্দ্রাতপের নীচে এমন মেক-শিফট বন্দোবস্তের মধ্যে হঠকারিতা করে বাঘের জন্যে বসাটাই উচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, হাজো এবং হিরু জানে না যে, এই বাঘ ও বাঘিনী মানুষও মারছে বা মেরেছে। তৃতীয়ত, অন্ধকার হয়ে যাওয়াতে আমি এবং ওরা কোথায় যে কে বসে রয়েছি তাও বুঝতে পারছিলাম না। বাঘ যদি আমার মাথার ঠিক ওপরের খাঁজে নেমে থাকে এবং যদি ওদের মধ্যে কেউ বাঘের দিকে গুলি করে বসে তবে সে গুলি আমার গায়েও লাগতে পারে। আমার গুলিও ওদের কারও গায়ে লাগতে পারে। চতুর্থত, এইরকম সম্পূর্ণ অচেনা অজানা পরিবেশে, রাতের বেলা আক্ষরিক অর্থে আন্দাজেই জোড়া-বাঘের মোকাবিলা করতে যাওয়ার মতো মুখামি করতে যাওয়াটা অত্যন্তই অনুচিত হয়েছিল।

আর একটু চা নেবে নাকি? তিতির বলল, ঋজুদাকে ইন্টারাপ্ট করে।

ভটকাই বলল, দাও, দাও তিতির। ঋজুদাকে চা দাও। আমাদেরও থাকলে দিতে পারো। একে ঠাণ্ডা, তায় টেনশান। হাত-পা জমে যাচ্ছে। ঠাণ্ডাতে।

ঋজুদা, তিতির চা ঢালতে-ঢালতে, নিভে যাওয়া পাইপটা আরেকবার ধরিয়ে নিল। পাইপ কেন যে মানুষে খায়। এ যেন ধৈর্যর পরীক্ষা!

তারপর, চা-টা খেয়ে নিয়েই আবার শুরু করতে যাচে ঠিক এমন সময় তিতির বলল, তোমার মাথার ওপরের পাথর থেকে নুড়ি গড়িয়ে পড়ল। নাও, তোমাকে কিউ দিয়ে দিলাম। বলো, তারপর থেকে।

হ্যাঁ। তবে আগেই বলেছি, তোদের যে, আমি বসেছিলাম পাথরের একটা খাঁজের ভেতরে। ওপর থেকে সেখানে সাপের পক্ষে আসা অসম্ভব ছিল না, কিন্তু বাঘের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। তাই তখনকার মতো আমার নিজের বিপদের ভয় ছিল না। তবু যে-বাঘ একজন শিকারির ঘাড় মটকেছে কিছুক্ষণ আগেই সেই বাঘই মাথার ওপরে এসে হরকৎ করছে এমনটি জানলে ভয় তো একটু হওয়ারই কথা! তা ছাড়া, আমাকে যদি ঐ খাঁজের আশ্রয় ছেড়ে বেরোতে হতোই তবে তো বাঘবাবাজির এক চাঁটিতেই এত যত্নের কেয়ো-কার্পিন-মাখা টেরিটি-সমেত চাঁদিখানিই কাপু হয়ে যেতে পারত। ইন্তেকাল ঘটে যেত। এমনকী একবার

আলম দুল্লিলাহে য়হ্ দিন সিরাতুল মুস্তকিমা
 রব্বিলে আলোমিন সিরাতল লাজিনা
আঃ রহমানে রহিম আমতাম আলেহি…

ইত্যাদি-ইত্যাদি বলে খুদাহর তারিফ পর্যন্ত করার সময় পেতাম না।

কিন্তু রাখে কেষ্ট মারে কে?

.

হিরু পানকা দুহাতের তেলোতে একদলা খৈনী মেরে চটাপট করে দু তালি দিয়েই নীচের ঠোঁটের আর নীচের পাটির দাঁতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বলল, হাঁ। উসকো বা যো হুয়াথা, ওহি বাতাইয়ে না বোস সাহাব।

ঋজুদা হিরু পানকার দিকে চেয়ে বলল, ওহি তো বতা রহা হ্যায় হিরু।

 হিরু পানকাও যে বাংলা একটু একটু বোঝে তা জেনে আমরা সকলেই বেশ অবাক হলাম। আমাদের মুখ দেখে মন পড়ে নিয়ে ঋজুদা বলল, আরে এই কাহা-কিসলির পেছনে কনসার্ভেটর দত্ত সাহেবের অবদান ছিল অসামান্য। পরে দত্ত সাহেব চিফ-কনসার্ভেটর তো হয়েই ছিলেন তারও পরে দিল্লিতে সবচেয়ে বড় সাহেব হয়েছিলেন। ওরা সবাই দত্ত সাহেব এবং আরও অনেক বাঙালি অফিসারের সঙ্গে কাজ করেছে, তাঁদের খিদমদগারী করেছে। তাই বাংলা একটু-আধটু অনেকেই বোঝে। বাঙালি শিকারিও আসতেন অনেকেই, আমারই মতো।

বলো, তারপর।

আমি বললাম।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি। রাইফেলের স্মল অব দ্য বাট-এ ডানহাতের পাতা আর ট্রিগার গার্ড-এ তর্জনী ছোঁয়ানো রয়েছে। বাঁহাতে ব্যারেলের নীচের দিকটা শক্ত করে ধরে আছি। ঐ শীতেও হাতের পাতা ঘেমে উঠেছে। ততক্ষণে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে আবার এদিকেই। আটটা হতে হবে হয়তো এল। বৃষ্টি থেকে জানে।

এদিকে কোনও সময়ে আটটা তো বাজবেই। ঘড়িকে তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না মোটেই। আটটা বাজলে ওদের সঙ্কেতও দিতে হবে। তারপর তিনজনে মিলে বাঘেদের খাদ্যও হতে হবে হয়তো।

এমন সময়ে হঠাৎই একটা জোর হাওয়া এল। বৃষ্টি থেমে গেছিল অনেকক্ষণই। শীতকাল। কোথা থেকে অমন হাওয়া এল কে জানে। আফ্রিকার উপজাতি বান্টুদের দেবতা উকুলুকুলু, না সিংভূম জেলার মুণ্ডাদের মূয়া ভূতেই এমন খেল দেখাচ্ছে, বোঝা গেল না।

সেই হাওয়াটা প্রান্তরের দিক থেকে এসে বনের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে আমার সমান্তরালে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে যেন নিঃশব্দে চুরচুর হয়ে, আজকালকার মোটরগাড়ির অ্যাসিডেন্টে-ভাঙা উইন্ডস্ক্রিনের মতোই ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল। আর সঙ্গে-সঙ্গে আরম্ভ হল বিদ্যুৎ-চমক।

এরকম বিদ্যুৎ-চমক ছেলেবেলায় একবার দেখেছিলাম গারো পাহাড়ের রাজধানী তুরা থেকে গৌহাটিতে নেমে আসবার সময়ে। জেঠুমনি সঙ্গে ছিলেন। চমকাতে থাকল তো চমকাতেই থাকল। এক মুহূর্ত অন্ধকার থাকে, তো পাঁচ মুহূর্ত আলো।

আটটা বাজা অবধি আর অপেক্ষা না করে আমি খুব জোরেই টিটি পাখির ডাক ডেকে উঠলাম। যেন পাখি, অতর্কিতে ভয় পেয়ে ডেকে উঠেছে। সঙ্গে-সঙ্গেই হাজোর পেঁচা বলল, দুরগুম, দুরগুম, দুরগুম্ আর হিরুর শুয়োরও ঘোঁতঘোঁতানি তুলে জাহির করল যে, সেও সামিল।

দুর্গা! দুর্গা! মনে-মনে বলে, পাথরের খাঁজটি থেকে নামতে যাব এমন সময়ে মালভূমির ওপরেই, কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে প্রায় একশো মিটার দূরের বড় গাছের ডালে-ডালে হুটোপাটি তুলে হনুমানের দল হু-উ-প হু-হুউপ হু-উ-প করে ডেকে উঠল। আর একটা কোটরা, আরও দূরে; মালভূমির ওপরেই, হনুমানদের গাছের দিক থেকে মালভূমির অন্য প্রান্তের দিকে ডাকতে-ডাকতে দৌড়ে যেতে লাগল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সাবধানে তো নামলাম নীচে। তারপর টর্চও জ্বালোম। কিন্তু টর্চের প্রয়োজন ছিল না। তিনজনে একত্র হয়ে ওই চন্দ্রাতপের ঘেরাটোপ ছেড়ে অতি ধীরে-ধীরে সাবধানে এগিয়ে গিয়ে প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়ালাম। অবশ্য হনুমানদের ডাক আর কোটরার ডাক নির্ভুলভাবেই বলে দিচ্ছিল যে, বাঘ বা জোড়া-বাঘ মালভূমির অন্য দিকে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, যদিও একটু আগেই কোনও অজ্ঞাত কারণে তারা আমাদের এদিকেই এসেছিল। তবে আমাদের অস্তিত্ব অবশ্য টের না পাওয়ারই কথা তাদের।

প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়াতেই বারোধ হয়ে গেল। সে কী অপূর্ব দৃশ্য। চতুর্দিকে বিস্তৃত ঘন সবুজ বৃষ্টিভেজা প্রান্তরে সেই শব্দহীন অবিশ্রান্ত বিদ্যুৎ-চমকের বিভা নিঃশব্দে যে কী শালীন স্নিগ্ধ শোভা এনে দিল তা ঠিকভাবে তোদের কাছে প্রকাশ করি এমন ভাষা আমার নেই।

বলেই, থেমে গেল ঋজুদা।

তিতির সম্মোহিতর মতো বলল, তারপর?

তখনকার মতো বাঘ বাঘিনী, মৃত মানুষ এবং আমাদের বিপদের কথাও সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে অতি সাবধানে সেই প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আবিষ্ট হয়ে চেয়ে রইলাম ঈশ্বরের সেই নীল-সবুজে মেশা প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন রংমশালের দিকে। আহা, কী অবর্ণনীয় সেই দৃশ্যর অনুভূতি, তোদের কী বলব!

 তিতির বলল, শিকারে না এলে কি তা দেখতে পেতে?

পেতামই না তো! শিকার তো একটা বাহানা, ছুতো; অ্যালিবাই। শিকারে ট্রিগার টানাটাই হচ্ছে লিস্ট ইমপট্যান্ট। শিকারের এই সব আনুষঙ্গিকই তো সব। সঙ্গী, সাথী, পটভূমি, প্রকৃতি, বন্য প্রাণীদের কুদরতি হরকৎ, এই সবই তো আসল। তোদের বোদ্ধাকাকু এইটাই হয়তো বোঝে না।

ছাড়ো তো!

 সবাই যদি সব বুঝতো তাহলে দুঃখ ছিল কি?

 বলেই বলল, আবার অন্য লাইনে চলে যাচ্ছ ঋজুদা! আগে বাড়ো।

 মিস্টার ভটকাই দৈবাদেশ দিলেন।

হ্যাঁ। হাজো আর হিরু এসে আমার সঙ্গে মিলিত হবার পরেই হাজো বলল, বড়া ভুখ লাগা হুজৌর।

মনে-মনে বললাম, তা তো লাগবেই! আমারও কি আর লাগেনি?

মুখে বললাম, চলো, ফেরা যাক এবারে সুফকর-এর দিকে। আজকের মতো।

কিন্তু মানুষটির কী হবে? মানে ঐ মৃতদেহের?

আমিই প্রশ্ন করলাম ওদের দুজনকে।

বলল, ঋজুদা। 

কোন মানুষটি? ওরা দুজনে সমস্বরে বলল।

 ওহো! নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললাম, তোমাদের বলা হয়নি। আমি যেখানে বসেছিলাম, তার পাশেই একজন মানুষের লাশ পড়ে আছে। বাঘে মেরেছে মাচারই ওপরে।

 তাই?

হ্যাঁ কিন্তু কে সে?

 তা, আমরা জানব কী করে?

 দেখতে কেমন?

মানুষটির চেহারার ও পোশাকের বর্ণনা দিলাম আমি ওদের। বললাম, বড়া খানদান-এর মুসলমান।

ওরা বর্ণনা শুনেই চিনে ফেলল।

 বলল, বুঝেছি, বুঝেছি। ইনি চিপির রহিস আদমি মহম্মদ বদরুদ্দিনের বড় শ্যালক হচ্ছেন। এঁর নাম ফকরুদ্দিন। প্রতি বছরই তো এই সময়ে উনি আসেন। শিকারের খুব শখ। কিন্তু গুলিতে জানোয়ারে কোনওদিনই যোগাযোগ হয় না। আমরা কতবার ছুলোয়া করেছি জঙ্গল, ওঁর জন্য। অথচ উনি নাকি চাঁদমারিতে উস্তাদ। অনেক মিডেল পেয়েছেন। খরগোস দেখলেও এমনই উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে খরগোস-এর গায়েও গুলি ঠেকাতে পারেন না।

ভটকাই বলল, এই ইনফরমেশানটাও বোদ্ধাকাকুকে দেওয়া দরকার। বাঘ তো দূরের কথা, খরগোস মারাও সোজা কথা নয়।

হাজো বলল, তবে মানুষটি বড় ভাল। দিলদার। ইসস তার এই হাল করল বাঘে!

হিরু বলল, কিন্তু ফকরুদ্দিন মিঞা তো আর বাঘ মারার পার্টি নয় আদৌ! তিনি বাঘ মারতে এলেনই বা কেন? খামোখা প্রাণটাই গেল।

হাজো বলল, বাঘ আছে জেনে কি আর এসেছিলেন? ভেবেছিলেন জলের পাশে শম্বর বা বারাশিঙা মওকামতো ধড়কে দেবেন। চিপিতে ভোজ হবে।

আমার ব্লক-এ সে আসেই বা কী করে? এই ব্লক তো আমারই রিজার্ভ করা।

আমি বিরক্ত হয়ে শুধোলাম।

ঋজুদা বলল।

 হুজৌর, এখানে মিঞা বদরুদ্দিনেরই রাজ। মস্ত বড়লোক সে। বাঘ তো কিছুই নয়। বদরুদ্দিনের শ্যালক ফকরুদ্দিন ইচ্ছে করলে ফরেস্টার, রেঞ্জার, মায় আপনাকেও মেরে তার হাভেলির ঘন সবুজরঙা দেয়ালে আপনার চামড়া বাঁধিয়ে রাখতে পারে। বদরু মিঞার শ্যালকের গায়ে হাত দেয় কে? কারও ঘাড়েই অত মাথা নেই।

আচ্ছা! এ কথা বাঘ বেচারা জানত না নিশ্চয়ই। তাই…।

তারপরই ভাবলাম, মরে-যাওয়া মানুষের ওপর রাগ করাটা ঠিক নয়।

তা হলে তো বদরুদ্দিন না কাকে বললে; একটা খবর এখুনি দিতে হয়। পুলিশকে খবর দিতে হয়। নইলে পরে তোমরা এবং আমিও ঝামেলাতে পড়ে যাব।

পুলিশে খবর দিলেই তো বাঘে ছুঁলে আঠারো-ঘা। বনের বাঘে ছোঁয়াতে তো মামুজান জানে-মরেও বেঁচে গেছেন আর পুলিশে ছুঁলে আমরা যে জানে বেঁচেও মরে যাব। তখন আমাদের জন্যে তো আর মামুনীজান কাঁদবে না!

 তাহলে কী করবে? মানুষটাকে হায়েনা-শেয়ালে তো এমনিতেই ছিঁড়ে খাবে। এমন করে কি ফেলে যাওয়া যায়? মানুষ তো!

 এদিকে হায়েনা-শেয়াল নেই। তবে শকুন আছে। কিন্তু এই ঘন জঙ্গলের নীচে শকুনের দৃষ্টি পৌঁছবে না। রাতে তো পৌঁছবেই না।

 সে যাই হোক, কিছু একটা করো। পুলিশ জানলে আমাদের নিয়ে টানাটানি তো করবেই, কিন্তু না জানালেও তো নয়।

 না, সরাসরি গিয়ে বলার দরকার নেই। গ্রামে ফিরে গিয়ে পাহাকে বলব। সেই ফরেস্ট গার্ডকে বলে যা হয় করবে।

হিরু বলল।

 তাই ভাল। নানাকে সকলেই মানে।

সেটাই ভাল।

হাজোও বলল।

সঙ্গে আর কে ছিল? মানুষটার? মাচা তো দেখেছিলাম আরও একটা। তোমরা যেদিকে ছিলে, সেদিকে। কি, তোমরা দ্যাখোনি?

আমি ওদের শুধোলাম।

ঋজুদা বলল।

 দেখেছি। ছিল, নিশ্চয়ই কেউ। হুজৌর, আমরা তো সেই মাচাতেই বসে ছিলাম। মাচাটি ভাল। কোনও শিকারির বসার চিহ্নও পেলাম। কিন্তু শিকারিকে পেলাম না।

 তবে কি বাঘ? বাঘেরা, তাকেও নিয়ে গেছে?

 যেতে পারে।

তখন এই হিরু পানকাই বলল, চলুন না হুজৌর, গিয়ে আরেকবার ভাল করে দেখে আসি।

আমি বললাম, বাঘকে যদি কাল মারতে চাও, তবে আজ আর ওখানে গিয়ে হল্লাগুল্লা কোরো না। তা ছাড়া, আমার মনে হয় তোমরা যার মাচাতে বসেছিলে সেই মাচার শিকারি পালিয়েছে। বাঘে তাকে ধরলে, তার চিহ্ন থাকত। মাচার আশেপাশে। মাচার ওপরেও। তোমরাও কি আর বুঝতে পারতে না? সেই গিয়ে অনেকক্ষণ আগে খবর দিয়েছে নিশ্চয়ই, এই অঘটনের।

চলো, এবারে এগোনো যাক।

 হাজো বলল।

.

শীতের রাতের আশ্চর্য নিঃশব্দ বিদ্যুতের কোনও বিরতিই নেই। কোটি-কোটি ওয়াট-এর সেই দেবদুর্লভ নীলচে-সবুজ আলোর বুকের কোরকটিকেই, হালকা-সবুজ ঘাসে-ভরা প্রান্তরের আর সীমান্তের গাঢ়-সবুজ অরণ্যানীর গায়ে; কারও অদৃশ্য হাত যেন সহস্র আঙুলে মাখিয়ে দিচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই গা-শিউরানো দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম সুফকর-এর দিকে। তখন সেই তিনমূর্তিকে যদি কেউ দেখতে পেত, তবে সে অবশ্যই ভাবত যে; স্বর্গপুরীর কোনও রঙ্গমঞ্চে উঁচুদরের কোনও নতুন-আঙ্গিকের একাঙ্ক নাটকের মূকাভিনয় চলেছে।

সুফকর-এর বাংলোতে যখন আমরা খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে ফিরলাম তখন রাত প্রায় বারোটা বাজে।

বহেড়া বাইগা মুরগীর মাংস গরম করে দিল মুহূর্তের মধ্যে। আর করে দিল গরম-গরম হাত-রুটি। হিরুদেরও খাইয়ে দিলাম জোর করে। ইতিমধ্যেই বারাশিঙাটার মাংস গ্রামের সকলে ভাগ করে নিয়েছিল, বাঘের নখ-লাগা, মুখলাগা জায়গাগুলো ফেলে দিয়ে। এই শিকারই হল বন-পাহাড়ের মানুষদের একমাত্র অ্যানিম্যাল প্রোটিন। বুঝলি। তাও নমাসে ছমাসে একবার জোটে কোনও শিকারী এলে। কারণ, ভারতের বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-করে মাংসর নামই শিকার। কারণ, শিকার করা মাংস ছাড়া অন্য কোনওরকম মাংসর কথা তাদের ধারনার বাইরে। পয়সা দিয়ে কিনে মাংস খায় এমন সামর্থ্য ওদের কারোরই ছিল না। তোরা সকলেই কম ক্যালোরির খাবারের জন্যে হন্যে হয়ে থাকিস ফিগার-ফিগার করে,আর এই হিরুরা, আর হাজারো অপুষ্টি রোগে ভোগে ভিটামিন আর প্রোটিনের অভাবে। বুঝলি তিতির। কী প্যারাডক্স।

ভটকাই বলল, সত্যই কইছে দাদায়। বড় বিচিত্র এই দ্যাশ!

ওর কথার ধরনে হেসে ফেললাম আমরা। ঋজুদাও হাসল ফিক করে। ভটকাই নিজে পেডিগ্রীড ঘটি কিন্তু ঋজুদা পেডিগ্রীধারী বাঙাল বলেই রসিকতাটা করল।

ঋজুদা থেমে গিয়ে পাইপ ধরাল।

মিস্টার ভটকাই বলল, এতবার থামলে গল্পের টেম্পোটাই যে মাটি হয়ে যায় ঋজুদা। মিস্টার রুদ্র রায় যে কী করে তোমার গল্প শোনে আর তোমাকে নিয়ে কী করে বই লেখে; তা সে মক্কেলই জানে।

ঋজুদা আমার রেসকুতে এল না বলে আমিই বললাম, সেকথা রুদ্র রায়কেই ভাবতে দে।

তা তো একশোবার। আমি ও লাইনেই নেই। লিখলে পদ্য লিখব, মানে ছড়া।

হ্যাঁ। সে আর কঠিন কাজ কী।

আমি বললাম, টন্টিং টোন-এ।

তিতির কথার পিঠে কথা বসিয়ে ভটকাইকে বলল, বলো দেখি, ছড়াই একখানা? অত্ত সোজা!

কার সঙ্গে কথা বলছ, ভেবে বলবে। আমার ক্লাসের ছেলেরা আমার নাম দিয়েছে বিচিত্রবীর্য। শব্দটির মানে জানো?

ভটকাই অন্য দিকে মুখ করে, তিতিরকে বিন্দুমাত্র ইস্পট্যান্স না দিয়ে বলল।

সে তো একটি চরিত্রের নাম…মহাভারতের…

আমি বললাম।

সে কথার জবাব না দিয়ে ভটকাই সত্যিই মুখে-মুখে ছড়া বানিয়ে দিল আমাকে নিয়ে :

ইট-চাপা লাল-ঘাস রুদদুর রায়
 গায়ে দিয়ে আঁটো-জামা শিকারেতে যায়।
থেমে থেমে, ভয়ে ভয়ে, পথেতে চলে।
ঋজুদার ল্যাংবোট সকলে বলে।
রংরুট হেঁটে চলে কাঁধে বন্দুক
পাছে বাঘ, পথে পড়ে; মনে নেই সুখ।

তিতির বলল, ফাইন! কনগ্রাস।

বলেই হাত বাড়িয়ে দিল ভটকাই-এর দিকে।

 ঋজুদা মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে হাসল।

আমার মুখ লাল হয়ে গেল। ভটকাই-এর অফট- রিপিটেড কথাই ওকে ফেরত দিয়ে বললাম, ওকে। ওয়ান মাঘ গান, বাট উইনটার উইল কাম এগেইন।

ঋজুদা হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে বলল, সেটা কী?

কী আবার। এক মাঘে শীত যায় না। এই রুদুর বাবুদের মতো ইংরিজি-মিডিয়াম স্কুলে-পড়া হাফ-সায়েব হাফবাঙালিরা তো বাংলা প্রবাদটা জানেই না। তাই সময় পেলেই ওদের শেখাই। ইংরিজির ক্যাপসুল-এ ভরে দিয়ে।

তিতির বলল, এটাকে ইংরিজি ক্যাপসুল-এ ভরে দাও তো দেখি?

কোনটা?

হকচকিয়ে গিয়ে বলল ভটকাই।

একদিনের বোস্টম, ভাতকে বলে পেরসাদ।

 ভটকাই সঙ্গে সঙ্গে বলল, খেলব না। ডোন্ট হিট মি বিলো দ্য বেল্ট।

আমি দু আঙুলে ময়দা চটকানোর মতো ভঙ্গি করে বললাম, ওরে ওরে ভটকাই। আয় তোরে চটকাই। 

ঋজুদা ও তিতির হো হো করে হেসে উঠল।

হাসি থামলে বললাম, ছড়াকার সকলেই, ভেবো না তোমার একারই বিশেষ পারদর্শিতা আছে এতে।

ভটকাই বলল, ঠিক আছে। পরে কখনও ছড়া-কম্পিটিশন হবে।

থাক। অন্য কথা বল। এনাফ ইজ এনাফ।

 তিতির বলল।

আমি বললাম, ঋজুদার গল্পের রেশই তো নষ্ট করে দিলি।

এবারে শুরু করো ঋজুদা। লাঞ্চ তো কানহাতে ফিরেই। তার আগে গল্প শেষ করো। তুমি এমন এমন জায়গাতে থামো যে, কোনও মানেই হয় না। এদিকে ইতিমধ্যেই খিদে-খিদে পাচ্ছে।

তিতির বলল।

ইয়েস। এটা তিতির ঠিকই বলেছে। গল্পের টানটাই নষ্ট হয়ে যায়।

 ভটকাই বলল।

.

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম দেরি করে। উঠেই দেখি পাহান বসে আছে বারান্দাতে। হলুদ-কালো আর লালরঙা চৌখুপি চৌখুপি কাপড়ের তুলোর কোট আজ তার গায়ে। হাতকাটা।

আকাশ তখনও মেঘলা। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বাংলোর হাতার কোণের অমলতাস গাছের নীচে আগুন করেছে ওরা অসমান পাথরের ঘের দিয়ে, উনুন বানিয়ে। তার চারপাশে গ্রামের চার-পাঁচজন মাতব্বরমতো লোক দুপা আগুনের দিকে দিয়ে, স্টেশনে কুলিরা যেমন করে দু হাত আর গামছা দিয়ে হাঁটু বেঁধে দুপা শূন্যে তুলে বসে, তেমনই করে বসে-বসে আগুন পোয়াচ্ছে আর চুট্টা খাচ্ছে। পাহানও রোধহয় ওদের ওখানেই ছিল। একটু আগেই বারান্দাতে এসেছে।

পাহান্ বলল, সেলাম হুজৌর।

সেলাম।

আমি বললাম। 

কাল রাতেই ফরেস্টারবাবুকে খবর দিয়েছিলাম লন্ঠন নিয়ে গিয়ে। সে আজ কাকভোরে চিপিতে খবর দিয়েছে পাকদণ্ডী দিয়ে গিয়ে, ঘোড়ায় চেপে। সেখান থেকে ফোনে খবর দেওয়া হয়েছে, কাহাতেও যে সঙ্গী ছিল মিঞা ফকরুদ্দিনের সঙ্গে, সেও রাত দশটা নাগাদ খতরার জায়গা থেকে ফিরে চিপিতে পৌঁছে খবর দিয়েছে। আবোলতাবোল বকছে নাকি সে। পাগলই না হয়ে যায়।

তাই?

চায়ের কাপ হাতে ধরে ড্রেসিং-গাউন পরে বারান্দার বেতের চেয়ারে এসে বসে আমি বললাম।

পাহান বলল, মিঞা বদরুদ্দিন আজই ঢের শিকারি নিয়ে গিয়ে বাঘ মারার চেষ্টা করবে। শালার মৃত্যুর বদলা নিতে।

আজই? তবে তো আর আমাকে দরকারই নেই তোমাদের। আমি অন্যদিকেই যাব বরং আজ। দেখি, কিছু মোরগা-তিতিরবটের পাই, তো কাবাব হবে।

পাহান্ বলল, ওতে আর কতটুকু মাংস হবে হুজৌর। একটা বড়কা শম্বর মেরে দিন, শিঙাল। তাতে আমাদের গ্রামের সকলের ভাগেই কিছু কিছু করে মাংস পড়বে। আমরা আপনার মারা শম্বরের শিং ও মাথা, চামড়া এমন করে ছাড়িয়ে নুন দিয়ে ঠিকঠাক করে দেব যে, কলকাতায় গিয়ে সোজা কাঁপারের দোকানে দিয়ে দেবেন।

সেটা আবার কোন দোকান?

তিতির শুধোল।

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, কাৰ্থবার্টসন হাপার। কলকাতার নামী ট্যাক্সিডার্মিস্ট। পাহান সবই জানত। মালিক ছিলেন এক আর্মেনিয়ান ভদ্রলোক। নাম, মিস্টার ফ্লেভিয়ান। আর ম্যানেজার ছিলেন হালদারবাবু।

পাহান একটা চুট্টা ধরিয়ে বলল, ওরা কিন্তু বাঘ আদৌ মারতে পারবে না হুজৌর। মধ্যে দিয়ে আরও দু-চারজন বাঘেদের হাতে ফও হবে। আর এত ঘন-ঘন মানুষ মারলে, কারও মাংস খেয়ে, ঐ জোড়া-বাঘ শেষে মানুষখেকোই না হয়ে যায়। এই আমার ভয়। বাঘ কি আর টাকা থাকলেই মারা যায়? না, যাত্রাপাটি নিয়ে এসে মারা যায়? বাঘ নিজেও একা-শিকারি, তাকে যে মারবে তাকেও একা-শিকারিই হতে হবে; হতে হবে, তার মতোই ক্ষমতাবান। বুদ্ধিমান। শিকারি কি আর সবাই হতে পারে?

পাহান্ আবারও একবার তার সেই অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করে চলে গেল। আমিও ভাবলাম যে মিঞা বদরুদ্দিন অ্যান্ড পার্টি কী করবে না করবে সেটা তাদেরই ব্যাপার কিন্তু সুফকর ব্লক আমার নামে রিসার্ভ করা আছে। এই ব্লকেরই বাঘ যাচ্ছেতাই করবে, মানুষ মারবে আর আমি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকব সেটা আদৌ উচিত হবে না। তাছাড়া গ্রামের মানুষেরা যখন এমনভাবে বারবার বলছে। তবে বদরুদ্দিনের শিকারীরা আজ আসবে বলে আমার মনে হয় না কারণ আজ সারাদিন তো কবর দিতেই চলে যাবে। সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এলেও তারা আগামীকালের আগে আসতে পারবে না বদলা নিতে।

ভাবলাম বটে কিন্তু সেদিন বাঘেদের ডেরাতে যাওয়া হল না। পাহান-এর পীড়াপীড়িতে ওদের জন্যেই শিকারে বেরোতে হল। এরকমই হয়। ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিজপোজেস।

চান করে, ব্রেকফাস্ট সেরে তো বেরোলাম হাজো আর বহেড়া বাইগাকে নিয়ে। হিরু পানকা বলল, আমি আজ ছাতুর লিট্টি বানাব ভালবেসে। পাকার বাড়ি থেকে খাঁটি ঘি আনিয়েছি।

ভটকাই বলল, আমরা কিন্তু শম্বর শিকারের গল্প শুনতে চাই না। আগেই বলে দিচ্ছি। তুমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছ ঋজুদা আজকাল।

ঋজুদা বাঁ হাতের পাতা দিয়ে স্বভাবোচিত এক অসহিষ্ণু ভঙ্গি করে ভটকাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আরে, সেদিন শুধু শম্বরই শিকার হয়নি, একজোড়া ভালুকের খপ্পরেও পড়েছিলাম, সে…। তা ছাড়া, সব শিকারের গল্পই শোনার মতো হতে পারে। খরগোস শিকারের গল্পও কি হয় না? হাঁস শিকার?

সে যাই হোক স্যার, বাঘে ফেরো।

ভটকাই বলল।

 ঠিক আছে।

 ঋজুদা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল।

 পরদিন সারা সকাল ও দুপুরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঘুমিয়ে, আর্লি-লাঞ্চ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

আমরা মানে?

আমরা মানে, আমি, হাজো আর হিরু পানকা। বহেড়া বাইগা বাংলোতেই থাকল।

.

গতকাল খবর যা পাওয়া গেছিল গ্রামের বিভিন্ন মানুষ এবং ফরেস্ট গার্ড, নানার কাছে তাতে জানা গেল যে আমার অনুমান মিথ্যে প্রমাণিত করে প্রায় বারোজন শিকারি বিভিন্নরকম দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে পুরো জায়গাটা ঘিরে গাছে-গাছে বসেছিল। মালভূমির ওপরের অন্য প্রান্ত থেকে শুরু করে, মালভূমির দু পাশে স্টপারদের দশ-পনেরো হাত অন্তর গাছে-গাছে বসিয়ে ছুলোয়া করেছিল একশ বিটারদের দিয়ে যাতে বাঘেরা তাড়া খেয়ে মালভূমি থেকে নেমে নীচে আসে, রাইফেল-বন্দুকের নলের সামনে। নীচে এলে, যেদিকেই যাক না কেন, একাধিক শিকারীর সামনে তাদের পড়তেই হত।

তারপর?

বাঘ এসেও ছিল। কিন্তু দুজন শিকারী আগ বাড়িয়ে হড়বড়িয়ে গুলি করে দেয় গাদা বন্দুক দিয়ে। বড় বাঘটির ওপরে। অনেকই দূর থেকে। গুলি লেগেছে কি লাগেনি তা নিশ্চিতভাবে বলতেও পারেনি তারা। বাঘ এক লাফে সোঁতা পার হয়ে বাঁ দিকের বনে ঢুকে গেছিল।

তবে, মস্ত বাঘ। যারা দেখেছে, তারা সকলেই বলেছে। মানে, ঐ বাঘটিই।

অন্য বাঘটা? মানে বাঘিনী?।

সে যে কোথায় ছিল, দেখেনি কেউই। সে বেরোয়ইনি। বা হয়তো তখন মালভূমিতে ছিলই না।

চমৎকার!

 মনে মনে বললাম, আমি।

 আজও সকাল থেকেই বৃষ্টি। শনশনে হাওয়া। কনে ঠাণ্ডা। পরশুদিনেরই মতো ওয়েদার। পৌঁছলামও গিয়ে অকুস্থলে প্রায় সেই পরশুদিনেরই সময়ে। তবে, আজ আমরা সারারাত থাকব বলে তৈরি হয়েই এসেছি।

সঙ্গে কোনও বেইট নিলে না ঋজুদা? মোষ বা বলদ?

আমি শুধোলাম।

না। ওই বাঘেরা অত্যন্তই সন্দিগ্ধ ছিল। বাঁধা বেইট-এর ধারেকাছেও আসে নাকি কখনও। আর ভুল করে যদি কখনও বাঁধা বেইট মেরেও দেয় তবুও কখনওই ফেরে না মড়িতে। বাঁধা জানোয়ার ধরার নজির নেই এদের। ভারী সেয়ানা। পাহান্ তো সে কথা আমাকে আগেই বলে দিয়েছিল।

তারপর?

ভটকাই বলল, কসেট্রেট ঋজুদা, প্লীজ কনসেনট্রেট।

এবারে তুই কিন্তু সত্যিই ডিসটার্ব করছিস ভটকাই।

ঋজুদা বলল।

সেদিনও আমার পরশুদিনের সেই জায়গাটিতে উঠে বসতে বসতেই অন্ধকার করে এল। ওরা যে কোথায় বসল, মানে অন্য মাচাটা যে কোথায়, তা আজ ঠিকঠাক দেখে নিয়েছিলাম। তবে অন্ধকার হয়ে গেলে এখানে দেখা যাবে না কিছুই। শব্দ শুনেই সব কিছু বুঝতে হবে। শ্রবণেন্দ্রিয়ই হবে একমাত্র ইন্দ্রিয়। সঙ্কেত আজও একই আছে। পরশুরই মতো।

আমি সেই খাঁজটাতে কষ্টেসৃষ্টে উঠে বসেছি পাথরজড়ানো মোটা শিকড়ে পা রেখে-রেখে। সেদিনেরই মতো পাহাড়ি ঈগলটি মালভূমির কোনও উঁচু গাছ থেকে উড়ে এসে বসল আজও একটি প্রাচীন শিমুলের ডালে। তার তীক্ষ্ণ ডাকে সেই সন্ধেরই মতো রাতের হিমেল বনের নিস্তব্ধতাকে ফালাফালা করে দিয়ে অন্ধকারকে নাড়িয়ে-চাড়িয়ে এলোমেলো করে দিল। করে দিয়েই, যখন উড়ে গেল উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে, তখন তাকে দেখা গেল। খরগোশ বা সাপ বা বড় মেঠো ইঁদুরের খোঁজে। এই শীতে সাপ পাবে না হয়তো। তবু, চেষ্টাই তো জীবন।

ঈগলটি চলে যেতেই একটি কোটরা হরিণ ওই চন্দ্রাতপের নীচের কোনও জায়গা থেকেই ভয় পেয়ে ডাকতে-ডাকতে জঙ্গলের গভীরে চলে গেল। হাজো আর হিরুরা যেদিকে বসবে বলে গেছে, সেদিকে। একটু পরই মনে হল যে, কোটটা ওদের মাচার পেছনে পৌঁছে গেছে।

এখন একেবারে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। চোখেমুখে থাবড়া মারছে পরশু রাতেই মতো। অন্ধকার যেন জলের নীচের জলেরই মতো ভারী। জলের নীচে তলিয়ে গিয়ে চোখের পাতা খুলতে যেমন জোর লাগে এই অন্ধকারেরও তেমনই ভার আছে। চোখ খুলতে বিষম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে সেই ভার।

হঠাৎই আবারও একটা কোটরা ডাকতে লাগল, যেদিকে হাজোরা বসে ছিল সেদিক থেকেই। আগের কোটরাটাই কি না তা বোঝা গেল না। পরক্ষণেই সে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ডাকতে-ডাকতে দ্রুত দৌড়ে গেল ওদের মাচার পেছনের গভীরে ঝোপঝাড় ভেঙে। ফারদার এওয়ে ফ্রম দ্য মাচান।

কোটরাটার ডাক থামার কিছুটা পরেই একটা গুলির শব্দ হল। তার পরক্ষণেই আরও একটা সেটা অন্য জায়গা থেকে। তবে প্রথম গুলিটির কাছ থেকেই।

ওরা কিসের ওপরে চাঁদমারি করছে কে জানে?

ভাবছিলাম আমি। কিছুমাত্রই দেখিনি বা শুনিনি আমি।

তারপরই নিস্তব্ধতাটা আরও গম্ভীর হল। কিসের ওপর যে গুলি হল এবং গুলির ফলাফল যে কী হল তাও বোঝার উপায় রইল না কোনও অন্ধকারে গুলি করলই বা কী করে ওরা, দুজনে দুজায়গা থেকে? টর্চ না জ্বেলে? টর্চ সঙ্গে থাকতেও কেন অন্ধকারে গুলি করল?

ওরা অবশ্য জঙ্গলেরই মানুষ। আমাদের চোখের দৃষ্টি-ক্ষমতার সঙ্গে ওদের চোখের দৃষ্টি ক্ষমতার তুলনা চলে না। অন্ধকারেও দেখতে পায় ওরা বনের প্রাণীদেরই মতো। তা ছাড়া, শটগান দিয়ে মারতে অত নির্ভুল নিশানার দরকারও হয় না। আন্দাজেও মারা চলে।

গুলির শব্দ হওয়ার সামান্য পরেই কুলকুচি করার মতো একটি আওয়াজ আমার ডান দিকে, উঠে-যাওয়া পাহাড়ের একেবারে পাড়ের কাছ থেকে হল। বাঘের মুখে রক্ত ওঠার আওয়াজ। মৃত্যুর আগে এরকম শব্দ হয় অনেক সময়ে। বুকে গুলি লাগলে। ওই শব্দটা কোথা থেকে এল তা অনুমান করে নিয়ে বুঝলাম যে, গুলি খুব কাছ থেকে করা হয়েছে, যেই করে থাকুক না কেন। একজন অথবা ওরা দুজনেই পর-পর লক্ষ্যভেদ করাতে বাঘ বা বাঘিনী যে-ই হোক, সে সম্ভবত নড়তেই পারেনি তার জায়গা থেকে। মার, মোক্ষম হয়েছে।

আসলে বুঝলি, এই হিরু, হাজো, এরা শিকারি তো আমাদের চেয়ে অনেক, অনেক গুণই ভাল। শিকার ওদের ধমনীতে বইছে অনাদিকাল থেকে। আমাদের বাহাদুরি বলতে কিছুমাত্রই নেই। আমাদের মতো হাতিয়ার ওদের যদি থাকত তবে আমাদের কোনও দামই থাকত না। তবে এ কথাও সত্যি যে, এইরকম সব আগ্নেয়াস্ত্র ওদের সকলের বা কিছু মানুষের কাছে থাকলে বন্যপ্রাণীও হয়তো অনেকদিন আগেই শেষ হয়ে যেত। ওদের খিদে যে সর্বগ্রাসী। তোদের বোদ্ধাকাকুরা জানেন না যে বন্যপ্রাণী শেষ হয়েছে আসলে বুনোদেরই হাতে। শিক্ষিত শহুরে শিকারীরা আইন মেনে আর কটি প্রাণী শিকার করেছেন তাদের তুলনাতে, সারা ভারতবর্ষে? গাদা বন্দুক, তীর-ধনুক, বিষ, ফলিডল, জাল ইত্যাদি দিয়ে যে-সংখ্যক বন্যপ্রাণী মারা হয়েছে স্বাধীনতার পর তা অবিশ্বাস্যই। মানুষের সংখ্যা এতই বেড়েছে, সঙ্গে মানুষের খিদে এবং লোভও এবং অপ্রয়োজনের প্রয়োজন যে; যা-কিছুই সুন্দর তার সব কিছুকেই শেষ করে দেওয়ার যজ্ঞে মেতে উঠেছে গ্রামীণ ও বন্য সব মানুষই। এইখানেই হিরু এবং হাজোদের সঙ্গে আমাদের তফাত। আমাদের শিক্ষা, আইনের প্রতি জন্মগত শ্রদ্ধাবোধ, বহির্বিশ্ব সম্বন্ধে জ্ঞান; আমাদের হয়তো সংযমী করেছে। অন্তত কিছুটা। সব ব্যাপারেই কোথায় যে থামা উচিত, সেই বোধটি আমাদের মধ্যে আমাদের শিক্ষা অন্তত কিছুমাত্রায় সঞ্চারিত করেছে অবশ্যই।

না-করে থাকলেও, সকলের মধ্যেই করা উচিত।

কন্টিনিউ।

ভটকাই বলে উঠল।

 ঋজুদা রীতিমত হকচকিয়ে গেল।

আমি বললাম, বুঝলি ভটকাই ঐ জ্ঞানের কিছুটা তোর সবজান্তা বোন্ধাকাকুকে দিস। বিলিতি রাইফেলের ঘোড়া টানলুম আর বাঘ মারলুম গোছের ধারণা যাদের, তাদেরও জ্ঞানের দরকার।

জ্ঞানের সীমা চিরদিনই ছিল, কিন্তু মূখামির সীমা তো ছিল না। কোনওদিনই!

ভটকাই বলল।

 তিতির বলে উঠল, তাই মূর্খদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ না করাই ভাল।

আমি বললাম, নাটকের শেষ অঙ্কে এসে তোরা এমন আরম্ভ করলি! সত্যি! তোদের কোনও সেন্সই নেই। বলো, ঋজুদা।

বলছি। চুপ কর আগে তোরা সকলে।

এই করলাম চুপ।

ভটকাই বলল।

দেখতে দেখতে রাত সোয়া সাতটা বেজে গেল। সন্ধে হয়েছিল, প্রায় পৌনে পাঁচটার সময়ে। পর-পর দুটি গুলির শব্দ এবং শব্দের প্রতিধ্বনি পাহাড়ে মালভূমিতে দৌড়ে গিয়ে থেমে যাওয়ার পর এখন নিস্তব্ধতা আরও গম্ভীর হয়েছে। শীত এবারে একেবারে স্বরাট সম্রাট হয়ে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসেছে। কোনওদিকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। শিশির ঝরছে গাছপালা থেকে এখনই। শুধু তারই টুপ টাপ শব্দ। থেমে থেমে হচ্ছে। কোনওরকম জানোয়ারের নড়াচড়ার সঙ্কেতও নেই, কাছে কি দূরে! জংলি ইঁদুর শুধু সির-সির তিরতির শব্দ করে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে বৃষ্টিভেজা লাল-হলুদ-সবুজ, ঝরা-পাতা, ঘাস-পাতার মধ্যে-মধ্যে।

আশ্চর্য!

থার্মোফ্লাস্কটা গতরাতে যেখানে রেখেছিলাম, সেখানেই আছে। তার মানে, এখানে কালকে কোনও শিকারী বসেনি। অথচ বসলে ভাল করত। জায়গাটা খুবই ভাল। থামোফ্লাস্কটাতে কি চা-কফি কিছু ছিল? সাবধানে, নিঃশব্দে খুলে গন্ধ শুকলাম একটু।

নিশ্চয়ই অন্য কিছু হবে। চা-কফি নয়। কড়া পানীয়।

আবার সাবধানে বন্ধ করে রাখলাম। পরের দ্রব্য না বলিয়া লইলে চুরি করা হয় যদিও, তবু হিরু আর হাজো এই বস্তু পেলে একেবারে লাফিয়ে উঠবে এই ঠাণ্ডাতে এই ভেবেই, সযত্নে রাখলাম সেটাকে।

ঘড়িতে ঠিক কটা বেজেছে জানি না। হঠাৎ ওরা পেঁচার ডাক ডাকল, আর শুয়োরের ঘোঁত-ঘোঁত করল।

কিন্তু কেন? আমিও টি-টি পাখির ডাক ডাকলাম। এবং নামার উদ্যোগ করলাম। খাঁজটা থেকে আমি নামতে যাব, টর্চ জ্বালব; ঠিক সেই সময়েই যেখানে ওদের মাচাটা থাকার কথা সেখান থেকে ধপ করে একটা আওয়াজ হল।

বুঝলাম, গাছ থেকে লাফিয়ে নামল কেউ। এবং হাজো চেঁচিয়ে বলল, জলদি আইয়ে হুজৌর। বাঘকো ভূঞ্জ দিয়া গোল্লিসে।

তাহলে হাজোই নামল গাছ থেকে লাফিয়ে!

কিন্তু হাজোর কথা শেষ হল না। একটা আঁ-আঁ-আক্‌ শব্দ যেন ওর কথাকটি গিলে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গেই টর্চটা জ্বেলে সেদিকে ফেললাম। দেখি, বিরাট একটা বাঘ হাজোর কাঁধ আর ডান হাতের মধ্যে কামড়ে ধরেছে। হিরু পানকাও গাছে বসেই সঙ্গে সঙ্গেই টর্চ জ্বালিয়ে আলো ফেলল জো আর বাঘের ওপরে। আর তুমুল গালাগালি করতে লাগল বাঘকে। বিচ্ছিরিভাবে। অশ্লীল ভাষাতে।

গুলি করলে হাজোর গায়ে লেগে যাবার আশঙ্কা ছিল। আসলে ও সেইজন্যেই চিৎকার করে বাঘকে তার দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিল। ঐ উচ্চাসনে বসে ঐ একই কারণে আমার পক্ষেও গুলি করার উপায় ছিল না।

আমি ফ্লাস্কটা ফেলে রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে নেমে এসেই বাঁ হাতে টর্চ আর ডানহাতে রাইফেল ধরে দৌড়ে গেলাম ওদিকে। দৌড়ে গেলাম এই জন্যে যে, মাচা থেকে গুলি করলেও গুলি হাজোর গায়ে লাগতে পারত।

আমার ওই মারমূর্তি দেখেও বাঘ একটুও ভয় পেল না।

ভয় ব্যাপারটা তাদের চরিত্রেই নেই আদৌ। সে এক ঝলক মুখ ফিরিয়ে দেখেই হাজোকে এক ঝটকায় মাটিতে নামিয়ে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে একবার হুঙ্কার দিল। সেই হুঙ্কার অন্ধকার শীতার্ত রাতের বৃষ্টিভেজা বনপাহাড়ের মধ্যে গহন জঙ্গলের সেই ঘেরাটোপের, চন্দ্রাতপের নীচে যেন নিউক্লিয়ার বোমা ফাটাল।

রেগে-যাওয়া বাঘের গর্জন যে বনে-পাহাড়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে না শুনেছে, সে কখনওই জানবে না যে, সে কী ভয়ানক ব্যাপার! ঘাসপাতা, ঝোপ ঝাড় মহীরূহ, পাহাড় সব যেন ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল সেই হুঙ্কারে। দুর্গন্ধ থুতু যেন ছিটকে এল আমার মুখে।

আমি ওখানেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, (সে আমার কাছেই ছিল। মানে, এমন কাছে যে, তার আর আমার দুজনেরই দুজনকে মারতে কোনও অসুবিধে ছিল না।) রাইফেলটা ডান হাতে তুলে কাঁধ বরাবর করলাম বাঁ হাতে টর্চ ধরে। ফোর-ফিফটি ফোর-হান্ড্রেড জেরি নাম্বার টু রাইফেলটা ভারীও তো কম নয়। তবে শরীরে তখন শক্তিও তেমনই ছিল। নিয়মিত স্কোয়াশ খেলতাম। তেমন-তেমন সময়ে শক্তি যেন উড়েও আসত কোনও অদৃশ্য উৎস থেকে।

হাজোকে মাটিতে নামিয়ে যেই বাঘ আমার দিকে ফিরে দ্বিতীয় বার হুঙ্কার দিয়েছে এবং আমি রাইফেল তুলেছি, তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাঘের প্রায় ঘাড়েরই ওপরের কেঁদ গাছে বসে-থাকা হিরু পানকাও বাঘের ঘাড় লক্ষ্য করে গুলি করল। ততক্ষণে আমার হেভি রাইফেলের সফট-নোজড গুলিও গিয়ে আমারই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা বাঘের সামনের দুপায়ের মধ্যে এবং গলার ঠিক নীচে, বুকে ঢুকে গেল। কিন্তু হলে কী হয়! তার মুখ যে ছিল আমারই দিকে। রিফ্লেক্স অ্যাকশানে সে আমাকে লক্ষ্য করে লাফ দিল গুলি করার সঙ্গে-সঙ্গেই। কিন্তু হিরুর গুলিটা ঠিক ঘাড় আর মেরুদণ্ডের সংযোগস্থলে গিয়ে পড়াতে তার বাঘত্ব আর ছিল না।

মানুষেরই মতো, বাঘেরও মেরুদণ্ডই চলে গেলে আর কী থাকে? কিছু থাকে কি?

জোড়া বাঘ ছিল কোথায়? তারা দুজনে তোমাদের কাছে এলই বা কোথা থেকে? তোমরা তিন শিকারি জানতেই পেলে না?

ভটকাই শুধোল।

 হিরু পানকা ভটকাই-এর কথা শুনে মাথা নাড়তে লাগল। যেন, বলতে চাইল, চুপ করো না বাপু। মেলা কথা বোলো না। কতদিনের সব ঘটনা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

ঋজুদা বলল, বাঘিনী তো হিরু ও হাজোর গুলি খেয়ে পটকেই গেছিল আগেই। কিন্তু সেইটেই তো কথা! একেই বলে বাঘ! আমরা তিনজন অভিজ্ঞ শিকারী অতি সামান্য একফালি জায়গাতে নজরদারি করছিলাম, তবু টেরই পেলাম না! কী করে বাঘ এল, কোথা দিয়ে এল! এবং একটি নয়, দু দুটি।

ভটকাই বলল, অবশ্য ঘুটঘুটে অন্ধকারে, দেখবেই বা কী করে?

 সেটা কোনও কথাই নয়।

ঋজুদা বলল।

ঘুটঘুটে অন্ধকারেও ইঁদুর নড়লেও শব্দ হয়। ঝোপের মধ্যে পাখি সরে বসলেও তার শব্দ কানে আসে বনের মধ্যের নিস্তব্ধ রাতে। গাছের ওপরের হনুমান দীর্ঘশ্বাস ফেললে তাও স্পষ্ট শোনা যায়, কিন্তু শোনা যায় না, যে-জানোয়ারের অত ওজন, যে-জানোয়ার একটি পূর্ণবয়স্ক মোষ বা শম্বর বা বারাশিঙাকে মেরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে বা পিঠে চাপিয়ে উঠে যেতে পারে পাহাড়চুড়োয় অথবা নেমে যেতে পারে পাহাড়তলিতে, (মাইলের পর মাইল কখনও কখনও) তারই কোনওই শব্দ পাওয়া যায় না।

আলো থাকলেও তাকে দেখা যায় না। পৃথিবীর সব আলোছায়ার রহস্যই শিশুকাল থেকেই আয়ত্ত করতে হয় প্রতিটি বাঘের। সব শব্দ-গন্ধের রহস্যও। পৃথিবীতে শিকারি যদি কেউ থাকে, সব শিকারির সেরা শিকারি; সে আমাদের ভারতের বন-জঙ্গলের বাঘ!

হাজোর কী হল? আর ওই লোকটির। কুতা-পাজামা পরা শিকারীর? তাঁর মৃতদেহ তো নিয়ে গেছিল গোর দেওয়ার জন্য।

তিতির শুধোল।

হ্যাঁ।

ঋজুদা বলল।

এইজন্যেই বিখ্যাত ব্যারিস্টার শিকারী কুমুদনাথ চৌধুরী বারবার লিখে গিয়েছিলেন তাঁর বইয়ে যে, রাতে বাঘকে গুলি করে কখনই মাচা থেকে নেমো না। অথচ তাঁকেও বাঘেই খেয়েছিল ওড়িশার কালাহান্ডির জঙ্গলে এবং রাতের বেলা বাঘকে গুলি করে মাচা থেকে নামতেই।

বলো ঋজুদা। তাই নয়!

তিতির বলল।

 তাই তো।

 ঋজুদা বলল।

ভটকাই বলল, হাজোকে কুমুদ চৌধুরীর বইটা আগে পড়িয়ে নেওয়া উচিত ছিল।

আমি বললাম, বাকিটা শোন। এত ফাজলামি ভাল লাগে না।

 তারপর কী করলে?

তিতির বলল।

আমি আর হিরু হাজোকে বয়ে নিয়ে এলাম বাইরের প্রান্তরে কয়েকটি পাথরের আড়ালে, যাতে হাওয়াটা কম লাগে অথচ খোলা হাওয়াও লাগে এমন জায়গাতে। ওকে একটি চ্যাটালো পাথরের ওপর শুইয়ে দিয়ে হিরুকে বললাম, সোজা দৌড় লাগাও। হাজোর টর্চটাও নিয়ে যাও। আর…।

আর, বললাম, আমি যে খাঁজে বসে ছিলাম তাতে একটি ফ্লাস্ক আছে, সেটি নিয়ে এসে হাজোর মুখে ঢেলে দাও কিছুটা। শকটা কেটে যাবে। যদি অবশ্য এখনও প্রাণে বেঁচে থাকে। হাজোর জ্ঞান ছিল না তখন। তারপর বাকিটা তুমি সঙ্গে নিয়ে দৌড়তে থাকে। সুফকর থেকে খাঁটিয়া নিয়ে এসো, লোকজন নিয়ে এসো। গ্রামের মধ্যে যা পাও ওষুধপত্র বদ্যি, তাই নিয়ে এসো।

হিরু গেল এক দৌড়ে ফ্লাস্কের খোঁজে টর্চ হাতে, আমি কাঠকুঠো জোগাড় করে নিয়ে এসে এই জঙ্গলের মধ্যেই পাথরের আড়াল দেখে নিয়ে একটু আগুন করলাম। বড় শীত। ছেলেটা যে বাঁচবে, তা মনে হচ্ছে না। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর; চারধার।

মানুষের রক্তে বড় বদগন্ধ। বুঝলি। সারাজীবন অনেক পশুপাখির রক্ত মেখেছি। দু হাতে, কিন্তু মানুষের রক্তের মতো বিচ্ছিরি বদবু জিনিস আর কিছুই নেই।

তারপর?

 তারপর আর কী? হিরু ফিরে এসে মুখে ঢেলে দিল ওই ওষুধ। অনেকখানি। ফ্লাস্ক থেকে। কিন্তু হাজোর মুখে ঢালামাত্রই সেই তরল পদার্থ তার কাঁধের পাশের বাঘের দাঁত ফুটোনোতে যে ফুটো হয়েছিল, তা দিয়ে গড়িয়ে বাইরে চলে এল।

কথাটা বলতে বলতে ঋজুদা যেন অনেক বছর আগে দেখা সেই দৃশ্যটা মনে করে শিউরে উঠল। বাঘের দাঁতের কথা তোমরা, যারা কিছুমাত্রও জানো তারাই অনুমান করতে পারবে দৃশ্যটা।

তারপর ঋজুদা বলল, আমি হিরুকে বললাম, দৌড়োও হিরু পানকা। যত জোরে পারো দৌড়োও।

হিরু পানকা ফটাফট শব্দ করে আরেকবার খৈনী মেরে মুখে দিল। পুরনো দিনের উত্তেজনাময় দুঃসাহসিকতা তাকে রোমাঞ্চিত করছিল।

ঋজুদাও আবার পাইপে আগুন দিল। একটুক্ষণ পাইপ টেনে, তারপর যেন সেই রাতকে চোখের সামনে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে, এমনভাবেই আবার বলা শুরু করল।

হিরু দৌড়ে যাচ্ছিল প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। দৌড়তে-দৌড়তে নিশ্চয়ই মাঝে-মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে ফ্লাস্ক থেকে একটু করে উগ্রগন্ধের সেই ওষুধ খাচ্ছিল। দূর থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ওর টর্চের আলোটা একটা ছোট্ট বৃত্ত রচনা করে অন্ধকারে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছিল ওর সামনে-সামনে। যেন, গ্রাম-বাংলার জলা-কাদা অঞ্চলে রাতের অন্ধকারে আলেয়ার আলো।

পাইপটা ধরালাম আগুন থেকে একটি জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে আগুনের সামনে বসে। হাজোর দুটি চোখই বন্ধ ছিল। খেয়েদেয়ে দুপুর দুটোতে সুফকর থেকে বেরিয়েছিলাম। তখন কী ছিল হাজো এখন কী হল!

যাঁরা শিকার সম্বন্ধে কিছুমাত্রই জানেন না, তাঁরাই শুধু বলতে পারেন শিকার? ফুঃ!

হাজো বেঁচে গেছিল?

তিতির শুধোল!

হ্যাঁ। প্রাণে বেঁচে গেছিল। থ্যাঙ্কস্ টু ডক্টর জ্যামখিন্ডিকার। তবে ন মাস জব্বলপুরের হাসপাতালেই ছিল। রাখে কেষ্ট মারে কে! সেই হাজো এখন হাটচান্দ্রার লাক্ষার কোম্পানিতে কাজ করে। যেখানে ঠুঠা বাইগা কাজ করত। বিয়ে করেছে। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। কোয়ার্টার পেয়েছে। চল, কাল নিয়ে যাব তোদের হাজোর কাছে।

তুমি কী বলো, হিরু? যাবে?

জি, হুজৌর। চলুন, আমিও যাব। দেখা হয়নি বহুদিন।

 চলো। তোমাকেও নিয়ে যাব।

আচ্ছা ঋজুদা, এই বাঘ-বাঘিনীর, মানে, সুফকর-এর জোড়া বাঘের আশ্চর্য ব্যবহারের তো কোনওই ব্যাখ্যা দিলে না?

তা দিতে হলে বাঘেদের বিহেভরিয়াল সায়ান্স নিয়ে একদিন পড়তে হয়। হবেও। অন্য কোনও সময়ে।

তারপর পাইপে দুটান লাগিয়ে বলল, ঐ জোড়া বাঘের ব্যাপার-স্যাপার সত্যিই আগাগোড়াই রহস্যময়। তবে তোর বোদ্ধা কাকুকে বলে দিস যে, যাঁরা বাঘ মারতেন আগে, আইন মেনে; তাঁদের চরিত্রের সঙ্গে বাঘেদের চরিত্রেরও কিছু মিল থাকতই! লার্জ-হার্টেড জেন্টমেন ছিলেন তাঁরাও, বাঘেদেরই মতো।

তারপর?

ঐ বাঘ আর বাঘিনীকে মেরে মস্ত বড় একটি উপকার আমরা করেছিলাম ঐ অঞ্চলের, না জেনেই; তা ভেবে আজও খুব ভাল লাগে।

কী উপকার ঋজুদা?

আমি শুধোলাম।

ঐ রাতেই ওই বাঘ ও বাঘিনী দুটিকেই না মারতে পারলে হয়তো মানুষখেকোই হয়ে যেত তারা।

এ কথা বলছ কেন?

ঐ অঞ্চলে আগে কখনও মানুষ খেয়েছিল কি না তারা, তা স্পষ্ট জানা যায়নি। কিন্তু বাঘিনীর পেট থেকে একটি আংটি বেরিয়েছিল। মেয়েদের আংটি। ঐ জোড়া বাঘের ব্যবহার সত্যিই আশ্চর্য করেছিল আমাকে! বাঘেদের ঠিক এমন ব্যবহার মধ্যপ্রদেশ কেন, আর কোথাওই দেখিনি। এখনও মনে করলে অবাক লাগে।

আর-এক কাপ করে চা হয়ে যাক, কী বলো ঋজুদা। তারপর ঐ পাহাড়টাতে গিয়ে তোমার গল্পের প্রান্তরটা দেখে আসা যাবে।

মিস্টার ভটকাই বলল।

আমি আর তিতির এখন সুফকর-এর জোড়া বাঘের চেয়েও, সত্যি কথা বলতে কী; বেশি বিপজ্জনক মনে করছি, মিঃ ভটকাইকেই!

তিতির এমন চোখে তাকাল ভটকাইয়ের দিকে, যেন ওকে ভস্মই করে দেবে।

ঋজুদা বলল, ভালই হয়েছে ভটকাই। এক কাপ করে চা বরং হয়েই যাক। শীতটা বড় জাঁকিয়ে পড়েছে। হিরু পানকাকেও দিতে ভুলিস না এক কাপ।

হিরু দুহাতে খৈনী মারতে মারতে, অতীতের স্মৃতিচারণ এমন করে করার জন্যে স্মিতহাসি দিয়ে, নীরবে যেন ধন্যবাদ জানাল ঋজুদাকে!

এবং ধন্যবাদ জানাল চায়ের জন্যেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *