আউলাদ

আউলাদ

অনেক ঝড়ের দোলা পার হ’য়ে এল সে নাবিক।
অনেক ক্ষুধিত রাত্রি, আর বহু সামুদ্রিক
চঞ্চল করেছে তারে, অন্ধকারে হারায়েছে দিক,
কালা-পানি ঘিরে ঘিরে ডাকিয়াছে মৃত্যুর দূতীরা,
ভেঙে-পড়া জাহাজের বেকে যাওয়া খোল ভ’রে তার
উঠিয়াছে ব্যর্থতার দেসিক্ত চরম নিরাশা,
সম্মুখে ডেকেহে তারে হিংস্র-নীল তিমির পাথার;
অচেনা জগতে তবু সে নাবিক খুজে পেল বাসা।
যদিও দু’চোখ তার দুঃস্বপ্নের কালো ভয়ে ভরা
যদিও বিবর্ণ ওঠে লেগে আছে মৃত্যুর আস্বাদ,
তবু জীর্ণ জাহাজের ভাঙা খোল আজ জয়ে ভরা
পশ্চাতে জাগিয়েছে শুধু সে দুঃসহ স্মৃতির নিষাদ,
বহু ঝড় পার হয়ে এনেছে সে সম্পূর্ণ পশরা,
মানুষের আউলাদ ফিরেছে বিজয়ী সিন্দবাদ।
দুর্গম সমুদ্র পারে আরেক অচেনা লোকে
দেখিয়ে সে মানুষের ঘর
জীবন্ত কবর,
যেথা বাসা বেঁধে আছে দাম্ভিকের মৃত মরু মন
পাথর জমানো প্রহসন।
সারে সারে
কাতারে কাতারে
চলে ভারবাহী দল,
গাঁইতি, শাবল নিয়ে
কলম, লাঙল নিয়ে,
শ্রান্ত পদতল
চলে যাত্রীদল,
চলে ক্ষুধাতুর শিশু শীর্ণদাঁড়া, আর
চলিতেছে অসংখ্য কাতার
পার হ’য়ে মরু, মাঠ, বন।
মানুষের আদালত ঘরে
পাথর-জমানো প্রহসন।
চলে দল বেঁধে শিশু ওষ্ঠে তুলি জীবনের
পানপাত্র সুতীব্র বিস্বাদ
মানুষের বুভুক্ষু মুমূর্ষ আউলাদ!
জড়তার–
পাথর জমানো পথ,
এ বীভৎস সভ্যতার
গড়খাই কাটা পথ
আঁধারে ঢাকিয়া আকাশের
ডাকে তাহাদেরে।।
এ কোন পরিখা?
এখানে জ্বলিছে শুধু ক্ষুধাতু দিবসের শিখা
বিষাক্ত ধোঁয়ার কুজঝটিকা
মৃত্যুর বিকট বিভীষিকা।
মজলুম মনের বোঝা, ভারাক্রান্ত বেদনা অগাধ,
আমি মাকে লাথি খেয়ে চলে আজ আদমের মৃত আউলাদ,
শয়তানের ডরে;
বীভৎস করে;
জটিল গহ্বরে।
দল বেঁধে চলিছে শিশুরা মড়কের পথে,
কুৎসিত কুটিল প্রান্তে অন্ধকার শড়কে বিপথে
যেখানে প্রত্যেক প্রান্তে আজাজিল পাতিয়াছে ফাঁদ
তারি পানে, দুর্নিবার টানে চলে আজ মানুষের
দুর্বল, বিশীর্ণ আউলাদ।
আমি দেখি পথের দু’ধারে ক্ষুধিত শিশুর শব,
আমি দেখি পাশে পাশে উপচিয়া পড়ে যায়
ধনিকের গর্বিত আসব,
আমি দেখি কৃষাণের দুয়ারে দুর্ভিক্ষ বিভীষিকা,
আমি দেখি লাঞ্জিতের ললাটে জ্বলিছে শুধু অপমান টিকা,
গর্বিতের পরিহাসে মানুষ হয়েছে দাস,
নারী হ’ল লুণ্ঠিতা গণিকা।
অনেক মঞ্জিল দূরে পড়ে আছে মানুষের ঘাঁটি,
এখানে প্রেতের বহির্বাটি
এখানে আবর্তে পথহারা
চলিতেছে যারা
তাদেরে দিয়েছে ডাক জড়তার কুর আজদাহা,
শতকের সভ্যতার এরা আজ হ’ল তাই অন্ধ, গুমরাহা।
বাড়ায়ে এন্তের দল, বাড়বে ভ্রষ্টের দল,
নর-ঘাতকের সাথে, নারী-ঘাতকের হাতে
হ’ল এরা শোণিত-চঞ্চল
হ’ল এরা জালিম, নিষাদ,
মানুষের অমানুষ মৃত আউলাদ।
পায় পায় বাধা শৃঙ্খল-বন্ধন,
 থেমে যায় জীবন-স্পন্দন,
মানুষের আদালতে
পাথর-জমানো প্রহসন।
এবার
জীবের প্রতীক এই মানুষের আদালতে নয়,
শয়তানের কাদা মাখা কালো পথে নয়–
এবার আব্বার আদালতে
আমাদের ফরিয়াদ,
ক্ষুধিত লুষ্ঠিত এই মানুষের রিক্ত ফরিয়াদ।
অনেক সভ্যতা জানি মিশেছে ধূলির নীচে, অনেক সামুদ
কত ফেরাউন, কত জালিম পিশাচ নমরুদ
মিশে গেল ধূলিতলে
নতুন যাত্রীর দল দেখা দিল দুর্গম উপলে
উড়ায়ে নিশান
সাথে করে নিয়ে এল জীবনের অ-শ্রান্ত তুফান।
শুনি আজ তাদেরি দামামা।
বাতাসে ওড়ে তাহাদের বিজয়ী আমামা
শুনি শুধু তাহাদেরি স্বর
বলিষ্ঠ বক্ষের তলে সুকোমল অন্তরের স্বর…
আর যেন ক্লিষ্ট নাহি হয়
আর যেন এস্ত নাহি হয়,
পথে দেখি-পীড়নের ফাঁদ,
আর যেন এই নাহি হয়
মানুষের ভবিষ্য দিনের আউলাদ।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *