2 of 4

২.১৫ খুবসুরৎ নওজোয়ান সাদ-এর কাহিনী

খুবসুরৎ নওজোয়ান সাদ-এর কাহিনী

যুবকের সুন্দর মুখে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। ধীরে ধীরে চোখ তুলে নিজের কাহিনী বলতে লাগলো :

ভাই, আমিও এক রাজার ছেলে। আমার গল্প অদ্ভূত আর আশ্চর্যজনক। আমার জীবনের কাহিনী শুনলে বিষাদে আপনার মন ভরে উঠবে।

যুবকটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছলো। কপালটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আবার শুরু করলো।—আমার জন্ম কাবুলে। সেখানে আমার বাবা টিগমাস বানু-সালানো এবং আফগানিস্থান রাজ্য শাসন করতেন। আমার বাবার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো, লোকে তার নামে ধন্য ধন্য করত। বাবার সাতজন সামস্ত রাজা ছিলো। প্রত্যেকের শাসনাধীন শহর ছিলো একশটি আর একশটি করে দুর্গ। বাবার অধীনে একশতটি দুঃসাহসিক ঘোড়া সওয়ার এবং একশজন অতি সাহসী যোদ্ধা ছিলো। আমার মা ছিলেন খোরাসানের সুলতান বাহিরোয়ানের মেয়ে। আমার নাম জানশাহ।

ছোটবেলা থেকে আমার বাবা আমাকে লেখাপড়া, নানা কলাবিদ্যায় এবং বলবত্তায় পারদর্শী করে তোলে। আমার যখন পনের বছর বয়স তখন আমার বাবার রাজ্যে আমার নাম ছিল সেরা অশ্বারোহীদের প্রথমে। আমার দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিকার করতে যেতে ভালো লাগতো। কখনো কখনো ঘোড়ায় চড়ে দূর থেকে দূরে চলে যেতাম!

একদিন বাবা তার পরিষদবৰ্গ নিয়ে শিকারে গেলেন। আমিও বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম। তিনদিন ধরে বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে নানান মজার খেলা খেলেছিলাম। তিনদিনের দিন সূর্যাস্তের সময় আমরা তাঁবু খাটিয়ে বসে বিশ্রাম করছি এমন সময় ছোট একটি হরিণ শিশু লাফিয়ে লাফিয়ে কোথা থেকে আমাদের সামনে এসে পড়লো। আমি একটা তাঁবুতে বসে সাতজন সৈন্যের সঙ্গে বিশ্রাম করছিলাম। দেখলাম হরিণটা লেজ তুলে দৌড়ে পালাল। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের নিয়ে হরিণটার পেছনে পেছনে ধাওয়া করলাম। অনেকক্ষণ ধরে ধাওয়া করতে করতে একটা বিরাট নদীর ধারে এসে পড়লাম। এবার ওকে ঘিরে ধরতে পারব। পালাবে কোথায়! হরিণটা একবার আমাদের দেখলো পেছন ফিরে। তারপর সঙ্গে সঙ্গে নদীতে কাঁপিয়ে পড়ে ওপরের দিকে সাঁতারাতে লাগলো। আমরাও ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে নদীর কিনারায় একটা মাছের নৌকা ঠেলে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তাতে চড়ে বাইতে লাগিলাম। আমাদের ঘোড়াগুলিকে একজন সৈন্যের ওপর ভার দিয়ে এসেছিলাম। যাহোক আমরা মাঝ নদীতে এসে পড়লাম। তাড়াতাড়ি। নৌকা আর আমাদের বাগে থাকছে না। ইতিমধ্যে ঝড় বইতে শুরু করেছে। তাছাড়া নদীর স্রোতও ছিলো প্রচণ্ড। সন্ধ্যা অনেকক্ষণ আগে হয়েছিলো, এখন ঘোর অন্ধকার। দিক-বিদিক শূন্য হয়ে নৌকা যে কোথায় ভেসে চললো বুঝতে পারছি না। সমস্ত চেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হলো। সারারাত ধরে প্রবলবেগে নৌক ভেসে চললো। এ সময় কোন পাথরে বা পাহাড়ে ধাক্কা খেলে আর রক্ষা নেই। এই আতঙ্ক আমাদের আরো কাহিল করে দিলো। পরের দিনও একই ভাবে ভেসে চললাম। আল্লার মেহেরবানীতে আমাদের কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না। দ্বিতীয় রাত্রির শেষের দিকে স্রোতে ভেসে আমাদের নৌকা পাড়ে এসে ভিড়লো। আমরা লাফিয়ে নৌকা থেকে নেমে পড়লাম।

এরমধ্যে যে সৈন্যের ওপর আমাদের ঘোড়ার দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলাম, সে আমার বাবাকে সব জানিয়ে দিলো। বাবা, মহামান্য টিগবাস ধরে নিলেন, আমরা নদীতে ডুবে গেছি। শোকে দুঃখে হতাশায় মাথার রাজমুকুট ছুঁড়ে ফেলে দিলেন নিজের হাতে। দিকে দিকে দূত পাঠালেন আমাদের খোজে। আমি হারিয়ে গেছি, এ খবরটা আমার মায়ের কাছেও পৌছোতে দেরী হয়নি। দুঃখিনী মা আমার নিজের মুখ নিজেই আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে তুললেন। মুঠো-মুঠো চুল ছিঁড়ে ফেললেন। গভীর দুঃখে বুক চাপড়াতে লাগলেন। নিজের পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন এবং সবশেষে শোক বস্তু পরলেন।

এদিকে আমরা তীরে নেমে একটু ভেতরে ঢুকে দেখি সুন্দর একটা ছোট্ট নদী। একটা লোক তার পাড়ে বসে তার পা দুটো জলে ডুবিয়ে রেখেছে। আমরা তাকে অভিবাদন জানিয়ে জানতে চাইলাম আমরা কোথায় এসে পড়েছি। লোকটা আমাদের অভিবাদন প্রত্যুত্তর না দিয়ে শকুনের মত তীক্ষ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। শকুন মরা জন্তুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আনন্দে যেমন চিৎকার করে তেমনি চেঁচাল। আমাদের বুক কেঁপে উঠলো সেই চিৎকারে।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ হয়ে গেলো।

 

তিনশো একষট্টিতম রজনী :

পরের দিন রজনীতে শাহরাজাদ গল্প শুরু করলো।

—লোকটা তারপর উঠে দাঁড়ালো। আশ্চর্য ওর কোমর দুভাগ করা। ওপরের ভাগটা আমাদের দিকে ছুটে আসছে আর নীচের অংশটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মত বহু লোক ছুটে আসছে ঝর্ণার ধার দিয়ে। ঝাঁকুনি দিয়ে দেহটা দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে ওপরের অংশ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমার সঙ্গীদের তিনজনকে কাছাকাছি পেয়ে ঘিরে ধরে হালুম হালুম করে খেতে শুরু করল। তিনজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে নৌকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। জলে ডুবে মরে যেতে রাজি—কিন্তু এই রাক্ষসদের হাত থেকে যে করেই হোক রেহাই পেতে হবে। নৌকাটাকে জলে ঠেলে দিয়ে স্রোতে ভেসে চললাম আমরা। নদীর তীর ধরে ছুটে আসছে অসংখ্য উরু, ঠ্যাং; আমাদের ধরার চেষ্টা করছে। দেহগুলো আমার হতভাগ্য সঙ্গীদের খেতে ব্যস্ত! ওদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এই রাক্ষসগুলোর পেটটাও পুরো ছিলো না দেহটার সঙ্গে। এই অৰ্দ্ধেক পেটেই কিভাবে খাচ্ছিল আমার সঙ্গী তিনটিকে! উঃ ভাবলেও শরীর কেমন করে। হতভাগ্য সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে শোক জ্ঞাপন করে ভাবছি, সমস্ত ঘটনাটা কি দ্রুতই না ঘটে গেলো। এ যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

পরের দিন ছোট্ট একফালি জমিতে আমাদের নৌক ভিড়লো। এখানে গাছে গাছে ফল ধরে আছে। বাগানে জানা অজানা কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে। নৌকা ছেড়ে এবার আর নিজে নামলাম না। সঙ্গীদের পাঠিয়ে দিলাম জায়গাটা ভালো করে দেখে আসবার জন্য। প্রায় আধবেলা কাটিয়ে ওরা ফিরলো। ওরা ডানে ও বায়ে  ভালো করে দেখেছে, সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। মার্বেল পাথরের একটা বড় প্রাসাদ দেখে এসেছে। প্রাসাদের সামনে স্বচ্ছ শামিয়ানা টাঙ্গানো। চারপাশে বাগান। বাগানে সুন্দর একটি দীঘি। ওরা সবাই মিলে প্রাসাদে ঢুকেছিলো। বিরাট একটা হলঘর। আবলুষ কাঠের বহু আসন মণিমাণিক্যখচিত সিংহাসনের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো। আশ্চর্যের ব্যাপার কি বাগানে কি প্রাসাদে ওরা কোন প্রাণীর চিহ্ন দেখতে পায়নি।

ওদের ভালো করে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিন্ত হলাম। নৌক ছেড়ে প্রাসাদে যাব বলে ঠিক করলাম। বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে গাছ থেকে পাকা আর টাটকা ফল খেয়ে তাজা হয়ে নিলাম আগে। বিশ্রাম নেবার জন্য প্রাসাদে ঢুকলাম আগে। সোজা সিংহাসনে গিয়ে বসলাম আর আমার সঙ্গীরা আবলুষ কাঠের আসনে বসলো। সিংহাসনে বসার পর আমার বাবা-মা আর বাবার সিংহাসনের কথা মনে পড়লো। নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, কেঁদে ফেললাম। আমার দেখাদেখি আমার সঙ্গীরাও কেঁদে ফেললো।

নিজেদের দুঃখে নিজেরা কাতর। এমন সময় বিশাল সমুদ্র গর্জনের মত শব্দ কানে এলো। সামনে তাকিয়ে দেখি উজির, পাত্রমিত্র অমাত্যের দল হলঘরে ঢুকছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এরা সবাই বান্দর। নানান আকারের বান্দর, ছোটবড় সব রকমেরই এই মিছিল রয়েছে। এবার আর উপায় নাই, মৃত্যু অবধারিত। দৈত্যাকার চেহারার বাঁদরটিকে উজির বলে মনে হলো। সে আমার সামনে এগিয়ে এসে কুর্নিশ করে কথা বললো। আশ্চর্যের ব্যাপার, মানুষের ভাষায় কথা বলছেঃ

—আমি আর আমার লোকজন আপনাকে সুলতান বলে মেনে নিচ্ছি। আপনার এই তিন সঙ্গী আমাদের সৈন্যবাহিনীর তিন প্রধান হবেন।

তারপর মহা সমারোহে কচি হরিণের মাংস দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলো। খানাপিনার শেষে আমাদের উজির বললো-জাঁহাপনা, প্রাসাদের বাইরে আপনার সৈন্যবাহিনী ও প্রজারা অপেক্ষা করছে। চলুন, বাইরে এসে দেখবেন। ওরা তৈরী হয়ে আছে, এই মুহার্তে যুদ্ধ শুরু হবে। আমাদের প্রাচীন শত্রু প্রেতের রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ হবে।

বহু ধকল গেছে শরীর আর মনের ওপর দিয়ে। ওদের বিদায় দিয়ে তিনজন সঙ্গী নিয়ে সমূহ পরিস্থিতির আলোচনা করতে বসলাম। ঘন্টাখানেক আলোচনার পর ঠিক হলো-প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাব এখনই। আর যত তাড়াতাড়ি হয় এদেশ ছেড়ে পালাতে হবে। প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে ঘুর পথে নদীর তীরে চলে এলাম। কিন্তু আমাদের নীকাটা নেই। কেউ সরিয়ে নিয়েছে বুঝলাম দাগ দেখে। কি আর করব, ফিরে এলাম সেই প্রাসাদেই। অবসন্ন শরীরে আর জেগে থাকতে পারলাম না, ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি উজির এসে কুর্নিশ করে বললো—জাঁহাপনা, সব তৈরি। প্রেতদের সঙ্গে যুদ্ধের সব তৈরি।

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখি কয়েকজন লোক বিরাট বিরাট চারটি কুকর ধরে আনছে। আমাদের চারজনকে কুকুরের পিঠে চড়তে হবে। আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন দাম নেই। কুকুরের পিঠে চড়তে হলো। কুকুরগুলো শিকলে বাঁধা ছিলো। তারা আগে আগে চললো আমাদের পিঠে করে। সমস্ত সৈন্যের নেতৃত্ব তো আমাদেরই দিতে হবে। আমাদের পেছনে উজির বিশাল বানর সৈন্যের দলপতি হিসাবে চলেছে। আর তার পেছনে লাখ লাখ বানর সৈন্য আকাশ বাতাস তোলপাড় করে চোঁচাতে চেঁচাতে চলেছে।

আমরা একদিন একরাত খালি কুচকাআওয়াজ করতে করতে এগিয়ে চললাম। বিরাট একটা কৃষ্ণবর্ণ পাহাড়ের কাছে এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রেতেরা লুকিয়ে ছিলো। আমাদের দেখে হঠাৎ বেরিয়ে এলো। বিচিত্র ধরণের সব চেহারা। ভয়ংকর দর্শন, বুকের রক্ত জমে যাবার অবস্থা। কারো উটের মত দেহে ষাড়ের মাথা, কারো হায়নার মাথা, কারো বা দেহই নেই! জীবনে যা দেখিনি বা কল্পনাও করিনি এমন সব চোহোরা ওদের।

আমাদের দেখতে পেয়ে ওরা পাহাড় থেকে নেমে এসে পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়ালো। তার পর অঝোর ধারায় পাথর ছুঁড়তে আরম্ভ করলো। আমার সৈন্যবাহিনীরাও ওদের ছুঁড়ে দেওয়া পাথর তুলে নিয়ে সামনে পাল্টা ছুঁড়তে লাগলো। ক্রমেই যুদ্ধের চেহারা ভয়ংকর রূপ নিলো। এবং যুদ্ধটা ক্বমেই ছড়িয়ে পড়ছে। আমার আর আমার তিনজন সঙ্গীর কাছে তীরন্ধনুক ছিলো। তীর ছুঁড়ে কয়েকটাকে ঘায়েল করলাম। বহু মরেও গেলো। আমার সৈন্যবাহিনী তা দেখে আনন্দে চেঁচায় ও উৎসাহ বোধ করে। যুদ্ধে জয় আমাদেরই হলো। প্রেতেরা পালাচ্ছে, ওদের পিছু ধাওয়া করলাম।

আমরা চারজন কুকরের পিঠে চেপে সবার আগে দৌড়াচ্ছি। ধাওয়া করার আনন্দে বিশৃংখল। এই সুযোগে আমাদের পালাতে হবে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে। সবাই ছুটছে, সবাই ব্যস্ত, মার মার, ধর ধর শব্দ। আমাদের দিকে কেউ নজর রাখছে না। পিছনে ফিরলাম আমরা। প্রেতি আর বানর সৈন্যের চোখের ওপর দিয়ে আমরা মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলাম।

কুকুরের পিঠে চেপে আমরা অনেকক্ষণ দৌড়ালাম। কুকুরগুলোর জিভ বেরিয়ে গেছে, মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। ওদের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য থামতে দেখি বিরাট এক ঝকমকে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে হিব্রু ভাষায় লেখা :

হে বন্দী ভাগ্য যাহাকে বঁদের নৃপতি সৃষ্টি করিয়াছিলো এবং তাঁহাদের হাত হইতে নিস্কৃতির উদ্দেশ্যে তুমি যদি দৌড়াইয়া থাক, তোমার মুক্তির পথ বলিতেছি। দুইটি পথ তোমার সম্মুখে রহিয়াছে।-হ্রস্বতর পথটি ডানদিকে গিয়াছে। উক্ত পথ সমুদ্রের বেলাভূমিতে মিশিয়াছে। বেলাভূমি পৃথিবীটা বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। পথটি বিশাল মরুভূমির অভ্যন্তর দিয়া চলিয়া গিয়াছে। মরুভূমির রাক্ষস, দৈত্য ও জিনে পরিকীর্ণ। অপর পথটি বামদিক দিয়া গিয়াছে।ইহা দীর্ঘতর পথ। চারিমাস লাগিবে পথের কিনারায় পৌঁছিতে। উক্ত পথটি একটি উপত্যকার অভ্যন্তর দিয়া গিয়াছে। উপত্যকার নাম পিপীলিকার উপত্যক। দ্বিতীয় পথ ধরিয়া কোনক্রমে পিপীলিকার সংশ্রব এড়াইতে পারিলে তুমি অগ্নি পর্বতের পাদদেশে আসিতে পরিবে। উক্ত পাদদেশেইহুদীদের নগরী বর্তমান। আমি, ডেভিডের পুত্র সুলেমান তোমার মুক্তি উপায় নির্ধারণ করিয়া রাখিলাম। ভোর হয়ে এলো।

শাহরাজাদও গল্প থামিয়ে চুপ করে রইলো।

 

তিনশো বাষট্টিতম রজনী :

পরদিন রাত্ৰিতে শাহরাজাদ। আবার গল্প শুরু করলো :

বাঁদরের হাত থেকে পালিয়ে ওরা পাহাড়ের গায়ে উৎকীর্ণ লিপি পড়ে বাঁদিকে যাত্রা শুরু করলো। জাঁহাপনা এবার যুবক জানশাহর মুখেই শুনুন :

বাঁদিকের পথ ধরে চলতে লাগলাম। এই রাস্তা ইহুদী শহরে গেছে। মাঝখানে পিপড়ে উপত্যকা পড়বে, আমাদের সেটা মনে রাখতে হবে।

আমরা একটি দিনও পুরো যাইনি আমাদের পায়ের তলার মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে-ভূমিকম্প শুরু হলো নাকি! পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি কি, আমার সেই বানর উজীর। সর্বনাশ! আমাদের আর পালানো হলো না। দ্রুত গতিতে আমাদের ঘিরে ফেললো চারদিক থেকে। অনেকে চেঁচাচ্ছে, নাচছে হুটোপুটি করছে। এর মধ্যে উজীর আমার সামনে এগিয়ে এলো। তামাম বানরদের প্রতিনিধি সে। যুদ্ধে জেতার জন্য অভিনন্দন জানালো। বহুদিন পর ওরা জয়ী হলো—একটা ছোটখাট বক্তৃতাই দিয়ে ফেললো উজীর।

দিব্যি সভা চালিয়ে গেলো। উজীর। রাগে আমাদের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। আমরা সতর্ক হলাম—কোন মতেই আমাদের মনের অবস্থাটা ওদের বুঝতে দেওয়া হবে না। হৈ হৈ করে প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে চললো। আমার নতুন রাজ্যে আমার নাকি অভিষেক হবে। যুদ্ধ জয় করেছি একি চাট্টিখানি কথা! ধরা পড়ার আগে আমরা একটি উপত্যকায় চলে এসেছিলাম। পিছন ফিরে চললাম নতুন রাজ্যপাটে। হঠাৎ উপত্যকার মাটি ফেটে গেলো। পিলপিল করে পিপড়ে বেরিয়ে এলো। আর তাদের কি আয়তন! বাপস। পলকের মধ্যে বানর। আর পিপড়ের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেলো। উঃ সে কি লড়াই! পিপড়েগুলো তাদের সাড়াশির মত দাঁতের ফাঁকে এক একটা বানরকে ধরে দুটুকরো করে ফেলছে। দশ পনরটা করে বাঁদর পিপড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে টেনে টেনেই ছিঁড়ে ফেলছে একটি একটা পিপড়েকে। জীবনে এরকম লড়াই দেখিনি।

লড়াই বেশ জমে উঠেছে। ওরা লড়াই করুক মজাসে। আমরা কুকুরের পিঠে করে পলাই। কিন্তু আমাদের সকলের পালান হলো না। আমার তিনজন সঙ্গীকে এখানেই রেখে যেতে হলো। বেচারী তিনজন কেমন করে যেন পিপড়ের দাঁতের সামনে পড়ে গিয়েছিলো। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে সঙ্গে-সঙ্গে। কি দুৰ্ভাগ্য আমার! আপদে বিপদে প্রতিবার পরামর্শ করে আমরা রেহাই পেয়েছি। এখন আমি একেবারেই একা! ওদের আত্মার জন্য সদগতির প্রার্থনা জানিয়ে এগিয়ে চললাম। চলতে চলতে একটা নদীর সামনে এসে পড়লাম। নদীর তীরে শেষ সঙ্গী কুকুরটিকে বিদায় দিলাম। সাঁতরে নদী পার হলাম। নদীর মধ্যে কোন বিপদ হয়নি। জামা কাপড় শুকিয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গতে সুস্থ মনে ভাবলাম, আর আমার ভয় নেই। পিপড়ে বা বোদর আর কেউ নদী পার হয়ে আমাকে ধরতে আসবে না।

এবার শুরু হলো পায়ে চলা। দিনের পর দিন হেঁটে চললাম। লতাপাতা আর গাছের শেকড় খেয়েই কাটলো আমার। অবশেষে সেই পৰ্ব্বতের লেখার নির্দেশ মত ইহুদীদের শহরে এসে পৌঁছলাম। একটা জিনিস সেই লিপিতে বলেনি। এটা আমার পরে নজরে এসেছে। একটা নদী খালি পয়ে হেঁটে পেরোতে হয়। অথচ নদীর পাড়ে আমাকে পুরো এক সপ্তাহ বসে থাকতে হয়েছিলো। এই নদীর কথা লিপিতে বলা ছিলো না। একটা বিশেষ দিনে নদীটা পেরোতে পেরেছিলাম। পরে শুনেছি; নদীতে শনিবার দিন জল থাকে না। ঐ দিন ইহুদীদের ভোজ হয়।

নদী পেরিয়ে শহরে ঢুকলাম। রাস্তায় কাউকেও দেখলাম না। ছিমছাম রাস্তা। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে সামনেই প্রথমে যে বাড়িটা পেলাম। সেখানেই ঢুকে পড়লাম। দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এলাম, একটা বড় হলঘর। কয়েকজন লোক গোল হয়ে বসে আছেন। তাদের দেখে বেশ গণ্যমান্য বলে মনে হলো। ঘরে ঢুকে নিজেকে নিরাপদ বলে ভাবলাম-ফাড়া বোধ হয় কেটে গেলো। ওদের কাছে সালাম জানিয়ে বললাম :

—আমার জানশাহ; আমি সুলতান টিগমাসের পুত্র। কাবুলে এবং বানু সালানের অধিপতি আমি। অনেক বিপদ কাটিয়ে এখানে এসেছি আমি। এখান থেকে আমার রাজ্য কত দূরে আর কোনদিকে দয়া করে বলে দেবেন? আমি ক্ষুধার্তা!

যারা বসেছিলেন সকলেই আমার দিকে তাকালেন। একজনই আমার সঙ্গে কথা বললেন। তাকে দেখে মনে হলো। উনি বোধ হয়। ওদের দলের মাথা। উনি আমাকে ইশারায় বললেন—আগে খানাপিনা করে নাও চুপচাপ। কথা বলে না।

আঙ্গুল দিয়ে একটা খাবারের থালা দেখিয়ে দিলেন। থালায় অনেকখানি রান্না করা মাংস। এরকম রান্না করা মাংস আমি কোনদিন খাইনি। পাশেই সরাব ছিলো। নিজের মনে মাংস আর সরাব খেলাম। তারপর চুপ করে বসে রইলাম।

কিছুক্ষণ পর সেই দলপতি আমার কাছে উঠে এসে কথা বললেন। অদ্ভুত সে সব কথা। সাংকেতিক ভাষায় বললেনঃ

–কে? কখন? কোথায়?

আমি ইশারা করে জেনে নিলাম। উত্তর দিতে পারব কি না।

ইশারায় জানালেন, মাত্র তিনটি কথা বলতে পার।

আমি বললাম—ব্যবসায়ীর দল, কালুল, কখন?

বৃদ্ধ ইশারায় জানালেন—জানা নেই।

তারপরে আমাকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন—খানাপিনা শেষ হয়েছে, যাও কেটে পড়।

সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আশ্চর্য হলাম-সবাই দেখি ইশারা করছে। এতো মহা সমস্যায় পড়া গেলো দেখি! কে সাহায্য করতে পারবে ভাবছি। একটা চীৎকার কানে এলো।

—এক সহস্ব সুবৰ্ণ মুদ্রা যে রোজগার করতে চাও, তার সঙ্গে সুন্দরী ক্রীতদাসীও পাবে, আমার সঙ্গে চলে এসো-মাত্র এক প্রহরের কাজ করলেই পেয়ে যাবে।

এদিক ওদিক ঘুরে কোন লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। যে লোকটা চেঁচাচ্ছিল তার কাছে গিয়ে বললাম-আমি করে দেব, এক হাজার সুবর্ণমুদ্রা আর মেয়েটাকে চাই।

আর কোন কথা না বলে লোকটা আমার হাত ধরে একটা বাড়িতে নিয়ে গেলো। বেশ ধনী লোকের বাড়ি। সুন্দর সুন্দর আসবাব পত্রে সারাবাড়ি ভর্তি। বাড়ির ভেতর একজন বুড়ো ইহুদী বসেছিলো একটা আবলুস কাঠের আসনে। সেই লোকটা বুড়োকে কুর্নিশ করে বললো—এই যে একজনকে পেয়েছি। লোকটা ভিনদেশী মনে হয়। তবে যুবক তো, খাটতে পারবে তিন মাস ধরে সমানে। হেঁকে যাচ্ছিলাম, এই লোকটাই সাড়া দিলো এত দিনে।

বুড়ো সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে ওর পাশে আমাকে বসিয়ে ভালো ভালো খাবার আর পানীয় এনে দিলো। খাবার দাবার খুব উপাদেয় ছিলো বলতে পারি। তারপর থলে থেকে গুণে গুণে এক হাজার দিনার দিলে আমাকে। ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিনারগুলো দেখলাম; না, এগুলো অচল বা জাল নয়। আমার খুব আশ্চর্য লাগছিলো ব্যাপার স্যাপার দেখে। যা হোক কয়েকজন নফরকে বলে আমার জন্য উৎকৃষ্ট পোশাক আনিয়ে দিলো। ওগুলো পরে ফেললাম। যে মেয়েটি আমার হবে, তাকেও আনিয়ে দিলো। এতো অদ্ভুত ব্যাপার! কি করতে হবে, কি কাজ তার নামে পাত্তা নেই। অথচ কাজের মজুরী মেয়েটাকে এনে দেখানো সবই আগাম হলো! ভারি মজা লাগছে। আমার।

ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে রইলো।

 

তিনশো তেষট্টিতম রজনী :

পরের দিন রাত্রে শাহরাজাদ বলতে শুরু করলো : রেশমের জামা পরিয়ে মেয়েটার ঘরে পৌছিয়ে দিলো আমাকে। মেয়েটি আমার জন্যে

অপেক্ষা করছিলো। আমাকে ঘরের মধ্যে রেখে নফররা বেরিয়ে গেলো। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। যা হোক সুন্দরী নারী সামনে বসে আছে, তাকে উপেক্ষা করা যায় না। রাত কাটালাম মেয়েটির সঙ্গে। বুড়ো বলেছিলো মেয়েটি কুমারী, অস্পর্শিত। সহবাসে বুঝলাম কথাটা বুড়ো মিথ্যে বলেনি। এভাবে তিনদিন তিনরত কেটে গেলো। তিনদিন তিনরত ঘর থেকেই বের হইনি। ভালো ভালো খানা খাওয়া ছাড়া আর যা কিছু করার ওই মেয়েটার সঙ্গে ছাড়া করার মত অন্য কিছু ছিলো না।

চারদিনের দিন সকালবেলা বুড়ো আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললো—তোমার কাজের পাওনা তো অগ্রিমই পেয়েছ। এখন কাজ করতে পারবে তো?

কি কাজ, কেমন কাজ কিছুই জানি না। তবু কাজ তো করতেই হবে। আমি শুধু বললাম-হ্যাঁ, আমি তৈরী।

বুড়োর নির্দেশে দুজন ক্রীতদাস আমাকে নিয়ে গেলো দুটো লাগাম বাঁধা খচ্চরের কাছে। একটির ওপর একজন আগে থেকে বসেছিলো। লোকটা আমাকে অন্যটার ওপর বসতে বললো। ঠিক ঠাক করে বসতে না বসতেই খচ্চর দুটো খুব জোরে ছুটতে আরম্ভ করলো। কোন মতে নিজেকে সামলে নিলাম! সকাল থেকে একটানা দুপুর পর্যন্ত খালি ছুটে গেলাম। অবশেষে আমরা একটা পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছলাম। পাহাড়টা ভীষণ খাড়াই। মানুষ বা কোন জন্তুর পক্ষে এ পাহাড়ে চড়া অসম্ভব। খচ্চর থেকে দু’জনে নেমে পড়লাম। লোকটা বললো :

-এই নাও ছুরি। এটা দিয়ে তোমার খচ্চরটার পেট ফাঁসিয়ে দাও। কাজ করার সময় শুরু হয়ে গেছে।–কাজ শুরু করা।

আমিও কাজ শুরু করে দিলাম। ছুরিতে পেট ফাঁসিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খচ্চরটা মরে গেলো। লোকটার নির্দেশ মত খচ্চরের ছাল ছাড়িয়ে নিলাম।

এবার লোকটা বললো-চামড়ার ওপর শুয়ে পড় ঝটপট। আমি চামড়াটা সেলাই করে দেব।

যেভাবে সে বলেছে সেভাবে আমি আদেশ মেনে চলেছি। চামড়াটা পেতে শুয়ে পড়ি। লোকটা সাবধানে সেলাই করতে লাগলো যাতে আমার গায়ে ফুটে না যায়। সেলাই করতে করতে সে বললো-শোনো মন দিয়ে এখনি একটা বিরাট বাজ পাখী এসে পড়বে। তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাখিটা ওর পায়ে খামচে তোমাকে ওর বাসায় নিয়ে যাবে। এই দুৰ্গম পাহাড়ের চুড়ায় ওর বাসা। আকাশে ওড়ার সময় একদম নড়বে না। নড়লে ভয় পেয়ে আকাশ থেকে ধাপ করে ফেলে দেবে তোমাকে। তাহলে কি হবে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। পাহাড়ের চুড়ায় যেই তোমাকে রাখবে সঙ্গে সঙ্গে ছুরি দিয়ে চামড়াটা কেটে বেরিয়ে আসবে। পাখীটা তোমাকে দেখে ভয়ে পালাবে। এবার তোমার আসল কাজ করতে হবে। চূড়ায় দেখবে বহু মূল্যবান পাথর রয়েছে। তুমি ওপর থেকে ওগুলো গড়িয়ে নীচে ফেলে দেবে। বুঝেছো? পাথর ফেলে দেওয়া হয়ে গেলে নীচে নেমে আসবে। আমরা দুজন ফিরে চলে যাবো।

কথা বলতে বলতে ইহুদীটা সরে গেলো আমার কাছ থেকে। মুখ ঢাকা ছিলো বলে বুঝতে পারিনি, কখন চলে গেছে। ওর কথা শেষ হতে না হতে আমাকে হেঁচকাটানে আকাশে তুললো, টের পেলাম। আমি মড়ার মত পড়ে আছি। এক জায়গায় আমাকে নামিয়ে দিলো মনে হলো। না। টই আকাশ থেকে ছাড়েনি, পিঠের নীচে শক্ত পাথর রয়েছে টের পেলাম। ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে চামড়া কেটে বেরিয়ে এলাম। সবে মাথাটা বার করছি পাখীটা ভয়ে বিকট চীৎকার করে পালিয়ে গেলো! আমার আসল কাজ শুরু হলো এবার। চুনি পান্না আরো মূল্যবান সব পাথর আগে এক জায়গায় জড়ো করে নিলাম। সব একসঙ্গে নিচে ফেলে দিলাম ইহুদীটার কাছে। ওপরের কাজ শেষ করে এবার নীচে নামব, আমার মজুরি নিয়েবাড়ি যাব। কত কাজ পড়ে আছে। কিন্তু নািমব কি করে? চুড়ার কার্নিশের পরে বিশাল খাড়াই। এদিকে ওদিকে ঘুরে দেখালম, নাঃ কোন রাস্তাই নেই নামবার। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। দামী দামী পাথরগুলো বস্তায় বেঁধে ইহুদীটিা ওর খচ্চরের ওপরে চেপে দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে। আমি ওপরে নির্বাসিত।

দুঃখে, কষ্টে, আতঙ্কে চূড়ায় বসে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলাম। তারপর আল্লার নামে সোজা হাঁটতে লাগলাম যা হবার হবে। না পড়ে যাইনি, হেঁটে চললাম। একনাগাড়ে দুমাস ধরে। আশে পাশে সব পাহাড়ের চুড়া মালার মত গাঁথা। শেষ চুড়ায় সে পৌঁছনোর পর পরম করুণাময় আল্লার কৃপায় এক উপত্যকা দেখতে পেলাম। ছোট ছোট নদী বয়ে চলেছে তার ওপর দিয়ে। তাছাড়া আল্লার দুনিয়ায় প্রকৃতি অকৃপণ হাতে সব যেমন ঢেলে দেয়, এখানেও তাই দেখছি। সবুজ গাছে গাছে ফল ধরে আছে, নানান রং-এর আর গন্ধের ফুল ফুটে আছে। জানা অজানা অসংখ্য পাখীর কলরব। প্রকৃতি যেন তার ভাণ্ডার এখানে উজাড় করে দিয়েছে। সামনে আকাশ ছোঁয়া বিশাল একটা প্রাসাদ। প্রাসাদপুরী ঢোকার সিংহদ্বারের সামনে একটা আসনে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। তিনি আমার পথরোধ করলেন। তার মুখে যেন বেহেস্তের দুতি। তার হাতে রাজদণ্ড—চুনির তৈরি। মাথায় হীরার মুকুট। ইনি নিশ্চয়ই রাজা হবেন। আমি কুর্নিশ করলাম।

প্রত্যাভিবাদন করে মধুর কণ্ঠে বললেন—বৎস, আমার পাশে বস।

আমি বসলাম। উনি বলে চলেছেন–এখানে কখন এসেছ বাছা? কোথা থেকেই বা আসছ? তোমার আগে কোন মানুষ এদেশে আসেনি! কোথায় যাবে বাবা?

এত অন্তরঙ্গ কথা এত মধুর ব্যবহার বহুকাল শুনিনি। আমার হৃদয়ের সব কথা যেন ঠেলে বের হতে চাইছে এক সঙ্গে। কথাগুলো এক সঙ্গে ঠোকাঠুকি করছে। জবাবে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কথার চাপে বুকটা ফুলে ফুলে উঠলো। অবরুদ্ধ অভিমানে, ক্ষোভে আমার চোখের জল বাধা মানে না। আমি ফোপাতে থাকি। বৃদ্ধ বললেনঃ

–এভাবে কেঁদ না বাছা! তোমার কান্নায় আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছে যে! নিজেকে শক্ত করা। বুঝতে পারছি দুর্বল হয়ে পড়েছি। ঠিক আছে এখন আর কিছু বলতে হবে না। আগে খানাপিনা করে চাঙ্গা হয়ে নাও তারপর সব শুনছি।

আমাকে সঙ্গে করে তিনি একটা হলঘরে নিয়ে গেলেন। বহু রকমের পানীয় আমাকে দেওয়া হলো। পাশে বসে আমাকে খাওয়ালেন বৃদ্ধ। বেশ তাজা মনে হলো নিজেকে। এবার আমার কাহিনী শুনতে চাইলেন তিনি। আনুপূর্বিক সব বলে গেলাম তাকে। আমার বলার শেষে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। এ প্রাসাদ কার?

তিনি বললেন—বৎস, প্রাচীনকালে এই প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন সুলেমান। তারই নির্দেশে আমি পক্ষীদের সর্বাধিনায়ক। দুনিয়ার তামাম পক্ষী এখানে একবার আসবেই তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য। তুমি দেশে ফিরে যেতে চাইলে আমি একটা পক্ষীকে বলে দেব। তারা আমার আদেশে যেখানে যেতে চাও সেখানে নিয়ে যাবে ভালোভাবে। তবে তারা এখনো এখানে এসে পৌছোয় নি। তারা না আসা পর্যন্ত তুমি এই প্রাসাদে ঘুরে বেড়াতে পোর। তোমার ইচ্ছে মত যে কোন ঘরে প্রবেশ করতে পার শুধু একখানা ঘর বাদে। সেই ঘরখানা সোনার চাবিতে খোলে। এই সব চাবির মধ্যে সোনার চাবিটি দেখতে পাবে।

এই বলে চাবির গোছাটি আমাকে তুলে দিয়ে পক্ষী-অধিপতি চলে গেলেন। আমি এবার ইচ্ছে মত ঘুরতে পারব। প্রথমে আমি হলঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। এসব ঘরে পাখীদের থাকবার চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। অবশেষে সেই ঘরখানা যেটা সোনার চাবি দিয়ে খোলে তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি। ঘরটাকে ছুতেও ভয় লাগে। বৃদ্ধের আদেশ-বাণী এখনো আমার কানে বাজছে।

ভোর হয়ে আসছে। গল্প থামিয়ে চুপ করে থাকে শাহরাজাদ।

 

তিনশো চৌষট্টিতম রজনী :

পরের রাজনীতে আবার গল্প শুরু করলো শাহরাজাদ।

জানশাহ্‌ বুলুকিয়াকে তার কাহিনী বলে চলেছেঃ

—এদিকে আমার মনের ভেতরে অদম্য কৌতূহল। তাকে চেপে রাখা বেশ কষ্টকর। কৌতূহল ক্বমে যুক্তি ও নিষেধ ভাসিয়ে দিলো। মনের সঙ্গে লড়াই করে সম্পূর্ণ পরাস্ত হলাম আমি। কাঁপতে কাঁপতে ঘরখানা সোনার চাবি দিয়ে খুললাম আমি। কী জানি ভেতরে কি আছে। অজানা নিষিদ্ধ বস্তুর টানে কম্পিত চরণে ঘরে ঢুকে পড়লাম।

নাঃ, ভয়ের কিছু নেই। বরং মনোহর দৃশ্যে আমার চোখ ভরে গেলো। দরজা খুলে ভালোই হয়েছে। নচেৎ এত সুন্দর জিনিস দেখা হত না। ঘরের ভেতরে বিরাট একটা শামিয়ান টাঙ্গানো। মেঝেটাি নানারকম মূল্যবান পাথরে তৈরি। একটা রূপের গামলার মত বড় পুকুরে ফোয়ারা থেকে মিষ্টি আওয়াজে জল বের হচ্ছে। পুকুরের চারধারে অনেকগুলি সোনার পাখী বসানো। পাশে একটা সিংহাসন বড় চুনি কেটে তৈরি করা।

ধীরে ধীরে সিংহাসনের সিডি বেয়ে আমি ওপরে উঠতে লাগিলাম। সিংহাসনের মাথায় লাল সিল্কের চাঁদোয়া। সিংহাসনে বসে একটু চোখ বুজলাম। চোখ খুলে দেখলাম তিনটি মেয়ে পুকুরে নেমে নাইতে লেগেছে। দেখে, বুলুকিয়া ভাই, কি বলব, আমারও সাঁতার কাটতে ইচ্ছে হলো। পাগলের মত ঐ গামলার পুকুরের ধারে ছুটে গেলাম। পাড়ে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠি :

-যুবতী মেয়েরা, সোনা মেয়েরা, রানীর দল। আমাকে দেখতে পেয়ে মেয়েরা তারস্বরে চিৎকার করতে করতে জল থেকে দ্রুত উঠে পালক দিয়ে নিজেদের গোপন স্থান ঢাকার চেষ্টা করে। তাদের মুখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। ওরা তাড়াতাড়ি পুকুরের পাড়ের গাছের মগ ডালে গিয়ে উঠলো। ঘাড় কত করে নিচে আমাকে দেখতে থাকে। ওদের দৃষ্টিতে যেন ঠাট্টার আভাস। আমিও সেই গাছে চড়ে ওপরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি :

—তোমরা রানীর মত সুন্দরী! তোমরা কারা বলো না গো! রাজ টিগমাসের ছেলে আমি। আমার নাম জানশাহ। আমার বাবা কাবুল ও বানু-সাহিলানের সুলতান।

ওদের মধ্যে কম বয়েসী মেয়েটি আমার কথার জবাব দিলো। মেয়েটি তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরীও বটে। ও বললো :

—আমরা তিন বোন রাজা নসার-এর মেয়ে। আমার বাবা হীরা প্রাসাদে থাকেন। গোছল করতে আর মজা করার জন্য আমরা এখানে আসি।

সঙ্গে সঙ্গে বললাম—আমাকে দেখে কি তোমাদের একটুও ভালো লাগে নি? নিশ্চয়ই লেগেছে, কি বল? তবে এসো, আমার সঙ্গে খেলবে। আর আনন্দ করবে!

মেয়েটি সেই মগডাল থেকেই বললো—জানশাহ, যুবতী মেয়েরা জোয়ান ছেলেদের সঙ্গে খেলতে পারে নাকি? আমার পরিচয় আরো ভালোভাবে নিতে হলে আমার সঙ্গে আমাদের প্রাসাদে চলো বাবার কাছে।

আমার দিকে বলোল কটাক্ষ হেনে মেয়েটি তার দু বোনকে নিয়ে চলে গেলো যেন উড়ে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম হৃদয়ে।

ওরা চলে গেলো। হায় হায়, আমার যে সব জ্বলে যাচ্ছে, কিভাবে নেবাই এ জ্বালা? মনোকষ্টে গাছ থেকে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।

গাছতলায় কতক্ষণ এভাবে পড়েছিলাম, জানি না। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি মাথার কাছে সেই বৃদ্ধপক্ষী অধিপতি বসে আছেন। আমার চোখে মুখে গোলাপ জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। চোখ খুলতে দেখে তিনি বললেন, :

–অবাধ্যতার শাস্তি কেমন দেখলে তো? এই নিষিদ্ধ স্থানের দরজা খুলতে তোমাকে পইপই করে মানা করি নি?

জবাব দেবার মুখ নেই আমার। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ফোপাতে থাকি।

—কি হয়েছে তোমার এবার বুঝতে পারলাম! পায়রার সাজে মেয়েদের তুমি দেখেছিলে। ওরা মাঝে মাঝে গোছল করতে এখানে আসে।

–আপনি ঠিকই বলেছেন ওরাই এসেছিলো। — কীদিতেকাঁদতে  বলি-হীরা প্রাসাদ কোথায় দয়া করে বলে দিন। কোন পথে সেখানে যাব বলে দিন।…সেই হীরা প্রাসাদে নাকি মেয়ে তিনটে থাকে ওদের বাবা নাসার-এর সঙ্গে।

–সর্বনাশ! সেখানে যাবার কথা চিন্তা করো না। রাজা নাসর কে জান? জিনদের অত্যন্ত শক্তিশালী নেতা সে। তুমি ক্ষেপেছ? ওর মেয়ের সঙ্গে তোমার শান্দি ও কখনই দেবে না। ওসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তার চেয়ে নিজের দেশে কি করে ফিরবে। তাই ভাব তৈরি হয়ে নাও। বড় বড় পাখীরা শিগগির এখানে আসছে। ওদের বলে দেবো। তোমাকে পিঠে চাপিয়ে নিয়ে দিয়ে আসবে।

—আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। ওকে যে আমি দেখতে না পেয়ে মরে যাব। আপনি আমার বাবার মত, ওকে যাতে আবার দেখতে পাই আপনি দয়া করে তার ব্যবস্থা করে দিন। আমি আমার দেশে ফিরতে চাই না। আমার লোকেদের দেখতে চাই না-শুধু একবারটি দয়া করুন, আপনার পায়ে পড়ি।

বৃদ্ধের পায়ে মাথা রেখে শুয়ে পড়ি। মেয়েটির রজনীগন্ধার রূপ দূর থেকে কেবল দেখেছি, কিন্তু তার সুবাস তো পেলাম না। তার স্পর্শ তো পেলাম না, না পেলে তো বাঁচব না। আভিমানে আব্দারে আঝোরে কাঁদতে থাকি।

এই সময় রাত ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ হয়ে গেলো।

 

তিনশো আটষট্টিতম রজনী :

জানশাহ বৃদ্ধের পায়ে পড়ে কাঁদছে। পক্ষী অধিপতি তাকে দু-হাত দিয়ে তুলে ধরে বললেন-বুঝেছি, মেয়েটার জন্য তোমার ভেতরে আগুন জ্বলছে। ওকে না পেলে এ আগুন আর নিভবে না। ঠিক আছে, এতই যখন তোমার ইচ্ছে, যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। আর আমার কথা মত চললে মেয়েটিকে তুমি পাবে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে চুপচাপ। ওরা আবার আসবে গোছল করার জন্য। পালক খুলে রেখে যথারীতি জলে নামবে। তুমি ঝাঁট করে ওদের পালকের পাখনাগুলি সরিয়ে ফেলবে। পাখনাগুলি ফেরত পাওয়ার জন্য। ওরা তোমাকে খুব ভালো ভালো কথা বলবে। তোমার মন জয় করার জন্য তোমার গুনগান করবে। এমন কি বিবসনা হয়ে তোমাকে সোহাগ জানাবে। কিন্তু সাবধান! একবার যদি ওরা তোমাকে ভিজিয়ে পাখনাগুলি নিয়ে যেতে পারে ওরা আর কখনো এখানে আসবে না। সুতরাং ওরা যাই বলুক। আর যা-ই করুক পাখনা ফেরত দেবে না কিছুতেই। ওদের বলবে, শেখ আসুক আগে তার পর তোমাদের পোশাক ফেরত পাবে। আমি এখানে না। আসা পর্যন্ত ওদের ওপর কিচুতেই নরম হবে না। নিজেকে শক্ত করে রাখবে। আমি এসে গেলে সব ব্যবস্থা করে দেবো, তোমার বাসনা পূৰ্ণ করে দেবো। ܐ

পক্ষী অধিপতিকে অজস্র ধন্যবাদ জানালাম। উনি চলে গেলেন আর আমিও গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম।

অনেকক্ষণ লুকিয়ে আছি বাতাসে পাখা ঝািপটের শব্দ শুনতে পেলাম, শুনলাম ওদের হাসোহাসিও। হ্যাঁ, ওরা আসছে। উড়ে এসে পুকুরের পাড়ে বসলো, এদিক ওদিক দেখলো আডি পেতে ওদের কেউ দেখছে কিনা। যে মেয়েটি সেদিন আমার সঙ্গে কথা বলেছিলো সে বোনদের বললো :

–দিদি, বাগানে কেউ লুকিয়ে নেই তো রে! সে দিন যে ছেলেটিকে দেখেছিলাম তার কি হলো বলতো?

—সানসা, ও নিয়ে তোর আর মাথা ঘামাতে হবে না। আয় জলে নামি।

ওরা পাখাগুলি খুলে ফেলে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সুন্দর ভঙ্গী করে কি দারুণ সাঁতারই না। কেটে চলেছে, যেন তিনটি চাঁদ জোয়ারের জলে পাড়ি দিচ্ছে। ওদের গায়ের রং-এর ঔজ্জ্বল্যে ফোয়ারার জলগুলি যেন রূপো বনে গেলো।

আমিও লক্ষ্য করে আছি কখন ওরা তীর ছেড়ে পুকুরের মাঝখানে চলে যায়। সাঁতার কাটতে কাটতে হুল্লোড় করে ওরা পুকুরের মাঝখানে যেতেই তীর বেগে বেরিয়ে ছোট মেয়েটির পোশাক তুলে নিলাম। আচমকা আমাকে দেখে ওরা সমানে চেঁচাতে থাকে। কোন কথা না। বলে আমি শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো বিবসনা সুন্দরী তিনজন। জলের ওপরে শুধুমাত্র মাথাগুলি ভাসিয়ে রেখে আমার দিকে তীরের কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। চোখে মিনতি। না, ভুলব না ওসব ছলনায়। নিজেকে শক্ত রেখে হাঃ হাঃ করে হোসে পাখনার পোশাক মাথার ওপর তুলে নাচাতে থাকি। ছোট মেয়েটি,

যার নাম সানসা, সে আমায় বললো :

—তুমি একজন যুবক, তার ওপর মানী লোক, যে জিনিস তোমার নয় তা কি করে নিলে?

–ওপরে উঠে এসো আগে তারপর আমার সঙ্গে কথা বলে।

–নিশ্চয় তোমার সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু বিবসনা তো উঠতে পারি। না! আমার পোশাকটা দাও, ওটা পরে নিয়ে তবে তো ওপরে উঠবো। তারপর যেমন তোমার খুশী আমার সঙ্গে কথা বলো আদর করো।

—তুমি আমার দিল! দুনিয়ার সেরা সুন্দরী তুমি! তোমাকে না পেলে আমি 零メ বাঁচব না। কিন্তু ওতো দিতে পারছি না গো! তোমার পোশাক ফেরৎ দেওয়া মানে তো আমার নিজের হাতে নিজের বুকে ছুরি বসানো। আমার বন্ধু, পক্ষী অধিপতি যতক্ষণ না এসে পড়ছেন, তোমার পোশাক ফেরত পোচ্ছ না, বুঝেছে সুন্দরী!

আমার কথা শুনে ওরা এ-ওর দিকে দেখে ফিসফিস করে কি যেন বললো। তারপর সানসা বললো :

—তুমি শুধু আমার পোশাকটাই নিয়েছ। এক কাজ কর, তুমি পেছন ফিরে দাঁড়াও, আমার দিদিরা জল থেকে উঠে ওদের পোশাক পরে নিক। ওদের পোশাক থেকে কয়েকটা পালক ছিঁড়ে দেবে আমাকে। আমার দেহের গোপন স্থানগুলি ঢেকে জলের ওপর উঠে আসব। লক্ষীটি, আমার এই মিনতিটুকু রাখে।

—এটা হতে পারে। বলে আমি চুনী সিংহাসনের পেছনে গিয়ে দাঁড়াই।

বড় বোন ওপরে উঠে এসে ঝটপট পালকের পোশাক পরে নিলো। ওদের পোশাক থেকে অনেকগুলি পালক ছিঁড়ে দিয়ে একটা ছোট আচ্ছাদনের মত তৈরি করে সানসা উঠে এসে পরে নিয়ে বললো—তুমি এবার বেরিয়ে আসতে পার।

ছুটে বেরিয়ে এসে সানসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওর গায়ে অসংখ্য চুমু খেতে থাকি। অবশ্য ওরা পোশাকটা ও হাত দিয়ে যাতে ধরতে না পারে তার ব্যবস্থা করে রেখেছি। এক হাতে ওটা শক্ত করে ধরে রাখি। পা থেকে জড়িয়ে ধরে তুলে নিয়ে ও আমাকে আদর করতে থাকে, সোহাগ জানায়। নানা খোসামুদি কথা বলে পোশাকটা চাইতে থাকে বার বার। উন্থ, আমি কিন্তু ভুলছি না। ওসব কথায় বা কাজে আমি টলছি না। ওকে চুনী সিংহাসনের কাছে কোন মতে টেনে নিয়ে আসি। সিংহাসনে বসে পড়ে ওকে আমার কোলে বসিয়ে নিলাম। ও বাধা দিতে পারলো না। বাস নিশ্চিন্ত!

পালাবার উপায় না দেখে আমার কামনায় সাড়া দিলো সানসা। দু-হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। চুম্বনের প্রত্যুত্তরে চুম্বন করলো, আলিঙ্গনের জবাবে শক্ত হাতে আলিঙ্গন করলো। পলে দু’জনের শরীর যেন মিশে যেতে থাকে। আবেগে আর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে সানসা। বড় বোন দুজন আমাদের পাহারা দিতে থাকে। ওদের মুখে মৃদুহাসি। আমাদের আনন্দে যাতে বাধা না পড়ে সে জন্য ওরা কোন কথা বলে না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমার আশ্রয়দাতা বৃদ্ধ দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন। তাকে সম্মান দেখানোর জন্য আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওঁর হাত চুম্বন করলাম। আমাদের বসতে বলে তিনি বললেনঃ

—মা, তুমি এই ছেলেটিকে পছন্দ করেছ, ও তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে, এতে আমি খুবই খুশী হয়েছি। উচ্চবংশের ছেলে জানশাহ। তোমার বাবা রাজা নাসির-ও মনে হয়। এতে খুশী হবেন। তোমাদের শাদীতে ওঁর বোধহয় আপত্তি হবে না। ওর বাবা রাজা টিগমাস আফগানিস্থানের সুলতান। তোমার বাবাকে সব বুঝিয়ে বলবে, তাকে রাজি করাতে হবে মা।

—আমি আপনার আদেশ মাথা পেতে নিলাম।

সানসা মাথা নীচু করে বললো। বৃদ্ধও মাথায় হাত রেখে বললেন, —যদি সত্যিই ওকে গ্রহণ করা তাহলে আমার সামনে শপথ করা যে আজীবন তোমার স্বামীর প্রতি নিষ্ঠাবতী থাকবে। আর কোনদিন ওকে ছেড়ে চলে যাবে না।

সানসা মাথা তোলে। পক্ষী অধিপতি দু-হাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন—এসো আমরা সেই সর্বসক্তিমান পরম করুণাময় আল্লাকে ধন্যবাদ দিই। তারই ইচ্ছায় তোমাদের মিলন হলো। তোমরা সুখী হও! তোমাদের মধ্যে আর কোন বাধা রইলো না। জনসাহ, ওর পোশাক ফেরত দিয়ে দাও। ও কথা দিচ্ছে কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবে না।

বৃদ্ধ এবার আমাদের হল ঘরে নিয়ে গেলেন। মেঝেতে সুন্দর গালিচা বিছান। তার ওপর অনেকগুলি থালা। থরে থরে ফল সাজান রয়েছে। থালাগুলিতে। সানসা ওর দিদিদের বিদায় দেবার জন্য বৃদ্ধের কাছে অনুমতি চাইলো। ওরা ওর বাবার কাছে গিয়ে ওদের শাদীর খবর দেবে। দেবে আমরা হীরা প্রাসাদে তাড়াতাড়ি পৌঁছাচ্ছি। সে খবরও।

বোনেরা চলে গেলে সানসা সুন্দর করে ফল কেটে সাজিয়ে দিলো আমাদের সামনে! ওর সৌজন্য বোধ কতখানি টের পেলাম। হাজার হোক রাজার মেয়ে তো!

এদিকে রাত হয়ে এসেছে। আমরা দুজনে চলে গেলাম একটি ঘরে। সারাদিনের ক্লাস্তি এবার দুটি দেহের মিলনে শ্রান্ত হলো! এক অনাস্বাদিত আনন্দে সারা রাত কেটে গেলো।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প বলা বন্ধ করলো।

 

তিনশো উনসত্তরতম রজনী?

জানশাহ তার কাহিনী বলতে থাকে।

ভোর হতেই সানসা ঘুম থেকে উঠে। ওর পালকের পোশাক পরে সেজোগুঁজে তৈরী। আমাকে ঘুম থেকে জাগাবার জন্য আমার কপালে ছোট্ট এখটি চুমু দিয়ে বললো-ওগো, ওঠে।া! তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। এক্ষুণি বের হতে হবে। বাবার হীরার প্রাসাদে যেতে হবে না!

বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। আমার তৈরী হতে বেশী সময় লাগলো না। দু’জনে পক্ষী অধিপতির কাছে গেলাম। তার সাহায্য ছাড়া আমার এমন সৌভাগ্য হত না! স্যানসাও আমাকে পেয়ে খুশী। আমরা দুজনে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।

সানসা বললো—এই শোনো, এবার তুমি আমার পিঠে উঠে শক্ত করে ধরে বসে পড়। দুষ্টুমি করো না। আমাকে অনেকখানি উড়ে যেতে হবে প্রাসাদে পৌঁছতে।

আকাশে উঠে বায়ু বেগে উড়ে চললো সানসা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নেমে পড়লাম হীরা প্রাসাদের প্রবেশ পথের সামনে। ধীরে প্রাসাদের ভেতের হেঁটে চললাম। আমাদের আগমনবার্তা ঘোষণা করার জন্য কটা জিন বাইরে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো।

সানসার বাবা রাজা নাসর জিনদের নেতা। তিনি আমাকে দেখে খুশী হয়েছেন বলে মনে হলো। আলিঙ্গন করে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দামী পোশাক এনে পরতে দিয়ে আমাকে রাজসিক অভ্যর্থনা জানালেন। একটা হীরের মুকুট আমার মাথায় পরিয়ে দিলেন। সানসার মা আসতে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেয়ের পছন্দ দেখে রানীও খুশী। তিনি তাঁর মেয়েকে কতগুলি হীরে উপহার দিলেন বরণ করে।

এবার আমাদের হামামে নিয়ে যাওয়া হলো। নানা সুরভিত এবং নানা রং-এ রাঙ্গানো জলে গোছল করলাম। গোলাপ জল, কস্তুরি মেশানো জল আরো কত কি জল যে। ছিলো। ঠাট্টা তামাসার মধ্যে উভয়ের গোছল শেষ হলো। শরীর ও মন তরতাজা হয়ে উঠলো। এর পর শুরু হলো ভোজন পর্ব। আমাদের সম্মানার্থে এক নাগাড়ে তিন দিন তিন রাত ধরে ভোজ চললো মহাসমারোহে। রাজ্যের যে যেখানে ছিলো সবাই এ ভোজে যোগর্দান করলো।

এভাবে মহাআনন্দে কয়েকদিন আমার শ্বশুরবাড়িতে কেটে গেলো। এবার দেশে ফিরতে হবে। তাই রাজা নাসরকে জানালাম, আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার মা-বাবাকে তো বৌ দেখাতে হবে। ছাড়তে কষ্ট হলেও রাজা ও রানী আমাদের যাবার অনুমতি দিলেন। একটা প্রতিশ্রুতি আমার কাছ থেকে তারা নিয়ে নিলেন যে, বছরে একবার আমাকে সানসাকে সঙ্গে নিয়ে হীরাপ্রাসাদে কিছুদিন বেডিয়ে যেতে হবে।

রাজা নাসর বিশাল এক সিংহাসন তৈরী করিয়ে আমাকে ও সানসাকে তাতে বসিয়ে কিছু মেয়ে জিন আমাদের তদারকির জন্য সঙ্গে দিয়ে পুরুষ জিনেদের কাঁধে চাপিয়ে দিলেন। তারা আকাশ পথে উঠে দুবছরের পথ দুদিনে শেষ করে আমাদের কাবুলে পৌঁছে দিলো।

আমার বাবা-মা ধরে নিয়েছিলেন। আমি আর বেঁচে নেই। প্রাসাদে আমাকে নামতে দেখে তাঁরা দুজনে যারপর নাই খুশী হয়েছিলেন। সানসার সঙ্গে আমার শাদী হয়েছে শুনে আনন্দে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। আনন্দের আতিশয্যে মা মুছিতা হয়ে পড়লেন। সানসা তার নাকে মুখে গোলাপ জল ছিটিয়ে সুস্থ করে তুললো।

সারা সালতানিয়ত জুড়ে খুশীর বন্যা বয়ে গেলো। খানাপিনা ও দানখয়রাতি চলতে লাগলো দেদার। শাদীর কিছু অনুষ্ঠান বাকী ছিলো, সেগুলি সম্পন্ন করা হলো। সব কিছু চুকে গেলে বাবা সানসাকে ডেকে বললেন – তোমার মত চোখ জুড়ানো রূপের মেয়ে দুনিয়ায় দুটি খুঁজে পাওয়া যাবে না মা। আমার রাজ্যের আকাশে চাঁদ হয়ে থাকবে তুমি। তোমার খুশীতে আমরা সবাই খুশী হব। এবার বলো এমন কি পেলে তুমি খুশী হবে।

—মনোরঞ্জনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই আমার আছে বাবা। আপনাদের দোয়া আমাকে

সবচাইতে বেশী খুশী করবে।

—তোমার মহান বংশের মেয়ের মতই উপযুক্ত কথা বলেছ মা। তবুও তুমি কিছু চাও যা দিয়ে আমি তৃপ্ত হই।

—বেশ আপনি এমন একটা জায়গা বেছে দিন যেখানে চারদিকে থাকবে বাগান। ফুল আর ফলের গাছ থাকবে সে বাগানে। ছোট্ট একটি নদী বয়ে যাবে বাগানের ভেতর দিয়ে। আমরা দুজনে সেখানে থাকবো। এর বেশী কিছু আমার চাওয়ার নেই।

–বেশ তাই হবে মা।

বাবার আদেশে কাজ শুরু হলো। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা নতুন জায়গায় বাস করতে শুরু করলাম। সুখে আর তৃপ্তিতে আমাদের দিন কাটতে লাগলো।

এভাবে বছর ঘুরে গেলো। সানসা বাপেরবাড়ি যাবার জন্য তৈরী হয়ে। আমার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলো। কিন্তু হায়! ওর বাপেরবাড়ি যাওয়াটাই কাল হলো!

আমরা সেই সিংহাসনে গিয়ে বসালাম। বাহক আমাদের উড়িয়ে নিয়ে চললো। রাত্রে যাত্ৰা স্থগিত থাকত। জলের ধারে বা গাছের নীচে বিশ্রাম নিতাম। একদিন সন্ধ্যাবেলা আমরা একটা নদীর ধারে থাকলাম। সানসা গোছল করবে। আমাকে বললো। আমি এ সময়ে গোছল করতে অনেক নিষেধ করলাম। বললাম, হীরা প্রাসাদে গিয়ে পৌঁছে গোছল করা যাবে। কিন্তু ও আমার কথা শুনলো না। ভীষণ জেদী মেয়ে। কয়েকটি বাঁদীকে সঙ্গে নিয়ে গোছল করতে চলে গেলো। পাড়ে পোশাক খুলে রেখে নদীতে কাঁপিয়ে পড়লো সবাই। বাঁদীদের মাঝে সানসাকে পরীর মত মনে হচ্ছিল। হৈ হুল্লোড় করে সবাই গোছল করছে, হঠাৎ সানসার আর্তনাদে সব থেমে গেলো। ওকে ধরাধরি করে তীরে নিয়ে আসা হলো। দৌড়ে গেলাম ওর কাছে। নদীর কিনারায় শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে। ঝুকে পড়ে কত ডাকলাম-কিন্তু সাড়া নেই, সব শেষ হয়ে গেছে। বিষাক্ত সাপে কামড়েছে ওকে, বাঁদীরা পায়ের গোড়ালি তুলে দেখালো।

শোকে দুঃখে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন। ওরা ভেবেছিলো আমিও মরে গেছি। মরণ কেন যে আমারও হলো না! দুৰ্ভাগ্য আমাকে বাঁচিয়ে রাখল। সানসার জন্য শোহ সহ্য করতে। বুকটা আমার ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি ওর জন্য সমাধি তৈরী করলাম। ঐটা আমার জন্য। এখন মৃত্যুর দিন গুণছি। ওর পাশেই সমাধিতেই আমার চির নিদ্রা হবে। যে কদিন বেঁচে থাকি। চোখের জলে আর তার স্মৃতিতে বাঁচতে হবে। সানসা যেদিন আমাকে কাছে ডেকে নেবে। সেদিনের অপেক্ষায় আছি। আমার দেশের বহু দূরে এখানে বসে আছি। পৃথিবীর মরুভূমি সব এখন আমার বুকে এসে স্থান নিয়েছে। আমার নিয়তিই আমাকে এখানে এনেছে।

বিষাদগ্রস্ত এক সুন্দর যুবক তার কাহিনী শোনাতে শোনাতে তার দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। বুলুকিয়া বলে :

—ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, ভাই তোমার কাহিনী আমার দুঃসাহসিক সব কাহিনীর চেয়ে ঢের বেশী চিত্তাকর্ষক ও আশ্চর্যজনক। ভেবেছিলাম আমার কাহিনীই সেরা কাহিনী। ভাই, আল্লাকে ডাক, তিনিই তোমার হৃদয়ে শান্তি দেবেন। ভুলে যাওয়া ছাড়া শান্তি পাবার আর কোন দাওয়াই নেই।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প বলা বন্ধ করে দেয়।

 

তিনশো সত্তরতম রজনী :

পরের দিন রাত্রে শাহরাজাদ শুরু করে।

বুলুকিয়া অনেকক্ষণ ওর পাশে বসে সাত্ত্বনা দিয়ে নিজের রাজ্যে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই এখান থেকে নড়বে না জানশাহ। ওর ভীষণ জেদ দেখে ভয় পেয়ে যায় বুলুকিয়া। আবার অনেক সাস্ত্বনার কথা বলে ওর হাতে চুমু খেয়ে আপন রাজধানীর দিকে পা বাড়োল। পাঁচ দিন অনুপস্থিতের পর ফিরলে রাজধানীতে। পথে আর তেমন কিছু ঘটে নি।

তার পর থেকে আমি আর বুলুকিয়ার কোন খবর পাই নি! তুমি এখানে এসেছ, আমি ওর কথা ভুলেই গেছি। ক্ষীণ আশা ছিলো ও হয়ত ফিরে আসবে। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে চলে যেও না। কয়েকটা বছর থাক, তোমার সঙ্গ উপভোগ করি। বিশ্বাস কর আমার কোন কিছুরই অভাব নেই। অনেক গল্পও জানি। বুলুকিয়া বা বিষাদগ্বস্থ যুবকের কাহিনী যেগুলোর কাছে পানসে মনে হবে। তুমি খুব ভালো শ্রোতা, এতে আমি খুশী। এসব মেয়েরা আমাকে খানা পরিবেশন করে, সারা রাত ধরে গান গায়। আমার খুশীর নিদর্শন হিসাবে তোমাকে আপ্যায়ণ করব।

পাতালের রানী গল্প শোনাল, খানাপিনা চললো তারপর সপকেন্যাদের নাচগানও হলো। এবার সবাই রাণীর গ্রীষ্মাবাসে চলে যাবে। তার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হাসিবের তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। এই এদের সঙ্গে যেতে হবে নাকি! ও মা আর বউকে ভালোবাসে, তাদের ছেড়ে আর কতকাল থাকবে? মনে সাহস সঞ্চার করে বলে?

রানী, আমি সামান্য এক কাঠুরে। আপনি আপনার সঙ্গ দান করে আমার জীবনে আনন্দ দেবেন, এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাড়িতে আমার বউ রয়েছে, মা আছেন, তাদের কাছে যেতে না পারলে তারা ভেবে ভেবে শেষ হয়ে যাবে। আর এভাবে আমিও বা কি করে বেঁচে থাকি, বলুন? আমার বিরহে ওদের মৃত্যুর আগে আমিবাড়ি ফিরে যেতে চাই। আমাকে যেতে দিন। অবশ্য সারা জীবন আমার একটা দুঃখ থেকে যাবে যে, আপনার সেই সব দারুণ গল্পগুলি শোনা হলো না।

রানী হাসিবের কথা শুনে বুঝলো যে ছেলেটি ঠিকই বলছে। তাছাড়া হাসিব চলে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রানী বললো :

-ঠিক আছে হাসিব। তোমার বৌ আর মার কাছে চলে যেতে আমি আপত্তি করব না। কিন্তু তোমার মত এমন ভালো একজন শ্রোতা চলে যাবে ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছে। তাই তোমার কাছ থেকে আমি একটা প্রতিশ্রুতি চাইছি, না পেলে আমি তোমাকে ছাড়ব না। জীবনে কোনদিন হামামে গোছল করো না। এই শপথ তোমাকে করতে হবে। শপথ ভেঙ্গে ফেলো যদি কোনদিন, তবে সেদিনই তুমি শেষ হবে। এখন আর বেশী কিছু বলব না!

এই অদ্ভুত শপথে হাসিব খুব অবাক হয়ে যায়। তাহলেও ও শপথ করলো। রানীর বিরোধীতা তো আর করা যায় না। এই মুহূর্তে। রানী ওকে বিদায় জানালো। একজন সৰ্পকন্যা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে রানীর সাম্রাজ্যের বাইরে রেখে আসার জন্য। একটা ভাঙ্গাচোরা বাড়ির তলা থেকে উঠে এলো। রাস্তাটা লুকানো। সেই মধুর গর্তের বিপরীত দিকে বেরিয়ে পড়লো হাসিব।

ভোর হয়ে আসছে। হাসিব তার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। তার মা দরজা খুলে দিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে চীৎকার করে উঠলেন। হাসিবের বুকে মাথা রেখে বৃদ্ধা চোখের জল ফেলতে থাকেন। চেঁচামেচি আর কান্নার ফোঁপানি শুনে ছুটে এলো হাসিবের ইউ বাউ। স্বামীর হাঁত চুম্বন করলো। বাড়ির ভেতরে চলে এলো তিনজন। আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় বাড়িতে। হাসিব সকলের খোঁজখবর নেয়; ওর সঙ্গে আর যারা গিয়েছিলো কাঠ কাটতে তারা তো ওকে মধুর গর্তে ফেলে রেখে এসেছিলো। হাসিব ওদের কথাও জিজ্ঞেস করে। ওর মা সবই বললেন। কাঠুরেরা ওকে বলেছিলো নেকড়ে হাসিবকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু ওদের যে কি হলো? ওরা রাতারাতি সব বড়লোক বনে গেলো। কেউ কেউ বড় বড় সুন্দর দোকান সাজিয়ে বসেছে। ওরা ক্রমেই ধনী থেকে আরো ধনী হয়ে উঠছে।

হাসিব অনেকক্ষণ কি যেন ভেবে বললো-মা কাল তুমি সকালে বাজারে গিয়ে বলবে যে আমি ফিরে এসেছি। আমার সঙ্গে দেখা করলে খুশী হব।

পরের দিন হাসিবের মা বাজারে গিয়ে সবাইকে ছেলের কথা জানিয়ে দিলেন। সেই কাঠুরেরা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলো নিজেদের। হাসিবের মাকে বললো, তারা হাসিবের সঙ্গে দেখা হলে খুব খুশী হবে। ওরা ঠিক করলো হাসিবের প্রত্যাবর্তনে বেশ ঘটা করে সম্বর্ধনা দিতে হবে। তাই হাসিবের মার হাতে মূল্যবান রেশমীবস্ত্ব, বুটিদার কিংখাব দিয়ে দিলো। ওদের দোকান থেকে। সকলে দোকানের সেনার জিনিসটি দিলো। দোকান বন্ধ করে। হাসিবেরবাড়ি যাবার আগে সকলে পরামর্শ করে ঠিক করলো, প্রত্যেকের লাভের অংশ থেকে কিছুটা তো দেবেই উপরন্তু বাঁদী আর বাড়ির অংশও দেবে ওকে। এসব ঠিকঠাক করে ওরা হাসিবের বাড়িতে হৈ হৈ করে চলে এলো। হাসিবকে সালাম জানিয়ে হাত দু’খানা টেনে চুম্বন করে বললো :

–ভাই হাসিব, আমাদের মাফ করো। তোমার ওপর আমরা ভয়ানক অন্যায় করেছি। ভাই, যা এনেছি সঙ্গে এটুকু তোমাকে নিতেই হবে। এতে তো তোমারও ভাগ আছে। না নিলে বুঝব। আমাদের তুমি ক্ষমা করলে না।

মনের মধ্যে ক্ষোভ জমিয়ে রেখে আর কি হবে? তাতে পড়শীদের সঙ্গে শক্রিতা বাড়া ছাড়া লাভ আর কিছু নেই। ওদের উপহার গ্রহণ করে সে বললো :

—হ্যাঁ, যা হবার তো হয়েই গেছে, মাথা খুঁড়লেও তা ফিরবে না জানি।

হৈচৈ করে মহা ফুর্তিতে ওরা চলে গেলো। হাসিবের অবস্থা ফিরে গেলো। একটা বড় দোকান খুললো বাজারে। কিছুদিনের মধ্যে শহরে একটা সুন্দরবাড়ি তৈরী করলো।

একদিন দোকানে যাচ্ছে বাজারের পথ ধরে। বাজারে ঢোকার মুখে একটা হামাম আছে। হামামের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। সে। হামামের মালিক সামনে বসে হাওয়া খাচ্ছিল। হাসিবকে দেখে দাঁড়িয়ে উঠে বললো :

—আসলাম আলেকুম।

—ওআলেকুম সালাম।

হাসিব দাঁড়িয়ে পড়লো। হামাম মালিক বললো—আসুন না। আমার হামামে। আপনার পদধূলি পড়লে আমার হামাম ধন্য হবে। আমার সৌভাগ্য হলো না যে আপনাকে সেবা করি। গা রগড়াবার নতুন বুরুশ এনেছি, নরম লোম, আপনার ভালোই লাগবে। রাগড়াতে রাগড়াতে আপনার ঘুম এসে যেতে পারে। লুফ গাছের ফলের রেশমী আঁশে সাবান মাখিয়ে দেবো। ভালো কস্তুরী সাবান এনে রেখেছি।

আল্লার কসম, আপনার লোভনীয় আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারছি না। আমি শপথ করেছি কোনদিন হামামে ঢুকব না।

ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প বলা বন্ধ করলো।

 

তিনশো একাত্তরতম রজনী :

পরদিন রাত্রে আবার গল্প শুরু হলো।

এমন উদ্ভট শপথের কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারে নাকি? জীবন বিপন্ন হতে পারে হামামে ঢুকলে এই সব আজগুবি কথা হামামের মালিক বিশ্বাস করলো না। তাই বললো :

—এসব শপথটপথ কিছু না। আপনি আমায় এডিয়ে যাচ্ছেন কেন বলুন তো? কি অপরাধ করলাম মালিক? আল্লার নামে আমিও শপথ করছি, আমার হামামে যদি আপনাকে ঢোকাতে না পারি। তবে আমি আমার তিন তিনটে বিবিকে তালাক দেব, দেব, দেব।

—আল্লার কসম খেয়ে বলছি, আমি যা বলেছি তা একটুও মিথ্যে নয়। এতো বেশ মুশকিল হলো! হামামের মালিক শপথ করেছে সেটা ও বুঝবে। হাসিবের কাছে হামামে গোছল করা একেবারে অসম্ভব। হাসিব চলে যাচ্ছিল, ওর পাশে ঝাঁপিয়ে পড়লো হামামের মালিক।

–আপনি চলে গেলে আমার শপথ রাখতেই হবে মালিক। ফালতু শপথ রাখতে গিয়ে বিবিদের তালাক দিতে হবে। কথা দিচ্ছি, হামামে গোছল করার জন্য যদি কিছু হয় তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার নিজের। তবু আপনি চলে যাবেন না।

ওদের বাদানুবাদে রাস্তায় বহু লোক জমে যায়। সব শুনে ভীড়ের লোকও হাসিবকে চাপাচাপি করতে থাকে। লোকটা তাকে বিনি। পয়সায় গোছল করাতে চায়, গোছল না করলে তার বিবিদের হারাতে হবে। হাসিব কোন কথাই শুনতে চায় না। ও চলে যাবেই। না, মিষ্টি কথায় কাজ হবে না, সবাই মিলে ঠিক করলে দু-এক ঘা লাগাতে হবে। হাসিবকে কয়েক ঘা লাগিয়ে সবাই চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেলো হামামে। পরিত্ৰাহি চিৎকার করেও হাসিবের রেহাই নেই। জোর করে ওর জামা-কাপড় খুলে নিয়ে হড়হড় করে জল ঢালতে থাকে। বিশ তিরিশ গামলা জল ঢেলে বেশ করে গারগড়ে সাবান মাখিয়ে গোছল করাতে থাকে মহানন্দে। গরম তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে দিলো। মাথায় পরিয়ে দিলো এক বিশাল পাগডি। তাতে মনোরম কাজ করা। হামামের মালিককে আর শপথ মানতে হবে না। খুশী মনে এক গেলাস গোলাপ জলের শরবত এনে বলে :

-গোছল আপনাকে ফুর্তি দিক, স্বাস্থ্যবান করুক। নিন, এই শরবতটা খেয়ে ফেলুন। একেবারে তরতাজা বোধ করবেন। আপনি আমাকে বাঁচালেন, বিবি ছাড়া বাঁচা যায়? কি বলেন?

এদিকে হাসিবের অবস্থা শোচনীয়। সময় যত বয়ে যায় বুকের ভিতরটা যেন শুকিয়ে যেতে থাকে। একটা ঠাণ্ডা স্রোত মেরুদণ্ড বয়ে সোজা নীচে নামতে দু থাকে। কি করবে। আর করবে না কিছুই বুঝতে পারে না বেচারী। কি একটা বলার জন্য এর ঠোঁট দু:খানা নড়ে ওঠে। এমন সময় হঠাৎ রাজার সেপাইতে? ভরে যায় হামাম। উন্মুক্ত তরবারি হাতে হামামকে ঘিরে ফেলে সেপাইরা। হাসিবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে যেভাবে ছিলো ঠিক সেইভাবে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো রাজবাড়িতে। গোছলের পর পোশোকও ভালো করে পরতে পারেনি। রাজপ্রাসাদে এনে প্রধান উজিরের সামনে ফেলে দিলো। উজীর হাসিবের জন্য উৎকণ্ঠিত চিত্তে অপেক্ষা করছিলেন।

হাসিবকে দেখে উজীর খুব খুশী। আভুমি নত হয়ে কুর্নিশ করে ওর সঙ্গে রাজার কাছে যেতে অনুরোধ করলো। নসিবে যা আছে তাই হবে ভেবে হাসিব উজীরের পেছন পেছন চললো। ওরা এসে পড়লো একটা হলঘরে। সারি সারি মান্যগণ্য লোক পদমর্যাদা অনুসারে বসে আছেন। সামন্তরাজা, প্রধান পারিষদ আর খোলা তরবারি নিয়ে-জল্লাদরা দাঁড়িয়ে আছে। হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুবেগে মাথা উড়িয়ে দেয় এসব জল্লাদ। ঘরের মাঝখানে এক বিশাল সোনার পালঙ্কে রাজা শুয়ে আছেন। তাঁর মাথা ও মুখ রেশমী কাপড়ে ঢাকা। তিনি বোধহয় ঘুমুচ্ছেন।

রাজার অবস্থা দেখে তো হাসিবের হয়ে গেলো। নাঃ এবার মৃত্যু আর দূরে নেই। শপথ ভাঙ্গার জন্য সতর্ক বাণী এবার ফলবে তাহলে। পালঙ্কের নীচে দাড়াম করে আছড়ে পড়ে কেঁদে বলতে থাকে, ও কিছু জানে না, কোন দোষ করেনি। উজীর তাড়াতাড়ি ওকে তুলে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। খুব ভদ্রভাবে। তারপর সে বলে :

—আপনি ড্যানিয়ালের পুত্র। আপনি আমাদের রাজা মহাশক্তিধর কারজাদানকে রক্ষা করবেন তার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। রাজার সারা দেহ আর মুখে সাংঘাতিক কুণ্ঠব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর অবস্থা ভালো নয়। আপনি মহান ড্যানিয়ালের পুত্র বলে রাজার এই কালব্যাধি নিরাময় করতে পারবেন। এটা আমরা জানি।

সঙ্গে সঙ্গে সামন্তরাজ্য, প্রাসাদরক্ষী ও জল্লাদের দল সমস্বরে বলে উঠলো—একমাত্র আপনিই পারেন রাজা কারাজাদানকে রক্ষা করতে।

ভয়ে আর ভাবনায় হাসিব যেন কেমন হয়ে যায়। কাঁপা গলায় চেঁচাতে চেষ্টা করে-আল্লার নামে শপথ করে বলছি আমি মহান কেউ নই, ওরা আমাকে ভুল করে ধরে নিয়ে এসেছে।–উজীরের দিকে ফিরে বললো—আমার বাবার নাম ড্যানিয়েল, এটা ঠিক। কিন্তু আমি একেবারেই মুখ। ছেলেবেলায় আমাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি কিছুই শিখিনি। হেকিমি শেখাবার চেষ্টা করেছিলো, মাসখানেক পরে তাও ছেড়ে দিয়েছি। তালিমদারও ভালো ছিলো না। শেষে আমার মা আমাকে একটা খচ্চর আর কিছু দড়ি কিনে দেন। আমি কাঠুরে হলাম। আমি যা শিখেছি সব বললাম।

কিন্তু উজীর নাছোড়বান্দা, সে বললো–নিজেকে লুকোবার চেষ্টা করবেন না। দুনিয়ার চারদিক খুঁজলেও আপনার মত ভালো একজন চিকিৎসক পাওয়া যাবে না।

এবার হাসিব হাউমাউ করে ওঠে—উজীর সাহেব, আমি তো রোগ বা তার নিদান সম্পর্কে কিছুই জানি না, আমি কেমন করে রাজাকে সারিয়ে তুলব।

—এখানে মিথ্যা কথা বলে কোন লাভ হবে না। আমরা ভালোভাবে জানি যে রাজাকে সারিয়ে তোলা আপনার হাতের মুঠোয়।

—কি করে? —হাসিব মাথার ওপর দুহাত তুলে দেখায়—এই দেখুন আমার হাত, কি আছে এই হাতে?

উজীর বললো-আপনি নিদান দিতে পারেন। কারণ পাতালের রানীর সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। রানীর কুমারী দুগ্ধ খেলে বা মলমের মত লাগালে যে কোন দুরারোগ্য ব্যাধি সেরে যায়।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ চুপ করে গেলো।

 

তিনশো বাহাত্তরতম রজনী :

পরের রাতে শাহরাজাদ গল্প শুরু করে।

এবার হাসিব বুঝতে পারে ঐ হামামে ঢোকার জন্যই এসব হচ্ছে। নিজের দোষ অস্বীকার করার জন্য চেঁচিয়ে বলে :

—আমি জীবনে এরকম দুধ দেখিনি, বিশ্বাস করুন। পাতালের রানীর নামও শুনিনি কোনদিন। কে সে তাও জানি না।

উজিরের ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝিলিক মারে।

—আপনি যদি না-ই বলেন, তবে আমি বলছি। আপনার কথা যে কত অসার তা আমি এক্ষুণি প্রমাণ করে দিচ্ছি। আমি জানি আপনি পাতালের রানীর কাছে থেকেছেন। কি করে বুঝলাম? সেই প্রাচীনকাল থেকে যারাই রানীর সঙ্গে থেকেছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই পেটের চামড়া কালো হয়ে গেছে। রানীর হামামে না গেলে কিন্তু চামড়া কালো হয় না। একখানা গ্রন্থ থেকে আমি শিখেছি। আপনাকে যে হামাম থেকে নিয়ে এসেছে আমার গুপ্তচররা ওখানে নজর রাখত। যারা গোছল করতে যেত তাদের চামড়া লক্ষ্য করত। আপনার গোছালের সময় আমার গুপ্তচরেরা আমাকে দৌড়ে এসে খবর দিয়ে যায়। আপনারও পেটের চামড়া কালো হয়ে যায় গোছালের সময়। আমার সঙ্গে আর চালাকি করবেন না।

হাসিব জেদী কণ্ঠে বলে—তাহলেও আমি আমন কোন রানীকে দেখিনি।

এবার উজীর এগিয়ে এসে ওর পরনের তোয়ালেটা এক ঝটিকায় খুলে পেটটা বার করে দিলো। মোষের মত রং পেটের। সেটা দেখা গেলো।

এটা হাসিবও জানত না। ওরা যেন কেমন একটা ঘোর লাগছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে।

–আমি বলছি আমি ঐ কলো পেট নিয়েই জন্মেছি। আপনার লোকেরা যখন হামামে ঢোকে তখন আমার পেটের ওই রং হয়নি।

উজীর হা-হা করে হেসে উঠলো।

–আমার গুপ্তচরেরা দেখে এসেই আমাকে বলেছে, আমি তা বিশ্বাসও করেছি।

রানীকে হাসিব কথা দিয়েছিলো, রানী কোথায় থাকে প্ৰাণ গেলেও সে কথা কাউকে বলবে না। তাই বারবার হাসিব শপথ করে বলতে থাকে, ও রানীকে দেখেনি।

উজীর দুজন জল্লাদকে ইশারা করলো। ওরা ওকে উলঙ্গ করে হাত দুখানি বেঁধে ছাদের আড়ার সঙ্গে বেঁধে দিয়ে পায়ের পাতায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করতে থাকে। বেচারা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। ওর মনে হচ্ছিল শপথ ভাঙ্গার জন্য এবার ওকে সত্যিই প্ৰাণ দিতে হবে। এদিকে প্রহার চলছে তো চলছেই। যন্ত্রণা আর সহ্য করতে না পেরে কেঁদে ফেলে বলে, সব সত্যি কথা ও বলবে।

হাসিবকে নামান হলো। দামী রাজকীয় পোশাক এনে উজীর নিজে পরিয়ে দিলেন। আস্তাবলে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সব চেয়ে ভালো ঘোড়াটা বেছে দিলেন। উজীরও নিজে যুদ্ধের ঘোড়ায় চেপে হাসিবকে নিয়ে চললেন। সঙ্গে চললো একদল সৈন্যবাহিনী প্রহরী হিসাবে। এসে দাঁড়ালো ওরা সেই ভাঙ্গাবাড়ির কাছে। রানী যমালিকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এই বাড়িটা থেকেই হাসিব বেরিয়ে এসেছিলো।

উজীর বইপত্র পড়ে যাদুবিদ্যা শিখেছিলো। কি একটা ধূপের মত জিনিস পুড়িয়ে সে মন্তর পড়তে থাকে বাড়িটার দরজায়। হাসিবকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো যাতে রানী হাসিবকেই দেখা দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ভূমিকম্প শুরু হয়। কাছাকাছি যারা ছিলো সবাই ছিটকে পড়ে দূরে। একটা বড় গর্ত দেখা দিলো। গর্তের মুখে রানীর মাথা দেখা গেলো। চারটি সৰ্পকন্যার কাঁধে গামলায় চেপে বসে আছেন। নিঃশ্বাসে তাঁর আগুন বেরুচ্ছে। যমালিকার মুখ তপ্ত সোনার মত জ্বলজ্বল করছে। রানী হাসিবকে দেখে চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন।

আমার কাছে তুমি এজন্য শপথ নিয়েছিলে?

আল্লার নামে শপথ করে বলতে পারি মহারানী, এতে আমার কোন দোষ নেই। ওই উজীরের সব দোষ। ওই সব করেছে। মারতে মারতে আমাকে প্রায় খুন করে ফেলছিলো!

-আমি সব জানি। সেজন্য তোমাকে কোন শাস্তি দিচ্ছি না। তোমাকে জোর করে ধরে এনেছে, আমাকেও দেখা দিতে জোর করে বাধ্য করেছে। অবশ্য রাজার নিরাময় হওয়া প্রয়োজন। তুমি দুধ নিতে এসেছ আমার কাছে। এই দুধে রাজা ভালো হয়ে যাবেন। আমি তোমাকে দুধ দেব। তুমি আমার কাছে অতিথি হয়ে থেকে ছ। সবচেয়ে বড় কথা তুমি অত্যন্ত মনোযোগী শ্রোতা। এরকম শ্রোতা আর পাইনি। আমি খুব খুশী হয়েছি তোমার ওপর। তোমাকে দুই পাত্র দুধ দেব। আমার আরো কাছে এসো। কানে কানে বলি, কি করে ওটা ব্যবহার করবে।

হাসিব রানীর আরো কাছে এগিয়ে গিয়ে শোনে-শোনো হাসিব, একটা পাত্রে লাল দাগ দিয়ে দিয়েছি, ওটার দুধে রাজার রোগ সেরে যাবে। আর অন্যটার দুধ উজীরের জন্য দিয়েছি। তোমায় মেরেছে, না? যখন উজীর দেখবে যে রাজা ভালো হয়ে গেছে, তখন আমার দুধ খাইতে চাইবে উজীর যাতে তার কোন অসুখ না হয়। এবার তুমি দ্বিতীয় পাত্রের দুধটা খেতে দেবে। এই কথা বলে রানী পাত্র দুটি হাসিবের হাতে তুলে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রানী আর তার বাহনের মাথার ওপর মাটি আবার জুড়ে গেলো।রাজ প্রাসাদে পৌঁছে রানীর কথামত কাজ করলো হাসিব। রাজার কাছে গিয়ে প্রথম পাত্র থেকে দুধ খাইয়ে দিলো তাকে। দুধ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজার সারা দেহে ঘাম শুরু হলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত চামড়া মামড়ি হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। জায়গাগুলিতে নতুন নতুন চামড়া গজাতে থাকে। যথারীতি উজীরও সেই দুধ খেতে চাইলো। দেওয়ার অপেক্ষা না করে নিজেই দ্বিতীয় পাত্র তুলে গলায় ঢেলে দিয়ে ঢাকচক করে খেয়ে নিলো। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে উজীরের সারা দেহ ফুলতে থাকে ধীরে ধীরে। দেখতে দেখতে হাতির মত হয়ে উঠলো দেহটা। তারপর বিকট আওয়াজ করে হঠাৎ ফেটে যায়। প্রভাবে উজীর মারা গেলো।

পুরো সুস্থ হয়ে রাজা সিংহাসনে বসে রাজ্যশাসন শুরু করলেন। প্রথমে তিনি হাসিবকে কাছে ডেকে এনে তাঁর পাশে বসালেন। তাঁর জীবনদাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মৃত উজিরের পদে নিযুক্ত করলেন। বহু হীরে দিয়ে তৈরী রাজসিক পোশাক পরিয়ে হাসিবকে যথাযোগ্য সম্মান দেখালেন। রাজ্যের সর্বত্র এই নিয়োগের কথা ঘোষণা করালেন।

রাজা আদেশ দিলেন :

—আমাকে যারা সম্মান দেখাবে তারা অবশ্যই হাসিবকেও সম্মান দেখাবে।

এ সময় ভোর হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে গেলো।

 

তিনশো তিয়াত্তরতম রজনী :

হাসিব লেখাপড়া শিখে বেহেস্তে যাবার আগে তার বাবার লেখা তার মার কাছে রাখা একটুকরো কাগজে এটা দেখতে পেলো।

‘সব শিক্ষাই অসার, কারণ সময় হলে আল্লাই তীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে সব শিখিয়ে দেবেন।’

শাহরাজাদ বললো :

জাঁহাপনা এই হলো ড্যানিয়েলের পুত্র হাসিব ও পাতালের রানী যমালিকার গল্প।

–আল্লা আরও বেশী জানেন।

গল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহরিয়ার হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন :

—আমার আরো বেশী ক্লান্তি লাগছে। মন অবসন্ন হয়ে পড়ছে যে শাহরাজাদ সাবধান! আমার যদি এরকম অবস্থা চলতে থাকে তাহলে তো বুঝতেই পারছ কাল সকালে তোমার মুণ্ডু আর ধড় এক জায়গায় থাকবে না।

দুনিয়াজাদের বুক কেঁপে ওঠে। ভয়ে সে কুঁকড়ে যায়। কিন্তু শাহরাজাদের মুখে কোন উদ্বেগের চিহ্ন নাই। সে নির্বিকারভাবে বলে, যাইহোক, বাকী রাতটুকু কাটিয়ে দেবার জন্য আমি দু-একটা চুটকী গল্প বলছি, শুনুন জাঁহাপনা।

Leave a Reply to পথিক Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *