অকালবৃষ্টি

অকালবৃষ্টি

আবার তুই মেয়েমানুষ এনে তুললি এখানে? জিজ্ঞাসা করল ভূতেশ হালদার তার কটা ক্রুদ্ধ চোখ তুলে। হাঁ, আনলুম। কথা শেষ করে দেওয়ার মতো একটা ভাব করে কোমরের কাছ থেকে কাপড় সরিয়ে দাদ চুলকোতে লাগল সিধু ডোম।

আর যে মেয়েমানুষটিকে আনা হয়েছে, সে বুড়ো বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা, বটতলার চালাটার দরজায় বসে তার দীর্ঘ চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে মুখ টিপে টিপে হাসছে এদের দুজনার দিকে আড় চোখে চেয়ে চেয়ে।

ও-দিকে পাঁচিল দিয়ে আড়াল করা শ্মশানের মধ্যে একটা মড়া পুড়ছে। তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মড়া বয়ে আনা দলটি পশ্চিম দিকের ঘাটে গঙ্গামুখো বসে নিজেদের মধ্যে জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে একটা খুব উত্তেজিত আলোচনায় ব্যস্ত। শ্মশানের কুকুরগুলো নেশাখোরের মতো জুলজুলে চোখে লেজ গুটিয়ে শুঁকে শুঁকে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে, নুলো বাড়িয়ে ছাই আর পোড়া কাঠের গাদা ঘাঁটছে, নয়তো তাদের লাল দগদগে মুখের বিশাল কশ বিস্ফারিত করে লোভিষ্টির মতো দেখছে মড়া পোড়ার দিকে।

ভাটা পড়ে গঙ্গা নেমে গেছে অনেকখানি। অগ্রহায়ণের গঙ্গা, জল খানিক স্বচ্ছ। স্রোতস্বিনী গাঙ্গের মতো গঙ্গা কলকল করে বইছে। তরঙ্গায়িতা গৈরিক সুরেশ্বরী যেন ছেয়ালো একহারা এক কিশোরী মেয়ে।

বেলা শেষ হয়ে আসছে। বটগাছের উপর মাটির দিকে ঘাড় নোয়ানো শকুনগুলোর চোখ কানা হয়ে যাচ্ছে। রাতকানা পাখি ওরা।

আগে গঙ্গার ধারে ধারে ঘাটে অঘাটে মড়া পোড়ানো হত। এখন এ গাঁ হয়েছে চটকল শহর। মিউনিসিপ্যালিটি হয়েছে মস্ত বড়। কোন্ এক চটকলের সাহেব এ শ্মশান তৈরি করে দিয়েছে। ইটে খোদাই করে ইংরেজিতে লেখা আছে, এস্ট, ১৯২৬। মস্ত উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও শ্মশান। মড়া যখন পোড়ে, তখন দূর থেকে মনে হয় বুঝি কোনও চটকলের চিনি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। পুবদিক ঘেঁসে বটতলায় ডোমচালার মেঝেটা ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভূতেশ হালদার তার ছোট ছোট কটা চোখের চোরা দৃষ্টিতে মেয়েটাকে একবার দেখে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াল যেন একটা লম্বা ছিপছিপে পোড়া কাঠ। কালো নয়, গায়ের রংটা ছাই ছাই। সারা মুখে বসন্তের দাগ, নাকটা ঘোড়ার নাকের মতো লম্বা, চুলগুলি ছোট করে ছাঁটা। কানে একটা হলদে পেন্সিল গোঁজা, গায়ে তার শরীরের অনুপাতে নিতান্ত ছোট খাকি শার্ট, গঙ্গার জলে কাচা লালচে ধুতি দশ হাত হলেও হাঁটুর বেশি নীচে নামেনি।

এই হল ভূতেশ, চিত্রগুপ্তের অবতার অর্থাৎ মৃত্যু রেজিস্ট্রার। মাইল কয়েকের এলাকার মৃত্যুর খতিয়ান তার কাছে। নামধাম, কারণ অকারণ স্ত্রী কি পুরুষ, মৃতের চৌদ্দ পুরুষের ঠিকানা লেখা আছে ভূতেশের চটের সুতো দিয়ে বাঁধা মোটা খাতাটায়। এই হল তার আসল পদমর্যাদা, বাকি কাজটুকু স্যানিটরি ইনস্পেক্টরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে সকালের কয়েক ঘণ্টা এ-দিকে ও-দিকে ঝাড়ুদার মেথরের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ানো। তবে এটা হল ফালতু কাজ। মাইনে ত্রিশ টাকা। নামের গেরোতেই বোধ হয় তাকে এ কাজটি বেছে নিতে হয়েছে। এখানকার লোকে অন্তত তাই বলে। মৃত্যু রেজিস্ট্রার হিসাবে তার এখানকার সহকর্মী হল সিধু ডোম। দোহারা শক্ত কালো শরীর, চোয়াল উঠানো গাল, আ-ছাঁটা গোঁফ, একজোড়া কালো কুচকুচে মস্তবড় টেরা চোখ, এক মাথা কালো পাঁশুটে ভেড়ার লোমের মতো কোঁচকানো চুল। রেজেস্ট্রি হয়ে গেলে চিতায় কাঠ সাজায় সে, মড়া তোলার আগে শত শোক ও আপত্তি সত্ত্বেও মড়ার গায়ের জামা কাপড় খুলে নেওয়ার চেষ্টা করে, মরা মেয়েমানুষের গায়ে গয়না থাকলে চেষ্টা করে তা খুলে নেওয়ার। সে হিসাব রাখে এ চাকলার কাকে পোড়াতে কত কাঠ লেগেছিল, কাকে আধা পোড়ানো হয়েছিল, কার কোন অঙ্গটা পুড়েছিল আগে, কিংবা লোকে যেমন শুকনো ও ভেজা কাঠের গুণ বর্ণনা করে, তেমনি কার মড়া পোড়াবার পক্ষে বেশ খনখনে ছিল বা স্যাঁতসেঁতে ছিল তার হিসাবও সে কড়ায় গণ্ডায় দিতে পারে।

ভূতেশ যদি চিত্রগুপ্ত হয়, সিধু ডোম তা হলে সাক্ষাৎ যম। সিধুর অবশ্য ধারণা, এটা তার রাজা হরিশ্চন্দ্রের মতো এ জীবনের ভোগান্তি, আগামী জন্মটা তার ভালই হবে।

তারা দুজনে এ গাঁয়েরই মানুষ। তারা বলে গাঁ, লোকে বলে শহর। উভয়ে তারা ছোট কাল থেকে পরিচিত। তবে একজন হল ডোম, অপর জন বামুন। মেলামেশা তাদের সম্ভব ছিল না, দরকারও ছিল না, আর আজ দীর্ঘ দশ বছর ধরে একই সঙ্গে কাজের মধ্যে থেকে ভূতেশ ‘বাবু’ থেকে সিধুর কাছে ‘ঠাকুর’ হয়েছে। সম্পর্কটা ঠিক বন্ধুত্ব না হলেও রেজিস্ট্রিবাবু আর ডোমের মর্যাদাপূর্ণ ফারাকটা যেন নেই। একজন কথায় কথায় ইংরেজি বলে, অপরজন রেগে গেলে বলে হিন্দি। ভূতেশকে উঠতে দেখে সিধু বলল, একটা বিড়ি দেও দিনি ঠাউর।

বিড়ি নেই। বলে ভূতেশ একটা বিড়ি পকেট থেকে নিয়ে তার নিজের ঠোঁটে চেপে ধরল।

বিড়ি এখন পাবে না বুঝেই সিধু চিতার কাছে গিয়ে তার হাতের পোড়া লাঠিটা দিয়ে ঝিমিয়ে পড়া আগুন উসকে দিল, দগ্ধ মৃতদেহটা দিল উলটে পালটে এবং দিতে দিতে আগুনের তাতে দাঁতে দাঁত চেপে ভাবল সে, ঠাকুর মেয়েমানুষ দেখলেই এমন খেপে যায় কেন? 

যাদের মড়া, তাদের একজন বলল, একটু আস্তে সুস্থে দাও বাবা, এমন ঠ্যাঙাড়ের মতো করছ কেন? সিধু হেসে বলল, মরতেও এত, তবু তো ঠেক্কে রাখতে পারলে না বাবু। মনে মনে বলল, আর শালা আমি য্যাখন মড়ার জামাটা চাইলাম ত্যাখন তো দরদ দেখা গেল না।

কথাবার্তা একটু চেপেচুপে না বললে বকশিশটা ফাঁক যাওয়ার সম্ভাবনা। ভূতেশেরও পাওনা আছে। তবে ভূতেশ সেটাকে বকশিশ বলে না, বলে রেজিস্ট্রির নজরানা। পাওনা বলতে পারে না, কারণ দাবির ব্যাপার নয় ওটা। তা ছাড়া কারণে অকারণে ভূতেশ নানান রকম গণ্ডগোল করে থাকে। আইবুড়ো মেয়ের মড়া হলে তো কথাই নেই। সে তার ঘোড়ার মতো লম্বা নাক ফুলিয়ে কটা খটাস চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করবে, কী হয়েছিল মেয়েটার?

কালাজ্বর।

হুঁ, কিন্তু মড়াটা থাক, কালকে মেডিকেল অফিসার এলে দেখে অনুমতি দেবে।

কারণ?

বুঝুক না বুঝুক, অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো ভূতেশ বলে, কী করব মশাই, এ রকম কত সুইসাইড কেস কিংবা এই ধরুন যুবতী মেয়ে কোনও গোলমাল করে ফেলল, মেটাতে গিয়ে হয় তো ফসকে গেল জান্। তখন–

অপর পক্ষ থেকে হয় তো প্রশ্ন আসে, তা এটাও সেরকম মনে হচ্ছে নাকি?

ভূতেশ তাড়াতাড়ি জবাব দেয়, হয়তো নয়। তবে বোঝেনই তো, হুকুম আছে, কোনওরকম সন্দেহ টন্দেহ হলে। …আমি তো আর ডাক্তার নই।

ফলে কখনও হয় তো পকেটে পাঁচ দশ কিছু এসে পড়ে, নয় তো গালগাল আর শাসানি। কিন্তু ঢিল একবার ছুড়ে দিলে যা হোক একটা হবেই। পয়সা এলে ভূতেশ আরও গম্ভীর হয়ে বলে, খামোখা বকালেন। যাই হোক, ডোমের পাওনাটা মিটিয়ে দেবেন। না হলে রাতভর মড়া আটকে রেখে মেডিকেল অফিসারকে খবর দিতে ছোটে সকালে। সিধু ডোম এ সময়ে তার নিষ্পলক টেরা চোখে ঠাকুরের মারপ্যাঁচ লক্ষ করে আর মনে মনে তারিফ করে। কথা চলে। শ্মশানের কুকুরগুলোর মতো উৎসুক নিবিষ্ট চোখে মুখের কশ বিস্ফারিত করে নীরবে হাসে সে।

সিধু ফিরে এসে দেখল তখনও ভূতেশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ঠোঁটের কোণে বিড়িটা গেছে নিভে। গাঁয়ের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। যেন যাবার জন্য পা বাড়িয়ে কিছু মনে পড়েছে তার। আর মেয়েটা আঁট করে খোঁপা পিটিয়ে পিটিয়ে বেঁধে মুখ টিপে টিপে হাসছে।

সিধু ফিরে এসেছে টের পেয়ে পেছন ফিরেই ভূতেশ বলল : আবার বলছি মিছে এ সব ঝঞ্ঝাট করিসনি। শ্মশানে মেয়েমানুষ নিয়ে কেউ থাকে না। এর আগে যে মেয়েটাকে এনেছিলি, দেখলি তো সেবারের মড়কে ছুঁড়ি পালিয়ে গেল। মড়া ঠ্যাঙাচ্ছিস, মড়া ঠ্যাঙা, ও-সব রমজানি কেন?

সিধু সবেমাত্র তাড়ির ভাঁড় নিয়ে প্রথম চুমুকটা দিয়েছিল। হঠাৎ সেই পুরনো স্মৃতিটা ঠাকুর উসকে দিতেই ভাঁড়টা নামিয়ে নিল সে মুখ থেকে। তার ট্যারা চোখের ভাব বোঝা দায়। মনে হল যেন জবাব দিতে গিয়ে অসহায় বোধ করছে সে। পর মুহূর্তেই তার চোখের তারা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে শুধু সাদা ক্ষেত্রটি চকচকিয়ে উঠল। গোঁফজোড়া মুচড়ে দিয়ে চিবিয়ে বলল সে, তুমি কি ঠাউর তোমার মতো হতে বলছ আমাকে? তা হবে না। একটা পালিয়েছে, এই তো ধরে নিয়ে এসেছি আরেকটাকে। কটা পালাবে। যত পালাবে, তত আনব।

হ্যাঁ, তোর জন্য মেয়েমানুষ হত্যে দিয়ে পড়ে আছে।

ঠাউর, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।

মেলা বকিসনি। ভাত তোর ঘরে হাঁড়ি ভরতি, না? বলে, তাড়ির দাম জোগাতে পারিসনে, ভাত ছড়িয়ে কাক ডাকবি।

কথাটা নির্মম সত্য এবং তার নিয়ে আসা মেয়েমানুষের সামনেই ভূতেশ ব্যঙ্গ করে সে কথা বলে তার বুকে অসহ্য জ্বলুনি ধরিয়ে দিল। কয়েক ঢোক তাড়ি গিলে সে হঠাৎ বলল : বউ নিয়ে তো কখনও ঘর করলে না ঠাউর, এ সবের আদর তুম নহি সমঝেগা।

চকিতে ভূতেশ ফিরে দাঁড়াল। ভাঁটার মতো জ্বলে উঠল তার কটা চোখ। পোড়া কাঠের ধারে ধারে যেন লুকানো অঙ্গার আচমকা হাওয়ায় গনগনে হয়ে দেখা দিল। বলল, বউ নিয়ে আমি ঘর করিনি, তুই করেছিস, না? ব্লাডি ডোম।

সিধুর গলা একটু ঠাণ্ডা হয়ে এল। তা বেলাডি ফেলাডি য্যাতই বল, ওকে কি ঘর করা বলে? এমন অপসরীর মতো বউ, কন্দর্পকান্তি ছেলে, তুমি ত্যাগ দিয়ে রাখলে। পান তোমার অমন পাষাণ বলেই না আমাকেও তাই বলছ।

আমি পাষাণ, আর তোরা সব কাদার মতো নরম। ভূতেশ তার লম্বা লম্বা দাঁত যেন ভেংচে উঠল। পোড়া বিড়িটা ধরাল আবার।

বটগাছের ঝুপসি ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে নামে অন্ধকার। পাখা ঝাপটার শব্দ শোনা যায় শকুনের। চিতার কাঠ পোড়ার চড়বড় শব্দে মনে হয় পুঁটকে ফটাস ফাটছে। ওদিকের খেয়াঘাটের নৌকা বুঝি ভিড়াল। এলোমেলো গলার স্বর শোনা যায় দু একটা। অনেক অদৃশ্য মানুষের নিশ্বাসের মতো হাওয়ায় সরসরিয়ে ওঠে বটপাতা।

মেয়েটা একটা লম্ফ জ্বালিয়ে ভূতেশ-সিধুর মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে গেল। গায়ে তার একটা ভাল দামি জামা এ পরিবেশের মধ্যে যেন কাদায় আধ-ঢাকা সোনার চকচকানি। শাড়িটাও নিতান্ত অল্পদামি নয়, আর তার যৌবনভরা বলিষ্ঠ শরীরে আনাড়িভাবে পরানো শাড়িতে তাকে মহাভৈরবী নয়, ইন্দ্রাণীর রূপ দিয়েছে। মৃতদের দৌলতে অমন দু একখানা জামা আর শাড়ি সিধু ডোমের বেড়ায় মাকড়শার ঝুলের মধ্যে গোঁজা আছে। মেয়েটির কালো কালো টানা চোখে রহস্য বঙ্কিম হাসি লেগেই আছে। শুধু মুখে কোনও কথা নেই।

বিড়িটা ফেলে দিয়ে হঠাৎ ভূপেশ বলল, এক পাত্তর দে দিনি তোর ওই ভাঁড়ের মাল।

শান্ত আর গম্ভীর গলায় বলতে বলতে সে বসল। সিধুর কাছে এ নতুন নয়। সেজন্য একটা আলাদা ছোট হাঁড়ি বাড়িয়ে দিল ঠাকুরের দিকে। নিজের এঁটো সে কখনও দেয় না তাকে। কিন্তু ঠাকুর এমন তাড়ির ভাঁড় নিয়ে বসে খুব ক্কচিৎ, যখন এ দুনিয়ার উপর বিরক্তির তার সীমা থাকে না। নেশার ঘোরে সারা দুনিয়ার, বিশেষ করে মেয়েমানুষের, পিণ্ডি শ্রাদ্ধ করার জন্য প্রাণ তার জ্বলতে থাকে।

পাত্রটি প্রায় নিঃশেষ করার পর ভূতেশের গম্ভীর আর বিদ্রূপ করা গলা শোনা যায়।

অপসরীর মতো বউ আর কন্দর্পের মতো ছেলে আমি ত্যাগ দিয়েছি, আমি পাষাণ!..তুই ব্যাটা কানা, আমার দিকে একবার তাকিয়ে দ্যাখ দিনি?

ব্যাপারটা না বুঝে সিধু তার ড্যাবা ট্যারা চোখ তুলে ধরল ভূতেশের দিকে। মেয়েটিও তাকাল। ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু তার ঝরব ঝরব করছে।

চোখের কোণ কুঁচকে ভূতেশ বলল, আমার কখনও অপসরীর মতো বউ হয়, না, কন্দর্পের মতো ছেলে হতে পারে—অ্যাঁ? বিয়ের রাতে তোদের অপসরী বউ ভয় পেয়ে বলেছিল, মা গো, যেন পোড়া কাঠ! আমি হলাম পোড়া কাঠ। আমার সঙ্গে কেউ ঘর করতে পারে? কিন্তু তখনও নিজের মুখটা ভাল করে কোনওদিন বোধ হয় দেখিনি, তাই রাগে ঘেন্নায় মাথায় রক্ত চনচনিয়ে উঠল। ফুলশয্যের রাতে পায়ের থেকে জুতো খুলে বেধড়ক ঠ্যাঙালাম নতুন বউকে। আহা, দুধে আলতার সে রং, আমার বুক জ্বালানো সে হাসি ফেটে বেরুল রক্ত আর চোখের জল। পরদিন শ্বশুর লোকজন নিয়ে এসে মেয়ে নিয়ে চলে গেল। একে হাভাতে বামুন ঘরের আকাট ছেলে, তায় এই কুৎসিত চেহারা আর নামটাও আমার কী চমৎকার বল দিনি? কিন্তু ঘরের লোক অবধি বললে দোষ আমারই। মাস কয়েক পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ডাক এল, জামায়ের ডাক, বুঝলি? গেলাম। অপ্সরী বউয়ের বোন সব উর্বশী শালীরা পালিয়ে গেল আমাকে দেখে। শাশুড়ি এল না দেখা করতে। বউ এল, তার কার্তিকের মতো সুন্দর জামাইবাবুর গা ঘেঁষে ভয়ে ভয়ে। ভায়রাভায়া আমার সঙ্গে কথা বলল না। রাতে শুতে গেলাম। মনের কথা আর তোকে বলব কী, সে জীবনে একবারই হয়েছিল সে অবস্থা। কিন্তু সারা রাতে বউ এল না। পরদিন দেখলাম, বউ তার জামাইবাবুর সঙ্গে হেসে জমিয়ে কথা বলছে। আবার রাত হল, শুতে গেলাম। অনেক রাত, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ চুড়ির শব্দে জেগে দেখি, অন্ধকার। পাশে হাতিয়ে দেখলাম বিছানা ফাঁকা। উঠে বারান্দার জানালার কাছে গিয়ে দেখি তোদের অপ্সরী বউ ভগ্নিপতির বুকে মুখ গুঁজে বলছে, ওই রাক্ষসটার কাছে যদি আমাকে তোমরা পাঠাও, গলায় দড়ি দেব আমি।

বলতে বলতে ক্ষিপ্ত চিতাবাঘের মতো জ্বলে উঠল ভূতেশের কটা চোখ, কান দুটো নড়ে উঠল মাথার শিরে টান পড়ে, অশ্বনাসারন্ধ্র উঠল ফুলে ফুলে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, যদি সত্যই রাক্ষস হতুম তা হলে ঘাড় মটকে ওর রক্ত খেতুম আমি, মাইরি। মাইরি বলছি, রাক্ষস হলে এই মেয়েমানুষগুলোকে–

বাকরুদ্ধ হল তার চালার দরজায় ঠায় তার দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার উপর চোখ পড়ে। ভয়ে বিস্ময়ে বেদনায় সে কালো চোখ বিচিত্র হয়ে উঠেছে। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ভূতেশ আচমকা তাড়িশুন্য হাঁড়িটা বটতলায় ছুড়ে দিয়ে ছাই গাদায় গিয়ে দাঁড়াল গাঁয়ের দিকে মুখ করে।

সিধুর ট্যারা চোখের ভাব বোঝা দায়। সে চোখে বিস্ময় না বেদনা, বোঝা গেল না। সে আস্তে আস্তে উঠে ভূতেশের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

শ্মশানের বটতলার আলো-আঁধারিতে মানুষ চেনা যায় না, মনে হয় দুটো কালো কালো প্রেতমূর্তি চিতা ঝাড়ানো ছাইগাদায় দাঁড়িয়ে গ্রামের দিকে তাকিয়ে মতলব ভাঁজছে। যেন প্রতীক্ষা করছে নতুন শব আসবার। তাদের পাশে এসে কুকুরগুলোও জুলজুলে চোখে তাকিয়ে থাকে গ্রামের দিকে। পাশ দিয়ে খেয়া ঘাটের পথ। যাত্রীরা সে মূর্তি দেখে ভয়ে পেছিয়ে যায়। বলাবলি করে, শালা ভূত দুটো এবার কাকে শ্মশানে টানবে তাই দেখছে।

হঠাৎ ভূতেশ বলল, কীরে, লোহার না ইটের মড়া পুড়ছে যে এখনও শেষ হল না?

সে কথা বোধ হয় ভাবছিল না সিধু। আচমকা একটা নিশ্বাস ফেলে চিতার কাছে চলে গেল। যাওয়ার সময় নীচের হাঁড়িটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে যাকে বলে, নে, দু চুমুক দিয়ে নে।

মেয়েটা তাকিয়ে দেখল কিন্তু চুমুক দিল না।

মাটিতে পোঁতা একটা শিশুর তাজা মৃতদেহ মুখে নিয়ে একটা শেয়াল গঙ্গার ধারে চলে যাচ্ছিল। কুকুরগুলোর নজরে পড়তেই অন্ধকারে হাওয়ার বেগে ছুটে গেল সেদিকে।

এক গাদা থুতু ফেলে কটূক্তি করে উঠল ভূতেশ, ভাল করে পুঁতেও দেয়নি। খা শালারা পেট ভরে।

মড়া পোড়ানো শেষ হল। ভূতেশ এগিয়ে এল সামনে। মড়া-বওয়া দলের একজন ভূতেশের হাতে একটা টাকা দিল।

এই দিলেন? রুষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল ভূতেশ।

লোকটা বলল, ওই নিয়ে নিন দাদা, আর বেশি নেই। বলে সিধুর দিকে একটা আধুলি বাড়িয়ে দিল।

সিধুর ট্যারা চোখে নির্মম শ্লেষ। বলল, ওই পেকাণ্ড মড়াটা পুড়োতে মাত্তর আট আনা? বারো আনার তো বাবু তাড়িই খরচা হয়ে গেল।

আমরা কি তোমার তাড়ির খরচা জোগাতে এসেছি? লোকটা বলল।

সিধু হাত উলটে বলল, তা ছাড়া আর খাই কী বাবু? ও পয়সা আপনি মায়ের মন্দিরে দিয়ে দেনগে, জোর তো কিছু নেই। মনে মনে বলল, মড়ার গায়ের জামাটা দিলেও না হয় কথা ছিল।

লোকগুলো এক বিচিত্র ভয়-ঘেন্না মেশানো চোখে শ্মশানের এ মানুষ দুটোকে একবার দেখে একটা টাকা ছুড়ে দিল সিধুর দিকে।

সিধু টাকাটা উঠিয়ে বলল, জন্মালে ধাইমাগী আর মলে এ ডোম বেটা, এ দু-হাত ছাড়া তো চলে না বাবু।

বলে সে চিতা সাফ করতে লেগে গেল। চিৎকার করে চালার দিকে মুখ করে ডাকল, আরে হই, কী নাম তোর, এদিকে আয় মাগী।

মেয়েটা এগিয়ে এল গাছকোমর বেঁধে। শ্মশানের মাঝে এক বেখাপ্পা জীব, গাছকোমর বেঁধে শাড়ির রেখায় রেখায় যার উছলানো যৌবন চলতে ফিরতে গায়ে ঝাপটা দেয়।

মুখ টিপে কটা চোখে খটাস দৃষ্টি নিয়ে ভূতেশ দাঁড়িয়ে রইল।

ওদের কাজ কর্ম সারা হলে সিধু এসে বলল, দেও দিনি ঠাউর বিড়ি একটা এবার।

কেন, তাড়িতে হল না?

সিধুর তাড়িমত্ত লালচোখ হাসিতে বুজে এল। তোমার অমন বাবার পেসাদ পোরা বিড়ি! দুটো টান দিলে শরীলের জাম একটু ছাড়ত।

অর্থাৎ ভূতেশের বিড়ির মধ্যে শুখা তামাক নেই, আছে গাঁজা ভরা। সিধু তাকে বাবার পেসাদই বলে।

ভূতেশ মুখ ভেংচে বলল, মাইরি আর কী!

তারপর কী মনে করে একটা বিড়ি ছুড়ে দিল সিধুর দিকে। সিধু বিড়িটা মেয়েটার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ছাইগাদা থেকে ধরিয়ে নিয়ে আয় তো?

মেয়েটা ভ্রূ টেনে ঠোঁট টিপে হেসে বলল, মাগো! ওর মধ্যে গাঁজা পোরা রয়েছে যে?

তা নয় তো কী, বিষ রয়েছে? সিধু বলল ট্যারা চোখ বাঁকিয়ে, বিড়ি গাঁজা ফুঁকতে পারবি নে, পারবি নে তাড়ি টানতে, তবে কি পোড়া মড়া খেয়ে থাকবি?

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। অমনি ভূতেশ মুখটা বিকৃত করে ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, তা হলে মেয়েমানুষ নিয়ে র‍্যালা করবি তুই এখানে?

কী একটা জবাব দিতে গিয়ে হঠাৎ থেমে সামনে এসে সিধু নেশামত্ত চোখ দুটো যতটা সম্ভব বড় করে জিজ্ঞেস করল, তা হলে ঠাউর নোকে যে বলে সে কন্দর্পকান্তি ছেলেটা তোমারই?

তোমার মাথা স্টুপিড। ধমকে উঠল ভূতেশ। মেয়েটা তখন জ্বলন্ত অঙ্গারের গায়ে বিড়িটা ঠেকিয়ে ফুঁ দিচ্ছে। সেদিকে একবার দেখে ভূতেশ ফিরে বলল, ব্যাটাচ্ছেলের শিক্ষা হয়নি। দাঁড়া আসুক ফাগুন চৈত্, লাগুক মড়কটা কে ঠেকায় তোর মেয়েমানুষকে একবার দেখব।

মড়ক লাগবে এও যেমন তার কাছে নিশ্চিত, মেয়েটাও পালাবে সেটাও তেমনি নির্ভুল।

সামনে শহরের ধারে জেলেপাড়াতেই হাফগেরস্ত শৈলী জেলেনির বাড়িতে তার ঘর। পথটুকু এক লাফে পেরুতে পারলেই যেন ভাল হত, এত তাড়াতাড়ি লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুলো ভূতেশ। মনটা তার কিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে, সিধুর উপর রাগ না নিজের উপর বিতৃষ্ণা, তা সে নিজেই বুঝল না।

খানিকটা এগুতেই বুড়ো হরেন কৈবর্তের একঘেয়ে কাশির শব্দ তার কানে এল। শৈলীর ভাসুর। কাশে বুড়ো সারা রাতই। মনে হতেই ভূতেশ খিঁচিয়ে উঠল, শালা বুড়ো মলেও দুটো পয়সা আসত পকেটে।

আর বস্তির ভিতরে যে সব মেয়েপুরুষেরা ঝগড়া লাগিয়েছে তাদের মৃত্যুতে অতগুলো পয়সা পাওয়া দুরাশা ভেবে বোধ হয় বলল, কবে এ আপদগুলোর নাম উঠবে খাতায়, কে জানে? অর্থাৎ তার মৃত্যু রেজিস্টার খাতায়।

কে একজন চেঁচিয়ে উঠল ভূতেশকে লক্ষ করে, কোত্থেকে খুড়ো?

দক্ষিণ দোর থেকে। দেখতে দেখতে বাড়ির অন্ধকার গলিটাতে ঢুকে পড়ল সে।

দিন যায়। ভূতেশ সেই সকাল থেকে দুপুর অবধি ঝাড়ুদার মেথরের পেছনে পেছনে ছুটে বেড়ায়। কোথাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো গালাগাল শোনে কিংবা তাকে মধ্যস্থ করেই কেউ হয়তো মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, কমিশনারের আদ্যশ্রাদ্ধ করে। কেন না, সে মিউনিসিপ্যালিটির লোক তো। আবার এ-সব লোকেরাই যখন শ্মশানে শব নিয়ে যায় তখন শত পরিচিত হলেও ভূতেশ তার কটা চোখ কুঁচকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, নাম কী? বয়স কত? বাপের নাম ও ঠিকানা? যেন এখানকার জমিদারিটা তারই। এদিক ওদিক হলে রেহাই নেই।

শীতকাল। শ্মশানের বটগাছটার পাতা ঝরে যায়, ন্যাড়া হয়ে যায় একেবারে। বেশির ভাগ সময় শ্মশান ফাঁকাই থাকে এখন। এ সময়টা মানুষ মরে একটু কম। তবে এটা চটকল শহর, মানুষে ঠাসাঠাসি। গড়ে অন্যান্য জায়গা থেকে অবশ্য মৃতের হারটা এখানে বেশিই।

তবু ভূতেশকে আজকাল সিধুর বটতলাতেই বেশি দেখা যায়। হ্যাঁ, তার বদ্ধজমাট প্রাণের কোঠায় যেন হাওয়া লেগেছে। সিধু খুব আড়ালে গিয়ে মাথা নাড়ে আর মনে মনে বলে, হায় রে পোড়া কপাল!

কিন্তু এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ভূতেশ আর সিধুতে। যেন একটা নূতন সংসার গড়েছে তারা এখানে। হিংসা দ্বেষ তো দূরের কথা, তাদের ফাঁকা জীবন যেন পুষ্ট হয়ে উঠেছে। ভূতেশ শুধু অবাক নয়, তার সারা গায়ের মধ্যে এক অপূর্ব শিহরন জেগে ওঠে থেকে থেকে আর নিজের ছাই বর্ণ ধূসর রুক্ষ শরীরটাকে দেখে আঁতিপাতি করে। প্রথম দিনের সে কথা। একে গাঁজাভরা বিড়ি, তার উপরে সিধু আর সে ভাঁড়ের পর ভাঁড় শেষ করে শুধু বুঁদ নয়, একেবারে অচেতন হয়ে পড়েছিল। আর ওই মেয়ে গঙ্গার জলের ছিটা দিয়েছিল চোখে মুখে, আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দু হাতে সাপটে ধরে টেনে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ছাইগাদা থেকে। অচেতন শরীরে চেতন ফিরেই আসেনি, বিড়বিড় করে বার বার বলেছিল, আমি যে পোড়া কাঠ, ছেড়ে দাও, ফেলে দাও।

সে মেয়ে হেসেছিল। সে হাসির নাম জানে না ভূতেশ। মনে হয়েছিল মাতাল। জীবনে এ মাতলামির স্বাদ যে জানত না।

তবু ভূতেশ মাঝে মাঝে বলে ওঠে, শ্মশানের মধ্যে মেয়েমানুষ নিয়ে ধ্যালান ছাড় বাপু। ও তো কাটল বলে।

তারপর তার কটা চোখ দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে সিধুকে, ওকেই জিজ্ঞেস করে দ্যাখ না।

মেয়েটা ভ্রূ বাঁকিয়ে নীরবে হাসে। কখনও বা কপট গাম্ভীর্যে বলে, তা বাপু, না মলে কে আসে তোমাদের এখানে?

সিধু হাসে। ভূতেশের কটা চোখের কোঁচকানিতে অবিশ্বাস্য হাসি ওঠে চকচকিয়ে। তারপর তারা তিনজনে বসে অদ্ভুত সব গল্প জুড়ে দেয়। কোনও দিন মড়া পোড়ে, কোনও দিন পোড়ে না। শ্মশানের কুকুরগুলো তাদের ঘিরে থাকে শুয়ে বসে।

মেয়েটি কখনও তাদের চা করে দেয়, বিড়ি ধরিয়ে দেয়, মাটির গেলাসে ঢেলে দেয় তাড়ি। নিজেও কোনও কোনও সময় গেলে দু এক ঢোক। তারপর প্রাণের আবেগে তিনজনেই তারা খানিকটা সতেজ হয়ে ওঠে। ভূতেশ বলে, এক এক সময় মনে হয়, শালা দুনিয়াটাকেই খাতায় তুলে ছেড়ে দিই। অর্থাৎ তার মৃত্যু রেজিস্ট্রির খাতায়।

সিধু বলে, খাতায় তুলে কী হবে ঠাউর, দিতে হয় চিতায় তুলে দেও, কাজ হবে।

মেয়েটি বলে অভিমান করে, শ্মশানে-মশানে থেকে তোমাদের খালি এক কথা। পুড়তেই শিখেছ খালি। আমাকে পুড়ুবার জন্যও বুঝি হাঁ করে আছ তোমরা? চিতা ধুয়ে তবে গঙ্গাজলের ছিটা দেও কেন?

জবাবে তারা দুজনে চুপ করে থাকে। খানিকক্ষণ পরে ভূতেশ বলে, শুনলি কথা? দেখবি, ও ঠিক কেটে পড়বে।

কোনও কোনওদিন সন্ধ্যার পরে দেখা যায় পুরনো ছাইয়ের ঢিপিটায় ভূতেশ সিধু অস্পষ্ট ছায়া নিয়ে দুটো প্রেতের মতো গাঁয়ের দিকে কিংবা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকে। আজকাল তাদের দুই মূর্তির মাঝখানে মাঝে মাঝে আর একটা মূর্তি দেখা যায়। নারীমূর্তি। অন্ধকারে সে দেহের রেখায় রেখায় কী যে প্রাণ-ভোলানো বাহার! দুই পুরুষের দিকে বারেক তাকিয়ে সে মেয়ে তাদের পায়ের কাছে বসে গুনগুনিয়ে গান গায় :

মা গো, জমমো দিলি এ সমসারে মেয়ে করে,
ত্যাখন তো বললি না গো, আবাগী আমি অবলা;
আজ য্যাতই কেন বাঁদিস্ মা মা, (তবু) পান যারে চায়,
তার গলাতে পরাব আমি মালা।

নয় তো সাপের মতো দুলে দুলে মোহিনী হেসে গায় :

মুখের ছায়া জলের তলে, মনের ছায়া দেখি না-হায়—
আমার মনের ছায়া তোমার চকেতে,
হায়, পোড়া মন এত ঢাকি এত চাপি সব্বো অঙ্গ উদাস করে
তবু ঘোমটা ঢাকা পড়ে না মোর মনেতে।

গঙ্গার বুক থেকে হাওয়া উঠে সে গান ভেসে যায় পথ পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে জেলে পাড়ায়। হাওয়ার গায়ে সে সুর শুনে গাঁয়ের লোকেরা বলে, শ্মশানে বটগাছে শকুনবাচ্ছা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।

সিধু হয় তো তাড়ি আনার নাম করে চলে যায়। অনেকক্ষণ ধরে আর আসে না। তারা দুজন এসে হয় তো দেখে, সিধু ঘরে না হয় বাঁধানো ঘাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কোনও সময় ভূতেশ হয় তো খুব রেগে এসে মেয়েটির কাছেই সিধুর নামে অভিযোগ করে, অ্যাই, একেই বলে মেয়েমানুষ নিয়ে শ্মশানে র‍্যালা চলে না। বললাম রাসকেল, স্টুপিড ড্যাম ডোম ব্যাটাকে যে দুটো গরু মরে গেছে আকালীর গোয়ালে। ভাগাড়ে কেন যাবে। তুই নিয়ে এসে ছাড়া, চামড়াটার দাম পাবি, কথার কথা বলছি– শকুনিগুলোরও পেট ভরে। পড়ে তো থাকবে হাড়টা। তাও দেখি, কতকগুলো ছোঁড়া আবার হাড় কুড়িয়ে বেড়ায়, কোথায় কোন্ ফ্যাক্টরিতে নাকি দু পয়সা সের বিক্রি করে। লোকসানটা কোথায়, বলতে পারো?

মেয়েটি হেসে জবাব দেয়, এসব তোমরাই ভাল বোঝো ঠাকুরবাবু। চেলা তোমার সারাদিন তো তাড়ি খেয়েই পড়ে আছে। শ্মশান তো আগলাচ্ছি আমি আর ওই কুকুরগুলো।

কখনও কখনও সিধুর মনে হয়, আর যাই হোক বামুনের ছেলে হয়ে ঠাকুর তা বলে ডোমের ছোঁয়াও খাবে। কিন্তু বলতে ভরসা পায় না, তাই কায়দা করে বলে, জানলে ঠাউর, আজ তোমার ইঞ্জিন সাহেবকে দেখলাম।

ইঞ্জিন সাহেবটা কে?

তোমার দাদা গো, বড় হালদার।

ভূতেশ বলে, ব্যাটাচ্ছেলে, ইঞ্জিনসাহেব বলছিস কী রে! বল এঞ্জিনিয়ার।

ওই হল। একটু থেমে ট্যারা চোখে পিটপিট করে বলে, দাদা তোমার অতবড় মানুষ, আর তুমি বামুনের ছেলে হয়ে

অনেক বড় রে, অনেক বড়। ভূতেশ বলে ওঠে, মলে পরে এ শর্মার কাছে এসেই আমার লায়েক ভাইপোকে তার বাপ-ঠাকুরদার নাম বলতে হবে।

কী বললে?

ভূতেশ বলে, তবে হ্যাঁ, কথায় বলে কেলে বামুন, কটা শুদ্দুর, বেঁটে মুসলমান—এ তিন ঘুঘুই সমান। আমি তো পোড়া কাঠ।

কিন্তু সিধু আগের কথাটার রেশ টেনেই বলে, কী বললে? তোমার ভাইপোকে তার বাপ ঠাকুরদার নাম তোমাকে বলতে হবে?

হবে বই কী।

ভাইপোর ঠাকুরদা মানে তোমার বাপ তো?

ভূতেশ ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, হলই বা। বাপ বলে তো খাতির নেই। আমি তো ডেথ মানে মৃত্যু রেজিস্ট্রার।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সিধু তার ট্যারা চোখ তুলে বলে, আচ্ছা বলো তো ঠাউর, তুমি মরে গেলে ওই খাতায় তোমার নামটা লিখবে কে?

জবাব দিতে গিয়ে থমকে থাকে কিছুক্ষণ ভূতেশ সিধুর চোখের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ মুখে কোনও কথা জোগায় না তার। তারপর লোমওঠা ভ্রূ তুলে বলে, আর তুই মরে গেলে তোকে পোড়াবে কে, বল দিনি?

সিধুর ট্যারা চোখও হঠাৎ অপ্রতিভ হয়ে পিটপিট করতে থাকে। এক মুহূর্ত দুজনেই তারা তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। তারপরেই মেয়েটি সুদ্ধ তিনজনেই তারা শ্মশান চমকে হাসিতে ফেটে পড়ে।

কিন্তু মেয়েটি আচমকা হাসি থামিয়ে বলে ওঠে ভ্রূ বেঁকিয়ে তোমাদের খালি এক কথা। মরা মরা আর মরা।

সিধু বলে, তা মরা নিয়েই তো আমাদের কারবার। জ্যান্ত পাব কোত্থেকে?

এক বিচিত্র অভিমানক্ষুব্ধ গলায় মেয়েটি বলে, দেখতে পাও না বুঝি জ্যান্তটাকে?

বলে চকিতে সিধু আর ভূতেশের দিকে চোখের দৃষ্টিতে মর্মঘাতী নালিশ জানিয়ে চলে যায়।

সিধু বলে, অ্যাই সেরেছে। কী হল রে?

ভূতেশ বলে বিড়বিড় করে, শালা! শ্মশানে মেয়েমানুষ। দেখিস ও ঠিক কেটে পড়বে।

শীত যায়, বসন্ত আসে। বোল ধরে আম গাছে। ন্যাড়া বটগাছটায় গজায় পাতা। ফাল্গুনের হাওয়ায় উদাস করে প্রাণ, গুটি দেখা দেয় গায়ে গায়ে– বসন্তের গুটি।

ভূতেশ রিপোর্ট দেয় পাড়াঘরের রোগের, আবার শ্মশানে এসে খাতায় মৃতের নাম পরিচয় লিপিবদ্ধ করে। ঝিম ধরা শ্মশান যেন আস্তে আস্তে আড়ামোড়া ভাঙে। কুকুরগুলোর ঝিমুনি আরও বাড়ে, নেশায় যেন বুঁদ। কেঁদো হয় আরও বেশি। বটের শক্ত ডালে শকুনি গৃধিনী চঞ্চু ঘষে ঘষে করে শক্ত, সাপের মতো চোখ নিয়ে গ্রামজনপদের দিকে তাকিয়ে খাবার খোঁজে।

কিন্তু বসন্তের ফাঁড়াটা অল্পেস্বল্পে কেটে গেলেও চৈত্রের শেষে ভূতেশের কথাকে বেদবাক্যি করেই যেন কলেরার মড়ক নেমে এল সারা চাকলা জুড়ে। ইস্! কী দুরন্ত তার বিস্তৃতির বেগ। রোগ ছড়িয়ে পড়ল যেন হাওয়ার দমকে দমকে। আর এ ফাঁকা গ্রাম নয়, শিল্পাঞ্চল। চটকল শহর। সারীবীজের মতো ঘন বস্তি ও বাড়ির ভিড়, তার চেয়েও বেশি ভিড় মানুষের, সরু সুড়ঙ্গের মধ্যে অগুনতি পিঁপড়ের মতো।

ওলাইচণ্ডী রক্ষেকালীর পুজো শুরু হল, শুরু হল পাড়ায় পাড়ায় অষ্টমপ্রহর নামকীৰ্ত্তন। হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে সারা এলাকার অল্প কটা ডাক্তার, কেঁপে উঠছে পকেটও। রোজগারের মরশুম এটা।

ভূতেশ তার খাতায় নতুন পাতা জোড়ে, পেন্সিল নিয়ে আসে নতুন। সময় নেই, সময় নেই, কেবলি মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু। শব শব শব।

চিৎকার, আর্তনাদ, কান্না। কান্না ভয়ের, আতঙ্কের, নিজের প্রাণের।

ভূতেশ বলল সিধুকে তার কটা খটাস্ চোখ তুলে, শালা শুরু হয়েছে, দে তো তোর শতরঞ্চেটা চার পাট করে পেতে, একটু জমিয়ে বসি।

সিধুও ক্লান্ত। চিতার আগুনের তাতে তাতে কালো হয়ে উঠছে সে। বেড়ে যাচ্ছে তাড়ি খাওয়া।

মড়ার যেন পাহাড় জমে উঠছে শ্মশানে।

সিধু মাঝে মাঝে খিস্তি খেউড় করে উঠছে, কে পোড়াবে অত মড়া? টান মেরে ফেলে দাও গঙ্গায়, ভাল গতি হবে। তারপর মনে মনে ফিসফিস্ করছে, শালা কাঠ কোথা? মানুষ দে মানুষ পোড়াতে হবে।

বিড়িতে গাঁজা পোরার সময় নেই ভূতেশের। হাত চলেছে চলেইছে। নির্লিপ্ত নির্বিকার চিত্রগুপ্ত। শোকে কেউ ফুঁপিয়ে উঠল, কেঁদে উঠল খ্যাঁক করে ধমকে ওঠে সে, ও-সব ন্যাকামো রাখো, নাম বলো। বাপের নাম? বয়স? রোগ? একজন যায়, আরেকজন, আরও আরও। এক কথা, এক প্রশ্ন, নাম? বাপের নাম? বয়স? রোগ? বলে যাও, বলে যাও।

কুকুরগুলো মারলেও নড়ে না। শেয়ালগুলো দিনের বেলাতেই এ-দিক ওদিক করে বেরিয়ে আসছে ঝোপ ঝাড় থেকে। গঙ্গার ধারে ধারে শকুনের ভিড়। হাওয়ায় ভাসছে যেন কোনও অশরীরী প্রেতিনীর একটানা কান্নার ঢেউ।

এখন পোড়ানো মানে আধপোড়ানো, আধপোড়ানো মানে চিতায় একবার শোয়ানো, কিংবা একই চিতায় কয়েকটা শব। কাঠ নেই, ছোট ছোট চিতা। সিধু মট মট করে মৃতের হাত ভেঙে পা ভেঙে কোনও রকমে ঢুকিয়ে দিচ্ছে চিতার মধ্যে। কেউ বারণ করলে চেঁচিয়ে উঠছে, তবে পুড়োও এসে তুমি। দেখি, তোমার তাগদ। দেবে তো আট আনা কি চার আনা?

হ্যাঁ, ক্রমাগত রেট কমে আসছে। কী ভূতেশের, কী সিধুর। মেয়েটি মাঝে মাঝে জোগান দিচ্ছে ভূতেশ সিধুর চা। একে তাড়ি, ওকে পুরে দিচ্ছে বিড়িতে গাঁজা। কিন্তু বাকরুদ্ধ হয়েছে মেয়েটার, দম আটকে আসছে বুকের। আর তো সে পারে না! মড়া মড়া মড়া, কেবলি মড়া! আর ওই ভূতেশ ঠাকুর আর সিধু। সেই হাসি মস্করাই বুঝি সত্যি যে, ওরা চিত্রগুপ্ত আর যম। শুধু ওরাই জীবিত, নির্লিপ্ত, নির্বিকার।

কখনও ভূতেশ কখনও সিধুর চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে। শ্মশানের ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন তার মুখ। বাঁধা নেই বিনুনি, আঁচল ঘুরিয়ে লতিয়ে দেয়নি বুকে সাপের মতো।

ভূতেশ ও সিধু চোখাচোখি করে আর তাকায় মেয়েটার দিকে। তারপর ভূতেশ বলে, দেখেছি একবার ওর চোখমুখ! ওরে, কেলেবামুন পোড়া কাঠ হলেও চিত্রগুপ্তের বেদবাক্যি। ও কাটল বলে।

সিধুর গলা জড়িয়ে আসে। ঢুলুঢুলু ট্যারা চোখে তাকিয়ে বলে, এটা কাটবে, আবার আসবে।

ড্যাম ডোম কোথাকার! ঘোড়ার মতো লম্বা নাকের ভিতর থেকে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে শব্দ করে ভূতেশ। হঠাৎ গলার স্বরটা তার মোটা ও চাপা হয়ে আসে, আবার যদি এ-সব ফিকির করিস তবে তোর নামই আমি খাতায় উঠিয়ে ছাড়ব।

অসীম ক্লান্তির সঙ্গে সিধু বলে, তা ঠাউর, দুনিয়াটা তো পেরায় খাতায় তুলে ফেলে।

যা বলেছি সিধে। চিত্রগুপ্তের খাতাটা বড় শস্তা হয়ে গেছে। বলে বিড়ি ধরায় সে।

এক একটা দিন কাটে না, যেন মাসে কাটে। কিংবা বুঝি বছর।

হঠাৎ আকাশে মেঘ করে আসে, গুম গুম শব্দ ওঠে মেঘের ডাকের।

ঘরে ঘরে ডাক পড়ে, আয় আয় আয়, আয় বৃষ্টি আয়, নেমে আয়, নেমে আয়।

অপলক ট্যারা চোখে চালা থেকে সিধু এসে দাঁড়াল ভূতেশের শতরঞ্চির সামনে। ভূতেশ তাকিয়েছিল আকাশের দিকে। একমাত্র সে-ই জানে, প্রাণভরে বৃষ্টিকে সেও ডাকছিল কি না, নাকি ওই শকুনিগুলোর মতো ভিজে ওঠা। ঠাণ্ডা শ্যামল পৃথিবীতে অনাহারের গন্ধ শুঁকছিল, আকাশের দিকে মুখ করে।

সিধু বলল, ঠাউর কেটে পড়েছে ছুঁড়ি।

অ্যাঁ? চমকে ফিরল ভূতেশ। যেন কথাটা ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। পরমুহূর্তেই রেজেষ্ট্রি খাতাটার দিকে চোখ নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল, শালা, বেদবাক্যি, বেদবাক্যি!

গুরু গুরু গর্জনে প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশ। তবু একটুও হাওয়া নেই, বদ্ধ গুমোট।

সিধু বলল ট্যারা চোখ ছোট করে, শ্মশানেও রেহাই নেই, মেয়েটা মরে গেছে গো ঠাকুর, ওলাওঠায়। বেদবাক্যি বটে তোমার।

মরে গেছে? ওলাওঠায়? ভূতেশের কটা খটাস্ চোখের চারপাশে মাকড়সার জালের মতো হাজার রেখা ফুটে উঠল। চালার দরজাটার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলতে লাগল সে, এ কখনও আমার বেদবাক্যি নয়, কখনও নয়। সিধু মেয়েটার শব এনে সামনে শুইয়ে দিল।

মরা মেয়ের এলানো চুল, নোংরা জামা-কাপড়। আর সারা মুখখানি এক অপূর্ব শান্ত সুষমায় ভরা। আধবোজা চোখের পাতা দুটো খুলে দিলে বুঝি এখুনি সেই বিচিত্র লজ্জায় হেসে উঠে বসবে, হয় তো গুনগুনিয়ে উঠবে, মাগো, জম্মো দিলি এ সমসারে মেয়ে করে–

ভূতেশ সিধু পরস্পর একবার চোখাচোখি করল। দুজনেই তারা বোধ হয় কিছু বলতে চায় এ মেয়েটিকে নিয়ে। কিন্তু বলল না।

তারপর গম্ভীর মুখে ঠোঁট টিপে মৃত্যু রেজিস্ট্রার কান থেকে পেন্সিল টেনে নামাল, আঙুলের ডগায় জিভের থুতু লাগিয়ে পাতা উলটে চলল। তারপর থেমে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করল, ওর নাম কী?

সিধুর ট্যারা চোখ ভাষাল না। বলল, কী জানি ঠাউর, মাগী বলেই তো ডাকতাম। তবে ওর মা ওকে ডাকত, কী বলে তোমার গে, সুলোচনা বলে।

লিখতে গিয়ে ভূতেশের পেন্সিল আটকাল, যে পেন্সিল চিত্রগুপ্ত ভূতেশের কোনওদিনই আটকায়নি। সুলোচনা!

তার হাতের পেন্সিল কেঁপে উঠল এই প্রথম। তারপর খসখস্ করে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে নামটা লিখে ভূতেশ ঠায় গঙ্গার দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, বলেই গেলি ড্যাম ডোম, সুলোচনা মানে জানিস?

সিধু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী জানি ঠাউর। অত মানে বুঝলে কি আর মড়া ঠ্যাঙাই।

ভূতেশ কয়েকবার খ্যাঁকারি দিয়ে চোখ বুজে বলল, সু-মানে সুন্দর, বুঝলি ব্যাটা? আর লোচনা মানে চোখ যার। অর্থাৎ সুন্দর চোখ যার।

সিধু বলল মুখ ফিরিয়ে, হবেও বা। তা ওর চোখ দুটো তো

আবার মেঘ ডেকে উঠল। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ কালো হয়ে উঠেছে আকাশ।

ওর বাপের নাম? পেন্সিল তুলল আবার ভূতেশ।

জানি নে ঠাউর, বলে সিধু কাঠ কোপাবার কুড়ুলটা নিল তুলে।

তবে, স্বামীর নাম?

কুড়ুলটা কাঁধে তুলে বলল সিধু, মিছিমিছি যদি লেখো, তবে আমার নামটাই লেখো।

ভূতেশের আঙুল অযথা নড়ে উঠল। চোখ বুজেই বলল, আর যদি সত্যি সত্যি লিখি?

এত ন্যাকামোও তুমি জানো ঠাউর। বলতে বলতে সিধু সরে গেল।

দুর গঙ্গার জলের দিকে চোখ মেলে তাকাল ভূতেশ তার খটাস্ দৃষ্টি দিয়ে। ঠোঁটটা বেঁকিয়ে সে বিড়বিড় করতে লাগল।

লিখব, লিখব, মিছিমিছিটাই লিখব চিত্রগুপ্তের খাতায়। কেবল—

মরা মেয়ের মুখের দিকে তাকাল সে! মনে পড়ল সেই প্রথম দিনের কথা, গঙ্গাজলের ছিটা আর পোড়াকাঠের প্রাণের মাতলামি। সুলোচনা!…ঠোঁট নড়ল তার। গলার পেশিগুলি ভিতর থেকে ঠেলে উঠল।—ফিসফিস করে উঠল সে, ভূতেশ হালদারের খাতায় সত্য নামটা লিখব।

ঘাড় গুঁজে এলোমেলোভাবে খসখস করে লিখে গেল সে। কী লিখল সে নিজেই জানে না বোধ হয়।

সিধু সব ঠিকঠাক করে চিতায় তুলে দিল মেয়েটিকে। তারপর আগুন ধরাতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে ঘরে জমানো সব জামাকাপড়গুলো এনে চিতার উপর ফেলে দিয়ে আগুন ধরাল।

আকাশে আকাশে দুরন্ত মেঘের কলরব। হাওয়া উঠেছে, মেঘ ছুটেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার। হয় তো বৃষ্টি হবে, কিংবা কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাসে।

শকুনগুলো উড়ে উড়ে গাছে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে, কুকুরগুলো জুলজুলে চোখে একবার আকাশ, একবার মাটি, একবার চিতাটার দিকে দেখছে।

ভূতেশ গিয়ে দাঁড়াল সেই বটতলার পুরনো ছাইগাদাটায়। সিধুও দাঁড়াল এসে। আজ আর মাঝখানে তাদের কেউ নেই। কেউ নেই অন্ধকারে বঙ্কিম চোখে আলো ফুটিয়ে, শরীরের রেখায় রেখায় প্রাণ-ভোলানো রূপের লহর তুলে গুন্‌গুনিয়ে ওঠবার, হায় আমার মনের ছায়া তোমার চকেতে। ….

কেবল অস্পষ্ট ছায়ার দুটো প্রেতমূর্তির মতো গাঁয়ের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল তারা।

অনেকক্ষণ পর ভূতেশের মোটা গলা শোনা গেল, জানলি সিধে, শ্মশানটা শালা সত্যি শ্মশান হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *