৩০. ক্লু

৩০. ক্লু

ভূমিকা আর উপসংহার যত ছোট হয়, ততই ভাল।

গোল টেবিল বৈঠক বসেছিল পুলিশ ডেরায়। চেয়ারপার্সন সেই পুলিশ পুঙ্গী। সিকিমি কন্যা। প্রশিক্ষণের দৌলতে তবর বড় নীরস। কিন্তু সেদিন সেই মুহূর্তে তার প্রোজ্জ্বল নয়ন তালিকায় যে বিজুলি দেখেছিলাম, তা আমার কর্মজীবনে দেখেছি বহুবার বহু সুন্দরীর চোখে। কিন্তু আমি যে ভীষ্ম, আমি অতিশয় কাঠখোট্টা নারস তরুবর। প্রেম-ট্রেম, বিয়ে-থা, সংসার-টংসার করার ব্যাপারে অতিশয় উদাসীন। আমি খুবই সাধারণ মানুষ। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে আমার তুলনা করা চলে। •াম বলে যাব? ক্ষমা করবেন আমার ধৃষ্টতার জন্যে। বিখ্যাত দার্শনিক কান্ট বিয়েই করেননি। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। ‘দ্য ডেক্লাইন অ্যাণ্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার’ বইটা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন লেখক এভোয়ার্ড গিব্বন কত বড় লেখক। অথচ পাত্রীর পিতা তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেননি লেখককে জামাই করবেন না বলে। ফলে, গিব্বন সাহেব অকৃতদার রয়ে গেছিলেন সারা জীবন। আমার জীবনের প্রথম দিকে প্রায় এই ধরনের একটা দাগা ছিল, তা অনেকেই হয়তো জানেন। কিন্তু হারবার্ট স্পেনসার? চিন্তার সাগরে ড়ুবে। থেকেই গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিলেন, ললনা-ছলনায় একদম ভুললেন না। বৈজ্ঞানিক নিউটন এমনই আত্মভোলা ছিলেন যে ভাবীপাত্রীকে বিয়ের কথা না বলে তার আঙুল দিয়ে তামাক খাওয়ার পাইপ খুঁচিয়ে সাফ করা শুরু করেছিলেন—বিয়ে আর হল।, উনিও সারা জীবনে বিয়ের চৌকাঠ আর মাড়াননি। বিয়ে-টিয়ের মধ্যেই যাবেন, এহেন ধনুর্ভঙ্গ পণ করে সাহিত্যিক ল্যাম্ব, শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, সঙ্গীত গুরু বিঠোফেন, ধর্মগুরু আলেকজাণ্ডার পোপ, লেখক লুই ক্যারল, জোনাথন সুইফট, কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান, হ্যান্স আণ্ডারসন, ভলতেয়ার, ম্যাকলে, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো এবং আরও অনেক জগতবরেণ্য পুরুষ। মালা বদলের কথা আজীবন ভাবেননি।

তাই, পুলিশ পুঙ্গবীর নয়ন বাণ আমাকে বিধতে পারেনি। তিনি যে মনের মতো পুরুষের পথ চেয়ে বসেছিলেন, তা জেনেছিলাম পরে। তখন আর আঁখির ভাষা প্রয়োগ করেননি, মুখের ভাষায় এই শর্মাকে কজায় আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি যে নিরুপায়। কবিতা বউদির ওই চোখেব শাসন মনে করলেই আমি পাথর হয়ে যাই।

যাগ গে, যাক গে, কথায় কথায় উপসংহার দীর্ঘ করে ফেলছি। কাজের কথায় আসা যাক।

পুলিশ পুঙ্গবীর ম্যাগনেটিক চাহনি এড়িয়ে গেছিলাম সে সিসের টুকরোর মতো। বলেছিলাম, ম্যাডাম, আপনার সায়েন্টিফিক ইনভেসটিগেশন ডিপার্টমেন্ট তাহলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে প্রমাণ পেয়ে গেছে?

পু—পু বললেন, ইয়েস, স্যার। কম্পিউটার ভেরিফিকেশন হয়েছে। সাদা ভানের নানান জায়গায় যে সব আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে বহু ফিঙ্গারপ্রিন্ট নাইজেলের। একদা যে ছিল সাউথ আফ্রিকার মোস্ট ড্রেডেড ক্রিমিন্যাল।

ইণ্টারন্যাশন্যাল পুলিশ তাকে খুঁজছিল?

ইউনাইটেড নেশনের ইণ্টারন্যাশন্যাল ওয়ারক্রাইম অ্যাক্ট অনুসারে।

পৃথিবীজোড়া সন্ত্রাসে যুক্ত বলে?

হ্যাঁ। কিন্তু, মিস্টার রুদ্র, আপনি তা জানলেন কী করে?

ম্যাডাম, আমি যে গোয়েন্দা। এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা গোয়েন্দা সংস্থা প্রেমচাঁদ ডিটেকটিভ এজেন্সির কর্ণধার প্রেমচাঁদ মালহোত্রা আমার কলেজ ফ্রেণ্ড। যা কিছু জেনেছি, তারই দৌলতে। সে যে সোর্স ইনফর্মেশন নিয়ে কাজ করে। আমার কেরামতি শুধু বুকের পাটা দেখিয়ে এখানে এসে বসা।

কিন্তু, আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, পুলিশ পুঙ্গবী—আপনি তো এসেছিলেন, ডোন্ট মাইণ্ড ফর মাই ফ্র্যাঙ্কনেস, মিসেস কল্পনা রে-চিটনিসের ফ্রেণ্ড হিসেবে।

এই কথায় আমার পাশের দু’জন আড়ষ্ট হয়ে গেছিল। তাদের একজন কল্পনা, অপরজন রবি।

সোমনাথকে এ ঘরে রাখা হয়নি। সে পাশের ঘরে গেমস ফ্রিক খেলছে। কালিকা রানির চাঁচাঁ চিল্লানি এ ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে।

আমি বললাম, ম্যাডাম, তাহলে একটু খুলে বলা দরকার। পুলিশ, উকিল আর ডাক্তারের কাছে কিছু গোপন করলে ফ্যাসাদে পড়তে হয়। আমি এখানে এসেছিলাম প্রিয়বন্ধু রবি রে’র স্পাই হয়ে।

স্পাই হয়ে! চারুনয়নার দুই চোখে দেখেছিলাম চকিত চমক। একই রিঅ্যাকশন দেখা গেল কল্পনার লবঙ্গলতিকা দেহসুষমায়। কাঠ হয়ে গেল নিমেষে।

আমি আয়েস করে এক টিপ নস্যি নিলাম। তারপর বললাম, দেখুন। ম্যাডাম, রবি আমার কলেজ ফ্রেণ্ড—যেমন প্রেমচাঁদ। শিক্ষাক্ষেত্রের ফ্রেণ্ডশিপ কখনও যায় না যায় কর্মজীবনে। এখন যা বলব, নিশ্চয় তা অফ দ্য রেকর্ড থাকবে?

ম্যাডাম বললেন, এ ঘরে ভিডিও ক্যামেরা বা টেপরেকর্ডার নেই। ঘরোয়া বৈঠক তো। স্বচ্ছন্দে বলুন।

আমি বললাম, কলকাতার শিল্পমেলা থেকে হিরের ডিম চুরি গেছিল—

হিরের ডিম!

হিরের কুচি বোঝাই অনিক্স পাথরের ডিম। তেহরান, পেশোয়ার থেকে আসত হিরের কুচি-চোরা পথে-খনি থেকে চোরাই হিরে—সেই হিরে পেশোয়ারের পাথর কারিগর ফোঁপরা ডিমে ভরে পাঠাত এমন এমন জায়গায়, যেখানে যেখানে রয়েছে টেররিজমের ঘাঁটি। টাকার বদলে হিরে! টেররিজম যাতে অব্যাহত থাকে।

ঈষৎ চমকালেন পুলিশ পুঙ্গবী—ও ইয়েস, এ রকম একটা ভাসা ভাসা মন্তব্য ‘ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে পড়েছিলাম বটে—

২০০২ সালের মার্চ সংখ্যায়?

তা হবে।… তারপর

ইনফরমেশনটা আমার বন্ধু প্রেমচাঁদের কাছেও ছিল। তার জাল পাতা গোটা পৃথিবী জুড়ে। সে জানত, পেশোয়ারের পাথর ডিম ঘুরে ঘুরে চলে আসবে এইখানে-নাইজেলের কাছে।

কেন?

নাইজেল যে হিরে এক্সপার্ট। হিরের খনির পাহারাদার ছিল। হিরে লোপাট করতে গিয়ে ধরা পড়ে। তাই তার মুখ দাগিয়ে দেওয়া হয় ছ্যাকা দিয়ে।

আই সি…, আই সি…

বদলা নেওয়ার জন্যে এই কারবারে নামে নাইজেল। ধর্মে সে খ্রিষ্টান। কিন্তু টেররিজম চালু রাখতে গেলে ক্যাশ কারেন্সি দরকার। তার দরকার টাকার। হিরে আনিয়ে তা ক্যাশ করে নেওয়া হতো। সে ঘাঁটি গাড়ে এখানকার রিসর্টে…

এক মিনিট। হিমাচল অঞ্চলে যে রমরমা রিসর্ট কারবার চলছে, সেখানেও কি আছে হিরের চোরা কারবার?

সরি ম্যাডাম, এ সব প্রেমচাঁদের সিক্রেট। সেখানে পর্নো ফিল্ম ভোলা হয় ঠিকই, বাকিটা উহ্য।

তাহলে বলুন, আপনি ম্যাডাম রে-চিটনিসের ওপর স্পাইগিরি করতে এলেন কেন?

কলকাতার শিল্পমেলায় হিরে চোর ছিল, সেখানকার একটা সংস্থা। তারা চায়নি সেই হিরে যাক টেররিস্টদের কাছে। সেই সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছিল রবি রে’র মাধ্যমে। সেই হিরে এখন রবির জিম্মায়। কাস্টডিতে বলতে পারেন, চোরের ওপর বাটপারি করেছিল রবি। পৃথিবীর মানুষের স্বার্থে। তাই মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে তার ছেলেকে কিডন্যাপ করে—ডিম সেই মুক্তিপণ—যা সে হাওয়া। করেছিল কলকাতার শিল্পমেলা থেকে।

সঙ্কুচিত চোখে, যে চোখ এমনিতেই সাইজে ছোট—তাদের আরও ছোট করে, আমার দিকে প্রায় নরুন চোখে চেয়ে রইলেন পুলিশ পুঙ্গবী।

আমি গ্রাহ্য না করে বলে গেলাম, কল্পনা হিরের জগতের মেয়ে। হিরের ওপর তার দুর্নিবার আকর্ষণ। সব মেয়েদেরই থাকে… না, না ম্যাডাম, আপনার যে আছে, তা বলছি না… তবে এই কল্পনার আছে… বলুক, ওর নেই? তাই চুরি করেছিল রবির প্রাণাধিক ছটা হিরে ভর্তি পাথরের ডিম।

কল্পনা যেন পাথর।

আমি চালিয়ে গেলাম, আমার বন্ধু এই রবি রে তামাম দুনিয়ার সবক’টা হিরের খনির সব খবর রাখে, হিরের বাজারগুলোর নাড়িনক্ষত্র নখদর্পণে রাখে, ঘরের বউকেও বেছে নিয়েছে হিরে মাজাঘযার জায়গা থেকে, দুজনেই দু’টুকরো হিরে, হিরে এদের ভালবাসে, এরাও হিরেদের ভালবাসে-আর বিরোধের সূত্রপাত সেই হিরে প্রেম থেকে।

আমি মঞ্চ অভিনেতার মতো ঈষৎ বিরতি দিলাম বাক্যস্রোতে। পরের কথাটায় শক্তির স্রোত বইয়ে দেব বলে। ওষুধ ধরে গেল। ঈষৎ ঝুঁকে বসলেন পু-পু। অকয়াৎ শিবনেত্র হয়ে গেল দেবা আর দেবী। মানে, রবি আর কল্পনা।

আমি সারেগামা স্বরে চলে গেলাম, ম্যাডাম, যে কোনও হিরের মধ্যে কসমিক এনার্জি ঠুসে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে, এমন আশ্চর্য এক সেট পাথরের ডিম বিয়ের যৌতুক পেয়েছিল রবি। প্রতিটা পাথরের ডিমের ফাঁপা গহ্বরে ছিল—এখনও আছে-এক-এক রঙের কুচি হিরে। কল্পনা, হিরের বাজারের মেয়ে কল্পনা চেয়েছিল, সেই সেট থাকুক তার কাছে। এ রকম যাজ্ঞা মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু, জহুরি দণ্ডপথ, যিনি এই হিরের ডিমের সেট আর মন্ত্র দান করেছিলেন রবিকে, পই পই করে নিষেধ করে গেছিলেন রবিকে—এমন দুর্বলতা যেন কখনও দেখানোনা হয়।

আবার বিরতি দিলাম বাক্যস্রোতে। আড়চোখে দেখে নিলাম কল্পনার মুখাবয়ব। সে মুখ রাঙা হয়ে গেছে। ফর্সা হয়ে গেছে। ফর্সা মেয়ে তো…।

বললাম, কল্পনা তাই স্বামীর অগোচরে আশ্চর্য হিরেদের খানকয়েক আত্মসাৎ করেছিল। পরিণাম, ডিভোর্স। কল্পনার হেথায় আগমন। আমাকে পিছনে লেলিয়ে দেওয়া। সেটা রবি একা করেনি, প্রেমচাঁদও আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিল-অফিসিয়াল চুক্তি—তার কাছে নেটওয়ার্ক খবর এনে দিয়েছিল, কলকাতার শিল্পমেলা থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া হিরের ডিমও যেতে পরে কল্পনার খপ্পরে—একই কারণে হিরে প্রেম, হিরে সঞ্চয়, হিরে দেখে ধ্যান।

স্ট্রেঞ্জ, ঈষৎ নাসিকাধ্বনি সহ বললেন পু—পু।

এক্সট্রিমলি, আমি বললাম অহীন চৌধুরি ঢঙে-কল্পনা অবশ্য হিরের চোরাচালানি আর টেররিস্ট গ্যাংয়ের পার্টনার নয়। কিন্তু পেশোয়ার থেকে অনিক্স পাথরের ডিম কলকাতার শিল্পমেলার মধ্যে দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল যাদের কাছে, ক্ষিপ্ত হয়েছিল তারা।

তাদেরই একজন এই নাইজেল? পু-পু বললেন মিহি গলায়।

ইয়েস, ম্যাডাম, ইয়েস। তাই তারা কল্পনাকে আর রবি রে-কে টাইট মেরে হিরে উদ্ধারের জন্যে সোমনাথকে কিডন্যাপ করে–টেলিফোনে মুক্তিপণ চায়… কী?

ডিম।

ওদের এই অ্যাকশন প্ল্যান অজানা ছিল আমার কাছে। কিডন্যাপিংয়ের একটা প্লাবন চলেছে ভারত জুড়ে—সেই প্লাবন যে সিকিমের এই গণ্ড পাহাড়ে আছড়ে পড়বে, এটা আঁচ করলে আমি আরও একটু সতর্ক হতাম। সোমনাথকে একলা ছাড়তাম না। আমার নজর ছিল কল্পনার দিকে। সে যেন টার্গেট না হয়—হিরে তো তার আগের স্বামীর কাছে-তার ছেলের কাছে তো নেই। ভুল করেছিলাম এইখানেই।

মানুষমাত্রই ভুল করে, মৃদুস্বরে সান্ত্বনা দিলেন পু-পু-শয়তানে করে না।

সত্যি কথা বলতে কি, পুলিশ পুঙ্গবীর এ হেন মৃদু বচন বিপুল স্বস্তিবোধ এনে দিল আমার মধ্যে। আমি বলে গেলাম-কিছু হিরে যার কাছে, চোখে চোখে রাখি তাকে, এই ছিল আমার গেমপ্ল্যান। কল্পনা ভেবেছিল উল্টো-বন্ধুর ডিভোর্সি বউয়ের দিকে নিশ্চয় নেকনজর দিয়ে চলেছি।

ঠিক এইখানে নিতান্তই বেরসিকের মতো গলা খাঁকারি দিয়ে বসল বন্ধুবর রবি রে। বললে, আমি কিন্তু তোকে ঠিক সেই রোলটাই প্লে করতে বলেছিলাম।

আমি বললাম, মাই ডিয়ার রবি রে, আগুনে হাত দিয়ে পুড়ে মরব নাকি? তবে হ্যাঁ, সেই আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিংয়ে তোর অ্যাকটিংটা হয়েছিল অনবদ্য-সোমনাথ কিডন্যাপড় হয়ে গেছে শুনে তুই মিসাইলের মতো এমন চার্জ করে বসলি আমাকে, যেন সত্যিই কল্পনাকে ক্যাচ করার জন্যে পথের কাঁটা সোমনাথকে ভ্যানিশ করে। দিয়েছি আমিই।

ঠোঁটের কোণে কোণে নিগৃঢ় হাসির মাকড়সা জাল ছড়িয়ে রবি বললে, হে বন্ধু, তুমি একাই অ্যাকটিং শেখোনি। স্কটিশ তুই ছিলিস হ্যালির ধুমকেতু, আমি ছিলাম–

পু-পু বললেন, কাট শর্ট! কাট শর্ট!

আমি বললাম, চেয়ার পার্সনের অর্ডার হয়েছে শর্টকাট করার। তবে হ্যাঁ, তোর মোস্ট ন্যাচারাল অ্যাকটিং আমাকে খুব বেদনা দিয়েছিল।

আহারে। বললে রবি।

পু-পু ফের মন্তব্য নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিলেন, আমি দক্ষিণ হস্ত শূন্যে তুলে বললাম, তিষ্ঠ ম্যাডাম। আমি চাইছি, কেসটাকে ট্র্যাজেডির দিকে না নিয়ে গিয়ে ইউনিয়নের দিকে নিয়ে যেতে।

হোয়াট ড়ু ইউ মিন?

কথায় বলে, অল সেপারেশনস এণ্ড ইন ইউনিয়ন। অ্যাণ্ড নাউ আই ওয়ান্ট দেম টু কাম টু এগ্রিমেন্ট।

টু বি রিইউনাইটেড?

টু অ্যাডজাস্ট ডিফারেন্সেস, হারমোনাইজ, অ্যাণ্ড লিভ টুগেদার-না, না, সেই লিভ টুগেদার নয়—টু লিভ অ্যাজ স্বামী অ্যাণ্ড স্ত্রী।

এটা কি একটা মিলন মন্দির।

ধরুন তাই। সব নাটকই যদি মিলনান্ত হয়, তাহলে জীবনটা কত মধুর হয় বলুন তো? আমরা একটা দৃষ্টান্ত রাখতে চাই, এই ডিভোর্স মহামারীর যুগে, ভুল করে যদি কিছু ভেঙে যায়, ভুল শুধরে নিয়ে তা জুড়ে নেওয়াই ভাল। ভালবাসার মেন্টিং পটে ভাঙা কাচও জুড়ে যায়। বিশেষ করে ওরা যখন এক চৈত্র মাসে একে অপরের চোখে নিজের নিজেদের সর্বনাশ দেখেছিল। প্রকৃত প্রেম তো তাকেই বলে। জ্বালায়, আবার জোড়া লাগায়।

পু-পু পুলিশি চোখে আমাকে জরিপ করতে করতে বললেন, আপনি কি অন্তর্যামী? থট রিডার? এই দুজন-রবি আর কল্পনাকে দেখিয়ে-এই দু’জন যদি এখনও প্রেমাসক্ত থাকেন, তাহলে এই লঙ্কাকাণ্ডটা বাঁধালেন কেন?

আমি টুকুস করে বলে দিলাম—অপরাধ নেবেন না, মেয়েরা একটু দ্রৌপদী-দ্রৌপদী টাইপের হয়—বিশেষ করে এই হাই-টেক যুগে সিলিকন বিউটি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা যখন চরমে উঠে বেশরমে পৌঁছে একটা হিড়িকে পর্যবসিত হয়েছে… ট্রয়য় ধ্বংস হয়ে গেল… লঙ্কাটঙ্কা পুড়ে ছাই হয়ে গেল… কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা… এই দ্রৌপদীর জন্যেই… হয়েছিল বলেই তো আমরা গীতা পেয়েছিলাম। উল্টে নিন গীতা-কে… ত্যাগী। একটু ত্যাগ করলেই সব পাওয়া যায়। বিশেষ করে ছেলের জন্যে সব বাবা, সব মা ত্যাগ করে এসেছেন যুগ যুগ ধরে। নইলে যে ছেলেরা সোশ্যাল প্রব্লেম হয়ে দাঁড়াবে। আমি সোমনাথকে ক্লোজলি ওয়াচ করেছি, ওর মনের নিঃসঙ্গতা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। মন্তেসরি। কি বলেননি, প্রথম দু’বছরই শিশুর মস্ত শিক্ষা সমাপ্ত হয়? ছ’বছরে বলতে গেলে জগত দর্শন করা হয়ে যায় মা আর বাবার মধ্যে দিয়ে। আর সোমনাথ? ঠিক ওই ছ’বছর বয়স থেকেই বাবাকে চোখের আড়ালে এনে ফেলল মায়ের চাপে। রবি, তোর বিবেক, তোর জাজমেন্ট, তোর পাওয়ার অফ অবজারভেশন, তোর ডিসিশন নেওয়ার ক্ষমতাতে আমি ঈর্ষা করি। সোমনাথের মুখ চেয়ে তুই কল্পনাকে কাছে টেনে নে। দেবর-বউদি সম্পর্ক থাকুক আমার সঙ্গে কল্পনার। তোরা এক হয়ে গিয়ে হিরে পাণ্ডাদের মেরে ঠাণ্ডা কর।

তাই হয়েছিল। পেশোয়ার থেকে আমদানি হিরে ভর্তি পাথরের ডিম গায়েব করেছিল বটে রবি এজেন্সি মারফত কলকাতার মরুদ্যানে, আমার এজেন্সি মারফতই তুলে দিয়েছিল জনহিতৈষী একটা সংস্থায়।

উপসংহারটা নাতিদীর্ঘ হয়ে গেল। সরি। আমি লেখক নই।

কী বলছেন? কল্পনার সঙ্গে আমার এখনকার সম্পর্কটা কি রকম?

মশায় পাঠক-পাঠিকা, আপনারা বড় বেশি জানতে চান। বড় বেশি কৌতূহলী। এ সব যে আমাদের প্রাইভেট ব্যাপার! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাকে দেখলেই এখনও কল্পনা তার সবুজ চোখ নাচায়, কথায় জলতরঙ্গ বাজায়, দেহ তরঙ্গে মণিপুরী নৃত্য দেখায়, মুক্তো দাঁতে বিদ্যুৎ ঝলসায়। রবি রে, আমার গ্রেট ফ্রেণ্ড রবি রে, তাই দেখে মুচকি মুচকি হাসে আর বলে, ও তোর বিয়ে দেবেই।

কিন্তু সে গুড়ে বালি!

 

আবার একটু উপসংহার

বেশ বুঝছি, পাঠক-পাঠিকারা উসখুস করছেন একটা বিষয়ের রহস্য কথা শুনতে। দণ্ডপথ হঠাৎ মারা গেলেন কেন?

মশায় পাঠক-পাঠিকা, মনে করে দেখুন, দণ্ডপথের ব্রহ্মতালুর কাছে নাছি উড়তে দেখা গেছিল। কেন জানেন? সেখানে রক্ত জমেছিল। সেই রক্ত এল কোত্থেকে? মাথায় পেরেক পোঁতা হয়েছিল। পেরেক কে পুঁতেছিল?

আমার কথাটি ফুরোল! …কি বলছেন? এখনও ফুরোয়নি? কে ঠুকে ঠুকে পুঁতে দিয়েছিল পেরেক? বড় পয়েন্টে প্রশ্ন করেন তো!

হ্যাঁ, কল্পনাই ঠুকে ঠুকে পুঁতে দিয়ে জান কাবার করে দিয়েছিল মহাত্মা। দণ্ডপথের। যাতে অন্য মেয়েগুলো রেহাই পায়। আমি কিন্তু তাই পই পই করে। বলে দিয়েছি রবিকে-খবরদার, কল্পনার সঙ্গে এক শয্যায় আর নয়। এক ঘরেও নয়। তোর ঔরসজাত পুত্রকে মানুষ করার জন্যেই তুই শুধু সঙ্গ দিবি তার গর্ভধারিণীকে—তার বেশি একদম নয়। নো বডি টাচ, নাথিং কিছু। তিব্বতের মন্ত্র দণ্ডপথের মধ্যে দিয়ে তোর কাছে এসে যেন লুপ্ত না হয়ে যায় ছেলেটাকে দিবি যথা সময়ে। সে বড় হোক, তুই এক বাড়িতে থাক—কিন্তু এক ঘরে নিশিযাপন আর নয়—ওই সবুজনয়না ত্রাটকযোগিনী খুনি ব্র্যাণ্ডেড রমণীর সঙ্গে।

কি বলছেন? পাথরের ডিম ছ’খানা কল্পনা ফিরিয়ে দিয়েছিল রবিকে? দিয়েছে… দিয়েছে… দিয়েছে… গুপ্ত সমিতিও ত্যাগ করেছে… ছেলের জন্যে।

আরও প্রশ্ন আছে? নাইজেলের রূপান্তর আমি জানলাম কী করে?

প্রেমচাঁদের দৌলতে। প্রেমচাঁদই আমাকে জানিয়ে রেখেছিল, সোর্স ইনফরমেশন দিয়ে জেনেছিল, সুবুদ্ধি মুসলিমরা সংঘবদ্ধ হয়ে উগ্রতা আর সন্ত্রাস রোধের চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্লোম সুফি এই সুবুদ্ধিদের একজন। নির্লোম কুবুদ্ধি নাইজেলকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। টেররিস্টদের হাত কাটা যাবে নাইজেলকে জেলে ঢোকাতে পারলে। সুফি তাই এসেছিল—প্রেমচাঁদের প্ল্যানে।

আপনাদের কৌতূহল এতক্ষণে নিশ্চয় মিটেছে? এবার তাহলে আমার ছুটি।

নমস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *