ইঁদুরের খুট খুট

ইঁদুরের খুট খুট

অনেককাল ধরে বড়োদে র গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে, আমি নিজেও যেন কেমন হাঁপিয়ে পড়েছি। অথচ যাদের সঙ্গে গল্প করতে পেলে আমার মন খুশিতে ভরে ওঠে, তাদের একটা গল্প নিজে থেকে শোনাতে পারি না। শোনাবার খুব সাধ। কিন্তু সাধ থাকলেই তো আর সাধ্যে কুলায় না। বড়োদের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে মনটা কেমন যেন মরচে ধরে গিয়েছে। মনের সেই তাজা টাটকা ভাবটা যেন হারিয়েই ফেলেছি, যা না থাকলে, তোমাদের আসরে এসে বসবার কোনো মানেই হয় না।

এসব কথা বলতে হলো, কারণ, আজ ঠিক করেছি, তোমাদের আমি একটি গল্প শোনাবো। সম্প্রতি আমি এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর লেখা, পড়ছিলাম। তিনি একটা অদ্ভুত কথা শুনিয়েছেন। তিনি মানুষের মন, নিয়ে অনেক গবেষণা করে, আবিষ্কার করেছেন, মাত্র ছবছর বয়সের মধ্যে, শিশুদের মনে যে-সব ভাবনা-চিন্তা কল্পনা এবং জ্ঞান বুদ্ধির প্রসার ঘটে, পরবর্তীকালে–অর্থাৎ ভবিষ্যতে মানুষ যত বুড়ো হয়, সেই ছবছরের ভাবনাচিন্তা কল্পনা জ্ঞান বুদ্ধিই নানা রূপে, নানা ভাবে বিকাশলাভ করে। তার মানে হলো, সেই বিজ্ঞানী এ কথাই বলতে চেয়েছেন, ছবছর বয়স পর্যন্তই মানুষের যা কিছু অনুভূতির পূর্ণতা ঘটে, পরে তা নানা রূপে বিকাশ লাভ করে। তা তিনি বিজ্ঞানী হোন, কবি বা সাহিত্যিক হোন, রাজনৈতিক নেতা বা ডাক্তার হোন।

আমি অবিশ্যি তোমাদের সেই বিজ্ঞানীর কথা শোনাতে বসি নি। তাঁর গবেষণায় যথেষ্ট যুক্তি আছে বটে, অনেক তর্কও আছে। সেসব নিয়ে আমাদের আপাততঃ মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমি যার বিষয় নিয়ে, তোমাদের একটি আশ্চর্য অথচ ভয়ঙ্কর গল্প শোনাতে যাচ্ছি, তার বয়স মাত্র ছ। নাম গোগোল। গোগোল নামটা ওর বাবা রেখেছিলেন। রাশিয়ার এক বিখ্যাত সাহিত্যিকের নাম ছিল গোগোল, আর আমাদের গোগোলের বাবা সেই রাশিয়ার সাহিত্যিক গোগোলের ভারি ভক্ত। সেই জন্যই ছেলেব নাম রেখেছেন গোগোল।

গোগোলের কথা শুনলেই তোমাদের মনে হবে, সে জানে না, এমন বিষয় নেই। আসলে সে হয়তো অনেক কিছুই এখনো জানে না, জানা সম্ভবও না। কিন্তু তার ভাব ভঙ্গি, স্পষ্ট উচ্চারণের কথাবার্তা শুনলে, একটু যেন থমকেই যেতে হয়। এই যেমন ধরো, গোগোলের বাবাকে কোনো ভদ্রলোক ডাকতে এলেন, বাড়ির চাকর এগিয়ে যাবার আগেই, গোগোল তার ঝকঝকে কালো চোখে, ভদ্রলোকের আপাদমস্তক একবার দেখবে। কপালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া চুলের নীচেই ওর সরু টানা ভুরু কুঁচকে উঠবে। জিজ্ঞেস করবে, জানতে পারি, আপনি কাকে চান?

স্বভাবতঃই অচেনা ভদ্রলোক হলে একটু হকচকিয়ে যাবেন, অবাক চোখে গোগোলের ফরসা মুখ আর টুকটুকে লাল ঠোঁটেব দিকে, ওর রঙচঙে জামা আর প্যান্টের দিকে দেখবেন, এবং গোগোলের বাবার নামটা বলবেন। তখন গোগোল গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করবে, আপনার নামটা জানতে পারি?

ওর জিজ্ঞেস করবার ভঙ্গিটাই এমন, ভদ্রলোককে তার নামটি বলতেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে গোগোলের পরের জিজ্ঞাসা, কোথা থেকে আসছেন, কী দরকার?

ভদ্রলোকের তখন মনে হতে পারে, গোগোল একটি ডেপো ছেলে। তখন ওর পাশে দাড়িয়ে হয়তো বাড়ির ভৃত্য সেসব কথা শুনছে আর মিটিমিটি হাসছে। সেও একই কথা, অন্যরকম ভাবে জিজ্ঞেস করবে, বাবু আপনি কোথা থেকে আসছেন, বাবুকে কী বলব?

গোগোল তখন ভৃত্যকে ধমক দিয়ে বলবে, আহ, তোমাকে কে কথা বলতে বলেছে, দেখছে আমি কথা বলছি।

বলে সেই ভদ্রলোককেই গোগোল বলবে, দেখছেন তোত কী রকম দুষ্টু ছেলে, কিছু মনে করবেন না। আপনি আসুন, বাইরের ঘরে বসুন, আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।

ভদ্রলোককে বাইরের ঘরে বসিয়ে, সে কিন্তু বাবাকে ডাকতে যাবে না। জানে, বাবার কাছে খবর চলে গিয়েছে। বরং ও নিজে বাইরের ঘরে চেয়ারে লাফ দিয়ে উঠে বসবে। জিজ্ঞেস করবে, আপনি সিগারেট খাচ্ছেন কেন?

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলবেন, আমি তত সিগারেট খাই না?

গোগোল বলবে: আমার বাবা খায়। বাবাকে ডাক্তারবাবু সিগারেট কম খেতে বলেছেন। আমিও খুব কম খাই।।

ভদ্রলোক চমকে উঠে জিজ্ঞেস করবেন, তুমি সিগারেট খাও নাকি?

গোগোল গম্ভীর মুখে বলবে, হ্যাঁ, যখন আমি কাজ করি। পড়ার সময়। আর আমার সিগারেটগুলো আমি নিজেই বানিয়ে নিই। মায়ের চিঠি লেখার কাগজ দিয়ে বানাই। আচ্ছা ও কথা যাক, আপনি কি সেই বাঘের গল্পটা জানেন, যে ছাগলছানার গা চেটে দিয়েছিল?

ভদ্রলোক বলবেন, না তো।

গোগোল চোখ বড়ো বড়ো করে বলবে, সে কি, আপনি জিম্ করবেটের নাম শোনেন নি? তিনিই তো লিখেছেন। আচ্ছা, আপনাকে আমিই গল্পটা বলছি। একদিন বিকালবেলা জিম্ করবেট একটা গাছে মাচা—মাচা মানে জানেন তো? মাচা হলে, গাছের ডালে বসবার জায়গা, সেখান থেকে বাঘকে গুলি করে মারা হয়। তা একদিন বিকেলে জিম্ করবেট একটা গাছের ওপরে মাচায় বসে আছেন, তখন কিন্তু আকাশটা লাল ছিল। উনি দেখলেন, কাছেই যে গ্রাম আছে না, সেই গ্রামের একটা ছাগলছানা বাড়ির পথ ভুলে, জঙ্গলের কাছে এসে পড়েছে। উনি ভাবলেন, ছাগলছানাটা বাঘের পেটে যাবে। ঠিক সেই সময়েই দেখা গেল, প্রকাণ্ড বড় একটা বাঘ একটা উঁচু ঢিবিতে এসে দাঁড়ালো। সেই বাঘটা অনেকগুলো মানুষ খেয়ে ফেলেছে, ওকে মারবার জন্যই উনি মাচায় বন্দুক নিয়ে বসেছিলেন। উনি বন্দুক তোলবার আগেই দেখলেন, ছাগলছানাটা ম্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ করতে করতে একেবারে বাঘটার মুখের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কেন বলুন তো?

ভদ্রলোক হয় তো সত্যি জানেন না, তাই বললেন, জানি না তো?

গোগোল হাত নেড়ে নিজেই খুব অবাক হয়ে বলবে, ছাগলছানাটা তত কোনদিন বাঘ দেখে নি। ও তো শিশু, তাই বাঘ যে কী ভীষণ জানোয়ার, ও তার কিছুই জানে না। ভেবেছিল, ওটাই বুঝি ওর মা, তাই বাঘের মুখের কাছ থেকে, একেবারে তার পেটের নীচে চলে গেল। জিম্ করবেট তখন ভাবলেন, বাঘটা এবার ছাগলছানাটাকে এক গরাসে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু বাঘটা কী করলে বলুন তো?

ভদ্রলোক বললেন, জানি না তো?

গোগোল বলবে, বাঘটা ওকে খেল না। একটু যেন বিরক্ত হলো, একবার ছাগলছানাটাকে শুকে, আস্তে আস্তে ঠ্যাং তুলে ছাগলছানাটাকে সরিয়ে দিল, তারপরে ঢিবির নীচে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। ব্যাপার দেখে, জিম্ করবেট বাঘটাকে মারবার কথাই ভুলে গেলেন। তার মনে হলো, জীবনে এমন ঘটনা মানুষ আর কখনো হয়তো দেখবে না। এটা নিশ্চয় ভগবানের কোনো লীলা। কিন্তু বাঘটা কেন ছাগলছানাটাকে খেলো না, বলুন তো?

ভদ্রলোক বললেন, জানি না তো?

গোগোল ঘাড় বাঁকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে বললে, আসলে বাঘেরা খিদে না পেলে, কারোকে মারে না। আমাদের যেমন দুষ্টু খিদে আছে না, খিদে না পেলেও খাবার জন্য বায়না করি, ওবা সেরকম না।

ভদ্রলোক তখন জিজ্ঞেস করবেন, তোমার বুঝি দুষ্টু খিদে পায়?

গোগোলের চোখে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠবে। বলবে, একটু একটু। আচ্ছা আপনি কি সেই বাহাদুরের কথা জানেন?

ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবেন, কোন্ বাহাদুর?

গোগোলও ভদ্রলোকের এত কম জানা আছে দেখে, খুব অবাক হয়ে বলবে, যুথপতি বাহাদুর?

ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবেন, যুথপতিটা কী?

গোগোল এবার ঠোঁট আর জিভ দিয়ে একটা শব্দ করবে, যেন ও ভদ্রলোককে করুণা করছে। বলবে, যুথপতি জানেন না? জঙ্গলে হাতীদের যে দল থাকে, তার যে সদাব থাকে, তাকে বলে যুথপতি।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলবেন, ও, তাই নাকি? তা সেসব বই কি তুমি পড়েছ নাকি?

গোগোল বলবে, আমি এখনো এভোটা ভালো করে পড়তে শিখিনি। মা আমাকে পড়ে শোনায়, আমার সব মনে থাকে। অবিশ্যি আমারও একটা গল্প লেখার খাতা আছে, তাতে অনেক গল্পই লিখি। তবে বানান একটু ভুল হয়, মা ঠিক করে দেয়। তারপরে শুনুন, বাহাদুর নামে একজন যুথপতি ছিল, ছোটনাগপুরের জঙ্গলে–

এ সময়েই হয়তো গোগোলর বাবা এসে পড়বেন, এবং ভলোকের সঙ্গে কথা আরম্ভ করবেন, ওহহ, আপনি এসেছেন? আমায় একটু দেরি হয়ে গেল।

গোগোল তাড়াতাড়ি বলবে, বাবা, আমি আগে বাহাদুরের গল্পটা বলে নিই।

গোগোলের বাবা বললেন, না গোগোল, লক্ষ্মী বাবা, এর সঙ্গে আমার অনেক জরুরী দরকারী কথা আছে। তুমি এখন ভেতরে যাও।

গোগোল চেয়ার থেকে লাফিয়ে নামবে, হতাশ মুখখানি ভারী করে বলবে, তোমাদের খালি দরকারী আর জরুরী কথা। • বাহাদুরের গল্পটা বুঝি কিছু না?

ভদ্রলোক তখন বলবেন, দরকারী কথা সেরেই, আমি তোমার বাহাদুরের গল্প না শুনে যাচ্ছি না।

গোগোল একটু চোখ পাকাবার ভঙ্গি করে বলবে, ঠিক তত? মিথ্যা কথা বলবেন না, পাপ লাগবে।

গোগোলের বাবা বলবেন, হা হা, কেউ তোমাকে মিথ্যা কথা বলছেন না। তুমি এখন ভেতরে যাও তো।

গোগোল তখন চলে যাবে।

 

আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি, বাড়িতে গোগোল ভারী নিঃসঙ্গ। মা রান্নাবান্না আরো দশ রকম কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। চাকরও তা-ই। ও ইস্কুলে যায় বটে। তারপর যে ওর আর সময় কাটতে চায় না। সেই দুপুরে মা কখন একটু গল্প পড়ে শোনাবেন। তারপরেও বিকেল আছে, সন্ধ্যে আছে। রোজ রোজ ওকে বেড়াতে নিয়েও যাওয়া যায় না। বাবা থাকেন বাড়ির বাইরে কাজে। সে জন্যই ও কারোকে পেলে ছাড়তে চায় না। আর সত্যি সত্যি ও চমৎকার গল্প বলতে পারে। লেখে। লেখাগুলো অবিশ্যি মায়ের কাছে শোনা গল্পগুলোরই মধ্যে প্রায়, একটু এদিক ওদিক থাকে। সেটা ওর নিজের বানানো।

তাছাড়া গোগোল প্লাস্টার দিয়ে নানারকম মূর্তি তৈরি করে। বাড়ির যাবতীয় ফেলে দেওয়া ইলেকট্রিকের তার, নষ্ট হয়ে যাওয়া সুইচ, সেসব দিয়েও সে অনেক কিছু তৈরি করে, জিজ্ঞেস করলে বলে, মাইক তৈরি করা হচ্ছে। আলো জ্বলছে না, সুইচ ঠিক করা হচ্ছে।

মোটের ওপর, গোগোল একদিকে যেমন নিঃসঙ্গ, অন্যদিকে আবার তেমনিই ব্যস্ত। তখন ওকে দশবার ডেকেও চান করানো খাওয়ানো যাবে না।

যাই হোক, যে অদ্ভুত আর ভয়ঙ্কর গল্পটা বলতে যাচ্ছি, এবার সেটাই বলি।

জুন মাসে গোগোল বাবা মায়ের সঙ্গে কাশ্মীরে বেড়াতে গেল। মনে মনে তার যত আনন্দ, তত উত্তেজনা। ও ওর বাবার কাছে আগেই শুনে নিয়েছে, হিমালয়ের অভ্যন্তরে, চল্লিশ মাইল চওড়া, আশি মাইল লম্বা এক অপূর্ব সুন্দর উপত্যকা আছে। সেই উপত্যকা ভূমিই হল কাশ্মীর।

গোগোলের সকালবেলা যখন পাঠানকোটে এসে পৌঁছুলো, দেখা গেল, সেখানে বেশ একটা উত্তেজনা আর পুলিশ মিলিটারী টহল দিচ্ছে। লোকজনকে ডেকে নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করছে, সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে। সন্দেহবশত অনেকের ট্রাঙ্ক সুটকেশ খুলেও দেখছে। এমন কি গোগোলের বাবাকেও একজন পুলিশ অফিসার ইংরেজীতে কী সব কথাবার্তা জিজ্ঞেস করলেন। বাবা পকেট থেকে রেলের টিকেট, তার অফিসের কার্ড, সবই দেখালেন। মাকে আর গোগোলকেও দেখিয়ে পরিচয় দিলেন।

পাঠানকোট স্টেশনের ক্যাটারিং-এর খাবার ঘবে, সকালের খাবার খেতে খেতে গোগোল বাবার মুখে সব ঘটনাটা শুনলো। গতকাল পাঞ্জাবে চণ্ডীগড়ে একটা সাংঘাতিক ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়ে গিয়েছে। ডাকাতেরা তিন জন লোককে গুলি করে মেরে ফেলেছে। এক ধরনের লোহার কে আছে, যার মধ্যে কোটি কোটি টাকা থাকে। এই কেগুলো যে-সে খুলতে পারে না। প্রত্যেকটা কেসের আলাদা আলাদা ধরনের চাবি আছে, আর চাবিগুলো, বাঁ দিকে বা ডান দিকে কতবার কীভাবে পাক দিতে হবে, তা জানা আছে শুধু একজনের। তিনি হলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। চাবিও তার কাছেই থাকে।

যেখানে নোট ছাপানো হয়, তাকে বলে মিন্ট। মিন্ট থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে টাকা যায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে, সেই রকম কয়েকটি কেস ভরতি টাকা নিয়ে যখন একটা গাড়ি চণ্ডীগড় স্টেট ব্যাঙ্কের দিকে যাচ্ছিল, তখনই একটা নির্জন জায়গায়, ডাকাতরা সেই গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাড়িতে। ড্রাইভার নিয়ে সব শুদ্ধ চারজন লোক ছিল। তিন জনের কাছে বন্দুক ছিল। কিন্তু ডাকাতরা এমনই দুর্ধর্ষ, তারা তিনজনকে মেরে ফেলেছে, একজন এখন হাসপাতালে আছে, বাঁচবে কি না সন্দেহ। তার মানে, ডাকাতরা প্রায় পনর কুড়ি কোটি টাকার কে নিয়ে পালিয়েছে। চার দিকেই সেই ডাকাত দলের সন্ধান চলেছে। কেউ কেউ অনুমান করছে, ডাকাতদল হয়তো কাশ্মীরে ঢুকে, ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে, পাকিস্তান পালিয়ে যাবে।

সেই জন্য সমস্ত লরি ট্রাক প্রাইভেট গাড়ি বাস পুলিস আর মিলিটারি খুজে খুজে দেখছে। সব থেকে মুশকিল হয়েছে, ডাকাতদলকে কেউ চেনে না। বা তারা কী গাড়ি নিয়ে পালিয়েছে, তাও কেউ বলতে পারে না। যারা পারতো, তাদের তিনজন তো মারাই গিয়েছে। একজন এখন অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে আছে।

গোগোল আবার খেতে খেতে, বাবার মুখে সমস্ত ঘটনাটা শোনার পর, মনে মনে কেবলই কল্পনা করার চেষ্টা করতে লাগলো, ডাকাতগুলোর চেহারা কী রকম হতে পারে। খাবাব খেয়ে, বাইরে বেরিয়ে, ও প্রত্যেকটা লোকের মুখের দিকে ভালো করে দেখতে লাগলো। লম্বাচওড়া চেহারা আর বড় গোঁফ দেখলেই, ওর মনটা যেন ছাৎ ছাৎ করে উঠতে লাগলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই তাদের হাসি আর কথাবার্তা শুনে, অন্যরকম মনে হলো। এদিকে ওর মা তাড়া দিলেন, পাঠানকোট থেকেই চান করে নিতে হবে। তাই নিতে হলো। তারপরে বেশ একটা ঝকমকে সুন্দর বাসে উঠে, ওরা কাশ্মীর যাত্রা করলো।

পাহাড়ের উপর দিয়ে, এঁকে বেঁকে যেতে যেতে, নানারকম দৃশ্য দেখে ডাকাতির কথাটা গোগোল প্রায় ভুলেই গেল। খাতা আর পেন্সিল নিয়ে, হঠাৎ হঠাৎ একটা করে কথা লিখতে লাগলো। গাড়ির মধ্যে ভারতের নানা প্রদেশের মহিলা পুরুষেরা রয়েছেন। তাদের ভাষা গোগোলের জানা না থাকলেও, সকলের সঙ্গেই তার বেশ ভাব হয়ে গেল। সকলেই তাকে গাল টিপে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আদরও করলো। এক দাড়িগোঁফওয়ালা তলোয়ারধারী শিখ ওকে চুমো খেতেই ওর ভীষণ সুড়সুড়ি লেগে গেল।

বাত্রিবেলাটা ওদের কাটাতে হলে কুঁদ বলে একটা জায়গায়। পরদিন ভোরবেলা আবার যাত্রা শুরু হলো।

গোগোল আর বাইরে থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। দুপুরের দিকে ওরা যখন কাশ্মীরে পৌঁছুলো, সমতলের মতো সেই উপত্যকায়, গোগোল একেবারে মুগ্ধ। হিমালয়ের বুকে যে এরকম সুন্দর হ্রদ আছে, ভাসমান বাগান আছে, ও ভাবতেই পারে নি। ঝিলম নদীর দিকে তাকিয়ে ওর চোখ চকচক করে উঠলো। বাবা ওকে চিনিয়ে দিলেন, চিনার গাছ। যেমন বিশাল গাছ, তেমনি ওর পাতা। সব থেকে ওর আনন্দ হলো, যখন বাবা একটা বোট ভাড়া করলেন। কোন হোটেলে ওরা থাকলে না। হাউস বোটটাই একটা বাড়ি। তার মধ্যে বসবার ঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘর, বাথরুম, সব আছে। এমন কি ইলেকট্রিকের আলোও আছে।

কয়েকদিন হাউসবোটে থেকে, গোগোলরা বেড়াতে গেল পহেলগাঁও বলে একটা জায়গায়। কাশ্মীর শহর থেকে, ষাট পঁয়ষট্টি মাইল দূরে পহেলগাঁও। জায়গাটা লিডর নদীর ধারে। পাহাড়ী নদী, পাথরে ধাক্কা খেয়ে, গর্জন করে বহে চলেছে। নদীর ওপারে পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে পাইন বন, আর বনের মাথায়, পাহাড়ের চূড়া বরফে সাদা ধবধব করছে। গোগোল এসব ছবিতেই দেখেছে। চোখে এই প্রথম দেখলো। এখানেও ঘোট ঘোট হোটেল আছে। কিন্তু হ্রদে যেমন হাউস বোট থাকে, পহেলগাঁওয়ে তাবু আছে। গোগোলের বাবা তাঁবুতে থাকাই ঠিক করলেন। সবুজ ঘাসওয়ালা উঁচু নীচু এক একটা জায়গা বেছে নিয়ে তাঁবু খাটানো হয়েছে। গোগোগালের বাবা তাঁবুওয়ালাদের সঙ্গে কথা বললেন। তাঁবুওয়ালা একটা বেশ বড় খাটানো তবু দেখালো, যার ভিতরে তিনটে ভাগ আছে। সামনের ভাগে কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিল। টেবিলে আবার কয়েকটা ইংরেজী ম্যাগাজিনও আছে। তার পরের ভাগটা বেশ বড়। সেখানে দুটো বড় বড় খাটিয়া আছে। গোগোল বুঝে গেল, এটাই তাঁবুর ভেতরে শোবার ঘর। তার পিছনে বাথরুম। সেখানেও কাঠের পাটাতন পাতা আছে। বালতি ঘটি আর গোগোল জানে, বাকী দুটো জিনিসকে বলে কমোড। হাউস বেটেই বাবা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এ সব জায়গায় তো পায়খানা নেই, তাই কমোডের ব্যবস্থা। তাঁবুওয়ালাই জানিয়ে দিল, তারা খাবাবও দেবে, যা গোগোলদের খেতে ইচ্ছা হয়।

সত্যি, কী মজা! বেড়াবার জন্য যে এত ব্যবস্থা আছে, আগে গোগোল জানত না। ওর সঙ্গে তাঁবুওয়ালার খুব ভাব হয়ে গেল। সে আবার ভাব করিয়ে দিল টাট্টু ঘোড়াওয়ালার সঙ্গে। গোগোলের বাবা টাট্টুওয়ালাকে গোগোলকে ঘোড়ায় চাপিয়ে বেড়িয়ে আনতে বললেন। টাট্টুওয়ালা গোগোলকে টাট্টুতে চাপিয়ে মাঠ আর পাইন বনের দিকে বেড়াতে নিয়ে গেল। পাইন বন আর কাঁকে ফঁাকে মাঠেও তাবু পড়েছে অনেক। আশেপাশে অনেক গাড়ি দাঁড় করান। যাদের গাড়ি আছে, তারা অনেকে গাড়ি নিয়েও বেড়াতে এসেছে। কয়েকটা গাড়ির পিছনে আবার আলাদা করে ভ্যান জুড়ে দেওয়া রয়েছে। ঠিক যেন গাড়ির পিছনে একটা মালগাড়ির ওয়াগন। গোগোল টাট্টুওয়ালাকে ওগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ওগুলো কী?

টাট্টুওয়ালা বাঙলা কথা না বুঝলেও, গোগোলের প্রশ্নটা বুঝে নিল। জবাব দিল, উমে সাব লোগকো শামান হায়।

গোগোল জিজ্ঞেস করলো, শামান কী?

টাট্টুওয়ালা হেসে বললো, শামান নহি জানতা খোকাবাবু? মাল মাল, বাক্‌সা বিস্তারা।

গোগোল বুঝে নিল, বললো, বাকশো আর বিছানা! তার জন্য এত বড় মালগাড়ি?

টাট্টুওয়ালা হাসলে, কোনো জবাব দিল না। গোগোল বেশ খানিকক্ষণ টাট্টুতে চেপে বেড়ালো। জায়গাটা ওদের তাঁবুর কাছেই।

দুপুরবেলা খেয়েই, গোগোল ওর খাতা আর পেন্সিল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বাবা বললেন, বেশি দূরে কোথাও যেও না, কাছে পিঠেই থেকো।

গোগোল মাঠ আর পাইনবন দেখিয়ে বললো, আমি ওদিকটায় থাকবে।

গোগোল মাঠ আর পাইন বনের দিকে গিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরলো। ওর মনে হলো, ওর বয়সী ছেলেরা সকলেই বোধহয় পাঞ্জাবী। কয়েকজনের সঙ্গে অল্প দু চারটি ইংরেজিতে কথা হলো। কিন্তু তেমন জমলে না। তখন গোগোল খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে গেল। বড় বড় করে লিখলো, পাইন বন অতি সুন্দর। লোকেরাও সুন্দর।

গোগোল ওর বাবার কাছে, দুপুরবেলা জেনে নিয়েছে, গাড়ির পিছনে জোড়া ওগুলোকে নাকি অটোভ্যান বলে। ও ঘুরে ঘুরে, হঠাৎ একটা অটোভ্যানের কাছে দাড়িয়ে পড়লো। অটোভ্যানের সামনে কোনো গাড়ি নেই, শুধু ভ্যানটা রয়েছে। গোগোলর মনে হলো, ভ্যানটার মধ্যে যেন ঠুং ঠুং করে একটা শব্দ হচ্ছে। ও খুব অবাক হলো। ভ্যানটার পিছনে গিয়ে দেখলো, তার দরজায় মস্ত বড় বড় দুটো তালা ঝুলছে। অথচ শব্দটা কিসের? ভ্যানটা যেখানে রয়েছে, সেখানে পাইন বন একটু ঘন, সামনে কোনো তাঁবু নেই, নিরিবিলি মতো।

শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। গোগোল ভ্যানটার চারপাশে ঘুরলো। উঁচুতে এক জায়গায় একটা বড়ো ফুটো রয়েছে। সেখানে উঠে দেখবার উপায় নেই।

গোগোলর মনে হলো, ও বোধহয় ভুল শুনেছে। আসলে ভিতরে বোধহয় ইঁদুর রয়েছে, ইহুর টুক টুক করছে। ও সেখান থেকে আবার অন্যদিকে সরে গেল। যেদিকে লোকজন আছে, সেদিকে বেড়াতে বেড়াতে, বাবা মাকে পেয়ে গেল। তাঁদের সঙ্গে লিডর নদীর ধারে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা গেল না। আকাশে মেঘ করে এল, বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। গোগোল বললো, বাবা, আমাদের তাঁবু ভিজে গেলে, থাকবো কেমন করে?

বাবা হেসে বললেন, দূর বোকা, তাঁবুর ভিতরে আবার জল পড়ে নাকি? ওয়াটার প্রুফ দেখোনি, যেমন কী না রেনকোট বা ছাতা, তার নীচে কি জল পড়ে? তাঁবুর কাপড়ও সেইরকম। ভেতরে জল পড়ে না।

গোগোল খুব গম্ভীরভাবে মাথা ঝাঁকালো। সত্যি, ব্যাপারটা ও ভাবে নি। ওরা তাঁবুতে ফিরতে না ফিরতেই বৃষ্টি নামলো, আর দারুণ শীত করতে লাগলো। বাবা তাবুর মুখ ভালো করে বেঁধে দিলেন।

 

পরের দিন সকালবেলা ঝকঝকে রোদ উঠলো। সব যেন নতুন হয়ে উঠেছে। গোগোল সেই মাঠ আর পাইন বনের দিকে গেল। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে, ও সেই ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানটার সঙ্গে এখন গাড়িটাও রয়েছে। এক ভদ্রলোক গাড়িতে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছেন, বাবারই বয়সী হবে। তিনি গোগোলকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু ভ্যানের ভিতরে সেই ঠুং ঠুং শব্দ হচ্ছে। গোগোল ভ্যানটার চারপাশে ঘুরে, গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই সময়েই ভদ্রলোক ওর দিকে তাকালেন। সামনে থেকে মনে হলো, ভদ্রলোক বাবার থেকে যেন বয়সে ছোট। লম্বা জুলফি, সরু গোঁফ, গালে অল্প দাড়ি গজিয়েছে। গোগোলকে দেখেই, লোকটি হঠাৎ ঝুকে পড়ে; গাড়িব হর্ন বাজিয়ে দিল। অমনি ঠুং ঠুং শব্দটাও থেমে গেল।

লোকটি গোগোলকে জিজ্ঞেস করলো, কেয়া মাংতা বাচ্চো?

গোগোল বললো, কিছু না : ইঁদুর-মানে, র‍্যাট-র‍্যাট টুক টুক করছে।

বলে ভ্যানের দিকে দেখিয়ে দিল। লোকটা হেসে বললো, হাঁ হাঁ, উকে অন্দর মে ইদ্দুর হ্যায়, মার দেগা।

গোগোলও হেসে সরে গেল। চলে যাবার সময়, হঠাৎ ভ্যানের উঁচু গায়ে, ফুটোর দিকে ওর চোখ পড়লো। পড়তেই দেখলো, একটা চোখ ওকে দেখছে। যেই চোখাচোখি হলো অমনি চোখটা সরে গেল। ওটা যে ইঁদুরের চোখ না, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মনে হলো মানুষের চোখ। কিন্তু তা কী করে সম্ভব হবে? ভ্যানের মধ্যে মানুষ থাকবে কেমন করে? গোগোল কি গাড়ির লোকটাকে কিছু বলবে? না, না বলাই ভালো। ও চলে যেতে যেতে ভাবলো, লোকটা তখন হঠাৎ হর্ন বাজালে কেন? আর তখনই ঠুং ঠুং শব্দটাও বন্ধ হয়ে গেল। এর মধ্যে কী ব্যাপার থাকতে পারে?

গোগোল তাঁবুতে ফিরে বাবাকে ঘটনাটা বললো। বাবা বললেন, তুমি নিশ্চয় ভুল দেখেছ, ওটা কখনো মানুষের চোখ হতে পারে না। ভ্যানের কোনো জানলা দরজা থাকে না, ওর মধ্যে মানুষ থাকলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে।

গোগোলের মনে হলো, কথাটা ঠিক। কিন্তু ও কি এততাই ভুল দেখেছে? ও অন্যদিকে বেড়াতে বেড়াতে ভাবতে লাগলো। দেখলো, এখানেও পুলিস আর মিলিটারি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। নিশ্চয় সেই ব্যাঙ্ক ডাকাতির, ডাকাতদের ধরবার জন্য। তাঁবুওয়ালা ওর বাঙলা কথা বুঝতে পারে। সেও বেশ ভাঙা ভাঙা বাঙলা বলতে পারে? ও গিয়ে তাঁবুওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলো, এখানে এত পুলিস আর মিলিটারি টহল দিচ্ছে কেন? সেই ডাকাতদের ধরবার জন্য?

তাঁবুওয়ালা বললো, হ খোকাবাবু, ডাকাতলোগ, ইধারেও আসতে পারে। পুলিস বাতলাচ্ছে কি, ডাকাতলোগ, নাকি ইধারে কোথায় এসেছে।

পুলিস খবর পেয়েছে?

তাঁবুওয়ালা বললো, তা জানি না। তবে উ লোগ ডাকাত খুঁজছে।

গোগোল বললো, কিন্তু এখানে তো সবাই বেড়াতে আসে। ডাকাতরা কি এখানে আসবে?

তাঁবুওয়ালা বললো, আসতে ভি পারে, উলোগ হর জায়গা যেতে পারে।

গোগোল চিন্তিত হয়ে তাঁবুতে ফিরে গেল।

 

গোগোল দুপুরবেলা খেয়ে দেয়ে, বাবার পাশে একটু শুয়ে রইলো। তারপরে বাবাকে বলে বেরিয়ে পড়লো, খাতা পেন্সিল নিয়ে। এক জায়গায় বসে লিখলো, ভ্যানের মধ্যে ইঁদুরের ঠুক ঠুক। তারপরে পাইন বনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ভ্যানটা রয়েছে, গাড়িটা নেই। গোগোল ভ্যানটার কাছে গেল। কোনো শব্দ হচ্ছে না। ও সেই ফুটোটার দিকে তাকালো। না, কোনো চোখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ভিতরে যেন খুট করে একটা শব্দ হলো, একবারই। গোগোল ভ্যানটার গায়ে কান ঠেকিয়ে শোনবার চেষ্টা করলো, কোনো শব্দ হচ্ছে কি না। ও চমকে উঠলো। খুব অস্পষ্ট হলেও, গোগোল মানুষের কথা বলার শব্দ পেল। কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ঠিক মানুষের গলা।

গোগোল সরে এসে পিছনে গিয়ে দেখলো, তালা দুটো ঠিক ঝুলছে। ও তাঁবুতে ফিরে গিয়ে, বাবাকে ঘটনাটা বললো। বাবা বললেন, তুমি তো অনেক কিছুই শুনতে পাও। কী শুনতে কী শুনেছ, তার ঠিক নেই। ও ভ্যানটা তোমাকে পেয়ে বসেছে।

বাবা তেমন আমল দিলেন না। গোগোল তখন তাঁবুওয়ালার কাছে গেল, তাকে সব কথা বললো। তাঁবুওয়ালার চোখে মুখে একটু চিন্তা দেখা দিল। সে গোগোলকে নিয়ে, পাকা রাস্তার ধারে একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে বন্দুক পিস্তল নিয়ে অনেক পুলিসের লোকেরা ছিলেন। তাঁবুওয়ালা

তাঁদের হিন্দীতে গোগোলের বলা ঘটনাটা বললো। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন উঠে দাঁড়ালেন। একজন লম্বা চওড়া অফিসার, কোমরে পিস্তল গোঁজা, গোগোলের হাত ধরে বললেন, চলো বাচ্চো, মুঝে ও ওয়াগন দেখা দেয়।

তাঁবুওয়ালা বললো, খোঁখাবাবু, ভ্যানটা ই সাবলোগকো দেখিয়ে দাও।

গোগোল বললো, চলুন।

গোগোলর সঙ্গে সেই অফিসার, এবং আরো কয়েকজন বন্দুক নিয়ে চললেন। কাছে গিয়ে দেখা গেল, ভ্যানের গাড়িটা তখন ফিরে এসেছে, আর সেই লোকটিই গাড়িতে বসে আছে। অফিসার এগিয়ে গিয়ে, সেই লোকটিকে কী বললেন। লোকটিও কী সব বললো। তারপরে একটা চাবির গোছ নিয়ে, লোকটি গাড়ি থেকে নেমে এল। নেমে এসে, ভ্যানের পিছন দিকে না গিয়ে, লোকটা হঠাৎ অন্যদিকে দৌড়ুতে লাগলো। অফিসার তৎক্ষণাৎ কোমর থেকে পিস্তল বের করে, লোকটার দিকে ছুড়লেন। কিন্তু লোকটা যেন সাপের মত এঁকেবেঁকে, পাইন বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ব্যাপার দেখে ভিড় জমতে লাগলো। অফিলার হুকুম দিলেন, ভ্যানকো তালামে গোলি চালাও।

দুজন বন্দুকধারী গুলি করে, তালা ভেঙে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে ভ্যানের ভিতর থেকেও গুলি ছুটে এল। তাঁবুওয়ালা গোগোলকে কোলে তুলে নিয়ে সরে গেল। একজন পুলিসের লোক গুলি খেয়ে পড়ে গেল। তখন বন্দুকধারী মিলিটারিও এসে গিয়েছে। ভ্যানের চার পাশ ঘিরে গুলি ছোড়া শুরু হলে।। যেন একটা যুদ্ধ চলছে। ভ্যানের ভিতর থেকে খানিকক্ষণ গুলি ছুটে এল, তারপরে বন্ধ হয়ে গেল। ভিতরে যেন কেউ আর্তনাদ করছে।

সেই পুলিস অফিসার চেঁচিয়ে বললেন, জিন্দা রহনে মাংতাত জলদি নিকালো।

একটু পরে, ভ্যান থেকে একটি লোক দু হাত তুলে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে একজন ধরে ফেললো। আর একজনকে নামানো হলো, তার ঘাড়ের কাছে রক্ত। তারপর কয়েকজন ভ্যানের ভিতর ঢুকলো। ভিতর থেকে বের করে নিয়ে এল, ব্যাঙ্কের সেই ভাঙা লোহার কে, আর বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকার নোট।

তাঁবুওয়ালার চোখ ছানাবড়া। সে গোগোলকে বললো, খোঁখাবাৰু, তুমি বহোত বরিয়া লেড়কা আছে, তোমার জন্যই ডাকাতলোগ ধরা পড়েছে, তামাম রূপেয়া ভি মিলে গেছে।

সেই লম্বা চওড়া ফরসা পুলিস অফিসার এসে, তাঁবুওয়ালার কোল থেকে, গোগোলকে নিজের কোলে তুলে নিলেন, আদর করে চুমু খেয়ে অনেক কথা বলতে লাগলেন। গোগোল তা বুঝতে পারলো না। শত শত লোক, পুলিস, মিলিটারি, পুরুষ মহিলা সবাই তখন গোগোলকে দেখছে, আর হাসছে, কেউ কেউ হাততালিও দিচ্ছে।

এ সময়েই গোগোলের বাবা মা ছুটে এলেন। বাবা ইংরেজিতে অফিসারকে ভয়ে ভয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করলেন, আর বললেন। অফিসার অমনি বাবাকেও এক হাতে জড়িয়ে ধরে ইংরেজিতে কী যেন বললেন। গোগোল দেখলো, বাবা মা হাসছেন, কিন্তু তাদের চোখে যেন জলও এসে পড়েছে। মা হাত বাড়াতেই, গোগোল মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মা ওকে চুমো খেয়ে বললেন, আমার সোনা মাণিক।

গোগোল বললো, কাঁদছো কেন মা?

মা বললেন, আনন্দে, তুমি যে আমাদের মুখোজ্জ্বল করেছ।

গোগোল লজ্জা পেয়ে মায়ের কাঁধে মুখ লুকালো।

এবার এখানেই ইতি। পরে আবার তোমাদের গোগোলের নতুন গল্প শোনাবো।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *