৪. অমরত্বতত্ত্ব

অমরত্বতত্ত্ব

কয়েকটা দিক থেকে ফিডো নামের সংলাপটি আগ্রহহাদ্দীপক। এতে সক্রেটিসের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো বর্ণনা করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, এতে রয়েছে হেমলক পানের ঠিক আগ মুহূর্তে এবং তা পান করার পর থেকে চেতনা না হারানো পর্যন্ত তার কথোপকথন। এতে উপস্থাপিত হয়েছে একজন মানুষ সম্পর্কে প্লেটোর আদর্শ। এই মানুষ জ্ঞানী এবং সর্বোচ্চ মাত্রায় উত্তম, আর পুরোপুরি মুক্ত মৃত্যুর ভয় থেকে। প্লেটো বর্ণিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো সক্রেটিস প্রাচীন ও আধুনিক-উভয়কালেই নৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টানদের জন্য গসপেল-এ বর্ণিত যিশু যা, প্যাগান ও মুক্তচিন্তার দার্শনিকদের জন্য ফিডো তাই। (এমনকি অনেক খ্রিস্টানের কাছে সক্রেটিসের মৃত্যুর স্থান যিশুর মৃত্যুর পরেই। প্রাচীন বা আধুনিক কোনো ট্র্যাজেডিতে, কাব্যে অথবা ইতিহাসে প্লেটো-বর্ণিত সক্রেটিসের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর মতো মহান আর কিছু নেই-কথাগুলো Benjamin Jowett-এর) জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে সক্রেটিসের অবিচলতা জড়িয়ে আছে তার অমরত্বের বিশ্বাসের সঙ্গে, আর ফিডো নামক সংলাপটি গুরুত্বপূর্ণ, শুধু একজন শহীদের মৃত্যু হিসেবেই নয়, আরো অনেক মতবাদের উৎস হিসেবে, যে মতবাদগুলো পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় মতবাদরূপে দাঁড়িয়ে গেছে। এখান থেকেই সেন্ট পল এবং পোপদের ধর্মতত্ত্ব সরাসরি বা পরোক্ষভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে। তাই সেই তত্ত্বগুলো বোঝা যাবে না প্লেটোকে অগ্রাহ্য করা হলে।

ক্রিটো নামের পূর্ববর্তী একটি সংলাপে বলা হয়েছে, কীভাবে সক্রেটিসের কিছু বন্ধু এবং শিষ্য একটি পরিকল্পনার আয়োজন করেছিলেন, যাতে তিনি পালিয়ে যেতে পারতেন থেসালিতে। তিনি পালিয়ে গেলে এথেন্সের কর্তৃপক্ষ সম্ভবত খুশিই হতেন; আর মনে হয়, পরিকল্পনাটির সাফল্যেরও খুব সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সক্রেটিস সেসবের কিছুই করেননি। তিনি মনে করেন আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই তার দণ্ড হয়েছে, আর এই দণ্ড এড়াবার উদ্দেশ্যে বেআইনি কিছু করা হবে অন্যায়। তিনিই প্রথম সেই নীতিটি ঘোষণা করেন যেটাকে আমরা সামন অন দ্য মাউন্ট (Sermon on the mount)-এর সঙ্গে জড়িত করি। আর তা হলো : কারোর অন্যায়ের প্রত্যুত্তরে আমাদের অন্যায় করা উচিত নয়, তা সে অন্যায় থেকে আমরা যত ক্ষতির শিকারই হই না কেন। অতঃপর তিনি নিজেকে কল্পনা করেন এথেন্সের বিধানগুলোর সঙ্গে একটি কথোপকথনে অংশ নিতে। এই কথাবার্তায় বিধানগুলো সক্রেটিসকে বোঝায় যে পিতার প্রতি সন্তানের বা মালিকের প্রতি দাসের যে শ্রদ্ধা থাকা উচিত, বিধানগুলোর প্রতিও সক্রেটিসের সে রকম শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করা উচিত। বরং তা আরো বেশি মাত্রায় থাকা উচিত। তারা আরো বলে, এথেনীয় রাষ্ট্রকে যদি কোনো নাগরিক পছন্দ না করে, তাহলে সে রকম প্রত্যেক এথেন্সবাসীর স্বাধীনভাবে অন্য কোনো দেশে চলে যাবার অধিকার আছে। বিধানগুলো একটি লম্বা বক্তব্যের ইতি টানে এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে : সক্রেটিস, তাহলে এখন তুমি আমাদের কথা মন দিয়ে শোনো। আমাদের কথা, যারা তোমাকে লালন-পালন করেছি। জীবন আর সন্তানদের কথা আগে, আর ন্যায়বিচারের কথা পরে-এইভাবে চিন্তা কোরো না; বরং আগে ভাব ন্যায়বিচারের কথা। ভেবে দেখো যে পরজগতে রাজপুত্রদের সামনে তুমি সঠিক প্রতিপন্ন হতে পারো। কেননা, ক্ৰিটো যে মত বলছে, তাই যদি তুমি করো, তাহলে তুমি এবং তোমার সঙ্গে যারা আছে, কেউই এ জীবনে বা পরজীবনে-কোথাও সুখী বা পুণ্যবান বা সঠিক প্রমাণিত হতে পারবে না। এখন তুমি বিদায় নেবে নিষ্পাপ অবস্থায়, অন্যায়কারী হিসেবে নয়, বরং একজন কষ্টভোগী হিসেবে, আইনের শিকার হিসেবে নয়, মানুষের শিকার হিসেবে তুমি চলে যাবে। কিন্তু তুমি যদি অন্য রকম করো, মানে অন্যায়ের জবাবে অন্যায় করো, আঘাতের বদলে আঘাত দাও, আমাদের সঙ্গে তুমি যে অঙ্গীকারগুলো করেছ তা যদি ভঙ্গ করো এবং যাদের প্রতি তোমার অন্যায় করা উচিত নয়, সেই তোমার নিজ সত্তা, তোমার বন্ধুবান্ধব, তোমার দেশ এবং আমাদের প্রতি যদি তুমি অন্যায় করো, তাহলে আমরা তোমার জীবদ্দশায় তোমার প্রতি রুষ্ট হবো এবং আমাদের ভাইয়েরা-পরকালের বিধানেরা-তোমাকে একজন শত্রু হিসেবে নেবে, কারণ তারা বিলক্ষণ জানবে যে আমাদের ধ্বংস করার জন্য তুমি সবকিছু করেছ। সক্রেটিস বলছেন, এই স্বর একজন মরমিবাদীর কানে বাঁশির সুরের মতো আমার কানে বাজছে বলে আমার মনে হতে থাকে। তিনি সেই মতো স্থির করেন, না পালিয়ে মৃত্যুদণ্ড মেনে নেয়া তার কর্তব্য।

সমাগত ফিডো সংলাপের শেষ মুহূর্তটি; সক্রেটিসের শিকলগুলো খুলে নেয়া হয় এবং তাকে তার সহচরদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি তার ক্রন্দনরতা পত্নীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন, যাতে তার বিলাপ আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে। সক্রেটিস তার কথা শুরু করেন এই বলে যে, যদিও দার্শনিক চেতনাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুকে ভয় পাবে না, বরং স্বাগত জানাবে, তবু সে আত্মহত্যা করবে না, কারণ সেটা হবে একটি বেআইনি কাজ। তার সহচরগণ জানতে চান আত্মহত্যা কেন বেআইনি হবে। উত্তরে তিনি যা বলেন, অর্ষিক মতবাদ অনুযায়ী একজন খ্রিস্টান যা বলতে পারেন, প্রায় হুবহু তাই। তিনি বলেন, গোপনে একটি তত্ত্বকথা বলা হয় যে, মানুষ হলো একজন কয়েদি, যার কোনো অধিকার নেই কয়েদখানার দরজা খুলে পালিয়ে যাবার; এ এক নিদারুণ রহস্য, যা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের তুলনা তিনি করেন পশুপালের সঙ্গে তাদের মালিকের সম্পর্কের সঙ্গে। সক্রেটিস বলছেন, আপনার বলদটা যদি বিগড়ে যাবার স্বাধীনতা নিয়ে নেয় তাহলে আপনি ক্ষিপ্ত হবেন। আর সে জন্য এ রকম বলার পেছনে যুক্তি থাকতে পারে যে, একজন মানুষের উচিত নয় আত্মহত্যা করা। ঈশ্বর তাকে তলব না করা পর্যন্ত তার অপেক্ষা করা উচিত, যেমন তিনি এখন আমাকে তলব করছেন। মৃত্যুতে তিনি ব্যথিত নন, কারণ তার অবিচল বিশ্বাস, প্রথমত, আমি যাচ্ছি অন্য দেবতাদের কাছে, যারা প্রজ্ঞাময় এবং উত্তম (যা সম্পর্কে আমি অন্য এ রকম যে কোনো বিষয়ের মতোই নিশ্চিত), আর দ্বিতীয়ত, আমি যাচ্ছি তাদের কাছে যারা ইতোমধ্যে চলে গেছেন, যারা তাদের পেছনে রেখে যাওয়া লোকদের চেয়ে অনেক উত্তম (যদিও এ ব্যাপারে আমি ততটা নিশ্চিত নই। আমার বেশ আশা আছে যে, মৃতের জন্য আরো কিছু থেকে যায়, মন্দদের চেয়ে ভালোদের জন্য অতি উত্তম কিছু।

সক্রেটিস বলছেন, মৃত্যু হলো আত্মা ও দেহের বিচ্ছিন্নকরণ। এখানে আমরা এসে পড়ি প্লেটোর দ্বৈতবাদে : সত্তা ও অবভাস, ভাব ও ইন্দ্রিগ্রাহ্য বস্তু, যুক্তি ও ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণ, আত্মা ও দেহের মধ্যকার দ্বৈততায়। এই পদজোড়াগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বাস্তবতা এবং ভালোত্ব-উভয় ক্ষেত্রেই এই জোড়াগুলোর প্রথম অংশগুলো দ্বিতীয় অংশগুলোর চেয়ে বড়। একটি কৃচ্ছ্ববাদী নীতি ছিল এই দ্বৈতবাদের এক স্বাভাবিক পরিণতি। খ্রিস্ট ধর্ম আংশিকভাবে এই মতবাদ গ্রহণ করে, তবে কখনোই পুরোপুরি নয়। তাতে দুটো বাধা ছিল। প্রথমটা হলো, যদি প্লেটোর মত সঠিক হয়, দৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি একটি মন্দ কাজ বলে মনে হতে পারে, আর তাই স্রষ্টা ভালো হতে পারেন না। দ্বিতীয়টা হলো এই যে, অর্থোডক্স খ্রিস্ট ধর্ম কখনোই বিবাহকে নিন্দনীয় মনে করতে পারেনি, যদিও কৃচ্ছসাধনাকে তা মহত্তর বলে মনে করেছে। উভয় ব্যাপারে Manichaeanরা অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

মন ও বস্তুর মধ্যকার ভেদ, যে ব্যাপারটা দর্শনে, বিজ্ঞানে এবং সাধারণ চিন্তায় একটি গতানুগতিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, তার একটি ধর্মীয় উৎস আছে এবং তা শুরু হয়েছিল আত্মা ও দেহের মধ্যকার ভেদ থেকে। আমরা যেমনটা দেখেছি, একজন অর্ষিক নিজেকে পৃথিবী ও তারকাময় স্বর্গের সন্তান হিসেবে দাবি করে। পৃথিবী থেকে সে পেয়েছে তার শরীর, আর স্বর্গ থেকে পেয়েছে আত্মা। এই তত্ত্বটিই প্লেটো দর্শনের ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।

ফিডোতে সক্রেটিস একই সঙ্গে তার মতবাদের কৃচ্ছ্ববতী নিহিতার্থগুলোর বিকাশের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। তবে তার কৃচ্যুবাদিতা মাঝারি ধরনের এবং ভদ্রজনোচিত রকমের। তিনি বলছেন না, দার্শনিককে সাধারণ আরাম-আয়েশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। তিনি শুধু বলছেন যে তার আরাম-আয়েশের দাস বনে যাওয়া চলবে না। দার্শনিকের পানাহার নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকবে না, কিন্তু অবশ্যই তাকে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করতে হবে, যতটুকু অপরিহার্য। উপবাসের কোনো পরামর্শ তিনি দিচ্ছেন না। আর আমাদের বলা হচ্ছে যে, সক্রেটিস যদিও মদ পানের প্রতি উদাসীন ছিলেন, তবু তিনি মাঝে মাঝে অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে বেশি মদ পান করতে পারতেন মাতাল না হয়ে। তিনি যা নিন্দা করতেন তা মদ পান নয়, বরং মদ পানের মধ্যকার আনন্দ। একইভাবে দার্শনিকের উচিত নয় প্রেমের আনন্দ বা দামি পোশাক-পরিচ্ছদ বা স্যান্ডাল বা ব্যক্তির অন্যান্য ভূষণ-অলংকারের আনন্দ নিয়ে মাথা ঘামানো। তাকে আত্মা নিয়ে সম্পূর্ণরূপে মশগুল থাকতে হবে। দেহ নিয়ে নয়। যতটা তিনি পারেন, তাকে অবশ্যই দেহ থেকে সরে যেতে হবে এবং আত্মার দিকে এগোতে হবে।

এটা পরিষ্কার যে, এই মতবাদ জনপ্রিয় হয়েছে এবং তা পরবর্তীকালে কৃচ্ছৃবাদী মতবাদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অভিপ্রায়ের দিক থেকে, সঠিক অর্থে বললে, তা কৃছুবাদী নয়। দার্শনিক ইন্দ্রিয়সুখ থেকে বিরত থাকার জন্যে আলাদাভাবে প্রয়াস চালাবেন-ব্যাপারটা সে রকম নয়। কথা হলো তিনি ইন্দ্রিয়সুখ নিয়ে ভাববার ফুরসত পাবেন না, কারণ তার অন্যান্য বিষয় নিয়ে ভাববার আছে। আমি অনেক দার্শনিককে দেখেছি, যারা হয়তো একটি বই পড়তে পড়তে খাবার কথা ভুলে গেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো তাদের খাদ্য গ্রহণ করতেই হয়েছে। প্লেটো যেমনটা উচিত বলে বলেছেন, এই সব মানুষের আচরণ ঠিক সে রকমই : তারা অতিভোজন থেকে বিরত থাকার জন্য কোনো নৈতিক প্রচেষ্টা চালাননি, বরং তারা ভিন্নতর বিষয়াবলি নিয়ে অধিকতর আগ্রহী। স্পষ্টতই একজন দার্শনিকের বিয়ে করা, সন্তান-সন্ততি জন্মদান ও তাদের লালন-পালন করা উচিত। কিন্তু এসব করবেন সেই একই ধরনের অন্যমনস্কতার সাথে। কিন্তু নারীমুক্তির সাথে সাথে ব্যাপারটা কঠিনতর হয়ে উঠেছে। জানথিল্পে যে একজন মুখরা রমণী ছিলেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

সক্রেটিস বলে চলেন, দার্শনিকগণ দেহ আর মনের মধ্যকার যোগটাকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। অথচ অন্য লোকেরা মনে করেন যে, একজন মানুষের জীবনযাপনের কোনো অর্থই হয় না, যার কোনো সুখানুভূতি নেই এবং শারীরিক সুখে যার কোনো অংশগ্রহণ নেই। এই বাক্যে মনে হয়, প্লেটো, সম্ভবত অনবধানতাবশত, এক শ্রেণির নীতিবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থনদান করেছেন যে, একমাত্র দৈহিক সুখ-শান্তিই বিবেচনার দাবিদার। এ নীতিবাদীগণ মনে করেন, যে মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ অন্বেষণ করে না সে অবশ্যই সব সুখ এড়িয়ে চলে এবং শুদ্ধ ও পবিত্র জীবনযাপন করে। এটা একটি ভ্রান্তি, যা অকথ্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। মন ও শরীরের বিভক্তি যত দূর পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়, তাতে দেখা যায় নিকৃষ্টতম এবং সর্বোত্তম-উভয় প্রকৃতির সুখ বা আমোদই হয় মানসিক-যেমন ঈর্ষা, নিষ্ঠুরতার নানা ধরন এবং ক্ষমতার মোহ। মিলটনের শয়তান দৈহিক যন্ত্রণাকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছে এবং নিজেকে এমনই এক ধ্বংসলীলায় উৎসর্গ করেছে যা থেকে সে আনন্দ লাভ করে, আর এই আনন্দ সম্পূর্ণরূপে মনের আনন্দ। অনেক বিশিষ্ট পুরোহিত ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করে এবং অন্যান্য সুখের বিরুদ্ধে ইন্দ্রিয় সুখানুভূতির রক্ষক না হয়েও ক্ষমতার মোহ দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন, যা থেকে তারা অবলীলায় ধর্মের নামে মর্মান্তিক সব নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী কর্ম করেছেন। আমাদের যুগে এই টাইপের লোক ছিলেন হিটলার; সব বিচারেই সব ধরনের ইন্দ্রিয়সুখই তার জন্য খুবই নগণ্য গুরুত্ব বহন করেছে। দেহের শাসন থেকে মুক্তির অবদান বিরাট, কিন্তু তা পাপ করার ক্ষেত্রে যেমন বিরাট, পুণ্য করার ক্ষেত্রেও তেমনি বিরাট।

যা হোক, আমরা মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গেছি। এখন আমাদের সক্রেটিসের কাছে ফিরে যেতে হবে। এখন আমরা ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক দিকের ওপর আলোকপাত করব, যেটাকে প্লেটো (সঠিকভাবে বা ভুলভাবে) সক্রেটিসের ওপর আরোপ করেছেন। বলা হচ্ছে, জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে দেহ একটি বাধা বলা হচ্ছে দৃষ্টি ও শ্রুতি শুদ্ধ সাক্ষ্য নয় : সত্যিকারের অস্তিত্ব আত্মার কাছে যদি আদৌ উন্মোচিত হয়, তবে তা হয় চিন্তার মধ্যে, ইন্দ্রিয়ের মধ্যে নয়। একবার এই মতবাদের নিহিতার্থগুলো বিবেচনা করে দেখা যাক। ইতিহাস ও ভূগোলসহ সব রকম অভিজ্ঞতাপ্রসূত ও প্রায়োগিক জ্ঞানকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই মতবাদ। আমরা জানতে পারি না, এথেন্স বলে একটি স্থান আছে বা সক্রেটিস নামে এক মানুষ ছিলেন; তার মৃত্যু এবং মৃত্যুর মধ্যে তার মনোবল অবভাসের জগতের জিনিস। এইসব সম্পর্কে কোনো কিছু জানতে পারি শুধু দৃষ্টি ও শ্রুতির মাধ্যমে, কিন্তু প্রকৃত দার্শনিক দৃষ্টি ও শ্রুতিকে অস্বীকার করেন। তাহলে তার কাছে থাকছেটা কী? প্রথমত লজিক ও গণিত। কিন্তু এগুলো আনুমানিক বা প্রাকল্পিক এবং সত্য জগতের সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত দাবির সত্যতা প্রতিপাদন করে না। দ্বিতীয় ধাপটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটা নির্ভর করে শুভ বা ভালোত্বের ধারণার ওপর। এই ধারণায় পৌঁছুবার পর ধরা যেতে পারে, দার্শনিক জানেন যে শুভই সত্য এবং এইভাবে তিনি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে, ভাবগুলোর জগই হলো সত্য জগৎ।

পরবর্তীকালে দার্শনিকগণ দাবি করেন, তারা সত্য ও শুভর অভিন্নতা প্রমাণ করতে সক্ষম। কিন্তু প্লেটোর বেলায় মনে হয় যে তিনি সত্য ও শুভকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করতেন। যদি আমরা তাকে বুঝতে চাই, তাহলে আনুমানিকভাবে, আমাদের তার এই অনুমানকে সঠিক বলে ধরে নিতে হবে। সক্রেটিস বলছেন, মন যখন নিজের মধ্যে সুসংবদ্ধ বা নিমগ্ন থাকে, তখন চিন্তা সর্বোত্তম। তখন শব্দ দৃশ্য যন্ত্রণা বা সুখ দ্বারা তা বিঘ্নিত হতে পারে না, বরং দেহ থেকে মুক্তি নেয় ও সত্য সত্তার পেছনে ধাবিত হয়; আর এ জন্য দার্শনিক দেহকে অবজ্ঞা করেন। এই পয়েন্ট থেকে সক্রেটিস এগিয়ে চলেন ভাব বা আকার বা সারসত্তার দিকে। পরম ন্যায়পরায়ণতা, পরম সৌন্দর্য, পরম শুভ রয়েছে, কিন্তু তারা চোখে দর্শনযোগ্য নয়। আর আমি শুধু এগুলো সম্বন্ধেই বলছি না, বরং পরম বৃহত্ত, স্বাস্থ্য সরলতা এবং সব বস্তুর সারসত্তা বা সত্য প্রকৃতি সম্পর্কেও আমার কথা আছে। এই সবকিছুকে কেবল বৃদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টি দ্বারাই দেখা যায়। তাই আমরা যখন দেহের মধ্যে থাকি, যখন আত্মা দেহের দুষ্টামি দ্বারা আক্রান্ত, তখন সত্যের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে পারে না। জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি হিসেবে এই দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে বর্জন করে। পরীক্ষাকারীর মন নিজের মধ্যে নিবদ্ধ নয় এবং শব্দ বা দৃশ্যকে এড়াবার লক্ষ্য তার নেই। প্লেটো যে পদ্ধতিটি অনুমোদন করেন তার দুটো মানসিক ক্রিয়া হলো গণিত ও মরমি অন্তদৃষ্টি। এ দুটো জিনিস কীভাবে প্লেটো এবং পিথাগোরাসবাদীদের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হতে পেরেছে সে ব্যাখ্যা এখানেই পাওয়া যায়।

অভিজ্ঞতাবাদীর কাছে দেহ হলো তাই, যা আমাদের বহির্বাস্তবতার জগতের সংস্পর্শে আনে, কিন্তু প্লেটোর কাছে তা দুইভাবে ক্ষতিকারক। প্রথমত দেহ বিকৃতকরণের এক মাধ্যম, যার কারণে আমরা অন্ধকারপূর্ণভাবে একটি কাঁচের মধ্য দিয়ে সবকিছু দেখি। দ্বিতীয়ত তা নানা রকম লিপ্সা ও লালসার উৎস, যা আমাদের মনোযোগকে জ্ঞান অন্বেষণ ও সত্যের স্বপ্ন থেকে ভিন্নমুখী করে। কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে : নেহাত খাদ্যের প্রয়োজনেই দেহ আমাদের জন্য সীমাহীন সমস্যার উৎস : তাছাড়া দেহ নানা রকম রোগবালাইয়ের অধীন, যা আমাদের ওপর চড়াও হয়ে প্রকৃত সত্তার অন্বেষণে আমাদের বাধা দেয়; দেহ আমাদের প্রেম, কাম, লিঙ্গ, লালসা, ভীতি ও সব ধরনের অলীক কল্পনা ও কামনা এবং সীমাহীন নির্বুদ্ধিতায় নিমজ্জন ঘটায়। লোকে যেমন বলে, দেহ বস্তুত আমাদের চিন্তা করার সকল ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যায়। যুদ্ধ হানাহানি আর বিভেদ কোথা থেকে আসে? দেহ আর দেহের কামনা-বাসনা ছাড়া আর কোথা থেকে? অর্থের মোহের কারণে যুদ্ধ হয়, আর অর্থ অর্জিত হয় দেহের কল্যাণার্থে দেহের সেবার জন্য; আর এইসব বাধা-বিপত্তির কারণে দর্শনের জন্য ব্যয় করার মতো সময় আমাদের থাকে না। শেষ এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো এই যে, কিছু চিন্তা করার অবকাশ যদি আমরা পাইও, দেহ সব সময়ই আমাদের বাধা দিতে থাকে, ফলে আমাদের অনুসন্ধানে গোলযোগ আর বিভ্রান্তি দেখা দেয়, আর এমনিভাবে আমাদের বিহ্বল করে ফেলে যে, আমরা সত্যকে দেখার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হই। অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, যদি আমরা কোনো কিছু সম্পর্কে সত্য জ্ঞান পেতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই দেহ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। আত্মা নিজেই প্রকৃত বস্তুগুলোকে দেখতে পাবে, আর তাহলেই আমরা কাক্ষিত প্রজ্ঞা অর্জনে সক্ষম হবো, যে প্রজ্ঞার অনুরাগী বলে আমরা নিজেদের দাবি করি; কিন্তু এটা হবে জীবদ্দশায় নয়, মৃত্যুর পরে। কেননা আত্মা যখন দেহের সংস্পর্শে থাকে তখন তা বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভ করতে পারে না; যদি জ্ঞান আদৌ অর্জন করা যায়, তবে তা অবশ্যই মৃত্যুর পরে। আর এইভাবে দেহের নির্বুদ্ধিতা থেকে মুক্ত হয়ে আমরা বিশুদ্ধ হবে এবং বিশুদ্ধের সঙ্গে আমাদের সংলাপ হবে এবং আমরা সর্বত্র স্বচ্ছ আলোয় নিজেদের সম্পর্কে জানতে পারব, যে আলো সত্যের আলো ছাড়া অন্য কিছু নয়। কারণ অবিশুদ্ধ বিশুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে পারে না…আর দেহ থেকে আত্মার বিচ্ছিন্নকরণ ছাড়া বিশুদ্ধীকরণ আর কী?…আর এই বিচ্ছেদ, দেহ থেকে আত্মার মুক্তির নাম হলো মৃত্যু…আর প্রকৃত দার্শনিক-কেবল প্রকৃত দার্শনিকই-সর্বদা আত্মার মুক্তি অন্বেষণ করেন। কেবল একটি প্রকৃত মুদ্রাই রয়েছে, যার সঙ্গে সবকিছুর বিনিময় হওয়া উচিত, তা হলো প্রজ্ঞা।

দেখা যায় গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানের প্রবর্তকগণ প্রকৃত অর্থময়তার অধিকারী ছিলেন বলে এবং তারা অনেক আগেই যখন এ কথা গোচরীভূত করেছিলেন যে, পবিত্র না হয়ে, দীক্ষা লাভ না করে যে ব্যক্তি মৃত্যুলোকে প্রবেশ করবে, সে পড়ে থাকবে একটি জলাভূমিতে, আর, যে ব্যক্তি দীক্ষা লাভের পর, বিশুদ্ধ হবার পর সে জগতে প্রবেশ করবে, সে বাস করবে দেবতাদের সঙ্গে, তখন বলা উচিত হবে না যে তারা বাজে কথা বলেছিলেন। মরমি কথায় যেমন তারা বলেন, দেহধারীর সংখ্যা অনেক, কিন্তু মরমি মানুষের সংখ্যা অল্প, মরমি বা আধ্যাত্মিক শব্দটাকে আমি প্রকৃত দার্শনিক বলে বোঝাতে চাই। এই ভাষার পুরোটাই মরমি, অতীন্দ্রিয়। এবং তা এসেছে গুহ্য ধর্মানুষ্ঠানগুলো থেকে। শুদ্ধতা একটি অর্ষিক ধারণা, প্রাথমিকভাবে এর একটি আচারগত অর্থ আছে, কিন্তু প্লেটোর কাছে শুদ্ধতার অর্থ হলো দেহ ও দেহের চাহিদার দাসত্ব থেকে মুক্তি। মজার ব্যাপার যে প্লেটো বলেন, যুদ্ধ ঘটে অর্থের মোহের কারণে, আর অর্থের প্রয়োজন শুধু দেহের সেবার জন্য। এই মতের প্রথম অর্ধেকটা মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির মতো, কিন্তু দ্বিতীয় অর্ধেকটা একটি খুবই ভিন্ন রকম দৃষ্টিভঙ্গি। প্লেটো মনে করেন মানুষ অত্যন্ত অল্প অর্থে জীবনযাপন করতে পারে, যদি তার চাহিদাগুলো কমিয়ে ন্যূনতম করা হয়; সন্দেহ নেই এ কথা সত্য। কিন্তু তিনি আবার এও মনে করেন যে, দার্শনিককে কায়িক পরিশ্রম থেকে মুক্ত থাকতে হবে; তাহলে তাকে অবশ্যই অন্যদের সৃষ্ট সম্পদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হবে। খুবই দরিদ্র কোনো দেশে তাহলে কোনো দার্শনিক না থাকারই কথা।

পেরিক্লেসের যুগে এথেন্সের সাম্রাজ্যবাদের সুবাদে সেখানে এথেন্সবাসীর পক্ষে দর্শন পাঠ করা সম্ভব ছিল। মোটা দাগে বললে, বুদ্ধিবৃত্তিক পণ্য প্রচুর পরিমাণ বস্তুগত ভোগ্যসামগ্রীর মতোই ব্যয়বহুল এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরে একই রকম নির্ভরশীল। বিজ্ঞানের জন্য দরকার গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ ইত্যাদি এবং বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন অন্যান্য লোকেদের পরিশ্রমের সমর্থন। কিন্তু মরমির কাছে এই সবকিছুই অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা। ভারত বা তিব্বতে কোনো সাধক পুরুষের কোনো হাতিয়ারের প্রয়োজন পড়ে না, তিনি এক টুকরো কটিবস্ত্র পরেন, শুধু ভাত খান এবং সামান্য ভিক্ষায় তার চলে; ভিক্ষা তিনি পান, কারণ তাকে জ্ঞানী মনে করা হয়। প্লেটোর দৃষ্টিকোণের এটি যৌক্তিক দৃষ্টান্ত।

ফিরে যাওয়া যাক আবার ফিডোতে : মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে সেবেস সংশয় প্রকাশ করছেন, তিনি সক্রেটিসের কাছ থেকে যুক্তি চাইছেন। সেকেস তর্ক করেই চলেন, কিন্তু বলতেই হবে, যুক্তিগুলো খুবই দুর্বল। প্রথম যুক্তিটি হলো, যেসব বস্তুর বিপরীত রয়েছে সেগুলো সেই বিপরীত থেকে সৃষ্ট। এ কথা মহাজাগতিক ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে অ্যানাক্সিমেন্ডারের দৃষ্টিভঙ্গির কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবন আর মৃত্যু পরস্পরের বিপরীত; তাহলে, অবশ্যই একটি থেকে অন্যটার সৃষ্টি। এর মানে হলো মৃত ব্যক্তিদের আত্মা কোনো এক স্থানে অবস্থান করে এবং ঠিক সময়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। বীজের মৃত্যু না হলে তা গতি লাভ করতে পারে না-সেন্ট পল-এর এই বক্তব্য মনে হয় এ রকম কোনো তত্ত্ব থেকে এসেছে।

দ্বিতীয় যুক্তিটা হলো, জ্ঞান হচ্ছে স্মৃতি, সুতরাং জন্মের আগে থেকেই আত্মার অস্তি ত্ব আছে। জ্ঞান যে স্মৃতি, এই তত্ত্বটির সমর্থনে প্রধানত এই সত্যটি তুলে ধরা হয় যে যথার্থ সমতার মতো আমাদের কিছু ধারণা রয়েছে যা অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত নয়। মোটামুটি সমতার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। কিন্তু পরম সমতা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর মধ্যে কখনো দেখা যায় না, কিন্তু তার পরেও আমরা জানি পরম সমতা বলতে আমরা কী বুঝি। যেহেতু আমরা এটা কোনো অভিজ্ঞতা থেকে শিখিনি, তাই নিশ্চয়ই তা আমাদের পূর্ববর্তী অস্তিত্ব থেকে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। তিনি বলেন, অন্যান্য সব ধারণার ক্ষেত্রেও একই রকম যুক্তি প্রযোজ্য। এইভাবে বস্তুসার-এর অস্তিত্ব এবং আমাদের তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা জ্ঞানসম্পন্ন আত্মার পূর্ব-অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।

জ্ঞান হলো স্মৃতি-এই তর্ক বিশদভাবে উঠে এসেছে মেনোতে। এখানে সক্রেটিস বলছেন, শিক্ষা বলে কিছু নেই, আছে কেবল স্মৃতি। তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রমাণ করার জন্যে মেননকে দিয়ে এক বালক দাসকে ডেকে আনেন, সক্রেটিস বালকটিকে জ্যামিতিক সমস্যাবলির ওপরে প্রশ্ন করেন। বালকটির উত্তরগুলো শুনে মনে হয় যে সে আসলে জ্যামিতি জানে, যদিও এ যাবৎ সে অনবহিত ছিল যে এই জ্ঞান তার রয়েছে। মেনো এবং ফিডোতে একই সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে যে, একটি পূর্ববর্তী অস্তিত্ব থেকে আত্মা জ্ঞান নিয়ে আসে।

এ ব্যাপারে কেউ প্রথম লক্ষ করতে পারেন যে, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই যুক্তিটি একেবারেই খাটে না। বালক দাসটি, যদি সে ওই ঘটনাগুলোর সময় উপস্থিত না থাকে, স্মরণ করতে পারে না কখন পিরামিড নির্মিত হয়েছিল অথবা ট্রয় দখলের ঘটনাটি আসলেই ঘটেছিল কি না। যে ধরনের জ্ঞানকে পূর্বতঃসিদ্ধ বলা হয় বিশেষ করে লজিক ও গণিত-কেবল সেগুলোই অভিজ্ঞতানিরপেক্ষভাবে প্রত্যেকের মধ্যে বিদ্যমান থাকে বলে মনে করা সম্ভব। বস্তুত একমাত্র এই ধরনের জ্ঞানকেই (অতীন্দ্রিয় অন্তদৃষ্টি ছাড়া) প্লেটো প্রকৃত জ্ঞান বলে স্বীকার করেন। এখন দেখা যাক, গণিতের ক্ষেত্রে এই যুক্তিটি কীভাবে নেয়া যায়।

সমতার ধারণাটি নেয়া যাক। আমাদের অবশ্যই মানতে হবে যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলোর মধ্যে নিখুঁত সমতার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, আমরা শুধু মোটামুটি বা কাছাকাছি সমতা দেখতে পাই। তাহলে পরম সমতার ধারণায় আমরা কীভাবে পৌঁছি? অথবা, হয়তো আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই।

একটি নির্দিষ্ট উদাহরণ নেয়া যাক। ধরা যাক, প্যারিস নগরীতে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট শলাকার একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যকে এক মিটার ধরে নেয়া হলো। এখন অন্য কোনো একটি শলাকা সম্পর্কে আমরা যদি বলি যে, সেটার দৈর্ঘ্য ঠিক এক মিটার, তাহলে কী বোঝানো হবে? আমার মনে হয় না এ থেকে আমরা কিছু বুঝব। আমরা বলতে পারি : বর্তমানকালে বিজ্ঞানের জানা সর্বাধিক নির্ভুল পরিমাপ পদ্ধতিগুলো প্যারিসের ওই আদর্শ মিটার অপেক্ষা অন্য শলাকা বড় না ছোট তা দেখাতে অক্ষম। যথেষ্ট পরিমাণে হটকারী হলে আমরা আরো একটি ভবিষ্যদ্বাণী যোগ করতে পারি : পরিমাপ কৌশলের আরো যতই উৎকর্ষ সাধিত হোক না কেন, তা ওই ফলাফল বদলাতে পারবে না। কিন্তু এর পরেও এটা একটি অভিজ্ঞতাবাদী বক্তব্য, এই অর্থে যে, প্রায়োগিক প্রমাণ যেকোনো মুহূর্তে সেটাকে ভুল প্রমাণিত করতে পারে। আমার মনে হয় না পরম সমতার ধারণা আসলেই আমাদের আছে, যেটা আমাদের আছে বলে প্লেটো মনে করেন। আর যদি তা থেকেও থাকে, এটা স্পষ্ট যে, কোনো শিশু একটি নির্দিষ্ট বয়সে না পৌঁছা অবধি সেটার অধিকারী হয় না। আর সেটা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রকাশিত হয়, যদিও সরাসরি অভিজ্ঞতা থেকে উৎপত্তি লাভ করে না। পরন্তু, জন্মের আগের অস্তিত্ব যদি ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণগুলোর একটি না হতো, তাহলে আমাদের এই জীবন যেমন ওই ধারণাটি তৈরি করতে পারে না, তেমনি পূর্ব-অস্তিত্বও তা পারত না, আর যদি আমাদের পূর্ব-অস্তিত্বকে আংশিকভাবে অতীন্দ্রিয় বলে মনে করা হয়, তাহলে একই অনুমান আমাদের বর্তমান অস্তিত্ব সম্পর্কে করা যাবে না কেন? এই সব কারণে যুক্তিটি ব্যর্থ।

স্মৃতির মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠিত ধরে নিয়ে সেবেস বলছেন : যেটা প্রয়োজন ছিল, তার অর্ধেকটা প্রমাণিত হয়েছে; অর্থাৎ, আমাদের জন্মের আগে আমাদের আত্মার অস্তিত্ব ছিল-আর জন্মের আগে যেমনটি ছিল তেমনি মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্ব থাকবে-এই অর্ধেকটা এখনো প্রমাণ করা বাকি আছে। সে অনুসারে সক্রেটিস নিজেকে এ কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক বস্তু তার বিপরীত থেকে সৃষ্টি হয়-এ বক্তব্য থেকে ব্যাপারটি পরিষ্কার, তাহলে জীবন যেমন মৃত্যুর সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনি মৃত্যু থেকেও জীবনের জন্ম হয়। তবে তিনি এর সঙ্গে আরো একটি যুক্তি যোগ করেন, দর্শনে যেটার একটি দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। যুক্তিটা হলো, বিলুপ্ত হয় শুধু তা-ই যা জটিল, আর ভাবগুলোর মতো আত্মা সরল এবং তা অনেক অংশের সমন্বয়ে গঠিত নয়। মনে করা হয়, যা সরল তার শুরু শেষ বা পরিবর্তন থাকতে পারে না। তাহলে সারসত্তাগুলো পরিবর্তনীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পরম সৌন্দর্য সর্বদা একই থাকে কিন্তু সুন্দর বস্তুগুলো অনবরত পরিবর্তিত হয়। এইভাবে, দৃশ্যবস্তুগুলো পার্থিব, কিন্তু অদৃশ্য বস্তুগুলো শাশ্বত। দেহ দৃশ্য, কিন্তু আত্মা অদৃশ্য; সুতরাং আত্মাকে শাশ্বত বস্তুগুলোর শ্রেণিতে ফেলতে হবে। আত্মা শাশ্বত বলে তা শাশ্বত বস্তুগুলো নিয়ে, অর্থাৎ সারসত্তা নিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম; কিন্তু ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষণের মতো, আত্মা যখন পরিবর্তনশীল জগৎ নিয়ে চিন্তা করতে যায় তখন তা ব্যর্থ ও বিভ্রান্ত হয়। আত্মা যখন দেহকে প্রত্যক্ষণের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, অর্থাৎ, দৃষ্টি, শ্রুতি বা অন্য কোনো ইন্দ্রিয় (দেহের মারফতে প্রত্যক্ষণ বলতে ইন্দ্রিয়গুলো দ্বারা প্রত্যক্ষণ বোঝাতে) ব্যবহার করে, তখন তা দেহ দ্বারা পরিবর্তনশীল জগতের মধ্যে আনীত হয়…তখন আত্মা ভবঘুরে আর বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তার চারপাশে জগত্তা ঘুরতে থাকে, আত্মা মাতালের মতো হয়ে যায় যখন সে পরিবর্তনকে স্পর্শ করে।…কিন্তু যখন সে নিজের মধ্যে ফিরে আসে, তখন সে আবার চিন্তাশীল হয়ে ওঠে, তখন সে অন্য জগতে প্রবেশ করে; শুদ্ধতা, চিরন্তনতা, অমরত্ব আর অপরিবর্তনীয়তার জগতে প্রবেশ করে। শুদ্ধতা, চিরন্ত নতা, অমরত্ব, অপরিবর্তনীয়তা হলো আত্মার পরিজন, যখন আত্মা নিজের কাছে থাকে, যখন পরিত্যক্ত বা বাধাগ্রস্ত হয় না, তখন সে তার এইসব পরিজনের সঙ্গে অনন্তকাল ধরে বাস করতে পারে, তখন সে তার ভুল পথগুলো রুদ্ধ করে দেয় এবং অপরিবর্তনীয়ের সঙ্গে মিলে নিজেও অপরিবর্তনীয় হয়ে ওঠে। আত্মার এই অবস্থাকেই। বলে প্রজ্ঞা।

প্রকৃত দার্শনিকের আত্মা, যা এই জীবনে রক্ত-মাংসের সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি পেয়েছে, তা মৃত্যুর পরে অদৃশ্য জগতে প্রস্থান করবে এবং দেবতাদের সাহচর্যে পরম সুখে বসবাস করবে। কিন্তু অশুদ্ধ আত্মা, যা দেহকে ভালোবেসেছে, তা একটি ভূতে পরিণত হয়ে কবরের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে, অথবা চরিত্র অনুযায়ী তা গাধা, নেকড়ে বা বাজপাখির মতো প্রাণীর দেহে প্রবেশ করবে। একজন মানুষ, যিনি দার্শনিক না হয়েও সদগুণের অধিকারী, তিনি মৌমাছি বা ভীমরুল বা পিঁপড়া বা অন্য কোনো যূথচর বা সামাজিক প্রকৃতির প্রাণীতে পরিণত হবেন।

মৃত্যুর পরে শুধু দার্শনিকরাই স্বর্গে যাবেন। শুধু জ্ঞানের অনুরাগী ছাড়া অন্য কেউ-যে দর্শন পাঠ করেনি এবং যে তার প্রস্থানের সময় সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ হয়নি-দেবতাদের সান্নিধ্যে প্রবেশের অনুমতি পাবে না। এসব কাররেণই দর্শনের প্রকৃত সেবকরা ইন্দ্ৰিয়জ বাসনাকে পরিহার করে চলেন; কিন্তু তারা তা করেন এই জন্য নয় যে, তারা দারিদ্র্য ও অসম্মান ভয় পান, বরং এই জন্য যে, দর্শন আত্মাকে গ্রহণ না করা পর্যন্ত আত্মা প্রকৃত অস্তিত্বকে দেখতে পায় একটি কারাগারের গরাদের মধ্য দিয়ে, আত্মার নিজের ভেতরে বা নিজের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত অস্তিত্বকে দেখতে পায় না…আর কামনা-বাসনার কারণেই আত্মা নিজের বন্দিত্বের প্রধান সহযোগী হয়ে পড়েছে। দার্শনিক মিতাচারী হবেন কারণ প্রত্যেকটা আনন্দ ও ব্যথা একধরনের পেরেক, যা আত্মাকে দেহের সঙ্গে গেঁথে ও নিবন্ধ করে রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মা দেহের মতো হয়ে পড়ে এবং দেহ যেটাকে সত্য বলে দাবি করে আত্মা তা সত্য বলে বিশ্বাস করে।

এই পয়েন্টে এসে সিমিয়াস পিথাগোরাসের সেই মত উত্থাপন করেন যে, আত্মা হলো একটি ঐকতান এবং প্রশ্ন করেন, বাদ্যযন্ত্র যদি ভেঙে যায় তাহলে কি ঐকতান টিকে থাকে? উত্তরে সক্রেটিস বলেন, আত্মা ঐকতান নয়, কেননা ঐকতান জটিল, কিন্তু আত্মা সরল। পরন্তু, তিনি বলেন, আত্মা একটি ঐকতান-এই অভিমত আত্মার পূর্ব-অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যেটা স্মৃতির তত্ত্ব থেকে প্রমাণিত হয়েছে; কারণ বাদ্যযন্ত্রের আগে ঐকতানের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এরপর সক্রেটিস তার নিজস্ব দার্শনিক অবস্থানের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা খুবই আগ্রহোদ্দীপক, কিন্তু মূল যুক্তিটির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। তিনি ভাব বা ধারণার তত্ত্বটির বিশদ ব্যাখ্যা দেন এবং এই উপসংহার টানেন যে ভাব বা ধারণাগুলো অস্তিত্বমান এবং অন্যান্য বস্তুগুলো ভাবগুলোতে অংশ নেয় ও সেগুলো থেকে তাদের নাম পায়। অবশেষে তিনি মৃত্যুর পরে আত্মার পরিণতি বর্ণনা করেন; ভালো আত্মা যাবে স্বর্গে, মন্দ আত্মা যাবে নরকে, মাঝামাঝিরা যাবে শুদ্ধি স্থানে।

তার সমাপ্তি ও তার বিদায় বর্ণিত আছে। তার শেষ কথাগুলো হলো : ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াসের কাছে আমার একটি মোরগ ঋণ আছে। ঋণটা শোধ করার কথা কি আপনার মনে থাকবে? লোকেরা অ্যাসক্লেপিয়াসকে একটি মোরগ দিয়েছিল, যখন তারা একটি রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছিল, আর সক্রেটিস জীবনের ক্ষণস্থায়ী ব্যাকুলতা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।

ফিডোর শেষ কথা : তার যুগের সব মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন বিজ্ঞতম, ন্যায্যতম এবং সর্বোত্তম।

প্লেটো-বর্ণিত সক্রেটিস অনেক যুগ ধরে পরবর্তীকালের দার্শনিকদের কাছে একটি প্যাটার্ন ছিলেন। তার সম্বন্ধে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কী ভাবতে পারি? (আমি শুধু প্লেটোর অঙ্কিত ব্যক্তির কথা বলছি) তার উৎকর্ষাবলি সুস্পষ্ট। পার্থিব সাফল্যের ব্যাপারে তিনি উদাসীন, সে জন্য নিঃশঙ্কচিত্ত; আর তাই তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শান্ত, মার্জিত ও পরিহাসপ্রিয়। অন্য সব বিষয়ের চেয়ে তিনি যা সত্য বলে বিশ্বাস করেন, সে ব্যাপারেই তার মনোযোগ সর্বাধিক। তবে তার কিছু বিরাট ত্রুটি রয়েছে। তর্কের সময় তিনি অসৎ এবং সফিস্টদের মতো চতুর; আর নিরাসক্ত জ্ঞানানুসন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি যেমনটা তার বুদ্ধিকে ব্যবহার করেন, তার চেয়ে ব্যক্তিগত চিন্তার ক্ষেত্রে তা বেশি ব্যবহার করেন সেই সিদ্ধান্তগুলো প্রমাণ করবার জন্য, যেগুলো তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তার মধ্যে আত্মতৃপ্তি ও অভ্যঞ্জন ধরনের একটি কিছু আছে, যা একধরনের খারাপ যাজকদের কথা মনে করিয়ে দেয়। মৃত্যুর মুখোমুখি তার সাহস আরো লক্ষণীয় হতো, যদি তিনি এমন বিশ্বাস করতেন না যে দেবতাদের সাহচর্যে তিনি চিরন্তন স্বর্গসুখ ভোগ করতে যাচ্ছেন। তার পূর্বসূরি অনেকে যেমন ছিলেন, তিনি চিন্তাভাবনায় তেমন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ছিলেন না, কিন্তু তিনি তার নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সঙ্গতিপূর্ণ প্রমাণ করতে দৃঢ়নিশ্চিত ছিলেন। এটা সত্যের সঙ্গে প্রতারণা এবং দার্শনিক পাপগুলোর মধ্যে নিকৃষ্টতম। আমরা তাকে একজন মানুষ হিসেবে ঋষিদের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করতে পারি; কিন্তু একজন দার্শনিক হিসেবে, তাকে পাঠানো প্রয়োজন দীর্ঘদিনের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক শুদ্ধি স্থানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *