৫৬. ভাদ্রের নির্মেঘ দুপুরে

ভাদ্রের নির্মেঘ দুপুরে রোদের তাপ লাগে চড়চড় করে, মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু হলে কী হয়, কুলসুমের সারা শরীর ঘিরে ফুরফুরে হাওয়া চলে তার সঙ্গে সঙ্গে। মানে কুলসুম। যেদিকে যায়, তার সারা শরীরের রোমকুপে আস্তে আস্তে ঢেউ খেলায় ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া। গন্ধটা কেমন চেনা চেনা লাগে, কিন্তু কোথেকে আসছে তা আর ঠাহর করা যায় না। তাকে তাই হাঁটতে হয় অবিরাম বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস টেনে। হালকা হালকা জর্দার গন্ধ মিশে যায় কড়া তামাকের ধোঁয়ায়। তবে এগুলো সবই আসে কিন্তু বিলের আঁশটে-গন্ধ বাতাসে সওয়ার হয়ে।

হাতের বাসন মাটিতে রেখে দরজা খুলতে গেলে পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে কুলসুম চমকে উঠলো। এই চমকাবার মধ্যে তার শরীর ঘিরে পাক-দেওয়া গন্ধের উৎস খুঁজে পাবার আশাটিও ছিলো। কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে সে দেখলো, না, সেরকম কিছু নয়। ঘরে ঢুকে সে হুড়কো লাগিয়ে দিলো।

কুলসুমের দরজার বাইরে একটি মানুষকে দেখে চমকে উঠেছিলো কালাম মাঝিও। তার চমকাবার মধ্যে ছিলো আরেক ধরনের আশা, আশার চেয়েও বেশি বিস্ময় এবং সবচেয়ে বেশি ছিলো খুশি। তা হলে তহসেন আর আমতলির দারোগার সন্দেহই ঠিক?-তমিজ শালা নিয়মিত দেখা করতে আসে কুলসুমের সঙ্গে। রাতে কালাম তার নিজের বাড়িতে কুলসুমের থাকার ব্যবস্থা করায় তমিজ আসতে শুরু করেছে দিনের বেলা? শালা দিনেদুপুরে খুনের ফেরারি আসামি এসে দিব্যি ঘুরে যায় কালাম মাঝির বাড়ির বগল দিয়ে! শালার এতো বড়ো আস্পর্ধা। তমিজটাকে হাতেনাতে ধরতে পারলে গায়ে কালাম মাঝির দাপটটা ফের প্রতিষ্ঠা করা যায়। আর তহসেনের মনটাও ফেরানো যায়। তহসেন আজকাল বাড়িতে আসেই না, এই আজ জিপগাড়ি নিয়ে গোলাবাড়ি পর্যন্ত এসে ওখান থেকেই ফিরে গেলো টাউনে। গিরিরডাঙা পর্যন্ত জিপটা নিয়ে একবার ঘুরে গেলে মাঝিগুলো অন্তত কিছুদিন ঠাণ্ডা হয়ে থাকতো। কিন্তু তহসেনের সঙ্গে কথা। বলাই কালাম মাঝির পক্ষে মুশকিল। হঠাৎ করে সে হয়ে উঠেছে তার সম্মায়ের ভক্তপুত্র। এই সত্যয়ের অত্যাচার থেকে তাকে বাঁচাতে কালাম চোখের পানি মুছতে মুছতে বালক ছেলেটিকে রেখে এসেছিলো তার প্রথম পক্ষের আত্মীয়ের বাড়ি। সেখানে

দিলে তহসেন কি আজ দারাগা হতে পারে? তাই সৎমায়ের ফুসলানি শুনে সে আজকাল বাপের চুলে-দাড়িতে কলপ মাখানো নিয়ে আকারে ইঙ্গিতে যা বলে, তাতে কালাম মাঝির একেকবার ইচ্ছা করে, সমস্ত সম্পত্তি তার লিখে দেবে দ্বিতীয় পক্ষের। মেয়েদের নামে। সেই মেয়েগুলোও আবার মায়ের জন্যে পাগল। শালার ভাগ্নেবৌটাও মনে হয় মামীশাশুড়ির কুটনির কাম করে। নইলে কালাম মাঝি রাতে উঠে যতোবার বুধার ঘরের বারান্দায় যায়, দেখে বুধার বৌ দাড়িয়ে রয়েছে কুলসুমের বিছানা ঘেঁষে। টাউন থেকে পুরো এক টাকা দিয়ে কালাম মাঝি কিনে এনেছে কন্দর্পসঞ্জীবনীর একটা শিশি। কাল রাতে সেটা খুঁজে পাওয়া গেলো না। এসব তার বৌ আর বুধার বৌয়ের শয়তানি। এখন ছেলেটাকে খুশি করতে পারলে এদের আটো করা কালাম মাঝির কাছে ডালভাত। আল্লাই মওকা মিলিয়ে দিলো। তমিজটাকে ধরতে পারলে আমতলির দারোগা থেকে শুরু করে করে টাউনের ছোটো দারোগা তহসেন পর্যন্ত তার বশ থাকে।

শালা ঘাঘু ডাকাত, জেল-খাটা কয়েদি শালা দুপুরবেলা এখানে হাজির হয়েছে। মাথায় বাবরি সাজিয়ে আর ময়লা সবুজ লুঙি আর নিমা পরে। কুলসুমের দরজার পৈঠায় দাড়িয়ে ছিলো বলে কেরামত একটুখানি লম্বা হয়ে যাওয়ায় এই ঝঝ রোদে তাকে ছদ্মবেশী তমিজ বলে ঠাওরানো এমন কি ঘাঘু মানুষ কালাম মাঝির পক্ষেও খুব একটা দোষের ব্যাপার নয়। নিজের পায়ের নতুন পাম্পসুর শব্দ কালাম মাঝির সর্তকতার পরোয়া করে নি। লোকটা তাই পালিয়ে গেলো পলকের মধ্যে। কালাম মঝি বুঝলো, শালা পেছন দিয়ে ঢুকেছে কুলসুমের ঘরে। না-কি পেছনের ভাঙা কাঁঠালগাছে উত্তর দিয়ে উধাও হলো পাকুড়তলার দিকে।

দরজা ঘেঁকে আসে কুলসুমের গলা, তুমি আসিছছা কখন? ওই বাড়িত মেলা কাম লাগিছে গো। আসার ফুরসৎ পাই না। তমিজ ছাড়া আর কারো সঙ্গে কুলসুম এমন কথা। বলতে পারে? কালাম মাঝি শুনতে শুনতে এতোটাই কাপে যে নিজের খুশি কি রাগ কি উত্তেজনার কোনোটাই সে ঠিকমতো ঠাহর করতে পারে না।।

কুলসুম ঘরে ঢুকেই নিজের নিঃশ্বাসের বেগ তীব্র করে গন্ধের উৎস খুঁজছিলো মনোযোগ দিয়ে। নিঃশ্বাসের কয়েকটা টানেই সে বার করে ফেলে তমিজের বাপকে। এক মাথা বালু নিয়ে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে তার মাচা ঘেঁষে। তাকে ওখানে রেখে উঠানের চুলা থেকে ছাই আর তমিজের চাল-ধসা ঘরের এক কোণ থেকে বঁটি আর মাটির মালসা এনে বসে তার নিজের ঘরে। তমিজের বাপ যদি মাচায় বসে এই আশায় এবং সে যদি দরজা খুলে বাইরে চলে যায় এই ভয়ে কুলসুম বঁটি পেতে বসেছিলো দরজায় পিঠ দিয়ে। মটকায় চাপা দেওয়া মাটির সরা তুলে নিতেই শিঙি মাছগুলো ভয়ে কি খুশিতে ওইটুকু পানিতে নানারকম খেল দেখায়। তাদের কোলাহলে মটকা থেকে ছলকে ওঠে আঁশটে সুবাস। মটকার ওপর সরা না থাকায় ফোঁটা ফোঁটা পানির ঝাপটা লাগে। কুলসুমের চোখেমুখে ভারী আরাম!

কালাম মাঝি তার মাছ কোটা কিংবা তার লম্বাটে মুখে আঁশটে পানির ঝাপটা কিছুই দেখতে পায় না, কিন্তু তার কথা শুনতে পায় সবই। কুলসুম জবাব দেয় যেন কার কথার, না গো, ধান ভানার এখনি কী? তার বেটার টাউনের বাসাত চাউল পাঠান লাগবি? আবার তহসেনের মাও কয়, ছুঁড়ি, তুই এ্যানা সর্যা থাকিস। কও তো, হামাক স্যা থাকা লাগবি কিসক? বুড়া হামার মাথা খায়া ফালাবি?

কুলসুমের কথা তো সবই শোনা যায়, কিন্তু তমিজের গলা কোথায়?

কিন্তু কুলসুমের পরের কথাগুলো কালাম মাঝির মাথাটা এলামেলো করে দেয়, তমিজ কুটি গেছে কচ্ছো?-ভালো করা কও। মর‍্যাও তোমার কথা আবোরের লাকান থ্যাকা গেলো?–খিয়ারেত গৈছে? তোমার বেটার বাপু মাথা খারাপ। মনে নাই? তখন একেবারে চ্যাংড়া মানুষ, খালি দৌড়াচ্ছিলো খিয়ার মুখে। মনে নাই?

কালাম মাঝির বুক ঢিপঢিপ করে, ঘরের ভেতর কুলসুমের সঙ্গী কি তবে তমিজ নয়? তা হলে কে? কেরামত নয় তো? ওই শালা না খিয়ারে চাষাদের জোটের সাথে গান বাঁধতো। এখন আবার তমিজের খবর নিয়ে কুলসুমকে দেয় নাকি? কিন্তু হাটেবাজারে গলা ফাটিয়ে গান করা কেরামতের কথা এখানে শোনা যায় না কেন?

কুলসুমের পরের প্রসঙ্গটি নতুন, উদিনকা বুধাও কচ্ছিলো, তমিজ বলে কুটি গেছে। চাষাগোরে সাথে জোট বান্দিবার। খালি হুজ্জত, খালি হুজ্জত। হুজ্জতের মধ্যে থাকবার না পালে তোমার বেটার প্যাটের ভাত হজম হয় না। তা তার বৌবেটি নাই? বৌবেটিক ভাত দেওয়া লাগে না? হামি না হয় ফকিরের বেটি, বানের সাথে ভাসা আসিছি। বৌবেটি? বৌ ভাত না পালে দেখো, ঐ ঘেগি মাগী আবার কার সাথে লিকা বসে।

কালাম মাঝির কান শিরশির করে। ঘরের মধ্যে লোকটি তবে কে? একবার ভাবে। ফিরে যাই। সঙ্গে সঙ্গে সে বল সঞ্চয় করে, না তমিজের খবর জানতে হলে এক্ষুনি ঘরে ঢোকা দরকার। লোকটা যে-ই হোক তমিজের সঙ্গে তার সাট আছে। আবার কুলসুমের গলার মিহি আওয়াজ একটু মুশকিলেও ফেলে। মেয়েটির এই রিনিঝিনি বোল তার কানে ঢুকে গোটা শরীরে মোলায়েম মালিশ করে দিচ্ছে, দরজার কপাট থেকে কান সরিয়ে নেওয়া তার জন্যে বড়োই কঠিন।

কিন্তু আসামির হদিস করার কর্তব্যবোধ তাকে কুলসুমের কথার গুড়ে সেঁটে থাকতে দেয় কী করে?

নতুন পাম্পগুজোড়া আস্তে করে খুলে, হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে পেছন দিক দিয়ে তমিজের ভাঙা ঘর পেরিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো রোদে-ভাসা উঠানের ওপর। কুলসুমের ঘরের ঝাপ খোলা। পা দুটো টিপে টিপে ভেতরে ঢুকে ঘরে অনধিকার প্রবেশকারী আসামিকে কীভাবে এক ঝটকায় ফেলে তাকে জাপটে ধরবে কালাম মাঝি সেই ফন্দি আঁটে। সঙ্গে তার অস্ত্র নাই, জুতোজোড়া রেখে দিয়েছে উঠানের কোণে। ভরসা শুধু এই হাত দুটি।

ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার, কুলসুমের মুখে পড়েছে উঠানের রোদের আলো। মেয়েটা মাছ কোটে আর কথা কয় আর মাঝে মাঝে একটু ওপরে তাকিয়ে ঘরের অন্য বাসিন্দাটির কথা শোনে, ফের কথা বলে। সেই মানুষটির কী কথা শুনে কুলসুম ফের মাছ কাটায় মন দেয় আর বলে, থাকো। মাছ দিয়া ভাত খায়া যায়ো কেরামত মিয়া কয়টা কানচ মাছ দিয়া গেছে। ফের কী শুনে আফসোস করে, তুমি, তুমি মাছও খাবার পারো না? আহারে, কালাহার বিলের সিখনত থাকো, মাছ মুখোত দিবার পারো না? তুমি খাও তো! পাকুড়গাছ বলে ক্যাটা ফালাছে, মুনসি আর দেখবি কুটি থ্যাকা খাও, কেটা দেখিচ্ছে?

কালাম মাঝির শরীর কাঁপে। লোকটি তবে কে? নিজের ভয় সারাতেই সে মনে করে আমতলির দারোগা আর তহসেনের কথা, নবাবগঞ্জ না নাচোল না ঠাকুরগাঁয়ে পুলিসের প্যাদানি খেয়ে তেভাগার লোকজন সব ছড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক। তাদেরই কেউ কেউ হয়তো লুকিয়ে রয়েছে বিলের উত্তর সিথানে ঝোপে জঙ্গলে। কিন্তু সেখানে তো মণ্ডলের ইটখোলা। বড়ো গাছ আর কোথায়? তা হলে কি ইটখোলাতেই মিস্ত্রি সেজে লুকিয়ে রয়েছে তারা? এই আসামিকে ধরে আজই কালাম মাঝি যাবে শরাফত মণ্ডলের বাড়ি। তহসেন আসলে ঠিকই বলে, গাঁয়ে দাপট নিয়ে থাকতে হলে মণ্ডলের সঙ্গে বিবাদ না করে বরং খাতির রাখা ভালো। আসামিকে আরো ভালোভাবে সনাক্ত করার জন্যে কালাম মাঝি আরেকটু ধৈর্য ধরে। কিন্তু কুলসুমের মুখে ও! মরার পরে ভাত মাছ গোশতো কিছুই খাওয়া হয় না? খালে গোর আজাব বাড়ে? আজাব হবি আবার খাবার পারবা না? মরা মানুষে মাছ খালে কী দোষ হবি গো? শুনে কালাম মাঝির গা এমনি ছমছম করে ওঠে যে মেঝেতে নিজের পড়ে-যাওয়া ঠেকাতে বেটার বুলি ধার করে তাকে চিৎকার করতে হয়, হ্যান্ডস আপ? তার গলা-ফাটানো হুংকারে দিশাহারা কুলসুম মুখ তুলে সামনে দেখতে পায় কালাম মাঝিকে। তার জবান বন্ধ হয়ে যায়, ছাইমাখা মাছকাটা হাত উঠে আসে বঁটির ওপর থেকে। এমন কি, বয়সে অনেক বড়ো মানুষটাকে দেখে মাথার ওপর কাপড় তোলার কথাও তার খেয়াল থাকে না। আর কালাম মাঝির মুখে পুলিসের ইংরেজি কথা দুটির মানে জানে না বলে নির্দেশটি পালন করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না।

কুলসুমের শেষ কয়টি কথা শোনার পর একটি জ্যান্ত মানুষ দেখতে কালাম মাঝি অস্থির হয়ে উঠেছে, হয়তো এই কারণেই সে ছাড়ে তার দ্বিতীয় হুঙ্কার, মানুষ কুটি? কথা কচ্ছিলু কার সাথে? কুটি?

ঘরের চারদিকে সে দেখে। মাচার ওপর জিনিসপত্র যেভাবে রাখা তাতে আস্ত একটা মানুষ সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে না। এই কাণ্ডজ্ঞানে সমৃদ্ধ কালাম কাঁপাকাঁপা হাতে মাচার ওপরটা কোনোমতে হাত বোলাতে বোলাতে ফের সত্যি সত্যি। কেউ বসে থাকে ওখানে এই ভয়ে ধপাস করে বসে পড়ে মাটিতে এবং কুলসুমের নিশ্বাসের নিরাপদ দূরত্বে বসে হাতড়াতে থাকে মাচার নিচে। সেখানে রাজ্যের জিনিস। তুষের বস্তা, কালাম মাঝির বাড়ি থেকে হাতানো কাচের একটা প্লেট আর একটা বসবার টুল আরো সব হাবিজাবি। মাচার নিচে হামাগুড়ি দিয়েও কালাম মাঝি কোনো মানুষ দেখতে পায় না। মাচার তলা থেকে মাথা বার করে পাছা ঘষটে কুলসুমের আর একটু কাছে বসে মোলায়েম গলায় সে বলে, কুটি গেলো? কথা কচ্ছিলু তুই কার সাথে রে?

কালাম মাঝির তৎপরতা ও কথাবার্তায় কুলসুমের টাকা লাগাটা একটু কাটে, তার চোখে লোকটার চেহারা স্পষ্ট হয়। তার বড়ো বড়ো চোখের পানসে লাল আলোয় কালাম মাঝির স্বর আরেকটু নামে, আরে তোর কী? তুই তো আর ডাকাতির আসামি লোস। খালি ক, তোর ঘরত তুই কার সাথে কথা কচ্ছিলু। মানুষটা পলালো কোনদিক দিয়া?

কুলসুমের হাতে শিঙি মাছের রক্ত শুকিয়ে চটচট করে। কালাম মাঝির আরেকবার তোর ঘরত কেটা রে? প্রশ্নসূচক নির্দেশের জবাবে চোখ তুলে সে চোখের ইশারা করে মাচার পাশের জায়গাটিতে এবং শুকনা গলায় বিড়বিড় করে, তমিজের বাপ।

কুলসুমের চোখের ইশারা কিংবা তার শুকনা খরখরে গলা অথবা দুটোতেই কালাম মাঝির শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। এর সঙ্গে একটু আগে কুলসুমের মোলায়েম স্বরের কথা শুনে তার গায়ে মোলায়েম ছোঁয়ার কোনো মিল নাই। তমিজের বাপ কি সত্যি এসে পড়েছে নাকি? মানুষটা তো আচ্ছা নেমকহারাম গো! চোরাবালিতে প্রতি জুম্মার পর তার গোর জিয়ারত করাচ্ছে কালাম মাঝি, কুদুস মৌলবিকে দিয়ে কোরান খতম করিয়ে তার নামে বকশা করে দেওয়া হয়েছে কয়েকবার। এর পরেও সে শান্তি পায় না? দুনিয়ার টান তার যায় না? কুলসুমের উঁচু বুক আর লম্বাটে মুখ নিজের চোখ দুটো ভরে দেখার চেষ্টা তার ব্যর্থ হলে কালাম মাঝি বলে, কলেই হলো? মুনসিই বলে ভাগিছে পাকুড়গাছ লিয়া, তমিজের বাপ আসবি কার ঘাড়োত চড়া?—নিজের ঠাট্টাবিদ্রুপে সে নিজেই ভয় পায় এবং এই ভয় কাটাতে ফের বলে, ওই যে বৈকুণ্ঠ, শালা মালাউনের বাচ্চা, ওটাও তার পাছ ধরিছে নাকি?—এমনিতে শরিয়ত মোতাবেক দাফন না-হওয়া মুসলমানের বেচইন রুহ, এর ওপর খুন-হওয়া হিন্দুর অতৃপ্ত প্রেতাত্মার কথা বলে কালাম এই ঘরে ছায়া ঘনিয়ে তোলে; সে আটকায় আরো প্যাচের মধ্যে : এই ঘরে সে কি বসে রয়েছে রুহু আর প্রেতাত্মার মধ্যে? মরার পরেও শালাদের জোট ভাঙে না? আর কুলসুম কি এদের বাঁদি? নাকি সে হলো এদের সর্দারনি?-না তাকে তারা দুনিয়ায় তাদের খলিফা। নিযুক্ত করেছে? তাদের বাঁদি, সর্দারনি আর খলিফা যাই হোক, এইসব ভূত পেতের মধ্যে একমাত্র মানুষ হলো কুলসুম। কুলসুম ছাড়া কালাম মাঝিকে এখন ঠাঁই দেবে কে? আর কে আছে?-কালাম ঠিক বুঝতে পারে নি, কখন পাছা ঘষটে এসে পড়েছে কুলসুমের গায়ের কাছে, তার বঁটি ঘেঁষে।

কুলসুম হঠাৎ বলে ওঠে, আপনে এটি কাক উটকান? তমিজ তো গাও ছাড়িছে আর বছর। উই কি আর এই মুলুকেত আছে?

এই সময় বাইরে ভ্যা ভ্যা করে ডেকে ওঠে একটা ছাগল, দুজন মানুষ কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে ডোবার ওপারের রাস্তা দিয়ে। জীবিত জানোয়ার ও মানুষের আওয়াজে কালাম বল পায়, ওই আওয়াজের ভেলায় চড়ে বসতে তার জানটা আকুলিবিকুলি করে। কুলসুম বোধহয় ভয় পাচ্ছে তাকে, ব্যাকুল হয়ে মেয়েটা বারবার তাকাচ্ছে মাচার দিকে। ওদিকে ছাগল ও মানুষের গলার স্বর দূরে মিলিয়ে গেলে বিজলির ধমকে-ঝলসানো ঘনঘোট আন্ধারের মতো ঘরের নীরবতা বাড়ে একশোগুণ, কালামের ভয় বাড়ে তার চেয়েও বেশি, একশো হাজার গুণও হতে পারে। আল্লা গো, মা গো বলে সে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করে কুলসুমকেই।

কালাম মাঝির ধাক্কায়, বরং বলা যায় তার ভারে কুলসুম মাটিতে গড়িয়ে পড়তে পড়তে হাত দিয়ে ঠেলে দেয় বঁটিটাকে। শিঙি মাছের রক্ত ও নাড়িভুড়িমাখা বঁটি পড়ে থাকে মাচার দ্বিতীয় খুঁটির গা ঘেঁষে। চিৎ হয়ে পড়ে গেলে দরজার বন্ধ কপাটে মাথা ঠেকে কুলসুমের, মাচার দিকে তাকিয়ে সে নালিশ করে, দেখো তো, মানুষটা হামার সাথে কী করিচ্ছে? খাড়া হয়া তুমি কী দেখো? এবার কুলসুমকে জড়িয়ে না ধরে কালামের আর কোনো উপায়ই থাকে না। আলগা করে ধরেও তার ছমছমে ভাবটা কিন্তু একটু কাটে। এখন একে জাপটে ধরতে পালেই জ্যান্ত ও মরা মানুষের নজর থেকে, তাদের থাবা থেকে কালাম বাঁচে। কুলসুম অবিরাম কিল মারতে শুরু করে তার বুকে, পেটে, এমন কি চিবুকে পর্যন্ত। কুলসুমের হাতের ঘায়ে এতো জোর কি আর থাকতে। পারে? মরিয়া হয়ে কালাম উপুড় হয়ে ধরে ফেলে কুলসুমের দুই বাহুমূল এবং চটকা মেরে উঠে বসে তার বুকের ও পেটের মাঝামাঝি। কুলসুম ফের নালিশ করে সামনের দিকে তাকিয়ে, তুমি খালি খাড়া হয়া থাকবা? দেখো না হামাক কী করিচ্ছে! এই মানুষটাক তুমি আটো করবার পারো না?

কালাম মাঝি পেছনদিকে না তাকিয়েও শুকনা গলায় বলে, তমিজের বাপ, তোমার। নামে হামি মিলাদ দিমু, তোমার নামে দোয়া পড়ায়া হাজার মানষেক খিলামু। তুমি মানুষের মধ্যে আরো আসো না। তোমার রুহের মাগফেরাত চায়া গাঁয়ের ব্যামাক- তমিজের বাপের প্রতি এই মিনতিতে কাজ হয় না। বরং কালাম মাঝির পিঠে পড়তে থাকে একটির পর একটি লাথি, মরা মানুষের পা ছাড়া এমন আবছা আবছা লাথি আর কে দিতে পারে?

ওদিকে কালাম মাঝিকে দেখেই কেরামত আলি তার বাবরি চুল, ময়লা বেনিয়ান ও সবুজ লুঙি নিয়ে বিজলির মতো ছিটকে গিয়েছিলো তমিজের বাপের ঘরের পেছনে ভাঙা কাঁঠালগাছের দক্ষিণে, সেখানে শরাফত মণ্ডলের বর্গাচাষা শমশের মরিচের জমি তৈরি। করে। শমশের তখন জমিতে নাই, কেরামত দাঁড়িয়ে হাঁপায়। অস্থির হয়ে ভাঙা কাঁঠালগাছের পাশে এসে শুনতে পায় কালাম মাঝি আর কুলসুমের কথা, কালাম মাঝি মনে হয় কুলসুমের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে। এখন কেরামত করেটা কী? কালাম মাঝি হলো তার অন্নদাতা, কালামের বাড়িতেই সে থাকে। কুলসুমের সঙ্গে তার নিকা দেওয়ার ইংগিতও তো দিয়েছিলো কালামই। এখন অবশ্য সে কথা সে তোলেই না, বরং কুলসুমের সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেখলে ভুরু কোঁচকায়। যতোই হোক, কালাম মাঝির ওপরেই তাকে চলতে হবে, তার রেজেক বলো রোজগার বলো সবই কালাম মাঝির হাতে। এই নিশ্চিত রোজগারটি না থাকলে তার গান লেখাও আর কখনো হবে না। গোলাবাড়ি হাটে মুকুন্দ সাহার দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একহাট মানুষের সামনে কেরামত যে গান করেছিলো, সেটা কালাম মাঝির তাগাদা ছাড়া কি হতে পারতো? এখন কুলসুমকে তার হাত থেকে বাঁচাতে যাওয়া মানে ওই মানুষটার সঙ্গে নেমকহারামি করা।-কেরামত কী করে?–ভাঙা কাঁঠালগাছের নিচে সে বসলো পেচ্ছাব করতে। বেগ ছিলো না, পেচ্ছাব তেমন হলোও না। এখন পেচ্ছাব করার পর তার আরো কোনো কিছুই করার নাই। তার পেচ্ছাবের ফেনার বুদবুদ সব মিশে যায় আর কেরামতের বাবরি চুলের নিচে লাগে কুলসুমের বড়ো বড়ো নিশ্বাসের ঝাপটা, গরম হাওয়ায় তার চুল ওড়ে। কেরামতকে কুলসুম দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু আড়ালে থাকলেও তার নিঃশ্বাসে কেরামতের এখানে এই কাঁঠালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সে ঠিকই কিন্তু ঠাহর করতে পাচ্ছে। এক্ষুনি তার ঘরে ঢোকাটা খুব জরুরি। কুলসুমের একটা কাজে যদি সে আসে তো মেয়েটা তাকে কি আর ফিরিয়ে দিতে পারবে?

ভাঙাচোরা বাড়ির পেছন দিয়ে হুবহু কালাম মাঝির পথ ধরেই সে পৌঁছে গেলো কুলসুমের ঘরে। ঝাপোলা ঘরের ভেতর ঢুকলে কেরামতের নজর আটকে যায় ঘাম চপচপ সাদা রঙের পাঞ্জাবিপরা পিঠের ওপর। কালাম মাঝি উপুড় হয়ে বসেছে কুলসুমের বুকের ওপর। সে কি তাকে চুমু খাবার চেষ্টা করছে? তার পিঠে পড়ছে কুলসুমের অবিরাম লাথি। ওই লাথি কি শালা মাঝির পিঠকে কাবু করতে পারে? না, মাঝির বেটা সুখই পাচ্ছে।

কুলসুম গলায় জোর খাটিয়ে বলে, খাড়া হয়া থাকো কিসক? কিন্তু কালাম মাঝির ভারি ভারি হাত দুটোর নিচে চাপা পড়েছে কুলসুমের মুখ। কেরামত বুঝতে পারে, কুলসুম তো তাকেই ডাকছে, কালাম মাঝির হাত থেকে বাঁচাতে কুলসুম তারই সাহায্য চায়। কালাম মাঝি বলছে, কুলসুম, তুই হামাক মাফ কর। তুই হামার চাচি, হামি তোর নামে এই ঘর লেখ্যা দিমু, সম্পত্তি চাস তো আরো দিমু। তুই তমিজের বাপোক এটি থ্যাকা যাবার ক। হামি ভালো করা দোয়াদরুদ পড়ায়া দিমু, তাক তুই যাবার ক।

পাকুড়তলার ভয়ে তার শরীরের বল অনেকটা ক্ষয় হওয়ায় কিংবা তমিজের বাপকে এক্ষুনি চলে যেতে বলার জন্যে সুযোগ দিতেও হতে পারে, কুলসুমের মুখের ওপর চাপা দেওয়া হাত তার একটু শিথিল হয়ে গিয়েছিলো। সেই সুযোগ কুলসুমের কথা বেরিয়ে আসে তার খুব দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে, হামাক ম্যারা ফালালো গো। তুমি আবোরের লাকান ওটি খাড়া হয়া থাকো কিসক? তুমি, তুমি।

তাকে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু কুলসুম ভরসা করছে তারই ওপর। তার তুমি তুমি কেরামতকে খুশিতে, কষ্টে, গ্লানিতে, গৌরবে, উত্তেজনায়, উস্কানিতে, এমনকি বলা যায় না, হয়তো প্রেরণাতেও এমনি বলকাতে শুরু করে যে শরীরের সমস্ত বল দিয়ে সে দুই হাতে ধাক্কা দেয় কালাম মাঝির পিঠে। তারপর ওই হাতজোড়া দিয়েই টেনে ধরে কালাম মাঝির গলা। তমিজের বাপ এবার কুলসুমের ডাকে সাড়া দিয়েছে কালামও তাই বুঝতে পেরে নিজের গলা থেকে বুক পর্যন্ত চেপে ধরে কুলসুমের মুখের ওপর। কুলসুমের নাকমুখ এমনভাবে চেপে ধরেছে যে তার পক্ষে কাউকে ডাকা দূরের কথা, নিশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত অসম্ভব। কুলসুমের ডাক কেরামত আরেকবার, অন্তত আর একবার শুনতে চায়। সুতরাং উপুড় হয়ে কালাম মাঝির ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত ডিঙিয়ে তমিজের বাপের মাচার দ্বিতীয় খুঁটির পাশ থেকে টেনে নেয় শিঙি মাছের রক্তমাখা বঁটি। বঁটির ধাক্কায় মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে জ্যান্ত শিঙিওয়ালা পানিভরা মটকা। পানিতে ভিজে যায় কুলসুমের চুল। মাটিতে কিলবিল করে তিনটে শিঙি মাছ। কুলসুমের চুলে গড়ানো আঁশটে গন্ধের পানিকে একটি শিঙি ঠাওরায় কাৎলাহার বিলের অংশ বলে এবং বোকার মতো ঢুকে পড়ে সেই কেশরাশির ভেতর। সেটা কালাম মাঝির নজরে পড়লে তার বুক কাঁপে আরেক পশলা : এটা কি শিঙিমাছ? না-কি আজকেই হুরমতুল্লার ঘরে দেখা সেই গোখরোটা? কিংবা তার জোড়া? কান্তাহার বিলের এপারে ওপারে সব জীবের মতো। এটাও তো মুনসির শাসনেই থাকে। মুনসিই কি এটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে তমিজের বাপের খেদমতে। তারপর পুরো বিলে ড়ুবসাঁতার দিয়ে শালার সাপ এসে হাজির হয়েছে কালাম মাঝিকে কাটতে। তমিজের বাপ, বৈকুণ্ঠ, সেই কোন আমলের মুনসি, চেরাগ আলি ফকির, এদের সঙ্গে এসে জুটলো হুরমতুল্লার বাড়ির গোখরোটা। কালাহারের সব মরা জীবের ভয়ে, তাদের সহকর্মী এই গোখরা সাপের ভয়ে কালাম মাঝি আরো জোরে চেপে ধরে কুলসুমের মুখ। সেখানে কোনো স্পন্দন নাই। মেয়েটা কি মরে গেলো নাকি? তা হলে? কুলসুমও যদি মরে তো এই ঘরভরা মড়াকে সে একা ঠেকাবে কী করে? আবার মাটি থেকে বঁটিটা চলে গেলো কার হাতে? তমিজের বাপের হাতে এখন হাতিয়ার, কালাম মাঝির এবার সব শেষ।

তবে পলকের ভেতর কালাম মাঝির কাণ্ডজ্ঞান ফিরে আসে, তার মনে পড়ে, লোহার কোনো কিছু কাহারের তেনাদের সাধ্যের বাইরে। তা হলে এই বঁটি তুলে নিয়েছে নির্ঘাৎ তমিজ। তমিজ না হলেও তার ওইসব জোট-বাঁধা চাষাদেরই কেউ হবে। সতর্ক হয়ে কালাম একটু ঘাড় সরিয়ে নিতেই বঁটির একটা কোপ পড়ে তার ডান হাতের কনুইতে। দ্বিতীয় কোপটি পড়ার আগেই সে ছিটকে সরে পড়ে অনেকটা বাঁয়ে। বঁটির এই কোপটি পড়ে কুলসুমের বাম স্তনের মাঝখানে। সেখান থেকে এবং কালামের কনুই থেকে রক্ত ঝরতে থাকে গলগল করে। দুজনের রক্ত গড়ায় মেঝেতে, বঁটিতে শিঙি মাছের শুকনা রক্ত এই দুজনের টাটকা রক্তে জেগে ওঠে লাল রঙে।

কুলসুমের গলা থেকে ঘর্ঘর শব্দ বেরুচ্ছিলো কালাম যখন তার মুখ ঠেসে ধরে তখন থেকেই। এখন তার স্তনের ওপর বঁটির ঘা পড়লে ফের আঁ আঁ করে কাত্যায়।

কালাম মাঝি ততোক্ষণে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কনুইতে তার জখম বেশ মারাত্মক। অন্য হাতে সেই হাত চেপে ধরে কেরামতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমে তাকে চিনতে পারে না। কেরামত তাকিয়েছিলো কুলসুমের মুখের দিকে। তার হাতে বটি তখনো ঝুলছে। কয়েক পলকের জন্যে তার চোখে কুলসুমের মুখে গোলাপি আভা দেখতে পায়, টাউনের রিফিউজি ক্যাম্পে দেখা ঐ রিফিউজি মেয়েটির কোন স্তনটি যেন কাটা ছিলো? বাকি স্তনটা কি কাটা পড়লো কেরামতের হাতে?

কেরামতকে কেরামত বলে চিনতে পেরে দারুণ অবাক হতে হতেও যন্ত্রণা, দুঃখ ও ভয়ের মাত্রাছাড়া চাপে কালাম মাঝি কোনো কথাই বলতে পারে না। তারপর সে অবশ্য খানিকটা সামলে নেয় এবং কুলসুমকে ডিঙিয়ে দরজার হুড়কো খুলে ছুটতে ছুটতে বলে। খুন খুন! কিন্তু গলায় তার জোর নাই।

কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে। খবর পেয়ে টমটম নিয়ে তহসেনউদ্দিন আসে টাউন থেকে। বাপকে নিয়ে সে চলে যায় টাউনে; হরেন ডাক্তার বলো আর করিম ডাক্তার বলো-এদের কারো ওপরেই তহসেনের ভরসা নাই। বুধাকে সে কড়া হুকুম দিয়ে যায়, আমতলি থেকে পুলিস না আসা পর্যন্ত লাশ যেখানে যেভাবে ছিলো। তেমনি থাকবে। কেরামতকে আচ্ছা করে বেঁধে রাখা হলো কালাম মাঝির খানকা ঘরে।

মাঝিপাড়ার মানুষ অনেকদিন পর একেবারে ভেঙে পড়ে কালাম মাঝির বাড়িতে। তমিজের বাপের মতো মানুষ, যে কি-না ঘরসংসার তুচ্ছ করে চেরাগ আলির পাছে পাছে ঘুরলো সারাটা জেবন, তামাম এলাকার মুরুব্বি মুনসিকে এক নজর দেখতে গিয়ে তার আরস খুঁজে না পাওয়ার কষ্টে ঢুকে পড়লো চোরাবালির মধ্যে, এ্যা, তারই বৌ এবং চেরাগ আলি ফকির, মুনসির খাস খলিফা, যে কি-না সারা জেবন খালি শোলোকে শোলোকে মুনসির শাস্তরই গেয়ে গেলো, তার সাক্ষাৎ নাতনিকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে গিয়ে জখম হয়েছে কালাম মাঝি। কালাম মাঝির দুঃখে লোকজন ভেঙে পড়ে। এমন কি, তার বিলডাকাতির মামলায় এখনো হাজতখাটা মাঝিদের আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত কালাম মাঝির ডান কনুইটা ডান হাতেই ঠিকমতো জোড়া লাগাবার জন্যে কুদুস মৌলবির নেতৃত্বে আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করে। চাষীপাড়ার মানুষ আসে, পালপাড়া থেকে আসে কেষ্ট পাল তার ভাই আর ভাইপোকে নিয়ে। শরাফত মণ্ডল আর কাদের একবার ঘুরে গিয়ে বাড়ি থেকে হ্যাজাক পাঠিয়ে দেয়।

আমতলি থেকে পুলিস আসতে আসতে পরদিন বেলা এগারোটা। তমিজের বাপের ঘর এবং ঘরের বাসিন্দা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একসা। মাচার ওপর এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে তলার দিকে একটা শুকনা কাঁথা পাওয়া যায়। লাল নীল সবুজ ও হলুদ সুতাতে চারদিকে বরফি তোলা কাথার মাঝখানে অনেকগুলি চাঁদ এবং একোটা চাঁদ পিছু তিনটে করে তারা। সেই কথায় জড়িয়ে কুলসুমের লাশ ফের মোড়ানো হয় বাঁশের চাটাইতে। চাটাই জড়ানো লাশ বাঁশে ঝুলিয়ে কাঁধে তুলে নিয়েছে মাঝিপাড়ার দুজন তাগড়া জোয়ান। লাশের আগে পুলিস, পিছে পুলিস। পেছনের পুলিসের হাতে ধরা কেরামতের কোমরে দড়ি। তার হাতেও হ্যান্ডকাপ পরানো।

রাতভর মাঝিপাড়ার আবাল বৃদ্ধের হাতে কিলচড়লাথি খেয়ে সে খুব দুর্বল। তার ঢুলঢুলু চোখে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে বাঁশের চাটাই থেকে বেরিয়ে-পড়া কুলসুমের পায়ের পাতা। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে পায়ের পাতাজোড়া ফ্যাকাশে, একটু ফোলা ফোলা। কাঁথার চাঁদতারা লুটিয়ে পড়েও সেখানে একটু আলো ফেলতে পারে না। কেরামতের মাথা এখন ভারী, তার মাথার ধারে কাছেও কোনো শোলোক নাই। কিন্তু কে বলতে পারে, জেল খাটতে খাটতে কিংবা ফাঁসির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আরো সব চোর ডাকাত আর জোট-বাঁধার-দায়ে-কয়েদখাটা উত্তরের চাষাদের সঙ্গে বসে কেরামত তার ওই শোলোকটায় আরো কথা জুড়বে না? শোলোকটা প্রথম থেকে বললে হয়তো শোনাবে এরকম :

কদাপিও রূপ যদি দেখে থাকি কোথা।
খোয়বে ও মুখখানি নাহিক অন্যথা।।
মুনসির আরস নাই পাকুড়ের তলে।
বিধ মাঝি হাঁকে রূপ ভেসে যায় জলে।।

কয়েদখাটা কোনো চোর কি ডাকাত কি জোটবাঁধা চাষাদে কেউ হয়তো জানতে চাইবে, এই শোলোক তুমি কুটি পাঁছো গো?

হামার লিজের বান্দা শোলোক। শোলোক হামি লিজে বান্দি।-কেরামত আলি কি তখন এই জবাব দিতে পারবে? পাকুড়গাছশূন্য পাকুড়তলা কি তার বুকে ছমছম করবে না?

তবে আজ কালাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছশূন্য পাকুড়তলা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ছমছম করার মতো জায়গা কি ফুরসৎ ফুলজানের বুকে হয় না, সেখানে তার বেটির মুখ লাগানো।

সকালে ফুলজান সৎশাশুড়ির লাশ দেখতে মাঝিপাড়ায় যেতে চাইলে হুরমতুল্লা খুব করছিলো : এইসব খুনখারাবির ব্যাপারে গেলেই ঝামেলা। পরে শরাফত মণ্ডল ও আবদুল কাদের পুলিসের দেখাশোনা করছে খবর পেয়ে তার সাহস হয় এবং একটু ভয়ে ভয়ে হলেও বেটিকে নিয়ে হাজির হয় কালাম মাঝির মানুষ গিজগিজ-করা বাড়িতে। ততোক্ষণে লাশ জড়ানো হয়ে গেছে বাঁশের চাটাইতে। শরাফতের বাড়ি থেকে ভাত ও মুরগির গোশতের তরকারি নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি কাজে হুরমতুল্লাহ হাত লাগায়। লাশ নিয়ে পুলিস রওয়ানা হলে সে মণ্ডলবাড়ি গিয়ে চারটে ভাতও খায়।

ফুলজান অনেক দূর থেকে লাশ ও কেরামতের পিছে পিছে গিয়েছিলো। তারপর বাঁদিকে ইটখোলা দিয়ে সে ধরে বাড়ির রাস্তা। বাঙালি নদীর রোগা স্রোতের ওপর বাঁশের সাঁকোটা কাল রাতের ঝড়ে ভেঙে গেছে। স্রোতে পানি বেড়েছে অনেকটা। এটা পেরোতে ফুলজানের কাপড় তুলতে হয় প্রায় উরুর ওপর। বাঙালি নদীর রোগা স্রোতে কেরামতের মার-খাওয়া মুখ ভেঙে ভেঙে যায়। এদিকে বুকের দুধ না পেয়ে কোলের বেটিকে কান্না থামাতে এবং ওদিকে কাল রাতে ফের বৃষ্টির পর ভিটার পেছনে আউশের জমিতে ধানশীষগুলো দেখার তাগিদে কদমে বাদাম না খাটিয়ে নিয়ে তার আর উপায় নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *