আলু খলিফার শেষ খুন

আলু খলিফার শেষ খুন

আগে নাম ছিল আলাউদ্দিন, সংক্ষেপে দাঁড়াল আলু। আলু নয়, আলু খলিফা।

লখনউয়ের মুসলমান—জাত কশাইয়ের ছেলে। লাল টকটকে দুটো চোখ যেন হিংসায় আরক্তিম হয়ে আছে। হাতে লম্বা একখানা চকচকে ভোজালি; তার হাতির দাঁতের বাঁটটার রং প্রথমে ছিল দুধের মতো সাদা, কিন্তু অনেক পশুর রক্ত জমতে জমতে তার রং হয়েছে। কুচকুচে কালো। শুধু ভোজালির ফলাটায় এতটুকু মালিন্য পড়েনি, ক্রমাগত রক্ত-মাংসের শান পড়ে পড়ে যেন তার ওপর থেকে হিরের আলো ঝলকে যায়।

আকস্মিক একদিন দর্শন দিলে প্রেতমূর্তির মতো।

শীতের সকাল, কিন্তু সকাল হয়নি। শেষরাত থেকে নেমেছে স্তরে স্তরে কুয়াশা। দূরের নিদ্রিত নির্বাক সিংহাবাদের বিস্তীর্ণ হিজলের বন থেকে, কৃষ্ণকালীর বিলের দুর্গন্ধ-ভরা জলের ওপর থেকে সেই কুয়াশা উঠে এসেছে। সমস্ত বন্দরটা শীতের আড়ষ্টতায় পড়ে আছে মূৰ্ছাতুরের মতো। দু-হাত দূরের মানুষ চোখে দেখা যায় না।

মদ-গাঁজার সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ভেণ্ডার জগদীশ তখন অঘোরে ঘুমে মগ্ন। জগদীশ নেশা করে না, কিন্তু দিনরাত নেশার জিনিস নাড়াচাড়া করে তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে এক-জাতীয় অভ্যস্ততা এসে দেখা দিয়েছে। নিজের পরিচিত জায়গাটিতে না শুলে ঘুম আসে না জগদীশের। কেরোসিন-কাঠের পুরোনো তক্তাপোশ থেকে সরাসরি ছারপোকা সারারাত সুড়সুড়ি দেয়। মাথার কাছে পায়া-ভাঙা টেবিলে গাঁজার নিক্তি আর গাঁজার পুরিয়া থেকে নিরুদ্ধ ঘরের মধ্যে অত্যুগ্র দুর্গন্ধ ভেসে ভেসে বেড়ায়। পায়ের কাছে পঁয়তাল্লিশ গ্যালন মদের পিপা থেকে পচা মহুয়া, চিটেগুড় আর অ্যালকোহলের একটা সুরভি নিশ্বাসে নিশ্বাসে জগদীশের স্নায়ুগুলোকে রোমাঞ্চিত করে তোলে। ওয়াড়হীন বাঁদিপোতার লেপে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে জগদীশ মধুর স্বপ্নে তলিয়ে থাকে। স্বপ্ন দেখে বন্দরের খোকা ভুঁইমালীর সুন্দরী বিধবা বোনটা তার জন্যে এক খিলি দোক্তা-দেওয়া পান এনে সোহাগভরা গলায় তাকে সাধাসাধি করছে।

আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে জগদীশ লেপের মধ্যে যখন বিড়বিড় করে উঠেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই কানের কাছে যেন বাজ ডেকে গেল।

খোকা ভুঁইমালীর সুন্দরী বোনের কোকিলকণ্ঠ নয়, এমনকী খোকার কটকটে ব্যাঙের মতো গলাও নয়। জগদীশ লাফিয়ে উঠে বসল।

বন্ধ দরজায় তখন লাঠির ঘা পড়ছে। ঘরের মধ্যে শীতার্ত অন্ধকারে মিটমিট করছে লণ্ঠনের লালশিখা, রাত শেষ হয়েছে কি না জগদীশ অনুমান করতে পারল না। এমন অসময়ে যেভাবে হাঁকাহাঁকি করছে, ডাকাত পড়ল না কি?

শীতে আর ভয়ে জগদীশের দাঁত ঠক ঠক করে বেজে উঠল, কে?

দারু চাই বাবু।

দারু। জগদীশের ধড়ে প্রাণ এল। নিশ্চয় মাতাল। অসীম বিরক্তিভাবে দাঁত খিচিয়ে বিশ্রী একটা শব্দ করলে জগদীশ, এই মাঝরাত্তিরে দারু? ইয়ার্কি পেলি নাকি? যা ব্যাটা, পালা।

আরও জোরগলায় কথাটার পুনরাবৃত্তি শোনা গেল, দারু চাই বাবু।

ক্রুদ্ধ জগদীশ লেপটাকে গায়ে জড়িয়ে নিয়েই উঠে পড়ল, ধড়াস করে খুলে ফেললে দরজাটা। যাচ্ছেতাই একটা গাল দিয়ে বললে, সরকারি আইন জানিস? বেলা ন-টার আগে…

কিন্তু কথাটা আর শেষ হতে পারল না। শীত-মন্থর আড়ষ্ট অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে পৈশাচিকভাবে হেসে উঠল লোকটা, ঝিকিয়ে উঠল হাতের ভোজালিখানা। জগদীশ দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো, শুধু হাঁটুর অস্থিসংস্থানগুলো যেন বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়ে পা-দুটো থরথর করে কাঁপতে লাগল।

সরকারি আইন? আইনভাঙা মানুষ আমরা বাবু, আইন দেখিয়ো না। দু-পয়সা বেশি নেবে নাও, কিন্তু লক্ষীছেলের মতো এক বোতল কড়া মাল বার করো দেখি। ভোর বেলায় হামলি আমার ভালো লাগে না।

দেখা গেল, ভোর বেলায় হামলি জগদীশও পছন্দ করে না। নিঃশব্দে আলমারি খুলে সিল করা ত্রিশের একটা বোতল বার করলে। কর্ক স্কুর প্যাঁচ পড়ল, হিস শব্দ করে তীব্র অ্যালকোহলের খানিকটা বিষবাষ্প ছড়িয়ে গেল হাওয়ায়। কালো কোর্তাপরা রাক্ষসের মতো চেহারার মানুষটা বোতলটাকে মুখের কাছে তুলে ধরল। ঢকঢকঢক, এক নিশ্বাসেই আগুনের মতো বিশ আউন্স পানীয় নিঃশেষিত। এক বার মুখবিকৃতি করলে না, শরীরের কোনোখানে দেখা গেল না এতটুকু প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ। তারপর দুটো টাকা ছুড়ে দিলে টেবিলের ওপর, ভোজালিখানাকে হাতে তুলে নিলে, ব্যঙ্গচ্ছলেই কি না কে জানে জগদীশকে একটা সেলাম দিলে এবং পায়ের নাগরা জুতোর মচ মচ শব্দ করে বেরিয়ে গেল বাইরে। তমসাচ্ছন্ন কুয়াশায় মিলিয়ে গেল ভৌতিক একটা ছায়ামূর্তি।

আট গন্ডা পয়সার চেঞ্জ পাওনা ছিল লোকটার, ফেলে গেছে অবজ্ঞাভরে। কিন্তু সেদিকে মন ছিল না জগদীশের। হাঁটুটা তখনও কাঁপছে, বুকের মধ্যে রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো শব্দ হচ্ছে তখনও। স্তব্ধ স্তম্ভিত জগদীশ ভাবতে লাগল কে এই লোকটা? যে এক নিশ্বাসে বিশ আউন্স আগুন পান করতে পারে এবং একটুখানি পা যার টলে না, যার হাসি অমন ভয়ানক এবং যার ভোজালি অমন ধারালো।

কিন্তু কয়েক দিন পরেই তার পরিচয় কারও কাছে অজানা রইল না।

লখনউ শহরের এক্সটার্নড় গুণ্ডা। মোট পাঁচ বার জেল খেটেছে। দু-বার রাহাজানিতে, তিন বার দাঙ্গায়। অবশ্য বয়সে ভাটা পড়েছে এখন, দাঙ্গা-রাহাজানি আলুর আর ভালো লাগে না। ছোটো একটা মাংসের দোকান বসিয়ে নির্বিঘ্নে কয়েকটা শান্তিপূর্ণ দিন যাপন করবার বাসনাই তার ছিল। কিন্তু পুলিশের বুদ্ধি একটু ভোঁতা, সব জিনিসই বোঝে কিছু দেরিতে। অতএব সারাজীবন উন্মত্ততার মধ্যে কাটিয়ে যখন প্রৌঢ়ত্বে নখদন্তগুলোকে সে আচ্ছাদিত করবার চেষ্টায় আছে, সেই সময়েই তার ওপরে এক্সটার্নমেন্টের অর্ডার এল।

প্রথমে ভেবেছিল মানবে না আইনের শাসন, লুকিয়ে থাকবে এদিকে-ওদিকে। কিন্তু বৈচিত্র্যের লোভ, পৃথিবীকে ভালো করে দেখবার একটা মোহ তার মনকে আচ্ছন্ন করে দিলে। এই লখনউ শহর, নবাবি আমলের বাগ-বাগিচা, চকবাজার, এর বাইরে কোন পরিধি, কত বড়ো বিস্তীর্ণ জগৎ? লখনউয়ের লু-হাওয়া ঘূর্ণির ঝড় উড়িয়ে ডাক পাঠাল আলু খালিফাঁকে। ট্রেন ছুটে এল কলকাতায়।

ক্যানিং স্ট্রিটের এক খোলার ঘরে গ্রেট মোগলাই হোটেল। সেই হোটেলের ম্যানেজার একদিন খুন হয়ে গেল। ফুসফুসের মধ্যে ভোজালির ধারালো ফলা বিঁধে গেছে আদ্যন্ত। আলু খলিফার কিছু হাত ছিল কি না অথবা কতখানি হাত ছিল ভগবান বলতে পারেন। কিন্তু পুলিশ আবার পেছনে লাগল, আলুকে কলকাতা ছাড়তে হল।

তারপর ঘুরতে ঘুরতে সে এসে পড়েছে এই পান্ডববর্জিত দেশে। উত্তরবাংলার এক প্রান্তে মাঝারি গোছের একটা গঞ্জ। ফাঁকা মাঠের মধ্য দিয়ে ক্ষীণস্রোতা পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে সরীসৃপ-গতিতে। বাবলা গাছের ডালে বসে আছে শঙ্খচিল। এপারে ছোটো গঞ্জ-বাঙালি

আর হিন্দুস্থানি ধান ব্যবসায়ীর উপনিবেশ। ওপারে ঢালু ব্ৰহ্মডাঙা—শস্যহীন কুশ আর কাঁকরে আকীর্ণ। তারই ভেতর দিয়ে গোরুর গাড়ির ধূলিমলিন পথ চলে গেছে যোলো মাইল দূরের রেলস্টেশনে। ছোটো-বড়ো রাঙামাটির টিলার উপরে বিচ্ছিন্ন তাল গাছগুলো নিঃসঙ্গতার বিরাট ব্যঞ্জনা।

আলু খলিফার ভালো লাগল জায়গাটা। আকাশে-বাতাসে, ভাষায়-মানুষে আর সীমাহীন শূন্যতার কোথায় যেন তার দেশের সঙ্গে মিল আছে এর। তা ছাড়া ফেরারির পক্ষে এর চাইতে নিরাপদ জায়গা আর কী কল্পনা করা চলে। সংসারে অবলম্বন তার দুটি ছেলে, দুজনেই গেছে যুদ্ধ করতে, কোনো দিন ফিরবে কি না কেউ জানে না। সুতরাং স্বচ্ছন্দ মনে জীবনের বাকি দিন ক-টা এখানে বানপ্রস্থ যাপন করতে পারে আলু খলিফা।

দিন কয়েকের মধ্যেই বন্দরের এক পাশে গড়ে উঠল ছোটো একটা মাংসের দোকান। যে ভোজালি সে রাগের মাথায় গ্রেট মোগলাই হোটেলের ম্যানেজারের বুকে বসিয়ে দিয়েছিল এবং অন্তত সাতটি মানুষের রক্তকণিকা যার বাঁটে অনুসন্ধান করলে খুঁজে পাওয়া যায়, সেই ভোজালি দিয়ে কচাকচ খাসির গলা কাটতে শুরু করে দিলে। মানুষ আর খাসির মধ্যে তফাত নেই কিছু, কাটবার সময়ে একইরকম মনে হয়। তা ছাড়া প্রথম মানুষ মারবার যে উত্তেজনা, লখনউ শহরে দু-তিনটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরে সে-উত্তেজনা ভোঁতা হয়ে গেছে। মানুষ কাটলে ফাঁসির ভয় আছে, কিন্তু পশুর বেলায় তা নেই। অতএব অর্থকরী এবং নিরাপদ দিকটাই বেছে নেওয়া ভালো।

বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে নতুন জীবন। দৈনিক একটা খাসি, কখনো-বা একটা বকরি জবাই দেয় আলু। রুদ্ধকণ্ঠ পশুটার শ্বাসনালি বিদীর্ণ করে দেয় তীক্ষ্ণধার ভোজালি। তিরের মতো ধারায় ছুটে যায় রক্ত, মুমূর্ষ অহিংস জীবন মাটিতে লুটিয়ে ছটফট করে। অদূরে দাঁড়িয়ে পরিতৃপ্ত চোখে আলু লক্ষ করে তার মৃত্যুযন্ত্রণা। রক্ত আর ধুলোর মিলিত কটুগন্ধ ছড়িয়ে যায় আকাশে। খচ খচ করে চলতে থাকে অস্ত্র। তারপর দড়ি-ঝোলানো ছোটো-বড়ো মাংসখন্ড ক্রেতাদের লোভ বর্ধন করে।

কত করে সের? ও খলিফা?

বারো আনা।

বারো আনা? এ যে দিনে ডাকাতি?

ডাকাতি! আলু খলিফা হাসে। ডাকাতির কী জানে এরা, বোঝেই-বা কতটুকু। করকরে খানিকটা প্রবল হাসিতে মুখরিত করে দেয় চারদিক।

সেরা খাসি বাবু, থকথকে তেল। কলকাতা লখনউ হলে সের হত আড়াই টাকা।

নানা জাতের খদ্দের আসে। হিন্দুস্থানি নিরামিষাশী ব্যাবসাদারেরা লোক পাঠিয়ে গোপনে মাংস কেনে। কাঁধে কাছিম ঝুলিয়ে, বাঁশের দোলায় শুয়োর নিয়ে হাট-ফিরতি ওরাওঁ, তুড়ি কিংবা সাঁওতালেরাও এক-আধ সের মাংস নিয়ে যায়। ভোজালির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মাংসকাটা কাঠটার নীচে জমে ওঠে রক্তমাখা সিকি-আধুলি, এক টাকার নোট। বারোটার মধ্যেই বিক্রিবাটা শেষ হয়ে যায় আলু খলিফার।

সন্ধ্যায় জগদীশের দোকান। এক বোতল তিরিশের মদ, ছিলিম তিনেক গাঁজা। জগদীশের সঙ্গে আলুর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব আজকাল। এরকম শাঁসালো খরিদ্দার দুর্লভ। বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ মাঝে মাঝে আলু জগদীশকে মাংস খাওয়ায়।

রাত ঘন হয়ে আসে। গ্রাম বন্দরের দোকানগুলো একটার পর একটা ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। মদের দোকান থেকে ফিরে আসে আলু। কোনোদিন খাওয়া হয়, কোনোদিন হয় না। রক্ত আর ক্লেদের ওপরে স্যাঁতসেঁতে চট বিছিয়ে আলু তার উপরে এলিয়ে পড়ে। বাসি মাংসের গন্ধ ঘরময় ভেসে বেড়ায়, হাওয়াতে দড়িবাঁধা খাসির শেষাংশটুকু ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো এদিকে-ওদিকে দুলতে থাকে। নদীতে হিন্দুস্থানি মাল্লাদের ঢোলের শব্দ আর উদ্দাম চিৎকার শান্ত হয়ে আসে। শুধু বালুচরে থেকে থেকে গাংশালিক কেঁদে ওঠে টি-টি-ট্টি-টি— হট ট্রি-ডি-টি—

আলু খলিফা স্বপ্ন দেখে লখনউ শহরের। দাঙ্গা বেঁধেছে। আল্লা-হো-আকবর। লাঠির ঠকাঠক শব্দ, মানুষের চিৎকার, লেলিহান আগুন। হাতের ভোজালি বাগিয়ে ধরে ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল রক্তলোলুপ বন্যজন্তুর মতো। বিদ্যুতের মতো ঝলকে উঠল ভোজালি। খাসির গলা নয়—মানুষের বুক। ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে আলুর দুখানা হাতকে রাঙিয়ে দিয়েছে।

জগদীশ ছাড়া আরও দুটি বন্ধু জুটেছে আলু খলিফার। একটি ছোটো মেয়ে—রামদুলারি তার নাম। তার বাপ বাজারে কী-এক হালুয়াই দোকানের কারিগর। মাংস কিনতে আসে না, মাংস কিনবার পয়সা নেই। মাঝে মাঝে দূরে দাঁড়িয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়।

স্নেহ-ভালোবাসা বলে কোনো জিনিস নেই আলুর জীবনে। তবু সেই মেয়েটাকে তার ভালো লাগল। বছর পাঁচ-ছয় বয়েস, একমাথা ঝাঁকড়া চুল। কালো রঙের ওপরে সুঠাম মুখশ্রী। গলায় কাচের মালা। হাটের শেষে একটা কেরোসিনের টেরি জ্বালিয়ে রাত করে পয়সা খুঁজে বেড়ায়। কী পায় কে জানে, কিন্তু সাধনার বিরাম নেই।

আলুই নিজে থেকে যেচে আলাপ করে নিয়েছে ওর সঙ্গে। প্রথম প্রথম কাছে আসতে চায়নি, রক্ত-মাংসের মাঝখানে ওই অস্ত্রধারী ভয়ংকর মানুষটাকে দেখে ছুটে পালিয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে তারপরে সহজ হয়ে এসেছে সমস্ত।

সকালে ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে দেখা দেয় ধূলিমলিন রামদুলারি।

আজকে ক-টা বকরি বানালে চাচাজি?

দুনিয়ার তামাম মানুষ বকরি হয়ে গেছে বেটি, তাই বকরি আর বানাই না। তাহলে তো দেশভর লোককে জবাই করতে হয়। তাই খাসি কেটেছি।

রামদুলারি কথাটা বুঝতে পারে না। বড়ো বড়ো বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে চাচাজির মুখের দিকে। বলে, দুনিয়ার সব লোক বকরি?

বকরি বই কী। কিন্তু সে থাক। মাটিয়া লিবি বেটি? এই নে ভালো মাটিয়া রেখেছি তোর জন্যে। একপোয়া-আধপোয়া মেটে প্রকান্ড মুঠিতে যা ওঠে, কলাপাতার ঠোঙায় করে রামদুলারির হাতে তুলে দেয় আলু খলিফা। ভালো লাগে রামদুলারিকে, ভালো লাগে এই দাক্ষিণ্যটুকু। বাংলা দেশের মাটিতে পা দিয়ে বাংলার স্নেহস্নিগ্ধ কোমলতা তার চেতনায় মায়া ছড়িয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের একটা মেয়ে থাকলে খুশি হত সে।

আর একটি বন্ধু জুটেছে, তার নাম বনশিধর। আড়তদার মহাবীর প্রসাদের ছেলে। কুড়ি বাইশ বছর বয়স, এর মধ্যেই সবরকম নেশায় সিদ্ধহস্ত। আলুকে সে তার দোসর করে নিয়েছে।

ফলে এই হয়েছে যে, জগদীশের দোকানে আলুকে আর গাঁটের কড়ি খরচ করতে হয় না। বনশিধর নিয়মিত তার নেশার খরচ জোগায়। হাতে প্রকান্ড ভোজালি নিয়ে বনশিধরের দেহরক্ষীর মতো তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় আলু খলিফা। চরিত্রগুণে বনশিধরের শত্রুর অভাব নেই, কিন্তু তার সহচরের দিকে চোখ পড়তেই শত্রুপক্ষের যা-কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব প্রশমিত হয়ে যায়। অত্যন্ত খুশি হয় বনশিধর। বলে, পঞ্চাশ টাকা মাইনে দেব তোমাকে খলিফা, তুমি আমার খাস বরকন্দাজ বনে যাও।

প্রকান্ড মুখে করকরে হাসি হাসে আলু খলিফা।

কোনো দিন গোলামি করিনি, আজও করব না। তুমি আমার দোস্ত আছ এই ভালো।

দিন কাটছিল, নিস্তাপ নিরুদ্ভেজ জীবন। আলুর মন থেকে মুছে আসছিল অতীতের যা কিছু স্মৃতি। কোথায় কত দূরে লখনউ শহর, কোথায় সেসব হিংস্র উন্মত্ত দিন! চোখ বুজে ভাবতে গেলে সত্যকেই এখন স্বপ্ন বলে বিভ্রম এসে যায়। এই ঝাঁপ-ফেলা ছোটো দোকান। সামনে বন্দর টিনের চাল, খড়ের চাল, ছোটো ছোটো ফড়িয়া আর পাইকার। সকলের ওপরে জেগে আছে মহাবীর প্রসাদের হলদে রঙের দু-তলা বাড়িটি। প্রতিদিনের চেনা নির্বিরোধ সমস্ত মানুষের মুখ, ধুলোর গন্ধ, বেনেতি মশলার গন্ধ, খাসির রক্ত আর বাসি মাংসের গন্ধ, জগদীশের দোকানে মদের গন্ধ। বাবলা গাছের তলা দিয়ে, কাঁকর আর কুশের তীক্ষ্ণাগ্রে আকীর্ণ দিকপ্রান্তের মধ্য দিয়ে তেমনি করে বয়ে যায় ক্ষীণস্রোতা নদী। নিশীথ রাত্রে তেমনি করে গাংশালিকের ডাক ট্টি-ট্টি-ট্টি-হট–ট্টি – ট্টি-ট্টি–

মায়া বসে গেছে এখানে, মায়া বসে গেছে এখানকার স্বল্পাবর্তিত সংকীর্ণ জীবনের ওপরে। স্বপ্নের মধ্যে সহস্র গলার আল্লা-হো-আকবর আর রক্তকে ফেনিল করে তোলে না, রামদুলারির মিষ্টি হাসি আর কচি মুখখানা ভেসে বেড়ায় চোখের সামনে। বয়স বেড়েছে আলু খলিফার। নিত্যসঙ্গী ভোজালির চওড়া ফলাটা ক্ষয়ে এসেছে আর তেমনি করে দিনের পর দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে মনের সেই পাশবিক উগ্রতা, সেই আদিম হিংস্রতার খর-নখরগুলো।

দিন কাটছিল, কিন্তু আর কাটতে চায় না। বাংলা দেশে মন্বন্তর এল।

পূর্বদিগন্ত থেকে, পশ্চিমের রণাঙ্গন থেকে কার একখানা আকাশজোড়া মহাকায় থাবা বাংলা দেশের ওপরে এসে পড়ল। নেই-নেই-নেই! তারপরে কিছুই নেই। তারও পরে দেখা গেল শুধু একটা জিনিস মাত্র অবশিষ্ট আছে, সে মৃত্যু। প্রতীকারহীন, উপায়হীন তিল তিল মৃত্যু।

প্রথম প্রথম সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করত আলু খলিফা, দেশের এ কী হল ভাই?

সংক্ষিপ্ত উত্তর আসত, যুদ্ধ।

যুদ্ধ-জং। কিন্তু জং তো আজকের দিনের ব্যাপার নয়, তারই দুই ছেলে তো জঙ্গি হয়ে জার্মান ঘায়েল করতে গেছে। এতদিন এই সর্বাঙ্গীণ অভাব কোথায় লুকিয়েছিল। তা ছাড়া ছোটোখাটো যুদ্ধ সেও না-করেছে এমন নয়। সেইসব দাঙ্গা, লাঠির শব্দ, মশালের আলো যুদ্ধ ছাড়া আর কী হতে পারে? কিন্তু এমন সর্বব্যাপী অভাবের মূর্তি তো চোখে পড়েনি কখনো।

খাসির দর বাড়ল, মাংসের দর বাড়ল। একপোয়া-আধপোয়ার খদ্দেররা আর এ পথ মাড়ায় না। দলে দলে দেহাতি লোক বন্দরে আসে, ভিক্ষা চায়, কাঁদে, হাটখোলার পাশে পাশে পড়ে মরে যায়। দিনের বেলাতেই শেয়াল-কুকুরে মড়া খায় এখানে-ওখানে। যুদ্ধ।

নেই নেই, কিছুই নেই। সাধারণ মানুষ যেন মৃত্যুর সঙ্গে মুহূর্তে মুহূর্তে লড়াই করে দিন গুজরান করে। এ এক আচ্ছা তামাশা, এও এক জং। আলু খলিফার বুকের রক্ত চনচন করে ওঠে উত্তেজনায়। প্রতিপক্ষকে যেখানে চোখে পায় না অথচ যার অলক্ষ্য মৃত্যুবাণ অব্যর্থভাবে হত্যা করে চলেছে—তাকে হাতের কাছে পাওয়ার জন্যে একটা হিংস্র কামনা অনুভব করে আলু।

একপোয়া-আধপোয়ার খদ্দের নেই, কিন্তু দু-সের আধ সেরের খদ্দের বেড়েছে। একটার জায়গায় দুটো খাসি জবাই করতে হয়, হাটবারে চারটে। আলু একা মানুষ, অভাববোধ তার কম তবুও অভাব এসে দেখা দিয়েছে। দামি মাংসের দামি খদ্দের বেড়েছে, জগদীশের দোকানে সন্ধ্যায় আর বসবার জায়গা পাওয়া যায় না। বনশিধর টাটকা সিল্কের পাঞ্জাবি পরে, দোক্তা-দেওয়া পান চিবোয়; মদের জন্যে নির্বিকার মুখে নোটের পর নোট বার করে। সমস্ত জিনিসটা গোলকধাঁধা বলে মনে হয় যেন। এত টাকা বেড়েছে বনশিধরের, টাকা বেড়েছে। হনুমান প্রসাদের, টাকা বেড়েছে আড়তদার গোলাম আলির, কিন্তু এত মানুষ না খেয়ে মরে যায় কেন?

দাঙ্গায় মানুষ মারতে ভালো লাগে—যে-মানুষের রক্ত উদবেলিত, হৃৎপিন্ড উত্তেজনায় বিস্ফারিত। কিন্তু যাদের অস্থির দেহ টুকরো টুকরো করে কাটলেও একবিন্দু ফিকে জোলো রক্ত বেরিয়ে আসবে না, তাদের এই মৃত্যু দুঃসহ বলে মনে হয়। আলু খলিফার অস্বস্তি লাগে।

বনশিধর আজকাল বিষয়কর্মে মন দিয়েছে। প্রায়ই বাইরে থাকে। শহরে যায়, ইষ্টিশনে যায়, আরও কোথায় ছুটে বেড়ায়। তারপর একদিন দেখা দেয় অতিশয় প্রসন্নমুখে। গায়ে পাটভাঙা সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়ে গ্লেজ-কিডের জুতো, মুখে সুর্তি-দেওয়া পান আর সিগারেট। মদের দোকানে খুলে দেয় সদাব্রত।

তারপরে, তামাম চিজ পাচ্ছ তো খলিফা?

কই আর পাচ্ছি। বোকার মতো মুখ করে তাকায় আলু খলিফা। বড়ো বড়ো দুটো আলুর মতো আরক্তিম চোখ মেলে তাকিয়েই থাকে বনশিধরের পানের-কষ-রাঙানো পুরু পুরু ঠোঁটের দিকে। ভাই, এ কী হল বাংলা মুলুকের হালচাল!

পুরোনো প্রশ্নের পুরোনো জবাব সংক্ষেপেই দেয় বনশিধর, লড়াই।

লড়াই! কিন্তু তোমরা এত টাকা পাচ্ছ কোথা থেকে?

খোদা মান? যাকে দেয় ছল্পর ছুঁড়ে দেয়।

তা বটে।

কিন্তু খোদা মানলেও কার্যকারণ সম্বন্ধ তো একটা থাকা দরকার। লখনউ শহরের এক্সটার্নড গুণ্ডা অনেক বুঝতে পারে, কিন্তু এই সোজা কথাটা বুঝতে পারে না কিছুতেই। জীবনের গতি তার প্রত্যক্ষ আর সরল। বাহুবলে, অস্ত্রবলে উপভোগ করো সমস্ত। কেড়ে নাও, রাহাজানি করো, মানুষ মারো। কিন্তু রাহাজানি নেই, হাঙ্গামা নেই, অথচ টাকা আসছে আর মানুষ মরছে। হ্যাঁ, একেই বলে তকদির। খোদা দেনেওয়ালাই বটে।

ছিন্নকণ্ঠ খাসির রক্তে দোকানের সামনে মাটিটা শক্ত কালো পাথরের মতো চাপ বেঁধে গেছে। কিন্তু এত মানুষ যে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে মরে গেল, তাদের রক্ত জমল কোথায়? এই হাজার হাজার মানুষের রক্তে সমুদ্র তরঙ্গিত হয়ে উঠেছে কোনখানে?

তারপর একদিন আলু খলিফার খেয়াল হল আজ অনেক দিন রামদুলারি তার দোকানে আসেনি। চাচাজির কাছ থেকে মেটে চেয়ে নিয়ে যায়নি কলাপাতার ঠোঙায়। কী হল রামদুলারির?

মনে পড়ল শেষ যেদিন এসেছিল সেদিন মেটে চায়নি, চেয়েছিল আধ সের চাল। চাচাজি, কাল সারাদিন আমাদের খাওয়া হয়নি।

বারো আনা দিয়ে আলু চাল কিনে দিয়েছিল রামদুলারিকে। কিন্তু পরদিন থেকে আর আসেনি রামদুলারি। নানা বিড়ম্বনা, বন্দরের পথে-ঘাটে মড়া, সন্ধ্যায় জগদীশের দোকানে বনশিধরের টাকায় মদের অবাধ স্রোত—কালো মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়েছিল একেবারে। কিন্তু সকালে দোকানের ঝাঁপ খুলতে গিয়ে সমস্ত মনটা খারাপ হয়ে গেল।

সতনারান হালুয়াইয়ের ঘর বন্দরের বাইরে। আলু বেরিয়ে পড়ল রামদুলারির সন্ধানে।

সতনারানের অবস্থা খারাপ, কিন্তু এত যে খারাপ আলু তা জানত না। ভাঙা খোছড়া ঘর দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ভাবে, নদীর বাতাসে তার চালটা কাঁপছে ঠকঠক করে। বারান্দায় একটা ভাঙা খাঁটিয়া, তার উপরে আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদছে সতনারান হালুয়াইয়ের বউ।

রামদুলারি কাঁহা? রামদুলারি?

সতনারানের বউ আরও তারস্বরে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। নামজাদা গুণ্ডা আলু খলিফার বুক কাঁপতে লাগল। জীবনে এই প্রথম ভয় পেয়েছে, এই প্রথম আশঙ্কায় তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে।

কী হয়েছে? কোথায় রামদুলারি?

রামদুলারি নেই। হ্যাঁ সত্যিই সে মরে গেছে। ভারী অসুখ হয়েছিল, কিন্তু এক ফোঁটা দাওয়াই জোটেনি। মরবার আগে চেঁচিয়েছে ভাত ভাত করে। গলা বসে গেছে, কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে দুটো মুমূর্ষু চোখ। চি চি করে আর্তনাদ করেছে ভাতের জন্যে, কিন্তু ভাত জোটেনি। কোথায় ভাত? রামদুলারি মরে গেছে। তার মুখে আগুন চুইয়ে শীর্ণ দেহটাকে নদীর জলে গাংসই করে দিয়ে এসেছে বাপ সতনারান।

টলতে টলতে চলে এল আলু খলিফা। সে খুন করবে, বহুদিন পরে খুন করবার প্রেরণায় তার শিরা-স্নায়ুগুলো ঝর ঝর করে উঠেছে। খুন করবে তাকেই—যে রামদুলারিকে মেরে ফেলেছে, শুষে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে সেই অদৃশ্য শত্রুকে, যার অলক্ষ মৃত্যুবাণ অব্যর্থ লক্ষ্যে হত্যা করে চলেছে? কোথায় সেই প্রতিদ্বন্দ্বী? ভোজালির সীমানার। মধ্যে তাকে পাওয়া যায় কী করে?

জগদীশের দোকান। আলুর মুখ দেখে জগদীশ চমকে গেল।

কী হয়েছে খলিফা?

আলু সেকথার জবাব দিলে না। শুধু বললে, একটা বোতল।

এই অসময়ে!

আলু চেঁচিয়ে উঠল কদর্য একটা গাল দিয়ে, তাতে তোমার কী?

জগদীশ আর কথা বাড়াল। নিঃশব্দে বোতল খুলে দিলে আলুর দিকে। কী যেন হয়েছে লোকটার। এমন মুখ, এমন চোখ সে আর কখনো দেখেনি, যেন থমথম করছে ঝড়ের আকাশ।

এক বোতল, দু-বোতল। আলু কাঁদতে জানে না, তার চোখের জল আগুন হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। খুন করবে, খুন করবে সে। কিন্তু কোথায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী, তার শত্রু।

গা টলছে, মাথা ঘুরছে। বহুদিন পরে আজ আবার নেশা হয়েছে আলুর। এমনই নেশা হয়েছিল সেদিন, যেদিন গ্রেট মোগলাই হোটেলের ম্যানেজারের বুকে সে তার ছোরাখানা বিঁধিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ কী মনে হল—আরক্ত আচ্ছন্ন চোখ মেলে সে জগদীশকে লক্ষ করতে লাগল। একে দিয়েই আরম্ভ করবে না কি? জগদীশের পেটে বাঁটসুদ্ধ বসিয়ে দিয়ে প্রথম শান দেবে ভোজালিতে?

আলু চিন্তা করতে লাগল।

কিন্তু নিছক পিতৃপুরুষের পুণ্যেই এ যাত্রা জগদীশের ফাঁড়া কেটে গেল। গ্লেজ-কিড জুতো মচমচিয়ে ঘরে ঢুকল বনশিধর।

উল্লসিত কণ্ঠে বনশিধর বললে, কী খবর খলিফা, এই সাতসকালেই মদ গিলতে বসেছ?

আলু বললে, আমার মর্জি।

একটা বড়ো কনসাইনমেন্টের টাকা হাতে এসে পৌঁচেছে—অত্যন্ত প্রসন্ন আছে বনশিধরের মন। তাহলে এসো এসো, আরও চালানো যাক।

জগদীশ বললে, দু-বোতল গিলেছে কিন্তু।

আলু গর্জে উঠল, দশ বোতল গিলব, তোমার মুভুসুদ্ধ গিলব আমি।

দশ বোতল কেন, ভাঁটিটাই গিলে ফ্যালো-না। কিন্তু দোহাই বাবু, আমার মুন্ডুটাকে রেয়াত কোরো দয়া করে। জগদীশ রসিকতার চেষ্টা করলে একটা।

বনশিধর হেসে উঠল কিন্তু আলু হাসল না। চোখের জল আগুন হয়ে ঝরে যাচ্ছে! কে মেরে ফেলেছে রামদুলারিকে? কে কেড়ে নিয়েছে তার রোগের দাওয়াই, তার মুখের ভাত? কোথায় সেই শত্রুর সন্ধান মিলবে?

বোতলের পর বোতল চলতে লাগল! শরীরে আর রক্ত নেই, বয়ে যাচ্ছে যেন তরল একটা অগ্নি-নিঃস্রাব। বনশিধরের কাঁধে ভর দিয়ে জীবনে এই সর্বপ্রথম আলু মদের দোকান থেকে বেরিয়ে এল। এই প্রথম এমন নেশা হয়েছে তার। এই প্রথম তার পরের ওপরে নির্ভর করতে হয়েছে।

চলতে চলতে আলু জড়ানো গলায় বললে, বলতে পার দোস্ত, চাল গেল কোথায়?

চাল? বনশিধরের নেশাচ্ছন্ন চোখ দুটো পিটপিট করতে লাগল। অর্ধচেতন এই মানসিক অবস্থায় আলু অনেকখানি বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে তার কাছে। একটা বিচিত্র রহস্য উৎঘাটন করতে যাচ্ছে এমনই ফিসফিস করে চাপা গলায় বনশিধর বললে, দেখবে কোথায় চাল?

দেখব। প্রতিটি রোমকূপে অগ্নিস্রাব যেন লক্ষ লক্ষ শিখা মেলে দিয়েছে। দেখব আমি।

বনশিধরের অন্ধকার গুদামের ভেতর থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ। লোকজন ছুটে এল ঊর্ধ্বশ্বাসে, দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। পাকার চালের বস্তার উপরে চিত হয়ে পড়ে আছে বনশিধর, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক, আর তারই হাঁটুর ওপরে বসে ভোজালি দিয়ে নিপুণ কসাইয়ের মতো আলু খলিফা তার পেটটাকে ফালা ফালা করে কাটছে-বনশিধরের মেটে

বার করবে সে। মানুষ আর খাসির মধ্যে কোনো তফাত নেই, কাটতে একইরকম লাগে।

এতদিন ঘাতকের মতো মানুষের প্রাণ নিয়েছে আলু খলিফা, কিন্তু কেউ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু যেদিন সে খুনের প্রথম অধিকার পেল, সেদিনই সে ধরা পড়ল পুলিশের হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *