২.২৯ সুবৰ্ণ একদিন উঠে বসে

সুবৰ্ণ একদিন উঠে বসে হাত বাড়িয়ে নিল জলটা, অনেকদিন পরে একটু হেসে বললো, তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, তাই না?

তা প্ৰবোধ চমকে গেল বৈকি।

ভালবাসার কথা তুলছে সুবর্ণ!

চমকে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকালো, ধারে-কাছে কেউ আছে কিনা দেখলো। তারপর কাছে সরে এসে কাঁদো কাঁদো ব্যাকুল গলায় উত্তর দিল, এতদিন পরে এই প্রশ্ন তুমি করছে আমায়? মুখ ফুটে বলতে হবে সে কথা?

নাঃ, সত্যিই সুবর্ণ বদলে গেছে।

হয়তো সুবর্ণ পৃথিবীকে ক্ষমা করে যাবে সংকল্প করেছে, তাই বলে উঠলো না— না, মুখ ফুটে বলতে হবে না বটে, সারাজীবন কাটা ফুটিয়ে ফুটিয়েই তো সেটা জানান দিয়ে এসেছ!

সুবৰ্ণ শুধু আর একটু হাসলো। তারপর বললো, না, বলতে হবে না অবিশ্যি। তবে ভালোই যখন বাসো, আমার একটা শেষ ইচ্ছে পূরণ করো না?

শেষ ইচ্ছে? প্ৰবোধ গেঞ্জিটা তুলে চোখ মোছে, তারপর বলে ওঠে, একশোটা ইচ্ছের কথা বল না তুমি মেজবৌ—

একশোটা মনে আসছে না। আপাততঃ একটাই বলছি–মেজ ঠাকুরবিকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে।

মেজ ঠাকুরঝি!

তার মানে সুবালা?

প্ৰবোধ যেন শূন্য থেকে আছাড় খায়।

মেয়ে নয়, জামাই নয়, নাতি-নাতনী নয়, ভাই-ভাইপো নয়, দেখতে ইচ্ছে হল। কিনা মেজ ঠাকুরঝিকে?

তাজ্জব!

তা তাজ্জব করাই পেশা ওর বটে।

বেশ, সেটাই হবে।

তড়বড় করে বলে উঠল প্ৰবোধ, এমন একটা আজগুবী ইচ্ছেই। যখন হয়েছে তোমার, তা সেই ব্যবস্থাই করছি।

প্ৰবোধের কথাটা অযৌক্তিক নয়, যে শুনলো সুবর্ণর শেষ ইচ্ছে, অবাকই হলো। আজগুবী ছাড়া আর কি? এত দেশ থাকতে চারটে ননদের মধ্যেকার একটা ননদকে দেখবো, এই হলো একটা মানুষের জীবনের শেষ ইচ্ছে? এই আবদারটুকু করেছে মুখ ফুটে?

তাও যদি সমবয়সী ননদ হতো!

হাস্যকর!

কিন্তু অভাগার ভাগ্যে বুঝি তুচ্ছও দুর্লভ!

সেখানেও তো মস্ত বাধা!

সুবালা যে তার শেষদিকের মেয়েগুলোকে ঝপাঝােপ। যা-তা বিয়ে দিচ্ছে! একটাকে চক্রবর্তরি ঘরে, একটাকে ঘোষালের ঘরে, একটাকে নাকি বারেন্দ্রর ঘরে, আবার শোনা যাচ্ছে ছোটটাকেও নাকি ওইরকম কি একটা ঘরে দেবে বলে তোড়জোড় করছে।

শহুরে নয়, ফ্যাশানি নয়, পয়সাওলা নয়। তবু এত সাহস! দেশে গ্রামে বসে এত স্বেচ্ছাচার!

মরুক গে যা খুশি করুক গে। ছেলেমেয়ের বিয়েতে পোস্টে একটা পত্তর দেওয়া ছাড়া যোগাযোগ তো ছিলই না, কে ওই রাবণের গুষ্টিকে এসো বোসো বলে ডাকবে? আসতে যেতে ভাড়া গুনতেই তো। ফতুর হতে হবে। সবাই ভেবে রেখেছিল, অতএব এই পত্তরখানাও এবার বন্ধ করতে হবে।

কিন্তু এখন আবার এই সমস্যা!

অথচ ঝপ করে কথা দিয়ে ফেলা হয়েছে মৃত্যুপথযাক্রিণীর কাছে। তার উপায়? এ সমস্যার সমাধান করলো কানু। বললো, এ তো আর আপনি কোনো সামাজিক কাজে আনছেন না বাবা, এতে আর কি হচ্ছে? মা যখন মুখ ফুটে বলেছেন—

ছেলের সমর্থন পেয়ে ভরসা পেলো কানুর বাবা।

অতএব সুবালা এল।

আনতে গেল ও-বাড়ির বুদো।

যে নাকি আশপাশের সকলেরই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো! কারে পড়ে প্ৰবোধ নিজে খরচাপত্তর ধরে দিয়ে অনুরোধ করে এল তাকে।

মেজ জেঠির শেষ অবস্থা! তোমায় দেখতে চেয়েছে!

এ খবর শুনে পর্যন্ত সেই যে কান্না শুরু করেছিল সুবালা, সে আর থামে না। চোখ মুছে মুছে আঁচলটা তার ভিজে শপৃশপে হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো ফুলে। লাল।

আরো দুটো দাঁত পড়ে, সারা মুখটাই যে তার আজকাল হাস্যকর বিকৃতির একটা প্রতীক! কেঁদে আরো কিন্তুতি!

বাড়ি ঢুকেই প্ৰবোধের পায়ে একটা প্ৰণাম ঠুকে উথলে উঠে বলে, আছে?

প্ৰবোধও উথলে বলে, আছে এখনও, তবে বেশীদিন থাকবে না।

বেশীক্ষণ নয়, বেশী দিন! তবু ভালো।

জ্ঞানে আছে?

তা টনটনে।

ঠাকুর রক্ষে কোরো! কথা-টথা বলছে?

বলছে অল্প স্বল্প।

অতএব একটু ঠাণ্ডা হয় সুবালা, চোখেমুখে জল দিয়ে রুগীর কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। প্ৰবোধ চড়া গলায় বলে, মেয়েগুলোর অঘরে-কুঘরে বিয়ে দিচ্ছিস শুনলাম—

সুবালা ওর স্বভাবে কান্নায় ফোলা চোখেও হেসে ফেলে।

অঘর-কুঘর নয় মেজদা, তবে স্বঘর নয়।

তার মানেই তাই। তা এ মতিচ্ছন্নের কারণ?

কারণ আর কি? সুবালা দিব্বি সপ্ৰতিভ গলায় বলে, অভাবেই স্বভাব নষ্ট! হাতে নেই কানাকড়ি, ঘরে একগণ্ডা বিয়ের যুগ্যি মেয়ে! নীচু ঘরেরা আমনি হাতে নিয়ে গেল—

গলায় দড়ি তোর! এর চেয়ে মেয়েগুলোকে গলায় পাথর বেঁধে পুকুরে ফেলে দিলেই হতো!

সুবালা শিউরে উঠে বলে, দুগগা দুগগা! কি যে বল মেজদা! আমার কুলীনগিরিটা ওদের প্ৰাণের থেকে বড় হলো? ভালো ঘরে পড়েছে, খেয়ে পরে সুখে আছে, এই সুখ। তাতে লোকে আমায় একঘরে করে করুক।

বোনের সম্পর্কে কোনোকালেও কোনো দায়িত্ববোধ না থাকলেও তার এই দুঃসাহসী কথায় খিঁচিয়ে ওঠে দাদা, একঘরে করে করুক? ভারী পুরুষাৰ্থ হলো! অমূল্যাটাও বুঝি এমনি গাড়োল হয়ে গেছে আজকাল?

সুবালা এ অপমান গায়ে মাখে না। শালা-ভগ্নীপতি সম্পর্ক, বলেই থাকে আমন। সুবালা তাই হেসে বলে, তা যা বলো! মোট কথা নিজের কুলের বড়াইটি নিয়ে বসে থাকবো, ওদের মুখ চাইবো না, এতো স্বার্থপর হতে পারলাম না মেজদা! স্বঘরের কেউ কি আমার মুখ চাইলো? আর আমার এসব কুটুমরা! একেবারে পায়ের কাদা। যাকগে বাবা ওসব কথা, এখন যাকে দেখতে এসেছি… বাড়ি তো খাসা করেছ–মেজবৌয়েরই ভোগে নেই—, আর একবার উথলে ওঠে সুবালা, আর একবার সে জল ঘষে ঘষে মুছে ফেলে দোতলায় উঠে যায় মেজদার পিছু পিছু।

 

কেঁদেই মালা!

সুবৰ্ণ বহুদিন পরে ভারী মিষ্টি হাসি হাসে। মুখের লাবণ্যের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবু কাঠামোটা আছে। সেই কাঠামোখানাই যেন উজ্জ্বল দেখায়।

সুবালা এসেই ওর বিছানার ধার চেপে বসেছিল, সুবর্ণ নিষেধ করে নি।

সুবৰ্ণ তার একখানা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। সুবালার কান্না দেখে সেই হাতে একটি নিবিড় গভীর চাপ দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, কেঁদেই মালো!

ভাল থাকতে আমি মরতে একবারও এলাম না!

বুজে আসা গলায় আক্ষেপ করে সুবালা।

অন্যকে অভিযোগ করে না। বলে না, এত ছেলে-মেয়ের বিয়ে গেলো, একবার আনলে না। আমায়! ও অভিযুক্ত করলো নিজেকে, ভাল থাকতে এক বার এলাম না। আমি!

সুবৰ্ণ হাতে ধরা হাতটায় আর একটু চাপ দিয়ে বলে, তোমার মতন মনটা যদি সবাইয়ের হতো মেজ ঠাকুরঝি! কাউকে দোষ দেওয়া নেই, কোথাও কোনো অভিযোগ নেই, সুন্দর!

তারপর জিজ্ঞেস করে ওর ছেলে-মেয়েদের কথা।

কে কত বড় হলো, কার কার বিয়ে হলো? কিন্তু উত্তরের দিকে কি মন ছিল সুবর্ণর? প্রশ্ন করছিল শুধু, উপর্যুক্ত প্রশ্নের অভাবে। একথা-সেকথার পর হঠাৎ বলে ওঠে, আচ্ছা, তোমার সেই বাউণ্ডুলে দ্যাওরটির খবর কি? সেই যাকে আমি বাড়িতে ঢুকতে দিই নি, দরজা থেকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম?

দুগ্‌গা দুগ্‌গা! তাড়িয়ে আবার কি!… অম্বিকা ঠাকুরপো কথা বলছে তো? সুবালা ব্যস্ত গলায় বলে, তুমি বলে তাকে কতো ভালোবাসো! সেও মেজবৌদি বলে– থেমে যায় সুবালা নেহাতই গলাটা বুজে আসায়।

জানি! সুবর্ণ একটু থামে, তারপর যেন কৌতুকের গলায় বলে, পোড়া কপাল আমার। সে আবার ঘর-সংসারী হবে? সে তো বিবাণী হয়ে গেছে!

বিবাগী!

হাত-ধরা মুঠোখানা শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়ে। প্রশ্ন-হারানো বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকে সুবৰ্ণ যেন ওই অদ্ভুত কথাটার দিকেই।

সুবালা আঁচলের ভিজে কোণটা দিয়েই আবার চোখটা মুছে নিয়ে ধরা গলায় বলে, তা বিবাগী ছাড়া আর কি! কোথায় কোথায় ঘোরে, ন-মাসে ছ-মাসে একখানা চিঠি দেয়। পায়ে হেঁটে নাকি ভারত ঘুরছে। তোমাদের ননদাই বলে, আবার হয়তো লাগবে ব্রিটিশের পেছনে, তাই দল যোগাড় করছে। আমার তা বিশ্বাস হয় না ভাই। গেরুয়াই নেয় নি, নচেৎ ও তো সত্যিই একটা বৈরাগী উদাসীন! এ জগৎ ছাড়া, অন্য এক জগতের মানুষ! নিজের জন্য কানাকড়ার চিন্তা নেই, অথচ কোথাও কিছু অন্যায় অবিচার দেখলে তো আগুন। সেই যোবার এখানে এসেছিলো— হঠাৎ একটু সামলে নেয় সুবালা। অবোধ হলেও যেন বুঝতে পারে, সেদিনের কথা আর না তোলাই ভালো। তাই বলে, সেই তার কদিন পরেই বাড়ি-ঘর বেচে দিয়ে চলে গেল। বলে গেল, এই ভারতবর্ষে বাংলা দেশের মতন অভাগা দেশ আরও কটা আছে দেখবো।… মনে মনে তাই ভাবি মেজবৌ, মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছিস, গরাদে ভরা আছিস, কী আর করবি? তুই যদি বেটা ছেলে হাতিস, নিৰ্ঘাত ওই অম্বিকা ঠাকুরপোর মতন হাতিস! সংসারবন্ধনে বেঁধে রাখা যেত না তোকে! সেরেফ কোন দিন জগৎ দেখবো বলে পথে বেরিয়ে পড়তিস!

মেজ ঠাকুরঝি!

সুবৰ্ণ যেন আর্তনাদ করে ওঠে।

সুবৰ্ণ আবার ওর হাতটা চেপে ধরে।

আর সুবর্ণর সেই আর্তস্বরটা যেন দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আস্তে ঝরে পড়ে, এই কথা ভাবো তুমি? অথচ কদিনই বা দেখলে তুমি আমাকে! আর যারা জীবনভোর দেখলো—

সুবালা বুদ্ধিহীন, কিন্তু অনুভূতিহীন নয়। তাই সেই ঝরা-স্বরের মৃদু মূৰ্ছনার উপর আর কথা চাপায় না। শুধু চুপ করে বসে থাকে। অনেকক্ষণ বসে থাকে।

তারপর অনেকক্ষণ পর সেই নীরবতা ভেঙে উদ্বিগ্ন গলায় বলে, হাতটা যে তোমার বড্ড ঘামিছে মেজবৌ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *