৩য় খণ্ড – ডাক্তার বসুর কথা

তৃতীয় খণ্ড।
(ডাক্তার বসুর কথা।)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

সেটী-মহল্লার ব্যাপার চুকিয়া গেলে গোবিন্দ বাবু কয়েক দিন মৌন ভাবাপন্ন হইলেন। নানা কারণে আমার শরীরও খারাপ হইয়া পড়ি; এইরূপে কয়েক দিন কাটিল।

একদিন দেখিলাম, তিনি তাহার শিশি-বোতল লইয়া বড়ই কাত রহিয়াছেন। তিনি কি করিতেছেন, তাহাই আমি আরাম কেদার অৰ্ধশায়িত অবস্থায় এক দৃষ্টে লক্ষ্য করিতেছিলাম। সহসা তিনি লক্ষ দিয়া উঠিয়া বঁড়াইলেন, আমিও উঠিয়া বসিলাম।, তিনি বলিলেন, ডাক্তার বাবু, এত দিনে আমার পরিশ্রম সার্থক

হল। আমি এক নূতন জিনিষ আবিষ্কার করেছি।

আমি বলিলাম, কি?

তিনি কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, এতদিন রক্ত পরীক্ষা করিবার ঠিক উপায় ছিল না। রক্তের দাগ পুরাতন হলে সেটা মানুষের রক্তের দাগ বা অন্য জানোয়রের রক্তের দাগ কি কোন ফলের রসের দাগ, তা ঠিক কবার উপায় ছিল না। অণুবীক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা করলে কতক কতক বুঝা যেত বটে, কিন্তু ঠিক হত না।

আমি। তা ঠিক, আমাকে পুলিশ-চালানী অনেক রক্তের দাগ পরীক্ষা করতে হয়েছে, কিন্তু অনেক চেষ্টায়ও ঠিক বলতে পারি নাই। আপনি কি আবিষ্কার করেছেন?

গোবিন্দ। আপনি ত জানেন যে, রক্তে দুটা জিনিষ আছে, একটা জলীয় ভাগ আর একটা রক্তের ভাগ। রৌদ্রে শীঘ্রই জলীয় ভাগটা উড়ে যায়, কেবল রক্তের ভাগটাতেই দাগ থাকে।

আমি। তা ত নিশ্চয়।

গোবিন্দ। কিন্তু মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ আর জানোয়ারের রক্তের বা অন্য কিছুর জলীয় ভাগ এক নয়।  

আমি। এ ত সকলেই স্বীকার করবে।

গোবিন্দ। তবে কোন উপায়ে যদি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ শিশিতে ধরিয়া রাখা যায়, তবে কোন রক্তের দাগের মত চিহ্ন দেখিলে ঐ জল একটু ঐ দাগের উপর ঢালিয়া দিলেই সেটা মানুষের রক্তের দাগ কিনা তখনই জানতে পারা যাবে। নয় কি?

আমি। যদি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ ধরে রাখতে পারা যায়, তা হলে মানুষের রক্তের দাগ যত দিনেরই হউক না, তা অবশ্যই ঐ জলীয় ভাগ ঐ দাগে দিলে নিশ্চয়ই জানতে পারা যেতে পারে।

দেখুন, বলিয়া গোবিন্দ বাবু একখানা রুমাল তুলিয়া ধরিলেন। দেখিলাম, তাহাতে রক্তের দাগের মত খানিকটা দাগ লাগিয়া আছে।

পরে তিনি  এই দেখুন, বলিয়া একখানি ছুরি নিজের একটা অঙ্গুলীতে অম্লানবদনে বসাইয়া দিলেন। ঝর ঝক্ করিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। তিনি সেই রক্ত একটা কাচের পাত্রে ধরিলেন। উহা হইতে একটা কাচের নল আর একটা কাচ-পাত্রে গিয়াছে। তিনি তখন যে পাত্রে রক্ত ছিল, উহার নীচে একটা বাতি জ্বালিয়া ধরিলেন। রক্ত হইতে ধূম নির্গত হইয়া নল দিয়া অপর কাচ-পাত্রে যাইতে লাগিল। তিনি ঐ কাচ-পাত্রের গায়ে শীতল জল দিতে লাগিলেন। তখন ঐ ধূমে ঠাণ্ডা লাগায় কাচ-পাত্রে জলে পরিণত হইতে লাগিল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই যে জল হল, এ জল কি মানুষের রক্তের জলীয় ভাগ নয়?

আমি। নিশ্চয়। এ জল অন্য কিছুর জলীয় ভাগ হতেই পারে না।

গোবিন্দ। আচ্ছা, এখন এই জল রুমালের রক্তের দাগে লাগাইয়া দেখা যাক্।

তিনি সেই জল ধীরে ধীরে রুমালের রক্তের দাগের উপর লাগাইতে লাগিলেন। আমি স্তম্ভিত ও বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, ঐ বহুকালের অস্পষ্ট দাগগুলি টাটকা রক্তের দাগ হইয়া পড়িল। বোধ হইল, যেন এইমাত্র কে ইহাতে রক্ত লাগাইয়া দিয়াছে।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, এখন কেউ কি বল্‌তে পারে যে, রুমালে মানুষের রক্তের দাগ ছিল না?

আমি। কারও সাধ্য নাই। আপনার নাম জগদ্বিখ্যাত হবে।

গোবিন্দ। তা হক আর নাই হক। এটা আগে আবিষ্কার হলে, যে সকল দুবৃত্ত খুনী এখনও নিশ্চিন্ত মনে পরের সর্বনাশ করে বেড়াচ্ছে, তারা ফাঁসী-কাঠে তাদের উপযুক্ত দণ্ড ইত।

 আমি। নিশ্চয়ই। আমি অনেক কেস জানি, যে রক্তের দাগ

গোবিন্দ। আমি এখন ভাবছি, এ আবিষ্কার দেখে রাম সিং, সূরযমল এণ্ড কোং কি বলবে?

আমি। যা আপনার নূতন হাতকড়ী দেখে বলেছিল।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া খুব উৎসাহের সহিত তাহার প্রিয় সেতার তুলিয়া লইলেন। বহুক্ষণ মনের আনন্দে সেতার বাজাইতে লাগিলেন। আমি নীরবে তাহার মধুর সেতারে গৌরারং শুনিতে লাগিলাম।

প্রায় অর্ধঘণ্টা পরে তিনি সহসা থামিলেন। বলিলেন, আপনি সেদিন না আমাকে কি জিজ্ঞাসা করবেন, বলেছিলেন?

আমি বলিলাম, , আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি বলেন যে এমন কি, কোন মানুষের ব্যবহারের জিনিষ দেখে আপনি সেই লোকের অনেক বিষয় বলে দিতে পারেন।

গোবিন্দ। কতকটা নিশ্চয় পারি বই কি।

আমি। এই ঘড়ীটা দেখে বলুন দেখি।

আমি তখনই আমার পকেট হইতে একটা পুরাতন রূপার ঘড়ী তাহার হাতে দিলাম। তিনি সেটি লইয়া বহুক্ষণ একমনে নাড়া-চাড়া করিতে লাগিলেন। আমি নীরবে বসিয়া রহিলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, আপনি এই ঘড়ীর ভূতপূৰ্ব্ব মালিকের বিষয় কিছু জাতে চান? কিন্তু এই ঘড়ী আপনার হাতে আসায় আপনি একে অয়েল করিয়েছেন, সাফ করিয়েছেন, সুতরাং ভূতপূৰ্ব্ব মালিকের অনেক চিহ্ন লোপ পেয়েছে।

আমি বলিলাম, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ঘড়ীটী পেয়ে যথার্থই অয়েল করিয়েছিলাম।

তিনি বলিলেন, তবুও আমি কিছু কিছু বলার চেষ্টা করব। এই ঘড়ীটা আপনার দাদার ছিল। তিনি এটা আপনার পিতার মৃত্যুর পর পান।

আমি হাসিয়া বলিলাম, ঘড়ীর পিছনে বি, সি, বি খোদা আছে দেখে এটা আপনি আন্দাজ করেছেন।

গোবিন্দ। আপনি ঠিক বলেছেন। বি তে বসু, কাজেই আপ নারই কেহ। ঘড়ীর উপরের তারিখে জানা যায়, এটা প্রায় পঞ্চাশ ষাট বৎসরের আগেকার তৈয়ারী। খোদাই অক্ষর তিনটিও সেই রকম পুরাণ। সুতরাং বুঝিলাম, ঘড়ীটা আপনার পিতার ছিল। ঠিক নয় কি?

আমি। হাঁ, তাই ঠিক।

গোবিন্দ। তার পর আপনি বলেন আপনি ঘড়ীটা পেয়েই অয়েল করেছেন। অয়েল বেশী দিনের নয়, কাজেই বোঝা যায়, আপনি ঘড়ীটা বেশী দিন পান নাই।

আমি। তাও ঠিক।

গোবিন্দ। সাধারণতঃ বাপের ঘড়ী-টড়ী বড় ছেলেই পেয়ে থাকে। আপনার কাছে শুনেছি, আপনার পিতা অনেক দিন স্বর্গারোহণ করে ছেন; সুতরাং তার মৃত্যুর পর ঘড়ীটা আপনার বড় ভাই পাতার পর আপনি পেয়েছেন। এই কি ঠিক নয়?

আমি। হাঁ।

গোবিন্দ। ভাল। তার পর আপনার বড় ভাই বড়ই অসাবধানী ছিলেন। তাহার পৃথিবীতে যশঃ মান ধন হবার কথা ছিল। কিন্তু স্বভাবের দোষে কখন তাহার অবস্থা ভাল ছিল, কখনও তিনি বড়ই কষ্টে পড়িয়াছিলেন। শেষে মদ খেয়ে তাহার মৃত্যু হয়। এই পর্যন্ত এই ঘড়ী দেখে জাতে পাছি।

আমি লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। বলিলাম, গোবিন্দ বাবু, আপনি কোন রকমে আমার অভাগা ভাইএর জীবনের সন্ধান জেনে এখন সেই কথা বলে আমাকে কষ্ট দিতে চান। এটা কি ভাল? আপনি কি বলতে চান যে, আপনি এই পুরণ ঘড়ী দেখেই এই সব জানতে পেরেছেন?

গোবিন্দ বাবু, আমার হাত ধরিয়া সাদরে আমাকে বসাইলেন। বলিলেন, ডাক্তার বাবু, আপনার প্রাণে যদি কোন কষ্ট দিয়া থাকি, তবে আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, অন্য কথা কি,আপনি আমার হাতে এই ঘড়ী দিবার পূর্বে আমি যথার্থই জানতেম না যে, আপনার কোন ভাই ছিলেন।

আমি বলিলাম, তবে আপনি কেমন করে এ সব কথা জানলেন? এ সমস্তই ঠিক কথা।

গোবিন্দ। স্থির হয়ে শুনুন। শুলেই বুঝতে পাবেন।

আমি। আমায় বুঝিয়ে দিন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

গোবিন্দ। আমি প্রথমে বলি, আপনার ভাই বড় অসাবধানী ছিলেন। ঘড়ীটা কত জায়গায় টোল খেয়েছে, ইহাতে কত জিনিষের দাগ রয়েছে,–যে লোক ভাল দামী রূপার ঘড়ী এমন অসাবধানে রাখতে পারে, সে লোক যে নিতান্ত অসাবধানী—তা বলা কি বড় কঠিন?

আমি কেবল ঘাড় নাড়িলাম। তিনি বলিলেন, তার পর ভিতর দিকার ডালায় চাটে দাগ আছে। মাড়োয়ারীদের কাছে কোন জিনিষ বাঁধা রাখলে, তারা এই রকম দাগ দেয়। এতে জালেম, আপনার ভাই চারবার এই ঘড়ী বাধা দিয়েছিলেন। এতে কি বোৰা যায় না যে, সময়ে সময়ে তার টাকার বড়ই অভাব হয়েছিল। আরও বছি যে, সময়ে সময়ে তার অবস্থা ভাল হয়েছিল, তা না হলে ঘড়ী খালাস করবেন কেমন করে?

আমি কি বলিব; নীরব হইয়া রহিলাম।

তখন তিনি বলিলেন,ঘড়ীর দম দিবার জায়গায় ভাল করে দেখুন। চাবী দিবার স্থানের চারিদিকে কত চাবীর আঁচড়ের দাগ পড়েছে। মাতাল না হলে ঘড়ীতে দম দিবার সময় তাহার এত হাত কাঁপে বা তিনি দম দেবার স্থান খুঁজিয়া পান না! যে লোক এত মদ খেত,তার তাতেই মৃত্যু হয়েছে বলা শক্ত নয়। এখন কি, এরূপ বলা শক্ত বলে মনে করেন? তাহার পর আরও দেখুন, ঘড়ীর উপর নীচে পিঠেও চাবীর গোচ্ছ, যা-তা আরও কত কি পূরেছেন-এ সকল লক্ষণ মাতালেই।

আমি বলিলাম, গোবিন্দ বাবু, আমাকে মাপ করুন,আমি আপনাকে চিনতে পারি নাই। বোধ হয় কেহই পারে নাই। আপনি যথার্থই অদ্ভুত লোক।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া সেতার তুলিয়া লইয়া বলিলেন, এখন একটা বেহাগ শুনুন।

কিন্তু এই সময়ে ডাকওয়ালা আসিয়া তাহার হাতে একখানি পত্র দিল। তিনি পত্রের খামখানি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া অবশেষে

অতি সাবধানে পত্রখানি খুলিলেন।

বিশেষ মনোযোগের সহিত পত্রখানি পাঠ করিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন; তৎপরে পত্রখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, পড়ুন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

আমি পত্রখানি পড়িলাম,

শ্রদ্ধাস্পদেযু–

কোন আত্মীয়ের নিকটে শুনিলাম, আপনি আমার পিতার সহপাঠী ও এক সময়ের বিশেষ বন্ধু। আমি শ্ৰীযুক্ত মনোহর কর মহাশয়ের একমাত্র কন্যা। আমার পিতা বহুকাল আগ্রায় বাস করেন। তিনি ডাক্তার ছিলেন; পরে আগ্রা হইতে বলী হইয়া আন্দামানে যান। তিনি ব্রাহ্ম, আমাকে ব্রাহ্ম-বালি-বিদ্যালয়ে রাখিয়া যান। পূর্বে আমার মাতার মৃত্যু হইয়াছিল। আমার পিতা ব্রাক্ষ বলিয়া, আত্মীয়-স্বজনের সহিত তাহার সম্ভাব ছিল না।

তিনি যখন আন্দামানে যান, তখন আমার বয়স বার-তের বৎসর। দুই বৎসর তাহার রীতিমত পত্র পাইয়াছিলাম; মাসে মাসে টাকাও পাঠাইতেন। তাহার পর একদিন তাহার পত্রে জানিলাম, তিনি দেশে আসিতেছেন। কিন্তু দুই বৎসর গেল, তাহার আর কোন সংবাদ নাই। তাঁহার যে কি হইল, অদ্যাপি তাহার কিছুই জানিতে পারিলাম না।

আমাদের আচাৰ্য মহাশয়ের নিকট আপনার প্রশংসা শুনিলাম। আপনি যে আমার পিতার বাল্যবন্ধু তাহাও শুনিলাম। আজ অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র লিখিতেছি। আপনি এই অনাথ পিতৃমাতৃহীনা বালিকার প্রতি এ দুঃসময়ে দয়া না করিলে, কে করিবে? আমি জানি, আপনি চেষ্টা করিলে নিশ্চয়ই আমার পিতার অনুসন্ধান হইবে।

যদি দয়া করিয়া একবার এখানে আসেন, তবে অন্যান্য সকল কথা জানাইতে পারি। আশা করি, অনুগ্ৰহ করিয়া আসিবেন। ইতি–

আপনার কন্যা
শ্ৰীমতী প্রতিভা দাসী।

আমি পত্র পাঠ করিয়া বলিলাম, কি করবেন?

গোবিন্দ। তাই ভাবছি।

আমি। এ রকম উপকার করা কর্ত্তব্য। এ নিরুদ্দেশ ভদ্র লোকের যদি কেউ সন্ধান করতে পারেন, তবে আপনিই পাবেন।

গোবিন্দ। আপনি এ কথা বিশ্বাস করেন?

আমি। যদি কেউ পারে, আপনিই পাবেন।

গোবিন্দ। এখন ত কিছুই জানি না।

আমি। এইজন্য এই বালিকার সঙ্গে আপনার দেখা করা কর্তব্য।

গোবিন্দ। আপনি যাবেন?

আমি গোবিন্দ বাবুর প্রশ্নে একটু বিস্মিত হইলাম। বলিলাম, আমি! আমি গিয়া কি করিব?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, আমার আর একটা ওস্তাদী দেখিতে পাইবেন।

আমি একটু ভাবিয়া বলিলাম, আমার এখানে থাকাও যা, আগ্রায় থাকাও তাই। আর একটা চেঞ্জও হবে, তাতে আরও উপকার হতে পারে।

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, আরও একটা উপকার হতে পারে; আপনি এখনও বিবাহ করেন নাই, এই প্রতিভাকে বিবাহ করুন না কেন?

আমি। আপনি ক্ষেপিলেন দেখছি। কোথায় এই বালিকা তার নিরুদ্দেশ পিতার জন্য দিন রাত কেঁদে মছে, আপনার শরণাপন্ন হয়েছে, আপনি কোথায় তার পিতার সন্ধান কবেন, না তার বিবাহ নিয়ে উপহাস করছেন।

গোবিন্দ। উপহাস নয়। ভবিতব্যের কথা কে বলতে পারে?

আমি সে কথা চাপা দিয়া বলিলাম, তবে কবে যাওয়া স্থির কলেন?

গোবিন্দ। আপনি কবে যেতে চান?

আমি। আমাকে যখন বলবেন, তখনই প্রস্তুত আছি।

গোবিন্দ। তবে শুভস্য শীঘ্রং। আজই—এখনই।

আমি। বেশ।

আমরা তখনই আগ্রা যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। রাত্রের গাড়ীতে রওনা হওয়াই স্থির হইল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আমরা আগ্রায় আসিয়া ব্রাহ্ম-বালিকাবিদ্যালয়ের সন্ধানে চলিলাম। সেটা প্রকৃত বিদ্যালয় নহে। এখানে যিনি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের কাৰ্য্য করিতেন, তিনি তাহার পরিবার মধ্যে একটি ছোট বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন। চার পাঁচটির অধিক ছাত্রী ছিল না। তাহার অবস্থা স্বচ্ছল না থাকায়, তিনি কয়েকটি বালিকাকে গৃহে থাকিতে দেওয়ায় তাহার অর্থের কিছু সহায়তা হইত। তাহার স্ত্রী বিদুষী ছিলেন; তিনিই শিক্ষয়িত্রীর কাজ করিতেন।

প্রতিভার পিতা নিরুদ্দেশ হইলে তাহার টাকা বন্ধ হইয়াছিল। এখন আচার্য্য মহাশয় তাহাকে নিতান্ত অনাথা দেখিয়া দয়া করিয়া গৃহে রাখিয়াছিলেন। তাহার পিতার সন্ধানের জন্য নিতান্ত যত্ন পাইতেছিলেন।

আমরা প্রথমে আচাৰ্য মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাদের উভয়কে বিশেষ সমাদর করিলেন। গোবিন্দ বাবুকে বলিলেন, আপনার প্রশংসা শুনে প্রতিভাকে আপনার আশ্রয় নিতে বলেছিলাম। আপনি তার পিতার বাল্য-বন্ধু। আপনি এই দুর্ভাগিনী বালিকার উপকার কলে, আমরা সকলেই আপনার চির ৰাধিত থাকব।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

তিনি বলিলেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি প্রতিভাকে এখানে আছি। তাহার মুখে শুলে আপনি সবই বুঝতে পারবেন।

তিনি উঠিয়া গেলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে এক পরম রূপবতী যোড়শী যুবতী সেই গৃহে প্রবিষ্ট হইলেন। তাহার অপরূপ রূপে গৃহ যেন প্রদ্যোতিত হইয়া উঠিল।

আচাৰ্য মহাশয় বলিলেন, এই আপনার বাল্যবন্ধুর কন্যা প্রতিভা। তৎপরে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন,ইনিই স্বনামখ্যাত গোবিন্দ বাবু—আর ইনি ইহার বিশেষ বন্ধু, ডাক্তার বসু।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তোমার পত্র পেয়ে কতক জানতে পেরেছি। কিন্তু তোমাকে আমার আরও কিছু জিজ্ঞাসা কবার আছে।

প্রতিভা বলিল, আপনি দয়া করে এসেছেন, এতে যে কত অনুগৃহীত হয়েছি তা

গোবিন্দ। (বাধা দিয়া) সে সব কথা এখন থাক,অনুগ্রহ-নিগ্রহের কথা পরে হবে। এখন যা জিজ্ঞাসা করি, তাই বল।

প্রতিভা। বলুন।

গোবিন্দ বাবু প্রতিভার সহিত এরূপ রূঢ়ভাবে কথা কহিতেছেন দেখিয়া, আমি বিশেষ দুঃখিত হইলাম।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

প্রতিভা ধীরে ধীরে এক পার্শ্বে আসিয়া বসিল। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বলিলেন, কোন তারিখে তোমার বাবা নিরুদ্দেশ হন, সে সম্বন্ধে তুমি কি জান?

প্রতিভা বলিল, দু বৎসর হল, কার্তিক মাসের পনেরই তারিখে বা তাঁর এখানে পৌছিবার কথা। সেই পৰ্যন্ত নিরুদ্দেশ।

তিনি পথে কোন্‌খানে নামবেন, বলেছিলেন?

হাঁ । লিখেছিলেন, যদি পারেন কাশী হয়ে আসবেন?

কেন? সেখানে কি তার কোন বন্ধু আছেন?

একজন ছিলেন। তিনি তাঁর বিশেষ বন্ধু শুনেছিলাম।

তার নাম?

হরিহর সরকার।

ইনি কি কাজ করতেন?

তিনি কমিশরিয়েটের গোমস্তা ছিলেন। শুনেছি, অনেক টাকা রোজগার করেছেন।

তার কাছে কোন সন্ধান নেওয়া হয়েছে?

প্রতিভা আচার্য্য মহাশয়ের দিকে চাহিল। তিনি বলিলেন, হাঁ, আমি নিজে কাশী গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম।

গোবিন্দ। তিনি কি বলেন?

আচাৰ্য। তিনি বলেন, কই মনোহর বাবু ত কাশী আসেন নাই। আসিলে নিশ্চয়ই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতেন।

গোবিন্দ। তার পর আর কিছু সন্ধান করেছিলেন?

আচাৰ্য। হাঁ, কোন সন্ধান পাই নাই।

গোবিন্দ। তিনি এখন কোথায়? আচাৰ্য। এক বৎসর হল মারা গেছেন। গোবিন্দ বাবু প্রতিভার দিকে চাহিয়া বলিলেন,তার পর।

প্রতিভা। এক বৎসর হল খবরের কাগজে আমার ঠিকানার জন্য কে একজন বিজ্ঞাপন দেন।

গোবিন্দ। যিনি বিজ্ঞাপন দেন, তার কোন ঠিকানা ছিল?

প্রতিভা। না, কেবল লেখা ছিল, ডাক্তার মনোহর কর, যিনি আন্দামানে চাকরী করিতেন, তাহার কন্যা এই সংবাদপত্রে তিনি এখন কোথায় জানাইলে, তাহার বিশেষ উপকার হইতে পারে।

গোবিন্দ। এই বিজ্ঞাপনের পর তোমার ঠিকানা কি কোন কাগজে ছাপান হয়?

আচাৰ্য মহাশয় বলিলেন, হাঁ, আমি ঠিকানা কাগজে ছাপাই।

গোবিন্দ। এই হরিহর বাবুর মৃত্যুর কতদিন পরে বিজ্ঞাপন বাহির হয়, তা কি জানেন?

আচাৰ্য। বোধ হয়, মাস দেড়েক পরে।

আবার গোবিন্দ বাবু প্রতিভাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তার পর কি কিছু ঘটেছিল?

প্রতিভা। হাঁ, তার পর প্রতি দু মাস অন্তর পার্শেল ডাকে এক একটা মুক্তা আমার নামে এসেছে। এই দেখুন।

এই বলিয়া প্রতিভা একটি বাক্স খুলিল। আমরা দেখিলাম, পাচটা বহু মূল্যবান্ মুক্তা তাহার ভিতর রহিয়াছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, পার্শেলের উপরের মোড়কগুলা আছে?

প্রতিভা। হাঁ, আছে। এই দেখুন।

গোবিন্দ বাবু বিশেষ করিয়া পার্শেলের মোক গুলি দেখিলেন, তৎপরে বলিলেন, তার পর আর কিছু হয়েছে?

প্রতিভা। এই চিঠী পেয়েছি।

প্রতিভা একখানি পত্র গোবিন্দ বাবুর হাতে দিল। আমরা পড়িলাম;

১৭ই তারিখে রাত ৯টার সময় তাজমহলের পশ্চিমদিকে থাকিয়ে। তোমার উপর যে অন্যায় ব্যবহার হইয়াছে,তাহার প্রতিকার করিব। যদি অবিশ্বাস হয়,কি ভয় হয়, তোমার দুইজন আত্মীয় বা শুভানু ধ্যায়ীকে সঙ্গে আনিয়ে। পুলিশের লোক আনিয়ো না, তাহা হইলে কাহারও দেখা পাইবে না। তোমারও কোন উপকার হইবে না।

গোবিন্দ বাবু পত্র ও খাম উভয়ই বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিলেন। তৎপরে আচাৰ্য মহাশয়কে বলিলেন, আপনি নিশ্চয় এর সঙ্গে যাচ্ছেন?

আচাৰ্য। আমি বুড়ো মানুষ,-আমাকে কেন? এখন যা করতে হয়, আপনি অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক করুন।

গোবিন্দ। এর যাওয়া নিতান্ত দরকার। দুইজন বন্ধু সঙ্গে নিতে বলেছে। আমি যাইব, আর আমার বন্ধুও আশা করি যাইবেন।

প্রতিভা আমার দিকে চাহিল।

আমি বলিলাম, আপনারা যদি বলেন, অবশ্যই যাইব।

গোবিন্দ বাবু প্রতিভাকে বলিলেন, আশা করি, আমাদের সঙ্গে যেতে তোমার কোন ভয় হইবে না।

প্রতিভা সলজ্জভাবে বলিল, আপনাদের সঙ্গে আমার যেতে ভয় কি? আপনি আমার পিতার বন্ধু।

গোবিন্দ বাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, তুমি যথার্থই আমার বন্ধুর উপযুক্তা কন্যা। আজ থেকে আমি তোমার পিতৃস্থানীয়।

এই বলিয়া গোবিন্দ বাবু পার্শেলের মোড়কের হাতের লেখা এবং পত্রের লেখা বিশেষ রূপে মিলাইয়া দেখিতে লাগিলেন,তৎপরে বলিলেন, যদিও পত্রের লেখা একটু বাঁকিয়ে লেখা হয়েছে, তবুও এই দুই লেখা যে একই ব্যক্তির, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। যা হক, কাল সন্ধ্যার পরই আমরা আস্ব। ঠিক হয়ে থেক।

প্রতিভা ঘাড় নাড়িল। আমরা আচাৰ্য মহাশয়ের নিকটে বিদায় লইয়া বাহির হইলাম।

পথে গোবিন্দ বাবু একটি কথাও কহিলেন না। বাসায় আসিয়া বলিলেন, এই মেয়ের বাপকে তারই পরম বন্ধু গোমস্তা মশায় খুন করেছেন।

শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। বললাম, বলেন কি?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, পরে দেখিবেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

পর দিবস সন্ধ্যার পরেই আমরা প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম। দেখিলাম, প্রতিভা প্রস্তুত হইয়া আছে।

আমরা উপস্থিত হইলে প্রতিভা বলিল, কাল আপনাদের একটা বিষয় দেখাতে আমি ভুলে গেছলেম।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কি?

প্রতিভা একখানা রেজিষ্টারী পত্ৰ গোবিন্দ বাবুর হাতে দিল। রেজিষ্টারী পত্ৰখানি ভোলা ছিল। গোবিন্দ বাবু পত্রখানি বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন।

প্রতিভা বলিল, বাবার যে দিন পৌঁছিবার কথা ছিল, ঠিক সেই দিন এই রেজিষ্টারী পত্ৰ তার নামে আসে। আমি সই করিয়া নিই। তার পর তিনি ফিরে না আসায় আমিই খুলেছিলাম।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন,এটা দেখছি, একটা বড় বাড়ীর রাফ, প্ল্যান, দেশী কাগজে আঁকা। অনেক ঘর, বারান্দা, উঠান আছে। এক জায় গায় একটা লাল কালির চিহ্ন আছে, তার ঠিক উপরে লেখা চার দিক হতে ৩৭ ফুট। নীচে উতে লেখা চারি সাক্ষর। তার পর ভিন্ন ভিন্ন হস্তাক্ষরে চারিটা নাম—আবদুল, দোস্ত মহম্মদ, হাজারিমল, কুমার সিং। এটা একটা দরকারী কাগজ সন্দেহ নাই, বলিয়া তিনি পত্রখানি যত্নে নিজ পকেটে রখিলেন। তৎপরে বলিলেন, আমাদের একটু আগে যাওয়া উচিত।

একখানা গাড়ী আনা হইল। আমরা তিনজনে গাড়ীতে উঠিলাম। আমরা শীঘ্রই তাজমহলে উপস্থিত হইলাম। কিন্তু সেখানে কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।

ঠিক নয়টার সময় একজন আমাদের নিকটে আসিয়া বলিল, আপনার নাম কি প্রতিভা দেবী? প্রতিভা হ, বলিলে সেই ব্যক্তি বলিল, এরা দুজন?

প্রতিভা। আমার আত্মীয়।

লোক। পুলিশ নয়?

প্রতিভা। না—দুজন লোক সঙ্গে যাবার কথা আছে।

লোক। জানি,—আসুন।

আমরা রাস্তায় আসিয়া দেখিলাম, একখানি গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। আমরা তিন জনে গাড়ীতে উঠিলে, সেই ব্যক্তি গাড়ীর কোচবাক্সে উঠিয়া গাড়ী হাঁকাইয়া চলিল। গাড়ী যে যে রাস্তা দিয়া চলিল, গোবিন্দ বাবু তাহা বিশেষ লক্ষ্য করিতে লাগিলেন।

নানা রাস্তা দিয়া গাড়ী চলিল। এই রূপে অৰ্দ্ধ ঘণ্টা চলিয়া একটি বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বালুগঞ্জ-জহর মলের বাড়ী।

গোবিন্দ বাবুর অবিদিত স্থান জগতে ছিল কি না সন্দেহ।

******

কোচম্যান নামিয়া গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল। আমরা তিন। অনে নামিলাম। দেখিলাম, বাড়ীটি বেশ সুসজ্জিত। প্রকোষ্ঠ পর প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিতে করিতে আমরা একটি প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলাম।

একটি বাঙ্গালী যুবক অগ্রবর্তী হইয়া বলিলেন, প্রতিভা দেবী?

প্রতিভা ঘাড় নাড়িলেন।

তখন তিনি বলিলেন, আমার নাম বরেন্দ্র নাথ দাস সরকার। হরিহর সরকার মহাশয়ের পুত্র-যমজ পুত্র। আমার এক যমজ ভাই আছে, তার নাম নরেন্দ্র নাথ সরকার। আমার স্বর্গীয় পিতা ঠাকুর আপনার স্বর্গীয় পিতা ঠাকুরের এক সময়ে বিশেষ বন্ধু ছিলেন। এ দুটি ভদ্রলোক কে?

প্রতিভা সলজ্জভাবে কহিলেন, আমার আত্মীয়।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, আমার নাম গোবিন্দরাম আদিত্য-ইনি ডাক্তার বসু।

বরেন্দ্র। বেশ-বেশ, খুব ভাল। তাই বলছিলাম, এঁর পিতা ঠাকুর নিরুদ্দেশ হয়েছেন।

গোবিন্দ। তা আমরা জানি।

বরেন্দ্র। সব জানেন না মহাশয়—সব জানেন না।

গোবিন্দ। কতক কতক জানি-জানি তিনি আপনাদের বাড়ীতে খুন বা গুম হয়েছেন।

প্রতিভা বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিল।

বরেন্দ্রে বাবু বলিলেন, দেখছি আপনি কতক কতক জানেন।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন,কতক কতক কেন, সব জানি।

বরেন্দ্র। বলুন–বলুন।

গোবিন্দ। জানি, আপনার পিতা তাকে খুন করেছেন।

এই অভূতপূর্ব কথা শুনিয়া প্রতিভা চমকিত হইয়া উঠিল। আমার বোধ হইল,যেন সে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে, কিন্তু মুহূর্ত মধ্যে প্রতিস্থা হইল। তাহার চক্ষু দুটী অশ্রুজলে ভরিয়া উঠিল।

গোবিন্দ বাবু এরূপ ভাবে এ কথা প্রতিভার সম্মুখে বলায় তার উপর আমার বড়ই রাগ হইল; অতি কষ্টে আত্মসংযম করিলাম। কিন্তু অনাথা প্রতিভার কষ্টে আমার বড় কষ্ট হইতে লাগিল।

বরেন্দ্র বাবু হাসিয়া বলিলেন, মহাশয়, তামাক খান,—আপনি কিছুই জানেন না। ওরে তামাক দে।

তাঁহার কথায় প্রতিভার ভগ্ন হৃদয় একটু আশ্বস্ত হইল। ব্যাকুল নেত্রে তাহার দিকে সে চাহিল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তবে আপনিই বলুন। আমি শুনিতে থাকি।

বরেন্দ্র। তাই ত বলতেই যাচ্ছিলাম—আপনি বাধা দেন কেন? গো

বিন্দ। বলুন।

বরেন্দ্র। বাবাও কমিসরিয়েটের গোমস্তাগিরী কাজে আন্দামানে যান। বছর দুই আগে তিনি হঠাৎ ফিরে আসেন; এসেই কাজ ছেড়ে দেন। উদরাময় রোগে তিনি অনেক দিন হতে ভুগছিলেন। তিনি অনেক টাকা রোজগার করেছিলেন; তার কোন অভাব ছিল না। অনেক টাকাও রেখে গেছেন।

গোবিন্দ। তা ত দেখতে পাচ্ছি।

বরেন্দ্র। আমার ভায়ের বাড়ী দেখলে আরও বুঝবেন। যা সে কথা, কিন্তু তিনি সুখী হতে পারেন নাই। সকল সময়েই যেন কিসের ভয়ে চম্‌কে চমকে উঠতেন। বিশেষতঃ কাঠের পা-ওয়ালা লোকের ওপর তার বড় ভয় ছিল। সকল সময়েই চাকরদের বলতেন,সাবধান, এ রকম লোক যেন বাড়ীতে না ঢুকতে পায়।

এমন সময়ে ভৃত্য তামাক আনিয়া গোবিন্দ বাবুকে দিল। বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, তামাক খান, মহাশয়।

গোবিন্দ বলিলেন, হুঁ খাচ্ছি–তার পরে?

বরেন্দ্র বাবু বলিতে লাগিলেন, বছর দুই আগে সহসা আন্দামা থেকে এক চিঠী পেয়ে তার ব্যাম বড় বেড়ে পড়ল। তিনি একদিন আমাদের দুজনকে ডেকে গোপনে বলেন, দেখ আমার আর বড় দেরী নাই, কিন্তু আমি মহাপাপী, আমার বন্ধুর ধনও আমি চুরি করেছি,আহা তার অনাথা কন্যার উপর বড় অবিচার করেছি। যে ধন তার পাওয়া উচিত ছিল, তার এক পয়সাও তাকে দিই নাই। বলে একছড়া বহুমূল্য মুক্তার মালা বার করে আমাদের দেখিয়ে বলেন, এই দেখ এই মুক্তার হার—তাকে পাঠিয়ে দেব বলে বার করেছিলাম, কিন্তু এমন লোভী আমি,এমনই পাপী আমি যে, প্রাণ ধরে দিতে পারি নাই? যে রকমে হক আমরা দুজনে প্রায় ক্রোড় টাকার জহরত পাই। আন্দামান হতে ফিরেই মনোহর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, কিন্তু—এই বলে বাবা মূর্চ্ছিতপ্রায় হলেন, তার বাবোধ হল, আমরা তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকৃতে ছুটলেম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বরেন্দ্রনাথ বাবু পুনরায় বলিতে লাগিলেন, ঘণ্টাখানেকের পর তিনি আবার কতকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তখন সকলকে বিদায় করে দিয়ে আমাদের দুজনের হাত ধরে বললেন, দেখ আমি এখন মৃত্যুশয্যায়। আমায় ছুয়ে ভগবানের কাছে শপথ কর যে, সেই ধনের অর্ধেক মনোহরের মেয়েকে দিবে। আমরা উভয়ে শপথ করলাম। তখন তিনি অতি কষ্টে বলতে লাগলেন, আমি ভগবানের নামে মৃত্যু সময়ে শপথ করে বছি যে, আমি মনোহরকে খুন করি নাই। সে এলে এই ধনের ভাগ নিয়ে আমাদের দুজনে বচসা হয়, সহসা মনোহর মূৰ্জিত হয়ে পড়ে যায়। আমি তাড়া তাড়ি তাকে তুলতে গিয়ে দেখি, তার মৃত্যু হয়েছে। আমি জানতেম, তারহৃদরোগ ছিল। হঠাৎ রাগ হওয়ায় মৃত্যু ঘটেছে।

পিতার মৃত্যু সংবাদ পাইয়া প্রতিভা আকুল হইয়া কঁদিয়া উঠিল। আমি নানারূপে তাহাকে সান্ত্বনা করিবার চেষ্টা পাইতে লাগিলাম। এই পিতৃশোক-কাতরা পরারুদ্যমানাকে কিরূপে আমি সান্ত্বনা করিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। তাহার হাত দুখানি আমার হাতে লইলাম। সেই সকরুণ দৃশ্যে আমারও চক্ষুদ্বয় অপূর্ণ হইয়া উঠিল। কিন্তু কি কঠিন-হৃদয় গোবিন্দ বাবু! তাহার চক্ষু সম্পূর্ণ নিরশ্রু। অষ্টম বর্ষীয় বালক যেমন আগ্রহপূর্ণ নত্রে বিচিত্রগল্পকারী মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, গোবিন্দ বাবু ঠিক তেমনই ভাবে বরেন্দ্র বাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, তারপর?

বরেন্দ্র বাবু বলিতে লাগিলেন, ভয়ে আমার সর্ব শরীর কাপতে লাগল। আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই আমাকে খুনী পুলিশে ধবে। তখন আমার বিশ্বাসী চাকরকে ডেকে সেই গভীর রাত্রে আমরা দুজনে মনোহরের সেই মৃতদেহ মাটির নীচে পুতে ফেলেম। ও কে—কি ভয়ানক! কে আছ—রক্ষা কর—রক্ষা কর–বলে সহসা বাবা জানালার দিকে চেয়ে ভয়ানক চীৎকার করে উঠলেন। আমরা দেখলেম, একটা দাড়ীওয়ালা বিকট মুখ জানালা দিয়া উঁকি মারূছে। আমরা ছুটে বাহিরে গেলাম, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না। ফিরে এসে দেখি, বাবার মৃত্যু হয়েছে।

বরেন্দ্র বাবু পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া চোখের জল মুছিলেন। তাহার পর নীরবে তামাক টানিতে লাগিলেন।

গোবিন্দ বাবু কি ভাবিলেন জানি না। আমি কিন্তু, বরেন্দ্র বাবু নীরব হওয়ায় বিশেষ সন্তুষ্ট হইলাম। আমি নানারূপে সান্ত্বনা করিয়া প্রতিভাকে কতকটা প্রকৃতিস্থ করিলাম। কিন্তু গোবিন্দ বাবু পাষাণ হতেও পাষাণ, তিনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করুলেন, তার পর? যেন এখনই সবটা না শুনিলে তাহার সর্বনাশ হইবে।

বরেন্দ্র বাবু, শটকার নল পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, মনোহর বাবুর মৃত্যুর পর বাবা কাশীর বাড়ী ছেড়ে আগ্রায় বেলেন-বাজারে এসে বাস করেন। আমরা দু-ভাইও তার সঙ্গে ছিলাম। এইখানেই ঝবার মৃত্যু হয়। তাহার সৎকার করে এসে দেখি, বাবার যে ঘরে মৃত্যু হয়েছে, সেই ঘরের সব জিনিষ কে ওলট-পালট করেছে, কিন্তু কিছু চুরি করে নাই। তবে দেখলেন, তার বিছানার ওপর কে এক থানা কাগজ রেখে গেছে; তাতে উর্দ্দুতে লেখা;

চারি সাক্ষর।

গোবিন্দ বাবু বলিয়া উঠিলেন, আমিও ভেবেছিলাম তাই।

আমরা সকলেই বিস্মিত-হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম, তিনি সে বিষয়ে লক্ষ্য না করিয়া বলিলেন, হাঁ, তার পর?

বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, বাবার মুখে এই গুপ্ত ধনের কথা আমরা শুনেছিলাম, আমরা কাশীর বাড়ী আর এখানকার আগ্রার বাড়ী তন্ন তন্ন করে খুঁজলেম, কিন্তু কোন সন্ধানই পেলেন না। তখন যদিও আমার ভাই কিছুতেই রাজী হল না,তবুও আমি সেই মুক্তার হার একে দিতে প্রতিজ্ঞা করলেম। একে সহজ ভাবে দিলেকে কি বলে অথবা ইনি নেন কি না নেন, এই ভেবে আমি কাগজে এর ঠিকানার জন্য বিজ্ঞাপন দিলেম।

গোবিন্দ। তা আমরা জানি।

বরেন্দ্র। এঁর ঠিকানা পাবার পর একেবারে হারটা পাঠিয়ে দিলে পাছে কে কি সন্দেহ করে, এই ভেবে দুমাস অন্তর এক-একটা মুক্ত পাঠিয়ে দিতে লাগলেম!

গোবিন্দ। দেখছি আপনি বড় সহৃদয়। প্রতিভা নিশ্চয়ই আপনার নিকট চির-বাধিত থাকবে। তার পর সে গুপ্ত ধনের সন্ধান আপনারা কি কিছু পেয়েছেন?

বরেন্দ্র। সেই কথাই ত হচ্ছে।

গোবিন্দ। বলুন, আমরা শোনবার জন্য উৎসুক আছি।

বরেন্দ্র। আমি ধনের কথা একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার ভাইটি সে ছেলে নয়। সে তন্ন তন্ন করে বাড়ী খুঁজে শেষ ছাদের উপর একটা ছোট চোর-কুরীতে বার করে। নীচের দিকে ছাদ খুড়লে সে জহরতের সিন্দুক দেখতে পায়। তার পর নীচে নাবিয়ে নিয়ে আসে।

গোবিন্দ। তার পর?

বরেন্দ্র। তার পর আমি বলি, দেখ এর অর্ধেক আমাদের নয়। আমরা বাবার মৃত্যুশয্যায় শপথ করেছি, মনোহর বাবুর মেয়েকে অর্ধেক দিব। এতে আর দেরী করা আমাদের ভাল নয়। সে বলে, এ ধন আমি খুঁজে বার করেছি, এর এক পয়সাও কাকেও দিব না। এই নিয়ে আমাদের দুজনের ভারি ঝগড়া হয়। তার পর আমি বিরক্ত হয়ে বাড়ী ছেড়ে এসে এখানে এই বাড়ী ভাড়া করে আছি।

গোবিন্দ। আপনি মহৎ লোক।

বরেন্দ্র। না—এতে মহত্ত্বের বিশেষ কিছু নাই। বাবার মরবার সময় শপথ করেছিলাম। যেমন করে হয়, একে তার অর্ধেক দিব।

গোবিন্দ। এ জহরতের দাম কত হতে পারে?

বরেন্দ্র। ভায়া আন্দাজ করেন ক্রোড় টাকার উপর। বাবাও তাই বলেছিলেন।

গোবিন্দ। তিনি এ জহরত কোথায় পেয়েছিলেন, তা কিছু আপনি জানেন?

বরেন্দ্র। কিছুই না।

গোবিন্দ। এখন কি করতে চান?

বরেন্দ্র। এখন আপনারা এসেছেন। এখনই তার সঙ্গে দেখা কব। এখন ভয়ে দেবে।

সেই রাত্রেই তার সঙ্গে দেখা করা স্থির হইল। প্রায় রাত্রি এগারটার সময় আমরা চারি জনে তাহার বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম।

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

অনেক ঠেলাঠেলির পর একজন চাকর আসিয়া দরজা খুলিয়া। দিল। বরেন্দ্র বাবু বলিলেন, ব্যাটারা সব মরে আছে? ছছাট বাবু কোথায় রে?

চাকর। হুজুর, ছোট বাবু তার ঘরে আছেন।

বরেন্দ্র। চল্ ব্যাটা, আলো দেখিয়ে চল্।

আমরা সকলে উপরে চলিলান। বরেন্দ্র বাবু অগ্রে অগ্রে যাইতে ছিলেন,—তিনি একটা ঘরের দ্বারে আসিয়া ধাক্কা মারিলেন। দ্বার রুদ্ধ। তিনি আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আর ত কোন কাজ নাই, এখন ভায়া আমার প্রত্যহ রাত্রে দরজা দিয়ে জহরতের ফন্দ করেন আর দাম কসেন। বেশী করে ধাক্কা মাতে হল দেখছি।

কিন্তু দ্বারে পুনঃ পুনঃ ধাক্কা দিতেও কেহ দ্বার খুলিল না—কোন উত্তর দিল না। তখন বরেন্দ্র বাবু দরজার একটা ছিদ্র দিয়া গৃহের ভিতর কি হইতেছে, দেখিতে চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু তিনি সহসা এমনই চীৎকার করিয়া পশ্চাৎ পদ হইলেন যে, আমরা সকলেই চমকিত হইয়া উঠিলাম। গোবিন্দ বাবু অগ্রসর হইয়াছিলেন,—ছিদ্রে চক্ষু দিলেন, তৎপরে বলিলেন, দরজা ভাঙতে হবে।

তাহার শরীরে অসীম বল। কবটের উপরে পৃষ্ঠ স্থাপন করিয়া তিনি এমনই বল প্রয়োগ করিলেন যে, মহা শব্দে দরজা ভাঙিয়া গেল।পরক্ষণে যে দৃশ্য সম্মুখে দেখিলাম, তাহাতে আমার শিরায় শিরায় শোণিত ছুটিল। প্রতিভা মূর্চ্ছিত হইয়া ভূপতিত হইতেছিল, আমি তাহাকে ধরিয়া ফেলিলাম।

 দেখিলাম, এক ব্যক্তি চেয়ারে বসিয়া আছে। তাহার দেহ অসাড় নিস্পন্দ, নিশ্চয়ই বহুক্ষণ তাহার মৃত্যু হইয়াছে। তাহার চেহারা ও বরেন্দ্র বাবুর চেহারা এমনই এক যে, আমি প্রথমে ভীত ও স্তম্ভিত হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম। তিনিও শুন্তিতভাবে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কাঁপিতে লাগিলেন।

সহসা বরেন্দ্র বাবু বলিয়া উঠিলেন, কে এমন সৰ্ব্বনাশ করে গেল! নরেনের মন ভাল ছিল না বটে, একটু লোভী, কিন্তু সে এদিকে লোক বড় ভাল ছিল! কে এমন সৰ্ব্বনাশ করিল। তৎপরে তিনি গোবিন্দ বাবুর দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, মশায় দেখুন, অরতের সিন্দুকটাও চুরি করে নিয়ে গেছে।

বরেন্দ্র বাবু বংশপত্রের ন্যায় কঁপিতে ছিলেন। কঁপিতে ঝাপিতে অস্পষ্ট স্বরে বলিলেন, আপনারা জানেন, আমি এর কিছুই। জানি না। কিন্তু এখন পুলিশে কি তা শুনবে? তারা ভাববে আমিই ধনেয়, লোভ নিজের ভাইকে খুন করেছি?

গোবিন্দ বাবু তাহার সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া আমাকে বলিলেন, ডাক্তার বাবু, প্রতিভাকে এখানে রাখা আর উচিত নয়; আপনি একে এর বাড়ী পৌছাইয়া আসুন। সেই গাড়ীতেই আপনি যেন এখন এখানে ফেরেন।

আমি বলিলাম, এখনই আসিতেছি।

গোবিন্দ বাবু তখন বরেন্দ্র বাবুর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, যদি বাঁচতে চান, তবে আপনিও এদের গাড়ীতে কোতোয়ালীতে এখনই যান, সেখানে গিয়ে খুনের খবর দিন। তাদের তদন্তে এখন আপনি সাহায্য না করলে তারা আপনাকে আরও সন্দেহ করবে।

বরেন্দ্র বাবু কম্পিত কলেবরে বলিলেন, আপনি যা বলবেন, তাই কব। আপনি আমাকে এ বিপদে রক্ষা করুন।

গোবিন্দ। যান, এখনই যান।

আমি অর্ধ-মূর্চ্ছিতা প্রতিভাকে ক্রোড়ে করিয়া লইয়া গাড়ীতে উঠিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বরেন্দ্র বাবুও আসিয়া গাড়ীতে উঠিলেন। তাহাকে কোতোয়ালীতে নামাইয়া দিয়া আমরা প্রতিভার বাড়ীর দিকে চলিলাম।

আমি নানারূপে প্রতিভাকে প্রকৃতিস্থ করিতে চেষ্টা পাইতে লাগিলাম। ভয়ে, বিস্ময়ে, উত্তেজনায় প্রতিভা প্রায় আমার বুকের ভিতর লুকাইয়াছিল। আমি বলিলাম, প্রতিভা, তোমার কি ভয় করছে?

প্রতিভা বলিল, না, আপনার কাছে থাকলে আমার ভয় করে না।

তাহার পর আমরা দুজনে কত কথা কহিলাম। কি কহিলাম, তাহা এখন আমার মনে নাই। তবে এইটুকু আমার বেশ মনে আছে যে, আমি বড়ই সুখে ও বিমল আনন্দে সে সময়টা কাটাইয়াছিলাম। আমি প্রতিভাকে নামাইয়া সেই গাড়ীতেই আবার সত্বর আসিয়া গোবিন্দ বাবুর সহিত মিলিলাম। দেখিলাম, তিনি গৃহটি বিশেষ রূপে লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছেন। তখনও পুলিশের কেহ আসে নাই।

তিনি আমায় দেখিয়া বলিলেন,আসুন ডাক্তার বাবু, আমরা দুজনে একবার এই ঘরটা ভাল করে দেখি। পুলিশ বাহাদুরেরা যে ভোরের আগে এখানে পদার্পণ করেন—এ বিশ্বাস আমার নাই; তাঁদের কুষ্টিতে তা লেখেও না।

প্রথমেই গোবিন্দ বাবু আমাকে মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে বলিলেন। আমি দেখিলাম, মৃতদেহের জামার বুকে একখানি কাগজ অটা, তাহাতে লেখা সেই ভয়াবহ কথা;–

চারি সাক্ষর।

আমি বলিলাম, এ সব কি?

গোবিন্দ। খুন। এইদিকে দেখুন।

দেখিলাম মৃতদেহের ঠিক স্কন্ধের উপর একটি ক্ষুদ্র তীর বিদ্ধ রহিয়াছে। আমি সেটায় হাত দিতে উদ্যত হইলে গোবিন্দ বাবু সচকিতে বলিয়া উঠিলেন, হাত দেবেন না—হাতে দেবেন না, নিশ্চয়ই এটা বিষাক্ত তীর। দেখছেন না, লাসের ভাব?

আমি। হাঁ, নিশ্চয়ই বিষে ইহার মৃত্যু হয়েছে।

গোবিন্দ। এখন দেখা যাক্, কে খুন করেছে।

তিনি গৃহের চারিদিক আমাকে দেখাইয়া বলিতে লাগিলেন, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল, জানালাও তাই। জানালা দিয়ে কোন রকমে কারই ঘরের ভিতর আসবার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু তবুও কোন লোক জানালা দিয়ে উঠেছে; ওই দেখুন তার পায়ের দাগ; আবার এই দেখুন, গোল গোল ছোট ঘোট কাদার দাগ, এক জায়গায় নয়—সমস্ত ঘরময় আছে।

আমি। এ কিসের দাগ?—বোধ হয়, মোটা রকম লাঠীর।

গোবিন্দ। তা নয়, তবে এই দেখুন পায়ের দাগের পাশেই গোল গোল দাগ, কাজেই লোকটার।

আমি বলিয়া উঠিলাম, তবে নিশ্চয়ই একটা কাঠের পা ছিল।

গোবিন্দ। সেই কাঠের পায়ের এক-পেয়ে লোক।

আমি স্তম্ভিত হইলাম।

নবম পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলেন, বিনা সাহায্যে জানালা খুলে এ ঘরে প্রবেশ করা যায় না, সুতরাং দুজন লোক ছিল।

আমি বলিলাম, তা নিশ্চয়ই।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এই এখানে একটা বড় দড়ী পড়ে আছে। কেউ এ ঘর থেকে জানালা দিয়ে দড়ীটা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মহাশয় দড়ীটা ধরে এই ঘরে এসে, এই লোকটাকে খুন করে। তার পর জহরতের সিন্দুকটা দড়ীতে বেঁধে নীচে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তার পর নিজেও দড়ী ধরে নেমে গেছে। এত তাড়াতাড়ি নেমেছে যে, হাতের চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল। এই দেখুন, দড়ীতে রক্তের দাগও রয়েছে।

আমি বলিলাম, কিন্তু কে দড়ী ঝুলিয়ে দিয়েছিল, এখন সেই কথা। সে কেমন করে এই ঘরে প্রবেশ করলে?

ছাদের যে ছিদ্র দিয়ে জহরতের সিন্দুক এই ভদ্রলোক নামিয়ে ছিলেন,—সেই পথেই এক-পেয়ের বন্ধুর আবির্ভাব হয়েছিল।

খুব সম্ভব। আবার আর কোন পথ নাই।

এখন দেখা যাক, ইনি কে, বলিয়া গোবিন্দ বাবু বিশেষ করিয়া গৃহতল পরীক্ষা করিতে লাগিলেন; তৎপরে টেবিলের উপর দাড়াইয়া হাতের জোরে ছাতের ছিদ্র দিয়া উপরের চোর-কুটরীতেআসিলেন। আমাকে ইঙ্গিত করায় আমিও সেই রূপে উপরে আসিলাম। দেখিলাম, সেই চোর-কুটাতে একটি ছোট ঘুলঘুলি আছে। উহার ভিতর দিয়া কোন ছোট বালক বা বালিকা ঘরে সহজে প্রবেশ করিতে পারে।

গোবিন্দ বাবু সেই ঘরের ধূলায় পায়ের দাগ আমাকে দেখাইলেন। আমি বলিয়া উঠিলাম, এ যে খুব ছোট ছেলের পায়ের দাগ। কি ভয়ানক।

গোবিন্দ বাবু মন্তকান্দোলন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ভয়ানক কিছুই নয় ডাক্তার বাবু,ভয়ানক কিছুই নয়; সংসারে সবুই সম্ভব। পরে দেখতে পাবেন। এই বালক বা বামন কোন রকমে ছাদে ছাদে এসে চোর-কুটরী হয়ে এ ছিদ্রের মধ্য দিয়ে এই ঘরে এসেছি। তার পর সে দড়ী ঝুলিয়ে দেয়, সেই দড়ী ধরে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মহাশয় এই ঘরে উঠে এসে কাজ হাসিল করে যান।

এখন তাই স্পষ্ট বোধ হচ্ছে।

এক পেয়ে লোকই ঢারি সাক্ষর লিখে গিয়েছে, সুতরাং এই এক-পেয়েকে দেখে এই ভদ্র লোকের গুণবা পিতা মরবার সময় ভয় পেয়েছিলেন।

এখন আমার স্মরণ হচ্ছে।

প্রতিভার পিতাও এই চারি সাক্ষরের মধ্যে ছিলেন, না হলে তিনি কেন এই চারি সাক্ষর যুক্ত প্ল্যান নিজের ঠিকানায় আন্দামান হতে পাঠাবেন?

হাঁ, তা নিশ্চয়।

এখন এই পর্যন্ত। এই যে আমাদের পুলিশ দেখা দিয়েছেন, বলিয়া গোবিন্দ বাবু ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।

এই সময়ে কোতোয়ালীর দাবোগা মহম্মদ তোগী সাহেব, জন কয়েক কনেষ্টবল সহ বরেন্দ্র বাবুর সহিত তথায় উপস্থিত হইলেন। আমরা দুইজনে সরিয়া দাঁড়াইলাম।

কিন্তু গোবিন্দ বাবুকে ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত পুলিশ কর্মচারীই চিনিতেন। তিনি গোবিন্দ বাবুকে দেখিয়াই চিনিলেন। বললেন, আপনি। আপনি যে এখানে?

গোবিন্দ। বরেন্দ্র বাবু আমার বন্ধু, কাজেই এসে পড়েছি।

মহম্মদ। ইনিই কি আপনাকে এখানে ডেকে এনেছেন?

গোবিন্দ। হাঁ।

মহম্মদ। কি বুঝছেন? বরেন্দ্র বাবু একটু ঐদিকে যান।

তিনি ইঙ্গিত করায় কনেষ্টবলের বরেন্দ্র বাবুর সঙ্গে সঙ্গে গেল। গোবিন্দ বাবু বলিলেন,কিছুই এখন বুঝি নাই।

মহম্মদ। কেন? এত স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।

গোবিন্দ। কি বুঝলেন?

মহম্মদ। কি আশ্চর্য! আপনার মত লোকও কোন বন্ধু বিপাকে পড়লে সে বিষয়ে আর কিছুই বুঝতে পারেন না।

গোবিন্দ। কি করি—আমি ত কিছুই বুঝতে পাছি না।

মহম্মদ। কেন? এত স্পষ্টই বুঝতে পারা যাচ্ছে। বরেন্দ্র বাবুটি ভাইকে মেরে জহরতের সিন্দুকটা সরিয়ে এখন নেকা সেজে পুলিশে খবর দিয়েছেন।

গোবিন্দ। আর লাস দাদার উপর দয়া করে, উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসে আছেন। ভ্রাতৃ স্নেহের এমন নিদর্শন এ জগতে বড়ই দুর্ল্লভ—তোগী সাহেব বড়ই, দুর্ল্লভ।  

গোবিন্দ। কেন,ভাই ভাইকে খুন করলে, তার পর ভাই তার পরম ভ্রাতৃস্নেহ ভুলতে না পেরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলে। এতে আর সমস্যার কি আছে!  

মহম্মদ। ওঃ—এখন বুঝেছি। এই যে ছাদে গৰ্ত্ত করা। হয়েছে। এই ছেদা দিয়ে উঠে ছাদ দিয়ে নেবে এসে শেষে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। গোবিন্দ বাবু, এখনও কি আপনার কোন সন্দেহ আছে?

গোবিন্দ। তার পর লাসের বুকে কাগজ মারা, তাতে উর্দ্দুতে লেখা চারি সাক্ষর।

মহম্মদ। কি মুস্কিল!–এ যে পুলিশের চোখে ধূলা দেবার চেষ্টা, অও আপনি বুঝতে পারূছেন না? বন্ধুর জন্য মানুষে এমন করেও আত্মহারা হয়! জমাদার, বরেন্দ্র বাবুকে এখনই এখানে নিয়ে এস।

জমাদার বরেন্দ্র বাবুকে তথায় আনিল। মহম্মদ তোগী সাহেব বরেন্দ্র বাবুকে বলিলেন, মশায়, আপনাকে এই খুনের জন্য আমি গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হলেম।

বরেন্দ্র বাবু কাতর ভাবে গোবিন্দ বাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, মহাশয়, আগেই আপনাকে বলেছিলাম।

গোবিন্দ। ভয় নাই,–আমি আপনাকে নির্দোষী সপ্রমাণ কর ভার নিলেম।

মহম্মদ। জমাদার, আসামীকে বাহিরে নিয়ে যাও। দেখ, সাবধান।

বরেন্দ্র। (গোবিন্দ বাবুর প্রতি) মশায়, এ বিপদে আপনি আমাকে দেখবেন।

গোবিন্দ। ভয় নাই।

জমাদার বরেন্দ্র বাবুকে লইয়া গেলে মহম্মদ সাহেব বলিলেন, আপনার কি এখনও সন্দেহ আছে?

গোবিন্দ। ঘোরতর। দাবোগা সাহেব, আপনার অনুসন্ধানের সাহায্য হবে বলে একটা কথা আমি আপনাকে এখন থেকেই বলে রাখি, যে খুন করে জহরতের সিন্দুক নিয়ে পালিয়েছে, সে আপনারই স্বজাতি—মুসলমান,-তার একটা পা কোন রকমে কাটা যায়। তার সে পাটা কাঠের।

মহম্মদ। বলে যান। তার নাম শুদ্ধ বলুন।

গোবিন্দ। তাও বলতে পারি। কিন্তু এখন বলব না। তার সঙ্গে আর একজন সঙ্গী ছিল।

মহম্মদ। বটে?

গোবিন্দ। হাঁ, সে আন্দামান দেশের লোক; এ দেশের মত অম্বা-চওড়া নয়,–ছোট। এ দেশের একটি ছোট ল্যাড়কার মত।

মহম্মদ। (সহাস্যে) বেশ, আর কিছু বলার থাকে—বলে যান।

গোবিন্দ। এখন ঠাট্টা করতে পারেন,–পরে বুঝবেন। আসুন ডাক্তার বাবু, আমরা যাই।

আমরা উভয়ে তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। দারোগা সাহেব বরেন্দ্র বাবুকে লইয়া কোতয়ালীর দিকে রওনা হইলেন। তখন প্রায় ভোর হইয়াছে।

দশম পরিচ্ছেদ।

আমি ভাবিয়াছিলাম, গোবিন্দ বাবু এখন বাসায় যাইবেন; কিন্তু তাহা তিনি করিলেন না। তিনি বাড়ীর সম্মুখস্থ বাগানের একখানি বেঞ্চের উপর ধপাস করিয়া বসিয়া পড়িলেন। বসিয়া বলিলেন, বসুন। ডাক্তার বাবু।

আমি বলিলাম, আপনি কি এখন বাসায় যাবেন না?

তিনি বলিলেন, এত ব্যস্ত কেন? ঘুম পাচ্ছে নাকি?

আমি। ঘুমের আর অপরাধ কি? সমস্ত রাত্রি জাগরণ।

তিনি। রোদ উঠুক, আর একটু দেখবার দরকার আছে। প্রতিভার কাছে তার কাজের ভার নিয়েছি। আপনি তাকে ভুলে গেলেন নাকি?

হা অদৃষ্ট! আমি তাহাকে ভুলিব! আমি বলিলাম, না, আপনি যতক্ষণ বলবেন, তুতক্ষণ আপনার সঙ্গে থাকতে প্রস্তুত আছি।

তিনি। এ ভাল কথা।

আমি। আপনি দারোগাকে যা যা বললেন তাকি ঠিক?

তিনি। নয় কেন? সহজেই বুঝতে পারা যায়। আপনি আমার দিক্ থেকে দেখলে, ঠিক এমনই বুঝতেন।

আমি। আমার মাথায় কিছুই প্রবেশ করে নাই।

গোবিন্দ। (গম্ভীর ভাবে) হাঁ–এ সহজবোধ্য প্রেমকাহিনী নয়—তদপেক্ষ। এসব অনেক জটিল।

আমি বিরক্ত হইলাম, কোন কথা কহিলাম না।

তিনি বলিলেন, বিরক্ত হবেন না। বুঝিয়ে দিই, দেখুন।

জাবার জন্য আমিও উৎসুক হয়েছি।

একজন এক-পেয়ে লোক, আর একজন খুব ছোট-খাট লোকের সাহায্যে যে এই কাজ করেছে, তা ঘরটা ভাল করে দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায়।

তা ত দেখেছি।

এখন চারি সাক্ষরএর কথা ভাবুন। এই চারি সাক্ষর বরে বাবুর পিতার মৃত্যুর পর তার বিছানায় দেখতে পাওয়া যায়। এখানেও আজ দেখা গেল; আবার প্রতিভার বাপের নিকট সেই চারি সাক্ষর যুক্ত একটা প্ল্যানও ছিল। ইহাতে কি বুঝেন?।

বুঝি এই যে, যে লোক খুন করেছে, তার সঙ্গে প্রতিভার পিতার ও বরেন্দ্র বাবুর পিতার কোন সম্বন্ধ ছিল।

হাঁ, এই সম্বন্ধ কিসের জন্য ছিল, তাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেটা কি এই জহরতের সিন্দুক নয়?

এখন ত তাই বলে বোধ হচ্ছে।

তা হলে জানা যাচ্ছে যে, এই দুজন ভলোক এই এক-পেয়ে লোকের কাছ থেকে এই জহরত কোথায় আছে, তা আন্দামানে জানতে পারেন। বরেন্দ্রের পিতা প্রথম ফিরে আসেন। তিনিই জহরত হস্তগত করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকেন। প্রতিভার পিতা আন্দামান থেকে ফিরে এসে প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা করেন। দুজনে এই জহরত নিয়ে ঝগড়া হয়। প্রতিভার পিতার সেই সময়ে সেখানে মৃত্যু হয়।

এ সব জানতে পারা গেছে।

ভাল। তার পর আমরা এও জেনেছি, যে এক-পেয়ে বা কাঠের পা-ওয়ালা লোকের উপর বরেন্দ্রের পিতার বড়ই ভয় ছিল; সুতরাং বোঝা গেল যে, এই এক-পেয়ে লোকই প্রথমে জহরতের কথা জান্ত। বরেন্দ্রের পিতা তাকে ফাঁকি দিয়েছিলেন, নতুবা এত ভয় কেন?

এখন বেশ বুঝতে পাছি।

তার পর আন্দামান দ্বীপ থেকে চিঠী পেয়ে তার ব্যায়াম বেড়ে যায়; এতে বোঝা যায় যে, তিনি খবর পান যে, এক-পেয়ে কোন গতিকে আন্দামান থেকে দেশে ফিরেছে। সে তার মরুবার দিন তার জানালায় উঁকি মেরেছিল।

হাঁ, বরেন্দ্র বাবু বলেছিলেন।

বেশ। কাজেই সেদিন সে চারি সাক্ষর লিখে রেখে গিয়েছিল। সুতরাং বোঝা যায় যে, তাকে জহরত থেকে ফাঁকি দেওয়ায় সে প্রতিহিংসা নেবার চেষ্টায় ছিল।

এখন তা বেশ বুঝতে পারছি।

প্রতিভার নিকট একটা প্ল্যান পেয়েছি, এতে স্পষ্টই এখন বোঝা যাচ্ছে যে,যেখানে জহরত আছে, খুব সম্ভব পোঁতা ছিল, প্ল্যানে তাহাই দেখান হয়েছে।

এখন তাও বেশ বুঝতে পাছি।

প্ল্যানে চার জন লোকের সই আছে, সুতরাং কেবল তারাই চার জন এই জহরতের কথা জান্ত। তারা কোন কারণে,সম্ভবমত খুন করে দ্বীপান্তর যায়। সেখানে ডাক্তার বাবু আর কমিসরিয়েট বাবু তাদের কাছ থেকে কোন গতিকে জহরতের কথা জানতে পারেন, প্ল্যান ও হস্তগত করেন। শেষে সমুদয় জহরত বরেন্দ্র বাবুর গুণবান্ পিতাই আত্মসাৎ করেন।

ত সবই এখন বেশ বুঝতে পাছি। কিন্তু এক-পেয়ের সেই সঙ্গীটি কে?

তা ত বলেই দিলাম। আপনি কি জানেন না যে, আন্দামান বাসীর আকার ভারি ছোট। তাদের মধ্যে যে খুব বড় সে আমাদের দেশের বার-তের বৎসরের ছেলের মতও নয়।

এক-পেয়ে তা হলে একজন আন্দামানের লোককে সঙ্গে করে এনেছিল?

সেকথা আর দুবার করে বতে। তার পর এক-পেয়ের নাম আপনি কেমন করে জানলেন?

অতি সহজে। দু-তিন বৎসরের সব খবরের কাগজ দেখতে আরম্ভ করেছিলাম। খুঁজতে খুঁজতে দেখলেম যে, দেড় বৎসর আগে আন্দামান দ্বীপ থেকে আবদুল বলে একজন দায়মালি কয়েদী পালিয়েছে, তার খোঁজ হচ্ছে। তার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। তার একটা পা কাঠের ছিল—এই যে এদিকেও ভোর হয়ে এসেছে-এখন কাজে লাগা যাক। 

একাদশ পরিচ্ছেদ।

একটু পরিষ্কার হইলে লোক চলাচলের আগে গোবিন্দ বাবু উঠিয়া রাস্তা বিশেষ রূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। সহসা বলিয়া উঠিলেন, দেখছেন?

আমি স্পষ্টই সেই বালকের পায়ের দাগ দেখিতে পাইলাম। গোবিন্দ। এও দেখুন।

আমি। তাই ত!

 আমি পথে সেই কাঠের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, এখন দেখা যা আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু জহরতের সিন্দুকটি নিয়ে কোন্ দিকে গিয়েছিলেন। দেখছেন না, পায়ের দাগে স্পষ্টই জাতে পারা যায় যে, একটা ভারি জিনিষ নিয়ে গেছে।

গোবিন্দ বাবু পায়ের দাগগুলির উপরে লক্ষ্য রাখিয়া চলিলেন, আমিও পশ্চাতে পশ্চাতে চলিলাম। তখনও রাস্তায় লোকের চলাচল আরম্ভ হয় নাই।

আমরা সেই পায়ের দাগ অনুসরণ করিয়া কত রাস্তা ঘুরিয়া ক্রমে যমুনার নিকট আসিলাম। সেখানে একখানা খোলর ঘরের সম্মুখেও সেইরূপ পায়ের দাগ দেখিলাম; আবার সেখান হইতে সেই দাগ যমুনাতীর পর্যন্ত গিয়াছে। তাহার পর আর কোন চিহ্ন নাই।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কি বুঝলেন?

আমি। এক-পেয়ে খোলার ঘরে কার সঙ্গে দেখা করে তার পর নদীর ধারে এসেছিল।

গোবিন্দ। কেবল তাই নয়। দেখছেন না, আরও দুজনের পায়ের দাগ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।

আমি। হাঁ, তা দেখতে পাচ্ছি।

গোবিন্দ। এ দুজন লোককে ডেকে নিয়ে এক-পেয়ে বন্ধু তাদের নৌকা করে সরে পড়েছে। এখন সন্ধান নেওয়া যাক, নৌকা কার আর কোথায় গেল;-বসুন এখানে একটু। ঘুরে ঘুরে যথেষ্ট ক্ষুধার উদ্রেকও হয়েছে, আর ত কিছু নাই, এখন এখানে বসে বসে যমুনা হাওয়া খাওয়া যাক।

গোবিন্দ বাবু যমুনার ধারে বসিলেন। আমিও বসিলাম। ক্রমে ধীরে ধীরে পূর্ব-গগনে সূর্যোদয় হইল।

সেই ঘাটে কতকগুলি নৌকা বাঁধা ছিল। ক্রমে বেলা হইলে দাঁড়ী মাঝিরা একে একে আসিয়া নিজ নিজ নৌকায় বসিতে আরম্ভ করিল। যাহারা নৌকায় নিদ্রিত ছিল, তাহারাও উঠিয়া বসিল।

গোবিন্দ বাবু একজন মাঝিকে ডাকিলেন। বলিলেন, বাপু, আমরা নৌকা করে মথুরা যেতে চাই,—কত নেবে?

মাঝি বলিল, নৌকা করে যাবেন, বড় দেরী হবে।

গোবিন্দ। আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, যমুনার হাওয়া খেতে যাচ্ছি, না হলে ত রেলেই যেতে পারি।

মাঝি। পাঁচ টাকা দেবেন।

গোবিন্দ। পাঁচ টাকা, বল কি! কাল রাত্রে আমার এক বহু দু টাকায় গেছে যে।

মাঝি। দু টাকায়? কে গেছে।

এই বলিয়া সে আরও দুই-চারিজনকে ডাকিয়া বলিল, বাবুর বলছেন, কাল রাত্রে কে দু টাকায় মথুরায় গেছে। কে গেছে? দু টাকায় কে গেছে রে?

তাহারা সকলে নৌকাগুলি দেখিতে লাগিল। তৎপরে একজন বলিল, দেখছি মঙ্গলুর নৌকা নাই? হয় ত সেই গেছে।

পূর্বোক্ত মাঝি ক্রোধে কহিল, তাকে পঞ্চাতে দিব।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, বাপু, যখন একজন গেছে, তখন আমরা তোমাদের বেশী দেব কেন?

মাঝি। দু টাকায় কেউ যায় না। চলুন দেখি, দেখি সে কেমন দুটাকায় গেছে।

সে ক্রোঃ ভরে চলিল। আমরাও তার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। সে সেই খোলর ঘরের দ্বারে আসিয়া মঙ্গলুর স্ত্রীকে ডাকিল। সে বাহির হইয়া আসিলে মাঝি বলিল, মঙ্গলু কোথায় গেছে?

সে বলিল, সে কাল রাত্রে তার নৌকা নিয়ে গেছে।

মাঝি। কার সঙ্গে গেছে?

মঙ্গলুর স্ত্রী। জনিয়ে সঙ্গে গেছে।

মাঝি। ভাড়ায় গেছে কি?

মঙ্গলুর স্ত্রী। হাঁ,-একটা কাঠের পা-ওয়ালা লোক সেই নৌকা তাড়া করে নিয়ে গেছে। সে লোকটাকে আমি দু চক্ষে দেখতে পারিনে। মাঝে মাঝে এখানে আসত।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তাকে আমরা জানি। তার সঙ্গে একটা খুব ছোট-খাট বেঁটে লোক ছিল,–না?

মঙ্গলুর স্ত্রী। হাঁ, সেটাকে দেখলে ভয় করে। ওমা, যেন কেউটে সাপ।

গোবিন্দ। মথুরায় দু টাকার ভাড়া করে গেছে না?

মঙ্গলুর স্ত্রী। তা আমি জানি না।

গোবিন্দ। কবে ফিরবে, তা কিছু বলে গেছে?

মঙ্গলুর স্ত্রী। না।

গোবিন্দ বাবু মাঝির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, দেখলে বাপু, তুমি যখন পাঁচ টাকা চাচ্ছ, তখন আমরা রেলেই যাব।

এই বলিয়া তিনি সত্বর চলিলেন। মাঝি চীৎকার করিয়া আমাদের পশ্চাৎ হইতে বলিল, কত দেবেন বলুন না।

গোবিন্দ বাবু সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া সত্বর পদে সহরের দিকে চলিলেন। কিয়দ্দর আসিয়া বলিলেন, রেলে গেলে পাছে কেউ সন্দেহ করে বলে এক-পেয়ে মহাশয় বুদ্ধি খাটিয়ে নৌকায় গেছেন?

আমি। বোধ হয়, দূরে গিয়ে কোন ষ্টেশনে রেলে উঠবে, না?

গোবিন্দ। শীঘ্র না। দিন কত কোথায়ও লুকিয়ে থাকবে। জানে খুন আর চুরির জন্য একটা মস্ত হৈ-চৈ পড়ে গেছে। পুলিশ চারিদিকে টেলিগ্রাফ করেছে।

আমি। এখন আপনি কি করবেন?

গোবিন্দ। চলুন বাসায় যাই। একটু ঘুমাতে হবে। সমস্ত রাত্রিটা নিদ্ৰা নাই।

গোবিন্দ বাবু বাসায় আসিবার পথে তার আফিসে গিয়া দুইটা টেলিগ্রাফ করিলেন। একথানা এলাহাবাদে, আর একখানা মথুরায়। আমি এতই ক্লান্ত হইয়াছিলাম যে, বাসায় আসিয়াই ঘুমাইয়া পড়িলাম।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

নিদ্রার পর আমি অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইলাম। উঠিয়া দেখি, গোবিন্দ বাবু চুরুট টানিতে টানিতে এক মনে কাগজ-পত্র দেখিতেছেন। তখন অনেক বেলা হইয়াছিল, আমরা উভয়ে স্নানাহার করিলাম। গোবিন্দ বাবু এত অন্যমনস্ক ছিলেন যে, তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমার সাহস হইল না।

সহসা তিনি বলিলেন, আমাদের একটা বড় অন্যায় কাজ হয়েছে।

আমি বলিলাম, কি?

গোবিন্দ। কি? প্রতিভা ভাবিত রয়েছে। তাকে একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল। আপনি এখনই যান।

আমি। আমি!

গোবিন্দ। হাঁ গো মশায়, আমার অন্য কাজ আছে।

আমি। তাকে কি বল?

গোবিন্দ। আশ্চর্য! যা-যা ঘটেছে, সব তাকে খুলে বলবেন?

আমি। এখনই যাব? গোবিন্দ।

আমি তৎক্ষণাৎ প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম। সে নিতা উদগ্রীব হইয়াছিল। আমাকে দূর হইতে দেখিয়া প্রতি সত্বর বাহিরে আসিল। আমাকে সাদরে একটা ঘরে লইয়া গিয়া বসাইল। সলজ্জভাবে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কোন কথা বলিল না।

আমি বলিলাম, কাল যা-যা ঘটেছে, তাই আপনাকে বলবার জন্য গোবিন্দ বাবু আমাকে পাঠিয়েছেন?

তৎপরে আমি সমস্ত তাহাকে বলিলাম। প্রতিভা বরেন্দ্রের গ্রেপ্তারের কথা শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইল। বলিল, আপনারা তাকে খালাস কার জন্য বিশেষ চেষ্টা করবেন। তিনি ত সে সময়ে বাড়ী ছিলেন না।

অবশ্যই গোবিন্দ বাবু এ বিষয়ে বিশেষ চেষ্টা করবেন?

এ লোকটা কবে ধরা পড়বে?

তা ঠিক কেমন করে বল্ব? তবে গোবিন্দ বাবু যেরূপ ক্ষমতাপন্ন লোক, তাতে বোধ হয় শীঘ্রই ধরা পড়বে।

সে ধরা পড়ক-না-পড়,ক, যা হয় হক, কিন্তু বরেন্দ্র বাবুকে আজই খালাস কবেন। নিশ্চয়ই তার ভারি কষ্ট হচ্ছে।

গোবিন্দ বাবু সে বিষয়ে খুব চেষ্টিত আছেন।

আপনি এখন যান, তাঁকে বিশেষ করে বলুন।

আমি আপনার নাম করে তাকে বলব।

আমি উঠিলাম। প্রতিভা বলিল,আপনি আবার কখন আসবেন?

আমি বড় ব্যস্ত হয়ে থাকব।

কত দুর কি হয়, রাত্রে এসে খবর দিব।

আমার জন্য আপনাদের ভারি কষ্ট হচ্ছে।

কিছুই নয়। আপনার জন্য আমাদের কোন কষ্ট হবার সম্ভাবনা কোথায়?

প্রতিভা কোন উত্তর করিল না দেখিয়া, আমি গমনোদ্যত ভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইলাম। আমাকে গমনোদ্যত দেখিয়া প্রতিভা বলিল, কখন আসবেন?

আমি বলিলাম, যত শীঘ্র পারি আসব।

আমি বাহিরে আসিল্প ভাবিলাম, একবার কোতোয়ালীতে খবরটা নিয়ে যাওয়া ভাল। এইরূপ মনে করিয়া আমি থানায় আসিয়া

ইনস্পেক্টর মহম্মদ তোগীর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া সাদরে বসাইয়া বলিলেন, নিশ্চয়ই গোবিন্দ বাবু আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন?

আমি। না, এদিকে এসেছিলাম, তাই একবার খবর নিয়ে যাব মনে করলেম।

মহম্মদ। গোবিন্দ বাবুই হয় ত ঠিক।

আমি। কি রকম।

মহম্মদ। আমরা বরেন্দ্র বাবুকে ছেড়ে দিয়েছি।

শুনিয়া আমার প্রাণে বড় যথার্থই আনন্দ হইল। আমি সাগ্রহে বলিলাম, কেন?

মহম্মদ। তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নাই। খুনের রাত্রে তিনি সে বাড়ীতে ছিলেন না। এমন কি,অনেক দিন হতেই তিনি সেই বাড়ীতে আন নাই। সে রাত্রে তিনি প্রথম আপনাদের সঙ্গে ঐ বাড়ী যান, গিয়ে ভাইকে মৃতাবস্থায় দেখতে পান। এ সব বেশ ভাল রকম সপ্রমাণ হয়েছে,-সুতরাং সুপারিন্টেডেন্ট সাহেব এই সব সাক্ষী-সাবুদ নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছেন। 

আমি। তিনি যে খুন করেন নাই, তা নিশ্চয়।

মহম্মদ। আমরা নিশ্চিন্ত নই। যিনি খুন হয়েছেন, তার বাড়ীর গত চাকর-বাকরকে ধরে এনেছি। দেখা যাক, তারা কি বলে। তার পর সমস্ত রেল-ষ্টেশনে, আর থানায় থানায়, জেলায় জেলায়, টেলিগ্রাফ করেছি; সুতরাং যিনিই খুন করুন, তাঁকে শীঘ্রই ধরা পড়তে হবে।

আমি। আপনারা যখন আছেন, তখন সে নিশ্চয়ই ধরা পড়বে। মহম্মদ। গোবিন্দ বাবুকে বলবেন; আজই সন্ধ্যার সময় তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করব; যেন তিনি বাসায় থাকেন। সাহেব তার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম করেছেন।

আমি উঠিলাম। পথে আসিয়া ভাবিলাম, প্রতিভাকে বরে বাবুর কথা বলে যাওয়া উচিত। আমি আবার প্রতিভার বাড়ীর দিকে চলিলাম। প্রতিভা আমাকে এত শীঘ্র ফিরিতে দেখিয়া ব্যক্তভাবে বাহিরে আসিল। আমি বলিলাম ব্যস্ত হয়ো না। বরেন্দ্র বাবুকে নির্দোষী জেনে পুলিশে তাকে ছেড়ে দিয়েছে, তাই জেনে আবার এখানে বন্দুতে এলেম।

প্রতিভা বলিল, আমরা ত জানতেম যে, তিনি নির্দোষী।

আমি। এখন চললেম, সন্ধ্যার পর এসে কি হয় বলে যাব।

প্রতিভা। আমি খুব খুশী হয়েছি, বরেন্দ্র বাবুকে বলবেন।

আমি। নিশ্চয়ই বলব।

প্রতিভা। সন্ধ্যার পর নিশ্চয় আসবেন।

আমি। নিশ্চয়ই আসব।

বাসায় আসিয়া দেখিলাম, গোবিন্দ বাবু ও বরেন্দ্র বাবু উভয়ে বসিয়া কথোপকথন করিতেছেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

বলা বাহুল্য, আমি বরেন্দ্র বাবুর মুক্তিতে বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিলাম। প্রতিভা যাহা বলিয়াছিল, তাহাও আমি বরেন্দ্র বাবুকে বলিলাম। তিনি বলিলেন, আমি সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা করব। যেমন করে হয়, চোরাই জহরত আমাকে বার করতেই হবে। এতে আমার সর্বস্ব যায়, তাও পণ; বাবা যথেষ্ট রেখে গেছেন।

গোবিন্দ বাবু আমার সম্মুখে দুইখানা টেলিগ্রাম ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, দেখছেন, আমি তখন মথুরা আর এলাহাবাদ পুলিশকে কেন খবর দিয়েছিলেম। মঙ্গলুর নৌকা মথুরা বা এলাহাবাদ পার হতে পাবে না। পুলিশ খুব নজর রাখবে।

আমি। তার পর এখন কি কবেন?

গোবিন্দ। নৌকা মধুরার দিকে গেলে উজান ঠেলে যেতে হবে খুব দেরী হবে। তারা সম্ভবমত কাল রাত্রি এগারটার সময় নৌকায় উঠেছে। সকালের মধ্যে কখনই মথুরায় যেতে পারে না। যদি এলাহাবাদের দিকে গিয়ে থাকে, তা হলে ভাটার টান পাবে, খুব শীঘ্র যাবে। তা হলেও এলাহাবাদ পৌঁছিতে পারবে না। দুখানা নৌকা দুদিকে পাঠিয়েছি, তারা মধুর আর এলাহাবাদ গিয়ে টেলিগ্রাফ করবে। তা হলেই সব জানা যাবে।

আমি। আপনাকে দারোগা সন্ধ্যার সময় বাসায় থাকতে বলেছেন। তিনি দেখা করতে আসবেন।

গোবিন্দ। দেখলেন, ডাক্তার বাবু।

আমি। তাদের সাহেব তাকে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম দিয়েছেন।

গোবিন্দ। দিতেই হবে। এই সব পুলিশ-কর্তারা ব্যস্ত হয়ে আগে হতে একটা ধারণা করে সকল কাজ একবারে মাটা করে ফেলে। এখন একটু সেতার বাজান যাক্।

তাঁহার সুমিষ্ট সেতারে মন তন্ময় হয়। আমরা উভয়েই নীরবে বসিয়া শুনিতে লাগিল। সন্ধ্যার একটু পূৰ্বে গোবিন্দ বাবু সেতার বন্ধ করিলেন। বন্ধ করিয়া তামাক টানিতে আরম্ভ করিলেন। বরের বাবুও দুই-একটান তামাক টানিয়া উঠিয়া গেলেন।

কিয়ৎক্ষণ পরেই দারোগা সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গোবিন্দ বাবু তাহাকে বিশেষ সমাদরে বসাইলেন। তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, গোবিন্দ বাবু, এখন দেখছি, আপনার কথাই ঠিক।

গোবিন্দ। কাল ত হেসেই একেবারে উড়িয়ে দিলেন।

মহম্মদ। সেইজন্যই সময়ে সময়ে আমরা বোকা বনে যাই। সাহেব আপনার কথা শুনে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে হুকুম দিলেন। তিনিও দেখা করতে আসবেন।

গোবিন্দ। কিছুই করতে হবে না। আসামী আমিই ধরে দেব।

মহম্মদ। বলেন কি? আপনি কি জানেন, সে কোথায় আছে?

গোবিন্দ। ঠিক জানি না, তবে শীঘ্রই জাতে পাব। আমি কাল, আপনাকে বলেছিলাম যে, আমি তার নাম পৰ্যন্ত জানি।

মহম্মদ। আপনি আশ্চৰ্য্য লোক। আমরা সকলেই আপনার কাছে মাথা নীচু করতে বাধ্য। তার নামটা কি?

গোবিন্দ। এক-পেয়ে আবদুল।

মহম্মদ। বলেন কি? আপনি অদ্ভুত লোক।

গোবিন্দ। আমি আপনাদের আসামী ধরে দিব; কিন্তু আপনাদের দু-একটা কাজ করা চাই।

মহম্মদ। বলুন, এখনই করব।

গোবিন্দ। বেশী কিছু নয়, আমি একখানা খুব ভাল নৌকা চাই, সঁড়ী-মাঝী আপনাদের বিশ্বাসী কনেষ্টবল হওয়া চাই। আর সেই নৌকা কোন রকমে কেউ যেন পুলিশের নৌকা বলে জানতে না পারে।

মহম্মদ। সে আর শক্ত কথা কি-কবে চাই?

গোবিন্দ। বোধ হয়, কালই চাই।

মহম্মদ। এখনই গিয়ে তার বন্দোবস্ত কছি।

গোবিন্দ। দুজন সুদক্ষ ইনস্পেক্টরকেও সঙ্গে চাই, সঙ্গে যেন রিভলভার থাকে। লোকটা সহজ নয়।

মহম্মদ। আমি নিজেই যাব, আর করিমবক্সকে সঙ্গে নেব।

গোবিন্দ। চারটে হাতকড়ী সঙ্গে নেবেন।

মহম্মদ। চার জন আসামী নাকি?

গোবিন্দ। এই রকম এখন বোধ করছি।

মহম্মদ। আপনি অদ্ভুত লোক,—নিশ্চয়ই অদ্ভুত লোক।

গোবিন্দ। এখন এই পর্যন্ত। আর কিছু দরকার হয় খবর দিব।

মহম্মদ। যখনই যা হুকুম করবেন, তাই তামিল হবে। আসামী ধরাই চাই।

গোবিন্দ। এখন কাকেও কিছু বলবেন না। আসামী ধরা পড়লে প্রশংসা আপনারই।

মহম্মদ। তা ত নিশ্চয়।

গোবিন্দ। প্রোমসনও হতে পারে।

মহম্মদ। সে আপনার মেহেরবানী।

মহম্মদ সাহেব অন্যান্য কথাবার্তার পর আমাদের সেলাম দানে একেবারে দাতাকর্ণ হইয়া বিদায় হইলেন। আমরাও প্রতিভার সহিত দেখা করিতে চলিলাম।

যদিও প্রতিভাকে ছাড়িয়া তখনই যাইতে আমার প্রাণ চাহিল না, কিন্তু গোবিন্দ বাবু আমাকে বিলম্ব করিতেও দিলেন না। বরেন্দ্র বাবু আমাদিগকে তাহার বাসা-বাড়ীতে রাত্রে আহারের নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন; আমরা তাঁহার বাসা-বাড়ীর দিকে চলিলাম।

বলা বাহুল্য,বরেন্দ্র বাবু আহারের বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার বাড়ী হইতে ফিরিতে আমাদের অনেক রাত্রি হইল। বাসায় আসিয়া গোবিন্দ বাবু ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন তার এসেছে?

সে উত্তর করিল, না।

গোবিন্দ বাবু কোন কথা কহিলেন না। আমি শয়ন করিতে গেলাম।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

পরদিবস প্রাতে আমি ও গোবিন্দ বাবু মঙ্গলুর সন্ধানে বাহির হইলাম। কিন্তু জানিলাম, সে এখনও বাড়ী ফিরিয়া আসে নাই। আমার ইচ্ছা ছিল, প্রতিভার সহিত দেখা করিয়া আসি, কিন্তু গোবিন্দ বাবু দ্রুতপদে বাসার দিকে চলিলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। মুখ ফুটিয়া কোন কথা বলিতে পারিলাম না।

বাসার পারে পদার্পণ করিয়াই তিনি ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন তার এসেছে?

সে উত্তর করিল, হাঁ হুজুর।

গোবিন্দ বাবু সত্বর ভিতরে প্রবিষ্ট হইয়া টেলিগ্রাম তুলিয়া লইলেন। একটি নয়, দুইটি টেলিগ্রাম। কিন্তু টেলিগ্রাম দুইটি খুলিয়া দেখিয়া তিনি চিন্তিত হইলেন; কোন কথা কহিলেন না। চিন্তিত মনে পথ চারণ করিতে লাগিলেন।

তিনি একেবারেই কোন কথা কহেন না দেখিয়া, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কিছু হয়েছে নাকি?

তিনি টেলিগ্রাম দুইটি আমার দিকে ফেলিয়া দিলেন। আমি তুলিয়া লইয়া পড়িলাম।

তিনি যে দুইখানি নৌকা দুইদিকে পাঠাইয়াছিলেন, সেই দুই নৌকার লোকে টেলিগ্রাফ করিতেছে যে, তারা যমুনার কোন স্থানে মজলুর নৌকার সন্ধান পায় নাই—কোন স্থানেই সে নৌকা নাই।

সহসা গোবিন্দ বাবুর মুখ ফুটিল,ওঃ,আমি কি গাধা! মঙ্গলু ভায়ার নৌকা কোন গতিকেই মথুরা বা এলাহাবাদ পার হয়ে যেতে পারে নাই, অথচ এলাহাবাদ থেকে মথুরার মধ্যে যমুনার কোনখানে মঙ্গলুর নৌকা নাই. আমার লোকের ভুল হতে পারে না, কারণ নৌকার মাঝিরা মঙ্গলুকে চেনে। তবে কি নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে এরা স্থলপথে পালিয়েছে। তা হতে পারে না, কারণ মঙ্গলু গরীর লোক, স্ত্রী পরিবার নিয়ে ঘর করে, সে এক-পেয়ের ভিতরের কথা কিছুই জানে না। সে তার জীবনের অবলম্বন নৌকা সহজে ডুবিয়ে দিতে রাজী হবে না। এক-পেয়েও মঙ্গলু মাঝির মত পণ্ডিতকে কখনই ভিতরের কথা বলবে না। তা হলে পুলিশের হাত এড়াবার জন্য দিন-কতক নৌকসুদ্ধ গা-ঢাকা দেবার পক্ষে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু মশায় কি উপায় করতে পারেন? সহজ উপায় আছে। মঙ্গলু হলে আর দাড়ী দাড়ে, ভিতরে গোপনে বন্ধু নৌকাটা বাচাল করে দেবেন। হু হু করে নৌকায় জল উঠতে থাকবে। মঙ্গলু তাড়াতাড়ি নৌকা কিনারায় লাগাবে। মেরামত না কলে নৌকা আর চলে না। নৌকা ভীরে ভোলা হবে, মেরামত আরম্ভ হবে। অবশ্য এক-পেয়ে বন্ধু মঙ্গলুকে যথেষ্ট টাকা দেবেন। এই রকমে এক-পেয়ে কোন গ্রামে নৌকা সুদ্ধ দিন কত বাস করবেন। পুলিশ নদী রেল খুঁজে মরুক, কোথায়ও তাদের সন্ধান পাবে না। গোলমালটা কিছু থামলে, তখন এক-পেয়ে ভায়া নৌকা করে এলাহাবাদ বা আর কোনখানে মেলে উঠে অন্তর্হিত হবেন। কেমন, এই কি ঠিক নয়, ডাক্তার?।

এতক্ষণ গোবিন্দ বাবু যে কথা বলিতেছিলেন, তাহাতে, কে হইতেছিল যে, যেন তিনি নিজের মনেই চিন্তা করিতেছিলেন ; এক্ষণে সহসা তিনি আমাকে প্রশ্ন করায় আমি কি উত্তর দিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। একটু পরে বলিলাম, আপনি যে ভাবে বাদানুবাদ করে মীমাংসায় আছেন, তার উপর আমার কোন কথা নাই।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তা হলে এটা সাব্যস্ত যে এক-পেয়ে ভায়া নৌকাসুদ্ধ তীরে কোন গ্রামে আছেন। নিশ্চয়ই নিশ্চিন্ত মনে আছেন; কারণ তিনি ভাবেন যে, সেখানে যে তিনি আছেন, তা কেহই সন্দেহ করবে না। তার সন্ধানে আমাকে স্বয়ংই যেতে হল, দেখছি। ডাক্তার, আপনাকে এখানে একা থাকতে হল; কারণ একজনের বাসায় থাকা দরকার। আমার নামে যদি কোন চিঠী কি টেলিগ্রাম আসে বা কেউ কোন কথা বলতে আসে, তবে যা ভাল বিবেচনা হয়করবেন। আমি এখনই রওনা হলেম।

আমার উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া তিনি তখনই প্রস্থানের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। সামান্য কয়েকটি দ্রব্যাদি লইয়া তিনি পনের মিনিট যাইতে-না-যাইতে অন্তর্হিত হইলেন।

পরদিন তিনি ফিরিলেন না। তার পর আর একটা দিনও কাটিয়া গেল। আমাকে কোন পত্রাদিও লিখিলেন না। আমি তার কোন সন্ধানই পাইলাম না। . এই দুইদিন আমি প্রতিভার বাড়ী সকালে বৈকালে গিয়াছিলাম। সত্য কথা বলিতে কি, তাহার নিকট সৰ্ব্বদা থাকিতেই আমার প্রাণ চায়।

তৃতীয় দিবসের দুই প্রহরের সময় আমি বাসায় বসিয়া নানা বিষয় নিজ মনে ভাবিতেছিলাম, এই সময়ে একজন কাবুলীওয়ালা কতক গুলা শীতবস্ত্র মাথায় করিয়া ঘরের ভিতর আসিয়া বলিল, বাবু সাহেব, কিছু কাপড়-চোপড় নিন।

আমি। না।

কাবুলী। খুব সস্তায় দিব। নগদ টাকা দিবেন না। মাসে মাসে কিছু দেবেন।

আমি। না বাপু, আমার দরকার নাই।

কাবুলী। একখানা নিন,–না হয় একবার দেখুন।

এই বলিয়া সে মাথার কাপড়গুলা ধপ, করিয়া সেখানে ফেলিল।

আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম, আমি লইব না,–তুমি কি আমাকে জোর করে দেবে। এখনই বেরিয়ে যাও, না হলে পুলিশ ডাকব।

সে হো হো করিয়া খুব হাসিয়া উঠিল। তাহার সেই বেয়াদবীতে আমার রাগ আরও বাড়িয়া উঠিল; দুই-এক ঘা দিবার উদ্যোগ করিতেছি,এমন সময়ে সে বলিল,ডাক্তার বাবু! আপনি যখন আমাকে চিতে পারেন নাই, তখন আর অপরের সাধ্য কি যে চেনে?

আমি বিস্ময়বিহ্বল হইলাম। একি, এ যে গোবিন্দ বাবু।

আমি বলিলাম, আপনি অদ্বিতীয় লোক। কার সাধ্য আপনার ছদ্মবেশ চেনে?

তিনি হাসিতে হাসিতে বলিলেন, আজ কাল গ্রামে গ্রামে বেড়াবার পক্ষে কাবুলী হওয়াই সুবিধা,–নয় কি?

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।

গোবিন্দ বাবু নিজ ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া স্থির হইয়া বসিলেন। এবং একটা সুদীর্ঘ চুরুটে অগ্নিসংযোগ করিয়া বলিলেন,যা বলেছিলাম তাই। আমাদের এক-পেয়ে বন্ধুটি মঙ্গলুর নৌকা বানচাল করেছেন, কাজেই নৌকা মেরামত করবার দরকার হয়। এলাহাবাদের দিকে এখান থেকে আট ক্রোশ দূরে, মীরপুর বলে একটা গ্রাম আছে। সেই খানেই নৌকা উঠিয়ে মেরামত আরম্ভ হয়েছে। নিশ্চয়ই মঙ্গলুকে অনেক টাকা দিয়ে রাজী করে রেখেছে। এ দিকে একটু গোলমাল থেমে গেলে আবার নৌকা জলে ভাসিয়ে ভায়া কোন ষ্টেশনে রেলে উঠে সরে পড়তে চান। তা বোধ হয় আর হচ্ছে না। এখন আপনি যতশীঘ্ৰ পারেন, প্রস্তুত হন।

কোথায় যাবেন?

ভায়াকে গ্রেপ্তার করতে।

আমিও যাব

নিশ্চয়। রিভলবারটা সঙ্গে নিন। বেটারা সহজ লোক নয়।

নৌকা করে যাবেন?

হাঁ, নৌকাতেই তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। না হলে জহরতের পিক পাওয়া দায় হবে। এখন কোথায় পুতে রেখেছে নিশ্চয়।

গোবিন্দ বাবু আর কাল বিলম্ব করিলেন না। আমরা প্রস্তুত হইয়া-শীঘ্রই কোতোয়ালীতে আসিলাম। মহম্মদ সাহেব আরও দুইজন ইনস্পেক্টরকে সঙ্গে লইলেন। কেহই রিভার লইতে ভুলিলেন না। চার জোড়া হাতকড়ীও লওয়া হইল। ছয়জন কনেষ্টবল দাড়ী ও একজন জমাদার মাঝি সাজিয়া চলিল।

মহম্মদ সাহেব নৌকা আগে হইতে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমরা সকলে সত্বর নৌকায় উঠিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিলাম। তীরবেগে নৌকা ছুটিল।

মিরপুরের নিকট আসিয়া গোবিন্দ বাবু নৌকা হইতে নামিলেন। আমাদের সকলকে তথায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া তিনি সেখান হইতে একাকী গেলেন।

কিন্তু তিনি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন, যা ভেবেছিলাম। তাই। বেটারা কেমন করে খবর পেয়ে বা সন্দেহ করে আধঘণ্টা আগেই নৌকা ছেড়ে এলাহাবাদের দিকে চলে গেছে। নৌকা এখনই খুলে দাও, খুব জোরে দাঁড় টান।

নৌকা তখনই খুলিয়া দেওয়া হইল। নৌকা আবার তীরবেগে দুটিল। ছয় দাড় আমাদের নৌকায় ছিল, সুতরাং তাহাদের নৌকা আমরা যে শীঘ্রই ধরিতে পারিব, সে বিষয়ে আমাদের সকলেরই বিশেষ ভরসা হইল।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছিল। আমরা রাত্রি আটটা পর্যন্ত চলিলাম, তবুও তাহাদের নৌকার কোন চিহ্ন দেখিলাম না। আমাদের কাহারও মুখে কোন কথা নাই। কথা কহিবার কিছু ছিল না। সকলেই বোধ হয়, আমার মত উৎসুকচিত্তে মঙ্গলুর নৌকার প্রতীক্ষা করিতে ছিলেন। গোবিন্দ বাবু নদীর চারিদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে লাগিলেন।

মহম্মদ সাহেব বলিলেন, আপনার ত ভুল হয় নাই, গোবিন্দ বাবু?

গোবিন্দ বাবু গম্ভীর ভাবে কেবল মাত্র বলিলেন, না। মহম্মদ। আমরা ত তাদের নৌকা ছেড়ে আসি নাই?

গোবিন্দ। না, সেদিকে চোখ রেখেছি।

মহম্মদ। তাদের দুই দাঁড়ের নৌকা, আর আমাদের ছয় দাড়ের নৌকা। আধ ঘন্টা আগে যদি তারা নৌকা ছেড়ে থাকে, তবে তাদের নৌকা এতক্ষণে আমাদের ধরা উচিত।

গোবিন্দ। তারা কি আর দুই চারটা দাড় বাড়াতে পারে না? সম্ভবমত তাই করেছে। বেশী পয়সা দিয়ে মিরপুর থেকে দুই তিনটা দাড়ী সংগ্রহ করেছে।

এই সময়ে আমরা সম্মুখে একখানা নৌকা দেখিতে পাইলাম। গোবিন্দ বাবু মহোল্লাসে বলিয়া উঠিলেন, খুব জোরে টান, ওই সেই নৌকা।

আমাদের নৌকা মহা বেগে ছুটিল।

******

আরও অর্ধঘণ্টা কাটিল। যদিও এখন সেই নৌকা আমাদের নৌকা হইতে বেশী দূরে ছিল না, তবু আমরা স্পষ্ট বুঝিলাম, সেই নৌকাও খুব জোরে চলিতেছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, দেখছেন দারোগা সাহেব, নৌকায় চার দাড়।

মহম্মদ। সে নৌকা না হতেও পারে।

গোবিন্দ। এখনই দেখা যাবে। সাধারণ চড়নদারের নৌকায়

ক্রমে আমাদের নৌকা অগ্রবর্তী নৌকার আরও নিকটস্থ হইতে লাগিল। তখন আমরা স্পষ্ট বুঝিলাম, সেই অগ্রবর্তী নৌকার মাঝি ভিতরের একজনকে কি বলিল। তখন সেই ব্যক্তি ছইয়ের বাহিরে আসিয়া আমাদের নৌকা দেখিতে লাগিল। আমরা তাহার আকৃতি বা চেহারা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম না।

গোবিন্দ বাবুর তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাহাকে দেখিল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, এই যে আমাদের এক-পেয়ে বন্ধু।

বোধ হইল যেন, তাহার কথা সেই ব্যক্তির কানে গেল। আমরা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম সে দাড়ীদের কি বলিল। আমরা দেখিলাম, তখন তাহারা প্রাণপণে দাড় টানিতে লাগিল।

তখন দুই নৌকায় প্রকৃতই বা আরম্ভ হইল। আমরা সকলে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ক্রমাগত বলিতে লাগিলাম,জোরেজোরেজোরে। ছয় জন পাহারাওয়ালা, তাহাদের শরীরে যত বল ছিল, সমস্ত প্রয়োগ করিয়া প্রাণপণে দাঁড় টানিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল, আর একটু বেশী জোর দিলে, দাড় ভাঙিয়া তাহারা উল্টাইয়া জলে গিয়া পড়িবে।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ।

আমাদের নৌকা ক্রমে সেই নৌকার আরও নিকটবর্তী হইল। বোধ হয়, আর এক শত হাত দূরেও নাই।

এই সময়ে গোবিন্দ বাবু চীৎকার করিয়া বলিলেন, রিভলবার, রিভলবার,-গুলি-গুলি কর।

আমরা কিছু না বুঝিয়াও সত্বর নিজ নিজ পকেট হইতে বিভ বার বাহির করিলাম। এই সময়ে ঝপ করিয়া কি একটা আমাদের নৌকার সম্মুখে জলে পড়িল।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, দেখছেন না, সেই আন্দামানী, মাঝির পিছনে দাড়িয়ে আমাদের দিকে তীর ছুড়ছে-ও সব বিষাক্ত তীর। ওতেই নরেন্দ্র বাবুর মৃত্যু হয়েছে। কাছে যাবার আগে আন্দামানীর হাত বন্ধ করতে না পারুলে, প্রাণ যাবে।

সৌভাগ্যের বিষয় নৌকা তখনও তত নিকটস্থ হয় নাই, নতুবা নিক্ষিপ্ত তীর নিশ্চয়ই আমাদের গায়ে লাগিত। এখনও দুই নৌকা পরস্পর হইতে যত দূর ছিল,তাহাতে আমাদের পিস্তলের গুলিও তাহার গায় লাগিবার সম্ভাবনা ছিল না।

আন্দামানীও তাহা বুঝিয়াছিল। সে তাহার তীর ধনুকে লাগাইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। আমাদের কাহারও মুখে কোন কথা নাই, আমাদের হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতেছিল।

ক্রমে নৌকা আরও নিকটস্থ হইল। সাঁ করিয়া একটা তীর আমাদের পাশ দিয়া চলিয়া গেল; আমরা একেবারে রিভলবার ছুড়িলাম। আমাদের রিভারের আওয়াজের সঙ্গে এক পৈশাচিক বিকট চীৎকারে যমুনার বক্ষ প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল।

আমরা দেখিলাম, আন্দামানী আহত হইয়াছে। সে দুই হতে নৌকার ছই ধরিবার চেষ্টা পাইল,—কিন্তু পারিল না; ঘুরিয়া যমুনার জলে পড়িয়া গেল।

পর মুহূর্তেই আমরা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম; কিন্তু আন্দা মানীর কোন চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। তাহার দেহ গভীর জলে নিমগ্ন হইয়াছে।

এই সময়ে গোবিন্দ বাবু চীৎকার করিয়া বলিলেন, জোরে–জোরে—আরও জোরে। বেটা জহরতের সিন্দুক জলে ফেলে দিচ্ছে।

আমরা দেখিলাম, একটা লোক যথার্থই একটা সিন্দুক নৌকার ধারে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করিতেছে। আমরা অগ্রসর হইবার পূৰ্বেই মহা শব্দে সেই সিন্দুক যমুনা গর্ভে পড়িল।..

গোবিন্দ বাবু বলিলেন একটু দাড় ছাড়। জায়গাটা ঠিক করে রাখি। পর মুহূর্তেই তিনি বলিলেন,না-না-হয়েছে। খুব জোরে বেয়ে যাও।

নৌকা আবার সবেগে ছুটিল। কিন্তু অপর নৌকার দাড়ী-মাঝি৷ ভয় পাইয়া নৌকা তীরের দিকে চালাইল। আমাদের নৌকাও তীর বেগে পশ্চাতে ছুটিল। তীরের নিকট আসিয়া দাড়ী-মাঝিরা লম্ফ দিয়া জলে পড়িল। আমরা নৌকা ধরিয়া ফেলিলাম।

সেই লোকটাও লাফাইয়া জলে পড়িল। তখন আমরা দেখিলাম, সত্য সত্যই তাহার এক পা কাঠের।

লম্ফ দিয়া তীরে পড়ায় তাহার সেই কাঠের পা কাদায় একেবারে বসিয়া গেল। সে প্রাণপণে কাদা হইতে পা টানিয়া বাহির করিবার চেষ্টা পাইতে লাগিল। তাহাতে তাহার পা আরও কাদায় বসিয়া গেল।

মহম্মদ সাহেব ও তাহার দুই ইনস্পেক্টর সত্বর গিয়া তাহার হাতে হাতকড়ী লাগাইয়া দিলেন। অন্যান্য কনেষ্টবল নৌকা বাঁধিয়া শীঘ্রই মঙ্গলু ও তাহার সহযাত্রীদের ধরিয়া হাতকড়ী লাগাইল।

আমরা সকলে পড়িয়া টানিতে টানিতে কাদা হইতে মুক্ত করিয়া এক-পেয়ে আবদুলকে তীরে তুলিলাম। সে বিকট হাস্য করিতে লাগিল। তাহার হাসিতে অন্যের কথা বলিতে পারি না, আমার হৃদয় কঁপিয়া উঠিল।

আমরা সকলেই বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। গোবিন্দ বাবু পকেট হইতে কতকগুলা চুরুট বাহির করিয়া সকলকে এক-একটি দিলেন; তৎপরে আবদুলকেও একটা দিয়া বলিলেন,আবদুল, খাও। এত কষ্ট না দিলেই ভাল ছিল। সিন্দুকটা জলে ফেলে না দিলে তোমার পক্ষেও ভাল ছিল।

গোবিন্দ বাবুর মুখে তাহার নাম শুনিয়া আবদুল অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল, বলিল, আপনি আমার নাম জানলেন কেমন করে?।

গোবিন্দ। তা না জানলে কি তোমার মত লোককে ধরা যায়। তোমার কথা সব জানি,কেবল জহরত কোথা হতে এসেছিল, তাই আনি না। সব কথা যদি সত্য বল,তবে তোমাকে ফাঁসী কাঠ থেকে বাঁচাব।

আবদুল। আমি সে বাবুকে খুন করি নাই। ঐ আন্দামানী টাঙ্গা তার তাঁর দিয়ে তাকে আগে মেরেছিল,–সেই আগে ঘরে গিয়ে দড়ী ধরে উপরে উঠে গিয়ে দেখি, বাবু মরে গেছে।

মহম্মদ। সেটাকে জেন্ত ধরতে পারলেই ঠিক হত।

গোবিন্দ। এখন নৌকা খুলে দাও ফিরে যেতে যেতে আবদুল তোমার ইতিহাস শুতে চাই। সত্য বলে, তোমার উপকার হবে, জানবে।

আবদুল। আর মিথ্যা বলে লাভ কি? সব খুলে বল্ব। আগে একটু চুরুট খাই।

গোবিন্দ। আহা, খাও-খাও, ঠাণ্ডা হও। অনেক কষ্ট দিয়েছ। আরও কিছু কষ্ট পেতে হবে জহরতের সিন্দুকটার জন্য।

আবদুল আবার হ হহ শব্দে হাসিয়া উঠিল। আমার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। আমি মনে মনে ভাবিলাম, এমন দুরাত্মা কি জগতে আর দ্বিতীয় আছে।

কিয়ৎক্ষণ পরে আবদুল বলিল, এ বেচারারা কিছু জানে না। পয়সা পেয়ে নৌকা ভাড়া দিয়েছিল। বাবু দেখবেন, এরা যেন আমার জন্য মারা না যায়।

আমি ভাবিলাম, এরূপ দুরাত্মার মনেও নীতি-জ্ঞান আছে।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন,  আমরা জানি। ওদের কিছু হবে না।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।

মঙ্গলুর নৌকা আমাদের নৌকার সঙ্গে বাঁধিয়া আমরা আগ্রার দিকে ফিরিলাম। চারিজন কনেষ্টবল দাঁড় টানিতে লাগিল। দুই জন মঙ্গলুদের পাহারায় রহিল। আবদুলকে আমরা চারিদিকে বেরিয়া বসিলাম। আবদুল বলিতে লাগিল;–

আমাদের চার জনের ফতেপুর শিখরিতে বাড়ী। ছেলে বেলা থেকেই আমরা দোস্ত। যাইহোক নসীবের দোষেই হক, আর গুনেই হক, আমরা ঠগীর দলে মিশে পড়ি। সে অনেক কথা,–সেসব বলার দরকার নাই, জহরতের কথাই বলি।

গোবিন্দ। হাঁ,–সে সব বোঝা গেছে। এখন এই জহরতের গল্পই বল।

আবদুল। কোন গতিকে আমরা শুনতে পাই যে, রামগড়ের নবাব তার উজীরকে অনেক টাকার জহরত দিয়ে মথুরার শেঠের কাছে পাঠিয়েছেন। এই সব জহরত বাধা রেখে তাঁর টাকা চাই।

মহম্মদ। শুনেছিলাম বটে, কিন্তু রামগড়ের নবাব জহরতের কথা অস্বীকার করেন।

আবদুল। তিনি খুব লুকিয়ে টাকা ধার করতে ইচ্ছা করেছিলেন। তাই তার বিশ্বাসী উজীর সামান্য সওদাগর সেজে কেবল একজন লোক নিয়ে আগ্রায় পৌঁছান। কেউ এ কথা জানতে পারে না। কোন গতিকে আমরা এ খবর পাই। জহরত খোয়া গেলে, তিনি কোম্পানীর ভয়ে সব কথা অস্বীকার করেন।

গোবিন্দ। তার পর।

আবদুল। তার পর এই খবর পেয়ে আমরা তাঁর সঙ্গ নিই; কিন্তু পথে কোনখানে কাজ হাসিল করতে পারি নাই। শেষে যখন তিনি আগ্রায় মসাফের-খানায় বাসা নিলেন, তখন সেখান থেকে যেতে দিলে কাজ হাসিল হবার আর সম্ভাবনা নাই ভেবে, আমরা চারজনে সাহসে ভর করে মাফের-খানায় গিয়ে সেই রাত্রেই তার গলা টিপে কাজ শেষ করে দিই। সঙ্গের লোকটাকে দেখতে পাই নাই। তাকে শেষ করতে পালে আমাদের আর কোন ভয় ছিল না।

মহম্মদ। তার পর।

আবদুল। সে লোকটা কোন গতিকে এই ব্যাপার দেখতে পায়। আমরা জহরতের সিন্দুক নিয়ে একেবারে সেইরাত্রেই ফতেপুর সিকরিতে এসে একটা ভাঙ্গা বড় বাড়ীর মধ্যে পুতে ফেলি। ফতেপুর সিকরিতে ত জানেন,কত বাড়ী ঘর দোর আছে। জায়গাটা পাছে মনে না থাকে বলে, সেই যায়গার চারখানা নক্সা করে আমরা চারজনের কাছে রাখি। চারজনের সাক্ষর সেই চারখানা কাগবেই ছিল। আমরা জানতে পারি নাই যে, সেই লোকটা আমারে দেখেছিল। আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল। সে অন্ধকারে আমাদের সঙ্গে সনে এসে আমাদের বাড়ী দেখে যায়। পাছে, আমরা তাকে দেখতে পাই বলে, ভয়ে যেখানে আমরা জহরতের সিন্দুক পুতে রাখি তা দেখতে পায় নাই।

মহম্মদ। তার পর?

আবদুল। সেই বেটা তার পরদিন পুলিশে সব কথা বলে দেয়। দু দিন যেতে না-যেতে পুলিশ এসে আমাদের গ্রেপ্তার করে। আমরা হাজতে যাই। বিচারের সময়ে আমরা সমস্তই অস্বীকার করি। মোকদ্দমায় জহরতের কথাও উঠে,—কিন্তু সেই লোকের সঙ্গে যে অহত ছিল, তা কেউ বল্‌তে পারে না। এমন কি তার সঙ্গের লোকলও কিছু জাত না।

মহম্মদ। হাঁ, জানি বিচারে তোমাদের চার জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল।

আবদুল। হাঁ,–আমরা চারজনে দ্বীপান্তরে যাই। কোন গতিকে মুখের মধ্যে করে নক্সা চারখানা আমরা চারজনে সঙ্গে নিই। অভ্যাস কলে গলার ভেতরেও অনেক জিনিষ রাখা যায়, তা ত জানেন।

মদ। খুব জানি।

আবদুল। আন্দামানে তিন-চার বৎসর থাবার পর আগ্রার ডাক্তার বাবু সেখানে যান। তিনি আমাদের জহরতের কথা সত্য কি না জিজ্ঞাসা করেন, আমাদের আর দেশে যাবার আশা নাই দেখে, আমরা সব কথা তাকে বলি। যদি তিনি টাকা খরচ করে বা যেমন করে হয় আমাদের খালাস করতে পারেন, তা হলে যেখানে জহরত আছে, তা বলে দিব, আর তাকে একটা ভাগও দিব স্বীকার করি। তিনি সেদিন আর কিছু বলেন না। কিন্তু তার পর তার বিশেষ বন্ধু কমিসরিয়েট বাবুকে নিয়ে এলেন। আমরা ছয়জনে অনেক পরামর্শ করলেম। তারা ভগবানের কাছে শপথ কলেন যে, জহরত বেচে টাকা নিয়ে যেমন করে হয় তারা আমাদের চারজনকে খালাস কবেন। তার পর যে টাকা থাকবে, তা আমরা ছয় জনে ভাগ করে কে। তারা দুজনই ছুটির দরখাস্ত কলেন। কিন্তু ডাক্তার বাবু সে সময়ে ছুটি পেলেন না। কমিসরিয়েট বাবু ছুটি পেলেন। আমরা একখানা নক্সা তাকে দিলাম। তিনি দেশে রওনা হলেন।

গোবিন্দ। তার পর। আবদুল। তার পর তার আর কোন খবর পেলাম না। তিনি ক্তার বাবুকেও কোন চিঠী লিখলেন না। ডাক্তার বাবু খবর পেলেন যে, তিনি দেশে ফিরেই বড় ব্যারামে পড়েছেন। আবার ছুটি নিয়েছেন। তখন ডাক্তার বাবু বলেন, বোধ হয়, তিনি ব্যারামে পড়ে জহরতের সন্ধান করুতে পারেন নাই। আমি এখন ছুটি পেয়েছি, আমি গিয়ে জহরতের তল্লাস করব। তিনি আমাদের খালাস করবার জন্য শপথ করায়, আমরা আর একখানা নক্সা তাকে দিলাম। তিনি দেশে গেলেন। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেল, তবু তারও কোন সংবাদ পেলাম না। শুলাম, তিনি নাকি মরে গেছেন; কিন্তু আমাদের মনে বিশ্বাস হল যে, তারা আমাদের ফাকী দিয়েছেন। আমাদের খালাসের চেষ্টা না করে দুজনে জহরত বা করে নিয়েছেন। আমরা চারজনে শপথ করলেম, যদি কখনও দেশে যেতে পারি, এর প্রতিফল দিবই দিব।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।

আবদুল বলিল, এই রকমে আরও অনেক দিন কেটে গেল। এমন সময়ে এই আন্দামানী টাঙ্গাকে আমি বাঁচাই। আমি একটা ঔষধ জানতেম, টাঙ্গা জঙ্গলে পড়ে মৰূছে দেখে, আমি তাকে ঔষধ দিয়ে বাচাই। তখন তার সঙ্গে আন্দামান থেকে কোন গতিকে পালাবার পরামর্শ করতে থাকি। সে আমার জন্য প্রাণ দিতেও স্বীকার করে। তার একটা ভোঙায় চড়ে কিছু খাবার আর জল নিয়ে আমরা দুজনে আন্দামান হতে পালাই। অনেক কষ্ট শেষে দেশে পৌঁছাই, সে সব বলতে গেলে অনেক কথা।

গোবিন্দ। সে সকল কথা আমাদের এখন শশাবার দরকার নাই। এখন দেশে এসে কি করলে তাই বল।

আবদুল। দেশে এসে প্রথমেই ফতেপুর শিরিতে গেলাম,–কিন্তু দেখলাম জহরত নাই। কে আগেই নিয়ে গেছে। কার নিয়ে গেছে তা বুঝতে দেরী হল না। যেমন করে হয়, যে দুজনে আমাদের ফাকী দিয়েছে, তাদের রক্ত দেখতে হবে। সন্ধান নিয়ে জানলেম, ডাক্তার নিরুদ্দেশ হয়েছে,–তার কোন খবর নাই।

গোবিন্দ। তার পর?

আবদুল। তার পর কাশী গিয়ে কমিসরেট বাবুর সন্ধান নিলেম। গুনলেম, তিনি আগ্রায়। যেদিন তাঁর সন্ধানে আমি তার জানলায় উঁকি মারি, সেইদিনই তার মৃত্যু হয়। মুরদ পোড়াতে নিয়ে গেলে, আমি জহরতের সন্ধানে তার ঘরের ভিতর যাই। কোন সন্ধান না পেয়ে চারি সাক্ষর লিখে চলে আসি।

মহম্মদ। তার পর?

আবদুল। হাঁ,–তার পর তাঁর ছেলেদের ওপর নজর রাখি। জাতে, পাই তারাও তাদের বাপ কোথায় জহরত লুকিয়ে রেখে গেছে জানে না। নানা জায়গায় খুঁজছে। একদিন জানতে পারলেম, তারা জহরতের সিন্দুক খুঁজে পেয়েছে। দুই ভাইয়ে তাই নিয়ে ঝগড়া করে। এক ভাই আর এক জায়গায় চলে গেছে। যে ঘরে সিন্দুক আছে, তাও সন্ধান নিয়ে জানতে পারি। তখন সেই জহরতের সিন্দুক যে আমাদের যথার্থ হকের ধন তাই ঘটাবার চেষ্টায় থাকি।

গোবিন্দ। তার পর?

আবদুল। সব খবর নিয়ে টাঙ্গাকে ছাদ দিয়ে পাঠিয়ে দিই। সে জলী,বাঁদরের মত সবধানে উঠতে পারে, যেতে পারে। তাতে ছোট-বেঁটে বীর। আহা, সে আমাকে বড় ভালবাসত। আপ নারা তাকে গুলি করে অন্যায় করেছেন।

গোবিন্দ। না কলে সে তার সর্বনেশে তীর দিয়ে আমাদের প্রতিও বড় অন্যায় কত।

আবদুল। তা নিশ্চয়, সে তীর গায়ে লাগলে এক মিনিটও দেরী হয় না। এমন ভয়ানক বিষ মাখান তীর। টাঙ্গাই সে বিষের তীর তৈয়ারী করতে জাত।

মহম্মদ। হাঁ, তার পর? আবদুল।

আবদুল। আমি ভেবেছিলাম, অত রাত্রে সে ঘরে কেউ নাই। কিন্তু টাঙ্গা ছাদের উপরের ছোট ফাঁক দিয়ে ঘরে লোক দেখে অমনই তীর ছুঁড়ে। সে লাফিয়ে ঘরে পড়বার আগেই কমিসরিয়েট বাবুর ছেলে সরে যায়। আমি গিয়ে দেখি, একদম আড়ষ্ট হয়ে গেছে। আমি টাঙ্গাকে অনেক গালাগালি দিয়েছিলাম। ছেলের উপর আমার রাগ ছিল না,সে বেচারা কি জানে। বাপকে পেলে বোঝা যেত।

মহম্মদ। তার পর?

আবদুল। তার পর আমি দড়ী দিয়ে সিন্দুকটা নামিয়ে দিই, পরে দুজনে নীচে নেমে এসে বরাবর যমুনার ধারে আসি। মঙ্গলুর নৌক ভাড়া করে সরে পড়ি।

গোবিন্দ। হাঁ, তার পর পাছে পুলিশ নৌকার সন্ধানে যায় বলে মজলুর অসাক্ষাতে নৌকা বাচাল করে দিয়ে মেরামতের জন্য ডেঙায় তুললে?

আবদুল। আপনি এ সব কেমন করে জানলেন?

গোবিন্দ বাবু হাসিলেন।

আবদুল বলিল, এখন সব কথাই–আপনাদের বলেম। আর আন্দামানে যাবার ইচ্ছা নাই,—ফাঁসী হলে বড় বেখুশী হব। আর একটা চুরুট দিন। এটা শেষ হয়ে এসেছে।

গোবিন্দ বাবু তাহাকে আর একটা চুরুট দিলেন।

এদিকেও রাত্রিশেষ। এইরূপ সময়ে আমাদের নৌকা আসিয়া, আগ্রায় ঘাটে লাগিল। দারোগা সাহেব তাঁহার আসামী লইয়া কোতোয়ালীতে গেলেন। যাইবার সময় বলিলেন, জহরতের সিন্দুকটা, কাল থেকে তুলতেই হবে।–জায়গাটা ত মনে আছে, গোবিন্দ বাবু?

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, কতক কতক।

পুলিশ কর্মচারিগণ আসামী লইয়া প্রস্থান করিলে গোবিন্দ বাবু আমাকে বলিলেন, প্রতিভা ব্যস্ত হয়ে আছে,–আপনি গিয়ে তাকে, সব কথা বলে তবে বাসায় আসবেন। আমি সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা করব।

আমি প্রতিভাদের বাড়ীর দিকে চলিলাম। সে আমাদের প্রতীক্ষায় সর্বদাই উদগ্রীব থাকিত,–আমাকে দেখিয়া, ছুটিয়া বাহিরের ঘরে আসিল। আমি তাহাকে সকল কথা বললাম। সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সব শুনিল। পরে আমি বিদায় হইবার জন্য উঠিয়া বলিলাম, তোমার সঙ্গে বোধ হয়, এই শেষ দেখা,-আর দেখা হবে কি না কে বলতে পারে?

প্রতিভা চকিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল কেন?

আমি। দেশে যাব মনে করেছি। আমি চলে গেলে আমার কথা কি তোমার মনে থাকবে,– তুমি কি একটু দুঃখিত হবে?

প্রতিভা মস্তক অবনত করিয়া বলিল, হব?

আমি কি বলিলাম জানি না,–বোধ হয়, বলিয়া ফেলিয়াছিলাম, তবে সঙ্গে চল না কেন? প্রতিভা কি বলিল, স্মরণ নাই, বোধ হয়, কিছুই বলে নাই। কিন্তু দেখিয়াছিলাম,-সহসা তাহার কপোলযুগ রক্তাভ হইয়া উঠিয়া এক অদৃষ্টপূৰ্ব কোন সৌন্দর্য্যে তাহার মুখখানি ভরিয়া উঠিয়াছিল। আর তখন আমি কম্পিত হস্তে তাহার মৃণালভূল্য হাত দুখানি ধরিয়া তাহার সেই আরজ মুখখানি চুম্বন করিয়াছিলাম। সে লজ্জায় আমার হাত ছাড়াইয়া এক নিমেষে ছুটিয়া, পালাইয়াছিল। সহসা আমার স্বপ্ন ভাঙিয়া গেল—সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আমি আচাৰ্য মহাশয়ের সহিত দেখা করিলাম।

উপসংহার।

পরদিবস সন্ধ্যার সময় গোবিন্দ বাবু আমাকে বলিলেন, ডাক্তার বাবু, কথাটা ফল্‌ল ত?

আমি বুঝিয়া ও-না বুঝিয়া বলিলাম, কি ফলবে?

গোবিন্দ বাবু হাসিয়া বলিলেন, ভবিতব্যি,-ভবিতব্যি।

আমি বলিলাম, আমি কিছুই বুঝতে পাছি না।

গোবিন্দ বাবু বলিলেন, তা পাবেন কেন? তবে মনে মনে যে না পারছেন–তা নয়। বৃথা চেষ্টা ডাক্তার-আমার কাছে কিছু গোপন করতে পারবেন না। আপনি গোপন করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু আপনারই মুখ চোখের ভাব আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তিনি একটু নীরবে থাকিয়া বলিলেন, যা হক–আমি আচাৰ্য মশায়ের কাছে সব শুনেছি। প্রতিভা যখন রত্ন, আমি আপনাকে কনগ্রাচুলেট করি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনারা দুজনে চিরসুখে সুখী হন। আর আমি আমার সেতার আর তামাক চুরুট নিয়ে মহা আনন্দে বাকী দিনগুলো কাটিয়ে দিই।

আমি। আপনি সব শুনেছেন। আমি আপনাকে বলব মনে করছিলাম।

গোবিন্দ। এতে আর লজ্জা কি? আপনি ত আর ছোট নন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *